মিড ডে ডেজারট এর সকল পোস্ট

মিড ডে ডেজারট সম্পর্কে

I shall say bye to my sleepless night if “tomorrow” comes to me with a message that I’m waiting for last twenty years, Then I shall pray for one more “tomorrow” to send you back pieces of clouds bottle of dew and a “one-sea tears”!

সবাই সবই বুঝে তবুও নির্বোধ থাকে অনন্তকাল

তিনি চুলে মেহেদি লাগাতেন; ঠোঁটে কড়া লাল লিপষ্টিক। সাধারণত অষ্টাদশির জন্য মানানসই সালোয়ার-কামিজ তিনি পরতেন। বসন্তের শাড়িতেও তাঁকে দেখেছি; সাথে খোঁপায় ফুলের মালা এবং হাতে নানান রঙের চুড়ি। সুখের একটা সংজ্ঞা তাঁর কাছ থেকে জেনেছি। তাঁর বয়স চার কুড়ির মতো ছিলো; গলির শেষ মাথায় ঘর। এখন আর তাঁকে দেখিনা।

মাজহার ইসলাম; আমার খুব কাছের বন্ধু। শিক্ষকতা করে। সম্প্রতি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে বদলি হয়েছে। বেশ কবছর আগে ওদের একতলা বাড়িটা দৃষ্টিনন্দন বহুতলে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশে এসেছি মাজহার খবর পেয়েছে। সে মেসেজে জানালো, ওর পিতা স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আমরা তিন বন্ধু তাঁকে দেখতে গেলাম। তখন বাতাসের অক্সিজেন উনার জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। একইদিন অন্য একটা হাসপাতালে গেলাম; আরেক জনকে দেখতে। তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

পাঁচ তারিখ রাতে মাজহারের পিতা চলে গেলেন!

বিভিন্ন দেশে নানান ঘটনার কারণে মাঝে মধ্যে মনে হতো আমার নিরাপত্তা যথেষ্ট নয়; আমি ভালো নেই। বাসস্থান নিয়েও আমার এবং বন্ধুদের কারো কারো কিছু স্বপ্ন ছিলো । অনেকেরই ডুপ্লেক্স বাড়ি পছন্দ; আমারও । কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধু রাশেদ তার পুরান বাড়ির পাশে আরেকটা ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছে; নিখাঁদ ডুপ্লেক্স। আমিও একটা ডুপ্লেক্স করেছি; তবে খাঁদহীন নয়। সামর্থ অসামর্থের মিশেলে একটা সখের ডুপ্লেক্স।

চার কুড়ির প্রিয়দর্শিনীকে আর দেখিনা; জায়গাটাতে শুধু তাঁর একটা ছবি অবশিষ্ট আছে। তিনি অন্যকোথাও সাড়ে তিনহাতে ঘুমিয়ে আছেন ।

মাজহার ওদের ঢাকার সুখবাড়ি থেকে কাল ভোরে ওর পিতাকে সিরাজগঞ্জে নিয়ে গিয়েছে। ওখানে এক নিরালায় উনার শেষ ঠিকানা হয়েছে! বাতাসের অক্সিজেন উনাকে নিরাপত্তা দেয়নি! এটা সবারই হয়; একদিন আমারও হবে! বিভিন্ন দেশে আমার অনিরাপত্তার অসন্তুষ্টি তাই অর্থহীন মনে হয়।শ্বাস-প্রশ্বাস মানেই তো জীবনের নিরাপত্তা !

বেশি কিছু তো নয়; বন্দুক-নিরাপত্তা নয়, ডুপ্লেক্স ঘরও নয় ।
স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারলেই সব মানুষের বলার যোগ্যতা থাকা জরুরি, ভালো আছি।

হাত ভরা রঙিন চুড়িই সুখের বিশাল কারণ হতে পারে।
আল্টিমেটলি সেইতো সাড়ে তিন হাত…
সবাই সবই বুঝে; তবুও নির্বোধ থাকে অনন্তকাল!

কবিতাঃ আকাশ কেনো রঙ ছড়ায় রাত্রি হবার আগে

জলের ছাইয়ে মেঘ কি হয় কালো?
সাগর নদি সব পুড়ে কেন মেঘে মেঘে উড়ে !
বিজলীরা কি জলের কষ্ট-আলো?
আকাশ ছেড়া সেই জলেতেই সূর্য কেন পুড়ে !

আমার কিছু কথা আছে আরো
আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগে;
বলতে পারো
আকাশ কেনো রঙ ছড়ায় রাত্রি হবার আগে?

অণুগল্পঃ দেড়খানা রুটি

ইটের ওপর হাতুরির কয়েকটা ঠোকা দিয়েই সে খুকখুক করে কেশে ওঠলো। লোকটার নাম সনোজ। তনির সনোজ দা। বয়োবৃদ্ধ; দেখতে ষাটের ওপরে লাগে। লম্বা রোগা গড়ন। পুরানো শ্বাস কষ্টের রোগ আছে। তার জন্য তনির বড় মায়া হয়।

সনোজের দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে এনে তনি আকাশের দিকে তাকালো। এরপর সে আঁচল দিয়ে নিজের চোখ কচলালো। কপাল বরাবর হাত রেখে সে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের অবস্থান দেখলো। বেশ বেলা হয়ে গেছে।

-দাদা খাইবেন না? তনি জানতে চাইলো
-তোমার বৌদি তো এখনো খাবার নিয়া আইলোনা। সনোজ জবাব দিল।

দুপুর হলেই তার স্ত্রী কাপড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় থালা বেঁধে খাবার নিয়ে আসে। আজ আর আসবে কিনা তনির শঙ্কা হচ্ছে।

সনোজের সাথে কথা না বাড়িয়ে তনি দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। খাবার মানে নরম গুড় দিয়ে রুটি। অমৃতের মতো স্বাদ। সাথে কাঁচা মরিচে কামড় দিতে পারলে আরও স্বাদ হতো। দেড়টা রুটি খেয়ে বাকি দেড়খানা সে রেখে দিলো। মোট তিনটা এনেছিল। সনোজের স্ত্রী যদি খাবার নিয়ে আসে তাইলে বাকি দেড়খানাও সে খেয়ে নেবে । ইট ভাঙ্গা বড়ই কঠিন কাজ; খুব ক্ষুধা লাগে।

তনির পুরো নাম তনিমা বালা। মধ্যবয়সী। তবে গায়ে গতরে সে একেবারে যুবতী। চোখে কাজল পরে সে রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যায় পাড়ার যুবক পোলাপান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয় থাকে।

সনোজের মতো তনিও এই জায়গায় বহুদিন ধরে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। ছোটকালে বাবা মা জোর করে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করেছিল ঠিক; কিন্তু তার সংসার হয়নাই। ভিন্ন কিসিমের মেয়ে সে। ভাবতে জানে, বুঝে নিতে জানে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। আরজ আলী মাতব্বর কয়েকবার পড়েছে। সারাদিন ইট ভেঙ্গে ঘরে গিয়ে সে তার মতো করে হিসেব করে, কতোটা জীবন ভাঙ্গলো আজ !

