নাজনীন খলিল এর সকল পোস্ট

সব যাত্রা পূর্বনির্ধারিত নয়

সব যাত্রা পূর্বনির্ধারিত নয়
রাত নেমে এলে গাছেরাও হিংস্র হয়ে উঠে। পাতাগুলো ছড়াতে থাকে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড।

আমার যে কী হয়! রাত নামলেই ইচ্ছে করে কোন ঝোপালো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে সারারাত পাতার বাঁশি বাজাই। যেমন বাজাতাম শৈশবের অলস উদাস দুপুর গুলোতে। বাজাই আর পান করি সোনালি জ্যোৎস্নার অমিয়দ্রাক্ষারস।

আমার কোন আপত্তি নেই রাতভর পাতার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ফুসফুস ভরে নিতে। সারাদিন কত মানুষের ছড়িয়ে দেওয়া বিষ ঢুকে যায় শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর শরীর সেই বিষগুলো নিতে নিতে হয়ে গেছে নীলকণ্ঠ পাখি। কণ্ঠনালীতে জমে আছে কালকুটের ভরা থলে।

হয়না। রাতগুলো থাকে লৌহদরোজার নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বন্ধী। দূরে থাকে গাছ। পাতার বাঁশি।
পাহাড়সমান অনতিক্রম্য বাধা অতি ক্ষুদ্র এক ইচ্ছেপূরণের পথেও!

পুনর্জন্মবিশ্বাসী হলে আমি চাইতাম খোঁপায় বুনোফুল গোঁজা এক পাহাড়ী আদিবাসি রমনীর জীবন। হ্যাঁ জন্মে জন্মে আমি এক নারীই থাকতে চাই। কিন্তু সেই নারী এই নিগড়বন্ধী সমাজের কেউনা। জীবন হবে মুক্তবিহঙ্গের মতো, প্রজাপতির মতো স্বচ্ছন্দবিহারের। যে নারীরা অবগুণ্ঠনের আড়ালে লুকোয়না তাদের নারীত্ব——–বিব্রত নয় লোভীচোখের নগ্ন-চাহনীতে। উৎসবের রাতে মহুয়ার নেশায় ঘোরমাতাল হয়। নাচে তার পুরুষের হাতে হাতে ধরে, পায়ের তালে তালে তাল মিলিয়ে। ঝোরার জলে পা ডুবিয়ে বঁড়শিতে মাছ ধরে। চুলে মহুয়ার ফুল গুঁজে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ীঝর্ণার মতো বন্ধনহীন।

জীবনতো হবেই এমন সহজ আর অনাবিল।
নিরিবিলি রাতে পাতার বাঁশি বাজানোর সুযোগহীন জীবন আমার চাইনা।
এমন নয় যে এই বাঁশির সুরে তৈরি হয় কোন মোহনীয় আবেশ, বরং খানিকটা বিকট অথবা উদ্ভট মনে হয় কখনো কখনো। কিন্তু বাজাতে পারলে প্রাণের অফুরান স্পন্দনের শব্দ বেজে উঠে ঠিকই।
এই ইচ্ছেপূরণের ব্যর্থতাকে আমূল গ্রাস করে ফেলে সীমাহীন বিষাদের নীলঢেউ। আর সারারাত সেই উথালপাথাল ঢেউয়ের নাগরদোলায় দুলতে থাকে পৃথিবী।

ঘুম আসেনা। ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী কেবলই পালিয়ে বেড়ায়। ছড়াগানের ছন্দে ছন্দে ঘুমে ঢুলু ঢুলু সেই চোখ দু’টোই যে ফেলে এসেছি সহস্র আলোকবর্ষ দূরের শৈশবে —- কেন যে বারবার ভুলে যাই! সেই মায়াভরা শিশুকাল আর ফিরবেনা। তবু হাতছানি দেবে। পিছু ডাকবে। আরো অনিদ্রায় অনিদ্রায় ভরে দেবে ব্যাকুল রাতগুলো।

