
করোনা প্যানডেমিকের এই ক্লান্তিকাল
থমকে দিয়েছে দুনিয়াকে
থমকে দিয়েছে শহর-বন্দর গ্রাম, থমকে দিয়েছে পথিকের পথ চলা।
কর্মব্যস্ত মানুষ আজ কর্মব্যস্তহীন
এ যেন ঘরে বসে মৃত্যুর দিকে প্রত্যাগমন করা
সবকিছু দেখেও কিছুই যেন দেখছি না সবকিছু বুঝেও কিছুই যেন বুঝছি না।
এইসব দুর্দশাগ্রস্ত খেটে খাওয়া কুলি শ্রমিক দিনমজুরের মত আটকে গিয়েছি’ আমি আর তুমি; এ যেন শিকলবন্দী জীবন।
এই প্যানডেমিক সিচুয়েশন একই সূত্রে গাঁথা
উন্মুক্ত দুনিয়াকে করেছে আবদ্ধ!
এদিকে পৃথিবীকে অপেক্ষার প্রহরে উৎকণ্ঠিত করেছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
এখানে বাবার অপেক্ষায় ছোট্ট ফুটফুটে
সোনামনিটা চেয়ে থাকে পথের বাঁকে
অসহায় মা তাঁর ভালোবাসার ধন, কলিজার টুকরো সন্তানের অপেক্ষার দিন গুনে।
প্রিয়তমা স্ত্রী’ ব্যাকুল নয়নে, অন্তর্দহনে একরাশ আফসোস আর কষ্ট তাড়িত আবেগ নিয়ে অপেক্ষা করে তাঁর ভালোবাসার মানুষের জন্য।
তোমার বেলি ফুল ভালো লাগে
তাই, প্রতিদিনের খোঁপায় বাঁধা বেলি ফুলটি যেন শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায় প্রিয়জনের অপেক্ষায়।
মনে হতে থাকে এই ক্রান্তিকাল, এই ক্রান্তি লগ্ন যেন শেষ হবার নয়;
আমিও তাদের মত করে অনেক স্বপ্ন দেখি,
স্বপ্ন বুনি; প্রতীক্ষার প্রহরে মন ধৈর্য্য হারা হয়। ব্যাকুল হৃদয় নানা রকম আশংকা তৈরি হয়। কোথায় কিভাবে বিপদ ওত পেতে রয়েছে তা কেই বা জানে।
প্রতীক্ষার দিন, রাত, প্রতিটা সেকেন্ড,প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা ঘন্টা যেন শেষ হবার নয়। সময়; এই দিন, এ রাত পার করা বড়ই কঠিন।
এই বিষন্ন দিনগুলো যেন তন্ন তন্ন করে শেষ করে যাচ্ছে জীবনের সকল সৌন্দর্য, সকল স্বপ্ন, সকল আশা, সকল আকাঙ্ক্ষা। কবে শেষ হবে এই পথ; দুরন্ত দিন কবে আসবে ফিরে?
প্রিয়তম আমার,
দেখবে এই অপেক্ষার শেষ হবে; এই দুঃসময়ে কেটে যাবে। এই নিরানন্দ দিনগুলো পেছনে ফেলে আবার ফিরে আসবে সুন্দর সকাল, সোনালী রৌদ্র, আমরা হাটি হাটি পায়ে পায়ে ছুটে চলবো মেঠো পথ ধরে ঘাসফড়িং এর মত।
আবার নতুন করে শুরু হবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন’
আবার নতুন করে শুরু হবে দিন, এই দুর্বিষহ জীবন পেরিয়ে ফিরবেই সুসময়।
এই অসময় একদিন চলে যাবে;
সবকিছু অতীত হবে, তারপর তুমি আমি মিলিত হব; কোন এক শহরে’ মুক্ত আকাশের নীচে, হুড-খোলা রিক্সায়; বিশুদ্ধ বাতাসে, হাতে হাত রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেব।
সেই সোনালী দিনটি ফিরে আসবে
হ্যাঁ খুব দ্রুত ফিরে আসবে যারা গত হয়েছে
তারা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে
ভবিষ্যৎ গত হবে, সকল দিন হবে অতীত আমরা সেই অতীত বাসনায় অধীর অপেক্ষায়’
যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে বন্দী জীবন পার করছি আমরা প্রত্যেকে, আমরা প্রত্যেকে পার করছি একরাশ আর্তনাদ নিয়ে
বহুরূপী করোনা তুমি; তোমার রূপের পরিবর্তন
না ঘটিয়ে বিদায় নিলেই পারো!
