বিভাগের আর্কাইভঃ ব্যক্তিত্ব

‘যদি আর বাঁশী না বাজে’…

ebc161

কখনো সখনো মনে হয় জীবন থেকে পালিয়ে যাই।
পরের যে প্রশ্নটি আসে, কোথায় !!
অনেক কথা না বলা রয়ে যায়।

আজ মনে হয় আমারই না বলা কথার কিছু শব্দ খুঁজে পেলাম;
কেন জানিনা একটা ছায়া হয়ে হৃদয়ের কন্দরে
আমারই প্রিয় কবির স্বগোক্তিতে…
‘যদি আর বাঁশী না বাজে’

nazrul02

বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রান আজ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে- “আমি ধন্য হলুম”, “আমি ধন্য হলুম”।

আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য্যবাদকের একজন আমি- এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই; আমি সকল দেশের, সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলি। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার ধর্ম। তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্তানের পথে তাঁকে ক্ষুধাদীর্ণ মুর্তিতে ব্যাথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। কারাগারের অন্ধভূমিতে তাঁকে দেখেছি। ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি।

আমাকে বিদ্রোহী বলে খামখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু-মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে এক দিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব; অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান- বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।

রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন,“দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’।” জীবনে সেই ট্র্যাজেডী দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু, আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত দগ্ধ। মেঘের উর্ধ্বে শূণ্যের মত কেবল হাসি, কেবল গান, কেবল বিদ্রোহ।

আমার বেশ মনে পড়ছে। একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে। আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রানভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য, আমার গান আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূণ্য থাকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না, আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কী দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পুর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।

যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসি নি। আমি নেতা হতে আসি নি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী হতে নিরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।

যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়ত বা বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমী, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী- বিশেষনের পর বিশেষন। টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পর মেরে। বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রার্থ্য দিনে বন্ধু তুমি যেন যেও না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোর। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটিকে বুকে চেপে বোল বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি।

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিঁধুর ধূপ।

nazrul03

সেলিম আল দীন: একজন মহানায়কের মহাপ্রয়াণ

Selim Al Deen

সেলিম আল দীন (১৮ই আগস্ট ১৯৪৯—১৪ই জানুয়ারি, ২০০৮)।
তৃতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

একজন প্রখ্যাত নাট্যকার। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক বা স্যাটায়ার-ধর্মী নাটকে তিনি বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

জীবনী:
সেলিম আল দীনের বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রে ঘুরেছেন বহু জায়গা। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর চরম ঝোঁক। তাই দূরে কাছে নতুন বই দেখলেই পড়ে ফেলতেন এক নিমেষে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর লেখক হওয়ার বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। লেখক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে, কপি রাইটার হিসাবে। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকাল মৃত্যু হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার।

তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং বহুবচন প্রযোজিত প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন করা হয় ১৯৭২ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে।

সেলিম আল দীনের প্রথমদিককার নাটকের মধ্যে সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মূল সমস্যা, এগুলোর নাম ঘুরে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে প্রাচ্য, কীত্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতি কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি ও চাকা তাকে ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জীবনের শেষ ভাগে নিমজ্জন নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান বেরিয়ে আসে সেলিম আল দীনের কলম থেকে। তিনি ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক এর উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।

উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ:

* মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৭৬)
* কিত্তনখোলা (১৯৮০)
* কেরামত মঙ্গল (১৯৮৪)
* চাকা (১৯৯০)
* যৈবতি কন্যার মন (১৯৯১)
* শকুন্তলা
* হাত হদাই
* বণপাংশূল
* ধাবমান
* পূত্র

সেলিম আল দীনের অপ্রকাশিত রচনা:

বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত ও কামালউদ্দিন কবির নির্দেশিত অহরকণ্ডল নিয়ে সেলিম আল দীন লিখেছেন ‘যে কথাগুলো বলা উচিত’। নিচে তাঁর ডায়েরির অংশবিশেষ-

লোকায়ত জীবনের মধ্যে খানিকটা বাইবেলের ফিউশন-অহরকণ্ডল। বাকিটা ছড়া-প্রবচন-ধ্রুপদী শব্দের ঘন গম্ভীর ধ্বনি। বাংলা নাট্যের সীমায় এ খুব অবাক হওয়ার মতো কাজ। নাট্য-ভূমিকায় লেখক যা বলেন তাতে তাঁর শিল্পভাবনার কৌশলটা বেশ বুঝতে পারা যায়। চরিত্রের নির্বিশেষ করণের বাড়তি প্রয়াস যে ওটা তাতে সন্দেহ নেই।
অহরকণ্ডলের গল্পটি আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। দীনপুণ্য বাংলা নাট্যে এ রকম কেউ ভাবে নাকি-বলে নাকি-লেখে নাকি?

