মিড ডে ডেজারট এর সকল পোস্ট

মিড ডে ডেজারট সম্পর্কে

I shall say bye to my sleepless night if “tomorrow” comes to me with a message that I’m waiting for last twenty years, Then I shall pray for one more “tomorrow” to send you back pieces of clouds bottle of dew and a “one-sea tears”!

কবিতাঃ মনলতা ওয়ার্মিং

ঘটনাটা হঠাৎ করেই ঘটে গেল-
ঈশ্বরকে চমকিয়ে দিয়ে কোটি গুণ বেশি বেগে বরফ গলতে শুরু করলো;
ফলে সমুদ্রতীর থেকে শহরে এবং
দেশ থেকে দেশে বানের মতোন মানুষের ঢল নামলো।

আবহাওয়ার জোরালো ফোরকাস্ট মিথ্যে করে দিয়ে
শীতপ্রধান দেশে শীত শতগুণ হলো
এবং জলশূন্য সব গ্রহ নক্ষত্র জলে ডুবে গেলো।
মহাকাশ স্টেশণ ছেড়ে নাশার বিজ্ঞানীরা
হন্যে হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে
নূহের নৌকা খুঁজতে লাগলো।

পরিণামে দেশে দেশে যুদ্ধ হলো,
রাস্তায় নারীরা ভ্রষ্ট হলো
আকাশ ভাঙ্গলো, চন্দ্র ভাঙ্গলো; সূর্য গলে বৃষ্টি নামলো
এইভাবে তিনদিন কেটে গেলো !

অতঃপর একটু আগেই ব্রেকিং নিউজ হয়েছেঃ
মহাবিশ্বের কোথাও আর অস্বাভাবিক বরফ গলছেনা
এবং সমুদ্রের সব বাড়তি জল আজ ভোরে উত্তর মেরুতে ফিরে গেছে;

কারণ তিনদিন পর আজ ভোরেই মনলতার গায়ের জ্বর নেমে গেছে !

—————————————
#গ্লোবাল ওয়ার্মিং অনুকরণে নাম দেয়া হয়েছে। ধারণা করা হয়, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ এরকমই কিছু ঘটবে।

গল্পে গল্পে ভ্রমণ কাহিনিঃ আদিম মানুষের দেশে (দুই)

কেনিয়া, ১ আগস্ট ২০১৮; লোকাল টাইম ০০:০১ মিনিট।

-কারিবু। নোরিনের চিবুকে হালকা স্পর্শ দিয়ে আদনান নাভিদ গ্রিট করলো।
-আসান্তে সানা। ঘুম ঘুম কন্ঠে সুতপা নোরিন জবাব দিলো

বিয়ে বার্ষিকী; তাই নোরিনকে নাভিদ ওদেশের ভাষা সোহাইলিতে স্বাগত জানিয়েছে। একই ভাষায় উত্তরটাও নোরিনের জানা ছিল।

গত ২৬ জুলাই এর পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা এখন লডোয়াতে; কেনিয়ার রিফটভ্যালি প্রোভিন্সের একটা কাউন্টি হেড কোয়ার্টার। ডায়োসিস অব লডোয়ার গেস্ট হাউজে।

চিবুক ছুঁয়ে দিয়েই নাভিদ মিটমিটি হাসছিল।

-তোমার মতলবটা কি? নোরিন প্রশ্ন করলো
-জলে জোছনা মিশাবো। আবার দুষ্টু-হেসে নাভিদ জবাব দিল
-গল্প বল; এদেশের গল্প

ফ্রিজ থেকে আধা লিটারের একটা বোতল খুলে নাভিদ এক ঢোক জল খেয়ে নিলো।

-এখানে লোমিয়া নামে একটা কাউন্টি আছে। সকালের নাস্তা সেরেই লোমিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেব
-লোমিয়ায় কেন? নোরিন জানতে চাইলো
-এদেশে চাকরীকালীন সময়ে নাইরোবি থেকে বহুবার এখানে এসেছি। তখন একবার লোমিয়ার একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাদের এই বার্ষিকীতে ওখানে যেতে চাই। নানান দেশে নানান রকমের বিয়ের সংস্কৃতি রয়েছে। সবগুলো থেকে তোমার-আমারটা যে প্রকৃতই ভিন্ন সেটা দুজন একসাথে অনুভব করতে চাই।

-আমার অমত নেই। তোমার সেই লোমিয়া ভ্রমণের অনুভূতি শেয়ার কর।

-লোমিয়ার এই নৃ-গোষ্ঠিটি মোটা দাগে টুরকান। সেবার এখান থেকে আড়াই ঘন্টা ট্রাভেল করে ওখানে গিয়েছিলাম; নিরাপত্তা বাহিনীর সবল প্রস্তুতি নিয়ে। শেষের দশ পনের মিনিটের পথ ছিল বিয়ের আয়োজন স্থলের ভিতর। উঁচু নিচু ঝোপ জঙ্গল; হঠাৎ হঠাৎ যেনো মাটি ফুঁড়ে সারিবাঁধা নারীরা হেলেদুলে নেচেগেয়ে গাড়ির সামনে এসে থেমে যেতো।

এর কয়েক মিনিট পর একটা লাঘার পাড়ে উপস্থিত হতেই ৩০-৪০ জনের একটা গ্রুপ আমার গাড়ির দিকে একে-৪৭ তাক করলো। বলে নেই, মরু ভূমিতে মরা নদিকে লাঘা বলে।

