মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

ছুটির দিনে

চাপা বনে ফুল ফুটেছে আয়রে তোরা আয়
ছুটির দিনে ঘরে কি আর বসে থাকা যায়।
শহর ছেড়ে মন চলে যায় অনেক দূরের গায়
নদীর জলে সেথায় মাঝি পাল তুলে ওই যায়।

চৈতী ফুলের মালা গাঁথে পল্লী বালিকা
ঝিরি ঝিরি বাতাসে ওই দোলে বীথিকা।
কলমি লতার ফাকে ডাহুক ভাটিয়ালী গায়
আজকে আমার মন যেতে চায় সেই দূর সীমানায়।

যেখানে রাখাল বসে বাঁশরী বাজায়
পথিক বসে জুড়ায় ঘাম বটের ছায়ায়।
আজকে তোরা আয়রে সবাই আয়রে ছুটে আয়
ছুটির দিনটা কাটিয়ে আসি শ্যামলা মায়ের গায়।

ভয়ংকর ভূত

রাজার বাড়ি ঝিটকার কাছে ছয়য়ানি গালা গ্রামে। এবার ঝিটকা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অনেক ভাল পাশ দিয়ে মানিকগঞ্জে দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। মহাদেবপুর, ঝিটকা, হরিরামপুর, ঘিওর এই সব জায়গার কয়েকজন ছাত্র মিলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেসের মত থাকে। এক মহিলা তিন বেলা রান্না করে দিয়ে যায়। মানিকগঞ্জ তখন মহকুমা শহর হিসেবে খুব বড় কিছু নয়, মোটামুটি ছোট এক শহর। শনিবারে ক্লাস করে সবাই যার যার বাড়ি চলে যায়। সোমবার সকালে আবার দেখা হবে। বাড়ি থেকে আসার সময় কারো মা এক ঝুরি চিরা, কারো জন্য কিছু পিঠা আবার কেউ কিছু নারকেল গুড় দিয়ে দেয় তাই নিয়ে আসে। সবাই মিলে মিশে খায়। একবার রাজার মা এক টিন মুড়ি দিয়ে দিয়েছিল সেই মুড়ি খেয়ে মহাদেবপুরের দ্বিজেন সাহা আবারও বায়না দিয়েছে। রাজা তোর বাড়ির মুড়ি ভীষণ সুস্বাদু তুই যখনই বাড়ি যাবি তখনই কিন্তু অন্তত আমার জন্য এক টিন মুড়ি আনবি। রাজা এবার বাড়ি এসে আগেই মাকে বলে দিয়েছে মা দ্বিজেনের জন্য এক টিন মুড়ি দিও।

রাজার কলেজে যেতে আর মাত্র দুই দিন বাকি আছে এর মধ্যে মুড়ি ভাজতে হবে। রাজার মায়ের মুড়ির চিন্তায় ঘুম হয় না। শীতের দিনে পাড়ার সব বৌ ঝিরা বাপের বাড়ি চলে গেছে। মুড়ি ভাজবে কাকে নিয়ে? কয়দিন দেরি করেও কাউকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে একাই ভাজবে বলে রাতে সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে যাতে ভোরে উঠে একা একাই শুরু করা যায়। ঘুম হয়েছে কি হয়নি তাতে কি আসে যায়! পুব আকাশ ফর্সা হবার আগে, পাখিরা কিচির মিচির শুরু করার আগেই রাজার মা বিছানা ছেড়ে ভোরের কাজ কর্ম সেরে মুড়ি ভাজার চাউল, হাড়ি পাতিল ঝাঁজর এই সব কিছু এনে চুলার পাশে রেখে বাঁশের চালার তৈরি রান্না ঘরের পিছন থেকে কলার পাতা কাটতে গেছে তখন দেখল ইয়া লম্বা কে যেন সাদা দবদবে পোশাক পড়ে রান্না ঘরের পিছন থেকে সরে বাড়ির ঢালু দিয়ে বন কচু, ছিটকি, মটকার আগাছা ভেঙ্গে পিছনের পুকুরের উপর দিয়ে হেটে পার হয়ে জংলা ভিটার দিকে চলে গেল। আস্তে করে কয়েকটা কলার পাতা কেটে এনে চুলার পাশে রেডি করে রাখল। চুলা জ্বালিয়ে দুই এক খোলা মুড়ি ভাজা হয়েছে মুড়ির ঘ্রাণ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে আশে পাশে পৌঁছেছে এমন সময় রান্না ঘরের পিছনে ঝোপ ঝাঁরে প্রচণ্ড জড়াজড়ি ভাঙ্গা চোরার শব্দ শুনতে পেল রাজার মা। একটু ভয় পেল কিন্তু চুলায় আগুন জ্বলছে বলে সে ভয়কে প্রশ্রয় দিল না। এদিকে ওই জরা জরি ভাঙ্গা চোরার শব্দ বেরেই চলেছে। এভাবেই আরও কয়েক খোলা ভাজা হয়ে গেল। রান্না ঘরের মেঝেতে খেজুর পাতার পাটির উপর পুরনো শাড়ি বিছিয়ে বালি পরিষ্কার করার জন্য মুড়ি রাখতে হচ্ছে। রাজার মা চুলা ছেড়ে রান্না ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে বলল
এই তোরা কে এমন হুড়া হুরি করছিস, তোরা একটু থামতো!
সাথে সাথে নাকি সুরে,
মুড়ি দে! মুড়ি দে আমরা বাড়ি যাই!
কোন বাড়ি যাবি?
ওই যে পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছে।
আচ্ছা ঠিক আছে হুড়া হুরি করবি না চুপ করে থাক মুড়ি ভাজা হলে দেব। এখন থাম।

নাকি সুরে জবাব এলো, বেলা উঠে গেলে লোকজন চলাফেরা শুরু হবে তখন আমরা থাকব কেমনে? এখনই দিয়ে দে!
আচ্ছা মুড়ি পাইলে চইলা যাবি?
নাকি সুরে,
হ যামু!
আচ্ছা নে!
এই বলে একটা ছোট ঝুরি ভরে কিছু মুড়ি ছিটিয়ে দিল ওই দিকে যেখান থেকে হুরাহুরি জড়াজড়ির শব্দ আসছিল। অন্ধকারে বিশেষ কিছু দেখতে পেল না কিন্তু ভোরের আলো ফুটে উঠলে দেখল কোন মুড়ি পড়ে নেই।

পরের দিন রাজা মুড়ির টিন নিয়ে মানিকগঞ্জে চলে গেল। সহসা আর কোন ছুটি নেই। আবার সেই এসএসসি পরীক্ষার সময় ছুটি। মুড়ি পেয়ে দ্বিজেন মহা খুশি, মজা করে মুড়ি খায়। এর মধ্যে শুধু ক্লাস আর ক্লাস। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যেন প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। এবার বিশ দিনের ছুটি। খালি মুড়ির টিন আর গাঁটঠি বোচকা নিয়ে রাজা বাড়ি আসছে। ক্লাস শেষ করে ছুটি হলো বলে রওয়ানা হতে বেলা পরে গেল। বাঠইমুরি ছেড়ে কলতার কাছে আসার আগেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। আট মাইল পথ হেটে আসা সহজ কথা নয়। অন্ধকার রাত বলে একটু ভয় ভয় করছিল।

কলতা থেকে কোন সাথি সঙ্গী পায় কিনা সে আশায় ছিল কিন্তু কলতা এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কাউকে না পেয়ে একাই হাটতে শুরু করল। কলতার পুল পার হয়ে ঝাউ তলা এসে একজনকে পেল সে বিজয়নগর যাবে। বেশ তবুও কিছুটা সঙ্গী হলো। হাটতে হাটতে আলাপ করতে করতে বেশ অনেকটা পথ প্রায় বিজয় নগর বাজার পর্যন্ত এসে সঙ্গের লোকটা ওপাড়ে নিমতা চলে গেল। রাজা একটু ভাবনায় পড়ল সোজা গ্রামের পাশ দিয়ে যাবে নাকি চকের মধ্যে দিয়ে ভুসকুরা হয়ে সোজা যাবে! না অনেক হাটা হয়েছে সোজা যাওয়াই ভাল হবে এতটা পথ ঘুরে যাবার এমন কি দরকার! বেশ, সেই অনুযায়ী বাম দিকে ভুসকুরার রাস্তা দিয়ে হেটে আসছে। অন্ধকারে গ্রামের মেঠো পথে হেটে যাচ্ছে আর লোক বসতি একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে। গেরস্ত বাড়ির পিদিমের আলো ম্লান হয়ে আসছে, দেখা যায় না।

এক সময় ভুসকুরার সেই বিখ্যাত দীঘির কাছে এসেছে পরে দীঘির পাড় থেকে কেমন যেন ছট ফটানির মত শব্দ পাচ্ছে। পুকুর পাড়ে যে সব আগাছা থাকে সেগুলি ভাঙ্গা চোরার মত কেমন শব্দ। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু তছনছ করে ওলট পালট করছে কেউ। যেন কোন আক্রোশ ঢেলে দিচ্ছে কারো উপর! কি হচ্ছে? কোথায় হচ্ছে? এত অন্ধকারে কি হতে পারে, কে হতে পারে? রাজা একটু দাঁড়াল। শুধু ওই শব্দ হচ্ছে জন প্রাণীর কোন সারা শব্দ নেই, কিন্তু এই শব্দ কে করছে! অবাক হয়ে অনেকক্ষণ এদিক ওদিক দেখল কিন্তু কিছুই পেল না। ঘুট ঘুটে অন্ধকারে তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছে না। একবার ভাবে ডেকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু কাকে

জিজ্ঞেস করবে? তবুও কি মনে করে একটু জোরে ডাকল কে, কে ওখানে? কারো কোন সারা নেই! আবার ডাকল, কে? কে ওখানে? এবারও কোন সারা নেই তবে ওই শব্দটা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। আশ্চর্য! আর কোন শব্দ নেই! রাজা বুদ্ধি করে পাশের শেওড়া গাছ থেকে একটা ডাল ভেঙ্গে সাথের মুড়ির টিন ঢোলের মত বাজাতে শুরু করল। তাক ঢুমা ঢুম, তাক ঢুমা ঢুম। বাজাতে বাজাতে যেখান থেকে শব্দ আসছিল প্রায় তার কাছে চলে আসল কিন্তু অন্ধকার বলে সঠিক জায়গাটা বুঝতে পারছিল না। তবুও অন্ধকারের মধ্যেই যতটা পারে হাতরে হাতরে কাছে এসে দেখ হ্যাঁ এইতো এইখানেই ঝট পটানি হয়েছে কিছু টানা হ্যাচরাও হয়েছে মনে হলো! মনে হল কাউকে টেনে দীঘির পাড়ে চালায় তুলে নিয়েছে, হ্যাঁ এইতো তাজা ডাল ভাঙ্গার চিহ্ন। এমন দেখেই রাজার একটু ভয় ভয় করতে লাগল, গা ছম ছম করে উঠল। মনে হলো শরীর ঘামতে শুরু করেছে। ওদিকে দীঘির কিনারা থেকে একটা অস্পষ্ট গোঙানির মত শব্দ পাচ্ছিল। এবার রাজা পুরোপুরি ভয় পেয়ে গেল। না আর এখানে থাকা যাবে না। ডিটেকটিভ গিরি করার কোন দরকার নেই যার যা হয়েছে
হোক বাবা আমি চললাম বলে বাড়ির দিকে এক দৌড়। কিছুদূর যেতে না যেতেই দেখে আব্দুলের বাবা আর বড় ভাই হারিকেন নিয়ে এদিকে আসছে। ওদের দেখে রাজা দাঁড়াল।

রাজা কি মানিকগঞ্জ থেকে আসছ?
হ্যাঁ চাচা
তা এ ভাবে দৌড়চ্ছ কেন, একেবারে হাঁপাচ্ছ, ভয় পেয়েছ নাকি?
হ্যাঁ চাচা, বলেই ভুসকুরার দীঘির পাড়ে যা দেখেছে সব খুলে বলল। শুনে আবদুলের বড় ভাই বলল
কি জানি আমাদের আবদুল তো সেই সন্ধ্যার আগে গরু নিতে এসেছিল কিন্তু গরু বাড়ি চলে গেছে অথচ ও যায় নি! কোথায় গেল আমরা খুঁজতে বেরিয়েছি।
রাজার কি মনে হলো বলল
চলেন তো দেখি, আমার মনে হয় ওই ওখানে দীঘির পাড়ে দেখতে হবে। আমি অন্ধকার বলে ভাল করে দেখতে পারিনি
আচ্ছা চলো।

ওরা হারিকেন নিয়ে আগে আগে আর পিছনে রাজা চলল।
কিছুদূর গিয়ে দীঘির পাড়ে এসে রাজা দেখিয়ে দিল এইযে এখানে আমি দেখেছিলাম কিছু ছিটকির ভাঙ্গা ডাল।
দীঘির পাড়ে চালার উপরে উঠে যেখানে গোঙানির শব্দ শুনেছে সেখানে গিয়ে দেখে অচেতন আবদুলের দেহ অর্ধেক পানিতে আর বাকি অর্ধেক কাদায় পরে রয়েছে। এই দেখেই ওদের কারো বুঝতে বাকি রইল না কি হয়েছে। দোয়া কালাম পড়তে পড়তে ওখান থেকে তিনজনে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করে যখন সুস্থ করল তখন আবদুল বলল আমি গরুর খুঁটি উঠিয়ে ছেড়ে দিয়েছি আর অমনিই গরুগুলি এক এক করে বাড়ির দিকে চলে এলো আমি আসছিলাম কিন্তু মনে হলো কে যেন আমাকে জোড় করে পিছনে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে অথচ কাউকে দেখছি না। বেশ কিছুক্ষণ ধ্বস্তা ধ্বস্তি করলাম কিছুতেই ছাড়া পেলাম না তারপরে আর আমার কিছু মনে নেই।
রাজা জিজ্ঞেস করল, তখন কি অন্ধকার হয়ে আসছিল?
হ্যাঁ অন্ধকার তো গরু ছাড়ার আগেই হয়ে গেছে
বুঝেছি তখনই আমি শব্দ পেয়েছি কিন্তু কিছুই দেখছিলাম না আবার ভয় করছিল বলে মুড়ির টিন বাজাচ্ছিলাম
আবদুলের ভাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা তোমার টিন বাজাবার শব্দ শুনেছি!

চোরাবালি

এই কুত্তার বাচ্চা আর কতক্ষণ বিছানায় থাকবি? রাইতে ঘুম হয় না? রাইত ভইরা কি চুরি করছ? তোর গুষ্টির পিণ্ডির যোগারে যাবি না? যা ওঠ! সকাল বেলা মেঝ ভাবির কণ্ঠে এই সুমধুর বানী শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল স্বপনের! কাকে বলছে?
নিশ্চয় তার স্বামী দেবতা মেঝ ভাইকেই বলছে! ওপাশে আবার মেঝ ভাবির সাথে যোগ দিয়েছে তার গরুটা, সেই ভোর থেকেই হাম্বা হাম্বা শুরু করেছে। করবে না কেন। গরুটা দুইয়ে বাছুরটাকে একটু দুধ খেতে দিলেই হয় শত হলেও ওরইতো প্রাপ্য! না, তা করবে না। দোয়ানো হয়ে গেলে বাছুরটাকে দূরে বেধে ঘাস খাওয়াবে। আহা অতটুক বাছুর! মা কি আর তাই মেনে নিতে চায়? পশু বলে কি মায়া দয়া কিছুই নেই? বেশ কিছুদিন থেকেই শুরু হয়েছে এমন ধারা। আগে এরকম ছিল না। বাবার জমি যতদিন বিক্রি করতে পেরেছে ততদিন বেশ সুখেই কেটেছে। এমন হতে শুরু করেছে যখন বিক্রি করার মত আর কোন জমি নেই, অভাব এসে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরেছে তখন থেকে। লেখাপড়ায় অষ্ট কলা, স্কুলের গণ্ডিও পার হতে পারেনি। কোথায় পাবে সাহেব গিরি করার মত চাকরি? গায়ে গতরে দেখতে কামলা দেয়ার মত হলে কি হবে সে মুরোদও নেই। ওদিকে আবার চাচাত বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে কেমন করে যেন এই চিজ ধরে নিয়ে এসেছে। মাত্র দুই দিনের পরিচয়ে যে মেয়ে মায়ের বাড়ি ছেড়ে অচেনা এক ছেলের হাত ধরে চলে আসতে পারে তার কাছে আর কতটুকই বা আশা করা যায়?

