সালজার রহমান সাবু এর সকল পোস্ট

সালজার রহমান সাবু সম্পর্কে

মানুষ হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জ্যবোধ করি....!

প্রকৃতপক্ষে কেউ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে কি?

16730622_1854733054784759_2151654945094531071_nযাকে ধারণ করা হয় সেটা ‘ধর্ম’। অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে- স্বভাব, শক্তি (সংসদ বাংলা অভিধান), প্রকৃতি, প্রত্যেক জীব বা বস্তুর নিজস্ব গুণ (বাংলা একাডেমি অভিধান)।
.
অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু বা জীব যে স্বভাব, গুণ বা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে সেটাই তার ধর্ম। প্রকৃতিতে এমন কোনো বস্তু বা শক্তি নেই যার নিজস্ব কোনো ধর্ম নেই। আর এই ধর্মকে অস্বীকার করে বা ধর্মনিরপেক্ষ থাকে- এমন সাধ্যও কারো নেই। প্রত্যেককে কোনো না কোনো ধর্ম ধারণ করতেই হয়। আগুনের ধর্ম পোড়ানা। আগুন যদি এই ধর্ম হারিয়ে ফেলে তাহলে সেটা কি আর আগুন থাকে? চুম্বক যদি তার আকর্ষণ ক্ষমতা হারায় তাহলে সেটাকে কি চুম্বক বলা যায়? যায় না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ধর্মকে ধারণ করার মধ্যেই বস্তুর সার্থকতা নিহিত।
.
একই কথা প্রযোজ্য মানুষের ক্ষেত্রেও। মানুষকেও কোনো না কোনো ধর্ম ধারণ করেই জীবনযাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে মানুষের সামনে কেবল দুইটি রাস্তা। একদিকে ন্যায় ও সত্য, অন্যদিকে অন্যায় ও অসত্য। পরিণতিও দুইটি- শান্তি ও অশান্তি। এখন হয় তাকে ন্যায় ও সত্য ধারণ করতে হবে, নতুবা অন্যায় ও অসত্যকে।
.
আলো নেই মানেই অন্ধকার আছে, দিন নয় মানেই রাত। তেমনি কেউ সত্য ও ন্যায় ধারণ করল না মানেই সে অন্যায় ও অসত্যকে ধারণ করল। এখানে ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ থাকার চিন্তা যদি কেউ করেন সেটা হবে অলীক কল্পনামাত্র। তবে হ্যা, আপনি যদি ধর্ম বলতে মানুষের প্রকৃতিজাত গুণ বা বৈশিষ্ট্য না বুঝে কতগুলো আনুষ্ঠানিকতা, রীতি-নীতি, নির্দিষ্ট লেবাস, আর শাস্ত্র হাতড়ানোকে বুঝে থাকেন তাহলে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতা অলীক বিষয় থাকে না। সেক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা যথার্থ বলেই প্রতীয়মান হয়।
আনুষ্ঠানিকতা, রীতিনীতি, পোশাক-আশাক কোনো সার্বজনীন ও শাশ্বত বিষয় নয়। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভিন্ন লেবাস, ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্র। প্রার্থনা পদ্ধতিও একেক সম্প্রদায়ের একেক রকম। সেক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র যদি বলে, আমি কোনো বিশেষ শাস্ত্রের, বিশেষ লেবাসের, বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার লোকের উপর অন্য কোনো বিশেষ শাস্ত্রের, লেবাসের ও আনুষ্ঠানিকতা পালনকারী লোকের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী নই, আমার কাছে সবাই সমান, তাতে দোষের কিছু নেই, বরং তেমনটাই সকলের কাম্য হওয়া উচিত। এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা অলীক তো নয়ই, বরং খুবই বাস্তবসম্মতই বলা চলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- ধর্ম তো বর্তমানের মত আনুষ্ঠানিকতা ও লেবাসসর্বস্ব বিষয় নয়।
.
মূল ধর্ম হচ্ছে ঐ ন্যায়, ঐ সত্য যা আমাদেরকে শান্তি এনে দিবে, যাকে ধারণ করে স্বার্থপর মানুষ পরোপকারী হবে, আত্মকেন্দ্রিক মানুষ আত্মত্যাগী হবে। ফলদায়ক বৃক্ষের ডাল-পালা থেকে শুরু করে শেকড়-বাকল পর্যন্ত, সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- ফল। সেই ফলটাই যদি না পাওয়া গেল তাহলে ডাল-পালা-লতা-পাতার কী মূল্য? ধর্মের আত্মা হলো ন্যায় ও সত্য। সেই আত্মাকেই যখন ভুলে যাওয়া হয়েছে, ধর্মকে যখন কেবল লেবাস-সুরত, আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঈমানকে অপব্যবহার করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে, তখন স্বভাবতই ধর্ম তার আবেদন হারিয়েছে। আর সেই সুযোগে যুগের প্রয়োজনেই জন্ম হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র। চিন্তাশীল ও যুক্তিশীল মানুষ ধর্মের নামে এই অন্ধত্ব, জড়ত্ব ও কুপমণ্ডূকতা দেখে ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে ওই ধর্মনিরপেক্ষতার ছাতার নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ধর্মের প্রতি তারা এখন বীতশ্রদ্ধ!
.
আমরা হেযবুত তওহীদ যখন ধর্মের কথা বলি, ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত- সকল অঙ্গনে ধর্মের উপযোগিতা তুলে ধরি, তখন ঐ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে উদ্বুদ্ধ লোকগুলো মনে করেন আমরাও বুঝি প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব, পোশাকী ধর্মের কথাই বলছি। ফলে পুরো বক্তব্য না শুনেই অনেকে আমাদেরকে ভুল বোঝেন, তিরস্কার করেন। তারা কবে অনুধাবন করবেন যে, ধর্ম কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়? তারা কবে বুঝবেন- সত্যই ধর্ম, আর মিথ্যাই অধর্ম?

