চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

হরণপর্ব

হরণপর্ব

আমেজামে শঙ্খ লেগে আছে
মেঘেজলে তরুণ বিচ্ছেদ
নিশুত রাস্তায় হাত পাতো —
চাঁদভিক্ষে আলো, তার গায়ে নুন, স্বেদ

কেননা, রাত্তির জেগে পড়া
বোনকে গিলিয়ে দিই দুধ
ভাতরান্না — সেও অধ্যয়ন
পাটকাঠি সহস্র, অর্বুদ
চুড়ো করে রেখে আসি ছাদে
সে ইশারা গুপ্ত সংবাদের

তাই বুঝি ভোরের বাইক এসে থামে
আজ গ্রাম্য মেঘের রাস্তায়
ঘুমঘোরে উঠেছে মেয়েটি
চাঁদের মর্মর শোনা যায়

শ্মশান কমিটি

শ্মশান কমিটি

জলের ট্যাঙ্কের নিচে এ-পাড়ার সমস্ত খুন হয়
তার পাশে মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পাড়ার সব বিয়ের মিঠাই
এই দোকান থেকে
তার গায়ে পার্টি অফিস, তরকারি-হাটের তোলা
এখানে ব’সে ভাগ-বাঁটোয়ারা
তার পেছনে ওষুধ-দোকান, ছোট ও বাঁকা ডাক্তার বলছে
নতুন বৌমার চরিত্রে দোষ আছে
তার ওপরে তিনতলা বাড়ি, সে-বাড়ির ছেলে
বৌকে নাইট শো সিনেমা দেখাবে বলে
তুলে আনছে জলের ট্যাঙ্কের ঠিক নিচে।

দুজন ধার্মিক

দুজন ধার্মিক

প্রজাপতির পেছনে ঠিক একটা বাচ্চা থেকে যায়

অনেক শৈশব ভেঙে পায়ে জল, কাদা;
অনেক তারা-দূরত্ব থেকে পেটে কিছু পড়েনি বাচ্চার।
এদিকে প্রজাপতি ছুটতে ছুটতে বোনের বাড়ি কিছুটা বসে গেল
দুটো প্রজাপতির গলাও শোনা যাচ্ছে — বাচ্চা এত চুপ!
একবার এমনও হয়েছে, বিছানায় অসুস্থ প্রজাপতি
আর বাচ্চাটা উড়ছে, উড়ে উড়ে দরকারি কাজ
সেরে দিচ্ছে তার
নিজেকে কী ভাবছে সে? সেই হাসি চেপে রাখা কিন্নর?
তার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে হালকা উদাস রামধনু-রেখা চলে গেছে

এখন ঘুরে ঘুরে বাতাসে পাহাড় আঁকে আর্টিস্ট প্রজাপতি, বাচ্চা-পা
পা টিপে উঠতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে
সত্যি দুটো সেলাই পড়েছে মাথায়, এত জ্বালাস তুই — ব’লে
একটা ঠাস পড়েছে গালে
তারপর তো তুমি খুঁজেই পাবে না সামনের ছুট আর পেছনের
মিসিং ডায়েরি নম্বর তিনশো বাইশ
হয়তো লম্বা পৃথিবী থেকে পা পিছলে গেছে
মুছে গেছে দুজন ধার্মিক
তবু প্রজাপতির পেছনে শেষ পর্যন্ত আর তার পরেও
ঠিক সেই সেই বাচ্চা থেকে গেছে…

জোগাড়ে মিস্ত্রির আগে আসে

জোগাড়ে মিস্ত্রির আগে আসে

ঘরের পাঁচিলে সাইকেল শ্রীকৃষ্ণ ক’রে রাখা
পাথরকুচির সাঁচিস্তূপ পার হলে ফারাওয়ের দেশ
উঠোনের গন্ধরাজটা ঠিক এবার মরে যাবে!
কিচ্ছু করার নেই, সিমেন্টের ধক টেনে
আমরা যদি বাঁচতে পারি, দিনমানে ষোলটা বিড়ি টেনে
ব্যাগ থেকে লুঙি আর ফুটো গেঞ্জি পরে নিই জোগাড়ের ড্রেস

জোগাড়ে মিস্ত্রির আগে আসে

দেয়ালগাঁথনি চলে গেছে পৃথিবীর ছ’ইঞ্চি জায়গা হাতে নিয়ে
দুপাশে বাড়ির চারা জল পায় হালকামতো,
সালোকসংশ্লেষ? দেরি হবে
ছক ছক মশলা পড়ছে ইঁটের গলিতে
ওগো খাটিয়ে হাত ধোও, বাবুর গিন্নির করা চা আসে চা আসে

এই বাড়ি শেষ হলে চিনতে পারব না
ঘরে ঢুকব কলিংবেলে চেপে —
জোগাড়ের কথা ধরতে নেই
ঘরের বিধ্বস্ত উড়ছে তাকে ধরো, ঘরের উত্থান উড়ে যায়…
আকাশঅফিসে তালা দিয়ে কানাকুয়ো ছাদে একটু
বসতে যাবে কি, জোগাড়ের মিথ্যে ঢিল খেয়ে ফের পাখি
পিঁপড়ের সারি কাঁচা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে বদর বদর
আর মুখ তুললেই বহুতল চাঁদ, চাঁদের কার্নিশে
দুটিখানা চাপান গাঁথনি হয়ে আমাদের জোগাড়ে শুয়েছে

চুনহলুদ

চুনহলুদ

রাস্তায় আসতে-বাঁদিক দিয়ে
ছমছম করে নদী গেছে
আড়খ্যাপা ভ্যানরিকশাওলা ঠিক
মোড় ঘোরাতে উল্টে ফেলে দেবে
রাস্তায় আসতে-ডানদিক দিয়ে
নাচনেউলি ধান আর ভ্যারাইটিজ হাওয়া

ছোটমাসি, তোমাকে বলছি…
ঘরের বারান্দাখানা কমপক্ষে দু’মানুষ উঁচু
ঘরের বাসিন্দাখানা ছায়া-টেনে সারাটা পাড়া ঘোরে
“এই জায়গায় দুটো খরিশ বসতি করতো
এখানে তুই গতবার লক্ষ্মীপেঁচা দেখেছিলিস”
ছিলিস কী বস্তু বলে হাসো যদি:
“হুঁ হুঁ বাবু, ঠোঁটের ওপরে তিল
তুমি খুব ডেঞ্জারাস ছেলে!”

বিপদজননী মেয়ে তুমিও তো।
বিকেলবেলা ঘুম ভাঙিয়ে সেতুর ওপরে নিয়ে গেছ
“নদীর দুপারও মেলে, দেখেছিস!
মানুষ মেলাতে পারে সাহস করলেই” — ব’লে
ভেসে বেড়াচ্ছে…অন্ধকার…তোমার না কোন পায়ে
মচকা লেগেছিল!