খুব চড়ামূল্যে কিনে নিতে হয় নিজস্ব নির্জনতাটুকু। আর এই মহামূল্য নির্জনতার ভেতরেই ঢুকে পড়ে পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল। নিজের সাথে কথা বলতে গেলেই শুরু হয়ে যায় চাওয়াপাওয়া যোগবিয়োগের অংক। জীবনতো কখনো শুরু হয়না কোন অংকের সূত্রে। তবে কেন এত হিসেবের মারপ্যাঁচ উঠে আসে ! কেন যে খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনটাকে স্মৃতিশূন্য কিংবা একেবারে অনুভুতিশূন্য করে ফেলা যায়না ! কেন যে!

বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না জীবনে কিছু পাগলামি না থাকলে। এই এখন যেমন একশ তিন ডিগ্রী জ্বর নিয়ে কুয়াশাভেজা ব্যালকনিতে বসে হি হি করে কাঁপছি। মনে হচ্ছে এর চাইতে আনন্দদায়ক আর কিছু ঘটেনি এই জীবনে। এমনকি এখন যদি আকাশভাঙ্গা জ্যোৎস্না নেমে এসে প্লাবিত করে দিতে চায়, তাকে বলবো– ‘এখন নয়। এখন এই জ্বরতপ্ত অন্ধকার নির্জনতাই আমার প্রিয়। আলো চাইনা’।

যাপিতজীবন আর স্বপ্নের মাঝখানে এক রেললাইন ফাঁক। আজীবন পাশাপাশি তবু কেউ কাউকে ছোঁয়না ; কেবলই সমান্তরে ছুটে চলা আকাশ আর সমুদ্রের মতো।

দৃশ্যতঃ আমার কোথাও যাবার ছিলনা।
তবু চোরাটানে আবার এসে দাঁড়াই ইস্টিশনে। টিকেট কাউন্টারের জানালায় হাত বাড়িয়ে এক অচেনা গন্তব্যের টিকিট কিনে ফেলি।

সব যাত্রাইতো আর পূর্বনির্ধারিত নয়।

রাতের পৃথিবী

fogg

কোন কোন ঘুম ভাঙ্গা রাতে দেখি
পৃথিবীটা নিঃসম্বল ভিখিরির মতো
ফুটপাথে কানা উঁচু থালা পেতে বসে আছে।
তন্দ্রাবেশে কুয়াশাভেজা নিস্তেজ রাত।

বাতাসের গায়ে গন্তব্যের প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে
একটি নিশাচর পাখি উড়ে গেলে; তুমুল
পাখসাটে হু হু করে বাজে অস্ফুট ব্যথাচ্ছন্ন এক সুর।
কখনোবা মানুষও তো পরিযায়ী পাখি!

শোনা না শোনার দোলাচলে হিস হিসে ধ্বনি বাজে ;
ঝলসে ওঠে রাতের চাবুক।

একটা প্রকাণ্ড কালো মাকড়শার মতো
কিলবিলে দশপায়ে হেঁটে যাচ্ছে জমকালো রাত।

যেতে যেতে কোথাও কী কিছু ফেলে গেলো কেউ
একটি পতত্র? এক ফোঁটা বিষ?

কবিতা

ভরসন্ধ্যার খাতা খুলে দেখি
তরঙ্গের ধ্যানমগ্ন মুদ্রার বিন্যাস,
যা কখনো শেখোনি তুমি জোয়ারভাটিতে;
অগাধ জলের শিথানে চোখ রেখে
দেখে গেছো শুধু মাছেদের কেলি
শেখোনি মাছের প্রকারভেদ,
কানকোর ভিন্ন গঠনপ্রকৃতি।

নোনাজল দেখেছো শুধু,
দেখোনি নিষিক্ত চোখের পাথর।

প্রত্যাবর্তনের কাল

কোথাও কী রেখে গেছে
সর্ষে ফুলের ঘ্রাণ?
তৃণের হরিৎ ছায়া?

