দীপঙ্কর বেরা এর সকল পোস্ট

দীপঙ্কর বেরা সম্পর্কে

আমি বাংলা ভালোবাসি। বাংলাকে ভালোবাসি।

বাছারে

আহা রে বাছা রে
হেসে মুখ আয় রে
কিছু মুখ রেখে যা
মুখোমুখি বসে যা,
সেই মুখে তুই ক
কথা বলা ওই খ
ভাবে আঁকা অন্তর
তুমি আমি মন্তর,
হেরো গেরো যাই হ
ডাল ধরে হাত হ
পাশে দেখ আমি রৈ
রামা হৈ বামা হৈ।

কোন রাজনৈতিক নয়

যে কোন দেশ চালায় রাষ্ট্রনেতারা। সেই রাষ্ট্রনেতা রাষ্ট্র চালায় সরকারী কর্মচারীদের মাধ্যমে। প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা চাইবে নিজস্ব ক্ষমতা দখল করে রাখার জন্য যা ইচ্ছে খুশি শাসননীতি। সেই শাসননীতি পূর্ববর্তী আইন মোতাবেক অথবা নতুন তৈরি আইন মোতাবেক করতে হয়। এই আইন বা নীতি কার্যকর সরকারী আমলাদের দ্বারাই হয়। সরকারী আমলা এবং অন্য সব শ্রেণি যদি আইন বা নীতির প্রতি সঠিক শ্রদ্ধাশীল হয় তাহলে জন প্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতার পক্ষে দুর্নীতি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাষ্ট্রনেতাদের পছন্দ হয় নি এমন আমলা বা সরকারী কর্মচারীকে সরিয়ে অন্য একজনকে নিয়ে আসে। সেও কিন্ত সরকারী কর্মচারী। তাহলে তাকে দিয়ে রাষ্ট্রনেতা নিজের ক্ষমতা বাঁচানোর প্রক্রিয়া করেন। যদি সমস্ত স্তরের সরকারী কর্মচারী বা আমলা শ্রেণি নীতিও আইন মোতাবেক কাজ করে এবং দৃঢ়চেতা দুর্নীতি মুক্ত থাকে তাহলে কোন সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হতেই পারে না।
এক রাষ্ট্রনেতা কোন সরকারী জায়গায় নিজস্ব মনমানি করল। সেখানে কর্মচারী তার প্রতিবাদ করল। সেই রাষ্ট্রনেতার তা ভাল লাগল না। সেই রাষ্ট্রনেতা প্রথমেই ওই কর্মচারীকে বদলী করতে চাইবে কোন দূর প্রদেশে। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই কর্মচারী বদলী করতে হলে অবশ্য আর এক ওই দপ্তরের উপরওয়ালার সাহায্য নিতে হবে। অর্থাৎ অন্য উপরওয়ালা বদলীর অর্ডার করবেন ওই রাষ্ট্রনেতার কথা শুনে।
ওই উপরওয়ালা যদি রাষ্ট্রনেতাকে বাবু বাবু না করে একটু দৃঢ় মনোভাব দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী সম্বন্ধে জেনে বুঝে অর্ডার করেন তাহলে সেই প্রতিবাদী কর্মচারী নিজস্ব কাজ আরও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারে। তার ইমিডিয়েট অথরিটি এবং বদলীর আদেশকারী যদি সহযোগিতা করে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হয় না। কর্মচারী বদলীর ভয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বা রাষ্ট্র পদাধিকার নেতার মনমানি মত কাজ করতে বাধ্য হয়। কেননা তার যেসব আপন সরকারী অফিসার ও আমলা সম্প্রদায় আছে তাঁরা তাকে সহযোগিতা করে না। সেই রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনেতাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে কাজকর্ম সরকারী আদেশনামা বা আইন বা নীতির ফাঁক খুঁজে ফাঁক অনুযায়ী কার্যকরী হতে থাকে। ফলে সামাজিক ও সংস্কারী উন্নতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারী যে সব টাকা বিভিন্ন খাতে দেওয়া হয় তা কখনই কোন জন প্রতিনিধি বা রাষ্ট্রনেতার নামে আসে না। সরকারী আমলা ও অফিসারদের পদমর্যাদায় আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই টাকার ভাগ খুব সহজে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রনেতার কাছে পৌঁছে যায়। ফলে দুর্নীতির সোপান শুরু হয়। এবং তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রোধ করা যায়। যদি সমস্ত স্তরের সরকারী কর্মচারী সে পিয়ন থেকে শুরু করে সচিব আমলা অফিসার সবাই একজোটে দুর্নীতিহীন ও ঘুষহীন দৃঢ়চেতা হয়।
তাহলে কি দাঁড়াল? কে দুর্নীতিগ্রস্ত। পড়াশুনা জানা সরকারী কর্মচারী না কি রাজনৈতিক নেতা ( তিনি শিক্ষিত কি না বিচার্য নয়)।
দেশ পরিচালিত হয় রাজনৈতিক বাতাবরণে। যে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতা পেলে তাকে ধরে রাখার জন্য তার মত দেশকে সে পরিচালিত করবে। এর মধ্যে দোষের কিছুই নেই। কিন্তু সেই নীতি আইন পদক্ষেপ কতটা সঠিক তা দেখার দায়িত্ব স্থায়ী কর্মচারীর। পুলিশ প্রশাসন অর্থ শিক্ষা স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই।
এই ব্যাপারে সবার উপরে দায়িত্বশীল হতে হবে অফিসার, আমলা, পদাধিকার ও ইন চার্জদের। এরা কোনভাবে কোথাও দাঁড়িয়ে পড়লে পেছনের অফিসিয়েল কোনভাবেই তা এভোয়েড করতে পারবে না। তাদেরকে আসতেই হবে। যেমন ধরুন ডাক্তারবাবু মুমুর্ষু রোগীর সামনে দাঁড়িয়ে এক্সজামিন করছেন অথচ সেখানেই নার্সিং পারসোন্যাল হেডফোনে গান শুনছে, জিডিএ চেয়ার পা তুলে র‍্যাল মারছে এটা হতেই পারে না। বরং উল্টোটা আকচার হয়। অন্য সবাই আছে ডাক্তারের খোঁজ নেই।
অফিসার সচিব ইনচার্জ কখন আসে কখন যায় ঠিক নেই কিন্তু অন্য জনকে কাজের হুমকি দেয়। কাজ দরকার, তা বলে এই নয় মাথার কোন খোঁজ থাকবে না।