-মরু ভূমিতে নদি? নোরিন বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলো

-উজানে উগান্ডা। ওখানে বৃষ্টি নামলে তা ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাডের রুপ নিয়ে এই মরুভূমির নির্দিষ্ট কিছু জায়গা দিয়ে প্রবাহিত হয়। সেই জায়গাগুলো দেখতে মরা নদির মতোই।

-লাঘায় ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড দেখেছ?
-হ্যা; এবং সেটা হৃদয় বিদারক ছিল। অন্য একদিন সেই গল্প বলবো। এখন লোমিয়ার কথা শুনো
-ওকে; গো এহেড
-কিন্তু তার আগে কিছু বিনিময় চাই।

বেগতিক বুঝে নোরিন ওর মুখ নাভিদের বুকে লুকিয়ে ফেললো। এর অল্প কিছুক্ষণ পর ওরা বারান্দায় গেলো। পাহাড়ের ওপর গেষ্ট হাউজটা। জোছনায় বেশ দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। মধ্যরাতে নোরিন যেন একটা মরুভূমি শহরের বিলাপ অনুভব করছিল।

-জলে জোছনা না মিশালে আজ এই রাত খুব অভিমানী হবে। বলেই নাভিদ আবার মুচকি হাসলো।

স্বভাবসুলভ ভাবে নাভিদের বুকে নোরিন একটা কিল বসিয়ে দিল। এটা না পেলে নাভিদের বাম বুকের “লাব-ডাব” শব্দ মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে যায়; তাই সে এই কিলটার প্রতীক্ষায় থাকে।

-গল্পটা বল। সকালে উঠতে হবে। নোরিন তাড়া দিল
-ওই রকম বন্দুকের মুখোমুখি আগেও বেশ কবার হয়েছি। তাই লোমিয়ায় তখন ভয় পাইনি। এর কিছু কারণও আছে। রিফ্টভ্যালির কোন টুরকানা কাউন্টিতেই সরকারের কার্যকর উপস্থিতি ছিলনা। আগেই বলেছি, বিরাশিভাগ মানুষ যাযাবর। পশুপালন ছাড়া ওদের জীবন নির্বাহের তেমন কোন বিকল্প নেই। আয়তনে প্রায় আমাদের দেশের সমান এই বিশাল এলাকায় খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা ইউএন এর ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। তাই ইউএন এর সাইন বা লগোযুক্ত গাড়ি বা কিছু দেখলে ওরা ভালো আচরণ করে।

-গুলি করেনি?
-না। আমার নিরাপত্তা বাহিনির প্রধানের নাম ছিল জন। সে অনেকগুলো ভাষা জানতো। জন ওর গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে গিয়ে ওদের সাথে মিনিট দুয়েক কথা বলার পর চিত্রটা পুরো বদলে গেলো

-সেটা কি?
-ওদের গোত্রীয় প্রধান এসে আমাকে নিয়ে গেল। আমার সাথে জিম্বাবুয়ে এবং কেনিয়ার দুই নাগরিক ছিল। ওদেরকে নিয়ে গোত্রীয় প্রধানকে অনুসরণ করতে লাগলাম
-ওই দুই ভিনদেশী নাগরিক পুরুষ না মহিলা?
-বলবোনা;
নাভিদ একটা চাপা হাসি দিলো

-ঠিক আছে; বলোনা। কিন্তু তারপর কি হলো?
-পায়ে হেটে লাঘা পেরিয়ে আমরা একটা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। সেখানে নানান বয়সী পুরুষ লোক ছিল। সবার হাতে একে-৪৭ । গায়ে যেটুকু আবরণ ছিল তা ওদের মূল কিছু আড়াল করতে পারেনি। একটা কথা সম্ভবত তোমাকে আগেই বলেছিলাম। টুরকানায় যে বৃদ্ধকে লাঠিতে ভর দিয়ে চলার কথা তার হাতেও একে-৪৭ দেখেছি

-পরে জঙ্গলে কি হয়েছিল?
-ওখানে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটা চলছিল। এখানে সেখানে গরু, ছাগল পুড়ানো হচ্ছিল। আমার উদ্দেশ্যে গোত্র প্রধান মিনিট পাঁচেক কথা বলে ভোজনে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানালো। সে কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেছিল। আফ্রিকার অনেক জায়গাতে একটা কমন কালচার হলো, কোন খাবার অফার করলে সেটা গ্রহণ করতে হয়। জন আমার হয়ে ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ওটা রমজান মাস ছিল এবং আমি মুসলিম এটা বুঝাতে জনকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

-রমজান মাস না হলে কি করতে?
-আমি আসলে ওদের খাবারে অংশ নিতে বেশ আগ্রহী ছিলাম। যদিও পশুগুলোর চামড়া আধপোড়া ছিল। ওরা নুন মরিচ চিনেনা। রোজা না রাখলে বার্থডে কেকের মতো চামড়াসহ কেটে দেয়া মাংস পিছগুলো আমি সানন্দে খেতাম