“পায়ে চুনহলুদ লাগালেই ভালো খবর পাই
গায়ে হলুদ হয় তাপসীদির, দাদার ফোন
সিওল থেকে আসে…তুই আসিস…”

ছোটমাসি, তোমাকে আর কিচ্ছু বলি না

সব অন্তর্গত

সব অন্তর্গত

আমি যখন ফিরে এসেছি
ফিরে এসো আকাশের সব অন্তর্গত
“অপদার্থ” খেতাব পাওয়া শৈশব ঘুরে এসো
আর তুমি রোদ — থেকে যাও, সূর্য যদি বা বাড়ি ফেরে
একটা রাত ঘুমোও, দোস্ত, যে প্রিয় সুপুরিগাছে
তোমার বউনি হয় রোজ

তোমাকেও বলিহারি, এই সেদিন ভূমিষ্ঠ হয়ে
ওই অতটা উত্‌রে যাওয়া ছায়াগাছ!
নেমে এসো সমান-সমান
হুড়োনাড়া চুল ধরে তোমাকে জোর কা
ঝটকা দিয়ে দিই

আমার তো আশাই ছিল না
তবু যখন চালু হল শরীরের সমস্ত নর্দমা
তার ভেতরে আবার কায়দা করে এগিয়ে চলল
ময়লা জল
তখন পাকানো রুটির মধ্যে চিনি এসে থামো
ভাতের থালায় লাফ দিয়ে উঠে এসো
ও মেয়ে-বেড়াল

জাতকের কবিতা

জাতকের কবিতা
এক

ওই যে ছায়া তৈরির কারখানা
গতজন্মে আমি তার শিশুশ্রমিক হই
একটু করে হাত ঢোকাই রোদের মেশিনে
আর ছিটকে ছিটকে গিয়ে পড়ে রক্ত, গাছ পড়ে
রুমালের মতো ছায়াগুলো

ওই যে ঐরাবত গাছ
আমি সম্পর্কে তার হই পুষ্পমুকুল
বয়স্ক পাতা পাতকুয়োয় ঝরে ঝরে যে অখাদ্য জল
যাকে ক্রমাগত বিয়ে করবে ব’লে
বেড় দিয়ে চলেছে হরিণ
আমি গতজন্মে ওই হরিণাস্থি হই

দুই
আগামি জন্মে আমি হয়েছি ভোঁকাটা বাতাস
তিন দিন অনশনের মধ্যে, এমনকি অবস্থান ধর্মঘটের পেটেও
দল বেঁধে অবস্থান করেছি
কিন্তু ওপরে উঠতে খুব ভয় আমার, তার মানে
নিচে পড়ে যাওয়ার ভয়
কেউ যদি ফুঁ দিয়ে ওপরে পাঠায় সেই জন্যে
মোটমাট এক টা ফুঁ-ই হয়ে গেছি আমি
তোমার চোখে কিছু পড়লে পাতা টেনে
খুব জোরে ফু: —
আবার অপ্রস্তুত শঙ্খের ভেতরেও নিজেকে চালিয়ে দিয়েছি

কই, কিছু শুনতে পাচ্ছ না?

নিসর্গ

নিসর্গ

রোদের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছি এত অবুঝ রোদ
আর যে ভোরের আমি সাধারণ সম্পাদক
সেই ভোর — যে কোনও ডাককে যে পাখি ব’লে বিশ্বাস করায়
সবে নির্মেঘ থেকে নেমে এসেছে সেলোফেন কাগজে মোড়া
আর মহল্লায় মহল্লায় বেঁটে দেওয়া হচ্ছে তাকে — জাগো জারুলফুল, জাগো রে ছোট বেড়াল

গাঢ় লিকারের আকাশ আজ
উদার, বড়ভাবে শরতের পৃষ্ঠা ওল্টানো…

আশা-সঞ্জীব

আশা-সঞ্জীব

চাপা সূর্য খাদটাকে বেড় দিয়ে আছে
মার্জিত খাদের গায়ে ফুটে উঠেছে চাপা সম্মান
যতই সম্মান দেখাক আশা পারেখকে আমাদের
সঞ্জীবকুমার, রসকষসিঙাড়ার সেই চাপা খেলাটা
শুরু হচ্ছে। রামধনুর ছোট ছোট পা, পাগুলো
হাত রেখেছে খাদের কোমরে, আর ওমনি, চাপা খিদের
দুদিকেই একসঙ্গে কামড় পড়েছে…

আনন্দশিমূল

আনন্দশিমূল

তোমার জন্যেই…
শুধু তোর জন্যে আমি মৃত্যু পিছিয়েছি

আজানুলম্বিত রাত
ভালোবাসা নামের এই জীবহত্যা
চারিদিকে ভারি শিল্প হয়ে বিকশিত

তবু যে-কোনও চিৎকারের কেন্দ্রে আশা থাকে

চোখকে বলা হোক আঁখি সেই জায়গাগুলোতে
যেখানে মাঠ, এক-ফর্মার চটি বৃষ্টিতে ভরে উঠছে
একশো কপি আনন্দশিমূল

অসম্ভবকে আমি তো বলেইছি অপেক্ষমান

চাতকী

চাতকী

না গো বউমনি, চিঠি পড়লে তোমার শোকদুঃখ পাবে
জানলা দিয়ে পুরনো বাড়ি দেখলেই
“এটা বুঝি বিদ্যাসাগরের?” যে জিগেস করতো
সেই গবেষণাসাগর হঠাৎ হঠাৎ লিখে
দশপাতা অ্যারোডাইনামিক্স আমাকে বোঝায়!

বাথরুম ইউজ করতে জানতো না, মনে আছে?
ন’দিনের ছোট বলে কান ধরতে আমার অধিকার
কিন্তু রোজ সকালে সেই বোকা পণ্ডিতের কাছেই
অংক জল, রসায়ন জল
জলের সাগর বলে এ-বাড়ির স্লুইস গেট খুলতে পেরেছিল

এখন ভাবি, ও-দেশেও পুরনো কোঠা দেখলেই
ধরো, মার্ক টোয়েনের বাড়ি কিনা সন্দেহ করে?
তা করুক, তৎক্ষণাত গাঁট্টা এসে মাথা ছোঁয় না তো!
না বউমনি, সব অভ্যেস পালটায়নি গো
চা দিলে সেই একঘন্টা থামিয়ে তবে খাবে
ওকে বরং একটা কথা জানিয়ে দাও তুমি
জানাও যে, চায়ে চুমুক দেওয়াই তাকে জুড়ানোর শ্রেষ্ঠ উপায়।

বারো ঘন্টা প্লাস (পঞ্চম পর্ব) সমাপ্ত

বারো ঘন্টা প্লাস
(পঞ্চম পর্ব)

রাত দশটা ষোলো

প্ল্যাটফর্মের এইখানে বউটা বসে থাকত প্রতিদিন। ঠিক সেই দাগ-ধরা জায়গায় নিশ্চল হয়ে থাকে মীনকেতন। যেন স্কুলে তাদের নাটকের রিহার্সাল, নির্দেশক মেঝেয় চকখড়ির গোল এঁকে তার মধ্যে দাঁড়াতে বলে গেছেন। আশপাশের দোকানের ঝাঁপ ফেলা, শনিমন্দিরের বাক্স যদিও প’ড়ে, তার পেটটি শুনশান। শুধু শূন্য রাস্তায় শালিখ যেমন খাবার খোঁজে, প্ল্যাটফর্মের দূরে দূরে দু’একটা লোক কী যেন টুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

