মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

সাগরিকা

ওই দূর নীল সাগরে
খোলা এই আকাশে
ঝিরি ঝিরি বাতাসে
এ মন হারাতে চায়
কোন সুদূরে।

বুঝি আকাশ হারিয়ে গেল
নীল সাগরের কোলে
যেখানে গান গেয়ে যায়
সারি সারি গাং চিলে
দুপুরের রোদে নিঝুম সুরে সুরে।

মনে মনে কে যেন এঁকেছিল
সাদা মেঘের আলপনা
অনুভবে ছিল বুঝি
স্বপ্নে পাওয়া কল্পনা।

ওই শান্ত অশান্ত ঢেউ
করে শুধু কানাকানি
এলোমেলো হাওয়ায় ভেসে
স্বপ্ন করে জানাজানি
এ গানের নিমন্ত্রণে হৃদয় ভরে।

৪০ বছর পুর্তি

অবাক হবারই কথা! যেখানে দুপুরে যা খেয়েছি তা আর রাতে খেতে ইচ্ছা করেনা। সেই আমি একই জেলর এর অধীনে একই কারাগারে কি করে ৪০টি বছর (১৯৭৮-২০১৮) কাটিয়ে দিলাম! এ এক মস্ত আশ্চর্যের বিষয়, এও কি বিশ্বাস হয়?
আবার আমার মা বলেছিলেন এই দিনেই আমি পৃথিবীর আলো বাতাসে এসেছিলাম।

উপরের এই ভদ্রমহিলার কারাগারে আমি সুদীর্ঘ ৪০ট বছর ধরে বন্দী জীবন যাপন করছি। আমি একজন সহজ সরল সুবোধ বালক। জীবনে কোন অপরাধ করিনি তাই কিছুতেই ভাবতে পারছিনা কেন আমার এই শাস্তি। কেও কোনদিন কোন জামিনের চেষ্টাও করেনি বলে কোন জামিন পাইনি। কোন ছুটি বা অবসর বলতে এই কারাগারে কোন সুবিধা পাইনি। তবে ভাগ্য গুনে মজার মজার খাবার যখন যা চেয়েছি তা অঢেল পেয়েছি, এদিক দিয়ে তিনি কোন কৃপণতা করেননি। আবার কত মান-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট, রাগ-বিরাগ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, নিরাপদ আশ্রয় এমনি অনেক কিছু বোনাস পেয়েছি। সাথে আরও অনেক কিছু পেয়েছি যেমন, মায়া মমতা, ভালবাসা এমনি কত কী। এই কারা জীবনেই আমার জেলর ম্যাডাম আমাকে তিনট রাজকন্যা উপহার দিয়েছেন।

এই কারাগারের একটা বিষেষ সুবিধা আছে, এখানে আমি একাই ছিলাম, কপাটটা ছিল দারুন মজবুত তাই আর কেও ঢুকতে পারেনি।

প্রিয় বন্ধুগন, আরও কত কী বলার আছে কিন্তু এই মুহুর্তে মনে আসছেনা পরে মনে পরলে জানাব, দয়া করে অপেক্ষায় থাকুন।

ফরিদ সাহেবের রোজনামচা

ফরিদ সাহেব এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। এতদিন সরকারি চাকরি করে ক্লান্ত হয়ে হাত পায়ে যখন নানা উপসর্গ যেমন গিরায় গিরায় ব্যথা, মাজায় ব্যথা দেখা দিচ্ছিল তখন একেবারে সময় মত এলপিআরের অফিস অর্ডার পেল। বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণে সাগর উপকূল ছাড়িয়ে সুন্দরবনের ধারে মংলায় সুন্দর মনোরম পরিবেশে জীবনের অনেকগুলি বছর কাটিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দোতলার বারান্দায় বসে বাসার বাম দিকে মংলা নালা আর পশ্চিমে একটু দূরে পশুর নদী এবং সামনে একটু ডানে সুন্দরবনের অবারিত সবুজ সেই সাথে পাখপাখালির কিচিরমিচির শুনে শুনে সুখেই কাটিয়ে দিয়েছে দিনগুলি। অবসর পেয়ে পৈত্রিক বাড়ি ঢাকায় এসে ঢাকা শহরের অন্ধ গলির পাশে বন্ধ অন্ধকার বাড়িতে হাঁপিয়ে উঠছিল। এতদিন যখন ঊর্ধ্বতন কর্তার নানা রকমের হুকুম তামিল করা, সরকারি নানা ধরনের কাজকর্ম দেখাশুনা করা এবং অধস্তনদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে তা নিরসনের জন্য জটিল ভাবনায় ব্যস্ত থাকত সেখানে এখন সারাদিন শুয়ে বসে শুধু শুধু গায়ে গতরের ওজন আর সর্বাঙ্গের ব্যথা বাড়ান ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এমনি এক সময় মেঝ মেয়ে একদিন মা বাবা আর বোনদের ডেকে বেশ আনন্দের সাথে জানাল তার একটা চাকরি হয়েছে। ভাল পদ, ভাল বেতন তবে থাকতে হবে একেবারে প্রত্যন্ত এক উপজেলায়।

বাহ! বেশ ভাল কথা!
হ্যাঁ আব্বু আমিও এমনি একটা চাকরি খুজছিলাম। এখানে বছর দুয়েকের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলে আমার পরের ডিগ্রিটা নেয়া হবে। ওতে প্র্যাকটিকাল এক্সপেরিয়ান্সের দরকার।
বেশ ভাল হয়েছে, তাহলে জয়েন করে ফেল। জয়েন করার লাস্ট ডেট কবে?
এইতো সামনের ১৭ তারিখ কিন্তু তোমরা আমার সাথে যাবে না?
তোমরা কারা?
মা আর তুমি!
হ্যাঁ যাব। আমরা গিয়ে তোমার থাকা রান্না খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসবইতো
না শুধু দিয়ে আসলেই হবে না, আমার সাথে ওখানে থাকতে হবে
থাকতে হবে? বল কি! এই দুই বছর ওখানে থাকতে হবে?
এখানেই বা কি করবে? এখানে তোমার কি কাজ?
ফরিদ সাহেব ভেবে দেখল মন্দ কি? এখানে বসে বসে হাড়ে ঘাস গজাবার সময় হয়ে গেছে
কিন্তু বাবা তোমার মা না হয় তোমার রান্না বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু আমি কি করব? আমার সময় কি করে কাটবে ওই অজ গ্রামে?
তুমি চিন্তা করোনা আব্বু আমি তোমার জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিব
কি ব্যবস্থা করবে, কোথায়?
আহা আগে চলইনা তখন দেখব কি করা যায়!
বেশ চল।

সুনামগঞ্জের আগাম টিকেট করা হলো। সুনামগঞ্জে নেমে আবার পাশের এক উপজেলায় যেতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা যা সাথে নেয়া দরকার বা কোচে যেতে যা যা নেয়া যায় সেগুলি বাঁধাছাঁদা করে শুভক্ষণে শুভ লগ্নে রওয়ানা হলো। বিকেলে সুনামগঞ্জ পৌঁছে আবার একটা সিএনজি নিয়ে চাকরীস্থলে পৌঁছল। প্রথমেই থাকার জন্য একটা হোটেলে আশ্রয় নিয়ে বের হলো খাবার সন্ধানে। আশেপাশে বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট দেখে একটায় ঢুকে পরল। খাবার পাট সেরে এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখার জন্য রিকশায় উঠে বসল। চারদিকে হাওরে থৈ থৈ পানি, দূরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় ছায়া ছায়া দেখা যায়। বেশ সুন্দর এলাকা। ছোট্ট উপজেলা শহর ঘুরে আসতে বেশিক্ষণ লাগল না।
পরদিন কাগজপত্র নিয়ে জয়েন করার জন্য মাঝু অফিসে চলে গেল। জয়েন করে অফিসের বস আর কলিগদের সাথে আলাপ পরিচয় হলো। সবাই জানতে চাইল কোথায় উঠেছেন?
হোটেলের নাম বলতে সবাই চিনতে পারল। সাথে মা বাবা এসেছে জেনে সবাই অবাক হলো।
বলেন কি আপনি কি একই মেয়ে?
না না আমার বড় আর ছোট দুই বোন আছে ঢাকার বাড়িতে।
ও তাহলে আপনি বুঝি বাবা মার খুব প্রিয় মেয়ে?
তা একেবারে অস্বীকার করা যাবে না তবে বাবা রিটায়ার্ড মানুষ তাই মা বাবাকে নিয়েই এসেছি তাছাড়া বাবা মা আমাদের তিন বোনকেই খুব স্নেহ করেন। কখনও কোথাও একা থাকিনি তাই একা আসতে দিতে রাজি হয়নি। ওনারা না এলে আমার এখানে জয়েন করা হতো না।
বেশ ভাল কথা। তাহলে এখন আপনার জন্য একটা ভাল বাসা খুঁজতে হয়।
বস সবাইকে ডেকে মেয়ের জন্য একটা বাসা দেখতে বলে দিল। একজন বলল
আপা কাছেই একটা সুন্দর বাসা আছে চলেন বিকেলে যেয়ে দেখবেন। কাছেই, আপনি হেটে অফিসে আসতে পারবেন।
হ্যাঁ যাব, সাথে আব্বু আম্মুকেও নিয়ে যাব।
বিকেলে অফিস সেরে মেয়ে তার এক কলিগকে সাথে নিয়ে হোটেলে উপস্থিত। পরিচয়ের পালা শেষ করে বলল
চল, আব্বু আম্মু দুইজনেই চল মনির ভাই একটা বাসা দেখাতে নিয়ে যাবে। কাছেই, হেটেই যেতে পারব।
চল।

বাসা দেখে খুবই ভাল লাগল। এত তাড়াতাড়ি এমন জায়গায় মেয়ের অফিসের এত কাছে এত সুন্দর বাসা পাবে ভাবতেই পারেনি। তিন রুম, বারান্দা, দুই টয়লেট তাতে আবার টাইলস বসান। উপজেলা শহরে এমন বাসা! চমৎকার! ঢাকার তুলনায় ভাড়া এত কম যে ভাবাই যায় না! তবে সমস্যা হলো এখানে রান্নার গ্যাস নেই। অবশ্য লাকড়ি দিয়ে রান্নার জন্য খুবই সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। বেশ বড়সড় রান্না ঘর আর তার এক পাশে টেবিল সমান উঁচুতে দুইটা লাকড়ির চুলা, উপরে এক্সাস্ট ফ্যান আর লাইটের ব্যবস্থা রয়েছে, চুলার নিচে আবার বেশ কিছু লাকড়ি রাখা যায়। ওরা সবাই এমন ব্যবস্থা দেখে অবাক হলো। এর আগে কোথাও এমন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। বাসায় ঢুকতে রাস্তার মুখে পাশেই আবার এলপি গ্যাসের বোতলের দোকানও দেখেছে একটা। মনির সাহেব জানাল এখানে রান্নার লাকড়ির দাম বেশ সস্তা। লাকড়িতেই রান্না বান্না হবে তবে জরুরী কাজের জন্য একটা সিলিন্ডার রাখলেই হবে। ব্যাস আর কি! বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে আলাপ সেরে পাকা কথা হয়ে গেল। ঢাকার মত কোন অগ্রিম দেয়ার ঝামেলা নেই। আগামী কাল ধোয়া মুছা করে তার পরেরদিন বাসায় উঠবে এমন কথা হলো। যথা সময়ে হোটেল ছেড়ে বাসায় এসে উঠল। এবারে ছুটল হাড়ি পাতিল, রান্নার আয়োজন, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেনাকাটা করতে। বাল্ব, ফ্যান, বাসন পেয়ালা, চামচ খুন্তি, রুটি বানাবার বেলন পিড়ি, দাও বটি, তোষক জাজিম বালিশ মশারি কম কিছুতো লাগে না! ছোট শহর বলে হাতের কাছেই সব পাওয়া যায়। একটা নিয়ে এসেই শুনে আর একটা আনতে হবে। আবার ছুটল। আবার ছুটল। আবার ছুটল। এবারে মোটামুটি থাকার মত একটু ব্যবস্থা হলো। মাঝুর মা ডাল, আলু ভর্তা ভাত রান্না করল। আস্তে আস্তে খাট, ডাইনিং টেবিল চেয়ার ফ্রিজ সহ আরও অনেক টুকি টাকি কেনা হচ্ছে একে একে। প্রায় প্রতিদিনই তিন চারবার করে মাঝুর বাবাকে বাজারে যেতে হচ্ছে। কাছে বলে হেঁটেই যায় আবার হেঁটেই আসে। তবে মাঝুর বাবা ফরিদ সাহেব মাছ কিনতে পারেননা বলে দেখে শুনে মাছ কেনার জন্য মাঝুর মা তার সাথে যায়। এখানে এসে এত সব কিছু সুবিধা হলে কি হবে হাউজ এসিস্ট্যান্ট বা কাজের মানুষ সখিনা কিংবা আবদুল কাওকে পাওয়া যাচ্ছে না মোটেই।

এদিকে ফরিদ সাহেব এখানে আসার আগে যেমন করে ভেবেছিলেন ওখানে যেয়ে আমার সময় কাটাব কি করে! আসলে দেখা যাচ্ছে কোথা দিয়ে যে তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছে তা টেরই পাচ্ছেন না। যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই মাঝুর মা মধুর কণ্ঠে আবদার করেন: শোন আমিতো আটা মাখাচ্ছি তুমি একটু সিংকের বাসন পেয়ালা গুলি ধুয়ে দাও না!
বেশ ধুয়ে দিচ্ছি। এই নাও তোমার সিংক খালি করে দিলাম।
বাহ! বেশ কাজ করেছ এবার এক কাজ করতে পারবে?
কি কাজ?
যা গরম পরেছে রান্না ঘরে মোটেই টিকতে পারছি না ওদিকে মাঝুর অফিসে যাবার সময় হয়ে এলো তুমি রুটি গুলি বেলে দাও আমি সেঁকে নিচ্ছি।
আচ্ছা দাও আমিই বেলে দিচ্ছি
এই ভাবে কেউ রুটি বেলে! এ তো বাংলাদেশের মানচিত্র বানিয়েছ! সারা জীবন ভরে কি শিখেছ? কিচ্ছু শিখলে না! রুটিও বেলতে পার না!
বাংলাদেশের মানচিত্র রুটি বেলা এবং সেঁকা হয়ে গেল। ফরিদ সাহেব এসে একটু বারান্দায় দাঁড়াল। বাইরে ডোবার পরে রাস্তা। রাস্তা দিয়ে বাস, লেগুনা সিলেট সুনামগঞ্জে যাচ্ছে আসছে তাই দেখছে। এর মধ্য এবার আর এক আবদার রেডি। রান্না ঘর থেকে মধুর ডাক ভেসে এলো, তুমি কোথায়? শুনছ এদিকে একটু আস না!
ওমনিই ফরিদ সাহেব এসে হাজির।
বল কি জন্য ডেকেছ
পেঁপে ভাজি করেছি এবার ডিম ভাজতে হবে, মাঝুতো পোচ খায় না ওর জন্যে একটা ডিম ভেজে দিই কি বল!
দাও, এজন্যে আবার আমাকে ডাকছ কেন?
একটু মিষ্টি হেসে, দুইটা পিয়াজ মরিচ কেটে দাওনা!
বেশ দিচ্ছি।
আহা করছ কি? এই এত মোটা করে কেউ মরিচ কুচি করে? আরও পাতলা করে কাট।
ডিমের পোচ এবং অমলেট হয়ে গেল, রুটিতো আগেই হয়ে গেছে। এবার মাঝু রেডি হয়ে টেবিলে এসে বসল। সবাই এক সাথে নাস্তা করছে।
শুনছ চা টা একটু ঢেলে আনতে পারবে? ওখানে দেখ চায়ের কাপ রেডি আছে
কথাটা শুনে মাঝু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মার মুখের দিকে তাকাল, আব্বুকে বলছ কেন, আমি আনতে পারি না?
থাক না তোমার আব্বু খুব ভাল চা বানাতে পারে।
সবার নাশতা এবং চা পর্ব শেষ হলো। মাঝু অফিসে চলে গেল।

তুমি আবার এগুলি ধোয়ার চেষ্টা করবে না সেই আজানের সময় উঠেছি আমি একটু গড়িয়ে নিয়ে আসছি।
মাঝুর মা বললে কি হবে মাঝুর বাবা রান্না ঘরে গিয়ে নাশতার বাসন পেয়ালা চায়ের কাপ সব কিছু ধুয়ে রেখে আসল। একটু পরে মাঝুর মা বলল বাজারে যেতে হবে। দেশী মুরগি পেলে আনবে আর সবজি, কাঁচামরিচ টমেটো আনবে আর চিংড়ি মাছ পেলে নিয়ে আসবে একটু ভর্তা বানাব।
মাঝুর বাবা আবার দুইটার বেশি সদাই হলে কোনোদিনই মনে রাখতে পারে না তাই স্লিপ প্যাড আর কলম নিয়ে লিখে নেয়ার জন্য আবার ডাইনিং টেবিলে বসল।
কি কি যেন বললে আবার বল না!
আচ্ছা তুমি কি কাজের মানুষ নাকি যে তোমাকে লিখে নিতে হবে? যা যা পাবে যা ভাল লাগবে নিয়ে আসবে।
না মানে ভুলে গেলেতো আবার যেতে হবে তাই লিখে নিয়েই যাই না কেন। তাছাড়া লিখতে পারি আর তা কাজে লাগাব না?
বাজারে থাকতেই মাঝুর বাবার পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
হ্যালো, কি ব্যাপার? আর কি লাগবে?
শোন, দেখতো লাউ আছে নাকি বাজারে!
না লাউতো দেখলাম না
চিংড়ি মাছ পেয়েছ?
হ্যাঁ নিয়েছি
আচ্ছা চলে আস তাহলে, রিকশায় এসো হেটে আসবে না কিন্তু
আচ্ছা দেখি।
বাজার থেকে ফিরে এসে দেখে মাঝুর মা রান্না ঘরে রান্নার আয়োজন করছে।
এই যে দেখ তোমাকে তখন নিষেধ করলাম বাসন পেয়ালা ধুবে না কিন্তু দেখ কি করেছ!
কি করেছি?
এই যে দেখ ডিমের প্লেটে যেমন তেল ছিল ওমনিই রয়ে গেছে
ও তাই নাকি?

তোমার ধোয়া এমনই হয় মনে হয় সখিনারা ধুয়েছে, তোমাকে দিয়ে কোন কাজই হবে না কি করে যে চলেছ এতদিন!
আরে ঠিক আছে কেউতো আর দেখছে না! চালিয়ে দাও না! এত এমন করছ কেন? আমিতো তোমার একটু আয়েশের জন্যেই চেষ্টা করেছি!
থাক এমন আয়েশের দরকার নেই, এগুলি আমাকে আবার ধুতে হবে, বুঝেছ?
তখনকার ঝর মোটামুটি ওখানেই থেমে গেল। আবার দুপুরে বাথরুম থেকে ডাকাডাকি।
কি হলো?
শোন এই কাপর গুলি ভাল করে ঝেরে বারান্দায় শুকাতে দাও
আচ্ছা দিচ্ছি।
গোসল সেরে এসে মাঝুর মায়ের আর এক দফা সুবচন প্রক্ষেপণ শুরু হলো
তোমাকে বললাম ভাল করে ঝেরে শুকাতে দিতে আর একি করেছ? কাপড়গুলা ঝাড়তে পার না?
আহা ইস্ত্রি করে নিলেই হবে এতে এত অস্থির হবার কি আছে?

