মাহবুব আলী এর সকল পোস্ট

মাহবুব আলী সম্পর্কে

মাহবুব আলী দিনাজপুর, বাংলাদেশ। প্রভাষক। প্রকাশিত বই: ১. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প) ১৯৯২ ২. ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা) ২০১৮ ৩. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প) (রিভাইজড ভার্সন) ২০১৮ ৪. ভয় (গল্প) ২০১৮ ৫. পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় (গল্প) ২০১৮ ৬. অযোগ্যতার সংজ্ঞা (গল্প) ২০১৮ ৭. রাত পাহারা চোখ (গল্প) ২০১৮ ৮. গোপনীয়তার অলিগলি (বড়গল্প) ২০১৮

সৌজন্য সংখ্যা ও আলোচনা (পাঠ্যসূচি বহির্ভূত পাঠ)

সৌজন্য সংখ্যা ও আলোচনা
(পাঠ্যসূচি বহির্ভূত পাঠ)

এক সাদা ঘোড়া অবসরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এলো। অন্য গ্রাম। সরু পথ দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে পুকুরের পাঁশে বাঁশঝাড়ের পার হলো। সেখানে চারপাশ খোলা এক ছোট্ট ঘর। মিঠেল দুপুর। আচমকা হিমেল বাতাস। সেই ঘরের নিমছায়ায় একটি ঘোড়া কচিঘাস চাবায়। তার গায়ের রং তেল চকচকে খয়েরি-কালো। সাদা ঘোড়া চমকে উঠল। হায় এত সুন্দর একজন রয়েছে, আর সে জানে না! সে পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে বলল, –

‘কী করো সুন্দরী?’
‘কেন ঘাস খাই।’
‘তাই তো…তাই তো! তা তুমি আজ আউটিং-এ যাওনি?’
‘মালিকের ভাব এসেছে। কবিতা লিখছে।’
‘তোমার মালিকও কবিতা লেখে?’
‘তিনি এই জেলার বিখ্যাত কবি। তোমার মালিক কী করে?’
‘তিনি গরুর দালাল। তিনি গ্রাম থেকে গরু কেনেন, শহরের বাজারে বেচেন। মাঝে মধ্যে তিনি কবিতা পড়েন এবং লেখেন।’
‘তার কাছে আমার মালিকের কাব্য আছে?’
‘সেইটা আবার কী?’
‘বই গো বই। আইসো তোমারে বই চিনাইয়া দি।’

সাদা ঘোড়া কালো ঘোড়ার কাছে গেল। কালো ঘোড়া একমুঠো ঘাস মুখে নিয়ে জোড়া পায়ে জোর লাথি ছুড়ল। সাদা ঘোড়া ছিটকে পুকুরে পড়ে গেল।

‘বন্ধু ইহাকে সৌজন্য সংখ্যা কহে।’
‘হাঁ হাঁ বুঝেছি। নিশ্চয়ই আলোচনা লিখিব আমি।’

অতপর সাদা ঘোড়া পুকুর হতে উঠে গা-ঝাড়া দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

(গুলতাপ্পি)

উপস্থাপনার পূর্বপ্রস্তুতি

যারা শিল্পসাহিত্য, আবৃত্তি, সঙ্গীত, অভিনয়, রাজনীতি এমন কি শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের কোনো না কোনো সময় মঞ্চে উঠতে হয়। লাইমলাইটে দাঁড়াতে হয়। মাইক্রোফোনে কথা বলতে হয়। এই কথা বলা বা উপস্থাপনা যদি দর্শক-শ্রোতাকে আকৃষ্ট বা মুগ্ধ করে তাহলে তো সমস্যা নেই। কিন্তু একটু অমনোযোগ বা সামান্য অসতর্কতায় যদি দর্শক-শ্রোতা বিরক্তবোধ করেন তাহলে সকল প্রস্তুতি ও উদ্যোগ পণ্ড হতে বাধ্য। তখন যিনি উপস্থাপনা করলেন, নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। আত্মদংশনের শত হুল মনের মধ্যে বিঁধতে থাকে। যতদিন মনে পড়ে ততদিন নিজের মনে বিব্রত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। তাই উপস্থাপনার ক্ষেত্রে পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া ও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

উপস্থাপনা কি?
উপস্থাপনা একটি শিল্প। কেউ কেউ একটু আধটু উপস্থাপনা করতে করতে সময়ে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেন। ঘন্টার পর ঘন্টা দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করে রাখতে পারেন। এটি কোনো মায়াজাল বিস্তারকারী ব্যাপার নয়। যে-কেউ খুব সহজভাবে উপস্থাপনা করতে পারেন। দিনযাপনে যেমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন ঠিক তেমনভাবে বেশ সহজে উপস্থাপনা চালিয়ে যেতে সক্ষম। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আড্ডা বা আসরে চমৎকার কথা বলে চলেন। আড্ডা জমিয়ে রাখার ক্ষমতা অপরিসীম; কিন্তু মঞ্চে উঠতে ইতস্তত করেন। ভয় পান। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বোকা হয়ে তোতলাতে থাকেন। পরবর্তীতে এই কাজ করতে আর আগ্রহী থাকেন না। অথচ কিছু প্রস্তুতি নিলে যে-কেউ চমৎকার ও আকর্ষণীয় উপস্থাপনা করতে সক্ষম হতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

সাধারণভাবে উপস্থাপনা হলো সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য সামনে রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো তথ্য বা অনুভূতির প্রকাশ। এই তথ্য বা অনুভূতি নানান মাধ্যমের হতে পারে এবং তা একটি ধারানুক্রমের নিয়ম অনুসরণ করে সম্পাদিত হয়। এটি মৌখিক হতে পারে। দর্শনযোগ্য হতে পারে, যেখানে ছবি বা চিত্র বিশ্লেষণমূলক বর্ণনা থাকতে পারে। এছাড়া উপস্থাপনা হতে পারে, লিখিত, সঙ্গীত, আবৃত্তি, অভিনয় অথবা সার্বিকভাবে অডিও-ভিজুয়াল। উপস্থাপনা একইসঙ্গে শোনা ও দেখার বিষয় হলেও বেতারে শুধুমাত্র শোনার বিষয়টি থাকে। মঞ্চ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে দর্শকশ্রোতার সরাসরি যোগাযোগ ঘটে। আপনি একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখলে তাঁদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খুব সহজে অনুধাবন করতে পারেন। তাদের ইতিবাচক অবস্থান আপনাকে উৎসাহিত করে তোলে। বিপরীত অবস্থান হতোদ্যম করে দেয়। সেক্ষেত্রে আপনার চলমান উপস্থাপনা আরও খারাব হয়ে যেতে বাধ্য।

উপস্থাপনার উদ্দেশ্য:
যেভাবেই বিশ্লেষণ করা যাক না কেন প্রতিটি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। এগুলোকে এভাবে বলা যেতে পারে। ১. কোনো ঘটনা, গবেষণা, আবিষ্কার কিংবা অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। ২. কোনোকিছুর সেবা প্রদান উপলক্ষ্যে অর্থাৎ সার্ভিস ডেলিভারির বিষয় প্রতিপাদন করা। ৩. কোনোকিছুর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা এবং একইসঙ্গে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা। ৪. কোনো পণ্য সম্পর্কে বিক্রয় ও সেবার উপর বিস্তারিত ধারনা প্রদান। ৫. কোনো সংঘ বা দল বা এজেন্সি বা দপ্তর সম্পর্কে প্রতিনিধিত্বমূলক বক্তব্য প্রদান। ৬. কোনো বিশেষ বিশ্বাস ও মনমানসিকতার বিষয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু বলা। ৭. কোনো বিশেষ দাবি, সমাধান প্রস্তাব, চিন্তা বা কাজের পথ নির্দেশনার জন্য বক্তব্য প্রদান এবং ৮. কোনো বিনোদনমূলক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মনোজ্ঞ উপস্থাপনা।

উপস্থাপনার সাত দিক:
যে-কোনো উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আয়োজনকারীকে কতগুলো বিষয় বিবেচনায় আনতে হয়। এগুলোকে পর্যায়ক্রমে এভাবে বলা যায় যে, উপস্থাপনাটি কেন বা কী জন্য নির্ধারণ করা হচ্ছে? সেটি কে বা কারা করবেন? উপস্থাপনাটি কাদের বা কোন লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য? কী বিষয়ে উপস্থাপনা? সেটি কোন সময়ে করা হবে? কোন স্থানে বা কোথায় এই আয়োজন? উপস্থাপনাটি কোন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সামনে খুব সহজে একটি প্রোগ্রামের সার্বিক দিক দৃশ্যমান হয়ে উঠে। যেমন ধরা যাক, একটি কবিতাপাঠের প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠান করা হবে। তাহলে দেখা যায়, অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনা কোনো একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছে। তাহলো কবি ও তার কবিতাকে জনসমক্ষে উপস্থাপন করা। অন্যতম এই লক্ষ্যের সঙ্গে দ্বিতীয় বা পরোক্ষ উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণের মধ্যে কবিতাকে জনপ্রিয় করে তোলা। এই প্রোগ্রামের বিভিন্ন অংশে প্রমুখ ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট করা আছে। তাঁরা কবির অথবা একাধিক কবির কবিতা পাঠ করবেন। কবি নিজেও তাঁর কবিতা পাঠ করতে পারেন। যিনিই করুন এক বা একাধিক উপস্থাপক সার্বিক অনুষ্ঠান দর্শকশ্রোতার মাঝে তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠান কবিতাপ্রেমিক সকল ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত। অনুষ্ঠানের মূল বিষয় জনৈক কবির কবিতা পাঠ এবং প্রাসঙ্গিকভাবে বিষয়সংশ্লিষ্ট আলোচনা থাকতে পারে। অনুষ্ঠানটির একটি নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ ঠিক করা থাকে যেমনভাবে কোথায় অর্থাৎ কোন্ ভেন্যুতে হবে সেটিও নির্ধারিত। এখন বিবেচ্য বিষয় কবিতপাঠের এই আয়োজন কোন প্রক্রিয়ার সম্পন্ন করা হবে যা দর্শকশ্রোতাকে আনন্দ দেবে একইসঙ্গে তাঁকে ভাবার ও স্ব-ভূমিকা রাখার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। অনুষ্ঠানটি কি সাধারণভাবে করা হবে নাকি কিছু অলঙ্করণ করা হবে? যেমন: ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড এফেক্ট, ভিজুয়ালাইজেশন এবং অংশ্রগহণমূলক পদ্ধতি রাখা হবে কি না? বস্তুত একটি অনুষ্ঠান বা প্রোগ্রাম আয়োজন করার ক্ষেত্রে আয়োজক বা আয়োজকগণের নিজস্ব মেধা পছন্দ-অপছন্দ, দক্ষতা ও দূরদৃষ্টি অনেক কাজ করতে পারে। দক্ষ আয়োজক বা উদ্যোক্তার জন্য যেমন একটি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হতে পারে তেমনভাবে একজন দক্ষ উপস্থাপকের মাধ্যমে দুর্বল অনুষ্ঠান বিশেষভাবে প্রশংসা কুড়িয়ে আনতে পারে ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

উপস্থাপকের পূর্বপ্রস্তুতি:
যে-কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে উপস্থাপকের পূর্বপ্রস্তুতি থাকে। এটি করা থাকলে উপস্থাপনার গুণে প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত ও সফল হয়। উপস্থাপনার সাতদিক বিবেচনায় এনে আমরা যদি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি একটু দৃষ্টি দিই তাহলে উপস্থাপনা সাবলীল হবে এবং যে-কোনো ভঙ্গুরতা এড়ানো সম্ভব। যেমন:

১. নিজের পোশাক ও অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। কোন ধরনের পোশাক পরবেন, আপনার হাঁটাচলা, নড়াচড়া, কথা বলা সবকিছুতে স্বাচ্ছন্দ্য আছে কি না পরখ করুন। গলা শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে পানি খেয়ে নিন। অহেতুক উষ্ণতা বা গরমবোধ যাতে না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিন। উত্তেজক খাদ্য পরিহার করুন। অতিরিক্ত মেকআপ না নেয়া সবচেয়ে ভালো। আত্মবিশ্বাসী থাকুন। তবে কখনো জ্ঞানীর ভূমিকা নিতে যাবেন না।
২. যে বিষয়ে উপস্থাপনা করবেন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা নিন। যদি অতিরিক্ত গবেষণার আবশ্যক হয় তা সম্পন্ন করুন। সময় সম্পর্কে সচেতন থাকুন অর্থাৎ কতটুকু সময় ধরে কথা বলা দরকার তা ঠিক করুন। এই উপস্থাপনার মাধ্যমে আপনি কি একটি অথবা তারও বেশি বার্তা পৌঁছুতে আগ্রহী?
৩. কারা এই অনুষ্ঠানের দর্শক শ্রোতা হয়ে এসেছেন? কী জন্য এবং কিসের আগ্রহে তাঁরা এসেছেন? সংখ্যায় তাঁরা কত হতে পারে? তাঁরা কি আপনার ভাষা ও কথা সহজভাবে বুঝতে পারেন অর্থাৎ আপনি কি তাঁদের কাছে আপনার বক্তব্য সঠিকভাবে নিয়ে যেতে সক্ষম?
৪. প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানটি কোথায় আয়োজিত হচ্ছে? সেখানের আসন ব্যবস্থা ও মঞ্চ কেমন? দর্শক-শ্রোতাদের প্রতি আপনার বক্তব্য সঠিকভাবে পৌঁছুনোর সুব্যবস্থা আছে কি না? বিদ্যুৎ ও আনুষঙ্গিক সহযোগগুলো আছে কি না? উপস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমগুলো সচল বা কর্যকর আছে কি? প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠান ঘোষিত সময়ে আয়োজন করা গেলে দর্শক-শ্রোতাকে বিরক্তির হাত থেকে রক্ষা করে যা একজন উপস্থাপকের জন্য একটি ইতিবাচক সুবিধা।
৫. অনুষ্ঠানের সঙ্গে আপনার উপস্থাপনার বিষয়টি মানানসই আছে কি এবং কিভাবে তা ভেবে দেখা দরকার। দর্শক-শ্রোতা যাতে ক্লান্তি বোধ না করেন তা দৃষ্টিতে রাখা। যদি তেমন হয়ে থাকে তাহলে তাঁদের উজ্জীবিত করার জন্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিলে যায় এমন বিকল্প উপস্থাপনার প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন।
৬. কিভাবে উপস্থাপনা করছেন? মাইক্রোফোনে? কোনো ওভারহেড প্রজেক্টর বা অন্যকোনো অডিও-ভিজুয়াল ব্যবহার করে থাকলে আগে থেকে তার অপারটিং পদ্ধতি শিখে রাখুন।
৭. দর্শকশ্রোতাদের কাছ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করছেন তার একটি আনুমানিক চিত্র মনে মনে আঁকতে পারেন। অথবা তাঁদের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া তৈরিতে উপস্থাপনা করছেন তা অনুমান করুন ও উদ্বুদ্ধ হোন।

