ফকির আবদুল মালেক এর সকল পোস্ট

ফকির আবদুল মালেক সম্পর্কে

কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লেখক।

শব্দ

শব্দ
……………………
পাখির কলতান শুনি,
বাতাসে নড়ে উঠা ধানগাছের মর্মস্পর্শী আওয়াজ,
আগুনের দাউ দাউ আস্ফালন,
পাহালে পাটখড়ির পট পট ধ্বনি,
ভালবাসা প্রকাশের শরীর সঞ্চালন শব্দ শুনি,
নবজাতকের ক্রন্দন শুনি-

সকল শব্দ একত্রে চলমান, কিছু বিস্ফোরিত,
কখনও স্থবির, কখনও প্রবহমান,
শহরের শব্দ শুনি- গ্রাম্য আবহের শব্দ, দিন রাত্রির,
অল্পবয়সী বাচালের প্রিয় অযথা সংলাপ,
খাওয়ার সময়ের কর্মজীবি লোকের অট্টহাসি,
শত্রুতার কোলাহল, রোগীর বিলাপ,
জজের টেবিলে হাতুড়ী পিটানোর শব্দ,
তার মলিন পাণ্ডুবর্ণ ঠোঁটে উচ্চারিত
মৃত্যুদন্ডের ঘোষনা শুনি-

ঘাটে জাহাজ ভিড়ানোর, নোঙর ফেলার শব্দ শুনি
ঢং ঢং বেজে উঠা ঘন্টা, আগুনের ক্রন্দন শুনি
ট্রেনের হুইশালের শব্দ, বাস ট্রাকের হর্ণের শব্দ
যন্ত্র ঘর্ষণের ঝিক ঝিক, যাত্রীর হাকডাক,
ট্রাফিকের হুইশাল শুনি-

বেহালার সূর শুনি
গিটার, তবলার ঐক্যতান
গণমানুষের কোরাস শুনি,
অসংখ্য মানুষের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শুনি।

মাঝে মাঝে ক্লাসিক সংগীত শুনি
প্রশিক্ষিত কণ্ঠ নিয়ে অপরূপ রমনী
শৈল্পিক উচ্চারণে মাতিয়ে তুলে
বাদকদল উড়িয়ে নিয়ে যায়,
যেন ঘুরপাক খেতে থাকি শনির বলয়ে,
পাল তোলা নৌকার মত দুলতে থাকি,
নগ্ন পায়ে তাদের বাদ্যতরঙ্গে নেচে উঠি-
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে! উড়নচন্ডী হয়ে যাই!

শুধু তোমর মুখ থেকে
‘ভালোবাসি তোমায়’ শব্দ দুটি
কতদিন শুনি না
কতদিন শুনি না!

মৃত্যুর আগে

মৃত্যুর আগে
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)
১.

আবার যদি প্রকৃতির নিয়ম ছিড়ে
আসি এই পৃথিবীতে; ধীরে ধীরে
আমার অনুভুতিকে ক্ষয়ে যেতে দেব না
আলোর স্পর্শ আমি নেব না
জলের স্পর্শ নয়, স্নেহের স্পর্শে শিহরিত
হব না, বাতাস এসে অবিরত
যে স্পর্শ দিয়ে যায়, নেব না তা
আমার সব স্পর্শানুভূতি একত্রিত করে যা
পাব; একত্রে জমিয়ে নিলে যে অপার বিস্ময়
জন্ম নেবে; সেই শিহরণে কম্পিত হৃদয়
নিয়ে ক্ষণিক ছুঁয়ে নেব তোমার হাত, আর
কিছু স্পর্শ করব না আমি-
মরে যাব- আহ্লাদে পূর্ণ হবে জীবন আধার।

২.