থাক আর সাফাই গাইতে হবে না এখন যাও মেয়ের লাঞ্চে আসার সময় হয়েছে রান্নাঘর থেকে ভাত তরকারি পেয়ালায় বেরে টেবিলে নিয়ে আস আমি নামাজ পড়ে আসছি।
আবার বিকেল বেলা। শুনছ! বারান্দা থেকে শুকানো কাপড়গুলা নিয়ে এসে খাটে রাখ ভাজ করতে যেও না আবার। আমি ভাজ করব। কাপড় আনা হলে জানালা গুলি বন্ধ করে মশার কয়েল জ্বালিয়ে ওঘর থেকে কয়েকটা ছোট শুকনা লাকড়ি রান্না ঘরে এনে রাখ দেখি রাতের জন্য ভাত রান্না করতে হবে।
রাতের খাবার হয়ে গেল।
শোন, তরকারি গুলি বাটিতে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে পারবে?
হ্যাঁ তা আর পারব না? দাড়াও রাখছি।
বেশ রেখে আস।
ফরিদ সাহেবের অবস্থা এমনিই চলছে।
একদিন ফরিদ সাহেব মেয়েকে বলল বাবা তুমি না বলেছিলে আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিবে, মনে আছে?
থাকবেনা কেন?
তাহলে ব্যবস্থা করছ না কেন?
এ আবার নতুন করে কি করব! তুমি একটা জব করছ না?
সে আবার কি করছি?
কেন আম্মুর আবদুলের কাজটা করছ না?

আমার প্রেরনা

আমার মেঝ কন্যা তাহমিনা খালিদ এর প্রথম সন্তান জনাব মোহাম্মদ রিজভান রিহানঃ


আমার প্রয়াত জৈষ্ঠ কন্যা তানজিমা খালিদ এর রেখে যাওয়া এক মাত্র স্মৃতি জনাব রাফসান চৌধুরী।

যাযাবরের চিঠি

প্রিয় শফিক,
আশা করি ভাল আছিস। অনেক দিন যাবত তোর কোন চিঠি পাই না। জানি বারবার এত করে বলার পরেও তোদের গ্রামের বাড়ি না গিয়ে চলে এসেছি বলে রাগ করেছিস তাই না? আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। কিন্তু, আমি কেন যাইনি সে কথা এতো দিনেও বলি বলি করে বলা হয়নি। তুই যখন রাগ করে আমাকে ভুল বুঝে চুপ করে বসে আছিস তা হলে আজ বলি, দেখ চেষ্টা করে আমাকে ক্ষমা করতে পারিস কি না।
তোদের গ্রামে এমন এক জন আছে যার হবার কথা ছিল আমার অনেক কিছু অথচ সে এখন আমার কেউ না। এ কথা আমার বাবা মা, আমি আর আমার বাবার এক বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানে না, আরও এক জন জানতেন তবে তিনি এখন এই পৃথিবীতে নেই। কি ভাবে যেন সব ওলট পালট হয়ে বিধাতার যা ইচ্ছা তাই হয়ে গেল। আচ্ছা, শুনেছিস কোথাও, যে নাকি বৌ হবে তাকে জন্মের পর প্রথম কোলে নিয়েছে কেউ?

আমার জীবনে ঠিক এমনি এক ঘটনা ঘটতে গিয়েও নিয়তির নিতান্ত অনিচ্ছা ছিল বলে আর হয়ে উঠেনি। আমার ছোট বেলা বিদেশে কেটেছে সে তুই জানিস। ওখানে একটা নাম করা হাসপাতালে আমার বাবার এক বন্ধু কালাম চাচার কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। চাচী অত্যন্ত অসুস্থ ছিল বলে আমার মা তাকে দেখা শুনা করছিল। মেয়ে হবার সংবাদ পেয়ে কালাম চাচা বাবা এবং আমাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। হাসপাতালে দেখি চাচির বিছানার পাশে দোলনায় ফুটফুটে এক মোমের পুতুল ঘুমাচ্ছে। পাশে আমার মা বসে। কিছুক্ষণ আগে নার্সরা দোলনায় দিয়ে গেছে এখনো কেউ কোলে নেয়নি। চাচির অবস্থা খুবই খারাপ। কে কেমন আছে কার কি অবস্থা এসব কথার মধ্যে সেই পুতুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, একটু কান্না করতে চাইল। আমি এগিয়ে দোলনার কাছে গেলাম আর চাচী আমাকে বলল নাও কোলে নাও। ওই বয়সে যতটা সাবধান হয়ে এমন নব জাতক কে কোলে নিতে হবে বুঝেছি ততটা সাবধানে আস্তে করে তুলে নিলাম। কি করি না করি সে ভয়ে মা এসে কাছে দাঁড়ালেন। চাচী ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কোলে তার মেয়েকে দেখে রোগ ক্লিষ্ট মুখে একটু হেসে বলল তুমিই প্রথম কোলে নিলে বাবা, এটা তোমাকেই দিব। তখন চাচির এ কথার মানে বুঝিনি। এমনিতেই চাচী আমাকে খুব আদর করতেন। না, মেয়ের জামাই করবে এই আশা নিয়ে নয় কারণ তখন তাদের কোন বাচ্চাই ছিল না। বাসায় গেলেই ফ্রিজ খুলে যত রকমের খাবার আছে সব বের করে দিত। না খেলে সাঙ্ঘাতিক বকা বকি করত। আমি নাকি ছোট বেলায় খুব শান্ত সুবোধ আর একটু বোকা ধরনের ছিলাম।

চাচির কি যে একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল নাম মনে নেই, এখনো মনে আছে শরতের স্নিগ্ধ জোসনার সাথে সিঁদুর মাখা মাখি হলে যেমন হয় তেমন ছিল চাচির গায়ের রঙ। পরে আস্তে আস্তে তার শরীরের নানা জায়গা নীল হয়ে যেতে দেখেছি। মাংস পেশিতে পচন। সোনার পুতুলটাকে রেখে ওই রোগেই চাচী বছর খানিক পর মারা গেল।
স্বাভাবিক ভাবে পুতুলটার সব ভার এসে পরল আমার মায়ের উপর, নিজের কাছে এনে রাখলেন। এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না, বিদেশে কার কয় জন আত্মীয় থাকে?প্রথম মাস কয়েক চাচার অবস্থা প্রায় পাগলের মত, অফিস নেই খাওয়া নেই, কখন কোথায় যায় কি করে কিচ্ছু ঠিক ঠিকানা নেই। এ ভাবে প্রায় বছর খানিক পর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার মা বাবা পুতুল সহ চাচাকে দেশে পাঠিয়ে দিলেন লম্বা ছুটি নিয়ে। এই মেয়ের ভার কে নিবে?দেশে যাবার পর সবাই ভেবে চিন্তে মেয়ের কথা ভেবে চাচির মার পেটের ছোট বোনের সাথে আবার চাচার বিয়ে দিলেন। কিন্তু মার পেটের বোন তার মেয়েকে নিজের পেটের মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেনি। যা হবার তাই হোল। ও মেয়ের আশ্রয় হোল নানীর কাছে।

এর মধ্যে হিমালয় থেকে অনেক বরফ গলা পানি গঙ্গা যমুনা পদ্মা বয়ে সাগরে, মিশেছে, অনেক কলি ফুটে ঝরে গেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন দেশের জন্ম হয়েছে আর আমরা সেই দেশে ফিরে এসেছি। কলেজে তোর সাথে প্রথম পরিচয়, মনে আছে সে দিনের কথা?ওই তখনকার কথা। সে যখন ক্লাস এইটে তখন নারায়ণগঞ্জে ওর নানার বাড়িতে আমি শেষ দেখেছি। ওর অবস্থা দেখে এসে মাকে বললাম সব কথা। বিশ্বাস করবি কিনা, গায়ের রংটা পেয়েছিল মায়ের মত সেই রঙ পুড়ে তামার মত হয়ে গেছে, আমি চিনতেই পারিনি। এই মেয়েকে ময়লা কাপড় পরনে, বিষণ্ণ মলিন মুখে রান্না ঘরে হাড়ি পাতিল মাজতে দেখলে কার সহ্য হয় বলতে পারবি? আমার মা কিছুক্ষণ কাঁদলেন, মার সাথে আমিও কেঁদেছিলাম। কয়েক দিন পর গিয়ে মা দেখে আসলেন, এসে আবার কান্না। এতো দিনে চাচির সেই কথার মানে বুঝতে শিখেছি। মনে মনে কখন যে মোর স্বপন চারিণী হয়ে গিয়েছিল বুঝিনি। তাই বুঝি মার কান্নার সাথে আমার কান্নাও মিশে গিয়েছিল
আমরা ঢাকায় আসার পরে বাবা দেখে শুনে ঢাকায় আমাদের বাড়ির কাছে একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। ওই জায়গা কিনে চাচা বাড়িও করলেন কিন্তু বাবার এই বাড়িতে ওই মেয়ের থাকা হয়নি। ছোট বেলা থেকেই আমি বিশেষ করে মেয়েদের কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। আমার একটাই বোন তাকে যে আমি কি ভালবাসি সে তুই জানিস।

তত দিনে লেখা পড়ার পাট শেষ করে এই চাকরিতে জয়েন করেছি, ওই যে যখন প্রথম চিটাগাং গেলাম তখন। এক বার ছুটিতে এসেছি তখন এক দিন সন্ধ্যায় কালাম চাচা তার মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আমাদের বাড়িতে এলেন। কথাটা শুনে চমকে উঠলাম, মা অবাক হয়ে মুখে কি!! বলে কিছুক্ষণ চাচার দিকে তাকিয়ে থেকে চাচাকে ডেকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। চাচাও কোন কিছু না বলে মাথা নিচু করে মাকে অনুসরণ করলেন। বাবা বাসায় নেই। ও ঘরে কি কথা হোল সব শুনতে পাইনি তবে মাঝে একবার মায়ের উচ্চ কণ্ঠ পেলাম এ মেয়ে আমার, আমি কিচ্ছু বুঝি না আমাকে এ মেয়ে দিতে হবে মার এ কথার প্রেক্ষিতে চাচার একটু উচ্চ কণ্ঠ শুনলাম, “আমি কি করব ভাবী”?
সেদিনের মত চাচা চলে গেল। একটু পরে বাবা এলেন। বাবার সাথে যখন মা এ নিয়ে আলাপ করছিল তখন যা শুনলাম তা হচ্ছে
মেয়ের নানা বিয়ে ঠিক করেছে, ছেলে গ্রামে (তোদের গ্রাম) থেকে দোকান দারী করে, অনেক জমি জমা নাকি আছে, এর চেয়ে ভাল পাত্র পাওয়া যাবে না তাই দেরি না করে বিয়ের দিন ঠিক করে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছে। মেয়ের বাবাকে একটু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। মেয়ের বাবা এ কথা শুনে প্রতিবাদ করেছিল, না আমি মেয়ের জন্য ছেলে ঠিক করে রেখেছি, ওর মা বলে গেছে। এ বিয়ে হবে না। আমার মেয়ে আমাকে একটু জিজ্ঞেস করবেন না?
তোমাকে কি জিজ্ঞেস করব, মেয়ে কি তুমি পেলে বড় করেছ?

দেখ, এই হোল আমাদের মেয়েদের জীবন, এক জন মা হারা মেয়ের জীবন কি এমন হতে হবে?এখানে তার কি দোষ ছিল?বাবা থাকতেও বাবার গলা জড়িয়ে ধরে একটু সোহাগ, একটু স্নেহ কেন পেল না?আমার মা বাবা ওই বিয়েতে যেতে পারেনি, আমার বিয়েতে ও ওই চাচা আসেনি। আমার বিয়ের আগে হবু বৌকে সব বলেছি এমনকি বিয়ের পরে ওকে সাথে নিয়ে চাচার বাড়িও গেছি। ওর কৌতূহল ছিল এ কেমন মা একটু দেখব, সৎ মা হলেই কি এমন হতে হবে আর বাবাই বা কেমন বাবা?তাই দেখাতে নিয়ে গেছিলাম। ও বাড়ি যাবার পর আমার বৌ এর মাথায় হাত রেখে চাচা কেঁদে ফেললেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম। এ কান্না কিসের কান্না আমাকে একটু বুঝিয়ে দিবি?তবে ওই পুতুলকে দেখতে চেয়েছিল তা আর হয়ে উঠেনি।
এখন বল আমার পক্ষে কি ওই গ্রামে যাওয়া উচিত?এখানে আমার কি দোষ? আশা করি আমাকে ভুল বুঝবি না। কারো মনে কষ্ট দেয়া তো দূরের কথা সে রকম কিছু ভাবাও আমার পক্ষে সম্ভব না। মানুষের সাথে সু সম্পর্ক না হতে পারে কিন্তু খারাপ সম্পর্ক থাকবে কেন?একটু খানি বন্ধুত্ব গড়ে তোলা অনেক কঠিন তাই চেষ্টা করি তা টিকিয়ে রাখতে। তোদের মত বন্ধুদের ভালবাসা আমার জীবনের পাথেয়। ওর কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মানুষ কি তা পারে?হঠাৎ করে সেদিন মনে হয়ে যাওয়ায় মনটা ভীষণ ভাবে অস্থির হয়েছিল। বৌকে বললাম এখন আমি কি করি?বৌ কি চিকিৎসা দিল শুনবি?বলল ঘুমাবার চেষ্টা কর, আর তার জন্য দোয়া কর তার ইহ কালের সুখ যেন পর কালে পায়, এ ছাড়া আর কিছু বলার নেই।
তুই তো জানিস আমার স্ত্রী ভাগ্য খুবই ভাল, এদিক দিয়ে আমি অত্যন্ত সুখী মানুষ। আমার কি প্রয়োজন তা আমি বোঝার আগেই সে বুঝে ফেলে। তাই মনে হয় আমার এই ভবঘুরে ছন্ন ছাড়া জীবন এখনো টিকে আছে।
আশা করি তোর ভুল ভেঙ্গেছে, এবার চিঠির উত্তর দিবি। এবার দেশে গেলে অবশ্যই দেখা করবি।
ইতি,
যে নামে আমাকে ডাকতে তুই পছন্দ করিস
তোর সেই যাযাবর।

মজার রেসিপি কাচ্চি বিরিয়ানি

অনেককেই দেখছি নানান রকমারি রেসিপি লিখছেন। শাপলা (ইদানিং তাকে দেখাই যাচ্ছে না), আমার প্রিয়তমা এবং একমাত্র প্রেমিকা ইজি রেসিপি এদের এই সব মজার মজার রেসিপি দেখে আমা্রও একটু সাধ হল দেশের পাবলিক, জনগন এবং জাতির উদ্দেশ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার। যেমন কথা তেমন কাজ, সাথে সাথে কলম কেঁচি হাতে বসে পড়লাম এমন একটা মজার রেসিপি লেখার জন্য। আমাকে দেখতে শান্ত সুবোধ বালকের মত মনে হলে কি হবে আমি কিন্তু আসলে অতিমাত্রায় অস্থির প্রকৃতির মানুষ। যখন যা ভাবি তা না করা পর্যন্ত স্থির হতে পারি না।
যাক, এমন কথা বললে সারা দিন ধরেই বলা যায় কিন্তু তাতে কি এমন আসে যায়? কাজে চলে আসি?
তাহলে আজ আমি একটা বিরিয়ানির রেসিপি দেই? ভয়ের কিছু নেই, নিতান্ত খারাপ কিছু হবে বলে আমি মনেই করি না। তা হলে শুরু করছি:

উপকরণঃ
১। কাচ্চি বিরিয়ানি- এক প্লেট।
২। শামি কাবাব- দুইটা কিংবা চিকেন কাটলেট হলেও চালিয়ে নেয়া যাবে।
৩। চিকেন ফ্রাই- দুই টুকরা, এর সাথে অল্প কিছু ফ্রেঞ্চ চিপস নিতে পারেন।
৪। টমাটো, শশা, কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ, লেটুস পাতা ও ধনে পাতার সালাদ- এক কোয়ার্টার প্লেট।
৫। মাটন রেজালা- এক পেয়ালা।
৬। এক গ্লাস বোরহানি, বোরহানি না পেলে কোক বা স্প্রাইট দিয়ে আজকের মত চালিয়ে দিন।
৭। রাইস পুডিং/আইসক্রিম/ফ্রুট কাস্টার্ড- এক বাটি।
৮। পানি- এক গ্লাস।

কি ভাবে সদ্ব্যবহার করবেনঃ
(যদি আপনি হাত দিয়ে খেতে পারেন তাহলে ভাল করে হাত ধুয়ে নিন আর যদি ছুড়ি কাটা দিয়ে খাবার অভ্যাস থাকে তাহলে ডান হাতে কাটা নিয়ে শুরু করুন)
১। হাত মুখ ভাল করে ধুয়ে টেবিলে বসুন।
২। সালাদের প্লেট থেকে দুই এক টুকরা শশা কিংবা লেটুস নিয়ে চিবিয়ে খেতে থাকুন। এতে মুখে এনজাইম নিঃসৃত হবে এবং খাবার খুব সহজেই হজম হবে।
৩। একটু বোরহানি চুমুক দিন। রুচি বৃদ্ধি পাবে।
৪। প্লেট থেকে কাবাব কিংবা চিকেন ফ্রাই আপনার পছন্দ মত তুলে খেতে থাকুন।
৫। এবার একটু একটু করে বিরিয়ানি মুখে দিন। সাথে একটু সালাদ/বোরহানি নিতে পারেন।
৬। এই ভাবে কার কথায় কান না দিয়ে কিংবা অন্য কোন দিকে মনযোগ না দিয়ে আপনার সম্পূর্ণ ইচ্ছে মত খেয়ে শেষ করুন।
৭। গ্লাসের তলানি বোরহানি বা কোক এক চুমুকে শেষ করে নিন।
৮। এবার ডেজার্ট এর পেয়ালা থেকে আপনার রুচি মত যা সম্ভব খেয়ে নিন।
৯। কিছুক্ষণ পরে পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে পান করে নিন।

আর কিছু মনে হয় বাকি নেই তাই এবার পাশের দোকানে গিয়ে এক খিলি পান কিনে চিবুতে থাকুন। সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন কিন্তু…………। যদি কেহ এর চেয়ে কোন উন্নত কিছু করতে চান তাহলে অনাদরে গৃহিত হবে, এব্যাপারে কোন ভাবনা করবেননা।
বিঃদ্রঃ রেসিপিটা কেমন লাগল জানাবেন, না জানালে এই পোস্ট দেখা নিষেধ।

হতাশ হাঙ্গর

আইরিশ সাগরে অক্টোবরের প্রথম থেকেই যেন শীত সাহেবের আক্রমণ বেড়ে যায়। এপারে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওপাড়ে আয়ারল্যান্ড। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আবার তার সাথে ঝড়ো বাতাস কিংবা ঘন কুয়াশা। প্রায় সারাক্ষণ একটা না একটা প্রাকৃতিক এলোমেলো ভাব থাকবেই। মাঝে মাঝে এমন হয় যে রীতিমত জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের জুতা পর্যন্ত দেখা যায় না এমন কুয়াশা। সাগরের পানি এবং পানিতে সাঁতরানো মাছগুলি বাছাই করতে থার্মাল গ্লোভস হাতে পরা থেকেও মনে হয় যেন হাত জমে বরফ হয়ে গেছে, কোন বোধ থাকে না। আর ডিসেম্বরে? সে তো এক ভয়ানক ব্যাপার। মনে হয় যেন সমস্ত সাগরের পানি বরফ হয়ে রয়েছে। এমন সময় সমুদ্রে মাছ ধরা হয় না বললেই চলে। তাই বলে কি আর ফিশিং ট্রলার গুলি বসে থাকবে? না, তেমন কোন সম্ভাবনা মোটেই নেই।

১৯৮০ এর দশকের প্রথম দিকে রবার্টলি নামের যে ফিশিং ট্রলারে কাজ করি সেটা স্কটল্যান্ডের উত্তরে ওবান শহর থেকে আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট এবং ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল কিংবা যদি সি স্ক্যানারে দেখা যায় সাগর তলে মাছের ঝাঁক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন খুব বেশি হলে লিভারপুল পর্যন্ত আইরিশ সাগরের মধ্যেই মাছ ধরে বেড়াই। স্যালমন বা লাল স্যালমন পেলে সেটা হয় বাড়তি পাওনা। আমাদের সেফ পিটারের ওভেন যেন রেডি হয়েই থাকে কখন গ্রীল করবে। একটা বা দুইটা না মোটা মুটি ৮/১০ টা রেড স্যালমন গ্রীল না হলে যেন হয় না। জাল তুলে ফেরার পথে ব্ল্যাকপুলের একটু পশ্চিমে ‘আইল অফ মান’ দ্বিপে কয়েক ঘণ্টার জন্য থেমে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র নিয়ে নেই। এই ফাঁকে আবার ওই আইরিশরা যারা এ কয় দিন একটু গলা ভেজাবার জন্য পাবে যেতে পারেনি তারাও একটু সুযোগ পেয়ে জেটির কাছের একটা পাবে গিয়ে দুই এক পাইন্ট লাগার (আমাদের দেশে যাকে বিয়ার বলে) গিলে আসে। জাহাজে বসে গিললে নাকি কোন স্বাদ পায় না!!
আমাদের কোম্পানির অফিস ওবান শহরে। এটা ছোট হলে কি হবে ভীষণ সুন্দর একটা টুরিস্ট শহর। সারা বছর এখানে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের নানা দেশের পর্যটকেরা আসছে যাচ্ছে, তবে শীত কালে কিছুটা কম। সারাটা শীতেই হয়ত ছাতা নয়ত রেইন কোট সাথে নিয়ে কি আর টুরিস্টরা বের হতে চায়?