তারপর কামালউদ্দিন কবির আমাকে অহরকণ্ডলের পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়। লেখাটি পড়তে পড়তে দেখতে পাই কথকের বলার ভঙ্গিতে বিচিত্র সব চিত্র-উড়ে আসে কি মাটি ফুঁড়ে বেরোয়। ঘটনা-চরিত্রের মনোভঙ্গি-ইঙ্গিত-দ্ব্যর্থবোধকতা-সব মিলিয়ে অবাক হওয়ার মতো লেখা।
বুঝতে পারা যায়, বাংলা নাটক চলনে-বলনে আর উপনিবেশকালের শাসন অগ্রাহ্য করছে সচেতন শিল্পরীতির মাধ্যমে, যে রীতিটা উঠে এসেছে আবহমানকালের ধারায়-প্রাচীন ও মধ্যকালের বাংলা থেকে। তবে তাতে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির ন্যায্য অংশটুকুই গৃহীত হয়েছে-বিশ্বসংস্কৃতির আধুনিক প্রবাহের ধারায়।

বর্ণনাত্মক বাঙলা নাটক যে বিশ্বনাটকের শিল্পযাত্রায় এক নতুনতর সংযোজন সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না, যখন দেখি আমাদের একদিনের ক্ষীণ-ভীরু চেষ্টাটা আজ বৃহত্তর শিল্পমণ্ডলবর্তী। একদিন নিজের রচনার ভিতরে নিঃসঙ্গের মতো নির্জনে বসবাস করতাম। আজ দেখি সেই চেষ্টা কতই না বিচিত্রতর ভিন্নধারায় বাহিত হচ্ছে।
রবীন্দ্রোত্তরকালে বাঙলা কবিতা ও উপন্যাসের চেয়েও বাঙলা নাটক নবতর অথচ ভূমিজ এবং অনঔপনিবেশীয় আঙ্গিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সে বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় বলা সংগত।

অহরকণ্ডল আমাদের নাট্যভাষায় এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ নাটকের পরিচালককে এ জন্য ভাষা পারিতোষিক দেই যে তিনি বলার ভঙ্গিটাকেই থিয়েটারে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছেন। একটা নতুন থিয়েটার সৃষ্টির অঙ্গীকার না থাকলে অহরকণ্ডলকে মঞ্চে তুলে আনা সম্ভব হতো না।
পাশ্চাত্য নাট্যধারার বিশাল থাবার নিচে আমাদের এ সকল প্রয়াস-একদিন ভূমিভেদী বৃক্ষরূপে দাঁড়াবেই-এই বিশ্বাসে নিরন্তর নিজবীজ প্রোথিত করি বাঙালির শিল্পভূমিতে।
৩রা মে ২০০৬।

sad-1.jpg
তথ্যসূত্র: ইউকিপিডিয়া

যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে শেষ পর্ব … আলতাফ হোসেন


যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে ১ম এবং ২য় পর্বের পর…
যুবক রবি শান্তি পেয়েছিলেন। বারবার তাই বলেছেন উদার- উন্মুক্ত প্রকৃতির কথা, নদী ও মেঘের কথা, সন্ধ্যাবেলার বাতাস ও স্তব্ধতার কথা। নির্জন- নিঃসঙ্গ মানুষের সঙ্গে আদিগন্ত ধূ ধূ প্রান্তর- ধান ক্ষেতের মুখোমুখি বসে থাকার মহত্ত্বপূর্ণ শান্তির কথা। তবে এই শান্তি স্বভাবতই ছিল না নিরবচ্ছিন্ন বা কেবল ইতিরই কোমলতায় আচ্ছাদিত। নিরর্থকতা, অসারতার অভিজ্ঞতার কথা আগেই বলা হয়েছে। নিঃসঙ্গতা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছে তাঁর উপলব্ধি আমরা এখানটায় দেখতে পাই:

“যার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে প্রাণসঞ্চয় করা যায় এমন মানুষ দশ-বিশ ক্রোশের মধ্যে একটি পাওয়া যায় না। কেউ চিন্তা করে না, অনুভব করে না, কাজ করে না, বৃহৎ কার্যের, যথার্থ জীবনের কোনও অভিজ্ঞতা কারও নেই, বেশ একটি পরিণত মনুষ্যত্ব কোথাও পাওয়া যায় না। সমস্ত মানুষগুলো যেন উপচ্ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে আপিস যাচ্ছে, ঘুমচ্ছে, তামাক টানছে, আর নিতান্ত নির্বোধের মতো বকর বকর করছে।

যথার্থ মানুষের সংশ্রব পাবার জন্য মানুষের মনে ভারি একটা তৃষ্ণা থাকে। কিন্তু সত্যিকার রক্তমাংসের মানুষ তো নেই। সমস্ত উপচ্ছায়া, পৃথিবীর সঙ্গে অসংলগ্নভাবে বাষ্পের মতো ভাসছে।”

কতখানি ক্ষুব্ধ, অশান্ত হলে, অপরিতৃপ্ত বোধ করলে কেউ এমনভাবে লিখতে পারেন? আঁরি বারবুসের ‘নরক’ বইটির নায়ক ছিলেন এমন একাকী, অতৃপ্ত। কাফকার দুই ‘কে’, কামুর মার্সো, সার্ত্রের রক্যাতাঁ যা বলতে পারতো, এভাবে না বললেও বলেছে অন্যভাবে, বা, বুঝিয়ে দিয়েছে যা আচরণে, রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণ তারই কাছাকাছি: “রক্তমাংসের মানুষ তো নেই। সমস্ত উপচ্ছায়া, পৃথিবীর সঙ্গে অসংলগ্নভাবে বাষ্পের মতো ভাসছে।”

কখন লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ এমন কথা? আজি হতে শতবর্ষেরও আগে। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে।

“কারো কারো এমন একটি অকৃত্রিম স্বভাব আছে যে, অন্যের ভিতরকার সত্যটিকে সে অত্যন্ত সহজেই টেনে নিতে পারে। সে তার নিজের গুণে। যদি কোনো লেখকের সবচেয়ে অন্তরের কথা তার চিঠিতে প্রকাশ পাচ্ছে তাহলে এই বুঝতে হবে যে, যাকে চিঠি লেখা হচ্ছে তারও একটি চিঠি লেখাবার ক্ষমতা আছে।”

এ কথার আগে লিখেছেন-

“নিজের যা সর্বোৎকৃষ্ট, ক’জনই বা তা নিজে ধরতে বা পৃথিবীতে রেখে যেতে পেরেছে! আমরাঃ ইচ্ছা করলে, চেষ্টা করলে প্রকাশিত হতে পারিনে। চব্বিশ ঘন্টা যাদের কাছে থাকি তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা সাধ্যের অতীত।”

‘সহজে সত্য আকর্ষণ করার ক্ষমতাটি’ যে ইন্দিরার আছে সে কথা বিশদ করে অন্য একটি চিঠিতে বলেছেন তিনি। বলেছেন, ‘যে শোনে এবং যে বলে এই দুজনে মিলে তবে রচনা হয়।। তটের বুকে লাগে জলের ঢেউ, তবে সে কলতান উঠে/বাতাসে বনসভা শিহরি কাঁপে, তবে সে মর্মর ফুটে।’

জয় হোক ইন্দিরার, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর হোক জয়। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড়ো এবং বিশ্বসাহিত্যের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক রবীন্দ্রনাথ যে আজ থেকে একশো বছরেরও আগে এত গভীর ও অগ্রসর চিন্তার তথা আভঁ-গার্দের ধারক হতে পেরেছিলেন তার পেছনে লেখকের তরুণ বয়সের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু ইন্দিরার ভূমিকা অনেক অনেকখানি।

bvc
কৃতজ্ঞতায়ঃ আলতাফ হোসেন।
অবাক বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য। পদ্মা পাড়ের মানুষ ব্লগ থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে ২য় পর্ব … আলতাফ হোসেন


যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে ১ম পর্বের পর… ১৮৯১-এর জানুয়ারি মাসে যুবক রবি একদিন তাকিয়েছিলেন নদীর জলের ব্যস্তসমস্ত গোটাকতক পাতিহাঁসের দিকে…