তনি খেয়েছে তাও প্রায় আধা ঘণ্টা হয়ে গেলো। সনোজের খাবার এখনো আসেনাই। এরকম অনিয়ম ইদানিং মাঝে মধ্যেই হয়। কারণ তার স্ত্রী দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জ্বরে ভুগছে। অল্প অল্প জ্বর; বিকালের দিকে ওঠে। কেউ কেউ বলে, ওটা ক্ষয়রোগ। সনোজই এই খবর সবাইকে বলেছে। তনির মনে হয় তার সনোজ দারও ক্ষয়রোগ আছে। সে নিজের চোখে দেখেছে, মানুষটার কাশির সাথে রক্ত যায়। যাহোক, আজ হয়তো মহিলাটা ভালো নেই; তাই আসেনি। আসতে একটু সময়ও লাগতে পারে। কম করে হলেও তো দুই কিলো পথ। কুমার পাড়ায় বাড়ি।

এক কুড়ির বেশি লোক এখানে ইট ভাঙ্গার কাজ করে। কিন্তু সনোজ সবদিনই সবচেয়ে কম মাইনা পায়। কেমনেই বা বেশী পাবে? গায়ে শক্তি নাই; বেশি ইট তো ভাঙ্গতে পারেনা। ইটের খোয়ার মাপেই না মাইনার মাপ হয়। মাঝে মধ্যে কিছু টাকা বা এটা সেটা সনোজকে কিনে দিতে তনির খুব ইচ্ছে হয়। কেন এমন ইচ্ছে হয় সেই কথাটা তার গোপন সিন্দুকে যত্ন করে রাখা আছে। রাজা রাণীদের যেমন মজবুত গোপন সিন্দুক থাকে; ফকির মিসকিনদেরও তেমনি। আসলে সবারই। অন্যকেউ সেটার চাবির খোঁজ জানেনা। তনিরটাও না!

তনি আবার সূর্যের দিকে তাকালো। সে ভাবলো, এতো বেলা না খেয়ে সনোজ দা ভালো থাকবেনা। রেখে দেয়া দেড়খানা রুটি নিয়ে সে সনোজের জন্য ওঠবে ওঠবে করছিলো, তখনই দূরে তার সনোজবৌদির মতোই কেউ একজন আসছে দেখলো। একটু পর নিশ্চিত হলো, তাইই। হাতে সেই চেনা কাপড়ে বাঁধা থালা।

এক ঢোক জল খেয়ে তনি চোখ বন্ধ করে রইলো। তার ভালো লাগছেনা। কিছুক্ষণ পর ইট ভাঙ্গার হাতুরিটা সে আবার হাতে নিলো। অদূরে সনোজের স্ত্রী আঁচল ভিজিয়ে স্বামীর মুখ মুছতে মুছতে আফসোস করছে, “মুখটা কেমন শুকাইয়া গেছে”!

তনির মন আরও ভার হলো। চোখের সামনেই কিছু কাক তার দেড়খানা রুটি ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলো। অথচ সে তা খেয়াল করলোনা!

হাতুরি হাতে তনিমা বালা মনোযোগ দিয়ে জীবন ভেঙ্গে চলছে।

কবিতাঃ বৃষ্টির পায়ে কষ্টনূপুর

খোঁপাটা খুলে গেছে দেখো;
তোমার নাকফুল ছুঁয়ে দেই?
চুল সব মেঘ নিয়ে গেলো;
নাকের ডগার জলটুকু নেই?

মেঘের বাড়িতে জলের নিমন্ত্রণ
মেঘবাড়ি কী এক আকাশ-দূর?
জানালার পাশে দেখো দলছুট মেঘ;
বৃষ্টিরা আজ পায়ে পরেছে নূপুর!

তোমার চোখে আকাশ নেমেছে;
চোখের কোণ দুটো ছুঁয়ে দেই?
ওখানেও এতো জল? টলমল!
“তিনভাগে” বুঝি কোন জল নেই!

অণুগল্পঃ আবার পোষ্টমাষ্টার

ফিরিয়া লাভ নাই জানিয়াও বছর কয়েক পর তাহার ক্ষণিক ফিরিবার সাধ জাগিলো। একান্ত করিয়া পাইবার বাসনা হইতে নহে, শুধু এইটুকু বুঝিবার জন্য যে, অতোদিন পরে রতনের মনে কতোখানি জায়গা জুড়িয়া তিনি অবস্থান করিতেছেন।

অত:পর তিনি পুরাতন কর্মস্থলে পৌঁছিলেন । নতুন পোষ্টমাষ্টারের সাথে তাহার আলাপ হইলো; কৌশলে রতনের কথা জানিতেও কার্পন্য করিলেননা। ইহাতে তিনি বুঝিলেন, কোন কিছুই কাহারো জন্য পড়িয়া থাকেনা।

আবারো নৌকায় পাল উঠিলো । তাহার জন্য আর কেহ অশ্রুসিক্ত চোখে পাড়ে দাঁড়াইয়া থাকিবার নাই জানিয়াও তিনি বার বার পিছনে ফিরিয়া তাকাইলেন। তারপর বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া মনে মনে বলিলেন, “এই পৃথিবীতে সত্যিই কেহ কাহারো নহে” !

(দ্রষ্টব্যঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “পোস্টমাস্টার” গল্প)

অণুগল্পঃ মুহিতের কোটি বছরের পাঠ

বিষয়টা কাকতালীয় কিনা মুহিতের জানা নেই। এই সপ্তাহে আজ নিয়ে তিনদিন সে দিনের কিছুটা সময় বাসায় একা থেকেছে; যা সচরাচর ঘটেনা এবং বেছে বেছে এই তিন দিনই ঠিক একা থাকাকালীন সময়ে সামিয়া বাসায় এসেছে। প্রথম দুদিন মুহিত তাকে দরজার ওপার থেকে বিদায় করে দিয়েছিল।

সামিয়া ইসলাম; সম্পর্কে মুহিতের অল্প দূরত্বের শ্যালিকা। মুহিতের বিয়ের পর পর সামিয়া বিশেষ কারণে প্রায় মাস খানেক এই বাসায় ছিল। সহজ সরল এবং খুব বিনয়ী। কাছের লোকেরা বলে, “একেবারে ফার্স্ট ক্লাস একটা মেয়ে”!

সামিয়া আজ শীতের পিঠা নিয়ে এসেছে। হয়তো “ভ্যালেন্টাইন ডে” মাথায় রেখে। হার্ট-শেপ পিঠা। মুহিত মনে মনে ভাবে, মেয়েটা কেন তার বোনকে ফোন করে আসেনা? ওর বাসা বেশি দূরে নয়- কেবল এজন্যই কী?

-তোমার বোন দুই ব্লক পরেই একটা বাসায় গেছে; তোমার আসার কথা ওকে জানাচ্ছি
-না থাক, আমি এখনি চলে যাবো।
কথাটা বলার সময় সামিয়ার মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল।

-আচ্ছা, ঠিক আছে।
মুহিত জবাব দিলো।

ডাইনিং স্পেসে বসতে দিয়ে সে সামিয়ার মেয়ের কুশল জেনে নিলো। বছর দেড়েক আগে সে বিধবা হয়েছে। উনত্রিশ বছর বয়সে। মুহিতের মাও প্রায় একই বয়সে বিধবা হয়েছিলো। সামিয়াকে আবার সংসার করার জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে কয়েকবার বলা হয়েছে। কিন্তু যতোবার এসব নিয়ে কথা হয়েছে ততোবার সে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে দিয়েছে।

“উনত্রিশে তো অনেকে বিয়ে করে”, মুহিত ভাবলো এবং বিষন্ন হয়ে সে একবার সামিয়ার দিকে তাকালো।

-তোমার বাবার শরীর এখন কেমন?
সামিয়ার বাবা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। হার্ট ফাউন্ডেশনে ডাক্তার দেখাতে তিনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ওঠেছেন।

-বুঝতে পারছিনা। এঞ্জিওগ্রামে ব্লক এসেছে। কিন্তু ডক্টর রিং পরাননি। ওপেন হার্ট সার্জারির পরামর্শ দিয়েছেন।
সামিয়া জবাব দিলো।

এরপর দুজন কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সামিয়ার গা থেকে পারফিউমের তীব্র গন্ধ তার নাকে আসছে। মুহিত চাইছিলো সামিয়া তাড়াতাড়ি চলে যাক; তাই সে অনর্থক কথা বাড়াচ্ছেনা। আসলে আগের দুদিন ঘরে ঢুকতে না দেয়ার অপরাধবোধ থেকে সে আজ ওকে ভিতরে বসতে দিয়েছে। নইলে আজও তাকে কৌশলে দরজা থেকে বিদায় করে দিত। মহিলা বলে নয়; একা থাকলে সে কাউকেই ভিতরে আনার আগ্রহ দেখায়না। একাকীত্ব নয়; “কিছু সময় একা থাকা” সে উপভোগ করে। তখন সে নিজের ভিতরের আরেকজন মুহিতকে খুঁজে পায়। সে বিশ্বাস করে, দিনের কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে তখন মানুষ কার্যকরভাবে একাকীত্ব দূর করতে পারে। বহুজনে মানুষ বরং বেশি নিঃসঙ্গ হয়!