ভাবনায় অণু গল্পের আকার

অণুগল্প নিয়ে অনেকের জিজ্ঞাস্য – অণুগল্পের সার কথা কি? অণুগল্পই বা কি? কি চাইছে সাহিত্যের এই ধারা।
সাহিত্য ধারা বিষয়ে প্রথমেই জানতে হবে আমরা লিখি কেন? কেন না কিছু একটা পড়াতে চাই। আমরা লেখালেখি পড়ি কেন? কিছু একটা জেনে নিতে চাই। আমরা বলি কেন? কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করি। আমরা শুনি কেন? কিছু একটা বুঝে নিতে চাই। আমরা ভাবি কেন? কিছু একটা ভাবাতে চাই। সর্বোপরি স্বপ্ন দেখি কেন? আগামী আরও স্বচ্ছ চাই।
এই এত কেন-র রাস্তা অনেক। প্রবন্ধে গল্পে উপন্যাসে কবিতায় নাটকে ছবিতে নানাভাবে প্রকাশ করি। এই প্রকাশ ভাবনায় নতুন সংযোজন অণু। অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত অথচ বিশাল ব্যাপ্তি। এই চর্চা শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগেই। শুধু তার পেছন ও সামনে ছিল অনেক কথা। সার কথা ছিল আরও স্পষ্ট ও নির্ধারিত।
যেমন ধরা যাক তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকির পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তার বেলা? কবিতাটির মূল ভাবনা কিছু এই কটা লাইন। এর পেছনে আরও যে বিস্তারিত ভাবনা তারও গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও আছে। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলেন তিনি মরে নাই। এই গল্পের মূল ভাবনা কিন্তু একটুকুই। তার পেছন ও সামনে খুবই অপরিহার্য একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। কেউ যদি এ রকম ভাবনা তার গল্প বা কবিতার মাধ্যমে আরও সংক্ষেপ করে বোঝাতে পারে তাহলে তা হবে অণু চর্চা। সে গল্প হোক বা কবিতা।
দূরবীন উপন্যাসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বোঝাতে চেয়েছেন দূরের মানুষ কি করে কাছে হয়ে যায় আর কাছের মানুষ কিভাবে লক্ষ্য যোজন দূরে চলে যায়।
কিভাবে? কেন? এই ভাবনায় কেউ যদি সংক্ষিপ্তায়নে সহজেই বোঝাতে পারে। তা হবে অণু চর্চা।
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি খাস তোর চ্যাঁচানি; মাসি গো মাসি পাচ্ছে হাসি; ছিল নেই মাত্র এই – এ রকম হল কবিতা। আর বনফুলের হাত ধরে গল্প। বনফুলের বিস্তৃতি আরও সংক্ষিপ্তায়ন। অর্থাৎ ছোট গল্প থেকে অণুগল্প।
অর্থাৎ সার কথা, উপলব্ধি, সঠিক ভাবনা, নির্দিষ্ট জীবন দর্শন যতটা সম্ভব সহজ ভাবনায় আশেপাশে দেখা অথচ না-দেখা দৃষ্টিকোণ দেখিয়ে দেওয়া গল্পভাবনার নাম অণুগল্প।
অন্য অনেক গল্পের লেখার মত অণুগল্প লেখা সম্ভব নয়। কেন না ছোট গল্প বা বড় গল্পের ক্ষেত্রে কুশীলবদের নিয়ে লিখতে লিখতে এ সময় সেই লেখার ভাঁজে একটা উপলব্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়। আগে থেকে সেই উপলব্ধি ভেবে নেয় অথবা নাও ভাবলে চলবে। কিন্তু অণুভাবনায় এই ভাবনা আরও স্পষ্ট হতে হবে। যতটা স্পষ্ট হবে অণু প্রকাশ ঠিক ততটাই পরিচ্ছন্ন হবে। কিন্তু ভাবনার ক্ষেত্রে কোন প্রকার জোর নয়। যতটা সম্ভব সহজ ও সাবলীল।