প্রয়োজনে – ০১৭২২ – ৬০৬০৪৫।

আমি বসন্ত খুঁজে পাইনি

দিনপঞ্জীর শুকনো পাতা দেখে হিসেব মিলালাম আজ বসন্তের আগমন ঘটেছে। ঋতুরাজের সাক্ষাৎ লাভের আশায় বেরিয়েছিলাম রাস্তায়। গ্রামে ফেলে আসা বসন্তের অতীত স্মৃতি মনে মনে ভাবছিলাম- প্রকৃতি দক্ষিণা দুয়ার খুলে দিয়েছে। দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। বসন্তের আগমনে কোকিল গাইছে গান। ভ্রমরও করছে খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এতো বর্ণিল সাজ।
মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম রবিঠাকুরের সেই কবিতার লাইনগুলো-
.
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল,
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।
চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়,
বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়
.
এতো কেবলই স্মৃতিগাথা। বাস্তবতা যা দেখলাম তা তো সম্পূর্ণ উল্টো। কোথাও পেলাম না বসন্তের ছোঁয়া। ফুলের সুবাস নেই, আছে নর্দমার গন্ধ। কোকিলের কুহু কলতান শুনতে পাইনি, কেবলই কর্কশ কাকা ধ্বনি আসছিলো কানে। পলাশ-শিমুলের গাছ কোথায়, কেবলই নতুন-পুরনো বিল্ডিং, সামান্য অক্সিজেন প্রদান করবার মতো সাধারণ বৃক্ষও খুঁজে পাওয়া যায় না। খাচায় বন্দী পাখির মতো কিছু ফুলগাছ দেখেছি বড় বড় বিল্ডিঙের বারান্দায়, ছাদে। খাচায় বন্দী পাখিকে কিছু দিয়ে কি আনন্দিত করা যায়? প্রকৃতি ক্রন্দন করছে মানুষের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য। প্রকৃতিতে বসন্তের ছোঁয়া কোথায়?
.
দেখলাম বস্তির ছেলেগুলোকে ডাস্টবিনের নোংরা খাবার খেতে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে গার্মেন্টস কর্মীদের ছোটাছুটি, দরিদ্র মানুষগুলোর করুণ দৃষ্টি, রিক্সাওয়ালাদের ঘামা শরীর আর খিটখিটে মেজাজ, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, খাদ্যের সন্ধানে ছুটেছে ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো, সাথে মানুষও। বসন্ত শব্দটি তাদের কাছে হয়ত অপরিচিত। ফুল আর কোকিলের ডাক তাদের হৃদয় কাড়বে না, তাদের চায় একটুখানি ভাত, এক টুকরো রুটি। গাছে গাছে যদি রুটি ধরত আর কোকিল যদি ভাত ছিটিয়ে বেড়াত তবে হয়ত তারা বসন্তের নামটা জানত ভালোমতোই।
.
মার্সিটিজ গাড়িতে ছুটে চলা মানুষকেও দেখলাম, সাথে কুকুরও। মসজিদ পানে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাওয়া নির্বিকার মুসল্লিদের দেখলাম, বসন্তকে বরণ করতে বাসন্তীরং শাড়ি পরা রমণীদেরও দেখলাম, কপোত-কপোতীদের নির্লজ্জতা দেখলাম— ফুল ফুটুক বা নাই ফুটুক বসন্ত হয়ত এদের জীবনে সবসময় লেগে থাকে কিন্তু সবার জীবনে বসন্ত কবে আসবে জানি না। আমি বসন্ত খুঁজে পাইনি, আমি যে ক্ষুধার্ত, হাড্ডিসার মানুষগুলো দলে। মার্সিটিজ গাড়িতে বসে থাকা সাহেববাবু, মসজিদে ছুটে চলা মুসল্লি, বাসন্তী রং এর পোশাক পরাদের দলে এখনো ভিড়তে পারিনি।

ধর্ম হলো জীবনের নাম

16640992_717544468394925_8334678341358560547_nআদম (আ.) যখন পৃথিবীতে আসলেন তখন মহান আল্লাহ তাঁকে পৃথিবীতে জীবনযাপনের জ্ঞান দান করেছিলেন। কীভাবে তিনি খাদ্য সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবারণ করবেন, কীভাবে বংশবৃদ্ধি করবেন, কীভাবে নবজাতকদেরকে বড় করে তুলবেন, শিক্ষা দিবেন, কীভাবে হিংস্র প্রাণীদের থেকে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখবেন ইত্যাদি বিষয়। এই পৃথিবীতে চলতে যা যা প্রয়োজন সবই তাঁকে শিক্ষা দেওয়া হলো। বাস্তব জীবনে যে যে সমস্যার সম্মুখিন তিনি হতে পারেন তার সবকিছুর সমাধান আল্লাহ তাঁকে শিক্ষা দিয়ে দিলেন। তাঁর জন্য এই শিক্ষাই ছিলো ধর্ম (দীন বা জীবনব্যবস্থা)। অর্থাৎ যথার্থ ধর্ম হলো বাস্তব জীবনের যাবতীয় সমস্যার বাস্তব সমাধান।
.
যুগের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সমাজ হয়েছে, রাষ্ট্র হয়েছে তখন ধর্মের বিধানগুলোতেও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল ঐ একই। মানুষের সার্বিক জীবনযাপনের বাস্তব সমাধান। জীবনকে সুন্দর করবার মূল মন্ত্রই হলো ধর্ম। ধর্ম সমাজকে শান্তিময় করবে, নতুন নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেবে।
.
কিন্তু বর্তমানে ধর্মকে নির্জীব, মৃত, কাল্পনিক করে ফেলা হয়েছে। কেবল উপাসনা, প্রার্থনা, সোয়াব-গোনাহর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ধর্ম এখন বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারছে না। এর কারণ হলো- ধর্মকে যখন থেকে স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে তখন থেকে ধর্ম তার আসল রূপ হারাতে হারাতে আজ সম্পূর্ণ কাল্পনিক রূপ নিয়ে শুধু মৃত্যু পরবর্তী জীবনের একটি ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (অবস্থা এমন হয়েছে যে, একে জীবনব্যবস্থা না বলে মরণব্যবস্থা বলাই যথার্থ হয়)। এখন ধার্মিক মানুষগুলো বলছে- সমাজের যা হই হোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমি উপাসনা-প্রার্থনা চালিয়ে যাব আর মৃত্যুর পর জান্নাতে যাব। এ দুনিয়া নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই।
.
কিন্তু আমার আহ্বান সত্যানুসন্ধী চিন্তাশীল বিবেকবান মানুষের প্রতি। আসুন আমরা ধর্মের প্রকৃত রূপটি ফিরিয়ে আনি। ধর্ম দ্বারা সমাজকে শান্তিময় করি, সমাজ শান্তিপূর্ণ করতে যা করা হবে, মানুষের শান্তির জন্য, কল্যাণের জন্য যা করা হবে তাই সওয়াবের কাজ, তাই ধর্ম।

