চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছিঃ ৭

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছিঃ ৭

প্রেম এমন এক নীতিকথা যেখানে বাবা তার সন্তানকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসবেন। কিন্তু যখন দৈব অপছন্দে জাতির সবচেয়ে আদরের প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, রুষ্ট দেবী এমন এক শীতল নিষ্ক্রিয়তা ছুঁড়ে দিয়েছেন যা উপহাস করছে মানুষের বিপদ কেটে বেরনোর সব চেষ্টাকে, যখন ভবিষ্যতবক্তা এই বলে তার শোকাবহ ভাষণ শেষ করলেন যে দেবী এক তরতাজা যুবকের রক্ত না পেলে তৃপ্ত হবেন না — তখন তুমি, আমার প্রেমিকা, নিশ্চয়ই সাহসের সঙ্গে সেই ক্ষতিস্বীকার করবে? তুমি তোমার অনিচ্ছা গোপন করবে, যদিও বারবার আমার মনে হবে, যদি সেইসব কমশিক্ষিত মহিলা হতে পারতাম যারা কাঁদতে সাহস করে! যদি বুদ্ধিমান না হতাম, সুন্দর না হতাম, সম্পাদক না হতাম, যাকে বুদ্ধিমান সুন্দর সম্পাদকের মতো ব্যবহার করে চলতে হয়? সমগ্র মানবজাতির মধ্যে মাত্র দুজনকে তুমি জানাতে পেরেছ যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটালে, বর্তমান প্রেমিক আর আগের স্বামী…না না, এটা কোনও সমস্যা নয়, আইনস্টাইনও পৃথিবীতে মাত্র ছ’জনের কাছে মন খুলে কথা বলতে পারতেন।

আমি জানি এই বিষাদ আস্তে আস্তে গোটা কলকাতার হৃদয়ে সঞ্চারিত হবে, যেভাবে ছড়িয়ে পড়বে তোমার কাজের জন্যে মানুষের আনন্দ, সবাই হাসিমুখে বলাবলি করবে মুদিখানার দোকানদার থেকে বাংলাসাহিত্য হয়ে অটোচালক অ্যাসোসিয়েশানের মঙ্গলের জন্যে আত্মক্ষতির মতো এই খুনটা তুমি করলে তাকেই যে কিনা তোমার প্রেমিক, তোমার সন্তান, তোমার বুবু — আহা কী ঢেউখেলানো চুল, তার নাকের পাশে হাসির ভাঁজদুটো, তার বার-চকোলেট পুরুষাঙ্গ। ক্ষতিস্বীকারের মুহূর্তে আমার চোখের জল তোমাকে আলোড়িত করবে নিশ্চয়ই, ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, কিন্তু সাহসিকা তার ছুরি উঁচু করে ধরতে ভুল করবেন না। তারপর যখন সংবাদমাধ্যম পৌঁছলো বাড়িতে, আমার স্ত্রী আদৌ রেগে ওঠেনি, নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ; বরং সিজন চেঞ্জের অল্প খুকখুক কাশির মতো সামান্য গর্বিত লাগছিল তাকে, তোমার কাজের কিছুটা ভাগ নিতে পারার অহংকার, কারণ সে তো আমাকে তোমার চেয়ে আরও অনমনীয়ভাবে আরও আজীবন ধরে রেখেছিল, তাই না?

অমৃত

অমৃত

মৃতকে পালকস্পর্শ দাও
জীবিতের চেয়েও সে আস্বাদকাতর

মৃতের সম্মান রেখে বলো
শিশু-খরগোশ বুঝে উৎকর্ণ রয়েছে

মৃত ঘিরে বিক্ষোভ আসুক
সিংহভাগ অশ্রু কেন সে শিকার করে?

মৃতকে অমৃত বলতে মুখে বাধে যদি
কাঞ্চন ফুলের রঙ সাদা রেখেছো কেন!