লেখকরা ভাবুক। এই ভাবুকতা যতটা সম্ভব কম কথায় প্রকাশ হয় কবিতায়। এখন উঠে আসছে গল্পে। যেমন খুঁড়োর কল, সৎ পাত্র, রামগরুড়ের ছানা, একুশে আইন, উলঙ্গ রাজা, কলকাতার যিশু, মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে এ সবই অনবদ্য উপলব্ধির অনন্য অমর প্রকাশ। সে রকমই উপলব্ধি গল্পে প্রকাশ হচ্ছে। অনেক পড়াশুনা ও সাহিত্যধারায় সম্পৃক্ত হয়ে তবেই এই উপলব্ধির অণু প্রকাশ সম্ভব।
এখন অণুগল্প কি? কিভাবে লেখা যায়? এটা নয় কেন? ওঠা হবে না কেন? ইত্যাদি। এখানে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, কবিতা লিখতে কাব্যিক হতে হবে আর গল্প লিখতে গল্প হতে হবে। কোথাও কোন ব্যাখ্যা কেউ চায় না। যেন অন্য কাওকে ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস/ ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’ এভাবে কবিতা বলতে পারি। এবং গোপাড় ভাঁড় বা কাবুলিওয়ালার মত অন্যকে এই গল্প যেন বলতে পারি।
অর্থাৎ গল্প হতেই হবে গল্পের ক্ষেত্রে আর কাব্যিক হতে হবে কবিতার ক্ষেত্রে। সে অণু হোক আর যাই হোক। কবিতায় বিশাল বিস্তৃতি অল্প শব্দে কাব্যে বাঁধার চেষ্টা। তেমনি গল্পের বিশাল বিস্তৃতি ধরে রাখার নাম অণুগল্প। স্বছ ভাবনা গড়ে তুলুন তারপর তাকে গল্পের আকারে উপস্থাপন করুন। অণু কিন্তু কোন বর্ণনা চায় না। সে চায় পরিপূর্ণ নিদির্ষ্ট লক্ষ্য। লক্ষ্য যেন গল্পের আকারে হয়। আর যেহেতু অণু তাই শব্দসংখ্যা খুব একটা বিচার্য নয়। বিচার্য হল বক্তব্য। সেই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে যতটা প্রয়োজন ততটাই লিখতে হবে। এবং পাঠককে ধরে রাখতে হবে। তাহলেই হবে অণুচর্চা।
এর জন্য সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হল নিরীক্ষণ। জীবন ভাবনা নিরীক্ষণ। আন্দাজে রামের সাথে শ্যাম জুড়ে এগিয়ে গেলাম তারপর একটা অবস্থানে পৌঁছলাম তা কিন্তু হবে না।
অণুর ক্ষেত্রে অবশ্যই মেদবিহীন, সঠিক শব্দ, বক্তব্যের উল্ফন, ভাবনার নির্যাস থাকা দরকার। শুধু রসটুকু, কোন ছিবড়ে চলবে না। বাড়তি চলবে না। আর কিছু অচেনা অজানা পাঠকের জন্য ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকা দরকার। আর পাঠক যেন পড়া শুরু করে পাঠে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তার জন্য ভাবনায় যেন কোন প্রকার জোর না থাকে। পড়ার পর পাঠক যদি মনে করে, কেন সময় নষ্ট করলাম তাহলে আপনার লেখা এই অণু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না।
শুধু না লিখে ভাল ভাবুন, ভাল লিখুন। যতটুকু দরকার ততটুকু। অণুকবিতা। অণুগল্প।

