দীপঙ্কর বেরা এর সকল পোস্ট

দীপঙ্কর বেরা সম্পর্কে

আমি বাংলা ভালোবাসি। বাংলাকে ভালোবাসি।

মেঘ পিয়াসা

মেঘ মাঝিদের পাড়ায় বসে সরব ঘোষণা
জল ফুরিয়ে জলের ছন্দ তবু বৃষ্টি হব না
চৌচিরে আজ মাঠ মোহনা আকাশ পানে
কালোর খোঁজে এক পশলা মাটির টানে
কোথাও কোথাও নেচে গেয়ে আষাঢ় মাস
গরম শুধু হেসে বেড়ায় ডাকের সর্বনাশ
গাছের খোঁজে বাদল ঘোরে এদিক ওদিক
ভাঙা পাথর যত্ন করে চাইছে জলের ভিখ।

শ্লোক বচন

পুরোটাই ছায়ামাখা দূরে শোনা গান
তবুও সে হৃদয়ের কণ্ঠ অভিমান
আগল খোলা সম্ভবে মূল্য মাপকাঠি
কিছু তার জন্ম লিঙ্গ রঙ্গ পরিপাটি।
কিছুটা বিশ্বাস পূর্ব আত্মস্থ সঙ্গম
পরিপূর্ণ চেষ্টা লিখ রূপ পারঙ্গম
শিক্ষার মোহ তুলন চরিত্রে চিত্রিত
মুগ্ধ চিত্ত মুক্ত নভে বিহঙ্গ মন্দ্রিত

মায়ামূলে এ সংলাপ আরও বিস্তৃত
যেন তার জাগরণ আগামী উদ্ধৃত
পথ ঘাট ভাট ফুল নদী কলকল
ডুব নৌকো ভুল পার দেখা ছলছল।
মেনে নেয় নাই মানা জৈব আগুয়ান
ভেতর স্রোতে রক্তের কাতর আহ্বান।

.|||

গল্পের অণু- বীক্ষণিক ভাবনা চিন্তা

গল্প এবং অণুগল্প নিয়ে কিছু ভাবা যাক। প্রথমে গল্প ভাবতে বা লিখতে হবে তারপর তাকে অণুর অবস্থানে আনার চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ ভিউ পয়েণ্ট নির্দিষ্ট করতে হবে। আপনি কি দেখছেন আর কি দেখাতে চাইছেন। গল্প এক রকমের জীবনের ছবি। এ ছবি অন্যের সামনে তুলে ধরতে হবে ভিন্ন মাত্রায়। গল্পের আকারে কিন্তু স্বল্প বিন্যাসে। অণুগল্প মানেই কিন্তু ক্ষুদ্র গল্প নয়। অণুতে কিন্তু পদার্থের সমস্ত ধর্মই প্রতীয়মান।

গল্প মানে আমরা সাধারণত বুঝি অন্যকে যেটি সহজে বলতে পারব। সেটি কোন ঘটনা দিক দিশা অবস্থান মর্যাদা ইত্যাদি যা কিছু হতে পারে। আমরা জানি কোন ঘটনার তিনটে দিক। প্রথম আমি যা দেখেছি ( গল্পের ক্ষেত্রে আমি যা দেখাতে চেয়েছি) দ্বিতীয় আমি যা দেখিনি ( এক্ষেত্রে যা দেখাতে চাই নি) এবং তৃতীয় সত্য ( গল্পের ক্ষেত্রে ভিউ পয়েণ্ট লেখকের দিক থেকে এবং পাঠকের দিক থেকে)।

এই তিনটি অবস্থান একা কেউ দেখতে পারে না। অর্থাৎ কোন ঘটনার দেখা, না-দেখা এবং সত্য একজনের পক্ষে কখনই জানা সম্ভব নয়। তাই তদন্তেও সঠিক খুঁজে বের করা মুশকিল। সেই রকম গল্পের ক্ষেত্রে এই ভাবনা বিস্তৃত থাকলেও অণুগল্পের ক্ষেত্রে এই তিনদিকের যে কোন এক বা দুটি দিক শুধু আভাসে অথবা স্পষ্ট কিন্তু কোন মোচড় বা উল্ফনে তা বিদ্যমান রেখেই গল্প চিত্রায়িত করতে হয়। লেখক বা পাঠক তার নিজের মত করে নিজস্ব দিশায় নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