মাছ বোঝাই জাহাজ নিয়ে এসে জেটিতে ভিড়েই মাছ এবং সামুদ্রিক অন্যান্য শামুক, স্টারফিশ ইত্যাদি সব আনলোড করে শুধু মাত্র জাহাজে ওয়াচ কিপিঙের জন্য দুই চার জন থেকে বাকি সবাই নেমে যেতাম। গত টানা অন্তত এক মাস সাগর বাসের এক ঘেয়েমি কাটাতে নেমে যেতাম। ছোট্ট অথচ ওপাশে পাহাড় ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো এই ওবান শহরের এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। সাধ মিটত না, অন্তত আমার কখন এক ঘেয়েমি আসেনি। প্রতিবার যখন এসেছি তখনি মনে হতো যেন এই প্রথম এসেছি। এর মধ্যে শহরের উত্তর দিকের সিভিক সেন্টারের টাউন হলে দেখে যেতাম কি নাটক হচ্ছে। মন মত কোন নাটক পেলে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে টিকেট করে ঢুকে পরতাম। সেক্স পিয়ারের নাটক গুলি ইংরেজরা যে ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তা মনে হয় আর কেউ পারে না। কাজেই এই লোভ সামলানো কোন বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতাম না। নাটক না হলেও অন্তত লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘণ্টা খানিক ধরে স্থানীয় দুই একটা সংবাদ পত্রের হেডলাইন দেখে আবার জাহাজে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরতাম। বেশির ভাগ সময়ে বাইরেই বিশেষ করে গোটা তিনেক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট আছে তার কোন একটাতে খেয়ে আসতাম। এখানে খেতে

আসলে বাড়তি একটা বোনাস পেতাম।কিছুক্ষণ বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেতাম। আমার সাথে যারা আছে তারা সবাই আইরিশ। আর এরা আইরিশ টানে যা ইংরেজি বলে তা প্রথম দিকে প্রায় কিছুই বুঝতাম না। তবে ওরা আমার কথা বুঝত।
একবার নিকির সাথে চলে গিয়েছিলাম ব্রিটেনের সর্ব্বোচ্চ শহর ফোর্ট উইলিয়ামে। ওবান থেকে বাসে করে উত্তর দিকে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। বাস যখন পাহাড়ি পথ বেয়ে ধীরে ধীরে একে বেঁকে উপরে উঠছিল সে এক মায়া ভরা অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে পাহাড়ি উঁচু নিচু সবুজের তেপান্তর। কোথাও কুয়াশা কুয়াশা ঝাপসা আবার কোথাও ঝিকিমিকি রোদ্দুরের আলোছায়া। প্রকৃতি যে এমন সুন্দর হতে পারে তা এই স্কটল্যান্ডে না এলে দেখা কঠিন। এমনিতে এখানে জন সংখ্যা খুবই কম। অনেক দূরে দূরে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কিছু কিছু জন বসতির ছোঁয়া। দূর থেকে বাড়ির ছাদের লাল রঙের টালি গুলি চোখে পরার মত। ফোর্ট উইলিয়াম পৌঁছে মনে হলো কে যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে অনন্ত কালের অলস সময় নিয়ে বসে বসে হাতে এঁকে সাজিয়ে রেখেছে। শহরের এক পাশে এসে যখন দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলাম আহা! সে কি মন জুড়ানো ছবি! কত দূরে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ, শুধু আঁকাবাঁকা এলো মেলো পাহাড়ি সবুজ আর সবুজ। দূরে ওই উত্তরে এবং পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে নীল সাগর, দুই চারটা গাং চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। চোখের পলক পরতে চায় না। মন প্রাণ চোখ সব এক সাথে বলে উঠেছিল বাকীটা জীবন এখানেই থেকে যাই। খেয়ে না খেয়ে শুধু এই প্রকৃতি দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দেই।

গরম কালে স্কটল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের শহর ইনভার্নেস এর উত্তরে দেড় দুই শত মাইলের মধ্যে যখন যেখানে মাছের ঝাঁক বেশি থাকে ওই এলাকায় জাহাজের পিছনে জাল ফেলে ট্রলিং করতাম একটানা সপ্তাহ খানিক। দিনে অন্তত তিন চার বার জাল টেনে মাছ তুলে বাছাই, গ্রেডিং করে হোল্ডে সাজিয়ে রাখতাম। স্যালমন, রেড স্যালমন, ট্রাউট, কড, হোয়াইট ফিস,চিংড়ি, লবস্টার, স্নিফার, হেরিং আরও কত ছোট বড় হাজার রকমের মাছের সাথে জেলি ফিস, স্টারফিশ, কাঁকড়া, নানা জাতের ঝিনুক, শামুক, বাচ্চা হাঙ্গর, বাচ্চা অক্টোপাস সহ কত কি যে উঠত সে এক দেখার মত দৃশ্য। সমুদ্রের নিচে যে এত প্রাণী তা এই মাছের জাহাজে কাজ না করলে হয়ত কোন দিনই জানতাম না। এগুলির মধ্যে আবার যা মানুষের খাদ্য নয় সেগুলি পশু খাদ্য তৈরির জন্য ব্যবহার হতো আর মানুষের খাদ্য যোগ্যগুলি আলাদা গ্রেডিং করতে করতে নাজেহাল অবস্থা। মানুষের খাদ্য বলতে আমাদের দেশে যা বোঝায় এখানে ঠিক তেমন না। এদের সুস্বাদু খাদ্য তালিকায় এক রকম ছোট ছোট মুসেল নামে ঝিনুক আছে যা বেশ দাম দিয়েই এরা কিনে বিশেষ করে ফ্রেঞ্চরা। অবশ্য আমাদের পিটার সামুদ্রিক সাদা কাঁকড়া দিয়ে যে কাটলেট বানাত তা প্রথম দিকে দেখে মোটামুটি নাক সিটকতাম। কিন্তু এক দিন ওদের সাথে ডাইনিং টেবিলে এক সাথে খেতে বসে নানান পদের সস দিয়ে ওই কাঁকড়ার কাটলেট খাবার ভঙ্গি দেখে একটু মুখে দিয়েই রীতি মত আফসোস হল। এত দিন কেন খাইনি।

সে যাই হোক, এসব লিখলে কোন দিন শেষ হবে বলে মনে হয় না। আজ যে কথা বলতে এসেছি সেখানেই ফিরে আসি। এক বার ঝুর ঝুর করে স্নো পরা নীলচে সাদা ধবধবে ওবান হারবারে যখন রাজহাঁসেরা সাঁতরে বেড়াচ্ছিল তেমনি একটা দিনে আমরা ওবানের ছোট্ট হারবার থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এঁকে বেঁকে বের হয়ে প্রায় এক শ মাইল দূরে এসে জাল ফেলেছি। এখানে হারবার থেকে বের হয়েই জাল ফেলা যায় না কারণ পানির নিচে প্রচুর পাহাড়ি এবং এবড়ো থেবড়ো সাগর তল। জাল বেধে জাল ছেঁড়া সহ নানা রকম ঘটনা ঘটে

যায় বলে নিরাপদ দূরত্বে এসে জাল ফেলতে হয়। বেশ পাঁচ ছয় দিন চলে গেল। জালে ভাল মাছ আসছে। আমাদের আইরিশ স্কিপার (ট্রলার ক্যাপ্টেন) সাম, আসল নাম স্যামুয়েল কিন্তু সবাই সহজ ভাবে সাম নামেই ডাকে। সে আবার আরও কিছু মাছ বেশি হলে জাল তুলে এক বারে লিভারপুল বা ব্ল্যাকপুল হারবারে পৌঁছে দিয়ে জাহাজ রেখে ফেরিতে পার হয়ে বেলফাস্টে তার বাড়ি যাবে এমন একটা আশা নিয়ে একটু দেরি করতে চাইছে।
সেদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তিন বার জাল টানা হয়েছে এবং প্রচুর মাছ ধরা পরছে। সন্ধ্যার একটু আগে দিনের শেষ বারে জাল টানা হচ্ছে, জাল বোঝাই মাছ বোঝা যাচ্ছে। জাহাজের ইঞ্জিন থামিয়ে আস্তে আস্তে উইঞ্চে টেনে জাল কাছে আনা হচ্ছে। মাছ তোলার জন্য ক্রেন রেডি করে রাখা আছে। পাশের উইঞ্চের শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে বেশ লোড হয়েছে। আইরিশ জেলে নাবিকেরা পিছনের ডেকে দাঁড়িয়ে মাছ দেখে সবাই মনের আনন্দে আইরিশ ভাষায় চিৎকার করে গান গাইছে। ওদের গান শুনে মনে হচ্ছিল যেন ভাটিয়ালি গাইছে তাই আমিও বাংলায় “ও রে নীল দরিয়া” শুরু করে দিলাম। জাল কাছে এসে পরেছে। পিছনে দেখছি কয়েকটা কাল হাঙ্গর লেজ দিয়ে বারি দিয়ে পানি ছিটিয়ে আবার ডুব দিচ্ছে। একটু পরেই ভেসে উঠে আবার লেজের বারি। এ আর এমন কিছু নতুন নয়।

প্রায়ই জাল টানার সময় এমন দৃশ্য আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু একটু ভয় পেতাম এ কথা স্বীকার করতে মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না। আমাদের মধ্যে পন্টি ছিল একটু বেশি রকমের সাহসী। পারলে লাফ দিয়েই যেন জাল টেনে তুলে আনে এমন লাফালাফি করছিল। ওর চিৎকারই সবার কানে আসছিল। হঠাৎ করে কি মনে করে সম্ভবত আনন্দের আতিসহ্যে জাহাজের রেলিঙের উপরে উঠে নাচতে চেয়েছিল আর অমনিই ঝপাত করে পানিতে পরে গেল। হেই পন্টি!!! বলে সবাই এক সাথে চিৎকার। কিন্তু চিৎকার করে কি আর পন্টিকে তুলে আনা সম্ভব? নিচে তাকিয়ে আর পন্টিকে দেখছি না, তলিয়ে গেছে। সবাই জাহাজের রেলিং ধরে অসহায়ের মত নিচে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই ও ভেসে উঠল। ওদিকে পিছনেই হাঙ্গরের ঝাঁক। কি হয়েছে? এমন করল কেন? কি হবে? কি হবে? এই শীগগির হিভিং লাইন (এক ধরনের রশি, যার এক মাথা কিনারায় বা পাশের অন্য জাহাজের সাথে ভিড়ার সময় ছুড়ে দেয়া হয় এবং ওরা ওটা ধরতে পারলে এ মাথার সাথে জাহাজ বাধার মোটা রশি টেনে নেয়ার জন্য বেঁধে দেয়া হয়) ফেল।লাইফ বয়া ফেল। তাড়াতাড়ি কর। এমনি হুলস্থূল ব্যাপার। কেও হিভিং লাইন খুঁজছে, কেউবা খুঁজছে লাইফ বয়া। এক হৈ চৈ ব্যাপার। হাতের কাছেই সব নির্দিষ্ট জায়গা মত রয়েছে কিন্তু কেও খুঁজে পাচ্ছে না।

সবার আগে লুইস একটা লাইফ বয়া পেয়ে পন্টির দিকে ছুড়ে ফেলল। কিন্তু ওটা ওর কাছে পৌঁছায়নি। এতক্ষণেও হাঙ্গরেরা বুঝতে পারেনি যে ওদের এক মস্ত শিকার ওদের একটু সামনে হাবুডুবু খাচ্ছে। ওরা শুধু জালের ভিতরে থাকা মাছ খাবার পিছনেই ব্যর্থ দৌড় দৌড়চ্ছিল। তবে হাঙ্গরের যেমন ঘ্রাণ শক্তি তাতে পন্টির গন্ধ ওদের কাছে পৌঁছে যেতে বেশী ক্ষণ লাগবে না। চেঁচামেচির শব্দ শুনে স্কিপার সাম দৌড়ে এসে পরিস্থিতি বুঝে তাড়াতাড়ি উইঞ্চ অফ করে নিজ হাতে একটা হিভিং লাইনের মাথায় একটা বয়া বেধে পন্টির দিকে তার সর্ব শক্তি দিয়ে ছুড়ে দিল। আর পন্টি দুই এক হাত এগিয়ে এসেই খপ করে বয়াটা ধরে ফেলল। এই এতক্ষণে সর্দার হাঙ্গর লাফ দিয়ে পন্টিকে উদ্দেশ্য করে ডুব দিয়েছে, সবাই এক সাথে দেখেছি। তার পিছনের সব হাঙ্গর একই কায়দায় লাফ দিয়ে ডুব দিয়েই সম্ভবত দৌড়। হাঙ্গরেরা কখনোই তার শিকার উপর থেকে ধরে না। ওরা আস্তে করে চুপি চুপি পানির নিচে দিয়ে এসে কামড়ে ধরে।

হিভিং লাইনের মাথায় বাঁধা লাইফ বয়া ধরতে ধরতে পন্টি বেশ কয়েক গজ পিছিয়ে গেছে তবুও যেই কিনা পন্টি লাইফ বয়া ধরেছে আর অমনি হিভিং লাইন ধরে টেনে কাছে আনা হচ্ছে। লাফ দিয়ে ডুব দেয়ার পর থেকে হাঙ্গরদের আর দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টা নিশ্চিত যে ওরা পন্টির গন্ধ পেয়েছে এবং কাছে আসতে আর মাত্র কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না। পন্টিকে একে বারে জাহাজের পিছনের ডেকের নিচ বরাবর আনা হয়েছে। এর মধ্যে কে যেন রশির তৈরি সিঁড়ি এনে নামিয়ে দিয়েছে। ওপর থেকে নানা জনের হাঁকডাক পন্টি সিঁড়ি ধরে উঠে আস, পন্টি তাড়াতাড়ি কর। ও জানেই না যে এক ঝাঁক হাঙ্গর ওর গন্ধ পেয়ে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। তবে রক্ষা একটাই যে ওরা সোজা আসতে পারছে না। বিশাল জাল ঘুরে আসতে হচ্ছে। সিঁড়ির নিচের দিকটা সাগরের সমতলে পৌঁছে গেছে। পন্টি ওর লম্বা হাত বাড়িয়ে সিঁড়ির একটা ধাপ ধরে ফেলেছে। বলা যায় না, এখন হাঙ্গরের আক্রমণের ভয় এড়ানো যাবে না যদি কাছে এসে থাকে। পানির নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। হ্যাঁ এইতো আর একটু উপরে, আর একটু হলেই পন্টি সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াতে পারবে। সম্ভবত পায়ের জুতা ভারী হয়ে গেছে বলে পা টেনে আনতে পারছে না।

হ্যাঁ এইতো পন্টি এক হাতে সিঁড়ির রশি ধরে আর একটু উপরে তুলে এক পা সিঁড়িতে তুলে দিয়েছে। মোটা মুটি দুই স্টেপ উপরে উঠে এসেছে এমন সময় পন্টির ঠিক নিচে সাগরের পানিতে তুমুল একটা তোলপাড় তুলে পানি ছিটিয়ে একটা হাঙ্গরের মাথা বের হলও। শিকার হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ডলফিন যেমন মনের আনন্দে লাফিয়ে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে বেশ খানিকটা উঠে আসে তেমনি করে মস্ত হা করা একটা বিশাল হাঙ্গরের মাথা এক লাফ দিয়ে পন্টির ডান পা কামড়ে ধরে ফেলেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় পন্টি পরে যাই যাই ভাব। কিন্তু পন্টি সাহস না হারিয়ে বা ভয়ে কাবু না হয়ে এর মধ্যে সিঁড়ির রশি ধরে ওর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান পা এক ঝারা দিয়ে বাম পা আর এক ধাপ তুলে এনেছে। ঝারি পেয়ে ডান পায়ের জুতা খুলে হাঙ্গরের মুখে আর আমাদের পন্টি খালি পা তুলে সিঁড়ির পরের ধাপে উঠে এক এক করে একেবারে জাহাজের কিনারা ধরে ফেলার আগেই ডেকে দাঁড়ানো দুই জনে ওকে ধরে টেনে ডেকে তুলে ফেলল। নিচে তাকিয়ে দেখি ওরা সবাই চলে এসে মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নেয়ার আক্রোশে পানিতে প্রচণ্ড ঘূর্ণি ঝড় তুলে ফেলেছে। পন্টিও নিচে তাকিয়ে কিছুক্ষণ তামাশা দেখছিল।

ঘটনার তাণ্ডবে উইঞ্চ অন করার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম সবাই। সাম আবার উইঞ্চের সুইচ অন করে বলল হে হে পন্টি, এত গুলি হাঙ্গরকে এমন হতাশ করে ওদের এত সুন্দর একটা ডিনার হতে দিলে না? দারুণ বাঁচা বেচে গেছ। এই নিক, যাও একটা শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে এসে পন্টির মঙ্গল কামনা করে ওকে শ্যাম্পেন দিয়ে গোসল দিয়ে দাও।

তুমি এসেছিলে ঘুমঘোরে

কাল সারাটি রাত ধরে
তুমি ছিলে স্বপন মাঝে
ঘুমেরই ঘোরে।।

কোথা দিয়ে কেটেছিল রাত
এসেছিল বসন্ত বাতাস
বুঝিনিতো আমি, বুঝিনি
কে এসেছিল আমারই দ্বারে।।

একটু খানি পরশ এখনও আছে লেগে
বুঝেছি তাই ঘুম থেকে জেগে
এসেছিলে যদি ডাকনি কেন নামটি ধরে
দিয়ে কেন গেলে না স্মৃতির পেয়ালা ভরে।