এক চোখ বুজে পিপ-শোর দৃশ্যগুলো
দেখতে দেখতে
মনে হলো
এক্ষুণি সেই চিঠিটা লিখে ফেলতে হবে
যার খচড়া তৈরি হয়েছিলো পার্চমেন্টে,
হাজার বছর আগে।
লিখে ফেলতে হবে সেই গল্পটা
কীভাবে রঙ-বিভোর পাখির বুকে
বিঁধেছিলো পারিজাত কাঁটা।
গোলাপ আঁকতে গিয়ে
শুধু শূন্য এঁকে যাওয়া
সেই অসমাপ্ত ছবির কথাও
মনে আছে আমার……….

পাথর থেকে গড়িয়ে পড়া
বহুবর্ণ অক্ষরের গল্প বলতে বলতে
উড়ে যাচ্ছিল কাকাতুয়া
ঝুটিতে সূর্যের রং………

অতীতের ঘরে ফেলে যাওয়া
একটি পায়ের জলছাপ
একদিন খুঁজে পাবে কেউ; মনে হয়

ফিরবে সে, হাজার আলোকবর্ষ পরে।

সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট/মুক্তগদ্য

এক প্রচণ্ড ঝড় উঠলো। ধুলোর। যেখানে যা কিছু ছিল স্থির, সব ছিটকে সরে গেল এখান থেকে ওখানে। লণ্ডভণ্ড।

ল্যাম্পপোস্টের গায়ে লেপ্টে থাকা মৃত প্রজাপতির চোখে তখনো সরব হয়ে ছিল এক বিস্মিত তীব্র জিজ্ঞাসা– আলোর কাছাকাছি গেলেই পুড়তে হবে কেন! কিছুক্ষণের ভেতরই মৃতমাংস সন্ধানী পিঁপড়ারা ভীড় করবে এখানে।আত্মাহুতি দেবে আরো কিছু ক্ষুদ্রকায় প্রাণ। প্রখর তাপে পতঙ্গ পুড়ে। পুড়ে খাদ্য সন্ধানী পিপীলিকা এবং যে তীব্রতাপ পুড়ায় পতঙ্গ, সেই খরদহন কখনো কখনো মানুষের নরম হাতগুলোতে ছড়িয়ে দেয় ফোসকার দাগ। আজীবনের।

এই যে মানুষ, পতঙ্গ অথবা পিঁপড়া যারা সন্ধান করে আলো অথবা মাংসের তাদের পরিণতিগুলো, একই সুতোয় বাঁধা। অবসান।

তার চাইতে এই প্রখর উত্তাপের উৎস থেকে দূরেই থাক্‌ ক্ষীণজীবী কীট-পতঙ্গ এবং সমস্ত কোমলতাগুলো। আগুনের কাছাকাছি থাকুক কেবল অগ্নিপ্রতিরোধক ধাতব কাঠিন্য। ‘সারভাইভ্যাল অব দ্য ফিটেস্ট’।

শন শন দমকা হাওয়ায় ইতিউতি উড়ে যাচ্ছে শুকনো জীর্ণ ডালপালা, পাতা, খড়কুটো।

বাতাসের দুর্নিবার আলোড়নে শূন্যে উঠে যাওয়া ঝরা পাতাগুলো পাখি নয়–এই কথাটা কখনো ভুলে যায় আত্মমগ্নতার গভীরে ডুবে যাওয়া কিছু মানুষ। ধূসর বর্ণের বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণিতে তারা ভুগতে থাকে উড়ে যাওয়া ডানা বিভ্রমে। অহেতুক।

ঝড় থেমে গেলে এসব ঝরে পড়া ছাইপাশ আবার নেমে আসবে মাটির মাধ্যাকর্ষণের টানে। জায়গা হবে ডাস্টবিনে। মিউনিসিপ্যালিটির আবর্জনার গাড়িতে।