ফলে গল্প পাঠের আবেশ হয় সুদূর প্রসারী। এই সুদূর প্রসারী পাঠক ভাবনায় গল্প হবে বোধগম্য সহজ ভাষায়, পড়ায় যেন কোন ছেদ না পড়ে। বক্তব্যের যেন সরলীকরণ হয়। দৃশ্যপট সহজে পাঠক মনে উদ্রেগ সৃষ্টি করে এবং অবস্থানকে বোঝার জন্য মনের মধ্যে মূলধর্ম বিশিষ্ট যেন অণু ভাবনা তৈরি হয়। জানা গল্প বা অজানা প্রেক্ষাপট অথচ না-জানা বা জানি জানি যেন ভাব থাকে।

অতএব আপনি যদি গল্পের পদার্থ ঠিক করতে পারেন তাহলে গল্পের অণু এসে যাবে। স্বচ্ছ ভাবনা, স্বচ্ছ নিরীক্ষণ এবং স্বচ্ছ উপস্থাপন গল্প লেখার প্রাথমিক অবস্থান। তারপর তাকে আরও সঠিক ভিউতে অবস্থিত করে দিতে হবে। তবেই অণুগল্পের দিশা নির্দিষ্ট হবে।

তার মানে গল্প লেখা বা ভাবার মুন্সিয়ানায় আপনার দেখা, না-দেখা এবং ভিউ পয়েণ্ট চরিত্রের মধ্যে ছড়িয়ে দিন। তারপর দেখবেন সেই চরিত্র যে গল্প বয়ে আনবে তাই গল্প থেকে অণুগল্পে বিন্যস্ত হয়ে যাবে। গল্পের সব চরিত্র স্পষ্ট প্রতীয়মান কিন্তু কিছু লেখক ছেড়ে দেবে, কিছু পাঠক খুঁজে নেবে, কিছু দুজনেই আবেশে অবস্থিত হবে। তবেই গল্পের প্রকাশ আরও তীক্ষ্ণ হবে।

কাদম্বিনীর আত্মকথা (রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট চরিত্র)

আমি কাদম্বিনী। আমিই মরে প্রমাণ করেছি আমি মরি নি আজও বেঁচে আছি। কি দূর্বিসহ এ যন্ত্রণা বুকের মাঝে। যারা মিথ্যে করে বলল আমাকে মরে যাওয়ার পর শ্মশানে দাহ করে এসেছে তারা সত্যি হয়ে গেল। আমি তো নিজেকে নিজে বিশ্বাস করাতে পারি নি যে আমি বেঁচে আছি। আমি তো ভেবেছিলাম আমি এই পৃথিবীর জনসমাজের আর কেহ নই – আমি অতি ভীষণ, অকল্যাণকারিনী; আমি প্রেতাত্মা। তবুও সইয়ের কথা মনে পড়ল। কিন্তু সেখানে জীবনের রহস্য পেলাম কই? মৃত্যুর ব্যবধানে পৃথিবীর লোক আর আমি যেন শূন্য ছায়া।

মৃত্যুকে সবাই ভয় পায়। তবু সে আসে। ছায়া হয়ে জীবনের মায়ায় মানুষ ভয় নিরপেক্ষ হতে পারে না। আমি তো বাঁচার চেষ্টায় নিজেকে পৃথিবীর বাইরে হতে চেয়েছিলাম। সইকে আমি বলেছিলাম আমি মরে গেছি এছাড়া আর তো কোন অপরাধ করি নি। কিন্তু নিশ্বাস প্রশ্বাসের এ দায়ভার নিয়ে কোথায় যাব।
কিন্তু কেউ শুনল না। শেষ পর্যন্ত আমার নাড়ির টান, জীবনের সন্ধান খোকার কাছে ফিরে বুঝলাম আমি মরি নাই। খোকাকে জল দিলাম। বুকে টেনে নিলাম। আমি মুখচুম্বন করলাম। প্রশ্বাসে নিশ্বাস মিশে আমাকে আমাকে জীবিত উজ্জীবিত করলাম। আসলে আমি জীবিত। নিজের কাছে নিজে প্রমাণ পেলাম।
কিন্তু খোকাও যে। এ পৃথিবীর। তার চেতনায় চলে মানুষের ছায়া অবয়ব। সে সেই ছায়া সহ্য করতে পারল না। মায়া জড়ানো হৃদয়ের চেতনা মানতে চাইল না। সেও বলল কাকিমা তুই তো মরে গেছিস। তুই যা।