চার ভাই চার বোনের সংসার, মা আছে বাবা নেই। বাবা হামিদ খান হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনায় মারা গেল। ঝিটকা বাজারের দোকানের মালামাল কেনার জন্য ঢাকার মৌলবি বাজারে যাতায়াত সেই অনেক দিনের। কেনা কাটা করে লঞ্চে মালামাল বুকিং দিয়ে বাসে করে চলে আসে। সেদিন বাড়িতে ফিরে আসার পথেই বানিয়া জুরি বাস স্ট্যান্ডের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা গেল। মা এত দিন সংসারের কিছুই খোজ খবর নেয়নি, কিছুই জানে না। বড় মেয়ে বিয়ে হয়েছে বেশ অনেকদিন, বছর খানিক আগে মেঝ মেয়েরও বিয়ে হয়েছে তারা তাদের মত ভালই আছে। বড় ছেলেটা কলেজের গণ্ডি এবং মেঝ ছেলে স্কুল শেষ করতে পারল না। বাবা মারা যাবার পর সবাই পরামর্শ দিল বাবার দোকানে বসার জন্য কিন্তু সাহেবদের বাবুগিরি করার মত উপায় হবে না তাতে তাই দোকান ভাড়া দিয়ে দিল। এখন সংসার চলবে কি দিয়ে? জমিজমা বেশ ছিল, প্রায় পঞ্চাশ বিঘা। এই জমি দিয়েই হেসে খেলে দিব্যি চলে যায় এমন সংসার। কিন্তু এতদিন মা ছিল অতিথির মত, বাবাই দোকান জমি সব সামাল দিত। কিছুদিন যাবার পর বড় ছেলের একটা চাকরি হলো। কিন্তু চাকরি হবার সাথেই কি আর বেতন দেয়? মাস পূর্তি না হলে যে বেতন মিলে না। চলবে কি দিয়ে? সহজ উপায় একটা আছে, বাড়ি এসে এক বিঘা জমি বিক্রি করে কিছু মাকে দিয়ে গেল আর বাকিটা নিয়ে বড় সাহেব তার কর্মস্থানে চলে গেল। শুধু মাস চলা নয় বৌয়ের চাহিদা অনুযায়ী রঙ্গিন টিভি, স্টিলের আলমারি, ঘরের অন্যান্য ফার্নিচার এগুলিও বাবার জমি বিক্রির টাকা দিয়ে মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই চলছে। যাবার সময় মায়ের হাতে দুই এক হাজার টাকা দিয়ে গেলেই মা খুশি। টাকা কোথায় পেল সে কথা জিজ্ঞেস করার কি প্রয়োজন! গ্রামের মানুষ দশ হাজার টাকার জমি ছয় হাজারে পেলে এমনি করেই কিনে। তারা যে হামিদ খানের জমি কেনার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে! যারা কিনে তারা সবাই এলাকারই লোকজন। সবাই জানে এই ছেলে হামিদ খানের জমির বেশ কিছু অংশ পাবে কাজেই ভয় নেই এক সময় রেজিস্ট্রি করে দিলেই হলো। এক ভাই বিক্রি করে তার অন্য ভাইয়েরা কেউ কিছু জানতেও পারে না।

হরিরামপুরে রেজিস্ট্রি অফিসে যেয়ে সব ভাইকে একসাথে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসতে হবে এমন কোন দরকার নেই। যার যখন প্রয়োজন হয় বা টাকার দরকার হয় তখন যার যার মত খরিদ্দার ঠিক করে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসলেই হলো। কে কতটা পাবে বা অন্য ভাই বোনেরা কে কতটা পাবে তা দেখার প্রয়োজন নেই। আমার এখন টাকার দরকার আমি বিক্রি করলেই হলো। শেষ অবধি যদি কিছু থাকে তখন দেখা যাবে কে কতটা পায়। আমারটা হিসেব করে বাদ দিয়ে দিলেই হবে। এভাবেই চলছে। বড় জন সেলিম চাকরি করে, সরকারি চাকরি তবুও তার অভাব লেগেই থাকে। মেঝ জন সংসার দেখাশুনা করে। জমি বিক্রি করে আনে আর সংসার চালায়। মা কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি হ্যাঁরে মাজেদ টাকা কোথায় পেয়েছিস বা চাল কিনে আনলি কি দিয়ে? ওদিকে সেঝ জন মানিক পাশের বিজয়নগর বাজারে ওষুধের দোকান করে। সন্ধ্যার পরে বাজারে এক কোণায় কয়েকজন মিলে নতুন করে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করে নিয়েছে সেখানে জুয়া খেলা হয়। মানিক তাদের সবার সাথে সংগ না দিলে তার মান থাকে না বলে ওই আড্ডায় নিয়মিত বসে এবং প্রতিদিনই হেরে আসে। এতে করে দোকানের চালান পত্রে টান পরছে এখন কি করে? বন্ধু স্বজনেরা বুদ্ধি দিল আরে তোর বড় ভাই মেঝ ভাই জমি বিক্রি করে শেষ করে দিল আর তুই দোকানের চালানের জন্য ভাবছিস? চল তোকে একটা জাঁদরেল কাস্টমার যোগার করে দিচ্ছি জমি বিক্রি করে দোকানে কিছু মাল উঠাবি আর বাকিটা দিয়ে সন্ধ্যার আসর চালাবি। এই করে করে স্বপনের এবং চার বোনের যে অংশ ছিল তার তলায় এসে পৌঁছেছে। স্বপন সবার ছোট। বড় ভাইদের এই কীর্তি কাহিনী কিছুই বুঝতে বা জানতে পারেনি। ছোট দুই বোন বড় বোনেদের কাছে থাকে বলে বোনেরাও কেউ কিছু জানতে বুঝতে পারেনি।

স্বপন একটু বড় হলে যখন এতদিনের চেনা নিজেদের জমিতে অন্যদের চাষ করতে এবং ফসল তুলতে দেখল তখন একদিন মেঝ ভাইকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা ভাইয়া ওই জমিটাতো দেখেছি আমাদের ছিল তাহলে ও পাড়ার হাবুলরা কেন চাষ দিল আর ফসলই বা কেন কেটে নিয়ে গেল?
তুই ছোট মানুষ এগুলি বুঝবি না, তোর মাথা ঘামাবার দরকার নেই
বারে, এ আবার কেমন কথা! আমাদের জমির ধান কেটে নিয়ে যাবে আর এ কথা আমার জানার দরকার নেই কেন?
স্বপন এই প্রশ্নের কোন জবাব কোনদিন পায়নি।

দিন থেমে থাকে না। ছয় ঋতুর এই দেশে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা তাদের নির্ধারিত নিয়মে অনেকগুলি বছর নিয়ে চলে গেছে আর সাথে সাথে স্বপনও বড় হয়ে উঠেছে। স্বপনের এখন বিয়ে করে সংসার করার সময় হয়েছে। এর মধ্যে দুই এক জন নিকট আত্মীয় ভাইদের সবাইকে ডেকে পারিবারিক ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছে। একান্নবর্তী থাকা কালীন বড় ভাইয়েরা যারা কোন রোজগার না করে শুধু বাবার জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছে এবং যার যার বৌয়ের সাধ মিটিয়েছে হিসেব করে তাদের হিসাব বাদ দিয়ে বর্তমানে অবশিষ্ট যে পরিমাণ জমি আছে তাই হিসেব করে দেখা গেল বড়রা জমি বিক্রি করার পর তাদের ভাগে আর কোন জমি নেই কেও তার প্রাপ্যের বেশিই বিক্রি করে ফেলেছে। এখন যতটা রয়েছে তা স্বপনের, বোনদের আর মায়ের অংশ। বাড়িটা ভাগাভাগি না হলেও মোটামুটি একটা নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হলো যে তোমরা ওখানে ঘর তুলে বসবাস করতে পার। বড়দের চূড়ান্ত ভাবে বলে দেয়া হলো যে তোমরা আর কোন জমি বিক্রি করতে পারবে না। বাজারে যে দোকান আছে সেটা নিয়ে এখন আর কিছু হলো না তবে ওটার ভাড়া বাবদ যে টাকা আসবে সে টাকা মা পাবে এই ভাবে সিদ্ধান্ত হলো। একটা সাদা কাগজে এই মর্মে সর্ব সম্মতিক্রমে যা যা সিদ্ধান্ত হয়েছে উপস্থিত সবার সই স্বাক্ষর নিয়ে লিখে রাখা হলো যেন শ্রীমান সেলিম, মাজেদ এবং মানিক ভবিষ্যতে আর কোন জমি বিক্রির সুযোগ না পায়। অবশ্য এ বিষয়ে আইনগত আর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নিতান্ত পারিবারিক সমস্যা মনে করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।

চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। স্বপনের বড় ভাইয়েরাও তেমনি করে সেদিন সই স্বাক্ষর দিয়ে আসলেও দুই এক বছর যেতে না যেতেই আবার সবার অগোচরে কাউকে না জানিয়ে যারা জমি কিনে তাদের সাথে গোপন আঁতাত করে কিছু জমি বিক্রি করতে শুরু করল। এর মধ্যে মেঝ সাহেব মানিকগঞ্জের পাশে চাচাত বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একজন ডানাকাটা পরী ধরে এনেছে। পরীর নানা চাহিদা মেটাতে গিয়ে শ্রীমান মাজেদ বুঝতে পেরেছে যে জমি বিক্রি করে ভবিষ্যৎ চলবে না কারণ আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। এই ভেবে এবং পরীর পরামর্শে বিদেশে যাবার একটা যোগাযোগ পেয়ে আবার আসল জমি বিক্রি করতে কিন্তু তার প্রাপ্য আর কোন জমি না থাকায় স্বপনকে বলল তুই আমাকে মালয়েশিয়া যাবার জন্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা ধার দে আমি ওটা বাজারের দোকানের অংশ থেকে ব্যবস্থা করে দিব। সরল স্বপন ভাইয়ের এই দুরবস্থার কথা ভেবে রাজি হয়ে ধার কর্জ করে ভাইকে টাকার ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু ওদিকে মাজেদ যাবার আগে গ্রামের একজনের কাছে গোপনে কিছু জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে পরীর হাতে দিয়ে গেল। স্বপন এর কিছুই জানতে পারল না। মাজেদ মালয়েশিয়া চলে গেল। মাসে মাসে টাকা পাঠায় আর সে টাকা দিয়ে পরী মনের সুখে সংসার চালায়। ঢাকায় খালার বাড়ি গিয়ে রঙ্গিন টেলিভিশন, গয়না, সুন্দর সুন্দর শারী কিনে আনে।

মাজেদ চলে যাবার পর মানিক বেশ পসার জমিয়ে ফেলেছিল। আশেপাশের রুগীদের প্রেশার মেপে দেয়া, স্যালাইন দেয়া, ইঞ্জেকশন দেয়া এবং সাধারণ কিছু ডাইরিয়া আর জ্বর জারির চিকিৎসায় বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছিল কিন্তু এই পসারের সাথে আর এক দিকেও বেশ পসার জমিয়ে নিয়েছিল। জুয়ার আসরে হাজিরা দেয়া আগে থেকেই নিয়মিত ছিল, এর সাথে আবার নতুন করে যোগ হয়েছে বিজয় নগর বাজারের পাশে শেখ বোরহানের বিধবা মেয়ে ময়নার সাথে মন দেয়া নেয়ার খেলা। ঘরে স্ত্রী সন্তান রেখে ময়নার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোন কোন রাতে বাড়িতেও আসে না। ময়নার সাথে অভিসার সেরে অত রাতে বাড়িতে পুরনো হয়ে যাওয়া মর্জিনা আর কাছে আসার কোন আগ্রহ তৈরি করতে পারে না বলে দোকানেই থেকে যায়। নিরীহ মর্জিনা যন্ত্রণায় অস্থির। কাওকে বলতেও পারছে না আবার নিজের মধ্যে চেপেও রাখতে পারছে না। কিন্তু সে না বললে কি হবে, বিষয়টা বিজয় নগর এলাকায় রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় ভেবে ভেবে শরীর মন দুইই যখন দুর্বল হয়ে গেছে যখন এই অবস্থা জটিল থেকে আরও জটিলের দিকে গড়াচ্ছে তখন আর কোন কুল কিনারা না পেয়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে মায়ের বাড়িতে যেয়ে মাকে জানিয়ে আসল। মা বলল তোর শাশুড়ি জানে?
সবাই যখন জেনে গেছে তখন সে জানে না এ কথা কি করে বলি?
তুই নিজে তাকে বলে দেখ কি হয়
বলে দেখব কিন্তু কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। ছেলেরা কি মায়ের কোন কথার দাম দেয়? এই যে যার যার ইচ্ছা মত জমিগুলি বিক্রি করে ফেলল তাতে কি মা কোনদিন কিছু বলেছে? কিছুই বলেনি। কাজেই তাকে বললে কিছু হবে না।
তাহলে তোর বড় ননাসকে বল, দেখ সে কি করে।
বড় দুলাভাইকে জানালে সে এসে মানিককে তাৎক্ষণিক ভাবে দোকান বিক্রি করে পরিবার সহ ঢাকায় যেয়ে তার পরিচিত শহিদ সাহেবের গার্মেন্টসে চাকরি নেয়ার জন্য বলল। তুই ওখানে যা আমি শহিদকে বলে দিব, যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করে দিবে। সে আবার শুধু পরামর্শ দিয়েই ব্যাপারটা শেষ করেনি। রীতিমত বিজয়নগর বাজারে গিয়ে বাজার কমিটি এবং ওখানকার গণ্যমান্য লোকদের সাথে আলাপ করে বিস্তারিত জানিয়ে এসেছে। তাদের সাথে আলাপের সময় ময়নার বাবা শেখ বোরহানকেও ডেকেছিল।

মাস বছর চলে গেল। দেখতে দেখতে দুই বছর পর ফিরে এসে মাজেদ দেখল তার ঘরে রঙ্গিন টিভি সহ কিছু ফার্নিচার আর তার পরীর গায়ে কিছু অলংকার হয়েছে এ ছাড়া আর কিছুই নেই। কি করবে এখন? ডানা কাটা পরীর সাথে অনেক বাক বিতণ্ডা হলো কিন্তু ফলাফল যা হবার তাই হলো। চ্যাঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি এবং মারামারি নিত্য দিনের সঙ্গী হলো।
মাজেদ কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে স্থানীয় চেয়ারম্যান চাচাত ভাই কালামের সাথে পরামর্শ করল।
আরে তুই এত ভাবছিস কেন, আমি আছি না? আমারতো একজন এসিসট্যান্ট দরকার তুই এখন থেকে আমার সাথেই থাকবি! সেই থেকেই সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে গেল। গম বিক্রি করা থেকে সালিস দরবার করা এবং নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেল। রাতে বাড়ি ফেরার পথে বা শনিবার ঝিটকার হাটের দিন যা হাতে দিয়ে দেয় এই সম্বল করে ভাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকল। চেয়ারম্যান সাহেব কি করতে চাইছে তা মাজেদকে জানিয়ে দেয় আর মাজেদ সম্ভব হলে তার চেয়ে একটু বেশি করে ফেলে। অন্তত কালাম ভাই যতদিন চেয়ারম্যান আছে তত দিনের জন্য একটা গতি হলো।
ওদিকে বড় শ্রীমান সেলিম আগের মতই গোপনে গোপনে জমি বিক্রি করা বন্ধ করতে পারল না। আজ বৌয়ের শারী, কাল গয়না, পরশু এটা সেটার দাবী মেটাতে তার আর কোন পথ খোলা নেই।

স্বপন এসবের কিছুই জানতে পারেনি। স্বপন জানে তার ভাগে যে পরিমাণ জমি আছে তাতে সেগুলি চাষ করে তার চলে যাবে। এই ভাবনা ভেবে স্বপন বিয়ে করে একটা বৌ নিয়ে এলো। না, এ বিয়ে মাজেদের মত নয়। বাড়ির মা বোনদের দেখে শুনে আনা বৌ। ঢাকার কাছেই শিঙ্গাইর গ্রামে বাপের বাড়ি। শিক্ষিত মেয়ে, সাহানা। বাপের বাড়ি থেকে বিএ পাশ করেই এসেছে। বৌ স্বপনের ঘরে এসেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক অন্যান্য বাড়ির মত নয় বিশেষ করে তাদের বাড়ির মততো নয়ই। তার বাবা একজন সফল কৃষক। ওখানে ধান পাটের সাথে নানা রকম শাক সবজি এমনকি পোলাওর ধান পর্যন্ত চাষ করে। ছোট বেলা থেকেই বাবাকে দেখে দেখে অনেক কিছু শিখেছে। সারা দিন কাজ কর্মের ব্যস্ততা সেরে রাতে শোবার পর মাথায় এসে নানা চিন্তা ভিড় করে। স্বামীর এই অবস্থা দেখে ভাবনার দুয়ার খুলে গেল। কি করা যায়? ভাইয়েরা যে সব জমি বিক্রি করে ফেলেছে সেগুলি উদ্ধারের কোন উপায় নেই। এখন চলতেও হবে, বাচতেও হবে আবার ভবিষ্যতের একটা উপায়ও করতে হবে। কয়েকদিন যাবার পর একদিন রাতে খাবার পর শোবার আগে স্বপনকে মধুর সুরে বলল
কিছু আলাপ করতে চাইছিলাম
কি আলাপ? কাল সকালে করলে হয় না? ভীষণ ঘুম পাচ্ছে
না সকালের আলাপ নয়, এ আলাপ একান্তে করার আলাপ
এমন কি আলাপ, বল শুনি
কয়েকদিন থেকেই ভাবছি এভাবে কত দিন চলবে তাই আমি একটা ভাবনা ভেবেছি
কি ভাবনা বল
তুমি সেদিন বলছিলে দক্ষিণ দিকের ওই জমি নিয়ে একটা প্রজেক্ট করবে, তাহলে করছ না কেন?