মনের মারপ্যাঁচ

(অণুগল্প)

১লা বৈশাখের সকাল। প্রতিবছরের মতো এবারও সুব্রত আর পৃথা এসেছে মন্দিরে পুজো দিতে। বছরের প্রথম দিনটিতে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে পুজো না দিলে মনটা ভালো লাগেনা। আজ মন্দিরে বেশ ভীড়। হঠাৎ পৃথার আঁচলে টান পড়লো। চমকে পিছন ফিরে তাকালো সে।
দেখে পাঁচ ছ বছরের একটা মেয়ে। একা। পৃথা জিজ্ঞেস করল – কি হল? মাকে হারিয়ে ফেলেছো?
কিছু বলছে না, আঁচলও ছাড়ছে না। পূজোর উপাচার সুব্রত হাতে ধরিয়ে পৃথা মেয়েটাকে কোলে তুলে নিল। সকালের সূর্যরেখায় মুখটা বেশ উজ্জ্বল। আবার জিজ্ঞেস করল – তোমার নাম কি?
কোন উত্তর না পেয়ে আশেপাশে তাকাল। না, কেউ তো নেই। ওদিকে সুব্রত তাড়া দিল – না চলো। ওদিকে দেরি হলে মহীনবাবু রেগে যাবে যে।
পৃথা বলল – চলো, তোমার সবেতেই তাড়া। না আসতেই পারতে। তাছাড়া বন্ধ করো তো তোমার এই পেছন ঘোরা।
মেয়েটিকে মাঝে বসিয়ে পৃথা পূজো সেরে নেয়। এদিকে আরও ভিড় জমতে থাকে। মন্দির চত্বর পবিত্র গন্ধে ম ম করে ওঠে। কিন্তু সুব্রত হাতে অন্য বুকের মধ্যে ছটপট করে। পৃথা জানে বোড়ের চালে সুব্রত অসহায়। মন্দিরের বাগানের পাশে মেয়েটিকে নিয়ে দাঁড়ায় পৃথা। আর একটুক্ষণ দেখি, তারপর চলে যাব।
হঠাৎ প্রায় ছোঁ মেরে মেয়েটিকে কোলে নেয় একজন। পৃথাকে বলে – কিছু মনে করবেন না। ও এ রকমই। বোবা। তার উপর মা হারিয়েছে।
তারপর সুব্রতকে দেখতে পেয়ে প্রায় আঁৎকে ওঠার মত করে কাঁপতে থাকে। চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে। নিজে নিজেই করে – চল মামন, চল। তারপর এক দৌড়ে বাঁক পেরিয়ে হারিয়ে যায়।
সুব্রত নিজের হাত মন্দিরের সিংহ মূর্তিতে মারতে থাকে। পৃথার মনে পড়ে যায় বছর শেষের মহীনবাবুর হুকুম ছিল। একেবার শেষ করে দাও। বন্দুকের গুলি। রক্ত! মনটা কি ভাল হবেই না?