আমি বাটি ঠুকে রক্তেও প্রমাণ করতে পারি নি আমি বেঁচে ছিলাম। বেঁচে আছি। পরলোক আসলে সাজ মাত্র। মনের ভ্রম। কিন্তু সে ভ্রম আর ঘোঁচে না। পৃথিবীর কোণায় কোণায় শুধু জীবনের উল্লাসে আরও কত জীবন এভাবে আমি কাদম্বিনী হয়ে বেঁচেও মরে আছে, মেরে দেওয়া হচ্ছে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে। আমি তো সাঁতার জানতাম। শ্মশানের ধারের পুকুরের পুণ্য অর্জনের জন্য স্নানে যেতাম। কিন্তু সেদিন বৃষ্টির রাতের মত এখনও পৃথিবীর বুকে ঝপাস করে শব্দ হয়। অনেকেই শোনে দেখে বোঝে তাও না-দেখা না-শোনা বা না-বলার ভান করে। আর জীবিত কাদম্বিনীদের মৃত হয়ে যেতে হয়। এছাড়া আর কোন রাস্তা তার জন্য রাখা হয় না।

না ভাবনার কিছু বিচিত্র

ভাবনা এভাবে শুরু করা যেতে পারে। ছেলে না মেয়ে। নারী না পুরুষ। সমান তালে দুজনেই সমরেখ কি?
যদিও প্রথম পার্থক্য। নারী এবং পুরুষ।
কিন্তু শিশু বলতে উভয়কেই বোঝায়। আর তাদের মানুষ হিসেবে মানুষ করার দায়িত্ব থাকে বাবা মায়ের এবং সমাজের। এই মানুষ করা ভাবনা থেকে ছেলে মেয়ে বিভাজন শুরু হয়ে যায়।
মেয়ে মানুষ করার ক্ষেত্রে পর পর ভাবনা থাকে। আর ছেলে আপন আপন। অর্থাৎ নিজের বা নিজেদের কাছে কাছাকাছি রাখা বা রাখা যাবে এই ভাবনায় শিশুটির খাওয়া পরা দেখাশোনা আদব কায়দা ও পড়াশোনা ইত্যাদি নির্ধারিত হয়।
যেমন, মেয়ে অন্যের বাড়িতে চলে যাবে তাই যতটা শিখে শিখুক না হলেও ক্ষতি নেই। ফলে সেও সেই মানসিকতায় বড় হয়। হয়তো বাড়ির কেউ সেভাবে ভাবে না। কিন্তু সমাজ দেখে এবং শিশুটিও দেখে। ফাঁকির রাস্তা সেখান থেকে শুরু।
অন্যদিকে ছেলের ক্ষেত্রে একটা কিছু করতেই হবে। তার মানে সেভাবে চাপ তৈরি করা। আবার সেই চাপের জন্য সেই চাপে সেই শিশু কিছুটা রাস্তায় ফাঁক খুঁজতে থাকে। তার মানে, ছেলেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো মানসিকতা, না হলে বাবা মায়ের ব্যর্থতা প্রকট। আবার মেয়ের ক্ষেত্রে সেই মানসিকতা হল, কিছু করা গেল তো ঠিক আছে, না হলে ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব ওখানে ভাল থাকবেই।
তাহলে কি দাঁড়াল? ছেলে মানুষ করা কঠিন, মেয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সহজ। আপনাকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় আপনি কি চাইবেন? ছেলে না মেয়ে? ভাবুন।
এবার ছেলের ক্ষেত্রে আপনি টিন এজের পর আর তার যৌবন আগমন জনিত কাজকর্মের অনেককিছুই টের পাবেন না। দেখবেন বাবা মায়ের নানান ঘেরাটোপের বাইরে সেও ঠিক চালাকি অনায়াসে বেছে নেয়। কিছুতেই মনের খারাপ ভাল ইত্যাদির হদিশ পাবেন না। বাবা মা যতই বন্ধুর মত ব্যবহার করুক, বন্ধু যে হাতছানিকে ডাক দেবে, প্রশয় দেবে তা বাবা মা কিছুতেই মেনে নেবে না। অর্থাৎ সে কিছুতেই আপনার সাথে সে সব শেয়ার করবেই না। এই হাতছানি থেকে অনেক ছেলে বেরতেই পারে না। অনেক সময় জানা গেলেও তখন অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। নাগালের বাইরে।