-তুমি সর্বোতভাবে জংলী;
কথাটা বলেই নাভিদের ফিনফিনে চুল নোরিন এলোমেলো করে দিল।

-ইন্টারেস্টিং কিছু কথা বলা হয়নি
-কি?
-বর ষাটোর্ধ ছিল; কনে সিক্সটিন। তাই কনেকে যৌতুক হিসেবে বর বেশি পশু দিয়েছিলো। রিপিট করছি, যৌতুক বরেরা দেয়; কখনোই কনে নয়

-ডিটেইল বল
-বর যেইই হোক না কেন প্রেমিক বা ভিখিরি; বিয়েতে ন্যূনতম চার ইউনিট পশু দিতেই হয়। এজন্য অধিকাংশ যুবকই বিয়ের আগে যুদ্ধে যায়। শত্রু নৃগোষ্ঠির পশু জয় করে এনে বিয়ে করে অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যায়। বলে রাখি, প্রতি ইউনিটে তিরিশটা পশু থাকে। এর মানে বিয়ে করতে হলে একজন পুরুষের কমপক্ষে ১২০টা পশু থাকতে হবে। এক ইউনিট মানে- এই যেমন ৩০ টা গরুর এক ইউনিট, ৩০ টা ছাগলের এক ইউনিট; এইভাবে মেষ, উট, জেব্রা ইত্যাদির ইউনিট। ওই বিয়েতে বর যেহেতু বেশি বয়সী এবং ধনী ছিল তাই সে ৪ এর অধিক ইউনিট পশু দিয়েছিল। সংখ্যাটা আজ একজাক্টলি মনে নেই।

-বিয়ে করতে যুদ্ধে যায়- এরকম কী যেন বললে?
-হ্যাঁ। রিলেটিভলি ধনীরাই পশু পালন করে। বাকীদের কেউ কেউ তাদের পশু দেখভাল করে। ওরা বিয়ে করবে কেমনে যদি নিজের পশু না থাকে? তাই ওরা পকট এ যুদ্ধে যেতো। পকট এলাকাটা বড় বড় পাহাড় দিয়ে টুরকানা থেকে আলাদা করা।

-ট্রুলি ভেরি ইন্টারেসটিং। নোরিন মন্তব্য করলো

-বিয়ের অনুষ্ঠানটিতে উল্লেখ করার মতো আরও কিছু ঘটনা ঘটেছিলো। আধাকাঁচা চামড়ায় তৈরি বরের পোশাকটা আমি পরেছিলাম।
-কোনদিন ছবি দেখাওনি তো!
-কেনিয়ার পর উগান্ডায় চাকরি করতাম। কামপালায় থাকতাম। শেষের দিকে একদিন আমার লেপটপ্টা ক্র্যাশ করে। ওখানে কেনিয়া এবং উগান্ডায় তোলা সব ছবি ছিল।
– বিগ লস
– রিয়াক্ট না করলে তোমাকে একটা কথা বলবো
-বলো
-আফ্রিকানরা রোমান্টিক হয়না। ইস্ট আফ্রিকার দেশগুলিতে দীর্ঘ সময় থেকে এই সত্যটা বেশ বুঝেছি। তবে আমার দিকে লোমিয়ার ওই কনের মিটমিট-তাকিয়ে থাকা দেখে ভাবছিলাম, আফ্রিকান রমণীরা সেদিনই প্রথম রোমান্টিক হয়েছে!
-তো?
-অথচ এই আমার সাথে এমন মধুরাতেও তুমি কেমন কৃপণ!

নাভিদের ধনুকের মতো বাঁকা ঠোঁটটা চেপে ধরে নোরিন “গৃহে” প্রবেশ করল। আজ সে নিজেই মুলবাতি নিভিয়ে নীলটা জ্বালিয়ে দিলো।

ঈশ্বব্রের ডায়েরিতে অবশ্য স্পষ্ট লিখা আছে, জগৎ সৃষ্টির পর কোন এক পহেলা আগস্টে মরুভূমিতে একবার বৃষ্টি নামবে।

ঈশ্বরের কী কখনো ভুল হয়?!

কবিতাঃ ঈশ্বর

জানালা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম;
যীশু বললো, “এখানে মধ্যরাতে ঈশ্বর আসবেন।”

মিনিট থেকে মাস
মাস থেকে আলোকবর্ষ ঈশ্বরের অপেক্ষায় থেকে থেকে
আবার জানালার ধারে গেলাম;
ক্রুশবিদ্ধ যীশু চিৎকার করে ওঠলো,
“মধ্যরাত হতে এখনো কিছুটা বাকি।”

কুরআন, পুরান, বাইবেল এবং আমার অন্তর খুলে
ঈশ্বরের প্রতিক্ষায় রইলাম।
তার আরও এক কোটি বছর পর প্রকম্পিত ইথারে
যেই মধ্যরাতের ঘণ্টা ভেসে এলো
জানালা খুলে দেখি, আমার ঈশ্বর খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
নীলরঙ শাড়ি পরা, খোঁপায় সাদা ফুলের মালা
এবং পা জুড়ে আলতার বাহার;

গত জনমে ঠিক যেভাবে তাকে সাজিয়েছিলাম !

গল্পে গল্পে ভ্রমণ কাহিনিঃ আদিম মানুষের দেশে (এক)

ওরা দুজন এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগষ্টেরে প্রথম দিন আফ্রিকায় থাকবে। শেষ বয়সে মধুচন্দ্রিমা আর কি! আজ ২৬ জুলাই; কাল ২৭, তারপর ৩১ জুলাই; এইভাবে একদিন ১ আগস্ট হবে! কতোদূর —- !

