ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

দুপুর ও দীনতা

পাতাগুলো ফুটে আছে, ফুটবে ফুলও
ভালোবাসায় তুমি মোচন করে দেবে আমার ভুলও
অথচ আমি সারাজীবন সাধনা করেছি ভুল সমুদ্রের গান-
তবে কি ঢেউগুলো ছিল, আমার চেয়ে আরও পাষাণ!

তবে কি এই ভবের ইন্দ্রজালে
মেঘ প্রেমিকা হয়ে সূর্যকে, ঢেকেছিল আরাধ্য সকালে
আর তুমি ছিলে তার সহযাত্রী – সখি
আমিতো তোমার ছায়া ভেবেই, জড়াতে চেয়েছি দুপুরের পাখি।

দীনতার মিছেঘোরে, পারিনি অনেক কিছুই ভবে
তবু বলি- পাতা ও পুষ্পের মায়া একান্ত আমারই র’বে।
#

তবুও জন্মমাটির দিকে

কালঝড়ের প্রশাখার দিকে তাকাই। আজ মন
ভালো নেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি কন্যার। কয়েক দফা
গুড়িগুড়ি বৃষ্টির পর খুব মন ভারী করে আছে আকাশ
পাখিদের নীরবতা দেখে, অনুমান করছি – পৃথিবীর
অন্য কোথাও এই ঝড় রেখে যাচ্ছে তার দাগ,
মানুষ ছুটছে, মানুষ ছুটছে, মানুষ ছুটছে…

নীরব আরাধনায় যেখানে বসে আছেন আমার মা,
আমি ফিরে তাকাচ্ছি সেই মাটির দিকে।
‘মোরা’ কোনও আর্তনাদ দেখতে চাই না আর-
বলতে বলতে আমিও কাঁপছি,
প্রকৃতি হে,
তুমি প্রেমময় হও, তুমি আমাদের হাত ধরো পুনরায়।

সংশোধিত গ্রহতন্ত্র

মানুষের কাতারে দাঁড়াবার দৌড়ে আমি বারবারই পরাজিত হই।
আমার শয়নকক্ষে যে অর্ধভাঙা ঝাড়বাতি দু’দশক থেকে ঝুলে
আছে, তা বদলাবার সাধ্য আমার জুটেনি এখনও। তাই মাঝে
মাঝে বাতিটির অর্ধ আলোয় নিজেকে চিনতে বার বার ভুল করি।
নিজস্ব কোনো ইমেজ না থাকায় কখনও ঢেউ, কখনও ধ্বনির কাছ
থেকে ধার নিই উত্থান অথবা পতনের সর্বশেষ সংজ্ঞা।

যে ঘরের সামনে আমি এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছি, এই ঘরের
বা’পাশে বহুকাল আগে একটি গ্রহগাছ ছিল। সে গাছের ছায়ায়
দাঁড়িয়ে যে কয়েকজন বালক-বালিকা বাল্যশিক্ষার পাঠ নিতেন,
তাদের একজন ছিলেন আমার প্রপিতামহ। তার রোজনামচা পড়ে
জেনেছি, গাছটি নিজের পাতায় ধরে রাখতো গ্রহণকাল। তাই
গাছটিকে ‘গ্রহগাছ’ বলেই আখ্যা দিয়েছিলেন পাড়া-প্রতিবেশী।
এটাও জেনেছি, সেকালের মানুষ আলোর উৎস সন্ধানে খালি পায়ে
হাঁটতেন মাঠের পর মাঠ। গ্রামের পর গ্রাম।

এসব ভাবতে ভাবতে আমি যখন গ্রামশূন্য ভূখণ্ডের মধ্যপ্রদেশে দাঁড়াই—
তখন দেখি, দু’টো পালকহীন পাখি আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
চামড়াশূন্য মানুষের দৌড়দৃশ্য আবারও আমার চোখে ভাসে। যারা অন্ধকারকে
স্বাগত জানিয়ে নগর থেকে আলোবিন্দুকে বিদায় জানিয়েছিল—
তাদের প্রতি আমার করুণা হয়।

জগতে যারা গ্লানি কিংবা ধিক্কারের করুণা নিয়ে বাঁচে, তারা কি
আদৌ কোনোদিন দৌড়াতে পারে !