নির্বিরোধী পরহেজগার ও আপসকামী ক্রিমিনাল

16473063_1233011506733966_3740051370736959372_n

যারা সমাজের অন্যায়, অবিচার দেখেও তা বন্ধ করার জন্য সংগ্রাম না করে নীরবতা পালন করে, সে আস্তিক বা নাস্তিক, আলেম বা মূর্খ, মুত্তাকী বা বেপরোয়া, নামাযী বা বে-নামাযী যা-ই হোক না কেন, সে আল্লাহর দৃষ্টিতে অপরাধী, ক্রিমিনাল, মুজরিম।
আল্লাহ মো’মেনদের রিপুজনিত দোষ- ত্রুটি গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন অসংখ্যবার। এই মো’মেন হচ্ছে তারা, যারা সমাজে যারা অন্যায় হতে দেন নি, অন্যায় প্রতিরোধ করছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন।
.
বর্তমানে আমাদের সমাজের পরহেজগার ব্যক্তিরা নামাজ, রোযা ইত্যাদির দ্বারা পুণ্য সংগ্রহ করে তা নিয়ে হাশরের দিন পার পেতে চায়, কারণ এগুলোকেই তারা আমল মনে করেন। কিন্তু সমাজে বিরাজিত অন্যায়কে প্রতিহত করার কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে নেই।
.
তাই সুদখোর মহাজন বা কোনো রাজনীতিক দলের সন্ত্রাসী হয় মসজিদ কমিটির পরিচালক। অনাহারী, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠলেও কথিত ধার্মিকেরা মাথা নিচু করে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে ছোটেন, রোযা রাখেন, হজ্ব করেন।
.
আল্লাহ বলছেন, “আমি কি তোমাদের এমন লোকদের কথা বলব, যারা আমলের দিক থেকে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত? (এরা হচ্ছে) সেসব লোক যাদের সকল প্রচেষ্টা এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে, তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে (সুরা কাহাফ: ১০৩-১০৪)।”
.
আদ-সামুদ ইত্যাদি জাতিগুলোকে আল্লাহ যখন ধ্বংস করলেন তখন তাদের মধ্যে কি পরহেজগার লোক ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। কিন্তু তাদের পরহেজগারির তোয়াক্কা আল্লাহ করেন নি।
.
তিনি বলেন, “তোমাদের পূর্ববতী জাতিগুলোর মধ্যে এমন সৎকর্মশীল কেন রইল না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে বাধা দিত; তবে মুষ্টিমেয় লোক ছিল যাদেরকে আমি তাদের মধ্য হতে রক্ষা করেছি। আর পাপিষ্ঠরা তো ভোগ বিলাসে মত্ত ছিল যার সামগ্রী তাদেরকে যথেষ্ট দেয়া হয়েছিল। আসলে তারা ছিল মহা অপরাধী।” (সুরা হুদ ১১৬)
.
এখনো এ জাতির মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ভোগ বিলাসে মত্ত হতেই উদগ্রীব। আর যারা আলেম, জ্ঞানী তারা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে মৌন। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে চান না। এগুলোকে তারা দুনিয়াবী কাজ বলে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এভাবে তারা প্রলয় এড়াতে পারবেন না। তারা প্রাকৃতিক বিধান যদি নাও বোঝেন রসুলাল্লাহর সাবধানবাণী অবশ্যই বুঝবেন।
.
তিনি বলে গেছেন, কোন সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কিছু লোক যদি অন্যায় কাজ সংঘটিত করে এবং সেটা পরিবর্তন করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অন্যরা যদি সেটা না করে তাহলে আল্লাহ্ তাদের সবার উপরে আযাব নাযিল করেন [হাইসাম (রা.) থেকে আহমদ]।

স্যার উইলিয়াম ম্যুর

পুঁজিবাদী ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল মস্কো গিয়েছিলেন, কমিউনিস্ট রাশিয়ার রাষ্ট্রনেতা জোসেফ স্ট্যালিনের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে বুদ্ধি পরামর্শ করার জন্য। ক্রেমলিনের বিরাট প্রাসাদে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে করতে গভীর রাত্রে চার্চিলের ক্ষিদে পেয়ে গেলো, যদিও রাত্রের প্রথম দিকে তারা যে ভোজ খেয়েছিলেন তা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষক জীবনেও দেখেনি। যাই হোক, ক্ষিদে চাপতে না পেরে চার্চিল বলেই ফেললেন যে কিছু না খেলে আর চলছে না। খাওয়া-দাওয়ার পাট আগেই চুকে গিয়েছিলো বলে স্ট্যালিন আর কাউকে ডাকাডাকি না করে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ভেড়ার একটি আস্ত রানের রোস্ট বের করে এনে টেবিলে রাখলেন।

চার্চিল তো চার্চিলই, এক হাত নেবার লোভ সামলাতে পারলেন না। রোস্ট চিবুতে চিবুতে বললেন “ইস! কবে আমি এমন কোরতে পারবো যে ইংল্যান্ডের প্রতিটি ঘরে ফ্রিজের মধ্যে এমনি ভেড়ার রানের রোস্ট থাকবে”। স্ট্যালিনের গালে এটা ছিল একটা মারাত্মক চড়। অর্থনৈতিক সাম্যবাদের দেশে রাশিয়ার ঘরে ঘরে ফ্রিজের মধ্যে রানের রোস্ট নেই, স্ট্যালিনের প্রাসাদের ফ্রিজে আছে। কিন্তু বলার কিছু ছিল না। স্ট্যালিনকে চুপ কোরে চড়টা হজম করতে হয়েছিল। স্ট্যালিন যখন চার্চিলকে রানের রোস্ট খাওয়াচ্ছিলেন ও খাচ্ছিলেন, তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। হিটলারের বাহিনী মস্কোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। লক্ষ লক্ষ রাশিয়ান অর্ধাহারে অনাহারে থেকে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার সৈনিক প্রচণ্ড শীতে জমে মারা পড়ছে।

অনেকটা অনুরূপ অবস্থায় এই শেষ জীবন-ব্যবস্থার নেতারা কি করেছেন তার একটা তুলনা দেয়া দরকার। এই ইসলাম যখন ইসলাম ছিল- অর্থাৎ বিশ্বনবীর কাছ থেকে যারা সরাসরি শিক্ষা-গ্রহণ করেছিলেন, তাদের অন্যতম, দ্বিতীয় খলিফা ওমরের (রাঃ) সময় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যতদিন দুর্ভিক্ষ ছিলো ততদিন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ যেমন অর্দ্ধাহারে অনাহারে থাকে তিনিও তেমনি থাকতেন। ওমর (রাঃ) প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যতদিন না জনসাধারণ এমন অবস্থায় পৌঁছবে যে তারা ভালো কোরে খাবার পরও উদ্বৃত্ত থাকবে ততদিন তিনি গোশত-মাখন এমনকি দুধ পর্যন্ত খাবেন না এবং খানও নি, যা ছিল তখনকার আরবের প্রধান খাদ্য।

তিনি বলতেন “আমি যদি ঠিকমত খাই তবে আমি কী করে বুঝবো আমার জাতি কী কষ্ট সহ্য করছে?” এই অর্ধাহারে অনাহারে থেকে খলিফা ওমরের (রাঃ) মুখ রক্তশূন্য ও চুপসে গিয়েছিল। এই ঘটনা ও ওমরের (রাঃ) ঐ কথা গুলো ঐতিহাসিক সত্য (ইসলামের কঠোর বিরুদ্ধবাদী, মহানবীকে প্রতারক, ভণ্ড বলে প্রমাণ করা চেষ্টায় প্রথম সারির লেখক স্যার উইলিয়াম ম্যুর এর দ্যা আর্লি খেলাফাত বইয়ের এর ২৩২-২৩৩ পৃঃ দেখুন)।

16427802_1385392278187098_7691136718687080291_n

করুণা…..!