সে তুলনায় মেয়ে আপনার সীমানার মধ্যেই থাকবে বা থাকে। যেহেতু আপনি জানেন মেয়ে মানেই অনেকটাই বেশি মান সম্মান জড়ানো। সেও নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কে সমাজের ভিন্ন মানসিকতায় ওয়াকিবহাল। তাকে সেই মর্যাদার বিবেচনায় বড় হতে দিলে খুব একটা অসুবিধা হবে না। সে তার সমস্ত হয়তো মাকে কিংবা বাবাকে বলবে না বা বলতে চাইবে না। কিন্তু ঠিক মত ওয়াচ করলে হয়তো বোঝা যেতেই পারে। বাইরের অনধিকার হাতছানিতে মেয়েরা চট করে সাড়া দেয় না। সে তার সীমানায় একটা বেড়া খুঁজে পায়। বাবা মায়ের অনেকবেশি না-নজরে সে বেরিয়ে যেতে পারে। না হলে সম্ভাবনা কম।
আবার ঠিক একই রকমভাবে নেশার ক্ষেত্রে মেয়েদের মধ্যে যতটা ছড়ায় ছেলেদের ক্ষেত্রে তা পুরো শতাংশই ছড়িয়ে যায়। এই নেশা ধরা পান বিড়ি সিগারেট খৈনি গুটখা মদ ভাঙ ড্রাগ ইত্যাদি কিছুতেই ছেলেদের ক্ষেত্রে ওয়াচ করেও ধরতে পারবেন না। যেদিকে বাঁধন দেবেন তার ঠিক অন্য দিকে দিয়ে অন্য রাস্তা খুঁজে ছেলেরা বেরিয়ে যাবে। ঠিক এই কারনে সমস্ত নেশা সামগ্রী বেশিরভাগ ছেলেদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ছে।
মেয়েরা যদিও বা করে আপনি এলার্ট থাকলে তা সহজেই ধরতে পারবেন। বাবা মায়ের দায়িত্বশীল ভাবনায় সহজেই ফিরিয়ে আনা যায়।
এই বিপথে যাওয়া ছেলে মেয়ের মধ্যে মেয়েকে যত সহজে ফিরিয়ে আনতে পারবেন ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। যদি না ছেলে নিজে ফিরতে না চায়। একটা জেদি একগুঁয়ে ভাব কাজ করে। এই একগুঁয়ে মনোভাব মেয়ের ক্ষেত্রে যতটা পরিবর্তনশীল ছেলের ক্ষেত্রে ততটা নয়। তাই বিপথে যাওয়া থেকে ফেরাতে ছেলের ক্ষেত্রে খুব সাবধানে মেপে এগোতে হয়। কখন কি করে বসে কিংবা আরও বেশি কিছু না হয়ে যায়। মেয়ের ক্ষেত্রে এই ফেরানো একটু রূঢ় হওয়া যেতেই পারে। আর একটু বেশি নিরাপত্তা নির্ভরতার আশ্বাস দিলে সহজেই মানানো যায়।
এবার যদিও আপন তবুও যদি এ রকম ভাবনা ভাবি যে এই শিশুটি শুধু ছেলে, এই শিশুটি শুধু মেয়ে। তাহলে দুজনকে যদি সমানভাবে মানুষ করি তাহলে মেয়েরা যার ঘরে যাবে তার ঘর থেকে মেয়ে বেরিয়ে আসবে ফলে সবার ঘরে এই মানুষ করা মানসিকতায় জোর থাকবে। ছেলেও এই বিভাজন থেকে বেরিয়ে আপনাআপনি দৃঢ় চেতা হতে শিখবে।

বাঁচার অস্ত্র

ডান হাতে কাস্তে
বাবা বলেছিল – এ আমার অস্ত্র
বাম হাতে আমাদের কাঁধ
বলেছিল – এ আমার ঢাল
মা সব্যসাচী
খুন্তি বাসন ঘরদোর
দাদা দিদি ঘিরে রাখত
সম্পর্ক বেড়া
সব মিলিয়ে
আমি কলমখোর
আমাদের সবার অস্ত্র আছে
তাতেই আমরা রোজ বাঁচি।