আমি পুনরায় দৌড়াবার জন্য পায়ের পেশিগুলো শক্ত করতে থাকি।
দেখি— আমার প্রতি ধেয়ে আসছে অন্ধকার। যে সংবিধান মানুষের
কল্যাণে নিবেদিত হবার কথা ছিল— তার শরীরের ক্ষত দেখে আমি
আঁতকে উঠি। যুথবদ্ধ সংশোধনী হরণ করেছে আমার চেতনার স্বাধীনতা।
মৃত্তিকায় নত হবার প্রগাঢ় মূল্যবোধ।

আমি সবগুলো সংশোধনীকে অমান্য করে একটি গ্রহের ঈশান কোণের
দিকে দৌড়াতে থাকি। আমার রক্তের পরতে পরতে বাজতে থাকে
সংঘর্ষ বিষয়ক দ্বৈত সেতার।

মেঘও রেখে যায় পাশে ভূমিষ্ট ছায়াডোর

কয়েকটি বিলাপ গেঁথে গেঁথে মেঘও রেখে যায় তার ভূমিষ্ট ছায়াডোর
পৃথক কোনো স্বার্থ নেই নিমগ্ন মাটিরও,
মেঘ ও মাটি পরস্পরের দেখা পেলে নিমিষেই মিতা হয়ে যায়
সবগুলো মিথ অস্বীকার করে তারা পরে নেয় একই পোশাক।
ভোরের পরিষেবা গ্রহণ করে সেরে উঠে সমগ্র ক্রান্তিকাল থেকে।
নদীরা নিরক্ষর নয়। তাই তারাও পড়তে পারে মেঘমাটির লিখিত
অঙ্গীকার।নিশ্চিত নিদ্রা চোখে নিয়ে যে চাঁদ শুয়েছিল অন্তরের
অগ্নিকোণে, তারও জাগার পালা শুরু হয়।
পালা করে আমরা পাহারা দিয়েছি যে ফালগুনের আভাস,
চেয়ে দেখি তার ঠিক দশগজ দূরে-
রূপসী বাংলা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ।

স্তরের স্থিরচিত্র

এসো প্রাণের বদলে আগুনকেই শুকিয়ে,
স্তরে স্তরে এই পথে রাখি।
যে পথে সহস্র কররেখা উঁচিয়ে
একদিন হেঁটে গিয়েছিল সহস্র পালক।
যে রোদে, একদিন বিন্যস্ত হয়েছিল আমাদের
উজ্জ্বল ভাগ্যরেখা। আর বাজপাখিরা গোলাপের
প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দখল করতে চেয়েছিল, গোলাপের
ভালোবাসার আকাশ।

আকাশে মূলত প্রাণগুলোই নক্ষত্র হয়ে স্থির হয় অবশেষে।
সারি সারি মেঘ, তাদের জন্য রাখে প্রেমের দ্যোতনা।
আর গভীর রাত্রির ভেতর
চাঁদ ও সড়ক ডুবে যেতে যেতে
আঁকে পৃথিবীতে বয়ে যাওয়া
প্রথম প্লাবনের চূর্ণরেখা।

দরবার ও তরবারি

একদিন আমিও দরবার খুলে টাঙাবো লাল চাদোয়া
তারপর ডেকে বলবো- এসো হে নক্ষত্রসমাজ,
এসো সূর্যপরীরা,
আমার হাত ধরে গ্রহণ করো আলোর বয়েত,
তোমরা যারা এই পৃথিবীকে আর ছটা দিতে পারছো না
তারা বদলে দাও নিজেদের খোলস
তারপর অন্য কোনো নামে ফেরি করো ঝাড়বাতি।

একদিন আমিও তরবারি হাতে চলে যাবো সকল স্বৈরাচারীর
গর্দানের কাছাকাছি, যারা দরবার খুঁজে
এখনও বেহাল দশায় – মানুষকে বোকা বানাবার জন্য
বাজপাখির মতোই করে ছড়ায় বাজনীতি ( রাজনীতি নয় ),
তাদের উদ্দেশে –
শামসুর রাহমানের মতোই লিখবো কবিতা
‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে’…………. পৃথিবী !

দুটি কবিতা

বীজের সখীত্ব ঘেরা রোদের জীবন ♦

অবশেষে আমিও ভাবতে শুরু করেছি, বীজের সখীত্ব ঘেরা রোদের গার্হস্থ্য
জীবন। কীভাবে জমিয়ে রাখে সবুজ কোলাহল। কীভাবে পাখিদের পাশে দু’মুঠো
খুদদানা ছিটিয়ে দেয় কিষাণী বালিকা। খুটে খাওয়ার দৃশ্য দেখে দাঁড়ায় দুপুর,
এই মধ্যনদীতে যারা নৌকো বেয়ে যায়, তারাও থামে। অতিক্রান্ত জোয়ারের
ধ্বনি বুকে নিয়ে বাঁচে যে মনন, সে তো থেমে গেছে অনেক আগেই। বিধ্বস্থ
আকাশ থেকে স্বপ্ন চুরি করে আমরা যে ছাউনী সাজিয়েছিলাম, বিপন্ন চাঁদের
সাথে- সে ও কাটায় রাত। আর অপেক্ষায় থাকে- মেঘের ঘনত্ব কেটে যাবে
ঠিকই। স্বপ্নেরা স্পর্শ করবে বিষুববৃত্তান্ত মাখা উষ্ণতার হাত।
#

হলুদ বৃষ্টির ছায়া ♦
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
মাঝে মাঝেই আমি কান্না ভুলে যাই। মাঝে মাঝেই,
একগুচ্ছ হলুদ বৃষ্টি আমাকে আলিঙ্গন করে।
অনেকগুলো বিষাদ-
সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানায়।

অনেকগুলো মৃত্যু,
আমার চারপাশে ছিটিয়ে যায় ফুল, পরাগের প্রহর।
আমি মানুষের প্রস্থানদৃশ্য দেখি। দেখি,
আকাশে আকাশে তারা হয়ে ঝলক দিচ্ছে
যে প্রাণ,
একদিন তারা মাটিতে ছিল। ছিল আমার প্রতিবেশী,
আমার স্বজন।

বেদনার ত্রিভুবনে যে দেহগুলো ঢাকা পড়েছে হলুদ কাপড়ে,
আমি আবার তাদের ছবিগুলো দেখি।
উড়তে উড়তে প্রেমিকার বাহু জড়িয়েছিল যে প্রেমিক,
কিংবা যে শিশু উড্ডয়নের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়েছিল
তার মায়ের কোলে-
তাদের মুখছবি আমার দুচোখে ভেসে যেতে থাকে।

কোনো সংবাদই আমি আর পড়তে পারি না।
সকল আকাশকেই আমার অবিশ্বস্ত মনে হয়..
সকল কান্না’কে মনে হয়,সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া
এক একটি পাখির কঙ্কাল।

বংশীবাদকগণ

পৃথিবী আপাতত বেঁচে থাক অন্ধ হয়ে। চলো, আলোর
আয়োজনে আমরা পূরণ করি তরুপ্রতিম সবুজের ছায়া।
তারপর বিলিয়ে দিই, এইসব পূরণ ও প্রমাণ। যারা নিতে
চাইবে – তাদের হাতেই তুলে দেবো দুপুর, দীনতা ও দ্রোহ।