মোবাইল বের ক’রে সে সময় দ্যাখে এবং সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায়। আবার জ্বালায় ফোনটা। এবার ভুল হাত লেগে মেসেজ-বক্স খুলে গিয়ে আঁখির পাঠানো তিনটে এস এম এস (সে মোটেই দেখতে চায়নি) — নিজে সুইসাইড করবে এই ধমকি দিয়ে শুরু করে ‘তুমি কিছু করে ব’সো না’ এমন অনুরোধে অন্তিম। মেয়েটা ভয় পেয়েছে। খ্যাপাকে তো ভরসা নেই, মরেটরে গেলে সে নির্ঘাত ফাঁসবে। অফ কোর্স, আঁখি তাকে ভালোই বাসে। ‘কেন ভালোবাসো, সোনা’ এই প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছিল, যেহেতু ভালো থাকতে চাই। আর স্বার্থপরতার উদাহরণ তুললে স্লোগানকারীর গলায় বলত, সবাই স্বার্থপর।

আঁখিদের হাউজিং থেকে নেমে চারপাশ রক্তাক্ত করে রাখা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটা মনে পড়ছে। তারপর অনেকক্ষণ অন্ধ মাতালের মতো ঘুরতে ঘুরতে আবার সে চিনতে পারে — ফুটপাথের বকুলবৃক্ষ। ওহ, এটা তাহলে লোয়ার সার্কুলার রোড! কতদিন পার্ক স্ট্রিট থেকে ঢাকুরিয়া টানা হেঁটেছে দুজনে। আজ একা উজান বাইতে বাইতে সে ওই সবুজ হল্ট স্টেশনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা গাছের নিচে মীন হাঁটু মুড়ে বসে গোছাতো বকুল আর তার প্রিয় ভিজে করতল ভ’রে দিত ফুলে। তাদের কত আবশ্যক ঝগড়া মুছে দিয়েছে এই ছায়াগাছেরা…।

বন্ধ ঘরের মধ্যে চার ঘন্টা একটা ফড়িং তাড়া খেয়ে উড়লে তার উড়ানের গ্রাফ যে জটিলতম রেখারাশি দেবে, তেমন করে সে ঘোরে শহরটায়। …কেননা, কেউ চায় যে কোনও মূল্যে ভালো থাকতে। আর কেউ ‘ঠিক থাকা’-র বাইরে ভালো থাকতে জানে না। এইভাবে জীবন থেকে জীবন ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

ট্রেনে উঠে আবার সুলতানার কথা মনে আসে মীনের। রাত অনুযায়ী যথেষ্ট ঠাসাঠাসি কামরায় দাঁড়িয়ে প্রাণপণে ওর হাতদুটো ভাবতে চেষ্টা করে। ফ্যাকাসে রক্তহীন করতল ও তাতে গভীর কালো রেখা? ঝাঁকা ওঠাতে নামাতে হাতের রুগ্ন পেশি ফুলে উঠেছে, তাই না? কেন সে ভালো করে লক্ষ করেনি এতদিন! মজিলপুরের কোন গ্রামে মেয়েটি জীবিত হয়ে থাকবে, আর জানা সম্ভব নয়…!

আজ আঁখিদের টয়লেটে ঢুকেই তার রুম ফ্রেশনারের স্মৃতি ফিরে এসেছিল। প্রায় চার বছর আগে এমনই একদিন সে অফিস কেটে গিয়েছিল ওর ফ্ল্যাটে। তুমুল আদর-বিনিময়ের পর দুজনে যখন ভদ্রস্থ, আঁখি শোয়ার ঘরে ঢুকে নাক টানতে থাকে।

— গন্ধ পাচ্ছো না?
— কীসের গন্ধ?
— এতক্ষণ যা করলে তার, ক্যাবলা-কেষ্ট! আসলে, তুমি ঘরেই রয়েছ বলে বুঝতে পারছ না। ছোটপিসি আসবে বললাম না একটু পরে? ঠিক টের পেয়ে যাবে। দাঁড়াও, ব্যবস্থা হচ্ছে।

চালাকিতে অন্যকে হারিয়ে দেওয়ার এক মহামহিম আনন্দ আঁখির চোখে লেগে ছিল। মীনের অভিজ্ঞতায় সেই প্রথমবার রুম ফ্রেশনারের ব্যবহার তার সামনা-সামনি। আর আজ দ্বিতীয়, তাকে দরজার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে।

টলতে টলতে যখন সে বেরিয়ে যাচ্ছে, আঁখি আর আটকায়নি।

— আসলে কী জানো তো? তুমি অসাধারণ! আর আমি খুব সিম্পল মানুষ। তোমার কল্পনাশক্তির সঙ্গে তাল দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। ভালো থেকো বাবি, নিজগুণেই ভালো থেকো।

‘অসাধারণ’ শব্দের বিস্ময় সঙ্গে নিয়ে সে এতক্ষণ পথ ঘুরেছে। তারপর একসময় মনে হল, সবটা তো ব্যর্থ হয়ে যায়নি! তার মতো একটা হৃদয়হীন আত্মকেন্দ্রিক অগ্নিশুদ্ধাকে যখন প্রথম বলেছিল ‘ভালোবাসি’, ভাবতে পেরেছিল কথাটা একদিন কি অসহায় গোঙানিময় সত্যি হয়ে যাবে! ঘুম থেকে উঠে টেলিফোনে গলা না শোনা পর্যন্ত তার দিন থেমে থাকে। রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে যতক্ষণ না তাকে ফোন করছে আঁখি, পড়ার টেবিলে বসে ঝিমোয় সে। এই কি প্রেম? এটাই কি প্রেম নয়? মীন তবে সত্যিই প্রেমিক! তাহলে ভেবে দ্যাখো, অন্তত একটা জায়গা আছে জীবনে, যেখানে তুমি ফাঁকি দাওনি, বরং নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছ বারবার। দরজার ঠান্ডা হাওয়ার দিকে যেতে ইচ্ছে করে মীনকেতনের, আজ ঠিক যেভাবে সে অগ্নিশুদ্ধার শরীরে যেতে প্রস্তুত হচ্ছিল। কারণ আজই বুকের নিচে পাওয়া আনন্দমাখা নগ্নদেহকে বলত, কী চাও জীবনের কাছে স্পষ্ট করে ভাবো; আর সেটাই প্রকাশ করে দাও নিজের বানানো ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে।

তার সামনে গোল চেহারার অল্পবয়েসি একটা বউ দাঁড়িয়ে, গা-ঘেঁষে এক পুরুষ খুব তৃপ্তমুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলছে। বোঝা যায়, এদের মধ্যে কোনও মহাজাগতিক টেনশান নেই। তাই হয়তো বউটার বাঁকাঁধের নিচে বৃষ্টিফোঁটার মতো ঘামের তিনটে আঙুরবিন্দু অপেক্ষা করছে —- প্রেমিক কখন জিভের মরুভূমিতে তাদের শুষে নেবে। এবং তখনই এক ভীষণ ঝাঁকুনি পেয়ে মীন আবিষ্কার করে ওই ঘামবিন্দুর ঠিক নিচেই বউটার পিঠের ওপর বসে যাচ্ছে তার দাঁত। ফলে সে-বউও হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের লোকের গায়ে, সামনের যাত্রী আবার…। ছোটবেলায় একটু ফাঁকা ফাঁকা ইঁট দাঁড় করিয়ে রেখে প্রথমটা ঠেলে দিলে যেমনটা হতো। কিন্তু প্রায় তৎক্ষণাত সারি-পতন থামিয়ে গোটা তিন-চার হাত তাকে টেনে সোজা করেছে।