সিঁড়ি (অণুগল্প)

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিনয় ভাবে উপরের বাড়িটা থুড়ি ফ্ল্যাটটা আমার তো? আমাদের তো? অর্থাৎ বিনয় মনালি মৈসমের বাড়ি তো? গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে চালাতে গিয়ে সামনে এসে যায় বয়স্ক বৃদ্ধ। পাশের বস্তিতে থাকে বোধহয়। অনেকটা বাবার হেঁটে যাওয়ার মত।
বিনয়ের বয়স তখন দশ বারো। প্রথম একখানা চটি পায়। ব্রেক কষতে গিয়ে পায়ের বুটে চোখ চলে যায়। মাঝে বেশ কয়েকটা বছর। খুঁটে আনা মায়ের সেই রান্না স্বাদ যত্ন কত হৃদয় মেশানো। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করায়। কাছেই একটা ফ্ল্যাট হচ্ছে। এক ভদ্রমহিলা জল ঢেলে সিমেণ্ট মাখাচ্ছে। উপরের দিকে তাকিয়ে বিশ্রাম খুঁজছে। মা এভাবে বিনয়কে জড়িয়ে বিশ্রাম নিত। কত গাছ ছিল পুকুর ধারে। সব এখন বেপাত্তা।
গাড়ির কাঁচে হাত লাগিয়ে মায়ের চলে যাওয়া দেখে বিনয়। সকালের স্কুল সেরে বাড়ি ফেরাদের দেখে। আজ যেন জরুরী মিটিংয়ের গায়ে কি যেন সেঁটে আছে। আয় ও ব্যয়ের হিসেবে আরও চাই। সিঁড়ি টপকানো উচ্চতায় বিনয়কে মই করা নীতি একবার নীচে একবার উপরে।
অথচ সমতল আবদারে দাদা দিদি পাড়া প্রতিবেশী অনেকটাই আকাশ ছাড়িয়ে। বা নীচে খাদে।
বিনয় গাড়ি পার্ক করে অফিসে ঢুকে প্রথমেই ডেকে নিল গ্রাস রুটের কর্মীদের। চেষ্টা করল তাদের হাত ধরে নিজের সিঁড়িটা চিনতে।

এরা জানে

সৈনিক জানে যুদ্ধ করা তার পেশা
তাকে যে বুড়ে সাজায় যুদ্ধই তার নেশা,

লোভী জানে লোভ তার একটুও ছিল না
বাবুর রাজা সাজা যোগানে সে নিরূপায় যন্ত্রণা

মাতাল জানে ভেতর খাওয়া সে চোখকানা
প্রসরা সাজানো উচ্ছন্নে ডাকছে তাকে বাহানা

স্বভাব বার বার দেখায় না-অভাব
অনৈতিক মাথায় হাত সঠিক দেয় না জবাব

এরা সবাই দাবার চালে দোষ চাপায়
বাঁচতে চাওয়া মুখ ফেরায় না, আবার তাকায়।

অল্প কল্প

আপনি লিখতেই পারেন। যা আপনার লেখা। কিন্তু সেই লেখা যখন অন্যকে পড়তে দেবেন তখন আপনাকে খেয়াল করতে হবে তাকে ঠিক বোঝাতে পারছেন তো। যে পড়ছে সে কি বুঝেছে সেটাই আসল ব্যাপার। সে যতটা বুঝতে পারবে অর্থাৎ আপনি তাকে যতটা বোঝাতে পারবেন সেটুকুই আপনার সার্থক লেখা। বাদ বাকী আপনি লিখতেই পারেন তা আপনার কাছে প্রয়োজনীয় হলেও পাঠকের জন্য পাঠ হবে কি না বলা মুশকিল।