-আগে কোন দেশে যাবো?
নোরিন জানতে চাইলো। সুতপা নোরিন। নাভিদ আদনানের স্ত্রী।

-কেনিয়া
নাভিদ জবাব দিল।
সে বিশেষ পাসপোর্টের অধিকারী; তাই ভিসা কোন বড় বিষয় না।

-ওখানে কি কি দেখবো?

-রিফটভ্যালি প্রভিন্সের টুরকানায় যাবো; লোকিচোগিয়ো বাদ দিয়ে বাকি মেজর এলাকাগুলিতে। এজন্য লডোয়াতে অবস্থান করতে হবে। আদিমানুষ এবং ওদের ডাইভারসড কালচার তোমার ভালো লাগেবেই। লেক টুরকানা দেখবো এবং অন দ্যা ওয়ে, ইকুয়েটর অতি অবশ্যই

-ওসব তুমি দেখেছ?

-হ্যাঁ। কেনিয়াতে যখন পোস্টিং ছিল কাজের জন্য বহুবার গিয়েছি। রিফটভ্যালি প্রভিন্সের এলডোরেট যথেষ্ট গ্রীন; বাকিটুকু ডেজার্ট। কেউ যেতে না চাইলেও আমার খুব আগ্রহ ছিল। এলাকাটা উদ্ধার করতে যাওয়ার উছিলায় ওসব উপভোগ করেছি। কী যে দারুণ সব কৃষ্টি কালচার ! এথনোগ্রাফিক স্টাডির জন্য ওখানে অসাধারণ সব বিষয় রয়েছে।

-ইকুয়েটর নিয়ে একটু বল।

-ওটা রিফ্টভ্যালি বা লডোয়ার পথেই পড়বে; নাইরোবি থেকে বেশি দূরে নয়। লডোয়া যেতে আমি অধিকাংশ সময় ফ্লাই করেছি। এর আড়াই তিনদিন আগে অফিসিয়াল ভেহিকল বাইরোডে গিয়ে লডোয়াতে উপস্থিত থাকতো। আকাশ পথে ঘণ্টা দেড়েক; কিন্তু বাইরোডে আড়াইদিনই লাগে। প্রথম যেবার বাইরোডে যাই ইকুয়েটর মিস করেছিলাম। আমার কাঠখোট্টা ড্রাইভার গাইড করেনি। পরে অবশ্য প্রতিবারই থেমেছি। যাওয়ার পথে থামলে ডান পাশের একটা ঘর থেকে একজন লোক বের হয়ে আসতো। কিছু ডলার বা কেনিয়ান শিলিং দিলে লোকটা ইকুয়েটরের ম্যাজিক দেখাতো

-ম্যাজিকটা কি?
-এখন দেখাই? নাভিদ মুচকি হাসলো
-না।

নাভিদের বুকে দুটো কিল মেরে নোরিন ইকুয়েটরের ম্যাজিক বলার জন্য তাগিদ দিল।

-ইকুয়েটরের বাংলা আমার মনে নেই। ওটা একটা ক্লিয়ার কাট স্ট্রেইট লাইন। এই লাইন থেকে নর্দান হেমিস্ফেয়ারের দিকে বিশ মিটার দূরে গিয়ে পানি ভর্তি গামলায় লোকটা একটা কাগজের টুকরা রাখলো। সাথে সাথে কাগজটা স্পিডে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরতে লাগলে। সাউদার্ন হেমিস্ফেয়ারে একই দূরুত্বে এর ঠিক উল্টো ঘটলো; অর্থাৎ কাগজটি এন্টিক্লক ওয়াইজ ঘুরতে লাগলো। আর ইকুয়েটর লাইনে কাগজটি স্থির রইলো। ওই লাইনে তোমার ওজন ৬২ কেজি হবে যা প্রকৃত ওজন থেকে ৩% কম।

যাহোক, এরপর বনের মতোন এরিয়া; প্রচুর মধু। আমি নাম দিয়েছিলাম হানিফরেস্ট। যেতে যেতে এক সময় এলডোরেট শহর পড়বে। ওখানে আমার বন্ধু আছে। সাউথ সুদানে আমার চার বছরের মধ্যে ওকে তিন বছর পেয়েছি।

-মহিলা?
একটু উদ্ভিগ্ন হয়ে নোরিন জানতে চাইলো

-না। রিচার্ড এর কথা তোমাকে আগে বেশ কবার বলেছি।

যাহোক, পথে প্রচুর পাহাড় পাবে। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে একেবেকে পথ গেছে। মন ভরবেই। যতোবেশি এগুবে; সবুজ কমতে থাকবে। এক সময় দেখবে, একে-৪৭ কাঁধে ৬ ফুটাধিক লম্বা কোন যুবতী; ডেজার্টে গরু, ছাগল, উট দেখভাল করছে। একটু যদি তাকাই দোষ দিবেনা তো?