‘শুয়োরের বাচ্চা, মা-বোনদের বডিতে হাত?’ বউটা হিস্টিরিয়া রোগির মতো তার চিৎকার থামাচ্ছে না, ফলে ওই আস্ফালন পরিবেশের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যায়। ‘চল বাঞ্চোত, আজ রাতটা জি আর পি-র লকাপে কাটাবি। নামা তো মালটাকে। না না, কেউ গায়ে হাত দেবেন না’। হাঁ-হতবাক মীনকেতন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়, একদল ছেলের ঘেরাটোপ তার পেছনে, পাখি ধরার আঠালো জাল যেন। ‘কী হয়েছে ভাই’ ব’লে যারা এগিয়েছিল, যুবকদের রহস্যময় সংগঠন দেখে উদ্যোগ হারাল।

খুব কী ভয় পেল মীন? নাকি সারাদিনের ক্লান্ত পাদুটো ওই বালা-পরা হাতের শ্রেণীতেই ভর দিয়ে দাঁড়াক কিছুক্ষণ! এবং পরের স্টেশনে যখন ট্রেন থামছে, পাশের ছেলেটাই, নামাতে সুবিধে হবে ভেবে হয়তো, তাকে আচমকা চড় কষাল।

মাথা ঘুরে ওঠে মীনকেতনের, আঘাতের শক্তি আর অপমানে। আর কী আশ্চর্য, আবার পেয়ারার গন্ধ মনে পড়ে যায়, শুকদেবদার গাছের পেয়ারা। গরমকালে স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে তাদের নিয়মিত টার্গেট ছিল স্কুল-পাঁচিলের সীমানা-ঘেঁষা গাছটা। শুধু এক কার-মুখ-দেখে-উঠেছিলাম দুপুরে শুকদেবদা দৌড়ে বেরিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে, টেনে বাগান-লাগোয়া ছোট্ট খুপরিঘরে নিয়ে যায় এবং আর কিচ্ছু করে না, শুধু শরীরের সমস্ত ক্ষমতা জড়ো করে পঁচিশ বছরের জোয়ান তার জীবনের শ্রেষ্ঠ চড়টি দশ বছরের বালকের গালে বসিয়ে দেয়।

স্টেশনে নামিয়ে তাকে উলটো দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে যে যুবগোষ্ঠী, তার সদস্যসংখ্যা দশের অর্ধেক হবে। ইতিমধ্যে এদের একজন খুব যত্ন করে তার পুরুষাঙ্গ কেটে নেওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছে। ছেলেটি সম্ভবত কথা বলতে ভালোবাসে। তাই, ‘বাঁড়া, গাছেরও খাবি, তলারও কুড়োবি’ বলার পর যুক্তিপূর্ণভাবে শুরু করে, ‘তুমি শালা ভদ্দরলোক হয়ে যদি ছোটলোকের সঙ্গে ন্যাকড়াবাজি করতে যাও…’ এবং এই পর্যন্ত এসে, হয়তো কারও ইশারায়, শিক্ষাদান থামিয়ে দেয়। প্ল্যাটফর্ম শেষ হলে এবার রেললাইনের খোয়ার ওপর দিয়ে সগৌরবে হাঁটানো হচ্ছে মীনকেতনকে। দূরে লাল-সবুজ সিগন্যালের চোখ গড়িয়ে জল নামল কি? এমন ভাবুক ও অত্যাচার-প্রত্যাশী ভিকটিম জীবনে পাওয়া যায়নি বলে সবাই খুব উৎসাহিত, ‘একটু চেঁচাল না মাইরি, যেন জামাইষষ্ঠী খেতে যাচ্ছে’।

বলো, কেন সে আওয়াজ ওঠাবে? কে আছে এই পৃথিবীতে যে নিজের ইচ্ছে মতো জীবন কাটানোর সুখের চেয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়? যে শিক্ষিত লোকজন গুছিয়ে পোষাক পরে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সঙ্গে কোথায় তফাত এই চার-পাঁচটা মাতাল-মস্তানের? আজ দুপুরে তার মন ধ্বংস হয়েছিল, এই রাতে শরীরের বিনাশ হবে, তফাত এইটুকুই তো?

মাথার ওপরে যেন দড়ি দিয়ে ঝোলানো ভাঙা চন্দ্রমা, নিচে জনা চারেক ছেলে তাকে আধাচাঁদের মতোই ঘিরে ধরে মুখে ঘুষি চালাচ্ছে, আর দুহাতের আড়াল দিয়ে মীনকেতন কোনওমতে ঠাকাচ্ছে আঘাতগুলো। নিখুঁত পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে এবার একজন একটু দূরে সরে গেল, এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিয়ে চট করে হাত ঢোকাল প্যান্টের পেছনের পকেটে। ওমনি মীনের তলপেট গুটিয়ে ছোট হয়ে গেছে, কেঁপে উঠে কাঁটা দিল সমস্ত শরীর। ফুলে ওঠা চোখে জীবন আর স্পৃহা-র বিখ্যাত জুটিকে এবার যেন সে আবছা দেখতে পেয়েছে। দুটো বাড়তি হাত মীনের এখুনি দরকার নিজের পাকস্থলি বাঁচানোর জন্যে। অথচ ঠান্ডা ভিজে শ্যামবর্ণ দুই করতল সে আর এ-জীবনে পাবে না।

(শেষ)

বারো ঘন্টা প্লাস … (চতুর্থ পর্ব)

বারো ঘন্টা প্লাস
(চতুর্থ পর্ব)


তার চেয়ে বছর তিনেকের বড়, ডিভোর্সি মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুর অফিসের খুব ঘিঞ্জি ক্যান্টিনে আলাপের পর থেকে তাদের সম্পর্কের অগ্রগতি এক কথায় ছিল দুর্ধর্ষ! মনে পড়ছে, ঠিক দ্বিতীয় দিনে দক্ষিণ কলকাতার এক আইসক্রিম পার্লারে দাঁড়িয়ে মিল্ক শেক খেতে খেতে মীন আঁখিকে দুর্ধর্ষের ব্যাসবাক্য শিখিয়েছিল — দুধ খেয়ে যে হর্ষ। ইম্মেডিয়েটলি আঁখির আকাশি রঙের শার্ট আপ্লুত হয়ে যায় মিল্ক শেকের অট্টহাসিতে।

সেই জমে ওঠা মিল্ক শেক উলটো পালটা ঝাঁকুনিতে কি নিরুচ্চারে এবং সশব্দে ছানা কেটে গেল!

নিজের চা নিয়ে সোফায় বসেছে আঁখি। তার পায়ের বেগুনি নখ, কবজির চারকোনা চুড়ি পেরিয়ে বাঁ হাতের খালি অনামিকায় দৃষ্টি চলে যেতে পারে, যেখানে মীন অনেকবার একটা আংটি পরাতে চেয়েছে সানুনয়ে। প্রায় সেই রকম বিনীতভাবে সে কথা শুরু করে।

— সোনা, আমাদের ভেতরের সমস্যাগুলো কি আর মেটার মতো নয়?
— আমার দিক থেকে তো কোনও প্রবলেম নেই! তুমিই নানারকম ভেবেটেবে জটিলতা ডেকে আনছ।
— সোনা, ভেবে দ্যাখো, গত দুবছরে তুমি আমাদের দ্যাখা হওয়া, ফিজিক্যালি মিট করা, একসঙ্গে বেড়াতে বেরনো, এমনকি ফোন করাটাও কীভাবে কমিয়ে এনেছ। কিন্তু আমি যে উইথড্র করতে পারছি না!
— শোনো মীন, আমাদের সম্পর্ক হওয়ার পরে এই পাঁচটা বছরে আমি বুড়ো হয়েছি আর বৈশাখী বড় হয়েছে। তোমার প্রসঙ্গ উঠলে, এমনকি মোবাইলে নম্বরটা বাজতে দেখলেও ও গম্ভীর হয়ে যায়। মা হয়ে আমি সেটা অন্‌দেখি করতে পারি, বলো?
— তাহলে মীনাক্ষি-প্রেমের গল্পের এটাই শেষ প্যারা?
— আমি কবে বললাম সে কথা? শুধু দুজনকে একটু সামলে চলতে হবে।
— আর মেয়ে যদি কাল বলে, বাবার কাছে ফিরে চল?

ঝটিতি ঘুরে তাকায় অগ্নিশুদ্ধা। চোখ তীক্ষ্ণ, সতর্ক। মীন জেনেছে, দিদির ফ্ল্যাটে আগের হাজব্যান্ডের সঙ্গে পারিবারিক মিলন হয় স্ত্রী-সন্তানের। কে জানে, হয়তো দাম্পত্য মিলনও। সেই পুরুষ, যাকে আঁখি একসময় ‘জানোয়ারটা’ ছাড়া অন্য সম্বোধন করত না।

—মেয়ের লাইফ, মেয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি প্রভাব খাটাতে যাব না, প্রভাবিতও হবো না।
মীনকেতনের ঠোঁট মুচড়ে যায় প্যাঁচানো হাসিতে। নির্ভরতার দুটো হাতের বদলে আঁখি তার দিকে বাড়িয়ে চলেছে তৃতীয় এক হস্ত, যাকে অজুহাত বলে। কিন্তু ব্যাঙ্গের কাঁটা এবার মেয়েটার রক্ষণেও টোল ফেলল।

— তোমাকে খুশি করার ক্ষমতা আমার নেই, মীন!
অগ্নিশুদ্ধার গলা তীব্র। এক মুহূর্ত থেমে সে ঢোঁক গেলে।
— তাছাড়া…তাছাড়া জীবন বা মন কোনও অংক মেনে চলে না।

পদ্মের পাপড়ি সম্পূর্ণ খুলে গিয়ে গর্ভকেশর উন্মুক্ত হওয়ার মতো , অথবা রিভলভিং স্টেজ যেমন পেছন থেকে চক্কর কেটে সামনে দাঁড়ায়, আঁখি তার বর্তমান জীবনসত্যকে ছেড়ে দেয় মীনের চোখের সামনে — পারো তো সামলাও!
মাছের লেজের শেষ ঘাইটাও ঠান্ডা স্রোতে অদৃশ্য হওয়ার পর আস্তে আস্তে দৃশ্যের সম্পূর্ণ মানে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। যেন আঁখি এক দুরূহ ইংগিতপ্রধান কবি এবং মীন তার একনিষ্ঠ টীকাকার।

— জীবন অংক মেনে চলে বলেই আমার মনে হয়, সোনা। শুধু প্রত্যেকে জীবনের অংক তার নিজের মতো। যে-কোনও দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম হতেই পারে, কিন্তু দুজনের ভালোবাসা সম্পর্কে বেসিক ধারণাগুলো একদম উলটো হলে সেই প্রেম বাস্তবে টিঁকবে না। আমাদের সমস্যাও এখানে। কোনও পরিণত মানুষের মূল্যবোধ সারা জীবন একই থাকে না নিশ্চয়ই, পালটায়…।

— ওহ্‌, আবার সেই মূল্যবোধ! এরপর আসবে ‘স্বচ্ছতা’। পাঁচ বছর শুধু এই লেকচার গিলে আসছি। একার জীবনে আমাকেই সমস্যাগুলো ফেস করতে হয়, তুমি তো প্রেম করেই খালাস।
চাপা ঘেন্নায় ছটফট করে ওঠে আঁখি। কিন্তু মীন থামতে পারছে কই? শেষ অনুচ্ছেদটা সুলিখিত না হলে তার ভাষ্য সম্পূর্ণতা পাবে না। কীভাবে তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম অগ্নিশুদ্ধার নতুন ও মৌলিক কাব্যরীতি থেকে শিক্ষা নেবে!

— তুমি যাই বলো, ভ্যালুজ ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। মূল্যবোধহীনতাও একরকম মূল্যবোধ। তবে একটা ডাহা জিনিস মেনে নিতেই হবে। গাছ যেমন মাটির ওপরে দাঁড়ায়, জীবদেহ যেমন কোষের সমষ্টি, তেমনি চেতনারও আসল কথা তার সততা। তোমার ওপর যার জীবন নির্ভর করছে, তার সঙ্গে অন্তত প্রতারণা করো না।

মশালের আগুনে কুলকুচি করে কেরোসিন তেল ছেটালে যা হয়, তেমন আশঙ্কা করছিল মীন, কিন্তু আঁখি বসে থাকে মাথা ঝুঁকিয়ে।

— ব্যাস, আমাকে মিথ্যেবাদী আর চরিত্রহীন প্রমাণ করা হয়ে গেছে তো? এবার শোনো, আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই, স্বাধীনভাবে। তোমরা পুরুষেরা নিয়ম বেঁধে দেবে,আর আমরা চলব তাতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, কীসের জন্যে?

—আমার আপত্তি নেই। তুমি অতীন্দ্রিয়র সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে জুড়তে পারো, বা তোমার অফিস ইউনিয়ানের নেতা, কী যেন নাম, তার সঙ্গে নাটক-টাটক দেখতে যাও। কিন্তু লুকোবে কেন? আমি ফোন করলে বলছো, ডাক্তারের চেম্বারে আছি, বা মোবাইল স্রেফ বন্ধ রেখে পরে জানালে নেট ওয়ার্কের গণ্ডগোল, … প্রেমিক হিসেবে তথ্যের অধিকারটুকু কেন কেড়ে নেবে আমার? আমি তো কোনওদিন তোমাকে ডিচ করিনি!

এতক্ষণে মশাল জ্বলে ওঠে। গলার মিষ্টি-নুপূর শব্দ স্ক্রুয়ের প্যাঁচ হয়ে মাথার ভেতরে ঢুকে যায়।
— বেশ করব, ঘুরব। তুমিও ঘোরো না, কে আপত্তি করেছে? আর আমার কৈফিয়ৎ চাওয়ার তুমি কে? কে তুমি!