আমাদের যাত্রা

কি যেন একটা দৈর্ঘ্য বরাবর বালুকারেখা
আমি ফেলে আসা দূর সীমানায় কিছু দেখা

ঢেউ গোনা অবসরে জ্যামিতিক প্রতিচ্ছবি
গলুই ভাবনায় মায়াবী রঙে বিষণ্ণ সবই

দিকচক্রবাল নোঙর ফেলে নি কতকাল
মুহূর্তের হাতে গোনা রহস্য মাপছে রত্নজাল

তোমার শ্বাস আঁকছে দিগন্তের অজেয়বাদ
আমি তাই অনাবিল নদী চর বাদানুবাদ

যে বেঁধেছে সেও ভেসে যাবে মোহনায়
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নৌকো ঐ দেখা যায়।

ভাষা বাংলার চিন্তায় ভাবনা

বাংলা বই ও বাংলা ভাষা ক্রমশ অধঃগামী। আর এ আলোচনা রাস্তা ঘাটে গ্রাম বাংলার অলিতে গলিতে শোনা যায়। প্রথমে জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমরা পড়াশুনা করি কেন?
ভবিষ্যতে সেই পড়াশুনা দ্বারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান এবং শিক্ষা তথা ডিগ্রী ভবিষ্যতে কতটা কার্যকরী। অর্থাৎ বাংলায় তেমন কাজ আছে কি? ধীরে ধীরে মন্দার বাজারে কর্মক্ষেত্র কমছে। কাজের জন্য বাংলা ছেড়ে অ-বাংলাভাষীতে যেতে হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে আরও যেতে হবে। তাহলে বাংলা ভাষার সাথে থেকে এ রকম কর্ম প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়তে হয়। শিক্ষালাভ যদি অন্য ভাষার সাথে করে থাকি তাহলে বাংলাতে থাকতে অসুবিধা হবে না। আবার বাংলা ভাষার বাইরে তো অসুবিধাই হবে না। তার মানে বাংলা ভাষার জন্য পিছিয়ে পড়া।
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে যে যার মাতৃভাষার সাথে ইংরেজী বা অন্য ভাষায় শিক্ষার বিস্তার ঘটায়। যে বা যারা উচ্চ শিক্ষায় পারদর্শী হতে পারল তারা সহজেই বাইরে ছড়িয়ে পড়ল আর যারা মোটামুটি শিক্ষা অর্জন করে তারা সেখানেই কিছু কাজ কর্ম জুটিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে দেয়। বাংলা ভাষা অঞ্চলে এই কর্ম সংস্থান একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর।
উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজী ছাড়া কিছু হবে না। অনার্স কোর্স থেকে শুরু করে কম্পিউটর, সায়েন্স, থিসিস গবেষণা এবং ডাক্তারী ইঞ্জিনিয়ারিং নার্সিং ম্যানেজমেণ্ট ভোকেশনেল সবেতেই ইংরেজী প্রয়োজন।
পেটের খিদে মেটার পর শুরু হয় মনের চাহিদা। সব বাবা মা ছেলের মিনিমাম খিদে মেটানোর সংস্থানের রাস্তা খোঁজে। সেখানে প্রথম অফসান চলে ইংরেজী। পারুক না পারুক। কেন না বাংলায় কিছু হবে না। সে বাংলাতে থেকে কিংবা বাংলা ভাষাতে থেকে। এই বাংলাতেই বাইরের অনেকেই বিজনেস করছে কেন না বাংলার নিজস্ব বাংলাভাষী সংস্থান কোথায়?