-কিছু বলবে সামিয়া?
নিরবতা ভেঙ্গে মুহিত জানতে চাইলো। কিছুদিন আগে সামিয়া বেশ কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। মুহিত ভাবলো, আজ হয়তো সেজন্যই এসেছে। লজ্জায় বলতে পারছেনা।

কিন্তু সামিয়া কোন জবাব দিলোনা। সে মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর ঘষতে লাগলো।

মুহিত আবার প্রশ্নটা করলো।
এবার সামিয়া মাথা তুলে তাকালো।

মুহিত দেখলো সামিয়ার দুচোখে বিশ্বটাকে পুড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্রমাগত আগুন জমা হচ্ছে। সেগুলিকে মুহিত তার হিসেবের যন্ত্রে নিয়ে যোগ বিয়োগ করার চেষ্টা করলো। সে অনুমান করলো, গত দেড় বছরে সামিয়ার চোখে এতো বেশী আগুন জমা হয়েছে যে তা পড়তে কোটি বছর লেগে যাবে।

সামিয়া চেয়ার থেকে ওঠে দাঁড়ালো। কিন্তু মুখে বললোনা যে, “আসি”। এর মানে, যাওয়ার জন্য সে ওঠে দাঁড়ায়নি। মুহিতের বুঝতে অসুবিধা হলনা যে সামিয়া হঠাৎ খুব সাহসী হয়েছে; সে এখনি হয়তো তার দিকে পা বাড়াবে।

তার ধারণাই ঠিক হলো।

কিন্তু সামিয়া যতোই এগোতে থাকলো মুহিতের ভিতরের মুহিত ততো প্রবল ভাবে জেগে ওঠতে লাগলো। সেই মুহিত তখন সামিয়ার আঁচল জুড়ে লেখা কেবল একটা শব্দই বৃহৎ হতে বৃহত্তর হতে দেখলো, “মা”!

কবিতাঃ দূরত্ব

প্রথমে একটা মৃত এবং তারপর জীবিত ধূমকেতু অতিক্রম করলে
সাতটা সমুদ্র পাবে;
সাথে আরো তেরোটা নদি পেরোলেই দেখবে হৃৎপিণ্ড রঙের একটা বাড়ি!
ওটার আশেপাশে যতো ব্ল্যাকহোল ছিল; পুড়িয়ে দিয়েছি।
বাড়ি নাম্বার সপ্তর্ষিমণ্ডল
রোড নাম্বার একটা নীলরঙ প্রজাপতি।

পথে এখানে সেখানে কিছু মৃত নক্ষত্র দেখবে
এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক কোটি হিমালয় !
তবুও পায়ে হেঁটেই বাড়িটাতে আসতে পারো;
ল্যান্ডমার্ক হিসেবে শুধু একটা সূর্যগ্রহণ মনে রেখো!

বাড়িটা বেশি তো দূরে নয়;
এক বেহুলার হৃৎপিণ্ড থেকে এক লখিন্দরের হৃৎপিণ্ড কেবল!

কবিতাঃ এখানেও গাছের পাতা নড়ে চড়ে

রেইনবোঁতে আইসক্রীম খাচ্ছিলাম। কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সে বললো, তোমার প্রেমে পড়তে চাই।
আমি বললাম, পড়ো
বয়স হয়েছে । প্ল্যাটোনিক প্রেম নয়, এই বলেই সবার সামনে সে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো;
আমি বললাম, মরো ।

একটু লজ্জা পেলো সে। তারপর ইতস্তত বললো, রাগ করেছো?
আমি বললাম: বন্ধু তুমি, এটুকু তাই করতেই পারো
এবার সে উল্টো একহাত নিলো, সবকিছুতেই আঁতলামি!?
আমি বললাম, মারবে যদি ওভাবে কেন মারো ?

তারপর অনেকদিন দেখা নাই। হঠাৎ সেদিন ইনবক্সে তার বার্তা:
শুনেছি দুনিয়া ঘুরছো! আমার কথা মনে পড়ে?
জবাবে লিখলাম: জানালায় চোখ রেখেই কনফার্ম করছি,
এখানেও গাছের পাতা নড়ে চড়ে !

দ্বিতীয় আমি

বিশেষ দরকারে নাইরোবি থেকে জেলা পর্যায়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে কাজের ফাঁকে একটা ডিভিশনে; এক নৃ-গোষ্ঠির বিদায়-বাসরের প্রস্তুতি দেখার জন্য। ওখানে ডিভিশন হলো জেলার ইমিডিয়েট নিচের এডমিনিস্ট্রেটিভ ইউনিট। জেলাকে ওরা এখন কাউণ্টি নাম দিয়েছে।

ওখানের কেউ আমাকে “কারিবু” বললো; কেউ “আবারিয়াকো” ।
জবাবে আমি “আসান্তে” এবং “মুজুরি সানা” বললাম।
এসবই গ্রিটিংস।

আমার জবাবে ওদের অনুভূতি এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় দেখে মনে হলো, মৃত্যু ওদেরকে একটু ভিন্নভাবে ভাবায়। কেনিয়ান এই নৃ-গোষ্ঠিটির নাম মনে নেই। স্বামী-স্ত্রীর একজন মারা গেলে ওদেরকে বিদায়-বাসর করতে হয়।

মৃত্যুর পর মৃতের সাথে ওরা অবিকল আরেকটা একটিভ বাসর করে কেন?
উত্তরটা খোঁজা হয়নি!

“মৃত্যু”কে বিদায়-বাসরের মাধ্যমে স্পেশাল করার পক্ষে বিপক্ষে নানান কথা বলা যাবে। ভাবতেই পারি, ওভাবে কেন? মৃত্যুকে স্পেশাল করার জন্য কতো কিছুই তো করা যেতে পারে! রঙে ঢঙ্গে বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে চির বিদায় দেয়ার সংস্কৃতির কথাও তো জানি।

কোনটা শুদ্ধ? কোনটা অশুদ্ধ?

আমার দুটো জগত আছে; বোধ করি অনেকেরই। সবার সাথে যে জগতে থাকি, সেখানে “শুদ্ধ” এবং “অশুদ্ধ” জোরালোভাবে বসত করে! তবে ওসবকিছুই ইম্পোজড!

একেবারেই নিজস্ব যে জগত আছে সেখানে “শুদ্ধ” এবং “অশুদ্ধ” বলে কিছু নেই। ওখানে “গ্রহণ করা” বা “না করা”র বিষয় কেবল!