এত দিন করিনি কিন্তু এখন তুমি এসেছ এখন করব। আসলে এত টাকা পাব কোথায়?
তাহলে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু কর। জমি যেখানে যা আছে সেগুলি বর্গা দিয়ে দাও আর একটা মেশিন কিনে এখানে বাড়ির দক্ষিণে ইরির প্রজেক্ট কর, টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। এদিকে যাদের জমি আছে তাদের সাথে আজই আলাপ কর। বাড়ির সাথে আমাদের যে জমি আছে ওখানে ভাল সবজি হবে, অঘ্রাণ মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সবজি করা যাবে। শীত আসার আগে আমি এর ব্যবস্থা করে ফেলব
মেশিন কেনার টাকা কোথায় পাব?
বললামতো আমি ব্যবস্থা করব
তুমি কি করে ব্যবস্থা করবে?
করব, দরকার হলে বাবার আছ থেকে আনব
দেখ যা ভাল মনে কর, এখন চল শুয়ে পরি।
চল
সকালে ঘুম ভাঙলে সাহানা তাড়াতাড়ি নাশতা বানিয়ে স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে বলল এখনই যাও তুমি ওদের সাথে আলাপ কর।
যাই দেখি কি বলে

দুপুরের মধ্যে ফিরে এসে সাহানাকে জানাল, সবাইকে পায়নি তবে যাদের সাথে আলাপ হয়েছে তারা মোটামুটি ইতি বাচক জবাব দিয়েছে। যারা বাকি আছে তাদের সাথে সন্ধ্যার পর আলাপ করে সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কয়েকদিনের মধ্যেই মিটিং করে সিদ্ধান্ত হলো স্বপন পানি দিবে এবং এজন্যে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ সে পাবে। জমি থেকেই ভাগের কাজটা করে নিবে। টিউব ওয়েলটা স্বপনের বাড়ির দক্ষিণ পাশে আম গাছের নিচে পোতা হবে ওখান থেকেই নালা কেটে সব জমিতে পৌঁছে দেয়া হবে। অঘ্রাণ মাসে বর্ষার পানি সরে গেলে নালা কাটার ব্যবস্থা হবে। চৈত্র মাসের মধ্যেই মেশিন কেনা, মেশিনের জন্য একটা চালা ঘর করা এগুলি সেরে ফেলবে। আপাতত এই হোক পরের ব্যবস্থা পরে হবে। ফলপ্রসূ আলাপে সাহানার প্রথম পরিকল্পনা কার্যকর হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মনে মনে উল্লাসিত হলো এবং রাতের বেলা সে উল্লাসের ঢেউ তার স্বামীর দেহে মনেও ছড়িয়ে দিল।

ভোরে দুইজনেই চোখে মুখে আনন্দের একটা ঝিলিক আর স্বপ্নের ছায়া নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠে এক সাথে রান্না ঘরে বসে রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে নাশতা খেয়ে দুইজনে মিলে পুকুর পাড়ে যেখানে শীতকালীন শাক সবজির চাড়া ফলাবে সে জায়গা ঠিক করে আগাছা পরিষ্কার করে কুপিয়ে বীজ বোনার উপযুক্ত করল। সন্ধ্যায় সাহানা বলল
আমি কাল সকালে শিঙ্গাইর যাব
কেন, হঠাৎ করে আবার শিঙ্গাইর কেন?
কেন আবার, বীজ আনতে হবে না? বাবার কাছ থেকে কিছু ভাল জাতের ফুলকপি, টমাটো, ঢ্যাঁড়স আর কাচা মরিচের বীজ নিয়ে আসি
ভাল কথা বলেছ।

বাবার বাড়ি থেকে উন্নত জাতের বীজ এনে বাড়ির সামনে পিছনে স্বপনের দখলে থাকা মাত্র চার বিঘা জমিতে ওই সব চাড়া বুনে নিয়মিত ভাবে দুইজনে মিলে ভাল যত্ন করে। সময়মত সেচ দেয়া, উপযুক্ত সার দেয়া, কীট নাশক স্প্রে করার কাজ সাহানা নিজেই করে স্বামী স্বপন শুধু তার সাথে থেকে তাকে জোগান দেয়। দেখতে দেখতে আশাতীত ফলন হলো এবং তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভ হলো। পাশাপাশি ইরির প্রজেক্ট থেকেও ভাল ফলন পাওয়া গেল। সাহানা নিজেই পাম্প চালান থেকে শুরু করে সমস্ত প্রজেক্ট ঘুরে ঘুরে কোন জমিতে কখন পানি দিতে হবে তা সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে বেশ মনের মত ফল পেল। পুকুরের জন্যে শিঙ্গাইর থেকে মাছের পোনা এনে আশ্বিন মাসে ছেড়েছিল সেগুলাও এখন বেশ বড় হয়েছে। নিজেদের খাবারতো চলেই কিছু বিক্রিও করা যায়। এ ছাড়া এত বড় বাড়িতে রান্না ঘরের পাশে একটা দোতলা মুরগির খোপ বানিয়ে তাতে উপরে মুরগি আর নিচে হাস পেলে বাড়ির ডিম মাংসের যোগানতো আগে থেকেই করেছে। আর এই সাথে সারা গ্রামে সোর পরে গেল যে, স্বপন একটা বৌ এনেছে! সবার মুখে মুখে এই এক কথা। স্বপনের সংসারে সুখের কোন অভাব নেই। স্বপন বাড়ির সামনে দক্ষিণের পুকুর পাড়ে বড় বকুল গাছের নিচে বসে সামনে সবজি ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে।

সাহানা এবার নজর দিল স্বামীর ভাগের জমিগুলি যেগুলি বড় ভাইয়েরা বাগি দিয়ে দিয়েছে সেগুলি নিজেদের আওতায় এনে চাষ করার জন্য। সাহানার নিয়ম অনুযায়ী রাতে স্বামীকে আনন্দ দিয়ে নিজে কিছু পেয়ে সকালে উঠে স্বামীকে পাঠিয়ে দেয় নতুন কাজে। তেমনি একদিন সকালে ভোরে তোলা ফুলকপি ভাজি আর ডিম ভাজি দিয়ে রুটি খেয়ে স্বপন চলল জমিগুলির বাগির ভাগ ছাড়িয়ে আনতে? কিন্তু দিনান্তে যে সংবাদ জেনে আসল তা মোটেও সুখের কোন সংবাদ নয়। বড় ভাইয়েরা বিশেষ করে সেলিম এবং মাজেদ এর মধ্যে সব বিক্রি করে ফেলেছে। এটা কেমন করে করল? কিছুতেই স্বপন ভেবে পাচ্ছে না এমন হলো কি করে? এই কাজ কখন করল? বড় দুলাভাই যে নিষেধ করে দিয়েছিল! তাহলে তাকে অমান্য করেই করেছে এগুলি? সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে এসে সাহানার সাথে পরামর্শ করে ঢাকায় মেঝ দুলাভাই, বড় দুলাভাইকে মোবাইলে জানাল। বড় দুলাভাই বলল আচ্ছা ভেবে দেখি কি করা যায়। দুই দিন পরে স্বপন আবার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করল
কি করবেন?

এক কাজ কর সামনের শুক্রবারে আমি আসছি তুই ওখানে তাহের, হানিফ, জলিল, বাদল এদেরকে বলে রাখ ওরা যেন নামাজের পরে থাকে আর তাহেরকে বলবি সেলিম, মাজেদ, মানিক দের বলতে যাতে ওরাও উপস্থিত থাকে, ওরা যেন অবশ্যই থাকে ওরা না থাকলে কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। আর শোন, কালাম চেয়ারম্যানকেও বলবি।
ওদিকে সাহানাও তার বাবাকে জানাল সালিশের দিনে যেন সে এখানে আসে।
শুক্রবারে নামাজের আগেই বড় আর মেঝ দুলাভাই সহ সব বোনেরাও আসল। নামাজের পরে সাহানার খোপের মুরগির মাংস, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে ওই বকুল গাছের নিচে পাতা মাদুরে বসে অপেক্ষা করছে কখন সবাই আসবে। একে একে গ্রামের যাদের বলা হয়েছিল তারা প্রায় সবাই এলো। বাড়িতে খোজ নিয়ে দেখা গেল মেঝ ভাই বাড়িতে নেই। বড় ভাই, সেঝ ভাই এবং চেয়ারম্যানের দেখাও নেই। মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা হলো কিন্তু কেও ফোন ধরছে না। তাহেরকে জিজ্ঞেস করল
তুমি কি ওদের জানিয়েছ?
হ্যাঁ আমি সেদিনই জানিয়েছি আবার গতকালও মনে করিয়ে দিয়েছি
কি বলেছিল?
বলেছিলতো আসবে
এমন সময় হারুন আসল। কি, ওরা কেও আসেনি?
তাহের বলল এলেতো দেখতেই
ওরা আসবে না
কে বলল আসবে না?
সেদিন আমি মাজেদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করছিলাম ও তখন বলল
স্বপন যদি জমি পায় তাহলে ওকে নিতে বল
কি করে নিবে? তোমরাতো সব বিক্রি করে দিয়েছ
বেশ তাই যদি হয় তাহলে আদালতে যেতে বল
আদালত তোদের তিন ভাইকে জেলে দিবে, তখন কি করবি?
জেলে দিবে কি করে, হিসেব অনুযায়ী আমরা আরও পাব
পাবি কেমন করে, তোদের কি আর কোন জমি আছে?
কেন, বাড়িটা আছে না? দোকান আছে না?
শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে নীরব হয়ে রইল।

বাড়ির দক্ষিণে যেখানে তাদের জমির আল দিয়ে হেটে আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যেত সেখানে আজ স্বপনের কোন দাবী নেই। বড় ভাইয়েরা সব বিক্রি করে দিয়েছে। যে জমির আশায় দিন গুনছে, অপেক্ষা করছে কখন চাষ দিয়ে ফসল ফলাবে। সাহানার জানা আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করবে সে জমি এখন তার কাছে চোরাবালি! অনেকক্ষণ ওই চোরাবালির দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাছেই নারকেল গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ান সাহানা স্বামীর এই অবস্থা দেখে কাছে যেয়ে ইশারা করে ভিতরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল
এত চিন্তা করছ কেন? এই বুকে তোমার জায়গা হবে না? মাথা গোজার এই বাড়িটাতো আছে। যেভাবে চলছে, যা আছে এভাবেই আমাদের চলে যাবে, দরকার হলে আমি মাস্টারি করব।

বসন্ত মেলা

শীতের শেষে বসন্ত মেলায়
এক স্বর্ণকেশীকে দেখেছি সেদিন
সাগর তীরে বালুকা বেলায়।

নীল সাগরের মুক্তা হয়ে
পায়ে পায়ে ছন্দ তুলে
সৈকত কুমারী সেজে সে
আপন মনে ঘুরে যে বেড়ায়।

প্রবাল দ্বীপের পথ চেয়ে
আচলে ঢেকে দিশা হারায়
এলো চুল বাতাসে ওড়ে
ঝিনুকের মালা জড়ানো গলায়।

অক্সফোর্ড এক্সপ্রেস

ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের ডিপারচার টার্মিনালের পাশে দাঁড়ান গ্রিন লাইনের অক্সফোর্ড এক্সপ্রেসে বসার পরে পরেই কোচটা ছেড়ে বাকিংহাম প্যালেস রোড দিয়ে বেকার স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মটর ওয়েতে যাবার আগে বেকার স্ট্রিটে থেমে যাত্রী ওঠাবে। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। সামনে পিছনে দেখে কোচের পিছন দিকে গায়ের গরম জ্যাকেটটা
পাশের হুকে ঝুলিয়ে রেখে একটা সীটে বসেছে। যাত্রী বেশি নেই। সাথের বড় লাগেজটা নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে দিয়ে দিয়েছে। হাতে ছোট একটা ব্যাগ। হাতের গ্লোভসটা খুলে ব্যাগে রেখে একটু গুছিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিংহাম প্যালেস রোড লন্ডনের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। এ পাশে হাতের বায়ে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের অ্যারাইভ্যাল এবং ডিপারচার টার্মিনাল আবার আর একটু এগিয়ে ডানে ভিক্টোরিয়া টিউব এবং রেল স্টেশন। মনে হয় লন্ডন শহরের ব্যস্ততা কোনদিন কোনও সময় কমবে না। ফুট পাথ দিয়ে নানা বর্ণের নানা দেশের মানুষ হেটে যাচ্ছে আসছে। সবাই ব্যস্ত, দেখলে মনে হবে হাঁটছে না সবাই দৌড়চ্ছে। রাস্তায় সাইকেল সহ নানা ধরনের গাড়ি যার যার গন্তব্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হাতের গ্লোভসটা রাখার সময় ব্যাগ থেকে চৌরঙ্গী বইটা বের করেছে কিন্তু এখনও খুলেনি হাতেই ধরে রেখেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। লন্ডন শহরে প্রতিক্ষণেই কিছু না কিছু ঘটে, চলার পথে অনেক কিছুই দেখা যায়, তাই দেখছে কিংবা কে জানে হয়ত অতীত ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। মটর ওয়েতে যাবার পর যখন কিছু দেখার থাকবে না তখন বইর দিকে মনোযোগ দিবে।

দেখতে দেখতে বেকার স্ট্রিটে টিউব স্টেশন ছাড়িয়ে কোচটা থামল। কয়েকজন যাত্রী উঠল, সবাই পুরুষ মানুষ। উঠে যার যার মত বসে পড়ল কিন্তু সবার পরে যে ভদ্রলোক উঠেছে সে এখনও বসতে পারেনি। হয়ত তার সুবিধা মত একটা সিট খুঁজছে। লোকটা উপমহাদেশীয়! দেখেই বোঝা যায়। পাশে দিয়ে যাবার সময় দোলার হাতে বাংলা বই দেখে এক পলের জন্য থেমে বইটা দেখল। বাঙালি! বাংলাদেশি, নাকি ইন্ডিয়ান? যেই হোক!
বসব?
বাংলা শুনে দোলা চমকে উঠল। ইনি বাঙালি! একটু সরে বসল। বসুন
গায়ের জ্যাকেট খুলে দোলার জ্যাকেটের পাশের হুকে ঝুলিয়ে রেখে বসতে বসতে বলল আমি রিজভী, ডঃ রিজভী আহমেদ
ও! আমি দোলা রায়

এই লোক নিশ্চয় বাংলাদেশের, ওর চেয়ে পাঁচ ছয় বছরের বেশি হবে। ভাল স্বাস্থ্য, পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব এবং বলিষ্ঠ চেহারা, দীর্ঘ গড়ন, চোখে চশমা, গায়ের শ্যামলা রঙের সাথে স্বাস্থ্য বেশ মানিয়েছে। রিজভী সাহেবও লক্ষ করল পরনে সার্ট প্যান্ট হলেও দেখতে সুন্দর লাগছে, বিশেষ করে মাথার চুলগুলো হাত খোপা করে বাঁধা শুধু একটা সুন্দর ক্লিপ দিয়ে আটকানো। খুবই ভাল লাগছে। শিরিনও এমনি করেই খোপা বাঁধত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দূরের জার্নি করে এসেছে হয়ত তাই চেহারা একটু বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কিন্তু তার মধ্যেও অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের লাবণ্য ছড়িয়ে রয়েছে যেন মাত্র ভোরের সূর্য উদয় হয়েছে। তার জীবন থেকে শিরিনের নাম মুছে যাবার পর আর কোন নারীর মুখের দিকে এমন সরাসরি তাকায়নি। এমনকি নিজের মায়ের দিকেও না। শিরিন তার জীবন থেকে অনেক কিছু নিয়ে গেলেও নারী জাতটার উপরে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা দিয়ে গেছে।