এর পরবর্তী অবস্থান বাংলায় চর্চা। শুরুতেই সেখানে গলদ বড় আকারে বিস্তারিত সেখানে এই চর্চা রহিত। কর্মক্ষেত্রে কোন চিঠি চাপাটি পড়া বা লেখা কোনটাই বাংলায় নেই। সে সরকারী হোক বা বেসরকারী। সমস্ত প্রায় ওয়েবসাইট নির্ভর। পুরোটাই ইংরেজী। ফলে কর্মক্ষেত্রে প্রায় সবাই বাংলা ভাষা কেবল নিজেদের মধ্যে বলে আর সকালে চোখ বোলানো খবরের কাগজ পড়ে। অর্থাৎ কোন অফিস আদালতে বাংলা অনেকটাই প্রবেশ নিষেধ। যে টুকু অচেনা অজানা ঠকমক বাংলা ভাষায় দু একটা দরখাস্ত আসে তাও বোধগম্যের বাইরে। এর বাইরে কিছু শিক্ষক মহাশয় এবং সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়েরা এবং বাংলা ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রী বাংলা বই নাড়াচাড়া করে।
তাহলে বাংলা ভাষার প্রসার বা বাংলা ভাষা কিভাবে জগতে নিজস্ব স্থানে অটুট থাকবে। এর পর আছে সাহিত্যপ্রেমী ও লিখিয়ে। অর্থাৎ যারা গল্প উপন্যাস ও কবিতা লিখছে। তারা কতটা টানতে পারছে পাঠক সমাজকে। বইমেলায় নামী প্রকাশক কতটা সবে নামকরা বা অনামীদের স্থান দিচ্ছে তার মূল্যায়নে কিছুটা হলেও ভাষা অবস্থিত হয়। সেখানে দেখবেন সেই বঙ্কিম শরৎ হয়ে সুনীল শীর্ষেন্দু সুচিত্রা জীবনানন্দ শঙ্খ জয় শ্রীজাততে থেমে গেছে। পরবর্তী তেমন আসছে না।
কেন আসছে না? নামী প্রকাশক বাধা দিচ্ছে, না কি গভীরতার অভাব আছে? ভাবার বিষয়। উপরে উপরে ভেসে বেড়ানো কেউ সহজে নেবে না। কালের নিয়মে তার হারিয়ে যাওয়া নিশ্চিত। অল্প ভাবনা অল্প পাঠ অল্প নিরীক্ষণ এবং অল্প বিষয়ীকরণ এই বাংলা ভাষা হারিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী নয়তো?
নাক ঘুরিয়ে পাঠককে বোকা বানানো, সরকারী তকমা বা অন্য পুরস্কারে পুরস্কৃত লেখক বা কবি কেউকেটা হয়ে যান। কত পুরস্কার। অথচ তিনি হয়তো জানেন না “অর্থাৎ পেছন ফিরিয়ে সিগারেট খায়”।
আবার অনেকেই আছেন তাঁর বই বিক্রির খতিয়ান প্রকাশ্যে বিতরণ করেন। কিন্তু লাভ কি হচ্ছে? বাংলা ভাষাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? যদিও গল্প উপন্যাসের বই বিক্রি হচ্ছে তাও একবার পড়ার পর তাকে আর ছুঁয়ে দেখছে না। পরবর্তী প্রজন্মকে বলছে – ওটা থাক বাবা, তুই বরং শীর্ষেন্দু পড়। সুচিত্রা পড়। কিংবা চেতন ভগত। তাহলে আপনার বই বিক্রি হয়ে কি লাভ হল? ভাবুন। আপনার সামনে বা বইমেলায় অটোগ্রাফের জন্য বই কিনল ( কেন না বেশির ভাগ লেখক নিজের বই ছাড়া কোন ডাইরি বা অন্যের লেখা বইয়ে অটোগ্রাফ দিতে চান না)। তারপর ফেলে রেখে দিল। তাহলে বাংলাভাষা কি করে এগোবে?