মূলত যিনি উপস্থাপনা করবেন তাকে সবদিক থেকে চিন্তা করে সাবলীল হতে হবে। নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস আনতে হবে। মঞ্চে এমনভাবে দাঁড়ানো যাবে না যাতে আপনাকে বোকা বোকা লাগে আবার খুব বেশি অহংকারি মনে হয়। সাধারণত উপস্থাপনারে ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় যে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, কানে ভোঁ ভোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে, নিজেকে বোকা দেখাচ্ছে বলে ধারনা হতে থাকে, অহেতুক তাড়াহুড়োভাব এবং ভুল হয়ে যায়। সর্বোপরি দর্শকশ্রোতা বিরক্তবোধ করছেন বলে মনে হতে থাকে।

সেক্ষেত্রে আপনি নিজের জন্য আত্মবিশ্বাস ফেরাতে এই ব্যবস্থা নিতে পারেন: ১. আপনি যোগ্য এবং দক্ষ বলে উপস্থাপনার কাজটি করতে এসাইন্ড হয়েছেন। ২. দর্শক-শ্রোতা আপনার কথা শুনতে আগ্রহী। ৩. তাঁদের মধ্যে আপনার চেয়ে অনেক জ্ঞানী ও দক্ষ ব্যক্তি থাকলেও আজ তাঁরা আপনার পক্ষে আছেন। ৪. কোনো বিষয়ে মতদ্বৈততার মানে এই নয় যে, তাঁরা আপনাকে আক্রমণ করছেন।

যা করবেন:
১. মঞ্চে উঠে সবচেয়ে আগেই দর্শকশ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানের বিষয়ে দুটো কথা বলবেন।
২. যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী এবং ইতিবাচক মনোভঙ্গীর প্রকাশ করবেন।
৩. শুরু করার আগেই মনে মনে একটি ধারানুক্রম সাজিয়ে নিন যে, কী কী বিষয় এবং কখন কখন বলবেন।
৪. মূল অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ সময়ের কতটুকু অংশে নিজের উপস্থাপনা রাখবেন তা পরিমাপ করে নিন।

যা করবেন না:
১. কখনো ওজর তুলবেন না। দুঃখ প্রকাশ করবেন না। কিংবা নিজের দুর্বলতা বা সবলতা সম্পর্কে বলবেন না। নিজেকে হাস্যকর রূপে হাজির করবেন না।
২. এলোমেলো এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে কথা বলবেন না।
৩. দর্শক-শ্রোতাদের প্রতি কোনো অভিযোগ করবেন না। তাঁদের কোনো কৃত কাজের উল্লেখ করবেন না।
৪. সমাজে বলা অসঙ্গত এমন কৌতুক বা উপকরণ পরিবেশন করবেন না।
৫. এভাবে উপস্থাপনা শুরু করবেন না যে, ‘প্রিয় দর্শক-শ্রোতা এবার আমি আপনাদের সে বিষয়টি বলতে যাচ্ছি যা আমাকে বলতে বলা হয়েছে যে,… ইত্যাদি ইত্যাদি।’
৬. এমন ভাব নেবেন না যাতে বোঝানো হয় যে, আপনি সবকিছু জানেন। এমন কি যে-কোনো যুক্তিতর্কে আপনি অবশ্যই বিজয়ী হবেন।
৭. দর্শকের সারিতে থাকা সুধিসমাজের প্রতি কোনো প্রশ্ন বা উক্তি ছুঁড়ে দেবেন না যা অত্যন্ত বিব্রতকর ও বিরক্তিকর।

পরিশেষে:
উপস্থাপনার বিষয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। যেমন: অনেকে বলে থাকেন, উপস্থাপনার বিষয়টি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি মেধা। এটি সহজে কেউ পারেন না। প্রথমেই যখন পারলাম না তখন কোনোসময়ে পারব না। অনেকে শুনলেন কিন্তু কেউ সাধুবাদ দিল না, অর্থাৎ উপস্থাপনা ভালো হয় নি। অন্যেরা চমৎকার ও সার্থক উপস্থাপনা করেন। আমার দ্বারা এটি হবে না। ইত্যাদি। কিন্তু সার্বিকভাবে বলা যায় যে, উপস্থাপনার বিষয়টি চমৎকার এবং উপভোগ্য। শুধু একটু সতর্ক প্রস্তুতি ও নিয়ম রক্ষা করলে যে-কেউ একজন সফল ও জনপ্রিয় উপস্থাপক হতে পারেন। তখন এই কাজে সবকিছুই আনন্দদায়ক হয়ে উঠে।

সূত্র: ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী_মাহবুব আলী

চালচিত্র

চালচিত্র

বিষ বেচেই কেউ ফুলেফেঁপে লাল
তিনতলায় থাকে শীতাতপ ঘরে
অমৃত সুধা হাতে দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে যে
সে মানুষ বসে থাকে পায়ের তলায়।

মোড়ে মোড়ে বসিয়ে দাও শুঁড়িখানা
হাজার ভক্তের ভিড়ে হয়ে যাবে মৌতাত
সাদা দুধ বাড়ি বাড়ি কড়া নাড়ে
ভিখিরি আজও কষ্টে বাঁচে অসহায়।

শয়তানের বসবাস মানুষের মগজে
স্নায়ুতন্ত্র থেকে রক্তের শিরায় শিরায়
ঈশ্বর আজও পলাতক তাড়া খাওয়া কুকুর
অনায়াসে বিক্রি হয় মাত্তর দু টাকায়।

গরিবের বুকে চড়ে মিষ্টি হাসিতে
হাজার কথামালা স্বপ্নিল চাটুবাদী মায়া
দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায় সমাজের দালাল-

গরিব সেই আজও গরিব
জোন দেয়…ঋণ করে…মার খায়
কাঁধভাঙা হিসাব কষে সূদ কিস্তির
দিনশেষে কড়ায়-গণ্ডায়।

(এপ্রিল ’৯৬)

শিরোনামহীন একজোড়া সাদা কেটস্

রক্তভেজা একজোড়া সাদা কেটস্
শুকিয়ে জলরং নকশি আঁকা ভূ-সীমানা,
অচেনা ডোবায় উপুর ভেসে থাকে কেউ
ডুবুরি টেনে তোলে ফ্যাকাশে তার লাশ,
মুখ উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকা খোলা চোখ
মরামাছ দৃষ্টি তুলে বলে যায়,
হে মানুষ বলো কী অপরাধ?

ওদিকে দু-দিন হয়ে গেল
আঙিনায় কোনো পাখি আসে না
চঞ্চল ডেকে ওঠে না ডালিমের ডালে
মেহেদির ফুলে ফুলে সাদা হয় আকাশ
গুমট বাতাসে কোনো সুবাস ভাসে না।
দু-একটি কাক শুধু তীব্র ভেসে যায় উত্তর-দক্ষিণ
খুঁজে ফিরে বুঝি শান্তির ঠিকানা।

‘ছেলেটা আজও ফিরে আসেনি,
কোথায় আছে…কেমন আছে কেউ জানে না।’

কত কথা কত গল্প শোনা যায় বাতাসে
কারও চোখে কালো পাজেরোর ছায়া
বুকে এসে ধাক্কা মারে মায়ের মন
সিসি ক্যামেরায় কোনো ছায়া ধরা পড়ে না
কোথায় হারিয়ে গেল সে কেউ কিছু বলে না।

সে আজ দেখ ডোবায় ভেসে ওঠে
কেউ খুবলে নিয়েছে তার চোখ পাণ্ডুর আকাশ
সেই দৃষ্টিতে কোনো স্বপ্ন ছিল একদা ছায়া ভাসমান
আজ অপলক মৃত কোনো কবিতা তাকিয়ে থাকে।

রক্তের দাগে অস্থির দুপুর কেটে যায়
রাস্তার বাতাসে শ্লোগানের মুহুর্মুহু ধ্বনি
কারও পিঠে জমে যায় কালশিটে দাগ
রক্তের আলপনা লিখে রাখে মানুষের ইতিহাস।

আমরা আবার হেঁটে যাই ফুটপাতে রাস্তায়
তড়িঘড়ি বাসে উঠি অফিসের সময়
রক্তছোপের উপর চলে যায় গতিশীল চাকা
জীবনযাপনের শত উপাচার নিয়ে ব্যস্ত থাকা।

কে ফেলে গেল রক্তমাখা সাদা কেটস্ একজোড়া?
কে ভেসে ওঠে ডোবার জলতলা থেকে দুপুরের আলোয়?
আমরা দেখি আমরা ভাসি কথকথায় গল্পগুজব আড্ডা
কি যায় আসে বলো এই দিনকালে খবরের কাহিনি
আমরা বাঁচি নিজেদের নিয়ে নিজেদের কথায়।

শিরোনামহীন একজোড়া সাদা কেটস্ রক্তরেখা
চপেটাঘাতে মুছে দিক মিথ্যে গরবের ইতিহাস।

(১.৮.১৮)

হারামখোরের পেট

হারামখোরের পেট

১.
এত রাতে সে লোক আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। রহমান তারপরও স্টেশনে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। প্রচণ্ড শীত। হু হু করে বইছে হিমেল বাতাস। রাতের শেষ ট্রেন প্লাটফরম কাঁপিয়ে চলে যায়। সে অলীক কোনো স্বপ্নের মতো তার পেছনে তাকিয়ে থাকে। একটি ধাবমান লাল আলোকবিন্দু খুব দ্রুত দিগ্বলয় ভেদ করে পুবের জমাট অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। যেনবা তার সমস্ত প্রত্যাশা মিলিয়ে যাচ্ছে সেই নিশীথ গহ্বরে। আকাশের একলা আধখানা চাঁদ নির্ণিমেষ তাকিয়ে আছে নিচে। পুব দিকের ডোবায় ঝিলমিল করছে তার শুকনো প্রতিবিম্ব। সে করবী গাছের তলায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসে থাকে। দু বগলের ভেতর দু পাঞ্জা গলিয়ে দিয়েছে। হাঁটুর উপর মাথা। নিজেকে থেকে থেকে খুব চেপে ধরছে। শীতের আগ্রাসী থাবা এভাবে ঠেকাতে চায়। হয়তো আর কোনো ট্রেন নেই। ঢাকা মেইল ডাউন হয়ে দিনাজপুর ঘুরে আবার মুখের উপর দিয়ে পার্বতীপুর ফিরে গেল। মন্মথপুরের এই থাকা না থাকা স্টেশন ধরে নি। ট্রেন দাঁড়ালেও কোনো লাভ হতো বলে মনে হয় না। তখন তেমন কিছুতে মনে জোর নেই। অনেক রাত হয়েছে। সে লোক আসবে না। যে আসার…ইচ্ছে থাকলে অনেক আগেই আসতো।

দবির তার টঙের মতো চার ফুট উঁচু ছোট দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করছিল। বানর-টুপিতে মাথা মুখ ঢাকা। ঘুমকাতুরে হাই তুলতে তুলতে বলে, –

‘আর কত্থন দেখিবেন বারে? টেরেন আর নাই। এ্যলা আইত মাঝ পহোরে ঠেকবা নাগছে। তোমহার ম্যানেজার সায়েব কি আর আইসবে রহমানদা!’
‘নহায় রে আর একনা টেরেন আইসবে বোধহয়। দ্যাখঁ যদি আইসে।’
‘হুহ্! খামাখা কি যে করেন তোরা!’
তারপর ট্রেন আর আসে নি। চলে গেছে শুধু প্রতীক্ষার ধাবমান সময়। স্টেশনের পুব কোণায় একটি ডোবা। সেখানে ঘুপ্-ঘুপা-ঘুপ্ করে জলকেলিরত পানকৌড়িও থেমে গেছে। রহমানের ধৈর্যের শেষ নেই। একবার অজানা অন্যমনষ্কতায় জিজ্ঞেস করে বসে, –

‘দবির আইত কয়টা বাজে বাহে? পেটের নাড়ি ভোগত ছিঁড়ি যাবা নাগছে।’

দবির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে শুয়েছে মাত্র। অস্ফুট কাতর ধ্বনির সঙ্গে উঠে বসে ম্যাচ জ্বালায়। ঘড়ি দেখে। মাথা বের করে বলে রাত একটার কাছাকাছি। সেই টুকরো আলোয় দোকানে ঝুলে থাকা ছোট ছোট কয়েকটি পাউরুটি রহমানের চোখ ঝলসে দেয়। ক্ষুধার তীব্রতা শুকনো জিহ্বাকে ভিজিয়ে তোলে। ঠাণ্ডা বেঞ্চের এককোণায় অসম্ভব কুণ্ডলিত নড়ে উঠে সে। পুরো স্টেশন চত্বর ফাঁকা। আকাশ থেকে চাঁদের আলোধোয়া শিশির ঝরে পড়ছে। থেকে থেকে কনকনে বাতাসের ঢেউ। এক ভুতুড়ে পরিবেশ। স্টেশন মাস্টারের বন্ধ ঘরে টিমটিমে আলোর কিছু কণা ফোল্ডিং দরজার ফাঁকফোকড় দিয়ে বাইরে আছড়ে পড়েছে। আর এই নিঃসীম তেপান্তরের মধ্যে রহমান নিজেকে বিষফোঁড়ার মতো উৎকট ভেবে নেয়। পেটের ভেতর মোঁচড় দিয়ে মাথা গুলিয়ে যেতে থাকে। সেই কখন খেয়েছে!