প্রবলবর্ষনের তোড়ে ছাদ উপচে পড়া অবিরাম জলধারাওতো মাঝে মাঝে ঝর্ণার বিভ্রম তৈরি করে ফেলে এক নিমেষে। পাহাড়, ঝর্ণা এবং নদী পিয়াসী মানুষের কাছে এও এক তৃপ্তিদায়ক সান্ত্বনা। উঠোনে মিছেমিছি তৈরি হওয়া এক নদীতে মানুষ ভাসিয়ে দেয় না না রঙের কাগজের নৌকা আর কপোল কল্পনায় ভাবে ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর দিয়েছি ভাসায়ে’।

শুভ্র শূন্যতা

আয়না তোমাকে পরিচিত করে তোমার মুখের রেখাগুলোর সাথে অথবা জাগিয়ে তুলে সুপ্ত নার্সিসিজম, নির্ভর করে তুমি কিভাবে ব্যাবহার করছো তোমার নিজস্ব দর্পণটাকে। তবে তুমি যা নও তা দেখতে চেয়োনা। ঠকে যাবে । তোমার বুঝতে হবে, নার্সিসিজমেরও একটা সীমা আছে।

বরং তোমার প্রতিবিম্বটাকে রেখে দাও পাখির চোখের ভেতরে।

কানামাছি খেলায় তোমার চোখে বাঁধা রুমালটা প্রজাপতি হয়ে গেলে, হারজিতের কথা মনে থাকেনা। সামনে তখন কেবল কতগুলো রং অথবা মিলিত বর্ণচ্ছটার রংধনু। রংগুলো আলাদা করে ফেলো। তুমিতো জানোনা কোনটা আসল রং। খুঁজে নাও। কিন্তু মুছে ফেলোনা ডানার পরাগ। সব রংয়ের উৎসতো এটাই।

আয়নার কাচে যখন বিম্বিত হবে রংগুলো তখন দেখবে সব বর্ণসমন্বয়েই ফোটে ওঠে —-শুভ্র শূন্যতা।

পিছনে পায়ের দাগ রেখে আসি

বিমুগ্ধ-আবেশ কেটে গেলে শরাব মিথ্যে হয়ে যায়
তবু লালপানির পেয়ালা হাতে বসে থাকি;
জীবন দোল খাচ্ছে অবিরত ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো।

এখনো এ ঘরের সব কোন ছেয়ে আছে শেষ বিকেলের সুরভি-মদিরা
এখনো মুছেনি তানপুরার শেষ ঝংকারের রেশ
গোধুলীর কনে দেখা আলোর ঘেরে ফুটি ফুটি সন্ধ্যামালতী
আকাশে পাখসাট বাজে- বিহঙ্গম ফিরছে কুলায়;
নিষ্প্রাণ স্ট্যাচুর মতো এক জোড়া মানব-মানবী
নির্বাক।ওদের সব কথা শেষ হয়ে গেছে।

তুমি তো জানতে –
চাঁদের কতটা গভীরে গেলে স্পর্শ করা যায় চরকাবুড়ির সুতো
আমাদের জন্য বাকী ছিল আরো এক তৃতীয়াংশ পথ।
ফিরে আসা যথার্থ ফিরে আসা হয়না আর
বারবার ভুল হয় প্রত্যাবর্তনের অলিখিত শর্তগুলো
অমলিন আঁকা থাকে পদযাত্রার ছাপ;

ফিরে আসি। পিছনে পায়ের দাগ রেখে আসি।

কবিতা

তুমি হুইসেল বাজাতে জানো?
নিমেষে খান খান
ভেঙ্গে ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করতে পারো
স্থবির পাথরের জগদ্দল স্তব্ধতা?
একটি আকাশপাতাল জোড়া খাতা খুলে বসে আছি।
অমিয় ঘোরে নিষিক্ত নতুন শব্দ লেখা হোক কিছু
এমন ভাবতে ভাবতে
চুরি হয়ে গেলো ভৈঁরো রাগে বাঁধা বেলীর সুগন্ধ।
বাতাসের কানে কানে রেখে দেই তবে
কিছু নীরবতা।

রঙীন কাচের চশমা

দৃশ্য বদলায়না
কেবল চশমার কাচ বদলায়।

মাঝে মাঝে
যখন—শীতের কুঁকড়ে যাওয়া পাতার মাঝেও
লিখে ফেলছি জীবন ;
বিবর্ণ ঘাসে
এক টুকরো সবুজ উষ্ণতা গড়িয়ে পড়ে।

প্রতিটি স্বপ্নের ভেতরে আমি যে ঠিকানা খুঁজি ,
কাগজকলমে সেই নাম
কেবলই লিখে যাচ্ছি ভুল বানানে।
বানান-বিভ্রাটে গন্তব্যের ভুল !

ফেলে যাচ্ছি রঙীন কাচের চশমা।

কবিতা

কোন কোন ঘুম ভাঙ্গা রাতে দেখি
পৃথিবীটা নিঃসম্বল ভিখিরির মতো
ফুটপাথে কানা উঁচু থালা পেতে বসে আছে।
তন্দ্রাবেশে কুয়াশাভেজা নিস্তেজ রাত।

বাতাসের গায়ে গন্তব্যের প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে
একটি নিশাচর পাখি উড়ে গেলে; তুমুল
পাখসাটে হু হু করে বাজে অস্ফুট ব্যথাচ্ছন্ন এক সুর।
কখনোবা মানুষও তো পরিযায়ী পাখি!

শোনা না শোনার দোলাচলে হিস হিসে ধ্বণি বাজে ;
ঝলসে ওঠে রাতের চাবুক।
একটা প্রকাণ্ড কালো মাকড়শার মতো
কিলবিলে দশপায়ে হেঁটে যাচ্ছে জমকালো রাত।

যেতে যেতে কোথাও কি কিছু ফেলে গেলো কেউ
একটি পত্র? এক ফোঁটা বিষ?

ইনকোগনিটো

সবাই সতর্ক খেলছে। চেস,ট্র‍্যাম্পকার্ড, হাউজির খেলা।
ছায়ার অন্তর্গত ভিন্ন ছায়াবাজির খেল ;
ইন্দ্রজাল আর ছদ্মবেশের চৌকাঠে
পা আটকে যাচ্ছে বারবার।

হয়তো-
তোমার পিংক বাথটাবের কানাভর্তি স্বচ্ছতার
আড়ালে আছে কোন প্রাণঘাতী দাহক ;
উপুড় অডিকোলনের শিশি ঢাললেই
রুদ্ধ হবেনা তার জ্বলনস্বভাব।

বিপরীতে –
গায়ে ভীতিকর রোঁয়া ফুলিয়েফাঁপিয়ে
ভয় দেখাচ্ছে যে হতকুৎসিত শুঁয়াপোকা ;
সে-ও একদিন ঠিক মধুবর্ণী প্রজাপতি হবে।

কোনটা যে কার আসল রূপ!
কে যে কোন আড়ালে লুকোনো!

কখনওবা আবরণও মনোহর
চরকির ফ্যাঁকাসে কাগজে
চড়ারঙের প্রলেপ মাখানো ঘুর্ণনে বুঁদ হয়ে থাকি।

একটি গাঢ়রাত যখন তিমিরাশ্রয়ী আরেকটা রাতকে
আবরণ খুলতে বলে ;
অন্যরাত অবজ্ঞায় পাশ ফিরে শোয়।
যেন সে বধির। যেন সে স্পর্শস্পন্দনহীন।