স্লোগান

স্লোগান

তোমার স্তন কখনও তোমার অপরাধ হতে পারে না।
মাথার সুচিন্তিত চুল হতে পারে না আঁকশি — রান্নাঘরে শিকে টাঙানোর।
সন্ধেবেলা টিউশান পড়ে বাড়ি ফেরার রাস্তায়
পাথর মেরে ভেঙে রাখা টিউবলাইট তোমারই বোকামি হতে পারে না।
যারা একপাটি জুতোর ভেতরে ভরতে চেয়েছে তোমার দুটো পা-ই,
তাদের বিরুদ্ধে উরু ছড়িয়ে দাঁড়ানো হতে পারে না
চরিত্রহীনতা।

জগন্নাথ

জগন্নাথ

যিনি আমাদের জন্ম দিলেন
এবং তার চেয়েও চিরজীবী মৃত্যু দিতে সব সময় প্রস্তুত
সেই অপাপবিদ্ধকে প্রণাম
যিনি আমাদের চালেডালে মিশিয়ে খাওয়ালেন
আর দুমুহূর্তের মধ্যে আদেশ দিলেন কালান্তক ভেদবমি
সেই যমগন্ধবাহী উদ্দীপনাকে প্রণাম
যে আচার্য গরমকালে থোকা থোকা কারখানা বসিয়ে
বৃষ্টিকালে সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে
এই শরতে তালা খুলে বাস্তুকারকে দেখাচ্ছেন
মেশিনের পেটে পাক দিয়ে ওঠা কাশফুল,
সেই হালকা বাতাস ও উপজাতি নৃত্যকে প্রণাম
কেননা, তিনি ভিক্ষুককে ভিখারি হতে আশীর্বাদ করেন
বোবাকে দেখান জিভ টেনে উপড়ে নেওয়ার ভয়
তারই দয়ায় হৃৎপাত্রে ভালোবাসা-অবিশ্বাস সমান সমান
মৃৎপাত্রে অশ্রুকণা-পায়েসান্ন সমান সমান
তাই জগন্নাথ হাতদুটিতে এক লক্ষ নমস্কার রাখি যদি
তো প্রশান্ত দুপায়ে সমকক্ষ ধিক্কার প্রণাম।

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছি… ৫

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছি… ৫

আমাদের দুজনের দেখা হওয়া মানে একটা সোনাচড়াই। পাখির যতটুকু প্রথমেই আঁকা হয়ে আছে — তুমি। আমি নিজের ভাগটায় চটপট স্কেচপেন চালাচ্ছি।

কিন্তু ছবিতে নিজেকে বসাতে গিয়ে যদি বেশি ঝলসে উঠি, গাঙশালিক তার সমস্ত শরীর নিয়ে আমার দিকে ছুটে যাবে, তোমার প্রতিভায় ফিরতে পারবে না। এবার যত তার আমাকে ঘিরে ওড়া, তত বিমূর্ত হতে হতে একবার ভস্ম হয়ে যাবে ডানা লুটিয়ে। অথবা যেন অনিঃশেষ তার কন্ঠনালির মধ্যে পাখিকে লুকিয়ে নিল। কিন্তু মরে গেলেও গাঙশালিক নদীচর ছেড়ে কোথাও নড়বে না, দেখো। তুমি যে ওখানেই দিনরাত বাসা বেঁধে ছিলে!