“তারা ভারি কলরব করছে এবং ক্রমাগতই উৎসাহ সহকারে জলের মধ্যে মাথা ডুবোচ্ছে এবং তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে নিয়ে সবলে ঝাড়া দিচ্ছে। ঠিক মনে হচ্ছে যেন তারা জলের নিচেকার নিগূঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্য প্রতিক্ষণেই গলা বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং তারপর সবেগে মাথা নেড়ে বলছে, ‘কিচ্ছুই না। কিচ্ছুই না।”

পড়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে না থেকে উপায় থাকে না। কোনো সন্ধানেই কোনো কিছুই যে পাওয়া যায় না কত প্রাজ্ঞ লোকই না বলে এসেছেন শত শত বছর ধরে সে কথা রবীন্দ্রনাথও কী চমৎকারভাবে একটি ছবি তৈরি করে বলে দিলেন, যা আবার মিলে গেল প্রিয় ফরাসি ঔপন্যাসিক আঁরি বারবুসের ‘দেয়ার ইজ নো ওয়ে আউট অর রাউন্ড অর থ্রু’-র সঙ্গেও, তা উপলব্ধি করে একরকম আশ্বস্ত বোধ করা যায়। প্রায়শই একরকম প্রত্যাশা যে মনে জাগে তা যেন পূরণ হয়।

ওই যে পড়াশোনার প্রসঙ্গ তোলা হয়েছিল, সে ব্যাপারে অনার্স ক্লাসের ছাত্রের মতো একটি প্রমাণ বা সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে চাই। বিবি তথা ইন্দিরাকে লিখছেন রবিকা:

“মানুষের আয়োজনের শেষ নেই।। তাকে যে কত রকমের কত-কী হাতে রাখতে হয় তার ঠিক নেই। সেই জন্য আমার সঙ্গে নেপালীজ বৌদ্ধিস্টিক লিটেরেচার থেকে আরম্ভ করে শেক্সপিয়ার পর্যন্ত কত রকমেরই বই রাখতে হয় তার ঠিকানা নেই।”

অন্য যা কারণ তার কথাও বলা হয়েছে: প্রকৃতি, প্রকৃতি এবং প্রকৃতি। প্রকৃতি থেকেও মানুষ তার জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেতে পারে বলে পণ্ডিতেরাই বলেন। সারা ছিন্নপত্র- ছিন্নপত্রাবলী জুড়ে রয়েছে প্রকৃতিবর্ণনা। প্রশান্ত এক আবহ রচিত হয়েছে সেখানে। আর রয়েছে এমন গভীর উপলব্ধির কথা:

“আমার বোধ হয় কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে এলেই মানুষের নিজের স্থায়িত্ব এবং মহত্বের ওপর বিশ্বাস হ্রাস হয়ে আসে। এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি। চারিদিকে এমন সব জিনিস দেখা যায় যা আজ তৈরি করে কাল মেরামত করে পরশু দিন বিক্রি করে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্ম-মৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াত করছে এবং চিরকাল অবিশ্রান্তভাবে প্রবাহিত হচ্ছে।”

চিরকালের এই অবিশ্রান্ত প্রবাহের অনুষঙ্গে এসে পড়ে হেরমান হেস-এর ‘সিদ্ধার্থ’ পড়ার স্মৃতি। কৈশোর যৌবনের সন্ধিক্ষণে আমরা কেউ কেউ বইটি পড়তে গিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে ভেবেছি জীবনের একটা অর্থ বুঝি এবার পাওয়া যাবে। অনেক চেষ্টা, অনেক ভ্রমণের পর সিদ্ধার্থ যখন গৌতমের দেখা পেল তখন কিছু প্রশ্ন করল তাঁকে। কিন্তু উত্তর তাকে সন্তুষ্ট করল না। কী ভাবে করবে? গৌতমের নিজেরও তো জানা ছিল যে, উত্তর নেই। বলেছিলেন তিনি: তোমার পথ তোমার নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। তখন সিদ্ধার্থ গেল কমলা নামের নৃত্যগীত ও চৌষট্টিকলায় পারদর্শিনী এক রূপোপজীবিনীর কাছে। কমলা এতটাই সহৃদয়া যে কেবল তাকে নিয়ে লেখা কবিতার বিনিময়ে সে সিদ্ধার্থকে দান করল তার শরীর ও মন। ভালোবাসার বন্ধনে জড়ালো তাকে। কিন্তু তাতে চিত্ত ভরল না সিদ্ধার্থের। একদিন বিদায় নিয়ে পথ চলতে-চলতে সে পৌঁছল এক নদীর ধারে। সেখানে খেয়াতরীর মাঝির সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হলো তার। সে মাঝিই তাকে বলে দিল জীবন হচ্ছে চিরপ্রবহমান নদীর মতো। এইখানে এসে আমার কাঁপুনি থেমে গিয়েছিল। তখন নিরাশ কি হয়েছিলাম, না কি জেনে শান্ত যে, তাই তো, তাই তো, অন্যরকম উত্তর পেলে তো হেরমান হেসকেই ছুঁড়ে ফেলতে হতো, মনে পড়ছে না। পরে অবশ্য এই চিন্তাই স্থিতি পেয়েছে যে, উত্তর তো এমনই প্রত্যাশিত। নদী চলেছে বহে। জীবনও সেইমতো। শান্তি যদি পাও এতে, পাবে, না হলে পাবে না।

