ওয়াচডগ এর সকল পোস্ট

স্মৃতির পাতায় বিদেশ

স্মৃতির পাতায় বিদেশ…

গেল শতাব্দীর ৭০’এর দশক। প্রবাসে এসেছি কেবল। আপনজনদের ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে নতুন জীবন শুরু করার চেষ্টা করছি। অবশ্য এ চেষ্টা আমার একা ছিলনা, সাথে ছিল আরও ১৫ জন। থাকি ইউক্রেইনের ছোট একটা শিল্প শহরে। এক বছর থাকবো আমরা। একটা স্কুলে রুশ ভাষা শিখছি। তারুণ্যের জোয়ার সবার চোখেমুখে। প্রতিদিন প্রতি-মিনিট নতুন কিছু দেখছি, আবিষ্কার করছি এবং শিখছি। প্রথম তুষারপাত, প্রথম প্রেম, প্রথম সেক্স, ১৮-১৯ বছরের একজন যুবকের চাওয়া-পাওয়ার সবকিছু ছিল এখানে। আমরাও নিয়েছে দু’হাত ভরে।

অনেক স্মৃতিই ফিকে হয়ে যায়, কিন্তু দু’একটা থেকে যায়, যা মুছে যায়না। কবর পর্যন্ত সাথে থাকে। প্রবাসের প্রথম ঈদ ছিল তেমনি একটা স্মৃতি। কুরবানির ঈদ। ঘুম হতে উঠতেই সবার মন খারাপ। আজ ঈদ অথচ মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ কাছে নেই। যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। চিঠি আসতে সময় নেয় একমাস। সবচাইতে কষ্টের জিনিস, আজও ক্লাসে যেতে হবে। এদেশে ধর্মচর্চা অফিসিয়ালি নিষিদ্ধ। তাই ঈদের নাম দিয়ে ছুটি নেয়ার সুযোগ ছিলনা। আমাদের একজনের মাথা হতে দুরূহ একটা পরিকল্পনা বের হওয়ায় ছুটিটা পাওয়া গেল।

হোস্টেলের কমনরুমে দরজা লাগিয়ে নামাজ পড়ছি। গলার স্বর খুবই নিচু। সুরা ও মোনাজাতের ভাষাও ছিল সংক্ষিপ্ত। আমাদের মাঝেই নামাজ পড়াতে জানে এমন একজনকে পাওয়া গেল ইমামের ভূমিকা পালনের জন্যে। তার পেছনে একজন বাদে বাকি সবাই কাতার করে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাকি একজন ছিল অন্য ধর্মের। হিন্দু।

নামাজের মাঝখানে বিকট আওয়াজে খুলে গেল দরজাটা। চিন্ময়! হাসছে সে! নামাজ নিয়ে বিদ্রূপ করছ। সাথে রুশ ভাষায় অকথ্য গালি। আমরা সবাই অবাক হলাম। সরকার আমদের বিদেশ পাঠিয়েছে মেধার ভিত্তিতে। সে ভিত্তির সাথে চিন্ময়ের এহেন আচরণ খাপ খায়না। কেউ একজন তাকে অনুরোধ করল এমনটা না করতে। এত রুষ্ট হয়ে আরও একধাপ এগিয়ে গেল সে। হাতে থাকা বড় একটা শুকরের হাড্ডি ছুড়ে মারল সামনের কাতারে।

৬ বছর পরের ঘটনা।
ভাষা-কোর্স শেষ হওয়ার পর ছোট ছোট গ্রুপ করে আমাদের চলে যেতে হয় বিভিন্ন শহরে। সেদিনের সে ঘটনা কেউ মনে রাখেনি। অনেকের মত চিন্ময়ও হয়ে যায় আমাদের আজীবনের বন্ধু। তো সবার কোর্স শেষ। আমরা সবাই ইঞ্জিনিয়ার বনে গেছি। এবার দেশে ফেরার পালা। বাংলাদেশ সরকারের সাথে এমনটাই ছিল আমাদের চুক্তি। মস্কোর একটা হোস্টেলে আবার জড়ো হচ্ছি আমরা। এবং তা শেষবারের মত। আমি নিজেও ছিলাম উত্তেজিত। অনেকদিন পর একত্র হব সবাই।

মস্কো শেরমেতভো এয়ারপোর্ট হতে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম নির্ধারিত ঠিকানায়। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে কেবল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি সবাই সজাগ। চেহারায় রাত জাগার ছাপ। আমি ঢুকতেই একজন আমাকে তার রুমে নিয়ে গেল। দরজা লক করে পাশে বসাল। আমি অবাক হলাম, নিশ্চয় রাতে কিছু একটা ঘটেছে।

চিন্ময়কে গতরাতে সবাই মিলে পিটিয়েছে! আমি আকাশ হতে পরলাম। পাঁচ বছর পর সবাই এক হয়েছি, আর তার পরিণাম কিনা মারামারি! আমার আওয়াজ পেয়ে আরও অনেকে রুমে ঢুকলও। আমি রাগে ফেটে পরলাম। একে একে সবাই কথা বলতে শুরু করল। সেই পাঁচ বছর আগের রাগ দু’একজন ভুলতে পারেনি। সাথে যোগ হয়েছে আগের রাতের ঘটনা।

বিদায় উপলক্ষে রুশ ট্র্যাডিশন অনুযায়ী পানের ব্যবস্থা ছিল। সবাই পান করেছে। রাত গড়ানোর সাথে সাথে চিন্ময় শুরু করে তার পুরানো কাজ, মুসলমান ধর্ম নিয়ে কুৎসিত গালি! এ যাত্রায় তাকে আর রেহাই দেয়নি কেউ।

তার রুমে তাকে দেখতে গেলাম। জামাকাপড় ছেড়া। শরীরে অনেক অংশ ফোলা। উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। ডাক দিতেই আমার দিকে তাকাল। সবার হয়ে ক্ষমা চাইলাম। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। চিন্ময় একজন প্রতিভাবান ছাত্র। ভাল গান করে, কবিতা লেখে, হাতের লেখা মুক্তার মত। কিন্তু মুসলমান ধর্মের নাম শুনলেই কেন জানি উন্মাদ হয়ে উঠত। ততদিনে আমাদের অনেকের ভেতর নাস্তিকতা বাসা বেধে ফেলেছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ধর্মের বিরুদ্ধে সীমাহীন বিদ্বেষের কোন কারণই বাসা বাঁধতে পারেনি। চিন্ময়ই ছিল তার ব্যতিক্রম।

বিদায় জেরুজালেম বিদায় ইসরায়েল বিদায় প্যালেস্টাইন

Dead Sea – মৃত সাগর!

হিব্রু ভাষায় ইয়াম হা-মেলাহ, যার ইংরেজি অর্থ, সী অব সল্ট। পুব তীরে জর্ডান এবং পশ্চিমে তীরে ইসরাইল। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে পৃথিবীর সবচাইতে নিচু এলিভিশনে অবস্থিত এ সাগর। মিটারের হিসাবে প্রায় ৪৩০ মিটার। কোন মাছ নেই পানিতে। নেই কোন জলজ প্রাণী। লবনাক্ততাই এর মূল কারণ, যার পরিমাণ শতকরা ৩৪ ভাগ। লবণের কারণে এখানে স্বাভাবিক সাতার কাটায়ও সমস্যা। পানিতে নামলে ভেসে থাকতে হয়। জর্ডান রিফট ভ্যালিতে অবস্থিত মৃত সাগরে পানি সরবরাহের মূল উৎসও জর্ডান নদী। ইউনিক বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক ভিড় জমায় ডেড সীর তীরে। অনেকের কাছে এটা একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অনেকে সাগরের কালো কাদামাটি চামড়ার চিকিৎসার জন্যে ব্যবহার করে থাকেন। বলাহয় মিশরীয়রা মমিফিকেশনেও ব্যবহার করেছে এই সাগরের কাদামাটি।

মাসাদার পথে জেরুজালেম হতে বেরিয়ে কিছুটা পথ যাওয়ার পরই চোখে পরে ডেড সী’র অবস্থান। দূর হতে দেখলে অনেকটা বাংলাদেশের খালের মত মনে হবে। সাগরের লম্বা উপকূল জনমানবহীন। রাস্তার দুইধারে সাড়ি সাড়ি খেজুর আর জলপাই বাগান। লবণ তৈরির কারখানার বিস্মৃতি গোট কূল জুড়ে। অনেক পরিত্যক্ত উপকূল দখল করে নিয়েছে লবণের স্রোত। সূর্যের আলো লবণ স্তূপের উপর আছড়ে পর আয়নার মত চক চক করে। ওদিকে টুরিস্টদের যাওয়া নিষেধ। লবণ ও পানির রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তীর জুড়ে তৈরি হয়েছে বিশাল সব সিঙ্কহোল। বা গর্ত। যে কোন সময় মাটি সরে গিয়ে তৈরি হতে পারে এই গর্ত। তাই সাবধানতা অবলম্বনের জন্যে ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই টুরিস্টদের।


প্রবেশমুখে বেদুইনদের উট।

দুপুর ৩টার পর মাসাদা ফোর্ট ভ্রমণ শেষে আমাদের বাস থামল কালিয়া নামের একটা বীচে। ভেতরে এসির ঠাণ্ডা বাতাসের কারণে বুঝা যায়নি বাইরের অবস্থা। বাসের দরজা খোলার সাথে মনে হল কেউ আগুনের গোলা ছুড়েছে আমাদের দিকে। এ যেন আগ্নেয়গিরি হতে নেমে আসা লাভার উত্তাপ। পানির বোতলটা হাতে নিয়ে নেমে পরলাম বাস হতে।

গাইড জানিয়ে দিল কালিয়া বীচের নিয়ম কানুন। বলে দিল যাদের ধারণা নেই তারা যেন সাতার কেটে বেশিদূর না যায়। মাথা নিচু করলে কি ধরণের বিপদ আসতে পারে তার ধারণা দিল। দৈবক্রমে চোখে লবণ ঢুকে গেলে কি করতে হবে তারও প্রেসক্রিপশন দিল। পাশেই দোকানপাট। ওখানে টাওয়েল সহ অনেক কিছুই ভাড়া করা যায়। পরিস্থিতির সামগ্রিক বিচার করে পানিতে না নামার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। একে সাতার জানিনা, দ্বিতীয়ত সূর্যের তাপে চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। ছাতার মত একটা সেদের নীচে জুতা আর গায়ের গেঞ্জিটা খুলে এলিয়ে দিলাম শরীর। ক্লান্তি এসে ভর করছে। চোখ বুজে আসছে।

একটু পর পর পানি খেতে হল। দুই লিটারের বোতলটা শেষ হওয়ার পর এক বোতল কোক কিনে ফিরে এলাম ছায়াটায়। হরেক রকম মানুষ। হরেক রকম ভাষা। তাদের সাঁতারের পোশাকও ভিন্ন। বিপদজনক বিকিনি পরিহিত ইউরোপীয়ানদের পাশেই লম্বা জুব্বা-ওয়ালা আফ্রিকান মহিলারা পানিতে মাতামাতি করছে। কালো কাঁদায় গোটা শরীর লেপটে নিয়ে ভুতের মত শুয়ে আছে সূর্যের নীচে। সদ্য পরিচিত ট্যুর বন্ধু ফ্রেঞ্চ-ম্যান পিয়ের দূর হতে আমাকে হাত নাড়াল। পানিতে নামার ইশারা দিল। মাথা নেড়ে আমিও ধন্যবাদ দিলাম। এবং পানিতে নামার জন্যে আমি যে তৈরি নই, তা জানিয়ে দিলাম। সময় গড়াচ্ছে এবং সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। আমি ঘামছি। শরীরের সাথে লেপটে যাচ্ছে আমার টি-শার্ট। সূর্য দখল নিয়েছে আমার ছায়ার জায়গাটা। উঠতে হল। পাশের বারে ঢুকে বরফের মত ঠাণ্ডা আরও এক বোতল কোক কিনতে হল। এক পর্যায়ে মন হল আমি আর পারছিনা।


সদ্য পরিচিত ট্যুর বন্ধু ফ্রান্সের পিয়ের।

নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট আগেই বাসটা এসে গেল। কেবল আমি নই, আফ্রিকা উপমহাদেশের বেশ কজন টুরিস্ট এক লাফে উঠে গেল। ওখানে বেহেস্তের ঠাণ্ডা বাতাস! আমার পাশের সীটের মহিলাকে দেখলাম বাইরের জলপাই গাছের ছায়ায় বিকিনি পরে বসে আছে। চোখে চোখ পরতে আমাকে ইশারায় ডাক দিল। অনিচ্ছাসত্ত্বে আবারও নামতে হল। দুঃখ প্রকাশ করে জানাল সমুদ্র-পারের যে জায়গাটায় আমি শুয়ে ছিলাম ওখানে সে তার ব্যাগটা ফেলে এসেছে। এত রোদে তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। পারলে আমি যেন হেল্প করি। করতেই হল। এটাই ভদ্রতা। সিঁড়ি বেয়ে অনেকদূর নামতে হবে। ফেরার পথে উপরে উঠতে হবে। নিজকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। গুন গুন করে গান গাইতে শুরু করলাম। জানতাম সহজ হবেনা এ যাত্রা।

বিশ মিনিট পর ট্যুর গাইড ফিরে যোগ দিল আমাদের সাথে। সবাইকে ধন্যবাদ জানাল এবং আজ ট্যুরে কি কি দেখেছি তার উপর ছোট্ট একটা লেকচার দিল। এখানেই আমাদের ট্যুরের সমাপ্তি এবং ঘরে ফেরার পালা।

চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করলাম। অবশ্য আশেপাশের বাকি যাত্রীরাও তাই করছে। বাস ছুটে চলছে জেরুজালেমের দিকে। আমি জানি এ দেশে এটাই আমার শেষ ট্যুর। আগামীকাল রাতে আমাকে ফেরার ফ্লাইট ধরতে হবে। ঘরে ফিরে ভোজবাজির মত ভুলে যেতে হবে পৃথিবীর এ অংশে কাটিয়ে যাওয়া কটা দিন। অনেকসময় হয়ত স্বপ্ন মনে হবে। এদেশে ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই। হয়ত ইচ্ছাও নেই। হয়ত হঠাৎ করেই বদলে যাবে এর চেহারা। ট্যাংক আর বন্দুকের পদভারে থর থর করবে রামাল্লার মাটি। হয়ত জেরিকো শহরের নির্জন রাস্তাঘাট ভারী হবে প্রতিবাদীদের মিছিলে। কোনকিছুরই নিশ্চয়তা নেই এ দেশে। এ অনেকটা বারুদের গোলার মত। যেকোনো সময় দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে। সেদিন দূর হতে আমিও হয়ত কষ্ট পাব এই ভেবে, রক্তস্নাত এই মাটিতে আমিও হেঁটেছিলাম।

বিদায় জেরুজালেম। বিদায় ইসরায়েল। বিদায় প্যালেস্টাইন।

.
২৭শে জুলাই, ২০১৯।
______________

ইসরায়েল সফরের উপর আমার লেখাগুলো অনেকটা তাড়াহুড়ো করে লেখা। আমি জানতাম সাথে সাথে না লিখলে ঘরে ফিরে সহজে লেখা হবেনা। সবার মত আমাকেও দিনের বড় একটা অংশ কাটাতে হয় অফিসে। বাসায় ফিরলে আমার দখল নেয় ছেলেমেয়েরা। ওদের ফেলে লিখতে গেলে গিন্নীর হতো মন খারাপ। তাছাড়া অন-গোয়িং এইজিং প্রসেসে ঘটনার অনেক কিছু মনে রাখা সম্ভব হতোনা। তাই প্রতিটা ট্রিপের পর রাত জেগে লেখার চেষ্টা করেছি। নিশ্চিত করে বলা যায় আমার লেখার সীমিত পাঠকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল লেখা শেষ করায় বিরাট একটা উৎসাহ। কোন ধন্যবাদই যথেষ্ট হবেনা। আমি কোন বিচারেই লেখক নই। আমার বাংলা ভাষার জ্ঞান সীমিত, কারণ ভাষা চর্চার পিক আওয়ারে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল দেশের বাইরে। তৃতীয় একটা ভাষা রপ্ত করে সে ভাষায় লেখাপড়া শেষ করতে হয়েছিল। ভাষা চর্চা খুব একটা সহজ কাজ নয়, এর জন্যে মৌলিক উপাদানের পাশাপাশি চাই জন্মগত ট্যালেন্ট। এসব অনেক কিছুর ঘাটতি আছে আমার লেখালেখিতে। কেউ না বললেও আমি বুঝতে পারি।

তেল আবিব এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করছি ফ্লাইটের। পেছনে রেখে যাচ্ছি ঝটিকা সফরের অনেক স্মৃতি। সাথে নিয়ে যাচ্ছি এমন অনেক কথা যা জেরুজালেমে বসে বলতে পারিনি নিরাপত্তার কথা ভেবে। সময় করে লেখাগুলো আপডেট করার চেষ্টা করবো। সাথে থাকার জন্যে রইলো অশেষ কৃতজ্ঞতা।

আজ ইহুদিদের Sabbath. এক কথায় অল-আউট হরতাল

ভালই বিপদে পরলাম দেখছি! রাতে ডিনার করিনি ক্ষিধা না থাকায়। এখন হোটেল লবিতে গিয়ে শুনি সব বন্ধ। রোববারের আগে কোন কিছুই খুলবে না। খাওয়ার প্রয়োজন হলে আমাকে পূর্ব জেরুজালেমের মুসলিম সেক্টরে যেতে হবে। চাইলে ওরা ট্যাক্সি ডেকে দেবে। কারণ রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। আজ ইহুদিদের Sabbath। এক কথায় অল-আউট হরতাল।

পশ্চিম বাংলার মতো বন্ধ! এটা এদের ধর্মের নিয়ম। এ সময় কেউ কাজ করেনা। বাইরে বের হয়না।

এ দেশে আর কোনদিন ফেরা হবেনা। ফিরলেও অন্তত হোটেল পছন্দের বেলায় আরও সজাগ থাকবো।

জাবিহুল জোহা : Sabbath অর্থ শনিবার। শনিবারে ইহুদিরা সব কাজ বন্ধ রেখে ডেভিড (AS) এর ‘যাবুর’ পাঠ বা আবৃত্তি শুনতো। তখন থেকে Sabbath চলে আসছে।
.
২৮ শে জুলাই ২০১৯।

কালো সূর্যের কালো রাতে কালো বন্যা

রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের দেশকে বিভক্তির শেষপ্রান্তে টেনে এনেছে সন্দেহ নেই। এই টানাটানির ফল এখন আমদের চোখের সামনে। গোটা দেশ ডুবে আছে পানির নীচে। মরণঘাতী মশার কাছে মানুষ পরাজিত। দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন কোন খবরই না। ছয় মাসের শিশু হতে ৭০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষণের সাথেও আমরা খাপ খাইয়ে নিচ্ছি। কোথাও এমন কোন খবর নেই যা নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে। জীবনের সব সঞ্চয় নিঃশেষ করে পিতা তার সন্তানকে পাঠাচ্ছে বিদেশ। সে ভূমধ্যসাগরে লাশ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। একটু সচ্ছলতার আশায় স্বামী তার স্ত্রীকে পাঠাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। ওখানে ওরা আরব ধনকুবের হাত লাঞ্ছিত, নির্যাতিত, ধর্ষিত হচ্ছে মধ্যযুগের ক্রীতদাসদের মত। এমিড এভ্রিং থিং, আমাদের রাজনীতিবিদের মুখে নির্বিবাদে চলছে মিথ্যাচারের জোয়ার।

ডেঙ্গু নাকি মিথ্যা… তাতেও কি বিরোধীদলের হাত আছে
বন্যার খবর নাকি অতিরঞ্জিত
উন্নয়নের মহাসড়কের কাহিনী নাকি সঠিকভাবে প্রচারিত হচ্ছেনা।

কিন্তু হায়! দিনশেষে একদিনেই নাকি ২৭ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায় শেয়ার মার্কেট হতে। হবে হয়ত এটাও বিরোধী দলের মিথ্যাচার। তবে একজন বিনিয়োগকারী যার ক্ষতি হয়ে গেল, তাকে কি গেলানো যাবে মিথ্যাচারের এ বিষ?

সুশাসনের অভাব এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মানুষ খুন করা হচ্ছে কেবল রাজনৈতিক মতভেদের কারণে। ক্ষমতার ডানায় ভর করে শিশুদের গলা কাটছে। পুলিশ ঘর হতে উঠিয়ে নিচ্ছে মা-বোনদের। মফস্বলের একজন সাংবাদিক আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে জানালেন তাদের অবস্থা। সরকারী দলের কেউ খুন করলে থানা হতে ফোন আসে তাদের কাছে। আসে খবর ছাপালে বাবার নাম মনে করার স্মৃতিশক্তি কেড়ে নেয়ার হুমকি।

ছবিটা দেখুন! কক্সবাজারের চকোরিয়ার এক ইউনিয়ন ছাত্রলীগ কর্মী অস্ত্র উঁচিয়ে নিজের দম্ভ প্রকাশ করেছে ফেইসবুকে। ক্যাপশন ছিল, সাবধান, ডাইরেক্ট একশন হবে। এই একটা ছবিই তুলে ধরে বাংলাদেশের সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক অবস্থা। রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষকে কতটা পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে এই ছবি তার নিষ্ঠুর প্রমাণ। ইউনিয়ন পর্যায়ের ছাত্রের কাছে যদি এ ধরণের অস্ত্র থাকতে পারে, তাহলে আন্দাজ করা যায় আরও উপরের নেতাদের অবস্থা। গোটা দেশ এখন একটা এখন ভাগাড়। জাতি এখানে লাশ হয়ে শুয়ে আছে। ক্ষমতাসীনরা এ লাশ চেটেপুটে খাচ্ছে।

ডেঙ্গু হতে বাঁচতে চান? – তাহলে আগে জবাবদিহিতা চান। জবাবদিহিতা চান? – তাহলে আগে ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করতে শিখুন। আইনের শাসন চান? – তাহলে ছবির এ নেতাকে দিয়েই শুরু করতে বলুন।

মাসাদা এন্ড দ্যা ডেড সী…

মাসাদা এন্ড দ্যা ডেড সী…

আধুনিক প্যালেস্টাইনকে নিজেদের বলে দাবি করতে গিয়ে ইসরায়েলিরা ফিরে যায় তাদের অতীত ইতিহাসে। সে ইতিহাস দুই হাজার বছরের পুরানো। জুডাইজমের উত্থান, বিবর্তন ও পতনের সে কাহিনী রক্তাক্ত নির্মম ও করুণ। হ্যারড ছিলেন অধুনা অনেক রক্ত-খেকো স্বৈরশাসকদের মতই একজন ক্ষমতা-লিপ্সু কিং। যাকেই দরকার তাকেই শিরচ্ছেদ করতেন ক্ষমতার পথ নিষ্কণ্টক ও মসৃণ রাখতে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরাম আয়েশের জন্যে বানাতেন রাজকীয় প্রাসাদ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় জেরিকো শহরের শীতকালীন প্রাসাদ ছিল তাদের অন্যতম।

হিব্রু ভাষায় মাসাদা শব্দের অর্থ strong foundation, বা শক্ত ভিত্তি। ইতিহাসবিদদের মতে জুদাইয়ান মরুর শেষপ্রান্তে প্রায় ১৩০০ ফুট উপরে মাসাদা দুর্গের গোঁড়া পত্তন করেছিলেন জনাথন দ্যা হাই প্রিস্ট হাসমোনিয়ান কিং অ্যালেক্সান্ডার জানেউস। যিনি রাজত্ব করে গেছেন সাল ১০৩ হতে ৭৬ বি সি পর্যন্ত। জেরুজালেমের অনতিদূরে ইন গেদি ও সডমের মাঝামাঝি Dead Sea’র কাছাকাছি মাসাদা দুর্গ এখন ইসরায়েলের ন্যাশনাল হ্যারিটেজ। প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ টুরিস্ট দেখতে আসে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা।

কিং হ্যরড মাসাদাকে বেছে নিয়েছিলেন শত্রুর আক্রমণ হতে নিজকে রক্ষার জন্যে। হ্যারডের মৃত্যু বা অপমৃত্যুর পর জুদেয়ার দখল চলে যায় রোমানদের হাতে। মাসাদার দুর্গকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলে ওরা। ৬৬ এ,ডি’তে শুরু হয় গ্রেট ইহুদি রেভল্ট। ইহুদিরা দখল নেয় মাসাদার। এলেজার বিন ইয়ারিরের নেতৃত্বে একদল ইহুদি রোমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৭০ AD’তে রোমানরা জেরুজালেম শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। পাইকারি-ভাবে হত্যা করে ইহুদিদের। পুরুষদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদেরও ওরা রেহাই দেয়নি। জেরুজালেম যখন জ্বলছে তখন ৯৬০ জন ইহুদি আশ্রয় নেয় মাসাদা দুর্গে। ওখান হতে শুরু করে প্রতিরোধ।

জেরুজালেমের চূড়ান্ত পতন ও ইহুদিদের নির্মূল করার পর রোমানরা চোখে ফেরায় মাসাদার দিকে। জেনারেল ফ্লাভিউস সিলভার নেতৃত্ব ৮০০০ রোমান সৈন্য অবস্থান নেয় মাসাদার চারদিকে। শুরু হয় অবরোধ। মাসের পর মাস চলতে থাকে এই অবরোধ। রোমানদের জানা ছিল পানি আর খাদ্যের অভাবের কারণ ইহুদিরা নেমে আসবে পাহাড় হতে। কিন্তু তা হয়নি। চলতে থাকে প্রতিরোধ। অনন্যোপায় হয়ে রোমানরা নির্মাণ শুরু করে চূড়ায় উঠার পথ। প্রতিরোধকারীরা বুঝতে পারে ঘনিয়ে আসছে তাদের দিন। তাদের নেতা বেন ইয়াইর শেষবারের মত সবাইকে একত্রিত করে পছন্দ দেন, হয় বেঁচে থেকে রোমানদের দাস হও, অথবা আত্মহত্যা করে। ৭৩ AD’র ১৫ই এপ্রিল পতন হয় মাসাদা দুর্গের। জেনারেল সিলভার সৈন্যরা দুর্গের চূড়ায় উঠে দেখতে পায় দুজন মহিলা ও পাঁচজন শিশু ছাড়া বাকি সবাই আত্মহত্যা করেছে। ওরা দখলদারদের দাস হয়ে বেঁচে থাকতে চায়-নি। তাই আত্মহত্যাকেই অধিকতর গৌরবের পথ হিসাবে বেছে নিয়েছে। বিদ্রোহীদের শেষ পরিণতিকে সন্মান জানিয়েছিল রোমানরা।
______________________