আমরা দুজনে হাত ধরলেই ভারুইপাখি। এবার আমার স্বপ্ন একাই গোটা মাংসপালক হয়ে ওঠার। প্রথমে মনে হয় অনেক সময় দরকার, কিন্তু মুহূর্তেরা খোলামকুচির মতো দ্রুতগামী; যত দিন যায়, প্রতিটা সেকেন্ড থেকে অসংখ্য আমি জন্ম নিয়ে একে অন্যকে অনুসরণ করতে থাকে, যতক্ষণ না শালুকপাতায় একবিন্দু মরীচিকামাত্র হয়ে উঠেছি। ভারুই সেই অবাস্তব আমাকে ত্যাগ করে, যদিও একটু ঘনভাবে লক্ষ করলে বোঝা যাবে পাখি আসলে যাকে হারিয়েছে সে তুমি, তার অনেকদিনের ড্রয়িং।

একটা গাঙশালিক আমি আর তুমি মিশে গেলে। কিন্তু তোমার ঐশ্বর্যের কাছে সমর্পণের শক্তি, তার মানে তোমার সীমাবদ্ধতার কাছে নিজেকে ছুঁড়ে দেওয়ার সাহস আমার আর নেই। ধন্যবাদ, মুখের সামনে আয়না ধরেছিলে, কিন্তু প্রতিচ্ছবির মধ্যেও নিজের বাঁগালের টোল খুঁজে নিতে হয় — সম্ভাবনার পারদ শুধু অর্ধেক সত্যি কথাই বলে যে!

সুতরাং পাখি পৃথিবীর নদীচর ধ’রে আকাঙ্খা আর বিষাদে ভেঙে দুটুকরো হয়ে আছে। আমি শুদ্ধ ব্যঞ্জনবর্ণ, তোমাকে না পেলে কথন হবো কীভাবে?

একজন দার্শনিক হিসেবে বলছি… ৪

চার

মাঝে মাঝে ভাবি, এই বাটিক প্রিন্টের রাস্তা দিয়ে তোমার চলে যাওয়া কি আমার প্রতিভার চিহ্ন বহন করছে না? তারপর দ্বান্দ্বিকভাবে চিন্তা করলে মনে হয়, হ্যাঁ, এসব আমার বাহাদুরি তো বটেই, দুর্বলতাও। যদি তোমার সরে যাওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে আনি, তবে বিচ্ছেদের একটা সামুদ্রিক সুবিধে আছে। সেদিক থেকে দেখলে ভাঙন হয়তো শৃঙ্গারের মতো — বাস্তব আর সম্ভাবনার মধ্যে যে জড়িয়ে ধরাটা কোনও দিনই ঘটে উঠবে না।

বিচ্ছিন্ন মানে আমি সঘন গহন অন্ধকার, এমন নয় কিন্তু। সেই ছোটবেলা থেকেই জানি, ভয় পেলে কীভাবে কথা বলতে হয়। সুযোগ থাকলে সিলভিয়া প্লাথের গলায় কেঁদে উঠতাম। এক সহকর্মী কবি মত দিয়েছিলেন, তোমার কেটে পড়াটা তোমার ফেরত আসা আর কস্মিনকালেও পলট না নেওয়াকে একসঙ্গে উঁচু করে তুলছে — লালুভুলু দুই স্তনের মতো। কিন্তু কী করে অস্বীকার করব, তোমার চলে যাওয়া ভয়ানক বিনাশও ডেকে আনল — তোমার আবার চলে যাওয়ার সুযোগের ধ্বংসাবশেষের মাঝখানে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আমাকে একটা সিগারেট ধরাতে হচ্ছে এখন।

সম্পর্ক-মাদুরের তিন কোনায় দাঁড়িয়ে তিনটে গুলি করেছিলাম, হাসিমুখে। কোথায় লাগল তোমার দেখতে পাইনি, তখন মুখ নিচু করে রিভলভারের নলে ফুঁ দেওয়ার সময়। শুধু জানতাম, হিংসা কী জিনিস টের না পেলে তুমি মহত্বেরও ঠিকানা খুঁজবে না! আজ বাড়ি ফিরে দেখছি, আমার উন্মাদ ল্যাপটপে উড-পেনসিলে লিখে রেখে গেছ বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ। যতই ডিলিট মারি, শব্দের পেছন থেকে ফুটে উঠছে অমরত্ব, বন্যতা, অসীমানন্দ মহারাজ…

সাঁকো

সাঁকো

কে জানিত জাগবে তুমি…
আমার পূর্ব-জন্মভূমি
আমার ছেলের চেয়েও ছোট!
সকালবেলা পড়তে ওঠো?

