চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

বারো ঘন্টা প্লাস (প্রথম পর্ব)

বারো ঘন্টা প্লাস
(প্রথম পর্ব)

সকাল দশটা

ট্রেন থেকে নামতেই লোহার তীক্ষ্‌ণ বেড়ার ওপাশে নিমগাছের ছায়ায় একটা শিবমন্দির, যদিও প্রণামীর বাক্সটা প্ল্যাটফর্মের ভেতরেই ছোট্ট টুলে বসানো। নিত্যযাত্রীরা তো বটেই, চলন্ত ট্রেন থেকে ড্রাইভার-গার্ড পর্যন্ত কপালে হাত ঠেকায়। মীনকেতনও ঘাড় একটু নিচু করে দেখে নিল মুলিবাঁশের চাঁচরে বানানো আধো-অন্ধকার কুঠুরিটা। তবে তার পর্যবেক্ষণ — একজন জীবনবিমা এজেন্ট যেমন তার মক্কেলকে মেপে নেয় অথবা কাঞ্জিভরমের দিকে আড়ে-আড়ে তাকায় ধনেখালি তাঁত। মীনকেতনের কাছাকাছি কেউ থাকলে নির্ঘাৎ চাপা বকবক শুনত — দিব্যি তো চারখানা হাত নিয়ে বসে আছো সেই কবে থেকে। এদিকে দুটো পাস করো না, বাবু।

এটা ঘটনা যে নিজের দিকে ধেয়ে আসা পৃথিবীকে সামলাতে মিনিমাম দুটো হাত লেগেই যায়। জীবন আক্রমণাত্মক। পাড়ার বন্ধুরাই হোক কি অফিসের বস, নিজের ছেলে কি গরীব মেধাবী ভাইঝিটি, সবার সঙ্গেই আলাদা আলাদা ভারসাম্যের খেলা। না হলে ভুল-বোঝার ফুল প্রতিহিংসার ফল হয়ে পাকতে কতক্ষণ! কিন্তু তাহলে সে নিজেকে সামলায় কী দিয়ে! বা প্রতিদিনের জীবনখেলার ধারাবর্ণনা — কে আজ পেছন থেকে বে-আইনি ট্যাকল করলো অথবা গতকাল তার কোন শটটা ক্রশবার উঁচিয়ে চলে গেছে, এসব খুঁটিনাটি সে কোন দুটো অপেক্ষারত হাতকে শোনাবে?

এক এক রাতে বেহুঁশ ঘুমিয়ে পড়ার পরেও হঠাৎ দুটো-তিনটেয় কেমন এক পাতলা গুনগুন শব্দে মীনের ঘুম ভেঙে যায়। বিভ্রমদশা কেটে গেলে সংগীতের উৎস খুঁজতে বেরিয়ে সে আবিষ্কার করে ওই ভ্রমর-ডাক উৎপন্ন হচ্ছে তার নিজের শরীরেই। আর একটুক্ষণের মধ্যে ধাপে ধাপে তীক্ষ্ণতা বাড়িয়ে চিৎকার করতে থাকবে তার দেহকোষ। মীনকেতনের ভেতর থেকে আর এক বিপজ্জনক মীন উচ্ছ্রিত হয়ে, যেন এলেবেলে লেগ-স্পিনারের সামনে ক্রিস গেইল, আস্ফালনে সামনে দাঁড়াবে। কোনও রকমে উঠে বসে সে বিছানা হাতড়াতে থাকে, কিন্তু বন্ধ মোবাইল আর চশমা ছাড়া আর কিছু মরাম্মত হয় না। যেমন পরীরা পিঠের ডানা নামিয়ে রাতে ঘুমোতে যায়, তেমনি সেও বাড়তি হাতদুটো কাঁধ থেকে খুলে শিয়রে রেখে থাকবে, এই আশা কি আধোঘুমে তার মনে ছায়া ফেলেছিল?


অটোস্ট্যান্ডের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির ঠিক গোড়ায় উবু হয়ে বসে আছে বউটা। প্ল্যাটফর্মের ওপর মুড়ির দোকান থেকে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি কিনে মীনকেতন গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। আজ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মারা যাওয়ার ছুটিতে পেয়ারার খদ্দের খুব সামান্য। ভারি-ভরকম ঝাঁকা সামনে রেখে বসেছিল বউটা, তার বাড়ানো মুড়ির ঠোঙা নিল লজ্জা আর সহজতা মেশানো ছোট্ট হাসি দিয়ে।

— কোনো কারণ লেই। লাকি আছে?

কথাটা এই পাঁচ মাসে আরও কয়েকবার জিগ্যেস করেছে সে। কী অস্বস্তিকর প্রশ্ন বলো তো! আজ জায়গাটা ফাঁকা ব’লে সে বোঝানোর চেষ্টা পেল।

— তুমি ভোর চারটেয় সেই মজিলপুর থেকে রওনা দাও, তারপর মাঝরাস্তায় পেয়ারা কিনে এখানে বেচে হোটেলে ভাত খেতে খেতে বেলা তিনটে। সেদিন নিজেই যদি না বলতে, জানতেই পারতাম না কী খিদেটা পেটে পুষে সারাক্ষণ দুপুর-রোদে বসে থাকো।
— তা বলে কষ্টের পহা ডেলি রোজ আমার পেছনে খচ্চা করে দেবে!

মজা লাগে মীনকেতনের। সে রোজ কত টাকার খাবার জল কেনে শুধু সেটুকু জানলেই বউটা ভিরমি খাবে।

— তবে বেশিদিন আর এই সিস্টিম চলবে নাকো। এ-জায়গা ছেড়ি দোবো। তোমার হাতে মুড়ি-বিস্কুট খাওয়া খোদায় নসিবে লেকেনি।

এবার দাঁত বের করে হাসে সে বউ। গুড়াকু-ডলা কালো বড় দশন ও ঘোমটার নিচে কাঁচাপাকা চুল তাকে বিশেষ এক লুক এনে দিয়েছে। রোগা, ফুট পাঁচেকের মহিলার বয়েস চল্লিশের এদিক-সেদিকেই হবে। কথাও সে বলে তেজি খোলা গলায়।

— দুটো শ্যাল বসি থাকে একেনে মাজেসাজে, দ্যাকোনি? পুলিশি রোজ টাকা লে যাচ্চে বলো। তার উপ্‌রি এ-দুটো পার্টির মস্তান। দুকুরবেলা আমারে ওই বস্তির মদ্দি টেনে লে তুলতি চায়।

আগুনে পুড়ে গিয়ে ক’দিনের মধ্যেই পুনর্নির্মিত ঘরগুলোর দিকে হাত তুলে দেখায় বউটা যার নাম সে গতকালই জেনেছে — সুলতানা।

(শুরু হল)

হাজারিকার গান

হাজারিকার গান

যখন বড় রাস্তায় মুখোমুখি নেতাজি বিড়ি আর
সারদামণি মদের দোকান
মাঝখানে বাসের মাহুত কানে চাপড় মেরে
হাঁটিয়ে আনছে মিনিবাস
বিশ্বকর্মা পুজোর যে-দিন জন্মের শোধ কালেকশান হচ্ছে
যখন রাজ্য আদালত ভবনে ঢুকে গেল পুলিশ-চালিত প্রাইভেট
আর গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বাদী-বিবাদী চা
উকিলের গলায় ইন হল, আউট হল না
তখন ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন ভেবে
আমার হাত নিশপিশ করে

যেখানে হাসপাতালের অপোজিটে ওষুধের দোকান
গাছ থেকে রিটায়ার করা তিনটে বাতাবি
এক বৃদ্ধকে নিয়ে বাজারে বসেছে
আর ভিড় ট্রেন থেকে নেমে শাড়ি ঠিক করছে মেয়েরা
যেখানে একমাত্র বিজেনকে ভয় পাচ্ছেন ওমেলো
যেহেতু পাখি আকাশের ভুরু এই আঁকে তো এই মুছে দেয়
অথবা নিজেকে পিটিয়েই পয়সা — বুঝতে পারে হাপুখেলা বাচ্চারা
তখন ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন
আমার একদম আইডিয়ায় আসে না

আমিই সেই আহীরী

আমিই সেই আহীরী

এক
ঘরের দুটো জানলাই কখনও একসঙ্গে খুলে দিই না আমি। সহ্য করতে পারি না প্রেসক্রিপশান-বহির্ভূত অতটা আলো, যারা তাদের দোলখাওয়া সবুজ ঘরবাড়ি থেকে ছুটে এসে আমার চোখের তারাদুটো খেয়ে নেবে, মমি বানিয়ে দেবে মুখটাকে।

কিন্তু আজ নিরপরাধ অঘ্রাণ-সকালের হলুদ দীপ্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি হাট করে দিলাম আমার দ্বিতীয় ফুসফুস। হেমন্তের মচকা তাত শরীরে এসে লাগল। সুতো-সুতো খুশি জড়ালো ঘুমহীন হাসপাতালে ছোটা থেকে অফিসের পেপার-ওয়েটের নিচে চাপা পড়া এ-পর্যন্ত আমার সবক’টা আত্মায়।
আমার মনে পড়ল তোমাকে।

নাকি তুমিই ছুটে এলে আমার ভেতরে, অতীতসঞ্চার? যেমন বেড়াতে নিয়ে যাবে শুনলে এ-কোল থেকে ও-কোলে ঝাঁপিয়ে যায় শিশু!

দুই
আজও শেষরাতের ঘুম ভেঙে ভারশূন্য ঋদ্ধিশূন্য মাথা অন্ধকার ঘরে ধড়মড় করে উঠে খাট থেকে পা নামিয়ে চপ্পল খোঁজে। খুব দেরি হয়ে গেল, বুঝি! তোমাকে সকালের ফোন করতে হবে না? তারপর মনে পড়ে, সতীদাহ বা গুটিবসন্তের মতো বহুদিন সে-প্রথা আমরা নির্মূল করেছি। তখন মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকা কিছুক্ষণ। সকালের চলাফেরা একগাছি খড়ের বাঁধন খোলা পালংপাতার মতো বারবার এলিয়ে যেতে থাকে।

তিন
আজ এই হালকা গলা-ব্যথার রবিবার বাজারে গিয়ে মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম, নতুন ক’রে দেখে নিই ইতরের মুন্ডু ঝরে যাওয়া। তাকে দুজন লোক যখন দোকানের বধ্য-বারান্দায় নিয়ে আসছে, খাসির ভাঙা গলার চিৎকার হ’ল নষ্ট হওয়ার আগে সম্পর্ক তাক করে ছোঁড়া কাচের শেষ বাসনগুলো। এবার ছুরিতে দুফাঁক ক’রে দেওয়ার পর গলার নলির একমুঠো টগর আর চারপাশে রঙ্গনের উৎসারিত ঢেউ তার সারা শরীরে গণবিক্ষোভ ও সত্যাগ্রহের জন্ম দিচ্ছে, মণিপুরী নগ্ন মেয়েদের আইন অমান্যের মতো। এখন শক্ত করে ঠেসে ধরা চাই আমার শরীর — দুটো পা সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দিন, এবং আরেক মনোবিদের কাজ হল নজরে রাখা পেশেন্টের হাত দুখানাও যেন খোলা বাতাসে ছড়িয়ে না যায়।