প্রায় দুটো দিন ছিলাম হোটেলে বন্দী। গোলান হাইটসে যাওয়ার ইচ্ছাটায় ইতি টানতে হয়েছিল এর দূরত্বের কথা ভেবে। ৪ ঘণ্টার বাস জার্নি। দিনে দুইটা মাত্র বাস যায় ইসরায়েলের উত্তরে সিরিয়া সীমান্তে। একই দিনে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা না থাকায় ঐদিকটা সফরের ইচ্ছা তালিকা হতে বাদ দিতে হল। ছোট কোন শহর অথবা লোকালয়ে রাত কাটানো আমার বিচারে নিরাপদ ছিলনা অনেক কারণে। প্রথমত, যে কোন সময় ঝামেলা ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে এ দেশে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি সৈন্যদের গ্যংষ্টার টাইপ আচরণ। ওরা চাইলেই যে কাউকে খুন করতে পারে। এ অনুমতি তাদের দেয়া আছে। জেরুজালেমের পথেঘাটে অনেক সাধারণ মানুষকে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে দেখেছি। শুট ফার্স্ট, আস্ক কোশ্চেয়েন লেইটার, এটাতে তাদের বৈধতা আছে। আরও একটা দিন হোটেলে বসে অলস সময় কাটানোর ইচ্ছা ছিলনা। অন্য কোথাও যাওয়া যায় কিনা তা পরখ করে রাত ২টার দিকে ঘুম হতে জেগে অনলাইনে অনুসন্ধান শুরু করলাম।

মাসাদা ও ডেড সী! ইসরায়েলি এসে কেউ এ দু’টো জায়গা না দেখে চলে গেছে এমনটা হয়না। আমি ভ্রমণের শুরুতেই ওখানটায় যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রামাল্লায় প্যালেষ্টাইনি গাইড আমাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। জেরিকোর ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ৫ কিলোমিটার ধকল সামলে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। আবু আল নাসের সাবধান করে দিল মাসাদা ও ডেড সী’তে তাপমাত্রা ৫০-৫২’তে উঠানামা করে। সাথে আর্দ্রতা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম গোলান হাইটস যাওয়া হলে ডেড সী’র দিকে যাবনা গরমের কারণে।

শুক্রবার সূর্যাস্তের কয়েক মিনিট আগে শুরু হয়। এবং চলে শনিবার সূর্যাস্তের পর যতক্ষণ না আকাশে তিনটা তারা দেখা যায়। এ সময়টা ইহুদিদের জন্যে Sabbath। ওদের ছুটি। কোন কাজেই হাত দেবেনা। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হতে শুরু করে ট্যুরিজমের অনেক কিছুই বন্ধ থাকে। অনলাইনে মাসাদা ট্যুর টিকেট কিনতে গিয়ে হতাশ হলাম। প্রায় সব ট্যুরেই বিরতি। লম্বা সময় ধরে ঘাঁটাঘাঁটির পর পাওয়া গেল একটা যারা চালিয়ে যাবে তাদের ট্যুর। অতিরিক্ত মূল্য দিতে হল এর জন্যে। সকাল সাড়ে আটটায় ট্যুর বাস আমাকে হোটেল হতে নিয়ে যাবে। ফিরিয়ে দেবে সন্ধ্যার দিকে। ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করতে সকাল ৩টা বেজে গেল। সকাল ১১টায় আমার ম্যান্ডেটরি চেক-আউট। হিসাব করে দেখলাম এখন ঘুমাতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।

খুব সকালে লম্বা মত একটা গোসল দিলাম। রুমেই রুটি ও কফির ব্যবস্থা ছিল। তাই দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। এ যাত্রায় ছবি তোলার জন্যে মোবাইল ফোন বাদে সাথে অন্যকিছু না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লবিতে নেমে আগের দিনের রিসেপশনিষ্টকেই পেলাম। খুলে বললাম আমার অবস্থা, এ মুহূর্তে নতুন কোন হোটেলে গেলে ট্যুর মিস করবো। প্রায় ৩০ মিনিট গুঁতোগুঁতির পর আমার ক্রেডিট কার্ড চাইল। পরিশোধ করে রুমে ফিরে আসলাম। সামান্য ধন্যবাদ দেয়ার যে রীতি তাও পালন করলো না মহিলা। পৃথিবীর কোন দেশেই এমনটা দেখিনি।

আসার কথা সাড়ে আটটায়, অথচ সাড়ে নটার আগে বাসের দেখা মিললো না। কোন কিছুতেই আর অবাক হচ্ছেনা। চমৎকার একটা মিনি বাস। ট্যুরিজমের জন্যে ওয়েল ইকুইপড। গাইড ইয়ায়ারের সাথে পরিচয় হল। আরও পরিচয় হল ফ্রেঞ্চ ম্যান পিয়ের ও কলোম্বিয়ান ফার্ণান্দোর সাথে। ওরাও যাচ্ছে আমার সাথে।


মাসাদার পথে সাময়িক বিরতী।


পাহাড়ের পাদদেশে ডেড সী।

ইসরাইল খুবই ছোট একটা দেশ। তাই এর এক শহর হতে অন্য শহরে যাওয়ার দূরত্ব খুব একটা বেশী না। মাসাদা পৌঁছতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে এমনটাই জানিয়ে দিল ট্যুর গাইড। ট্যুরের বিস্তারিত জানিয়ে ও ড্রাইভারের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে রওয়ানা দিলাম নতুন গন্তব্যে। প্রথমে মাসাদা ও ফেরার পথে ডেড সী।


পাহাড় ও সাগর। ওপারে জর্ডান।

চল্লিশ মিনিট পর বাস হতে বেরুতেই আগুনের গোলার মত চোখে মুখে আঘাত হানল চারদিকের বাতাস। পথে পাহাড়, এক পাশে ডেড সী, আর পাহাড়ের চূড়ায় সেটল্যারদের বাড়িঘর, সব মিলিয়ে সেলুলয়েডের ফিতার মত দৃশ্যপটে ভেসে উঠল চারদিকের প্যানোরমা। মাইলের পর মাইল খেজুর আর জলপাই বাগান। ফাঁকে ফাঁকে বেদুইনদের বস্তি, আঙ্গিনায় ক্লান্ত উটদের নিদ্রা, ডেড সী হতে লবণ তুলে আনার সরঞ্জাম; হুট করেই কেটে গেল সময়টা। মাসাদার পাদদেশে এসে থামার পর আন্দাজ করতে পারলাম এর বিশালতা।

একটা ক্যাবল কার যাচ্ছে উপরে। ওটা ধরতে হবে। গাইড জানিয়ে দিল পানি ছাড়া ওখানটায় যাওয়া হবে আত্মঘাতী। দুই লিটারের একটা বোতল কিনে বগলে চাপিয়ে উঠে বসলাম কেবল কারে। সাবাথ হলেও টুরিস্টদের অভাব দেখলাম না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে ওরা আসছে। ৮০’র দশকের পিটার ও’টুল অভিনীত মাসাদা টিভি সিরিজের কারণে এর পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। মিনিট দশেকের ভেতর পৌঁছে গেলাম চূড়ায়।


মাসাদার চূড়ায়।


পানির অন্য নাম যে জীবন, এখানে না এলে ধারণা করা যাবেনা।

উপর হতে পৃথিবীটা এত সুন্দর দেখায় না দেখলে বুঝা যাবেনা। তিনদিকে জুদিয়ান মরু। সামনে ডেড সী। তার ওপারে জর্ডান। হঠাৎ করে পেরুর মাচুপিচুর কথা মনে পরে গেল। ২০০২ সালে দেখ পেরুর ঐ পাহাড় ছিল কাব্যময়। হাতের কাছে মেঘমালার ঘোরাফেরা। পাহাড়ে সবুজের সমাহার। এখানটায় ঠিক উলটো। তাতানো মরু আবহাওয়া। মাথার উপর জ্বলন্ত চুলার মত সূর্য। কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই। যতদূর চোখ যায় পাহাড় আর পাহাড়। নগ্ন এবং ক্ষমাহীন। একবার কেউ পথ হারালে মৃত্যু তার অবধারিত।

ইতিহাসের কোন পাতাই উলটানো বাকি রাখল না আমাদের গাইড। জুদাইজম ও এ মাটিতে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক মালিকানা তত্ত্বও বাদ গেলনা। সন্দেহ নেই দুই হাজার বছর আগে এ মাটিতে ইহুদি রাজত্ব ছিল। কিন্তু অনেক সভ্যতার মত সেটাও ধ্বংস হয়েছিল, যাতে মুসলমানদের কোন হাত ছিলনা। এ মুহূর্তে মাসাদায় হরেক রকম মানুষ একত্রিত হয়েছে, অথচ নেই একজন প্যালেষ্টাইনি। ওরা দেয়ালের ওপাশে বন্দী। রোমানরা যেভাবে ইহুদিদের দাস বানিয়েছিল, একই কায়দায় ইহুদিরাও আজকে প্যালেষ্টাইনি মুসলমানদের দাস বানাতে চাইছে। এ সত্য ও বাস্তবতাটা এক মুহূর্তের জন্যে মাথা হতে দূর করতে পারলাম না।

ক্যাবল কার ধরে ঘণ্টা দুয়েক পর নেমে আসলাম মাসাদার চূড়া হতে। পাহাড়ের গোড়াতেই বাফে। ৭০ স্যাকেল খরচ করে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। সাথে অতিরিক্ত দু’বোতল কোন নিলাম পরবর্তী গন্তব্য ডেড সী বীচের জন্যে। ওখানে আরও গরম। প্রচণ্ড অসহনীয় গরম। ডেড সী – সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৪৫০ মিটার নীচে। পৃথিবীর সর্বনীচু স্থান।

.
জেরুজালেম। ২৭শে জুলাই, ২০১৯।

দুই ধর্ম, দুই দৃশ্যপট: জেরুজালেমের গল্প

পুরানো জেরুজালেমের মুসলিম কোয়ার্টার ছেড়ে আজ নতুন জেরুজালেমের ইহুদি এলাকায় আসতে হল। আল হাশেমি নামের যে হোটেলটায় এতদিন ছিলাম তাতে আমার জন্যে খালি রুম পাওয়া যায়নি। গন্তব্যের অনিশ্চয়তার কারণে একরাতের বেশি কোথাও হোটেল বুক করিনা। যদিও একরাতের কথা বলে ঢুকি এবং পরেরদিন তা নবায়ন করি। এভাবেই চলছিল। আজ সকালে কাউন্টারে যেতেই পেলাম খবরটা। হোটেল বুকড! রিসিপশনিষ্ট সাজেষ্ট করলো পাশের আল-আরাবি হোটেলে খোঁজ নিতে। লাগেজ গুটিয়ে লবিতে রেখে গেলাম পাশেরটায়। সকাল বাজে প্রায় ১০টা। লবির টেবিলে লম্বা হয়ে কেউ একজন ঘুমাচ্ছে। জোরে কাশি দিলাম। তাতেও কাজ হলো না। অচেনা ঘুমন্ত কাউকে ডেকে উঠানো কোন সংস্কৃতিতেই ভাল উদাহরণ না। ইসরায়েলি এসেছি নিজকে ভাল নাগরিক হিসাবে তুলে ধরতে। তাই ফিরে এলাম। আধাঘণ্টা পর ফিরে গিয়ে দেখি একই অবস্থা। এদিকে চেক আউটের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত আল হাশেমিতে ফিরে অনলাইনে খুঁজতে থাকলাম নতুন কোন হোটেল। জেরুজালেমের রাস্তাঘাট আমি চিনি না, তাই কোন হোটেল কোথায় অবস্থিত তার কোন হদিস করতে পারলাম না। সময় নেই, তাই সস্তা যেটা পেলাম সেটাই বুক করলাম। চেক-ইন সময় দুপুর ৩টা। হাতে অনেক সময়। সবাই যা করে তাই করলাম। লাগেজ গুলো আল হাশেমির স্টোরে রেখে বেরিয়ে পরলাম। আজ আর মুসলিম কোয়ার্টারে ঘোরাফেরার ইচ্ছা ছিলনা, রওয়ানা দিলাম ইহুদি কোয়ার্টারের দিকে। ওদিকটায় না ঘুরলে জেরুজালেম শহর দেখা সম্পূর্ণ হবেনা।

অনেকটা চাঁদের অন্য-পীঠের মতই পুরানো জেরুজালেমের ইহুদি কোয়ার্টার। মুসলিম এলাকা হতে হাঁটা শুরু করলে কখন যে সীমানা অতিক্রম করা হয় তা চারদিক না তাকালে বুঝার উপায় নেই। হঠাৎ করেই বদলে যায় সবকিছু। লম্বা আলখাল্লা পরিহিত আরব পুরুষদের জায়গা করে নেয় নানান জাতির ইহুদিরা। এক্সট্রিম পশ্চিম ইউরোপিয়ান সাদা, সেন্ট্রাল এশিয়ার বাদামি, আফ্রিকার কালা, পূর্ব ইউরোপের অসুখী সাদা, সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বের ইহুদিদের পাওয়া যায় পশ্চিম দেয়ালের কাছে। ওদের অন্যতম পবিত্র স্থান হচ্ছে এই দেয়াল। তবে মুসলিম কোয়ার্টারের সাথে পার্থক্যটা ধরতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়না। এ কোয়ার্টারে আরব মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন তার ছিটেফোঁটাও নেই। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, অথচ কেউ কথা বলছেনা। আরবদের মত অচেনা কাউকে সালাম দিচ্ছেনা। রুশ ইহুদিদের দেখলে মনে হবে ওরা তেড়ে আসবে। এখুনি জিজ্ঞেস করবে, – ইয়ব তোবায়ো মাত, পচিমু তি জদিয়েছ?
এ কোয়ার্টারের রাস্তায় নিজকে অপাক্তেয় মনে হলো। অনেকেই সন্দেহের চোখে চাইছে। আমি চোখে চোখ রাখা হতে বিরত থাকার চেষ্টা করলাম।