এ তো গেল একটা দিক। আর একটা দিক হল পাঠককে আপনি শুধু পাঠ করালেন না কি ভাবালেন। শুধু পাঠ করালাম এক আর ভাবালাম আর এক। শুধু পাঠেরও সরল বিন্দু থাকে। তার চারপাশে মাঝে মাঝে ঘুরতে বেশ লাগে। আর ভাবাতে গেলে কিছু রহস্যময়তা ছেড়ে দিতে হয়। সেখানে পাঠক তার নিজস্ব কৌশলে ভাববে। ডান না বাম। কিংবা একদম সোজা। বা কোথাও না, যেমন আছি তেমন।

এই জায়গাতে লেখকের মুন্সিয়ানা। লেখা খুবই সহজ। যা দেখলাম পটাপট লিখে ফেললাম। দেখা না-দেখা, ভাবা না-ভাবা লিখে পাঠককে কিছু দেওয়া যায় না। দেখা না-দেখা, ভাবা না-ভাবার উপলব্ধিকে লিখতে শেখাটাই আসল ব্যাপার। এই উপলব্ধি ব্যাপারটাই আসল ব্যাপার। উপলব্ধিতে খামতি থাকলে লেখা প্রায় অসম্ভব।

যে কোন ঘটনা আপনি যত সহজে বুঝে নিতে পারবেন ততটাই তার উপলব্ধ সমীকরণ আপনার লেখায় যদি ফুটিয়ে তুলতে পারেন তাহলেই সার্থক লেখা হয়ে উঠবে। লিখতে গেলে এটুকু অন্তত রপ্ত করতে হয়। জীবনের সরল উপলব্ধি সাধারণকে কবি করে তুলতে পারে। উপলব্ধিতে পলাশ রাঙা আগুন ঝরানো যায়।
এবার পাঠকের দিক বিবেচনা করলে দেখবেন। বই পড়ার নেশা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। বইয়ের মজা হারিয়ে যাচ্ছে। তা কিন্তু নয়। বই বা লেখা পাঠককে কতটা টানছে, সেই ব্যাপারটা ভাবা দরকার।

এই ভাবনার রাজত্বে শাসন শুরু করতে আসছে অণুকবিতা অণুগল্প। একটা দোহাই থেকেই যায়, সময় কম যা বলার তাড়াতাড়ি বলতো বাপু। যদি অল্প কথার মধ্যে কল্প থাকে তাহলে তাকে টানতে বাধ্য। কোন মেদ কোন আকডুম কোন উপদেশ কোন ফিরিস্তি কোন অযাচিত কোন দোষারোপ কোন গুণকীর্তন কেউ শুনতে চায় না। স্বচ্ছ অথচ কিছু বলব না বলব করেও বলতে চাওয়া বা বলিয়ে নেওয়া পাঠককে দাঁড় করিয়ে রাখবে। তাহলে অল্পে কল্প আঁকতে বলতে লিখতে দেখাতে শেখাতে যে মুন্সিয়ানা দরকার সেটা আমরা রবীন্দ্র সুনীল শক্তি জয় শ্রীজাতের পরে কতটা শিখেছি সেটা ভাবা দরকার।