তুমি কি এসেছিলে নীরব পায়ে
ঘুম ঘুম আবেশে
বসন্ত হয়ে জোনাকির সাথে
রাতের আঁধারে।।

আভিজাত্য

১।
সোলায়মান হায়দর। বাড়ি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ৪০ মাইল উত্তরে কালাকান নামের ছোট্ট শহর ছেড়ে আরও প্রায় ১৫ মাইল উত্তরে সাওয়ারখিল ছেড়ে এশিয়ান হাইওয়ে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে কারাকান বাজারে ডান দিকে মোর নিয়ে যে ইসতালিফ সড়ক পূর্ব দিকে চলে গেছে তার বাম পাশে চৌরাস্তার ধারে। নিচে বিশাল মটর পার্টস এর দোকান আর দোতলায় বসত বাড়ি। মটর পার্টসের দোকান হলে কি হবে সাথে কিছু বন্দুক আর পিস্তলের গোলাগুলি সহ টুকি টাকিও আছে। রাশিয়ানরা যখন এখানে যুদ্ধ করছিল তখন নিতান্ত জীবন রক্ষার তাগিদে এলাকা বাসিদের অনুরোধে এগুলি রাখতে হত।

বাবা আফছার হায়দর স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক। ভূ-সম্পত্তি বলতে বিশাল পাথুরি পাহাড়ি এলাকা যেখানে কোন ফসল বা চাষাবাদ হয় না শুধু ছাগল আর দুম্বার চারণ ভূমি। ছাগল জাতীয় পশুর খাদ্য সাদা কষ হয় এমন পাহাড়ি ঘাসে ভরা। হাজার খানিক ছাগল আছে ওদের। তবে এই সব পাহাড়ি এলাকার বৃষ্টির পানি বয়ে যাবার জন্য যে নালা এশিয়ান হাইওয়ে পাড় হয়ে কাবুল শহরের পশ্চিম দিয়ে বয়ে গেছে সেখানে এই নালার পাড়ে কিছু জমি আছে ওখানে শুধু পায়রা আর ভুট্টার চাষ হয়, পাশে ছোট্ট একটুকরা আঙ্গুর বাগান আছে। মোটামুটি উচ্চ বিত্ত পরিবার। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে এই অনেক। সোলায়মান কাবুলে লেখাপড়া শেষ করে বাবার সাথে দোকানের কাজে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বর্ডার থেকে এটা সেটা যা পায় নিয়ে আসে। আবার ওদিকে ইরানের বর্ডারেও যাতায়াত আছে। বন্ধুরা মিলে গাধার গাড়িতে তাঁবু সহ প্রয়োজনীয় মালামাল বহন আর ঘোড়া নিয়ে যাতায়াতে আড্ডার আড্ডাও হয় আবার এক ঢিলে বাবাকেও কিছু সাহায্য করা হয়ে যায়। কিছু মালামাল নিয়ে আসা যায়।

রাশিয়ানরা যুদ্ধ করছে করুক, ওরা প্রায়ই ওদের দোকানের সামনে দিয়েই সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে ধুলো উড়িয়ে কাবুল যায় আবার লরি ভরে বাজার সদাই নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জনপদের বাইরে ওদের আস্তানায় চলে যায়। সামনে পরে গেলে ইশারায় কুশল বিনিময় হয় কখনো। সব কিছুই চলছিল বেশ। বাদ সাধল যখন আমেরিকানরা এলো। এমনিতেই আফগানরা জাতি হিসেবে একটু, না না একটু নয় বেশ স্বাধীনচেতা। কারো বশ্যতা মেনে নেয়া ওদের ধাতে নেই।

আমেরিকানরা এসেছে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আফগানিস্তানের দখল নিয়ে আমেরিকান সাম্রাজ্য বিস্তারের আশা নিয়ে। তা বেশ মারামারি কাটাকাটি খুনখারাবি করবি কর। আমরা কি কম পারি এগুলি? আমরা জাতি হিসেবে যোদ্ধার জাতি সে কথা কি তোরা ভুলে গেলি! বাগড়ম এয়ার ফিল্ড দখলের উছিলায় যেদিন গোলাগুলি শুরু হল সেই সময় গোলাগুলির এক পর্যায়ে একদিন এলাকার প্রায় সবাই বাড়ি ঘর দোকান পাট ছেড়ে গাধার গাড়িতে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমি এবং জনবসতির শেষ সীমা জুলফিকার খাইলে মামা বাড়িতে চলে যায়। দিন পনের পরে যখন গোলাগুলি বন্ধ হল তখন একদিন সোলায়মানের বাবা গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে এসে নিজ এলাকা দেখে গেল। বাবা যখন ফিরে এলো তখন তার কাছে শুনল তাদের বাড়ি ঘর দোকান কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শুধু তাদের না কারাকান বাজারের কোন চিহ্ন বলতে লাইট পোস্টের কয়েকটা খুঁটি ছাড়া আর কিছু নেই। সব ভেঙ্গে চুরে ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। এই সব শুনে বাবার সাথে তার পরদিন বাপ বেটা দুইজনে দুইটা গাধা নিয়ে দেখতে এলো। বাবা নিষেধ

করেছিল আর যেয়ে কি হবে, কি দেখবি? কিছুই যে আর নেই! না বাবা আমি দেখব, আমাকে যে এর প্রতিশোধ নিতে হবে। মাও নিষেধ করল কিন্তু সোলায়মান নাছোড় বান্দা, সে নিজ চোখে দেখবেই।
আরে বেকুব তুই কি করে আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিতে যাবি? না মা আমি দেখবই, তুমি বাবাকে যেতে দিতে না চাইলে দিও না আমি একাই যাব। ছেলের মনের দুঃখ বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত বাবা তার সাথে এলেন। হাইওয়ের পশ্চিম পাশে এসে গাধার পিঠে থেকে নেমে দুই জনে দাঁড়িয়ে দেখল কিছুই নেই।
মামারাও বেশ উচ্চ বিত্তের মানুষ কিন্তু হলে কি হবে এ ভাবে কত দিন চলা যায়? বাবা আর মামার সাথে পরামর্শ করে কাগজপত্র গুছিয়ে কাবুলে এসে ব্রিটেনের দূতাবাসে ভিসার দরখাস্ত জমা দিয়ে এলো। দূতাবাস থেকে একটা তারিখ বলে দিল, পাসপোর্ট নেয়ার জন্য। সময় মত এসে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেখল ভিসা হয়েছে। বাড়িঘর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বলে একেবারে তিন বছরের ভিসা।

শুরু হল লন্ডন আসার প্রস্তুতি। বেশী দেরি করা যাবে না, যত তারা তারি সম্ভব দেশ ছেড়ে আসতে হবে। আমেরিকানদের মতিগতি বলা যায় না। একদিন সত্যি সত্যি মায়ের কান্না বাবার নিষেধ উপেক্ষা করে নিজের নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র নিয়ে চলে এলো লন্ডনে। কাবুলে যাদের সাথে লেখাপড়া করেছে তেমন এক বন্ধু কাদের হেকমত বেশ অনেকদিন আগেই লন্ডনে এসেছিল। আরও কয়েকজন মিলে স্টেপনি গ্রিনের কাছে গ্লোব রোডে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। সোলায়মানের টেলিগ্রাম পেয়ে সময়মত হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। পথে টিউবে পাশাপাশি বসে এত দিন পরে দেখা হওয়া দুই বন্ধুর অনেক কথা। তার মধ্যে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ঘোলাটে ও অস্থির পরিস্থিতিই প্রধান। কাদের বেথনেল গ্রিনে টেসকো সুপারস্টোরের পাশে এক কাশ্মীরী দোকানের সামনের ফুটপাথে জুতা স্যান্ডেল বিক্রি করে। সেও আফগানি এক সম্ভ্রান্ত উচ্চ বিত্ত পরিবারের ছেলে কিন্তু পৃথিবীর দুই শক্তির উন্মত্ততার খেলায় তাদের ভাগ্যের বিড়ম্বনার জন্য আজ এই অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
কয়েকদিন যাবার পর সোলায়মান বলল দোস্ত,
আমার কি ব্যবস্থা করতে পারবে?

এসেছ যখন কিছু করতেই হবে, এ নিয়ে তোমার ভাবনার কিছু নেই, তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে, আমাকে সাহায্য করবে। আমি বড্ড নিঃসঙ্গ বলে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তুমি কয়েক দিন এদিক ওদিক ঘুরে দেখে শুনে চিনে নাও তারপরে আমার সাথে দোকানে থাকবে। তোমাকে দোকানে রেখে আমি মাল আনতে গেলাম বা কখনও তুমি মাল নিয়ে আসলে আর আমি দোকানে রইলাম। কি, পারবে না?
কি বল দোস্ত পারব না কেন এযে সোনায় সোহাগা! আমি ভাবতেই পারছি না! আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা তোমার মঙ্গল করুন।
হিসাব নিকাশের জন্য তুমি কিচ্ছু ভাববে না, লাভ লোকসান সব আধাআধি! ঠিক আছে?
আমার যে কোন চালান নেই? আমি কি করে তোমার সাথে ব্যবসা শেয়ার করব?
কে বলল চালান নেই, তোমার এই মাথার মগজগুলিকে তোমার চালানে বদলে নিলেই দেখবে তোমার কত চালান!
বলে একটু হেসে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল তুমি এসেছ বলে আমি যে কত খুশী হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না।
আভিজাত্য

কাদের তুমি মহান! ঠিক আছে আমি তোমার সিদ্ধান্ত জেনে অতি আনন্দিত। তাহলে বাড়িতে বাবাকে একটা চিঠি দিতে হয়।
তা জানিয়ে দাও, আর চিঠিতে বলে দিও আমার বাড়িতে যেন একটু সংবাদ দেয়।
হ্যাঁ হ্যাঁ তা অবশ্যই বলব।

২।
কাদের আর সোলায়মান দুই বন্ধু মিলে বেশ চালিয়ে যাচ্ছিল। দুই জনে মিলে কাস্টমর ডাকাডাকি করে বিক্রি করে, মাল কিনে আনে আবার সারা দিনের শেষে সন্ধ্যা হলে মালামাল গুছিয়ে কার্টুনে ভরে কাশ্মীরী দোকানের পিছনে এক কোণে রেখে চলে যায়। যাবার সময় প্রায়ই পাশের টেসকো সুপারস্টোর থেকে রেডি নান এবং আর একটু এগিয়ে পাকিস্তানি কাবাবিশ দোকান থেকে গ্রিল চিকেন কিংবা শিক কাবাব বা ভিন্ন কিছু কিনে দুই বন্ধু পাশাপাশি হাটতে হাটতে ভবিষ্যতের কল্পনার জাল বুনতে বুনতে গ্লোব রোডের বাসায় এসে খেয়ে শুয়ে পরে আর সারা দিনের কঠিন যুদ্ধের পর ক্লান্ত শরীর প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরে পরের দিনের প্রস্তুতি নিতে।
দুই বন্ধু মিলে বেশ চলে যাচ্ছিল।
ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যায় বৃষ্টির জন্য রাস্তায় কোন লোকজন ছিল না কাস্টমর আসার কোন সম্ভাবনা নেই মনে করে কাদের দোকান গুটিয়ে নিচ্ছিল আর সোলায়মানকে বলল তুমি টেসকো থেকে রুটি নিয়ে আস আমি দোকান প্যাক করছি। সোলায়মান বন্ধুর কথামত টেসকোতে যেয়ে নান রুটি, দুধ, দৈ এবং সকালের নাস্তার জন্য এক প্যাকেট কর্ণ ফ্লাক্স নিয়ে কাউন্টারের পাশে এসে হাতের ঝুরিটা নামিয়ে দেখল অপরূপা কাল কেশী এক সুন্দরী মেয়ে ওই কাউন্টারে কাজ করছে। পরনে টেসকোর নির্দিষ্ট পোশাক বলে বুঝতে পারল না এ কোন দেশী। তবে সার্টের পকেটে লেখা নাম দেখল ফাতেমা। যাক তাহলে এ মুসলমান। এর আগেও এসেছে কিন্তু কোনদিন দেখেনি, হয়ত ডিউটি ছিলনা কিংবা ভিন্ন কোন টিলে ছিল বলে দেখেনি। যথারীতি কিউ এগিয়ে যাচ্ছে আর যখন সোলায়মানের পালা এলো তখন সে এক এক করে পাশের ঝুরি থেকে তার জিনিসপত্র কনভেয়ার বেল্টে নামাচ্ছে আর মেয়েটির দিকে দেখছে। লক্ষ করল মেয়েটিও তাকে লক্ষ করছে। এক্সকিউজ মি, আমি কি জানতে পারি তুমি (ইংরেজি ভাষায় আপনির প্রচলন নেই তাই তুমি) কোন দেশের?
কেন?
নিতান্ত কৌতূহল।
একটু হেসে দিয়ে বলল-
তুমি কোন দেশের?
আমি আফগানিস্তান থেকে এসেছি, তুমি?
আমার মা বাবা এবং পূর্ব পুরুষ পাকিস্তানের তবে আমি এই দেশের।
ও আচ্ছা।
কথার ফাঁকে ফাঁকে ফাতেমা সোলায়মানের জিনিসপত্র স্ক্যান করছে আর ব্যাগে ভরছে।
সব কিছু স্ক্যান হলে দেখা গেল ওর ১২ পাউন্ড ৭২ পেনি দাম হয়েছে।
২০ পাউন্ডের একটা নোট বেল্টের উপর নামিয়ে রাখল আর যথারীতি ফাতেমা টিল থেকে ভাংতি ফেরত দিল।

সোলায়মান ভাংতি নেয়ার সময় আবার দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেল, একটু মিষ্টি হাসির সাথে ফাতেমা সোলায়মানের হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিল।
গুড নাইট, আবার দেখা হবে বলে সেদিনের মত সোলায়মান চলে এলো আর ফাতেমা পরের কাস্টমারকে এটেন্ড করতে মনোযোগ দিল।
এই ভাবে বেশ কয়েকদিন গেল। দোকান বন্ধ করার আগে সোলায়মান বলে দোস্ত তুই মালামাল গুছিয়ে নে আমি টেসকো থেকে আসছি। কোন দিন চা পাতা, কোন দিন চিনি কিছু না কিছু তো একটা কিছু লাগেই হোক না সে দুইজনের সংসার। এমনি একদিন সোলায়মান ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করে বসল-
আজ তোমার ডিউটি কয়টা পর্যন্ত?
এইতো আর মাত্র আধা ঘণ্টা আছে, ৮টায় শেষ হবে, কেন?
না, তেমন কিছু না। তোমার সাথে একটু আলাপ করতাম, এই আর কি!
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি কি আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবে?
আধা ঘণ্টা কেন, তুমি যদি বল এক বছরও পারব।
তুমি খুব দ্রুত এগিয়ে গেছ মনে হচ্ছে! আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ওই ডান পাশের এক্সিট এর বাইরে দাঁড়াও আমি শেষ করে আসছি।

৩।
ফাতেমার দাদার বাড়ি পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের (প্রাক্তন লায়ালপুর) খুরিয়ান ওয়ালায়। দাদা ওমর বখত পাকিস্তান ভারত স্বাধীনের পর এদেশে চলে আসে। এখানেই বিয়ে করে সংসার ব্যবসা করে বেশ অর্থ, নাম, যশ ও প্রতিপত্তি কিনে নেয় মানে সে তার ভাগ্যের কাছে থেকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিল। এখানেই জন্ম হয় একমাত্র ছেলে আবুল বখতের। এক সময় যখন সময়ের সাথে আবুল যৌবনের দরজায় পৌঁছে তখন অনেকদিন, অনেক বছর পরে ওমর বখত ফয়সালাবাদে ফিরে এসে দেখে তার এই এলাকার নাম আর লায়ালপুর নেই এটা এখন ফয়সালাবাদ হয়ে গেছে। খোদ বিলাতের বাসিন্দা নিজের ছেলের জন্য কনে খুঁজতে এসেছে, কম কথা নয়। তাদের পাশের এক গ্রামের মেয়ে রুখসানার সাথে ছেলের বিয়ে পড়িয়ে আবার পাকিস্তানে পাড়ি দেয়। ছেলেকে রেখে যায় বৌকে সাথে নিয়ে যাবার আয়োজনের জন্য এবং নিজের পিতৃভূমিতে কিছুদিন থেকে সবকিছু দেখেশুনে চিনে নেয়ার জন্য।
মাস ছয়েক থেকে বৌ এর কাগজপত্র ঠিকঠাক হলে একদিন তাকে নিয়ে আবার বিলাতে চলে আসে পূর্ব লন্ডনে বাবার ইস্ট হেমের বাড়িতে। রুখসানা বেগমের বাবা মায়ের সাথে দেখা করার জন্য হলেও অন্তত দুই বছরে একবার পাকিস্তানে যাতায়াত করতে হয়, সাথে আবুল বখতকেও যেতে হয়। রুখসানা বেগম একে একে ওমর বখতকে দুই নাতনি আর এক নাতি উপহার দেয় বলে তার মান এবং মর্যাদা শ্বশুরের কাছে অত্যন্ত বেড়ে যায়।
ফাতেমা সবার ছোট। বড় বোন কুলসুমের বিয়ে হয়েছে ওয়েস্ট হেমের আলী আসগরের সাথে আর মাঝে এক ছেলে হামিদ বখত। ওমর বখতের আপটন পার্কের এশিয়ান মুদি দোকানের ব্যবসা বেশ জমজমাট। ছেলে বড় হবার পর থেকে সে আর দোকানে বসে না। এর মধ্যে দিন বদলে গেছে অনেক। দোকান বড় হয়েছে, ব্যবসা

বড় হয়েছে আবুল বখত এখন আর খুচরা দোকানদারি করে না। বাবার কেনা দোকান ভাড়া দিয়ে আপটন পার্কের দক্ষিণ মাথায় এক বিশাল পাইকারি দোকান বা ক্যাশ এন্ড ক্যারি দিয়ে ছেলে আর জামাইকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী কুলসুম আর হামিদ বখতের পড়ালেখা স্কুলের গণ্ডি পর্যন্তই শেষ কিন্তু ফাতেমা আবার এর বিপরীত। সে স্কুল ডিঙ্গিয়ে কিং’স কলেজে একাউন্টিং পড়ছে আর নিজের হাত খরচের জন্য টেসকোতে পার্ট টাইম মানে দিনে চার ঘণ্টা করে সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা কাজ করছে।

৪।
ফাতেমার নির্দেশ অনুযায়ী মেইন এক্সিটের বাইরে দাঁড়িয়ে সোলায়মান শুধু ঘড়ি দেখছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল এখনও ফাতেমা আসছে না! তাহলে কি ও আমাকে ফাকি দিল? না, ওর চেহারা মুখ বলে না যে এই মেয়ে কেউকে ফাঁকি দিতে জানে। গোলাপের মত নিষ্পাপ যার মুখ সে কি করে একজনকে ফাঁকি দিবে? নানা কিছু ভাবছে সোলায়মান। এমন সময় হটাত দেখল মেইন এন্ট্রান্সের পাশে ফুলের ব্লকের পাশ দিয়ে ফাতেমা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। টেসকোর পোষাক চেঞ্জ করেছে বলে ও চিনতে ভুল করেছে।
আসতে বললাম আর ও ঠিক আসছে এখন কি বলব, কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করব এই সব ভেবে কিছুক্ষণের জন্য একটু হতবিহবল হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাতের ফুলটার অস্তিত্ব দেখে যাচাই করে নিলো, ফুলটা ঠিক আছে। ফাতেমা বেড় হয়ে এদিক ওদিক দেখেই সোলায়মানকে দেখতে পেল। চার চোখের মিলনের সাথে আবার এক টুকরো মিষ্টি হাসি বিনিময়।
কি ব্যাপার, কি বলবে বল
একটু ইতস্তত করে পিছনে লুকিয়ে রাখা ডান হাতে ধরা লাল গোলাপটা সামনে এনে ফাতেমার দিকে বাড়িয়ে বলল
I love you Fatema! তুমি কি কোথাও এনগেজড?
ফাতেমা একটু থতমত খেয়ে আস্তে করে গোলাপটা হাতে নিয়ে হাতের গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট গুলি থির থির করে কাঁপা কণ্ঠে বলল-
সম্ভবত আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম!
এইতো শুরু হল সোলায়মান আর ফাতেমার এক নতুন অধ্যায়। দেখতে দেখতে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেল কিন্তু কাদের কিছুই জানতে পারল না।
ওরা ভাবে আর কতদিন? লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, সারাটা দিন ছটফট করা, যতক্ষণ কথা হয় দেখা হয় ততক্ষণ একটা অজানা আতংকের মধ্যে থাকতে হয়। ফাতেমার রক্ষণশীল পরিবারের কারো চোখে পরে গেলে সর্বনাশের চূড়ান্ত কিছু ঘটে যেতে বিন্দুমাত্র দেরি হবে না। কতদিন এ ভাবে চলে? অবুঝ দুটি মনে কেউ কোন কিনারা পাচ্ছে না, কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না। ফাতেমা একবার না, দুইবার না অনেকবার বলেছে আমাদের যে পরিবার তাতে তাদের কেউ এই সম্পর্ক মেনে নিবে না! ফাতেমা সোলায়মনকে তার বাবা মা এবং দাদার বংশের কৌলীন্য সম্পর্কে ভাল করে জানিয়ে বলেছে এরা নিজ বংশের কৌলীন্য সম্পর্কে অতিরিক্ত খেয়ালী। কি জানি কি হয় আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে।

ওদের লুকিয়ে চুরিয়ে কথা হয়। ফাতেমার ডিউটি শেষ হলে পোষাক বদলে টেসকোর কাস্টমারের বসার জন্য যে বেঞ্চ আছে ওখানে বসে বা আড়ালে কোথাও দাঁড়িয়ে। তাতেও ভয়, যদি কেউ দেখে ফেলে! প্রেম! প্রেম কি আর ভূগোল মানে? সে কি আর অর্থ সম্পদ চায়? মান মর্যাদা বুঝে? সে তো হৃদয়ের ভিখারি!
ফাতেমা
শুনছি বল
চল আমরা লন্ডন ছেড়ে কোথাও চলে যাই!
কোথায় যাব? এটা ব্রিটেন, আমার নিখোঁজ সংবাদ যখন আমার পরিবার থেকে পুলিশকে জানান হবে তার দুই ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ আমাদের খুঁজে বের করে ফেলবে। জান এরা কি ভয়ংকর পুলিশ? তার চেয়ে তোমার বন্ধু কাদেরকে বলে দেখ সে যদি আমাদের কোন সাহায্যের পথ বের করে দিতে পারে!
তুমি এদেশের মেয়ে, তুমিই কোন পথ খুঁজে পাচ্ছ না, সে কি করবে? শুধু শুধু জানাজানি হবে! আচ্ছা বলত তোমাদের পরিবারে কে তোমাকে সবচেয়ে বেশে স্নেহ করে?
কেন?
না তাকে যদি বলে দেখতে পার এবং সে যদি কিছু করতে পারে!
না না সোলায়মান তা হবার নয়!
তাহলে?
তাহলে দেখি আরও কিছুদিন যাক, ভেবে দেখি।
ঠিক আছে তাই দেখ।

৫।
ফাতেমা অনেক ভেবে চিন্তে একদিন রাতে তার দুলাভাই দোকান থেকে ফিরে এলে তাদের এই কথা জানিয়ে একটা উপায় বের করে দেয়ার জন্য অনেক অনুনয় বিনয় জানাল। সব কিছু খুব মনোযোগের সাথে শুনে দুলাভাই তাকে উপায় বের করে দেয়ার জন্য আশ্বস্ত করে বলল তুমি কোন চিন্তা করনা আমি এর একটা ব্যবস্থা করব। শুনে আনন্দের আতিশয্যে সাথে সাথে সোলায়মানকে মোবাইলে সুসংবাদটা জানাল। ফাতেমা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে দুলাভাই এত সহজে তাকে সাহায্য করতে রাজী হবে। সে আজ একটা অসাধ্য সাধন করেছে মনে করে মনে মনে খুশীর জোয়ারে মুক্ত পায়রার মত নীল আকাশে উড়ছিল। সারা রাতে তার চোখে ঘুম নেই। শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে যেন এলো মোর দারে।
বেথনেল গ্রিন, গ্লোব রোড এবং ইস্ট হেমে দুটি নবীন এবং অবুঝ মন সময়ের অপেক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত গুনছে কখন সোনা ঝরা শুভ লগ্ন তাদের দুয়ারে উকি দিবে।
ব্রিটেনের অধিকাংশ সাধারণ বাড়ির মত ডুপ্লেক্স টাইপের এই বাড়ির এক তলার ফাতেমার রুমে সারা রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে ভোরের একটু আগে যখন দুটি চোখ ক্ষণিকের জন্য একটু এক হয়েছে ঠিক তেমনি সময় তার ঘরের দরজা খোলা এবং মানুষের মনের ষষ্ট ইন্দ্রিয়ের বিপদের একটা ইঙ্গিত পেয়ে ফাতেমার তন্দ্রা ভেঙ্গে দেখে তার মা দুটি হাত ধরে রয়েছে, দুলাভাই ধরে রেখেছে দুই পা। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার কথার শব্দ পাচ্ছে পিছনে। পাশে মাংস বানাবার চাপাটি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাই, এক মাত্র ভাই যার কাছে সেই

ছোট বেলা থেকে ছিল কত আবদার কত স্মৃতি জড়ান এই ভাইয়ের সাথে, সেই ভাই আজ তার গলায় চাপাটি ধরে রয়েছে! কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না। মা কি করে তার হাত দুটি এমন চেপে ধরে রেখেছে যে এক চুল পর্যন্ত নারার উপায় নেই। যে মা তাকে দশটি মাস পেটে ধরেছে আবার কত কি করে এত বড় করে তুলেছে সেই মা কি করে এ ভাবে তার হাত দুটি ধরে রেখেছে! বাবা কোথায়? মাথা ধরে রেখেছে যে সেই কি তাহলে বাবা? সব সম্পর্ক কি তাহলে এই দুলাভাইকে কাল রাতে বলার পর থেকেই শেষ হয়ে গেল? এই বংশের আভিজাত্য কি রক্তের সম্পর্কের চেয়েও কঠিন? ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, কত কথা বলছে, প্রাণের কত আকুতি, বেঁচে থাকার কত অনুনয় কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। পিছন থেকে বাবা ধমকে বলে উঠল কি দেখছ? ছুড়ি চালাও। সাথে সাথে দেখল ভাই নিচু হয়ে চাপাটিটা তার গলা বরাবর এনেছে আর অমনিই ফাতেমার গলা খুলে গেল “মা তুমিও আমাকে বাঁচতে দিলে না?” সাথে সাথেই একটা অস্পষ্ট গোঙ্গানির শব্দের সাথে সব শেষ।

৬।
গত রাতেই ফাতেমা এত আনন্দ নিয়ে কথা বলল আর আজ সারাটা দিনেও তার কোন একটা কল নেই কেন? কোন কল ধরছেও না, কি ব্যাপার? সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ১০০ বার কল করেও যখন কোন সারা পেল না। সারা রাত একটুও চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকালে আবার ফোন করে কোন সারা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে পুলিশে জানাল। আমার বন্ধুর কোন খোঁজ পাচ্ছি না তাকে কল করেও ফোন ধরছে না। তোমরা কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
ঠিকানা নিয়ে সেই সকালেই পুলিশ আবুল বখতের ইস্ট হেমের বাড়িতে ডগ স্কোয়াড সহ হাজির। বারিতে কেবল হামিদ বখত ছাড়া আর কেউ নেই। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কুকুর তার বসের হাত থেকে ছুটে যেখানে ফাতেমার দেহ লুকিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছে সেই কার্পেটের কাছে শুঁকছে আর ঘেউ ঘেউ করছে।
কি ব্যাপার? রক্তের তাজা গন্ধ কেন এই ঘরে?
কার্পেট সরিয়ে দেখা গেল মেঝের আলগা কাঠ। কাঠ সরিয়ে মাটি একটু সরাতেই দেখা গেল কাল রক্তে মাখান ফাতেমার নিথর দেহ কুণ্ডলী করে কোন রকম চাপা দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
হামিদ বখত পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছিল কিন্তু এই ব্রিটেনের রয়াল পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাই কি সম্ভব?
তোমার মা বাবা কোথায়?
ওরা কাল রাতে পাকিস্তান চলে গেছে।
দুলাভাই?
সে লিভারপুলে গেছে আজ সকালে।
কিসে গেছে কার নিয়ে নাকি ট্রেনে?
ট্রেনে।
পুলিশ হাতের ঘড়ি দেখে বলল এখনও লন্ডন ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেনি।
সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন এবং লিভারপুলের মাঝের স্টেশন রেডিং এ ফোন করে জানিয়ে দিল লন্ডন থেকে যত ট্রেন রেডিং স্টেশনে থামবে তার সব চেক করে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আলি আসগর নামের যে লোক পাবে তাকে এরেস্ট করে লন্ডনে পাঠিয়ে দিন, সে একজনকে খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে।

চালতে বাড়ির ভূত

পরীক্ষা শেষ হলেই গ্রামে যাব বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ওখানে শরিফ চাচা, চাচাত ভাই কায়েস আর মোল্লা আছে তাদের সাথে জমানো আড্ডা হবে, টো টো করে ঘোরাঘুরি হবে, মুরগী চুরি করে চড়ুইভাতি হবে। আরও কি

হবে আগেই বলতে পারছি না। শরিফ চাচা আগেই বলে দিয়েছিল পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই যেন চলে যাই। কিন্তু সমস্যা হলো এই সময়ে আমার বাবা গ্রামে যাবার মত কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরামর্শটা আমিই দিয়ে দিলাম। দাদু একা রয়েছে, আমি গিয়ে ওখানে কয়েক দিন থেকে জমিজমার ঝামেলা যা আছে সেগুলি সেরে দাদুকে নিয়ে আসব।
মা’কে নিয়ে আসবি?
হ্যাঁ, তাই ভাবছি!
মাও রাজী হলেন।

ব্যাস আর দেরী কিসের? সেইদিনই দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়ব এমন ইচ্ছা জানালাম। আচ্ছা ঠিক আছে।
গ্রামে যাত্রার বিল পাশ।
তখন গাবতলি, ধামরাইর আগে নয়ার হাট এবং মানিকগঞ্জের পরে ত্বরা ঘাটে ব্রিজ ছিলনা। দুই নৌকা একত্র করে বানানো ফেরিতে পাড় হতে হতো। সরাসরি কোন বাসও ছিল না। গাবতলি থেকে নয়ার হাট আবার নয়ারহাট পাড় হয়ে মানিকগঞ্জের ত্বরা ঘাট এবং সবার শেষে ত্বরা ঘাট থেকে আরিচার বাসে উঠে বানিয়া জুরি নামতে হতো। গাবতলি থেকে বাসে উঠে বানিয়া জুড়ি নেমে বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে ৫/৬ ঘণ্টা লেগে যেত। দুপুর ১টায় রওয়ানা হলে সন্ধ্যা ৬/৭টার মধ্যে বাড়ী পৌঁছানো যায়। দিনে দিনে পৌছলে একা একা রাতের ভয় থাকে না। বানিয়া জুড়ি থেকে সোজা দক্ষিণে ঝিটকার পথে হেটে যেতে হয় প্রায় ৪ মাইল এবং এর মধ্যে গাং-ডুবিতে খেয়া পাড় হয়ে চালতে বাড়ি পর্যন্ত কোন জনমুনিষ্যির দেখা মিলে না। দিনের বেলা যদিওবা দুই একজন পাওয়া যায় কিন্তু সন্ধ্যার পর সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। চালতে বাড়ি আর ষোল ধরার মাঝে চাপা খালটা পাড় হয়ে শ্মশানটা একটা ভয়ংকর জায়গা। দিনের বেলাই গা ছম ছম করে। পাশের বাঁশ ঝাড়ের ও পাশে চোখ গেলেই মনে হতো এই বুঝি কে আসছে ঠক ঠক করে লাঠি হাতে। শ্মশান পাড় হয়ে প্রায় আধা মাইল দূরে পারাগ্রাম নামে এক গ্রাম শুরু হয়েছে এবং এখান থেকে প্রায় আধা মাইল পথ পাড়ি দিলে আমাদের ছয়য়ানি গালা গ্রামের বিশ্বাস বাড়ি। শুনেছি এই খালের উপরে বাঁশের সাকোতে উঠা মাত্রই কাওকে ঘাড় মটকে দেয় এবং যার সাথে যেমন সুবিধা করতে পারে তেমন কিছু করে বসে। ওখানে দিনে দুপুরে নানা কিছু শোনাতো যায়ই অনেক কিছু নাকি দেখাও যায়। যদিও আমার কানে বা চোখে কখনও কিছুই পড়েনি। অবশ্য এ কথা ঠিক যে আমি কখনও একা এই পথে চলাফেরা করিনি। আর একা না হলে নাকি ভূত বা পেত্নী বা জ্বিন পড়িরা কাউকে কিছু বলার মত রুচি বোধ করে না।

সেদিন মা বেগুন দিয়ে ইলিশ মাছ দোপিয়াজি করেছিলেন। প্রিয় সেই ইলিশ দোপিয়াজি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়েই দুপুর একটায় বের হলাম। মা বাম হাতের উলটো পিঠে মুখ মুছে দিলেন এক কোয়া রসুন পকেটে ভরে দিতে চাইলেন কিন্তু পকেটে ওই রসুন বয়ে বেরানোতে ঘোর আপত্তির মুখে মার এই আবদার টিকল না। তবে এক টুকরা সুপারি মুখে দিয়েই বের হতে হলো। ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে যাচ্ছিস ওখানে চালতে

বাড়ির পাশ দিয়ে হেটে যাবি সুপারিটা অন্তত মুখে দিয়ে বের হ। একা একা যাবি না। দরকার হলে একটু অপেক্ষা করবি, কারো সাথে শ্মশান পার হবি। একা শ্মশান ঘাট পার হবি না। খবরদার। এমনি কিছু উপদেশ দিয়ে মা দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিলেন। হাতে একটা ব্যাগ। তাতে কয়দিন থাকার মত কাপড় চোপড় আর দাদুর জন্য মা কিছু খাবার দিয়েছেন তাই নিয়ে বের হলাম।

গাবতলি এসে ফেরিতে পাড় না হয়ে নৌকায় পাড় হয়েই দেখি নয়ারহাট গামী কাঠের বডি এক মুড়ির টিন স্টার্ট দিয়ে একটু এগুচ্ছে আবার দুই পা পিছনে আসছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। বেশ অনেক সিট ফাকা আছে। দেখে শুনে জানালার পাশে একটা সিট দখল করে বসলাম। আধা ঘণ্টা লেগে গেল বাস ভর্তি হতে। প্রায় আড়াইটার দিকে বাস ছেড়ে দিল এবং হিসেব অনুযায়ী সাড়ে তিনটায় নয়ারহাট পৌঁছল। এখানেও ওই আগের মত ফেরিতে পার হবার সময় নেই, নৌকায় করেই বংশী নদী পার হয়ে দেখি আমিন বাজারের মত একটা বাস সামনে এক পা যাচ্ছে আবার দুই পা পিছনে আসছে। এই মাত্র ছেড়ে যাচ্ছি এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে। তখন এমনি রেওয়াজ ছিল। বেশ ভাল কথা। বাসে উঠে বসলাম। একটু পরে বাস ভর্তি হলে ছেড়ে দিল। সুতি পাড়া আসার আগেই মুড়ির টিনের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। হেলপার কন্ডাকটর নেমে হ্যান্ডল ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে ক্লান্ত কিন্তু মুড়ির টিনের ইঞ্জিন কিছুতেই স্টার্ট করতে পারছে না।
ভাই আপনারা একটু ধাক্কা দিবেন?

ওরাতো এই কথা বলল কিন্তু আমি ভাবছিলাম ভিন্ন কথা। সুতি পাড়া হয়ে বায়ে সুয়া পুরের রাস্তায়ই আমার নানার বাড়ি। বাস যদি এখানে বিগড়েই যায় তাহলে এমন কি ক্ষতি? পদব্রজে কুঠাধারা, নান্নার হয়ে রৌহা যেতে মাত্র এক ঘণ্টার পথ। যাত্রা পরিবর্তন করে নানার বাড়ি চলে যাই! কাল সকালে এখান থেকে বাড়ি যাব! হ্যাঁ তাই ভাল কোন হাঙ্গামা নেই। কিন্তু নানা বাড়ির আনন্দ যে ছোট মামা আর মামাত ভাই মুকুল- ওরা যে ঢাকায়! ওরা না থাকলে ভীষণ একা একা লাগবে। কি করা যায়? নাহ নানা বাড়ি যেয়ে কাজ নেই। দেখি না কি হয়!
ভাবছি এমন সময়-
ভাই আপনেরা একটু নেমে ধাক্কা দিলে স্টার্ট হইতে পারে, আসেন না ভাই
কি আর করা, আমার মত যাদের সন্ধ্যার আগে চালতে বাড়ির শ্মশানঘাট পাড় হবার তাড়া আছে তেমনি কিছু জোয়ান অতি আগ্রহ নিয়ে নেমে পিছন থেকে ঠেলতে শুরু করলাম। অল্পতেই স্টার্ট হয়ে গেল। আবার সবাই উঠে পরলাম। মুড়ির টিন চলতে শুরু করল। আমার যাত্রা বিরতি করে নানার বাড়ি যাবার প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল!
জাগীর পর্যন্ত মোটা মুটি কোন উপদ্রব ছাড়াই আসতে পারলাম। জাগীর ব্রিজ পাড় হয়েই ঠাস করে এক বিকট শব্দ করে চাকা পাংচার হয়ে থেমে গেল।
এই কি হোল?
একটু বসেন তেমন কিছু হয় নাই চাকা পাংচার হইছে চাকা বদলি করলেই সব ঠিক হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে চাকা বদল কর।
ইঞ্জিন বন্ধ আর চাকা বদলির জন্য বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে সবার অপেক্ষা।

বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বাসের ছাদ থেকে চাকা নামিয়ে সে আবার বদল করা হলো এবং পুরাতন চাকা ছাদে উঠিয়ে নিয়েই উঠেন উঠেন তাড়াতাড়ি উঠেন!
এবার ত্বরা ঘাটে পৌছাতেই প্রায় ছয়টা বেজে গেল। হাতের ঘড়ি দেখছি। এখনও যদি কোথাও দেরি না হয় তাহলেও অন্ধকার হবার আগে কিছুতেই চালতে বাড়ি পাড় হতে পারব না। কি করি? কেন যে মামা বাড়ি গেলাম না, এখন নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে। ওদিকে আবার ইলিশ মাছ খেয়ে বের হয়েছি। কি জানি ইলিশের গন্ধ গায়ে লেগে রয়েছে কি না কে জানে! শ্মশানের ভূত পেত্নীরা নিশ্চয়ই ইলিশের গন্ধেই কোলাকুলি করতে চাইবে!
ভাবছি কি জানি হয়তো বানিয়া জুরি থেকে কিংবা গাং ডুবি খেয়া ঘাট থেকে ঝিটকা গামী কাউকে পাব। তাহলে আর কোন চিন্তা থাকবে না। কিন্তু যা ভাবা যায় সবসময় তা নিজের প্রয়োজনে বাস্তব হয়ে উঠে না। আজ এখানে আমার বেলায়ও তাই হলো। ধলেশ্বরী পাড় হয়ে এ পাড়ে এসে বাস ছাড়তেই প্রায় সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যে বানিয়া জুরি নেমে দেখি সূর্য ডুবি ডুবি করছে এখনও সন্ধ্যার অন্ধকার হতে কিছু সময় নিবে তবে আকাশে একাদশী কিংবা দ্বাদশীর একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মনের মধ্যে একটুখানি ভয়ের ছায়া দেখা যেতে চাইল কিন্তু তারুণ্যের অহংকারে সে ভয় এক ঝারা দিয়ে বিদায় করে দিলাম। বানিয়া জুরিতে দোকানে এসে এক প্যাকেট স্টার সিগারেট আর একটা ম্যাচ কিনলাম। শরিফ চাচার কাছে শুনেছি ভূত পেত্নীরা আগুন দেখে ভয় পেয়ে কারো কাছে আসে না। আর লক্ষ করলাম আমার গন্তব্যের দিকে বা আশে পাশে যাবার মত কেউ আছে কি না। সিগারেট ম্যাচ নিয়ে ব্যাগে রাখতে গিয়েও রাখলাম না কি জানি যদি কিছু হয়েই যায় তাহলে ব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি বের করা যাবে না। তারচেয়ে পকেটে রাখাই ভাল। পকেটে ভরে ২/৪ মিনিট দাঁড়িয়েই রইলাম কিন্তু যা খুঁজছি তেমন কাউকে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত একাই রওয়ানা হলাম। দোয়া কালাম যা জানা ছিল মনে মনে সব পড়ছি আর বুকে ফু দিচ্ছি।

যখন অন্ধকার পুরোপুরি হয়ে এসেছে আর চাদের আলো ছড়াতে শুরু করেছে এমনি এক সময় গাং ডুবি খেয়া ঘাটে পৌঁছলাম কিন্তু পৌঁছেই দেখি খেয়া নৌকাটা একটু আগে ঘাট ছেড়ে প্রায় মাঝ গাঙ্গে চলে গেছে। দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ওপাড়ে নামিয়ে আবার এপাড়ে আসার মত দুই এক জনকে নিয়ে নৌকাটা এসে ঘাটে ভিড়ল কিন্তু এই এতক্ষণেও আর একজন কেউ এলো না যে কিনা আমার সাথে ওপাড়ে যাবে। মনটা একটু খারাপ হয়ে এলো। কিছু করার নেই। এই এলাকায় চেনা জানা কেউ নেই বা এখনকার মত মোবাইল ফোনও হাতে নেই যে শরিফ চাচাকে ফোন করে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বলব! আছে শুধু মাত্র এক এই মাঝি উপেন কাকা। কিন্তু তাকে বলা মানে তারুণ্যের অপমান করা। না কিছুতেই উপেন কাকাকে বলা যাবে না আমাকে শ্মশান ঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসুন। যদিও প্রায়ই এই পথে আসা যাওয়া হয় বলে কাকা আমাকে ভাল করেই চিনে, গালার বিশ্বাস বাড়ির ছেলে। সে শুধু বলল এত দেরি করলে কেন, আর একটু আগে আসতে পারলে না? এসেছিলাম কাকা কিন্তু পথে দুইবার বাস নষ্ট হয়ে দেরি হয়ে গেল।
ও আচ্ছা, আমিও এইতো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যাব, রাত হয়ে গেছে অনেক।
তখন এমন সময়েই গ্রামে রাত হয়ে যেত।

খেয়া থেকে নেমে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। দূরে দূরে গ্রামের কোন কোন ঘরে দুই একটা বাতি দেখা যাচ্ছে একটু পড়েই হয়তো নিভে যাবে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজলে কি হবে গ্রামের হিসাবে রাত প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। যদিও চাঁদের আলো না থাকলে অন্ধকার হয়ে যেত এতে কোন সন্দেহ নেই। চাঁদের আলোতে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। ওইতো ষোল ধরার খালের বাঁশের সাকোর বাঁশ দেখা যাচ্ছে, জোসনার আলো পড়ে বেশ চিকচিক করছে। সাকোর কাছে আসতেই সারা গায়ের লোম খারা হয়ে গেল গায়েও কেমন যেন ছমছম করা ভাব এলো, সারা গায়ে একটু একটু ঘাম হচ্ছে মনে হলো। দাঁড়ালাম। একটা সিগারেট জ্বালালাম। একটা টান দিয়ে হাতের ব্যগটার বেল্ট টেনে বড় করে গলায় ঝুলিয়ে নিলাম যাতে করে সাকোর উপরে হ্যান্ডল ধরার জন্য একটা হাত ফ্রি থাকে। ঠোঁটে শক্ত করে সিগারেট চেপে ধরলাম। সাকোর উপরে উঠেছি। একটু একটু করে পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রথম বাঁশটা যেখানে শেষ হলো সেখানে পরের বাঁশে পা দিতে গিয়ে একটু উপরে ছিল বলে পায়ে হোঁচট খেয়ে এক ঝাঁকি লাগল আর ওতেই ঠোঁট থেকে সিগারেট পড়ে গেল। এক হাতে প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালান সম্ভব নয়। ভাবলাম সাঁকোটা পাড় হয়েই আর একটা সিগারেট জ্বালাতে হবে কিন্তু মনে হলো আমার পিছন দিকে কে যেন সাঁকোতে উঠেছে। মনে করে দেখলাম সাঁকোতে ওঠার আগে আমার পিছনে যতদূর দেখা যায় তাতে কাউকে দেখিনি যে এত তাড়াতাড়ি সাঁকোতে উঠতে পারবে। সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপছে বুঝতে পারছি। পিছনে তাকাবার সাহস নেই। তবুও দুই হাতে শক্ত করে সাকোর হ্যানডেলের বাঁশ ধরে ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি ওপাড়ের দিকে। শূন্যের উপরে ভূতের শক্তি বেশী থাকে। যে কোন সময় এক ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবে এই অপেক্ষায় আছি। নিচে পানি বেশি নেই, খুব বেশি হলে কোমর পর্যন্ত হতে পারে। ঘার মটকে খালের কিনারার কাদায় পুতে রাখার জন্য এই টুক পানিই যথেষ্ট।

অনেক কিছু মাথায় আসছে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই করতে পারছিনা তবে পা গুলি ঠিক ভাবেই চলছে কিছুটা বুঝতে পারছি। এর মধ্যে পায়ে পায়ে প্রায় ওপাড়ে এসে পড়েছি। কি যেন পানিতে পড়ার শব্দ পেলাম। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে তাকালাম। পিছনে বা পায়ের নিচে তাকাবার সাহস নেই। জোড়ে জোড়ে কালাম পড়ছি কিন্তু কি পড়ছি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না। জোসনায় সামনে বেশ অনেক দূর দেখা যাচ্ছে। খালের বাম পাশে কালীবাড়ি, এপারে বাঁশ ঝাড়ের পাশে বুনো গাছের লম্বা চিকন জংলা ভিটা, এই ভিটার পাশের রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখলাম না। এক লাফ দিয়ে এ পাড়ে নেমে এলাম। লাফ দেয়ার সময় পানিতে আবার কি যেন পড়ল। নেমে এসে বুঝলাম জুতায় লেগে থাকা ঘাটের কিছু কাদার চটা পড়েছে। এর আগের বারেও তাই পরেছিল।

একটু বায়ে এসে খালটা আবার ডানে ঘুরেছে। এ পাড় দিয়ে আমার রাস্তা ওপাড়ে কালীবাড়ি। কালীবাড়ির টিনের চালা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আর একটা সিগারেট জ্বালালাম। দুই টান দিয়ে বেশ কিছু ধোয়া ছেড়ে সামনে হাঁটছি। প্রায় এক’শ হাত এসেছি হঠাৎ করে সামনে ডান দিকে জংলা ভিটায় কয়েকটা লম্বা দেবদারু গাছের দিকে চোখ পড়তেই পা থেমে গেল। চিকন একটা ভয়ের রেখা মেরুদণ্ডে বেয়ে কাঁধ থেকে চিন চিন করে পায়ের পাতা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। পা আর এগুতে চাইছে না। মুখ এবং পিঠের ঘাম হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেল। সামনে আবার তাকালাম দেখলাম গাছের মাথার দিকে কে যেন মাথা দুলিয়ে হাসছে আর হাত দিয়ে ইশারায় কাছে ডাকছে। আয়! আয়! আয়! কাছে আয়!
কিন্তু অত উপরে উঠবো কি করে? আর ডাকছে বলেই কি যেতে হবে নাকি?

ভয় পাচ্ছি কিন্তু এটাও বুঝতে পারছি এখানে ভয় পেলে চলবে না। আশে পাশে কেউ নেই যে গলা চড়িয়ে ডাকব! আবার দাঁড়ালাম। সিগারেট জ্বলছে। টান দিয়ে আবার আগুনের অস্তিত্ব নিশ্চিত হলাম। হাত দিয়ে পরখ করে দেখলাম তাপ লাগছে। শরিফ চাচা শিখিয়েছে আগুন থাকলে কোন ভয় নেই। তবুও নির্ভয় হতে পারছিলাম না। সিগারেট শেষ হয়ে আসছিল এটার আগুন দিয়েই আবার আর একটা জ্বালালাম। আগুনের জন্য সিগারেট জ্বালাচ্ছি সিগারেটের জন্য নয়। এখান থেকে কাওকে ডাকলে কোন লাভ নেই, আধ মাইলের মধ্যে কোন বসতি নেই। পারাগ্রামের ওই মাঝামাঝি যাবার পর বসতি শুরু হয়েছে। কি করি? কি করি? একটু একটু বাতাস আছে তবুও ঘামে জামার নিচে গেঞ্জি ভিজে গেছে। নাক মুখ দিয়ে ফোটা ফোটা পরতে চাইছে। সার্টের হাতায় মুখ মুছে নিলাম একবার। আবার ভাবছি কি করি? হঠাৎ একটু জোড়ে বাতাসের ঝাপটা এলো আর ওই যিনি ইশারা করে ডাকছিলেন যেখানে যে পাতা সহ দেবদারুর ডাল ছিল তাতে নিচে থেকে একটা বেত গাছের পাতা বেয়ে উঠে এমন করে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে যে বেতের চিকন পাতা একটার পর একটা মিলে নুয়ে এসে মানুষের মাথার মত আকার হয়েছে আর দেবদারুর ডালটা হাতের মত আকার ধরে ঝির ঝির বাতাসে দুলছে আর তার উপরে চাঁদের জোসনা পড়ে চিক চিক করছিল যাতে মনে হচ্ছিল মাথা ঝাঁকিয়ে হাত নেড়ে কাছে ডাকছে। বাতাসে ওটা সরে গিয়ে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

আরে ধুর! এই দেখে এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলাম? মনে হলো বুক থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেল। তবুও আস্তে আস্তে কাছে এসে নিশ্চিত হলাম। এবার আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে প্রায় দৌড়ের মত এগিয়ে যেয়ে যেখানে বসতি শুরু হয়েছে সেখানে ডান পাশে নিমাই বাবুর বাড়িতে উঠে ডাকলাম, নিমাই কাকা বাড়ি আছেন?
অজ গ্রামে এর মধ্যেই রাত দুপুর হয়ে গেছে। ডাকাডাকির সারা পেয়ে নিমাই কাকা জবাব দিল, কে?
কাকা, আমি শরিফ চাচার ভাতিজা, কাকা বাতিটা একটু জ্বালাবেন?
তুমি এত রাতে কোথা থেকে এলে?
সে অনেক কথা কাকা, একটা বাতি জ্বালান সব বলছি
আচ্ছা একটু সবুর কর
কাকা উঠে হাতিয়ে দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছেন না, দিয়াশলাইটা যে কোথায় রাখলাম পাচ্ছি না
লাগবে না কাকা এই যে আমার কাছে দিয়াশলাই আছে
কাকা এবার দরজা খুললেন
পায়ে পায়ে এগিয়ে কাকার দরজার কাছে গিয়ে কাকার হাতে দিয়াশলাই দিলাম, কাকা একটা কুপি বাতি জ্বালালেন। একটা পিড়িতে বসলাম কাকাও বসল। বুকের ধড়ফড়ানি এখনও যায়নি। তাই দেখে
তুমি অমন করছ কেন, কোথা থেকে এত রাতে এসেছ, কোথায় গিয়েছিলে, ভয় পেয়েছ নাকি?
কাকার এক সাথে এতগুলি প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে আস্তে আস্তে সমস্ত ঘটনা খুল বললাম। শেষে বললাম কাকা আমাকে একটু বাড়ি দিয়ে আসেন।
কাকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন
চলো।

ব্লগিং এর মূলমন্ত্র

এই ছবিটি লক্ষ করে দেখুন এখানে একটা ব্লগে যা যা প্রয়োজন বা ব্লগিং করতে যেসব উপাদান দরকার তার অনেক কিছুই লিখা রয়েছে।

আমরা একটা ব্লগে কি চাই?

সবাইকে এই কথাটাই মনে রাখতে হবে ব্লগিং কোন পেশা নয়। ব্লগিং করা সবারই একটা নেশা। এখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে সহ অবস্থানটাই, সবার আগে বিবেচ্য। এখানে যে যা পারছে যে যা ভাবছে তা অন্যের কাছে প্রকাশ করে ছোট্ট একটু মতামত চাইছে। নিজের চেয়ে জ্ঞানে গুণে বড় বা নিজের সমসাময়িক এমন সবার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছে। তবে এখানে লিখতে লিখতে যে কেউ কোনদিন হুমায়ুন আহমেদ বা ইমদাদুল হক হয়ে যাবে না, তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে?

এখানে অনেকেই নয়; কেউ কেউ নিজের পরিচিতি অংশে নিজেকে এমন করে জাহির করছেন যেন, তিনি এ দেশের কোন একজন মস্ত মহাজন পদের জন্য নিজের বায়োডাটা সকলকে জানাচ্ছেন।

আসলে তার কোন প্রয়োজন আছে কি?
এখানে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন চরিত্রের, বিভিন্ন পরিবেশের, বিভিন্ন পেশার ব্লগার রয়েছেন। কেউ হয়ত বিমানের পাইলট, কেউ হয়ত জাহাজের ক্যাপ্টেন, কেউ সরকারি সচিবালয়ের উপ-সচিব, কেউ কৃষক, কেউ ডাক্তার আবার কেউবা নিতান্ত কাঠমিস্ত্রি কিংবা সাধারণ দোকানদার। অতএব সঙ্গত কারণেই সবার মন, মনন, চিন্তাশক্তি, ধ্যান ধারনা, লেখার গভীরতা, ভাবনার প্রশস্ততা যার যার মতই। এদের কাউকে বাদ দিয়ে কিন্তু আমরা ব্লগিং করতে পারব না। সবাইকে নিয়েই আমাদের এক সাথে চলতে হবে। এতে যদি আপনার ভাল না লাগে তাহলে কে কি করবে বলুন! এখানে কারোও সাথে কারও প্রতিযোগিতা কাম্য নয়। কেউ কারো সাথে প্রতিযোগিতার জন্য এখানে আসেনি। প্রতিযোগিতা হয় সমসাময়িকদের সাথে। অসম প্রতিযোগিতা সুন্দর বা সহনীয় হয় না। সবাই সবার সঙ্গে মিশবে, ছোটরা নতুনরা বড়দের কাছে অভিজ্ঞদের কাছে শিখবে, আলাপ আলোচনা করবে তবেই না হবে সহ অবস্থান।

আর প্রতিযোগিতা যেখানে আছে, যে ব্লগেই এমন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল বা আছে সেখানে কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছে কেউ? আর নিরপেক্ষতাই যদি না থাকে তাহলে আবার কিসের প্রতিযোগিতা? আমি ভাত রান্না করব, আপনি সুন্দর কবিতা লিখবেন, তিনি সুন্দর উপন্যাস লিখবেন, রহিম সুন্দর ফুল ফোটাবে, জামাল বাঘ শিকারের গল্প বলবে, কামাল রাঙ্গামাটি বা টোকিও বেড়াবার গল্প বলবে, মামুন খেজুরের রস খাবার ছবি দেখাবে, কোন সুন্দর বাগানের ছবি দেখাবে এদের কার সাথে কার প্রতিযোগিতা করবেন? কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েই কি আর ব্লগ চলে? কখনও চলেছে বলে বিশ্বাসও করি না।

ছবিতে দেখুন সবাই মিলেমিশে কি সুন্দর ব্লগিং করছে!

আপনি একে দেখে নাক সিঁটকাবেন, ওর ব্লগে যাবেন না, এর ব্লগে মতামত বা আপনার প্রতিক্রিয়া জানাবেন না, এতে আপনার মান রক্ষা হবে না, এমনকি আপনার লেখায় মতামত করলেও নিতান্ত ভদ্রতা করে হলেও তাকে চা নাস্তা খাওয়ানো তো দূরের কথা ধন্যবাদ টুকু জানাতে কৃপণতা করবেন তাহলে আর এক সাথে থাকার ইচ্ছা কেন? আপনি বড় পদে চাকরি করেন কিংবা বড় ব্যবসায়ী বলেই যদি আপনি বড় মানুষ হয়ে থাকেন, বড় কিছু লিখতে পারেন তাহলে তো আপনি ব্যবসায়িক সফল ব্যক্তি, আপনি আর কেন ব্লগিং করে সময় নষ্ট করবেন?

প্রতিযোগিতার মনোভাব ছেড়ে, ছোট বড়র বিভেদ ছেড়ে আসুন আমরা সবাই একই শব্দনীড়ের ছায়ায় বসে হাসি তামাশা করে, আনন্দ পাবার চেষ্টা করি, সময়গুলোকে রাঙ্গিয়ে তুলি। ক’দিনেরই বা এই জীবন! আসুন সবাই সবাইকে ভালবাসি। পরস্পরকে ভালবেসে নিজ অবস্থান থেকে শব্দনীড়কে রাঙ্গিয়ে তুলি।

সকলে আমরা সকলের তরে প্রবাদটি শুধু কথায় নয় কাজে ফুটিয়ে তুলি। ধন্যবাদ।
আবার দেখা হবে আগামীতে কোন আনন্দ উৎসবে যদি কেও হাসের মাংস আর খিচুরি রান্না করে নিমন্ত্রণ করে!

বারটি বছর পরে

আমি তো তেমনই আছি যেমন দেখেছিলে বারটি বছর আগে,
এখনও তোমার আশায় পথ চেয়ে বসে থাকি শিউলি তলে।
কোথা থেকে কি ঝড় বয়ে গেল, হয়ে গেল সব এলো মেলো,
কত যতনে গাঁথা কুড়ান ফুলের মালা খানি শুকিয়ে গেল।

যে মালা গেঁথেছিলাম শুধু তোমায় পরাব বলে আপন হাতে,
আকুলিত ছিল এ মন, বাঁধব ঘর তুমি আমি একই সাথে।
জোনাক জ্বলা কোন রূপালী রাতে হারিয়ে যাব দূর তেপান্তরে
গানে গানে বলব কথা দোলন চাঁপার গন্ধ ভরা আবেশে।

এখনও শিউড়ে উঠি ক্ষণে ক্ষণে ঝোপের পাশে পেঁচার ডাকে,
ভাবি একা আনমনে, এই বুঝি তুমি এলে আজ আমারই দ্বারে।
জানো না তো হায় তুমি রয়েছ তেমনি হৃদয়ের গহীনে
সাঁঝের আলো হয়ে, বল না তুমি এত দিন কোথায় ছিলে?

বারটি বছর আগে

তুমি কি এখনও আছ বারটি বছর আগের মত,
পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাক শিউলি গাছের নিচে?
রাতের আঁধারে ঘুম ভেঙ্গে জানালায় খুঁজে দেখ
জোনাকিরা আছে নাকি আমার পথের পাশে!

এখনও কি শিউরে ওঠ, যদি শোন লক্ষ্মী পেঁচার
ডাক, আলো আঁধারি আকাশে তারার মিছিলে
ফুটেছে কিনা একটু আলো আমার চলার পথে,
ভেবে সারা হও অনুক্ষণ জানালার ধারে বসে!

এখনও কি ভুলে যাও দিয়েছ কিনা কপালের
টিপে চন্দন, রেখেছ কি লুকিয়ে আমার চিঠি
বালিশের নিচে, চমকে ওঠ কি অকারণে
কি কথা বলবে আমায় একান্তে কানে কানে!

শুকতারা জেগেছিল তোমার প্রাণের পরশে,
কত কি বলেছিলে শিশির ঝরা আকাশের নিচে।
আরও কিছু বলনি আধো লাজে, আধো আভাসে
কিছু কি বলতে চেয়েছিলে হাত রেখে হাতে?

তোমার এই পথ চাওয়া হারিয়েছে কি আপন মনে,
শুনেছ কি, কি কথা বলে যায় হংস বলাকার সারি?
দুপুরের নির্জনে ঘুঘুর ডাকে নেমে আসে বিরহীর
অশ্রুজল, কত কথা জমে আছে বলবে গানে গানে!

কত নিশি গেছে এমনি করে তোমারই বিরহে
একা একা কথা বলে আকাশের তারার সাথে।
বকুলের কত গন্ধ ভেসে গেছে সাগরের ওপাড়ে
শুক সাড়ি উড়ে গেছে হায় দূর নীলিমার পানে!

বারটি বসন্ত কেটে গেছে তোমাকে না বলে
কেউ তো আসেনি আজো তোমার ছায়া নিয়ে,
তুমি কি তেমনি আছ, যেমন ছিলে বারটি বছর আগে?
দোলন চাঁপার গন্ধ হয়ে জোছনা ভরা রাতে।

নিয়তি তুমি কোথায়?

ট্যাংকার ‘নেপচুন’ জাহাজটি ত্রৈমাসিক রুটিন মেইনটেনেন্সের জন্য নিজ কোম্পানি গ্রে ম্যাকেঞ্জির রিজিওনাল হেড অফিস বাহরাইনের মোহাররেকে নিজস্ব স্লিপ ওয়েতে এসেছে। এটি ব্রিটিশ পতাকা বাহী এবং এর ধারণ ক্ষমতা বার হাজার টন। জাহাজটির পোর্ট অফ রেজিস্ট্রি লন্ডন হলে কি হবে এতে মোটামুটি চার পাঁচটা দেশের নাবিক কাজ করে। এদের সাথে রয়েছি বাংলাদেশের আমি এবং জসীম। আমরা এক সাথে লেখাপড়া করেছি এবং দেশ ছেড়ে দুই জনে এক সাথে রয়েছি বলে স্বাভাবিক ভাবে অন্তরঙ্গতা বা ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি। স্লিপ ওয়েতে সাধারণত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজের বটম, প্রপেলার, রাডার চেক করা আর টুকি টাকি যা মেরামত কাজ থাকে সেগুলি সেরে পাশের সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে লোড নিয়ে ভিন্ন কোন বন্দরে চলে যাই।

এবার প্রথম যে দিন সকালে এখানে এসেছি সে দিন স্লিপ ওয়ের লোকজনেরা আমাদের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন বার্কির দেয়া লিস্ট অনুযায়ী জাহাজের মেরামত কাজ করছে। সারা দিন আমরা জাহাজের নাবিকেরা সবাই যার যার কাজ অনুযায়ী ওদের দেখিয়ে দিচ্ছি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছি।

বিকেলে কাজকর্ম সেরে মানামা যেতেই হবে। ওখানে একটা দোকানে দারুণ সিঙ্গারা বানায়। এক শ ফিলসে একটা কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা আর তার সাথে যে চাটনি সেও দারুণ। তবে কোন পানি নেই, পানি খেতে হলে আলাদা সফট ড্রিঙ্কস কিনে নিতে হবে। জাহাজ যখনই এই ছোট্ট মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন আসে তখনই আমাকে ঐ সিঙ্গারার লোভে মানামা যেতেই হবে। কখনো শোর লিভ না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্য যেই যাক তাকেই বলে দিতাম আমার জন্য সিঙ্গারা নিয়ে এসো। এক বার এক এক করে পাঁচ প্লেট খেয়েছিলাম। আজও সে কথা মনে হলে হাসি পায়। জাহাজে শুধু মাত্র বাংলাদেশি রান্না বাদে নুন মরিচ মশলা ছাড়া পাঁচ মিশেলি যেমন কখনো ইংলিশ, কখনো ইটালিয়ান কিংবা গ্রীক। এই সব রান্না খেয়ে কি আর বাঙ্গালির মন ভরে? তাই যখন এই উপ সাগরের পাড়ে যেখানে জাহাজ যায় খুঁজে বেড়াতাম কোথায় বাংলাদেশি বা ভারতীয় বা নিদেন পক্ষে পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট আছে। অবশ্য অনেক দিন যাতায়াত করতে করতে আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল কোথায় কি আছে। জাহাজ থেকে শোর লিভ পেলেই নুন মরিচের স্বাদের আশায় ছুটে যেতাম ওই সব রেস্টুরেন্টে।

যাক, যা বলছিলাম। এবার প্রথম দিন বিকেলে বাইরে যাবার জন্য জসীমকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজের গ্যাং ওয়েতে এসে নিচে নামার সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছি এমন সময় ক্যাপ্টেন পিছন থেকে ডাকল। ফিরে দাঁড়ালাম। শোন, ওই যে ডেকের উপরের ব্রিজের নিচ দিয়ে যে পানির লাইনে লিক হয়েছিল তুমি ডেভকন দিয়ে মেরামত করেছিলে মনে আছে? হ্যাঁ থাকবে না কেন, এইতো সেদিনের কথা। তা হলে কাল ওয়ার্কশপের লোকজনেরা আসার আগে ওই ডেভকনের প্রলেপ সরিয়ে দিও যাতে ওটা ওয়েল্ডিং করে নেয়া যায়। আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালেই করে ফেলব। বলে নেমে গেলাম। যাবার পথে জসীমের সাথে নানা ধরনের গল্প। ওর ভয়েজ শেষ করে দেশে ফেরার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ও চাইছে আরও কিছু দিন থেকে আরও কিছু ডলার সাথে নিয়ে যেতে। ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছি দেরি করে কি হবে তার চেয়ে তুই এবার চলে যা, আবার না হয় তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি! ওদিকে তোর বৌ অপেক্ষা করছে। না, ও কথা সে মানছে না। যাক, না মানলে আমি কি করব? আমার যেতে অন্তত আরও মাস খানিকের মত দেরি আছে। ও জানে কিন্তু তবুও আমাকে বলল তুই চলে যা। আরে আমি কি করে যাই? আমার আরও দেরী আছে না?
সে দিন আগের মতই মানামা থেকে সিঙ্গারা খেয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাতে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে জাহাজে ফিরে এসে শুয়ে পরলাম।

পর দিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ডেকে গেলাম। শুকনো ডেভকনের আস্তর তোলার জন্য চিপিং হ্যামার এনে যেই প্রথম বারিটা দিলাম আর ওমনিই ডেভকনের একটা বিরাট টুকরো এসে আমার ডান চোখে আঘাত করল। সে কি যন্ত্রণা! মনে হচ্ছিল এই বুঝি জীবনের শেষ। সমস্ত পৃথিবী এক ঝলক করে নানা রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে উঠল। রঙ গুলো আসছে যাচ্ছে। ভাবছি, আমি বুঝি মরে যাচ্ছি। শুধু একটা চিৎকার দিতে পেরেছিলাম। এই মনে আছে। আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি আমার পাশে সাদা পোশাক পরা এক জন ইন্ডিয়ান নার্স দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কবরের ভিতরে এই মানবী এলো কেমন করে?সেও আবার আমার দেশের মেয়েদের মত চেহারা! দুনিয়ার কাজ কর্মের হিসেব নিবে না কি করবে বুঝে উঠতে পারছি না। অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল এখন কেমন লাগছে? এ কি! এ দেখি আবার মানুষের মতই ইংরেজিতে কথা বলছে। ফেরেশতারা কি এমন হয়, ইংরেজিতে কথা বলে? কিন্তু দুনিয়াতে শুনেছি ফেরেশতারা আরবিতে কথা বলে। তাহলে? পাপ পুণ্যের কিছু জিজ্ঞেস করছে না কেন? তাহলে এ কি ফেরেশতা নয়? আবার জানতে চাইল, কেমন লাগছে? এ্য, এটা কোন জায়গা? এটা বাহরাইন জেনারেল হাসপাতাল। আমি এখানে কেন? তোমার চোখে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। শোনার সাথে সাথে অনুভব করলাম আমার ডান চোখে ব্যান্ডেজ। সম্ভবত কোন আঘাত পেয়ে তুমি সেন্স লেস হয়ে গিয়েছিলে। ডাক্তার এক্স রে করে তোমার ডান চোখ অপারেশন করে মণির ডান পাশ থেকে প্রায় তিন মিলিমিটার ডিপ থেকে লোহার মরিচার গুড়া বের করেছে। কি হয়েছিল? এই এতক্ষণে সব কিছু একটু একটু মনে পরছে। আমি ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ডেকের উপর দিয়ে ফোর ক্যাসেলে যাতায়াতের পথের নিচের পানির লাইন থেকে ডেভকন তুলছিলাম। কি একটা যেন ছুটে এসে আমার চোখে আঘাত লাগল। এরপর আর কিছু মনে পরছে না। মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই পারছি না। নার্স আবার জানতে চাইলে যা মনে পরেছে তাই বললাম। শুনে খুব আফসোস করল। সিথানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সান্ত্বনার কথা বলছে। তোমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে চোখের মণিতে লাগেনি। চোখটা রক্ষা পেয়েছে, কয়েক দিনেই ভাল হয়ে যাবে চিন্তা করো না এখন এই ওষুধটা খেয়ে নাও। সেই সকাল থেকে এমনি রয়েছ, আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।

বিকেলে ক্যাপ্টেন ই বার্কি, জসীম এবং আরও কয়েক জন এলো। জসীম বলল আমি তোমার চিৎকার শুনেই দৌড়ে কাছে এসে দেখি তুমি ডেকে পরে রয়েছ পাশে চিপিং হ্যামার। তোমাকে তুলে দেখি পকেটে প্রায় চার ইঞ্চি সাইজের একটা পুরু ডেভকনের টুকরো। ওই দেখেই বুঝলাম ওটা তোমার চোখে লেগেছে। সেফটি গ্লাস পরে নাওনি কেন?যাই হোক তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেনকে জানালাম উনি সাথে সাথে ওয়ার্কশপের গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে এই হাসপাতালে এলো। সাথে আমি আর ড্যানি এসেছিলাম। ইমার্জেন্সীতে নিয়ে সাথে সাথে এক্স রে করে দেখে অপারেশন করে এখানে নিয়ে এলো। আমরা সবাই ছিলাম। তোমার জ্ঞান ফিরছে না বলে এই নার্স এখানেই ছিল। বেশ অনেকক্ষণ থেকে ওরা চলে গেল। এর পর থেকে পালা করে কয়েক জন নার্স

ডিউটি করেছে। বেশ যত্ন করছিল সবাই। গোসল করা যাবে না বলে গরম পানিতে শরীর মুছে দেয়া থেকে সময় মত খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানো সব কিছু। শুধু টিভি দেখতে বা কোন পত্রিকা পড়তে দেয়নি। তারপর দিন বিকেলে আবার জাহাজ থেকে কয়েক জন এলো। ওদের সাথে আমাদের এই স্থানীয় অফিসের ক্রু সুপার ক্যাপ্টেন রামস বটম এলো। এ দেশে হাসপাতালে রুগীর জন্য বাইরে থেকে কোন খাবার দাবার বা ফুল বা কোন কিছুই সাথে করে নিয়ে আসার কোন নিয়ম নেই। সে দিন যাবার সময় ক্যাপ্টেন বার্কি বলল জাহাজের মেরামত হয়ে গেছে, আমরা কাল সকালে সিতরা থেকে লোড নিয়ে দোহা যাব। ক্যাপ্টেন রামস বটম বলল তুমি এখানেই থাকবে, সুস্থ হলে পরে তোমাকে হোটেলে পাঠিয়ে দিব। জাহাজ থেকে তোমার পাসপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি। ইমিগ্রেশনে এন্ট্রি করিয়ে নিয়েছি। পরে তোমার জাহাজ কোথায় থাকে সেই অনুযায়ী জাহাজে যাবার ব্যবস্থা করা যাবে। আমার চিন্তিত মুখ দেখে বলল, ডোন্ট ওরি মাই বয় আই উইল বি হেয়ার। আমি প্রতি দিন এক বার এসে তোমাকে দেখে যাব। আমি বললাম আমার ভাল লাগছে না আমি বাড়ি যাব। আচ্ছা ঠিক আছে দেশে যাবে, তবে এমন শরীরে জার্নি করবে কি করে? একটু সুস্থ হয়ে নাও তখন যেও।

চার পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হলে আমার অফিসের গাড়ি এসে হোটেল মানামায় নিয়ে গেল। হোটেলে তিন চার দিন থাকার পর এক দিন সকালে অফিস টাইমে ফোন এলো। ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান মুর্থি কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলল তোমাকে আবুধাবি যেতে হবে, কাল তোমার ফ্লাইট। গাড়ি পাঠাচ্ছি অফিসে এসে তোমার টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে যাও। অফিসে যেয়ে মুর্থির সাথে দেখা না করে সরাসরি রামস বটমের রুমে চলে গেলাম। আমি আবুধাবি যাব না, আমাকে দেশের টিকেট করে দাও। আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কথা আমার মনে আছে। আপাতত তুমি ওখানে যাও, আমি চিটাগাং এ এজেন্টের কাছে তোমার রিলিভার এর জন্য টেলেক্স পাঠিয়েছি কেউ এক জন এলেই তোমাকে পাঠিয়ে দিব। আচ্ছা ঠিক আছে বলে ধন্যবাদ জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এবার মুর্থির রুমে এলাম। কিছুক্ষণ কেমনে কি হল এসব নিয়ে আলাপ করে চা খাইয়ে টিকেট পাসপোর্টের খাম দিয়ে বলে দিল কাল বিকেলে ড্রাইভার তোমাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসবে। আবুধাবিকেও বলে দিয়েছি তুমি ওখানে পৌঁছে অফিসে ফোন দিলেই ওরাও গাড়ি পাঠাবে। আচ্ছা গুডবাই বলে চলে এলাম।

আবুধাবি পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি জাহাজে এসে দেখি ওরা তেল আনলোড করে জেটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওঠার পরেই লোড নেয়ার জন্য সউদি আরবের রাস্তানুরাহ এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। এই ভাবে কয়েকটা ট্রিপ পরেই এক দিন দুবাই থেকে কুয়েত যাবার পথে ক্যাপ্টেন জানাল আগামী সপ্তাহে তোমার রিলিভার আসছে। খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। হাতের কাছে যা ছিল তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়ার ব্যস্ততা শুরু হল। আবুধাবি যাবার পর টিকেট পেতে দুই এক দিন সময় লাগবে তখন কিছু কেনা কাটা করে নিব। যদি দুবাই থেকে ফ্লাইট হয় তাহলে ভাল হবে। এখানে সব কিছুর দাম কম। কুয়েত থেকে লোড নিয়ে আবার আবুধাবি পৌঁছাতে এক সপ্তাহ লেগে গেল। আবুধাবি পৌছার দুই দিন আগেই জাকির এসে দুবাইর এক হোটেলে থাকছে। গ্রে আবুধাবি (আমাদের কোম্পানিকে রেডিওতে ডাকার নাম) জানিয়েছে। জুলাই মাসের ২২ তারিখ সকালে আবুধাবি পৌঁছে সরাসরি জেটিতে ভীরে দেখি জাকিরকে নিয়ে এজেন্ট অপেক্ষা করছে। আমি আগেই রেডি হয়ে ছিলাম। জাকির জাহাজে ওঠার পর আমার সাইন অফ করে আমার পাসপোর্ট দিয়ে দিল। সাথে চিটাগাং এর এজেন্টকে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেনের লেখা একটা চিঠি। জসীমের কাছে বিদায় নিয়ে ব্যাগ সুটকেস সহ নেমে এজেন্টের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি জসীম করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা কেন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। মনের অবচেতনা থেকে একটা প্রশ্নের উদয় হল। জসীম, আবার কি দেখা হবে? নিজেকে ধমক দিলাম, কি সব ভাবছ? কেন দেখা হবে না? গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই একটা বিশাল শেড এর আড়ালে চলে গেলাম। ওরা এখন জাহাজ ছেড়ে আবুধাবির অফ শোর মুরিং এ যেয়ে তেল আনলোড করবে। আর সেই তেল গিয়ে পৌঁছাবে অফ শোর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে “আবুধাবি ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানি” বা এডনকের ট্যাঙ্কে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দুবাই পৌঁছে জাকির যে হোটেলে ছিল ওখানেই আমাকে নামিয়ে দিল। যাবার সময় ড্রাইভার বলে গেল তোমার টিকেট হলে অফিস থেকে জানাবে, তখন এসে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাব। ওকে ইব্রাহিম, বাই!

ইব্রাহিম চলে যাবার পর হোটেলের কাউন্টারে গেলাম। আমাদের এই গ্রে মেকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিস কোম্পানির যত সিম্যান এই দুবাই দিয়ে আসা যাওয়া করে তার সবাই এই হোটেলেই থাকে। এখানকার সবই আমাদের চেনা। অফিস থেকে আগেই হোটেল ম্যানেজারকে জানিয়ে রেখেছিল। রিসিপসনের খাতায় নাম ধাম লিখে আমার হাতে ৬ তলার একটা রুমের চাবি দিয়ে বলে দিল “হ্যাভ এ নাইস টাইম হেয়ার”।

দুপুরে খাবার পর বের হয়ে সোজা বার দুবাই মার্কেটে চলে গেলাম। দেশে যাচ্ছি বলে কিছু কেনা কাটা করব। হাতে যা ডলার ছিল সেগুলি সব ভাঙ্গিয়ে যা যা মনে ধরল কিনে নিলাম। কিনে দেখি এখনও বেশ কিছু দিরহাম পকেটে রয়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে কাল আবার আসব। কাল সকালে একবার দেরা তে অফিসে যাব দেখি টিকেটের কি করেছে জেনে আসব আর হিসেব নিকেশ করে কত ডলার বাকী আছে তা যদি দিয়ে দেয় তা হলে নিয়ে আসব। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের ভিতরে ঢুকে লাউঞ্জ পার হয়ে রিসিপসনের পাশ দিয়ে লিফটে উঠবো বলে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছি আর অমনি রিসিপসনের ইন্ডিয়ান জন একটু উত্তেজিত ভাবে ডাকল
এই এদিকে আস, তোমার একটা জরুরী ম্যাসেজ আছে!
এগিয়ে গেলাম।
কি খবর জন?
তুমি কি জান যে তোমাদের নেপচুনে আগুন লেগেছে?
শুনেই বুকটা ধক করে উঠল। জসীম, জাকিরের চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠল।
কি বলছ জন?
হ্যাঁ তুমি বেরিয়ে যাবার পর তোমাকে জানাবার জন্য তোমাদের অফিস থেকে ফোন করেছিল।
বল কি?
হ্যাঁ তুমি তোমার অফিসে ফোন করে জেনে দেখ। বলেই ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। ওদের ফোন বুক বের করে আমাদের গ্রে মেকেঞ্জির ফোন নম্বর বের করে দিল। নম্বর ঘুরিয়ে রিসিভার কানে নিয়ে রিং টোন শুনছি আর বুক ঢিব ঢিব করছে ‘আল্লাহ জন যা বলছে তা যেন সত্যি না হয়!’ ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান স্টেনলির কণ্ঠ চিনতে পারলাম।
হ্যালো স্টেনলি, নেপচুনের কি হয়েছে?
আমি খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে নেপচুন ইজ ডেড এন্ড মস্ট অফ দি ক্রুজ আর ইন হসপিটাল এন্ড মোর ওভার সাম আর ডেড।
কি করে হল?
সংক্ষেপে সব বলল। সাথে যারা জীবিত আছে তারা আবুধাবির কোন হাসপাতালে আছে বলে দিল।
আমি কি এখন ওখানে যেতে পারি?
না এখন পারবে না, কাল সকালে যেও।

বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল। আমার হাত থেকে কখন রিসিভার নামিয়ে রেখেছি না কি জন নিয়ে রেখেছে বলতে পারছি না। মনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বইছে। জসীম আর ওর নতুন বৌ মল্লিকার চেহারা মনে ভাসছে। আজ সকালেই মাত্র জাকির এসেছে। ওর হাসি খুশি চেহারা মনের পর্দায় ভেসে এলো। আমাকে দেখেই বলেছিল যান, আপনার জন্য ঢাকা শহর সহ পুরো বাংলাদেশ রেখে এসেছি। নিজেকে অসম্ভব অসহায় মনে হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কেন শপিং করতে গেলাম বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কি হল? জসীমের কি হয়েছে? ওকি বেচে আছে না কি? সেকেন্ডে কয়েক হাজার মাইল বেগে মনের আকাশে অসংখ্য প্রশ্নের ধারা বয়ে গেল। কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এখন কি করব? দুবাই থেকে ট্যাক্সিতে আবুধাবি গেলেও দেড় ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু এখন ওখানে যেয়েও কিছু হবে না। কাউকে দেখতে পাব না, কিছু জানতে পারব না। অনেকক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কোন বোধ নেই। জন ডেকে লাউঞ্জের একটা সোফা দেখিয়ে বলল ওখানে একটু বস। চিন্তা করে কিছু হবে না। কাল সকালে আবুধাবি গিয়ে দেখ। সোফায় বসলাম। জন রিসিপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসা যাওয়ার পথে দুবাই এলে এই হোটেলে থাকি বলে প্রায় সবার সাথে বেশ আলাপ আছে। ওর কথা কিছু কানে ঢুকছে অধিকাংশই ঢুকছে না। বুঝতে পারছি। জাকির যদি আর মাত্র কয়েকটা দিন পরে আসত কিংবা জসীম যদি আমার আগে চলে যেতে চাইত তা হলে আমি নিজেই ওই জাহাজে থাকতাম। “নেপচুন ইজ ডেড” বারবার স্টেনলির এই একটা কথাই শুধু মনের আকাশে কাল মেঘের মত ছেয়ে আছে। এ কথার মানে কি তা আর কেউ না জানলেও যারা নাবিক, সাগরে ভেসে যাদের জীবন কাটে তারা খুব ভাল করেই জানে।

মানুষ নিজেই জানে না তার নিজের একটা অসম্ভব সুন্দর এবং কার্যকর গুণ আছে। আর তা দিয়ে যত রকমের বিশাল বা ক্ষুদ্র মনের আঘাত এক সময় ভুলে যেতে পারে। মনের উপরে ভুলের একটা প্রলেপ দিয়ে দেয়। যেমন পারে নিজের সন্তানের অকাল মৃত্যু যন্ত্রণা, মায়ের সাধ না মিটিয়ে তাকে কবরে রেখে আসার ব্যথা কিংবা প্রিয়তমর হঠাৎ করে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার হাহাকার। তেমনি একটা গুণ বোধ হয় আমারও আছে আর তাই সম্ভবত এক সময় যে কোন ভাবেই হোক আমিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লিফটে করে উপরে চলে গেলাম।
সারা রাতে ঘুম আসেনি। বারবার জসীম, জাকির, মাত্র গত ভয়েজের শেষে বিয়ে করা জসীমের নতুন বৌ মল্লিকা আর আমার অবস্থান নিয়ে একটি করুণ বিষাদে ভরা চলচ্চিত্র দেখেছি। যার পরিচালক নিয়তি স্বয়ং। অভিনয় করেছি আমরা এই কয়েক জন এবং আশে পাশে ছিল আরও কয়েক জন। তাদের এক জন হচ্ছে

এমন এক জন যার সাথে এই ভয়েজের শেষে দেশে যাবার পরে আমার সাথে সারা জীবনের জন্য একটা মধুর সম্পর্ক হবার কথা গুরু জন মহলে ঠিকঠাক হয়ে আছে। কি হবে এই সম্পর্কে? এই তো জসীম কত গুলি বছর ধৈর্য ধরে কত অপেক্ষা করে কত বাধা বিপত্তি এড়িয়ে মল্লিকাকে নিয়ে এলো। আজ কোথায় মল্লিকা আর কোথায় জসীম? মল্লিকা কি জানতে পেরেছে? ওর এত প্রতীক্ষার জসীম এখন কোথায়? গ্রে ম্যেকেঞ্জি টেলেক্স পাঠাবে চিটাগাঙের এজেন্টকে। ওই টেলেক্স পেয়ে চিটাগাঙের এজেন্ট টেলিগ্রাম পাঠাবে জসীমের বৌ মল্লিকাকে। তাতে অন্তত তিন থেকে চার দিনের আগে মল্লিকার এ সংবাদ জানার কথা নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? মল্লিকা কি স্বপ্নে কিছুই দেখেনি? তার হাত থেকে কি কিছু ছুটে পরে যায়নি? হাটার পথে কি কোন হোঁচট খায়নি? কিংবা মল্লিকার বুকের ভিতরে লুকান জসীমের জন্য ভালবাসার যে স্বপ্ন সরোবর রয়েছে সেই সরোবরে কি উথাল পাথালি কোন ঢেউ ওঠেনি? নিশ্চয় টেলেক্স টেলিগ্রামের ধাঁধা ডিঙ্গিয়ে মল্লিকার লুকান সরোবরে এতক্ষণে উত্তাল প্রলয়ঙ্করী কোন ঢেউ আছড়ে পরছে। মল্লিকা কি ধারনাও করতে পারছে এই ঢেউয়ের মানে কি?

তা হলে আমি কেন এই কণ্টক বিভীষিকা এবং পায়ে পায়ে বিপদের হাতছানি জড়িত জীবনের সাথে তাকে জড়াব? তাকে কি জানাব জসীম মল্লিকা জাকিরের কথা? এ সব কথা জেনে সে কি আমাকে সহজেই বরণ করে নিবে? তার মনে কি দ্বিধা থাকবে না? তা হলে কি হবে, কি হবে ভেবে ভেবেই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেমন করে চলে গেল কিছুই বুঝলাম না। ভোরের আজানের সুরে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের দরজা খুলে বারান্দায় চেয়ারে বসলাম। অনেক দূরের মরু পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্যের লাল রশ্মি চিক চিক করে উপরে উঠে আসতে চাইছে কিন্তু কি জানি মল্লিকার কথা ভেবে হয়ত সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বেশ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক সময় ভিতরে এসে সকালের কাজ কর্ম সেরে কাপর পরে নিচে এসে রিসিপসনে বলে হোটেল ছেড়ে এলাম। ভাগ্য ভাল, সাথে সাথেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে সোজা আবুধাবির ওই হাসপাতালে চলে এলাম।

রিসিপসনের লোকদের আমার পরিচয় জানালাম। সাথে আরও বললাম, ওখানে আমিও থাকতে পারতাম কিন্তু নিতান্ত নিয়তির অনিচ্ছা ছিল বলে থাকা হয়নি। শুনে ওরা আফসোস করল, ভেরি স্যাড! এক জন আমাকে ডান বাম ইত্যাদি বলে লিফট দেখিয়ে দিল। লিফট বেয়ে ওদের ডান বাম অনুযায়ী ৩২ ডি নম্বর রুমে ঢুকে দেখি জাকির শুয়ে আছে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু ব্যান্ডেজ। নার্সকে বললাম, পাশের টুল দেখিয়ে বসতে বলে ডাকতে নিষেধ করল। ঘুম ভাঙলে কথা বলতে বলল। অপেক্ষা করছি। রুমের বাইরে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম অন্য যারা ছিল তারা কোথায়? নার্স রুম ছেড়ে পাশের রুম থেকে একটা টাইপ করা কাগজের ফটো কপি এনে হাতে দিল। পড়ে দেখলাম পাঁচ জন স্পট ডেড। তার মধ্যে জসীমের বিকৃত ডেড বডি পাওয়া গেছে বাকী কারো কোন চিহ্নই পায়নি। এডনকের যে পাইপ ফিটার ছিল তাকেও পাওয়া যায়নি। হয়তবা কোন হাঙর বা কোন সামুদ্রিক জীবের ক্ষুধার খাদ্য হয়েছে কি না কে জানে? এই হাসপাতালে বার জন চিকিৎসায় আছে।

প্রায় ঘণ্টা খানিক পরে জাকির চোখ মেলে তাকিয়েছে। দেখে পাশে দাঁড়ালাম। আমার দিকে হাসি কান্না সব কিছু ভুলে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে ওর কোন বোধ বিকার কিছুই নেই। আমাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখছি না। কি হয়েছে বা ও কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ওর সাথে আমিও কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এ ভাবে কতক্ষণ? মিনিট দশেক পরে ডাকলাম, জাকির! কেমন আছ জাকির? মনে হল কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়েছে। ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল, বুঝে আমার মনেও আঘাত লাগল। মাত্র এই, এই টুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল সকালেই যাকে দেখেছি ফুরফুরে বাতাসের মত হাসছে। আজ তার এ কি চেহারা! শুধু কাল সকালে কেন, বিগত ৭/৮ বছর ধরেই দেখছি যে জাকির কখনও মুখ ভার করে থাকেনি। আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটি ভিজে আসছে। গায়ে মাথায় কোথাও হাত দেয়ার উপায় নেই। শুধু ব্যান্ডেজ। অনেকক্ষণ কাঁদল। কিছু বলতে পারলাম না, কোন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু ঠোট নড়ল দেখে বুঝলাম হয়ত কিছু বলতে চাইছে। ওর ঠোটের কাছে কান এগিয়ে আনলাম। নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ভাই, আপনি কি ভাবে জানলেন? এখানে এলেন কি ভাবে? বললাম সব কিছু। কি হয়েছিল জাকির? শুনেই আবার কান্না। কাঁদার সুযোগ দিলাম। কান্নার পানিতে যদি দুঃখ কষ্ট গুলি ধুয়ে ফেলতে পারে। কাঁদুক, ও যতক্ষণ পারে কাঁদুক।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু শান্ত হলে আবার জিজ্ঞেস করলাম। তখন অতি নিচু কণ্ঠে যা বলল:
আমাকে নামিয়ে দেয়ার পর ওরা অফ শোর বয়াতে মুরিং করে সাগর তলা থেকে তেলের পাইপ তুলে মুখে লাগান ঢাকনা খুলে লাইনের তেল বের হয়ে যাবার অপেক্ষা করছে। সমস্ত জাহাজ পেট্রোলের গ্যাসে ভরে গেছে। জাকির, জসীম আর ইরানি জাবের জাহাজের পিছনের ডিসচার্জিং লাইন এডনকের যে লোকটা খুলছে তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে এমন সময় পাকিস্তানি কুক হেলপার আরাফাত গ্যালিতে (কিচেন) ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালাবার জন্য দিয়াশলাই জ্বালাবার সাথে সাথেই আগুনের শিখা মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত জাহাজে ছেয়ে গেল। জসীম ভাই চিৎকার দিয়ে পরে গেল জাবেরও ওই ভাবে একটা চিৎকার দিয়ে কি হল জানি না আমি আর কোন উপায় না দেখে পাশের বয়াটা নিয়ে পানিতে ঝাপ দিলাম কিন্তু ঝাপ দেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম এতক্ষণে এডনকের পাইপ দিয়ে যে তেল পরে পানিতে ভাসছিল তাতে আগুন ছড়িয়ে গেছে এবং আমি ওই আগুনের মধ্যেই নামছি। চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বয়া ধরে সাঁতরাতে পারব না। যতক্ষণ পারা যায় ডুব দিয়ে থেকে শ্বাস নেয়ার জন্য হাত দিয়ে উপরের পানি সরিয়ে মাথাটা কোন ভাবে উঠিয়ে শ্বাস নিয়ে আবার ডুবে থাকতে হবে। কিন্তু পানিতে পরার একটু পরেই আমার হাত থেকে বয়াটা ছুটে গেল। এর মধ্যে পানিতে নামার সাথে সাথেই সমস্ত শরীর পুরে গেছে বুঝতে পেরেছি, শরীরে জ্বালা করছে। সাগরের নোনা পানির জন্য চোখ খুলে কিছু দেখতে পারছি না। হাত পুরে গেছে। সাঁতরাতে পারছি না। শেষ যখন হাতে বয়া ছিল তখন দেখেছিলাম যেখানে জাহাজ ছিল তার আশে পাশে আগুন আর আগুন। জাহাজের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু আগুন। এডনকের পাইপ ফিটারদের যে বোট ছিল ওরা যে কখন বোট নিয়ে সরে পরেছিল জানি না। ওরাই ওয়ারলেস দিয়ে শোর অফিসে সংবাদ দিয়ে ওই আগুনের মধ্যেই কিছুক্ষণ ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার দিয়ে ফোম ছিটিয়ে ছিটিয়ে যাকে যাকে দেখেছে তাদের তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে আবুধাবি হারবার থেকে ফায়ার ফাইটিং টাগ আসতে দেখেছি। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।
আমাকে জিজ্ঞেস করল
জসীম ভাই কোথায়? আমি কোন জবাব দিতে পারিনি। শুধু এটুক বলেছিলাম অন্য কেবিনে আছে।
আপনার টিকেট হয়েছে?
না এখনও অফিসে যাইনি। আজ সকালে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু কাল রাতে তোমাদের এই সংবাদ জেনে আজ অফিসে না যেয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে চলে এসেছি।

এর দুই এক দিন পরেই আমার টিকেট হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা গভীর টান থাকা স্বত্বেও বিদেশের নানা জটিলতার জন্য আর জাকিরকে দেখতে আবুধাবি যেতে পারিনি। দুবাইতে অফিস, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নানা ঝামেলা সেরে বিষণ্ণ মনে যখন দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠে সিট বেল্ট বাধছিলাম তখন ভাবছিলাম, “নিয়তি তুমি এখন কোথায়”? একটু পরে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের প্লেন যখন দুবাইর মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল তখন ফেলে আসা জসীমের নিশ্চিহ্ন দেহ, জাকিরের করুণ দৃষ্টি আর মল্লিকার কল্পিত হাহাকারের কথা ভেবে কেমন যেন পাথরের মত বসে বসে জানালা দিয়ে সব দেখলাম।

কখন ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমেছি বলতে পারিনা। প্লেন থেকে নেমে জনস্রোতের সাথে এরাইভ্যাল লাউঞ্জে এসে নিজের ব্যাগ নিয়ে গেটের কাছে এসে ওই একই ভাবনা মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, এক ট্যাক্সি ড্রাইভার পাশে এসে জিজ্ঞেস করল স্যার কোথায় যাবেন? সেই কখন থেকেই দেখছি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?
সম্বিত ফিরে এলো।
না কেও আসবেনা, আমি মতিঝিল যাব, যাবেন?
চলেন।

লেডিস ফার্স্ট

টোনা এবং টুনির মাঝে গভীর প্রেম। কেও কাওকে ছাড়া থাকতে পারে না। এমনকি তারা এক সাথে থাকবে বলে একই কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে যাতে করে অন্তত কাজের সময় দুইজনকে খুব একটা বেশী সময় ধরে দূরে থাকতে না হয়।
একদিন তারা উভয়ে কাজ শেষ করে একটা পাব এ গিয়ে বসল। অনেকদিন পরে দুই জনে এক সাথে একটু সুরা পান করবে।

টোনা জিজ্ঞেস করল তুমি কি খাবে?
একটু সাদা ওয়াইন হলেই হবে।
টোনা টুনির ইচ্ছা জেনে বার কাউন্টারে গিয়ে টুনির জন্য একটা সাদা ওয়াইন আর নিজের জন্য এক পাইন্ট লাগার নিয়ে এসে টুনির পাশে বসে ওয়াইনের গ্লাসটা টুনির দিকে এগিয়ে দিল।
চিয়ার্স করে একটু একটু চুমুক দিচ্ছে আর অতীত, ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে নানা রকম গল্প করছে আর গ্লাস ফুরিয়ে গেলে আবার বার এ গিয়ে নতুন করে গ্লাস ভরে আনছে। এভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনেক পান করে সবারই মাথা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
টোনার সামান্য এক কথায় টুনি এমন রেগে গেল যে আত্মবিসর্জন দিবে বলে টোনাকে জানিয়ে দিল।
এতদিন ধরে আমরা একসাথে রয়েছি আর আজ তুমি আমাকে এই কথা বললে? আমি আর বেচে থাকতে চাই না। বলেই পাব ছেড়ে ঝরের মত বের হয়ে গেল।
তার পিছনে টোনা অসমাপ্ত গ্লাস ফেলে দৌড় দিল।
টুনি দৌড়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে তাতে উঠতে যাবে এমন সময় টোনাও টুনির সাথে ট্যাক্সিতে উঠেই বলল টুনি প্লিজ তুমি একা যেয়ো না দরকার হলে আমরা একসাথেই মরব।
এর মধ্যে টুনি ড্রাইভারকে বলল কাছের পাহারের নিচে যেতে, গন্তব্য শুনেই ড্রাইভার পাহারের দিকে ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ার এবং অবশেষে ফোর্থ গিয়ারে দিয়ে ফুল স্পীডে ছুটে চলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহারের নিচে এসে উপস্থিত।
টুনি পার্স খুলে মিটার দেখে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুর্বার গতিতে পাহার বেয়ে উপরে উঠছে আর তার পিছু পিছু টোনাও।
পাহারের চূড়ায় উঠে টোনা বলল চল আমরা একসাথে লাফ দেই!
না, পাব থেকে যেমন আমি আগে বের হয়েছি তেমনি আমি আগে লাফ দিব।
না না তা কি করে হয়? তার চেয়ে আমিই আগে লাফ দেই।
না, আমি আগে লাফ দেব।
না, তা হতেই পারে না, আমি বলছি চল আমরা এক সাথে হাত ধরে লাফ দেই।
অসম্ভব, আমার পক্ষে তোমার হাত ধরা আর সম্ভব নয়।
তাহলে ঠিক আছে, দেখ আমিই আগে লাফ দিচ্ছি কারণ আমি সত্যিই তোমাকে খুব ভালবাসি।
বলেই টোনা লাফ দিল আর অবধারিত ভাবে নিচে পরে গিয়ে মৃত্যুর সাথেই আলিঙ্গন করল। টুনি যেমন পাহারের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে টোনার মৃত্যুর দৃশ্য দেখে নিশ্চিত হয়ে আস্তে আস্তে পাহার থেকে নেমে বাসায় ফিরে গেল।

ঘটনাক্রমে ওই পাহার চূড়ায় এক দাঁড়কাক বিকেল বেলা হাওয়া খেতে এসেছিল এবং টোনা টুনির এই কথোপকথন এবং তাদের কার্যকলাপ সবই দেখছিল শুনছিল। তবে সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি যে, টোনাই আগে লাফ দিবে। দাঁড়কাক ভাবল এভাবে যদি টুনি টোনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাহলে একটা কথা চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে যে, “লেডিস ফার্স্ট” তাহলে মহিলারা অত্যন্ত পুলকিত হবে এবং অন্তত তারা আর এভাবে কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগ পাবে না।