লক্ষ করুন, এই প্রতিরোধের ডোজ একদম ঠিকঠাক পড়েছে বলেই আমার ক্রমহ্রাসমান তলপেট এখন নিজের রক্তের বিছানায়, যার ওপর ওই রক্তেরই বেডকাভার, আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে আগ্রহী। বিড়বিড় করে বলছে ‘শান্তি, আত্মসমর্পণ’, কিন্তু চালচিত্রে একটা সাদা পতাকার অভাবের জন্যে কেউ আমার সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাবে খুব একটা আস্থা রাখতে পারল না — না চিকিৎসক, না সাইকোথেরাপিস্ট। শেষপর্যন্ত গায়ের লোম খ’সে, চামড়া খুলে যখন ছাগল থেকে এক নির্মীয়মান খরগোশের দিকে চলে যাচ্ছি, এই প্রাণকে তামাদি ঘোষণা করা হয়। কারণ জীবন মানেই ‘ইশ্‌ছা’, যেমন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস বলেছিল, সুতরাং অসন্তোষও, আর সেখান থেকে জন্ম নেওয়া পালটা-আক্রমণ। অন্যদিকে অসুস্থতা মোক্ষের কাছাকাছি, এবং মরণ হল পরমগতি। যে মরহুম, ধরে নেওয়া হচ্ছে তার ব্যাধিও মারা গেছে। তাই অভিযুক্ত টেঁসে গেলে প্রশাসন যাবতীয় অপরাধের তালিকা ও শাস্তির সুপারিশ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে।

কিন্তু অনেক সময় আলাদা কিছু ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। যেমন, আমাকে সুশ্রীমতো ধুয়ে-মুছে উলটো করে বাস্তবের মাটিতে লটকে দেওয়ার পরেও দেখা গেল, যেখানে আগে কলিজা ছিল এবং বর্তমানে লেপচাজগত-এর আচমকা ধসনামা শূন্যতা, তিরতির করে কাঁপছে সেই সিনাঅঞ্চল। কাজেই, শিশুদিবসের সকালের বাচ্চারা তাদের অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, “দ্যাখো বাপি, কতক্ষণ বেঁচে আছে ছাগলটা”! জীবিত থাকার ছদ্মবেশে এই চিউইংগাম কায়দায় দেহত্যাগ মেগা সিরিয়ালকেও লজ্জা দেবে ব’লে তৈরি, যখন গ্যাস ওভেনের উপর কড়াইতে খাসির ঠ্যাং ছেড়ে দিয়ে সভয়ে পিছিয়ে আসে বাড়ির নতুন বউ, “ও মাগো, এখনও নড়ছে যে”!
এই লেখাটাকেও এক জাতিস্মর স্নায়ুতাড়না ভাবতে পার তুমি।

চার
খুব মনে পড়ে, মনকষাকষি হলেই বলতে: আমাকে তুমি মোটেও ভালোবাসোনি। ভালোবেসেছ শুধু প্রেমের একটা আইডিয়াকে।

কিন্তু প্রেমকে প্রধানত ধারণা ছাড়া আর কীই বা ভাবতে পারি, বলো? যেন নার্সারি থেকে আনা গাঁদাফুলের চারা — মাটিতে বসালে তবেই না সে উদ্ভিদ!
ধারণা আর আধার — এই দুইয়ের যোগসাজসেই হয়তো সম্পর্ক গড়া হতে থাকে। স্বীকার করছি, নিজেকে কোনওদিন একতিল বাস্তবতা ভেবে শান্তি পাইনি, বরং হাতে-ধরা আমি-র চেয়ে আয়নায় প্রতিফলিত ছায়াই চিরদিন বেশি আদরের ছিল নিজের কাছে। এই শরীরকে যখন আত্মপরিচয়ের বদলে অঘ্রাণ মাস ভাবি, পাইনগাছের মাথার কুয়াশাপাগড়ি ভাবি, বা দু’পা পঙ্গু ভিখিরির ময়লা হাতের কয়েন একটাকা-দুটাকা, ফুরফুর করে ওড়ে কপালের ওপর আমার মাথার চুল।

সবাই জেনে গেছে, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না কোনওদিন। দুটো মানুষ মনে-মনে ইচ্ছে না করলে তাদের তো ইহজীবনে দোকানদারি হয় না! তবু একটা পছন্দের রূপকথা আছে আমার, প্রেমের পেয়ারাডাল ভেঙে ধরাশায়ী সব প্রেমিকই বুঝি জাতিস্মর মোটর নিউরোনের তাড়নায় কেঁপে উঠে স্বপ্ন দ্যাখে — প্রেমের ওপর সে নিজস্ব কায়দায় শোধ নেবে, ছোটবেলায় পড়া গল্পের গরীব গয়লানির মতো। মাথায় দুধের মট্‌কি নিয়ে মেয়েটা রোজ বাজারে যেত। তো, একদিন হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, এই দুধ বেচে লাভ ক’রে আরও বেশি দুধ কিনে সেই দুধ বিক্কিরি করে অসীম মুনাফা অর্জনের পর সে এমন অনাস্বাদিতপূর্ব বড়লোক হয়ে যাবে যে দেশের রাজপুত্রও বিয়ে করতে চাইবে তাকে। কিন্তু মেয়ে তখন ঘচাং করে খারিজ করে দেবে নবাবজাদাকে। মাথা নাড়িয়ে বলবে, না না না …।

আমিও ভাবি, কস্মিনকালে দেখা না হয়েও একদিন অকস্মাৎ মুখোমুখি পড়ে তো যেতে পারি আমরা। গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশানে? বেশ, তাই হোক।
তুমি এগিয়ে এসে ইতস্তত গলায় বললে, কেমন আছো!
রোগা হয়ে গেছ এতটা? নিশ্চয়ই এখনও না খেয়ে অফিসে চলে যাও?
আহা, আমার ওপর রাগ করে কবিতা লেখাই বন্ধ করে দিলে!

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদিও আমার স্বভাব সিগারেট ও নীরবতাবিরোধী। তুমি আরও একটু অস্থির: আচ্ছা বাবি, সব ঝগড়া ভুলে আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায় না! ধরো (গলা ধ’রে এসেছে) মাঝখানের দশ বছর মিথ্যে, দুজনে ফিরে গেছি শুরুর দিনটায়। তুমি আমার হাতে সদ্য বেরনো কবিতার বই তুলে দিচ্ছ, আর সেই আগের মতো আমি দেমাক দেখিয়ে বললাম, ‘পড়ব নিশ্চয়ই, কিন্তু মতামত দিতে অনুরোধ করবেন না, প্লিজ’!

না গো, বলব না। পুরনো ভুলগুলো আমরা কেউ করবো না আর কখনও, দেখো তুমি।

তখন মনে হল, আমার গায়ের রঙ পরিপক্ক চাপা, টলটলে স্বাস্থ্যের ওপর হলুদ ডুরে শাড়ির গাছকোমর। আমার মাথায় গাগরিভর্তি ছলছলাৎ। আর সামনে তুমি — ফর্সা, উচ্চাকাঙ্খী এক অস্ত্রসমাবেশ! এবার বহু বছর ধরে রিহার্সিত সেই ছোট পংক্তির ডায়লগ বের করে আনছি চিত্রনাট্য থেকে, এক্সপ্রেশানে গন্ডোগোল না করে বসি, যেন প্রতিটা অক্ষরে সমান জোর পড়ে:
না বাবি, এখন আর সেটা সম্ভব নয়”।

বাক্য শেষ। এবার সান্নাটা! ড্রপসিন আপেলের মতো পতনমুখী। “এখন আর সম্ভব নয়” বলতে বলতে আকাশ থেকে পাখির ঝাঁক উধাও হচ্ছে। “সম্ভব নয়” — যাত্রাপালায় ঝাঁঝর বাজল তুলকালাম “ঝং” করে। দন্ত্য স, ম আর অন্তস্থ য়-এর ভেতরের সেলাই খুলে গিয়ে তিনটে পোকায় কাটা আলাদা দাঁতের টুকরো…।

আমার মাথা থেকে খসে প’ড়ে, প’ড়ে চুরমার হয়ে, হ’য়ে ভরপুর মৃত্যুর মধ্যে মিশে যাচ্ছে ওরা দুজন — ধারণাপূর্ণ দুধ আর মাটির কলসাধার।

ছোটদের গল্প কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত (শেষ পর্ব)

ছোটদের গল্প :
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত (শেষ পর্ব)

কাল থেকে চিরকুটটা একবারও দেখিনি, সকালেও না! মেনে নিচ্ছি, ভোরবেলা ঘুমচোখে আমার নজরে নাও পড়তে পারে। কিন্তু ঘরের সদর দরজা তো বন্ধ এখনও, আর পেছনের গভীর খাদ বেয়ে ব্যালকনিতে উঠে আসা কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। জিনিয়া ম্যাডামকে বলতেই জোরে জোরে মাথা নাড়াতে লাগলেন, “দো দিন পহলে ভী উসি রুম মেঁ বোর্ডার থা”।
গিজার খারাপ হতেই পারে না।

আমার পেছন-পেছন কাঠের সিঁড়িতে দুম-দুম করে পা ফেলে বিনোদ চলে এল। তারপর বাথরুমে ঢুকেই “কিসনে কিয়া ইয়ে বদমাসি” বলেই ছিঁড়তে গেছে গিজারের সুইচের গায়ে লাগানো সেই চিরকুট। আমার হঠাৎ কেন জানি না মনে হল, একটা ভয়ংকর ভুল করতে যাচ্ছে ছেলেটা যা পরে আর কিছুতেই শোধরানো যাবে না। পেছন থেকে ওর জামার কলার ধরে দিলাম এক হ্যাঁচকা টান। টাল সামলাতে না পেরে সে বাঁদিকে কাত হয়ে বাথরুমের উল্টোদিকের দেয়ালে ধাক্কা খেল। তারপর আর একটা পাক খেয়ে এসে পড়ল আমার গায়ের ওপর। আমি স্নানঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, চিৎপাত হলাম সোজা বেডরুমের মেঝেতে।

শোয়া অবস্থাতেই হাঁফাতে হাঁফাতে চিৎকার করছিলাম, “মত ছুঁয়ো! খবরদার”! ইলেকট্রিক মিস্তিরিকে ডাকো, তার আগে কেউ গিজারে হাত লাগাবে না।

এর পরের ঘটনা প্রমাণ করে দিল, বিনোদের শার্টের দুটো বোতাম ছিঁড়ে ফেলার বদলে আমি আজ ওর প্রাণ বাঁচিয়েছি। তুমুল বৃষ্টিতে শর্ট সার্কিট হয়ে সুচবোর্ডসুদ্ধু গিজারটা একটা মৃত্যুফাঁদ হয়েই ছিল। মিস্তিরি এসে যেখানেই টেস্টার ছোঁয়ায়, আলো জ্বলে ওঠে! আর তখন হোটেলে আমার খাতির দ্যাখে কে?

শুধু বিনোদ কেন, কুইন অ্যানের নতুন জীবন — সেও তো ঘড়িবাবার হাতেই পাওয়া!

কিন্তু এত হইচইয়ের মধ্যে মনে মনে অনেকগুলো অংক মেলাতে পারছি না। লক্ষ করলাম, সতর্কবার্তা লেখা কাগজটা সবাই খুঁটিয়ে জরিপ করছে, কিন্তু উল্টিয়ে পেছনের পাতায় নজর দিচ্ছে না। ওদের হাত থেকে নিয়ে কাগজের অন্য পিঠটা দেখতে গেলাম আর ওমনি আরও একটু গন্ডোগোল হয়ে গেল আমার মাথার ভেতরটা।

এদিকে মিসেস জিনিয়া রাই তো আমার কাছ থেকে ঘরভাড়া, খাবার বিল — কিছুরই টাকা নেবেন না। তাকে বললাম, ম্যাডাম বরং আপনার বাবার গল্প বলুন, শুনি। সেটাই হবে আমার পাওয়া সেরা উপহার।

মহা উৎসাহে বৃদ্ধা শুরু করলেন: আমার বাবা প্রকাশ লিম্বু আঠারো বছর বয়েসে পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সেনা বাহিনির গোর্খা রেজিমেন্টে হাবিলদারের পদে যোগ দেন। বাবা পঞ্চম রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়নে কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজের হয়ে আড়াই লাখেরও বেশি গোর্খা লড়াই করেছিল। সাহসিকতার জন্যে তাদের মধ্যে দু’হাজার সাতশো চৌত্রিশজন মেডেল পান। জানো, আমার বাবা জাপানের বিরুদ্ধে বার্মার জঙ্গলে যুদ্ধ করে নিজের জন্যে একটা পদক জিতে নিয়েছিলেন। তারপর যে বছর দেশ স্বাধীন হল — আমার জন্মও ওই ঊনিশশো সাতচল্লিশে — বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনির এক নম্বর গোর্খা রাইফেলস-এ জয়েন করেন। অনেকে বোঝাল, ব্রিটিশ আর্মিতে থেকে যাও, ওখানে মাইনেকড়ি অনেক বেশি। বাবা বলেছিলেন, এতদিনে নিজের দেশের জন্যে লড়ার সুযোগ পেয়ে ছেড়ে দেব, এতবড় গদ্দার আমি নই।

আমি কমেন্ট করলাম যে, মিস্টার লিম্বুর মতো নির্লোভ মানুষের জন্যে আমাদের গর্ব হওয়া উচিত। আচ্ছা, উনি ঘড়িটা পেলেন কীভাবে?