কারো প্রস্থানে কি ব্যক্তির প্রতি সকল অনুভবের ক্রমান্বয়-মৃত্যু ঘটে? এটাই যদি নিয়ম হয়ে থাকে তাহলে সেটাও মনোজগতে সেঁটে দেয়া অনুভব; যা আমরা বুঝতে পারিনা! চিরবিদায় অনুষ্ঠানকেও যে আগমন অনুষ্ঠানের মতোন আনন্দময় করা যায় সেটা যেমন জানিনা!

বেধে দেয়া নিয়মটুকু আমার নয়; সবার সাথে আমার! ব্যাতিক্রমটুকুই শুধু আমার আপন জগতের! রঙে ঢঙ্গে বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে প্রফুল্ল চিত্তে বিদায় দেয়ার ব্যাতিক্রমের মতোন।

আছেই তো দুইখানা ঘটনাঃ জন্ম এবং মৃত্যু!
মাঝখানে কিছু ইম্পোজড নিয়ম, বিয়ে, বিশ্বাস এবং সন্ধ্যায় কারো কারো পথ হারানোর স্বপ্ন;

পাখির মতো!

অণুগল্পঃ ঈশ্বরকন্যা

তিনি চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছেন মাত্র; মন্ত্রী মহোদয় কক্ষে প্রবেশ করলেন। আগুন্তক খুব সংক্ষেপে তার পরিচয় দিলেন।

-একটা এ্যাপিল নিয়ে এসেছি ইয়োর এক্সেলেন্সি, আমপাতি যাবো
-কেন জনাব?
-এক মহিয়সী থাকেন; তাঁকে সালাম জানাতে।

একাত্তুরের শরণার্থীদেরকে যখন কেউ আশ্রয় দিতে সাহস পাচ্ছিলোনা; স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার কন্যাকে দনু নদির পাড়ে পাঠালেন।

মায়াবী দনু নদি;
মেঘালয়;
সাং আমপাতি।

আগুন্তক নিজ থেকে এসব বলে যাচ্ছিলেন।

ছয় বছরের শিশু পুত্রকে বুক থেকে একপাশে সরিয়ে রেখে সেখানে প্রায় অর্ধ লক্ষ বাংলাদেশী শরণার্থীর জন্য তিনি জায়গা করে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকল শরণার্থীর জন্য খাবারের আয়োজন করতেন। একসাথে সেই খাবার খেয়ে তিনি সারাক্ষণ তাদেরই একজন হয়ে থাকতেন।

আগুন্তকের কথা মন্ত্রী নিরবে শুনছিলেন। তিনি কক্ষ থেকে অন্য সবাইকে চলে যেতে বললেন।

কলেরা মহামারীতে যখন দনুপাড় সয়লাব তখন তিনি ফ্লোরেন্স নাইটেংগল হলেন। সেই মহামারীতে প্রায় তিন হাজার শরণার্থী মৃত্যু বরণ করে। ইয়োর এক্সেলেন্সি আপনি নিশ্চয়ই জানেন, সেই দিনগুলিতে কলেরার আরেক নাম ছিল যমদূত । নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি সেই যমের সাথে লড়েছিলেন।

আমি তাঁকে দেখতে যেতে চাই।

-তাঁর নাম তো রওশন আরা সাংমা
মন্ত্রী বললেন।

-প্রযত্নে ঈশ্বর
আগুন্তক যোগ করলেন।

-মা তো ঈশ্বরের কাছে ফিরে গেছেন !

কথাটা বলে মন্ত্রী জানালা দিয়ে মেঘালয়ের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন;

পিন পতন নিরবতা!

আগুন্তক চোখ খুললেন; কক্ষটা শূণ্য!
কোথাও কেউ নেই; কেবল একজন ছয় বছরের শিশু এবং চারচোখ দনু নদি ছাড়া !

জীবন-অতিজীবনের গল্প: নাগর

ঝর্ণার পা দুটো কোলে নিয়ে সুরুজ তাতে আলতা মেখে ছবি আঁকছে; আর স্বগোক্তি করছে,

“এটা সন্ধ্যার দুখিতারা, এটা একশ রাজপুত্তুরের রক্তে ভেজা জবা”

ঝর্ণা তন্ময় হয়ে শুনছে।

“এটা অন্তর নদি, এটা ঈশ্বরের হৃৎপিন্ড”

মুগ্ধতায় ঝর্ণার চোখ বুজে আসে। এক মহারাজের কোলে তার পা!
নিজেকে সে স্বপ্নের রাণি ভাবে; পুরো আকাশ তার আঁচলে।

চোখ থেকে মেঘ খুলে দিয়ে সে সুরুজকে বললো,
“এখানে আমার একটা বাড়ি আছে; একঘর জল আছে। এসো বাসর করি”।

ঝর্ণার একেকটা পায়ে সুরুজ ততোক্ষণে একটা করে রাতের আকাশ নামিয়ে এনেছে। বিছিয়ে দেবে বলে ঝর্ণা বুকের আঁচল সরালো; কারণ এখনি ঝড় ওঠবে!

হঠাৎ দরজার ওপারে বুড়িকন্ঠে একজন খেঁকিয়ে বললো,

“বাচ্চাডা কাইন্দা নীল হইয়া যায়; নাগর বিদায় কর”!

ছোটগল্পঃ লালরঙা শাড়ি

কাঁধে স্পর্শ পেয়ে আরিফ ঘুরে তাকালো।
পেছনে জবা।

– এই পাগলা, আমার সাথে এক জায়গায় যাবি?

আরিফের দূর সম্পর্কে চাচাতো বোন সে। বছর পাঁচেকের বড়।

আসলে আরিফ তখন বৈরাগীর ঘাটে দাঁড়িয়ে একমনে পানির ঘূর্ণিপাক দেখছিল। এটাতে তার অস্বাভাবিক আগ্রহ রয়েছে। এর পেছনে অবশ্য একটা উল্লেখযোগ্য কারণ আছে।

আড়াই বছর আগে আরিফের বাবা মারা গেছে। তখন ওর বয়স সাড়ে ছয় বছর ছিল। মৃত্যুর বছর দেড়েক পরে সে তার বাবার অনুপস্থিতি অনুভব করে। দিন যায় তার এই কষ্টানুভূতি বাড়তে থাকে। সে এমনও ভাবে, নদির গভীর থেকে একটা জাহাজে করে ওর বাবা ভেসে ওঠবে। বৈরাগীর ঘাটে দাঁড়িয়ে পানির ঘূর্ণিপাক দেখতে দেখতে আরিফ আজ যখন এই একই বিষয় নিয়ে ভাবছিল জবা তখনই তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।

-কোথায় যাবা বুবু?
কাঁধ থেকে জবার হাত নামিয়ে আরিফ জানতে চাইলো।

-পূঘলদীঘা বিলে। শামুক কুড়াব। ট্রেনও দেখব। যাবিনা?
-একটু দাঁড়াও। এক দৌঁড়ে মারে কইয়া আসি

বাড়ির কাছে তেমাথায় এসে সে একটু দাঁড়ায়। বিপরীত দিক থেকে একটা যাত্রার দল আসছিল। সারি বেঁধে কোথাও যাচ্ছে।
-এই নাগর, কই যাও?
যাত্রাদলের এক কম বয়সী মহিলা আরিফের চিবুক ধরে প্রশ্ন করে। বাকিরা হিহি করে হেসে ওঠে

-এইডা আমাদের বাড়ি;
কিছুটা বোকার মতে করে আরিফ জবাব দেয়।

পথে যাত্রাদল দেখে আরিফ যে আনন্দ পেয়েছিল বাড়িতে নানীকে দেখে তা মুহূর্তেই উবে গেল। সে তার বিধবা মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে চায়। এইজন্য মাঝে মধ্যে এই বাড়িতে আসে এবং মা মেয়ে ঝগড়া করে। কিন্তু সে আরিফের কথা ভাবেনা। ওর কাছে নানীকে তাই রুপকথার ডাইনী মনে হয়।