আবার যদি প্রকৃতির নিয়ম ছিড়ে
আসি এই পৃথিবীতে; ধীরে ধীরে
আমার অনুভুতিকে ক্ষয়ে যেতে দেব না
পাখির কলোতানে মুগ্ধ হবো না
নদীজলের কলোধ্বনি নয়, সমুদ্র গর্জনে শিহরিত
হব না, বাতাসের শু শু ধ্বনি অবিরত
যে সুখ দিয়ে যায়, নেব না তা
আমার সব শ্রবেন্দ্রীয় একত্রিত করে যা
পাব; একত্রে জমিয়ে নিলে যে অপার বিস্ময়
জন্ম নেবে; সেই শিহরণে কম্পিত হৃদয়
নিয়ে তোমার মুখনিসৃত ‘ভালোবাসি তোমায়’- শুনে নিব, আর
কিছু শুনব না আমি-
মরে যাব- আহ্লাদে পূর্ণ হবে জীবন আধার।

একটি চুমু ও একটি থাপ্পরের বৃত্তান্ত

একটি চুমু ও একটি থাপ্পরের বৃত্তান্ত


আমাদের গেদু মিয়া বিজ্ঞানী।
সে দিন ঘরের দেয়ালে একটি টিকটিকি পোকা ধরতে গিয়ে ধপ করে ছাদ থেকে ফ্লোরে পরে গেল তার সামনে । গেদু মিয়া খেয়াল করল টিকটিকিটি ৪৫ ডিগ্রির পরিবর্তে ৯০ ডিগ্রীতে ঝাপ দিতে গিয়ে এই অঘটনটি ঘটিয়েছে। টিকটিকিটি দৌড়ে পালাল। গেদু মিয়া নিশ্চিত বিশ্বাসে উপনীত হলো টিকটিকি পরে মরে না, মরে পরে। গেদু মিয়া এত দ্রুত ভাবতে পারে! মজার ব্যাপার হলো সকাল বেলা উঠানে যখন মোরগ কর কর করে উঠে তখন সে তার ভাষা বুঝতে পারে। মোরগ তার প্রেমিকাকে ডাকছে। এ ব্যাপারে সে যে থিসিসটা তৈরী করে ফেলেছে তাতে সে পশু পাখীদের ভাষার হুবুহু বিবরণ দিয়েছে। কিন্তু তার সমস্যা হল মানুষ নিয়ে, মানুষ গুলো অন্যরকম। মুখে বলে এক আর হৃদয়ে ঝপে আরেক। সে দেখেছে মানুষ ভালোবাসার কথা বলে নির্দিদ্ধায় বোমা ছুড়ে মারতে পারে। সেবার যখন হিরোশিমায় পারমানবিক বোমা মারা হলো তখন তারা শান্তির কথা প্রচার করল। মানুষের ভাষা এমনই চমৎকার!!

তো আমাদের বিজ্ঞানী বহু দিন বহু দেশ ঘুরে বহু পথ পেরিয়ে একটা যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। মানুষের মনের ভাষাকে আলাদা করে ফেলতে পারে মুখের ভাষা থেকে। নাম দিলো মনো-মিটার। নেহাতই সে বাংলাদেশে জন্মগ্রহন করেছেন না হলে তাকে নোবেল পুরস্কার দিতে বাধ্য হতেন সুইডিস কর্তৃপক্ষ। অবশ্য এমন আশা সে করেও না কারন তার পূর্বপুরুষ জগদীশ চন্দ্র বসুকে কোনি মেরে নোবেল নিয়ে নিলো মার্কুনি। এই কুনির ভয়ে সে তাই তার যন্ত্র জনসমে প্রকাশ করল না। কিন্তু যন্ত্রটা নিয়ে সে বসে রইল না। মাঝে মাঝে টেস্ট করে নেয়।

একবার ট্রেনে চড়ছিলেন গেদু মিয়া । তার যন্ত্রটা একটা কামড়ায় রেখে সে বসে রইল। কামড়ায় ছিল চার জন। একজন মহিলা অধ্যাপিকা, সুদর্শন যুবক, যৌবতী সুন্দুরী আর একজন রাজনীতিবিদ। তাদের কথোপকথন বেশ উপভোগ্য ছিল।