যার কোন চাল চুলো নেই আছে শুধু একটুখানি মেধা। মেধা দিয়ে কি হয়? মেধা দিয়ে সুখের সাজান বাড়ি তৈরি করা যায় না, গাড়ি কেনা যায় না, স্ত্রীর গা ভরে অলংকার গড়িয়ে দেয়া যায় না, মাসে মাসে নতুন দামি শারী কেনা যায় না, চার পাশে দাস দাসী রাখতে পারে না, আপন জনকেও ধরে রাখা যায় না। এমনি এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সরকারি অফিসের সামান্য এক কেরানির ছেলের জীবন থেকে শিরিনদের অনেক দিন ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের বন্ধন ছিড়ে অন্যের হাত ধরে চলে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র রিজভী আহমেদের আশেপাশে অন্তত ডজন খানিক শিরিন, ডলি, জলি, রাত্রি, নিশা, নিশিতা এমনি কতজনই ঘুরে বেড়াত, শেষ পর্যন্ত হত দরিদ্র মেধা সর্বস্ব রিজভীর সাথে কেমন করে যেন শিরিনই টিকে গিয়েছিল কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া রিজভীর হাতে শিরিনের বাবা তার মেয়ের হাত তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পাস করার পরে ইউনিভার্সিটিতেই মাস্টারি করার একটা চাকরি পেয়েছিল।

বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল কিন্তু এতদিন রিজভীর অবস্থার কথা ভেবে শিরিন সম্মতি দেয়নি। শুধু বলেছিল সময় হলে আমি বলব। এতদিন বাবাকে রিজভীর কথা কিছু বলেনি ভেবেছিল রিজভীর একটা চাকরি হলে বাবা অরাজি হবে না কিন্তু রিজভীর চাকরি হবার পর বাবাকে যখন বলল তখন বাবা রিজভীদের বাড়ি এসে নাক সিটকিয়ে চলে গিয়েছিল। এক কাপ চা খেতেও তার প্রবৃত্তি হয়নি। আর শিরিন! সেও তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনি। বাবার ব্যবসার পার্টনার সুফিয়ান সাহেবের আমেরিকা প্রবাসী ছেলে রিয়াদের হাত ধরে পারি দিয়েছে কলম্বাসের দেশ আমেরিকায়। ও দেশে নাকি সুখ শান্তি সমৃদ্ধির অভাব নেই পয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা যায়। শিরিন এখন প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে আছে। এদিকে বছর দুয়েক চাকরি করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়ে সেই যে এখানে এসেছে আর ঘরমুখো হয়নি। ইচ্ছে হয়নি, কার জন্য যাবে? বিয়ের জন্য মা বাবা উভয়েই তাগিদের পর তাগিদ দিয়ে এসেছে কিন্তু শিরিনের জায়গায় আর কাওকে স্থান দেয়ার মানসিকতা রিজভীর মনে স্থান পায়নি। নিয়মিত মা বাবাকে টাকা পাঠিয়ে দায় শেষ করতে চেয়েছে, আর কোন ভাই বা বোন কেও নেই বলে কোন পিছুটানও নেই।

ভদ্রলোক বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, লন্ডনেই থাকেন বুঝি?
না, অক্সফোর্ডে থাকি তবে আমি এখন কলকাতা থেকে আসছি
তাই নাকি? তাহলেতো আপনি খুবই ক্লান্ত, দেখেই মনে হচ্ছে। আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না আমি বরঞ্চ অন্য কোন সিটে বসি আপনি রেস্ট করুন
না না, কি বলছেন? আমি ভাবতেও পারিনি একজন বাঙ্গালির সাথে এভাবে যেতে পারব। বলুন আপনি কথা বলু্‌ন, আপনি না হলেতো আমি এই যে বলে হাতের বইটা দেখাল, জার্নি যত বড়ই হোক আমি ঘুমাতে পারি না। সেই যে কাল কলকাতা ছেড়ে আসার পর এ পর্যন্ত একটুও চোখ লাগেনি
বেশ, তাহলে বলুন কলকাতার কি খবর?
ভালই
বাড়িতে যাদের রেখে এলেন তারা কে কেমন আছে?
ভাল, সবই ভাল এখন, বাবা মা সবাই ভাল আছে। বাবার কিডনিতে পাথর হয়েছিল তাই অপারেশন করাতে আমি কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিলাম। আপনি কি বাংলাদেশের?
হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশের, আমার বাড়ি ঢাকা। অক্সফোর্ডে কোথায় থাকেন?
কুইন স্ট্রিটে, আপনি?
উইটনি। কতদিন হলো এখানে?
এইতো বছর খানিক, উইটনিতে কোথায় থাকেন?
কোথায় থাকি মানে কি আপনি চেনেন?
হ্যাঁ ওখানে আমার এক বান্ধবীর বাড়ি, মাঝে মাঝে যাই। বাসস্ট্যান্ডের পাশে যে তাজ রেস্টুরেন্ট, তার পাশেই
ও আচ্ছা, আপনার বান্ধবীর হাজব্যান্ডের নাম কি অতীশ দে আর বান্ধবীর নাম বিশাখা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি চেনেন?
চিনি মানে অতীশ আমার বন্ধু। উইটনি এই এলাকার রিটায়ার্ড ডিফেন্স অফিসারদের বসতি, অধিকাংশই এদেশের, বাঙালি খুবই কম তাই যে কয়জন আছি সবাই সবাইকে চিনি।
ও, আচ্ছা
দেখতে দেখতে কোচ M25 মটর ওয়েতে চলে এসেছে। একভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অক্সফোর্ডের রাস্তায় যাদের দেখা যায় তারা সাধারণত ছাত্র নয়ত শিক্ষক। পথে যেতে কেও পথ ভুল করে ফেললে বা চিনিতে না পারলে কাওকে জিজ্ঞেস করলে যে কথাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোনা যায় তা হচ্ছে ‘সরি আমি ভিজিটর’ বা ‘নিউ কামার’। পুরো শহরটাই বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এখানে এই ফ্যাকাল্টি, ওখানে ওই ডিপার্টমেন্ট সেখানে অমুক স্কুল এমনি। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় প্রায় হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এদেশে বিশেষ করে এই শহরে ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে বাস সার্ভিস খুবই ভাল। অনেক দূরে দূরে একেকটা বিল্ডিং। অনেক দিনের পুরনো শহর, দালান কোঠা, রাস্তা, দোকানপাট এসব দেখেই বোঝা যায়। ওয়েলিংটন স্ট্রিটে ইউনিভার্সটির মুল ভবন আর আশেপাশে ছড়ানো সব শাখা প্রশাখা।

এখানে কি করছেন?
আর্থ সাইন্স নিয়ে রিসার্চ করছি
কার সংগে আছেন?
ডঃ রিচার্ড
কোন রিচার্ড, পার্কার?
হ্যাঁ হ্যাঁ রিচার্ড পার্কার
আপনি?
কি আর করব মাস্টারি করি, ছেলেমেয়েদের বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই
ও! স্যার আপনি…………………
কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল
নো নো, নট স্যার। স্যার বলবেন না। you are not my student! এবার বলুন আপনার মিস্টার কোথায়? কি করে, সঙ্গেই আছে?
এমনিতেই বিশাল জার্নির ধকলে মুখ শুকিয়ে ছিল তারপরে আবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা যদিও কোচের ভিতরে হিটার চলছে। দোলার মুখ এই কথা শুনে আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল এমন কেও নেই।

মাথা নিচু করেই চলে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগের কলকাতায়। সেই দিন আর ফিরিয়ে আনার উপায় নেই।
কলকাতার টালি গঞ্জের অতি সাধারণ একজন স্কুল মাস্টারের মেধাবী মেয়ে দোলা কলেজে যাবার পর পাড়ার ডাক্তারি পড়ুয়া অভিজিতের কাছে পড়ত আর সেই সময়ের সাথে একটা সুক্ষ সূত্র ধরে কখন যেন উভয়ের অজান্তে একজন
আরেকজনের সাথে একান্ত নিবিড় ভাবে মিশে গিয়েছিল। চোখের ভাষা থেকে শুরু করে মান অভিমানের লেনদেন এবং একদিন না দেখার বিরহ যাতনার অনুভব সবই আঁকড়ে ধরেছিল। কিন্তু দুই জনের লেখা পড়া শেষ করে যখন অভিজিত ডাক্তারি শুরু করল তখন বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মাকে দোলার কথা জানাল কিন্তু মা নিচু ঘর এবং বাঙ্গাল বলে বিয়েতে মত দেয়নি। বাবারও একই কথা। দেখে শুনে বাবা মা অভিজিতের বিয়ে দিল কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল বছর না ঘুরতেই।

এমনি অবস্থায় দোলার মন ভেঙ্গে চুরমার হবার অবস্থা হচ্ছে জানতে পেরে প্রিয় বান্ধবী বিশাখার উদ্যোগে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দোলাকে এখানে রিসার্চ করার সুযোগ পাইয়ে দিল। এমন কি, এখানে আসার প্লেন ভাড়াটাও সেই দিয়েছিল। দোলার বিলাতে আসার সংবাদ জেনে অভিজিতের মা দোলার মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। দোলার মা অত কিছু না জেনে মেয়েকে অভিজিতের মায়ের প্রস্তাব জানাল কিন্তু মেয়ে তাতে সম্মতি দেয়নি। এত ভাল পাত্র, হোক না দোজবরে তাতে কি পুরুষ মানুষের এত খুত ধরতে নেই। বিশেষ করে তাদের মত অভাবের সংসারে অমন পাত্র যেন রাজযোটক। এই পাত্র হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে দোলার মা নানা ভাবে মেয়েকে সন্দেহ করে নানা রকম কটূক্তি করতেও দ্বিধা করেনি এমনকি এত দিনের চেনা নিজের গর্ভের শান্ত অথচ জেদী মেয়ের চরিত্রের খুঁত খুঁজে দেখতেও পিছপা হয়নি। কেন যে মেয়েকে এত পড়ালেখা শেখালাম এই ক্ষেদ তার মনে অহর্নিশ লেগেই থাকত। অসুস্থ বাবা সব কিছু দেখে শুনেও না দেখা না জানার ভাণ করেই পড়ে থাকত। এ ছাড়া রিটায়ার্ড বাবার আর কিই বা করার থাকে? মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেমন করে বাড়ি থেকে বের হতে পারে সেই চিন্তায় নানা ভাবে চেষ্টা তদবির করে বিলাতে আসার আগে টাটা কোম্পানিতে একটা চাকরি পেয়ে জামসেদপুরে চলে গিয়েছিল। বাবার পেনশনের কয়েকটা টাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মাসে মাসে টাকা পাঠাত কিন্তু কোন খোঁজ খবর নেয়ার মত ইচ্ছা হোত না।

বলেন কি! সময় হয়ে উঠেনি না কি?
দোলার ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে, আচ্ছা থাক এসব কথা, আপনি খুবই ক্লান্ত
দোলা চমকে উঠে আবার ফিরে এলো।
তার চেয়ে আপনার কথা বলুন, আমার কথা শুনতে ভাল লাগবে না তেমন কোন সুখের কথা নয়
আমার কথা আর কি বলব, আছি! খাই দাই ছেলেমেয়েদের পড়াই ব্যাস আর কি?
উইটনিতে কি আপনার নিজের বাড়ি? কে কে আছে ওখানে? মানে ছেলে মেয়ে
হ্যাঁ বাড়ি নিজেরই বটে তবে আর যা বললেন তার কিছু নেই
নেই! মানে?
নেই মানে নেই। কোনদিন ছিলও না আর হবেও না
কি আশ্চর্য, তা কেন হবে?
সে অনেক কথা। থাক এত শুনে কি হবে?
আপত্তি না থাকলে বলুন না!

শুনবেন? না আপত্তি নেই, তাহলে বলি
কেন যে রিজভী সাহেবের মত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অমায়িক, স্মার্ট এবং দুর্দান্ত প্রফেসর ঘর বাঁধেনি এ কথা নিয়ে আশেপাশে কানাঘুষা লেগেই আছে। তার কিছু যে রিজভী সাহেবের কানে যায়নি সে কথা বলার উপায় নেই কিন্তু রিজভী সাহেবের কোন মাথা ব্যাথা নেই। অনেকেরই জানার আগ্রহ থাকলেও কেও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি তবে একান্ত কাছের বা ঘনিষ্ঠ দুই একজন বাঙ্গালির স্বাভাবিক কৌতূহল নিবারণ করতে পারেনি তা বলা যাবে না। তবে জানতে চেয়েও এ যাবত কেও জানতে পারেনি। কিন্তু আজ দোলাকে দেখে তার কঠিন ব্যক্তিত্ব কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে, বরফ গলে পানি হয়ে শিশির কণার মত টলমল করছে। মনে যেন কিসের দোলা লেগেছে! মনে চেরি ফোটা বসন্ত এসেছে, ডেফোডিল, প্রিমরোজ, ব্লু বেল, টিউলিপের নানা রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে, বর্ষার প্রথম কদম ফুল ফুটেছে, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছে, জানুয়ারির স্নো মাখা নীলচে পূর্ণিমার চাদরে দেহ মন জড়িয়ে রয়েছে। কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যে কথা কাওকে কোনদিন বলা হয়নি! দোলার ‘আপত্তি না থাকলে বলুন না’ কথাটা শ্রাবণ ধারার সুরের মত মনে গুনগুন করছে।

আস্তে আস্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম দেখা শিরিনের সমস্ত কাহিনী একে একে সব খুলে বলল। জানেন, শিরিন এখন ভীষণ সুখী। ওকে সুখী করতেই আমি চেয়েছিলাম কিন্তু সে যে এভাবে সুখী হবে সে আমি কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি। আজ আর আমার কোন দায় নেই, আমি নির্ভার। কথা গুলা বলতে পেরে মনটা যেন অনেক হালকা হলো, এতদিনের সঞ্চিত কষ্টের বিষ বাষ্প বের হয়ে গেল। দারিদ্র্য জর্জরিত না পাবার বেদনা, হতাশার গ্লানি সব যেন এক নিমেষেই কোথায় কোন দূর মহাসাগরের অতলে হারিয়ে গেল। বলা শেষ হলে দোলার দিকে তাকাল। দোলা এক মনে কথা গুলা শুনছে। মনে হলো রিজভী সাহেবের বলা শেষ হয়নি তাই জিজ্ঞেস করল
তারপর?
তারপর আর কি, এইতো! আপনার সামনেই দেখতে পাচ্ছেন
কিন্তু এ ভাবে কতদিন চলবে? জীবন নদী কি কখনও একা পাড়ি দেয়া যায়? একজনে হাল ধরে আর একজনে বেয়ে চলে
যে ভাবে চলছে চলুক না, বেশ তো চলছে এই বেশ
না, তা হয় না, এ যে প্রকৃতির বিধান আমরা যে কেও এর বাইরে যেতে পারি না
তাহলে আপনি আপনার মিস্টারের কথায় অমন করে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন কেন?
সে অনেক কথা, থাক না.

