বারো ঘন্টা প্লাস
(প্রথম পর্ব)
সকাল দশটা
১
ট্রেন থেকে নামতেই লোহার তীক্ষ্ণ বেড়ার ওপাশে নিমগাছের ছায়ায় একটা শিবমন্দির, যদিও প্রণামীর বাক্সটা প্ল্যাটফর্মের ভেতরেই ছোট্ট টুলে বসানো। নিত্যযাত্রীরা তো বটেই, চলন্ত ট্রেন থেকে ড্রাইভার-গার্ড পর্যন্ত কপালে হাত ঠেকায়। মীনকেতনও ঘাড় একটু নিচু করে দেখে নিল মুলিবাঁশের চাঁচরে বানানো আধো-অন্ধকার কুঠুরিটা। তবে তার পর্যবেক্ষণ — একজন জীবনবিমা এজেন্ট যেমন তার মক্কেলকে মেপে নেয় অথবা কাঞ্জিভরমের দিকে আড়ে-আড়ে তাকায় ধনেখালি তাঁত। মীনকেতনের কাছাকাছি কেউ থাকলে নির্ঘাৎ চাপা বকবক শুনত — দিব্যি তো চারখানা হাত নিয়ে বসে আছো সেই কবে থেকে। এদিকে দুটো পাস করো না, বাবু।
এটা ঘটনা যে নিজের দিকে ধেয়ে আসা পৃথিবীকে সামলাতে মিনিমাম দুটো হাত লেগেই যায়। জীবন আক্রমণাত্মক। পাড়ার বন্ধুরাই হোক কি অফিসের বস, নিজের ছেলে কি গরীব মেধাবী ভাইঝিটি, সবার সঙ্গেই আলাদা আলাদা ভারসাম্যের খেলা। না হলে ভুল-বোঝার ফুল প্রতিহিংসার ফল হয়ে পাকতে কতক্ষণ! কিন্তু তাহলে সে নিজেকে সামলায় কী দিয়ে! বা প্রতিদিনের জীবনখেলার ধারাবর্ণনা — কে আজ পেছন থেকে বে-আইনি ট্যাকল করলো অথবা গতকাল তার কোন শটটা ক্রশবার উঁচিয়ে চলে গেছে, এসব খুঁটিনাটি সে কোন দুটো অপেক্ষারত হাতকে শোনাবে?
এক এক রাতে বেহুঁশ ঘুমিয়ে পড়ার পরেও হঠাৎ দুটো-তিনটেয় কেমন এক পাতলা গুনগুন শব্দে মীনের ঘুম ভেঙে যায়। বিভ্রমদশা কেটে গেলে সংগীতের উৎস খুঁজতে বেরিয়ে সে আবিষ্কার করে ওই ভ্রমর-ডাক উৎপন্ন হচ্ছে তার নিজের শরীরেই। আর একটুক্ষণের মধ্যে ধাপে ধাপে তীক্ষ্ণতা বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকবে তার দেহকোষ। মীনকেতনের ভেতর থেকে আর এক বিপজ্জনক মীন উচ্ছ্রিত হয়ে, যেন এলেবেলে লেগ-স্পিনারের সামনে ক্রিস গেইল, আস্ফালনে সামনে দাঁড়াবে। কোনও রকমে উঠে বসে সে বিছানা হাতড়াতে থাকে, কিন্তু বন্ধ মোবাইল আর চশমা ছাড়া আর কিছু মরাম্মত হয় না। যেমন পরীরা পিঠের ডানা নামিয়ে রাতে ঘুমোতে যায়, তেমনি সেও বাড়তি হাতদুটো কাঁধ থেকে খুলে শিয়রে রেখে থাকবে, এই আশা কি আধোঘুমে তার মনে ছায়া ফেলেছিল?
২
অটোস্ট্যান্ডের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির ঠিক গোড়ায় উবু হয়ে বসে আছে বউটা। প্ল্যাটফর্মের ওপর মুড়ির দোকান থেকে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি কিনে মীনকেতন গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। আজ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মারা যাওয়ার ছুটিতে পেয়ারার খদ্দের খুব সামান্য। ভারি-ভরকম ঝাঁকা সামনে রেখে বসেছিল বউটা, তার বাড়ানো মুড়ির ঠোঙা নিল লজ্জা আর সহজতা মেশানো ছোট্ট হাসি দিয়ে।
— কোনো কারণ লেই। লাকি আছে?
কথাটা এই পাঁচ মাসে আরও কয়েকবার জিগ্যেস করেছে সে। কী অস্বস্তিকর প্রশ্ন বলো তো! আজ জায়গাটা ফাঁকা ব’লে সে বোঝানোর চেষ্টা পেল।
— তুমি ভোর চারটেয় সেই মজিলপুর থেকে রওনা দাও, তারপর মাঝরাস্তায় পেয়ারা কিনে এখানে বেচে হোটেলে ভাত খেতে খেতে বেলা তিনটে। সেদিন নিজেই যদি না বলতে, জানতেই পারতাম না কী খিদেটা পেটে পুষে সারাক্ষণ দুপুর-রোদে বসে থাকো।
— তা বলে কষ্টের পহা ডেলি রোজ আমার পেছনে খচ্চা করে দেবে!
মজা লাগে মীনকেতনের। সে রোজ কত টাকার খাবার জল কেনে শুধু সেটুকু জানলেই বউটা ভিরমি খাবে।
— তবে বেশিদিন আর এই সিস্টিম চলবে নাকো। এ-জায়গা ছেড়ি দোবো। তোমার হাতে মুড়ি-বিস্কুট খাওয়া খোদায় নসিবে লেকেনি।
এবার দাঁত বের করে হাসে সে বউ। গুড়াকু-ডলা কালো বড় দশন ও ঘোমটার নিচে কাঁচাপাকা চুল তাকে বিশেষ এক লুক এনে দিয়েছে। রোগা, ফুট পাঁচেকের মহিলার বয়েস চল্লিশের এদিক-সেদিকেই হবে। কথাও সে বলে তেজি খোলা গলায়।
— দুটো শ্যাল বসি থাকে একেনে মাজেসাজে, দ্যাকোনি? পুলিশি রোজ টাকা লে যাচ্চে বলো। তার উপ্রি এ-দুটো পার্টির মস্তান। দুকুরবেলা আমারে ওই বস্তির মদ্দি টেনে লে তুলতি চায়।
আগুনে পুড়ে গিয়ে ক’দিনের মধ্যেই পুনর্নির্মিত ঘরগুলোর দিকে হাত তুলে দেখায় বউটা যার নাম সে গতকালই জেনেছে — সুলতানা।
(শুরু হল)