সাহিত্য আসলে একটা ধারা তাকে প্রবাহিত করাতে হয়। বাটন ধরার মত হাত বদল করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। হাজার দৌড়বে দু একজন সামনের মুখ হয়ে উঠবে। কিন্তু সবাইকে দৌড়তে হবে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে ভাষা মর্যাদায় আপন গরিমা। পেছনের জন সামনের জনের এক অংশীদার। সবার ক্ষেত্রে একটাই ভাবনা হওয়া উচিত সঠিক উপলব্ধি। ভাবনার জগতে পাঠককে টেনে টুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা আমাদেরকেই করতে হবে। ভাল শিক্ষক তিনি যিনি ছাত্র ফ্রেণ্ডলি। অর্থাৎ ছাত্র কতটা শিখল তার উপরে শিক্ষকের মর্যাদা। না হলে বড় ডিগ্রী বিশাল পণ্ডিত কোন কাজেই লাগবে না। কারন ছাত্রের মনন উপলব্ধি করেই বিষয়ের পাঠাভ্যাস ভাল শিক্ষার অগ্রবর্তী।

আবার লেখক নিজের জন্য লিখতেই পারেন। লেখা নিজস্ব উপলব্ধিতে রাঙা হতেই পারে। সব পাঠক যে তাতে সম্পৃক্ত হবেন তা নাও হতে পারে। কিন্তু লেখার বৈশিষ্ট্য যে সীমা পেরিয়ে সীমাতে সীমাবদ্ধ থাকে। মন উড়ানের পাখনায় কোন বাঁধন নয় কিন্তু জীবনের ছোঁয়া অপরূপ হয়ে যেন থাকে।

অণুগল্প লেখা তেমনি একটি ধারা। অণুসন্ধানে একক থেকে ভিন্নতরের দিকে উৎক্ষেপন হল অণুগল্প। বিষয়ের মাঝে সহজ সংক্ষেপ স্বতন্ত্র স্বরক্ষেপন করার বিস্তৃত আকাঙ্ক্ষা, যেটা বলতে চাই সেটা না বলেও বলার বিন্দু উল্লেখ করার মুন্সিয়ানা, সঠিক উপলব্ধির পাঠক ভাবানুবাদ, সঠিক উপলব্ধির জারিত রসবিন্দু, যা দেখছি বা দেখেছি তা তোমাকে দেখিয়েও কিছু না-দেখা চেনানোর আপ্রাণ প্রয়াস, অনেক ভাবানার জারিত সমগ্রের সংক্ষেপ অথচ স্পষ্ট বৃত্তের কেন্দ্র আঁকাই হল অণুগল্প।

রূপক

দিনের শুরু দিনের শেষ
দিন বদলের থাকবে রেশ,
আমিও যে হব মতভেদ
রোজকার এই ঝরবে মেদ।

ভাবছো মনে দিনান্তে ওই
হাসছে দেখি সূর্যটা;
মেঘের ছায়ায় বসে খুঁজি
পাল্টে যাওয়া স্বপ্নটা।
দিনের আলোয় রঙের ছবি
রাতে যে হয় অভিরূপ;
মল্লভূমে তারই আদল
খুশির শান্তি অপরূপ।

বঞ্চিত

বঞ্চিত করা মানুষের জন্মগত মানচিত্র

যে করেই হোক যতটা সম্ভব
আমার হুকুমে যেন তরঙ্গ খেলা করে,
সেই মাপে চার ফেলে ছিপ হাতে
পুকুর হয়ে বসে আছি;
তুলব আর তড়পানো যন্ত্রণা দেখে
শ্লাঘা পতাকায় উড্ডিয়মান হব।

দয়ার অদৃষ্ট ভিক্ষে করবে
শুধু বঞ্চিত মতামত।

আমিও তো

ভুলভাল যাই দেখি
আমিও তো দেখি
সামনের ওই সব
আসল না মেকি?

ঠিকঠাক যাই শিখি
আমিও তো শিখি
আয়নায় তাই ফেলে
নিজেকেই লিখি।

দেখাদেখি যাই করি
আমিও তো করি
পেছনে আমিও আছি
তোমাকেই ধরি।

মুখোমুখি যাই ভাবি
আমিও তো ভাবি
রাঙিয়ে আকাশ রঙ
পাই স্বপ্ন চাবি।