আমার কারো করুণার দরকার নেই’ — এটি একটি চরম অহঙ্কারী ধারণা। মানুষ প্রতি মুহূর্তে অন্যের উপর নির্ভরশীল। করুণা, সহমর্মিতা যখন মানবসমাজ থেকে উধাও হয়ে যায় তখন সেটা প্রতিটি মানুষকে নিরাশ্রয় নিরাপত্তাহীন করে তোলে।
.
সে যখন শিশু ছিল তখন সে একটু স্নেহদৃষ্টির জন্য, একটু আদর পাওয়ার জন্য সবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। অন্যের সহায়তা ছাড়া এক ফোটা পানিও সে খেতে পারত না। আবার বার্ধক্যে একই অবস্থায় সে পতিত হয়।
.
আত্মাহীন সমাজে অর্থ দিয়ে অধিকাংশ বৈষয়িক প্রয়োজন পুরণ করা যায় বলে মানুষ যৌবনে কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি প্রাপ্ত হলেই অহঙ্কারী হয়ে ওঠে, আর বলে – আমি কারো করুণা, দয়া চাই না। আমি কারো খাই না। এর পরোক্ষ অর্থ হচ্ছে, সে নিজেও কাউকে করুণা আর দয়া করা থেকে, অন্যকে খাওয়ানো থেকে দায়মুক্ত হতে চায়।
.
একটা সময় ছিল, মানুষ অতিথিপরায়ণ ছিল। অথচ বর্তমানে তারা আত্মীয়-স্বজনকে আপদ মনে করে, মৌখিক সৌজন্য রক্ষা করাকেও কষ্টকর মনে করে। কাউকে কালেভদ্রে সহায়তা করলে সারাজীবন সেই উপকারের কথা অন্যের কাছে বলে বেড়ায়।
.
স্রষ্টা পরম করুণাময়। তার প্রতিভূ মানুষ যদি করুণাহীন ও নির্দয় হয়ে যায় তাহলে কেবল স্বার্থের উপর ভিত্তি করে বেশিদিন সমাজ টিকে থাকতে পারে না। চতুর্মুখী স্বার্থের দ্বন্দ্বে তা মানুষের বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। এই সমাজে প্রতিটি মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে নিজের জীবন ও সম্পদকে অন্য মানুষের হাত থেকে রক্ষার জন্য উৎকণ্ঠিত থাকতে হয়।
.
বাড়ির দরজায় দারোয়ান রাখতে হয়, সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হয়, রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ রাখতে হয়, সেই পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য ষড় ইন্দ্রিয় খাড়া রাখতে হয়। করুণাহীন সমাজের এটাই বাস্তবতা।

আমাদের মুসলিম সমাজের প্রতি প্রশ্ন-

ইসলাম যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ হয়ে থাকে তাহলে মুসলিম ঘরের সন্তানরা নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকছে কেন? তাহলে কি ইসলামের আদর্শে কোনো ভেজাল ঢুকে পড়েছে? এই ইসলাম বিশ্বনবীর আনিত প্রকৃত ইসলাম নয়?
.
নাস্তিক হবার কারণে কাউকে হত্যা করার বৈধতা আছে কিনা ইসলামে? যদি বৈধতা থাকে তাহলে কী করবেন? দেশের সকল নাস্তিককে হত্যা করবেন? সারা বিশ্বে মুসলিমদের মোট সংখ্যার তুলনায় মোট নাস্তিকের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
.
শুধু নাস্তিক হবার কারণে বিশ্বনবী কি কাউকে হত্যা করেছিলেন?
কেউ রসুলের সমালোচনা করলেও তাকে হত্যা করার বৈধতা আছে কি ইসলামে? শাস্তির বৈধতা যদি থাকেও সেটা কার্যকর করবে কে? যে কেউ শাস্তি প্রদান করতে পারবে নাকি রাষ্ট্র?
.
নাস্তিকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে কেন? নাস্তিকদেরকে বাংলাদেশ ছাড়তে হবে কেন? নাস্তিকদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হবে কেন? ‘নাস্তিকতা-আস্তিকতার লড়াই’ নামে কোনো লড়াই বিশ্বনবী কখনও করেছিলেন কিনা? কিংবা আমাদেরকে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবার হুকুম দিয়ে গেছেন কিনা?
.
বিশ্বনবী ইহুদিদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্মপালনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন, খৃষ্টানদেরকে মসজিদে এবাদত করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করা হয় নাই। তাহলে নাস্তিকরা কেন ব্যক্তিগতভাবে তাদের অবিশ্বাস লালন করতে পারবে না?
.
সমাজের চাক্ষুষ্মান হাজারো অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা ইত্যাদি চলতে দেখেও যারা ‘টু’ শব্দটি উচ্চারণ করেন না, এইসব অন্যায়-অবিচার বন্ধ করার প্রচেষ্টাকে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব মনে করেন না, তারা ‘নাস্তিক্য’ ইস্যুতে এত সরব হন কেন? যারা নিজেদেরকে উমরের উত্তরসূরী দাবি করে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেবার হুংকার ছাড়েন তারা কেন ঐসব লোকের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়েন না যারা মানুষের অধিকার কেড়ে খাচ্ছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে, ব্যাংক থেকে টাকা লুট করছে, মা-বোনদের সম্ভ্রম নষ্ট করছে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, ঘুষ-দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে আছে?

তাহলে কোথায় ইসলাম শিখব?

যে দেশে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র কায়েম থাকে সে দেশে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র শিখতে আলাদা স্কুল লাগে না। এমন কি সক্রিয় রাজনীতি করতেও, দেশ চালাতেও ঐ জীবনব্যবস্থার উপর কোনো বাড়তি ডিগ্রি নিতে হয় না। কারণ জীবনব্যবস্থার শিক্ষা ও চর্চা বাস্তব জীবনেই হয়ে থাকে। আলো বাতাসের মতই তার প্রকাশ ও বিস্তার হয় সর্বব্যাপী।

ইসলাম যদি একটি জীবনব্যবস্থা হয়ে থাকে তাহলে সেটা শিক্ষা করতে কেন একটি আলাদা শিক্ষাব্যবস্থা, আলাদা মাদ্রাসা, সিলেবাস, কারিকুলাম থাকতে হবে? বলে রাখা ভালো, আরবি ভাষা শিক্ষা আর ইসলাম শিক্ষা এক বিষয় নয়।

মানুষ যখন মুখ দিয়ে খেতে পারে না তখন নাক দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে খাওয়াতে হয়। যখন শারীরিক শ্রম তার জীবনযাত্রার অংশ থাকে না তখন জিমনেসিয়ামে গিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হয়। তেমনি ইসলাম যখন মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা হিসাবে পরিত্যক্ত হয়ে আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তখনই ইসলাম শিখতে মাদ্রাসায় যেতে হচ্ছে।

মুসলিম ছিল বীরের জাতি। সেই বীরত্ব তারা কোনো মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা করে নি। মুসলিম ছিল সত্যবাদী, আমানতদার। সেই চরিত্র তারা কোনো মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা করে নি। মুসলিম ছিল ন্যায়বিচারক। সেই ন্যায়নিষ্ঠা তারা তাদের সমাজ থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা করেছিল। তাদের শাসক যেমন ছিল, যে আদর্শে দীক্ষিত ছিল নাগরিকরাও তেমন হয়েছে। কেবল জনগণের মনমত চলা শাসকের কাজ নয়, বরং জনগণকে সঠিক পথ দেখানোও তার মহান দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
একইভাবে আমাদের তরুণরা মাদকাসক্ত হচ্ছে, ইভটিজার হচ্ছে, শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, সন্ত্রাসী হচ্ছে, রাজনৈতিক ক্যাডার হচ্ছে – তাদের এই চরিত্র শিক্ষা দিতে আমাদেরকে কোনো স্কুল কলেজ বসাতে হয় নি, পৃথিবী যেমন সূর্য থেকে শক্তি নিচ্ছে, তারাও এই সমাজ থেকেই ঐ সব কুশিক্ষা নিজেদের জীবনচর্চায় অঙ্গীভূত করে নিচ্ছে।

কেন জীবন থেকে মানবতা হারিয়ে গেল ?