না, থাকবে কেন? আমি এতক্ষণ বকবক করলাম আর আপনি চুপ করে শুনবেন তাই কি হয়? বলুন শুনি
বললামতো সে কোন সুখের কথা নয়, শুনতে ভাল লাগবে না
আচ্ছা আমি যে এতক্ষণ বললাম এ কি সুখের কথা?
মোটেই না
তাহলে? আচ্ছা প্রথম আলাপেই এত কিছু বলাবলিতে আপনি কি দ্বিধা বা কোন সংকোচ করছেন?
একটু হেসে বলল, আপনি কিন্তু নাছোড় বান্দা
দোলার হাসিটাও শিরিনের মতই মনে হলো। মধুর ক্যান্টিনে বসে বলত দেখ শিরিন আমি এত দরিদ্র ঘরে জন্মেছি যে তোমার কথা তোমাদের মত ঘরের কথা চিন্তাও করতে পারি না। তখন এমনি করেই হেসে বলত আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি, আমিতো আর কিছু চাই না!
তাই যদি মনে করেন তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি?
আচ্ছা,
বলে তার ছোট বেলা থেকে শুরু করে এখানে আসার সমস্ত কাহিনী শোনাল। বিশাখাই আমাকে এখানে নিয়ে এসে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। মটর ওয়েতে চলন্ত কোচের ইঞ্জিন এবং হিটারের একটানা গুঞ্জণের শব্দ ছাপিয়ে দোলার কণ্ঠ শোনার জন্য রিজভী সাহেব দোলার মুখের কাছে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।

ও! মনে হচ্ছে আমরা এক সাথে একই নদীতে দুই নৌকা ডুবিতে ডুবে গিয়েছিলাম আবার এক তীরেই ভেসে উঠেছি। নিয়তি আমি বিশ্বাস করি না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ যেন নিয়তির ই খেলা। নিয়তি অনেক কিছু পারে যা আমাদের ভাবনার সীমা রেখা থেকে অনেক দূরে।

কথা বলতে বলতে অক্সফোর্ড গ্লস্টার গ্রিন কোচ স্টেশনে চলে এসেছে, গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার মাইকে জানিয়ে দিল। রিজভী সাহেব পকেট থেকে তার কার্ড বের করে দোলার হাতে দিয়ে বলল তোমার ফোন নম্বরটা দিবে? কাল তোমার সাথে দেখা করব। কোচ থেকে এক সাথে নেমে দোলার লাগেজ সহ একটা টেক্সিতে তুলে দিয়ে বলল
কাল আমি না আসা পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টেই অপেক্ষা করবে?
টেক্সির সিটে বসে দোলা ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ফোন নম্বরটা লিখে রিজভী সাহেবের হাতে দিয়ে বলল
এসো, আমি তোমার অপেক্ষা করব
দোলার টেক্সি ছেড়ে দিল, টেক্সির পিছনের লাল বাতি ভিড়ে মিশে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থেকে রিজভী সাহেব আর একটা টেক্সি নিয়ে উইটনি চলে গেল।

আমার প্রকাশনা

এইতো আটলান্টিকের তীরে সেই আমি আর আমার অপকীর্তি এ যাবত যা প্রকাশ হয়েছেঃ

জীবন পথের বাকে বাকে। একজন ম্যারিনারের ডাইরি। বইমেলা ২০১২ সালে। ISBN: 978-984-90146-8-3
২০১২

মম চিত্তে নিতি নৃত্যেঃ উপন্যাস। প্রকাশক- নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, প্রকাশকাল-বইমেলা ২০১৫ সালে। ISBN: 978-984-702-074-7

ভূত ভয়ংকর। ভূতের গল্প। প্রকাশক- নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, প্রকাশ কাল- বইমেলা ২০১৫ সালে। ISBN: 978-984-702-073-0

ষড় ঋতু-ছোট গল্প। প্রকাশক- নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, প্রকাশ কাল- বইমেলা ২০১৫ সালে। ISBN: 978-984-702-072-3

নক্ষত্রের গোধূলি। উপন্যাস। প্রকাশক- নওরোজ সাহিত্য সম্ভার, প্রকাশ কাল-বইমেলা ২০১৬ সালে। ISBN: 978-984-702-091-4

সব কিছু বিলাইয়া দিলাম, আর কি দিমু?

কারাবন্দীর কান্না

একটি নদীকে ভালবেসেছি
দু’পাড়ে ছিল তার সুখের নীড়
সেই নদীর পাড়ে নীল আকাশে
নিঝুম দুপুরে গাং চিলেরা করত ভিড়।

কলসি কাঁখে সন্ধ্যা বেলা সে
শামুকের ঘুঙ্গুর বেধে পায়
জল নিতে আসতো ঘাটে
আঁচল উড়িয়ে দখিনা বায়।

সখীদের সাথে হেসে-খেলে,
দু’গালে টোল ফেলে
মুক্ত বলাকার মত চঞ্চল পায়ে
ফিরে যেত বাঁধানো তুলসী তলে।

সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে ঘরে
আঁচলে জড়িয়ে দেহলতা
প্রণাম সেরে দেবতায় নীরবে
কি বর চাইতো, জানি সে কথা।

সে ছিল আমার মানসী,
শান্ত নদীর বালুকা বেলায়
তারই সাথে বসে দু’জনে
স্বপ্ন সাগরে ভেসেছি কত স্বপ্ন ভেলায়।

চন্দন টিপে আর সিঁদুরে সেজে
শ্বেত-শুভ্র শাখা হাতে
আসবে সে ঘরে পথ খুঁজে।
ভরে দিবে আমার আঙ্গিনা,
মন মাতানো গন্ধ বিধুর ধুপে
বসন্ত বাসর ছুটে আসবে
দুয়ারে রিনিঝিনি সুরে।

মানুষের সাথে মানুষ হয়ে
ঘর বাধবো মানুষের মত
আমি আর মালতী
মুছে দিব দু,জনার বেদনা যত।

সোনালী প্রেমের বাগানে
ফুটবে নতুন কুড়ি,
বনে বাদারে ঘুরে কুড়িয়ে
আনবে ভরে ফুলের ঝুড়ি।

বসন্ত না আসিতে কাল বৈশাখী
এলো জাতের ঝড় তুলে
হিন্দু মুসলিম আর বৌদ্ধ খৃস্টানের
মিথ্যে ভেদাভেদে মানুষের জাত ভুলে।।

গাবতলি টু মহাখালী

দুইজন, দুইজন মহাখালী, মহাখালী। ডাইরেক্ট ডাইরেক্ট মহাখালী। এই যে একটু চাপেন বইতে দেন, আরে একটু ভিতরে যান না! প্যাসেঞ্জার উঠতে দেন, আরও দুইজন উঠবো। উঠেন ভাই উঠেন, সামনে যান। হ, কইলামতো ডাইরেক্ট, দশ টাকা। সামনে বাড়ান ওস্তাদ।

গাবতলি মহাখালী রুটে গত দুই তিন বছরের নিত্য দৃশ্য। জিনসের ছেড়া একটা প্যান্ট পরনে, গায়ে ময়লা এবং উপরের কয়েকটা বোতাম খোলা হাফ সার্ট, সার্টটা যে কি রঙের তা বোঝা যাচ্ছে না। সারা গায়ে গতরে নোংরা তেল কালি ধুলা মাখা লম্বাটে চেহারা, মাথায় কোঁকড়ানো ঝাঁকরা চুল কতদিন তেল সাবানের ছোঁয়া নেই কে জানে! ১৪/১৫ বছরের ছেলেটা এই কথা গুলি বলে লাফ দিয়ে গাবতলি থেকে মহাখালী চলাচলকারী টেম্পোর পিছনে পা দানিতে পা রাখল। এক হাতে টেম্পোর পিছনের একটা রড ধরা আর এক হাতে টাকা।

ছেলেটা কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেট এর পূর্ব পাশের একটা বস্তিতে মায়ের সাথে থাকে। দুই ভাই দুই বোন। ওরা সবাই ছোট। বাবাকে যতদিন দেখেছে সে স্মৃতি কোন মধুর স্মৃতি নয়। মায়ের সাথে সারাক্ষণ ক্যাচ ক্যাচ মারামারি লেগেই থাকত। রাতে তাহের মৌলবির গ্যারেজে রিকশা রেখে কালা শেখ এর আড্ডায় গাজা টেনে বাড়ি ফিরে এসেই ‘ওই খানকি মাগি ভাত দে’! এই সংলাপ ছাড়া বাবার মুখে অন্তত ওই সময় আর কোন কথা শোনেনি। এমনিতেই মা বেশ নিরীহ গোছের চুপচাপ থাকা মানুষ। এই নিরীহ মানুষটা প্রতিদিন নিয়মিত মার খেতে খেতে এখন আর নিরীহ নেই। পরিস্থিতি তাকে কিছুটা উগ্র হতে বাধ্য করেছে। কতদিন চুপ থেকে এমন মার খাওয়া যায়? গত চৌদ্দ পনের বছর ধরে এই চলে আসছে। আর কত? একবারতো পাড়া পড়শিরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। মাথায়, মুখে এবং হাতে ব্যান্ডেজ করে আধা মরা মাকে ফিরিয়ে এনেছিল। জামালও কাঁদতে কাঁদতে ওদের সাথে গিয়েছিল। একবার ডাইরিয়া হয়ে মা সারাদিনে বার চৌদ্দ বার পায়খানা আর বমি করে করে নেতিয়ে বিছানায় পড়েছিল। বিছানা আর কি! ওই ছেড়া কাঁথায় মুখ গুজে পরে থাকা। প্রতিদিনের মতই গাজার নেশায় বুদ হয়ে এসে ভাত চাইল কিন্তু মার কোন সারা শব্দ না পেয়ে ঘরে ঢুকে মাকে ওই অবস্থায় দেখেই যেন তার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। কষে এক লাথি দিয়ে বলল
কিরে খানকি ভাত চাই হুনস না?
কোন রকম মিনমিন করে মা বলেছিল, হুনছি!
হুনছস তে নবাবজাদীর মত হুইয়া রইছস কেন? ওঠ!
বলেই চুলের মুঠি ধরে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে আসছিল। তখন বার বছরের জামাল পাশেই দাঁড়ান ছিল। মায়ের এই অবস্থা দেখে নিজেকে সামাল দিতে না পেরে পাশে রাখা পাশের বাসার ভাঙ্গা চেয়ারের এক টুকরা কাঠ উঠিয়ে ওই হারামজাদা করস কি? বলেই মেরেছিল বাবার মাথায়।
ওরে বাবারে আমারে মাইরা ফলাইলরে, বলেই এক চিৎকার দিয়ে বাবা জলিল হাওলাদার পড়ে গিয়েছিল চিৎকার শুনে বস্তির লোকজন ছুটে এসে ভিন্ন চিত্র দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে গিয়েছিল। জামালকে জিজ্ঞেস করল
কি হইছেরে?

বলেই কয়েকজন জলিল হাওলাদারের মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হল আবার কয়েকজন বিশেষ করে মহিলারা জামালের মা আর জামালকে ঘিরে ধরল
দিছি আইজকা, জন্মের সাধ মিটাইয়া দিছি হারামজাদারে!
কথাটা বলেই সকলকে শুনিয়ে বলল।
আপনেরা হুনেন, আইজ থিকা আমি আর বাবার লগে থাকুম না। আমি মায়েরে আর ভাই বইনগো নিয়া চইলা যামু
কনে যাবি?
আইজ রাইতে রহিম দাদার বাড়ি থাইকা কাইল একটা বাসা ভাড়া নিমু
বস্তির মালিক রহিম শেখ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। তার নাম শুনে সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল
তুই যে আমার হেনে যাবি পরে তর বাপের লগে হাঙ্গামা করব কেরা?
কোন হাঙ্গামা করন লাগব না দাদা, আপনে আমাগো এই রাইতটা খালি জাগা দেন আমরা কাইলই অন্য কুন হানে চইলা যামু
নারে ভাই আমি কি কামে তগো এই ঝামেলায় জরামু?
দাদা, আপনে কি রোজকার কিসসা হুনেন না? রোজ আমাগো এইনে কি অয় জানেন না? আপনের মইধ্যে কি একটুও মায়া দয়া নাই? একটা রাইতের জইন্যে জাগা দিবেন না?
এতটুক ছেলের মুখে এই কথা শুনে রহিম সেখ কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল। প্রতিবেশীরাও দুই একজনে অনুরোধ করল এই হাবিয়া দোজগের মইদ্ধ্যে থাহার চাইতে না থাহাই ভাল। চাচা আপনে ওগো একটু জাগা দেন জালাইল্য কিছু কইলে দিবেন লাত্থি। বাজার আনবি না, চাইল কিনবি না খালি খাওন দেও! খাওয়ান আহে কইত্থিকা? গাঞ্জা টাইনা আইলেই খাওয়ান পাওয়া যায়? সারাডা দিন বেডির অবস্থা কাহিল আর এর মইদ্ধ্যেই মাইর! অহন পোলা বড় হইছে! বুঝ অহন, কেমন ঠ্যালা। শয়তানের হাড্ডি কুনহানকার!

রহিম শেখ বলল
তোমরা যহন কইতেছ তাইলেতো জাগা দেওন লাগবই, আইচ্ছা জামাইল্য চল তর মায়েরে নিয়া চল আমাগো বারান্দায় থাকবি। আয় আমি তর দাদিরে কইগা।
রহিম শেখ চলে গেল আর তার পিছনে জামাল তার মাকে উঠিয়ে ধরে ভিড়ের মধ্যে থাকা ছোট ভাই বোনদের নিয়ে তার পিছনে পিছনে চলল।
নুর বানু ছেলেকে আঁকড়ে ধরে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল
ও পুত তুই যে আইলি খাবি কি? থাকবি কনে? ঘর ভাড়া দিবি কেমনে?
মা যে কি কও! মনে অয় আমরা রোজ গোস পোলাও খাই আর এহন কিছু পামু না! তুমি চিন্তা কইর না মা, খালেক ওস্তাদ হের টেম্পোতে আমারে কাম দিব কইছে।
টেম্পোর কাম করবি! কি কাম?
হেলপারের কাম
তুই পারবি?
কি যে কও মা
হেই কবে থিকা আমি ওস্তাদের লগে যাই না? তুমি যে আমারে বিচরাইয়া পাওনা আমি কই যাই জান?
কই যাস?
ওইতো, ওস্তাদের লগে যাইতাম। কেমনে কি করে তাই দেখতাম। অহন আমি সব পারি। প্যাসেঞ্জার ডাহা, ভাড়া উঠান তারপরে ওস্তাদরে সিগন্যাল দেওয়া, সব পারি ওস্তাদ কইছে।

রহিম শেখের বারান্দায় সেদিনের মত রাত কাটিয়ে সকালে পাশেই একটা ঘর খালি পেয়ে ওতেই উঠে যেতে চাইল কিন্তু দাদি কিছুতেই যেতে দিতে চাইল না।
আহারে এই অসুইখ্যা মাইয়াডা কই যাইব? যাওনের কাম নাই তরা আমাগো বারান্দার ওই ধারে যে ঘরডা আছে ওই হানে থাক কুন ট্যাহা পয়সা দেওন লাগব না।
সেদিন থেকেই রহিম শেখের টিনের বারান্দার সাথের ঘরে জামাল তার মা এবং ভাই বোনদের নিয়ে থাকা শুরু করল। নিয়ম করে প্রতিদিন সকাল বেলা সূর্য ওঠার আগে এক মুঠ পান্তা খেয়ে মায়ের আচলে মুখ মুছে বের হয়, রাত দশটা এগারটা বাজলে দুই হাতে বাজার নিয়ে ফিরে আসে। চাউল, ডাল, ডিম, সবজি বা কোনদিন অত রাতে যদি বাজারে থাকে তাহলে একটু গুঁড়া মাছ। দুপুরে ওস্তাদের সাথে বাইরেই খেয়ে নেয়। একদিন রাতে খাবার সময় মা বলল
রুশনীর মা হাউজিঙে সাহেবগো বাড়ি কাম করে, তিন বেলা খাওন দেয় আবার দুই হাজার টাকা মাইনা দেয়, আমারে কইছে করুমনি? আমি তর লগে কথা কইয়া তারপরে কমু কইছি। তুই কি কস?
বলেই ছেলের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
না মা তোমার শরীরের যে অবস্থা তাতে কাম করন লাগব না, আমাগো আর কিছু লাগব না।
মাস গেলে অত গুলা ট্যাহা কি কম? তুই না করস কেন?
না মা, তুমার কামের বেটি হওনের দরকার নাই। আমরা কি তুমারে কোনদিন মায়ের মত কইরা পাইছি কও? তুমি অগো দেখবা, রাইন্ধা বাইরা খাওয়াইবা এইতেই আমাগো হইব। তুমি আমাগো মা হইয়াই থাকো।
এমনে কয় দিন চলব? তুই একলা কত করবি?
এইতো মা ফরিদ আর একটু বড় হইলেই ওরে কোন এক জাগায় লাগাইয়া দিমু
মা অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। কি ভেবে আর কথা বাড়াল না।

খালেক মিয়া জামালের সব ইতিহাস জানে বলে ওকে বেশ একটু আদর যত্ন করে। কোন ভুল বা বোকামি নিরবে সয্য করে নেয়, সামান্য একটু বকাঝকা দিয়েই শেষ করে ফেলে। দেখতে দেখতে দুই তিন বছর কেটে গেল। নুর বানুর সংসার ভালই চলছে। ওদিকে জামালও ভাল হেলপার হয়ে উঠেছে। এখন মাঝে মাঝেই টেম্পো নিয়ে এদিক ওদিক সরিয়ে রাখতে পারে। টেম্পো রেখে ওস্তাদ খেতে বসেছে তো এমন সময়ে কোন গাড়ি এসে হর্ণ দিলে খালেক মিয়া বলে যাতো জামাল গাড়িটা একটু সামনে আগাইয়া রাইখা আয়।
সব ভালর কি শেষ থাকে? কিছু কিছু ভাল ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। বিশেষ করে এমন হত দরিদ্রের ভাল কি কোনদিন স্থায়ী হয়, সুখের হয়? সব ভাল গুলা যে শুধু ভালর পাশেই থাকতে চায়! সুখ গুলা শুধু সুখের পাশে সুখীর পাশেই থাকতে চায়। গোলাপ যেমন ফুলদানি ছাড়া আস্তা কুড়ে মানায় না তেমনি অভাগার দিকেও সুখ কখনও ফিরে তাকায় না।

মাঝ রাত থেকেই বৃষ্টি। বস্তির পাশে পানি জমে গেছে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর ভীষণ আলসেমিতে পেয়ে বসল। উঠতে ইচ্ছা করছে না। মা ডাকল কিন্তু জামালের কোন সারা নেই। মা এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখল জ্বর টর হয়েছে কি না। আবার ডাকল কিরে মানিক উঠবি না? কত বেলা হইল তর ওস্তাদ গাড়ি নিয়া বইয়া রইছে। ওঠ। পেটের তাগিদে, ক্ষুধার তাগিদে জামালকে উঠতেই হবে। ওস্তাদের গাড়ি কি আর বইসা থাকব? ও না গেলে ওস্তাদ বোরহানরে ডাইকা নিয়া যাইব। তার মানে আইজ আর খাওয়ানের জন্যে কিছু নিয়া আইতে পারব না। এ কথা মনে আসার সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে পরল।
মা আমি গেলাম
ওস্তাদের বাড়ি এসে দেখে ওস্তাদ গাড়ি বের করে ফেলেছে।
কিরে নবাবজাদা আইজ এত দেরি করলি?

জামাল কিছু বলল না, চুপ করে থাকাই নিরাপদ। গালাগালি যাই করুক রাইতে ফেরার সময় হাতে দুইশ টাকা গুজে দেয়। কোনদিন দুই একটা ট্রিপ বেশি হলে বা রাস্তায় একটু বেশি ভিড় হলে আরও একশ টাকা দিয়ে দেয়। মন ভাল থাকলে কোনদিন গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বাজারে গেলে ওকেও সাথে নিয়ে যায়। নিজের বাজার করে ওখান থেকে ওকেও কিছু দিয়ে দেয়। সেদিনও একটা পাঙ্গাশ মাছ আর কিছু বেগুন কিনে দিয়েছিল। ওস্তাদের সাথে বেয়াদবি করতে নেই। যা বলে বলুক। দোষতো সে নিজেই করেছে! এজন্যে একটু বকাবকি শুনতে পারবে না? বাবা যেমনে মাকে মারত তেমন করে মারে না। মারলেই বা কি করত? তাওতো সইতে হতো! কোন কথা না বলে চুপচাপ একটা কন্টেইনারে গাড়ির জন্য পানি ভরে সিটের নিচে রেখে ন্যাকরা দিয়ে গাড়িটা মুছে বলল
চলেন ওস্তাদ।
মহাখালী, মহাখালী। ওঠেন ফার্স্ট ট্রিপ, ওঠেন। আর একজন। শ্যামলী, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী আর একজন। ওস্তাদ ডাকল। কাছে এসে জানালা দিয়ে ওস্তাদের দিকে তাকাল।
কিরে সীট ভরছে?
না ওস্তাদ একটা খালি আছে
ডাক দে
ডাইরেক্ট মহাখালী, মহাখালী, শ্যামলী, জাহাঙ্গীর গেট একজন একজন
এই আমাকে রাওয়া ক্লাবের সামনে ব্রিজের এ পাড়ে নামিয়ে দিবে।
আচ্ছা দিমুনে।
সীট ভরে গেল। টেম্পোর ছাদে দুইটা টোকা দিয়ে, আগে বাড়ান ওস্তাদ।

শ্যামলী পার হয়ে ডাইনে পঙ্গু হাসপাতাল রেখে রোকেয়া সরণি দিয়ে এসে এয়ারপোর্ট রোডে পরল। সামনে জাহাঙ্গীর গেট। একটু জ্যামে গাড়ি দাঁড়াল। দেন ভাই আপনেগো ভাড়াডা দিয়া দেন।
মহিলা মাথা নিচু করে বলল এই সামনে নামব
হ হ মনে আছে নামাইয়া দিমুনে, ভাড়াডা দেন
জ্যাম ছুটে গেল। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে।
রাওয়া ক্লাবের সামনে এসে ছাদে এক টোকা দিয়ে বলল ওস্তাদ বায়ে রাখেন মহিলা নামব
আস্তে করে টেম্পো বায়ে চেপে থেমে গেল। মহিলা যাত্রী নামল কিন্তু তার ভাড়া এখনও দেয়নি। নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাতের পার্স খুলে টাকা বের করতে বেশ একটু দেরি হলো আর এই ফাকে সকাল বেলা ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি দাড় করিয়ে রাখা সম্ভব না বলে ওস্তাদ একটু একটু করে ডাইনে চেপে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সে মনে করেছে জামাল উঠেপড়েছে। জামাল ভাড়া নিয়ে দৌড়ে টেম্পোর কাছে চলে এসেছে হ্যান্ডেল ধরে লাফ দেয়ার আগেই, পিছন থেকে একটা ল্যান্ড রোভার এসে ধাক্কা দিল। সঙ্গে সঙ্গে সামনে ছিটকে পড়ে গেল, হাতের টাকাগুলা বাতাসে ছড়িয়ে গেল সেই সাথে শুধু একটা চিৎকারের শব্দ হলো। এই সাত সকালে এমন ব্যস্ত রাস্তায় কে কার খবর রাখে! ল্যান্ড রোভারটা যে গতিতে আসছিল সেই গতিতেই চট করে ডাইনে চেপে খালেকের টেম্পোর পাশ কাটিয়ে চলে গেল। খালেক জানতেও পারল না এই গাড়িটা কি করে গেল তার জামালের কি হয়েছে? জামাল পড়ে যাবার পরেই ল্যান্ড রোভারের পিছনে যে কার আসছিল সে এগিয়ে এসে সামনের রাস্তায় মানুষ পড়ে রয়েছে দেখে কড়া ব্রেক করল।

ব্রেকের শব্দে বাম পাড়ে ব্রিজের নিচে দাঁড়ান কয়েকজন পথচারী দৌড়ে কাছে এসে দুই একজন জামালকে রাস্তার পাশে ফুটপাথে এনে দেখে নাক মুখ কান দিয়ে রক্ত ঝরছে, হৃৎপিন্ডে কোন স্পন্দন নেই আর বাকিরা ওই গাড়ির নিরীহ ড্রাইভারকে বের করে মারপিট শুরু করল। হঠাৎ এই জটলা দেখে রাস্তার ওপাড়ে মোটর বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সার্জেন্ট এসে এম্বুলেন্স খবর দিল এবং যে গাড়িটা মানুষ দেখে মানবিক কারণে দাঁড়িয়েছিলো তার নামে মামলা ঠুকে দিল। জামাল কোন ভিআইপি নয় বলে তার খবর সংবাদ পত্রেও এলো না বা কেও জানতেও পারল না। ওদিকে খালেক মিয়া স্ট্যান্ডে গাড়ি থামিয়ে জামালকে খুঁজে না পেয়ে অবাক হলো। কি ব্যাপার? এইতো, ব্রিজের ওপাশে প্যাসেঞ্জার নামাল! গেল কোথায়? তবে কি ওখান থেকে গাড়িতে উঠতে পারেনি? ভেবে পিছনে এগিয়ে এসে দেখে যেখানে ও শেষবার থেমেছিল তার পাশে জটলা এবং পুলিশের গাড়ি থেমে আছে। ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দেখে জামালের রক্তাক্ত দেহ পড়ে রয়েছে। রাস্তায় চলাচল এবং রাস্তায় কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের হেলপার পরিচয় না দিয়ে বলল এরে আমি চিনি আমার বাসার লগেই এগো বাসা, এর নাম জামাল।

ভালবাসা

সুপ্রিয় ভাই ও বোনেরা,
আস সালামু আলাইকুম, কে কেমন আছেন? স্নিগ্ধ শরতের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে আনন্দ সুখের ভেলা। আপনজনকে সাথে নিয়ে শুনছেন অদৃশ্য কোন সেতারে মধুর সুর, তাই না? এইতো জীবন পথের ভেলা, এই ভেলায় চরে পাড়ি দিতে হবে দূরের সেই চেনা জগতের অচেনা ভুবনে।
আমারও ভীষণ ভাল লাগছে পরিবারের সাথে এই দিনগুলি কাটাতে। ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাটের এই অসহনীয় জ্যাম ডিঙ্গিয়ে সারা দিনের ক্লান্তির পরে বাড়ি ফিরে এসেই স্ত্রী সন্তানের মুখ দেখে সব ক্লান্তি ভুলে বলি আমি তোমাদের কতো ভালবাসি, সারা ইনের ক্লান্তি মুছে গেল। ছট মেয়ে এক গ্লাস পানি এনে দিল তারপরে গিন্নি কিছু হালকা নাস্তা আর তার সাথে এক কাপ গরম চা, আহ! প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। আপনারা কে কিভাবে দিন কাটান তাই নিয়ে আসুন আড্ডা দেই।
সু স্বাগতম সবাইকে, যারা বিগত ঈদে বাড়ি গিয়েছিলেন আপন জনের সাথে মিলিত হতে। আপন জন, আত্মীয় স্বজন, পারা পড়শি, বন্ধু বান্ধব, হিতাকাঙ্ক্ষী শুভাকাঙ্ক্ষী সবার সাথে দেখা করেছেন? একান্ত জনকে কি বলেছেন আমি তোমাকে ভালবাসি কিংবা I love you? কিংবা আমি তোমাকে/তোকে কত আদর করি, কত মায়া তোর জন্য, সব সময় তোর কথা আমার মনে হয় কিংবা মা তোমার মত মা এই জগতে আর নেই, তুমি সত্যিই খুব ভাল মা, আমি তোমাকে কতো ভালবাসি মা। মনে করতে পারেন স্ত্রী কিংবা স্বামীকে জীবনে কয়বার বলেছেন আমি তোমাকে ভালবাসি? যদি বলে থাকেন তাহলে ভাল কথা। আর যদি নিতান্ত আনন্দের আতিশয্যে বা ভুলে বা লজ্জায় বা শুধুমাত্র তাচ্ছিল্য করে না বলে থাকেন তাহলে আজই ফোন করে বা নিতান্ত একটা sms করে বলে দিন। “আমি তোমাকে ভালবাসি”। আমাদের জীবন পথের জন্য অন্যান্য যে সব কথা নিত্য বলে থাকি সে তুলনায় খুবই ছোট্ট একটা কথা কিন্তু এর আবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তিন শব্দের কথা কয়টি বদলে দিতে পারে আপনার আমার সাথে এই পৃথিবীর সম্পর্কের ধরন এবং গতি প্রকৃতি।
ইংরেজি ভাষায় যেমন তিনটি যাদু শব্দ রয়েছে প্লিজ, এক্সকিউজ মি এবং সরি তেমনি এই বাক্যটিতে ও একটু যাদু রয়েছে। ইংরেজরা ওই তিনটি জাদু খুবই সম্মানের সাথে মেনে চলে আমি নিজ চোখে দেখেছি। আমরাও কি পারিনা তেমনি করে এই সামান্য কয়টি শব্দ প্রিয়জনকে বলতে। আমি আমার স্ত্রী সন্তানদের প্রায় প্রতিদিনই এই কথাটি বলি। এমনকি জেনে অবাক হবেন যে আমি সন্তানদের সামনেও স্ত্রীকে এই কথাটা বলি এমনকি আমার নাতি রিজভান রিহানকেও শিখিয়েছি I love you, তোমাকে ভাল বাসি। যেখানে স্বার্থের কোন বালাই নেই যেখানে ভালবাসা অর্থের মাপে মাপা যায় না সেখানে এই কয়েকটি শব্দের মূল্য অনেক অনেক অনেক। এই সুখের স্মৃতি ধরে রাখতে আমাদের ভালবাসা গুলি বিলিয়ে দেই চারিদিকে ছোট বড়, চেনা অচেনা, জানা অজানা সবার জন্য।

আবার নতুন করে শুরু করি বিদ্বেষ, হিংসা, মোহ আর আক্রোশ থেকে বেরিয়ে আসার নতুন এক প্রযুক্তি যার নাম ভালবাসার যাদু।
আসুন আজ থেকে আমরা আবার নতুন করে ভালবাসার প্রকল্প হাতে নিই। আমাদের ভালবাসার নীরব আর অদৃশ্য সৌধ রেখে যাই আমাদের উত্তর পুরুষের জন্য, শূন্যতার অভিশাপ মুছে রেখে যাই আগামীর জন্য। আগামী যেন দাঁড়াতে পারে তার নিজ মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে। আমাদের জীবনের ব্রত হোক সবাইকে হাসিমুখে ভালবাসা, এবং তাকে জানতে দেয়া যে, আমি তোমাকে ভালবাসি।
ধন্যবাদ সবাইকে

বিষাদ নূপুর

আকাশের ঘনঘটা দেখে বাজে
কার বুকে এমন করুন সুর?
চাঁদের হাসি মুছে গিয়ে
জোছনা হলো কেন দূর?

কলঙ্ক সাগরে ডুবে কে অবেলায়
রেখেছে বেধে অন্তঃপুরে বেদনা হৃদয় ভেলায়
আঁধার ঘনালে মেঘে ঢেকে
বিরহ ভোল ডাকে যেন ময়ূর।

নিশি ঝড় থামলে পরে বনের ধারে
জেগে থাকে না কেহ মৌন বিরহ পাড়ে
ছিন্ন সুতায় বাঁধা জীর্ণ বসন্ত
ভেঙ্গেছে কার এই স্বপন মধুর।

স্বপ্ন তরী

ও কাজল কাল রাত তুমি
বল আমার কৃষ্ণ বরণ সখীরে
ইশারায় সে কেন ডাকে না আর আমাকে।

তার চন্দন টিপে জ্বলে সন্ধ্যাতারা
আমার ডাকে দেয় না আর সারা
ভুলিতে কেন পারি না কেন আর তাকে।

সে যে এমন সখী, বলব কি তার কথা
কখনও সে আমায় ডেকে বলে না আর সখা।

নিশীথে সে ফুলের সাথে কথা বলে চুপি চুপি
নীল যমুনা আছে তার আঁখি জলে
জানি না কেমন করে মনের কথা বলি তাকে।

সংকট

বিরহ বিরাগ জড়িত
শ্যাম সুন্দর মোহিত,
সুরভিত সখী সেই অন্তর
পরশে সরস হয় মরু প্রান্তর।

জানিনা আমার একি হলো জ্বালা
পথ চেয়ে বসে থাকি হাতে নিয়ে মালা।
জানি আমি বলে কি লোকে
তবু না দেখিলে মরি শোকে,
লুকাই আমি কোথায় দে না তুই বলে
ছল করে সে যে মুখ ঢাকে আঁচলে।

লতিকা যে রাঙ্গা হয় লাজে
এ প্রণয় কি আমার সাজে,
ইঙ্গিতে বোঝাব তাকে কি বলে
কেন সে আমায় এ বাঁধনে জড়ালে।

শিম্পাঞ্জির দেশে

রাস্তার দুই পাশে যতদূর দৃষ্টি যায় লাইন ধরে সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর, এলো মেলো ভাবে কোন বাড়ি নেই। অধিকাংশই সিরামিক ইটের রঙের মত দেয়াল, উপরে লাল টালির দোচালা ছাদ। প্রতিটা বাড়ির সামনে সুন্দর করে কাঠের জাফরি করা বেড়া আর তার ভিতরে চমৎকার সব ফুলের গাছে ফুল ফুটে আছে। রাসেল শুধু একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করল যে সব বাড়ি এক তলা, কোথাও কোন দোতলা বা এক তলার বেশি উঁচু কোন বাড়ি নেই। সব বাড়ির সুন্দর রঙ করা দরজা জানালা খোলা কিন্তু কোথাও কোন জন প্রাণীর সারা শব্দ নেই। প্রতিটা বাড়ির পিছনেই নানান ফল গাছে ফল ঝুলছে। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট সুন্দর ফুলের গাছে নানা রঙ বেরঙের ফুল ফুটে রয়েছে প্রজাপতি আর মৌমাছিরা উড়ে উড়ে এক ফুল থেকে আর এক ফুলের মধু নিচ্ছে। এমনি নির্জন ছিমছাম রাস্তায় একা একা হাটতে হাটতে গ্রাম ছেড়ে বেশ অনেক দূরে চলে এসেছে যেখানে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। শুরু হয়েছে নানা ফসল এবং শাক সবজির জমি। টমাটো, কলা, গম, ভুট্টা, গাজর, বিট, ফুল কফি, বাঁধা কফি, লেটুস এমনি নানা কিছু সহ অচেনা নানা ফসল বেশ ফলে রয়েছে কিন্তু এখানেও কোন জন প্রাণী নেই। যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে আর একটু একটু করে এগুচ্ছে। সামনে ডান পাশের ভুট্টা ক্ষেত ছাড়িয়ে যেতেই দেখল বেশ বড় সাইজের কয়েকটা কাল শিম্পাঞ্জি একটা টমাটো ক্ষেত থেকে ঝাঁকায় করে টমাটো তুলছে। একটু দূরে দূরে এমনি আরও অনেক শিম্পাঞ্জি বিভিন্ন ক্ষেতে কাজ করছে। রাসেল অবাক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল। এ কি দেখছি! নিজের চোখে দেখছে তবুও নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হলো। এও কি সম্ভব? কোন মানুষ নেই শুধু শিম্পাঞ্জি এই জমিতে কাজ করছে? অবাক হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। পা আর সরতে চাইছে না। একটু ভয়ও পেল।

এমনি সময় এক শিম্পাঞ্জি ঝাঁকা নিয়ে এপাশে ঘুরতেই রাসেলকে দেখল। ওকে দেখে ঝাঁকাটা নামিয়ে রেখে ওর কাছে এসে মানুষের মত জিজ্ঞেস করল
কি দেখছেন?
রাসেলের মুখ দিয়ে কথা আসছে না। দিশাহারা। কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় মানুষ সমান লম্বা লেজ ওয়ালা একটা শিম্পাঞ্জি যদি এই ভাবে সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের মত কথা বলে তাহলে কে না অবাক হয়? ঝাঁকা নামিয়ে চার হাত পায়ে এদিকে এগিয়ে এসেছে কিন্তু এখন মানুষের মত দুই পায়ে দাঁড়ান।
শিম্পাঞ্জিটা এবার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
এতক্ষণে রাসেল সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, ভাল আছি কিন্তু…………
কিন্তু বলেই থেমে গেল। আর কিছু বলতে পারছে না।
তাই লক্ষ করে শিম্পাঞ্জিটা বলল
আপনি অবাক হয়েছেন তাই না? আমাদের দেখে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই তো?
হ্যাঁ তাই, কিন্তু………………
আবার থেমে গেল।
এর মধ্যে ওদের কথার শব্দ পেয়ে অন্য যারা কাজ করছিল তারা সবাই ফিরে দেখল কি হচ্ছে।
আরে সাহেব এটা আপনাদের মানুষের দেশ নয় এটা আমাদের শিম্পাঞ্জিদের দেশ। এখানে আমরাই বাস করি। আমাদের পূর্ব পুরুষ আপনাদের দেশেই ছিল কিন্তু আপনাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, না খেতে পেয়ে এই দেশে এসে বসতি করেছে। আমরা তাদের বংশধর। আমার নাম কিলা, ভয় পেয়েছেন?
আমতা আমতা করে বলল, না না ভয়ের কি!
না ভয় পাবেন না। আমরা জাতে শিম্পাঞ্জি হলেও আমরা আপনাদের চেয়ে অনেক সভ্য। চলেন আমার বাড়িতে চলেন দেখবেন আমরা কেমন সভ্য।
বাড়িতে যাব?
হ্যাঁ অতিথিকে কি আর রাস্তায় ফেলে চলে যাওয়া যায়? আপনি একটু অপেক্ষা করেন সন্ধ্যা হলেই দেখবেন সবাই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে তখন আপনাকে নিয়ে যাব। ওদের দিকে ঘুরে বলল এই তোমরা কাজ কর অতিথির সাথে পরে আলাপ হবে।
বসেন এই ঘাসের উপরেই বসি।
বলেই শিম্পাঞ্জিটা রাসেলের হাত ধরে টেনে বসে পড়ল।

এবার বলুনতো এতক্ষণে আমাদের দেশ যতটা দেখলেন তাতে আপনার কাছে কেমন লাগল?
রাসেল এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল
খুব ভাল লাগছে, এমন সুন্দর এলাকা আমি আগে কখনও দেখিনি।
হ্যাঁ, চলেন আমাদের বাড়ি চলেন ওখানে গেলে আরও ভাল লাগবে।
আচ্ছা আপনারা কি কি চাষ করেন?
আমরা বানরেরা যা খেতে পারি আমরা তাই চাষ করি, আমরাতো আর আপনাদের দেশে যেতে পারি না যে ওখান থেকে কিনে আনব তাই আমাদের প্রয়োজনীয় খাবার নিজেদেরই করে নিতে হয়। এইতো চার দিকে যা দেখছেন এই সবই করি, কখনও তরমুজ, চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, আখ তবে ধানের চাষ করি না আর দেখেছেনতো আমাদের বাড়িতে নানা ফলের গাছ আছে আমাদের এই এলাকায় সব রকমের ফল পাবেন কারণ আমরাতো ফল আর সবজি খাই তাই। মাঝে মাঝে কেও কেও গম আর ভুট্টার চাষ করে কারণ মাঝে মাঝে রুটি পরটা খেতে ইচ্ছা করেতো! আমরাতো আবার মাছ মাংস ডিম খাই না।
বেশ ভাল কথা!
আচ্ছা আপনার নামটা কিন্তু এখনও বলেননি!
ও হ্যাঁ আমার নাম রাসেল।
বাহ!, বেশ সুন্দর নাম!
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। যারা বিভিন্ন জমিতে কাজ করছিল তারা সবাই কাজ শেষে যার যার জিনিস পত্র গুটিয়ে আল ধরে বড় রাস্তায় চলে এলো। এবার যার যার বাড়িতে যাবে। কিলার শিম্পাঞ্জিরাও এসে রাস্তায় দাঁড়াল আর কিলা বলল, চল বাড়ি যাই। আসেন রাসেল সাহেব বাড়ি যাই। টমাটোর ঝাঁকা মাথায় করে ওরা কিলাকে অনুসরণ করছে, রাসেলও কিলার পাশে পাশে হাঁটছে। অল্প কিছুক্ষণ হেঁটেই আগের দেখা ওই আবাসিক এলাকায় এসে ডান দিকের একটা গলিতে ঢুকে বাম হাতের প্রথম বাড়িটাই কিলার।
ঘরে ঢুকে রাসেলকে বসার ঘরে বসতে বলে কিলা ভিতরে চলে গেল। সুন্দর সাজান গোছান ঘর তবে ঘরে কোন আসবাব নেই শুধু ভুট্টার পাতা দিয়ে বোনা পুরু সুন্দর গালিচা বিছান। ওতেই বসে পড়ল। একটু পরেই কিলা আর তার পিছনে কিলার স্ত্রী এবং দুই বাচ্চা আসল। কিলার স্ত্রীর হাতে ছোট ট্রেতে একটা বড় গ্লাসে শরবতের মত কি মনে হলো। রাসেলের দিকে বাড়িয়ে বলল নেন শরবত খান। কিলা পরিচয় করিয়ে দিল। এই আমার স্ত্রী যুঁই আর এরা আমার ভবিষ্যৎ তারা আর টুকি। এ হচ্ছে রাসেল। যুঁই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড সেক করে বলল
আপনি বসুন আমি আসছি।

রাসেল ভয়ে ভয়ে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দেখল দারুণ শরবত। এক চুমুকেই শেষ করে ফেলল।
তাই দেখে কিলা বলল, আর একটু খাবেন?
না না অনেক খেয়েছি
একটু পরে যুঁই একটা সুন্দর নক্সা করা বড় ট্রেতে করে নানা রকম ফল কেটে সাজিয়ে এনে সামনে নামিয়ে রাখল। কিছু চেনা ফল আর বাকি সবই অচেনা। মাঝ খানে ট্রে রেখে চারদিকে গোল হয়ে বসে সবাই এক সাথে ফল খাচ্ছে আর আলাপ করছে। ভীষণ সুস্বাদু ফল।
তারপর বলুন রাসেল সাহেব আপনাদের দেশের কি অবস্থা?
এই চলছে আর কি, কোন ভাবে দিন চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের কথা আর কি বলব আপনাদের এখানকার কথা বলেন শুনি আমার কাছে খুব ভাল লাগছে।
চলেন তাহলে আমার প্রতিবেশীদের সাথে আপনার আলাপ করিয়ে দেই
হ্যাঁ তাহলে ভালই হয়, চলেন
তারা আর টুকি দুইজনে লাফ দিয়ে বাবা মার কাঁধে উঠে বসল। কিলা আর যুঁই অতিথিকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে রাস্তার পাশে আর এক বাড়িতে যেয়ে দেখে ওই বাড়ির সামনের বাগানে কয়েকজন শিম্পাঞ্জি বাঁশের চেয়ারে বসে গল্প করছে।
এই যে মিশা, টাকি, ইগু তোমরা দেখি এখানেই আছ, বেশ হয়েছে দেখ আমাদের এখানে নতুন অতিথি এসেছে তার সাথে আলাপ করিয়ে দেই। ওরা কিলার সাথে একজন মানুষ দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড সেক করে বসতে বলল।
কেমন আছেন অতিথি?
ভাল ভাল বেশ ভাল
আপনারা সবাই ভাল আছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ আমরাও খুব ভাল আছি, বলেন ভাই আমাদের দেশ কেমন লাগছে?
খুউব ভাল লাগছে। যতই দেখছি ততই ভাল লাগছে আর তার সাথে অবাক হচ্ছি। আসলে আপনাদের সম্পর্কে আমার আরও অনেক জানতে ইচ্ছে করছে, কিছু বলুন না ভাই

মিশা বলল কি আর বলব! আমাদের এখানে আপনাদের মত না। আমি ছোট বেলায় বাবার সাথে আপনাদের দেশে গিয়েছিলাম সেখানে ভয়ংকর অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। দেখেছেন আমাদের রাস্তা ঘাট কেমন? আমাদের বাড়ির আশে পাশে দেখেন কেমন সুন্দর সাজান গোছান। এমনকি পথে একটা কাগজের টুকরোও খুঁজে পাবেন না পলিথিনতো দূরের কথা। তারপরে আমাদের জমিগুলাও লক্ষ করেছেন, এখানে কেও কারো জমির আল কাটে না। আমাদের সব কিছুই নিয়মের মধ্যে থাকে কিছুই নিয়মের বাইরে যায় না। আমরা সবাই এই নিয়ম মেনে চলি। ছোটরা কেউ এদিক ওদিক করলে সাথে সাথে বাবা মা বা প্রতিবেশী যেই সামনে থাকে সেই দেখিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয়।
মিশা থামলে টাকি বলতে শুরু করল
এখানে কেউ কারো গায়ে হাত দেয় না, কেউ নিয়ম ভাঙ্গে না। মারামারি, কাটাকাটি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, খুন খারাবি, অন্যায় অবিচার, লুটপাট, চুরি ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ, ঘুষ দুর্নীতি এসব আমাদের এখানে কেও জানেই না।
বাহ! বেশ সুন্দর কথা! আরও বলুন
হ্যাঁ বলছি, আমরা প্রতিবেশীরা প্রতি সপ্তাহে এক এক দিন এক এক বাড়িতে পার্টি করি।
মানে, বুঝলাম না
এবারে ইগু বলল
মানে হলো প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল বারে আমরা কোন কাজ করি না সেদিন সবাই নিজের বাড়ি ঘর, বাগান, পাশের রাস্তা এগুলি পরিষ্কার করি। আগে থেকেই ঠিক করা থাকে কবে কার বাড়িতে এই পার্টি হবে সেদিন সন্ধ্যা হলে সবাই ওই বাড়িতে চলে যাই। সবার সাথে গল্প হয়, কার ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে এগুলি দেখে বিয়ে শাদীর জন্য পাত্র পাত্রী নির্বাচন করা হয়। তবে ছেলে মেয়েদের কারো কোন পছন্দ অপছন্দ থাকলে আমরা তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এলাকার সমস্যা নিয়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত হয় আনন্দ হয়, হৈ চৈ হয়, খাওয়া দাওয়া হয় তারপর আমরা সবাই এক সাথে সৃষ্টি কর্তার প্রার্থনা করি এবং প্রার্থনা শেষ করে রাত হলে আগামী মঙ্গল বারে কার বাড়িতে যাব সেটাও ওই সময় সবাইকে জানিয়ে দিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে এসে ঘুমিয়ে পরি।
বাহ! দারুণ!
আমাদের আরও কিছু নিয়ম আছে
সেগুলি আবার কেমন?
আমাদের বাচ্চাদের স্কুলে কোন শিক্ষক নেই
তাহলে কে পড়ায়?
আমরা পালা করে বাচ্চাদের স্কুলে পড়াই, প্রতি মাসে একটা শিডিউল করে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয় সেই অনুযায়ী ক্লাসে চলে যাই। ওই যে দেখুন ওটাই আমাদের স্কুল। স্কুল থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আমাদের হাসপাতাল, বাজার এবং অনেক কিছু আছে। আজকে থাকুন কাল আমাদের ছুটির দিন সব দেখিয়ে আনব আবার বিকেলে আমাদের সাথে পার্টিতেও নিয়ে যাব কাল আমার বাড়িতে পার্টি হবে।
আপনার বাড়ি কোথায়?
ওই স্কুলের পাশে।

আচ্ছা, তখন দেখলাম সব বাড়ির দরজা জানালা খোলা কিন্তু কোন প্রাণী দেখলাম না এর মানে কি?
কিলা প্রচণ্ড অট্টহাসি হেসে বলল কি করে দেখবেন বলুন সবাই যে কাজে গিয়েছিল।
তা এই খোলা পথে যদি কেও ঢুকে পরে?
কে আসবে? বলল না এখানে কেও অমন কিছু জানেই না। আর তা ছাড়া আমাদেরতো আর আপনাদের মত রান্না করতে হয় না কাজেই বাড়ির মহিলারাও জমিতেই কাজ করে সাথে বাচ্চাদেরও নিয়ে যায় না হলে ওরা শিখবে কি করে?
আপনাদের এখানে কোর্ট কাচারি নেই? পুলিশ, সেনা বাহিনী?
মিশা বলল, আরে ভাই এতক্ষণ বললাম কি! আমাদের এখানে কেও কোন অপরাধই করে না কেও জানেই না অপরাধ কি, তো কোর্ট কাচারি থাকার দরকারটা কি? আর পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কথা বলছেন, হ্যাঁ সেনাবাহিনী আছে তবে সেটা শুধু আমাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য যাতে করে বাইরে থেকে কেও এসে কোন হাঙ্গামা করতে না পারে তবে আপনাদের মত কোন পুলিশ নেই। আমাদের সেনা বাহিনীর লোকেরা শুধু আমাদের দেশের সীমানা পাহারা দেয় ওদের আর কোন কাজ নেই।
বাহ! কি সুন্দর দেশ! রাসেল বলল ঈশ আমিও যদি আপনাদের মত শিম্পাঞ্জি হয়ে এই দেশে আসতে পারতাম!
এমন সময় রাসেল শুনল মা ডাকছে কিরে রাসেল অফিসে যাবি না? আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ!