-ঘুষি দেব

-তা দাও। ওদের ছবি ওঠাবেনা কিন্তু; গুলি করে দেবে। একটা ঘটনা বলি।

কেনিয়াতে প্রথম যেবার গেলাম; নাইরোবিতে ইসরাইল এমব্যাসির বিপরীতে যে হোটেলটা আছে ওখানে অফিস আমার একরাতের জন্য থাকার ব্যাবস্থা করেছিল। যতদূর মনে পড়ে ওটা বিশপ রোডে। হোটেলটা এক্সপেন্সিভ কিন্তু সুবিধা কম। কমপ্লেমেন্টারি কিছু ছিলোনা। আড়াই ডলার দিয়ে আধা লিটার জল কিনেছিলাম। এর সপ্তাহ দুয়েক পর আমি লডোয়াতে যাই একটা রোগের এপিডেমিক ইনভেস্টিগেশনের জন্য। সাথে অন্য একজন ভিনদেশি কলিগ ছিল। “মিস্টার টি-কাট” চুলের সাড়ে ছয় ফুটের মতো লম্বা যুবতীর হাতে একে-৪৭ দেখে সে পুলকিত হয়। লোভী কলিগটা ক্যামেরায় ক্লিক করতেই সেই যুবতী তার দিকে বন্দুক তাক করেছিল। মেরেই ফেলবে। তখন পাশ থেকে একজন পরামর্শ দিয়েছিলে অর্ধেক ভরা বোতলটা দিয়ে দিতে। নাইরোবির সেই হোটেলটাতে এক বোতল পানির দাম আড়াই ডলার যা দিয়ে লডোয়া কিংবা টুরকানা সাউথে একটা ছোট সাইজের ছাগল কেনা যায়।

-ছাগলের কথা বলছ কেন?
-ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার থেকে ওরা বন্দুকগুলি কিনে। ডলার পাবে কোথায়? তাই বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ওরা ছাগল ব্যাবহার করে
-পরে তোমার কলিগের কি হয়েছিল?
-ওই অর্ধেক বোতল জলই সমাধান ছিল
-ভেরি ইন্টারেস্টিং।
নোরিন মন্তব্য করলো।

-হ্যাঁ; একটা একে-৪৭ সমান মাঝারি বা বড় সাইজের একটা ছাগল; যার বাজার দাম দিয়ে ইসরাইল এমব্যাসির বিপরীত থেকে দুই লিটার জলও কিনতে পারতাম না।

এই জল নিয়ে আমার কিছু কাহিনি আছে; আজ একটা শোনাই। তার আগে বলি, লডোয়া আসলে টুরকানা সেন্ট্রালের কাউন্টি হেড কোয়ার্টার। এখন অবশ্য জেলা বলে; কাউণ্টি না। তো সেন্ট্রাল থেকে টুরকানা সাউথে যাচ্ছিলাম। আমার নিরাপত্তা প্রধানের নাম ছিল জন; বেশ ইন্টিলিজেন্ট। উপতক্যার মধ্যে পাথুরে পথ দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগুচ্ছিলাম। সামনে হঠাৎ একে-৪৭ ধারী ২০-৩০ জনের একদল যুবক পথ আগলে দাঁড়াল। বাম দিক থেকে একই সংখ্যক বন্দুকধারী দৌঁড়ে আসছিল। জন ওর নিজের বাহিনীকে বন্দুক নামিয়ে ফেলতে বললো। পেছনের গাড়িতে আমি অতিভয়ে একেবারে ভয়শূন্য হয়ে পড়লাম।

-পরে কি হয়েছিল?
-জন নিগেশিয়েট করেছিল; জল দিয়ে।

মরুভূমিতে জলের বড় আকাল। ওখানে জায়গায় জায়গায় মরা নদির চিহ্ন আছে; লাঘা বলে। উগান্ডায় বৃষ্টি হলে লাঘায় প্রাণ আসে; ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড প্রাণ কেড়ে নেয়। নিজ চোক্ষে দেখেছি। কোন কোন এলাকায় ওই লাঘা খুঁড়ে খুঁড়ে ওরা চামড়া রঙের যেটুকু জল পায় তা দিয়েই দিন চালায়। শতকরা তিরাশি ভাগ লোক যাযাবর। কোথাও একটু জলের খবর পেলে ওরা সেখানে যায়। ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন এলাকার খোঁজ করে। ওদের জীবনে জল নেই; প্রেম নেই।

সত্যি বলছি, ওরা প্রেম বুঝেনা। টুরকানায় যেয়ে তুমি যদি কোন কিছুকে প্রেম হিসেবে চিহ্নিত কর; সেটার দাম কমপক্ষে চার ইউনিট পোষা প্রাণী। যার প্রতিটি ইউনিটে তিরিশটা গরু বা ছাগল বা ভেড়া বা উট থাকে।

আবার বলি, ওখানে প্রেম মানে কমপক্ষে ১২০ টা প্রাণি।

-বুঝিয়ে বল

-আজ না ময়না; আগামিকাল বলবো। তবে জানিয়ে রাখি, সবসময় সাথে জল রাখবে। মেইন লাইট অফ করে নীল লাইটটা অন করতে করতে নাভিদ দুষ্টুমি মাখানো হাসি দিলো।

এখন ওদের নিঃশব্দে কথা বলার সময়; তাই বাকি কাহিনি কাল হবে। এখন নোরিন বেশ উতলা হয়ে আছে; নাভিদ ততোধিক।

ঘর ভরা নীল জোছনা; এখনই কী বৃষ্টি নামবে?

দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে

মেঘ থেকে পড়ে গিয়ে হঠাৎ সেদিন আমার মৃত্যু হলো!
ঝরাফুল এলো, নদির কূল এলো
চোখ ভরে শিশির নিয়ে ভোর এসে বললো,
“আহা, বড় ভালো লোক ছিলো”!

রাতজাগা ঝর্ণাটা খুব অবাক হলো;
“এভাবে পড়ে গিয়ে মরে যাওয়া মোটেই ভালো কথা নয়!
এই মৃত্যু সারাতে অষ্টধাতুর তাবিজে যতো পাহাড় লাগবে
তার জন্য টারশিয়ারির ভূমিকম্পটা দ্বিতীয় বার খুব জরুরি”।

তারপর কতো ঝাড়ফুঁক, বেহুলার গান
নক্ষত্রে নক্ষত্রে অবিরাম প্রার্থণা এবং অতঃপর-
আস্ত একটা “সমুদ্র-পড়া” গায়ে ছিটিয়ে তবেই
কাল সন্ধ্যায় আমার “মৃত্যুটা” সেরে গেলো।

পড়ে গিয়েও যেটুকু লালরঙ আমার হৃৎপিণ্ডে অবশিষ্ট ছিল
তা দিয়ে হাওয়ার পায়ে আলতা মাখছিলাম;
হঠাৎ চোখ মেলে দেখি, ঈশ্বর কেমন
ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে !

পাছে ঈশ্বরের নজর না লাগে তাই কাছে এসো হাওয়া,
দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে তোমার কপালের বাম কোণে একটা রাত এঁকে দেই।

অণুগল্পঃ প্রতীক্ষা

অদূরে একটা বড় বটগাছ দেখে জুলেখা সেদিকে হাঁটা দিলো। ঘড়ি ধরে সাড়ে চার মিনিটের রাস্তা। ওখানে ঘাসের ওপর বসে খাবার জলের বোতলটা হাতে নিয়েছে মাত্র- জটাধারী একটা লোক ওর চোখে পড়ল। কাছেই একটা প্রশস্ত ঠেসমূলের আড়ালে বসে আছে। গলা এগিয়ে জুলেখা লোকটাকে একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। তার চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবে ভিতরে ঢুকানো। সম্ভবত লম্বা সময় সে জল খায়নি। বোতল নিয়ে জুলেখা লোকটার কাছে গেল।

-এই নিন; জল
-আমার এসবের দরকার হয়না। কোনদিনই না।
চোখ তুলে জটাধারী জবাব দিলো

-“কোনদিনই না” মানে?
-এই ধর শত বছর ধরে না, হাজার বছর ধরে না, তারো বেশি বছর ধরে না

প্রথমে বেশ ভয় পেলেও জুলেখা অল্প সময়ের মধ্যেই তা কাটিয়ে ওঠলো। কিছু রোগ আছে তাতে আক্রান্ত মানুষগুলো এমন আচরণের হয়। স্কিজোফ্রেনিয়া। তবুও লোকটাকে নিয়ে ওর ভিতর কিছু সংশয় রয়ে গেলো।

-আপনার বয়স কত?
লোকটা কৃত্রিম ভদ্রাচারের উর্ধে। জুলেখা এটা খুব সহজেই বুঝতে পেরেছে। তাই ভনিতা না করে সরাসরি প্রশ্নটা করেছে।

-জন্ম তারিখ বলতে পারবো। বয়স তুমি নিজে হিসেব করে নিয়ো।
জটাধারী জবাব দিলো

-বলুন
-ভুল বলেছি জুলেখা। জন্ম নয়, আমার মৃত্যু তারিখ বলতে পারব

লোকটাকে মানসিক রোগী মনে করে জুলেখা এতক্ষণ কিছুটা নির্ভয় থাকলেও এবার ভয়ে কাঁপতে লাগল। নিজের মৃত্যু তারিখ নিজে বলবে! তার নাম জুলেখা- এটাও সে জানে!

ভয় কমাতে জুলেখা একবার মাটির দিকে; একবার ওপরের দিকে তাকাল। ওপরে যেন আকাশ জুড়ে বট গাছটার ডালপালা। এত্তো বড় গাছ! কিন্তু ওতে একটা পাখিও নেই। এতে ওর মনে আরও একটু ভয় যোগ হলো। তবুও জটাধারীর সাথে সে কথা চালিয়ে গেল;

-সেটাই বলুন।
জুলেখা লোকটার কথিত মৃত্যু তারিখ শুনতে চাইল

-বেথিংহামে যে মুহূর্তে যীশু জন্ম নিলো তার একদিন দুই ঘণ্টা পাঁচ মিনিট আগে আমার মৃত্যু হয়
-এভাবে মেপে মেপে সময় কেন?
-আমার মৃত্যুর বেদনা দিয়েই মা মেরির প্রসব বেদনা শুরু হয়েছিল

জুলেখা এবার নিজের গায়ে নিজেই একটা চিমটি দিলো। লোকটা তা খেয়াল করেছে। “তুমি কোন স্বপ্ন বা ঘোরের মধ্যে নেই” বলে লোকটা মুখ খুলে হাসলো। জুলেখা দেখল, লোকটার দাঁতগুলো শ্যাওলা রঙের। কোন মাড়ি নেই, জিহবাও নেই। চোখ দুটো গর্তের ভিতর থাকলেও ভিন্ন রকমের সুন্দর। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত কিছু তার দুচোখে খেলে যাচ্ছে। সেই ঢেউয়ে কিছু স্বপ্ন আঁকা আছে- একটা এক কক্ষের ঘর এবং একজন রমণী। তবে সেই রমণীর চেহারা স্পষ্ট নয়।

-মৃত্যুর পর এই দুইহাজার আঠার বছর বছর সাত মাস ধরে আপনি কি করছেন?
-একজনকে খুঁজি।
-কাকে?