অধ্যাপিকা: সমাজটা অধ:পতনে চলে যাচ্ছে, যুবক যুবতী অবাধ মেলামেশাই এর প্রধান কার।
যুবক: আমরা সামাজিক আন্দোলন গড়তে পারি।
যুবতী: নারীদের কে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে হবে।
রাজনীতিবিদ: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটাই পাল্টাতে হবে।

এমন সময় বিদ্যুত্ চলে গেল। সাথে সাথে একটি চুমুর ও থাপ্পরের আওয়াজ পাওয়া গেল। আজব খেলা আবার বিদ্যুত্ চলে এলো। দেখা গেল যুবকের গাল লাল হয়ে আছে। নিশ্চিত যে থাপ্পরটি যুবক খেয়েছে।

গেদু মিয়া বিশাল আগ্রহী হযে উঠল। তার মনো-মিটারে দৃষ্টি দিয়ে বসে রইল।
মনে মনের কথাগুলো যন্ত্রটি পড়তে লাগল।

অধ্যাপিকা: ঠিক আছে, সাবাস মেয়ে , আমার দেশে এমন মেয়েই দরকার। একটু চান্স পাইছে আর… থাপ্পরটি যথার্থ হয়েছে।

যুবতী: আমাকে রেখে ম্যাডামকে? থাপ্পর খাবা নাতো কি খাবা?

যুবক: শালা রাজনীতিবিদ মজা লইলি তুই আর থাপ্পর খেলাম আমি।

রাজনীতিবিদ: নিজের হাতে একটা চুমু দিলাম আর একটা থাপ্পর দিলাম বেয়াদপ পোলাডার গালে। আমারে কেউ সন্দেহ করে নাই তো??/

এভাবে রাজনীতিবিদরা সন্দেহাতীতভাবে নিজেদেরকে অনন্য উচ্চতায় মেলে ধরেন আর ঐ যুবকের মতো আমরা চুমুর আওয়াজ শুনে ও থাপ্পর খেতে খেতে বছরের পর বছর পার করে দেই এবং নতুন খাপ্পরের প্রতীক্ষা করতে থাকি।

আবার এলো যে সন্ধ্যা

আবার এলো যে সন্ধ্যা
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)

সন্ধ্যা এলো নীড়ে ফেরা পাখির পাখনায় ভর করে
নীড় ছোট আকাশতো বড়- ভুলে গিয়ে, ইদুরের মতন
গর্তে ঢুকে যায়, অথচ ছিল তাদের ঘিরে
বিশালতা আর উদারতা, পিছুটান এমনি হৃদয় ক্ষরণ !
আমিও এইখানে বটগাছটার নিচে বসে থাকি সন্ধ্যায়
তখন কৃষাণ বাড়ি ফিরে নদীটির তীর দিয়ে হেটে
তখন আকাশ লাল, আমি আসি এখানে স্মৃতির ব্যাথায়
এইখানে সুন্দরী বসেছিল পাশে তারপর গিয়েছিল ছুটে।

বৃহৎ কাজ বড় দায়িত্ব সংসার সব ছেড়ে এইখানে এসে
পড়ন্ত বেলায় চোখ বুজলে সুন্দরী, চোখ খুললে নাই-
বসে থাকি মরুচিকায়! জানতে চাও কোন সুন্দরী সে?
আমাকে দিয়েছিল স্পর্ধা প্রথম সৃষ্টির বেহেশতেই।

তারপর পৃথ্বী সংসার হলো ছাড়খাড় রাজ্য জয় রাজ্য ক্ষয়
অসীম সাহস দুরন্ত আবেগ, পুড়ে ছাই হলো কত যে ট্রয়!

