সালজার রহমান সাবু এর সকল পোস্ট

সালজার রহমান সাবু সম্পর্কে

মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জ্যবোধ করি....!

তাহলে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারল কি?

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা বলা হলেও ভোটার কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীরাই। সেই ভোটারদেরকে মই হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন দেখে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো।
.
মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হয়। একই ধর্মনিরপেক্ষ সিস্টেমের অধীনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ও নির্বাচনে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো খাঁটি মো’মেন বনে যায়, আর অন্যান্য দলগুলোকে বলা হয় কাফের।
.
তারা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর মতই হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও, পোড়াও, ভাঙচুর করে তার নাম দেন জিহাদ, আর ভোটযুদ্ধের ব্যালট পেপারকে বলেন জান্নাতের টিকিট। অর্থাৎ যে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পরিত্যাগ করে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল তা আর ব্যক্তিগত জীবনে থাকল না। রাষ্ট্র যখন ধর্মকে অবজ্ঞা করে দূরে সরিয়ে দিল, সেটাকে লুফে নিল ধর্মব্যবসায়ীরা। রাষ্ট্র যখন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক খাতে কাজে লাগাল না, ধর্মব্যবসায়ীরা তখন সেটাকে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের মাধ্যম বানিয়ে নিল।
.
মানুষ ধর্মের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। মানুষের ঈমান এক বড় শক্তি। সেই মহাশক্তিটি উঠে গেল একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতে। আজ পর্যন্ত ধর্মের নামে যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরেছে, সবকিছুর ঘুড়ির নাটাই হচ্ছে এই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তারা বিভিন্ন ইস্যুতে ইত্তেজনার পারদ চড়ায়, ইসলাম গেল ইসলাম গেল জিগির তুলে মানুষকে উন্মাদনায় মাতায়, জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করে, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তবু রাষ্ট্র তাদেরকে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য হয় কারণ ঐ ঈমান নামক মহাশক্তি তাদের হাতে।
.
তাহলে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে পারল কি?

স্বার্থবাদী রাজনীতি বন্ধ হোক

রাজনীতি হলো রাজ্য পরিচালনার নীতি। যে নীতি অনুসরণ করে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যাবে। এরিস্টটল, প্লেটোর মতো মহান দার্শনিকদের মতে রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো সাধারণ কল্যাণ, সামাজিক শুভবোধ ও নৈতিক পূর্ণতা সাধন। যারা রাজনীতি করবে তাদের লক্ষ্য হবে মানুষের কল্যাণ, সমাজে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা। এ কাজের জন্য রাজনীতিকদের অবশ্যই নিঃস্বার্থ হতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। প্রতিটি কাজ করতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে।

কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত ভোগবাদী, বস্তুবাদী, আত্মাহীন দাজ্জালীয় সিস্টেমটাই এমন যে এখানে প্রায় প্রতিটা মানুষই স্বার্থপর হয়ে বেড়ে উঠছে। শিশুগুলো জন্ম নিচ্ছে স্বার্থবাদী এক সমাজে, পরিবারের কাছ থেকে শিখছে স্বার্থপরতা, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিখছে ভোগ-বিলাসিতা, সমাজ থেকে শিখছে আত্মকেন্দ্রিকতা। নিরেট নিজেকে, সর্বোচ্চ নিজের পরিবারকে নিয়ে ভাবতে শিখছে। এই মানুষগুলো থেকেই কিছু মানুষ রাজনীতিতে আসছে। তারা আমাদের এই সমাজেরই মানুষ- ফলে তারাও স্বার্থপরতার গণ্ডি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ না ভেবে নিজের ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। আর আমরাও তাদের সেই স্বার্থপরতা হজম করে চলি।

রাজনীতি আজ সর্বাধিক লাভজনক একটি পেশাতে পরিণত হয়েছে। ভোটের সময় আসলেই রাজনীতিকদের মুখে দেশপ্রেম, দেশ ও জনগণের সেবা, দেশের উন্নয়ন ইত্যাদি আপ্তবাক্যে মাইক্রোফোন সিক্ত হয়, আকাশ-বাতাস মুখরিত হয় কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশের ব্যস্ত সময় কাটে নিজের পকেট ভারী করতে, নিজের নানামুখী স্বার্থ ও নিজ দলের স্বার্থ উদ্ধার করতে। আবার পাঁচ বছর পর নতুন প্রলোভন নিয়ে জনগণের সামনে ভোটভিক্ষা করতে উপস্থিত হয় তারা। প্রচলিত সিস্টেমে যেহেতু নির্বাচনের সময় ব্যালটে প্রতিবাদের মাধ্যমে অন্য কোনো স্বার্থবাজ লোককে নির্বাচিত করা ছাড়া সাধারণ মানুষের আর কোনো উপায় থাকে না তাই নতুন কোনো স্বার্থবাজ নেতা পায় জনগণের সমর্থন আর নতুন উদ্যমে চলতে থাকে নবনির্বাচিত প্রতিনিধির স্বার্থ উদ্ধারের পালা। জনগণের রক্তঝরানো টাকা নেতা-নেত্রীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমতে থাকে নানা কৌশলে। সেই অর্থের ন্যূনতম লভ্যাংশও যেন জনগণের ভাগ্যে না জোটে সে জন্য সেই অর্থ আবার বিদেশি ব্যাংকে পাচার হয়ে যায়। দেশ ও জাতি সঙ্কটে পড়লে জনগণকে ছেড়ে তারা যেন উড়াল দিয়ে প্রভুদের দেশে বসবাস করতে পারে সে ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করা থাকে। দেশের মানুষ বন্যায় ডুবে মরে আর তারা সাহায্যের অজুহাতে ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থলুট করে। এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকে যায়। আমরা প্রতিদিন চোখের সামনে দুর্নীতির খবর দেখি, দেখি রাজনীতিকদের দেশ বিক্রির প্রতিযোগিতা তবুও আমরা নিশ্চুপ, নিশ্চল দর্শক হয়েই বসে থাকি। এটাকে আমরা ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি।

রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা নিজ দল অথবা গোষ্ঠীর ভেতর নিজেদেরকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেন যে তারা আর মুক্ত মানুষ থাকতে পারেন না। দেশপ্রেমিক হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রকৃত অর্থে রাজনীতির সাথে বিপ্লবের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় রয়েছে। রয়েছে দেশপ্রেমের আত্মিক সংস্পর্শ। কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থায় রাজনীতির যে ধারা প্রবল প্রতাপ নিয়ে বিরাজ করে তা স্বার্থবাদী দলীয় রাজনীতির গণ্ডি থেকে একচুলও বেরুতে পারে না।

আমরা মনে করি, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল এবং ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য যে অপরাজনীতি চলছে এই স্বার্থবাদী অপরাজনীতি অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত। রাজনীতির নামে সংঘাত, সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর ইত্যাদি আজ যেন নিত্য ঘটনা। নিজের নামে ছাফাই গাওয়া, অন্যের নামে কুৎসা রটনা করা, বিরোধী দলে থাকলে কারণে-অকারণে সরকারের সকল কাজের বিরোধিতা করা আর সরকারি দলে থাকলে নানা মিথ্যা অজুহাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে হয়রানি করাই এখন রাজনীতির রীতি। এগুলোকেই মানুষ রাজনীতির অংশ হিসাবে ভাবছে। এই রীতিগুলোকে রাজনীতি থেকে বিদায় জানাতে হবে।

নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের চিন্তা বাদ দিয়ে দেশ ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। রাজনীতিকরা সেই কাজই করবেন যা রাষ্ট্রের প্রতিটা জনগণের জন্য কল্যাণকর হয়। রাজনীতি কোনো পেশা নয়। যারা রাজনীতি করবে তারা শুধুই মানুষের কল্যাণের জন্য তা করবে। এর কোনো বিনিময় নেওয়া চলবে না। নিজের বাড়িতে থাকবে, নিজের উপার্জিত টাকায় সংসার চালাবে, নিজের গাড়ি থাকলে নিজের টাকায় তেল খরচ করবে আর গাড়ি না থাকলে পাবলিক বাহনে চলবে, নিজের টাকায় মোবাইল খরচ করবে। একটা টাকাও জাতির কাছ থেকে তথা সরকারের কাছ থেকে নেবে না। এই রাজনীতি মানুষের শান্তি দেবে, এই রাজনীতি যারা করবেন তারা পরকালেও আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পাবেন। ব্যবসায়ীরা যদি সৎভাবে ব্যবসা করেন, মানুষের কল্যাণ চিন্তা করে ব্যবসা করেন তবে সেটা তাদের এবাদত হবে। ঠিক একইভাবে রাজনীতিকরা যদি মানুষের কল্যাণে কাজ করেন তবে সেটাই হবে রাজনীতিকদের এবাদত। তারা স্রষ্টার সান্নিধ্য পাবার আশায়, মানুষের ভালোবাসা পাবার জন্য রাজনীতি করবে। মানুষের সেবা করার মধ্যেই যারা জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পাবে, ভোগের পরিবর্তে ত্যাগেই যারা পরিতৃপ্ত থাকবে, অর্থ-সম্পত্তির চেয়ে মানুষের ভালোবাসা, দোয়া যাদের কাছে অধিক কাম্য তারাই কেবল রাজনীতি করতে পারবে।

বিকল্প সিস্টেমের কথা কেন ভাববেন?

evangelical-divide
একটি গান আমরা সকলেই শুনেছি- ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই।’ উত্তাল পদ্মার যেন কোনো কুল-কিনারা নেই, সে ভেঙেচুরে ভাসিয়ে নিতে চায় সবকিছু। তার বিশালতার মাঝেও হিংস্রতা স্পষ্ট। আজ দুনিয়াময় গণতন্ত্রের নামে যে সিস্টেমটি চলছে তা যেন ওই উন্মত্ত পদ্মারই স্বভাব ধারণ করেছে। সে একদিকে নিজেকে উদার ভাবে, পরমতসহিষ্ণুতার দীক্ষা প্রদান করে, অধিকারের কথা বলে, অন্যদিকে সবার জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সে সমস্ত পৃথিবীকে পদানত করে রাখতে চায়, মানুষের সাথে, মানবতার সাথে তার প্রতারণা সুস্পষ্ট।

দুনিয়াময় আজ গণতন্ত্রের নামে যা চলছে সেখানে কেবল অনৈক্যের সুর, ভাঙ্গনের সুর। পরিবার ভাঙছে, সমাজ ভাঙছে, দল ভাঙছে, রাষ্ট্র ভাঙছে। অনৈক্য, শত্রুতা, বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংস- গণতন্ত্রের এই অশুভচক্রে আটকা পড়েছে রাষ্ট্রসমূহ। পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র রপ্তানি করতে গিয়ে পরাশক্তিধর শোষক রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্যে দখলদারিত্ব চালাচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ জনপদকে বিরানভূমিতে পরিণত করছে। প্রয়োজনে চালানো হচ্ছে গণহত্যা। এদিকে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো না পারছে এহেন গণতন্ত্রকে হজম করতে, না পারছে উগরে দিতে। জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, ভাঙচুর, অবরোধ-হরতাল এসব দেশের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশ্চাত্যের পানে বাড়ানো ভিক্ষার হাত দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। পদানত রাষ্ট্র আরও পদানত হচ্ছে। চূড়ান্তবিচারে লাভবান হচ্ছে একমাত্র পাশ্চাত্য শোষক রাষ্ট্রগুলোই, যেখান থেকে এ শোষণযন্ত্রের সূচনা হয়েছিল।

স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র বরাবরই এক বৃহৎ ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গণতন্ত্রের আশায় বুক বেঁধেছে লাখো মানুষ। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে গণতন্ত্রের দাবিতে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে। উত্তপ্ত স্লোগানে স্লোগানে গরম হয়ে উঠেছে রাজপথ। বুলেটে ঝাঝরা হয়েছে কত বুক। তারপর একসময় শোনা গেল গণতন্ত্র নাকি মুক্তি পেয়েছে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বিজয়ের আস্ফালন করল। নব্বই এর দশকে যাত্রা শুরু করল কথিত গনতন্ত্র। কিন্তু যে শান্তির জন্য এতকিছু, তার এতটুকু চিহ্নও কি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনামলের কয়েক দশকের ইতিহাসে আমরা পেয়েছি? গণতন্ত্র চলছে, পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হচ্ছে, ক্ষমতা পরিবর্তিত হচ্ছে, কিন্তু দেশবাসীর ভাগ্যের কাক্সিক্ষত কোনো পরিবর্তন নেই।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চালানো হয় তাকে এক কথায় ‘সর্বনাশা’ বললে অত্যুক্তি হয় না। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক দল হিসেবে পরিচিত। তারা কথিত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে যোগ দেয়, গণতান্ত্রিকভাবে জয়লাভ করে ক্ষমতায় বসে। সবার মুখেই গণতন্ত্রের বুলি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- কোনটা গণতন্ত্র আর কোনটা স্বৈরতন্ত্র সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত এরা ঐক্যমতে পৌঁছতে পারল না। যে দল ক্ষমতায় বসে তার কাছে গণতন্ত্রের মানে একরকম, যে দল পরাজিত হয় তার কাছে অন্যরকম। ইদানিং শুরু হয়েছে- ‘গণতন্ত্রের আসল রূপটা কী’ এই নিয়ে বিতর্ক। সরকার যেখানে দেশে গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই দেখছে না, সেখানে বিরোধী পক্ষগুলোর অভিযোগ হলো দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সরকার বলছে, এই দেখো, দেশ চলছে একশভাগ সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন হচ্ছে সংবিধান মেনে, বিচারবিভাগ কাজ করছে স্বাধীনভাবে, যে কেউ সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করতে পারছে, দাবি আদায়ের আন্দোলনও করছে অনেকে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নের জোয়ার বইছে। মানুষ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো আছে। এটাই গণতন্ত্র। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষটি বলছে, না, দেশের কোথাও গণতন্ত্র নেই। দেশ চলছে স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়লাভ করলেই কেবল সে সরকার বৈধ হয়। এ সরকার সেই শর্ত পূরণ করে নি। এ বিতর্ক আজকের হলেও, খেয়াল করলে বোঝা যাবে, একই ধরনের বিতর্ক আমাদের দেশে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি এ ধরনের বিতর্কে নতুন একটি মাত্রা যোগ হয়েছে। গণতন্ত্র জরুরি নাকি উন্নয়ন জরুরি- কোনটা আগে? যদি গণতন্ত্র জরুরি হয় তাহলে কোন গণতন্ত্র? সীমিত গণতন্ত্র (Controlled democracy) নাকি বিস্তৃত পরিধির গণতন্ত্র (wide space democracy)? এসব নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। সব কিছুতেই যারা গণতন্ত্রের সার্থকতা খুঁজেন, তাদের নিজেদের মধ্যেই গণতন্ত্র নেই, তা কি হয়? ইদানীং তাই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার জোর চেষ্টা চলছে। রাজনীতিক দলের বা অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটাভুটির মাধ্যমে। কিন্তু যে গণতন্ত্র রাষ্ট্রে ব্যর্থ, তা দলে সফল হবে এমন আশা তো করা যায় না। পরিণাম- কাদা ছোঁড়াছুড়ি, চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি, শক্তিশালী সিন্ডিকেট, এক কমিটিকে আরেক কমিটির অস্বীকার। কোনো কোনো জেলায় দশকের পর দশক চলে যায়, কমিটি গঠন করতে পারে না। মারামারি, খুনোখুনি ও আতঙ্কের কারণে শেষ পর্যন্ত আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দল চলে। কাজের কাজ এই হয় যে, গণতন্ত্রের ব্যর্থতার ফুটো আরও বড় হয়।

এই সর্বনাশা বহুরূপী পুঁজিবাদী গণতন্ত্র জাতিটাকে শেষ করে দিল। একদিকে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় টিকে থাকার নগ্ন প্রতিযোগিতা, হামলা-মামলা, খুন-খারাবি, হয়রানি, দমন-পীড়ন; অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ভাঙচুর, মানুষ পোড়ানোসহ যার যা খুশি বলা, যার যা খুশি লেখা ও যার যা খুশি করার মানসিকতা এ জাতিকে একটি মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দেয় নি। স্রোতস্বিনী নদী যেমন তার স্রোতের টানে একটু একটু করে তীরের গাছপালা, গ্রাম-গঞ্জ, বাজার ও জনপদ ধ্বংস করে নিজেকে বিস্তৃত করে, তেমনি চলমান সর্বনাশা গণতন্ত্র এ জাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে চলেছে।

গণতন্ত্রের উৎপত্তি ইউরোপে। মধ্যযুগের বর্বরতা কাটিয়ে উঠার জন্য এমন একটি সিস্টেম ইউরোপের প্রয়োজন হয়েছিল। ধর্মের নামে চালানো চার্চের অধর্মের অপশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যশীল জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপীয়ানরা তাই গণতন্ত্র আবিষ্কার করে। পরবর্তীতে শিল্পবিপ্লবের ফলে গণতন্ত্র পরিণত হয় পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে। তার কুফল থেকে মানুষকে বাঁচাতে আবার একদল সমাজচিন্তক আবিষ্কার করেন সমাজতন্ত্র। সেই সমাজতন্ত্রও যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, সমস্ত পৃথিবীকে পুনরায় গ্রাস করে নিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। ঔপনিবেশিক আমল শেষ হয়ে গেলে, নব্য নাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদের আধুনিকতম পদ্ধতি হিসেবে গরীব দেশগুলোতে গণতন্ত্র রপ্তানি করতে শুরু করল। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্রের দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সেই ব্রিটিশ, যাদের অপশাসন, দমন-পীড়ন ও শোষণের দাগ তখনও ভারতের বুকে দগদগ করছে। যাদের দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক আমলে একবারের জন্যও গণতন্ত্রের প্রয়োগ লক্ষ করা যায় নি। যুগে যুগে এ উপমহাদেশের মানুষের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতির যোগসূত্র রচিত হয়েছে ধর্মের দ্বারা। সেই ধর্মকেই অবাঞ্ছিত করে রেখে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের নামে এমন একটি সিস্টেম তারা চাপিয়ে দিল যার সাথে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস, রুচি-অভিরুচি, কৃষ্টি-কালচার ও ধ্যান-ধারণার বিন্দুমাত্র সামঞ্জস্য নেই। আমাদের দেশসহ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক সঙ্কটাবস্থা ও বিভিন্ন জটিলতার প্রধান কারণ এটাই। এছাড়াও রয়েছে প্রাচ্যের এই দেশগুলোর দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে চালানো পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের বহুমুখী শোষণ। গণতন্ত্রের প্রধান কুফল- জাতির ঐক্য বিনষ্টকরণ। যে জাতিতে যত বেশি অনৈক্য, সেই জাতিকে শোষণ করা তত সহজ। গণতন্ত্র এ কাজটি খুব সহজ করে দিয়েছে। আর সে কারণেই গণতন্ত্রের জন্য পাশ্চাত্যের এত মায়াকান্না।

আজ সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। পশ্চিমাদের গণতন্ত্রের তত্ত্বকথা অনেক শোনা হয়েছে। সেগুলো যে ‘শাখের করাত’ ছাড়া কিছুই নয় তা প্রমাণ হতে বাকি নেই। সুন্দর সুন্দর শব্দজাল বিছিয়ে জাতিকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থানে আটকে রাখা হয়েছে। তাই আর সংজ্ঞা দেখে নয়, ফলাফল দেখে বিচার করতে হবে। আর নির্লিপ্ত থাকা চলে না। সবাইকে বসতে হবে। রাজনীতিক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সকলে মিলে আসুন আমরা একটি ঐক্যমতে পৌঁছাই। আমাদের বিশ্বাস, কৃষ্টি-কালচার, রুচি-অভিরুচি অর্থাৎ আমাদের চিন্তা-ভাবনার সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং প্রাকৃতিক সত্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত এমন একটি সিস্টেম দাঁড় করাই যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমাদের মতো ভাগ্যবরণ করা থেকে রক্ষা করবে, সেটা যে তন্ত্রই হোক না কেন।

আমার কালে

প্রবাহমান সময়ের গতিধারায় এমন এক কালে আমি পৃথিবীতে এসেছি,
আমার কালে ধর্মগুরুরা ধর্ম বেচে জীবনধারণ করেন,
শাসকেরা শাসিতের সাথে ছল করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে,
রাজনীতিকরা ওয়াদাই করে ভঙ্গ করার জন্য,
স্বার্থই হচ্ছে রাজনীতির ভিত্তি, জনসেবাকে পেশা মনে করে,যত বড় শিক্ষিত তত বেশি অহঙ্কারী,
ধনীরা হাজারো অবৈধ উপায়ে সম্পদ কুক্ষিগত করে দরিদ্রকে বঞ্চিত করে,
নারীরা চরমভাবে পদদলিত অথচ তাদেরকে স্বাধীন বলে প্রতারণা করা হয়,
অসৎ লোকগুলো সমাজে সম্মানিত,
সরল লোকগুলো বোকা বলে পরিগণিত,
বিচারক শক্তিমানের পূজারী,
নিরপরাধ লোক শাস্তি পায়,
অর্থের বিনিময়ে পানি পান করতে হয়,

২২ মাসের শিশু ধর্ষিতা হয়,
যুদ্ধের কোনো ধর্ম নেই,
যুদ্ধে বেসামরিক লোক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়,
বেওয়ারিশ লাশ বেসুমার,
যে কেউ যে কোন সময় গুম হয়ে যায়,
চিকিৎকরা রোগীকে মক্কেল, ক্লায়েন্ট মনে করে,
তাদের সাথে প্রতারণা করে,
ব্যবসায়ীরা খাদ্যে বিষ দেয়,
পণ্যে ভেজাল দেয়,

ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রহার করে,
শিক্ষাকে পণ্য হিসাবে গণ্য করা হয়,
স্ত্রী স্বামীকে-স্বামী স্ত্রীকে,
পিতা-পুত্রকে হত্যা করে,
সন্তানরা বাবা-মাকে বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়,

অশ্লীলতাকে ফ্যাশন মনে করে,
গালিকে বুলি মনে করা হয়,
সাহিত্যিকরা আজগুবি সাহিত্য তৈরি করেন,
ধর্মকে অধিকাংশ মানুষ কাল্পনিক মনে করে,

সন্তানের ভরণপোষণ করাকে পিতা-মাতা বিনিয়োগ মনে করে,
নব প্রজন্ম বিয়ে করাকে প্রাচীনপন্থা মনে করে,
সমকামিতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করা হয়,

কুৎসা রটনা করে মানুষের চরিত্র হনন করাকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মনে করা হয়,
বিক্রি করা জমিকে আরো বহুজনের কাছে বিক্রি করা হয়,
আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ছাড়া সমাজে কাউকে সম্মান করা হয় না,
অর্থ আর ক্ষমতাই সম্মানের মাপকাঠি,
উকিল উভয়পক্ষ থেকে টাকা খায়,
বিয়ের দেনমোহর আজীবন অপরিশোধিতই থাকে,
শ্রমিক ন্যায্য পারিশ্রমিকের দাবিতে আন্দোলন করলে গুলিতে ঝাঁঝরা হতে হয়,
শহরগুলো অলস আর অন্তর্মুখী জনতায় পরিপূর্ণ,
প্রতিবেশী বলে কিছু নেই, নাগরিক সম্পর্ক বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়ায় সমাপ্ত,
.
পৃথিবীকে কাল্পনিক বেড়া দিয়ে শতশতভাগে বিভক্ত করে সম্পদ ও জনসংখ্যার প্রাচুর্য ও ঘাটতি সৃষ্টি করে তাকেই স্বাধীনতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়…………
এভাবে বলতে গেলে আরো আরো বহু কিছুতেই পরিপূর্ণ আমার কাল।
.
এই ঘোর কলিকালের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম।

মানবতার কল্যাণ ও পুণ্যের জন্য ‘সঠিক’ কাজটি করুন

15977352_1206198969415220_1724389112158428015_nউদ্বাস্তু শিবিরে ত্রাণ বিতরণ মানবতার কাজ বটে কিন্তু প্রকৃত মানবতার কাজ, সওয়াবের কাজ হচ্ছে সেই ব্যবস্থা করা যেন কোনো মানুষ আর উদ্বাস্তুই না হয়। সেটা হচ্ছে এমন কিছু করা যা সাম্রাজ্যবাদী আর শাসকদের যুদ্ধকে বন্ধ করবে।

রেলস্টেশনে কনকনে শীতে শিশুগুলো কাঁপছে, অতি বৃদ্ধদের জীবনসংকট উপস্থিত। তাদেরকে শীতবস্ত্র দান করা মানবতার কাজ বটে। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হলো চারপাশে এত মনোরম অট্টালিকা আর বড় বড় উপাসনালয় থাকতে মানুষের বাচ্চারা কেন রাস্তায় ঘুমায়?

আধুনিক সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী লড়াই মানুষকে নিরাশ্রয় করে তারপর তাদেরকে এনজিও করে ত্রাণ আর করুণা ভিক্ষা দেয়। আধুনিক সভ্যতার পুজিবাদী অর্থনীতির শোষণ চাপিয়ে মানুষকে ভিটে মাটি বেচে কিস্তি শোধ করে রেললাইনের বস্তিতে এনে উপস্থিত করে। তারপর তাদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে মানবতা প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।

যতদিন একজন নিরাশ্রয় মানুষ রাস্তায় ঘুমাবে আর উপাসনালয়/অট্টালিকায় তালা ঝুলবে ততদিন মানবতাবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের একটাই কাজ, প্রতিটি ধার্মিকের একটাই এবাদত মানুষের জন্য বাসযোগ্য নিরাপদ একটি সমাজ, একটি পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া।

সেটা না করে আস্তিক-নাস্তিক আর দাড়ি-টুপির বিতর্ক চালিয়ে যাওয়া, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরের মতো চোখ কান বুজে নিজের ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য উদায়াস্ত খেটে যাওয়া মানুষের কাজ নয়, সেটা পশুর কাজ। সেই স্বার্থপরকে দিয়ে মানব জাতির কোনো কল্যাণ হবে না। তার নামাজ, রোজা, পূজা, প্রার্থনা আল্লাহর সন্ত্বোষ যোগাবে না, এক ফোটা সওয়াব লেখাবে না।

প্রয়োজন আরেক রেনেসাঁ

ধর্মীয় দর্শন ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের সঙ্গে অন্য সব প্রাণীর মৌলিক তফাত রয়েছে। এবং এটা সর্বজনস্বীকৃত, বৈজ্ঞানিকভাবেও স্বীকৃত। মানুষ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। কোনো প্রাণীর প্রখর ঘ্রাণশক্তি আছে, কিন্তু তার সেরকম প্রখর দৃষ্টিশক্তি নেই। কোনো কোনো প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি সাংঘাতিক কিন্তু সে আবার সে বর্ণান্ধ। কারো গায়ে অনেক শক্তি কিন্তু তার শ্রবণশক্তি ক্ষীণ। কিন্তু মানুষ হচ্ছে এমন এক সৃষ্টি যার মধ্যে সকল প্রাণীর বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি সমন্বয় ঘটেছে। মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক দিয়ে সে চিন্তা করে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে। আরেকটি অসাধারণ, বিস্ময়কর সত্ত্বা মানুষের মধ্যে বিরাজ করে সেটা হচ্ছে তার আত্মা যাকে কেউ বলেন বিবেক, চিন্তাশক্তি, উপলব্ধি করার ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, মন। আল্লাহর ভাষায় এটাই হচ্ছে রূহাল্লাহ বা আল্লাহর আত্মা যার মধ্যে আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীর সঙ্গে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিও রয়েছে, যদিও তা অতি ক্ষুদ্র মাত্রায়। বস্তু হলে তা চোখে দেখা যায়, তার আয়তন ভর পরিমাপ করা যায়। কিন্তু যা অবস্তু যেমন কোনো সংকট, তাহলে সেটা কত বড় সংকট, তার ভয়াবহতা কী তা মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হয়, আত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যদি কারো সম্মানের ব্যাপার হয় তাহলে সেই সম্মানের মাহাত্ম্য, উচ্চতা উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে। যে জাতির চিন্তার জগতে স্থবিরতা আসে তাদের মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায়। কিন্তু সমাজের শিক্ষিত শ্রেণিটি আধুনিকতার অহংকারে এতটাই স্ফীত হয়ে আছে যে, তারা এই সভ্যতাকে এই সমাজকে প্রগতিশীল সমাজ বলে। কারণ এই সময়ে মানুষ এত প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে যা দেখে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে যে আমরা বুঝি অনেক সভ্য হয়েছি। সে একশ-দেড়শ তলা হাইরাইজ বিল্ডিং বানাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বর্তমানের চেয়ে বেশি স্থবিরতা, এত আবদ্ধতা, এত সংকীর্ণতা মানব ইতিহাসে আগে কখনো হয়েছে কিনা সন্দেহ।

এটা মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে যে মানুষের সবচেয়ে বড় পরাজয় কখন? যখন মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। যখন দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, মজলুমের উপর জালেমের অত্যাচার মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে না তখন তারা কীভাবে সভ্যতা ও প্রগতির অহংকার করে? আজকে মানুষ সকল অন্যায়ের কাছে দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করেছে। সে অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে। সে তার চোখ, কান, মুখ সব বন্ধ করে ফেলেছে। মানুষ এখন মৃত। সে আর দশটা পশুর মতো কেবল জীবনধারণে ব্যস্ত।

আধুনিক এই সভ্যতার জন্ম হয়েছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁর হাত ধরে। রেনেসাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। মানুষ সঙ্কট উপলব্ধি করেছিল। এজন্য ধর্মযাজকদের প্রাচীন ধ্যানধারণা, জড়ত্ব, স্থবিরতা, অন্ধত্ব, সবকিছুর মধ্যে পরকালীন শাস্তির ভীতিপ্রচার, নিজেদের ঐশ্বরিকতা ইত্যাদি ধ্যান-ধারণা থেকে বাইরে বের হবার চেষ্টা করেছে শ্বাসরুদ্ধ মানুষ। তাদের চিন্তাকে ঐ জড় ধর্মচিন্তার কারাগার থেকে বের করে এনেছে বহু জীবনের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে, বহু প্রজন্মের সম্মিলিত প্রয়াসে। সেখান থেকে বের হয়ে মানুষ দেখেছে যে না আসলেই তো আমার তো অনেক চিন্তার করার বিষয় আছে। সে একটা মুক্ত আকাশ পেয়েছে। এই যে চিন্তার মুক্তি তা মানুষকে নতুন একটি সভ্যতার সম্ভাবনার ঊষালগ্নে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এরই নাম তারা দিয়েছে রেনেঁসা (renaissance), নবজাগরণ। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের, শিল্প-সাহিত্যের একটা স্ফূরণ ঘটে গেছে। ধর্মযাজকদের কথা ছিল তাদের কথা মানলে পরকালে স্বর্গপ্রাপ্তি হবে, না মানলে নরক। কথায় কথায় তারা ফতোয়া দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারত, নৃশংস উপায়ে হত্যা করত। যারা এই রেঁেনসার অগ্রনায়ক তাদের লক্ষ্য ছিল এই পৃথিবীটাকে তারা স্বর্গে অর্থাৎ শান্তিময় আবাসে রূপান্তরিত করবেন। একদিকে বিকশিত হলো শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি আরেকদিকে জীবন চালানোর জন্য একটার পর একটা সৃষ্টি হলো উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি। এগুলো তারা রচনা করলেন ঐ চিন্তাশক্তি দিয়ে, মস্তিষ্ককে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে। যারা করেছে তারা নিজেদের সমাজের সঙ্কটটাকে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই সভ্যতা বস্তুগত উন্নতির পাশাপাশি মানবজাতিকে এমন একটি নির্মম বাস্তবতা উপহার দিয়েছে যা অতীতের সব ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গেছে। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে রেনেসাঁর যে নেটফল মানুষ লাভ করেছে তাতে তাদের সকল প্রাপ্তি অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিশ্বমানবতা সেই দানবিক শক্তির সামনে আত্মসমর্পণ করে নিয়েছে। এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সেই মহান রেনেসাঁ কার্যত একটি আত্মাহীন একপেশে আখেরাত-বর্জিত, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞানশূন্য, ভারসাম্যহীন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে যা আসলে কোনো সভ্যতাই নয়, বরং ভোগবাদী একটি যান্ত্রিক প্রগতিমাত্র (Utilitarian Technological advancement)।

এখন যারা সমাজের সচেতন মানুষ, যারা শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, পত্র-পত্রিকা নিয়ে আছেন সবার আগে তাদেরকে বর্তমানের সঙ্কটের গুরুত্ব আত্মা দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। চিন্তা করতে হবে যে আজকের আন্তর্জাতিক সঙ্কট, জাতীয় সঙ্কট কতখানি গভীর। আজ চোখের সামনে মানুষ হত্যা হচ্ছে, অন্য মানুষ কোনো প্রতিবাদ করে না, চোখের সামনে নগর ধ্বংস হচ্ছে, মানুষ নির্বিকার টিভি দেখছে। প্রতিকারের জন্য কোনো চেষ্টা নেই। চোখের সামনে লুটপাট হচ্ছে, চাঁদাবাজি হচ্ছে কোনো প্রতিবাদ করে না, চোখের সামনে সব অন্যায় হচ্ছে মানুষ দেখছে না। ভাবছে দেখে কী লাভ? এর অর্থ মানুষ অন্যায়কারীর কাছে, শক্তিমানের কাছে আত্মসমর্পন করেছে, সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ভাবছে আমি কোনোমতে জীবনটা কাটাই। এখন এই দুর্বলকে কে জাগাবে? কে তাদের ডেকে তুলবে? কে নতুন একটি রেনেসাঁ, নবজাগরণের সূচনা করবে? কে নতুন সভ্যতার আলো ছড়াবে? শিক্ষিত মানুষ কর্পোরেট বাণিজ্যের গোলাম হয়ে গেছে। অর্থের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে। এখন আমাদের প্রগতি নয়, অধঃগতি, এখন উন্নতি নয় পতন, আমাদের এখন কেবল পরাজয়। আসন্ন বিশ্বযুদ্ধ তো একটা পরিণতি, আমাদের সবার অথর্বতা, স্থবিরতা, নিষ্ক্রিয়তার যোগফলমাত্র। সেই ধ্বংস, পরিণতি সামনে। এখনও বুঝতে হবে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কটটা কী। চোখে তো প্রতিদিনের বিপর্যয় দেখতেই পাচ্ছেন, আর কত দেখবেন? আর দেখার কি আছে? এর পরেও দৃষ্টি ক্লান্ত হচ্ছে না? এখনই সময় আরেকটি নবজাগরণের যে জাগরণ হবে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

ইউরোপের সেই বিপ্লব, সেই রেনেসাঁ মানবজাতিকে যা দেওয়ার তা দিয়েছে। বহু প্রযুক্তি দিয়েছে, কিন্তু মানুষকে শান্তি দিতে পারে নি। এটা পারবেও না। এখন তা শক্তির শাসনে পর্যবসিত হয়েছে। তাদের সদিচ্ছার কোনো কমতি ছিল না কিন্তু তাদের আবিষ্কৃত ফর্মুলা বা পদ্ধতিগুলো তাদের কাক্সিক্ষত স্বর্গ দিতে পারে নি। পৃথিবীটা আজ স্বর্গের বদলে নরককুপে পরিণত হয়েছে, তারা একটি আত্মাহীন, মানবতাহীন, ভারসাম্যহীন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। এ সত্যটি যত দ্রুত মানুষ হৃদয়ঙ্গম করবে তত দ্রুতই তারা পরবর্তী রেনেসাঁর অভিমুখে যাত্রার সূচনা করতে পারবে। আসলেই আমাদেরকে একটি নতুন রেঁেনসা করতে হবে, এই রেনেসাঁ হবে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যাবতীয় অসত্যের বিরুদ্ধে, যাবতীয় স্থবিরতার বিরুদ্ধে। অতীতে ধর্মের বিকৃত রূপগুলো মানুষকে স্থবির করেছিল, এখন করেছে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ভোগবাদী মতবাদগুলো। ফল একটাই- কান্না, অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ ও অসহায়ত্ব।

এই যে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি, যুদ্ধ, সংঘাত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, তারা এসব থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না। মানুষ তো ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মানুষ প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে আইন, নীতি-নৈতিকতা ধর্ম সবকিছুই ধ্বংস করে ফেলছে। এখনও কি শিক্ষিত সমাজ এই সংকটটি উপলব্ধি করবেন না? যারা ঘরের কাছেই নিপীড়িত জনতার চিৎকার শুনে না, শুনলেও নিজেদের ধারণকৃত ব্যবস্থার জালে অসহায় বন্দীর মত চেয়ে থাকতে বাধ্য, কিছু করতে অক্ষম, যারা পাশের বাড়ির মানুষের চিৎকার শুনে না, এরা বধির, এরা মৃত। মানবসভ্যতাকে এই স্থবিরতা থেকে, মৃত অবস্থা থেকে উদ্ধারের একদিন রেনেঁসা হয়েছিল। সেই মানুষগুলি পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ ছিল, কিন্তু এখনকার মানুষ সক্রিয়ভাবে পরিবর্তনও চায় না। তাদের চেতনা নেই, বোধ শক্তি নাই। খাচ্ছে দাচ্ছে টিভি দেখছে যেন সব কিছু স্বাভাবিক আছে।

প্রগতি অতীতকে অস্বীকার করে না, অতীতে ফিরেও যায় না। সে অতীতকে মূল্যায়ন করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের মননশীলতার সঙ্গে মানানসই, কালের প্রয়োজন পুরন করার মত ব্যবস্থা নিয়েই যুগে যুগে নবী রসুলদের আগমন হয়েছে। না হলে একজন নবী দিয়েই কাজ চলত। এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল এসেছেন মানুষকে প্রগতির শিক্ষা দেয়ার জন্য, মানুষকে পিছনে ফেরানোর জন্য নয়। কিন্তু এখন আমরা পেছন দিকে হাঁটছি। আমরা অহঙ্কার করি আদিম সমাজে নাকি জোর যার মুল্লুক তার ছিল। এখনকার কথিত আধুনিক প্রগতিশীল সমাজে মুল্লুক কার? আমরা তো অতীতেই ফিরে গেছি। আপনারা উঁচু টাওয়ারের অহঙ্কার করেছেন। উঁচু উঁচু টাওয়ার অতীতের অনেক সভ্যতাই বানিয়েছিল। পিরামিড বানিয়েছিল, ঝুলন্ত বাগান বানিয়েছিল। সেই সব উঁচু টাওয়ার অভিশাপ হলো কেন, পর্যটকদের দর্শনীয় পরিত্যক্ত স্থান হলো কেন? কারণ উন্নতি প্রগতি যখন অহঙ্কারের বস্তু হয়ে দাঁড়ায় তখন তা অভিশাপে পরিণত হয়। এই আধুনিক সভ্যতার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অহঙ্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবধান! অতীত থেকে শিখুন।

ইউরোপের রেনেসাঁর আগের রেনেসাঁটি ঘটিয়েছিলেন আল্লাহর শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.)। তিনি আরব জাতিকে জাহেলিয়াতের বন্দীদশা, কূপমন্ডুকতা থেকে এমন এক হ্যাঁচকা টানে বের করে আনলেন যে সেই অশিক্ষিত মূর্খ আরবরা জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হল। তাদের চিন্তাশক্তি এতটাই গতিশীল হলো যে, তারা রসায়ন, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রযুক্তি, জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, স্থাপত্যবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বিশাল ভূমিকা রাখলেন, হাজার হাজার মহামূল্যবান বই রচনা করলেন। বহু নতুন ভূখণ্ড তারা আবিষ্কার করলেন। সামরিক শক্তিতে তারা ছিলেন অপরাজেয়, রোমান পারস্যের মতো হাজার বছরের পুরনো শক্তিও তাদের সামনে শুকনো পাতার মতো উড়ে গিয়েছিল। উরাল পর্বত, কারাকোরাম, কিরঘিজ পর্বতের শিখরে তাদের পতাকা উড়ল। সেই আরবজাতি যারা কিছুদিন আগেও ছিল চিন্তাহীন, অথর্ব, চুরি-ডাকাতি আর কামড়া-কামড়িতে ব্যস্ত, ছিল অন্যায়কারী, অন্যায়ের সাথে আপসকারী ভীরু কাপুরুষ, তাদেরকে আল্লাহর রসুল দুঃসাহসী যোদ্ধা ও অর্ধ দুনিয়ার শাসক জাতিতে পরিণত করলেন, তারাই বিশ্বের বুকে সবচেয়ে আলোকিত, মহিমান্বিত, সমৃদ্ধ জাতিরূপে আবির্ভূত হলো। ইতোপূর্বে তারা ধর্ম বলতে বুঝত কাঠ পাথরের মূর্তি পূজা আর মন্ত্রপাঠ অর্থাৎ সংকীর্ণ গ-িতে, স্থবির জড়বস্তুর মধ্যে মানুষের অপার চিন্তাশক্তিকে আড়ষ্ট, আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। মানবজীবন প্রচণ্ড গতিময়, ধর্মও যদি তদ্রূপ গতিময় না হয় তাহলে তা পরিত্যাক্ত হবেই, মানুষ তা বেশিদিন বহন করতে পারবে না, এটা প্রাকৃতিক। রসুলাল্লাহ (সা.) তাদেরকে কী ধর্ম শেখালেন? না, স্থবির উপাসনা নয় বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে অত্যাচারী শাসকের জুলুম থেকে রক্ষা করা, ন্যায়ের স্থাপনা করা, এটাই তোমাদের ধর্ম, এটাই তোমাদের এবাদত। শেখালেন দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেই আরবরা নিজেদের সুপ্তসত্তাকে জাগ্রত করলেন, অনুভব করলেন তাদের মধ্যে অপার সম্ভাবনা লুকায়িত আছে। তারা নিজেদেরকে নতুনরূপে আবিষ্কার করলেন, বিশ্বের ইতিহাসকে পাল্টে দিলেন। আরব জাতির এ নবজাগরণ সম্বন্ধে, স্থবিরতার পরিবর্তে আলোড়ন সৃষ্টির নেপথ্য কারণ বলতে গিয়ে ইতিহাসবেত্তা Lothrop লিখেছেন- Forgetting the chronic rivalries and blood feuds which had consumed their energies is internecine strife, and welded into a glowing unity by the fire of their new found faith, the Arabs poured forth from their deserts to conquer the earth for Allah the One true God (The New World of Islam- Lothrop). অর্থাৎ “যে পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পুরুষানুক্রমিক রক্তাক্ত বিবাদের দরুন ও আত্মকলহে তাদের শক্তি নিঃশেষ হচ্ছিল তা ভুলে যেয়ে এবং নতুন বিশ্বাসের আগুনে উজ্জ্বল ঐক্যে দৃঢ় সংবদ্ধ হয়ে আরবরা তাদের মরুভূমি থেকে বানের ঢলের মত নির্গত হলো- এক এবং সত্য অল্লাহর জন্য পৃথিবী জয় করতে।” কথা হলো, রসুলাল্লাহর সৃষ্ট এই রেনেসাঁ কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁর মতো আত্মাহীন, ভারসাম্যহীন, কেবল বস্তুতান্ত্রিক ছিল না। সেটা ছিল শরিয়াহ ও মারেফাত তথা দেহ-আত্মা, দুনিয়া আখেরাতের ধারণার সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ (Balanced) সভ্যতা। যে সভ্যতা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে সম্প্রীতি সৃষ্টি করেছিল, সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল, কিন্তু পুঁজিবাদের শোষণ সেখানে ছিল না, অধিকাংশ মানুষ নৈতিক মূল্যবোধে, আত্মিক মানবিক গুণাবলীতে আলোকিত মানুষে পরিণত হয়েছিল। কালেভদ্রে কেউ অপরাধ করলে নিজে গিয়ে আদালতে নিজের প্রায়শ্চিত্যের জন্য শাস্তি কামনা করত, তাকে ধরে আনার জন্য পুলিশ গোয়েন্দাবাহিনী কিছুই প্রয়োজন পড়ত না। অর্থাৎ মানুষের ভেতরে বাহিরে আমূল পরিবর্তন করল। এটাই হলো প্রকৃত বিপ্লব, প্রকৃত রেনেসাঁ। সেই যে রেনেসাঁ সৃষ্টি করে দিলেন রসুলাল্লাহ সেটার ধাক্কা কয়েক শতাব্দী চলল। আবার যখন এই উম্মাহতে ভারসাম্য নষ্ট হলো, রাজা বাদশাহরা ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে গেল, একদিকে ভারসাম্যহীন সুফিবাদ জাতির সংগ্রামী বহির্মুখী চরিত্রকে অন্তর্মুখী করে দিল, গতিশীল জাতিকে স্থবির করে দিল; অপরদিকে আলেম মুজতাহিদ, মোফাসসেররা দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল উদ্ভাবন করে জাতিকে বহু ফেরকা, মাজহাবে বিভক্ত করে ফেলল এবং সহজ সরল দীনকে এমনভাবে মাকড়সার জালের ন্যায় জটিল ও দুর্বোধ্য করে ফেলল যে তা সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে চলে গেল। দীনের ভারসাম্য নষ্ট হল। এভাবে জাতিকে পঙ্গুত্ব পেয়ে বসল, তারা অন্তর্মুখী জড় হয়ে গেল। তারপর থেকে তাদের উপর আবার গজব শুরু হলো যা এখনও চলছে।

এখন আমরা হেযবুত তওহীদ চেষ্টা করছি আবারও একটি রেনেসাঁ, নবজাগরণের সূচনা করতে, মানুষের চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটাতে। বুদ্ধি, চিন্তা, আত্মা, দৃষ্টি, বিবেক খুলে দিতে। মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে সঙ্কটের গভীরতা। তাকে জাগতে হবে, এই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার পথ সন্ধান করতে হবে।