জালি লাউয়ের ডগার মতন
হাতের ঘায়ে ইন্দ্রপতন!
ক্রিকেট-চাঁদে লাগল জোয়ার
অফ কাটার আর তীক্ষ্ণ স্লোয়ার

খেলা যখন হিংসেগিরি
ধর্ম-ভূগোল-জাতভিখিরির,
তুমি এপার-ওপার সাঁকো।
হারিয়ে দিয়ে হাসতে থাকো!

সখার বাজার

সখার বাজার

এই পৃথিবীর পান্থশালায়
যাকে ধরতে যাই সে পালায়

লুকিয়ে ওঠে অন্য হাতে
শিখিনি ফুলগাছ নোয়াতে

কেঁদেকেটে যেই ঘুমবো
বলে পাঠায় বন্ধু হবো

এই পৃথিবীর বন্ধুশালা
চড়া মেকআপ যাত্রাপালা

এক-জানলা নীতির দিনে
সব পাবে কিছু না চিনে

প্রেমের মোকাম কবরপাড়া
সখার বাজার নজরকাড়া

ধরিত্রীফুলগাছ

ধরিত্রীফুলগাছ

সৌন্দর্য, আমাকে স্নিগ্ধ চোখে চোখে রাখো

বাতাস শান্তিপীড়িত, বাতাস কীটবাসস্থান
আর প্রেমিক-প্রেমিকা ফোঁড় আছে অন্ধকারে
সিক্ত-অভিসিক্ত দুই পাখি
গালে ছোট ছোট সুশ্রী চাঁদের কারখানা

ওই যে ষোল শাখার ধরিত্রীফুলগাছ
কিছু না কিছু পাপড়ি সবার মাথায় —
আমি সেখানে লেখা কুড়োতে যাই
দেখি রোগা একটা আহারে ইঁদুর, তার দিন শুরু হল
আলো এসে বসেছেন ঝিঙেক্ষেতে স্বয়মাগতা
তারপর আজ রাতে যতবার শরীরে গিয়েছি
ছোট্ট সোঁতায় শুধু মাছ চমকে ওঠার শব্দ

তুমি আর বিবাহ করো না
আমার শান্ত পোতাশ্রয় হয়ে যাও!

ভালোবাসার জলকামান দুজনে ঘুরিয়ে দেব পৃথিবীর দিকে…

সূর্যসহকারী

সূর্যসহকারী

আমার প্রথম পংক্তি সূর্যশ্লোকে ভরা
মাটিকে অচ্ছুত করে গাজর-রশ্মিরা
উঠে যায় আকাশের সবজি-গুদামে
আমার দ্বিতীয় পংক্তি ঘিরে রাত্রি নামে

সবুজ গাছের মাথা মেঘ-সহোদর
মস্তিষ্ক দু’ফাঁক হয়ে শোণিত-শেকড়
টেনে নেয় বোমা, গুলি, বৃষ্টিদুধ গাঢ়
আমার আহার-পাত্রে মৃত্যু বসতে পারো

নিচে বিশ্ব, যুদ্ধে যাবে বিকলাঙ্গ সেনা
কিছু খেতচাষি, কিছু নোনতা কারখানা
বিশুদ্ধ প্রণয় তবু বিরুদ্ধ শিবিরে
স্ত্রী-ধমনী তার, সুপুরুষ টোকা পড়ে…

আমার অন্তিম ভাষা স্নেহ-উচ্চারণ
আকাশ সুরেলা করা সে-কবি চারণ
মুছে যায়, চক্রাকারে ফিরে আসে তারই
প্রথম জাগ্রত শ্লোক — সূর্যসহকারী