চিত্রনাট্য

চিত্রনাট্য
……………….
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)

চিত্রনাট্য লিখেছি একটা।
নাম দিয়েছি ‘সত্য-মিথ্যার দ্বন্ধ’।
অনেকটা কমেডি-ট্রেজেডির মতো।
ব্যাপারটা বুঝা গেল না, তাইতো!
কমেডির ভিতর লুকিয়ে থাকা ট্রেজেডি।
ভাবছো এ আবার কেমন কথা,
আমি বলি তরমুজ দেখেছো কি
সবুজের ভিতর লুকিয়ে থাকা লাল। তেমনি।

চিত্রনাট্যটি প্যারডি বলতে পারো।
শব্দের বিকল্প শব্দ সাজিয়ে কাট-টু-কাট প্যারডি নয়,
জীবনের প্যারডি। প্রতিটি শিল্পকর্মই প্যারডি,
ঠিক জীবন নয় তবে জীবনেরই নান্দনিক উপস্থাপনা।
আমি তেমন শিল্পী নই, শব্দের পর শব্দ গেঁথে,
মাত্রা গুণে গুণে ভাবনাকে কালোত্তীর্ণ শৈল্পিক আচড়ে আঁকতে আমি জানি না
সংলাপ বলতে বলতে উপমায় উপমায়
সমাজ-রাষ্ট্রের-ধর্মের
বিমূর্ত চিত্রায়ন করতে আমি জানি না
ভালোবাসতে জানি
ভালোবাসতে বাসতে নিঃস্ব হতে জানি
ভালোবাসতে বাসতে মরে যেতে জানি।

আমার এই চিত্রনাট্যটি এই নিঃস্ব হয়ে যাওয়া
মরে যেতে চাওয়ারই প্যারডি,
শৈল্পিক কোন উপস্থাপনা নয়
নয় উপমার দৌঁড়ঝাপ- এ একেবারে সরাসরি।

ব্যাকগ্রাউন্ডে রূপালী চাঁদ পূর্ণ অবয়বের
অপার্থিব মায়ায় ছড়ানো থই থই জোৎস্না সমস্ত সবুজ গ্রহটিকে প্লাবিত করে রেখেছে
মদ খেলে যেমন পা টলতে থাকে,
পদক্ষেপগুলো বিন্যস্ত হয় খানিক এখানে খানিক সেখানে
বাতাস তেমন কখনও উড়িয়ে নিচ্ছে সুন্দরীর চুল,
কখনও কারুকাজ করা ওড়না
আমি হাঁটুগেড়ে বসে দু’হাত বাড়িয়ে বললাম
‘এই জোৎস্না, এই মাতাল বাতাস সাক্ষী থাক,
এই হাত স্পর্শ করে শুধু একবার বলো, ভালোবাসি…’

-ব্যাস শুধু এটুকুই?

– হ্যা শুধু এটুকুই।
আবার যদি প্রকৃতির নিয়ম ছিড়ে
আসি এই পৃথিবীতে; ধীরে ধীরে
আমার অনুভুতিকে ক্ষয়ে যেতে দেব না
আলোর স্পর্শ আমি নেব না
জলের স্পর্শ নয়, স্নেহের স্পর্শে শিহরিত
হব না, বাতাস এসে অবিরত
যে স্পর্শ দিয়ে যায়, নেব না তা
আমার সব স্পর্শানুভূতি একত্রিত করে যা
পাব; একত্রে জমিয়ে নিলে যে অপার বিস্ময়
জন্ম নেবে; সেই শিহরণে কম্পিত হৃদয়
নিয়ে ক্ষণিক ছুঁয়ে নেব তোমার হাত, আর
কিছু স্পর্শ করব না আমি-
মরে যাব- আহ্লাদে পূর্ণ হবে জীবন আধার।

-তারপর?

আবার যদি প্রকৃতির নিয়ম ছিড়ে
আসি এই পৃথিবীতে; ধীরে ধীরে
আমার অনুভুতিকে ক্ষয়ে যেতে দেব না
পাখির কলোতানে মুগ্ধ হবো না
নদীজলের কলোধ্বনি নয়, সমুদ্র গর্জনে শিহরিত
হব না, বাতাসের শু শু ধ্বনি অবিরত
যে সুখ দিয়ে যায়, নেব না তা
আমার সব শ্রবেন্দ্রীয় একত্রিত করে যা
পাব; একত্রে জমিয়ে নিলে যে অপার বিস্ময়
জন্ম নেবে; সেই শিহরণে কম্পিত হৃদয়
নিয়ে তোমার মুখনিসৃত ‘ভালোবাসি তোমায়’- শুনে নিব, আর
কিছু শুনব না আমি-
মরে যাব- আহ্লাদে পূর্ণ হবে জীবন আধার।