মিসেস রাই উত্তর দিলেন, গোর্খা রেজিমেন্টে বাবার মেজর ছিলেন উইলিয়াম অসবর্ন নামে এক সাহেব। বাবাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন এই ভারতপ্রেমিক। শেষে এক নেপালি মহিলাকে বিয়ে করে লোলেগাঁও-এ সংসার পাতেন। তো, সেই অসবর্ন সাহেব তার কুইন অ্যান দেয়ালঘড়ি বাবাকে গিফট করলেন। বাবাও ততদিনে রিটায়ার করে এখানে ছোট্ট রেস্তোঁরা খুলেছেন। বাবার যত্নে ঘড়ি চলতও খুব ভালো। কিন্তু তারপরই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে গেল…।

আর মিনিট পনেরোর মধ্যে আমার বাস এসে যাবে। প্রচুর ধস নেমে শিলিগুড়ি যাওয়ার সব রাস্তা একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে ইচ্ছে না থাকলেও আজই সমতলে নেমে যেতে হবে। কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে পর্যন্ত বরফ-সুন্দরী লাভা যেন তার মায়াবী ধাঁধাঁটার জবাব কিছুতেই জানাবে না। আর ফিরে যাওয়ার সময় যত এগিয়ে আসছে, আমিও নাছোড়বান্দার মতো সমাধান কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি নানা সূত্র জোড়া দিয়ে দিয়ে।

জিগেস করলাম, মিস্টার লিম্বু কি ঊনিশশো সাতাশিতে মারা যান?
— হ্যাঁ, ঠিক একত্রিশ বছর আগে। কিন্তু তুমি কী করে জানলে!

উত্তর না দিয়ে ওর টেবিল থেকে পেনটা তুলে ওরই প্যাডের কাগজে একটু আঁকিবুকি কেটে তুলে ধরলাম চোখের সামনে:
— দেখুন তো কার সই?
এতখানি অবাক বোধ হয় ম্যাডাম জীবনেও হননি।
— আমার বাবার! তুমি নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যা জানো?
কথা ঘোরানোর জন্যে থেমে যাওয়া কাহিনির সুতো ফের ধরিয়ে দিলাম:
— আপনার আপত্তি না থাকলে দুর্ঘটনার কথাটা বলুন, শুনি।

—সে ভীষণ মর্মান্তিক ব্যাপার! অবসর নেওয়ার পর বাবা সকাল-বিকেল দুবেলা নিয়ম করে হাঁটতে বেরোতেন। ঊনিশশো সাতাশির শীতের সন্ধ্যায় লাভা-কালিম্পং রুটের একটা জিপ ওকে ধাক্কা মেরে খাদে ফেলে দেয়। আর্মির লোকজন মানে বাবার ডিপার্টমেন্টের সহকর্মীরাই দেহ উদ্ধার করে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিল।

ম্যাডাম জিনিয়ার গলা ভারি হয়ে এসেছে। এদিকে হাতে সময় বড্ড কম। একটু অপেক্ষা করে বললাম, এবার শেষ ম্যাজিক। আপনার কাছে বাড়ির সদস্যদের ছবির অ্যালবাম থাকলে একটু নিয়ে আসবেন, প্লিজ?

যেতে যেতে…

বাসে অন্তহীন ভিড়। দুর্যোগ মাথায় নিয়ে সেনাবাহিনির কর্মীরা এখানে-ওখানে রাস্তা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। আমার ঘুরে ফিরে কেবল মনে পড়ছে গতরাতের ঘটনা আর জিনিয়া রাইয়ের হতবাক চোখদুটো। যখন বাড়ির ষোল সদস্যের গ্রুপ ফটো থেকে আমি নিজেই ওর বাবার ছবিটা বেছে দিই, উনি কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

প্রাচীন শ্যাওলামাখা জল-টুপটুপ ঝাউসারির ভেতর দিয়ে বাস নামছে। আমি পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করলাম যার একপিঠে আমারই লাল ইংক পেন ব্যবহার করে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে, “স্পর্শ ক’রো না! বিপজ্জনক!!” কাগজটা ওল্টালে বোঝা যায়, সেটা ছয় জুন ঊনিশশো সাতাশি সালে কাটা একটা রেস্তোঁরার বিল। রেস্তোরাঁ-মালিকের সইও আছে নিচে — পি লিম্বু। আজ একটু আগে বিনোদ খুব লাফঝাঁপ দিয়ে একটা উইন্ডোসিটের ব্যবস্থা করেছে। এই পাহাড়ি ছেলেটা হয়তো সারা জীবন আমার ‘আভারি’ হয়ে থাকবে যেহেতু তার প্রাণ বাঁচিয়েছি। কিন্তু আমিও যে একইভাবে অন্য একজনের কাছে কৃতজ্ঞ রয়ে গেলাম, ইহলোকে যাকে বিনোদের মতো ধন্যবাদ জানানোর সুযোগ পাবো না?

পাহাড়-ঘুরে-নামা পথ অনেক দূর থেকে নজরে পড়ছে মেয়েদের চুলের ভাঁজকরা রিবনের মতো। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বাঁ দিকের নিচু রাস্তায় ফুটে উঠল গতকাল বিকেলের সেই ছবিটা। এক বৃদ্ধ — কালো কোটের ভেতর থেকে সাদা শার্টের হাতা উঁকি দিচ্ছে — হাতে ছড়ি নিয়ে ঝুঁকে হেঁটে মিলিয়ে গেলেন পাইনবনের আড়ালে! যতক্ষণ দ্যাখা যায়, আমি তাকিয়ে থাকলাম।

“থ্যাংক ইউ, মিস্টার লিম্বু।”

ছোটদের গল্প কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত ৩য়

ছোটদের গল্প
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত।

হোটেলের দরজা ঠেলে ঢুকছি, তখনও বুক ধড়ফড়! রিসেপশানে রাই পরিবার সার দিয়ে ব’সে টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখছিল, হইহই করে উঠল: এতক্ষণ কোথায় ছিলে? বলেছিলাম না, রাতের খাবার আমরা সেভেন থার্টিতে সার্ভ করি?
— ও হো, আটটা বেজে গেছে! সরি সরি, আমি একেবারেই…।
— আচ্ছা ঠিক আছে, ঘরের চাবিটা দাও — সেই বৃদ্ধা মালকিন বললেন মিষ্টি হেসে। বিনোদ, তুমি ডিনারটা হটপটে করে ওনার ঘরে রেখে এসো। আসলে, এই দুর্যোগের রাতে ছেলেটাকে দু’কিলোমিটার রাস্তা পার করে বাড়ি পৌঁছোতে হবে তো!
— এখন যাবে? একা!
বিনোদ হেসে ফেলল: যাব মানে? প্রত্যেকদিনই তো ফিরি।
— কোনও বিপদ নেই পথেঘাটে? চিতা বা ভালুক? তারপর…জানোয়ার ছাড়াও কত কিছু আছে!
— কুছ ভী নেহি হ্যায়। এবার বিনোদের হাসিতে যোগ দিল সবাই, এমনকি তানিয়ার বয়েসি বৃদ্ধার সেই সুন্দরী নাতনিও।

লজ্জা পেলাম খুব। মাথা থেকে ভয়ের বোঝাটাও নেমে গেল পুরোপুরি। সেই খুশিতে ওয়ালক্লক থেকে এযাত্রা আর চোখ সরিয়ে নেওয়াও হল না। ম্যাডাম রাই-কে জিগেস করলাম, কুইন অ্যান কতদিন হল অচল পড়ে আছে?
— বাহ, তুমি ঘড়িটার নাম জানো দেখছি! তা, দশ বছর তো বটেই। এটা আমাদের বাড়িতে এসেছিল যখন আমার বয়েস…।

কথায় বাধা দিতে হল। শক্ত কাঠের ফ্রেমে গাঁথা এই ভারি-ভরকম বস্তুটি দেয়াল থেকে নামানো আমার একার কর্ম নয়। ম্যাডামকে বললাম, প্লিজ বিনোদকে বলুন ঘড়িটা আমার রুমে তুলে দিতে। একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।

যা আশা করেছিলাম, ভদ্রমহিলা একেবারে আপ্লুত। “ওমা, তুমি ঘড়ি সারাতে জানো! আহা কী ভালোই না হবে যদি সামনের ক্রিসমাসে এটা সময় দেখাতে পারে।”

ছুঁয়েছ কি মরেছ!

হোটেলের ঘরে ঢুকে ভাবলাম, সকাল থেকে এই ঠান্ডায় দৌড়ঝাঁপ তো কম হল না, গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে কাজে লাগি। বাথরুমে ঢুকে দেখি আয়নার ওপর খয়েরি রঙের এক পাহাড়ি মথ বসে আছে। গিজারের সুইচ অন করতে যাব, হঠাৎ বিচ্ছিরি রকম উড়তে লাগল সেটা। এমন বোম্বাই সাইজের বেপরোয়া উডুক্কু মথ জীবনেও দেখিনি বাবা! আর সে ঘুরে ফিরে খামোখা আমার গায়েই বা বসতে চাইছে কেন? পোকা-মাকড় মেরে ফেলা আমার ধাতে সয় না, ভয় হল এটা আমার পিছুপিছুু শয়নঘরে ঢুকে পড়লে তো কাজ আর ঘুম দুইয়েরই দফারফা। সাবধানে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এসে লাগলাম ঘড়ির পেছনে।

এ-ঘড়ি, যাকে বলে বড্ডো অভিজাত। কেসটা পাক্কা চেরি কাঠে তৈরি, পেন্ডুলামের দণ্ডটিও কাঠের। ফুট তিনেক লম্বা ঘড়ি-মহাশয়ার বয়েস হেসেখেলে একশো বছর তো হবেই। যে রানি অ্যানের নামে এই যন্ত্র, তিনি অবিভক্ত ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের অধীশ্বরী ছিলেন আঠেরো শতকের শুরুতে। লন্ডনের সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে তার মূর্তি রয়েছে আজও।

কুইন অ্যানকে আমি কোনও ছবিতে হাসিমুখে পাইনি, এই ঘড়ি অবশ্য আমাকে দেখা পর্যন্ত মাঝে মাঝে স্মাইল দিচ্ছে। যেখানেই যাই, যন্ত্রপাতির একটা ছোট্ট কিট আমার সঙ্গের ব্যাগে থাকে। প্রথমে ঘড়িটা খুলে পার্টসগুলো লোশানে চুবিয়ে রাখতে হবে ঘন্টাখানেকের জন্যে। কাজ করতে করতে চোখ চলে যাচ্ছিল বাইরের কুয়াশা-ঢাকা শুনশান বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আচ্ছা, হিমে ভেজা বেঞ্চটার ওপর কেউ কি বসে আছে কালো কোট, কালো ট্রাউজার, বো টাই…?