ইনিশিয়েটিভ

ইনিশিয়েটিভ

আমরা জানতাম তুই পাগল হয়ে যাবি
বাসে দুবার ভাড়া দিতিস, কন্ডাকটার স্পেশাল খাতির করত
আবার, বাজার করে ফেরার পথে পেছন-পেছন ছুটছে দোকানদার
আমরা বলাবলি করতাম, ওই দ্যাখো
ভবিষ্যতের উন্মাদ

মাথায় টোকা দিলে কাঁসর বাজে, তাই না!
ভেতরটা দাগ-ধরা, তরকারি কড়াইতে লাগো-লাগো হলে যেমন হয়
তখনও তুই ক্লাসে ফার্স্ট হচ্ছিস, এক চান্সে কলেজপাশ,
তার মধ্যে হঠাৎ জানলা দিয়ে দেখি কি, মায়ের বুকের
ওপত চেপে বসেছিস, আর একবার
বন্ধুর গায়ে, একদম ওপেন, ক্ষুর তুললি

তারপর বীভৎস চুপচাপ…। সেদিন কানে এল
পাড়ায় নতুন ভাড়াটে
দিনের বেলাতেই দরজায় টোকা পড়লে ভয় পায়, ফোন এলে
ধরতে চায় না — আখির ক্যা হুয়া তুমহে!
তোর বউটাকে দেখলে কষ্ট লাগে
টাকা-পয়সা কুড়িয়ে চেন্নাই নিয়ে যাচ্ছে
কিন্তু বিজ্ঞানকে কি অস্বীকার করা যায় রে পাগল…
ফিরে এসেই বা কোন কাজে লাগবি বল তো?
সেই ইনিশিয়েটিভ কোথায়!

পুরনো কবি, নতুন আঁকা: চন্দ্রমল্লিকা

সব পাখি আমার দিকেই উড়ে যায়
প্রশ্নের, উত্তরের সব পাখি
আমার ভেতরে অন্য কোনও দিক পেয়ে গেছে

নাহ, ও ভুল শিস দিয়েছিল। পাখি ভুল ভাঙাতে ওস্তাদ!
বুকের পংক্তি ভেঙে ভেতরে ছুটে আসে আর
পিঠ ভেদ করে এভাবে বেরিয়ে যায় ধারালো পালক
যেন আমি নেই, যেন আমি — কী বলবো — খুব সামান্য জন্মেছি

তবুও পথের গায়ে কেউ পাখি বসিয়ে রাখো তো!
দুখানা হাড়ের ওপর চন্দ্রমল্লিকা
সেই পথ আমাকে উৎসর্গ করে দাও
গাছ ঠিকই রাগ করবে, বড়বাবু গাছ
হয়তো ধমক দিতে পারে
ওকে বুঝিয়ে বলবো, আমি একদম ভালো উড়তে পারি না
সব পাখি অন্ধ তাই সব পাখি গান গাইতে পারে তাই
পাখি যেটুকু মাঙন ভিক্ষে পাবে
তাতে দুজনের একজীবন দিব্যি চলে যায়…

গতজন্মে আমি পাখি হবো

একটা আর্বান ফোক বা (গো)লোকগীতি প্রেম-কিশমিশ

কথা জানো মন জানো না
ও প্রেমিক, কাচ-বাসনা!
আনা চার খুঁজতে গিয়ে
লাখে অনাচার ক’রো না

জল কি বাঁধতে পারো?
বান যায় পড়শিঘরও
মিলমিশ না হয়ে দু’মন
প্রেম-কিশমিশ পেল না

হার্টস-এর টেক্কা চেপে
খ্যালো তাস খেপে খেপে
প্রেমে শর্ট নিতে গিয়ে
ও-শিওর পিঠ হবে না

ট্রেনে কত উঠল হকার
নিমে, নবী, যিশু অবতার
তারা সব ধরছে দোহার
মাঠে ফুল হাসে, টবে না…

