ব্যাঙ মাংসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রুম্মম বললো, নিকাশদাকে কেউ কি গত ছয়মাস ডাইনিং এ দেখেছেন? দেখবেনও না। কারণ উনি নিজ রুমে দুই বেলা ব্যাঙের মাংস খান”।
রুম নাম্বার ৩১১; ভিতরে আড়াই বাই সাড়ে ছয় ফুটের দুটি খাট। রিকাবী বাজার থেকে দেড়শ টাকা করে কেনা। দুটো খাটের ওপরই খোলা বই, জিন্সের ময়লা প্যান্ট, আন্ডারওয়ার এবং আরও হাবিজাবি। ওগুলো একপাশ করে যে যার মতো বসেছে। এক খাটে তিনজন এবং অন্যটাতে দু’জন। সবাই একমনে রুম্মমের কথা শুনছে।
একটু দম নিয়ে রুম্মম ফিসফিস করে বলতে লাগলো, “আপনারা আরেকটা খবর জানেন? বিয়ের এক বছর না যেতেই দাদার বউ প্রায় চলেই গিয়েছিল। তিরিশ ডোজ ব্যাঙের মাংস খাওয়ার পর বৌদি নতুন করে দাদার প্রেমে পড়েছে”। এখন তো বৌদি দাদার টানে মাঝে মধ্যে হোস্টেলে চলে আসেন। দাদার সিঙ্গেল রুমের সুবিধা পাইপাই অসুল করেন।
দুই খাটের মাঝে যে স্পেস সেখানে দাঁড়িয়ে রুম্মম এসব কথা বলছিল। খাটে চতুর্থ বর্ষের রাতিল,সঞ্জিত; পঞ্চম বর্ষের মুন্নাফ, জেমস এবং জায়েদুল। কেবল রুম্মম তৃতীয় বর্ষের। গুরুত্বপূর্ণ ওই সভায় নিকাশদা ছিলেন না। থাকার কথা না। এসএসসি, এইচএসসি দুটোতেই উনি বোর্ডস্ট্যান্ড করেছিলেন। কিন্তু মেডিক্যালে তিন বছর ধরে উনি পঞ্চম বর্ষে। তাই কিছুটা বন্ধুহীন। মেডিক্যাল কলেজে এটা অবশ্য অস্বাভাবিক কোন ঘটনা না।
রুম্মমের গল্পের দ্বিতীয় অংশে জোস পেয়ে জায়েদুল ওঠে দাঁড়ালো। মুন্নাফ এবং রাতিলও ওঠবে ওঠবে করছিল।
-বৃষ্টিতে ক্যাম্পাস ডুবে আছে। এখনই ব্যাঙ ধরার উপযুক্ত সময়।
জেমস মন্তব্য করলো।
-মশাল আর হকিস্টিক লাগবে। বালতিও।
রুম্মম ওর এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিলো।
যেই কথা সেই কাজ। আধা ঘণ্টার মধ্যে ওরা ব্যাঙ শিকারে বের হলো। সাথে নতুন আরও দুজন যোগ দিয়েছে। চাঁদমুখী লোটনও। তবলায় ওর খুব নাম ডাক। কিন্তু আজ রাতে সে ব্যাঙ-সেনা।
-হকি স্টিকের কী ভিন্ন ব্যাবহার !? সবাইকে পিঞ্চ মেরে লোটন কথাটা বললো
-হকি স্টিকের এটা তৃতীয় ব্যবহার লোটন ভাই। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাবহারের মতোই কলঙ্কিত।
আজকের এরাই হকিস্টিকের দ্বিতীয় ব্যবহারে একে অপরের মাথা ফাঁটিয়েছে। পূর্ণিমা কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সুযোগটা হাত ছাড়া করলোনা।
পূর্ণিমা চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। লেডিস হোস্টেলে থাকে। প্রতিবেশী নাট্যগোষ্ঠীতে ওর সরব বিচরণ। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে সে যোগ দিয়েছে। এই অভিযানে সে আজ সাতভাই চম্পা।
তিন চার ঘণ্টার মধ্যে ওরা শখানেক এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ব্যাঙ ধরে। সেসব থেকে বেছে বেছে শতাধিক লেগপিস আলাদা করে। এসব করতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে যায়। হোস্টেল ডাইনিং-এ কোন ফ্রিজ নাই। কোথায় রাখবে?