ধুস, কি পাগলামি করছি! উঠে গিয়ে জানলার পর্দা টেনে দিলাম। বলতে ভুলে গেছি, এই ঘরে ঢোকার দরজার ঠিক উল্টোদিকে বড় দুটো কাচের জানলা আর তার মাঝখানে মোটা প্লাইউডের আরও এক দরজা রয়েছে। দরজা খুলে বাইরে বেরোলে ছোট্ট ব্যালকনির গা ঘেঁষে গভীর খাদ আর বাঁদিকে বাস-গুমটি। রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া যাক ভেবে হাত বাড়ালাম হটপটের দিকে।

মা বলল, এবার আমাদেরও চা-পানের বিরতি।

ঘড়িকাকুর গল্প অ্যানাসথেশিয়ার মতো, মার কথায় যেন শরীরে সাড় এল! চায়ের কাপ কোলের কাছে টেনে নিয়ে উনি আবার বলতে লাগলেন:

অনেক রাতে শুয়েছিলাম সেদিন, আলোটালো না নিভিয়েই। কিন্তু খুব ভোরে মাথার যন্ত্রণা আর বন্ধ-নাক নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি ঘরের ভেতরটা চাপচাপ মেঘে ভীষণরকম আবছা আর টিউবলাইট জিরো পাওয়ারের বাল্বের মতো মিটমিট করছে। উঠে জানলার সামনে যেতেই… ও হরি, ব্যালকনির দরজা হাট করে খোলা যে! কী আশ্চর্য, গতরাতে ছিটকিনি হাঁসকল সব লাগিয়েই তো বিছানা নিয়েছিলাম!

তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ওষুধ বার করতে হল, তারপর চট করে বাথরুম ঘুরে এসে আবার পড়লাম আমার পেশেন্টকে নিয়ে। কাল রাতেই লোশান থেকে তুলে সুতিকাপড় আর পেগ-উড দিয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিলাম পার্টসগুলো। এবার স্প্রিং, পিনিয়ন, লিভার, পিভট, হুইল ট্রেন — একটা করে বসাতে লাগলাম যথাস্থানে। তোমাকে হয়তো বলেছি সিদ্ধার্থ, এই সময়ে আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। যন্ত্রাংশের ঠিকঠাক লেগে যাওয়া, জায়গামতো বসে যাওয়া যেন সংকেত পাঠায় মনের মধ্যে — আগে থেকেই বুঝে নিতে পারি ঘড়িটা সেরে উঠছে কিনা। আসলে সব ঘড়িই কিন্তু চায় সর্বক্ষণ চালু থেকে আমাদের সময় দেখাতে। আর, একটু ভালোবাসা পেলে মানুষের মতো ঘড়িও কখনও বিগড়োয় না!

ঘড়িকাকু এবার গলা নামিয়ে বললেন, একটা গোপন খবর দিই। সুস্থ করে তোলার পর প্রত্যেকটা ঘড়ি আমাকে চুপিচুপি ধন্যবাদ জানায়। আজও চাবি ঘুরিয়ে পুরো দম দিয়ে সোজা করে ধরতেই কুইন অ্যান মিষ্টি স্বরে বলল “থ্যাংক ইউ”, তারপর চলতে শুরু করল তার একশো বছরের চেনা সময়-পথ ধরে।

ঘড়ির কাজ সেরে নিজের কাজ মনে পড়ল — স্নান সারতে হবে। ওষুধ খেয়ে শরীরটা ঝরঝরে হয়েছে, সকালে দেখেছি বিদেয় হয়েছে সেই হাড়-জ্বালানি মথটাও। তো, বাথরুমে ঢুকে যেই গিজারের সুইচ অন করতে যাব… আরে, এ আবার কী! সুইচবোর্ডের গায়ে এক টুকরো কাগজ সাঁটানো আর তাতে লেখা:

DON’T TOUCH! DANGEROUS!!

( আবার আসছি… )

ছোটদের গল্প কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত (২য়)

ছোটদের গল্প
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত

পেছনে তাকিও না

বেশি সাধতে হল না, ঘড়িকাকু নিজের হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শুরু করলেন:
গত বছর এই রকম ভরা শ্রাবণে আমি কালিম্পংয়ের পাহাড়ে বেড়াতে গেলাম। তুমুল বৃষ্টি আর রাস্তার ধস মাথায় ক’রে ট্রেকারে চেপে এক শেষ-দুপুরে পৌঁছোলাম লাভা-তে। বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া যে-হোটেলে ছাতামুড়ি দিয়ে এসে ঢুকেছি, তার একমাত্র বোর্ডার আমিই। জানলা দিয়ে তাকালে চারদিকে কুয়াশার দুধ-সাদা দেয়াল, ক্কচিৎ দু’একটা জিপ ফগলাইট জ্বালিয়ে ওঠানামা করছে। পোশাক পালটে আমার দোতলার রুম থেকে নেমে এলাম। হোটেলটা চালান জিনিয়া রাই নামে এক টুকটুকে সুন্দরী বৃদ্ধা আর তার পরিবারের সদস্যরা। রিসেপশানের বাঁপাশের হলঘরটা রেস্তোঁরা; এই অবেলায় দুপুরের খাবার মিলবে না বুঝে এক কাপ কফি আর পকোড়ার অর্ডার দিয়ে চেয়ার টেনে বসতে গেছি, দেখি উল্টোদিকের দেয়াল জুড়ে এক সুপ্রাচীন ওয়াল-ক্লক। এবং সেটা নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু!

এ-হল আমার যাকে বলে বার্নট ফোরহেড, বুঝলে তানিয়া মা? ঘড়িকাকু আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন: যেখানেই যাই, অচল ঘড়ি ঠিক আমার পিছু নেবে। অথবা, আগে থেকেই সেখানে পৌঁছে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে আমার অপেক্ষায়। আরেকটা ঝামেলার ব্যাপার হল, প্রত্যেক বন্ধ ঘড়ির মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি তারা আমাকে মুচকি হেসে চ্যালেঞ্জ করছে, পারো তো সারাও দেখি! কাজেই, অন্তত বেড়াতে গিয়ে আমি তাদের দেখি না। এবারও চট করে চোখ সরিয়ে মোবাইল হাতে নিলাম — বাড়িতে একবার জানানো দরকার আমি আস্ত শরীরে লাভায় পৌঁছেছি। কিন্তু সিগন্যাল নেই। ফর্সা, ছিপছিপে যে কিশোরী খাবার সার্ভ করছিল, বলল: এত বৃষ্টিতে মোবাইল টাওয়ারগুলো হয়তো কাজ করছে না। আপনি বৌদ্ধ গুম্ফার চত্বরে গিয়ে চেষ্টা করুন, ওখান থেকে লাইন পাওয়া সহজ।

বেরিয়ে এসে দেখি বৃষ্টি থেমেছে, আকাশও কিছুটা ভদ্রলোকের মতো। হোটেলের ঠিক সামনে একটা রাস্তা ডানদিকের উৎরাই ধরে চলল গোরুবাথানের দিকে, আলগা নুড়িপাথর আর পিচের গুঁড়োয় তার অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। তবু ওর মধ্যেই কয়েকটা খুদে বাচ্চা দিব্যি ছুটোছুটি করছে সোয়েটার জিনসের প্যান্ট চাপিয়ে। আর নজরে পড়ল এক বৃদ্ধ পাহাড়ি মানুষ — পুরনো আমলের ঢংয়ে কেতাদুরস্ত থ্রিপিস স্যুট, মাথায় কানাতওলা টুপি, হাতে ছড়ি নিয়ে টুকটুক করে নামছেন আমার পেছনে। যা হোক, বৌদ্ধ মন্দিরের ফটকে পৌঁছে দেখি নোটিশ ঝুলন্ত — সাড়ে পাঁচটার পরে ভেতরে ঢোকা যাবে না। এদিকে আমার হাতঘড়ির বক্তব্য: এখন সাড়ে ছ’টা। কী করি! হঠাৎ পেছন থেকে এসে দুজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ঢুকলেন গেট ঠেলে, আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় জিগ্যেস করলেন: ফোন করতে চান তো? ভেতরে আসুন।

বৌদ্ধ মন্দিরের পাঁচিল-ঘেরা চত্বরে ঢুকতেই মালুম হল, ভিউ পয়েন্ট হিসেবে জায়গাটা দুর্দান্ত! নিচের খাদ থেকে বিশাল চেহারার কত যে ঝাউগাছ উঠে এসেছে, তাদের মাথায় সাদা ফিতের মতো জড়ানো কুয়াশা। বাড়িতে ফোন সেরে আবার উৎরাই বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম, আলো থাকতে থাকতে আজকের মতো যতটুকু দেখে নেওয়া যায়! এখন রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই-ই, দোকানগুলো ঝাঁপ ফেলছে এক এক করে। পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম শুধু সেই বৃদ্ধকে, আস্তে আস্তে ছড়ি হাতে নামছেন। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন উনি!

এখানে রাস্তা অনেকখানি সমতল পেয়ে দু’একটা বড় দোকানকে তার গা ঘেঁষে জায়গা দিয়েছে। ডানদিকে তাকালে অস্পষ্ট উঁচুনিচু ঢেউয়ের মধ্যে একটা বিশেষ পাহাড় অনেক আলোয় সাজানো। আকাশ থেকে তারাগুলো খসে যেন পাথরের খাঁজে খাঁজে আটকে গেছে। “ওটা কালিম্পং” — চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি যে ভদ্রলোককে এখুনি তার মোটর গ্যারাজে তালা লাগাতে দেখলাম, কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

“এই বৃষ্টিতে পাহাড়ে বেড়াতে এলেন! কলকাতার লোক মনে হচ্ছে?” ঘাড় নাড়িয়ে তাকে হ্যাঁ বলতে গিয়ে আবার চোখে পড়ল সেই বৃদ্ধ মানুষটি পথের শেষ উৎরাইটুকু ভেঙে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। সামনের দিকে হাত তুলে গ্যারাজ মালিককে শুধোলাম: কোথায় গেছে এই রাস্তা?
— বস্তির দিকে। তবে একা একা অন্ধকারের মধ্যে ভেতরে ঢুকবেন না। ফরেস্ট এলাকা, জানেন তো?
— হ্যাঁ, নেওড়া ভ্যালি। জীবজন্তু বেরোতে পারে বলছেন?
— ভালুক বা লেপার্ড কখনও সখনও নিচে নেমে আসে। দিনের বেলা তেমন হলে গ্রামের লোকই আপনাকে সাবধান করে দিত। কিং কোবরা, পাইথন — কয়েক রকম সরীসৃপেরও বাস এই জঙ্গলে। তারপর ধরুন…জানোয়ার ছাড়া আরও কতকিছু আছে!

গুড নাইট বলে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। ওমনি আমার খেয়াল হল অনেক রাত নেমে গেছে চারপাশে। রাস্তাটা যেন হঠাৎ ক’রে ঘুরঘুট্টি, কোথা থেকে একটা বড় লোমওলা কুকুর উদয় হয়ে আমার প্যান্ট শুঁকতে লেগেছে। দেরি না করে পা চালিয়ে দিলাম ফিরতি পথে।

তুমি তো জানো সিদ্ধার্থ, ঘড়িকাকু মুখ তুলে বাবার দিকে তাকালেন, সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার পাত্র আমি নই। ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি শুরু হতে বুঝলাম গাঢ় রাত নেমে যাওয়ার রহস্য। সন্ধের আকাশে মেঘ জমে আসা আর দুম করে লোডশেডিং — কোনওটাই আমি আসলে লক্ষ করিনি। সে যা হোক, কিছুটা ওঠার পর শরীরের মধ্যে এক রকম ছমছমে অস্বস্তি টের পেতে লাগলাম। মন বলল, আমার পেছনে এমন একটা কিছু ঘটছে যা দেখা একেবারেই উচিত হবে না। অথচ, তাকাবো না তাকাবো না করেও পেছনবাগে ঘুরে গেল মাথাটা। আর যা দেখলাম তাতে কোনও যুক্তিবুদ্ধিই আমাকে ভয়ে শিউরে ওঠা থেকে বাঁচাতে পারল না। সেই বৃদ্ধ! একইভাবে মাথা রাস্তার ওপর ঝুঁকিয়ে হেঁটে আসছেন আমার পিছু পিছু। কিন্তু এবার অবিশ্বাস্য জোরে হাঁটছেন, ঘাড়ের ওপর এসে পড়লেন আর কি!

ভয়ের স্বপ্নে যেমন হয়, ছুটতে চাইলেও কিছুতেই পাদুটো নড়বে না মাটি থেকে, তেমনি স্ট্যাচু অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে জানি না, হঠাৎ নিচু গলার কথা আর চপ্পলের ফটফট শব্দে সম্বিত পেয়ে দেখি, ডানদিকের গলি দিয়ে পাঁচছ’জন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হেঁটে আসছেন, গায়ে লাল-মেরুন কাপড়; তাদের মধ্যে আছেন আমার বিকেলবেলার দুই মুখচেনাও। “হোয়াট হ্যাপেনড! গট ফোন লাইন?” — মাথা কাত করে আমি পা চালিয়ে মুহূর্তে মিশে গেলাম সেই দলে। ওরা জানতেও পারলেন না, কত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন আমাকে!

(কাল আসছি… )

ছোটদের গল্প কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত (১ম)

ছোটদের গল্প
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত

ভূত-বিজ্ঞান
বাবা বলেছিল, আজ অফিস থেকে ফেরার সময় ঘড়িদাকে নিয়ে আসবো। আমাদের টেবল-ক্লকদুটো সারানো দরকার।
তবে আমার ভুলোমন পিতাজি যে সত্যি-সত্যি সন্ধেবেলা ভদ্রলোককে সঙ্গে করে বাড়ি ঢুকবে, এতটা আমরা মা-মেয়েতে আশা করিনি।

নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করে ঘড়িদা (আমার ঘড়িকাকু?) কয়েকমাসের অকেজো সময়মাপক যন্ত্রদুটোকে চালিয়েও দিলেন মিনিট কুড়ির মধ্যে। তারপর সবাই মিলে বসা হল বাইরের ঘরের সোফায়।

বাবার মুখে এবার ব্রেকিং নিউজ: তোদের কখনও বলার সুযোগ হয়নি তানিয়া, ঘড়িদা মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে খুব ইন্টারেস্টেড। আর একটা ব্যাপারেও ওর বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি আছে — অশরীরি আত্মা।

শুনে আমার গা রি-রি করে উঠবে এতটা না হলেও পরিষ্কার বলছি, খুব বোকা-বোকা লাগে এই আলোচনাগুলো।
কাজেই, “আপনি নিজে কখনও ভূত দেখেছেন?”-ই ছিল আমার আধা-বিনয়ী চ্যালেঞ্জ। ঘড়িকাকুই বুঝে নিন, আর এগোবেন কিনা।

ভয়ও ছিল, উল্টে “তোমাকে যেমন দেখছি, তেমনি দেখেছি ভূতকেও” এরকম কথামৃত-মার্কা কিছু শুনে ফেলতে পারি। না, ঘড়িকাকু মাঝামাঝি পথে হাঁটলেন।
— যে দেখতে চায় তাকে সাধারণত দ্যাখা দেয় না। ভিতুকে ভয় পাইয়েই প্রেতাত্মার আনন্দ।
এমত বলে ঘড়িকাকু উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছেন। শ্রাবণ মাসের সন্ধে, আর এক পশলা বৃষ্টি উপহার দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে কালো আকাশ।

বাবা মুচকি হেসে আমার পাশ থেকে উঠে গেল রান্নাঘরে তারপর মায়ের ইশারা পেয়ে ছাতা হাতে রাস্তায় — যদি খুব ভুল না ভেবে থাকি, মোড়ের রজতদার দোকান থেকে বেগুনি আর মিষ্টি সিঙাড়া কিনে আনতে।

ঘড়িকাকু কন্টিনিউ করছেন: এই ইঁট, সিমেন্ট, পাথরের দুনিয়াতে যেমন প্রজাপতি বিরল হল, তেমনি ভূতও বিরল প্রজাতি হয়ে উঠবে, কারণ সেটাই স্বাভাবিক!
রান্নাঘরে থাকলেও মায়ের কান যে এদিকেই, বোঝা গেল তার গলা-উঁচু প্রশ্নে:
শামুক, ফড়িং, ঝিঁঝিঁপোকা এসব নয় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভূতদের তো মৃত্যু নেই, তারা মরে ভূত। তাহলে?

খুব সৎ জিজ্ঞাসা। কিন্তু ঘড়িকাকু লেগস্ট্যাম্পের ওপর ফুলটস পেয়েছেন। আবার এক-পশলা উদাস শান্ত হাসি দিয়ে জানালেন:
ভূতেরা মরে যাচ্ছে বলিনি তো! সরে যাচ্ছে। আগে গৃহস্থ পাড়ার আনাচেকানাচে বা হাটবাজারের রাস্তায় মেছোভূত ঘুরত মাছ খাওয়ার লোভে। দুষ্টু ছেলে ভরদুপুরে বাগানের আম চুরি করছে, গেছোভূত মাথায় ঢিল মেরে তাকে বাড়ি পাঠাত। কিম্বা ধরো, পাড়ার নতুন বউ কাউকে না জানিয়ে রাতবিরেতে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়, পেত্নী তার খোলা চুল বেয়ে উঠে বসতো ঘাড়ে। এখন সব জায়গায় আলো, সর্বত্র মানুষ। ভূতেরা তাই ওপরের নানান বায়ুস্তরে উঠে গেছে।

— আসলে বিজ্ঞানই সেই আলো, বুঝলে ঘড়িদা? আলো যত ছড়াবে, ভূতদের ফিউচার টেন্স ততই ডার্কনেস। কী বলিস, তানি? বাবা বেগুনির বদলে ডালের বড়া নিয়ে ফিরেছে।
ঘড়িকাকু হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন: কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস নাইন।
তুমিও বাবার সঙ্গে একমত?
মোটামুটি হ্যাঁ। দেখিনি, তাই বিশ্বাস করি না। এভাবে বলা চলে যে আপনি যদি মানতে চান তবে ভূত আছে, না মানলে নেই।

— হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন বিক্রিয়া করে জল তৈরি হয়, ঠিক তো?
— হুঁ।
— দেখেছ কখনও?
— না, কিন্তু তাতে কী? এ-তো বিজ্ঞানের আবিষ্কার। ব্যবস্থা করলেই দ্যাখা বা দেখানো যেতে পারে।

— লক্ষ লক্ষ মানুষ ভূত দেখেছে, লিখেও গেছে নিজেদের অভিজ্ঞতা। তাদের কথায় বিশ্বাস করছ না কেন?
— তারা কি আমাকে ভূত দেখাতে পারবে?
আলবৎ পারবে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়া চাই। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দুটো গ্যাস এমনি মিশিয়ে দিলেই তো আর জল হয় না। বিশেষ তাপমাত্রা, বায়ুস্তরের চাপ আর অনুঘটক লাগে রিঅ্যাকশান করাতে। এটাকেই পরিবেশ বলছি। এমন অনেক হানাবাড়ি রয়েছে যেখানে গেলে অশরীরি আত্মা যে রয়েছে সেই অনুভূতি মনে আপনা থেকেই জোরালো হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে একটা পত্রিকায় বেশবিদেশের প্রাসাদ আর দুর্গের খবর বেরিয়েছিল, যেমন ইংল্যান্ডের উইনসর কাসল, স্কটল্যান্ডের এডিনবরা কাসল, বা আমাদের রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ। জানো কি, সে-সব ট্যুরিস্ট স্পটে মানুষ পয়সা খরচ করে ভূত দেখতে ছোটে!

কাকুটাকে আমার ভালো লেগে যাচ্ছে! না, ভূতে রাজি হয়ে গেছি এমন নয় মোটেই। অশরীরি সত্তার ওপর এত বিশ্বাস আর মায়া — যেন তারা সবাই ওর নিজের লোক, আত্মীয়স্বজনের মতো!

এবার ইন্টারভ্যাল ঘটিয়ে দিয়ে দৃশ্যের ভেতরে মা ঢুকে পড়ল, হাতে যথারীতি দুরকম স্বাদ — নোনতা আর মিষ্টি। সঙ্গে ঘোষণা:
— এসব বিশ্লেষণ এখন থাক, দাদা। আপনি বরং নিজের চোখে দ্যাখা ভূতের একটা গল্প বলুন, আমরা জমিয়ে শুনি। তারপর ভেবে দেখব, ভূতে বিশ্বাস করা যায় কিনা।

( সবে ভূতের সন্ধে… )

ছোটদের গল্প আজকের ভগীরথ

ছোটদের গল্প : আজকের ভগীরথ

চার

কপালজেঠুর পাঁচ টাকা এখনও উশুল হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে মনের মধ্যে। সুপারের সামনেই ফস করে শুদ্ধ বাংলায় আবেদনপত্র লিখে ফেলল কর্তৃপক্ষের কাছে। সুপার সেটা জমা নেননি বটে, তবে খুব খাতির করে নাম-ঠিকানা টুকে নিয়েছেন অভিযোগ-বইতে। আর, রোগিকে অন্য ডাক্তারের কাছে রেফার করে দেওয়ার মতো বলেছেন, এই কাছেই পিএইচই-র অফিস, আপনি একবার ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন না!

কিন্তু কাছে হলেই কি সাততাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়? রাস্তা জুড়ে অটো-টোটো-ভ্যানরিকশা-টেম্পো-লরি-বাসের শো-রুম! সেসব সাঁতরে যাহোক ক’রে এগনো, হঠাৎ দ্যাখা যায় কয়েকটা ঝকঝকে ছেলেমেয়ে, খুব ড্রেসপত্তর, হাতে বড় বড় ক্যামেরা আর পেছনে এক দঙ্গল জনতা নিয়ে এই দিকেই ধেয়ে আসছে। কপালজেঠু পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে কি, দলের একজন তার পাঞ্জাবির হাতা টেনে ধরল, হাতে গদিতে মোড়া লম্বা সরুপানা মাইক।
— দাদু, আপনি তো এই শহরেরই নাগরিক, এখানকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তাঘাট এসবে সরকারি পরিষেবা কেমন একটু বলুন না!
— কেন বলতে যাব? কে আপনারা!
— আমরা “আশ্চর্য বাংলা” টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলায় সমীক্ষার কাজ করছি। পুরসভা থেকে নানা স্তর পর্যন্ত এই যে কোটি কোটি টাকার সরকারি পরিকল্পনা…।
— সমীক্ষা করে ঘন্টা হবে! লক্ষ-কোটি ছেড়ে দাও, আজ সকালে যে আমার বেমক্কা পাঁচটাকা বেরিয়ে গেল, তারই উশুল পাচ্ছি না।

কপাল জেঠু গড়গড় করে বলতে শুরু করেছে তার দুঃখ-হয়রানি। মাইক-ধরা মেয়েটা অর্ধেক শুনেই খুব উত্তেজিত —“এই স্বরাজ, সুধীনদাকে এখুনি ওবি ভ্যান ঘোরাতে বল। বিশাখা, পারিজাত — দাদুর সঙ্গে চলো, ডেস্টিনেশান পিএইচই অফিস।

পাঁচ
বিদ্যার্থী সংঘের সবচেয়ে জুনিয়ার মেম্বার ক্লাস ফাইভের তুহিন, সাদা মনে কাদা নেই।
— কপালজেঠু, তুমি আজ রান্না করবে না?

কপালেশ্বর সরখেল লম্বায় সাড়ে পাঁচ আর প্রস্থে তিনফুট তক্তপোষে বসে আছে। পিঠটা বেঁকিয়ে দেয়ালে ঠেসান দেওয়া। শুয়ে পড়লে দু’পা বেরিয়ে থাকে; পা সামলানো যাবে না, তাহলে মাথা ঝুলে পড়বে। তক্তোপোষের ডানদিকের একটা কোনা ভেঙে তুবড়ে গেছে। তার ওপর তোষক-চাদর এমন টানটান করে পাতা যে উদ্ধৃত অংশ “খাটের চোরাবালি” নামে কুখ্যাত। আদতে তক্তোপোষটি কপালজেঠুর দিদিমার, এখন স্মৃতিরক্ষা-অর্থরক্ষা যমজ ভূমিকা পালন করছে।

পাড়ার ছেলেপুলের পেছনে লাগাটা কপালেশ্বর উপভোগই করে, তবে উপদ্রবের খুব বাড়বাড়ন্ত হলে দলের কাউকে সে কায়দা করে চোরাবালিতে বসাবে। শিকার তো লতাপাতা ছিঁড়ে প’ড়ে খাটের গর্তে লটকে গেছে! তখন হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে হাতপা ধ’রে টেনে ওপরে ওঠাও আর কি।

চোরাবালির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিকাশ একটু সাবধানে মুখ খুলল:
— কপালজেঠুর রান্না তো সকাল ছ’টাতেই শেষ। তাছাড়া, উনি তোদের মতো ছ-সাতখানা পদ বানানো পছন্দ করেন না, বড় ক’রে একটা আইটেম তৈরি করে নেন। আজ কী রাঁধলে গো, জেঠু?
— উচ্ছেসেদ্ধ ভাত।
— দেখেছিস! আচ্ছা কাল কি খেয়েছে?
— উচ্ছে ভাজা আর ভাত।
— আগামি কাল তো রবিবার। সেদিনের কী মেনু গো?
কপালেশ্বরের মুখে খুব শান্তিমাখা হাসি ফুটে উঠেছে।
— কাল স্পেশাল ডিশ। ভাত আর আলুউচ্ছেমাখা!

ঘরের মেঝেতে বিদ্যার্থী সংঘের থিকথিকে কালো মাথাগুলো হাসিতে ওলট-পালট খেতে শুরু করেছিল সবে, হঠাৎ শীতলপাটি হয়ে গেল পুরো সমাবেশ। এই চুপ চুপ, কপালজেঠু “নতুন বাংলা”র টিম নিয়ে পিএইচই-এ প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের ঘরে ঢুকে পড়েছে!

ইঞ্জিনিয়ার বিব্রত, আবার একটু খুশিও। সবার জন্যে চায়ের অর্ডার দিচ্ছে। কপালজেঠু বলে উঠল, চা পরে হবে, আগে স্যার এক গেলাস জল খাওয়ান। তার সঙ্গে একটা লিখিত নির্দেশ করে আমার টাকা পাঁচটা ফেরত দিলে বড় বাধিত হই — বলেই অ্যাপলিকেশানটা ধরিয়ে দিল সাহেবের হাতে। সব শুনেটুনে এবার চিফ এঞ্জিনিয়ার তার জুনিয়ারকে ডেকে ধমকাচ্ছেন। সে ওখানে দাঁড়িয়েই এক্ষুনি-চলে-আসুন মর্মে ফোন করছে কন্ট্রাকটরকে।

ওয়র্ক অর্ডার বাগানো পেটমোটা ভ্যাবলা চেহারার লোকটা আশেপাশে কোথাও ছিল বোধ হয়, দুমিনিটের মধ্যে দন্ডায়মান চিফের সামনে।

— শুনুন, আজকের মধ্যে জেলা হাসপাতালের সবকটা ট্যাপে সাপ্লাই চালু করতে হবে। চেক করুন, কোন-কোনটা রি-সিংক হবে আর কতগুলোয় ছোটখাটো মেরামতি। যত রাতই হোক, আমি দেখতে চাই কাজ শেষ হয়েছে। আমাকে রিপোর্ট করবেন কাল ঠিক সকাল দশটায়, এক মিনিট দেরি হলে সরকারি কনট্রাকটরের লিস্ট থেকে আপনার নাম চিরকালের মতো বিদায় নেবে।

টিভির ছবিতে যেমন চটাপট হাততালি পড়ল, তেমনি কপালজেঠুর ঘরেও। কোনও কোনও বিদ্যার্থী সিটি পর্যন্ত দিচ্ছে!

এবার ইঞ্জিনিয়ার তার হাত ধরে বলবে: এই তৎপরতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস্টার সরখেল। আজ দেশে আপনার মতো কিছু সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক আছে বলেই…। (টিভি ক্যামেরার দিকে ঘুরে) উপস্থিত সবাইকে “আশ্চর্য বাংলা” চ্যানেলের মাধ্যমে অনুরোধ করছি, জেলার কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জলের কল ভেঙে নষ্ট হয়ে আছে দেখলেই খবর করুন আমাদের দপ্তরে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে অ্যাকশান নেওয়া হবে, কথা দিলাম।

শেষে ক্যামেরায় চ্যানেলনেত্রীর মুখ। “আপনারা শুনলেন চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য। শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, যে-দেশের মন্ত্রীসভায় কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ পেশ করা হয়, সেখানে দিনের পর দিন গরীব অসুস্থ মানুষের পানের জলটুকু না জুটলেও মন্ত্রী-আমলাদের ঘুম ভাঙে না। আবার সেই দেশেরই একজন সাধারণ মানুষ শুধু পাঁচটা টাকা ফেরত চেয়েই একটা জেলার প্রশাসনে সাড়া ফেলে দিতে পারেন। এ-যেন এক নতুন গান্ধিগিরি। নাকি বলবো, সূর্য বংশের রাজা ভগীরথ শুকনো কলে তেষ্টার জল বইয়ে দিতে আবার ফিরে এলেন আমাদের রাজ্যে। ক্যামেরায় রজতাভের সঙ্গে আমি হৈমন্তী, “আশ্চর্য বাংলা”।

ছয়
অতএব, হইহই করে সবাই উঠে পড়েছে। কাল থেকে দুবার রিপিট টেলিকাস্ট হয়ে গেল প্রোগ্রামটার! “জিও কপালজেঠু, তোমার জন্যে আমাদের পটাশপুর এখন সেলিব্রিটি-পাড়া। এবার চল, সমীর পালকে অ্যাডভান্স না করে রাখলে কাল সকালে দেখবি সবক’টা প্রতিমা বেচে দিয়েছে। কারা কারা ফুলের মার্কেটে যাবে ঠিক করো।”

উঠোনে নামতেই ডানদিকের শিউলিগাছ ঘেঁষে একটা আবছা চেহারা, সড়াৎ করে পিছিয়ে গেল নারকোলগাছের আড়ালে।
— কে ওখানে ভাই? বেরিয়ে এসো। বক্তা সুরথ, বিদ্যার্থী সংঘের সবচেয়ে ঘ্যামা মেম্বার, ক্লাবের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিতও। ক্লাস এইট পাশ করে অল্প কিছুদিন লেদ কারখানায় ঢুকেছে।

দুদ্দাড় করে বারান্দা থেকে নেমে এল কপালজেঠু। আরে, সহদেববাবু না! এদিকে কোথায়?
— বাবু বলে লজ্জা দেবেন না, সার। গতকাল আপনি “আশ্চর্য বাংলা”কে ঘুরিয়ে পিএইচই অফিসে নিয়ে না ফেললে আমরা, হচ্ছে গিয়ে, সুনামি-বৃদ্ধ হয়ে যেতাম। ওদের তো কাল জেলা হাসপাতালই টার্গেট ছিল।

— তা এই সুনামি-বিদ্ধ কথাটা কার মুখ দিয়ে বেরলো?
— কেন সার, সরকার সায়েব — মানে আমাদের সুপার। ওনার গতকাল থেকে খুবই লজ্জা। টেলিফোনে বন্ধুকে বলছিল, বুড়ো বয়েসে লোকটা আমাকে আচ্ছা শিক্ষা দিয়ে গেল।

মাথা নিচু, অ্যাটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সহদেব। উশখুশ-অন্তে সামনে আনলো ডান হাত, তাতে প্রকাণ্ড এক সন্দেশের বাক্স।
— উনি পাঠিয়েছে। যদি অনুগ্রহ ক’রে গ্রহ…।

ফিনিশিং
এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি বর্ধমানের ঘোষ সুইটসের পঞ্চাশ পিস প্রাণহরার প্যাকেট সুরথের হাতে দোল খেতে খেতে পুজোমণ্ডপ অভিমুখে যাত্রা করেছে। তবে মিষ্টিটা ওদের হাতে তুলে দিতে গিয়ে কপালজেঠুও ঠিক পঞ্চাশ বার বলেছিল: এক পয়সাও চাঁদা ঠেকাতাম না। তোদের ভাগ্যি ভালো পাঁচটা টাকা ফেরত এল সরকার থেকে।

ছোটদের গল্প আজকের ভগীরথ

ছোটদের গল্প : আজকের ভগীরথ

“ওরে, আমি হচ্ছি ধূর্জটি সরখেলের ছেলে, সারা জীবন যার পোশাক বলতে ছিল বাইরে পরার জন্যে একখানি ধুতি আর ঘরে একটা গামছা, ব্যাস। সেই আমার কাছে তোরা সরস্বতীপুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিস! তোদের সাহস দেখে দেখে, সত্যি, আর অবাক হতেও উৎসাহ পাই না।”

পাড়ার বিদ্যার্থী সংঘের ছেলেরা এসব জানে, তবু রামায়ণ-মহাভারত কি পুরনো হওয়ার জিনিস?

— আর তোমার ঠাকুরদার গল্পটা যেন কি, কপালজেঠু?
— আদিনাথ সরখেল ভুল করে একবার একটা অমৃতি কিনে ফেলেছিলেন। তারপর টানা দশদিন হররোজ সকালে সেই অমৃতির একটা করে পাপড়ি ভেঙে তাই দিয়ে মুড়ি মেখে খেতেন।
— ঠাকুরদা বোধ হয় মারা গেছিলেন ডায়রিয়ায় ভুগে আর তোমার বাবা নিউমোনিয়ায়, তাই না গো?
— কী করে জানলি? এসব খবর তো কাউকে দিই না আমি!

দুই
তো, কপালজেঠু গতকাল টেলিফোন অফিসে গিয়েছিল বিলের টাকা জমা দিতে। ঠিক পাশেই জেলা হাসপাতাল, আর রাস্তার অন্য ফুটে ওষুধের দোকান, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এইসব। কপালজেঠু ফিরতি অটো ধরবে বলে সেখানে দাঁড়িয়ে, এমন সময় মিনিমাম সত্তর বছর বয়েস হবে এক খুনখুনে বুড়ি এসে — “ও ছেলে, পাঁচটা ট্যাকা দাও না, একটা সন্দেশ কিনি। কিছু না কিনলে দোকানদার এক গেলাস খাবার জল দিতে চাইছে না। এদিকে হাসপাতালের কলগুলো সব শুকনো। সকাল থেকে নাইনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তেষ্টায় আমার জিভ বেঁকে গেছে গো ছেলে!”
অন্যমনস্ক ছিল তাই, নাকি বহু যুগ পরে কারও মুখে “ছেলে” ডাক শুনে গলে গিয়ে থাকবে, পকেট থেকে তুলে ঝপাত করে একটা পাঁচ টাকার কয়েন ফেলে দিল বুড়ির হাতে।

দিয়েই মনে হল, হায় এ কী করলাম আমি! তিল তিল করে এগিয়ে কিপটেমি-সাধনার যে উচ্চমার্গে নিজেকে স্থাপন করেছিলাম সারা জীবনের চেষ্টায়, সেই আসন মুহূর্তের ভুলে ধুলোয় টেনে নামালাম! এতবড় বংশমর্যাদার কথাও একবার মনে পড়ল না? ধিক্কার!

তারপর দ্বিতীয় চিন্তায় মনে হল, টাকাটা আজ বেমক্কা খসেছে বুড়ি মানুষটা সকাতরে চাইল বলেই না? না-চেয়ে তার উপায়ই বা কী ছিল? গোটা হাসপাতালে অঘোষিত খরা চলছে যেকালে। কাজেই এই ক্ষতির দায় সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবাকেই নিতে হবে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।

হনহন করে গেট দিয়ে ঢুকে একটু এগোতেই কপালজেঠুর সামনে এক নার্স, ঘাসের উঠোন পেরিয়ে এ-ওয়ার্ড থেকে সে-ওয়ার্ডে যাচ্ছে।
— এই যে দিদি, আপনাদের হাসপাতালে একফোঁটা খাবার জল পাওয়া যায় না কেন?
নার্স খুব বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকাল।
— নাম কী আপনার? কোত্থেকে আসছেন?
— ইয়ে, কপাল…
— না না, কপালের চিকিৎসা এখানে হবে না, এটা হার্ট। আপনি ওই ছাতিমগাছের পাশ দিয়ে ডানহাতে…।
— কী মুশকিল, আমার নামই তো কপাল, মানে কপালেশ্বর সরখেল।

“পোড়া কপাল আমার”, নার্স ফিক করে হেসে ফেলে আবার গম্ভীর:
— ওদিকে অফিসে গিয়ে জিগ্যেস করুন। আমি এখানে জলসত্র খুলে বসিনি আপনার জন্যে।

তিন
লম্বা, ইঁটপাতা রাস্তার শেষ মাথায় পুরনো বিল্ডিংয়ে বসেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট। ছোট্টখাট্টো চেহারার পিওন হাত নেড়ে ভীষণ বারণ করল: এখন ঢুকবেন না, স্যার টিফিন করছেন।

অগত্যা সরু বেঞ্চিটায় বসে থাকল কপালজেঠু। পাঁচ টাকা মানে যে পুরো পাঁচশো পয়সা, ক’জন ভেবে দেখেছে, বলো? পাঁচ টাকার অর্থ আড়াইখানা গরম ফুল সাইজের বেগুনি বা ভ্যান রিকশায় বালিশা মোড় থেকে বিড়া স্টেশান অথবা সাইকেল টিউবের লিকে তাপ্পি লাগানো। এমনকি বিদ্যার্থী সংঘের লটারি প্রতিযোগিতায় একখানা টিকিটের বিনিময়ে প্রথম পুরস্কার একুশ ইঞ্চি কালার টিভি পর্যন্ত…“ও দাদা, ভেতরে যান। একদম টাইম লাগাবেন না, স্যার বিজি।”

সুপারের চোখদুটো ফোলাফোলা। ছোট্ট হাই তুলে সেই চোখেই মেপে নিলেন ভিজিটারকে।
— কী চাই?
— এটা আপনার জেলা হাসপাতাল না নির্জলা হাসপাতাল, বলতে পারেন? টাকা জলে না দিলে জল খাওয়া যায় না যেখানে!

প্রথম ডেলিভারিটাই বাউন্সার। দুতিন বছর আগে পেলেও নিখুঁত রিফ্লেক্সে কোমর হালকা বাঁয়ে ঘুরিয়ে বলটাকে মিড উইকেট বাউন্ডারির বাইরে ফেলে দিতেন। কিন্তু রিটায়ার করতে বাকি মাত্র সোয়া তিনমাস। এখন পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনও শট খেলা উচিত হবে না। টেস্ট ম্যাচে দিনশেষের আধ ঘন্টায় শচীনও এম এল জয়সীমা হয়ে যেত, তাই না? আর এখুনি যেন কী বলল লোকটা? বাইরে টিউবয়েলের জলও বিক্রি হচ্ছে? সর্বনাশ! চোখমুখ দেখে আদৌ গরীবগুর্বো মনে হয় না, গ্রেটা গার্বোর ভাইপো হলেও হতে পারে। তাহলে পাঁচ টাকার জন্যে অদ্ভুতপূর্ব শোকের উৎস কী?

লোকটার হাফ-পাঞ্জাবির বুকপকেটও ভারিভারি ঠেকছে। গোপন ক্যামেরা না হোক, পুঁচকে টেপ রেকর্ডার বাসা বাঁধতেই পারে। সুপার মাথা নামিয়ে যেতে দিলেন বাউন্সারটাকে।

— না না, আপনি একেবারেই ঠিক বলেছেন। আরে, দাঁড়িয়ে কেন, বসুন না! আসলে কি জানেন, হাসপাতাল আমরা মানে স্বাস্থ্য দপ্তর চালাই বটে, জলের ব্যবস্থা কিন্তু করে পিএইচই মানে পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং। এটা সবার জানার কথা নয়, বিশেষ করে তারা তো খোঁজই রাখে না যারা পরের ইয়েতে নজরদারি…।
সুপার নিজের নিরীহ ডেলিভারিটায় গুগলির উলটো মোচড় আনতে চাইলেন ঠিকই, কিন্তু কপালেশ্বর তাতে কপাল, সরি কান করল বলে মনে হয় না।
— এটা একটা জবাব হল? বাসস্টপে দাঁড়িয়ে শুনলাম ছ’মাস এখানকার কলগুলো খারাপ, আপনারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন নাকি?

আর সন্দেহ থাকে না সুপারমশাইয়ের, এ-লোককে লাগিয়েছে তার কোলিগ বীজেশ চক্রবর্তীই। ওপর মহলে অনেক ধরে-করে একই গ্রামের বাসিন্দা বিজুকে ডিঙিয়ে বাড়ির কাছাকাছি পোস্টিংয়ে এসেছিলেন। সে-বুড়োর রিটায়ার করতে বাকি বোধ হয় আর দিন দশ-পনেরো। যাওয়ার আগে একটা বিষ-কামড়ের ছক সাজাবে না? কে জানে, আরও কি কি দুসরা বেরোবে হাতের কপাল, ধুস, কপালের হাত থেকে। কাজেই ভাই, বলের লাইনে গিয়ে মাথা নিচু করে পরিষ্কার ডেড-ব্যাট পাতা আছে।

— ছি ছি, আমরা ঘুমিয়ে পড়ব, এটা কল্পনায়ও আনবেন না। যেদিন থেকে চাকরিতে এলাম, ঘুমটুম সব হোল্ড-অলে বেঁধে বাড়ির বড় আলমারিতে তুলে রেখেছি। রিটায়ার করে ফিরে আবার তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে নামাতে হবে — ব’লে সুপারিন্টেন্ডেন্ট টেবিলের ওপর রাখা ফিনফিনে নীল ফাইলের বুকে টোকা দেন। এই দেখুন, কত কত চিঠি দিলাম পিএইচই-কে, অন্তত পনেরোটা, কিন্তু ওরা শুনলে তো!

— কোথায়, ফাইলে তো অত কাগজই নেই!
— ও, নেই? আসলে নানা রকম ফাইল থেকে চিঠি ছাড়া হয় তো। দাঁড়ান। সহদেব?

শিশুসুলভ শরীরের সেই পিওন দরজা খুলে ঠিক মুখটুকু ভেতরে আনল।
— পি এইচ ই-এ ফাইলগুলো নিয়ে এসো দেখি।
— সে তো আন্নার টেবিলের ওপরেই।
— আহা না। ওদের চিঠি পাঠিয়েছি খাবার জলের কল সারিয়ে দিতে। সেই সব ফাইল চাই। বুঝতে পারলে?
— খুব বুজিচি স্যার।

সহদেব দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর সোজা হাসপাতালের কম্পাউন্ড পার হয়ে রাস্তার উল্টোদিকের চায়ের দোকানে ঢুকে বসে পড়ল ঠ্যাং ছড়িয়ে।

( গড়িয়ে চলবে… )

কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক … দুই

কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক

দুই

আপনার হার্ট আপনাকে অ্যাটাক করার আগে যেমন একদুবার শাসিয়ে দিয়েছে বুকের মাঝখানে ব্যথার চিউয়িংগাম লাগিয়ে, তেমনি নিজেই নিজের সেকেন্ড-হ্যান্ড হয়ে ওঠা কবিকুল প্রচুর গদ্য লিখতে শুরু করে, ছোটদের জন্যে গল্পছড়া, আর স্বপ্ন দ্যাখে উপন্যাস ছাড়ব বাজারে। ভাবে কিন্তু লেখার সাহস পায় না; ভালোরকম জানা আছে, কবিতা কাঁচি মেরে দেবে বাকি লাইফের মতো। আর লিখেই ফেললে উপন্যাস?
“আমার বিচার তুমি করো”।
[অ্যানেক্সচার টু-এ: আলোচনা থেকে বাদ যাচ্ছে সেই সেই কবি যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা মাল্টিপারপাস প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।

মুশকিল হল, পৃথিবীতে কাউকে এক্স-পোয়েট বলার চল নেই। একবার কেউ কবি, তো চিরকাল এক্সপ্লয়েট করবে তোমাকে।

কবি মরে যাওয়ার দ্বিতীয় লক্ষণ, সে পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকবে, নিজের প্রকাশনীও খুলে ফেলতে পারে। [অ্যানেক্সচার টু-বি: বাদ যাবে ওই ওই কবির নাম যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা সাংগঠনিক প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।

কবিদের তিনটে দশা আছে ব’লে আমার ধারণা। এক: শুধু কবিতা লেখা (সৃষ্টি)। দুই: কবিতা লেখা আর ছাপানো (স্থিতি)। তিন: শুধু ছাপানো (প্রলয়)।
এই প্রলয়কালের আগেই কবিকে রুখে দিতে হবে। সে তো মরা নক্ষত্র। আলো ছড়াচ্ছে মানে বেঁচে আছে ভাবলে এত চরম ভুল হবে, আপনি সর্বোচ্চ পরিমাণ জিভ কেটে গোটা বাংলাদেশ খেপিয়ে দেবেন। ধরুন, কবি তিনটে কবিতার বই লিখে ফতুর হয়ে গেছে। কিন্তু সুবুদ্ধি করে থামে আর কে? ফুরিয়ে যাওয়ার সিকি শতাব্দী পরে তার প্রথম কবিতার বই নিয়ে নাড়াচাড়া। ওই মরা তারার আলো আসা শুরু হল। কবি উৎসাহিত হয়ে বাইশ নম্বর কাব্য প্রকাশ করে দিলেন, তাতে সবক’টা অপদার্থ কবিতা। জনমনস্তত্বের নিয়মে সেই কিতাব নিয়েও হইচই পড়ে যাবে। ইতিমধ্যে এতদিনে তার দু’নম্বর কবিতার বইও পাঠকদের মনে ধরতে লেগেছে। ব্যস, মরা তারার তেইশতম কাব্যগ্রন্থ পেয়ে গেল অ্যাকাডেমি/জ্ঞানপীঠ/নোবেল, যেকালে একটা পদের পদ্য লেখার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে বসে আছেন।

সার্ত বেনি লেভিকে বলেছিলেন, পুরস্কার কমিটি লেখকের সেই বইটা বেছে নেয় যেখানে লেখকের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তারপর সেটাকে পুরস্কার দিয়ে লেখকের কফিনে পুঁতে দেয় শেষ পেরেক।

একশো বছর হয়ে গেল, সাহিত্য সমাজকে আর প্রভাবিত করতে পারে না। সফটঅয়্যার-বিনোদনের যুগে তার অবস্থা সুকিয়া স্ট্রিটের দোতলার লেটারপ্রেস। সাহিত্য-পুরস্কার কথাটারও তাই মানে হয় না কোনও। তবু আমি যদি “বউ নেই শ্বশুরবাড়ি যাই পূর্বের সম্বন্ধে”, তবে ওই বাচ্চা ছেলেটা-মেয়েটাকে তাদের প্রথম বা দ্বিতীয় বইয়ের জন্যে পুরস্কার দিই না কেন? দিয়ে দেখি গলার মালা নিয়ে আর কী গুলদস্তা সে তৈরি করতে পারে, নাকি মালাটি হয়ে ওঠে মালা-ডি? আর তা-নয়তো মরা বডিতে কোরামিন মারো, সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড-এর নাম পালটে সাহিত্যগ্র‍্যাচুইটি রেখে দাও…
যত্তো ঝামেলি!

( চলতিছে… )

কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক … এক

কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক

এক

হোয়্যারঅ্যাজ ইট অ্যাপিয়ারস যে কবিকে পঞ্চাশ বছর বয়েস হলেই মরে যেতে হবে। না মরুক, থেমে যাবে — তার মানেই তাই। সোজা কথা — কবিজনের মধ্যেকার কবি খতম হোক। এবং হোয়্যারঅ্যাজ ইট আবার অ্যাপিয়ারস: কবি যেন তিরিশ বছরের বেশি কাব্যচর্চা না করে (যে সময়সীমা আগে পার হচ্ছে, সেটাই বলবৎ)। নাহলে আনফিট কবি প্রচুর পাতলা লেখে আর রফা করে আর ভাটবাক্য বকে যায়।

লিখতে না পারার কারণ অসংখ্যবিধ। দৃষ্টি মোছে চোখ থেকে, মন নতুন দ্যাখে না, সবচেয়ে বেশি সরু হবে মন:সংযোগ। পুরনো প্যান্টের বোতামের মতো বিস্ময়বাটন খুলে পড়ে গেছে চেতনা থেকে — কাজেই উল্টে কবির সর্বস্ব দ্যাখা যায় ফাঁক দিয়ে, কবিতা ছাড়া। ঘটনার পলেস্তারা খসিয়ে আইডিয়ার গাঁথুনিতে ব্রাশ ছোঁয়াতে পারবে না, শুধু ত্বক থেকে কথা বলা। নিজের পুরনো লেখা পড়ে আর ভাবে, শালা ফাটিয়ে দিয়েছিলুম।
[অ্যানেক্সচার ওয়ান: বাদ যাবে সেই সেই কবি যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।

কবিতার একটা মাথা-ঠেকে-যাওয়া, শ্যাওলাধরা চোরাদরজা আছে — পদ্য। পদ্যকে সিলেবল-এ ভেঙে দেখুন, পায়ুর সঙ্গে মিল পাবেন কোথায় একটা। কিন্তু পদ্যের পাছদরোজা গিয়ে থেমেছে কবিতার জাঙ্করুমে। ছানা নয়, গাদ থেকে তৈরি হল পদ্য এবং কোনও ট্যারিফ সিস্টেমেই চমচমকে আপনি রসগোল্লা বানাতে পারেন না! তবে এই টি-টোয়েন্টি সমাজব্যবস্থায় পদ্যের একটা ইয়াব্বড়ো ভূমিকা আছে, প্যারাসিটামলের মতো। যারা পদ্য লেখে তারা দীর্ঘজীবী হোক।
কবি মরে যাক।

( চলতিছে… )

ক্লাস সেভেনিয়

ক্লাস সেভেনিয়

তোমার সদ্যোজাত ছিল তোমারই স্কুলব্যাগে…
কী ক’রে? ওর ঘাড়ে তো মাথাই বসেনি!

সব বাস্তব আমরা স্বীকার করি না
খরজ থেকে ঊর্ধ সা —একটা লম্বা মিড়ের একদিকে
দেহরতি তো আরেক চুড়োয় কী, তুমি জানো।
কিন্তু মাঝখানে প্রেমিকের উধাও হয়ে যাওয়া,
পুলিশের ভয়, সৎ-মায়ের এই মাইনাস তেত্রিশে
বে-ঘর ক’রে দেওয়ার হুমকি —
সব কল্পনা আমরা অস্বীকারেও গুমসুম।
তার চেয়ে বলো, হিসি-করা পুতুল সামলাতে জেনেছ তো?
আমি হয়তো আমার নাতনির নাতনিরও মুখ দেখে যাবো
প্রত্যেকে তোমার মতো উলটো ঢেউ লাগানো নাক, দুভাঁজ থুতনি…
এখন স্কুলব্যাগ থেকে বের করো ওটাকে
ইস, জ্যামিতিবাক্স রক্তে ভিজে চাপুড়-চুপুড়!

ও খুব শক্ত ক’রে বেঁচে থাকবে, দেখো
ইদি আমিন বা রাশিচক্র ওকে থামাতে পারবে না
শুধু প্রথম ক’মাস ঘাড়ের নিচে হাত দিয়ে ধরতে হয়
যেটুকু জানি বলছি
প্রথম পাঁচ মাস নাম রাখতে পারো ঢকঢকি
পরের ছ’মাস খলবলাই
(কলেজে দ্বিতীয় বছরে পড়া আমার ছেলেকে ঘটনাটা জানিয়েছিলাম। ওরা মোস্টলি মন্তব্য করে না।)

আমরা সারা জীবনে সত্যের একটামাত্র তলই ছুঁতে পারব
তাই নিশ্চিন্তে দেখি, তুমি কুয়াশাঘেরা সকালে বাঁধানো সড়ক দিয়ে হাঁটছ
ধূষর লংকোট, হাঁটু পর্যন্ত সাদা মোজা
পিঠের স্কুলব্যাগে তোমার নগ্ন নবজাতক
দিব্যি পৃথিবীর বরফ দেখতে দেখতে যাচ্ছে সবুজ মার্তণ্ড!
আর একুশ শতকের হেলিকপ্টার আকাশ থেকে জুম করল
ধ’রে পৌঁছে দেবে হাসপাতালে
সেখানে ক্লাস সেভেনিয় তোমার পাশে ব’সে আমি কপালে হাত রাখি
এখন ভালো লাগছে, মা?

অন্ধকারের চিপস

অন্ধকারের চিপস

সকাল উবু হয়ে, ঘামালো-পিঠ, অন্ধকারের চিপস কুড়োচ্ছে মাটি থেকে
সকাল বাঁ-পা ন্যালব্যাল ক’রে রাস্তার আলোর নিচে এসে বলছে টাকা দাও, ডাক্তার দেখাবো
পাতিকাক সাইকেলে হাফপ্যাডেল মেরে পাতিপুকুরে চলে গেল

মাটিতে উপুড় হওয়া প্লাস্টিকের প্যাকেট হালকা মাথা তুলে বুঝে নিচ্ছে,
গুলি বন্ধ হয়েছে তো! চলে গেছে সন্ত্রাসবাদীরা?
অন্যায়ের উল্টোদিকে উড়ে আছে গঙ্গাফড়িং
কথা দেওয়ার বিপরীতে অপরিসীম ট্রেন লেট করছে
তাছাড়া, বাবা-মার গান বাজছিল, ও প্রজাপতি প্রজাপতি পড়তে ব’সো

কাল সকালে আবার আসবো বঙ্গলক্ষ্মী লটারি নিয়ে কথা বলতে
ততক্ষণ বেড়ালের দুধ খাওয়ার ভিডিও তুলছে একটা সকাল
ছাগলবাচ্চাও তার কচি-কলাপাতা রঙের গলা থেকে কাতর বের করে শোনাচ্ছে
আসলে রুদ্রপলাশ বলো, অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ বলো, আর হাতফেরতা মোটর বাইক,
ব্যথায় পড়লে সব্বাই মা ডাকে

কালবর্ষা

কালবর্ষা

ভোর, ঊষাগেট, একটা অটোতে যাওয়া যায়
ঘুমের চৌরাহা থেকে আকাশি বর্ষায়
সেখানে গুচ্ছের মেঘ, সুরজ ট্রেডিং ঝাঁপ বন্ধ রেখেছেন
তবু টুকটাক আসল চন্দন বলবেন

কাজের বিকল্প কাজ কী বা আছে বিড়িটানা ছাড়া
মন্ত্রীর পুলিশ, বেশ্যার মুখখিস্তি পাহারা
মাঝখানে হড়কে যাচ্ছে গঙ্গাসাগরের দিকে সব ড্রেন
ভাই, প্রতিদিন প্রচুর চন্দন বলবেন

শোণিত-কম্বলে শীত ঢেকেঢুকে শুয়েছে জনতা
শিল্প পাতে মারো আর লিফলেট ছড়িয়ে — একই কথা

শোক থেকে শ্লোক হবো, ফুটো হাড়ে ঠোঁট রাখলে বাঁশি
অগুরু আমার গুরুদেব, মম আকাশ কাটা খাসির
মতো ছটফটাচ্ছে…থেমে যাবে এক্ষুণি…আমেন!
পোড়া ডাকলো, অর্জিনাল চন্দন বলবেন

(তাহলে গত বছর এইদিনে জন্মের শোধ বৃষ্টি হয়েছিল!)

আলোকন ক্লিনিক

রিসেপশানের মাথায় আমরা ছবিটা ঝুলিয়ে রেখেছি
ছবিতে যে মুখ, তার চোখের নিচে ফ্লুইড জমে বড় বড় পাফ
কপাল থেকে জুলপি পর্যন্ত শালিখের পা ছড়ানো
মাথার মাঝখানটায় চমৎকার এইট বল পুল খেলা যাবে
আর এসবের প্রতিক্রিয়ায় ভদ্রলোকের মুখে একটা ঘেঁটে যাওয়া
ডিপ্রেসড লুক

আপনি বড্ড দেরি করে ফেলেছেন স্যার

মিনোডিক্সিল আর অ্যামিনেক্সিল সলিউশান (টেন পার্সেন্ট)
মাথায় দিনে দুবার করে। খেয়াল রাখবেন, ওষুধটা শুরুতে ডেসিড্যুয়াস
কাজেই ব্যবহারের আগে আপনার অভ্যেসমতো কিছুটা
ঈশ্বরকে নিবেদন করতে যাবেন না, কেলেংকারি হবে!

রোমশ হয়ে ওঠা আমাদের কাছে তত মূল্যবান হতে পারে না
যতটা সার্থকভাবে রোমশ হয়ে ওঠা। তাই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে
পাতার পর পাতা পথিক-থামানো বিতর্কের পর আমরা রোগটির নাম রেখেছি
অ্যা্লোপেসিয়া, যেভাবে একদিন নৈতিকতার সংজ্ঞা খুঁজে পেয়েছিলাম

এছাড়াও ছবিতে আপনার হাতে রয়েছে একটা স্ফটিকের পানপাত্র
কিন্তু যেটা জানা যাচ্ছে না — পানপাত্রের তরল এখন কোথায়?
অনুমান সত্যি হলে আমরা একই সঙ্গে আপনাকে রেফার করবো
সাইকো-থেরাপির জন্যে যেখানে বোঝানো হয়, সমস্ত দার্শনিক মুক্তির
পেছনে রয়েছে মানুষের শরীর। জানানো হয়, এ-পর্যন্ত সভ্যতা
আমাদের দিয়েছে ৪-৫টা জিনিস — ঢাকাই মসলিন, ইস্তাম্বুলের মিনিয়েচার ছবি,
হ্যামবার্গার, আফগান মহিলা ক্রিকেট টিম…আর এ-সবই একজোট
হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একক পৃথিবীর দিকে যার একমাত্র সমস্যা
কালো হয়ে যাওয়া

যদিও অলরেডি অনেকটা দেরি হয়ে গেল, পিগমেন্টেশনের বিরুদ্ধে
আমরা আপনাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছি গ্লাইকোলিক অ্যাসিড ক্রিম
রাতে শোয়ার আগে। এবং সকালে যদি অন্যান্য নানা কারণে
আর জেগে উঠতে না পারেন তো স্যার মনে রাখবেন এই বিউটিশিয়ানের
কথাটা —
ইতিহাস আর নিয়তি একই কলমে লেখা হয়