অর্থাৎ আসল বিষয় হল গভীরতা। যা খুবই প্রয়োজন। তার জন্য নিজেকে পড়ার সাথে নিরীক্ষণ করা খুবই জরুরী। বাংলা ভাষায় যে গভীরতা রবীন্দ্রনাথ বিস্তৃত করে গেছেন, জীবনানন্দ প্রসারিত করে গেছেন তার আরও তলদেশে ডুব সাঁতার দিতে হবে। এবং লেখক হিসেবে কবি হিসেবে সেই মুক্তো তুলে আনতে হবে। না হলে তুমি আমি নিয়ে লেখা, চুটকি, ছড়া, বোরোলীনে সারানো ক্ষতের মত ক্ষত থেকে যাবে। আর ভাষা হবে পঙ্গু।
বাংলা ভাষা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাবে চিৎকার করে কি লাভ? সেই বনলতা সেন, সেই চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, সেই শেষের কবিতা, সেই রক্তকরবী, সেই চাঁদের পাহাড়, সেই মনোজদের অদ্ভূত বাড়িতে বাংলা সাহিত্য আটকে গেছে। যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল তারা আবার ঘরের ভেতরে। ভাসছে উপরে উপরে।
সে তুলনায় অন্য ভাষা আরও তলদেশে ডুবছে। খুঁজে আনছে মুক্তো। সেক্সপীয়ারকে সাথে করে অনেকটা দূর পাড়ি দিয়েছে। বাংলা ভাষা বাঁচানোর এটাও অন্যতম রাস্তা। আমি আমার ছেলেকে ধমকে বলতেই পারি যা ওদিকে যা। সে আমাকে দেখিয়ে এগিয়ে যাবে। যদি তার মনের মত হয় সে নিজেই সে পথে যাবে না হলে হঠাৎ রাস্তা পাল্টে ফেলবে। সে রকম বাংলা বই আপনাকে দেখিয়ে কিনবে কিন্তু যদি রসদ না পায় খেলো কথায় তাকে ভোলানোর চেষ্টা করা হয়। তাহলে সে রাস্তা বদল করবেই। এখনকার এ রকম অনেক লেখক আছে। উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে তাতে লাভ হবে না। দায়িত্ব সবার।
লেখক বা কবি বা এই চর্চার সাথে যুক্ত সবাই এক গোত্রীয় হওয়া উচিত। সবার উচিত আলোচনায় গভীরতায় অগ্রবর্তী হওয়া। অর্থাৎ পেছনে কেউ নেই। যারা চর্চায় তারা প্রত্যেকের লেখা পড়ুক। আত্মগম্ভীরতা বড্ড বেশি দেখা যাচ্ছে। ভাবছে আমার বই তো বেশ বিক্রি। তাহলে আর ওদিকে তাকিয়ে লাভ কি?
এবার আসা যাক গ্রাম বাংলার কথা। যাদের ভরসায় কিন্তু বাংলা ভাষা এখনও জীবন্ত উজ্জীবিত। খেটে খাওয়া জীবনযাত্রায় বাংলাভাষা স্বমহীমায় প্রতিষ্ঠিত। গাঁথা গান পাঁচালি যাত্রা মঙ্গলকাব্য গীতিকা কীর্তন লোকগান ভাটিয়ালী এখনও নানান ভাবনা চিন্তায় নিজের মত প্রচারিত। সেই মাটির সাথে বাংলা ভাষা শালুক ফুল তোলে ডিঙি বায় বৃষ্টিতে ভিজে চাষ করে। শহুরমুখী তথাকথিত ধীরে ধীরে বাংলাভাষা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা এই সব মানুষী বাংলাভাষার পরম হৃদয়। এদের জন্যই কোনদিন কোনভাবেই বাংলাভাষা হারিয়ে যাবে না।