সকালে নতুন ভাটার সুড়ঙ্গ চেক করে। চেম্বারে বাঁশের মুড়ো ঠেলে দেয়। তারপর নদী পাড়ের হাটখোলা। সেখানে দুখানা লুচি খায়। সেনগুপ্তের রেস্তোরাঁয় খুব ভালো তৈরি হয়। সাধ হচ্ছিল পেট পুরে খায়। কিন্তু অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে দমন করেছে। পকেটে কয়টি মাত্র টাকা। ওদিকে বাড়িতে ওরা দুদিন কি খেয়ে যে আছে কে জানে! মেয়েদুটোর চেহারা তার চোখে ভেসে ওঠে। ক্ষীণ স্বাস্থ্যের মধ্যে দু জোড়া উজ্জ্বল চোখ। সে চোখে কোনো অভিযোগ নেই। শুধু মায়ার বাঁধন। তারপর ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে আনছু আরা আর বুড়ো বাবার মুখ। আনছু আরা খুব বিরস বদনে তার প্রতীক্ষায় রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। রহমান সে দৃশ্য কল্পনায় কেঁপে কেঁপে যায়। দু হাঁটুর মাঝখানে চেপে রাখা মাথা আস্তে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, –

‘দবির পারুটির দাম ক টাকা বাহে? মোক একখান দেও তো।’
‘রাইতত্ ভাত খান নাই রহমানদা? আর এত্তি কোঠে ভাত খামেন! সঅব দুনম্বরি।…পারুটি খামেন? একটায় দুই টাকা। দেমো?।’

দবিরের ঘুম দু পয়সার ধান্ধায় উধাও হয়ে যায়। এমনি বেচাবিক্রি নেই। ট্রেন সময় মতো আসে না। লোকজনের ভিড় নেই। ভিড় হলে পান-বিড়ি এটা-ওটা বেশ ভালো বিক্রি হয়। আজকাল লোকজন শহরে তেমন যায় না। আসেও না। ব্যবসায় মন্দা। সে চট করে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া টুকরো মোমবাতি জ্বালায়। রহমানের হাতে একটি পাউরুটি তুলে দেয়। প্রায় চুপসে যাওয়া এক টাকার দুটো নোট খুব যত্নে বাক্সে রাখে। নজরে পড়ে ক্ষুধার্ত লোকটি কাঁচা মাংস ছিঁড়ে খাবার মতো রুটিতে দাঁত বসিয়েছে। আলো-অন্ধকারে জ্বল-জ্বল চোখদুটো হয়তো কোনো মানুষের নয়।

‘রহমানদা এত্তি তো পানি পামেন না। মোর কাছোতে ছিল…ফ্যালে দিছু।’
‘থাউক…থাউক। নাই যেখন নাই।’
‘আলোটাও নিভি দেবার লাগবি বাহে। একটু নিঁদ যাও।’
‘নিন্দা…নিন্দা।’
‘রহমানদা আর এইঠে কত্থন থাকিমেন? যা জাড় শুরু হইছে! ভাটাত চলি যান। ওঁয় মানুষ আর আসিবে না।’

রহমান কিছু বলে না। চোখের সামনে মোমবাতির শিখাকে তার অসহ্য মনে হয়। ভয় করে। লজ্জা লাগে। বাড়িতে সবার মুখে খাবার জুটেছে তো! আনছু আরা জোগাড় করতে পেরেছে? বুড়ো বাপ? পরশুদিন আবার বলেছে, –

‘বা অহমান মোক কেনেবা মুর্গির ঝোল দিয়া গরম ভাত খাবা মনাছে। স্বপোনত্ দেখিনু বউ বড়ও একনা মুর্গি রান্ধোছে…কি তার খুসবু! মুই গরম ভাত খাইম বা। উটি খাবা পারো না বাপ। জিউ উল্টি আইসে।’

সে বুড়ো মানুষটিকে আবার সান্ত্বনা দিয়ে ছাপরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। আনছু আরা দরজায় দাঁড়িয়ে আকুল চোখে কী বলতে চেয়েছে, একপলক দেখেই বুঝে ফেলে। তাই শত দুর্ভাবনা আর কষ্টের চেহারায় হাসি ফুটিয়ে নিজের মধ্যে বিশ্বাস খুঁজতে চায়।

‘ম্যানেজার আসিবে। আট ন মাসের বেতন বাকি। আইজ দিবে কইচে। মিন্তির মাও টাকা পাইলে একনা মুর্গি আনিম। অনেকদিন ধরি বাপ খাবা চাছে। তুই ভাবিন না। মুই সাঁঝোতে চলি আসিম।’
‘ভালমতোন থাকেন। দেরি করেন না ফির। ঘরোর অবস্থা তো জানোইছেন।’
‘মুই টপ করিই আসিম। টাকা নিতে আর কত্থন?

ভেবেছিল ম্যানেজার দুপুর বারোটার ট্রেনে আসবে। মটরসাইকেল খারাব। দুদিন আগে ট্রলিতে পাঁচ হাজার ইট শহরে গেছে। টাকা অবশ্যই আছে।

২.
সেদিন নীল রঙের ট্রলি ড্রাইভার কেরামত মিয়া তাকে একদিকে ডেকে নেয়। দুজনে জামগাছের নিচে উঁচু ঢিপিতে বসে। পৌষের রোদ বেশ মিষ্টি লাগে। সামনে সর্ষের ক্ষেত। দু চারটি গাছে কচি ফুল। কিছুদিনের মধ্যে সবগুলোতে ফুল আসবে। চারিদিক হয়ে যাবে হলুদে হলুদ। সে দৃশ্য বেশ মনোরম। রহমান সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে যায়। কেরামত মিয়া বেশ দামি এক সিগারেট এগিয়ে দেয়।

‘আজ একটা বিড়ি খা রে দাদা। তুই তো নিরামিষ হয়ে গেছিস। আমার মতো মাল খেতিস, দেখতি তোর মরা চেহারায় আনন্দ খেলছে।’
‘কি যে কবা লাগছেন কেরামত ভাই। মুই যে বিড়ি খাও না তাই কছেন। তা দেন আইজ একটা সিগ্রেট খামো।’

রহমান প্রথম টান দিয়েই খুক খুক করে মুহুর্মুহু কাশতে থাকে। মুখ ভর্তি লালা জমে যায়। মানুষে এসব খেয়ে কি যে মজা পায় সে বুঝতে পারে না! দুজন লেবার ট্রলিতে ইট সাজাচ্ছিল। সেখান থেকে হাসির রোল ওঠে।

‘ওস্তাদ রহমানদাকে ট্রেনিং দিচ্ছো নাকি? ওর তো যক্ষ্মা হয়ে যাবে। রহমানদা ক্যান্সার হবে গো…খেও না।’

আবার হাসির রোল। রহমানের দুচোখে পানি এসে যায়। ঝাপসা হয়ে পড়ে দৃষ্টি। সে সিগারেটে কোনো মজা পায় না। আবার সেটি ফেলতেও পারে না। কেরামত ড্রাইভার ঠেস ধরা কথা বলবে। সে দ্রুত টান মারতে থাকে। মুখ দিয়ে নীল-ধূসর ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দেয়। আর কিছু না হোক গন্ধটি বেশ। নেশা নেশা লাগে।

‘তারপর রহমানদা একটো সিগারেট খেতে পারছো না। ওদিকে মানুষ হারাম কামাইয়ে লোহা হজম করে ফেলছে। নাহ্ তুমি শালা একটা বুরবাক আছো।’
‘ওইটা ফির কি?’
‘হা হা হা! এই রশিদ বোঝা, রহমানকে বোঝা বুরবাক কাকে বলে।’

ওদিক থেকে আবার হাসির ঢেউ ভেসে আসে। রহমান বুঝে ফেলে বড় ফাউল করে ফেলেছে। সেও বোকার মতো হাসতে থাকে।

‘তা কেমুন আছো রহমানদা। বালবাচ্চা বুড়া বাবা বউ সবাই ভালো তো? তুমার সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। আজ দেখা হয়ে বেশ ফুর্তি লাগল। তাই মজা করছি আর কি!’
‘খুব ভাল নহায় ভাই। টাকা পাইসার খুব কষ্ট।’
‘তুমার চেহারা দেখে এটাই মালুম করছিলাম। আমি তো এক মাস রাণীশংকৈল খাটলাম। ওখানের ভাটাতে ভি কম্মচারিদের বেতন বাকি পড়েছে।’
‘তোমার বাকি পড়েছে? ক মাসের?’
‘ছিল ছিল…গেল হপ্তায় কিছু নিলাম। সব ক্লিয়ার হয় নাই। অন্য জায়গায় কাজ খুঁজছি। পেলে লাথি মেরে ভাগব। এখানে তো টাকার কথা বললে শুনি বিজিনেস নাই কালেকশান নাই। নানান বাহানা। আবে শালা আমি কি তুমার পাটনার আছি যে…। মাদারচোদ। চাকরি করি। ট্রলি চালাই। মাস যাবে বেতন দিবে। আমি খুশ তুমি খুশ। নাকি রহমানদা?’

রহমান কথায় ড্রাইভারের সঙ্গে পেরে উঠে না। আবাঙালি লোক। যেমন আলাপি তেমন অল্পতেই মুখ দিয়ে খিস্তি বেরোয়। শুনেছে যারা ট্রাক-ট্রলি চালায় তারা নাকি নেশা ভাঙ করে। নেশা না হলে থাকতে পারে না। গাজা খায়। মদ খায়। আর কি কি যে খায়! ওতে উল্টা-পাল্টা কথা বলে। তুই তোকারি করে। তা ভাটার মালিকও খায়। গতবছর শীতের আগে-আগে মালিক ভাটায় এসে থেকে ছিল। সঙ্গে এক বয়োবৃদ্ধ ছোঁড়া। তপসে…না তাপস কি যেন নাম। টিংটিঙে আর গাল টসকানো চেহারা। ঢ্যাঙ্গা…লম্বু। লোকটির কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠার হাড় প্রচণ্ড ওঠানামা করে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, কন্ট্রাক্টর সাহেবের এসিস্টেন্ট। লোকটিকে তার পছন্দ হয় নি। গায়ের রঙ যেমন কালো তেমন চোখের চাউনি। সারা ক্ষণ কুতকুতে চোখে কি যেন খুঁজে বেড়ায়।

পরদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কোনো না কোনো ছুতোয় আরিফার ডাক পড়ে। সে কাজ ফেলে বারবার টিনের ছাপরা দেয়া অফিস ঘরে যায়। রহমান সব লক্ষ্য করে। কয়েক মাস হলো বউটিকে তার স্বামী ছেড়ে দিয়েছে। দেখতে শুনতে কে বলবে গরিবঘরের বউ! সাজালে ফিল্মের নায়িকা হার মানে। রহমান জানে স্বামী লোকটি বেহুদা। নেশা করে। জুয়া খেলে। সে তার মূল্য বুঝতে পারে নি। বোঝার ক্ষমতা নেই। রহমান এ বিষয়ে নিশ্চিত। আরিফা তার গাঁয়ের মেয়ে। অসুবিধায় ছিল। সে তাই এখানে এক কাজ জুগিয়ে দিয়েছে। সারা দিন ফর্মায় কাদামাটি ফেলে ইট তৈরি করে। অন্যান্য কাজও করে। দিনমজুর মানুষ। বুড়ি মা ছাড়া কেউ নেই। খুব অসহায়।

রহমান কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেশ সন্দেহ নিয়ে ভাবে। ওকে কেন বারবার ডাকা হচ্ছে? বুঝে না বুঝেও কিছু বলে না। ভাটাতে তো অনেককিছু হয়। সব কথা বলা যায় কি? সে সন্ধ্যায় খুব আড়াল করে তাকে ডেকে নেয়। তারপর দুজনে ডিস্ট্রিক্টবোর্ডের রাস্তায় হাঁটে। ভাটা থেকে বেশ দূর। শুধু চিমনি আর ধোঁয়া দেখা যায়। ধোঁয়া মানে সেখানে আগুন আছে। রাস্তা থেকে সামান্য দূরে পুবদিকে স্টেশন। চলন্ত ট্রেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে পেছন ফিরে একবার দেখে। তারপর থামে। বলে, –

‘হ্যাঁরে তোক বারবার ডাকাছিল্ ক্যান?’
‘তা মুই কি জানো রহমানদা? মালিক মানুষ। ওই ঢ্যামনাটা কথা কছে।’
‘তাঁয়বলি বারবার ডাকাবি? তুই খুলি ক তো কি কছে?’
‘ওই পুরান কাথা। কেংকরি সংসার ভাঙিল। ফের বিয়া করবার হাউস আছে কি না। ম্যালায় কাথা ভাই। মোর এটি কাজ করা হবি না রহমানদা।’
‘তুই কি কলু? বিয়াত বসবু?’
‘ক্ষ্যাপেছেন ভাই! এইলা দুদিন ফুর্তির তনে কছে। চউখের মাথা মুই বুঝা পাঁও না?’
‘তুই ক দিন বাড়িত থাক। এ্যলা তোর মাও কেংকা আছে?’
‘আছে ভাই একেরকম। যাবার সমায় হইছে। চলি গেইলে মুই ফের কুণ্ঠে যাম?’
‘ফের বিয়া করবু…জীবন তো আর বসি থাকে না।’
‘তুই ফের কি কছি রহমানদা? মোক কাঁয় নিবি? ছ বছর ঘর করনু। ডাং খানু। তালাক দিলি। মুই কি ভাল বেটি ছুয়া? সব মোর নসিব।’
‘ভাল্ লোক পাইলে বিয়া বসবু কি না ক? মুই দেখিম।’
‘বসিম।’

আরিফার মুখ-চোখ আরক্ত হয়ে যায়। খুব দ্রুত মাথা নিচু করে কিছু হয়তো ভাবে। মুহূর্তখানেক। তারপর বেশ অকপটে জবাব দেয়। রহমান যা জানার জেনে নিয়েছে। সে-সব জেনে অবশ্য কোনো লাভ নেই। জানা কথা সবসময় বলা যায় না। কেউ কেউ বলতে পারে না। সে সামান্য আগুন মিস্ত্রি। ভাটাতে আগুন দেয়। বাইরের আগুন নিজের বুকে নেয়া যায় না। তারপরও কখনো কখনো এসব দেখে শুনে সহসা বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠে। সে আগুন কাউকে দেখানো যায় না। সে ভাটায় ফিরে আসে। ধৈর্য ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর দক্ষিণ কোণার সুড়ঙ্গে গাছের গুঁড়ি পোরাতে গিয়ে কি সব উদ্ভট ভাবে। অকারণ উল্লসিত হয়। মনে মনে ছবি দেখে রাত গভীর হলে ঢ্যাঙ্গাকে সুড়ঙ্গের চেম্বারে ঢুকিয়ে দেবে।