-কথা দিলাম, এরপর আর কখনও ভালোবাসার দাবি নিয়ে এসে দাঁড়াবো না তোমার কাছে। চলে যাব, কোনদিন ফিরব না আর।

-মরে যাব।

-মরে যাবে? একটা মিথ্যাকে বুকে ধারণ করে মরে যাবে?
জীবনে যদি কোন সত্যি ধারণ করে থাকি
যদি একবিন্দুও তোমার পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকি,
তবে তোমাকে বলি, ভালোবাসি না আমি তোমাকে,
ভালোবাসি না, কোনদিন ভালোবাসিনি তোমায় ।

চিত্রনাট্যটি এখানেই হতে পারতো শেষ। গান না থাকলে ঠিক জমে না। জুড়ে দিলাম সুমধুর গান-

তুমি দিনের আলো, তুমি রাতের আধার
তুমি আমার সুস্থতা, তুমি কারণ অসুস্থতার
তুমি আমার রক্তের লোহিত কণিকা
তুমি আমার না ছুঁয়া আজন্ম ব্যাথা
তুমি কখনো ভেবে দেখোনি
তুমি কখনো ভেবে দেখোনি

তুমি আমার ভয়, কখনো ভাবিনি
নিজেকে কখনো অপরূপ জানিনি
এই আঁধারে আমায় খুঁজে দেখো
হাতটি ধরে একটু সামনে হাটো
যেন পুরো পৃথিবী তোমার, পুরো পৃথিবী তোমার
যেন পুরো পৃথিবী আমার, পুরো পৃথিবী আমার

তবে তুমি আছো কিসের অপেক্ষায়?

আজ ভালোবাস তোমার যেভাবে মন চায়
ভালোবাস আমায় যেভাবে মন চায়
ছোঁয়ে দেখো তোমার যেভাবে মন চায়
ছোঁয়ে দেখো আমায় যেভাবে মন চায়

এ কেবল আমার কল্পনা হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, সুন্দরী কোথাও নাই।

নিঃস্ব

নি:স্ব
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)
……………………………..
যদি এমন হতো, খুঁজলেই পেতাম তোমার নগ্ন হাত
তোমায় নিয়ে আপন মনে ঘুমহীন কাটত সারারাত?
যখন তোমার চুলগুলি এলোমেলো বাতাসে যায় উড়ে
তখন আমি থাকি তোমার হতে যোজন যোজন দূরে!
যেইদিন মরে যাব, ভবে তোমার থাকার উপায় নাই
তুমিও যাবে হারিয়ে শূন্যে, যখনই অজানায় হারাই।

প্রশ্ন

প্রশ্ন
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)

মহুয়া বন মাতাল হাওয়ায় এলোমেলো দুলছে কেন
ঘনকালো মেঘগুলো সব এদিক ওদিক ছুটছে কেন
চিত্ত হরণ রিক্ত কারণ আমার প্রেমে করতে বারণ
অশ্রুতে ছলো ছলো নয়ন দু’টি টলোমলো হইছে কেন

কবুতর দুইটি থেকে থেকে চুমোচুমি করছে কেন
বনহংস বনহংসী পাশাপাশি আনমনে উড়ছে কেন
কি কারণে কার স্মরণে তোমার নিটোল ননীর গাল
অশ্রু অঙ্গারে পুড়ে লাল জ্বলজ্বল বেসামাল হচ্ছে কেন

বৃষ্টির ফোটা আকাশ চুইয়ে কাঁদন হয়ে ঝরছে কেন
ঝর্ণা থেকে জলধারা ধরণীতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে কেন
আমায় তুমি না করতে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে পারলে
যখন, উথাল পাথাল ঝড়ের তোড়ে সবেগে কান্না কেন!

এই নির্জনে

এই নির্জনে
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)

বাইরে ঝিমঝিম করে পড়ন্ত দুপুর।
ভারী নির্জন, নিরিবিলি অথচ কোমল রোদে ঝলমলে।
মস্ত মস্ত ঘরের ঘুলঘুলি, বারান্দায় ওপরের কড়ি বর্গায়
নানান জাতের পায়রা নড়াচড়া করে আর ডেকে ওঠে।
পড়ন্ত দুপুরে পায়রার গদগদ স্বরের ডাক এক অদ্ভুত মায়া তৈরি করে।

শব্দের কি কোন আকার আছে? শব্দরা সম্ভবত নিরাকার।
তবু পায়রার বুকুম বুকুম শব্দের আকার গোল মনে হয় আমার,
তুলোর বলের মত গোল।
স্টিমারের হুইছালের বাঁশির শব্দটি কি সরু ও দীর্ঘ মনে হয়!
সেতারের ঝনৎকার যেন ফুলঝুরির বহুবর্ণ কেন্দ্রতিগ অগ্নিবিন্দু।
এজরাসের ছড় টানলেই মনে ভেসে ওঠে তন্তুজালের মত আকৃতি,
অদৃশ্য এক মাকড়সা অদ্ভুত দ্রুতলয়ে বুনে চলছে।

পশু-পাখির আত্মজন নেই, সংসার নেই।
তবু পায়রারা গদগদ শব্দে এ কী কথা কয়?
ধ্বনিগুলোকে পরস্পর আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিয়ে
ক্রমাগত বুনন চলায় মাকড়শার মতো,
তাতীবাড়ির একটানা ঠকঠককের মতো,
কাঠঠোকরার একটানা ঠোকরের মতো,
সেতারের ঝনৎকারের ফুলঝুরির মতো
এজরাসের ছড় টানার ঐক্যতানের মতো
বুকুম বুকুম স্বরে আপ্লুত হতে থাকা আত্মজনহীন, সংসারহীন পায়রারা
এই নির্জনে আমাকে সুন্দরীর কথা কয়!

পর্দার অন্তরালে সুপ্ত ছিল যাহা

পর্দার অন্তরালে সুপ্ত ছিল যাহা
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)

হৃদয় গোরস্থানে ওঠলো বেজে ইস্রাফিল এর ফুকধ্বনি
পর্দার অন্তরালে সুপ্ত ছিল যাহা অনুভব হয়ে
শব্দের রূপ নিয়ে খিল খিল করে ওঠলো হেসে-
তাড়িয়ে দিতে চেয়েছি, দূর দূর করে দুরে রাখতে চেয়েছি যতবার
ওরা আমার সমস্ত কোল জুড়ে, বুক জুড়ে, কাদ বেয়ে মাথার
ভিতরে লাফাতে লাগল।

আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করতো নিশুতি রাতের তারা
তাদের সত্যিকার নাম জানা ছিল না আমার
তবে সবাইকে চিনতাম আমি, আমার নিজস্ব নামে।
কোন ঋতুতে কোন দিকে কোন তারা উদিত হয় সব
বলে দিতে পারি, আজও। এমন সময় যেত
চারতলা ছাদে শুয়ে শুয়ে তারাদের উদয়স্ত দেখতাম।
কোন কোন মধ্যরাতে যখন পৃথি ঘুমে বিভোর
আমার আর তারাদের মাঝে কথা হতো-
সুন্দরী চুপি চুপি আসত তাদের বাড়ীর ছাদে।
দুটি পশাপাশি, ও বাড়ীর উপর দিয়ে
বইয়ে যাওয়া হাওয়া এ বাড়ীতে আছরে পড়ে,
আমি আকাশের সাথে কথা বলতে বলতে সুন্দরীর গায়ে গন্ধ পেতাম,
কানে আসত ভেসে চেপে রাখা খিল খিল মাখা ফিস ফিস ধ্বনি
-`ওরে পাগলা, শুয়ে শুয়ে তারা গুন।’ না শুনার ভান করতাম ।
– ‘পাগলা, ও পাগলা’- চকিত তাকাতাম পাশ ফিরে।
কিছু না, সুন্দরীর চোখে মুখে যে আনন্দ বিভা ছড়িয়ে পড়ত
দেখতাম তা ছড়িয়ে পরেছে সমস্ত আকাশ জুড়ে তারাদের বিন্যাসে বিন্যাসে।

ও নিশুতি রাতের তারা
ও অনন্ত অনাদি আকাশ
আমিতো চেয়েছি ভুলে যেতে, রেখেছি সেই দ্যোতি বুকের গভীরে যতন করে
কেন তারে জাগালে আজ রাতে
ওই বাড়ীর ছাদ এখন মাহাদেশ অট্টালিকা
হয়তবা নিয়ন বাতির উচ্ছ্বল আলোকে উজ্জ্বল আজও
সামান্য এক টুকরো খুশিমাখা চোখের ঝিলিকের কি মূল্য বলো চক্রকালের ডমাডোলে।

ও নিশুতি রাতের তারা
ও অনন্ত অনাদি আকাশ
আজো কেন রাখলে ধরে সামান্য খুশির ঝিলিক তোমার অলীক বিন্যাসে?
এ কোন অত্যাচারে স্মৃতির অতল গহ্বরে
হৃদয় গোরস্থানে ওঠলো বেজে ইস্রাফিল এর ফুকধ্বনি
পর্দার অন্তরালে সুপ্ত ছিল যাহা অনুভব হয়ে
শব্দের রূপ নিয়ে খিল খিল করে ওঠলো হেসে-
তাড়িয়ে দিতে চেয়েছি, দূর দূর করে দুরে রাখতে চেয়েছি যতবার
ওরা আমার সমস্ত কোল জুড়ে, বুক জুড়ে, কাদ বেয়ে মাথার
ভিতরে লাফাতে লাগল।

কষ্টের ফেরিয়লা

কষ্টের ফেরিয়লা
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)
……………………………….

নিয়ে কষ্টের ঝোলা ডাকিছে ফেরিয়লা দখিন রাস্তার ধারে
বসে মনেতে ভাবি আছে কোন অভাবী আজব এ সংসারে
কষ্ট কিনতে চায় চুপি চুপি সুধায় এদিকে এসো ভাই
ফুরিয়ে গেছে সব কষ্টের কলোরব ঘরেতে কষ্ট নাই
বালক বালিকারা গুটিয়ে বই পড়া বারবার হাকায়
তাদের কষ্ট চাই নাই উপায় নাই কষ্ট গেল কোথায়!
এসব হবে নাকি ভাবি গিয়েতো দেখি কষ্টের ফেরিয়লা
কি এনেছে এমন এতো যে আয়োজন ডাকিছে মনভোলা।

নানা রকম কষ্ট লালচে নীল নষ্ট দেখতে পেয়ে ভাবি
চাপা ঘাসের সাদা এনেছে একগাদা আসল নাকি সবি?
ফেরিয়লার ঝোলা হলো খানিক খোলা কপাল পুড়া গন্ধ
একেবারে আসল একটু নয় ছল সব কাটলো দ্বন্ধ
আর কে দেবে তার মত কষ্ট এমন বলছে বারবার
হৃষ্ট পুষ্ট কষ্টগুলি থরে আছে ঝুলি বাহারি কারবার।
আমায় দেখে হেসে বলল অবশেষে ওরে শব্দ কান্ডরী
নাও না কিনে কিছু ছুটিয়া পিছু পিছু কেন করছ দেরি।

শব্দগুলি এমন হৃদয়ে হরদম তোলে যেই তোলপাড়
প্রকাশের যাতনা অগ্রন্থিত কামনা স্তব্দতা হাহাকার
আনন্দের উচ্ছ্বাস অযত্ন পরিহাস উঠবে সবি ভাসি
আকার হয়ে সব করবে কলোরব ফুটবে মুখে হাসি
কবুতরের ডাক কালচে কালো কাক কিচ্ কিচ্ চড়ুই
শিশিরের পতন বাতাস শন্ শন্ আকার পাবে সবি
আসল কষ্ট হতে নাও ভরে দুহাতে ওরে ও হৃদস্পর্শী
শব্দগুলির রূপ, হবে যে অপরূপ- তবু করছ দেরি?