bvc
কৃতজ্ঞতায়ঃ আলতাফ হোসেন।
অবাক বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য। পদ্মা পাড়ের মানুষ ব্লগ থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

যুবক রবি অন্য রবি ছিন্নপত্রে ১ম পর্ব … আলতাফ হোসেন


ছিন্নপত্রে কীভাবে এমন পরিণত ও আধুনিকমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই তার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি, পাঠাভ্যাস ও প্রকৃতি প্রেমের কথা জেনে ছিলাম। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি সেটি হচ্ছে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর তথা বুড়ির প্রতি রবীন্দ্রনাথের অপ্রতিরোধ্য টান। অন্য কারো সাক্ষ্য মানার দরকার নেই, চিঠিগুলো পড়তে-পড়তে যে কেউ দেখতে পাবেন, ‘যার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে প্রাণ সঞ্চয় করা যায়’। তিনি ছিলেন প্রাপয়িত্রী ইন্দিরা দেবী স্বয়ং। তার মধ্যে তরুণ কাকা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ‘বেশ একটু পরিণত মনুষ্যত্ব।’

“আমি অন্তরে অসভ্য, অভদ্র। আমার জন্য কোথাও কি একটা ভারি সুন্দর অরাজকতা নেই? কতকগুলো খ্যাপা লোকের আনন্দমেলা নেই?”

১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর উদ্দেশে একটি চিঠিতে এই পঙ্ক্তি ক’টি লিখে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর মনে হবে কী বকছেন তিনি!

আজ ২০১০ সালেও ক’জন বাঙালি কবি সাহিত্যিক এমন করে পারবেন বলতে? যদি হঠাৎ বলেও ফেলেন ‘অসভ্য, অভদ্র’ নিজেকে, লজ্জা পেয়ে যাবেন হয়তো, ভাববেন- যে কী বকছেন তিনি !!

১১৮ বছর পরও আমরা কি আছি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে?

“মানুষ কি লোহার কল যে ঠিক নিয়ম অনুসারে চলবে? মানুষের মনের এত বিচিত্র এবং বিস্তৃত কাণ্ড-কারখানা। তার এত দিকে গতি। এবং এত রকমের অধিকার যে এ দিকে-ও দিকে হেলতেই হবে। সেই তার জীবনের লক্ষণ, তার মনুষ্যত্বের চিহ্ন, তার জড়ত্বের প্রতিবাদ। এই দ্বিধা, এই দুর্বলতা যার নেই তার মন নিতান্ত সংকীর্ণ এবং কঠিন এবং জীবনবিহীন। যাকে আমরা প্রবৃত্তি বলি এবং যার প্রতি আমরা সর্বদাই কটুভাষা প্রয়োগ করি সেই তো আমাদের জীবনের গতিশক্তিঃ।”