সুরের খেয়া

নিঝুম নীল সাগর তীরে
এলোমেলো ঢেউ আসে ধীরে ধীরে
তোমার গানে সুরের খেয়া বেয়ে।

নীলিমার নিচে এ গান
যদি শুনতে চায় শান্ত সাগর
বলব তাকে না না শুন না
এ গান শুধু আমারই
বেধে রেখেছে অনুরাগ দিয়ে।

ওই নীলাঞ্চল উড়িয়ে
দখিণা চৈতি হাওয়ায়
জড়ালে আপন খেয়ালে
হৃদয় বীণার ঝঙ্কারে
ভালবেসে তুমি আনমনে।

আমি ঢাকা মহানগরী


১৮৭২ সালে ঢাকা কলেজ

বর্তমান ঢাকা কলেজ

এই যে আজকে আপনারা বসবাস করছেন আমার বুকে এই আমি ঢাকা মহানগরী। এক সময় কিন্তু আমি এত বড় ছিলাম না। নবাবদের আমলে মাত্র কয়েকজন নবাব বাড়ির নায়েব, গোমস্তা আর খানসামারা এখানে বসবাস করত এবং তাদের সেবা যত্নের জন্য কামার, কুমার, নাপিত ধোপা, স্বর্ণকার, তাঁতি, গোয়ালা, ময়রা এমনি যাদের প্রয়োজন তেমনি কয়েক ঘর জনবসতি ছিল। সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় চারশো পঞ্চাশ বছর হবে। আমার চারিদিকে ছিল খাল বিল নদী নালা এমনি সব কিছু, হ্যাঁ হ্যাঁ, ধান ক্ষেতও ছিল। ওই যে বুড়িগঙ্গা নদী, সে যে কি সুন্দর নদী ছিল তা বলার নেই। নবাব বাড়ির আশপাশ থেকে এসে রাজহাঁস গুলি যখন নদীর বুকে সাতার কাটত কি সুন্দর ছিল সে দৃশ্য। পানসী নৌকা, নবাবদের বজরা ছোপাত ছোপাত বৈঠা তুলে বেয়ে যেত সে দৃশ্য ছিল দেখার মত। এগুলি আবার কখনও পাল তুলে যেত তখন আরও বেশি সুন্দর লাগত, নানা রঙ বেরঙের পাল দেখতে যে কি সুন্দর ছিল তা আর বলার নয়। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কতজনে এই দৃশ্য দেখত! বজরা বা পানসী থেকে ঘাটে নেমে বেশিরভাগই যেত ঘোরার গাড়ি করে। সাধারণ মানুষেরা যেত এক্কা গাড়ি করে। গরুর গাড়িও ছিল আবার হাতে টানা রিকশাও ছিল অনেক।

নবাব বাড়ির মেয়েরা তাতি বাজারে গয়না বানাতে যেত, তারা বেশির ভাগই আসত ঘোরার গাড়িতে চেপে। অল্প কিছু পাকা রাস্তা ছিল। নবাব বাড়ির সৈন্যরা যখন ওই পাকা রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে যেত ভারি সুন্দর লাগত। লোকজনে চেয়ে দেখত তাদের। সবারই একরকম পোষাক, এক রকম তরবারি হাতে, মাথায় এক রকম পাগড়ী। সন্ধ্যার পরে রাস্তার পাশে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে দিত। সে সব দিন ছিল সুখের দিন শান্তির দিন। মানুষ কত ভাবেই যে উৎসব করত যেমন শবে বরাত, রমজান এবং তারপরে ঈদ, দুর্গা পূজা, কালি পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা। এ ছাড়া বার মাসে তের পাবন লেগেই ছিল। নবান্ন উৎসব, বৈশাখী উৎসব, বসন্ত উৎসব, নৌকা বাইচ এমনি কত কি! সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে লোক জনেরা আমার বুকের উপর দিয়ে হেটে বেড়াত বাচ্চারা কত খেলাধুলা করত! কি আনন্দ ছিল! দেশের নানা জায়গা থেকে নৌকা করে কত মালামাল লোকজন আসত যেত। সদরঘাটে সবসময় হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকত।

একদিন দেখলাম কোথায় থেকে ফিরিঙ্গী না কি যেন বলে তারা এসে হাজির। ইংরেজিতে ট্যাঁস টুস করে কথা বলত। আস্তে আস্তে তাদের অনেক লোকজন এসে আমার বুকে ডেরা বাধতে শুরু করল। সে যে কি ভয়ংকর দিন গেছে সে কথা মনে হলে আজও আমার বুক কেপে উঠে। দেশের মানুষ যারা ওদের কথামত চাষ বাস কাজ কর্ম করত না তাদের ধরে এনে চাবুক দিয়ে যে কি মারাই মারত সে সব চাবুক দেখলেও ভয় হতো। শুরু হলো রক্তের বন্যা, এত রক্ত আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এইতো শুরু হলো অত্যাচার। তবে ওই ফিরিঙ্গীরা কিছু ভাল কাজ করেছিল। আমার উপর দিয়ে বেশ কিছু রাস্তা বানিয়েছিল, স্কুল কলেজ বানিয়েছিল। ওদের দেখাদেখি অভিজাত এবং ধনী পরিবারের লোকজনেরা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও বানিয়েছিল। তারপরের ইতিহাস বড়ই করুণ। যখন তাদের অত্যাচার চরমে পৌঁছল তখন এদেশের যুবকেরা একে একে জেগে উঠল। অনেক চোরাগোপ্তা আক্রমণ, শাস্তি আরও কত কি হলো! অনেক দিন পরে দেখলাম ওই ব্যটা ফিরিঙ্গীরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু ওরা পালালে কি হবে ওদের জায়গায় যারা এলো তারা আরও ভয়ংকর। পাঞ্জাবী না কি যেন বলত। কেমন করে কথা বলত। একদিন শুনলাম আমাদের এখান থেকে ওরা সমস্ত সম্পদ নিয়ে অনেক দূরে নাকি ওদের দেশ সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে ওরা আবার এক হুকুম জারি করল, কেও বাংলায় কথা বলতে পারবে না। আচ্ছা বলুনতো, বাংলায় কথা বলা যাবে না এটা আবার কেমন কথা? জন্ম থেকে যে ভাষায় কথা বলে আসছে সেই কথা কি ইচ্ছে করলেই বন্ধ করা যায়? এইতো শুরু হলো এক যুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ত তারা সহ সকল ছাত্র ছাত্রী মিলে এর প্রতিবাদ করল আর ফলাফল যা হবার তাই হলো। পাঞ্জাবীরা নির্বিচারে গুলি শুরু করল। কতজন মারা গেল। বয়ে গেল রক্ত স্রোত। তাদের কথা মনে রাখার জন্য শহীদ মিনার হলো। আজও তাদের কথা কেও ভুলেনি আর কোনদিন ভুলবেও না। তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। সবই হয়েছে আমার বুকের উপরে। এমনি করে নানা অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন শেখ মজিবর রহমান দল সংগঠন করা শুরু করল। ক্রমে সে যখন শক্তিমান হলো তখন একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিল আর অমনিই সারা দেশবাসী তার আহবানে সারা দিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। যুবকেরা ট্রেনিঙের জন্য চলে গেল পাশের দেশে। ওদিকে ওই পাঞ্জাবীরা শুরু করল বাঙালি নিধন অভিযান।

আমার উপরে ছাত্র ছাত্রীদের যত হল হোস্টেল, পুলিশ নিবাস ছিল সে গুলিসহ পথে ঘাটে শুরু করল ট্যাংক মেশিন গান দিয়ে গুলি করা। কত মানুষ যে মরল তার কোন হিসাব নেই। অনুমান করে বলছি, কয়েক লক্ষতো হবেই। যারা সুযোগ পেল তারা আমার আশ্রয় ছেড়ে চলে গেল, যার যেখানে সুবিধা। সেদিন আমার যে কি কান্না পেয়েছিল! কিন্তু আমি কাওকে কিছু বলতে পারিনি। আমিই তাদের বলে দিলাম তোমরা যে যেখানে পার চলে যাও। আমি আর তোমাদের বুকে আগলে রাখতে পারছি না, আমার উপরে হায়েনার আসর হয়েছে। আমি নিজেই বিপদগ্রস্ত। কয়েকদিন আগে থেকেই ওদের সেনা দলে আমার বুক ভারি করে ফেলেছে। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পাপে ভরা। ওরা যেমন খুশি তেমনি চলা ফেরা করছে। আমার বুকে বয়ে যাচ্ছে রক্ত নদী। যাকে খুশি তাকে মারছে সম্পদ লুটে নিচ্ছে কেও দেখার নেই কেউ প্রতিবাদ করার নেই। সকল বিদেশীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করে দিল। সংবাদ সংগ্রহের জন্যে কেও আসতে পারেনি। আমার বুকে বাস করে আমার আলো বাতাস জল নিয়ে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের কিছু অমানুষ আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ওই পাঞ্জাবীদের সাথে হাত মেলাল। আহ! কত অনাচার অবিচার জুলুমই যে ওরা করেছে তা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারা শহর আতংকে ছিল। যখন তখন গোলাগুলি হয়েছে, তখন এক বিভীষিকাময় দিন গেছে। কোন ভাবে কাজকর্ম সেরেই মানুষ ঘরে ফিরে এসেছে। কাজে বের হবার পর বাড়ির মানুষ ভাবতেও পারেনি সে আবার সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে।

এভাবেই চলে গেল নয়টা মাস। একদিন পাশের দেশ থেকে সৈন্য এলো আর তাদের কাছে এখানে যারা অত্যাচার করছিল তাদের প্রধান আত্মসমর্পণ করল। এই দেশ স্বাধীন হলো। আমার ইতিহাসের আর এক অধ্যায় শুরু হলো। আমার বুকে বসে কত পরিকল্পনা হয়েছে, কত আলাপ আলোচনা হয়েছে, কত আশা উদ্দীপনা হয়েছে তা মনে হলে আজ মনটা ভরে যায়। শুরু হলো আমার বুকে আর এক খেলা। আমার বুকে নতুন বড় বড় রাস্তা ঘাট তৈরি হলো, কত সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় ভরে গেল। গন ভবন হলো, বঙ্গ ভবন হলো, সংসদ ভবন হলো। এমনি আকাশ ছোঁয়া কত দালান হলো। আমাকে এদেশের রাজধানী বানানো হলো। আমাকে মহানগরীর মর্যাদা দেয়া হলো। একটুখানি জায়গার কত দাম হলো, আমার আকার পরিধি কত বেড়ে গেল। কয়েক হাজার থেকে এখন আমার বুকে এক কোটি মানুষ বসবাস করছে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। কত রঙ বেরঙের গাড়ি চলছে। গাড়ি চাপা পড়ে কত মানুষ প্রতিদিন মরছে কে তার হিসাব রাখে আর কেই বা তার বিচার করে? গাড়িতে গাড়িতে আমার সমস্ত রাস্তা ভরে আছে। শুধু গাড়িতে পা দিয়ে দিয়ে যাত্রা বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে বসে থাকে। কাজের কত ক্ষতি হয় কত তেল গ্যাসের অপচয় হয় কেও দেখে না। রাজা মহারাজারা এদিক ওদিক যাবার সময় শহর বাসির সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পথে বসিয়ে রেখে কত আনন্দ পায়। দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে দেখছি যেই আমার বুকে আসে সেই হনুমান হয়ে যায়। আমার মনে কোন শান্তি পাচ্ছি না। কেও আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। কত মিছিল দেখেছি, কতি শ্লোগান শুনছি, ভিন্ন মিছিলের ভিন্ন ভিন্ন শ্লোগান। হরেক রকম ভাষা, হরেক রকম উদ্দেশ্য, কত কি যে হচ্ছে! এতদিন ভিন দেশিরা এখানে অন্যায় অনাচার করেছে এখন শুরু হয়েছে নিজেদের অনাচার। এত অনাচার আমি কি করে সহ্য করি? জনসাধারণের সংসদ ভবনে বসে যাকে তাকে অশ্রাব্য গালাগালি করছে। জুতা ছোড়া ছুরি করছে! ছি! ছি! কি লজ্জা!

আমার বুকের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যেয়ে কত পাপ করছে। বিধাতা এই পাপ কেমনে সইবে ভেবে অস্থির হই। মানুষ খুন করা, ধর্ষণ করাতো এখন মামুলি ব্যাপার এতে আর এখন আমি আঁতকে উঠি না। কত বিচিত্র ভাবে নৃশংস উপায়ে মানুষ খুন করছে, গুম করছে। আহা! তাদের পরিবারের কি আহাজারি! সে আর আমি সইতে পারছি না! মানুষ এত নৃশংস এত জঘন্য পিশাচ কি করে হয় ভেবে পাই না। শুনেছি বনের হিংস্র পশুরাও নাকি এমন হয় না। মেয়েরা যে ভাবে চলাফেরা করে তাতে আমার ভারি লজ্জা লাগে, আমি ওদের দিকে তাকাতে পারি না। পুরুষেরা সন্ধ্যার পর ওত পেতে থাকে কখন মেয়েরা আসবে! দেহ ব্যবসা করার জন্য কত বড় বড় লোকেরা তাদের মাইনে দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখে আবার ওদিকে মঞ্চে উঠে দামি দামি মন ভেজানো কথা বলে। যে সব মেয়েরা স্বাধীন ভাবে এই ব্যবসা করে তারা এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে না তারা অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেয়।

কত জন্ম হয়েছে কত মৃত্যু হয়েছে এই আমার বুকে। এক দিকে আনন্দ হাসি উচ্ছ্বাস আবার আর এক দিকে শোক কান্না। প্রতিদিন কত লঞ্চ, জাহাজ, বাস, কোচ, প্লেন ছেড়ে যায় আবার কত আসে কেও তার হিসেব জানে না। আমার বুকে একটু আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে কত মানুষ আসছে, রোজগারের জন্য একটু ভাল থাকার জন্য। রাস্তার ফুটপাথে মানুষ গিজগিজ করে, কিন্তু আমি সবার মনের আশা পূরণ করতে পারছি না। রাস্তায় কত বাস চলে কিন্তু তবুও মানুষের ভিড় কমে না। এত মানুষ কেন আসে? মানুষের লোভ লালসা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, কেও আর অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মানুষের অভিলাষ এত উঁচু কেন হলো?

চকচকে কর্পোরেট কালচার নামে বৈধ উপায়ে নির্লজ্জের মত লোক ঠকাবার, কর্মচারীদের ঠকাবার জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা আমদানি হয়েছে। শ্রমিক কর্মচারীদের ঠকিয়ে, এ ওকে ঠকিয়ে ফাকি দিয়ে মেরে কেটে কতজনে শত শত কোটি টাকা জমা করছে, টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। ব্যাংকও সে টাকা রাখার জায়গা পায় না অথচ আমার বুকেই কত শিশুকে দেখি খাবার না পেয়ে আস্তা কুড়ে খাবার খুঁজছে। কতজনে ফ্রান্স থেকে পানি এনে পান করে আবার কতজন রাস্তার ফুটপাথে রাত কাটায়। এত টাকা দিয়ে কি করবে ওরা? এই উন্নয়নশীল দেশে এত চাকচিক্যের কি এমন প্রয়োজন আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিনে দিনে আমার দুর্নাম ছড়িয়ে যাচ্ছে! কি লজ্জা! আমি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহর! কিন্তু কারা আমাকে নোংরা করছে? আমাকে নোংরা করে তারা কেমন করে ভাল থাকছে?

যারা আইন রক্ষা করবে তারাই আজ আইনের তোয়াক্কা না করে জঘন্য অপরাধে, পাপ কাজে, অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়েছে। কেও তাদের বিচার করছে না। সবাই শুধু নিজের কথা, নিজের ক্ষমতা-লোভের কথা ভাবছে। আমার বুকে বসেই ওই পাঞ্জাবী ইয়াহিয়া খান বলেছিল আমি ইস্ট পাকিস্তানের মানুষ চাই না শুধু মাটি চাই। এখনও সেই রূপ দেখছি, যারা শাসন করছে তাদের এমন মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।
আসলে আমার কোন পরিবর্তন হয়নি আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি শুধু পাপের প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়েছে, পাপের পথ পরিবর্তন হয়েছে এবং পাপের ওজন ভারি হচ্ছে। মানুষের আমোদ প্রমোদের ধরণ বদলে গেছে। সেদিন দেখলাম কয়েকজন বন্ধু সারাদিন কাজ কর্ম সেরে রাতে ক্লাবে মিলিত হয়ে ইচ্ছে মত মদ পান করে সবাই যার যার গাড়ির চাবি টেবিলের উপরে রাখল এবং এক এক করে চোখ বন্ধ করে সামনে রাখা চাবি থেকে একটা চাবি তুলে নিল, যার হাতে যে চাবি আসল সে রাতের জন্য সে ওই গাড়ি যার তার বাড়িতে যেয়ে তার স্ত্রীর সাথে রাত কাঁটালো। এমন বিকৃত মানসিকতা এবং বিকৃত রুচি আমার বুকে আগে কখনও দেখিনি।
আমার ভীষণ ভয় করে! মাঝে মাঝে লজ্জায় ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার বুকে নিরীহ সাধারণ মানুষ যারা বাস করে তাদের কি হবে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। আমি আর পারছি না বিধাতা! আমাকে রক্ষা কর! আর কত পাপ আমাকে দেখতে হবে? হে বিধাতা তুমি কোথায়? আমাকে রক্ষা কর! মানুষের মনে শান্তি দাও!