যা হবে স্মরণীয় বহুতে বরণীয় বোধগুলো দুঃখের
ফেরিয়লা আমায় তড়িত বলে যায়- বেলা হয়েছে ঢের
শব্দের অলংকারে মুগ্ধতা চারিধারে যদি ছড়াতে চাও
আমার কাছে এসে স্তব্ধতা ভালোবেসে কষ্ট কিনিয়া নাও
শুধাই বারবার মিছে হোক সংসার কষ্ট লইব কিনে
এসেছি বাড়ি হতে মালের গাড়ি সাথে তোমার মূল্য জেনে
অবাক কান্ড একি! গাড়িতে নাই বাকি এখন কি যে করি
কখন চুপিসারে কষ্ট বোঝাই করে চলে গেল সুন্দরী!

কবিতা ট্রেন চলে

কবিতা ট্রেন চলে
(সুন্দরী সিরিজের কবিতা)
…………………

শব্দ টিকিট কাটা হয়ে গেছে, লোটা কম্বল যা সম্বল, বাক্স-প‌্যাঁটরা
জলের বোতল অব্দি গুছিয়ে নিয়ে সিটে বসে পড়েছি, নিজেকে যতটা পারি
বিচ্ছিন্ন করে কবিতা ট্রেনে চেপে বসেছি,

ভোঁ, কু ঝিক ঝিক, কবিতা ট্রেন চলে ভোঁ

কবিতার এই অনন্ত যাত্রায় অদ্ভুত অন্তর্দশী এক যাত্রী আমি,
স্মৃতির পুকুরে সাতার কেটে তাকিয়ে দেখি-
সামনের সীটে সুন্দরী এককাহন হাসি নিয়ে
সাতকাহন বক বক শুরু করে দিল,
কুয়াশা কাটাবার প্রকৃতির খামখেয়ালীপনার
এক টুকরো রোদ্দুরের ঝিলিক যেন ।
তারপর যোজন যোজন সময়ের পারাপার
কোথাও সেই ঝিলিক দেখি না আর!
শুনি না হাসির আলোড়ন!
শুধু থাকে কুয়াশা, কেবলই মৌনতা, স্তব্ধতার শিহরণ!

এমনিতেই খুব সুখের অভিজ্ঞতা নয়, হোটেলের ধকধকে লোহার কড়াইয়ে
পরোটার মত এপিঠ ওপিঠ ভাজা হচ্ছে আমাদের, নষ্ট সময়ের নষ্টামীতে
দগ্ধ সবাই, নিজেকে যতটা সম্ভব ছাড়িয়ে নিয়ে কবিতা ট্রেনে চেপে বসেছি
গন্তব্যহীন। সামনে কোন ষ্টেশনে নেমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নেই
একটা ডিমের মামলেট অথবা একটা চিকেন-রোল
অথবা ডালডা-চপচপ মোগলাই,
সঙ্গে একটা বরফ-ঠান্ডা কোক অথবা পেপসি –

নিসঙ্গ এই কাব্য যাত্রায় মৌনতার গানগুলি পিছুটানে
অশ্রু হয়ে ঝরে নিরব নিস্তব্ধ চিহ্ণহীন উদভ্রান্ত হাহাকারে।

এইসব হৃদয়ের ব্যাথাগুলি, ঢের ব্যাথাগুলি বাক্স-প‌্যাঁটরায় লুকিয়ে নিয়ে
শব্দটিকিট কেটে চেপে বসেছি-
ভোঁ, কু ঝিক ঝিক, কবিতা ট্রেন চলে ভোঁ
ভোঁ, কু ঝিক ঝিক, কবিতা ট্রেন চলে ভোঁ