দুদিকের দোকানপাটেও পরিবর্তন চোখে পরার মত। সবকিছুতে ধর্মের প্রতিফলন। টুপি, হনুকা সাইন, বিভিন্ন সুগন্ধি যা হতে বেরিয়ে আসছে কটু গন্ধ। আরবদের মত গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে চীৎকার করছেনা। এক কথায় সব আছে, শুধু নেই চাঞ্চল্য, নেই উচ্ছ্বাস, নেই জীবন নিয়ে উচ্ছলতা। ওদের প্রতিটা সিনেগগে ঢু মারলাম। রাবাইদের সাথে ভালমন্দ কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও কোন রেসপন্স পেলাম না। সবাই কেমন নির্লিপ্ত। চোখের ভাষায় একটাই যেন জিজ্ঞাসা, তুমি এখানে কেন! বেশকিছু ছবি তুললাম। দুয়েকটা স্যুভেনির কিনলাম। অচেনা কাউকে থামিয়ে ছবি তুলে দেয়ার যে অভ্যাসটা মুসলিম কোয়ার্টারে প্রাকটিস করেছি এখানে তেমনটা করতে উৎসাহ পেলাম না।

মন কিছুটা হলেও বিষণ্ণ হয়ে গেল পুরানো জেরুজালেম ছেড়ে আসতে। অনেক কিছুই মিস করবো। রাস্তার হৈ-হোল্লা, দোকানীদের চীৎকার, উঁচু আওয়াজের আরবি গান, মধুর সুরের কোরান তেলাওয়াত। বিশেষ করে মিস করবো সকালের আজান। এই পরিবেশ এই কোলাহল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও নস্টালজিক বানিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা ঢাকায়।

নতুন হোটেলটা নতুন শহরের খুব চকচকে একটা জায়গায়। দেখলেই বুঝা যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনে ততটা অনিশ্চয়তা নেই যতটা দেখেছি পূর্ব জেরুজালেমে অথবা পশ্চিম তীরের রামাল্লায়। হোটেলের মূল ফটকেই মেটাল ডিটেক্টর। অনেকটা এয়ারপোর্টের লাগেজ চেকিং’এর মত। লাস্যময়ী এক তরুণী দাঁড়িয়ে মনিটর করছে সবকিছু। ভদ্রতার হাসি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলাম। উত্তরে কিছুই বললো না। আমিও আর কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলাম না। কাউন্টারে একই অবস্থা। হোটেল ব্যবসার চিরাচরিত আপ্যায়ন একেবারেই অনুপস্থিত। কাগজপত্র দেখার আগেই জানিয়ে দিল, চেক-ইন’এর এখনো আড়াই ঘণ্টা বাকি। কথা যা বলার তখনি বলবে।

বিশাল একটা লবি। আধুনিক সুবিধাদির সুখময় সমাহার। আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আশপাশের মানুষদের। ভুলে যেতে চাইলাম ওদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত আমি। না চাইলেও আমার মার্কিন পরিচয়টা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। বলতে ইচ্ছা করলো…হতে পারি আমি জন্মগত মুসলিম, আমাকে তোমরা অপছন্দ করতে পার, কিন্তু ভুলে যেওনা আমার ট্যাক্সের টাকায়ই তোমাদের লালন করা হয়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে আমার দেশই তোমাদের নিরাপত্তা দেয়। যদি ঘৃণা করতে চাও, তাহলে প্রথমে আমার ট্যাক্সের টাকাকে ঘৃণা কর।

চারদিকে অদ্ভুত সব সুন্দরীদের চলাফেরা। ওরা হিব্রু ভাষায় নিজেদের ভেতর কি বলছে বুঝতে পারছিনা। কারও কারও কোমরে দুই দুইটা পিস্তল। আসলে জীবন কোথাও থেমে থাকেনা। ওরা যেমন নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে স্বাভাবিক জীবন যাপন নিশ্চিত করতে চাইছে, তেমনি মুসলমানরাও নিজেদের শিক্ষা সংস্কৃতি বজায় রেখে চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। আমরা বাইরের মানুষরা সব সময়ই চাইবো শান্তি আসুক এ ভূমিতে। মিলেমিশে বেড়ে উঠুক ওদের শিশুরা। অনিশ্চয়তার বেড়াজাল হতে বেরিয়ে নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হোক।

জেরুজালেম। ২৬শে জুলাই।

উই উইল ওভারকাম সাম ডে….

লাগেজ গুটিয়ে বের হতে হচ্ছে। স্যুটকেসটা রেখে যাবো হোটেলের লবিতে। কথা দিয়েছে ফিরে না আসা পর্যন্ত ওরা আগলে রাখবে। দামাস্কাস গেইট হতে রামাল্লার বাস ধরবো। এবং প্রবেশ করবো প্যালেষ্টাইনের মূল ভুখণ্ডে। এক ঘণ্টার বাস জার্নি। চেক পয়েন্ট পার হতেই যত ঝামেলা। অবশ্য একজন মার্কিন নাগরিক হিসাবে তেমন কোন অসুবিধা আশা করছিনা।

পশ্চিম তীরের রামাল্লা, জেরিকো অথবা বেথেলহেমে না ঢুকলে গোটা ইসরাইয়েল সফরটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। আলোর নীচেই অন্ধকারের বাস, আমাদের ইউনিভার্সটা নিজের কক্ষপথে আপন নিয়মেই আবর্তিত হয়। মেনে চলেই বরণ করে নেয় এ বাস্তবতা। কিন্তু প্যালেষ্টাইনিদের ভাগ্য তাদের নিজেদের বরণ করতে হয়েনি, বরং জাতিসংঘ নামক ঠুঁটো জগন্নাথ ও পশ্চিমা দুনিয়ার বন্দুকের নল তা চাপিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের হাতে নির্যাতিত ইহুদিদের সেইফ হ্যাভেন হিসাবে প্যালেষ্টাইনকে বেছে নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন সরকার। অযুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়েছিল ধর্মীয় উপকথা। কোন এক রৌদ্রজ্বল সকালে ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙ্গে আঙ্গিনায় অচেনা মানুষের ভীড়ে। সেই যে শুরু তা আর শেষ হয়নি। কালের চক্রে বদলে গেছে অবাক হওয়ার পালা। এখন ইউরোপীয় উদ্বাস্তূরা অবাক হয়ে তাদের আঙ্গিনায় ফিলিস্তিনিদের দেখে। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় কুকুরের মত।

আবু আল নাসেরের সাথে পরিচয় রামাল্লার বাসস্ট্যান্ডে। জেরুজালেম হতে ছেড়ে আসা বাসটা থেমেছে কেবল। সাথের ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কোথা হতে শুরু করা যায় ভাবছি। অচেনা জায়গায় এর আগেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কোথাও থমকে যাইনি। তালিকার প্রথমেই ছিল চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের কবর ও যাদুঘর। তারপর বর্তমান প্যালেষ্টাইন সরকারের হেডকোয়ার্টার। আবু নাসের এমন একজনের সন্ধানেই রাস্তায় ঘুর ঘুর করছিল। স্থায়ী পেশা বলতে কিছু নেই। যখন যা পায় তাই আকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। ট্যুরিষ্টদের গাইড হিসাবে কাজ করাও তার পেশা্র অংশ। চালানোর মত ৫/৬টা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। ইংরেজি তার অন্যতম। আমার সামনেই স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ও রুশ ভাষায় অনেকের সাথে কথা বললো। ইমপ্রেসড না হয়ে উপায় নেই। প্রস্তাবটা নিজেই দিল; পাঁয়ে হেটে রামাল্লা শহর দেখ। দরাদরি শেষে ৮০ সেকল (ইসরায়েলী মুদ্রা) ঠিক হল। এছাড়া ভাল কোন উপায় ছিলনা শহরটা দেখার। চেয়ারম্যান আরাফাতের কবরস্থান শেষ করে মাহমুদ আব্বাসের অফিসে অপেক্ষা করছি। ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করল নাসের।

থাকে উদ্বাস্তু শিবিরে। ৬ ছেলেমেয়ে। স্ত্রী কঠিন রোগে আক্রান্ত। ভাল চিকিৎসা দূরে থাক, টেবিলে তিন বেলা খাবার যোগাতে তার কষ্ট হয়। আয়-রোজগার বলতে যা হয় তার অর্ধেকটাই চলে যায় স্ত্রীর চিকিৎসায়। প্রতিবেশী দেশ মিশর হতে গোপনে স্মাগল করে আনতে হয় তার ঔষধ। অথচ প্যালেষ্টাইনকে আলাদা করার দেয়াল উঠানোর আগে ভালই কাটছিল তার জীবন। কাজের সন্ধানে প্রায়ই চলে যেত জেরুজালেম, তেল আবিব অথবা হাইফায়। ওসব জায়গায় কাজের অভাব নেই। দেয়াল সম্পূর্ণ হওয়ার পর তার মত হাজার হাজার ফিলস্তিনির জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। অনোন্যপায় হয়ে একরাতে দেয়াল টপকে ওপারে চলে যায়। এভাবে নিয়মিত টপকাতে থাকে। যদিও জানা ছিল ধরা পরলে নির্ঘাত জেল। এবং একদিন ধরা পরে। ইসিরায়েলি সৈন্যদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কোন রকমে পালিয়ে জান বাঁচায়। কিন্তু তা বেশি দিনের জন্যে না।

এক রাতে সৈন্যদের বুটের আঘাতে এলোমেলো হয়ে যায় তার দরজা। পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করেই ওরা অপারেশনে নেমেছে। গ্রেফতারে বাধা দেয়নি আবু নাসের। তার মতে এমন কোন ফিলিস্তিনি পুরুষ নেই যে জেল খাটেনি। তাদের বয়সের পুরুষদের জন্যে অনেকটা বাধ্যতামূলক এ জেলটার্ম। ওরা জানে এটাই তাদের ভাগ্য।

জেলখানায় হার্ট এট্যাকের কারণে মুক্তি দেয় আবু নাসেরকে। একজন ফিলিস্তিনির চিকিৎসা মানে সরকারের অতিরিক্ত খরচ। তাই কোন এক সুন্দর সকালে দেয়ালের ওপারে এনে লাথি মেরে ফেলে দেয় ট্রাক হতে। বন্ধ হয়ে যায় তার আয় রোজগারের সব পথ। যেহেতু পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে তাই বৈধভাবে ইসরায়েলে প্রবেশ করার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে তার জন্যে।

দৃশ্যত কোন কাজই নেই আবু নাসেরের মত লাখ লাখ ফিলিস্তিনিদের জন্যে। ওরা দরিদ্র হতে স্থায়ী দারিদ্রের খাতায় নাম লেখায়। একবেলা খেলে দু’বেলা ঊপোস করে। নিজের বাড়িঘর ত্যাগ করে নাম লেখায় উদ্বাস্তূ শিবিরে। মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আবু নাসের আমাকে নিয়ে যায় তার নিজস্ব শিবিরে। প্রায় কান্নাভেজা চোখে ঠোঁট কামড়ে বলল, – দেখে যাও মানুষ নামের কিছু সবজি।

রিফিউজি ক্যাম্প মানেই অস্থায়ী কোন তাবু নয়। দেখতে স্বাভাবিক দালান-কোঠার মত। কিন্তু রানিং ওয়াটার বলতে কিছু নেই, বিদ্যুৎ আসে আর যায়। বাড়িঘর শ্রীহীন, দারিদ্রের ছোঁয়া সব জায়গায়। আবু নাসেরের একটাই ক্ষোভ, আমার নিজঘরে আজ আমি উদ্বাস্তু। একজন অর্থডক্স ইহুদির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে রাগে ক্ষোভে বলে ফেলল, – এই ভিনদেশী দখলদাররা এখন আমার অন্নদাতা। তাদের দয়া দাক্ষিণ্যের উপর বেঁচে থাকি আমরা। অথচ পাহাড়ের উপর যে অলিভ গাছগুলো দেখছো একসময় আমাদের ছিল।

রামাল্লার পর জেরিকো নামের একটা শহরের দিকে রওয়ানা দেই আমরা। বাস বসে চারদিক দেখাচ্ছে আমাকে। পাহাড়ের চূড়ায় অনেকগুলো বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে যা ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘরের সাথে কেমন যেন বেমানান। আবু নাসের হর হর করে বলে গেল ঐ বাড়িঘরের ইতিহাস। ওগুলোই নাকি গুই সাপের মত দখল করছে ইহুদিরা। ওরা সুঁই হয়ে ঢুকে ফিলিস্তিনিদের এলাকায় এবং কিছুদিনের মধ্যে পরিণত হয় বিশাল এক সাপে। কোন এক সুন্দর সকালে ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙ্গে কাছের ভূমিতে নতুন কিছু মানুষের পদচারণায়। ওরা বুঝতে পারে নতুন কোন বসতভুমি স্থাপন করতে যাচ্ছে স্যাটেলাররা। প্রথমে তাঁবুর মত কিছু একটা খাটায়, অথবা নিয়ে আসে নড়বড়ে একটা কনস্ট্রাকশন ট্রেইলার। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, আমরা ভূমির জরীপ করতে এসেছি। খণিজ পদার্থ লুকিয়ে আছে এখানে। তারই সন্ধান করবো। ফিলিস্তিনিরা জানে এ মিথ্যে।

কিছুদিন পর শুরু হয় নির্মাণ কাজ। তা বাড়তে বাড়তে রূপ নেয় মেগা প্রজেক্টে। ওরা আসে পূর্ব ইউরোপের রাশিয়া, ইউক্রেইন, রুমানিয়ার মত দেশ হতে। আচার ব্যবহারে একেবারেই কুৎসিত এবং দু’দিন না যেতে ওখানে হাজির হয় বেদুইনরা। বেদুইনরা নাকি ইসিরায়েলিদের বিশ্বস্ত বডিগার্ড। আপন মা-বাবা, ভাই-বোনদের চাইতেও নাকি এরা বেশী বিশ্বস্ত। পশ্চিম তীরের গেরিলা বাহিনীর যে সব সদস্যদের মোসাদ বাহিনী রাতের অন্ধকারে হত্যা করে তার পেছনেও নাকি থাকে বেদুইনদের হাত। অনেকটা বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, – তোমাদের রেজিসটেন্ট পাওয়ার কি তাহলে মরে গেছে? কোথাও কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ দেখছিনা! আবু নাসের চোখ মুখ লাল হয়ে গেল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে শুরু করল অনেকটা বিষাক্ত সাপের মত। আমি বললাম, ছোট ছোটে শিশুদের বুকে আত্মঘাতী বোমা বেধে তোমরা যা করেছ তাতে পশ্চিম দুনিয়ার সমর্থন হারিয়েছ। তাদের মত আমিও এ হত্যার সমর্থক নই। কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিল আবু নাসের।

প্রতিটা ফিলিস্তিনি পরিবারে এখন হতাশা। এক কথায় নিজদেশে বন্দী। ঘরে ঘরে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, আর ভবিষৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, না পাওয়ার হাহাকার। এ সুযোগটাই নাকি নেয় সৌদি আরবের ধনী শেখরা। অর্থ আসে মিশর সীমান্ত দিয়ে। প্রতিটা আত্মঘাতী শিশুর জন্যে বরাদ্দ থাকে পাঁচ হাজার ডলার। স্বপ্নহীন অনেক শিশু পরিবারের কথা ভেবে যোগ দেয় সৌদিদের এ মিশনে। ওরা মরে গিয়ে নিশ্চিত করে পরিবারের বেঁচে থাকা। আবু নাসেরের মতে, এ মুহূর্তে তাদের মুল সমস্যা ইসরায়েলিরা না, বরং সৌদি ও আমিরাতী ধনকুবের দল। ওরা আমুদ আহলাদের বিপদজনক খেলা খেলতে আসে প্যালেষ্টাইনের মাটিতে। ইচ্ছা করে বাতাস ভারী করে তোলে। সুযোগ করে দেয় ইসরায়েলিদের এখানে ঢুকার। অস্থির করে ফেলে তেলের বাজার। ওখান হতে কামিয়ে নেয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আবু নাসেরের মতে শেখরা এখন আর আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে যায়না নিজেদের যৌনলিপ্সা চরিতার্থ করতে। ওদের বর্তমান টার্গেট ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফা শহর। রুশ মহিলারা এখন তাদের প্লেটের খাবার। অনেকে এসে রুশ পতিতাদের মাথায় ডলারের বৃষ্টি নামায়।

আবু নাসের গড় গড় করে বলে গেল সৌদি আরবে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর অনেক দেশের গৃহকর্মীদের কথা। বাড়ির কর্তা তার ভাই, বাবা, চাচা এমনকি আপন সন্তান নিয়ে নাকি ভোগ করে এসব গরীব মহিলাদের। মনুষ্যত্বের ন্যূন্যতম লেশ মাত্র দেখায় না। সৌদি আর আমিরাতীদের কাছ জীবন মানেই অর্থ, নারী আর মদ।

বেথেলহেম পর্যন্ত আসতে সূর্য ডোবা শুরু হয়ে গেল। জেরিকোর ৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় ৫ কিলোমিটার হাঁটায় আমি ছিলাম ক্লান্ত। কিন্তু শেষ বিকেলে বেথেলহেমের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস দূর করে দিল সে ক্লান্তি। আমাকে জেরুজালেমগামী বাসে উঠিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল যে পর্যন্ত না বাসটা ছেড়ে যায়। খোলা জানালার সামনে এসে আবারও কথা বলতে শুরু করল… ব্রাদার, আমাদের প্রতিটা শিশু পর্যন্ত বিশ্বাস করে we’ll overcome someday… আমাদের মত তোমরাও বিশ্বাস রেখ এ অন্যায় একদিন দুর হবে… আমরা স্বাধীন হব… তোমার মত আমিও দেয়াল পেরিয়ে জেরুজালেমের ওপারে যেতে পারবো। সেদিন আবার ফিরে এসো এ পবিত্র মাটিতে… আমরা অলিভ ব্রাঞ্চ দিয়ে তোমাকে বরণ করে নেব।

ছেড়ে দিল বাসটা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। শেষ বাঁকটায় এসে লক্ষ্য করলাম তখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আবু নাসের।

আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত লইয়াছেন


শেষপর্যন্ত পরওয়ারদিগারের সাথে হোসেন মোহম্মদ এরশাদের দেখা হইল। কুশল বিনিময়ের পর সৃষ্টিকর্তা বলিলেন…..
– রে এরশাদ, তোর খেরো খাতা খুলিয়া আমি একটা সত্য আবিস্কার করিতে সক্ষম হইইয়াছি। মনে হইতেসে তোর প্রতি আমি অবিচারই করিয়াছি।
– উহা কি, সর্বশক্তিমান?
– তোর পাওনা ১০০ ইচ্ছার মধ্যে ইতিমধ্যে ৯৯টা ইচ্ছা আমি পূরণ করিয়াছি। ১টা ইচ্ছা এখনো বাকি। রে নাদান, ইচ্ছা প্রকাশ কর। আমি নিশ্চয় পূরণ করিব। বান্দার সুখই যে আমার সুখ।
– হে পরওয়ারদিগার, খুবই পুলকিত বোধ করিতেছি। মনে হইতেছে আবেদন জানাইয়া ফিরিয়া যাই প্রেসিডেন্ট টাওয়ারের সেই বাসাটায়। তবে এমন আবেদন আমি পেশ করিতে চাহিনা। কারণ এইখানেই অনেক হুরপরীর সাথে আমার কথা হইয়াছে। বিশেষ বুঝাপরা হইয়াছে। তাই ঐপারে ফিরিয়া যাওয়ার আর কোন ইচ্ছা নাই। আপনি সর্বশক্তিমান, চাইলে সবই পারেন। শেষ ইচ্ছাটা আমি জগত ভ্রমণ শেষে তিনি যখন এইপারে আসিবেন তখনই পেশ করিব।
– ইহার হেতু কিরে ফকিরের বাদশা?
– আছে রাব্বুল আলামিন, আছে।

হঠাৎ করিয়া ফেরেশতাদের একজন আগাইয়া আসিয়া সৃষ্টিকর্তার কানে কি যেন একটা বলিলেন। সর্বশক্তিমান রাগান্বিত হইলেন। উনাকে চিন্তিত দেখাইল। অবশেষে তিনি আবার মুখ খুলিলেন।
– এইমাত্র আমার ইনফরমেশন মন্ত্রী মারফত জানিতে পারিলাম তোর শেষ খায়েশ। তুই অপেক্ষায় আছস মিডনাইট ড্রামাকুইনের। এইখানে এই অনন্তকালেও তুই আশায় আছস তিনি আসিয়া মিডনাইট ক্যু করিয়া আমাকে সরাইয়া দিবেন। এবং তুই তেনার ক্ষমতার রুটি-হালুয়া খাবি।
– আপনি সর্বজান্তা পরওয়ারদিগার। কি করিব বলেন, রুটি-হালুয়া একবার খাইলে বার বার খাইতে ইচ্ছা করে যে! আর আমি জানি এই অবিনশ্বর দুনিয়ায় আসিয়া তিনি নিশ্চয় আপনাকে ক্ষমতাচ্যুত করিবেন। তেনার পিতাকে মুক্ত করিবেন। এবং তেনাকে যাহারা দোজখে হাবিয়ায় পাঠাইছেন তাহাদের সবাইকে বিচারের মুখোমুখি করিবেন।
– রে পাপিষ্ঠ, তেনারও একটা খায়েশ বাকি আছিল। সেইটা আজ পেশ হইয়াছে এবং আমি তা পূরণ করিয়া দিয়াছি।
– সুবহানাল্লাহ! কি সেই খায়েস রাব্বুল আলামিন?
– এইপারে তিনি আমার প্রতিবেশির রাজ্যে অনন্তকাল কাটাইবার খায়েশ করিয়াছেন। নরেন না খগেন মোদি, তিনিই হইবেন তেনার রুম-মেট। আমারে ক্ষমতাচ্যুত করার আর কোন রাস্তা খোলা নাই।

এরশাদকে চিন্তিত দেখাইল। মনোবাসনা ব্যর্থ হইবে এই ভাবিয়া তিনি হতাশ হইলেন।
– সে সর্বশক্তিমান, আপনার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। আর আপনি যদি তেনার গায়েবি বিচার করিতে চাহেন আমি হইব বিচারের রাজস্বাক্ষী। অনেক কিছু বলিবার আছে। ক্ষমতার আশা যখন তিরোহিত হইয়াছে তখন ভেতরের কথা ভেতরে রাখিয়া লাভ নাই।
তবে যাইবার আগে একটা কারণে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানাইলেই নহে।
– সেইটা কি-রে নাদান?
– ছাত্রলীগের মতিগতি সময়মত ঠাণ্ডা করিয়ে দিবার জন্যে ১৬ কুটি মানুষের পক্ষ হইতে আপনাকে মোবারকবাদ জানাই। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত লইয়াছেন।
– রে এরশাদ, তোর অবগতির জন্য জানাইতেছি। ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রলীগ না। তাহাদের আমি এডিস মশায় রূপান্তরিত করিয়াছি। ডেঙ্গুর সিরোমে শক্তিশালী করিয়া রোহিঙ্গাদের চাইতেও দ্রুত প্রজননের ক্ষমতা দিয়াছি। তোর কৃতজ্ঞতা গ্রহন করিতে আমি অক্ষম!

এরশাদ ভাবনায় পরিয়া গেল। এডিস কাহাকে আগে কামড়াইবে, রওশন না বিদিশাকে, এই ভাবিয়া চিন্তিত হইয়া পরিল।

ব্রেকফাস্ট ইন জেরুজালেম, ইসরায়েল

ব্রেকফাস্ট ইন জেরুজালেম।
কেবল জেরুজালেম কেন, গোটা ইসরায়েলই জীবনযাত্রা খুব কস্টলি। এখানে আসার আগে অনলাইনে হোটেল খুঁজতে গিয়ে তার ধারণা পেয়েছি। একটু ভাল হোটেলে থাকতে গেলে দৈনিক ১৫০ হতে ২০০ ডলার পে করতে হয়। অবশ্য অনেক হোস্টেল আছে নাম মাত্র মূল্যে। কিন্তু আমার মত প্রথমবার ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্যে ওগুলো নিরাপদ নয়। তবে এখন পর্যন্ত এমন কাউকে দেখিনি বা মোকাবেলা করিনি যার দরুন এ দেশে চলাফেরায় নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ করা যাবে। বিশেষকরে পশ্চিম তীরের আরব প্যালেষ্টাইনিরা খুবই ফ্রেন্ডলি। পথ খুঁজতে তাদের সাহায্য চাইলে কেবল দু’হাত না, বরং বুক বাড়িয়ে এগিয়ে আসে।

ব্রেকফাস্টের জন্য গতকাল দামাস্ক গেইট পেরিয়ে জেরুজালেমের ওপাশে গিয়েছিলাম। রাতে কিছু খাইনি। পেটের তাগাদাটা ছিল অনেকটা অ্যাম্বুলেন্সের জরুরি সিগন্যালের মত। চত্বরের গোড়াতেই মিলল হোটেলটা। দেখতে অনেকটা মগবাজার মোড়ের ব্যস্ত হোটেলের মত। ঘড়িতে ঠিক কটা বাজে তা নির্ধারণ করার উপায় ছিলনা। আমার স্মার্ট ফোনে তখনও নিউ মেক্সিকোর টাইম। মেনু আরবী ও হিব্রু ভাষায়। বুঝার উপায় নেই। তেল আবিবের মত এখানেও মেনুর ছবির সাহায্য নিলাম। ডিমের অমলেটের সাথে লবনাক্ত শসা ও জলপাই। সাথে তাদের ট্রাডিশনাল রুটি। এ পর্যন্ত এ রুটি খাওয়ার প্রক্রিয়া আবিস্কার করতে পারিনি। তবে তা করার ইচ্ছাটা তব সময়ই ছিল। পাশের টেবিলে একটা আরব পরিবার প্রায় একই রকম খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল। চোখটা ওদিকেই খোলা রাখলাম। রহস্যটা আবিস্কার করতে সময় লাগল না। রুটির ভেতরটা খোলা। এবং শসা ও জলপাইয়ের ওখানে ঢুকিয়ে অনেকটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে হয়। এবং রুটির কোন লিমিট নেই। যত খাওয়া যায়!

সকালের কফিটা খাওয়া হয়নি। তাই ওয়েটারকে প্রথমে কফিটা দিতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু তা সে করতে গেলনা। অনেকটা শুনেও না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়ে গেল। সময় মত নাস্তা এলো। ডিমের ওমলেট। খেতে বেশ সুস্বাদু। খাবার অপচয়ের অভ্যাসটা আরবদের বোধহয় জন্মগত। একজনের পক্ষে সকালের নাস্তা এতটা খাওয়া কি করে সম্ভব তার অংক মেলাতে পারলাম না। খাবার শেষের দিকে কফি দিয়ে গেল। প্রথম চুমুকে মুখ বিকৃত করে টেবিলের নীচে লুকানোর চেষ্টা করলাম। মানুষের পক্ষে এ ধরণের কফি খাওয়া সম্ভব বুঝতে পারলাম না। মনে হল এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ সহ হরেক রকম হার্ব রীতিমত রান্না করে এনেছে। সাথে চিনির নামগন্ধ নেই। হতাশাটা লুকানোর চেষ্টা করলাম না। ওয়াটারকে চিনি দিতে অনুরোধ করলাম। চিনিতে কাজ না হওয়ায় বিরক্ত মনে বেরিয়ে এলাম। বলাই বাহুল্য নাস্তাটা খুব একটা সস্তা ছিলনা।

রাস্তায় বেরুতেই দেখলাম ইতিমধ্যে বদলে গেছে জেরুজালেমের চেহারা। মানুষ কিলবিল করছে। পাশের বাস ষ্টেশনটা লোকে লোকারণ্য। পর্যটকরাও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। দামাস্ক গেইট পেরিয়ে পূর্ব জেরুজালেমের আরব সেক্টরে প্রবেশ করতেই জীবনের স্পন্দন পেতে সময় লাগলো না। দোকানীদের দল পসরা সাজাচ্ছে। এক ইঞ্জিনের ছোট ছোট ট্রাকগুলো মালামাল নিয়ে সরু গলিতে ঢুকে পরছে। ওরা সবাই কথা বলছে। এবং উচ্চস্বরে। উঁচু গলায় কথা বলা আরবদের বোধহয় জন্মগত অভ্যাস। বিরক্তবোধ না করলে খারাপ লাগে না। অন্তত জীবন বলতে যে একটা চলমান গাড়ি আছে তা টের পাওয়া যায়।

হোটেলে ঢুকতেই রিসেপশন ডেস্কের মহিলা জিজ্ঞেস করল নাস্তা খেয়েছি কিনা। হ্যাঁ বলতে একটু অবাক হল। বলল, আমি তো তোমাকে ব্রেকফাস্ট রুমে যেতে দেখিনি! ব্রেকফাস্ট রুম! আকাশ হতে পড়লাম। আঙ্গুল উচিয়ে ইঙ্গিত করল গ্রাউণ্ড ফ্লোরের দিকে। ওখানে একটা এরো সাইন সহ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে; BREAKFAST ROOM। এবং তা ফ্রী।

.
২৫শে জুলাই। পূর্ব জেরুজালেম। ইসরায়েল।

সংখ্যাগুরুদের উপর সংখ্যালঘুর অত্যাচার! ইতিহাস হতে নেয়া

সংখ্যাগুরুদের উপর সংখ্যালঘুর অত্যাচার! ইতিহাস হতে নেয়া…

প্রিয়া সাহার কাছে আমি বিভিন্ন কারণে কৃতজ্ঞ। দেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের বিরুদ্ধে লেখালেখি দিয়েই আমার ওয়াচডগি শুরু হয়েছিল। সাল ফাল মনে নেই। পুরানা পল্টনে বোনের বাসায় থাকি, চাকরি করি ধানমন্ডি নতুন ২ নাম্বার রাস্তায়, সোবহানবাগ মসজিদটার পাশে। চাকরি করতে গিয়ে আবিস্কার করি কর্পোরেট দুনিয়ায় আমার ইংরেজী জ্ঞান যথেষ্ট নয়। শুরু হয় ইংরেজী শিক্ষার শাটল মিশন। ভর্তি হই নটেরডেম কলেজের ইংরেজী শর্ট কোর্সে। বাসা হতে তালাক দেই বাংলা পত্রিকা। টিভি চ্যানেলে কেবলই ইংরেজী। নিজের সাথে নিজেই কথা বলি, তাও ইংরেজিতে। নিজের জ্ঞান যাচাই করার জন্যে এনায়েতুল্লাহ খানের সাপ্তাহিক একটা ইংরেজি পত্রিকায় পাঠকের কলামে দু’চার লাইন লেখা শুরু করি। ওখানেই জানতে পারি বিডিআরের রিটায়ার্ড জেনারেল সি আর দত্ত ঐ চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠনের প্রধান। তিনি এক কলামে লিখেছেন সরকার এখুনি ব্যবস্থা না নিলে দেশ খুব শীঘ্রই হিন্দুশুন্য হয়ে পরবে। পাঠকদের মন্তব্যের কলামে কাঁচা ইংরেজিতে আমি লিখলাম, এ দেশের মাটি হতে একজন মানুষও যদি চলে যায় তা হবে ব্লেসিং, রিগার্ডলেস অব হিন্দু অর মুসলিম। ট্রাম্পের মত বলেছিলাম, ভাল না লাগলে হিন্দুদের এ দেশ হতে চলে যাওয়াই ভাল। তাতে আর যাই হোক, দেশের অর্থনীতি উপকৃত হবে। আর যাই কোথা! মৌমাছির মত আওয়ামী লীগাররা ঝাঁপিয়ে পরল আমার উপর। বিশেষকরে সংখ্যালঘুর দাবিদার হিন্দুরা। বোকার মত আমার লেখায় ঠিকানা দিয়েছিলাম। হুমকি ঘরের দরজায় এসে পর্যন্ত নক করল। রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে কটা দিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। প্রিয়া সাহার কারণে আজ এসব নিয়ে মুখ খুলতে পারছি।

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস। অনেকের মত আমরাও নিরুর্দ্দিষ্ট হয়ে যাই নিজ শহর ছেড়ে। চলে যাই দাদাবাড়ি। এলাকাটা ছিল অনেকটা দ্বীপের মত। কাছের বাজারে যাওয়ারও একমাত্র রাস্তা ছিল খেতের আইল ধরে হাঁটা। আমাদের মফস্বলের আপন শহর ততদিনে চলে গেছে রাজাকার সহ পাকিস্তানিদের দখলে। আমাদের বসতবাড়ির অর্ধেক উড়ে গেছে ওদের আর্টিলারির আঘাতে।

মার্চ হয়ে এপ্রিল, এভাবে জুন পর্যন্ত কাটিয়ে দেই গ্রামের বন বাদারে ঘুরে। সখের বশে ফুফাতো ভাইদের সাথে মিলে কবুতরের ব্যবসা শুরু করি। মাঝে মধ্যে ফসলের মাঠে খাবার নিয়ে যাই কৃষিকাজে নিয়োজিত কামলাদের জন্যে। গরুর কাধে জোয়াল চড়িয়ে কিভাবে চাষাবাদ করতে হয় তার তালিম নেয়ার চেষ্টা করি। এক বিষ্যুতবার হাট হতে ফিরি মহাখুশি হয়ে। কবুতর ব্যবসায় বেশকিছু লাভ করেছি আমি। এখানেই ঘুরে যায় আমার জীবন।

এক সকালে তৈরী হচ্ছি গঞ্জের ওপারে রেলষ্টেশন যাব বলে। ওখানে সস্তায় ঘোড়ায় চড়া যায়। বাবা গম্ভীর গলায় ডাক দিয়ে বললেন, আমি শুনেছি তোমার ব্যবসার কথা। মনে হচ্ছে মাথা আছে তোমার। চলো আমার সাথে, বাজারের ব্যবসায় মন দেবে। বাবাকে না করার মত ইহজগতে কেউ ছিলনা। আমিও পারিনি। সেই হতে প্রতিদিন সকালে রওয়ানা দেই গঞ্জের দিকে। ওখানে আমাদের হরেক রকম ব্যবসা। বাবার সাথে যাই, আবার রাতে ফিরে আসি। দুপুরের খাবার বাড়ির কামলা দিয়ে আসে। উপভোগ করতে শুরু করি নতুন জীবন। এভাবেই চলতে চলতে একসময় বর্ষা আসে। ডুবে যায় গ্রাম-গঞ্জের মাঠঘাট। এখন আর হেঁটে যাওয়া যায়না, যেতে হয় নৌকায় চড়ে।

একদিন লাল রঙের ক্ষয়িষ্ণু একটা বাড়ির সামনে এসে নৌকার মাঝিকে থামতে বললেন বাবা। আমি একটু অবাক হলাম। এ পথে অনেকদিন ধরে আসা-যাওয়া করছি বাবাকে কোনদিন মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেও দেখিনি বাড়িটার দিকে। মনে হল কিছু একটা হতে যাচ্ছে।

নৌকাটা ঠিক বাড়ির মুল ফটকের সামনে এসে থামল। বাবা আমার দিকে তাকালেন। ভয় পেয়ে গেলাম। গ্রামের দুষ্ট একটা মেয়ের সাথে কিছু একটা হয়ে গেছে আমার, এমন একটা অলীক তথ্য বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভাবলাম হয়ত কিছু শিক্ষা দেবেন। না, তার ধারে কাছেও গেলেন না। কিছু কথা হলো…
– তুমি কি বাড়িটা চেন? কখনো ভেতরে গেছ?
– জমিদার বাড়ি হিসাবে চিনি। ভেতরে যাওয়া হয়নি কোনদিন। ওখানে নাকি শেয়াল-কুকুরদের বাস।
– হ্যা, ওটা জমিদার বাড়ি নিশ্চয়। ওখানে এখন কেউ থাকেনা। সবাই ভারতে চলে গেছে। একটা দারোয়ান আছে পাহাড়ার জন্যে।
– আমরা কি এখন ভেতরে যাব?
– না, তা দরকার নেই। এখানে একটা আইল আছে। শুকনার দিনে দেখা যাবে, এখন ডুবে আছে। এই আইলটা ধরে প্রতিদিন আমি স্কুলে যেতাম। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাওয় আইল। নিয়ম ছিল কোন মুসলমান বাড়ির সামনে জুতা পরে হাটতে পারবেনা। এখানে আসার আগে জুতা হাতে নিতে হবে।
– এ কেমন আইন? একই দেশে একদল জুতা পরবে, অন্যদল পরতে পারবেনা?
– বাবা আকাশের দিকে তাকালেন। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে হল একদলা কষ্ট বাইরে আনার চেষ্টা করছেন।
– তা আপনারাই বা খুলতে রাজী হতেন কেন?
– এটাই ছিল নিয়ম। শুধু তাই না, স্কুলে আমাদের বসতে হতো মাটিতে পাটি বিছিয়ে। আর হিন্দুদের জন্যে কাঠের টুল। মাঝে মধ্যে আমার বাবাকে ডেকে নিয়ে ওরা ধমকাতো ছেলেকে ইস্কুলে পাঠাচ্ছে বলে। খাজনা বাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিত। লোভ দেখাতো বিভিন্নভাবে। বাবা ভয় পাননি। বরং আরও উৎসাহ দিয়ে আমাকে ইস্কুলে পাঠাতেন।
যেদিন ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হয়ে গেল, প্রথম রাতেই জমিদার বাড়ির সবাই প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেল। ভারত বিভক্তির আভাষ আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল ওরা। তাই গোপনে সহায় সম্পত্তিও বিক্রি শুরু করেছিল। ওরা আমাদের প্রজা হিসাবে মনে করত। আমাদের লেখাপড়া ছিল তাদের অন্যতম প্রধান শত্রু।

বাবার একাডেমিক শিক্ষা কতদূর পর্যন্ত গড়াতে পেরেছিল তা আমরা কেউ জানতে পারিনি। যে শিক্ষাই থাক তা নিয়েই তিনি ঐ আমলে পার্লামেন্টে বসেছিলেন। ৭১’এ ঐ দিনের পর আর কোনদিন বাবার মুখে জমিদারদের কথা শুনিনি।

প্রিয়া সাহা বিলুপ্ত হিন্দুদের হিসাব দিতে গিয়ে আগের ইতিহাস টেনেছেন। ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন সেই বৃটিশ আমল হতে আমরা তাদের উচ্ছেদ করছি। কিন্তু এই সাহা উচ্ছেদ কাহিনীর সবটা তুলে ধরেননি হয়ত নিজদের কালো ইতিহাস আড়াল করার জন্যে।

মোরাল অব দ্যা স্টোরি ইজ, অত্যাচারীরা এভাবেই বিলুপ্ত হয়। ইতিহাস তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় এবং তারা সে পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের হিন্দুদের সবাই অত্যাচারী ছিল তা সত্য নয়। কিন্তু অনেকেই ছিল। এবং এই তারাই ধর্ম ভিত্তিক বিভক্তির প্রথম বীজ বপন করেছিল এ দেশে।

জেরুজালেম, ২৫ শে জুলাই। ২০১৯ সাল।

ডেশটিনেশন রামাল্লা, পশ্চিম তীর, প্যালেষ্টাইনঃ

ডেশটিনেশন রামাল্লা, পশ্চিম তীর, প্যালেষ্টাইনঃ


পশ্চিম তীরে ঢুকার ইসরায়লী চেক পয়েন্ট।


এই সেই নটরিয়াস দেয়াল যা নিরাপত্তার অজুহাতে ইসরাইল নির্মাণ করেছে।

আজকের সময়টা রাখা ছিল প্যালেষ্টাইনের জন্যে। দু’এক জায়গায় বিছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও সফরটা ছিল নিরাপদ ও ঘটনাবহুল। গুছিয়ে লিখলে দশপর্বেও শেষ হবেনা। তাছাড়া উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জেরুজালেমের বাতাস। আমি যেখানে আছি সেখান হতে আধা মাইল দূরে ঘটেছে ঘটনাটা। বোধহয় রোববার রাতে ইসরায়েলি বুলডজার গুড়িয়ে দিয়েছে প্যালেষ্টাইনিদের ১০০’র মত বাড়ি। ওদের ভাষ্য বাড়িগুলো নিরাপত্তা দেয়ালের খুব কাছে হওয়ায় ইসরায়েলের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি স্বরূপ। কোন পূর্বনোটিশ ছাড়া ১০০ পরিবারকে পথে বসিয়েছে। ফুঁসছে গোটা প্যালেষ্টাইন। রামাল্লায় গিয়ে তার উত্তাপ কিছুটা হলেও অনুভব করেছি।

আগামীকাল বিক্ষোভ করবে গোটা প্যালেষ্টাইন। পূর্ব জেরুজালেম হতে ঢুকার মূল ফটক দামাস্কাস গেইট বন্ধ করে দিবে সৈন্যরা। মারাত্মক কিছু না হলে তার স্থায়ীত্ব হতে পারে ৩/৪ ঘণ্টা। আর রক্তারক্তি হলে তা বাঁক নেবে বিপদজনক পথে। স্বভাবতই কয়েক ঘণ্টার জন্যে আগামীকাল বন্দী হয়ে পরবো হোটেলে। কারণ দামাস্কাস গেইট হচ্ছে পূর্ব জেরুজালেম হতে বের হওয়ার অন্যতম পথ। দিনের প্ল্যান চেঞ্জ করতে হবে ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যে রেখে। হোটেল রিসিপসনিষ্টের মতে, এমনটাই প্যালেষ্টাইন ইসরায়েলের সম্পর্ক। দুদিন ভাল তো তৃতীয়দিন খারাপ। টেইক ইট অর লীভ ইট!


চেয়ারাম্যান ও প্রেসিডেন্ট আরাফাতের অফিস কক্ষ। এখানে বসেই মোকাবেলা করতেন ইসরায়েলীদের অল-আউট আক্রমণ।


চেয়ারম্যান আরাফাতের রান্নাঘর। একাধারে ৩৪ মাস ইসরায়েলী অবরোধের সময় এটাই ছিল তার মূল আশ্রয়স্থল।


এখানেই ঘুমিয়ে আছেন প্যালেষ্টাইনিদের প্রাণপ্রিয় পুরুষ ইয়াসির আরাফাত।


রামাল্লাহ শহরের কেন্দ্রে।

প্যালেষ্টাইনের রাজধানী রামাল্লায় পৌঁছে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে দেখা করার অনুরোধ পাঠাই। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে তার সেক্রেটারী জানাল, বাংলাদেশ হতে আসা একজনের সাথে প্রেসিডেন্ট দেখা করতে খুবই উৎসুক, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণ তিনি এখন সময় সময় দিতে পারবেন না। দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন চাইলে পরের সপ্তাহে এমন একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দিতে পারেন। ধন্যবাদ দিয়ে জানালাম একসপ্তাহ পর আমি আর এখানে থাকবোনা। চেয়ারম্যান আরাফাতের কবরের সাথে দেখা প্রশাসন ভবনের প্রবেশের মুখে। দুজন সৈনিক পাহারা দিচ্ছে ২৪/৭। দেখলাম আরাফাতের অফিস, যেখানে বসে একনাগাড়ে ৩৪ মাস ইসরায়েলিদের অবরোধ মোকাবেলা করেছেন।


ঐতিহাসিক শহর জেরিকো।


১০,০০০ বছর বয়সের এই শহরই আজকের বিশ্বের সবচাইতে পুরানো শহর।

রামাল্লাহ হতে বেরিয়ে পরবর্তী ষ্টপেজ ছিল জেরকো নামের একটা ঐতিহাসিক শহর। বলা হয় সী-লেভেল হতে পৃথিবীর সবচাইতে নীচুতে অবস্থিত এই শহরের বয়স ১০,০০০ বছরের উপর।


ছোট এই জায়গাটাতেই জন্ম হয়েছিল যীশু খ্রীষ্টের।

খ্রীষ্ট ধর্মের জনক যিশু খৃষ্টের জন্মস্থান বেথলেহেম ছিল আজকের শেষ ষ্টপেজ।

প্রতিটা শহর ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ঘটনা। লুকানো আছে প্যালেষ্টাইনিদের লম্বা দীর্ঘশ্বাস। নিজ দেশে শরনার্থী হওয়ার চাপা ক্ষোভ ফুঁসে উঠে অনেক কথাই প্রকাশ করেছিলেন আমার ট্যুর গাইড আবু আল নাসের। ৪৭ বছর বয়স্ক প্যালেষ্টানিয়ান, যিনি একসাথে জেল খেটেছেন ইসরায়েলি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রবিনের খুনির সাথ, বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন নিজেদের অসহায়ত্বের কথা। নিয়ে গিয়েছিলেন আপন বাসস্থান পশ্চিমতীরের এক রিফিউজ্যি ক্যাম্পে। এসব কথা পূর্ব জেরুজালিমে বসে লেখা নিরাপদ না, পরিচিত অপরিচিত অনেকেই লিখতে মানা করে দিয়েছেন।

বাড়ির ফিরে এর উপর বিস্তারিত লিখার ইচ্ছা।

পূর্ব জেরুজালেম : আল আকসা মসজিদ- পর্ব-২

পূর্ব জেরুজালেম। আল আকসা মসজিদ। পর্ব-২।

ঘণ্টা-খানেক কষে একটা ঘুম দিলাম। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি দুটো কবুতর বসে আছে ব্যালকনিতে। ওরা ভালবাসায় ব্যস্ত আর ঘো ঘো করে চীৎকার করছে। অনেক জাতির কাছে কবুতর দেখা নাকি শুভ লক্ষণ। এসবে আমার বিশ্বাস না থাকলেও মনটা ভাল হয়ে গেল। ছবি তুলতে চাইলাম কপোত কপোতীর। কিন্তু কোত্থেকে একটা বিড়াল এসে সব পালটে দিল। কবুতর-দ্বয় ডানার পত পত আওয়াজ তুলে মিলিয়ে গেল শূন্য দিগন্তে।

সূর্যের তেজ খুব একটা কমেছে বলে মনে হল না। রুমে এসির কারণে প্রচণ্ড শীত। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পরলাম রুম হতে। উদ্দেশ্য দামাস্কাস গেইট।
মানুষ কিলবিল করছে ওখানে। ক্লান্ত টুরিস্টদের দল গেইটের সামনে গ্যালারিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। অনেকে ছবি তোলায় ব্যস্ত। মূল এন্ট্রিতেই চোখে পরল চার জনের গ্রুপটা। ইসরায়েলি পুলিশ। সেমাই অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে বসে আছে। খুব একটা সিরিয়াস তা বলে যাবেনা। নিজেদের ভেতর হাসাহাসি করছে। একজন মোবাইল ফোনে কি যেন একটা করছে। নিজকে ইনসিগ্নেফিকেন্ট রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই করলাম। খুব দ্রুত গেইট হতে বেরিয়ে চলে গেলাম সামনের স্কয়ারে।

পাশাপাশি দুটো বাস ষ্টেশন। একটা বেথলেহেম ও অন্যটা রামাল্লা গামী। পাশেই কাঁচাবাজার। ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরি শেষ। বিক্রেতাদের সবাই ঘরে ফেরার আয়োজন করছে। ফিলিস্তিনি ছেলেরাও দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। দেখলেই মনে হয় পরিশ্রম করছে বাঁচার জন্যে। গায়ে আধুনিক পোশাক হলেও মুখের হাল্কা হাসিটা বলে দেয় ওর ভেতরটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদী সাদাদের মত নয়। বেশ কজনকে মাথা নুইয়ে সালাম দিলাম। উত্তরে ওরাও দিল এবং জানতে চাইল কোন উপকার করতে পারে কিনা। অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটির পর হোটেলের দিক রওয়ানা দিলাম।

পবিত্র শহর জেরুজালেমে সূর্য তখন শেষ রশ্মি ছড়িয়ে ডুবি ডুবি করছে। চারদিকে আরও একবার ভাল করে তাকালাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে হয়ত আর কোনদিন আসা হবেনা। কিন্তু আজকের এই অভিজ্ঞতা আজীবন বয়ে বেড়াবো। গল্প করবো যতদিন বেঁচে থাকবো।
হঠাৎ করে নিজকে খুব ভাগ্যবান মনে হল।
১৬ কোটি বাংলাদেশির ঠিক কতজন ইতিপূর্বে এ শহর ঘুর যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে সমীকরণ মেলাতে গিয়ে মনে হল এ সংখ্যা নিশ্চয় খুব একটা বেশী না।

হোটেলে ফিরে এসে লবির কফি ভাণ্ডার হতে এক কাপ গরম কফি বানিয়ে গল্প করতে শুরু করলাম রিসিপশনিষ্ট ইয়াসিনের সাথে। ও প্রতিদিন রামাল্লা হতে বাস ধরে জেরুজালেমে আসে এবং কাজ শেষে ফিরে যায়। চেক পয়েন্টের ঝামেলা নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপ হল। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো আল আকসায় ঢুকতে পেরেছি কিনা। না বলতেই কিছু টিপস দিল। রাত নেমে এসেছে। অন্ধকারের চাদরে ডুবে আছে জেরুজালেম। আল আকসাও এক অর্থে বন্ধ। তবে তা মুসলমানদের জন্যে খোলা। সিকিউরিটি চেকপয়েন্টে লম্বা একটা সালাম দিলেই নাকি ওরা ধরে নেবে আমি মুসলমান এবং ঢুকতে ঝামেলা করবেনা।

খুব দ্রুতই বেরিয়ে পরলাম কালকের কথা ভেবে। আজ এ অভিযান শেষ করতে পারলে দিনটা খালি থাকবে এবং শহরের পশ্চিম দিকে খ্রিষ্টান এলাকায় ঘুরে বেড়াতে পারবো। বিকেলে বাস ধরে রামাল্লা যাওয়ার প্লানেও বাঁধা থাকবেনা।

দিনের আলো থাকায় আগের চেষ্টায় নিরাপত্তার ভয়টা মাথায় চাপেনি। কিন্তু এখন ব্যপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্ধকার চিপা রাস্তা। আলোও নেই তেমন। চাইলে যে কেউ আমাকে ঠেক দিতে পারে। ছিনতাই কাজে আমাদের উপদেশের জন্যে এ হতো আদর্শ লোকেশন। সাহস করে এগুতে থাকলাম। মানুষের চলাচলও কম। অনেকে তখনো দোকানপাট বন্ধ করছে। পুলিশ উপস্থিতিও বেড়েছে অনেক জায়গায়। দুপুরে যেখান হতে আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেখানে আবারও থামতে হল।
পুলিশ!

প্লান-মত লম্বা সালাম দেয়ার পরও জানতে চাইলো মুসলমান কিনা। ওরা সবাই ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি পুলিশ। এ সময়টায় কেবল মুসলমানদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে এ পবিত্র মসজিদ। হাসি দিয়ে নিজের পুরো নাম বললাম। ওরা বোধহয় বিশ্বাস করলো না আমার পোশাকের কারণ। শর্টস ও টি শার্ট। মসজিদে প্রবেশের আদর্শ পোশাক না নিশ্চয়। একজন জিজ্ঞেস করলো কোরানের আয়াত জানি কিনা। অন্যজন জানতে চাইল কালিমা মুখস্থ আছে কিনা। এসবের সাথে যোগাযোগ নেই অনেক বছর। আমি ধার্মিক নই। এর চর্চাও করিনা স্কুল জীবন হতে।

ভড়কে না গিয়ে নিজকে সামলে নিলাম। প্রতিবাদ অথবা তর্ক করার জায়গা এটা না। চোখ বুজে সূরা ফাতেহা মনে করার চেষ্টা করলাম। গড় গড় করে বেরিয়ে এলো.. বিসমিল্লাহে রহমানের রাহিম…। আলহামদুলিল্লাহ রাব্বুল আলামিন। বেশ ক’লাইন বলার পর একজন থামিয়ে দিল। বলল, আমার উচ্চারণ নাকি যথেষ্ট কনভিনসিং না। এবার হতাশ হলাম। সাথে থাকা মার্কিন ড্রাইভিং লাইসেন্সটা এগিয়ে দিলাম। নিজকে মুসলমান হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার এই চেষ্টা নিজের কাছে বড় ধরণের হিপোক্রেসি মনে হল। কিন্তু উপায় ছিলনা। ওদের একজন বলে উঠল, ‘সবকিছু দেখে তো মনে হচ্ছে মুসলমান, ছেড়ে দাও’। এবং ছেড়ে দিল।

একটু আগাতেই পথরোধ করে দাঁড়াল সিভিলিয়ান কেউ। গায়ে গতরে বিশাল। বিনয়ের সাথে জানতে চাইল মুসলমান কিনা। এবার মাশায়াল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ জাতীয় দুয়েকটা শব্দ ঝেড়ে দিলাম। মনে-হল সন্তুষ্ট করতে পেরেছি।
বাড়তি কোন ঝামেলা ছাড়াই পা বাড়ালাম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আল আকসা মসজিদের দিকে।

মসজিদ প্রাঙ্গণে অনেক ফিলিস্তিনিরা ঘোরাফেরা করছে। বাইরেটা ভাল করে দেখার পর পা বাড়ালাম ভেতরের দিকে। জুতা খুলে ভেতর ঢুকতে ঠাণ্ডা একটা বাতাস এসে সমস্ত শরীর জুড়িয়ে দিল। আমার মত অনেকে দেখতে এসেছে। ছবি তুলছে। দু’একজন নামাজও পড়ছে। অনেকটা সময় হতবাক হয়ে চিন্তা করলাম, এই সে আল আকসা মসজিদ যার অস্তিত্ব ছোটকাল হতে জেনে এসেছি। জেনে এসেছি এর ইতিহাস, এর বিবর্তন এবং সমসাময়িক পরিস্থিতিতে এর ভাগ্য। অবাক লাগলো এই ভেবে, চাইলেই তো এখানে আসা যায়। আগে আসেনি কেন!

বেশকটা ছবি তুললাম। একজন মহিলা আমার একটা ছবি তুলে দিল। বেশকিছুটা সময় কাটিয়ে দিলাম কিছু না করে। একদম নীরবে। স্মৃতির গলি হাতড়ে ফিরে গেলাম অনেক বছর পিছনে। আব্বা তখনো বেঁচে। দাদা বাড়ির ঘোড়া মাওলানা ওয়াজ শেষে মোনাজাত ধরেছেন… হে আল্লাহ, আল আকসা মসজিদের পবিত্রতা তুমি রক্ষ করো…”

জানিনা কি লেখা আছে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে। তবে তা যাই হোক, তাদের এ সম্পদ, তথা বিলিয়ন মানুষের বিশ্বাস, সন্মান ও শ্রদ্ধার এ স্থান যেন আসল মালিকদের হাতে থাকে এই কামনা করেই বেরিয়ে এলাম আল আকসা মসজিদ হতে। ততক্ষণে রাতের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে চেপে বসেছে জেরুজালেমের বুকে। দুপুরের তপ্ত বাতাসের জায়গা করে নিয়েছে হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাস। ফেরার পথটা মনে হল ঘোরের মধ্যে হেঁটেছি। মনে হচ্ছিল এ সত্য নয়, নেহাতই স্বপ্ন অথবা কল্পনা। হাজার রজনীর আরব্য উপন্যাসের পুরানো পাতা উলটাচ্ছি আমি…

.
জেরুজালেম। ২২শে জুলাই, ২০১৯।

পূর্ব জেরুজালেম : আল আকসা মসজিদ পর্ব-১

পূর্ব জেরুজালেম। আল আকসা মসজিদ। পর্ব-১।

প্রচণ্ড গরম থাকায় মধ্যদিনে আর ঘরের বাইর হইনি। লাঞ্চ খাবার পর চোখ এমনিতেই ঢুলু ঢুলু করছিল। ভেতর হতে ঘুম বার বার তাগাদা দিচ্ছিল। গেল দুই রাত ভাল ঘুম হয়নি ঘন ঘন সময় ও স্থান বদলের কারণে। তাতে ছক আঁকা ভ্রমণ পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে বার বার। সুখনিদ্রায় যাওয়ার আগে মনে হল একটু হেঁটে আসা উচিৎ। বিগ এন্ড ফ্যাট লাঞ্চ গলা পর্যন্ত উঠে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দিচ্ছিল সগৌরবে। গ্রীলড চিকেন সাথে তন্দুরে ভাজা প্যালেষ্টানিয়ান রুটি। স্বাদে গন্ধে এক কথায় অতুলনীয়।

হোটেল কাউন্টারে পরিচয় ইয়াসিনের সাথে। জন্ম প্যলাষ্টাইনে হলেও বড় হয়েছে ইংল্যান্ডে। ছেলে-মেয়ে সহ স্যাটলড রামাল্লায়। তার কাছে নির্দেশনা নিয়ে রওয়ানা দিলাম মসজিদে আল আকসার দিকে।

পায়ে হাঁটার দশ মিনিটের পথ। আঁকা বাঁকা এবং উঁচু নিচু। ব্যস্ত ও গিঞ্জি প্যালেষ্টানিয়ান মার্কেটের বুকে চিড়ে চলে যাওয়া এ রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটলে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে এদের জীবনের উপর। সন্দেহ নেই এদের জীবন অন্যরকম। কিন্তু মানুষ হিসাবে ওরা আমাদের মতই রক্ত মাংসের মানুষ। হাসিখুশি উচ্ছল। হাঁটার পথে কাউকে সালাম দিলে খুশিতে গদ গদ হয়ে জানতে চায় মুসলমান কিনা। ইসরায়েলিদের মত এদেরও মূল পরিচয় এখন ধর্ম। ধর্মের প্রভাব সবকিছুতে। কথায়, কাজে, পোশাকে এবং ব্যবহারে। মার্কেটে টুরিস্টদের ঢল। সাদা, কালো, বাদামি, মিনি স্কার্ট পরিহিতা ইসরায়েলি যুবতীদের পাশেই হাঁটছে আপাদমস্তক হিজাবে ঢাকা প্যালেষ্টানিয়ান তরুণী। দেখলে মনে হবে জীবন নিয়ে ওদের কোন অভিযোগ অথবা আক্ষেপ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ কথা বললেই বেরিয়ে আসে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস। এবং এ শ্বাসের সাথেই মিশে থাকে তাদের না বলা কথা।

কম করে হলেও দশটা বাঁক নিয়ে হয় খুবই সরু ও ঘিঞ্জি এ রাস্তায়। প্রতিটা বাঁক নেয়ার আগে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করে নিলাম পথ হারানোর ভয়ে। তরুণরা দোকানে পশরা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে ক্রেতার। পাশেই হুঁকা হাতে তামাক টানছে বৃদ্ধের দল। অনেককেই সালাম দিলাম। দুয়েকজন ডেকে কাছে বসাল। খুঁটিয়ে জানতে চাইল কোথা হতে এবং কেন এসেছি। মার্কিন পরিচয় এখানে মূল্যহীন। বরং বাংলাদেশের কথা শুনলে জানতে চায় অনেক কিছু।

আড্ডা জমিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি সময়ের কারণে। সময়ের সাথে আমার লড়াই চলছে গত দুদিন ধরে।

একটা জিনিষ খুব ভাল লাগলো জেরুজালেমের এ অংশে। ছেলে বুড়ো হতে শুরু করে প্যালেষ্টাইনিদের প্রায় সবাই ইংরেজি জানে। কম্যুনিকেশনে অসুবিধা হয়না।
আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকার প্রথম গেইটেই আটকে দিল ইসরায়েলি পুলিশ। জানালো বন্ধ হয়ে গেছে! জানানোর ভাষাটা ছিল খুবই কর্কশ। এই প্রথমবার অনুভব করলাম হলিল্যান্ডের সবকিছুই ছবির হলি নয়।

মন খারাপ করে ফিরে এলাম। উলটো রাস্তায় কারও সাথে কথা বললাম না। মনে মনে অংক কষে টাইট মেনুতে নতুন করে ঢুকাতে চাইলাম ফিরে আসার প্লান।

হোটেল কাউন্টারে ইয়াসিনকে খুলে বলতেই সে হেসে দিল। জানালো ওটা ছিল নামাজের ব্রেইক। চাইলে এখুনি আবার ফিরে যেতে পারি। শরীর আর চলছিল না। নতুন করে বাইরে বের হওয়ার আগে একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার। কোন রকমে রুমের দরজা খুলে লুটিয়ে পরলাম বিছানায়।

ব্রেকফাস্ট ইন তেল আবিব …. ইসরাইল

প্যালেষ্টাইনে প্রথম প্রহর…

তেল আবিব হতে শেষ মুহুর্তে হোটেল বুক করার সময় ইচ্ছে করেই পুরানো জেরুজালেমের একটা হোটেল বুক করেছিলাম। নাম হোটেল হাশেমি। এক শহর হতে অন্য শহরে আসতে একঘণ্টার বাস জার্নি। বাসে উঠে ঠিকমত বসার আগেই ড্রাইভার জানালো চলে এসেছি। জেরুজালেমের সেন্ট্রাল বাস ষ্টেশন। লোকে লোকারন্য। দলে দল পর্যটকরা আসছে। তিন ধর্মের পূণ্যভূমি এই শহরকে ঘিরে আছে অনেক ইতিহাস। এ ইতিহাস আমাদের যেমন নিয়ে যায় হাজার বছর আগে, তেমনি সমসাময়িক পটভূমিতে। এ মুহূর্তে ইতিহাস এবং তাকে ঘিরে স্থানীয়দের কনফ্লিক্ট নিয়ে লিখতে চাইনা নিরাপত্তার কথা ভেবে। তবে এখন আমি প্যালেষ্টাইনে। দামাস্কাস গেইটে ট্যাক্সি ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলে এসেছি হোটেলে। বুঝতেই পারিনি নীরবে অতিক্রম করেছি এমন একটা সীমানা যাকে দেখার স্বপ্ন আজীবন লালন করেছি…

ছবির ব্যাকগ্রাউণ্ডে এই সেই দেয়াল যা ইসরাইল ও প্যালেষ্টাইনকে আলাদা করে। দরজাটাই দামস্কাস গেইট। পাশেই দুটো বাস ষ্টেশন। একটা যাত্রীদের নিয়ে যায় বেথেলহেম এবং অন্যটা প্যালেষ্টাইনের অলিখিত অস্থায়ী রাজধানী রামাল্লায়।

ঘড়ির কাটায় স্থানীয় সময় ঠিক কটায় ঘুম ভাঙ্গলও আন্দাজ করতে পারলাম না। স্মার্ট ফোন, স্মার্ট ঘড়ি দু’টোর একটাও স্থানীয় সময় দেখাচ্ছে না। একটাতে ক্যালিফোর্নিয়া অন্যটাতে এখনো নিজ অঙ্গরাজ্য নিউমেক্সিকোর সময়। অথচ আমার দরকার স্থানীয় সময় এবং সাথে বাংলাদেশ ও পেরুর। ১৪ ঘণ্টা বিরামহীন জার্নির পর এমনিতেই ক্লান্ত। তার উপর ক্ষুধা। ডিনার করা হয়নি এই ভেবে বিকাল ৬টায় দেয়া ফ্লাইটের ডিনারই হয়ত রাত কাটিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু লম্বা একটা গোসল দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পরতেই পেট আওয়াজ দিতে শুরু করল। ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে।

ঘুম খুব একটা লম্বা হয়নি। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি ঘোর অন্ধকার। হঠাৎ করেই অংকটা মাথায় এলো; এয়ারপোর্টে নেমে কষে নিয়েছিলাম। আমার শহরের চাইতে ৯ ঘণ্টা এগিয়ে ইসরাইলের সময়। সে হিসাবে এখন ভোর প্রায় ৪টা। দুয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। রাস্তা পরিষ্কার করার ট্রাকটাকে দেখলাম বেশ সময় নিয়ে পরিষ্কার করছে।

বাইরে তাকালে মনে হবে ঢাকার কোন গলির কার্বন কপি। জরাজীর্ণ দালানের অনেক জায়গায় পলিস্তরা খসে খসে পরছে। ছাদের উপর পুরানো দিনের এন্টেনা। জানালার পর্দাগুলোও স্যাঁতস্যাঁতে। শুধু বাকি ছিল মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি ভেসে আসার।

ভোরের আলো ফুটতেই পেটের খিদা জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করল। অপেক্ষা করার সময় ছিলনা। নীচে নামতেই দেখি হোটেলের মুল ফটক তখনো তালা দেয়া। রেসিপশনে কেউ নেই। অজান্তেই মুখ হতে অশ্রাব্য একটা গালি বেরিয়ে এলো। লবিতে ফ্রি কফির ব্যবস্থা ছিল। এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ফিরে এলাম রুমে।

৮টার দিকে দ্বিতীয় চেষ্টাতে বেরিয়ে পরলাম। তেল আবিব। আধুনিক একটা শহর। চারদিক চকচক করছে। রুম হতে দেখা পুরানো বাড়িটা মনে হল একটা যাদুঘর। মানুষের কোলাহল বাড়ছে রাস্তায়। সাথে গাড়ি। হাঁটছি অলস গতিতে। উদ্দেশ্যবিহীন। একটু এগুতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। সমুদ্র! রাশি রাশি ঢেউ আছড়ে পরছে কূলে। সাত পাঁচ না ভেবে দ্রুত রওয়ানা দিলাম ওদিকটায়। ১১টার দিকে রওয়ানা দেব জেরুজালেমের দিকে। সময় কম। এ শহরে যা দেখার অল্প সময়ের ভেতরই দেখে নিতে হবে।

বীচের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম অসংখ্য মানুষ দৌড়চ্ছে। মেয়েদের মিছিলটা একটু লম্বা। অনেকের পরনের কাপড় একবারেই সংক্ষিপ্ত। ২৪ ঘণ্টারও কম সময় এ দেশে। এরই ভেতর একটা উপসংহার টানলে বোধহয় ভুল হবেনা। এ দেশের মেয়েরা বিপদজনক সুন্দরী। কেবল গায়ের রঙ আর চেহারাই নয়, শরীর সঠিক রাখার মাপকাঠিতেও ওরা এগিয়ে। ছেলেদের সৌন্দর্য বিচার করার দায়িত্ব আমার নয়। কিন্তু এদের দিকে তাকালেও মনে হবে ঈশ্বর হয়ত নিজ হাতে তৈরি করেছেন। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর পেটের ক্ষুধাটা চরম পর্যায়ে চলে গেল। আর অপেক্ষা নয়।

বীচের পাশেই দেখা মিলল মাকডোনাল্ডের। পরিচিত দোকানের গন্ধ পেয়ে ওদিকে রওয়ানা দিতে দেরী করলাম না। কিন্তু হতাশ হলাম। ভেতরে কোন আলো নেই। একেবারেই অন্ধকার। দেখে মনে হল হয়ত মেরামত চলছে।

এবার হোটেলের ফেরার রাস্তা ধরলাম। ওখানে বেশকটা খাবার দোকান রাতেই দেখেছি। দরদাম অথবা প্রকারভেদ খুঁজে দেখার মত অবস্থা ছিলনা। ঢুকে পরলাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে। মেনু হিব্রু ভাষায়, তাই কিছু বুঝতে পারলাম না। তবে মেনুতে ছবি থাকায় আঙ্গুল তুলে ঐদিকটায় ইঙ্গিত করলাম।
সাজগোজে পরিপক্ব সুপার আবেদনময়ী মেয়েটা ভুবন-জুড়ানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এদিকটায় এই প্রথম বুঝি?’

আমিও সহজ ভাবে উত্তর দিলাম। ‘একেবারে ব্রান্ড নিউ। চব্বিশ ঘণ্টারও কম।
সময় নিয়ে রান্না করলো। প্লেট যখন টেবিলে রেখে গেল আমার চোখ ছানাবড়া। বিশাল আয়োজন। চার টুকরো পাউরুটি। টমেটো সসে ডুবানো দুটো ডিম ভাজি। শসা ও টমেটোর সালাদ। সাথে অলিভ ওয়েল। এবং ফ্রেশ এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। তেল আবিবের প্রথম ব্রেকফাস্ট। এক কথায় ইসরায়েলে আমার প্রথম খাবার।