‘কে’ শব্দটায় এত চাপ দিতে থাকে, যেন এই কাঠবাদামের খোলা ভাঙলেই তাদের ভালোবাসার অপদার্থতা বেরিয়ে আসবে। ‘কোনও দিন ছেড়ে যাবে না তো সোনা?’ — আদরের মুহূর্তে মহাসমারোহে শোনাতো যে, আজ আঙুল তুলে দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে। খুলে রাখা জুতো পায়ে গলাতে চেষ্টা করল মীন সোফায় বসে বসেই। জুতোর ফিতে কীভাবে যেন বাঁধতে হয়! মাথা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নামছে, কিন্তু খুলির ভেতরটা শুকনো ঘাসে ভর্তি। কোনও রকমে উঠে দরজার ছিটকিনির দিকে হাত বাড়িয়েছে, তৎক্ষণাত প্রথমে পিঠের জামায়, তারপর বাঁ-কাঁধে টান খেয়ে পেছনে আধখানা ঘুরতে না ঘুরতেই আঁখির সম্পূর্ণ শরীর ঝাঁপাল গায়ের ওপর। ফলে ভারসাম্যের বারোটা বাজিয়ে দড়াম করে শোকেসে ধাক্কা খায় সে, ভ্রূক্ষেপহীন মেয়েটা তার বুকের ওপরেই কান্নায় ভাঙছে তখন।

— কোথায় যাচ্ছো? কোত্থাও যেও না। টেলিফোনে, দেখা হলে, এখন বাড়ি বয়ে এসেও অপমান করে যাচ্ছো। একে কি ভালোবাসা বলে, সোনা!

বুকের নিচে ভারি স্তনের ঠেসান পেয়ে মীনের দেড় মাসের খিদে জমানো শরীরের ছিলা টান খেল। কিন্তু মন অসমাধিত থাকলে স্পৃহা কাজ করবে কীভাবে?

তবু লক্ষ করো, আঁখি ঘাড় উঁচু করে একটা চুম্বন-চেষ্টা চালাচ্ছে। মেয়েটা চুমু খেতে জানে না — ভনিতা না ক’রে বলতে হবে। মুখের অনতিদূরে এসে প্রজাপতির ডানার মতো কেঁপে রেণু রেণু হয়ে যায় তার ওষ্ঠ। স্নায়ুর তীব্র তাড়নাতে হাঁ-মুখ বন্ধ করতে পারে না ব’লে পুরুষের গাল ও জিভের সঙ্গে মূলত তার ছোট ছোট সাজানো দাঁতের সাক্ষাৎকার ঘটে। আজও মীনের ঠোঁটের চারপাশটা শিশুর হামির মতো হালকা লালামাখা হল। সেই রুগ্ন, একপেশে চুমুর জন্যেই যেন আরও বেশি আত্মসমর্পণ আঁখির।

— একটুও আদর না করে চলে যাবে সোনা!
— তুমিই তো বারবার বললে, খুব টায়ার্ড?
— এখন পারবো।
বলেই সে দ্রুত জুড়ে দেয়,
— তোমার সঙ্গে ঝগড়া মিটে গেলেই আমার শরীর ভালো হয়ে যায়, জান না যেন?
চলো চলো, ফ্রেশ হয়ে নাও।
মীনের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলে বাথরুমের দিকে, সেই অবস্থায় পেছন থেকে হুমড়ি খেয়ে খুলে দেয় ছিটকিনি। ওমনি ভক করে আবার রুম ফ্রেশনারের গন্ধ। আধো অন্ধকারে সাবান খুঁজতে খুঁজতে মীন অগ্নিশুদ্ধার গলা শুনতে পেল।

— দিদি, শরীরটা খুব খারাপ রে! মালতিমাসিকে বল না, তিন্নিকে স্কুল থেকে তুলে ও-বাড়িতে রাখতে। এই ঘন্টাখানেক পরে গিয়ে নিয়ে আসব। না না, তোকে আসতে …।

(চলছে)

বারো ঘন্টা প্লাস … (তৃতীয় পর্ব)

বারো ঘন্টা প্লাস
(তৃতীয় পর্ব)

— এই, না না। আমাকে একটু দিদির ফ্ল্যাটে যেতে হবে। বেরবো বলেই শাড়ি বের করছিলাম, ফোন ধরতে এলাম এ-ঘরে। নেক্সট উইকে একটা ডেট করো। আহ, আবার কলিং বেল বাজছে। এখন বেরনোর সময় কে মরতে এল! একটু রাখো, আমি ব্যাক করছি।

— দরজা খুলে কাকে দেখতে পাবে, আন্দাজ করো।
— এই-ই, তুমি নাকি! কী আশ্চর্য! দাঁড়াও, দাঁড়াও, ঘরটা যা অগোছালো করে রেখেছি। বলে আসতে হয় তো।

আঁখির গলার স্বর আবার দূরে চলে গেছে। মীনের অপেক্ষার মুহূর্তগুলো অনন্তে না হোক, চাঁদে পৌঁছোয়। ফ্ল্যাটের মধ্যে কিছু একটা উলটে পড়া আর আঁখির বিরক্তির শব্দ একসঙ্গে কানে এল। শেষ পর্যন্ত দরজা খোলে সে, ঘামা-নাওয়া, বিভ্রান্ত আর একটুখানি খুশিও। তার দীঘল শ্যামরঙ শরীর থেকে বডি লোশনের গন্ধ বন্দুক তুলে আছে। সোফায় বসতে বসতে মীন টের পায়, গন্ধটা আসলে রুম ফ্রেশনারের।

—বাব্বাঃ, ঘর যে আমোদিত! এটাও কি নতুন ওভ্যেস?
বলতে বলতে মীনের নজরে পড়ে, তার মা যেমন দামি শায়ার ঝুলে লেস বসাতেন, আঁখির নাইটির গলায়, দুহাতে আর পায়ের দিকে এমব্রয়ডারি-করা লেস লাগানো। যে কোনও নতুন পোষাকেই আঁখিকে অপ্রতিরোধ্য সুন্দরী লাগে, কিন্তু সে কথা থাক…।

—তুমি যে বললে দিদির বাড়ি যাওয়ার জন্যে শাড়ি পরে ফেলেছ?
অগ্নিশুদ্ধার চোখের কোনে রাগ ছোট ট্রেলার দেখিয়েই বিষন্নতায় বদলে গেল। ওর তো জানাই, অবিশ্বাসপরায়ণ প্রেমিক এই প্রশ্নগুলোই করবে।

— মীন, আমি তোমাকে বলেছিলাম, শাড়ি পরছি, শাড়ি পরে ফেলেছি একবারও নয় কিন্তু। নিজের মনগড়া কথা আমার মুখে বসানো কি ঠিক? আরও বলছ, রুম ফ্রেশনার নাকি ব্যবহার করি না। ইউজ করব না যদি, শুধু শুধু কিনে আনলাম? ছোট ছোট ব্যাপারেও এত সন্দেহ জমিয়ে রাখলে ভালোবাসবে কখন, সোনা!

স্কটিশের ইংলিশ অনার্স, ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাংকের টেলর কাউন্টার সামলানো মেয়েটার পরিশীলন দেখবার মতো। রিনরিনে মিষ্টি গলার এই অদা-ই মেরেছে মীনকেতনকে। সে প্রশ্ন করে না, ভেতরের ঘরে শাড়ি পরতে থাকলে দেড়খানা রিংয়ের মধ্যেই বসার ঘরে এসে ফোন ধরা কীভাবে সম্ভব? অভিজ্ঞতা বলছে, সমাধান কোনও সমস্যাই নয় আঁখির কাছে। নিখুঁত যুক্তি আউড়ে মীনকে সে চুপ তো করাবেই, গাইবে সেই ধুয়োটাও — এত সন্দেহবাতিক নিয়ে চললে আমাদের ঝগড়া কোনওদিনও থামবে না! সোনা, তুমি কি প্লিজ একটু কাউন্সেলিং করাবে?