দ্বিতীয় রূপকথা

একজন দার্শনিক হিসেবে বলতে পারি, তোমার আমাকে ছেড়ে যাওয়া ছিল আন্তর্জাতিক মানের ঘটনা। তুমি পরিহার করেছ, আমার এই স্বীকারোক্তি অবশ্য আমার একধরণের চলে যাওয়াকেও প্রমাণ করছে।

যতক্ষণ না কেউ বলে সে ফিরে যাচ্ছে, নিয়মমতো ধরে নেওয়া হয়, মানুষটা উপস্থিত; আর যদি মুখ ফুটে বলল ‘ঘর বাঁধলাম, বাবি’, তবে তো কথাই নেই। কিন্তু একজন দার্শনিক সংক্ষেপে একজন দার্শনিক বলেই এই কাছে থাকা বা দূরে যাওয়ার রহস্যে সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখে না। সে জানে, যেমন কাল্পনিক বিদায় আছে, তেমনি কাল্পনিক উপনিবেশও, তাই শুরুতেই দ্বিতীয় রূপকথাকে ভেঙে দিতে এগিয়ে আসে।

আবার, হারিয়ে যাওয়াকে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে, বা প্রস্থানের অভিনয়ের সঙ্গেও গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না, যদিও বলা যায়, অভিনয় সবচেয়ে স্থায়ি বাস্তবতা।

তুমি বলেছিলে পাশে আছি, তারপর দেখা গেল মুছে দিয়েছ আমাকে; তাহলে আইন মতো ধরলে, পাশে থাকার সময়ই অগ্রহণ করেছিলে। শুধু তাই নয়, তুমি অনন্তকাল ধরেই দূরে আছ। মানে, ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে একরকম অসীমতা রয়ে গেল। যদি শান্ত আর শান্তিতে থাক, মনে হতে পারে বুঝি আমার মন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছ। আবার এমনও ভাবা যায় যে তুমি হয়তো সম্ভবত শান্ত শান্তিতে বিরাজ করছ অন্য কোথাও।

তাহলে, পরিবেশ সব সময়ই সংকটে রয়েছে। অথচ, আমরা দুঃখের লাগোয়াভাবে সংকটের কথা বলি, সুখের সংযুক্তে বলি না। কেন বলি না?

যদি শক্তি হিসেবে দেখা যায় — তোমার চলে যাওয়া ভীষণ সৌন্দর্যময়, যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। কারণ সৌন্দর্যের গভীরতম ভেতরে বিচ্ছেদ রয়েছে আর সে খুব ক’রে ওখানটাতেই থাকতে চায়।

ওকে বসতে দিও।

দুভাবে রাঁধা পশুমাংস

এক
গত বছর ঠিক এই বৈশাখে আমার অচেতন শরীর আর এন টেগোর-এ ভর্তি হয়েছিল। ডঃ কল্যাণ চৌধুরী, কার সঙ্গে কে জানে, তিনদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ভাসিয়ে তোলেন আমায়। চতুর্থ সকালে বেডের কোনায় বসে গলাটাকে এক্সটেনশান কর্ড বানিয়ে কানের কাছে ফিসফিসানি: কী সমস্যা আপনার, খুলে বলুন তো? খামোখা বিষ খেতে গেছিলেন কেন!

আমি তো মাল্টিস্টোরিড থেকে পড়লাম: বলছেন কী ডাক্তারবাবু! বিষ খাবো, পাগল হয়েছি নাকি?
পাঁচ পাটকাঠি-আঙুল নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলেন: না না, অবসাদে ভোগা রোগিকে ক্লিনিক্যালি পাগল বলা যাবে না। কিন্তু বোতলের গায়ে ‘পয়জন’ লেখা দেখেও তো আপনি ওটা গলায় ঢেলেছেন?

— হ্যাঁ, ডঃ চৌধুরী, লেখা ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি!

এক্সটেনশান কর্ড শীতকালের লাউডগা সাপে বদলে গেল, তোতলা লাউডগা: “ক্‌কী বলছেন! বিষ লেখা, তবুও বিশ্‌…!

— কেননা আমি আমার জীবনে যখনই কাউকে বিশ্বাস করেছি, তখনই ঠকেছি।

দুই
আমাদের যত বয়েস বাড়ে, শিখতে থাকি কীভাবে অন্যের ওপর থেকে ভরসা তুলে নিতে হবে, সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়তে হবে কোন সিজিএস-এফপিএস পদ্ধতিতে। এটা আমার ভেতরে এতো ছোট ছোট ডোজে চালু হয়েছিল যে শুরুতে ধরতেই পারিনি! এখন তো করার কিছু নেই, সুতরাং “অবিশ্বাস” শব্দটাকে আপগ্রেড করে আমি তার নাম দিয়েছি “অভিজ্ঞতা”। অবিশ্বাস নিয়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না — না সম্পর্কে, না খেলার মাঠে। মিলন-বিচ্ছেদ সমান যন্ত্রণার মনে হবে, হার-জিত জিভে ঠেকবে দুভাবে রাঁধা একই পশুমাংস। অভিজ্ঞ সে-ই — যে হৃদয়ের সঙ্গে সব যোগাযোগ সফলভাবে ছিঁড়ে ফেলতে পেরেছে। তাকে এবার কেউ ঠকাক দেখি?

তবু মোপাসাঁর গল্পে মায়ের হৃদপিণ্ডের মতো মাঝে মাঝে আমার মৃত্যুমুখী মনের অস্ফুট গলা শুনি: তুমি নিজেকে ঠকানোর দায়িত্ব অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিজের হাতেই তুলে নিলে বুঝি!

তিন
এদিকে মাছ ছাড়া যদিও বা একবেলা চলে আমার, ভালোবাসা ছাড়া…উঁহু! তাই মানুষের ‘পরে অবিশ্বাসহেতু কেমিস্ট্রির প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া মেনে আমি জিনিস-এর ওপর আস্থা রেখেছি। এখন আমার বাড়ি, আমার ছোট্ট মারুতি জেন, আমার জিন্সের প্যান্টগুলো আর ব্যাংকের টাকাক’টাকে ভালোবাসি। আমার ধারণা, প্রত্যেকটা বাড়িই একরকম স্মৃতিসৌধ আর এও খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করি যে জগতে শুধু স্মৃতিতোরণই অমর হওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাদের দেশের তাজমহল বা কুতুবমিনারই দেখুন না! দ্বিতীয়ত, সম্পর্কের চেয়ে গাড়ি অনেক বেশি নাইলোগ্রিপ। আর টাকা কখনও নিজের ইচ্ছেয় খরচা হয়ে যেতে পারে না। নোট তো মৃত, তাই সে সব সময় আমার মুঠোতেই থাকবে।

চার
আজকাল পুরনো অভ্যেসে কোনও মেয়েকে ভালো লেগে গেলে আমি তাকে জিনিস-এ কনভার্ট করার চেষ্টা করি। মানে একটা ভূমিকা দিই, ধরা যাক, বিয়ে করে ফেলতে চাই। তাকে আমার বউয়ের চরিত্র প্রদান করলাম আর কি। প্রেমিক বা প্রেমিকার চেয়ে একজন স্ত্রী অথবা স্বামী অনেক বেশি সলিড ব্যাপার। রাষ্ট্রের আইন, কোর্ট, সবার ওপরে পুলিশ রয়েছে চরিত্রটাকে ঘনত্ব দেওয়ার জন্যে। প্রেমিক যেন অনেকখানি স্বপ্ন, তাই যেইমাত্র কেউ প্রেমে পড়ল, ওমনি বিয়ের চিন্তা মাথায় ঢুকে যায় — ভালোবাসা কী মারাত্মক ভয়ের বস্তু ভেবে দেখুন তাহলে! আর বিয়ে হলে তবেই তো আমরা একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার যুদ্ধে মেতে উঠবো? যে সম্পর্কের কোনও নাম আছে — বাবা-মেয়ে, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, সেখানেই এই কাহিনি। কে কাকে সংজ্ঞায়িত করবে, কে কাকে কমিয়ে আনবে, কে প্রভু হবে কে দাস?