৩.
দুদিন পর হলুদ বিকেল হঠাৎ মেঘে ছায়া ছায়া হয়ে যায়। ঢ্যাঙ্গা এদিক-ওদিক ঘুরছিল। একফাঁকে ইশারায় তাকে ডেকে নেয়। পুবকোণায় পুরাতন ইটের সারিবাঁধা স্তূপ। সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। শুরু হয় সাংবাদিকের মতো প্রশ্নবাণ। কত দিন ধরে কাজ করছে? কীভাবে ভাটায় আগুন দিতে হয়? ছয় লাখ ইটের জন্য কত কয়লা আর কত বাঁশের মুড়ো বা গাছের গুঁড়ি দিতে হয়? ইত্যাদি বিষয়। আলাপের এক ফাঁকে তাকে সিগারেট সাধে। রহমান বেশ বিনয়ের সঙ্গে আপত্তি জানায়। সে ওসব খায় না।

‘ওদিকের পাড়াটা কি আদিবাসিদের নাকি হে?’
‘হয়। কয়েক পরিবার হিন্দু আর সবগুলান খৃষ্টান। এঁঠে ক জন কাজ করোছে ওরা হিন্দু।’
‘তোর গ্রাম কোন্ দিকে? কী নাম?’
‘সরস্বতীপুর। কাঁকড়া নদীর আগোত।’
‘কাঁকড়া নদী! কেন ওখানে কি খুব কাঁকড়া?’
‘আগোত নাকি পাওয়া যাছিল। এ্যলায় শুধু নামে কাঁকড়া। আসল নাম আত্রাই সাতান্ন।’
‘সাঁতাল পাড়ায় ভালো চোলাই পাওয়া যায় নাকি?’
‘পাওয়া যায়।’
‘ওই এক জিনিস ভালোমতো টেস্ট করা হয় নি। টাকা দিচ্ছি এনে দিতে পারবি?’
‘না পারিম না। মুই অত্তি যাঁও না।’
‘দূর ব্যাটা…কোনো কাজের না!’
‘ওই পাড়ার লেবারগুলাক বলেন আনি দিবি।’

রহমানের এসব খেজুরে আলাপ ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। মালিকের লোক। সঙ্গে এসেছে। সে শুধু অপেক্ষা করে। কেননা বুঝে গেছে আসল প্রসঙ্গ এখনো আসে নি। মতলব একটি আছে। ঢ্যাঙ্গা কি এমনি তাকে আড়ালে নিয়ে এসেছে?

‘ওই যে আরিফা তোর গ্রামের মহিলা না?’
‘হয়!’
‘ওর সম্পর্কে কিছু খবর দে। একই পাড়ায় তো থাকিস?’
‘খুব গরিব মাইয়া। স্বামী তালাক দিছে। মায়ের গোড়তে থাকে।’
‘ওকে ম্যানেজ করতে পারবি? তোকে টাকা দেব।’
‘জি?’
‘আরে আরিফাকে সেট করে দিতে হবে? এক রাত। হাজার টাকা পাবি।’
‘জি?’
‘শশালা বোকাচোদা লোক।

রহমান বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। অথবা ভান করে। মনে হয় সে কিছু শোনে নি। ঢ্যাঙ্গা এবার আসল কথাতে এসেছে। তখন দূরের কোনো মসজিদে মাগরিবের আযান শুরু হয়। সে একটু ব্যস্ত হয়ে উঠে। লম্বু আবার তাকে বলে, –

‘শোন্ মালিকের বেশ পছন্দ হয়েছে বুঝলি? এই ফাঁকে কিছু করে নে।’
‘শোনেন দাদা, আরিফা ভদ্দলোকের বেটি ছুয়া। মোক ধরমভাই জানে। এইলা কাথা কাঁহো কয়?’
‘কি! ধরমভাই? যাহ্ শশালা!’

রহমানের প্রচণ্ড ভয়ংকর এক ইচ্ছে জাগে। যেমন পরশুদিন জেগেছিল। দক্ষিণ কোণার সুড়ঙ্গের আশেপাশে বেশ ঝোপঝাড়। সুযোগ বুঝে ব্যাটাকে ঢুকিয়ে দেবে। একেবারে ভাটার গনগনে আগুনে। কাঠ-কয়লার সঙ্গে পুড়ে সাফ হয়ে যাবে। প্রথমে আরিফাকে শিখিয়ে নেবে। তাকে দিয়ে লোভ দেখিয়ে সেখানে টেনে নিয়ে যাবে। তারপর পেছন থেকে আলগোছে একটি শক্ত আঘাত। লোহার প্লেট সরিয়ে সুড়ঙ্গের চেম্বারে সেঁধিয়ে দেয়া তেমন কঠিন কাজ নয়। তার মনের ভেতর হুড়মুড় করে আজগুবি কল্পনার ডালপালা গজাতে থাকে। অদ্ভুত তৃপ্তি আসে আর নামাজ ভুল হয়ে যায়।

৪.
রহমানের কানের কাছে বিকট স্বরে একটি প্যাঁচা ডেকে ওঠে। পাখিটি হয়তো ডোবার ধারে কোনো শ্যাওড়া গাছে বসেছে। তার মতো রাত জেগে জেগে ক্লান্ত। নাকি রাত পাহারা দিচ্ছে? কারও প্রতীক্ষা করছে? সে মাথা কাত করে আলো-আঁধারের ভেতর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয়। এখন হাল্কা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। হিমেল বাতাস। ঘোলাটে জোছনার শীত। সে দবিরের কথা মনে করে। ভাটাতে চলে যাওয়াই বোধহয় ভালো। এখন এক নম্বর ভাটায় তেমন করে গাছের গুঁড়ি দেয়া হয় না। মেপে মেপে পাথুরে কয়লা আর বাঁশের মুড়ো। কিছুদিনের মধ্যে খোলা হবে। বের করা হবে লাল ইট। একেকটি ইট আস্ত টাকার নোট। ভাটার উপরে গরমের ভাপ রয়ে গেছে। এমন শীতে সেখানে শুয়ে বসে রাত কাটিয়ে দেয়া আরামের। যেহেতু আর কোনো ট্রেন নেই। থাকলেও এত রাতে কেউ কাজে আসে না। ম্যানেজার তো আসবে না। হয়তো কাল সকাল বা দুপুরে আসবে।

সে ফোঁস করে প্রচণ্ড এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার শব্দে চমকে ওঠে নিজেই। সমস্ত নির্জনতার…নীরবতার বুঝি ঘুম ভেঙে যায়। এই অন্ধকার স্টেশনের কোণায় বসে ঝিমুতে ঝিমুতে নিজের অক্ষমতা হতাশা তাকে উলঙ্গ করে ফেলে। একবার চিৎকার করে কেঁদে উঠার অসম্ভব দুর্দমনীয় সাধ হয়। সে কেন খারাব হতে পারে না? নীতিহীন হতে পারে না? ওই মালিকের মতো। ম্যানেজারের মতো। ঢ্যাঙ্গা তপসের মতো। নয়কে ছয়…ছয়কে নয় করে ভলোভাবে খেতে-পরতে কেন সে ব্যর্থ হয়? বিবেক আর পাপবোধ কেন তার পিছু টেনে ধরে?

ম্যানেজার দিন পনেরো আগে এসেছিল। দশ হাজার ইট বিক্রি করেছে। হিসাবে লিখল সাত হাজার। রহমান এসব দেখে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চায়। ইচ্ছে করে। পরে কী হবে এসব বলে…ভেবে চুপ করে যায়। সে দেখে কমবেশি সকলে এভাবে পয়সা কামাই করছে। উপর হতে তলা পর্যন্ত। তাদের কোনো অভাব নেই। তাকে শুধু বিবেক হারাম হালাল চিনিয়ে তাড়া করে। করতে থাকে। কখনো কখনো চোখের সামনে এই চুরি সহ্য করতে পারে না। পাপ দেখাও যে পাপ। সে ভুল করে বলে বসে, –

‘স্যার এইটা কেমন হিসাব কইরলেন?’

ম্যানেজার চমকে উঠে। তার কাঁচাপাকা গোঁফ দাড়ি ফুলে যায়। সুন্দর সাইজ করে কাটা। ফ্রেঞ্চকাট। কপালের মাঝখানে বৃত্ত চিহ্ন। ভরাট কালো রঙ। নামাজি লোকদের যা হয়। রহমান জানে ম্যানেজার পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে। চুরিও করে। ম্যানেজার তার কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকায়। মনে হয় খুব জোরে ধমকাবে। কিন্তু সেটি করে না। বেশ মধুর করে হাসে। বলে, –

‘রহমান মিয়া তুমি চাকুরি করছ। ভাটাতে আগুন দাও। আগুন মিস্ত্রি। আগুন দেয়া তোমার কাজ। কারও বুকে আগুন জ্বালাবে না। কে কী করছে তুমি দেখবে না। বুঝলে? একেবারে মুখ বন্ধ। ধরো এ টাকাটা নাও।’
‘নহায় স্যার, মুই হারাম খাও না। হারাম খাওয়া আর ছইলহারের রক্ত খাওয়া সমান কাথা।’
‘ব্যাটা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!’

রহমান সেখানে আর দাঁড়ায় না। দ্রুত সরে যায়। এ হলো নিজের কাছ থেকে পলায়ন। আসলে সে কোথা থেকে কোথায় পালাতে চায়? যখন চৌধুরি সাহেব নদীপাড়ের আমবাগান বিক্রি করে দেয়, ম্যানেজার ভালো দাঁও মেরেছে। আজও চোখের সামনে নতুন পাঁচ শ’ টাকার বান্ডিল গোনার দৃশ্য মনে পড়ে। শুনেছে ম্যানেজার ওই টাকায় অনেক জিনিসপত্তর কিনে ঘর সাজিয়েছে। হারাম টাকার নাকি মজা বেশ! রহমান এসব দেখেশুনে মাঝে মাঝে ভাবে এখান থেকে বেরোবে। কাজ করবে না। বিশ্বাসহীনতার বিষাক্ত বাতাস তার শ্বাসরোধ করে। তারপর কোথায় যাবে ভেবে উঠতে পারে না। কাজ না করলে কীভাবে চলবে? তাকে তো কাজ করতে হবে। তার জীবন অকূল দরিয়ায় ভাঙা ডিঙির এক অভিযাত্রা। দিগন্ত বিস্তৃত শুধু তিক্ততা আর পরাজয়।

৫.
আরিফা বেঁচে গেছে। ঢাকার কোনো এক গার্মেন্টসে কাজ পেয়েছে। সেজন্য মেয়েটি মূল্যও দিয়েছে অনেক। রহমানের মনে পড়ে সে কথা। ওই ঢ্যাঙ্গার সঙ্গে কথা বলার ঠিক দুদিন পর। সে তখন এশার নামাজ শেষে দক্ষিণ সুড়ঙ্গের চেম্বারে আগুন ঠিক আছে কি না দেখছিল। আকস্মিক দুচোখে কোনো ছায়া এসে পড়ে। আলোছায়া রাত। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ আরও শীর্ণ হয়ে গেছে। চারপাশে বেশ ঘুম ঘুম নীরবতা। তার মাঝে এ কোন্ ছায়া? অনেক আগে থেকে জায়গাটির বদনাম আছে। কাছাকাছি উঁচু পাড় দেয়া এক পুকুর। নাম গঙ্গাসাগর। সেখানে চমৎকার পদ্ম ফোটে। দূরের রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। শোনা যায় একাত্তরে বিহারিরা ওই পুকুরে অনেক বাঙালি মারে। এখন কোনো কোনো রাতে সেই পুকুরের আশেপাশে নানান আর্তনাদ শোনা যায়। কেউ কেউ শুনেছে। ছায়ামুর্তি দেখে থাকে। সে কোনোদিন দেখে নি। সে-সময় এসব ভেবে শিহরিত হয়। ভয়ের একটি স্রোত বুকের ভেতর ঢেউ খেলে। তারপরও স্থির দাঁড়িয়ে ছায়াটিকে জিজ্ঞেস করে বসে, –

‘কাঁয় কাঁয় ওইঠে? কাঁয় বাহে?’