অন্ধত্বের দ্বিতীয় অভিষেক সেরে যারা আমূল গৃহহীন, তাদেরকে
দেখিয়ে যাই ভাঙনের অষ্টম পয়ার। আবার ভাঙুক। গড়ে তোলার
প্রয়োজন নেই আজ। গহীনে হারিয়ে যাওয়া নদীর কঙ্কাল খুঁজে
একদিন আমরাও ডুবুরি হবো – কথা তো এমনই ছিল ! তাহলে
আজ ভয়ের সন্ধ্যা কেন ছানি পাতে আমাদের চোখে ! জলান্তরে
কেন হারিয়ে যায় জলের যৌবন !

পৃথিবী বেঁচে থাক প্রায়শ্চিত্তের সিঁড়ি হয়ে। সেই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
সারি সারি বংশীবাদক বাজাক শুশ্রূষার সুর। কষ্টেরা কাছে নেই, –
না থাক। স্রোতপর্বের প্রতিটি অণুতে, আমরা রেখে যাবো স্বপ্নের
ঋতুচন্দন। অবশেষে যারা অন্ধত্ব নিয়ে বেঁচে থাকবে, তারাই পাবে
এই রঙের বিষাদ। চতুর চক্ষুগুলো খুঁজে কিছুই পাবে না।

দুটি কবিতা

মৃত পাখির হাড় থেকে জন্ম নিয়েছিল যে পাথর

অলক্ষ্যেই অনেক কিছু আমার দেখা হয়ে যায়। মৃত পাখির হাড় থেকে
জন্ম নিয়েছিল যে পাথর তার উপর জন্মেছে একটি বৃক্ষ, সেই বৃক্ষে ফুটে
আছে একটি নামহীন ফুল। ফুলটি কী তবে সেই পাখির ডানাচিহ্ন! আর
বৃক্ষটি কী তবে পাখির সহদোরা! যে বিলে স্নান সারতো ঐ পাখি, সেই
চলনবিল কী তবে আমার লেখার খাতা! এমন অনেক ঘোরদৃশ্য দেখতে
দেখতে আমি ট্রেনে চেপে বসি। টিকিট চেকার এসে আমার টিকিট দেখতে
চান। টিকিট কাটি’নি আমি। দিইনি ট্রেনের ভাড়া।আমাকে সামনের স্টেশনেই
নেমে যাবার আদেশ জারি হয়। আমি কাঁধের ঝুলো’টি সামলাতে সামলাতে
নেমে পড়ার জন্য তৈরি হই। একজন কাগজ বিক্রেতা এসে আমার সামনে
দাঁড়ান। এবং বলতে থাকেন— নামবেন না বাবু! আপনার ভাড়াটা আমিই
দিয়ে দিচ্ছি…………
আমি ক্রমশ পাথর হতে থাকি। মনে হয়, মানবজনমের চেয়ে পাথরজনম
অনেক ভালো। পাথর অনেক কিছুই দেখতে পারে। মানুষ চেয়েও দেখে না।
#

.
স্যাটেলাইট, ছায়া হয়ে থাকো

মনে আনন্দ এলে আমি মাঝে মাঝে অজান্তেই
‘জয় বাংলা’ বলে ফেলি। একদিন নিউইয়র্কের ব্রায়ান্ট পার্কে বসে এমনটি
বলার পর বেশ বিপাকেই পড়েছিলাম।
পাশের চেয়ারে বসা তরুণ জানতে চেয়েছিলেন- ‘আর ইউ ওকে!’
তিনি ভেবেছিলেন, আমি নিজের সাথেই
কথা বলছি।

একই অবস্থা হয়েছিল লন্ডনেও। গতবছর,
ট্রাফালগার স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা
বলে উচ্চস্বরে শ্লোগান দেয়ার পর-
আমার দিকে তেড়ে এসেছিলেন এক বাঁশিওয়ালা
তার অভিযোগ ছিল, আমি তার সুরধ্যানে
ব্যাঘাত ঘটিয়েছি।

আমি এভাবেই আত্মালাপ করে করে দেশে বিদেশে,
শুনিয়েছি ৩২ নম্বরে নেমে আসা কালোরাতের
বিষাদগল্প। এভাবেই পঙক্তি লিখেছি
শেখ মুজিবের নামে।
৮৯ এর এক দুপুরে জাতিসংঘ চত্বরে
‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে যে শ্লোগান দিয়েছিলাম,
তা পৌঁছেছিল স্বৈরশাসকের তখত পর্যন্ত।
আমার সতীর্থরা, তেমন স্মৃতি এখনও
মনে করিয়ে দেন। তারা আরও বলেন-
এই জাতিসংঘের পুষ্পবিতানেই একদিন
জনকের ছায়া পড়েছিল।

আমি এখনও সেই পদরেখা খুঁজি।
আজ ১১ মে ২০১৮ এর এক সূর্যময় বিকেলে
ফ্লোরিডার আকাশ থেকে যে স্যাটেলাইট’টি
উড়ে গেল, অথবা আমাদের একগুচ্ছ স্বপ্ন
ছড়িয়ে দিল আকাশে-
সেখানেও উজ্জ্বল হয়ে থাকলো জনকের
শক্তিছায়া,
‘আমি যদি হুকুম দিবার না ও পারি’….
বলে তিনি যে সাহস জাগিয়েছিলেন প্রজন্মের
প্রাণে প্রাণে, সেই প্রজন্মই আজ আবার বললো, ‘জয় বাংলা’
বিশ্ববাসী দেখলো, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন এয়ারস্পেসে,
নিজেদের সাকিন করে নিয়েছে।
#

পদচিহ্নাবলী

সেই দৃশ্য আবার ফিরে আসুক। সেই সমতল ভূমির মন লিখে
রাখুক নাগরী হরফে তাদের পদচিহ্নাবলী। আর যারা পদাতিক
পাতার আড়ালে বার বার লুকিয়েছে নিজেদের কৃতিদিন-স্মৃতিরাত,
প্রভাত হবার আগে জেগেছে চৈতন্যে। বনকে ভালোবেসে সেজেছে
পুষ্পে, নদীকে ভালোবেসে বয়ে গেছে নৈঋতে। দিতে কিছু মন আর
নিকষিত কালের কদম, হিজল – জারুল ফুলে সাজানো বাসরে। ফিরে এসে
বলেছে – সোহাগী আমার ! দ্যাখো এই পুষ্ট ধানদুধে আগামীর সঞ্চিত সম্ভার।

তিনটি কবিতা

পথিক ও পরাণপর্ব

কতটা পথ হাঁটলে হওয়া যায় পথিক! কতটুকু ভূমি
পেলে নির্মাণ করা যায় একটি সড়ক, তা ভেবে আমি,
কখনোই পথে দাঁঁড়াই’নি। বরং কয়েকটি হাসনা-হেনার
ডাল রুয়ে রেখেছি, পথের দু’পাশে। কেউ এসে
নেবে সেই সুবাস।

অথবা কেউ পাঠ করবে মমিচিত্র, মনচিত্র, মানচিত্র
এমন আরাধনায় সাজিয়েছি ভোর, সেরেছি
পরাণপর্বের পঞ্চম সুরবীক্ষণ।

মানুষেরা অনেক কণ্ঠধ্বনিই শোনে না,
মানুষেরা অনেক চিত্রের আদলেই আঁকতে
পারে না নিজস্ব অবয়ব, তা জেনেই
হাত বাড়িয়েছি মানুষের দিকে-
পৃথিবীর সকল পাথরকে সাক্ষী রেখে।
#
ভাসমান যমুনার মুখ

আমাদের রাত্রিকলায় সংরক্ষণ করে রেখেছি নিরংকুশ নদীদের
জীবন। স্রোতের দেখা পেলে মিশিয়ে দেবো আমূল নগ্নতা,
ভূমিতে-শেকড়ে-স্বপ্নের প্রতিটি বিভায়। একটি ভ্রূণের বৃত্তান্ত
লিখে জানিয়ে যাবো জন্মসংক্রান্তির আদি উন্মীলণ। কারা দেখবে
ভাসমান যমুনার মুখ, কারা পাবে পাপড়ির প্রাণপরিধান – সবই
নির্ধারণ করে লিখে যাবো লাভাপৃথিবীর পৃথক ভূগোল। আপাতত:
উৎপাদিত অগ্নিগিরির অনলে-
নিজেদের মুখ দেখে ভেসে যাবো বেদেদের বাহারি জলে।
#

ভুলে যাওয়া উষ্ণতার গান

আর কোনও দিন বৃষ্টি এসে আমাদের ডাকবে না তাদের কাফেলায়।
বলবে না- চলো সমুদ্র দেখে আসি। দেখে আসি পাখিদের সংসার, আর
লাঙল কাঁধে যে পিতামহ প্রত্যুষে ছুটে চলতেন মাটির টানে-তার পদছাপ।
আর কোনও দিন আমাদের ডাক দেবে না কোনও প্রতিবেশী আগুন।
বলবে না- উষ্ণতা নেবে, উষ্ণতা ! সওদাপাতি কিনতে না পেরে যে
অভিমানী পিতা খালি হাতে বাজার থেকে ফিরে যান, দেখবে তার হাত!
অথবা যে মা- সাবালিকা কন্যার দায় মাথায় নিয়ে ঘুরেন পথ থেকে
পথে, আমাদের ডাকবে না সেই পথও। বলবে না- দ্যাখো মানুষ,
তোমরা ভুলে যাচ্ছো অনেক কিছুই। ভুলে যাচ্ছো- তোমাদেরও একদিন
আয়ু ছিল। অরম্ভ ছিল। এখন এই যে তোমরা বেঁচে আছো, তা কিন্তু
মূলত আয়ুহীন। আরম্ভহীন। আরাধনাহীন। শিকলঘেরা বালাখানায়।

জলশুনানী

আমাকে প্রহার করছো মাটি,
আমাকে-
প্রহার করছো আকাশ, এই সবুজ
সকাল ঘিরে আজ উঠবে যে সূর্য,
আমি তার কাছে কোনো নালিশ
জানাবো না। শুধু লিখে যাবো
এই বিষণ্ণ প্রহরে, আমি যখন একা
দাঁড়িয়েছিলাম, আমাকে উদ্ধারে
একটি বারও নামেনি ঝড়। একটুও
এগিয়ে আসেনি শীতলক্ষ্যা নদী।

গলিত মাংসের দোকান

আমার চারপাশে এখন গলিত মাংসের দোকান-
ঝরে পড়ছে লাল মাংস থেকে রক্তের ফোটা
কাঁপছে মাংস, ঢেউ তোলে ভ্রমণ করছে আমার দক্ষিণ
উত্তরে, বাড়ন্ত আলু ক্ষেতের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে,
নতুন মাংসমূল।

থেতলে যাওয়া বাহু থেকে নীল মাংসের
ক্ষত, চিহ্নায়নে এগিয়ে আসছে না কেউ-
কেউ উপুড় হয়ে পড়ে থাকা পাঁজরের মাংসের
পাশে দাঁড়িয়ে তুলে রাখছে প্রথম সেলফি !

মৌ-লোভী’দের কাছ থেকে,
শরীয়া আইনের সনদ নিয়ে মাংস বিক্রি করছে
যে হালাল গ্রোসারি,তার অন্য দরজা দিয়ে
বিক্রি হচ্ছে শূকরের মাংস,
কেউ স্টেক বানিয়ে চিবোচ্ছে হাড়-চর্বি।

আমার চারপাশে এখন অনেক মাংসের দোকান।
মাংসাশী’রা হেঁটে যাচ্ছে। দুলছে। কাঁপছে। উড়ছে…..
কেউ দেখছে রক্তের দাগ,
কেউ;
ভাসতে চাইছে না রক্তস্রোতে, খরায়,বসন্তে অথবা বর্ষায়।

গোলকীপার

গোল হয়ে বসে থাকে দুপুরের দুঃখ। কেউ দেখতে আসেনি আজ, -সেই
বেদনায় মাথা নত করে থাকে অভিমানী মাঘের মেয়ে। এই বসন্ত
এর আগেও কারারুদ্ধ ছিল। এই শীতের শেষে, মাটিচিহ্নে পড়েছিল অগোছালো পুষ্পের ছায়া।

রুদ্ধশ্বাসে উড়ে যাচ্ছে মেঘের গোলন্দাজ বাহিনী। কোনো যুদ্ধ নয়, তবুও
দেশ ছেড়ে অন্যদেশে দখলের পতাকা উড়াচ্ছে বিচ্ছেদের নবম সারিন্দা।
বিরহের জয় হোক। প্রাণজ আনন্দে বেদনার সারিন্দা বাজুক, কথাগুলো আবারও লিখছেন প্রাক্তন বিভাগীয় সম্পাদক।

আমি গোললকীপার হয়ে, হাঁটু গেড়ে বসে আছি। সবগুলো গোল আটকাবোই।
আমাদের পরাজয় ঠেকাতে, আজ মধ্যরাতেই করবো বিকল্প চন্দ্রের সন্ধান।

দুটি কবিতা [] ফকির ইলিয়াস

ছাপতন্ত্র

তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমি জেনে যাই
আমার সীমাবদ্ধতা। জেনে যাই, বোশেখ আসার আগেই
এই নগরে নামবে ঝড়। বিদায়ী চৈত্রের তাণ্ডবরেখা
উড়িয়ে নেবে আমার দারিদ্র, দীনতা, দু’খের দরজা,
কেবল জানালাটি তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে
আর বলবে তুমি কি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাও
কবি! আরও কিছুদিন হতে চাও বেদনার ছায়া বিক্রেতা!

আমি কেবলই পসরাহীন বানিজ্যের সওদাগর হয়ে
ঘাটে ঘাটে ভিড়িয়েছি আমার ডিঙা। কোনো রেখা
রেখে যাবো না জেনেই, রোদের গলায় পরিয়েছি
বাসন্তী মালা, লিখেছি এমন ছাপতন্ত্র- যেখানে কেউ
কখনো খুঁজে পাবে না আমার
একান্ত গমনদৃশ্য।
::

শিকলের শ্রেণীবিন্যাস

লুট হয়ে যায় আমাদের রাজকোষ। যারা জুয়া খেলে
ব্যাংকক, ম্যানিলা,ওয়াশিংটনে- তারা জানে কোথা থেকে,
এসেছে পুঁজি। হ্যকিং সভ্যতার মন্দিরা বাজিয়ে
যারা সারারাত করেছিল মদ্যপান, তারাও ছাড়ে
হুক্কা হুয়া আওয়াজ।

তবে কি শিয়াল তাড়াবার কৌশল ভুলে গেছে
মানুষ ! চৌকি কেঁপে উঠলে “ভূমিকম্প”-“ভূমিকম্প”
বলে দৌড়ে বাইরে বেরুতো যারা,
তারাও এখন হয়ে পড়েছে ঘরকুনো !

বৈষম্যের ব্যাধি নিয়ে কুঁকড়ে উঠছে যে শিশু-
তাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে একজুড়ো
চকচকে কালোজুতো।
::