কাউকে কিছু না বলেই সে জবার সাথে পূঘলদীঘার পথ ধরলো। কী হবে কাউকে বলে? তার কথা তো কেউ শুনেনা। বুকের ভিতরে তার কেমন যেন লাগে! কারো সাথে তাই সে মন খুলে মিশেনা। দূর সম্পর্কের জবা বু ছাড়া।

খেয়া পার হয়ে ওরা দুজন কিছুক্ষণ নদির তীর বরাবর দক্ষিণ দিকে হাঁটলো। এরপর সোজা পশ্চিম দিকে আরো আধা ঘণ্টা। বিলের আগে আগে একটা মাদ্রাসা। পাশেই বিশাল বটগাছ। বর্ষাকালে বিলের পানি গাছটার কাছাকছি চলে আসে। তখন নাকি প্রায়ই মাঝরাতে এক বুড়িকে গাছটার উচু ডালে রান্না করতে দেখা যায়।

এরকম কতো কিছুই তো হয়!

ফকির বাড়ি কালো পুকুরের গভীর থেকে অমাবশ্যা রাতে নাকি সোনার কলসি ভেসে ওঠে। তাইলে নদিতে কেন নিচ থেকে জাহাজ ভেসে ওঠবেনা? আরিফ নিজেকে প্রশ্ন করে। উত্তর না পেলেও প্রশ্নটা নিজের মধ্যেই রেখে দেয়।

একসময় ওরা দুজন বিলে নামে। বিলটা বেশি বড় নয়। শামুক কুড়াতে কুড়াতে রেল লাইনের ধারে চলে যায়। আরও কয়েকজন ছেলে মেয়ে শামুক কুড়াচ্ছে। দূরে কেউ কেউ জলে নেমে পদ্মফুল তুলছে। লাল টুকটুক ফুল। অন্যসময় হলে আরিফ ওর মায়ের জন্য বেছে বেছে কিছু ফুল নিতো। আগে কোন অনুষ্ঠান হলে লালরঙ শাড়ি পরে ওর মা খোঁপায় ফুল গুজে নিতো; তাতে কী দারুণ যে লাগতো! বিধবা হবার পর থেকে লাল পেড়ে শাড়িও পরেনা।

পদ্মফুল বা শামুক নয়; পূঘলদীঘায় আরিফের আসার মূল উদ্দেশ্য ট্রেন দেখা। নানান কারণে আজ সে অস্থির।

-বুবু, ট্রেন কখন আসবে?
-জানিনা রে; বলেই জবা রেল লাইনে কান রাখলো।
তুইও কান পাইতা শুন; জবা যোগ করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লালরঙ ট্রেন এলো। আরিফ দেখছে, ট্রেনটা যেন কালো চুল উড়িয়ে যাচ্ছে; পরনে লাল শাড়ী। আরিফ মুগ্ধ চোখে ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে রইলো; যতক্ষণ দৃষ্টির মধ্য রইলো ততোক্ষণ।

-ট্রেনটা আমার;
ছোট বেলায় লাল শাড়ির মাকে স্মরণ করে আরিফ কথাটা বললো।

শিশু-মনোজগতে অদ্ভুত কিছু বিষয় খেলা করে। আরিফেরও করছে। মৃত্যুর দেড় বছর পর থেকে বাবার জন্য সারাক্ষণ কষ্ট পেলেও তা একা বয়ে বেড়ানো, মায়ের প্রিয় পোশাকের রঙের সাথে মিল পেয়ে একটা ট্রেনকে নিজের ভাবা; ইত্যাদি।

-না পাগলা। ট্রেনটা এইমাত্র চোখের বাইরে চইলা গেলো। ওইডা এখন আর তোর নাই; অন্যকারো।

জবা বুঝে না বুঝে মন্তব্য করলো।
বুঝেও বলতে পারে। গত বছর ওর বিয়ে হয়েছিল। ছয়মাস না যেতেই ডিভোর্স হয়েছে। ইতোমধ্যে সে তো জীবনের অনেক কিছুই জেনে গেছে। জবা তার নিজের অবস্থান থেকে একজন দার্শনিক। শিশু আরিফও। কে না?

এরপর আরিফ জবা ফির বাড়ির পথে হাঁটা ধরল। সামান্য এগিয়েই জবা বটগাছটার ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার প্রস্তাব করলো। আরিফের অসম্মতি জানানোর কোন কারণ ছিলোনা। মাদ্রাসার সামনে টিউবওয়েল থেকে জল খেয়ে ওরা ছায়ায় বসলো।

-ট্রেনটা যখন কাছ দিয়া যাইতাছিল আমি ভয় পাইছিলাম;
জবা বললো

-আমিও;
-এই দেখ, বুকটা এখনো কেমন ধড়পড় করতাছে;
আরিফের একটা হাত টেনে নিয়ে জবা তার বুকে চেপে ধরলো। কিন্তু আরিফ কিছু টের পেলনা; কোন কিছুই না।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা নদির পাড়ে চলে এসেছে। খেয়া নৌকায় কিছু লোক বলাবলি করছে, উজান থেকে অনেক বড় একটা জাহাজ আসছে। ভিতরে অদ্ভুত পোশাকের লোকজন। এই গায়েই নাকি ভিড়বে। খবরটা শুনে আরিফ শিহরিত হলো।

জাহাজে করে বাবা আসছেন- আরিফের এই বিশ্বাস ক্রমান্বয়ে শক্তি পাচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আজ মাকে নিজের ভিতরের সব কষ্টের কথা খুলে বলবে। জাহাজটির খবরও। বাবা ফিরে এলে আর কোন কষ্ট থাকবেনা। মা লাল শাড়ি পরে আবার চুল উড়িয়ে তাকে নিয়ে হাঁটবে। তিনজন মিলে একদিন যাত্রা দেখতে যাবে। কী সুন্দর যাত্রা দলের মেয়েগুলি! এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে আরিফ দ্রুত পা ফেলতে লাগলো।

কিন্তু সদর দরজায় এসে আরিফ থমকে দাঁড়ালো। ওঠোন ভরা লোকজন। ওর নানীও আছে। মায়ের পরনে আরিফের পছন্দের পুরনো লাল শাড়িটা; হাতে একটা ব্যাগ। মা তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আরিফকে এক পলক দেখে সে তার নিজের মাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করতে লাগলো। আড়াই বছর আগে আরিফ তার বাবার জন্য কাঁদেনি; আজ মায়ের জন্যও চোখের জল ফেললোনা।

ঘণ্টাখানেক আগেই লাল শাড়ির ট্রেনটা দেখে আরিফ জেনেছে, দৃষ্টির বাইরে গেলে নিজের কোন কিছুই আর নিজের থাকেনা।

গল্পে গল্পে স্মৃতিচারণঃ ব্যাঙফিস্ট

ব্যাঙ মাংসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রুম্মম বললো, নিকাশদাকে কেউ কি গত ছয়মাস ডাইনিং এ দেখেছেন? দেখবেনও না। কারণ উনি নিজ রুমে দুই বেলা ব্যাঙের মাংস খান”।

রুম নাম্বার ৩১১; ভিতরে আড়াই বাই সাড়ে ছয় ফুটের দুটি খাট। রিকাবী বাজার থেকে দেড়শ টাকা করে কেনা। দুটো খাটের ওপরই খোলা বই, জিন্সের ময়লা প্যান্ট, আন্ডারওয়ার এবং আরও হাবিজাবি। ওগুলো একপাশ করে যে যার মতো বসেছে। এক খাটে তিনজন এবং অন্যটাতে দু’জন। সবাই একমনে রুম্মমের কথা শুনছে।

একটু দম নিয়ে রুম্মম ফিসফিস করে বলতে লাগলো, “আপনারা আরেকটা খবর জানেন? বিয়ের এক বছর না যেতেই দাদার বউ প্রায় চলেই গিয়েছিল। তিরিশ ডোজ ব্যাঙের মাংস খাওয়ার পর বৌদি নতুন করে দাদার প্রেমে পড়েছে”। এখন তো বৌদি দাদার টানে মাঝে মধ্যে হোস্টেলে চলে আসেন। দাদার সিঙ্গেল রুমের সুবিধা পাইপাই অসুল করেন।

দুই খাটের মাঝে যে স্পেস সেখানে দাঁড়িয়ে রুম্মম এসব কথা বলছিল। খাটে চতুর্থ বর্ষের রাতিল,সঞ্জিত; পঞ্চম বর্ষের মুন্নাফ, জেমস এবং জায়েদুল। কেবল রুম্মম তৃতীয় বর্ষের। গুরুত্বপূর্ণ ওই সভায় নিকাশদা ছিলেন না। থাকার কথা না। এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই উনি বোর্ডস্ট্যান্ড করেছিলেন। কিন্তু মেডিক্যালে তিন বছর ধরে উনি পঞ্চম বর্ষে। তাই কিছুটা বন্ধুহীন। মেডিক্যাল কলেজে এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কোন ঘটনা না।

রুম্মমের গল্পের দ্বিতীয় অংশে জোস পেয়ে জায়েদুল ওঠে দাঁড়ালো। মুন্নাফ এবং রাতিলও ওঠবে ওঠবে করছিল।

-বৃষ্টিতে ক্যাম্পাস ডুবে আছে। এখনই ব্যাঙ ধরার উপযুক্ত সময়।
জেমস মন্তব্য করলো।

-মশাল আর হকিস্টিক লাগবে। বালতিও।
রুম্মম ওর এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিলো।

যেই কথা সেই কাজ। আধা ঘণ্টার মধ্যে ওরা ব্যাঙ শিকারে বের হলো। সাথে নতুন আরও দুজন যোগ দিয়েছে। চাঁদমুখী লোটনও। তবলায় ওর খুব নাম ডাক। কিন্তু আজ রাতে সে ব্যাঙ-সেনা।

-হকি স্টিকের কী ভিন্ন ব্যাবহার !? সবাইকে পিঞ্চ মেরে লোটন কথাটা বললো
-হকি স্টিকের এটা তৃতীয় ব্যবহার লোটন ভাই। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাবহারের মতোই কলঙ্কিত।

আজকের এরাই হকিস্টিকের দ্বিতীয় ব্যবহারে একে অপরের মাথা ফাঁটিয়েছে। পূর্ণিমা কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সুযোগটা হাত ছাড়া করলোনা।

পূর্ণিমা চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। লেডিস হোস্টেলে থাকে। প্রতিবেশী নাট্যগোষ্ঠীতে ওর সরব বিচরণ। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সে যোগ দিয়েছে। এই অভিযানে সে আজ সাতভাই চম্পা।

তিন চার ঘণ্টার মধ্যে ওরা শখানেক এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ব্যাঙ ধরে। সেসব থেকে বেছে বেছে শতাধিক লেগপিস আলাদা করে। এসব করতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে যায়। হোস্টেল ডাইনিং-এ কোন ফ্রিজ নাই। কোথায় রাখবে?

-চন্দ্রাদের বাসায়;
মুন্নাফ প্রস্তাব করলো।

চন্দ্রা পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা এবং বেশ সুশ্রী। সবার কাছে সে খুব প্রিয়। ওর বাবা অধ্যাপক, তাই টিচার’স কোয়ার্টারে থাকে।

যেই কথা সেই কাজ। মাংসগুলি সুন্দর করে তিনটা পলিথিন প্যাকেটে ভরে সবাই এক সাথে টিচার’স কোয়ার্টারে গেলো।

মুন্নাফ দরজায় কড়া নাড়লো। পাশে জায়েদুল। বাকীরা চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে। দু’বার কড়া নাড়ার পর চন্দ্রা দরজা খুলে দিল।

-তোমাদের ফ্রিজে কিছু মাংস রাখব
-কিসের মাংস?
-মুরগীর
-সত্যি মুরগীর?
-তিন সত্যি। দুই কানের লতিতে হাত দিয়ে মুন্নাফ বললো
-পাজির দল

গালিটা দিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ভাসিয়ে চন্দ্রা ভিতরে গেল। এক মিনিটের মধ্যে ওর বাবা দরজার কাছে এলেন। বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন বর্ষের ছয় সাত জনকে প্রায় মধ্যরাতে একসাথে দেখে তিনি চিন্তিত হলেন।

-কি চাও তোমরা?
-স্যার, ফিস্ট করার জন্য কিছু মুরগী কিনেছিলাম। ডাইনিং এর কর্মচারীরা ডিউটি শেষে আমাদের মুরগীগুলি প্রসেস করতে করতেই এতো রাত হয়ে গেলো। এখন তো আর রান্না করা যাবেনা তাই রাখতে এসেছি। যদি ফ্রিজে রাখতে দিতেন !

-এই পূর্ণিমা; ওরা ঠিক বলছে তো?
-স্যার, মুন্নাফ ভাই তো একটু আগেই চন্দ্রাদিকে কসম কেটে বলেছে
-ঠিক আছে; রেখে যাও

মুন্নাফ যখন প্যাকেটগুলি দিচ্ছিল সঞ্জিত পালকে খোঁচা দিয়ে লোটন বললো;
-এই, তোর ভগবানের নাম নে !

জেমসকে পূর্ণিমা বললো,
-আমি আল্লাহ আল্লাহ করছি। দাদা আপনি ঈশ্বরের নাম নেন
-কেন?
-স্যার যদি প্যাকেট খুলে দেখেন তাইলে কারো রক্ষা নাই!

পরদিন বিকেলের ওয়ার্ড শেষে মুন্নাফ আর রুম্মম চন্দ্রাদের ফ্রিজ থেকে মাংস নিয়ে যায়। প্যাকেট ইন্ট্যাক্ট দেখে ওরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। স্যার খুলে দেখেননাই।

জনপ্রতি তিরিশ টাকা করে চাদা তুলে পোলাও এর চাল, ঘি, মশলা ইত্যাদি কেনা হয়। কিছু বিয়ারও। পূর্ণিমাকে খবর দেয়া হয়েছিল। অভিযানের মজাটাই কেবল নিতে সে কাল এসেছিল; বাকী কিছু তার পক্ষে সম্ভব না।

রাত নয়টার মধ্যে রান্না শেষ হয়। হোস্টেলের অন্যকেউ জানেনা যে ডাইনিং এর পাতিলে ব্যাঙ এর মাংস রান্না করা হয়েছে। রান্না শেষ করেই সবাই পুকুরে গোসল করতে নামে। এতে ক্ষুধা বাড়বে; তাই। হোস্টেলের সামনে বেশ বড় পুকুর।

তখন রাত সাড়ে নয়টার একটু বেশি। সবাই আয়েশ করে খেতে বসেছে। কিন্তু অতো মাংস কী খাওয়া যায়? হোস্টেলের আর কে কে ব্যাঙ খেতে পারে সেটা ভেবে তাদেরকে গোপনে খবর দেয়া হলো। এক বাটি মাংস নিয়ে লোটন লেডিস হোস্টেলে গেলো। বাটিটা এগিয়ে দিতেই পূর্ণিমার সেকি বমি! শেষে লোটন পালিয়ে বেঁচেছে।

টিটোন ওর রুমমেট বদরুলের জন্য একবাটি নিয়ে গেলো। ভীষণ কৃপণ এই বদরুল। টাকা পয়সার অভাবে না। ওর সবাই লন্ডনি। স্বভাবে কৃপণ। কোনদিন কারো সাথে বাইরে খেতে যায়নি। কিন্তু চাইনিজের চিকেন ওর খুব পছন্দ। আধা খাওয়া মুরগীর রান এনে দিলেও খুব তৃপ্তি নিয়ে খায়। বাইরে খেতে গেলে টিটোন সাধারণত তার এই সাদা মনের কৃপণ বন্ধুটার জন্য কিছু খাবার প্যাকেট করে নিয়ে আসে।

-রুমমেট তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। দেখ, আজ অনেক মাংস এনেছি। ঠান্ডা হয়ে যাবে; জলদি খা
-থ্যাঙ্কস দোস্ত; বলেই বদরুল গোগ্রাসে খেতে লাগলো

টিটোন একফাকে ৩১১তে গিয়ে রাতিলকে পাঠিয়ে দেয়। চার নাম্বার রানটাতে কামড় দিতে যাবে তখনি জানালার পাশে রাতিল এসে দাঁড়ালো;

-বদরুল ভাই কি খান?
-টিটোন চাইনিজ থেকে মুরগীর মাংস নিয়ে এসেছে। খাবা এক পিছ?
-নাভাই। ব্যাঙফিস্ট খেয়ে পেট ভরে গেছে

সাথে সাথে ওয়াক ওয়াক করতে করতে বদরুল ওয়াশ রুমের দিকে দৌড়! তারচে বেশি জোরে রাতিল ৩১১ এর দিকে।

বদরুলের বমির খবর পেয়ে টিটোন সিদ্ধান্ত নেয় আজ সে রুমে ফিরবেনা। বাকীদের অনেকেই ৩১১ তে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো।

চার ক্যান বিয়ার ছিল। রুম্মম গ্লাসে ঢেলে সবাইকে দিলো। নিজে সবচে বেশি নিলো এবং লোটনকে সবচে কম। তারপর খাটে এবং ফ্লোরে সবাই সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। ওই সময় ৩১১ এর সামনে দিয়ে কারো হেটে যাওয়ার শব্দ পেলেই ওরা কোরাস করে ব্যাঙ ডাকার শব্দ করতে থাকে। এতে কেউ হেসে চলে যায়; কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, “ঘটনা কী”?

লোটন তখন ইন্টেশনালি আশপাশে ঘুর ঘুর করছিলো। কেউ “ঘ্যাগু… ঘ্যাগু” আওয়াজের রহস্য জানতে চাইলে সে বলে, “ভিতরে যারা আছে; ওদের পেটের ভিতর এখন একশটা ব্যাঙ। তাই ঘ্যাগু… ঘ্যাগু শব্দ হতেই পারে। কিন্তু আমি তো কোন আওয়াজ পাচ্ছিনা”!

আসলে, কাবাবিয়া রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে জাইয়ান দুই যুগ আগের এই স্মৃতিচারন করছে। ওর সামনে দেড় কুড়ি ডাক্তার। প্রায় সবাই জুনিয়র।

-নিকাশদা এখন কি করেন জানিস?
গল্পের এমন পর্যায়ে জাইয়ানকে এই প্রশ্ন করায় মাহবুবের ওপর জুনিয়রদের কেউ কেউ বিরক্ত হলো। মাহবুব জাইয়ানের সহপাঠী বন্ধু। কার্ডিয়াক সার্জন।

-শুনেছি, সাহারা মরুভূমিতে বৃষ্টির পানি কিভাবে ধরে রাখতে হয় তা শেখানোর কাজ করেন।

জাইয়ান গলা নামিয়ে টেনে টেনে ফান করে জবাব দিলো। সে দেখছিল, এক ফুটবল টিম ছেলে নিয়ে একলোক দরজা ঠেলে সস্ত্রীক প্রবেশ করছে। তার পেটটা অভাবনীয়ভাবে ব্যাঙের মতো।

লোকটা আরেকটু কাছে আসতেই জাইয়ান সবাইকে ফিসফিস করে বললো, “নি–কা–শ–দা”।

জাইয়ানের এই ফিসফিস আওয়াজ গল্প বলার কৌশল মনে করে উপস্থিত জুনিয়রদের একজন প্রশ্ন করলো,”তারপর”?

পেট্রোলিনার সাথে কিছুক্ষণ

পেট্রোলিনা ছুটি কাটিয়ে কাল এসেছে ! এখানে একটি এজেন্সিকে প্রতিনিধিত্ব করে। আজ দেখা করতে এসে সে কিছু জরুরি কথা বলতে চেয়েছিলো ! শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিলোনা ! আমার পেটে তখন ভাজ করা পরোটা আর আলুর দমের গভীর দাবি ! তাই প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করলাম।

ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথেই শিশুরা কেঁদে উঠে কেনো? পেট্রোলিনাকে প্রশ্ন করলাম।
সে রিপ্রোডাক্টিভ হেল্থ নিয়ে কাজ করে; আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছিলো হয়তো।
-তুমি ডিফারেন্ট কিছু জানতে চাইছো, পেট্রোলিনা বললো –

-চোখ খুলেই প্রতিটা শিশু অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর একটা নোটিশ পেয়ে যায় ! সেখানে মৃত্যুর দিন ক্ষণ উল্লেখ থাকে; সে পরে তা ভুলে যায় ! “মৃত্যু” জীবনের সবচে বড় এবং প্রথম সত্য ! এই সত্যটা এক সেকেন্ড বয়সী শিশুও জানে; তাই কাঁদে ! আমি মুচকি হেসে বললাম!

-দ্বিতীয় সত্য কি? পেট্রোলিনা জানতে চাইলো –

-আমার মাতৃ ভাষায় সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি দারুণ ছোট গল্প লিখতেন! তার একটা গল্পে দুটো চরিত্র আছে! একজন পোস্টমাস্টার; অন্যজন বালিকা রতন ! এ দুজনের মধ্যে রোদ-ছায়ার মতো এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয় ! পোস্টমাস্টারের চলে যাওয়ার সময় আসে ! সেদিন ঘাটে নৌকা ছিলো ! পোস্টমাস্টার রওনা হবেন; পাল উঠলো ! বালিকা রতনের মনেও যেনো কষ্টের পাল নিঃশব্দে উড়তে থাকলো! তখন নদীটা সম্মুখে নয় তার চোখের কোণ ছুঁয়ে বয়ে যাচ্ছিলো! নদীর ভাঙ্গা পাড় পোস্টমাস্টারের অন্তর অতিক্রম করলো ! চোখ জলে ছলছল হলো ! সে রতনের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ বোধ করলো! পরক্ষণেই ভাবলো, “ফিরিয়া লাভ কী? এই পৃথিবীতে কে কাহার?” এটিই হলো জীবনের দ্বিতীয় সত্য!

-তৃতীয় সত্য কি? আগ্রহ নিয়ে পেট্রোলিনা জানতে চাইলো –

-“মায়া” যা দ্বিতীয় সত্যের সাথে কিছুটা সাংঘর্ষিক; কিন্তু সত্য ! ঘরের মায়া, পরের মায়া, পথের মায়া-সব কিছুতেই মায়া ! আমি দেখছি তোমার চোখের কোণ এখন জলে ছলছল করছে! ঐ জলের উৎস কোন ঝর্ণা নয়; মায়া! বলতে পারো সত্য মায়া; বলতে পারো মিথ্যে মায়া; বলতে পারো পাঁচমিশালী মায়া ! জবাবে বললাম।

-চতুর্থ?

-আমাদের দেশে বিশেষ একধরনের আচরনের মানুষ আছে আমরা তাদেরকে বাউল বলি ! তারা দার্শনিক; তারা ঘরকে পর করে; কিন্তু পরকে আপন করেনা ! তুমি আমি এই যে ঠেলা গাড়ি ঠেলছি; রাজ্যের ক্লান্তি নেমে এসেছে তবু ঠেলছি ! ওরা এসবকে তুচ্ছ করে ! ওরা দেহতত্বে বিশ্বাসী – শরীর ও মনকে খুব গুরুত্ব দেয়! কোন কিছুই যে সাথে যাবেনা এটা ওরা শুধু বিশ্বাসই করেনা-অনুসরণও করে ! এই ঠেলাগাড়ি ঠেলাকে ওরা মোহ বলে ! আমরা মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও মোহমুক্ত হতে পারিনা ! সবই ভুল; এবং এই ভুলের বৃত্তে আজীবন বন্দি থাকার কারণ হলো মোহ; এটাই চতুর্থ সত্য!

-পঞ্চম?

-তুমি যখন কিশোরী ছিলে তখন কি চাইতে? সহজেই কী পাইতে সেসব? তখন তোমার মাথার ওপর “না” বলার শত কারণ ছিলো! মাঝপথ তো পেরিয়ে এসেছো ! মন যা চায় এখন কী তার সব কিছু করতে পারো?! তুমি কতোটা স্বাধীন? কতোটা পরাধীন? নিজের কাছে; পরিজনের কাছে?

আমি বলে দেই, তুমি চাইলেই সব পারোনা ! তুমি যদি বলো, পারিনা কারণ অনেক গুলো কণ্ঠ একসাথে “না” বলে ! সেটা আসল সত্য নয় ! পারোনা তুমি অতোটা শক্তশালী নও বলে ! তুমি সীমিত, তুমি নিজের কাছে বন্দি, তুমি সংকুচিত, তুমি তুচ্ছ ! সবার জন্য এটাই পঞ্চম সত্য!

-ষষ্ঠ?

-জানিনা ! তবে এই পাঁচটা সত্যকে একসাথে সাজাও: দুটোকে দুইপা, আর দুটোকে দুই হাত শরীরসহ, বাকিটাকে মাথা ! কী দাঁড়ালো?

-মানুষ ! পেট্রোলিনা জবাব দিলো!

সে মানুষ একজন তুমি, একজন আমি, একজন সে; তাঁর বসত পৃথিবীর আরেক কোণে
তার দূরত্বটাও কী জানি? হয়তো তিন ঘন্টার সূর্য দূরত্বে বসে সে মিছে কারো স্বপ্ন বুনে!
——————————————–
(কিছুটা সত্য; বাকিটুকুতে মনের রঙ লাগানো। পুরোটা পেট্রোলিনাকে অনুবাদ করে শুনিয়েছি)

অণুগল্পঃ উপরি

গাড়িতে উঠে বসেছি মাত্র; মিষ্টি হেসে মেয়েটি কাছে এলো
-কিছুক্ষণ আগে আপনার সাথেই কি ফোনে কথা বলেছি?
-আপনার ভুল হচ্ছে; মৃদু হেসে জবাব দিলাম
-ও আচ্ছা
কথা না বাড়িয়ে সে একটু দূরে সরে কারো জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। বয়স তিরিশ বত্রিশ হবে। স্বাভাবিক সাজসজ্জা। হাবেভাবে বেশ রুচির ছাপ আছে।

পাশের এক রিকশাচালক কী একটা মন্তব্য করলো বুঝা গেলনা। সম্ভবত মেয়েটির প্রতি ঋণাত্মক কিছু। গাড়িটা সেইফ পার্ক করে কেন জানি কী মনে করে মেয়েটার কাছে গেলাম। এই আচরণ নিজের কাছেই কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও আফ্রিকান সংস্কৃতির প্রচ্ছন্ন প্রভাবে তা সহজ হয়ে গেলো।
-আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে;
গায়ে পড়ে কথা বলা শুরু করলাম

-ঠান্ডা সহ্য করতে পারেন না? মুচকি হেসে মেয়েটা প্রশ্ন করলো
-তা কিছুটা
-কেন?
-মরুভূমিতে অভ্যস্ত; তাই
-মরুভূমিতে কি করেন?
-বাড়ি বাড়ি রুম হিটার সাপ্লাই দেই

মেয়েটা শব্দ করে হেসে উঠলো। এটা দেখে দুই রিক্সাওয়ালা টিপ্পনি কাটল
-তো এখানে কি করেন?
-একজনের জন্য অপেক্ষা করছি; জবাব দিলাম

অল্প দূরে এক লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলো। চোখে চোখ পড়তেই সে মুচকি হেসে বললো
-মামা দেবো এক ঠোঙ্গা?
ঝালমুড়িওয়ালার আমন্ত্রণ মেয়েটাকে রেফার করে বললাম;
-দেবে এক ঠোঙ্গা?
আমার নিমন্ত্রণে সে একটু অবাক হয়ে জবাব দিলো;
-জ্বী, আ…চ…ছা

মুড়ি খেতে খেতে জানতে চাইলাম,
-বাড়ি আশেপাশেই?
-হুম;
মফস্বল শহরে বড় হয়েছি। শেষ পর্যন্ত মাস্টার্স পরীক্ষাটা দেয়া হয়নি। ঢাকাতে বছর আটেক। শুরুতে একটা বেসরকারি অফিসে জব করেছি।কামরাঙ্গি চরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি।
-আচ্ছা
-তো আপনি কি করেন?
-হিউমেনিটেরিয়ান
-সেটা আবার কি?
-টেলিভিশনে দেখেননি? যুদ্ধ লেগেছে; মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য জতিসংঘ বা অন্যান্য লোক কাজ করছে। ওরা হিউমেনিটেরিয়ান
-একটু আগে না বললেন, রুম হিটার সাপ্লাই দেন!

মুড়িওলার হাত থেকে কৌটা নিয়ে স্পেশাল করে সে আমার জন্য আরেক ঠোঙ্গা ঝালমুড়ি বানালো।
তার জন্যও; নিজেরটাতে অনেক ঝাল যোগ করলো! বুঝতে বেগ পেতে হলোনা দুজনের মধ্যে পূর্ব পরিচয় আছে।

-এখন কি করেন?
মেয়েটা আগেই উল্লেখ করেছে যে, সে একটা বেসরকারী অফিসে জব করেছে। এখন কী করে সেটা না বলার যথেষ্ট কারণ আছে বুঝেও তাকে বোকার মতো প্রশ্নটা করে বসলাম।

সে আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সুযোগ পেলোনা; অথবা দিলনা। তার মোবাইলে কল এসেছে।
আগে যে ফোন করেছিলো হয়তো সে; অথবা অন্যকেউ।
-আমরা তিনজন
“ওরা তিনজন”; ফোনের অন্যপাশ থেকে আসা এই সংবাদে মেয়েটার মন ভার হলো।

ওদের কথাগুলো আমি বেশ পরিষ্কার শুনছিলাম।

“উহ, ঝাল! চোখে জল চলে এসেছে”, আমাকে শুনিয়ে বলতে বলতে মেয়েটা চলে গেলো।

কিন্তু অন্যপাশ থেকে আসা শেষ কথাটাই কেবল আমার কানে বাজতে লাগলো,

“সমস্যা নাই; উপরি পাবি!”