যখন থেকে মূল্য কেবল অর্থ দ্বারা নির্ধাণ করা শুরু হলো তখন থেকে কিছু অমূল্য সম্পদ মূল্যহীন হতে থাকলো। সত্যবাদিতা, আতিথেয়তা, সেবাপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস ইত্যাদি অমূল্য সম্পদ তার দ্যুতি হারিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে, অর্থ দ্বারা এগুলির মূল্যায়ন সম্ভব নয় বলে মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে।
.
মায়ের ভালোবাসা, পিতার অপার স্নেহ, শিক্ষকের জীবনগড়া শাসন ইত্যাদি মহামূল্যবান সম্পদগুলোও আজ সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। শিক্ষকের মর্যাদা আজ বেতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। আমরা যে পাশ্চাত্যদের অন্ধ অনুকরণ করে চলেছি সেই পাশ্চাত্য সমাজে মা-বাবার ভালোবাসা প্রায় অনুপস্থিত। শুধু অর্থ দিয়েই সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন করে তারা। সন্তানও তাই সে ঋণ অর্থ দ্বারাই পরিশোধ করে, কখনো বা সেটাও করে না। আমাদের সমাজও দিন দিন সেদিকেই যাচ্ছে।
.
তরুণীরা এখন টাকাওয়ালা স্বামী পেতে চায়, মেয়ের বাবা-মায়ের দৃষ্টিও জামায়ের পকেটের দিকেই। ভালোবাসা, সচ্চরিত্র- এগুলোর কোনো মূল্য নেই এখন। ছেলেরাও টাকাওয়ালা শ্বশুর খোঁজে।
.
সমাজে তারই সম্মান বেশি যার অর্থ বেশি। ভোটে জিতে বিত্তশালী ব্যক্তিগুলোই জনপ্রতিনিধি হচ্ছে, চরিত্রবান লোকগুলো সর্বত্র তিরস্কৃত হচ্ছে। লেখকরা লিখছে অর্থের জন্য, ছাত্ররা পড়ছে অর্থ উপার্জনের জন্য, ডাক্তাররা অর্থের জন্য চিকিৎসা করছে (রোগীরা তাদের খদ্দেরে পরিণত হয়েছে), নামের সাথে অনেকের সমাজসেবক, দানশীল ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করা হলেও দেখা যাচ্ছে মূলত আর্থিক স্বার্থেই সে এগুলো করছে।
.
যখনই কোনো জিনিসের মূল্য কেবল অর্থ দ্বারা নির্ধারণ করা হয় তখন সেটা পণ্যে পরিণত হয়। সেবাগুলো যখন পণ্যে পরিণত হয় সমাজ থেকে তখন মানবতা হারিয়ে যায়। এখন সাধারণ জনগণ খদ্দেরে পরিণত হয়েছে। পুলিশের কাছে তারা খদ্দের, ধর্মজীবীদের কাছে তারা খদ্দের, ডাক্তারের কাছে খদ্দের, আইনজীবি, রাজনীতিবিদ সকলের কাছেই তারা কেবল খদ্দের। এভাবে পাশ্চাত্যের কনজিউমারিজম সমস্ত কিছুকে পণ্য বানিয়ে ফেলেছে আর সাধারণ মানুষকে খদ্দেরে পরিণত করেছে।
.
এই সিস্টেমের কারণে আমাদের সমাজ এখন চরম স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। সমাজ থেকে নীতি-নৈতিকতা সব হারিয়ে যাচ্ছে, চরমভাবে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে, সমাজ ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। এ থেকে মুক্তি দিতে পারত যে ধর্ম সেই ধর্মকেই বানিয়ে ফেলা হয়েছে পণ্য। ধর্ম বলতে মানুষ এখন বোঝে মোল্লাকে টাকা দেওয়া, মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করা, হজ্জ করা, নামাজ-রোজা করা।
.
এখন সমাজকে বাঁচাতে হলে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে- ধর্ম এসেছে মানুষে কল্যাণে, নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণ করা, মানুষের দুঃখ, কষ্ট হৃদয়ে ধারণ করা ও সেটা দূর করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করাই ধর্মের মূল কাজ। স্বার্থপর মানুষ কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না।

মানবসমাজ ও পশুর সমাজের মধ্যে পার্থক্য

এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, আড়াই বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?
.
মানুষ পশু নয়, তাই মানব সমাজ আর পশুর সমাজও এক নয়। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, স্রষ্টা প্রদত্ত রূহের ধারক, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অসাধারণ এক সৃষ্টি। তার সম্মান, মর্যাদা অন্য যে কোনো সৃষ্টির চেয়ে বহুগুণ বেশি। একই কারণে মানবসমাজও সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো কেবল মানবসমাজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে সমাজে অনুপস্থিত থাকে তাকে কখনও মানবসমাজ বলা যায় না।

মানবসমাজের প্রধানত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ‘মানুষ তার স্বীয় ধর্মকে ধারণ করে সে সমাজ নির্মাণ করে। সমাজ পরিচালিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে।’ মানুষের ধর্ম হলো মানবতা, মনুষ্যত্ব তথা মানবীয় গুণাবলী, যেমন অন্য মানুষের জন্য তার সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, দয়া, মায়া, সহমর্মিতা ইত্যাদি। ধার্মিক ব্যক্তি তার সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয় অন্যের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অন্যের কষ্ট দেখলে, দুর্দশা দেখলে, বিপদ-আপদ দেখলে তার নিজের আত্মায় সে কষ্ট অনুভূত হয়। সমাজের সকল কিছুতেই সে কেবল নিজেকে দেখতে পায়। সমাজের কোনো মানুষ তো দূরের কথা কোনো জীবেরও এতটুকু দুঃখ তাকে পীড়া দেয়, আর সুখ তাকে আনন্দ ও সন্তুষ্টি প্রদান করে। ধার্মিক ব্যক্তি তার জীবন নির্বাহ করে শুধুই অপরের দুঃখ নিবারনের চেষ্টায়। কারণ সে জানে- অপরের কল্যাণে কাজ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজনমের সার্থকতা। এটাই জেহাদ, এটাই ধর্মযুদ্ধ, এটাই ধর্মের সর্বোত্তম কাজ। এই যে মানসিকতা, সর্বভূতে হিত সাধনার্থে প্রয়াস, অপরের মাঝে নিজেকে দেখা- এটাই মানবসমাজের বৈশিষ্ট্য। এ সমাজে কোনো স্বার্থচিন্তার স্থান থাকে না, শুধু থাকে বিনিময়হীন সেবা। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেখে যে যত বেশি সেবা প্রদান করতে পারে সে তত বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়, তত বেশি তার কীর্তি প্রাপ্ত হয়।