কোনো জবাব নেই। ছায়াটি শুধু নড়ে উঠে সামনের কলা বাগানে ছুটে যায়। ততক্ষণে রহমানের বোঝা হয়ে গেছে। মেয়েমানুষ। ছিচকে চোর হবে হয়তো অথবা…। সে দ্রুত ছায়ার পিছু নেয়। কিছু দূরে গিয়ে জাপটে ধরে ফেলে। ছায়াটিও কেমন করে নিজেকে তার কাছে সঁপে দেয়। তারপর ধপ করে বসে পড়ে। রহমানের দুচোখে তখন হতাশার এক বিস্ময়।

‘তুই এইঠে কি করোছি আরিফা?’
‘কি আর করিম ভাই? বোঝোছেন না? পেটের ভোগোতে মোক সব মানি নিবা হইল। দূরোত্ যান রহমানদা, পাপ করি আনু মুই।’

রহমানের মাথা ঘুরে ওঠে। যা বোঝার…অজানা থাকে না। তার ভেতর আবার এক অদ্ভুত জিঘাংসা জন্মে। সেটি মাথা থেকে সারা শরীর ছড়িয়ে যায়। অন্ধকার রাত গ্রাস করে নেয় তার অস্তিত্ব। তাই কোনোকিছু না ভেবে ডান হাত তুলে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারে। পরক্ষণে সম্বিত ফিরে পায়। ভাবে কেন এ কাজ করল! আরিফা তার কে? তখন নিশ্চুপ ছায়াটি ডুকরে উঠেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে আর্তনাদ করে, –

‘মোক আরও ডাং দি ভাই। মুই খারাব বেটি ছুয়া। ওইতনে ভাতার ছাড়ি গেইছে। পেটের তনে মোক এই কাম করিবা হইল। সব পেটের তনে।’
‘হ্যারে মোর কাথাও কি একবার মনে আছিল না? মুই না হয় গরিব মানুষ; তাও তো কিছু করবার পানু হয়।’
আরিফা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এবার সামনে এসে দুপায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রহমানের তখন খুব খারাব লাগে। প্রতিবেশী এই মেয়েটির জন্য তার বুকের ভেতর শূন্য হয়ে যায়। তার কেবল মনে হয়, চতুর এই সমাজে ধূর্ত লোকের কাছে বোকারা এভাবে মার খায়। খেতে থাকে। আরিফার জন্য তার খুব মায়া জাগে। সে তাকে দু কাঁধ ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়।

‘মোক মাফ করি দি ভাই। তোক মুই বুঝা পাও নি। মোর কাছোত আপন মানুষ। জানা পাও নি।’
‘শোনেক যা হইছে…হইছে। চুপ করি চলি যা। কাঁহোক কিছু কবু না।’

এরপর আরিফা কলাবাগানের সরু পথ দিয়ে চলে যায়। রহমান আলোছায়া রাতের ভেতর যতদূর দৃষ্টি যায় তাকিয়ে থাকে। সেই আরিফা এখন বড় চাকুরি করে। ভালো আয় উপার্জন হয়। গত মাসে অসুস্থ মাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। এবার যাবার আগে তার সঙ্গে দেখা করে। অনেক গল্প হয়। রহমান দেখে গ্রামের সাধারণ মেয়েটি কত ঝকঝকে হয়ে গেছে। আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তার বেশ ভালো লাগে।

৬.
এখন স্টেশনের নির্জন অন্ধকার কোলে বসে রহমানের দুচোখ সজল হয়ে ওঠে। পৌষের হিমেল বাতাস হু হু করে টেনে আনে জড়তা। হাত পা আসাড় হয়ে যেতে থাকে। শরীর ঠকঠক করে কাঁপে। চোখের আদ্রতা কঠিন বরফ হয়ে যায়। প্রাণ আকুল করা উদ্বেগ আর দুঃশ্চিন্তাগুলো হামলে পড়ে। সকালে ছোটমেয়ের জ্বর আর পাতলা পায়খানা দেখে এসেছিল। বউকে বলেছে খেয়াল রাখতে। উপায় বলে নি। আনছু আরা কীভাবে তাদের দেখাশুনা করবে? ঘরে কোনো খাবার নেই। মুদির দোকান হতে আনা কেজিখানেক আটা। এসব ভাবতে ভাবতে তার বুকের ভেতর ঝিমঝিম করে ব্যথা জেগে ওঠে।

ম্যানেজারের কথা মনে আসে। সেবার কেন সে উপযাচক হয়ে নীতিকথা বলে ছিল? দুনিয়াতে কে কোন্ পথে চলছে তার দেখার দরকার কী? সে কি এসবের ঠিকাদারি নিয়েছে? যেমন কথা বলে ছিল, ফল পেয়েছে। ম্যানেজার এরপর তাকে বহুবার ধমকায়। কাজে অকাজে প্রায়শ। বলেছে সে দেখে…অথচ কিছু দেখে নি। কথা বলা যাবে না। বোবা হয়ে থাকতে হবে। নইলে চাকুরি থাকবে না। তখন রহমান নিজের সঙ্গে এক অসম যুদ্ধ করে। বুকে অসহায় দীর্ঘশ্বাসের মিছিল দেখতে থাকে। সেখানে ভেসে ওঠে আনছু আরা। প্রিয় সন্তান। অসহায় বুড়ো বাবার মুখ। বুড়ো মানুষটি সারা জীবন শুধু খেটে গেছে। কপালে একটু স্বস্তি কিংবা শান্তি জোটে নি। সুখ তো দূরের কথা। এই ক দিন ধরে গরম ভাতের কথা বলছে। গরম ভাত আর মুর্গির মাংস। সে পারে নি। পারছে না। সে কোত্থেকে আনবে? কয়েক মাস হলো বেতনের পুরো টাকা পায় না। বলে কয়ে পঞ্চাশ একশ। মুদির দোকানে বাকি করে চলছে। আজকাল সেখানে যেতেও ভয় লাগে। দোকানি আগের টাকার জন্য খিস্তি কাটে। সে সব বোঝে। দোকানি বাকি দেবে কেন? সে জানে না উপায়হীনতার এই নাগপাশ থেকে মুক্তি কবে! তার দিন এমনি আসে। আবার গড়িয়ে চলে যায়।

সে-সময় বাতাস কাঁপিয়ে একটি ইঞ্জিনের শব্দ ওঠে। তার ঝিমিয়ে পড়া শরীরমন বিদ্যুতস্পর্শের মতো দ্রুত জেগে উঠতে চায়। ম্যানেজার আসছে। দিনাজপুর হতে ক মিনিটের পথ। অথচ সেই দুপুর হতে সে এর জন্য বসে আছে। ক দিন আগে ম্যানেজার এসেছিল। তখন তার হাতে পঞ্চাশ টাকার দুটো নোট ধরিয়ে দেয়। বলে, এবার এসে সবার বেতন হালনাগাদ করে দেবে। রহমান তখন মুখ ঘুরিয়ে ব্যাকুল চোখে দুপুরের দিগন্তে তাকায়। আশেপাশের প্রখর উজ্জ্বল দৃশ্যগুলো দ্রুত বদলে যেতে থাকে। দূরের সবুজ গাছপালা আর ধানের ক্ষেত ঝাঁপসা হয়ে যায়। চোখে ভেসে ওঠে বুড়ো বাপ বিছানায় পড়ে আছে। একটু ভালো খাবার ওষুধ-পথ্য পেলে মানুষটি আবার উঠে দাঁড়ায়। আরও কত ছবি ভেসে ওঠে। উঠতে চায়।

পুরনো দিনের কথা বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাসের আরও ঢেউ জাগায়। সে দূরের সিগনাল পিলারের সবুজ আলোকবিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্রেন নয়। একটি ইঞ্জিন ধক্ ধক্ করে মুখের উপর দিয়ে পুবে চলে যায়। বাতাসে ভাসিয়ে দেয় ডিজেল পোড়া গন্ধ। হায় তার হৃদয়টিও ইটভাটায় কাঠকয়লার মতো হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে। সেখানে শুধু ব্যর্থতা। নীরব আত্মদহনের হাজার বিলাপ। অক্ষমতার পীড়নে দগ্ধিভূত শত শত ক্ষত। সে ক্ষত হতে রক্তের মতো অশ্রু ঝরে।

গভীর রাত ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। কয়েক ঘন্টা পর ফুটে উঠবে সকাল। স্টেশন মাস্টারের ঘরের বাতি নিষ্প্রভ দেখা যায়। ম্যানেজার আর আসছে না। হয়তো সকালের কোনো লোকালে আসবে। সেই ট্রেন দ্রুতযানের দেড় ঘন্টা পর। রহমানের শরীর ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে ভারী হয়ে আসে। তার চোখদুটো আপনি নিচে নেমে যায়। সামনের ডোবায় দৃষ্টি পড়ে। মনে হয় হাবুডুবু খেতে খেতে ভেসে থাকা চাঁদ তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। সে একটি বড় শুকনো ঢোক গেলে। এখন সূর্যের অপেক্ষা।

৭.
চমৎকার দুপুরবেলা। ইট ভাটা অফিসের সামনে চাঁদোয়ার মতো বিশাল বট গাছ। তার ডালে ডালে লাল ফলের বাহার। গাছের নিচেও থকথক করছে। কতগুলো পথের পাশে ছড়িয়ে আছে। ঝাঁকড়া পাতার ফাঁকে সূর্যালোর লুকোচুরি। কয়েকটি দোয়েল আর শালিক মৃদু বাতাসে লেজ ছড়িয়ে ডাল থেকে ডালে বসছে। রহমানের হাত একগোছা টাকা। সে ভ্যাবাচাকা চোখে ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকায়। খুব অবিশ্বাস লাগে। আসলে এ টাকা তাকে দেয়া হলো কি না! অস্থিরতায় হাতের আঙুল কাঁপছে। কিছুতে থামছে না। ম্যানেজারের মুখে কৌতুক।

‘টাকাটা নাও। বাড়ি গিয়ে ফুর্তি করো।’
‘ঠিকে স্যার এই টাকালা মোর! মোকে দিলেন?’
‘আরে তোমারই টাকা। বেতনের জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর করছিলে। তাই দিলাম।’
‘বেতনের টাকা…হারাম নহায়? ওইযে কি কয়, ক্যাংকা হিসাবের নহায় তো? মুই হারাম খাওনা। হারাম হইল ছইলের রক্ত খাওয়া।’
‘আবে গাঁড়ু! তুই কি জাকির নায়েক না সাঈদি? হালাল হারাম শেখাচ্ছিস? টাকা পাইলি। এখন ফুট হ। বুঝলি?’

রহমান ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেছে। ম্যানেজার লোকটি অমন। রেগে গেলে তুই তোকারি করতে ছাড়ে না। সে কী বলবে? বলার কিছু নেই। সে কথা বলে কেন? ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। কে কী করে জীবন চালায়? হালাল না হারাম খেয়ে? তার কি যায় আসে! নিজে ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। সে ফিরছে। হাতে টাকা। গুণে দেখে নি কত। দেখার সময় কোথায়? এখন তো সাধ পূরণেরও ফুরসৎ নেই। তবে অনেক অনেক টাকা। বাজারে গিয়ে চিকন চাউল নেবে। একটি বড় মুর্গি। তেল মশলা। মেয়েদুটোর জন্য নতুন কাপড়। বউয়ের জন্য শাড়ি। বাবার জন্য পাঞ্জাবি লুঙ্গি। তারপর সবাই মিলে খাবে। কত দিন তারা একসঙ্গে খেতে বসে না। আনছু আরা যা রাঁধে একজন অন্যজনের মুখে তুলে দিতে ব্যস্ত। হায় অদৃষ্ট! অদৃষ্টের দোষ কি! সে এসব ভাবছে কেন? এখন আর দুঃখ নেই। ম্যানেজার বলেছে, এবার থেকে সবাই ঠিকমতো বেতন পাবে। কাজ বেড়েছে। তেমন আয় বেড়েছে। সামনের মাস থেকে বেতনও বাড়বে।

পথের সামনে বাঁক। সেটি পেরিয়ে একটু হেঁটে গেলে নিজের ঘর। সেখানে নিম গাছের মিঠেল ছায়া। দুটো আম গাছের চারা বড় হচ্ছে। ঘরের সামনে একচিলতে জমি। মূলা বেগুনের সবুজ সমারোহ। লাউয়ের ডগা কেমন লতিয়ে উঠে গেছে ঘরের আধভাঙা চালে। সাদা ফুল ফুটেছে। কয়েকটি বড় হয়েছে। ঘরের সামনে বারান্দা। সেখানে একটি চৌকি। তার উপর বসে থাকে তার প্রিয় বাবা। সে বুড়ো মানুষটিকে খুঁজল। কিন্তু নেই। কোথায় গেল? আনছু আরা আর প্রিয় সন্তান? কাউকে দেখছে না কেন?

সে ভালো করে চোখ রগড়ে নেয়। চমকে উঠে। এ ঘর তার নয়। ঘরের দরজা ঝলমলে রঙ দেয়া। সাদা প্রাচীর এলো কোত্থেকে? সে আবার চোখ কচলিয়ে ভালো করে তাকায়। এ ঘর…এ বাড়ি তার নয়। দরজায় স্পষ্ট লেখা আছে এক নামফলক। আবুল হাসিম। ম্যানেজার মা ব্রিক্স। এটি তবে ম্যানেজারের বাড়ি। সে এখানে কেন এসেছে? টাকায় চিন্তায়? কেউ কি টেনে এনেছে তাকে? সে কিছু ভাবতে পারে না। নেশাগ্রস্থের মতো টলতে টলতে হুড়মুড়িয়ে দরজায় আছড়ে পড়ে। উন্মুক্ত হয়ে যায় আঙিনা। আর সেখানে কি বীভৎস দৃশ্য! ম্যানেজারের হাতে একটি বটি। কাছেই পড়ে আছে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়ে। তার ফুটফুটে চেহারা পরীর মতো সুন্দর। গলা দিয়ে তখনো রক্ত পড়ছে। ম্যানেজার একটি বাটিতে চুমুক দিচ্ছে। তার ঠোঁট মুখ দিয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত। ম্যানেজার তাহলে নিজ সন্তানের রক্ত পান করছে! রহমান কী করবে? তার হাত পা কাঁপতে শুরু করে। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ উঠতে থাকে। কিছুতে থামে না। বিমুঢ় নির্বাক। চলৎশক্তি রহিত। সে কিছু ভেবে উঠতে পারে না। দেখে ম্যানেজারের মুখের হা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। চোখদুটো পেছনে চলে গেছে। শুধু বিকট আর সর্বগ্রাসী এক কালো গহ্বর। রহমান স্থবির হয়ে পড়ে। নড়তে পারে না। কতক্ষণ কে জানে! মনে হয় অনন্তকাল। তারপর কে যেন কানে চিৎকার করে উঠে, পালাও…পালাও। সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশে মিশে যায়। কোথায় আকাশ? কোনো আকাশ নেই। শুধু কপিশ অন্ধকার। সে কোনোমতো নিজেকে ঘুরিয়ে দুটো পা সামনে ছুড়ে দেয়। ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। শরীর প্রচণ্ড ভারী হয়ে গেছে। সে ভয়ে ঘেমে ওঠে। নিজেকে জোর ঝাঁকুনি দিয়ে নড়তে চায়। পিছু হটতে থাকে। পেছনে। আরও পেছনে। আরও…। কিন্তু একি পা কেন চলছে না? সে কেন দৌডুতে পারছে না? আর ম্যানেজারের মুখ নয় সমস্ত পথ বিশাল মুখ ব্যাদান করে তাকে গিলতে আসে। বিশাল অন্ধকার কালো গহ্বর।

৮.
রহমান পৌষের হিমেল ভোরেও ঘেমে নেয়ে ওঠে। চোখদুটো জড়িয়ে গেছে। খুলতে চায় না। সিমেন্টের বেঞ্চের নিচ থেকে ভারী নিঃশ্বাস আর চপচপ শব্দ উঠছে। রহস্যময় কিছু। সে আঙুল দিয়ে বারবার চোখ রগড়ে নেয়। মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে, বেঞ্চের নিচে নির্লোম এক কুকুর। অস্থির হয়ে কোনোকিছু চিবোচ্ছে। পুবদিকে এক চায়ের দোকান। সেখানের তোলা উনুনে কয়লার ঘন সাদা ধোঁয়া। ছড়িয়ে পড়ছে আকাশময়। এত বাস্তবতার চারপাশ থেকেও তার চোখে ভেসে ওঠে সেই বিশাল কালো গহ্বর। মনে হয় তখনো তাড়া করছে। কত জীবন্ত আর তীব্র সেইসব দৃশ্যাবলী। সে একবার চমকে ওঠে। তার শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়।

তলপেটে প্রচণ্ড চাপ। সে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায়। ক জন ছোট ছোট মেয়ে পড়ে থাকা ফুল কুড়োচ্ছে। তার মতো গরিব ঘরের সন্তান। রহমানের মনে হয় ওরা অনেক ভালো। অনেক স্বাধীন…নিশ্চিন্ত। শৈশব যে কত মধুর ভেবে নিয়ে সে দ্রুত হাতে চোখের পিঁচুটি মুছে ফেলে। স্টেশনের আরও পুব দিকে এক পত্রিকার দোকান। সে সেটি পেরিয়ে হেডভাঙ্গা টিউবওয়েলের কাছে যায়। সেখানে নাম না জানা গাছের ঝোপঝাড়। সে যুতমতো বসে ভাসাতে থাকে পিঁপড়েদের উপনিবেশ।

তার কৈশোর মনে পড়ে যায়। বাবা তার জন্য স্কুলের মাঠে বসে থাকত। স্কুল ছুটি হলে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরত। এভাবে সে বড় হয়েছে। স্কুলের বড় পাশ দিয়েছে। তারপর একসময় কাজে নেমে পড়ে। তখন বাবা হয়ে যায় একা। সেই একাকীত্বে তার মনে ভিড় করত সুখময় স্মৃতি। পুরনো দিনের কথা। কোনো কোনো দিন সে স্মৃতিকথায় রহমান সামিল হতো। এ সময়ে বাবার মুখে থাকত মায়ের কথা। ব্যাকুল চোখে তাকে কত কথা জিজ্ঞেস করত। তার মাকে মনে পড়ে কি না। সত্যি বলতে মায়ের কথা তার খুব বেশি মনে পড়ে না। মায়ের মুখও সে ভুলে গেছে। কেমন ছিল মায়ের চেহারা? কখনো এক অপরাধবোধ বুকে বাজতো। সে মাকে ভুলে গেছে। কখনো সান্ত্বনা খুঁজতো। তখন তার কত বয়স? সেই বয়সের অনেক ছবি মনে থাকে না। সে চুপ করে বাবার কথা শোনে। বাবা বলে, –

‘এক বছর এ্যঠে তোর মাও শিম কপি কইল্লার গাছ লাগাইছিল। সে কি ফলন ফইলছিল! খাও আর পাড়া পড়শিক দাও। কিছু বেচাইছিনো।’
‘মা খুব পয়মন্ত ছিল বা। যেঠে হাত দিছে সেইঠে সোনা ফলিছে।’
‘তুই মেট্রিক পাশ কইরলে তোক মুই বিয়া করাম বেটা। মোর উজাড় সংসার ফের নতুন করি ভরি উঠিবি।’
‘কি যে কছি তুই!’

তারপর এক পড়ন্ত সন্ধ্যেয় বাতাসে নতুন ধানের সৌরভ ওঠে। সে সুবাস শেষ অগ্রহায়ণে দিগন্ত বিস্তৃত করে ছড়িয়ে যায়। উন্মাতাল হয়ে যায় মন। রহমান তখন জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে। বাবার সাধের কাছে তার কোনো আপত্তি জোর পেল না। তার সুখের জন্য জেনেশুনেই এক বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলল। জীবনে এলো আনছু আরা। তাকে পেয়ে বুঝতে পারে সে হয়তো কখনো মনের অজান্তে খুঁজে গেছে। আনছু আরাকে। হয়তো কল্পনায়। কিংবা স্বপ্নে। সে ভালবাসতে শুরু করে। নিজের দায়িত্ব বুঝে নেয়। দেখতে দেখতে আট বছরে দুটো মেয়ের বাবা হয়ে গেল। ইচ্ছে ছিল অন্তত বিএ পর্যন্ত পড়বে। কিন্তু কলেজে এডমিশন নিয়েই শেষ হলো ওই পাঠ।

রহমানের দুঃখ নেই। জীবন চলার বন্ধুর পথে সবকিছু চাইলে পাওয়া যাবে এমন কথা নেই। বেশিরভাগ মানুষ সারা জীবন অনেক না পাওয়া নিয়ে বেঁচে থাকে। সুখহীন অতৃপ্তি খুব গোপনে বুকের ভেতর পিষে মারে। তারপর বাকি পথ চলতে চলতে একদিন টুপ করে মরে যায়। বুড়ো বাবার কথা মনে আসে তার। বাবা একদিন মরে যাবে। সে-সময় ঘনিয়ে আসছে। বাবার মনে কোনো অতৃপ্তি আছে কি? সেটি মোচনের ক্ষমতা তার রয়েছে? না নেই। এসব ভেবে তার মনে অতৃপ্তি আর অস্বস্তির ঢেউ জাগে। আর কিছু না হোক বাবার সামান্য আবদার পূরণ করতে হবে।

সে ফিরে এসে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে। ক্ষুধায় পেটের নাড়ি হজম হতে শুরু করেছে। রেস্তোরাঁ থেকে চায়ের লিকার তৈরির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তার ক্ষুধা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু দেবার কোনো উপায় নেই। পকেট শূন্য। দবির তার দোকানের সামনের জায়গাটুকু ঝাড়ু দিয়ে উপরে উঠে গেছে। কাচি দিয়ে সবুজ পান পাতা কেটে কেটে সাজিয়ে রাখে। এসব দেখে রহমানের মনে হয় পরের গোলামি ছেড়ে পান সিগারেটের দোকান দিলে কেমন হয়। ভালোই হবে। কিন্তু মূলধন কোথায় পাবে? এই ভাবনার মধ্যে রেললাইনে গুড়গুড় আওয়াজ ওঠে। পশ্চিম থেকে ধেয়ে আসা ঢাকামুখি দ্রুতযান পুবদিকের ঊষালোক ভেদ করে দৈত্যের মতো ছুটে চলে যায়। তার স্টেশন ধরে না। তখন গাছের শিখরে নতুন একটি দিনের সূর্যকিরণের মধুর স্পর্শ। সে এসব দেখে দিনের প্রথম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। পরের একটি ট্রেন দেখবে। তারপর ভাটার পথ ধরে বাড়ি চলে যাবে। কেমন আছে বাড়ির সবাই কে জানে! উদ্বেগাকুল চোখদুটো তার দিগন্তে আটকে যায়।

৯.
রহমান বুকের ভেতর খুশি আর আকুলতা নিয়ে বাড়ি ফেরে। আনছু আরা দরজায় দাঁড়িয়েছিল। কেউ প্রতীক্ষায় থাকলে খুব ভালো লাগে। নিজেকে বড় সুখী মানুষ মনে হয়। হয়তো জগতের সকল পুরুষের আনন্দের মুহূর্ত সেটি। আনছু আরার উন্মুখ চোখদুটো নিশ্চয়তায় ভরে ওঠে। রহমান সেদিকে একমুহূর্ত অপলক দেখে থাকে। আশ্চর্য অনুভূতিতে মন প্রশান্ত হয়ে যায়। মনে হয় যেভাবে বলা হোক তার জীবন অনেক সার্থক। এ রকম প্রশান্তির মধ্যে কোত্থেকে আবার হাজার বিছুটি দংশন বুকের ভেতর বেজে ওঠে। আজ সে পরাজিত হয়ে এসেছে। নিজের কাছে এক অসহায় পরাজয়। সে এক পরাজিত মানুষ।

আনছু আরা এগিয়ে এসে চমৎকার করে হেসে ওঠে। বাজারের থলে হাতে তুলে নেয়। রহমানের অপর হাতে ঝুলে থাকা মোরগ একবার মাথা উঁচু করে। কঁকিয়ে মৃদু ডাক দেয়। রহমান আশেপাশে তাকিয়ে কী খোঁজে। মনের মধ্যে হাজার ভাবনাকে এড়িয়ে যেতে এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

‘বাপ কেংকা আছে বউ? আর বিন্তির জ্বর ভালো হইচে? মিন্তি কোঠে?’
‘আছে একরকাম। ঘরর ভেতরোত আইসেন। কিছু তো মুখোত দেন নাই? চেহারাখান শুকান লাগেছে।’
‘না না মুই ভাটাত পরাটা খাইচু। কেরামত ভাই আইল তো। মুই কনু আইজ ওবেলা আসিম। শালার কাইল দুপহোর থাকি ইস্টিশানোত পড়ি আছো। নিন্দাবাও পারোনি।’
‘তোমহার খালি খালি ঝামলা পাকান। যান একটু শুতি থাকেন। আরাম করেন।’

সে-সময় এক তীক্ষ্ণ ভেজা কন্ঠ বেরিয়ে আসে। সেই প্রত্যাশিত আদরের প্রিয় ডাক। রহমান বসে থাকতে পারে না। হন্তদন্ত হয়ে এগোয়। সেদিকে তাকিয়ে আনছু আরার দৃষ্টি সজল ভক্তিতে চকচক করে ওঠে।

‘বা রহমান আইলু বা? আর এ্যংকা করি কতদিন তুই ঘুরি ঘুরি বেড়াবু। থির হ বা থির হ।’
‘থির হবা কি পারিম বাপ? দুইন্যা এ্যলা ঘুরি চলোছে। যাঁয় যত ঘুরিবে তার তত লাভ। শোনেক বা, আইজ ভাতের জোগাড় করছি। আগুড়পাক চাইল আর একনা মুরগ কিনিছু।’
‘এত্তুলা টাকা খরচ করলু…বিন্তিটাক ডাক্তার দেখাবা নাগবি না? ছইলটা খালি হাগোছে।’
‘দেখাম দেখাম। ও বেলা বাজারত যাই হেনে ডাক্তরের কাছে থাকি অষুদ নিম।’
‘তুই এ্যলা যা বাপ। ছইলটা কষ্ট পাছে খালি। সেখন মুই মুদির ঠে একটা স্যালাইন আনিছু। পাইশা পাবি।’

আজ আনছু আরার উদ্বেগাকুল মনে খুশির ঝিলিক ওঠে। দুর্ভিক্ষময় জীবনে স্বপ্নের মতো আনন্দ। প্রশান্তির ঢেউ জেগেছে তার সংসারে। মিন্তি বিন্তি বাপের কোলে বসেছে। তাকে জড়িয়ে ধরে বিস্কুট খাচ্ছে। দুনিয়ার কত কথা শোনায় তারা। সকল দুঃখ বেদনা প্রিয় মানুষটির ফিরে আসায় উবে গেছে একেবারে। শুধু কি মানুষটি না কি টাকা? দুনিয়াতে টাকা থাকলে সব কেনা যায়।

তখন তরকারি রান্নার খুসবু বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। রহমানের দৃষ্টি আকস্মিক আকাশে আটকে যায়। পৌষের মেঘ দুপুরের রোদেলা আলোয় রঙ বদলায়। বদলাতে থাকে। এক রূপ এক আকার ভেঙে আরেক রূপ নিচ্ছে। সে-সব চেহারা ছবি ভয়ংকর মনে হয়। সূর্যের তেজ কমে গেছে। বেশ নিস্তেজ আর ঠাণ্ডা বাতাস ঢেউ খেলে খেলে ভেসে আসে। তখন মনের কোনো কোণায় ভেসে ওঠে আজকের ঘটনা। এই আনন্দের পেছনে কতটুকু যন্ত্রণা আর অভিজ্ঞতা সে-সবের কথা। সে এক মেকি সুখ।
১০.
ম্যানেজার আসে নি। অন্য কাজে ব্যস্ত। আগামী সপ্তাহে আসবে। ড্রাইভার কেরামত মিয়া তার হাতে একটি চিরকুট দেয়। আড়াই হাজার ইট ট্রলিতে পাঠাতে হবে। সেই ইট দুই টিপে শহরে যাবে। আগুন মিস্ত্রির এও আরেক কাজ। রহমান নির্দেশ পড়ে চুপসে যায়। তার মাথা ঘুরছে। সারা রাত আধজাগা। পেটে অসহনীয় ক্ষুধা। টাকার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। এসবের মধ্যে কাজের হুকুম বুকের ভেতর আগুন জ্বেলে দেয়। তার মন এলোমেলো হতে শুরু করে। সবকিছু বিরক্তিকর লাগে। কী করবে ভেবে পায় না। সে নিস্তেজ হয়ে মাটিতে বসে পড়ে। তখন কেরামত ট্রলির সীটের নিচ থেকে তোয়ালে বের করে আনে। মুখ চোখ মুছতে মুছতে বলে বসে, –

‘কী খবর রহমান ভাই! তুমার চেহারা সুরত এত্তো ধ্বসে গেল কেন? আরে এই জন্যে তো বলি, দুনিয়া যে শালা চালাচ্ছে উয়ো ভি বুরবাক তুমভি বুরবাক। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘কাল থাকি ইস্টিশানোত পড়ি আছো কেরামত ভাই। ম্যানেজার কইল দু এ্যক দিনে আসিবে। আর এত্তি হামার অবস্থার ব্যবস্থা কাঁয় করে?’
‘ওহহো! শুনো যেখুন ঘিউ সোজা আঙুলে উঠে না তেখুন বাঁকিয়ে তুলতে হয়। ও শালা মাদারচোদ হারামখোর। দেখ গিয়ে বউ ছাওয়াল নিয়ে ফুর্তিতে আছে। আর তুমি ঈমানদারি করছো?’
‘কি যে কন কেরামত ভাই ছি ছি!’
‘ঠিকই বলছি। উ শালা আমাদের দঃখ কী বুঝবে! শুনো এই চিঠি দিয়েছে ম্যানিজার। দেড় হাজার ইট, আসলে আড়াই যাবে। হিসাবে দেড় হাজার লিখতে হবে বলেছে।’
‘ফের ওই কাঁহিচাল? নহায় মুই পারিম নাই। কী জবাব দিম আল্লার ঠে?’
‘জবাব দেবার সময় হলে জবাব মিলবে। ভয় নাই। এই পাঁচ শ টাকা বখসিস দিয়েছে। বেতন নয়।’
‘তার মানে হারাম?’
‘বললাম না, তুমি একটা বড় বুরবাক আছো! আরে এ দেশে এখুন এটাই হলো আসল খাওয়া। চোখ কান খোলা রেখে দেখ। সব্বাই এখুন কি যেন বুলে…দূর শালা মনে আসছে না। এটাই খাচ্ছে। যে পাচ্ছে না সে মরছে। তার শালা দুনিয়াতে ভাত নেই। সে গু খাবে। ’

রহমান টাকা হাতে দেয়। সুন্দর একটি নতুন নোট। টাকার এক অদ্ভুত মাদকতা মাখানো গন্ধ আছে। সে নাকে ধরে গন্ধ শোঁকে। সেখানে বিষ্ঠার দুর্গন্ধ। সে দ্রুত নোটটি পকেটে রেখে দেয়। এখন সততার দিন শেষ। তার খাওয়া নেই। তার গায়ে দুর্গন্ধ। কষ্ট। যন্ত্রণা। তার দীর্ঘদিনের লালিত মূল্যবোধ এক নিমিষে কাচের মতো ঝুর ঝুর করে ভেঙে যায়। সে-সবের তীক্ষ্ণ টুকরো ফলা তার বুকে খোঁচাতে থাকে। কতক্ষণ কে জানে। তার দৃষ্টি দূর দিগন্তে নির্নিমেষ থেমে থাকে। কখনো আনমনে ট্রলিতে ইট সাজানো দেখে যায়। নিজেকে প্রবোধ দেয়। বাঁচতে হবে। সে কোনো অন্যায় করছে না। তার থেকেও বড় বড় চোর আছে। তাদের জীবন জৌলুসময়। সেখানে কোনো দুর্গন্ধ নেই। তারা কোনো গু খায় না। নিজের সন্তানের রক্ত পান করে না। এসব ভাবনা তাকে আরও ক্লান্ত করতে চায়। সে তখন নিজের মনে বিড়বিড় করে কী বলে ওঠে কিছু বোঝে না।

সময় পেরিয়ে যায়। রহমান স্থবির হয়ে কতক্ষণ বসে থাকে জানে না। তারপর আকস্মিক দমকা এক বাতাসের মতো চমকে ওঠে। ইটের বোঝা নিয়ে ট্রলি চলে গেছে। পরের ট্রিপ বিকেলের আগে নয়। সে হেঁটে হেঁটে বাজারে যায়। এটা-ওটা কেনাকাটা করে। মনে বেশ ফুর্তি। মাথায় কোনো চিন্তা থাকে না। তারপর সূর্য যখন বেশ উপরে উঠে গেছে, বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। রাস্তায় ভাবনাগুলো আবার কিলবিল করে ওঠে। মনে হয় শত শত কৃমি তার পেটে সাঁতার কাটছে। নাড়িতে শুয়ে আছে। তার মাথা গুলিয়ে ওঠে। মনে হয় পড়ে যাবে। সে সামনের একটি গাছের গোড়ায় বসে। কিছুক্ষণ জিরোয়। এতে ভাবনা আরও সুযোগ মতো ছড়িয়ে পড়ে। দশ হাত মেলে প্রসারিত হতে থাকে। সকল প্রশ্নের ইতি টেনে নিতে সিদ্ধান্ত নেয়। তার ভাত দরকার…গরম ভাত। নিজেকে যতটুকু সৎ রাখা যায় সেভাবে চেষ্টা করেছে। পারে নি। কষ্টের দিনযাপনে মনে এইটুকু সান্ত্বনা ছিল। সে কারও ক্ষতি করে নি। মিথ্যে বলে নি। দু নম্বরি করে নি। এসব কাজ পাপ। মহাপাপ। আজ তাকে টিকে থাকার জন্য মিথ্যে কাজে অংশ নিতে হয়েছে। এ ছাড়া কোনো পথ ছিল না। সত্যের মতো মানুষের দুনিয়ায় সে এতদিন মিথ্যে হয়ে ছিল। এখন সে পথ চিনে নিয়েছে। সে পথের চারপাশে বিষ্ঠা-পুরীষের গন্ধ থাকলেও এটিই বাস্তবতা। এতকিছু ভাবনার মাঝে বুকের কোনো অজানা কোণায় কে তবু ডেকে যায়। সেখানে বুড়ো বাবা, আনছু আরা আর মেয়েদের ছবি ভেসে ওঠে। সেখানে কেউ খুব অস্ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করে। কৈফিয়ৎ চায়। সে কী জবাব দেবে? তার কাছে কোনো উত্তর নেই। সব জিজ্ঞাসার উত্তর হয় না। সে দুচোখ বন্ধ করে ভুলতে চায়। অথচ সেখানে দুঃস্বপ্নের ছবি ভেসে বেড়ায়। সে শিহরিত হয়। আজ তাকেও সন্তানের রক্তে মুখ ভেজাতে হলো। বেঁচে থাকার অন্ধকার দুনিয়ায় হাতড়ে হাতড়ে গুতেই গিয়ে ঠেকল। হায় খোদা!

সেদিন দুপুরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসে। অনেকদিন পর। রহমান বেশ তৃপ্তি নিয়ে বাবার খাওয়া দেখে। তার মন ভরে যায়। কিন্তু সে যা গিলে ফেলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করে ওঠে। তখন তার আবার সেই কথা মনে হতে থাকে। শত শত কৃমি পেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেগুলো রক্তের স্বাদে কিলবিল করছে। একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িয়ে জট লেগে যাচ্ছে। আকস্মিক তার মুখে লবণ-ঝালের এক ভরাট ঢেউ ওঠে। পেটের ভেতর থেকে এক বীভৎস ঊর্ধ্বচাপ। সে দ্রুত উঠে বেরিয়ে যায়। তারপর আঙিনায় বমি করে ফেলে। সবাই চমকে ওঠে। কী হলো তার? আনছু আরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন রহমানের শুধু একটি কথাই মনে পড়ে: কুকুরের পেটে ঘি সয় না।

(সেপ্টেম্বর ’৯১)

পাছে লোকে কিছু বলে

পাছে লোকে কিছু বলে

দুই চোর পাশাপাশি
এক চোর দূরে
আধ-পাগলা বুড়ো এক
গান গায় সুরে।

আসর বসেছে বাসর বড়
গল্প-কবিতা পাঠ
নাম পরিচিতি প্রচার ভায়া
মানুষের হাট।

রণে ভঙ্গ দিয়ে পাগলা
গৃহে ফিরে চলে
অনেককিছু হলো দেখা
পাছে লোকে কিছু বলে।

জীবনের টুকরো গল্প

আজ অনেকদিন পর চারুবাবুর মোড় পেরিয়ে পুবে যেতে যেতে উত্তরে দৃষ্টি গেল। হায় সেই পুরোনো দালানগুলো নেই। দূরে কালি মন্দির একাকী দাঁড়িয়ে আছে শুধু। রতন দাশ’এর কথা মনে পড়ে গেল। তখন স্কুলের শেষের দিক, মাথায় বেঞ্জু বাজানোর ঝোঁক চেপে বসেছে। রেলবাজার-বড়বন্দর থেকে ভারতের ম্যামোলা কোম্পানি’র একটি বেঞ্জু কিনেছি। ডানহাতে টিংটিং শব্দ হলে বাঁ-হাতের রীড থেমে যায়। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সেই সমস্যা দূর হলো বটে, কিন্তু পরিচিত গানের সুর তুলতে পারি না। একদিন চকবাজারে বসবাসকারি সহপাঠি বীরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলল, –

‘রতন দাশ’এর সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দেব, ও কিন্তু যে-কোনো গান শুনেই সুর তুলতে পারে।’

একদিন সত্যি সত্যি রতন দাশ’এর কাছে থেকে স্বরলিপি লিখে নিতে শুরু করলাম। ডায়রির পাতা স্বরলিপিতে ভরে উঠল। তারপর একদিন রতন দাশ আমার কাছে শেখা শুরু করল। সেই রতন দাশ নেই। কোথায় গেছে জানি না। তবু তার কথা মনে পড়ল। কেননা রতন দাশ শেষে আমার সিনিয়র বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। উনিশ শ পচাত্তর’এর কোনো এক সময়ে জেলা অডিটরিয়ামে প্রোগ্রাম শেষে রতন দাশ বলল, –

‘যে গান বাজালি তার স্বরলিপি লিখে দিস্ তো।‘

লিখে দিয়েছিলাম খুব যত্ন করে। তারপর জীবন আর পৃথিবীর বুকে খুদ কুড়োতে কুড়োতে কোথায় হারিয়ে গেছে আমার সাধের সুর আর স্বরলিপি মনে নেই। আজ দুচোখ ভিজে উঠল। হায় কি আনন্দের ছিল দিনগুলো! আর আজ…? রতন দাশ’কে একবার পেলে বলতাম, আমার গানের স্বরলিপি অচেনা হয়ে গেছে বন্ধু।

(১৩.৪.১৫)

কী লিখবেন কীভাবে লিখবেন

লেখালেখির জগতে যা কিছু লিখি না কেন, সেটি লেখা ও প্রকাশনা শিল্পের প্রেক্ষিত বিচারে নতুন সৃজন। কথাটি সৃজনশীলতার নিরিখে সত্য। ব্যতয়গুলোর উল্লেখ করছি না। ক্রমে সেই সৃজনগুলো লেখক ও পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একজন কবি যখন কবিতা সৃজন করে চলেন আর সৃষ্টির আনন্দ গ্রহণ করেন, পরে পাঠক সেই কবিতা পড়ে নির্মাণের আনন্দ গ্রহণ করেন। তিনি সেই লেখা থেকে তার ব্যক্তিজীবন, সামষ্টিকজীবন এমন কি আদর্শগত বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে মানবিক উৎকর্ষতার উজ্জীবন ঘটাতে পারেন। তাই লেখালেখির বিষয়ে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে, কী জন্যে লিখবেন? কেন লিখবেন? কাদের জন্য লিখবেন? কোন্‌ বিষয়ে লিখবেন কিংবা আপনার পছন্দ ও সাহজিকতা কোন্‌ বিষয়ের প্রতি? এরপর যুক্ত হয় লেখকের পছন্দ ও দক্ষতার বিষয়। পাঠকপ্রিয়তার ক্ষেত্রও লেখককে অনেকাংশে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

অনেকে লিখতে আগ্রহী; কিন্তু কেউ কেউ নিজের মধ্যে একধরনের ‘নেতিবাচক’ ভাবনা পোষন করেন যে, যা লিখতে চাই হয়তো সেটি প্রয়োজনীয় তথ্য সম্ভারে পূর্ণ হবে কি না, কিংবা আদৌ তুলে ধরা সম্ভব হবে কি না। তারা প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের লেখা এবং তাদের জীবনপ্রবাহ ও অভিজ্ঞতা থেকে অনেককিছু জানতে পারেন। সুতরাং লেখালেখির প্রাথমিক সূচণা করতে হয় পড়ার মধ্য দিয়ে। এর কোনো বিকল্প নেই। পড়ার মাধ্যমে যে অভিজ্ঞতা ও দিব্যদৃষ্টি লাভ হয়, নবীন লেখকের জীবনবোধ এবং নিজেকে, মানুষকে, সমাজ ও পরিবেশকে বুঝতে অনেক সহায়তা করে। ভাবনা ও মননের যতগুলো স্তর চেনা ও বিশ্লেষণ করার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে তিনি পাঠককে তত বেশি সৃজনশীলতা দিতে পারবেন ও তার লেখা পাঠকপ্রিয়তা ও গুরুত্বলাভ করে।

প্রথমেই যদি এই প্রশ্ন ধরে চিন্তা করি যে, কী উদ্দেশ্যে লিখছি? তা হলে অনেকেই হয়তো জবাবে সহজবোধ করবেন না। কেননা, বনের পাখি আপন মনে গান গায়, তার আবার উদ্দেশ্য কি? কিন্তু যৌক্তিক কথা এই যে, পাখি কিন্তু এমনি এমনি গান গায় না। তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। গানের পাখি কোকিল গাছের ফাঁকে লুকিয়ে যখন ডাকে বা গান গায়, সেই সুর শুনে আমরা মুগ্ধ হলেও ওই পুরুষ কোকিলের উদ্দেশ্য বায়স-ফিঙেকে তার বাসা থেকে বের করে আনা, যাতে স্ত্রী কোকিল সেখানে ডিম পাড়তে পারে। তাই প্রতিটি লেখার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। লেখককে সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে কাদের জন্য লিখছেন তার সমন্বয় ঘটাতে হয়। সেইসঙ্গে এই লেখা কতদিন পর্যন্ত জাগ্রত থাকতে পারে তার একটি ‘মেয়াদ’ সম্পর্কিত ভাবনা কল্পনা চোখে এঁকে দেখতে পারেন। যেমন: একটি খবর, যা আর্জেন্টিনা ফুটবল খেলোয়াড় মেসির ঢাকা আগমন উপলক্ষ্যে লেখা সেটি দুদিন পর বাসি হয়ে যাবে। জেনে যাওয়া লোকের কাছে তার তেমন কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু তার ঢাকা আগমন, নাইজেরিয়া দলের সঙ্গে প্রীতি খেলা ও সে খেলায় বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে মেসির ভূমিকা নিয়ে যেকোনো নিবন্ধ অনেকদিন পর্যন্ত পাঠকমনে আনন্দ ও অন্যান্য উপলব্ধি জাগরুক করে চলতে পারে।