লোকটা কোন জবাব না দিয়ে মাটিতে একটা মুখ আঁকতে লাগলো। .

জুলেখা এক ঢোক জল পান করে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। কোথাও কেউ নেই। বামে দিগন্ত পর্যন্ত বালুচর। সম্মুখেও। ডানে অর্ধেক জায়গা জুড়ে তপ্ত লাভার উদগীরণ। বাকী অর্ধেকে একটা বাগান, অগনিত পাখি এবং একটা নীল জলের ঝর্ণা।

-কোথায় যাবে?
মাটিতে ছবি আঁকা শেষ করে জটাধারী জানতে চাইল

-জীবন নগর;
জুলেখা জবাব দিলো।

-এই পথে যাও
-কিন্তু ওদিকে তো লাভা, ফুলের বাগান এবং ওদুটোর মুখে সুউচ্চ পাহাড়ের দেয়াল
-তবুও যাও;
কথাটা বলে মুহূর্তেই জটাধারী নিরুদ্দেশ হল।

জুলেখা লাভা এবং বাগানের মাঝে সার্কাসের রশির মত সরু পথ দিয়ে এগুতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পাহাড়টার কাছে পৌঁছল। হালকা বাতাসে গাছের পাতা যেমন নড়ে পাহাড়ের পাদদেশে তেমনি একটা পাথর নড়ছে। তার ফাঁক দিয়ে একটা সরু পথ দেখা যায়। জুলেখা কাঁপা বুকে সেই পথটাতে প্রবেশ করলো। অন্যপাশে পৌঁছে সে একটা বিরান মাঠ দেখতে পেলো। কাছেই একটা ধবধবে সাদা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। একই রঙের কাপড়ে মুখসহ সারা শরীর ঢাকা একটা লোক; ঘোড়ায় বসে আছে।

-হুকুম আছে তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবার।
গম্ভীর গলায় লোকটা বললো।

জুলেখা ঘোড়ায় ওঠে বসলো।
-কে তুমি?

লোকটা জবাব দিলনা।

অদ্ভুত এক ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে পাহাড় পর্বত মরুভূমি সমুদ্র সব পেরিয়ে জুলেখা আলোর গতিতে যাচ্ছে। এক সময় একটা অদৃশ্য ইশারায় লোকটা থেমে বললো,

-এসে গেছি
-এতো সেই জায়গা যেখান থেকে আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম;
জুলেখা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলো

সাড়ে তিনহাত একটা জায়গা দেখিয়ে লোকটা বললো,
-আসলে তুমি ওই জমিটারই কাছাকাছি গিয়েছিলে। ভুল টিকেট; তাই আজ অন্দরে যাওয়া হলনা। তবে একদিন যাবেই।

কথাটা বলেই ঘোড়াসহ এই লোকটাও অদৃশ্য হল।

ক্লান্ত জুলেখার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। এর কিছু সময় পর চোখ খুলেই দেখে, সে একটা সাদা বিছানায় শুয়ে আছে। সম্মুখে বিশ্ববরেণ্য চিকিৎসক, দেশের রাজা, রাণী এবং উদ্ভিগ্ন স্বজনেরা বসে আছে। কারণ সুদীর্ঘ সময় কোমায় থেকে সে অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে এসেছে।

কিন্তু ওদের কাউকে নয়! জুলেখার চোখ কেবল সেই মানুষটাকে খুঁজছে যীশুর জন্মের আগে থেকে যে তার প্রতীক্ষায় আছে!

অণুগল্পঃ টোল

যা রোদ পড়েছে ! গামছা ভিজিয়ে মতিনুল মাথার ওপর চাপ দেয়। আসলে সে জাফলং দেখতে এসেছিল। যা শুনে এসেছিল সেসবের কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। ঘোলা পানি আর আধাডুব পাথর ছাড়া। আর দশ জনের মতো প্রথম দিনই সে ফিরে যেতে পারতো। নিজের বলে তার তো কেউ নেই। কোন পিছুটানও নেই। এসেছেই যখন তাই দিন কয়েকের জন্য রয়ে গেছে। খাসিয়া পাড়াসহ এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে। আর নদীর পাড়ে গিয়ে পাথর তোলা দেখে। সে চুক্তিতে এক বাড়িতে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছে।

গামছাটা মতিনুল আবার ভিজিয়ে নেয়। পায়ের কাছে একটা পাতলা পাথর। ওটা হাতে নিয়ে সে নদীর পানির সমান্তরালে ছুড়ে মারে। কেমন ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে পাথরটা অন্য একটা দেশ ছুঁয়ে দিল। এই দৃশ্যে মতিনুল আনন্দের বদলে কিছুটা বিষন্ন হল। সে ভাবলো, “চাইলে নিমিষেই অন্য একটা দেশ ছুঁয়ে দেয়া যায়। কিন্তু বুকের সাথে লেপ্টে থাকা মানুষকে হয়তো আমৃত্যু চেষ্টা করেও ছোঁয়া যায়না”।