পাঁচ
এত কথা মনে পড়ছিল আজ বাসে চেপে আর এন টেগোর-এ যাওয়ার রাস্তায়। ভাববেন না, “জেনেশুনে বিষপানের একবছর” পালন করতে আমাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেমন্তন্ন করেছে। রুটিন চেকআপে যাচ্ছি — ছোটখাটো রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি, খুব তেমন বুঝলে একটা সাইকোমেট্রি।

ডঃ চৌধুরী বুকে স্টেথো বসিয়ে আচমকা চমকে দিলেন: আপনি আমার কাছে আসার আগে সঞ্জয় বসুকে দেখাতেন?

কোথায় সঞ্জয় মানে কেন সঞ্জয়..: ধরা পড়ে আমি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে উঠি।

— আমরা দুই বন্ধু মেডিকেল কলেজে এক ব্যাচেরই, এখনও ইন্টারেস্টিং কেস নিয়ে ফোনে কথাবার্তা হয়। ও আপনার ব্যাপারে খুব দরকারি ইনপুট দিল, এদিকে নিজে পুরোটা চেপে গেছেন!

কল্যাণ এবার স্টেথো রেখে নাকের সামনে মেটে-হাতুড়ি উঁচু করলেন: আপনার জীবনে গত কুড়ি বছর একটা স্টেডি প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, অথচ লোকজনকে বলে বেড়ান আমি একা, নিঃসঙ্গতায় ভুগে ভুগে ডিপ্রেশানের শিকার হয়েছি। লজ্জা করে না মানুষকে বোকা বানাতে?

— যাব্বাবা! বিশ্বাস করুন, এসব গুজব একেবারেই ভিত্তিহীন…।

— আপনার মুখে বিশ্বাসের কথা!
ডাক্তারের হাসি অনেকটা এ কে ফর্টি সেভেনের মতো। সাতচল্লিশ সেকেন্ড ব্রাশ ফায়ারিং করে আবার গলা এগিয়ে দিলেন চোখের কর্নিয়ার কাছাকাছি: আরন্ট ইউ ইন লাভ উইথ ইওর আমব্রেলা?

ছয়
— হ্যাঁ, আমি ছাতা পছন্দ করি। ওর শ্যামা রঙ আমাকে মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মা সব সময় মুখনাড়া দিত, কী ছাতামাথা লিখিস! শেষ পর্যন্ত সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল! ও আমার জন্যে অনেক কিছু করেছে, আর আমি দুহাত পেতে নিয়েই গেলাম। আমি হারিয়ে না ফেললে ছেড়েও যায়নি কোনওদিন। আই রেসপেক্ট মাই আমব্রেলা, রোদবৃষ্টি শুধু নয়, ঝড় বা খুব গভীর জ্যোৎস্নাতেও ওর সঙ্গ ভালো লাগে আমার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি ছাতার প্রেমে পড়েছি, প্লিজ বিশ্বাস করুন!

মুখ নিচু করে বসে থাকলাম। সৃষ্টি মানে কি উন্মোচন নয়, ক্রমাগত নিজেকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়া; সত্যি থেকে সরে আসতে থাকা চাঁদের কলাক্ষয়ের মতো, আর তাই মনের অসুখ? চিকিৎসা মানে কি নিজেকে না-জেনেও লম্বা ভয়ার্ত এমআরআই চেম্বারের মতো হিমঠান্ডা স্বীকারোক্তিবাক্সে গিয়ে দাঁড়ানো! দুরারোগ্য একা…