তোমার করালগ্রাসে পুরো পৃথিবী নাস্তানাবুদ
কত প্রাণ হলো বিপর্যস্ত। কত মায়ের বুক হলো খালি
সন্তান হারালো বাবা-মা’কে, কত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হল। মনে হচ্ছে যেন সহস্র শতাব্দী এই অপেক্ষা! ভাবতেই হৃদয়ে কাঁপন ধরে, হার্টবিট বেড়ে যায়।
আহা হচ্ছেটা কি এই পৃথিবীতে
পুরো দুনিয়াটাই যেন নরকে পরিণত হয়েছে।
চারপাশে ভয়ার্ত আর্তনাদ, লাশের স্তুপ
এ যেন এক কঠিন যুদ্ধের দামামা। এ যেন এক অদৃশ্য শক্তির সাথে মানবসভ্যতার টিকে থাকার লড়াই।
কত বুক শূন্য হয়েছে, কত হৃদয় খালি হয়েছে, পিতৃহারা, মা হারা, কত নারীর সিঁদুর মুছে গেল তোমার নৃশংস থাবায়। কত বোন হারিয়েছে তার পিতৃতুল্য ভাই।
কত সেবিকা, কত ডাক্তার অদৃশ্য এই শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে করতে জীবন দিল।
কি এক বিভীষিকাময় সময়, এ যেন এক কঠিন অন্ধকারের যুগ।
প্রিয়জনদের স্বজনহারানো আর্তনাদে
ভারী হয়েছে আই.সি. ইউ, হসপিটাল, শহর-গ্রাম বন্দর, প্রত্যেকটা সেকেন্ড মৃত্যুর দামামা বেজে চলছে, মৃত্যু যেন এক সহজলভ্য বস্তু
যা মানব সভ্যতাকে সহজেই বধ করছে ;
এ যেন এক মৃত্যুপুরী; এই প্রকৃতির মনোরম জগত যেন থমকে যাওয়া মৃত্তিকা।
তবুও আমরা প্রতিদিনের মত অপেক্ষা করছি
নতুন সূর্যোদয়ের; নতুন আশায় বুক বাঁধছি,
নতুন স্বপ্নে, নতুন নতুন ভাবনায়, নতুন আঙ্গিকে জীবনের স্বপ্ন আঁকি,
প্রিয়জনের অপেক্ষায়…
আপন মানুষের অপেক্ষায়, বুক বাঁধি।
কবে এই বন্দি জীবনের অবসান ঘটিয়ে
নতুন একটি আকাশ দেখবো…
বন্দিজীবন ভেদ করে কবে বেরিয়ে আসবো মুক্ত আকাশের নীচে
মুক্তি মিলবে একাকীত্বের, নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে কবে তোমার দেখা পাবো।
কবে বা সড়কে যানবাহন চলবে।
আবার প্রাণচঞ্চল হবে শহর বন্দর গ্রাম
পৃথিবীর এই মহাপথ শব্দ আর কোলাহলের
তাণ্ডবে জ্বলে উঠবে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো।
মানুষ জীবিকার তাগিদে আবার ঘর থেকে বের হবে। প্রিয়জন তার প্রিয়তমার অপেক্ষার প্রহর শেষ করে আবার টেনে নিলে বুকে। আহা অপেক্ষা! এ যেন পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী অস্ত্র যাকে বধ করা এতটা সহজ নয়।
কবে ক্ষুধার্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হতাশা, আনন্দে পরিণত হবে! এই ব্যাধী,এই যন্ত্রণা,এই হাহাকার শেষ হবে। মহুর্মুহু ভাবে প্রহরে-প্রহরে মৃত্যুর মিছিলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে মানুষের আর্তনাদ আর্তচিৎকারের অবসান ঘটবে।
আমরা কেউ কি জানি এই করোনার ক্রান্তিলগ্ন
কবে শেষ হবে! এর থেকে কবে মুক্তি পাব।
কেউ জানিনা; তবুও আমরা আশায় বুক বাঁধি,
তবুও আমরা অপেক্ষায় বুক বাঁধি, দিন আসবে আর মুক্ত করবে আমাদের…
সুন্দর সময়, সুন্দর জীবনের আশায় অপেক্ষায় থাকি। প্রিয় মানুষকে কাছে পাবার আশায় অপেক্ষায় থাকি, তুমি আমি আমরা অপেক্ষায় থাকি, দেখবে সেই সময় খুব নিকটে, খুবই নিকটতম। আমরা মিলিত হব।
আমাদের এই জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী ভূমিকায় থাকা মানুষেরা অবশ্যই জয়ী হবে। জয়ী হবে আমাদের সভ্যতা আমাদের জন্য যারা লড়াই করে যাচ্ছে তারা। আমরা হারতে শিখিনি, হারাতে জানি।
এই ক্রান্তিলগ্ন কেটে যাবে, এই ক্রান্তিলগ্নের অবসান ঘটবে; এই জীবন আবার ফিরে পাবে তার মুক্ত নিঃশ্বাস; স্বাধীনতা আবার হাতছানি দেবে প্রকৃতিতে… এবং মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।