অদূরে এক মধ্যবয়সী লোক পাথর ওঠাচ্ছে। আশে পাশে আরও অনেকে একই কাজ করছে। বিশ তিরিশ বছরের কিছু মহিলাও। মাঝে মধ্যে কিছু লোক এসে ওদেরকে কি যেন বলে যায়। পাইকার হবে হয়তো। তার মতো ভুলে কিছু পর্যটকও আসে। কিছুক্ষণ থেকে আফসোস করে চলে যায়। তাদের কেউ কেউ তখন জাফলং দেখার বদলে গায়ে কাপড় লেপ্টে থাকা মহিলাদেরকে দেখে।

তৃষ্ণায় মতিনুলের গলা শুকিয়ে গেছে। বোতলটা দেখল। বেশি জল বাকি নাই। তার জীবনের মতোই সম্ভবত। এক ঢোকে গলা ভিজিয়ে বোতলটা সে হাতের ডানে রাখল। তখনই ডান পাশ দিয়ে এক মহিলা যাচ্ছিল। দুদিন ধরে ঠিক এই সময় মহিলাটাকে সে এখান দিয়ে যেতে দেখে। মধ্যবয়স্ক লোকটার জন্য খাবার নিয়ে যায়।

মহিলাটার চেহারা বেশ মলিন। দেখলেই বুঝা যায়, প্রতারক দারিদ্র হিমোগ্লবিনের বদলে প্রতিদিন জাফলং এর ময়লা জল দিয়ে তাকে ভুল-বুঝ দেয়।

-আজ কি খাবার নিয়ে যাচ্ছেন?

মহিলা প্রথমে বুঝেনি যে তাকেই প্রশ্নটা করা হয়েছে। দুই কদম এগিয়ে যখনই বিষয়টা বুঝলো, ঘুরে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো;
-ভাতের সাথে শাক ভর্তা। সাথে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ।

মতিনুল জেনে নিয়েছে, মহিলার নাম সাহানা। স্বামী বাছিত মিয়া।

-ছেলে মেয়ে নাই?
-আছে। দূরে থাকে। খবর নেয়না
সাহানা জবাব দেয়।

“এটাই তো স্বাভাবিক। কে কার খবর নেয়”? মতিনুল স্বগোক্তি করে। পরক্ষণেই সে আবার ভাবে, “মানুষের জীবন নিজেই আসলে সুদখোর। ঠকানো ছাড়া হিসেবের খাতা মিলাতে পারেনা”।

আরো খুটিনাটি কিছু কথা বলে সাহানা চলে গেলো। তার শাড়ির নিচে পেটিকোট নেই। বাতাস শরীরের আপত্তিকর ভাজগুলো বিনা অনুমতিতে দেখিয়ে দিচ্ছিল।

ওরা অল্প দূরে। মতিনুল ওদের দুজনের সবকিছু স্পষ্ট দেখছে। বাছিত মিয়ার জমানো পাথর সবার চেয়ে কম। কিন্তু এতে সাহানার মন খারাপ হলনা। কারণ এটা নতুন কিছু না। কী আর করবে? শরীরে কুলায়না। বয়স হয়েছ। তার ওপর বাছিতের হার্টের একটা কপাট নাকি একটু ঢিলা। মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার বলেছিল। সেজন্যই নাকি বেশি হয়রান লাগে। কয়েক মিনিটের আলাপে মতিনুল এসব জেনেছে।

সাহানা খাবারেরে ডিব্বা খুলে আর একবার সে স্বামীর চোখের দিকে তাকায়; একবার কমবয়সী মহিলাদের দিকে। বাছিত মিয়া সাহানার কান্ড দেখে মিটমিটি হাসে। মতিনুল দেখছে, সাহানার রাগ হয়েছে। তার স্বামী আর কারো দিকে তাকাক নিশ্চয়ই সে এটা চায়না। কিন্তু রাগের নিচেই তো জল; মায়া। সাহানার আচরণে মতিনুল সেটা টের পায়।

ইতোমধ্যে মতিনুল ওদের একেবারে কাছে এসে বসেছে। সে দেখছে, জাফলং এর জলে ছিঁড়া আঁচল ভিজিয়ে সাহানা তার স্বামীর মুখ মুছে দেয় আর বলে,”এতো খাইটা অসুখ বাঁধাইয়োনা”। বাছিত কোন উত্তর দেয়না। এই কথার তো কোন উত্তর হয়না। সে চুপচাপ ভাতের সাথে শাকভর্তা মাখে। প্রথম নলাটা সে সাহানার মুখে দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই সাহানা ছোট হতে হতে ষোড়শী হয়ে যায়। তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে জাফলং এর পাঁথরে গিয়ে মিশে। কিন্তু মুখজুড়ে তৃপ্তির হাসি। তার গালের টোলটাও হেসে ওঠে।

সাহানার টোলে বাছিত মিয়ার মুগ্ধতা দেখে মতিনুল মনে মনে বলে, বাছিতের পঞ্চাশ বছরের জীবনে দেখা এই জাফলং কী কোনদিন ওই টোলটার মতো সুন্দর ছিল?