আঁখি উঠে গিয়েছে রান্নাঘরে আর তক্ষুনি “একদিন তেরি বাহোঁ মেঁ” বেজে উঠল চিৎকার। মীন বেল বাজালে সে যেমন বিরক্ত হয়েছিল, তেমনি গজগজ করতে থাকল।

— ঠিক দেবযানী বৌদি। আর ফোন করার সময় পেল না। এখন ধরলে মিনিমাম চল্লিশ মিনিট।
—তাহলে বলে দাও যে ব্যস্ত আছো।
— না বাবা, ধরবোই না।

কিন্তু মীনকে উঠে আসতে দেখেই সে দ্রুত ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে মোবাইল তুলে নেয়। মীন তার হাতের ওপর থেকে চোখ সরায় না বলে বুঝতে পারে, ‌আঁখির ডানহাতের বুড়ো আঙুল অ্যাকসেপ্ট বাটন ছোঁয়ার ভঙ্গি করে রিজেক্ট নব টাচ করল, গান থামা মাত্র বলল ‘হ্যালো’ এবং একই নিঃশ্বাসে, ‘যাহ, কেটে দিয়েছে’।

গত একবছরকাল মীনের উপস্থিতিতে সে ফোনটা বন্ধ বা মিউট করে রাখে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, গোপনীয়তা সম্পদে অনেক ধনী অগ্নিশুদ্ধা। তাই উন্মোচনবিরোধী। জীবনকে নানা ঘর, তল আর গবাক্ষে ভাগ করে রেখেছে, যার এক বাতায়নের খবর অন্য কুলুঙ্গি জানে না। আর ঘর থেকে ঘরে অনুপ্রবেশের মুখে শক্ত করে তোলা মিথ্যের দেয়াল। এই মুহূর্তে তেমনই কোনও এক বাসভূমিতে সে মীনের সামনে নামাল লিকার চায়ের কাপ। মীনের চোখে ঝলসাতে থাকল তার শ্যামবর্ণ বাহুমূল, কনুই থেকে অপ্রশস্ত নিচের হাত আর ছোট নাজুক কবজি। সিনেমা হলের অন্ধকারে যতবার আঁখির পাতলা ভিজে ভিজে প্রচুর কাটাকুটিময় করতল নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, ততই নিজেকে মনে হয়েছে ষোল বছরের এক কিশোরির প্রেমিক। এবং ভেবেছে, তার স্বপ্নের ডানা এরাই। এখন চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে মীনকেতন পাশের সোফা দেখাল।

— একটু বসবে? কথা ছিল…।

(চলছে)

বারো ঘন্টা প্লাস (দ্বিতীয় পর্ব)

বারো ঘন্টা প্লাস
(দ্বিতীয় পর্ব)

আবার একটা ট্রেন এল, দু’চারজন লোক নেমে পেয়ারা বাছতে উন্মুখ। একটু সরে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করল মীনকেতন। মৃত্যুর আগে কতো যে ধ্বংস পেরিয়ে যেতে হয় একজন মানুষকে! গা থেকে এভাবে মাংস খসে যেতে যেতে শেষদিন যখন বাজপাখির ফাইনাল ছোঁ এসে নামবে, তখন মুখ দিয়ে যাতে একমাত্র ‘থ্যাংক ইউ’ বেরিয়ে আসে, তার জন্যেই জীবনের এখানে ওখানে এত সাপ-হায়না-নেকড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে? দুই হাঁটু জড়ো করে বসা মেয়েটাকে এক শ্যামকপোতী মনে হতে থাকে মীনের। খদ্দের ছেড়ে দিয়ে তাকে আবার ইশারায় ডেকে নেয় কপোতী, মানে সুলতানা।

— আমাদের গেরামে তোমারে একবার লে যাবো। ঝেকানে ইছেমতী বাঁক লেচে, সেই মোক্তারপুরে এক পীরসায়েব থাকে, ক্যামোন? সে তোমার তাবিজ-কবোচ কত্তি পারে। আর সবায়েরে বলে, খোদার নাম লে বে-মতলব কাজ করবা। মান্‌সের উপ্‌কার কোত্তি থাকপা বে-মতলব। এই তোমারে দেখায়ে পীরসায়েবেরে বলবো ভেবিচি, এট্টা লোক পাওয়া গেচে দুনিয়ায়, যে কোনও ফিকির না খুঁজে অচেনা লোকেরে হামেশা জলখাবার দেচ্চে।

হঠাৎ ঘাড়ের কাছে বিকট থুতু ফেলার শব্দে চমকে উঠতে হয়। মীন মুখ তুলে দেখে কখন তার চারদিকে ছ’-আটজন লোকের ঘেরাটোপ তৈরি হয়েছে। চেহারায় বা ভাবভঙ্গিতে ট্রেনের যাত্রী বা স্টেশনের দোকানদার মনে হয় না। মানুষগুলো সেই শ্রেণীর যারা রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে জামাকাপড় পরে ঘর থেকে বেরোয় আর অনেক রাতে ফিরে ওই জামাপ্যান্টেই শুয়ে পড়ে। মাঝখানে ফুটপাথের দোকান থেকে দিনমানে ধারে বা অন্যের পয়সায় চা। এভাবেই দুপুরে পাঁউরুটি-ঘুঘনি হয়ে গেল তো রাতে অতি অবশ্যই একটু গাঁজা বা ছোট পাউচ চুল্লুর।

সারাদিন রাস্তার পাশে বসে চারদিকে ধেয়ে যাওয়া জনস্রোতে এরা নজরের ছিপ ডুবিয়ে আছে। কোন কিশোরি বাড়িতে ঝগড়া করে পালিয়ে একা স্টেশনে নামল, কোন বাচ্চাটা ভিড়ের মধ্যে মাকে হারিয়ে ফেলেছে, বা রাস্তায় হঠাৎ বাওয়াল বাধলে কার সাইড নিলে কিছু ইনকাম। এরা সেই অভিজ্ঞ ভালুক যারা ঝর্নাজলের পাশে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে ওঠা মাছগুলো মুখে পুরে নেয়।

ভিড়ের একটা ছেলে, বাঁহাতে খৈনি ডলছে, তার ওপর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে জিগেস করল, ঝুড়ির পেয়ারা খাবে, না বৌদির পেয়ারা? ফুঁসে উঠল সুলতানা।

— আরে শালা মোজাম্মেল, আরে হারামির বাচ্চা রতন, আজকেরে ঝা অপমান করার করি লাও। কাল থেকে এ গু-মুতির জায়গা জম্মের মতো ছেড়ি দোবো। তোদের মস্তান দাদারে জানায় রাখিস, জাল পাতলিই সব পাখি গোত্তা খেয়ি পড়বে, অ্যাতোডা মাগনা পাওনি বলো।