অন্যদিকে পশুর সমাজ হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সমাজ পরিচালিত হয় স্বার্থচিন্তার ভিত্তিতে। সেখানে প্রত্যেকেই আত্মস্বার্থে কাজ করে। সবসময় নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকে। অন্যের প্রতি কোনো অনুভূতি থাকে না। এমন কি নিজের স্বার্থ হাসিলের পথে যত অন্যায়-অবিচার, যুলুম দরকার হোক তার কোনো বাছ-বিচার করা হয় না, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য থাকে না। এ সমাজে শক্তিই পরিণত হয় ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডে। প্রত্যেকের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যে করেই হোক নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায় করে নেওয়া। এখানে আত্মার কোনো স্থান থাকে না, থাকে শুধু দেহ। তাই দেহের প্রয়োজন পূরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পশু বেঁচে থাকে শুধু উদরপূর্তি করার জন্য। সে সারাদিন চিন্তা করে কোনো পশুকে আক্রমণ করবে, পরাভূত করবে, মাংস ভক্ষণ করবে। পাশাপাশি শঙ্কিতও থাকে এই বুঝি তার ওপর হামলা হলো, এই বুঝি তার থেকে শক্তিশালী কেউ তাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল।

আপনি যদি পশুর সমাজে যান, অর্থাৎ কোনো ভয়ংকর বনে-জঙ্গলে প্রবেশ করেন তখন অবশ্যই আপনি খালি হাতে যাবেন না। কারণ সেখানে নিরাপত্তা নেই, যে কোনো সময় প্রাণ চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। বন্য পশুর সামনে হাতজোড় করে দয়াভিক্ষা করলেও নিস্তার পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে দরকার পড়ে পাহারার। কিন্তু যে সমাজ, যে জগতে একজন আরেকজনের জন্য নিজের সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয়, অপরের মাঝে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে, অপরের সুখে নিজের তৃপ্তি খুঁজে পায় এমন সমাজে কি পাহারার দরকার পড়ে? বস্তুত পাহারা দিতে হয় পশুর সমাজে, মানবসমাজে তো কেবল সৌহার্দ্র্য, ভ্রাতৃত্ব, দয়া-মায়া, ভালোবাসার সমাহার। সেখানে অনিরাপত্তার ছোঁয়াও লাগে না, তাই পাহারারও দরকার হয় না।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকের মানবজাতির! দুর্ভাগ্য কথিত মানবসমাজের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে কী না করতে হয়। এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?

সোজা কথা হলো মানবতা-মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজকের মানবজাতি ধর্মহীন পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের সমাজ পরিণত হয়েছে পশুর সমাজে। কারণ পাহারা দেওয়ার দরকার হলেই সে সমাজ আর মানুষের সমাজ থাকে না। এ কারণেই যুগে যুগে যখন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখা গেছে তখন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর দরকার পড়ে নি, অস্ত্রের লাইসেন্স করার দরকার পড়ে নি, অস্ত্রব্যবসার জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের দরকার পড়ে নি। অথচ সমাজে কোনো অন্যায়-অবিচার ছিল না, অনিরাপত্তা ছিল না। এমনটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখন প্রতিটি মানুষ ছিল মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আর আজ এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কারণ এখন প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে নিয়োজিত।

মুঠোফোন – 01722 606045।

স্বার্থপর মুত্তাকির পরিণতি

Article-2বর্তমানে ধর্মহীন পশ্চিমা বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাবে মানবজাতি এতটাই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে যে তাদের কাছে উন্নত জীবনযাপন মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে আরাম আয়েশ, ভোগবিলাস, বস্তুগত সমৃদ্ধি। যে এটা হাসিল করতে পারে তাকে বলা হয়ে থাকে যে, সে বড় মানুষ হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জীবনে সফল হয়েছে অর্থাৎ তার জীবন স্বার্থক। কিন্তু এটা তো স্বার্থকতা নয়। মানদ- পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বুঝতেই পারছে না যে তাদের মানবজীবনের স্বার্থকতা হলো নিজের জীবন এবং সম্পদকে অন্য মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা। মো’মেনের সংজ্ঞার মধ্যেই এই বিষয়টিই আছে যে জীবন এবং সম্পদ দান করে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা (সুরা হুজরাত ১৫)। আবার সুরা তওবার ১১১ নং আয়াতে এই কথাটাই লেখা আছে যে আল্লাহ মো’মেনদের জান মাল কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।

আল্লাহ জান মাল নিয়ে কী করবেন?

আসলে কিছুই করবেন না, তিনি চান সেই জান ও মাল আল্লাহর অভিপ্রায় মোতাবেক মানুষের কল্যাণে ব্যয়িত হোক। সুতরাং পরিষ্কার হয়ে গেল মো’মেন হওয়ার শর্ত হলো আপনাকে আগে জীবন-সম্পদ কোরবান করতে হবে। আর নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত যাবতীয় আমল সব মো’মেনদের জন্য। মো’মেন না হলে সব আমলই অর্থহীন। আল্লাহ বলছেন, ‘আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদের স্বীয় কর্ম ও শ্রমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের কথা জানিয়ে দেব?- পার্থিব জগতে কৃত সমস্ত আমলই যাদের পন্ড শ্রম হয়েছে। অথচ তাদের ধারণা, খুব ভালো কাজই করে যাচ্ছে তারা।’ (কাহাফ : ১০৩-১০৪)

তাদের এই আমল বিনষ্ট হওয়ার কারণ তাদের তাকওয়া আছে কিন্তু তারা হেদায়াতে নেই আর হেদায়াহ বিহীন ব্যক্তিগত তাকওয়ার মূল্য নেই। অন্যের জন্য জীবন সম্পদ কোরবান না করলে ব্যক্তির তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। আরও পরিষ্কার করে বলা যায় ব্যক্তিগতভাবে আপনি যত ভালো মানুষই হওয়া চেষ্টা করুন না কেন, যদি ভাবেন যে আমি একা ভালো মানুষ হয়ে থাকব, সমাজ, দেশ, মানবজাতির কী হয় না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না, আমি চোখ নাক কান বন্ধ করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লাম, কারো ক্ষতি করলাম না মিথ্যা কথা বললাম না, কারো হক নষ্ট করলাম না, টাখনুর উপর পায়জামা পরলাম, দাড়ি রাখলাম আমি ব্যক্তিগতভাবে ভালো মানুষ হলাম কিন্তু সমাজের অশান্তি দূর করার কোনো প্রচেষ্টা করলাম না, এটা চরম স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা আত্মকেন্দ্রিক ভালো মানুষের কোন জান্নাত নাই।

আল্লাহ বলছেন, ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে। যারা নিজেরাও কার্পণ্য করে এবং অন্যকেও কৃপণতা শিক্ষা দেয় আর গোপন করে সে সব বিষয় যা আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে দান করেছেন স্বীয় অনুগ্রহে। বস্তুত তৈরি করে রেখেছি কাফেরদের জন্য অপমানজনক আযাব (সুরা নিসা: ৩৭)।

সুতরাং কৃপণতা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি মো’মেন হওয়ার শর্তের বিপরীত এবং কাফেরের বৈশিষ্ট্য। বর্তমানের পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষার প্রভাবে উপরোক্ত আয়াতের প্রতিটি কথা মানবচরিত্র বাস্তবায়িত করে। যেমন এই শিক্ষা ও সম্পদ মানুষকে গর্বিত ও দাম্ভিক করে তোলে, বিনয়ী করে না। পিতা-মাতা, আত্মীয় পরিজন, প্রার্থী, এতিম, অধীন ব্যক্তিদের প্রতি সৎ ও সদয় আচরণে প্রবৃত্ত করে না, কৃপণতা শিক্ষা দেয়, নিজের সম্পদকে গোপন করা শিক্ষা দেয়। আল্লাহ এই ব্যক্তিকে কাফের আখ্যা দিয়ে অপমানজনক জাহান্নামের শাস্তির সতর্কবার্তা জানিয়েছেন।

ব্যক্তি ভালোমানুষি দিয়ে কেউ জান্নাতে যাবে না, কারণ জান্নাত সামষ্টিক। ইসলাম মানে শান্তি, তাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করলে জান্নাতে ঠাঁই পাওয়া যাবে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা একটি সামষ্টিক কাজ সুতরাং জান্নাতও একটি সামষ্টিক কাজের ফল। এর অর্থ কি আপনি ভালো মানুষ হবেন না? সত্যবাদী হবেন না? হ্যাঁ, ভালো হবেন সমাজকে ভালো করার জন্য। অন্য মানুষকে ভালো করার জন্য আপনাকে ভালো হতেই হবে। ব্যক্তি তাকওয়ার কোন মূল্য নেই। সামষ্টিক তাকওয়াই হলো জান্নাতে যাবার পূর্বশর্ত। যেমন আপনার উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য আপনাকে সুশৃঙ্খল হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, আত্মিক দিক দিয়ে আপনাকে অনেক দৃঢ় হতে হবে, অনেক দানশীল হতে হবে। আপনাকে সালাহ করতে হবে, সওম করতে হবে এইজন্য যেন আপনি শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করতে পারেন। অ র্থাৎ আপনি দুনিয়ার সমাজের মানুষের ভালো করার জন্য আমল করবেন। সেটা আমল হবে। আর দুনিয়ার মানুষ ধ্বংস হয়ে যাক তাতে কিছু যায় আসে না, আমি ভালো হলেই চলবে, এ জাতীয় স্বার্থান্ধ দৃষ্টিভঙ্গির লোক কোনদিন জান্নাতে যেতে পারবে না।

এই পোস্টির বিষয়ে আপনার কোন মতামত থাকলে – 01722 – 606045

স্বার্থচিন্তা যেভাবে ঐক্যের অন্তরায়

সমষ্টিগত জীবন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় খ্রিস্ট ধর্মের ব্যর্থতায় উদ্ভূত সমস্যার ফলে পশ্চিমা সভ্যতা আবিষ্কৃত বিভিন্ন জীবনব্যবস্থা তথা তন্ত্র-মন্ত্র সারা বিশ্বজুড়ে গ্রহণ করার ফলে মানুষের নৈতিকতায় একটি সাঙ্ঘাতিক পরিবর্তন এসেছে। আর তা হলো ভৌগোলিক রাষ্ট্র ধারণা বা যার যার সীমানার স্বার্থ সংরক্ষণ। ফলে মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল একটি সীমার ভেতর। অর্থাৎ একটি ভূ-খণ্ডের মানুষ তাদের নিজস্ব গণ্ডি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এই সীমার বাইরে যারা রয়েছে তাদের প্রতি কোন প্রকার দায়বোধকে তারা অস্বীকার করে বসলো। এতে করে ভৌগোলিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করলো। অপরদিকে নিজস্ব ভূ-খণ্ডের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বাকি রাষ্ট্রের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে তারা মোটেও ভাবছে না।

ব্যাপারটা এমন যে আমাকে সুখে থাকতে হবে, সেটা যদি অন্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়েও হয়। স্বাভাবিকভাবেই একেকটি ভৌগোলিক রাষ্ট্রের এই ধারণা তাদেরকে প্রচণ্ড স্বার্থপর করে তুললো। তাতে করে স্বার্থ উদ্ধারে যাই করা হোক না কেন, তার সবই নীতিগতভাবে সঠিক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। শক্তির জোরে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, লুণ্ঠন, শক্তিশালী দেশ কর্তৃক দুর্বল দেশের প্রতি চাপিয়ে দেওয়া দাসখত চুক্তি সব কিছুই এর মধ্যে পড়ে। তাই কে কার চাইতে শক্তিশালী হতে পারে এই নিয়ে দেখা দেয় প্রতিযোগিতা। আবার ভিন রাষ্ট্রের আক্রমণে অন্তরায় সৃষ্টি কিংবা ভয় দেখানোর জন্যও তারা প্রতিযোগিতায় নামলো। যার ফলে পৃথিবীতে দেখা দিয়েছে ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা। এতে করে দেখা যায় সাধারণ জনগণকে না খাইয়ে রেখে হলেও বহু রাষ্ট্র পাল্লা দেওয়ার জন্য মারনাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে। কৃষি, আবহাওয়া, চিকিৎসা ও শিক্ষাখাতে কম অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে অস্ত্র ক্রয় ও নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কারের পেছনে।

এই যে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার পেছনে পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলা, এটা শেষ পর্যন্ত মানুষকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বা এর শেষ কোথায়? এটা কি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তার সম্মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? মোটেও নয়। এই প্রতিযোগিতা মানুষকে পশুর কাতারে নামিয়ে দিচ্ছে।

অপরদিকে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে দেখতে পাব আমাদের হয়েছে ভিন্ন রোগ। অন্যরা যেখানে ভৌগোলিক রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কাজ করে না, তেমনি আমরা জাতীয় ঐক্যহীনতা ও যথার্থ শিক্ষার অভাবে আরো ক্ষুদ্র পর্যায়ে নেমে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে আবদ্ধ হয়ে গেছি। আমরা জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে নিমজ্জিত হয়ে যা-ই করছি তাকেও বৈধ বলে জ্ঞান করা হচ্ছে। সার্বজনীন স্বার্থের পরিবর্তে ভৌগোলিক স্বার্থে আটকে যাওয়ার চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থে নেমে যাওয়ার এই অবস্থাটি আরো মারাত্মক এবং বিপজ্জনক। এতে আগের অবস্থায় যে দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্র পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিলো তা এখন ব্যক্তি পর্যায়ে নেমে এসেছে। অর্থাৎ দায়িত্ববোধও ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে গেছে। তাই অন্যদের তুলনায় আমাদের অবস্থা আরো করুণ, আরো দুঃখজনক। তাই শুধু ব্যক্তিস্বার্থ নয়, আমরা কি পারি না ভৌগোলিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে? কেননা আমরা এই পৃথিবীর যে যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমরাতো একই দম্পতি অর্থাৎ আদি পিতা আদম (আঃ) ও আদি মাতা হাওয়া (আঃ) থেকে আগত, সুতরাং সে হিসেবে আমরা সবাই ভাই-বোন, আমাদের প্রত্যেকের অনুভূতিও একই রকম। পৃথিবীর সব জায়গার পরিবেশ একরকম নয়। প্রাকৃতিক সম্পদও সব স্থানে সমপরিমাণে পাওয়া যায় না। সুতরাং আমরা একই পৃথিবীর মানুষ নিজেদের ভাই-বোন মনে করে কি পারি না সমবণ্টন করে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করতে? পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মই কি এ শিক্ষা দেয় না? তাহলে আমরা কোথায় চলেছি? কেনই বা পৃথিবীর বুকে কল্পিত সীমারেখা টেনে বিভক্তি বাড়াচ্ছি? আমরা কি সমষ্টিগত ঐক্যের কথা চিন্তা করতে পারিনা?

আমরা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে

প্রতিটি মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ঠিক যেন আদর্শ একটি পরিবারের মতোই। মাথা, হাত, পা, চোখ, কান, নাক, পেট ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি ঐ পরিবারের সদস্য। এই সদস্যগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সুদৃঢ় ঐক্য বিদ্যমান। একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে অন্যসকল অঙ্গ কষ্ট পায় এবং তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসে, কেউ কোনো অভিযোগ তোলে না। এই পরিবারে যদি কখনো অনৈক্য দেখা দেয়, যদি একে অপরের ক্ষতি করার চেষ্টায় মত্ত হয়, এক হাত যদি অন্য হাতকে কেটে ফেলতে উদ্যত হয়, এক পা যদি অন্য পা ভাঙ্গার মনস্থির করে, মুখ যদি পেটকে খাদ্য দেওয়া বন্ধ করে দেয় তবে ঐ পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে অর্থাৎ শরীর হয়ে পড়বে অসুস্থ এবং এক পর্যায়ে শারীরিক মৃত্যু ঘটবে। মৃত্যুর পর হাত, পা, নাক, কান, মুখ, পেটসহ সকল অঙ্গেই পঁচন ধরবে।

একটি দেশ, একটি জাতি, একটি সমাজও মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির মতোই। একটি সমাজের প্রতিটি মানুষ যখন সকল অনৈক্য ভুলে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তখন সেটি হয় সুস্থ, সবল ও শান্তিপূর্ণ আদর্শ সমাজ। আর যখন ঐ মানুষগুলিই একে অপরের ক্ষতি করার চিন্তা করে, নানা অজুহাতে অন্য ভাইয়ের উপর আক্রমণ করে, হত্যা করে, অন্যের সম্পদ ধ্বংস করে তখন তা অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে ফলে ঐ দেশ, ঐ সমাজ বা ঐ দেশের প্রতিটি সদস্যের গায়েই পঁচন ধরবে, কেউই এই পঁচন থেকে বাঁচতে পারবে না। আজ আমাদের সমাজে অনৈক্য আর বিভেদের দেওয়াল এমনভাবে তোলা হয়েছে যে, আমরা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, কাজেই এখনই যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হয় তবে ধ্বংস থেকে কেউই বাঁচতে পারবো না।

কিছু পরিবার মিলে একটি পাড়া, কিছু পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি গ্রাম এভাবেই একটি ইউনিয়ন, থানা, জেলা, বিভাগ নিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ। আমরা চাইলেই হয়তো অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত দেশকে পরিবর্তন করতে পারবো না কিন্তু সৎ মানুষিকতা নিয়ে উদ্যোগী হলে অন্তত আমাদের পাড়া, আমাদের গ্রাম, আমাদের থানাটিকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যের ভিত্তিতে শান্তির নীড় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। আসুন আমরা উদ্যোগ নিই- আমাদের গ্রামের প্রত্যেকেই দল, মত, পথ, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হব। কেউ কারও উপর হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, গাছ কর্তন করব না, কারোর কোনো ক্ষতি করব না, একে অপরের সহযোগিতা করব, আমাদের গ্রামে কেউ না খেয়ে থাকবে না, আমাদের গ্রাম হবে শান্তির গ্রাম। এভাবে যদি আমরা আমাদের গ্রামকে সমগ্র বাংলাদেশে একটি আদর্শ গ্রাম হিসাবে পরিচিত করতে পারি, তবে অন্য গ্রামগুলিও আমাদের অনুসরণ করবে।

কোথায় বান্ধি ঘর?

যে সমাজে নিরাপত্তা নেই, যে সমাজে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি তো দূরের কথা আড়াই বছরের বালিকা পর্যন্ত ধর্ষিতা হয়, সাত বছরের বালিকা যেখানে গ্যাং রেপের শিকার হয় সেখানে ভবিষ্যত প্রজন্মকে বড় করে তোলা কিংবা নিজে একটুকু ভালো থাকার আশায় একটা চাকুরি, সুন্দরী স্ত্রী, একটা বাড়ি করার স্বপ্ন বড় বেমানান জিনিস।

এখানে সন্ত্রাসী, র‌্যাব পুলিশ যোগসাজস করে ৭টা মানুষকে তুলে নিয়ে হত্যা করে ফেলে। লাশ গোপন করার জন্য পেট ফেড়ে শরীরে ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়, ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুম করে ফেলা হয় সেই সমাজে সুদ-ঘুষের হারাম উপার্জন দিয়ে সন্তান বড় করে লাভ কী? কোথায়, কোন পৃথিবীতে আমরা তাদেরকে রেখে যাচ্ছি? একটিবার ভেবে দেখেছেন আমাদের চলে যাওয়ার পর তারা কোথায়, কোন দুনিয়ায় গিয়ে পড়বে?

আমরা কিন্ত মনে করছি আমরা তাদের ভালোটাই করার চেষ্টা করছি। তাদেরকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করছি, আরাম-আয়েশের জীবন দিচ্ছি। কিন্তু তাদের উপকার করতে গিয়ে আমরা যে খাল কাটছি সেই খাল বেয়ে একদিন কুমির আসবে আপনার আপনার আমার সন্তানকে গিলে খেতে। সেই কাজটা আমরাই করে যাচ্ছি। আমরা ঘুষ দিয়ে চাকুরি নিচ্ছি, টেন্ডার বাগাতে বড় কর্তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করছি। এভাবে অসৎপথের একটা জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।

আজকে পুলিশের কিংবা সরকারি চাকুরি করতে যতটাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে তার পরিমাণ আগামী দশ বছর পরে কতগুণ বৃদ্ধি পাবে সেটা আপনারাই চিন্তা করুন। আপনার আমার সন্তানের উপর তখন চাপটা কত পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে সেটাও ভেবে দেখুন। আর তারাও অনুরূপ আত্মসার্থ বিবেচনা করতে গিয়ে একসাথে কয়টা খুন করতে পারে সেটাও অনুমান করুন। খুন করে গুম করাতো তখন আরো স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যাবে। রাখঢাক করে অবৈধ উপার্জন হবে না। বরং কে কত মারতে পারে সেটা দিয়ে মর্যাদা নির্ণয় হবে।

সুতরাং, আসুন চিন্তা করি কোথা বাঁধছি ঘর? কিসের উপর বানাচ্ছি স্বপ্নের আবাসন? কোনদিকে ঠেলে দিচ্ছি আগামী প্রজন্মকে? অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে তাদেরকে আপাত ভালো রাখতে গিয়ে কত বড় ক্ষতি করছি সেটাও আসুন ভেবে দেখি।