-চন্দ্রাদের বাসায়;
মুন্নাফ প্রস্তাব করলো।
চন্দ্রা পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা এবং বেশ সুশ্রী। সবার কাছে সে খুব প্রিয়। ওর বাবা অধ্যাপক, তাই টিচার’স কোয়ার্টারে থাকে।
যেই কথা সেই কাজ। মাংসগুলি সুন্দর করে তিনটা পলিথিন প্যাকেটে ভরে সবাই এক সাথে টিচার’স কোয়ার্টারে গেলো।
মুন্নাফ দরজায় কড়া নাড়লো। পাশে জায়েদুল। বাকীরা চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে। দু’বার কড়া নাড়ার পর চন্দ্রা দরজা খুলে দিল।
-তোমাদের ফ্রিজে কিছু মাংস রাখব
-কিসের মাংস?
-মুরগীর
-সত্যি মুরগীর?
-তিন সত্যি। দুই কানের লতিতে হাত দিয়ে মুন্নাফ বললো
-পাজির দল
গালিটা দিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ভাসিয়ে চন্দ্রা ভিতরে গেল। এক মিনিটের মধ্যে ওর বাবা দরজার কাছে এলেন। বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন বর্ষের ছয় সাত জনকে প্রায় মধ্যরাতে একসাথে দেখে তিনি চিন্তিত হলেন।
-কি চাও তোমরা?
-স্যার, ফিস্ট করার জন্য কিছু মুরগী কিনেছিলাম। ডাইনিং এর কর্মচারীরা ডিউটি শেষে আমাদের মুরগীগুলি প্রসেস করতে করতেই এতো রাত হয়ে গেলো। এখন তো আর রান্না করা যাবেনা তাই রাখতে এসেছি। যদি ফ্রিজে রাখতে দিতেন !
-এই পূর্ণিমা; ওরা ঠিক বলছে তো?
-স্যার, মুন্নাফ ভাই তো একটু আগেই চন্দ্রাদিকে কসম কেটে বলেছে
-ঠিক আছে; রেখে যাও
মুন্নাফ যখন প্যাকেটগুলি দিচ্ছিল সঞ্জিত পালকে খোঁচা দিয়ে লোটন বললো;
-এই, তোর ভগবানের নাম নে !
জেমসকে পূর্ণিমা বললো,
-আমি আল্লাহ আল্লাহ করছি। দাদা আপনি ঈশ্বরের নাম নেন
-কেন?
-স্যার যদি প্যাকেট খুলে দেখেন তাইলে কারো রক্ষা নাই!
পরদিন বিকেলের ওয়ার্ড শেষে মুন্নাফ আর রুম্মম চন্দ্রাদের ফ্রিজ থেকে মাংস নিয়ে যায়। প্যাকেট ইন্ট্যাক্ট দেখে ওরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। স্যার খুলে দেখেননাই।
জনপ্রতি তিরিশ টাকা করে চাদা তুলে পোলাও এর চাল, ঘি, মশলা ইত্যাদি কেনা হয়। কিছু বিয়ারও। পূর্ণিমাকে খবর দেয়া হয়েছিল। অভিযানের মজাটাই কেবল নিতে সে কাল এসেছিল; বাকী কিছু তার পক্ষে সম্ভব না।
রাত নয়টার মধ্যে রান্না শেষ হয়। হোস্টেলের অন্যকেউ জানেনা যে ডাইনিং এর পাতিলে ব্যাঙ এর মাংস রান্না করা হয়েছে। রান্না শেষ করেই সবাই পুকুরে গোসল করতে নামে। এতে ক্ষুধা বাড়বে; তাই। হোস্টেলের সামনে বেশ বড় পুকুর।
তখন রাত সাড়ে নয়টার একটু বেশি। সবাই আয়েশ করে খেতে বসেছে। কিন্তু অতো মাংস কী খাওয়া যায়? হোস্টেলের আর কে কে ব্যাঙ খেতে পারে সেটা ভেবে তাদেরকে গোপনে খবর দেয়া হলো। এক বাটি মাংস নিয়ে লোটন লেডিস হোস্টেলে গেলো। বাটিটা এগিয়ে দিতেই পূর্ণিমার সেকি বমি! শেষে লোটন পালিয়ে বেঁচেছে।
টিটোন ওর রুমমেট বদরুলের জন্য একবাটি নিয়ে গেলো। ভীষণ কৃপণ এই বদরুল। টাকা পয়সার অভাবে না। ওর সবাই লন্ডনি। স্বভাবে কৃপণ। কোনদিন কারো সাথে বাইরে খেতে যায়নি। কিন্তু চাইনিজের চিকেন ওর খুব পছন্দ। আধা খাওয়া মুরগীর রান এনে দিলেও খুব তৃপ্তি নিয়ে খায়। বাইরে খেতে গেলে টিটোন সাধারণত তার এই সাদা মনের কৃপণ বন্ধুটার জন্য কিছু খাবার প্যাকেট করে নিয়ে আসে।
-রুমমেট তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। দেখ, আজ অনেক মাংস এনেছি। ঠান্ডা হয়ে যাবে; জলদি খা
-থ্যাঙ্কস দোস্ত; বলেই বদরুল গোগ্রাসে খেতে লাগলো
টিটোন একফাকে ৩১১তে গিয়ে রাতিলকে পাঠিয়ে দেয়। চার নাম্বার রানটাতে কামড় দিতে যাবে তখনি জানালার পাশে রাতিল এসে দাঁড়ালো;
-বদরুল ভাই কি খান?
-টিটোন চাইনিজ থেকে মুরগীর মাংস নিয়ে এসেছে। খাবা এক পিছ?
-নাভাই। ব্যাঙফিস্ট খেয়ে পেট ভরে গেছে
সাথে সাথে ওয়াক ওয়াক করতে করতে বদরুল ওয়াশ রুমের দিকে দৌড়! তারচে বেশি জোরে রাতিল ৩১১ এর দিকে।
বদরুলের বমির খবর পেয়ে টিটোন সিদ্ধান্ত নেয় আজ সে রুমে ফিরবেনা। বাকীদের অনেকেই ৩১১ তে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
চার ক্যান বিয়ার ছিল। রুম্মম গ্লাসে ঢেলে সবাইকে দিলো। নিজে সবচে বেশি নিলো এবং লোটনকে সবচে কম। তারপর খাটে এবং ফ্লোরে সবাই সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। ওই সময় ৩১১ এর সামনে দিয়ে কারো হেটে যাওয়ার শব্দ পেলেই ওরা কোরাস করে ব্যাঙ ডাকার শব্দ করতে থাকে। এতে কেউ হেসে চলে যায়; কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, “ঘটনা কী”?
লোটন তখন ইন্টেশনালি আশপাশে ঘুর ঘুর করছিলো। কেউ “ঘ্যাগু… ঘ্যাগু” আওয়াজের রহস্য জানতে চাইলে সে বলে, “ভিতরে যারা আছে; ওদের পেটের ভিতর এখন একশটা ব্যাঙ। তাই ঘ্যাগু… ঘ্যাগু শব্দ হতেই পারে। কিন্তু আমি তো কোন আওয়াজ পাচ্ছিনা”!
আসলে, কাবাবিয়া রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে জাইয়ান দুই যুগ আগের এই স্মৃতিচারন করছে। ওর সামনে দেড় কুড়ি ডাক্তার। প্রায় সবাই জুনিয়র।
-নিকাশদা এখন কি করেন জানিস?
গল্পের এমন পর্যায়ে জাইয়ানকে এই প্রশ্ন করায় মাহবুবের ওপর জুনিয়রদের কেউ কেউ বিরক্ত হলো। মাহবুব জাইয়ানের সহপাঠী বন্ধু। কার্ডিয়াক সার্জন।
-শুনেছি, সাহারা মরুভূমিতে বৃষ্টির পানি কিভাবে ধরে রাখতে হয় তা শেখানোর কাজ করেন।
জাইয়ান গলা নামিয়ে টেনে টেনে ফান করে জবাব দিলো। সে দেখছিল, এক ফুটবল টিম ছেলে নিয়ে একলোক দরজা ঠেলে সস্ত্রীক প্রবেশ করছে। তার পেটটা অভাবনীয়ভাবে ব্যাঙের মতো।
লোকটা আরেকটু কাছে আসতেই জাইয়ান সবাইকে ফিসফিস করে বললো, “নি–কা–শ–দা”।
জাইয়ানের এই ফিসফিস আওয়াজ গল্প বলার কৌশল মনে করে উপস্থিত জুনিয়রদের একজন প্রশ্ন করলো,”তারপর”?