ছায়াময়

ডুবে যাওয়া ছায়া
আমার কোন অংশীদার নয় তো?
না শেখা নত মস্তক
তোমার আদিখেতায় কাটিয়ে দিচ্ছে যুগান্তর
আলো উদাসী সম্ভাবনায় গভীরের সমারোহ
আমি শুধু তার দুপুর কীর্তন।

জেগে আছে যে মহা তৃষ্ণা
অপরূপ প্রদীপ্ত চক্রবালে
তারই কণায় কণায় আমি খুঁজি মতান্তর
বয়ে চলে যায় অনতি সময়
তোমার হাত ধরে
আমাকে ছিনিয়ে।

ভাষার আপন

-সাব হিন্দি মে বাতাইয়ে না?
এই কথা শুনতে শুনতে ভরণের খুব রাগ হয়। সকাল থেকে প্রায় এই নিয়ে দশবার হল। উত্তর দিতেই হল – কিঁউ তুম বাংলা সমজতে নেই?
– থোড়া থোড়া সমজতে হ্যাঁ। ফিরভি?
– ফিরভি? কিঁউ ফিরভি? কাঁহা সে আয়া হো।
– উধার বড়া সা রাজ্য সে।
– ক্যায়া ভাই। উধার বাংলা চলতা হ্যায় ক্যায়া। কৈ বলেগা, স্যার বাংলায় বলিয়ে না। তো বাংলা বলে গা, ক্যায়া? তো তুম যব ইঁহা পর র‍্যাহেতে তো, বাংলা শিখলো। ঠিক হ্যায় কি নেহি?
– ক্যায়া সাব। ইতনা সব কুচ হিন্দী মে বোলা, লেকিন এ জো মুচকো দিয়া হ্যায় ও হিন্দী মে বলিয়ে না?
আরও সব উপভোক্তা লম্বা লাইনে। চিৎকার জুড়ে দিল – আপনি বড্ড কথা বলেন মশাই। ওকে একটু হিন্দীতে বলে দিলে ক্ষতি কি? ও তো বুঝতেই পারছে না?
ভরণ চেষ্টা করল বোঝানোর – কে বলেছে ও বুঝতে পারে নি? ভালই বুঝেছে।
সেই ভদ্রলোককে আবার ভরণ জিজ্ঞেস করল – কত দিন এখানে এসেছ, ভাই।
– আমরা তো আসি যাই। তা বছর চার পাঁচ হয়ে গেল। বাবা মা কাকা সবাই আছে এখানে।
ভরণ এবার উপভোক্তাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল – দেখলেন। ভালই বাংলা জানে। শুধু আমাদের দিয়ে হিন্দী ভাষাটি বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
সময় চলে যাচ্ছে। উপভোক্তাদের আর তর সইছে না। বলে বসল – আর বেশি বাতেলা মারতে হবে না। হাত চালাইয়ে। হামকো ভি কাজ মে যানা হ্যাঁয়।
ভরণ আর একটু গলা চড়াতে বাধ্য হল – কি ভাই? তুমিও। নিজের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাও।
একজন তেড়ে ফুড়ে এগিয়ে এল – এই চুপ! হিন্দী উচ্চ ভাষা হ্যায়। সমজে মিঃ। আর বাংলার আছে টা কি? যতসব ব্যাকডেটেড।
ভরণ আর কিছু বলল না। আমাদের আমরাই যেখানে চাই না সেখানে একা ভরণ আর কতটা কি বা করতে পারে।
কাজ শুরু করে দিল। হিন্দী বাংলা ও কিছু ইংরেজী মিশিয়ে। এছাড়া আর উপায় কি? বাসে ট্রামে ট্রেনে রাস্তায় রেঁস্তরায় সর্বত্র হিন্দী ইংরেজী মেশানো ভাষ্য। এখানেও দেখল আমরা নিজেরাই খুব একটা বাংলা বলতে চাই না। পারে না তাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অন্য ভাষা বলছে, তাও বাংলায় বলছে না। যেন প্রেস্টিজ চলে যাবে।
সেবার ভরণও তাই করেছিল। একটা নামী কোম্পানির ব্যাগ সারাই করতে গিয়ে শুরু করল হিন্দীতে। ঠিক বোঝাতে পারছিল না। তাও। আর সেই ভদ্রলোকের দ্রুত হিন্দীর পাশে একটু পরেই কুপোকাৎ। ভদ্রলোক স্পষ্ট বাংলায় বলল – আপনি তো নিপাট বাঙালী মশাই। তো বাংলায় বলুন। নিজের ভাষার চেয়ে মধুর কিছু হয় না। কেন বলেন, এ রকম।
ভরণ বাংলা ভাষা নিয়ে এত গর্ব করে। বাংলা নিজের খুব প্রিয়। কত গল্প উপন্যাস কবিতা পড়েছে। সব সময় বাংলা গান গুনগুনিয়ে আপন মনে গায়। ছেলেকেও বাংলা মিডিয়ামে পড়াচ্ছে। আজ কেন এমন করল। ভরণ নিজেই লজ্জা পেল।
ব্যাগ সারিয়ে ধন্যবাদ ও নমস্কার জানিয়ে ফিরে এল। তারপর থেকে আর নয়। বাংলা ভাষা যেহেতু তার মাতৃভাষা তাই সেই ভাষাতেই যতটা সম্ভব বলার চেষ্টা করে। সামনে যে থাকে তাকে দিয়ে বাংলা ভাষা বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
কাজ শেষ করে ভরণ বাড়ি ফিরছে। একটু দূরে বাসস্ট্যাণ্ড। সেখানে সকালের সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। বলল – নমস্কার স্যার। ডিউটি শেষ হল। বাড়ি ফিরছেন।
ভরণ একমুখ হাসল। বলল – হ্যাঁ। বাস এসে গেছে। যাই।
বাসে উঠে ভরণ শুনল – স্যার, ভাল থাকবেন।

অনন্ত রচনায়

রাত্রি শুয়ে আছে কথার গল্পে
তোমাকে ছুঁয়ে অবিনশ্বর শয্যা
দুদণ্ড জিরানো নিত্যভোগী সুখ
আমাকে খোঁজে প্রেম প্রেম মজ্জা,

উপত্যকায় শারীরিক কিছু ঢেউ
আছড়ে পড়ে তুমি বালুকাবেলায়
কারুকার্যের ধৃতিমান আমি সুর
পরাগত গেয়ে যায় অনন্ত রচনায়।

ভাঁজ হৃদয়ের মুখোটি দৃশ্য মূলে
ফুল বাতাসের পাখি লেখা গান
তোমাকে খোঁজে আমি নীড়ে ফেরা
বাড়ানো হাতের অপেক্ষা সম্মান ।