দেয়াল এঁকে যাচ্ছে ঝড়মন্দ্র বাতাসের করতাল
ফুটে ওঠে একটা হাঙ্গরভয়ের ছায়া
ঝরে যাচ্ছে সব আচ্ছাদন………

আড়াল ভালোবাসি আমিও তো।

চলে যাবার ঠিক আগে

চলে যাবার ঠিক আগে

মনে হচ্ছে আচমকা কোথাও চলে যাবো। যেতে হবে।

প্রবল জ্বরের পায়ের কাছে শুয়ে আছে প্রাণঘাতি ভাইপার।
মাত্র একটি ছোঁবলেই তুলে নেবে সমস্ত উত্তাপ, আর
উজাড় ঢেলে দেবে বিষথলির সম্পূর্ণ গরল।

চেনা-জানা পাখিদের চঞ্চুগুলো খুব আদরে মুখর
সবুজপাতায় অবিরল ঢেলে দিচ্ছে সোহাগঅমৃত।
গোধূলিতে– নীড়ের কোটরে ঢুকার আগেই
মাধবীর গোলাপিঘ্রাণ ঠোঁটে মেখে নেবে ; এবং মধুরঙ সুধা।

আমাদের মাতাল ঘোড়াগুলো
খুব অবজ্ঞায় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সব খানাখন্দ,
স্ফিত নাসারন্দ্র এবং মুখে শ্রান্তির ফেনা তুলেও
তুমুল ছুটে যাচ্ছে চিরহরিৎ উপত্যকার দিকে।
তাদের পায়ের নীচের ঘাসগুলো কেঁপে ওঠে বিস্ময়ের ত্রাসে ;
এ কেমন উন্মত্ত ছুটে চলা!

আরো তীব্র ছুটে যাক।
আরো।
আরো।
হ্রেষার ভেতরে বাজুক প্রচন্ড তূর্যনাদ, আরো দুরন্ত হোক খট খটা খট
খুরধ্বণি ; থেঁতলে যাক তৃণগুচ্ছের আড়ালে লুকোনো বিষধরগুলো।
দুমড়েমুচড়ে যাক স্বপ্নপ্রাঙ্গণের পথে সমস্ত আগাছা।

আসলে এমন করে যাবার কথা ভাবিনি কখনো
যেতে হবে—
ভাবতেই কালো চাদরের মতো এক আকাশ বিষাদ নেমে আসে।
যেন ভোরের নীলিমা চিরে এক ঝাঁক পরিযায়ি পাখির
যুথবদ্ধ আর্তনাদের কোলাহল তোলে অনিচ্ছুক ফিরে যাওয়া।

ক্রমশঃ প্রিয় হয়ে ওঠা ব্যালকনি ;
রেলিং জড়িয়ে ধরা গোল্ডেনশাওয়ারের ঝাড়,
টবে ফোটা মল্লিকা, গোলাপ——————
এদের দীর্ঘশ্বাস সাথে নিয়ে, যেতে চাইনি কোথাও।

অদূর মাঠের অন্যপাশ থেকে জারুল-শিরিষের হিমনিঃশ্বাস ভেসে আসে ;
তারাও যে খুব আপন ; রঙের ঘোরলাগা বিকেলের সাথী।

তবু চলে যেতে হবে। সারাক্ষণ পায়ে পায়ে ঘুরছে এক বিষাক্ত সরীসৃপ।

যেতে হবে।

তবে
এভাবে আচমকা কোথাও চলে যেতে হলে
বিষপিঁপড়ার কৌটাতে এক চামচ মধু ঢেলে দিয়ে যাবো।

_____________________________
বাংলামেইল ( ইংল্যান্ড) ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত।

রঙ

colo

কারো গাঢ় নীল চোখ
বেজে যাচ্ছে বেদনার্ত সেতারের মতো ;
যেন ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে এক খণ্ড আকাশ,
যেন এক্ষুণি জন্ম নেবে এক নতুন সমুদ্র।
অথবা মনে করো
এক বিভোর উদ্যানে অপরাজিতা ফুটেছে অনেক
যেন নীল নীল ভোরের আধখোলা জানালায়
সবুজ ঝালরের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দেয়া সকালের দূত।
আকাশ অথবা সমুদ্রের এই প্রগাঢ় রঙ
আনন্দ নাকি যন্ত্রণার এই প্রশ্ন ভুলে
এক মনোরম ল্যান্ডস্কেপে বিমুগ্ধ,
তাকিয়েই থাকি।
মাঝেমাঝে
দুঃখ ও সুখের সব রঙ বুঝি এমনি একাত্ম!

এখনো দুই হাতে বিবর্ণ ধূসরতা মাখা,
ছায়াটাকে আততায়ী ভেবে নিয়েছি সন্ন্যাস ;
রঙিন ফানুশ ওড়ানো কালে
এই চিত্রকল্প খুব বেমানান মনে হয়।

চোখের ব্যাথা দেখি,
অথবা নীলকণ্ঠ ফুলের সুন্দর
কথাতো একটাই
আমার বিবর্ণ ধূসর হাত নীল ছুঁয়ে থাকে।

মনে হয়
এইসব রঙের বিপরীতে ভিন্ন কোন রঙ নেই,
ছিলো না কোথাও।

বেহুলার ভেলা

বেহুলার ভেলা

উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন দুঃখেরা
‘ভালবাসা’ চাতকের মতো
এক ফোঁটা নোনা জল চঞ্চুতে তুলে নেয়
‘প্রেম এসেছে কি’ বলে মেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়।

অহল্যার পাষাণ ভেঙ্গে রক্ত কমল ফোটে ;
গোপন-কলসীর এক বিন্দু নীরে
শাপ তার কেটে গেছে বুঝি ?

বারিধি-বিম্বে শকুনের ডানার ছায়া কাঁপে
তবু সরোজ-শিহরে কাঁপে আয়ুষ্মতী-জল
মৎসাকাংখী পানকৌড়ি ডুব-সাঁতার কাটে সরোবরে।

আদিম নিগড় ভেঙ্গে সুরের লহরী ভেসে আসে
নূপুর-নিক্কন বেজে চলে
বেজে চলে
বেজেই চলে।

ক্রোড়ে মাথা অবিকল শিশু লখিন্দর
নবজন্ম দেবে বলে জননী-জায়া বেহুলার
ভেলাটিও ভেসে ভেসে চলে।

( রচনাকাল-১৯৯৭)

শুভ্র শূন্যতা

আয়না তোমাকে পরিচিত করে তোমার মুখের রেখাগুলোর সাথে অথবা জাগিয়ে তুলে সুপ্ত নার্সিসিজম, নির্ভর করে তুমি কিভাবে ব্যাবহার করছো তোমার নিজস্ব দর্পণটাকে। তবে তুমি যা নও তা দেখতে চেয়োনা। ঠকে যাবে। তোমার বুঝতে হবে, নার্সিসিজমেরও একটা সীমা আছে।

বরং তোমার প্রতিবিম্বটাকে রেখে দাও পাখির চোখের ভেতরে।

কানামাছি খেলায় তোমার চোখে বাঁধা রুমালটা প্রজাপতি হয়ে গেলে, হারজিতের কথা মনে থাকেনা। সামনে তখন কেবল কতগুলো রং অথবা মিলিত বর্ণচ্ছটার রংধনু। রংগুলো আলাদা করে ফেলো। তুমিতো জানোনা কোনটা আসল রং। খুঁজে নাও। কিন্তু মুছে ফেলোনা ডানার পরাগ। সব রংয়ের উৎসতো এটাই।

আয়নার কাচে যখন বিম্বিত হবে রংগুলো তখন দেখবে সব বর্ণসমন্বয়েই ফোটে ওঠে —-শুভ্র শূন্যতা।