আমরা নিবন্ধ, প্রবন্ধ, আলোচনা, কবিতা, গল্প, উপন্যাস যা লিখতে চাই তার পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। সেটা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য যাই হোক। এখন আমরা দেখতে চাই, কত সহজে লেখা যায়। লেখার জন্য প্রথমেই দরকার চিন্তা ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। বলা হয়ে থাকে, চিন্তার স্তর যত বেশি তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা তত বেশি। ভালো চিন্তা পরিচ্ছন্ন লেখার মৌলিক শর্ত। সুতরাং আমরা যে বিষয়ে লিখতে চাই, প্রথমেই সেটি নিয়ে চিন্তা করব। অনেকটা ডাক্তারের রোগি দেখার মতো। কী রোগ, কি কি কারণে হলো, সেই কারণগুলোর পেছনের কারণ কি কি ইত্যাদি চিহ্নিত করা। বিষয়টা এ রকম যে, problem identification, its causes and its manifestations। যত গভীরে যাওয়া যাবে তত পরিস্ফুট হয়ে উঠবে আপনার কল্পনা শক্তি ও তার সঙ্গে বাস্তবের বিশ্লেষণ। তবে একটি সতর্ক বার্তাও আছে যে, অতিবিশ্লেষণ লেখনীকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে তুলতে পারে। সুতরাং অতিবিশ্লেষণ সম্পর্কে লেখক নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন।

লিখুন প্রাণ খুলে। জুলভার্ন যদি তার সময়ে এই সত্য উপলব্ধি করতেন যে, চাঁদে যাওয়া অসম্ভব, কিংবা এইচজি ওয়েল্‌স যদি বুঝতেন সময়ের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করা যায় না, তা হলে হয়তো চন্দ্রাভিযান কিংবা টাইমমেশিন লেখা হতো না। তা হলে কী উদ্দেশ্য এই উপন্যাসদুটো লেখা হলো? বস্তুত মানবের অন্যতম মানবিক গুণ বাস্তব ও কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে সত্য উপলব্ধি করা, তার শ্রেষ্ঠত্বের ও মানবিকতার জয়গান করা। এর মধ্য দিয়েই সময়ে সময়ে বিশিষ্টজনেরা সমাজ পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদান রেখে চলেছেন। তাই লেখককে লেখার শুরুতে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। যেমন:

১. যে বিষয় নিয়ে লিখতে চাই সে সম্পর্কে যথাসম্ভব সঠিক ধারনা থাকা আবশ্যক। পূর্ণাঙ্গভাবে জেনে এবং বুঝে লিখতে হবে।
২. সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিষয় নির্বাচন করা উত্তম। তবে যে বিষয়ে লিখি না কেন, নির্বাচিত বিষয়টি নিয়ে আসলে কী বলতে চাই স্পষ্টভাবে নির্ধারন করতে হবে।
৩. আমি লিখতে পারি এটি প্রদর্শন কিংবা কাউকে মুগ্ধ করার আগ্রহের পরিবর্তে যা বলতে চাই সেটি সহজভাবে লেখা উত্তম।
৪. প্রথমে একটি কাঠামো তৈরি, তারপর চিন্তা বা বিশ্লেষণ এবং শেষে লেখা শুরু করতে হবে।
৫. পরিচিত ও নির্ভুল শব্দের ব্যবহার, করা উচিত। ছোট ছোট সহজবোধ্য বাক্য ও প্যারাগ্রাফ পাঠককে আকর্ষিত করে। সর্বপোরি নির্দিষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ভাষারীতিতে লেখা উত্তম। একই কথার পুনরাবৃত্তি, ভুল বানান, দুর্বোধ্যতা ও বিশেষণের বাহুল্য পরিহার লেখাকে সহজ ও সুখপাঠ্য করে তোলে।
৬. সঠিক তথ্য প্রদান করতে হবে। যা জানা নেই তার উল্লেখ না করা উত্তম। এবং বিষয়টি যে জানা নেই তার প্রচার করা যাবে না। সবাইকে সবকিছু জানতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। একইসঙ্গে সেকেন্ডহ্যান্ড ইনফরমেশন দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৭. লেখার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রামাণ্য উদ্ধৃতি লেখার বস্তুনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করে। সহায়ক গ্রন্থের নাম ও লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তার পৃষ্ঠা নম্বর, প্রকাশক, প্রকাশনার কাল ও প্রকাশকের পরিচিতি দেয়া দরকার।
৮. লিখতে গিয়ে কোনোক্রমেই বিচারকের ভূমিকা নেয়া উচিত হবে না।
৯. প্রচারণামূলক, পক্ষপাতিত্বমুলক ও অহং দোষে দুষ্ট এমন লেখা থেকে বিরত থাকা একটি ভালো গুণ।
১০. সকল লেখার কেন্দ্রবিন্দু হোক মানুষ ও জীববৈচিত্র, যার মাধ্যমে মানবিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

(সূত্র: ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী/মাহবুব আলী। প্রকাশনা বইমেলা ২০১৮, জয়তী বুকস, ঢাকা।)

মে দিবসের ছড়া

মালিক দেছে টাকা ভায়া
মিছিল-র‍্যালি যাই
সারাদিন ঘুরিফিরি
কাউয়া-বিরানি খাই।

মজদুর সব এক হও
কত কথা যে বলি
নেতা হামার গুঁতা মারে
ঠিক হয়ে তাই চলি।

নেতা হামার চাচা হয়
মালিক হয় বাপ
মে দিবস সুখে থাক
করিস ভায়া মাফ।

দুঃখের দিন শেষে

দুঃখের দিন শেষে

সৌরতাপে নেমে গেছে দুঃখের প্লাবন
সোনামুখি প্রিয়র পলিমাটি শরীর থেকে
যেখানে শেষ সীমা ধৈর্যের…প্রতীক্ষার
নতুন দিগন্তের সূচনা হাসিময় ঠোঁটে।

চন্দ্রালোকিত ঝাউবনের রূপোলি ছায়ায়
শুভক্ষণে উঠেছে পাগলিনী বাউরি বাতাস
কেঁপে কেঁপে কুমারি শিহরনে নিরালায়
শোনায় শ্রাবনে বসন্তের মদির-বিলাপ।

আমি কৃষক নেমে যাই শরতের মেঘে
কচি ধানের গন্ধে আকুল স্বপ্নিল কবিতায়
এক এক রহস্যের সব জট সরিয়ে
প্রিয় তোমায় জেনে নিই তুমিহীন কায়ায়।

আত্মার সাথে কথা বলা, এই যদি প্রকৃতি
সূর্যের প্রখরতায় মোম তাই বুঝি গলে
আঘনে উঠলে ফসল সোনালি সুখের গোলায়
শিশুর কান্নাতে বুক ভরে আসে মায়ায়।

(উত্তরের সাহিত্য: ১৩ মে ১৯৮৭)

আনন্দ-বেদনা শোকগাঁথা

আনন্দ-বেদনা শোকগাঁথা

একে একে চলে যায় প্রিয় মানুষজন
ফেলে রাখে দিনকালের চেনা-অচেনা ইতিহাস,
উত্তরের মেঘে ভেসে ভেসে এলে কতক চড়ুই
আঙিনায় নেমে কুড়োতে থাকে স্মৃতিকণা জ্বল জ্বল।

বর্ণিল সময়ের জানা-অজানা নান্দীপাঠ
সুর তাল লয় প্রিয় গানের প্রগলভ স্বরলিপি
সব শেষ করে সহসা সাধুজন হারায় কোথায়,
হামলে পড়ে বেদনা বুকের জমিন আঁচলতলায়
ঠুকরে বের করে আনে অশ্রুনীল রক্তধারা…
দীঘল বিকেলের আকাশ হয়ে পড়ে আনমনা।

আমাদের শোকসভা স্থির-নিশ্চুপ-নীরব
মনের গহিনে কথামালার স্রোতোধারা উদবেল,
আকাশগঙ্গায় একাকী উড়িয়ে সুতোকাটা ঘুড়ি
ভাসিয়ে দিই নাটাই জীবনের গল্পপাঠ শেষ অধ্যায়
ভেসে যায় অগোছালো জীবনের সরল পঙক্তিমালা।

আমাদের জীবন আমাদের মরণ একে একে রেখে দিই
দিনরাতের আকাশ দিগন্ত চুপিসার দেয়ালের কোণায়
কখনো হাতড়ে এনে বিষণ্ন বিকেলের একাকী তেপান্তর
স্মৃতিপাঠ আনন্দ-বেদনা শোকগাথা খেরো খাতায়।
___________________________________

(আমার শহর দিনাজপুরে সামান্য কিছুদিনের ব্যবধানে কয়েকজন গুণী মানুষ চলে গেছেন। এই লেখাটি সেই স্মৃতি তর্পেণে রচিত। কোনো সাহিত্য আসরে পঠিত।)

যখন গল্প মরে যায়

যখন গল্প মরে যায়

প্রতিটি মানুষের মধ্যে গল্প থাকে
প্রতিটি গল্পের ভেতর মানুষ
তারা গাছের ছায়ায় নদীর তীরে বসত গড়ে
তারা একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে
ভালবাসা বিরহকাতর রাত্রি জাগে
কান্নাহাসির দিগন্তরেখা ছায়াপথ
দৃষ্টিসীমায় হেসেখেলে যেতে যেতে
আগমীকে বপন করে মানুষের ভেতর
প্রেম অপ্রেমে কাতর উল্কাপাত।
মানুষ মানুষের কাছে যায়
শত প্রত্যাশায় ভালবেসে গল্প শোনে
গল্প শোনায় অব্যক্ত বিকেলের হলুদ আলোয়
সে গল্পের কোনোটি জেগে থাকে নক্ষত্রের জমিনে
গান যেমন কথা বলে বাঁশির সুরে সুরে বুকে স্বপ্নদোলা।
অনেক গল্পের ভিড়ে কারও গল্প হয় না শোনা
বলা হয় না বুকের দরজা খুলে আগলিয়ে জীবনপাঠ
কী হবে শত অভিযোগ আর প্রত্যাশার লাইন গুনে
প্রতারিত মরুপথ মরুদ্যান হোক তেপান্তর মাঠ
আর এভাবেই গল্পের ভেতর গল্প জেগে থাকে
গল্পের মধ্যে গল্প মরে যায় বদ্ধ নিশ্বাসে।

(র: ২০১৬)

লিমেরিক

লিমেরিক

॥ ০১ ॥
লিখেছেন তিনি শ’ তিনেক পদ্য
তখন যদিও উঠেছে গোঁফ দাড়ি সদ্য,
পাতার পর পাতা
খাতার পর খাতা
ছাপা না হওয়াতে হাপিত্যেশ অদ্য।

॥ ০২ ॥
একটা লোকের দেমাগ ভারি স্বভাবেতে খল
নিজেকে ভাবে মাসুদ রানা বাকি সব পাগল,
ভাবে সে সবরকম
নিজেই করে বকবকম
আড়াল থেকে সবাই বলে আস-রামছাগল!

টাককা টাকা টাকা

টাককা টাকা টাকা

টাকা না থাকায় দুঃখ বাড়ে
টাকায় আসে সুখ
কারও মুখ আমসি থাকে
কারও ফোলে বুক।

আছে যাদের অনেক টাকা
সুখ যে দুইহাতে
টাকাবিহীন জীবন মলিন
উপোষ থাকে রাতে।

কামাই টাকা জোটাই টাকা
পোদ্দারি খুব জোর
চুরির টাকা লুটের টাকা
বরাত মানিকজোড়

খরচ টাকা দু-হাতে খুব
জীবন থাকে রঙিণ
কেউ খাটে উথাল পাতাল
বেঁচে থাকা সঙিণ।

টাকাই জীবন টাকাই গড
টাকা পূণ্যফল
বাকি সব বেকার সাবাড়
বল হরিবল বল।

____________________
(অনেক আগে লেখা একটি ছড়া)

ধীরে ধীরে দখল হয়ে যায়

ধীরে ধীরে দখল হয়ে যাচ্ছে গলিপথ ফুটপাত রাস্তা
ঘাগরার দু-পাড় নদীর বেলাভূমি খেলার মাঠ
জঙ্গলের ঝোপঝাড় ফুলের বাগান গাছের ছায়া
ফসলের ক্ষেত বাঁশবাগান কাজলা দিঘি
আমাদের একান্ত হেঁটে চলার পথ-ঘাট দিঘল ভাবনা
পুকুরের পাড় বাড়ির আঙিনা সুখের দুয়ার
সব দখল হয়ে যায়…দখল হয়ে যায়;
সব দখল করে নেয় বেনিয়া দস্যু।

যারা চর দখলের লাঠিয়াল অশ্লীল খিস্তি-খেউর
মাথায় নিয়ে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-হত্যার হুলিয়া
কাঁধে ঝোলানো ভিক্ষের ঝুলি মাদরাসার চাঁদাবই,
তারা খুব ধীরপায়ে আসে…আসতে থাকে বানভাসি
সিঁদকাটা চোর দুচোখে অবিশ্বাস দৃষ্টিঘোলা ভিনদেশি।
দখল করে নেয় আমাদের সাধের সাজানো শহর
প্রিয় গলিপথ খেলার মাঠ রকের দেয়াল
দখল করে নেয় শান্তি
একমুঠো নিরিবিলি নিবিড় জীবন।

আমরা তারপর নির্জীব বসে থাকি আলস্য শরীর
শৌখিন বেদনায় তিন তাসের টেক্কা খুঁজি আকাশের ঘুড়ি
মিয়াবাড়ির দহলিজে যেমন সান্ধ্য আসর বসে সহসা
একজন আরেকজনের দোষ দেখি,
গালমন্দ কটুভাষ্য দায়ভার দিই খুব অনায়াসে;
এই তো বেশ আছি…বেশ ভালো আছি।

পুনরায় ধীরে ধীরে দখল হয়ে যায় সবকিছু
আমাদের রাতের ঘুম সুখ স্বপ্ন গ্রহ-নক্ষত্র-তারা
নিদহারা দুচোখ দেয়ালের পিঠে তুলে দিয়ে ভাবি
একদিন এ শহর গলিপথ ফুটপাত রাস্তাঘাট
আমাদের ছিল…আমাদের গৌরবগাঁথা পুঁথিপাঠ
সন্তানের হাসিমুখ মুড়ির মোয়া রেশমি জিলেপি
এখন আমাদের কিছু নেই…কিছু নেই আর।
মাথায় নিয়ে হুলিয়া কাঁধে ভিক্ষের ঝুলি মানুষজন
তারা সব দখল করে নেয়
দখল করে নেয় একটি কবিতার নান্দীপাঠ।