বাইপাস ধ’রে ছোটা বাসের জানলায় বসে সে ব্যাগ থেকে সুলতানার কাছে কেনা পেয়ারাটা বের করে। তারপর ফাস্ট বোলারের মতো নিজের উরুতে কয়েকবার পালিশ করে নিয়ে এক কামড় বসায়। তৎক্ষণাত হুড়মুড় করে মীনকে আক্রমণ করে তার শৈশব।

যেন ঠাকুমার সরু সরু সাদা হাতের ছাল উঠছে,এই আন্দাজে সে পেয়ারার ডাল থেকে হালকা ঘষায় খোসা ফেলে দিত। এবং তখন কী মসৃন, কী শীতল পেয়ারাগাছের ডালপালা! নিজের থমথমে কিন্তু পাতলা গাল মীন রাখতো ওখানে। একটা গিরগিটির মতো সে তখন উপুড়, ডাল বুকের তলায় কঠিন পৈতের মতো প্রশাখা, উরুসন্ধি চেপ্টে আছে তারই গায়ে। মীনের ছোট্ট পুরুষ, এবং অল্প দুটিখানি লেবু লজেন্সের মতো অণ্ডকোষে শুক্রবীজ তৈরি হওয়ার ভিয়েন বসেনি। ফলে মীনের শরীরের সব পর্বসন্ধিতে তখনও কুসুমগন্ধ লেগে। এবং ভুললে চলবে না, পেয়ারার ডাল একটি ভরসাকেন্দ্র; আতাগাছের মতো নয় যে দেখাবে তো খুব মোটা-কালো রঘু ডাকাত, কিন্তু গত বছরই মড়মড়িয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে নাক থেকে কতখানি রক্ত উদ্গীরণ করিয়ে দিল!

আজও প্রতিদিন পেয়ারায় কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের বনজ গন্ধে ভর করে আলাদা আলাদা দৃশ্য ও কাহিনি ছুটে আসে। যেমন গত পরশু ঝুড়ি থেকে নিজেই বেছে যে পেয়ারাটা তাকে দেয় সুলতানা, তার প্রথম টুকরো মুখে চালান করামাত্র শুকদেবদার বাড়ির গাছটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই পেয়ারার গায়ের গন্ধ ছিল অবিকল ওইরকম।

তুমুল হাওয়া তার লম্বাটে চুলে ঝড় তুলে দিয়েছে। অফিসে পৌঁছোনোর ছোট্ট গাড়ি নিজেকে টেক অফ করার আগের মুহূর্তের বিমান ভেবে নিল নাকি! রাস্তার মাঝখানের আলোস্তম্ভ দু’ডানা ছড়ানো সার সার অ্যালবাট্রস। যেন কাছাকাছির মধ্যে কোথাও, জানলা দিয়ে ঘাড় একটু টান করলেই, দেখা যাবে সমুদ্র। শহরের ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে সাঁ করে এমন শূন্যতা জীবনে প্রথমবার সে দীঘা গিয়ে পেয়েছিল। তার অনেক বছর পরে সদ্য বিয়ে করা বন্ধু তাকে শোনায় আনকোরা যৌন-অভিজ্ঞতা। মীনকেতনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠেছিল ওই দীঘা, ওপরে হেমন্তের ধূষরতা টাঙিয়ে রাখা নীল সমুদ্রের শোষণধ্বনি।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোনবুকে গেল মীনকেতন। নামগুলো ফ্লিপ করতে করতে পাঁচ-এ অগ্নিশুদ্ধা, আজ পাঁচ বছর হল মীনের বাড়তি দুটো হাতের মালকিন ইনিই। অবশ্য মীন তাকে কখনও আঁখি ছাড়া ডাকেনি, দুজনের নাম যোগ হয়ে মীনাক্ষি হয়ে যাওয়াটা তার কাছে বাংলাভাষার সবচেয়ে আশ্চর্য কবিতা! আঁখিকে মীন এখুনি শোনাতে চায় সেই পেয়ারা-বেচা মেয়েটার কথা। জানো, সুলতানা বলে কি, জীবনে অনেক অন্যায়ের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আল্লাহ চিরকালই কিছু কিছু মানুষের ভেতর দিয়ে তার করুণা পাঠিয়ে চলেন। তাই সে খারাপের সঙ্গে আর কোনও সমঝোতায় যাবে না। সিম্পলি ভাবতে পারছি না, আমার মতো খ্যাপাটে, আত্মবিশ্বাসহীন একটা লোক কাউকে এভাবে ইন্সপায়ার করতে পারে…।

কিন্তু চার-পাঁচবার ডায়াল করেও দেখা গেল আঁখি এতটা জরুরি এনগেজড, এখন তার নম্বর ধরবে না। একটু দমে গেল মনে মনে আর তখুনি পালটা বেজে উঠল অনিমেষের, মীনের অফিসের বন্ধু। খুব একটা গ্রহণযোগ্য খবর শুনিয়েছে সে, কেননা খুশি মুখে স্টপেজ ছেড়ে যাওয়া বাস থেকেই লাফিয়ে নেমে পড়ল মীনকেতন।

দুপুর দুটো

গরম হাওয়ায় চোখ-মুখ অন্ধ করে দিয়ে অটো এসে থেমেছে গলির মুখটায়। পেছনে ধুলো-ওড়া ব্রিজের নিচে পচা নিঃস্রোত জলের খাল। সামনে গেরুয়া রঙ চারফুট উঁচু বিষ্ণুমন্দির। মানুষের চোখ-নাকের মতো গর্ত আর ঢিবিতে ভরা রাস্তার ওপর টুপির কানাতের মতো ঝুঁকে এসেছে ঠাসা দোকানঘরের ছাদ। তবু ঘন বিকেল নেমে রোদের তাত কিছু জুড়োলে শহরের এই রাক্ষসরূপ পাল্টায়। যদিও বর্ষার জমা জল জামাকাপড়ে ছিটকে আসার আদলে কানে লাগতে থাকে বাইক আর প্রাইভেট গাড়ির হর্ন, তবু অপরিচ্ছন্ন নারীর প্লাক করা ভুরু যেমন, চিলতে পানের দোকানের মাথাতেও গ্লো-সাইন জ্বলে ওঠে। সকালে দেখা শনি ঠাকুরের মতো এই বিষ্ণু দেবতারও হাত চারখানা। কিন্তু আজকের বিশিষ্ট দুপুরে ঠাকুর-দেবতাকে অতটা হিংসে করার মন নেই মীনকেতনের। পাঁচ বছর আগে যেমন, আজও কান-গরম আর বুক-ধড়াস নিয়ে সে চারতলা ফ্ল্যাটের মাথায় উঠে এল। তারপর কলিং বেলে হাত রাখতে গিয়েও কী ভেবে সরে এসে রিং করল আঁখির ল্যান্ড লাইনে।

— দেখেছ, আমি জানতাম তুমি অফিসে যাওনি।
— আহা, আমি নিজেই তো কাল রাতে বললাম, নাও যেতে পারি। শরীরটা একদম ভালো লাগছে না গো! আজ গোটাদিন ঘরে শুয়েই কাটাব।
স্পষ্টতই আঁখি মিন করছে, আজ বিকেলেও দেখা করতে রাজি নয়। মানে, পাক্কা তিন সপ্তাহ তারা মুখোমুখি হল না।

— আজ অফিস কাটার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। যাব তোমার কাছে, সোনা?

(চলছে)