ভাইঝি ইন্দিরার উদ্দেশে যুবক রবির এই চিঠি ১৮৯০ সালের ১০ই অক্টোবর লেখা। কিন্তু এইসব এ কালেরই কথা। চিরকালেরই কথা আসলে, কিন্তু এখনও আমরা ততটা অভ্যস্ত হতে পারিনি এমন কথায়। দ্বিধা-দুর্বলতাকে মেনে নিতে আমাদের এখনও চরম আপত্তি। একই রকম উপলব্ধি হলেও দু-একজন বাদে আমাদের লিখকরা এমন কথা লিখার মতো সৎ বা সাহসী হন না। তাই যেতে ইচ্ছা হয় কখনো-কখনো আর সব লেখককে এক পাশে সরিয়ে রেখে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ সালের যুবক রবীন্দ্রনাথের কাছে। যখন তাঁর বয়স ২৬ থেকে ৩৪। ভেবে অবাকই লাগে, যখন তাঁর চারপাশের লিখার জগতে চিন্তার জগতে কূপমণ্ডুকতা, হিংসা-দ্বেষ আর কুটিলতা (দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে চাইলে অনেক পৃষ্ঠার এক বই লিখতে হবে) তখন রবীন্দ্রনাথের মাথায় কী করে প্রবেশ করেছিল আভঁ-গার্দের আলো? একটি কারণ যদি অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি বা গভীর উপলব্ধি শক্তি হয়ে থাকে, অন্যটি নিশ্চয় পড়াশোনা। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতি প্রীতি। শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়র’ লেখা হয়েছিল আরও অনেক বছর আগে, যাতে রয়েছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা, সংশয়, প্রকৃত বাস্তব তথা অধিকতর বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার উপাদান। হ্যামলেট নাটকেও আমরা পেয়েছি প্রাজ্ঞ নায়কের প্রচণ্ড দ্বিধাপীড়িত কাতরতার চালচিত্র। জীবনের নিরর্থকতা, হাস্যকরতা নিয়েও বহুকাল ধরেই কবিতা, গান, নকশা-পালা লেখা হয়ে আসছিল বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই তার কিছু বয়ান। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় কি পড়েছিল ছাপ খানিকটা সে বোধের-ভাবনারও? ১৮৯১ সালের ২০ জুন যুবা রবীন্দ্রনাথের কলমে এসেছিল এই পংক্তিগুলো :

“আমি তো পূর্বেই বলেছি জীবনটা একটা গম্ভীর বিদ্রুপ, এর মজাটা একটু বোঝা শক্ত। কারণ যাকে নিয়ে মজা করা হয়, মজার রসটা সে তেমন গ্রহণ করতে পারে না। এই মনে করো দুপুর রাত্রে খাটে শুয়ে আছি, হঠাৎ পৃথিবীটা ধরে এমনি নাড়া দিলে যে কে কোথায় পালাবে পথ পায় না। মতলবটা খুব নতুন রকমের এবং মজাটা খুব আকষ্মিক তার আর সন্দেহ নেই। বড়ো বড়ো সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদের অর্ধেক রাত্রে উর্দ্ধশ্বাসে অসম্বৃত অবস্থায় বিছানার বাইরে দৌঁড় করানো কি কম কৌতুক ! এবং দুটো-একটা সদ্যোনিদ্রোত্থিত হতবুদ্ধি নিরীহ লোকের মাথার উপরে বাড়ির আস্ত ছাদটা ভেঙে আনা কি কম ঠাট্টা! হতভাগ্য লোকটা যেদিন ব্যাংকে চেক লিখে রাজমিস্ত্রীর বিল শোধ করছিল, রহস্যপ্রিয়া প্রকৃতি সেইদিন বসে কত হেসেছিল!”

লক্ষ্য করা যায়, রবীন্দ্রনাথ এখানে রহস্যপ্রিয়া প্রকৃতির কথা বলেছেন, ঈশ্বরের কথা নয়। তবে জীবনটাকে যে ‘একটা গম্ভীর বিদ্রুপ’ বলেছেন তিনি, বলতে পেরেছেন একশো বছরেরও আগে এটাই আমাদের মনে বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। পরের দিনের পরের দিন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:

“এক দল আছে তারা ছটফট করে ‘জগতের সকল কথা জানতে পারছি নে কেন’, আর এক দল ছটফটিয়ে মরে ‘মনের সকল ভাব প্রকাশ করতে পারছি নে কেন’। মাঝের থেকে জগতের কথা জগতেই থেকে যায় এবং অন্তরের কথা অন্তরেই থাকে।”


কৃতজ্ঞতায়ঃ আলতাফ হোসেন।
অবাক বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য। পদ্মা পাড়ের মানুষ ব্লগ থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারীর নাম কোথায়?

১৯৫০ সাল।
তখন ঢাকার ১৫০ নাম্বার পুরোনো মোঘলটুলি ছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কেন্দ্র বিন্দু। সেখানে সবার মধ্যে সততায়, সত্যবাদিতায়, স্বকীয়তায় তাজউদ্দিন ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন, আস্থাভাজন। চিন্তায়, কর্মে এবং দৃঢ়তায় তাজউদ্দিন সব সময়ই ছিলেন, কোনো স্বার্থ বুদ্ধি, কোনো অসৎ চিন্তা অথবা তার মধ্যে কোনো অবসাদ ছিলোনা।

সত্তরের নির্বাচনের সময়ই হোক, কি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই হোক অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন দেশ সেবায় সব সময় একই রকম তাঁর ভূমিকা রেখেছেন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শক্তিশালী সাধারণ সম্পাদক ফকির আব্দুল মান্নানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন তাজউদ্দিন। জয়লাভ করলেন। সেই তাঁর জয়যাত্রা। সেই থেকে গণআন্দোলনের পুরো ভাগে তিনি শেখ মুজিবের দক্ষিণ হস্ত। শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিনের মিলনে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। শেখ মুজিবের কারিশমা এবং তাজউদ্দিনের বুদ্ধিমত্তা আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের আশা আকাঙ্খার বাহনে রূপান্তরিত করলো। গনআন্দোলনের মুখে আইউব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরন্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নৃশংস ভাবে মানুষ হত্যা শুরু করলে অত্যাচার, হত্যা, লুন্ঠনে মানুষ দিশাহারা, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়। জাতি বুঝতে পারছিল ধ্বংসের এখানেই শেষ নয়, আরো ধ্বংস বাকী আছে। সেই দিনগুলোতে তাজউদ্দিন শক্ত হাতে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে, বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামকে, বাংলার চেতনাকে উদ্দীপ্ত রাখার জন্য শপথ গ্রহণ করলেন। অসীম সাহসিকতায়, ধৈর্য্য- শক্তি ও ত্যাগ নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকার গঠন করতে পেরেছিলেন।

এক কোটি শরনার্থীর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাংলার এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা আদায় করেছিলেন তাজউদ্দিন। তাজউদ্দিনের আশেপাশে বহু সদস্য, নেতা কর্মী ছিলেন কিন্তু স্বাধীনতার জন্য তাজউদ্দিনের একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এক অনন্য সাধারণ ঘটনা।

১৯৭৪ এর ২৬শে অক্টোবর তাজউদ্দিন অর্থমন্ত্রীর পদ ছাড়লেন। ডঃ কামাল হোসেন তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। আসলে শেখ মুজিব বনাম তাজউদ্দিনের যে সংঘাত, সেই সংঘাতে তাজউদ্দিনের কিছুই করার ছিল না। তাজউদ্দিন কারো কাছে কোন দিন নালিশও করেননি, কারো কাছে কোনো দিন আফসোসও করেননি। কিন্তু তারপরও তাঁকে জীবন দিতে হলো? তাজউদ্দিন কারাগারে নিহত হলেন। ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ এ।

তাজউদ্দীনের হাতে গড়া বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গত উনচল্লিশ বছরে একে একে কত কিছু হলো! সরকারের অদল- বদল, সরকার টিকিয়ে রাখবার কলা, কৌশলে চরিত্র হনন করা হলো। বাংলাদেশের যে মূল্যবোধ ছিলো তা একেবারেই জলাঞ্জলি দেয়া হলো। সেই মূল্যবোধ চরিত্র কোথা থেকে আসবে? এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
ভাষা আন্দোলনের কথাও বিকৃতির হাত থেকে রেহাই পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হলো হাইজ্যাক। যদি সম্ভব হতো তাজউদ্দিনকে সুযোগ দিলে আবার সে দৃঢ় হাতে, স্থির বুদ্ধিতে পারতেন আমাদেরকে কলংকের হাত থেকে রক্ষা করে মহিমান্বিত করে তুলতে। কিন্তু হায়! সেই মুক্তিযুদ্ধের নাম কোথায়? যোগ্য সন্মান, প্রাপ্তি, আমরা দিয়েছি কি তাকে?

কিন্তু ধন্য তাজউদ্দিন, সে তো জাতির পতাকা দিয়ে গেল। এখন যারা জাতির নেতৃত্বে আছেন, ক্ষমতায় আসীন তারা সেই পতাকাকে সমুন্নত রাখুন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করুন, কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটান। তবুও তো তাজউদ্দিনের প্রতি দেশের ঋণ কিছু শোধ হবে।


তথ্যঃ জমীরুদ্দীন আহমেদ। মালয়েশিয়া ও লিবিয়ায় নিযুক্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত।