বিভাগের আর্কাইভঃ ব্যক্তিত্ব

শ্রী রবীন্দ্রনাথের ১৫২ তম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা ২


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২ তম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা’র প্রথম অংশ।

বিশ্বভ্রমণঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ।

SUBHA  5 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশী দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথম জীবনে দু-বার (১৮৭৮ ও ১৮৯০) তিনি ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯১২ সালে তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটস প্রমুখ ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান। এই পাঠ শুনে তাঁরাও কবির গুণমুগ্ধে পরিণত হন। ইয়েটস স্বয়ং উক্ত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের সময়েই “দীনবন্ধু” চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৯১৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কতকগুলি বক্তৃতা দেন। ১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে। এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদ বিরোধী বক্তৃতা দেন কবি। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান। পরে পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণ করেন। উভয় দেশের সরকারই কবির ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বভারতীকে ১,০০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য প্রদান করেছিল। ১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেও, পরে লোকমুখে তাঁর স্বৈরাচারের কথা জানতে পেরে, মুসোলিনির কাজকর্মের সমালোচনা করেন কবি। এর ফলে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছেদ পড়ে। এরপর রবীন্দ্রনাথ গ্রীস, তুরস্ক ও মিশর ভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন।

SUBHA 6 ১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। ১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর তিনি ভ্রমণ করেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবি। এরপর ১৯৩৪ সালে সিংহলে যান রবীন্দ্রনাথ। এটিই ছিল তাঁর সর্বশেষ বিদেশ সফর।

রবীন্দ্রনাথ যে সকল বইতে তাঁর বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন সেগুলি হল: য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি (১৮৯১, ১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরী ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)। ব্যাপক বিশ্বভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ অঁরি বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ তাঁর সমসাময়িক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। জীবনের একেবারে শেষপর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়েছিল মাত্র। এবং বিশ্ব পরিক্রমার ফলে ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে পরিচিত করে তোলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়ের সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি।

সৃষ্টিকর্মঃ এই বিষয়ে মূল নিবন্ধের জন্য দেখুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম।

428755_167793793385299_85034388_n রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মূলত কবি। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশ। তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা মূলত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ দুই সহস্রাধিক গান লিখেছিলেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, শতাধিক গল্প-ছোটগল্প, দুই শতাধিক প্রবন্ধ, ত্রিশটিরও বেশি নাটক লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র উনিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বহু রচনা আজও অপ্রকাশিত। নৃত্য বিষয়েও রবীন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। নৃত্যকলা নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র নৃত্যশৈলী উদ্ভব করেছিলেন। এই শৈলীটি “রবীন্দ্রনৃত্য” নামে পরিচিত।

SUBHA 7 কবিতাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুকরণে কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন। বিহারীলাল-অনুসারী কবি হিসেবে তিনি কবিকাহিনী, বনফুল ও ভগ্নহৃদয় কাব্য তিনটি রচনা করেন। সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পর্বের সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান ও কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষযবস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী এবং তার পর প্রকাশিত সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কল্পনা ও ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি কাব্যগ্রন্থে। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলে বলাকা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিবর্তে আবার মর্ত্য জীবন সম্পর্কে আগ্রহ ফুটে ওঠে। পলাতকা কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারী জীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। পূরবী ও মহুয়া কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রেমকে উপজীব্য করেন। এরপর পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী নামে চারটি গদ্যকাব্য প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষযবস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়কার রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনে ও শেষ লেখা (মরণোত্তর প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফূট করেছিলেন তিনি। শেষ কবিতা “তোমার সৃষ্টির পথ” মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, উপনিষদ্‌, কবীরের দোঁহাবলি, লালনের বাউল গান ও রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষিত হয়। তবে প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি এক সহজ ও সরস কাব্যরচনার আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন। আবার ১৯৩০-এর দশকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালিখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন কবি। বহির্বিশ্বে তাঁর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হলো গীতাঞ্জলি। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি “গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ” রূপে।

ছোটগল্পঃ

SUBHA 8 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রণী ছোটগল্প রচয়িতা। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন। এই গল্পগুলির উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের “সাধনা” পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর গল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটির গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে) তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল “কঙ্কাল”, “নিশীথে”, “মণিহারা”, “ক্ষুধিত পাষাণ”, “স্ত্রীর পত্র”, “নষ্টনীড়”, “কাবুলিওয়ালা”, “হৈমন্তী”, “দেনাপাওনা”, “মুসলমানীর গল্প” ইত্যাদি। শেষ জীবনী রবীন্দ্রনাথ লিপিকা, সে ও তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যান ধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন। কখনও তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকেই গল্পে বেশি প্রাধান্য দিতে।

রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা (“মনিহারা”, “পোস্টমাস্টার” ও “সমাপ্তি” অবলম্বনে) ও চারুলতা (“নষ্টনীড়” অবলম্বনে), তপন সিংহ পরিচালিত কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ, পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি।

SUBHA 9 উপন্যাসঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হলো: বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ দুটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা। এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলিও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজ পত্র, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

চোখের বালি উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সম-সাময়িককালে বিধবাদের জীবনের নানা সমস্যা। নৌকাডুবি উপন্যাসটি আবার লেখা হয়েছে জটিল পারিবারিক সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে। গোরা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত ও ভারতের তদনীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি। ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী যোগাযোগ উপন্যাসেও। চতুরঙ্গ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের “ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস”। স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি – এই বিষয়টিকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ দুই বোন ও মালঞ্চ উপন্যাস দুটি লেখেন। এর মধ্যে প্রথম উপন্যাসটি মিলনান্তক ও দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক। রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস চার অধ্যায় সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে ও ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি।

প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্যঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বহু প্রবন্ধ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজ চিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি সমাজ (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে কালান্তর (১৯৩৭) সংকলনে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ধর্ম (১৯০৯) ও শান্তিনিকেতন (১৯০৯-১৬) অভিভাষণ মালায়। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ভারতবর্ষ (১৯০৬), ইতিহাস (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে। সাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্যের পথে (১৯৩৬) ও সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন যথাক্রমে প্রাচীন সাহিত্য (১৯০৭) ও আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭) গ্রন্থদুটিতে। লোকসাহিত্য (১৯০৭) প্রবন্ধমালায় তিনি আলোচনা করেছেন বাংলা লোকসাহিত্যের প্রকৃতি। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে শব্দতত্ত্ব (১৯০৯), বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮) ইত্যাদি গ্রন্থে। ছন্দ ও সংগীত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে ছন্দ (১৯৩৬) ও সংগীতচিন্তা (১৯৬৬) গ্রন্থে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা (১৯০৮) প্রবন্ধমালায়। ন্যাশনালিজম (ইংরেজি: Nationalism, ১৯১৭) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে তার বিরোধিতা করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন বিষয়ে যে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি রিলিজিয়ন অফ ম্যান (ইংরেজি: Religion of Man, ১৯৩০; বাংলা অনুবাদ মানুষের ধর্ম, ১৯৩৩) নামে সংকলিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ সভ্যতার সংকট (১৯৪১) তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭) নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। জীবনস্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০) ও আত্মপরিচয় (১৯৪৩) তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী (ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা), ভানুসিংহের পত্রাবলী (রানু অধিকারীকে (মুখোপাধ্যায়) লেখা) ও পথে ও পথের প্রান্তে (নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা) বই তিনটি রবীন্দ্রনাথের তিনটি উল্লেখযোগ্য পত্র সংকলন।

SUBHA 10 নাট্যসাহিত্যঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত হঠাৎ নবাব নাটকে (মলিয়ের লা বুর্জোয়া জাঁতিরোম অবলম্বনে রচিত) ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই অলীকবাবু নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকি-প্রতিভা মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে কালমৃগয়া নামে আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন। এই নাটক মঞ্চায়নের সময় তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

গীতিনাট্য রচনার পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কাব্যনাট্য রচনা করেন। শেক্সপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর রাজা ও রাণী (১৮৮৯) ও বিসর্জন (১৮৯০) বহুবার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় এবং তিনি নিজে এই নাটকগুলিতে অভিনয়ও করেন। ১৮৮৯ সালে রাজা ও রাণী নাটকে বিক্রমদেবের ভূমিকায় করেন রবীন্দ্রনাথ। বিসর্জন নাটকটি দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চায়িত করেছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালের মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কাব্যনাট্য পর্বে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) ও মালিনী (১৮৯৬)।

কাব্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ প্রহসন রচনায় মনোনিবেশ করেন। এই পর্বে প্রকাশিত হয় গোড়ায় গলদ (১৮৯২), বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭), হাস্যকৌতুক (১৯০৭) ও ব্যঙ্গকৌতুক (১৯০৭)। বৈকুণ্ঠের খাতা নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি প্রজাপতির নির্বন্ধ উপন্যাসটিকেও চিরকুমার সভা নামে একটি প্রহসনমূলক নাটকের রূপ দেন।

SUBHA 11 ১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রূপক- সাংকেতিক তত্ত্বধর্মী নাট্যরচনা শুরু করেন। ইতিপূর্বে প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪) নাটকে তিনি কিছুটা রূপক-সাংকেতিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে একের পর এক নাটক তিনি এই আঙ্গিকে লিখতে শুরু করেন। এই নাটকগুলি হল: শারদোৎসব (১৯০৮), রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), অচলায়তন (১৯১২), ফাল্গুনী (১৯১৬), মুক্তধারা (১৯২২), রক্তকরবী (১৯২৬), তাসের দেশ (১৯৩৩), কালের যাত্রা (১৯৩২) ইত্যাদি। এই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল গড়ে মঞ্চস্থ করতেন। কখনও কখনও কলকাতায় গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন তিনি। এই সব নাটকেও একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯১১ সালে শারদোৎসব নাটকে সন্ন্যাসী এবং রাজা নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৪ সালে অচলায়তন নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৫ সালে ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৭ সালে ডাকঘর নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয়। নাট্যরচনার পাশাপাশি এই পর্বে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয়ের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পুরনো নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ করে নতুন নামে প্রকাশ করেন। শারদোৎসব নাটকটি হয় ঋণশোধ (১৯২১), রাজা হয় অরূপরতন (১৯২০), অচলায়তন হয় গুরু (১৯১৮), গোড়ায় গলদ হয় শেষরক্ষা (১৯২৮), রাজা ও রাণী হয়তপতী (১৯২৯) এবং প্রায়শ্চিত্ত হয় পরিত্রাণ (১৯২৯)।

১৯২৬ সালে নটীর পূজা নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে “নৃত্যনাট্য” নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। নটীর পূজা নৃত্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ একে একে রচনা করেন শাপমোচন (১৯৩১), তাসের দেশ (১৯৩৩), নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (১৯৩৮) ওশ্যামা (১৯৩৯)। এগুলিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাই প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন।

সংগীত ও নৃত্যকলাঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রসংগীত।

SUBHA 12 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় ২,২০০ গান রচনা করেছিলেন। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত, বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন। তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে। এই গ্রন্থের “পূজা”, “প্রেম”, “প্রকৃতি”, “স্বদেশ”, “আনুষ্ঠানিক” ও “বিচিত্র” পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়। পরে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয়েছিল। ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে বাল্মীকি-প্রতিভা, কালমৃগয়া গীতিনাট্য এবং চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, ও শ্যামা সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।

রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ও ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন। এই শৈলীটি “রবীন্দ্রনৃত্য” নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তার পিছনেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল।

চিত্রকলাঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। প্রথম দিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর, যার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য চিত্রকলার পুনরুত্থানে আগ্রহী হলেও, তাঁর নিজের ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মূলত কালিকলমে আঁকা স্কেচ, জলরং ও দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, নিসর্গদৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। নন্দনতাত্ত্বিক ও বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর চিত্রকলা বেশ অদ্ভুত ধরনেরই বলে মনে হয়। তবে তিনি একাধিক অঙ্কনশৈলী রপ্ত করেছিলেন। তন্মধ্যে, এর কয়েকটি শৈলী হলো – নিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্প, কানাডার (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ) পশ্চিম উপকূলের “হাইদা” খোদাইশিল্প ও ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প।

রাজনৈতিক মতাদর্শঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ।

SUBHA  13 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করতেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে “চরকা-সংস্কৃতি” বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য” ও “একলা চলো রে” রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। “একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর “তোতা-কাহিনী” গল্পে বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, দেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কিভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে বের করে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও এই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি। ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্বভারতী নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের। বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে। নিজেও শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।

SUBHA 14 প্রভাবঃ বিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা দার্শনিক অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথকে এক “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ও “গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে “ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি” হিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী “পঁচিশে বৈশাখ” ও প্রয়াণবার্ষিকী “বাইশে শ্রাবণ” আজও বাঙালি সমাজে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এই উপলক্ষ্যেজোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, শান্তিনিকেতন আশ্রম ও শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হয়। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত ধর্মীয় ও ঋতু উৎসবগুলির মাধ্যমেও তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি অক্ষুন্ন আছে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে ও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা রবীন্দ্ররচনা পাঠের রেওয়াজও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এগুলি ছাড়াও কবির সম্মানে আরও কতকগুলি বিশেষ ও অভিনব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের আরবানাতে আয়োজিত বার্ষিক “রবীন্দ্র উৎসব”, কলকাতা-শান্তিনিকেতন তীর্থ-পদযাত্রা “রবীন্দ্র পথপরিক্রমা” ইত্যাদি।

SUBHA 15 জীবদ্দশাতেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংল্যান্ডে ডার্টিংটন হল স্কুল নামে একটি প্রগতিশীল সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অনেজ জাপানি সাহিত্যিককে তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলী অনূদিত হয় ইংরেজি, ওলন্দাজ, জার্মান, স্প্যানিশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। চেক ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেনসি সহ একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদ্, রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা , প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত একেভিত, মার্কিন ঔপন্যাসিক জোনা গেইল সহ অনেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তাঁর ভাষণগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পায়। তবে কয়েকটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে জাপান ও উত্তর আমেরিকায় তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কালক্রমে বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ “প্রায় অস্তমিত” হয়ে পড়েছিলেন।

চিলিয়ান সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা ও গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মেক্সিকান লেখক অক্টাভিও পাজ ও স্প্যানিশ লেখক হোসে অরতেগা ওয়াই গ্যাসেৎ, থেনোবিয়া কামপ্রুবি আইমার, ও হুয়ান রামোন হিমেনেথ প্রমুখ স্প্যানিশ-ভাষী সাহিত্যিকদেরও অনুবাদের সূত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হিমেনেথ-কামপ্রুবি দম্পতি রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন। দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথ) সহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু রচনার বিস্তারিত পর্যালোচনা ও স্প্যানিশ সংস্করণ প্রকাশও করেছিলেন তাঁরা। এই সময়েই হিমেনেথ “নগ্ন কবিতা” (স্প্যানিশ: poesia desnuda) নামে এক বিশেষ সাহিত্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটান।

রবীন্দ্রনাথের মূল বাংলা কবিতা পড়েননি এমন বহু পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব অস্বীকারও করেছিলেন। গ্রাহাম গ্রিন সন্দিগ্ধচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, “ইয়েটস সাহেব ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন না।” রবীন্দ্রনাথের সম্মানের কিছু পুরনো লাতিন আমেরিকান খণ্ডাংশ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নিকারাগুয়া ভ্রমণের সময় সালমান রুশদি এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখে অবাক হন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামাঙ্কিত স্মারক ও দ্রষ্টব্যস্থলঃ
■ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গন।
■ রবীন্দ্র পুরস্কার — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার।
■ রবীন্দ্রসদন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত কলকাতার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান কার্যালয়।
■ রবীন্দ্র সেতু — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত হাওড়া ও কলকাতা শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতু।
■ রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত ভারতের একটি জাতীয় হ্রদ। এটি কলকাতার বৃহত্তম হ্রদ।
অতিরিক্ত ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং কৃতজ্ঞতা : সুব্রত হোতা।

79596_n

httpv://youtu.be/vD8GeZ7jnEo
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পূণ্য করো দহন- দানে।

ফেসবুক লিঙ্ক : আজাদ কাশ্মীর জামান।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনপঞ্জিকা …

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন

রবীন্দ্রনাথ কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ জীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।

রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারনকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেব বিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথে গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর রচিত আমার সোনার বাংলা ও জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে গান দুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত।

জীবনঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)

SUBHA  2 শৈশব ও কৈশোর (১৮৬১ – ১৮৭৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬–১৮৭৫)। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা। ১৮৭৫ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় তাঁর মন না বসায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ।

১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি দেখেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনী, কালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য ও নাটক এবং উপনিষদ পাঠেও উৎসাহিত করতেন। ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলো হলো মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ এবং ‘ভিখারিণী’ ও করুণা নামে দুটি গল্প। এগুলির মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলির অনুকরণে “ভানুসিংহ” ভণিতায় রচিত। রবীন্দনাথের ‘ভিখারিণী’ গল্পটি (১৮৭৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথক কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ কবিকাহিনী। এই পর্বে তিনি রচনা করেছিলেন সন্ধ্যাসংগীত (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থটি। বিখ্যাত কবিতা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

SUBHA  3a যৌবন (১৮৭৮-১৯০১) ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইন বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেক্সপিয়ার ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। এই সময় তাঁর ইংল্যান্ড বাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। পত্রিকায় এই লেখাগুলি জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনাসহ প্রকাশিত হত য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা নামে। ১৮৮১ সালে সেই পত্রাবলি য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ। শেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।

১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ )। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর পাঁচটি সন্তান হয়েছিল: মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) ও শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)। এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।

robi2 ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া (নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা), পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে “পদ্মা” নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। গ্রামবাসীরাও তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করতো।

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের অপর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয়। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ও গীতিসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি হল প্রভাতসংগীত, শৈশবসঙ্গীত, রবিচ্ছায়া, কড়ি ও কোমল ইত্যাদি। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত নিজের সম্পাদিত সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্যজীবনের এই পর্যায়টি তাই “সাধনা পর্যায়” নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ গ্রন্থের প্রথম চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই এই পর্যায়ের রচনা। এই ছোটগল্প গুলিতে তিনি বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের এক আবেগময় ও শ্লেষাত্মক ছবি এঁকেছিলেন।

মধ্য জীবনঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯০১–১৯৩২)

১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে। এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ বা ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান। ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।

এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করেন আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এই সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পুত্র ও জামাতার বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভারও রবীন্দ্রনাথকে বহন করতেন। এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর গয়না ও পুরীর বসতবাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হন।

ইতিমধ্যেই অবশ্য বাংলা ও বহির্বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে প্রদান করে। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে “স্যার” উপাধি (নাইটহুড) দেয়।

১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের আরও কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ “পল্লী সংগঠন কেন্দ্র” নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন “শ্রীনিকেতন”। শ্রীনিকেতন ছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রতীক ও প্রতিবাদ সর্বস্ব স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর আন্দোলনের পন্থাটির বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীকালে দেশ ও বিদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞ, দাতা ও অন্যান্য পদাধিকারীরা শ্রীনিকেতনের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।

১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

শেষ জীবনঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯৩২–১৯৪১)

জীবনের শেষ দশকে ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর এই সময়কার কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী ও পত্রপুট (১৯৩৬) – এই গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি। জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এই পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসল হল তাঁর একাধিক গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬; চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ), শ্যামা (১৯৩৯) ও চণ্ডালিকা (১৯৩৯) নৃত্যনাট্যত্রয়ী। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাসও দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) এই পর্বে রচনা করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ ছবি জীবনের এই পর্বেই আঁকা। সঙ্গে সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়। এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলো সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও। সে (১৯৩৭), তিন সঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে। পরবর্তীতে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং সমাদৃত হয়।

জীবনের এই পর্বে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে গান্ধীজি “ঈশ্বরের রোষ” বলে অভিহিত করলে, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির এহেন বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেন। কলকাতার সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের দ্রুত আর্থসামাজিক অবক্ষয় তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। গদ্যছন্দে রচিত একটি শত-পঙক্তির কবিতায় তিনি এই ঘটনা চিত্রায়িতও করেছিলেন।

জীবনের শেষ চার বছর ছিল তাঁর ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ের মধ্যে দুই বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির। সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি। এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যু চেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

httpv://youtu.be/vD8GeZ7jnEo
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পূণ্য করো দহন- দানে।
বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন : সুব্রত হোতা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২ তম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা শেষ অংশ।

ফেসবুক লিঙ্ক : আজাদ কাশ্মীর জামান।

মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারির নাম কোথায়?

১৯৫০ সাল।
তখন রাজধানী ঢাকার ১৫০ নাম্বার পুরোনো মোগলটুলি ছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের কেন্দ্র বিন্দু। সেখানে সবার মধ্যে সততায়, সত্যবাদিতায়, স্বকীয়তায় তাজউদ্দিন ছিলেন সবার শ্রদ্ধাভাজন, আস্থাভাজন। চিন্তায়, কর্মে এবং দৃঢ়তায় তাজউদ্দিন সব সময়ই ছিলেন, কোনো স্বার্থ বুদ্ধি, কোনো অসৎ চিন্তা অথবা তার মধ্যে কোনো অবসাদ ছিলো না।

সত্তরের নির্বাচনের সময়ই হোক, কি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই হোক অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন দেশ সেবায় সব সময় একই রকম তাঁর ভূমিকা রেখেছেন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শক্তিশালী সাধারণ সম্পাদক ফকির আব্দুল মান্নানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন তাজউদ্দিন। জয়লাভ করলেন। সেই তাঁর জয়যাত্রা। সেই থেকে গণআন্দোলনের পুরো ভাগে তিনি শেখ মুজিবের দক্ষিণ হস্ত। শেখ মুজিব এবং তাজউদ্দিনের মিলনে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। শেখ মুজিবের কারিশমা এবং তাজউদ্দিনের বুদ্ধিমত্তা আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের আশা আকাঙ্খার বাহনে রূপান্তরিত করলো। গণআন্দোলনের মুখে আইউব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ইয়াহিয়া নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নৃশংস ভাবে মানুষ হত্যা শুরু করলে অত্যাচার, হত্যা, লুণ্ঠনে মানুষ দিশাহারা, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়। জাতি বুঝতে পারছিল ধ্বংসের এখানেই শেষ নয়, আরো ধ্বংস বাকী আছে। সেই দিনগুলোতে তাজউদ্দিন শক্ত হাতে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে, বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামকে, বাংলার চেতনাকে উদ্দীপ্ত রাখার জন্য শপথ গ্রহণ করলেন। অসীম সাহসিকতায়, ধৈর্য্য- শক্তি ও ত্যাগ নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকার গঠন করতে পেরেছিলেন।

এক কোটি শরণার্থীর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাংলার এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা আদায় করেছিলেন তাজউদ্দিন। তাজউদ্দিনের আশেপাশে বহু সদস্য, নেতা কর্মী ছিলেন কিন্তু স্বাধীনতার জন্য তাজউদ্দিনের একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এক অনন্য সাধারণ ঘটনা।

১৯৭৪ এর ২৬শে অক্টোবর তাজউদ্দিন অর্থমন্ত্রীর পদ ছাড়লেন। ডঃ কামাল হোসেন তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। আসলে শেখ মুজিব বনাম তাজউদ্দিনের যে সংঘাত, সেই সংঘাতে তাজউদ্দিনের কিছুই করার ছিল না। তাজউদ্দিন কারো কাছে কোন দিন নালিশও করেননি, কারো কাছে কোনো দিন আফসোসও করেননি। কিন্তু তারপরও তাঁকে জীবন দিতে হলো? তাজউদ্দিন কারাগারে নিহত হলেন। ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ এ।

তাজউদ্দীনের হাতে গড়া বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গত একচল্লিশ বছরে একে একে কত কিছু হলো! সরকারের অদল- বদল, সরকার টিকিয়ে রাখবার কলা, কৌশলে চরিত্র হনন করা হলো। বাংলাদেশের যে মূল্যবোধ ছিলো তা একেবারেই জলাঞ্জলি দেয়া হলো। সেই মূল্যবোধ চরিত্র কোথা থেকে আসবে? এর ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
ভাষা আন্দোলনের কথাও বিকৃতির হাত থেকে রেহাই পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হলো হাইজ্যাক। যদি সম্ভব হতো তাজউদ্দিনকে সুযোগ দিলে আবার সে দৃঢ় হাতে, স্থির বুদ্ধিতে পারতেন আমাদেরকে কলংকের হাত থেকে রক্ষা করে মহিমান্বিত করে তুলতে। কিন্তু হায়! সেই মুক্তিযুদ্ধের নাম কোথায়? যোগ্য সন্মান, প্রাপ্তি, আমরা দিয়েছি কি তাকে?

কিন্তু ধন্য তাজউদ্দিন, সে তো জাতির পতাকা দিয়ে গেল। এখন যারা জাতির নেতৃত্বে আছেন, ক্ষমতায় আসীন তারা সেই পতাকাকে সমুন্নত রাখুন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করুন, কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটান। তবুও তো তাজউদ্দিনের প্রতি দেশের ঋণ কিছু শোধ হবে।

মাষ্টার দা সূর্যসেন চিরজীবি হোন

সূর্যসেন, মাষ্টার দা। ব্রিটিশ ভারতের প্রখ্যাত বিপ্লবী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনসহ বহুবিধ বিপ্লবের অধিনায়ক। এঁর পুরো নাম সূর্য কুমার সেন। সংক্ষেপে সূর্যসেন নামে অধিক পরিচিত। তবে মাষ্টার দা নামে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন। সূর্য সেন (জন্ম: ২২ মার্চ, ১৮৯৪ – মৃত্যু: ১২ জানুয়ারি, ১৯৩৪) (ইংরেজি: Surya Sen) বা সূর্যকুমার সেন, ডাকনাম কালু, যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নিজ জীবন বলিদান করেন।

কলকাতা মেট্রো সূর্য সেনের স্মরণে বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনটির নামকরণ করেছে “মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন”। এছাড়া তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়।

জন্ম ও শৈশব:
সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। দুই ছেলের নাম সূর্য ও কমল। চার মেয়ের নাম বরদা সুন্দরী, সাবিত্রী, ভানুমতি ও প্রমিলা। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমণি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন। সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ছাত্র এবং ধর্ম ভাবাপন্ন গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।

শিক্ষা জীবন:
তাঁর প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ.-তে ভর্তি হন। সে সময় আই.এ বা বর্তমানের এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফ. এ. পরীক্ষার নিয়ম ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি একই কলেজে বিএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিতাড়িত হন। ফলে, তাঁকে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়তে যেতে হয়। ১৯১৮ সালে তিনি বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারের বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি ‘মাস্টারদা’ হিসেবে পরিচিত হন।

বিবাহ:
বিপ্লবী ভাব ধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই তাঁর বিবাহের কথাবার্তা অভিভাবকরা তোলেন। অবশেষে তাঁর বড় ভাই শিক্ষক চন্দ্রনাথ সেন (সহোদর নয়) ও অন্যান্য আত্মীয়দের বিশেষ অনুরোধে ১৯১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্প দত্তকে বিয়ে করেন। আত্মীয়-স্বজনের চাপে বিয়ে করলেও মাস্টারদার মনে এ ধারণা বলবৎ ছিল যে, বিবাহিত জীবন তাকে কর্তব্য ভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। তার ফলে স্ত্রীর সংগে একদিন তিনি কথা পর্যন্ত বলেন নি। বিবাহের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যায় প্রথা প্রচলিত আছে, সেদিন তিনি তাঁর বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সংগে সহবাসে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং তারপর স্ত্রীর সাথে আর কোনদিন দেখা করেন নি।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজী স্বরাজ এনে দেওয়ার জন্য বিপ্লবীদের কাছ থেকে এক বৎসরের সময় চেয়ে নেন। তৎকালীন বিপ্লবীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী না হলেও গান্ধীজির কথায় অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অহিংস আন্দোলন এক বৎসরের ভিতর ভারতের স্বরাজ আনতে ব্যর্থ হলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় তিনি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এবং বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। এভাবেই তিনি খ্যাত হন মাস্টারদা নামে। এই বিদ্যালয়টিই পরে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে একপ্রান্তে বাটালি পাহাড় এলাকায় সরকারি রেলের টাকা লুণ্ঠন করে। এই লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন অনন্ত সিং, দেবেন দে ও নির্মল সেন। অম্বিকা চক্রবর্তী ও দলিলুর রহমান রেল ডাকাতির সতের হাজার টাকা নিয়ে অস্ত্র কেনার জন্য কলকাতায় চলে যান। সে সময় সুলুক বাহার এলাকায় ছিল বিপ্লবীদের সদর দপ্তর। ২৪শে ডিসেম্বর এই দফতরে পুলিশ হানা দেয়। এখান থেকে তাঁরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হলেও এঁরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এঁরা প্রথমে নগরকানা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলে মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী ও রাজেন দাস তাঁদের পকেটে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেই মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। উল্লেখ্য এঁরা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন, কিন্তু ভালো থাকার সময় সীমা পেরিয়ে যাওয়ার কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছিল। ফলে এই তীব্র বিষে খেয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতির মামলা রুজু করেছিল হয়েছিল। যতীন্দ্র মোহন এই মামলা পরিচালিত করেন এবং প্রায় ৯ মাস কারাবন্দী থাকার পর মামলা থেকে তাঁরা খালাস পান।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। এই কারণে ১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হয়। শুধু এক ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাস্টারদা কলকাতা শোভাবাজার আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ নিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। সূর্যসেন গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে একটা অপরিষ্কার ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে চায়ের কেতলি হাতে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। পুলিশ তাঁকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সাদাসিধেভাবে বলেন, বাবু লোকদের জন্য চা আনতে যাচ্ছেন। পুলিশের দারোগা কিছুক্ষণ জেরা করার পর সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু না পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন। এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ‘মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা’। এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত দুইবছর তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়।

১৯২৮ সালের শেষের দিকে তাঁর স্ত্রী পুষ্প কুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সূর্যসেন তাকে দেখতে আসার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তিনি জেল থেকে তিনি ছাড়া পান। কিন্তু তাঁকে নজরবন্দী রাখা হয়। বাড়ি পৌঁছার দিনে তাঁর স্ত্রী পুষ্প কুন্তলা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলেন। তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। এই সময় একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দেন এবং এর বিনিময়ে সংসারের খরচ ব্রিটিশ সরকার চালাবে বলে জানানো হয়। সূর্যসেন এর কোনো উত্তর দেন নি। সূর্যসেনের দাদা চন্দ্রনাথ সেন বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেন। এরপর একদিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান এবং কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন।

এরপর থেকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলে। মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই সময় তাঁদের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোষাক। তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন কয়েকটি রিভলবার এবং সাধারণ বন্দুক। অস্ত্রাগার ভেঙে তাঁরা মাস্কেট্রি রাইফেল, রিভলবার এবং কার্তুজ লাভ করেন। এই আক্রমণের শুরুতেই তাঁরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। ফলে আক্রমণের সময়, ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরের অন্য প্রান্তের সৈন্যদের কাছে এই আক্রমণের যথার্থ সংবাদ পাঠাতে ব্যর্থ হয়। এইউ সময় বিপ্লবীরা এত দ্রুত আক্রমণ করে দখল করে নেয় যে, সার্জেন্ট ব্লাকবার্ন, কলোন, সার্জেন্ট মেজর ফেরেল-সহ অনেক অফিসার প্রতিরোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এই মামলায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ১৪ আগষ্ট ১৯৩৩ সালে মামলার রায় ঘোষনা করে। এবং ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অস্তমিত হয় এক ইতিহাস।

মাষ্টার দা সূর্যসেন চিরজীবী হোন।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

আমার শেষ বাণী – আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার বন্ধু রূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো সময়।

কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্র্যহীন আমার এই জীবনের একঘেয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদিমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।

আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে– এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বন্দেমাতরম্।
চট্টগ্রাম কারাগার, ১১ জানুয়ারি ১৯৩৪ সকাল ৭টা।
তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল।

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে … স্বাধীনতার পতাকা হাতে সাম্য মুক্তির জন্য যাঁরা লড়ছেন কাজ করছেন – তাঁদের চেতনায় মাস্টারদা সূর্যসেন অমর হোন চিরজীবী থাকুন। জন্ম বার্ষিকীর এই দিনে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জিয়া রায়হান … প্রত্যয়ী এক শব্দ যোদ্ধার জন্মদিন আজ

shoykot

হে বন্ধু, সবার চেয়ে চিনি তোমাকেই এ কথায় পূর্ণ সত্য নেই। চিনি আমি সংসারের শত সহস্রেরে কাজের বা অকাজের ঘেরে নির্দিষ্ট সীমায় যারা স্পষ্ট হয়ে জাগে, সৌন্দর্যের যে- পাহারা জেগে রয়েছে অন্তঃপুরে সে আমারে নিত্য রাখে দূরে। তোমার মাঝে শিল্পী তার রেখে গেছে তর্জনীর মানা, সব নয় জানা। আজ কোন কথা নয়। নয় কোন স্বপ্নচারীর অসত্যের মুখভাষা। কেবলই ভালোবাসা। আজ তোমার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন।
birthday_124-2-1

zia1
যাও তুমি মিছিলে যাও।
আজ দাবী আদায়ের হরতাল।

সবুজ ঘেরা নির্জনে আজ না আসুক তোমার প্রিয়,
টি.এস.সি কিম্বা পাবলিক লাইব্রেরী কোথাও
তোমাকে খুঁজে পাবে না সে, কারণ
তুমি আজ মিছিলে যাবে
আজ যে দাবী আদায়ের হরতাল।

জানি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হবে সে
ক্লান্ত হবে তার দু’টি পা
তবু বলবো না তোমার ঠিকানা।

যদি আজ তোমাকে পেতে চায়
যদি তোমার কাছে আসতেই চায় – তবে
তবে জেনে নিক তোমার অবস্থান
চলন্ত ট্রাক, সশস্ত্র পুলিশ কিম্বা গোপন অস্ত্রের কাছে
ওরাই শুধু বলতে পারবে – আজ
তুমি কোথায় কেমন থাকবো কিম্বা আদৌ থাকবো কিনা।

যাও তুমি মিছিলে যাও। আজ দাবী আদায়ের হরতাল।

তুমি আমাদের অহংকার। তুমি আমাদের প্রিয় বান্ধব zia0005 জিয়া রায়হান।

special cake

58197_482521061800173_503856566_n zzzzia
538505_476286862423593_1045806040_n 269366_482587041793575_899911904_n

জিয়া রায়হান প্রত্যয়ী এক শব্দ যোদ্ধার জন্মদিন আজ। হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে জানাই আমাদের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা এবং সম্মান। পঞ্চাশ বসন্ত পেরিয়ে আজ যিনি একান্নয়। কথা বলেছেন অমিয় সব শব্দ ভাবনায়, ছবি এঁকেছেন হৃদয়ের তুলিতে, চোখ রেখেছেন আপনার চোখে। অসম্ভব সব সৃষ্টির অন্বেষণে আজন্ম অস্থির যে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। মা মাটি মানুষ এর প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রিত ডিজিটাল ক্যানভাসে। A day in the world আন্তর্জাতিক ছবি প্রতিযোগিতায় এনে দিয়েছো বিশ্বসেরা বাঙ্গালী ছবি’র বিরল সম্মান।
শুভ জন্মদিন বন্ধু। দেখা হোক শতাব্দীতে …।

তুমি যে ভাষাতেই কবিতা লিখো আমি পড়বো। সে যদি কবিতা হয়।
তুমি যে ভাষায় গান গাও, সুর তোলো – সে গান সে সুর – শুনবোই।
যে সুরে ও গীতিকায় হৃদয় হৃদয়ের সাথে কথা কয়।

happybirthdayblueflash
312hpdsga
raa

birthday cake ity
special cake
happ866
zia6
zia8
zia9zia9zia9zia9zia9zia9zia9zia9zia9
101010101010101010101010101010

জীবনের কর্মে এবং সাফল্যে থাকুন বেঁচে। আমাদের সকলের শুভেচ্ছা ভালোবাসা সর্বোপরি শুভকামনা সব সময়ে থাকবে আপনার জন্য। শুভ হোক ব্লগিং।

ফেসবুক লিঙ্ক : আজাদ কাশ্মীর জামান।

সেলিম আল দীন: একজন মহানায়কের মহাপ্রয়াণ

Selim Al Deen

সেলিম আল দীন (১৮ই আগস্ট ১৯৪৯ – ১৪ই জানুয়ারি ২০০৮)।
পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

একজন প্রখ্যাত নাট্যকার। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক বা স্যাটায়ার-ধর্মী নাটকে তিনি বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

জীবনী:
সেলিম আল দীনের বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রে ঘুরেছেন বহু জায়গা। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর চরম ঝোঁক। তাই দূরে কাছে নতুন বই দেখলেই পড়ে ফেলতেন এক নিমেষে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর লেখক হওয়ার বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। লেখক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে, কপি রাইটার হিসাবে। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকাল মৃত্যু হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার।

তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং বহুবচন প্রযোজিত প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন করা হয় ১৯৭২ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনুদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে।

সেলিম আল দীনের প্রথমদিককার নাটকের মধ্যে সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মূল সমস্যা, এগুলোর নাম ঘুরে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে প্রাচ্য, কীর্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সায়ফুল মূলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতি কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি ও চাকা তাকে ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জীবনের শেষ ভাগে নিমজ্জন নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান বেরিয়ে আসে সেলিম আল দীনের কলম থেকে। তিনি ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক এর উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।

উল্লেখযোগ্য নাটক সমূহ:

* জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন (১৯৭৫)
* মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৭৬)
* বাসন (১৯৮৫)
* কিত্তনখোলা (১৯৮৬)
* কেরামত মঙ্গল (১৯৮৮)
* চাকা (১৯৯১)
* হরগজ’ (১৯৯২)
* যৈবতি কন্যার মন (১৯৯৩)
* শকুন্তলা
* হাত হদাই (১৯৯৭)
* বণপাংশুল
* ধাবমান
* পূত্র
* নিমজ্জন (২০০২)
* প্রাচ্য (২০০০)
* স্বর্ণবোয়াল (২০০৭)

গীতিনৃত্যনাট্য:
* স্বপ্ন রজনীগণ
* ঊষা উত্সব

রেডিও-টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটক:

* বিপরীত তমসায় (রেডিও পাকিস্তান, ১৯৬৯)
* ঘুম নেই (পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭০)
* রক্তের আঙ্গুরলতা (রেডিও বাংলাদেশ ও বিটিভি)
* অশ্রুত গান্ধার (বিটিভি, ১৯৭৫)
* শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য (বিটিভি, ১৯৭৭)
* ভাঙনের শব্দ শুনি (আয়না সিরিজ, বিটিভি, ১৯৮২-৮৩)
* গ্রন্থিকগণ কহে (বিটিভি, ১৯৯০-৯১)
* ছায়া শিকারী (বিটিভি, ১৯৯৪-৯৫)
* রঙের মানুষ (এনটিভি, ২০০০-২০০৩)
* নকশীপাড়ের মানুষেরা (এনটিভি, ২০০০)
* কীত্তনখোলা (আকাশবাণী কোলকাতা, ১৯৮৫)

গবেষণাধর্মী নির্দেশনা:

* মহুয়া (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯০)
* দেওয়ানা মদিনা (ময়মনসিংহ গীতিকা অবলম্বনে, ১৯৯২)
* একটি মারমা রূপকথা (১৯৯৩)
* কাঁদো নদী কাঁদো
* মেঘনাদ বধ (অভিষেক নামপর্ব)

চিত্রনাট্য:

* চাকা’ নাটক অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৪
* ‘কীত্তনখোলা’ নাটক থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে।
* ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচনা করেন ১৯৯৪ সালে।

অন্যান্য রচনা:

* দিনলিপি
* ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ

পুরস্কার ও স্বীকৃতি:

* বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪)
* ঋষিজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা (১৯৮৫)
* কথক সাহিত্য পুরস্কার (১৩৯০ বঙ্গাব্দ)
* একুশে পদক (২০০৭)
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩)
* অন্য থিয়েটার, কলকাতা কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা
* নান্দিকার পুরস্কার, আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা, ১৯৯৪
* শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার (১৯৯৪)
* খালেকদাদ সাহিত্য পুরস্কার
* জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (একাত্তরের যীশু, শ্রেষ্ঠ সংলাপ) ১৯৯৪
* মুনীর চৌধুরী সম্মাননা (২০০৫)

সেলিম আল দীনের অপ্রকাশিত রচনা:

2010-12-02-09-09-45-066189200-selim_al_din বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত ও কামাল উদ্দিন কবির নির্দেশিত অহরকণ্ডল নিয়ে সেলিম আল দীন লিখেছেন ‘যে কথাগুলো বলা উচিত’। নিচে তাঁর ডায়েরির কিছু অংশ বিশেষ তুলে দেয়া হলো –

লোকায়ত জীবনের মধ্যে খানিকটা বাইবেলের ফিউশন-অহরকণ্ডল। বাকিটা ছড়া-প্রবচন-ধ্রুপদী শব্দের ঘন গম্ভীর ধ্বনি। বাংলা নাট্যের সীমায় এ খুব অবাক হওয়ার মতো কাজ। নাট্য-ভূমিকায় লেখক যা বলেন তাতে তাঁর শিল্পভাবনার কৌশলটা বেশ বুঝতে পারা যায়। চরিত্রের নির্বিশেষ করণের বাড়তি প্রয়াস যে ওটা তাতে সন্দেহ নেই।
অহরকণ্ডলের গল্পটি আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। দীনপুণ্য বাংলা নাট্যে এ রকম কেউ ভাবে নাকি-বলে নাকি-লেখে নাকি?

তারপর কামালউদ্দিন কবির আমাকে অহরকণ্ডলের পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়। লেখাটি পড়তে পড়তে দেখতে পাই কথকের বলার ভঙ্গিতে বিচিত্র সব চিত্র-উড়ে আসে কি মাটি ফুঁড়ে বেরোয়। ঘটনা-চরিত্রের মনোভঙ্গি-ইঙ্গিত-দ্ব্যর্থবোধকতা-সব মিলিয়ে অবাক হওয়ার মতো লেখা।
বুঝতে পারা যায়, বাংলা নাটক চলনে-বলনে আর উপনিবেশ কালের শাসন অগ্রাহ্য করছে সচেতন শিল্পরীতির মাধ্যমে, যে রীতিটা উঠে এসেছে আবহমানকালের ধারায়-প্রাচীন ও মধ্যকালের বাংলা থেকে। তবে তাতে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির ন্যায্য অংশটুকুই গৃহীত হয়েছে-বিশ্ব সংস্কৃতির আধুনিক প্রবাহের ধারায়।

বর্ণনাত্মক বাঙলা নাটক যে বিশ্বনাটকের শিল্পযাত্রায় এক নতুনতর সংযোজন সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না, যখন দেখি আমাদের একদিনের ক্ষীণ-ভীরু চেষ্টাটা আজ বৃহত্তর শিল্পমণ্ডলবর্তী। একদিন নিজের রচনার ভিতরে নিঃসঙ্গের মতো নির্জনে বসবাস করতাম। আজ দেখি সেই চেষ্টা কতই না বিচিত্রতর ভিন্নধারায় বাহিত হচ্ছে।
রবীন্দ্রোত্তরকালে বাঙলা কবিতা ও উপন্যাসের চেয়েও বাঙলা নাটক নবতর অথচ ভূমিজ এবং অনঔপনিবেশীয় আঙ্গিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সে বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় বলা সংগত।

অহরকণ্ডল আমাদের নাট্যভাষায় এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ নাটকের পরিচালককে এ জন্য ভাষা পারিতোষিক দেই যে তিনি বলার ভঙ্গিটাকেই থিয়েটারে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছেন। একটা নতুন থিয়েটার সৃষ্টির অঙ্গীকার না থাকলে অহরকণ্ডলকে মঞ্চে তুলে আনা সম্ভব হতো না।
পাশ্চাত্য নাট্যধারার বিশাল থাবার নিচে আমাদের এ সকল প্রয়াস-একদিন ভূমি ভেদী বৃক্ষ রূপে দাঁড়াবেই-এই বিশ্বাসে নিরন্তর নিজ বীজ প্রোথিত করি বাঙালির শিল্প ভূমিতে।
৩রা মে ২০০৬।

sad-1.jpg
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

সেলিম আল দীন: একজন মহানায়কের মহাপ্রয়াণ

Selim Al Deen

সেলিম আল দীন (১৮ই আগস্ট ১৯৪৯ – ১৪ই জানুয়ারি ২০০৮)।
চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

একজন প্রখ্যাত নাট্যকার। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি নাটকের আঙ্গিক ও ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক বা স্যাটায়ার-ধর্মী নাটকে তিনি বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

জীবনী:
সেলিম আল দীনের বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সেই সূত্রে ঘুরেছেন বহু জায়গা। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর চরম ঝোঁক। তাই দূরে কাছে নতুন বই দেখলেই পড়ে ফেলতেন এক নিমেষে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর লেখক হওয়ার বিষয়ে পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। লেখক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৮ সালে, কবি আহসান হাবিব সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মাধ্যমে। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধ নিগ্রো সাহিত্য ছাপা হয় ওই পত্রিকায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেলিম আল দীন, যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে, কপি রাইটার হিসাবে। ১৯৭৪ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ওই বছরই বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। তাঁদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের অকাল মৃত্যু হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই। ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সাথী করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার।

তাঁর প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায় ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় লিব্রিয়াম (পরিবর্তিত নাম ঘুম নেই) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। আমিরুল হক চৌধুরী নির্দেশিত এবং বহুবচন প্রযোজিত প্রথম মঞ্চনাটক সর্প বিষয়ক গল্প মঞ্চায়ন করা হয় ১৯৭২ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্য বিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। তার রচিত হরগজ নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয় এবং এ নাটকটি ভারতের রঙ্গকর্মী নাট্যদল হিন্দি ভাষায় মঞ্চায়ন করেছে।

সেলিম আল দীনের প্রথমদিককার নাটকের মধ্যে সর্প বিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মূল সমস্যা, এগুলোর নাম ঘুরে ফিরে আসে। সেই সঙ্গে প্রাচ্য, কীত্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সায়ফুল মূলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতি কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি ও চাকা তাকে ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জীবনের শেষ ভাগে নিমজ্জন নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান বেরিয়ে আসে সেলিম আল দীনের কলম থেকে। তিনি ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারী মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে নাটক এর উপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন।

উল্লেখযোগ্য নাটকসমূহ:

* মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি (১৯৭৬)
* কিত্তনখোলা (১৯৮০)
* কেরামত মঙ্গল (১৯৮৪)
* চাকা (১৯৯০)
* যৈবতি কন্যার মন (১৯৯১)
* শকুন্তলা
* হাত হদাই
* বণপাংশুল
* ধাবমান
* পূত্র
* নিমজ্জন
* প্রাচ্য

সেলিম আল দীনের অপ্রকাশিত রচনা:

বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত ও কামালউদ্দিন কবির নির্দেশিত অহরকণ্ডল নিয়ে সেলিম আল দীন লিখেছেন ‘যে কথাগুলো বলা উচিত’। নিচে তাঁর ডায়েরির অংশবিশেষ-

লোকায়ত জীবনের মধ্যে খানিকটা বাইবেলের ফিউশন-অহরকণ্ডল। বাকিটা ছড়া-প্রবচন-ধ্রুপদী শব্দের ঘন গম্ভীর ধ্বনি। বাংলা নাট্যের সীমায় এ খুব অবাক হওয়ার মতো কাজ। নাট্য-ভূমিকায় লেখক যা বলেন তাতে তাঁর শিল্পভাবনার কৌশলটা বেশ বুঝতে পারা যায়। চরিত্রের নির্বিশেষ করণের বাড়তি প্রয়াস যে ওটা তাতে সন্দেহ নেই।
অহরকণ্ডলের গল্পটি আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। দীনপুণ্য বাংলা নাট্যে এ রকম কেউ ভাবে নাকি-বলে নাকি-লেখে নাকি?

তারপর কামালউদ্দিন কবির আমাকে অহরকণ্ডলের পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়। লেখাটি পড়তে পড়তে দেখতে পাই কথকের বলার ভঙ্গিতে বিচিত্র সব চিত্র-উড়ে আসে কি মাটি ফুঁড়ে বেরোয়। ঘটনা-চরিত্রের মনোভঙ্গি-ইঙ্গিত-দ্ব্যর্থবোধকতা-সব মিলিয়ে অবাক হওয়ার মতো লেখা।
বুঝতে পারা যায়, বাংলা নাটক চলনে-বলনে আর উপনিবেশ কালের শাসন অগ্রাহ্য করছে সচেতন শিল্পরীতির মাধ্যমে, যে রীতিটা উঠে এসেছে আবহমানকালের ধারায়-প্রাচীন ও মধ্যকালের বাংলা থেকে। তবে তাতে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির ন্যায্য অংশটুকুই গৃহীত হয়েছে-বিশ্ব সংস্কৃতির আধুনিক প্রবাহের ধারায়।

বর্ণনাত্মক বাঙলা নাটক যে বিশ্বনাটকের শিল্পযাত্রায় এক নতুনতর সংযোজন সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না, যখন দেখি আমাদের একদিনের ক্ষীণ-ভীরু চেষ্টাটা আজ বৃহত্তর শিল্পমণ্ডলবর্তী। একদিন নিজের রচনার ভিতরে নিঃসঙ্গের মতো নির্জনে বসবাস করতাম। আজ দেখি সেই চেষ্টা কতই না বিচিত্রতর ভিন্নধারায় বাহিত হচ্ছে।
রবীন্দ্রোত্তরকালে বাঙলা কবিতা ও উপন্যাসের চেয়েও বাঙলা নাটক নবতর অথচ ভূমিজ এবং অনঔপনিবেশীয় আঙ্গিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ সে বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় বলা সংগত।

অহরকণ্ডল আমাদের নাট্যভাষায় এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ নাটকের পরিচালককে এ জন্য ভাষা পারিতোষিক দেই যে তিনি বলার ভঙ্গিটাকেই থিয়েটারে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছেন। একটা নতুন থিয়েটার সৃষ্টির অঙ্গীকার না থাকলে অহরকণ্ডলকে মঞ্চে তুলে আনা সম্ভব হতো না।
পাশ্চাত্য নাট্যধারার বিশাল থাবার নিচে আমাদের এ সকল প্রয়াস-একদিন ভূমি ভেদী বৃক্ষ রূপে দাঁড়াবেই-এই বিশ্বাসে নিরন্তর নিজ বীজ প্রোথিত করি বাঙালির শিল্প ভূমিতে।
৩রা মে ২০০৬।

sad-1.jpg
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা শেষাংশ

SUBHA
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা। প্রথম অংশ।

বিশ্বভ্রমণঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ।

SUBHA  5 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট বারো বার বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়েছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশী দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথম জীবনে দু-বার (১৮৭৮ ও ১৮৯০) তিনি ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯১২ সালে তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটস প্রমুখ ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান। এই পাঠ শুনে তাঁরাও কবির গুণমুগ্ধে পরিণত হন। ইয়েটস স্বয়ং উক্ত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকাটি লিখে দিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের সময়েই “দীনবন্ধু” চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৯১৩ সালে সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করে। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কতকগুলি বক্তৃতা দেন। ১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে। এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদ বিরোধী বক্তৃতা দেন কবি। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান। পরে পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণ করেন। উভয় দেশের সরকারই কবির ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বভারতীকে ১,০০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থসাহায্য প্রদান করেছিল। ১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেও, পরে লোকমুখে তাঁর স্বৈরাচারের কথা জানতে পেরে, মুসোলিনির কাজকর্মের সমালোচনা করেন কবি। এর ফলে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছেদ পড়ে। এরপর রবীন্দ্রনাথ গ্রীস, তুরস্ক ও মিশর ভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন।

SUBHA 6 ১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে। এই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। ১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর তিনি ভ্রমণ করেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবি। এরপর ১৯৩৪ সালে সিংহলে যান রবীন্দ্রনাথ। এটিই ছিল তাঁর সর্বশেষ বিদেশ সফর।

রবীন্দ্রনাথ যে সকল বইতে তাঁর বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলি লিপিবদ্ধ করে রাখেন সেগুলি হল: য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি (১৮৯১, ১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়েরী ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)। ব্যাপক বিশ্বভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ অঁরি বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ তাঁর সমসাময়িক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। জীবনের একেবারে শেষপর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়েছিল মাত্র। অন্যদিকে বিশ্ব পরিক্রমার ফলে ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে পরিচিত করে তোলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়ের সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি।

সৃষ্টিকর্মঃ এই বিষয়ে মূল নিবন্ধের জন্য দেখুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্ম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মূলত কবি। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশ। তবে বাঙালি সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা মূলত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ দুই সহস্রাধিক গান লিখেছিলেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, শতাধিক গল্প-ছোটগল্প, দুই শতাধিক প্রবন্ধ, ত্রিশটিরও বেশি নাটক লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র রচনা রবীন্দ্র রচনাবলী বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর সামগ্রিক চিঠিপত্র উনিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বহু রচনা আজও অপ্রকাশিত। নৃত্য বিষয়েও রবীন্দ্রনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। নৃত্যকলা নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র নৃত্যশৈলী উদ্ভব করেছিলেন। এই শৈলীটি “রবীন্দ্রনৃত্য” নামে পরিচিত।

কবিতাঃ

SUBHA 7 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুকরণে কাব্যরচনা শুরু করেছিলেন। বিহারীলাল-অনুসারী কবি হিসেবে তিনি কবিকাহিনী, বনফুল ও ভগ্নহৃদয় কাব্য তিনটি রচনা করেন। সন্ধ্যাসংগীত কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পর্বের সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান ও কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী এবং তার পর প্রকাশিত সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কল্পনা ও ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে নৈবেদ্য, খেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালি কাব্যগ্রন্থে। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটলে বলাকা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার পরিবর্তে আবার মর্ত্যজীবন সম্পর্কে আগ্রহ ফুটে ওঠে। পলাতকা কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারী জীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। পূরবী ও মহুয়া কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার প্রেমকে উপজীব্য করেন। এরপর পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী নামে চারটি গদ্যকাব্য প্রকাশিত হয়। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময়কার রোগশয্যায়, আরোগ্য, জন্মদিনে ও শেষ লেখা (মরণোত্তর প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি। শেষ কবিতা “তোমার সৃষ্টির পথ” মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব পদাবলি, উপনিষদ্‌, কবীরের দোঁহাবলি, লালনের বাউল গান ও রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত পদাবলি সাহিত্যের প্রভাব লক্ষিত হয়। তবে প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতার পরিবর্তে তিনি এক সহজ ও সরস কাব্যরচনার আঙ্গিক গ্রহণ করেছিলেন। আবার ১৯৩০-এর দশকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালিখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন কবি। বহির্বিশ্বে তাঁর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হলো গীতাঞ্জলি। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি “গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ” রূপে।

ছোটগল্পঃ

SUBHA 8 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রণী ছোটগল্প রচয়িতা। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন। এই গল্পগুলির উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের “সাধনা” পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর গল্পগুচ্ছ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটির গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের সবুজ পত্র পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে) তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল “কঙ্কাল”, “নিশীথে”, “মণিহারা”, “ক্ষুধিত পাষাণ”, “স্ত্রীর পত্র”, “নষ্টনীড়”, “কাবুলিওয়ালা”, “হৈমন্তী”, “দেনাপাওনা”, “মুসলমানীর গল্প” ইত্যাদি। শেষ জীবনী রবীন্দ্রনাথ লিপিকা, সে ও তিনসঙ্গী গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি বা আধুনিক ধ্যান ধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতেন। কখনও তিনি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকেই গল্পে বেশি প্রাধান্য দিতে।

রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ হলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত তিন কন্যা (“মনিহারা”, “পোস্টমাস্টার” ও “সমাপ্তি” অবলম্বনে) ও চারুলতা (“নষ্টনীড়” অবলম্বনে), তপন সিংহ পরিচালিত কাবুলিওয়ালা ও ক্ষুধিত পাষাণ, পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি।

উপন্যাসঃ

SUBHA 9 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলি হলো: বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি (১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে (১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪)। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ দুটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা। এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলিও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজ পত্র, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

চোখের বালি উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সম-সাময়িককালে বিধবাদের জীবনের নানা সমস্যা। নৌকাডুবি উপন্যাসটি আবার লেখা হয়েছে জটিল পারিবারিক সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে। গোরা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসে দেখানো হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত ও ভারতের তদনীন্তন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলি। ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী যোগাযোগ উপন্যাসেও। চতুরঙ্গ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের “ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস”। স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি – এই বিষয়টিকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ দুই বোন ও মালঞ্চ উপন্যাস দুটি লেখেন। এর মধ্যে প্রথম উপন্যাসটি মিলনান্তক ও দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক। রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস চার অধ্যায় সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে ও ঋতুপর্ণ ঘোষের চোখের বালি।

প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্যঃ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বহু প্রবন্ধ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই সব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজ চিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি সমাজ (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে কালান্তর (১৯৩৭) সংকলনে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ধর্ম (১৯০৯) ও শান্তিনিকেতন (১৯০৯-১৬) অভিভাষণ মালায়। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ভারতবর্ষ (১৯০৬), ইতিহাস (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে। সাহিত্য (১৯০৭), সাহিত্যের পথে (১৯৩৬) ও সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন যথাক্রমে প্রাচীন সাহিত্য (১৯০৭) ও আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭) গ্রন্থদুটিতে। লোকসাহিত্য (১৯০৭) প্রবন্ধমালায় তিনি আলোচনা করেছেন বাংলা লোকসাহিত্যের প্রকৃতি। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে শব্দতত্ত্ব (১৯০৯), বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮) ইত্যাদি গ্রন্থে। ছন্দ ও সংগীত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে ছন্দ (১৯৩৬) ও সংগীতচিন্তা (১৯৬৬) গ্রন্থে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা (১৯০৮) প্রবন্ধমালায়। ন্যাশনালিজম (ইংরেজি: Nationalism, ১৯১৭) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে তার বিরোধিতা করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন বিষয়ে যে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি রিলিজিয়ন অফ ম্যান (ইংরেজি: Religion of Man, ১৯৩০; বাংলা অনুবাদ মানুষের ধর্ম, ১৯৩৩) নামে সংকলিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ সভ্যতার সংকট (১৯৪১) তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় (১৯৩৭) নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। জীবনস্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০) ও আত্মপরিচয় (১৯৪৩) তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ।

রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী (ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা), ভানুসিংহের পত্রাবলী (রানু অধিকারীকে (মুখোপাধ্যায়) লেখা) ও পথে ও পথের প্রান্তে (নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা) বই তিনটি রবীন্দ্রনাথের তিনটি উল্লেখযোগ্য পত্র সংকলন।

নাট্যসাহিত্যঃ

SUBHA 10 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত হঠাৎ নবাব নাটকে (মলিয়ের লা বুর্জোয়া জাঁতিরোম অবলম্বনে রচিত) ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই অলীকবাবু নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য বাল্মীকি-প্রতিভা মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে কালমৃগয়া নামে আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন। এই নাটক মঞ্চায়নের সময় তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

গীতিনাট্য রচনার পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কাব্যনাট্য রচনা করেন। শেক্সপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর রাজা ও রাণী (১৮৮৯) ও বিসর্জন (১৮৯০) বহুবার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় এবং তিনি নিজে এই নাটকগুলিতে অভিনয়ও করেন। ১৮৮৯ সালে রাজা ও রাণী নাটকে বিক্রমদেবের ভূমিকায় করেন রবীন্দ্রনাথ। বিসর্জন নাটকটি দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চায়িত করেছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালের মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কাব্যনাট্য পর্বে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) ও মালিনী (১৮৯৬)।

কাব্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ প্রহসন রচনায় মনোনিবেশ করেন। এই পর্বে প্রকাশিত হয় গোড়ায় গলদ (১৮৯২), বৈকুণ্ঠের খাতা (১৮৯৭), হাস্যকৌতুক (১৯০৭) ও ব্যঙ্গকৌতুক (১৯০৭)। বৈকুণ্ঠের খাতা নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি প্রজাপতির নির্বন্ধ উপন্যাসটিকেও চিরকুমার সভা নামে একটি প্রহসনমূলক নাটকের রূপ দেন।

SUBHA 11 ১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রূপক- সাংকেতিক তত্ত্বধর্মী নাট্যরচনা শুরু করেন। ইতিপূর্বে প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪) নাটকে তিনি কিছুটা রূপক-সাংকেতিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে একের পর এক নাটক তিনি এই আঙ্গিকে লিখতে শুরু করেন। এই নাটকগুলি হল: শারদোৎসব (১৯০৮), রাজা (১৯১০), ডাকঘর (১৯১২), অচলায়তন (১৯১২), ফাল্গুনী (১৯১৬), মুক্তধারা (১৯২২), রক্তকরবী (১৯২৬), তাসের দেশ (১৯৩৩), কালের যাত্রা (১৯৩২) ইত্যাদি। এই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল গড়ে মঞ্চস্থ করতেন। কখনও কখনও কলকাতায় গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন তিনি। এই সব নাটকেও একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯১১ সালে শারদোৎসব নাটকে সন্ন্যাসী এবং রাজা নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৪ সালে অচলায়তন নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৫ সালে ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৭ সালে ডাকঘর নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয়। নাট্যরচনার পাশাপাশি এই পর্বে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয়ের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পুরনো নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ করে নতুন নামে প্রকাশ করেন। শারদোৎসব নাটকটি হয় ঋণশোধ (১৯২১), রাজা হয় অরূপরতন (১৯২০), অচলায়তন হয় গুরু (১৯১৮), গোড়ায় গলদ হয় শেষরক্ষা (১৯২৮), রাজা ও রাণী হয়তপতী (১৯২৯) এবং প্রায়শ্চিত্ত হয় পরিত্রাণ (১৯২৯)।

১৯২৬ সালে নটীর পূজা নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে “নৃত্যনাট্য” নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। নটীর পূজা নৃত্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ একে একে রচনা করেন শাপমোচন (১৯৩১), তাসের দেশ (১৯৩৩), নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬), নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (১৯৩৮) ওশ্যামা (১৯৩৯)। এগুলিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাই প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন।

সংগীত ও নৃত্যকলাঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রসংগীত।

SUBHA 12 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় ২,২০০ গান রচনা করেছিলেন। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত, বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন। তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে। এই গ্রন্থের “পূজা”, “প্রেম”, “প্রকৃতি”, “স্বদেশ”, “আনুষ্ঠানিক” ও “বিচিত্র” পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়। পরে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয়েছিল। ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে বাল্মীকি-প্রতিভা, কালমৃগয়া গীতিনাট্য এবং চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, ও শ্যামা সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।

রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ও ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন। এই শৈলীটি “রবীন্দ্রনৃত্য” নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তার পিছনেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল।

চিত্রকলাঃ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। প্রথম দিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর, যার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য চিত্রকলার পুনরুত্থানে আগ্রহী হলেও, তাঁর নিজের ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মূলত কালিকলমে আঁকা স্কেচ, জলরং ও দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, নিসর্গদৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। নন্দনতাত্ত্বিক ও বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর চিত্রকলা বেশ অদ্ভুত ধরনেরই বলে মনে হয়। তবে তিনি একাধিক অঙ্কনশৈলী রপ্ত করেছিলেন। তন্মধ্যে, এর কয়েকটি শৈলী হলো – নিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্প, কানাডার (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ) পশ্চিম উপকূলের “হাইদা” খোদাইশিল্প ও ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প।

রাজনৈতিক মতাদর্শঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক মতাদর্শ।

SUBHA  13 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করতেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে “চরকা-সংস্কৃতি” বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথের “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য” ও “একলা চলো রে” রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। “একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর “তোতা-কাহিনী” গল্পে বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, দেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কিভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে বের করে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও এই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি। ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর বিশ্বভারতী নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের। বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে। নিজেও শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।

প্রভাবঃ

SUBHA 14 বিংশ শতাব্দীর বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা দার্শনিক অমর্ত্য সেন রবীন্দ্রনাথকে এক “হিমালয়প্রতিম ব্যক্তিত্ব” ও “গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও বহুমাত্রিক সমসাময়িক দার্শনিক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে “ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি” হিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী “পঁচিশে বৈশাখ” ও প্রয়াণবার্ষিকী “বাইশে শ্রাবণ” আজও বাঙালি সমাজে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়ে থাকে। এই উপলক্ষ্যেজোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, শান্তিনিকেতন আশ্রম ও শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হয়। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত ধর্মীয় ও ঋতু উৎসবগুলির মাধ্যমেও তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি অক্ষুন্ন আছে। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে ও অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া বা রবীন্দ্ররচনা পাঠের রেওয়াজও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এগুলি ছাড়াও কবির সম্মানে আরও কতকগুলি বিশেষ ও অভিনব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় রাজ্যের আরবানাতে আয়োজিত বার্ষিক “রবীন্দ্র উৎসব”, কলকাতা-শান্তিনিকেতন তীর্থ-পদযাত্রা “রবীন্দ্র পথপরিক্রমা” ইত্যাদি।

SUBHA 15 জীবদ্দশাতেই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইংল্যান্ডে ডার্টিংটন হল স্কুল নামে একটি প্রগতিশীল সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। অনেজ জাপানি সাহিত্যিককে তিনি প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থাবলী অনূদিত হয় ইংরেজি, ওলন্দাজ, জার্মান, স্প্যানিশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। চেক ভারততত্ত্ববিদ ভিনসেন্স লেনসি সহ একাধিক ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ফরাসি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক আন্দ্রে জিদ্, রাশিয়ান কবি আনা আখমাতোভা , প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত একেভিত, মার্কিন ঔপন্যাসিক জোনা গেইল সহ অনেকেই অনুপ্রেরণা লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে। ১৯১৬-১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেওয়া তাঁর ভাষণগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা পায়। তবে কয়েকটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে জাপান ও উত্তর আমেরিকায় তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। কালক্রমে বাংলার বাইরে রবীন্দ্রনাথ “প্রায় অস্তমিত” হয়ে পড়েছিলেন।

চিলিয়ান সাহিত্যিক পাবলো নেরুদা ও গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, মেক্সিকান লেখক অক্টাভিও পাজ ও স্প্যানিশ লেখক হোসে অরতেগা ওয়াই গ্যাসেৎ, থেনোবিয়া কামপ্রুবি আইমার, ও হুয়ান রামোন হিমেনেথ প্রমুখ স্প্যানিশ-ভাষী সাহিত্যিকদেরও অনুবাদের সূত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৪ থেকে ১৯২২ সালের মধ্যে হিমেনেথ-কামপ্রুবি দম্পতি রবীন্দ্রনাথের বাইশটি বই ইংরেজি থেকে স্প্যানিশে অনুবাদ করেছিলেন। দ্য ক্রেসেন্ট মুন (শিশু ভোলানাথ) সহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু রচনার বিস্তারিত পর্যালোচনা ও স্প্যানিশ সংস্করণ প্রকাশও করেছিলেন তাঁরা। উল্লেখ্য, এই সময়েই হিমেনেথ “নগ্ন কবিতা” (স্প্যানিশ: poesia desnuda) নামে এক বিশেষ সাহিত্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটান।

রবীন্দ্রনাথের মূল বাংলা কবিতা পড়েননি এমন বহু পাশ্চাত্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব অস্বীকারও করেছিলেন। গ্রাহাম গ্রিন সন্দিগ্ধচিত্তে মন্তব্য করেছিলেন, “ইয়েটস সাহেব ছাড়া আর কেউই রবীন্দ্রনাথের লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন না।” রবীন্দ্রনাথের সম্মানের কিছু পুরনো লাতিন আমেরিকান খণ্ডাংশ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নিকারাগুয়া ভ্রমণের সময় সালমান রুশদি এই জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখে অবাক হন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামাঙ্কিত স্মারক ও দ্রষ্টব্যস্থলঃ
■ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গন।
■ রবীন্দ্র পুরস্কার — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার।
■ রবীন্দ্রসদন — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত কলকাতার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাগৃহ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান কার্যালয়।
■ রবীন্দ্র সেতু — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত হাওড়া ও কলকাতা শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতু।
■ রবীন্দ্র সরোবর, কলকাতা — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত ভারতের একটি জাতীয় হ্রদ। এটি কলকাতার বৃহত্তম হ্রদ।

ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং কৃতজ্ঞতাঃ সুব্রত হোতা।

Robi-copy

সহ+অর্ধ=সার্ধ, এর অর্থ সাড়ে বা দেড়। তাই ‘সার্ধশত’ মানে দেড়শো। আগামীকাল (২৫ বৈশাখ) কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শোতম জন্মবার্ষিকী।
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পূণ্য করো দহন- দানে….

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা

SUBHA রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। তাঁকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খণ্ডে রবীন্দ্র রচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র ও চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত। এছাড়া তিনি প্রায় দুই হাজার ছবি এঁকেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার এক ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেননি; গৃহশিক্ষক রেখে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-এ তাঁর “অভিলাষ” কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে মাত্র সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ইংল্যান্ডে যান। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘজীবনে তিনি বহুবার বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং সমগ্র বিশ্বে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করেন। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মৃত্যু হয়।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথ দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পূজার কথা বলেছিলেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথে গান তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর রচিত আমার সোনার বাংলা ও জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে গানদুটি যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত।

জীবনঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৮৬১–১৯০১)
শৈশব ও কৈশোর (১৮৬১ – ১৮৭৮)

SUBHA  2 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) এবং মা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী (১৮২৬–১৮৭৫)। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা। ১৮৭৫ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যালয়-শিক্ষায় তাঁর মন না বসায় বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন রবীন্দ্রনাথ।

১৮৭৩ সালে এগারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর তিনি কয়েক মাসের জন্য পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে। এরপর পাঞ্জাবের অমৃতসরে কিছুকাল কাটিয়ে শিখদের উপাসনা পদ্ধতি দেখেন। শেষে পুত্রকে নিয়ে দেবেন্দ্রনাথ যান পাঞ্জাবেরই (অধুনা ভারতের হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত) ডালহৌসি শৈলশহরের নিকট বক্রোটায়। এখানকার বক্রোটা বাংলোয় বসে রবীন্দ্রনাথ পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতে শুরু করেন। দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনী, কালিদাস রচিত ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য ও নাটক এবং উপনিষদ্‌ পাঠেও উৎসাহিত করতেন। ১৮৭৭ সালে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলি হলো মাইকেল মধুসূদনের “মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা”, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী এবং “ভিখারিণী” ও “করুণা” নামে দুটি গল্প। এগুলির মধ্যে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কবিতাগুলি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলির অনুকরণে “ভানুসিংহ” ভণিতায় রচিত। রবীন্দনাথের “ভিখারিণী” গল্পটি (১৮৭৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথক কাব্যগ্রন্থ তথা প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ কবিকাহিনী। এছাড়া এই পর্বে তিনি রচনা করেছিলেন সন্ধ্যাসংগীত (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থটি। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

যৌবন (১৮৭৮-১৯০১)

SUBHA  3a ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু সাহিত্যচর্চার আকর্ষণে সেই পড়াশোনা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শেক্সপিয়ার ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। এই সময় তাঁর ইংল্যান্ডবাসের অভিজ্ঞতার কথা ভারতী পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতেন রবীন্দ্রনাথ। উক্ত পত্রিকায় এই লেখাগুলি জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনা সহ প্রকাশিত হত য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা নামে। ১৮৮১ সালে সেই পত্রাবলি য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে ছাপা হয়। এটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ। অবশেষে ১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে এবং ব্যারিস্টারি পড়া শুরু না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।

১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ )। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর পাঁচটি সন্তান হয়েছিল: মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১), রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) ও শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)। এঁদের মধ্যে অতি অল্প বয়সেই রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।

robi2 ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া (নদিয়ার উক্ত অংশটি অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা), পাবনা ও রাজশাহী জেলা এবং উড়িষ্যার জমিদারিগুলির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে “পদ্মা” নামে একটি বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় চড়ে প্রজাবর্গের কাছে খাজনা আদায় ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যেতেন। গ্রামবাসীরাও তাঁর সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করতো।

১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথের অপর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয়। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ও গীতিসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি হল প্রভাতসংগীত, শৈশবসঙ্গীত, রবিচ্ছায়া, কড়ি ও কোমল ইত্যাদি। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত নিজের সম্পাদিত সাধনা পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্যজীবনের এই পর্যায়টি তাই “সাধনা পর্যায়” নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ গ্রন্থের প্রথম চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই এই পর্যায়ের রচনা। এই ছোটগল্প গুলিতে তিনি বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের এক আবেগময় ও শ্লেষাত্মক ছবি এঁকেছিলেন।

মধ্য জীবনঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯০১–১৯৩২)

SUBHA  4 ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে। এখানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৮ সালে একটি আশ্রম ও ১৮৯১ সালে একটি ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ উদ্যানে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন “ব্রহ্মবিদ্যালয়” বা “ব্রহ্মচর্যাশ্রম” নামে একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান। এরপর ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কন্যা রেণুকা, ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।

এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করেন আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শেখার জন্য। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এই সময় শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে অর্থসংকট তীব্র হয়ে ওঠে। পাশাপাশি পুত্র ও জামাতার বিদেশে পড়াশোনার ব্যয়ভারও রবীন্দ্রনাথকে বহন করতে হয়। এমতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর গয়না ও পুরীর বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।

ইতিমধ্যেই অবশ্য বাংলা ও বহির্বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯০১ সালে নৈবেদ্য ও ১৯০৬ সালে খেয়া কাব্যগ্রন্থের পর ১৯১০ সালে তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি (ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১২) কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে প্রদান করে। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে “স্যার” উপাধি (নাইটহুড) দেয়।

১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের আরও কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ “পল্লীসংগঠন কেন্দ্র” নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন “শ্রীনিকেতন”। শ্রীনিকেতন ছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রতীক ও প্রতিবাদসর্বস্ব স্বরাজ আন্দোলনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর আন্দোলনের পন্থাটির বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীকালে দেশ ও বিদেশের একাধিক বিশেষজ্ঞ, দাতা ও অন্যান্য পদাধিকারীরা শ্রীনিকেতনের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন।

১৯৩০-এর দশকের প্রথম ভাগে একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

শেষ জীবনঃ মূল নিবন্ধ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন (১৯৩২–১৯৪১)

SUBHA 5 জীবনের শেষ দশকে (১৯৩২-১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর এই সময়কার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), শ্যামলী ও পত্রপুট (১৯৩৬) – এই গদ্যকবিতা সংকলন তিনটি। জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর এই পরীক্ষা নিরীক্ষার ফসল হল তাঁর একাধিক গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬; চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ), শ্যামা (১৯৩৯) ও চণ্ডালিকা (১৯৩৯) নৃত্যনাট্যত্রয়ী। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাসও (দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) এই পর্বে রচনা করেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ ছবি জীবনের এই পর্বেই আঁকা। এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন বিশ্বপরিচয়। এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব লক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও। সে (১৯৩৭), তিন সঙ্গী (১৯৪০) ও গল্পসল্প (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে।

জীবনের এই পর্বে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্রতম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ বিহার প্রদেশে ভূমিকম্পে শতাধিক মানুষের মৃত্যুকে গান্ধীজি “ঈশ্বরের রোষ” বলে অভিহিত করলে, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজির এহেন বক্তব্যকে অবৈজ্ঞানিক বলে চিহ্নিত করেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর সমালোচনা করেন। কলকাতার সাধারণ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের দ্রুত আর্থসামাজিক অবক্ষয় তাঁকে বিশেষভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। গদ্যছন্দে রচিত একটি শত-পংক্তির কবিতায় তিনি এই ঘটনা চিত্রায়িতও করেছিলেন।

জীবনের শেষ চার বছর ছিল তাঁর ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ের মধ্যে দুই বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির। সেবার সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি। এই সময়পর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যু চেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

অনুমতি দানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং কৃতজ্ঞতাঃ সুব্রত হোতা।
আগামী খন্ডে সমাপ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী এবং জীবনপঞ্জিকা শেষাংশ।

প্রত্ননিমগ্ন 'পাখি তীর্থ দিনে'… সুশান্ত বর্মন

tr

প্রাবন্ধিক সুশান্ত বর্মন। প্রত্ননিমগ্ন ‘পাখি তীর্থ দিনে’… সুশান্ত বর্মন। প্রথম অংশ।

কানাডা প্রবাসী মাসুদ খান পেশায় একজন প্রকৌশলী। যন্ত্রজীবী কবি যন্ত্র, ধাতু, বস্তু, জড়, কৃত্রিম, অপ্রাণজ বিজ্ঞানের দিকে তাকালে দ্বিধাহীন হয়ে যান। যন্ত্রের ভিতরের যন্ত্রটিকে তিনি নিমেষে বুঝে ফেলেন। তবে তিনি যন্ত্রবাদী নন। তাই তাঁর রচনায় বিজ্ঞান উপস্থিত হয় নিজস্ব সত্যবোধ ও ন্যায়নিষ্ঠতা নিয়ে। ফলে তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে, লাভ করেছে আধুনিক যুগের নৈকট্য। তিনি বাংলা কবিতার গতিপথে একটি নতুন পথ যেমন তৈরি করতে পেরেছেন তেমনি কবিচরিত্র বা কবিত্বের সংজ্ঞা সম্পর্কেও তৈরি করেছেন নতুন দর্শন।

তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আধুনিক যুগের কবিদের ভাববাদী হওয়াটা ততোটা জরুরি নয় যতোটা জরুরি প্রয়োজন বিজ্ঞানসচেতন হওয়ার। বিজ্ঞানের যুগে বাস করে যে কবি ভাববাদী হয়ে ওঠে সে তো পুরনোবাদী, তাকিয়ে থাকে অতীত গহ্বরের দিকে। তিনি জানেন এমন কোনো শর্ত নেই যে কবিদের বিজ্ঞানসচেতন হওয়া যাবেনা। তাহলে একালে বাস করে কেনো বিজ্ঞানবিমুখ থাকা; কেনোই বা বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন চেতনার দাসত্বে নিজেকে বন্দি করা।

সমকাল সম্পর্কে যে মানুষ অসচেতন সে নিজেই তো যান্ত্রিক, মৃত। এই সচেতনতার জন্যই তাঁর কবিতায় বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট শব্দ বারবার এসেছে। প্রতিদিনের যাপিত জীবনকে তিনি এড়িয়ে যেতে চাননি। ‘অকটেন’, ‘ম্যাঙ্গানিজ’, ‘প্রাণীবিজ্ঞান’, ‘স্বর্ণ’, ‘প্লাস্টিক’, ‘ফ্লাডলাইট’, ‘পারদস্তম্ভ’, ‘অম্লজান’, ‘সোডিয়াম’, ‘সিলিকন’, ‘রেডিও তরঙ্গ’, ‘ইঞ্জিন’, ‘গিয়ার’, ‘স্পিডোমিটার’, ‘ভূগোল’, ‘ইলাস্টিক’, ‘সুপারনোভা’, ‘গ্রাফাইট’, ‘ব্লাকহোল’, ‘ইলেকট্রন’ প্রভৃতি শব্দগুলি জীবনের প্রাত্যাহিক পরিচিতি নিয়েই তাঁর কবিতায় এসেছে।
তিনি জানেন বিজ্ঞানচেতনা মানে যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শীতা নয়, যন্ত্রের মৌলদর্শনকে ধারণ করা। তাঁর বিজ্ঞানসচেতনতা কোনো লোক দেখানো বিষয় নয়। তাই আধ্যাত্মিক নয় বরং বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বকে তিনি ধারণ করেন মনেপ্রাণে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন সমাজকে। এজন্যই তিনি অকপটে বলে যান প্রাণীর সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানুষের সামাজিক ইতিহাস-
“ডাঙায় প্রথমে খ’সে গেলো বাঁকা লেজের অহং
ধীরে ধীরে গুল্মীভূত হলো দেহ।
কামারশালার গনগনে কান্তলোহা,
আগুনের ফুল আর ফুলকার অক্সিজেনে সখ্য হলো।”

এই ইতিহাস আমাদের অচেনা নয়। কিন্তু একালে বসে মাসুদ খান বেদনার সাথে দেখেন-
“কংকালের লোভে ব’সে ব’সে ঝিমোচ্ছে
পৃথিবীর নিঃস্ব প্রাণীবিজ্ঞান
পাঠাগার থেকে চোখ মুছে ফেরে ব্যাধ”। (ত্রিজ)

মহাকালের সামনে দাঁড়িয়ে কবি দেখেন-
“ধর্ম ও বীর্যবাসনা প্রবল হ’লে জাগে টান…
ক্ষুধায় ধর্মলালায় যৌনে ও প্রেমে
হরিণ ও চিতার রূপচিত্রগতি অবিরল চকচকে যুগ্ম ট্রাজেক্টরি।”
(একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে)

আপাতদৃষ্টিতে মানুষ যূথপ্রেমী হলেও প্রধানত সে নিঃসঙ্গ। সমাজের একক মানুষের জীবন জীবনব্যাপী সঙ্গীহীন সাথীহীন। শত কোলাহলের মাঝেও মানুষের একাকিত্ব কাটেনা। পরিজন বেষ্টিত জীবনেও মানুষ নিরন্তর একা হয়ে থাকে। আত্মবাদী বর্তমানকালে মানুষ নিরন্তর নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের চূড়ায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতিও মানুষের অন্তর্মুখীতা দূর করতে পারেনা। সাফল্যছোঁয়া মানুষ তাই বুঝে ফেলে এই বিজন জীবন তার নিজেরই মাত্র। এই মিত্রহীন মানুষ অনবরত খুঁজে বেড়ায় একাকিত্ববিরোধী বিভিন্ন বস্তুমালা। একাকিত্বের নিঃসীম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজে নেয় যূথধারণার মৌলিক দর্শনটিকে। “ঐ বাঁধে নির্জন সভাপতি থাকে। সন্ধ্যাভাষা জানে।”

মাসুদ খানের কবিকীর্তির অনবদ্য উপহার উপমা বৈচিত্র। তাঁর কবিতার উপমা ও রূপকগুলো বাংলা শব্দভাণ্ডারে একাধিক নতুন শব্দবন্ধ সংযুক্ত করেছে। ‘কীটপুত্র’, ‘ঐশী পর্যটন’, ‘অণ্ডআত্মা’, ‘আলকাতরার জলাশয়’, ‘ক্রোমোজমের উল্লাস’, ‘রাত্রিগ্রস্ত’, ‘শাদা হিংসা’, ‘ছাইরঙা সন্ন্যাস’, ‘অগ্নিপাহাড়’, ‘অন্তরঙ্গ রোম’, ‘ঘন চৈত্রদুপুর’ প্রভৃতি উপমা/ রূপক বাংলা সাহিত্যে একেবারে মৌলিক।

‘চেরাগজন্ম’ কবিতায় সমসময়ের চাপে বাংলার এক চারণের জন্ম বৃথা যায়। এর ফলে যে মহাবিপর্যয় ঘটে তার রূপক অভিনব ও অভূতপূর্ব।
“চারণ, তোমার চেরাগজন্ম বৃথা যায়
মন্দ গাহিছে লোকে দিকে দিকে পুনর্বার
চিমনি চিড় খায় আজ উন্মার্গ জলের ছিটায়
চিমনি চিড়ে যায় আজ চক্রবাল থেকে
তেড়ে আসা অভিশাপে, ভৎর্সনায়।”

তাঁর রচনায় ‘চারণ’, ‘শ্রমণ’, ‘নিষাদ’, ‘ব্যাধ’, ‘শুদ্র’, ‘হরপ্পা’, ‘ধীবর’, ‘টোটেম’ প্রভৃতি প্রত্নইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো বারবার এসেছে। এই শব্দগুলো শত অতীত মনে হলেও তা পুরান, রূপকথা, অলৌকিক, মীথ বা পরকালবাসী কোনো শব্দ নয়। এই শব্দগুলো প্রাক্তন মনে হলেও পরদেশী নয়। সেমেটিয় নীতিবোধের অবাধ প্রচলন আমাদের প্রান্তিক সমাজে যে স্থায়ী রাত্রিকালের সৃষ্টি করেছে তার প্রতি তিনি আশরীর ক্রোধ ও আমাদের নিজস্ব অর্থাৎ নিষাদ, শবর, অষ্ট্রোলয়েডদের জীবনের প্রতি প্রবল আগ্রহ বোধ করেন।
তাই তাঁর মননে প্রত্নইতিহাস কোনো সেমিনার কেন্দ্রিক শব্দচিত্র সাজায় না। তিনি নিজের রক্তের দিকে, কোষের দিকে, ক্রোমোজম-ডিএনএ’র দিকে তাকিয়ে নিজেকেই খোঁজেন। প্রতিষ্ঠিত স্ববিরোধীতা ও ভণ্ডামোর রাজত্বে বাস করতে করতে ক্লান্ত তিনি অতঃপর সচকিত হয়ে ওঠেন। দেখেন প্রত্নমানুষেরা আজ আর পরাজিত নয়।
কারণ আজ এসেছে ‘উর্ধ্বগমনের দিন’-

“পুরাতন বস্তু থেকে উত্থিত সেই কবেকার
ব্রাত্য সংকেতেরা এতোদিন পর আজ কেন ধেয়ে আসছে
তীব্র জ্বরকম্পন নিয়ে রেডিও তরঙ্গে তরঙ্গে।
এই কায়া, এই নিঃসীম বিভ্রান্তি,
ছায়াসহ, কোথায় লুকিয়ে রেখে
তবে যাই উর্ধ্বগমনে ?”

প্রত্নপ্রেমিক কবি জানেন-
“হরপ্পার কোষে খুব হাতুড়ি-গর্জন, হ্রেষা, সিংহের বৃংহণ শাবল মোহর শিশু সিন্ধু সুরকি পাখি লেদ লায়ারের মিশ্রিত কূজন আরো বহু শব্দ ছিলো।”

এমন বিপর্যস্ত সমাজে বাস করেও কবি মোটেও আশাহীন নন। কারণ-
“শ্রীকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে তাই লীলাকৃত্য ফেলে
উষাকাল থেকে
বিবিধ আমিষ ও অ্যামিনো অম্লের সামনে দাঁড়াতে হয়
নিষ্পলক, নিয়তিবাধিত।
দেখে যেতে হয়
আমিষে এসিডে ঠিক কখন উন্মেষ, প্রথম স্পন্দনের।” (স্রোত)

এই সমসময়ের বাস্তবতা হচ্ছে-
“ইতিহাস-কারাভাঁচ্যুত পশু ও মানুষ
আবার নতুন কার কাটা মুষ্ককোষ ঘিরে আবর্তিত
কালে কালে হাড়ের কাঠামো অতিক্রম ক’রে
ছলকে ছলকে ওঠে মাংশ
পচনপ্রবণ, শুধু মাংশের ছোবল।
পঙ্গু ভিখারির বিষন্ন আত্মমৈথুনের মতো
কাঁটাতারে হঠাৎ আটকে যাওয়া ভুবনচিলের
লালদীর্ঘ চিৎকারের মতো।” (স্বকাল)

এই অপার্থিব অমানবিকতার ধারাবাহিকতা ক্রমান্বয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করছে। মানুষ এখন আর মানুষের নেই। শত হিংসাজর্জর। তিনি জানেন যুগে যুগে ভূমিজ মানুষেরা অপশক্তির হাতে নির্যাতিত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে। বিভিন্ন রঙের-ঢঙের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা ভূমিপুত্রদের ধ্বংস করতে চেয়েছে। তাই বলে তারা কখনও পরাজিত হয়নি। কালের ইতিহাস আমাদের এই সত্যই শেখায় যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি সবসময়ই জয়ী হয়। তাই তিনি প্রত্যাশা করেন-

“সব উদ্বৃত্ত নিদ্রা আর আচ্ছন্নতা
পরিত্যাগ ক’রে কন্যা একসময় গাত্রোত্থান করবে,
সকন্যা আমাদের উজ্জ্বল গৃহযাত্রা হবে-
সেই দুর্মর অভিলাষ ঘিরে এই সাধ্যসাধনা নিরন্তর।” (কন্যাসংহিতা)

তাঁর এই আশাবাদ কোন অলৌকিক স্বপ্ন নয়। কষ্টকল্পিত চেতনার বহিঃপ্রকাশও নয়। তাঁর একান্ত প্রার্থনা-
“এইবার এই অবেলায়, হে জ্ঞাতি, হে রহস্যের উপজাতি,
অন্তহীন শিবলিঙ্গের প্রহরী,
গলমান গ্রাফাইট স্তরের ওপর গড়াগড়ি দাও
পুনর্বার পাপ ক’রে ফিরে এসো
পুনর্বার মুদ্রণযন্ত্র ভেঙে ভূমিসাৎ ক’রে দাও হে অর্জুন
স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যাধ, স্মরণকালের হে অবিস্মরণীয় ব্যাধি।” (সার্কারামা)

মাসুদ খান মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নটিকে অনিশ্চিত ভাবেননা। তিনি জানেন এই হিংসাকাতর যাপিত জীবন মূলত বৃত্ত মাত্র। এক মহাকালিক বৃত্তের ফাঁদে বন্দি আমরা-
“বৃত্ত ঘোরে মহাবৃত্ত
বিনাশ, মহামারী নৃত্য
মনুকুলের শেষকৃত্য
প্রাণী এবং পতঙ্গের সাথে।” (সার্কারামা)

বস্তুবাদী কবির উপলব্ধি বড়ই অমোঘ ও নির্মোহ। তাই প্রাত্যাহিক জীবনের শত দুঃখ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা থেকে আড়াল পেতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত জপ করার জন্য প্রদান করেন একটি সত্যমন্ত্র-
“শ্রবণ বধির ক’রে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া।”

t
m1 m2
কবিঃ মাসুদ খান ( জন্মঃ জয়পুরহাট ২৯/০৫/১৯৫৯ )
কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ সুশান্ত বর্মন। প্রাত্যাহিক পায়চারি ব্লগ।
থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

প্রত্ননিমগ্ন 'পাখি তীর্থ দিনে'… সুশান্ত বর্মন

tr

প্রাবন্ধিক সুশান্ত বর্মন বলেন, দর্শনের প্রধান দুটি শাখাতেই মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের প্রশংসা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ভাববাদী মতে সুদূর অতীতে ‘সত্যযুগ’ নামে এক কাল ছিল। সেসময় সবাই ছিল সত্যবান। কেউ কোনো মিথ্যা কথা বলতো না, কোনো অসৎ কাজ করতো না। এখনও এদেশের সাঁওতাল, গারো, ওঁরাও প্রমুখ প্রত্নমানুষদের অভিধানে ‘পরশ্রীকাতরতা’, ‘ধর্ষণ’ প্রভৃতি শব্দ অপরিচিত।

আধুনিক বস্তুবাদী মতে ইতিহাসপূর্বকালে ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’ নামে একটি প্রাকৃতিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সে সমাজে সকল মানুষ সমান ছিল। কেউ কারও তুলনায় কোনো অজুহাতে বিশিষ্ট ছিলনা। প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে এর কোন ক্ষণ স্বীকৃত নয়, তাই বলে সুস্থ সমাজের এই ধারণাটি আমাদের কল্পলোক পরিত্যাগ করেনি। এই চিরনতুন, চিরকাঙ্খিত, আনন্দময় ও ধ্রুপদী স্বপ্নলোকের রশ্মিপ্রকাশ স্বদেশে সমকালে বিলুপ্ত। স্বকালের যাবতীয় মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা, অনৈতিকতা, অসঙ্গতি, সহিংসতা অর্থাৎ সার্বিক স্ববিরোধীতা মানুষের মানসলোকে আজ বেকেটের দুঃস্বপ্নগুলোকে মূর্ত করে তুলেছে। ফলে শিল্পজগতের সবখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক বিরান মরুভূমি। বাংলাদেশের কাব্যজগতও এই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারেনি। আশির দশকের শেষাংশে এবং নব্বই দশকে এসে এই বন্ধ্যাত্বের কিঞ্চিত উপশম আমরা অনুভব করি। চারপাশের উষর কাব্যমাঠের মাঝে মাঝে কিছু মরুদ্যান- সদৃশ সবুজ বাগান আমাদের দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। এরকমই একটি তৃণভূমি সৃজন করেছেন কবি লেখক মাসুদ খান তাঁর ‘পাখিতীর্থদিনে’ কাব্যগ্রন্থে।

মাসুদ খানের কবিতাপাঠে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি যেন কবিতার জন্যই কবিতা লিখেছেন। তিনি যেন Art for Arts shake এর বীজকে নিজের মগজে গেঁথে নিয়েছেন। কিন্তু সন্ধানীপাঠক মাত্রই জানেন মাসুদ খান এত স্থূল নন। বরং ত্রিকালদর্শী প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি এঁকেছেন ভবিষ্যতের কাল।

এই ভারতভূমির সার্বিক অসামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রথম প্রমূর্ত বিদ্রোহ করেন গৌতমবুদ্ধ।
“সার্থবাহ নিয়ে আসে ঝলমলে বাসকপাতার কোলাহল
দুঃখ সেরে যায়, অসুখ সারে না।” (বৈশ্যদের কাল)
এই বাস্তবতায় বুদ্ধ নির্ভার-নিশ্চিত থাকতে পারেননি। মানুষের জীবন আঁকড়ে থাকা সমস্যা সমাধানের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে জাগিয়ে তোলে বিলাস জীবন থেকে। এক সুন্দর স্বপ্নের আশায় তিনি বেড়িয়ে পরেন রাজপুত্রের খোলস থেকে।

“…একদিন ঘুমন্ত স্ত্রী আর পুত্র রেখে ঘন রাত্রে
নিরুদ্দেশে যায়
নিরঞ্জনা নদীকূল শুধু কাঁপে অকূল তৃষ্ণায়।
ধীরে ধীরে এই ভূমিপৃষ্ঠে ফিরে এলো বৈশ্যদের কাল
…ধুলিঝড় হলো, হিমবাহ গেলো শতযুগ।”

তারপর বোধহীন বোধির আক্রমণে বুদ্ধের বোধি এই ভূখণ্ডে ক্রমাগত রঙহীন নির্জীব হয়ে যায়। শুধু ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকে-
“ঐখানে হৈ হৈ রৈ রৈ পঞ্চকাণ্ড মেলা বসতো
হাজার বর্ষ আগে
আজ শুধু এক জোড়া নিরিবিলি জলমগ্ন বৃক্ষ বাস করে।”

মানুষ প্রথমত এবং প্রধানত বস্তু। তাই সে বেশিরভাগ সময়ই চরম বস্তুবাদী। বস্তুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে; শ্বাস হিসেবে শরীরের ভিতরে প্রবেশাধিকার দেয়। বস্তু দিয়ে লেখে, বস্তু পড়ে, বস্তু ব্যবহার করে; তাঁর চারপাশের যা কিছু গ্রহণযোগ্য তার সব কিছুই বস্তু। এমন চরম বস্তুবাদী মানুষকে আধ্যাত্মবাদ বিচার করে ভিন্নভাবে।

প্রাণীজগতের সবচাইতে বুদ্ধিমান জীব মানুষের দিকে কবি তাকাতে চান যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে। কিন্তু মাসুদ খান দেখেন সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন দর্শন মানুষকে বিশ্লেষণ করতে চায় ভিন্ন উপায়ে। মানুষের প্রচলিত ও বহুল বিবৃত কোন কোন সংজ্ঞায় বিব্রত বোধ করেন। মানুষ সম্পর্কিত দার্শনিক তত্ত্বগুলো তাঁর মনে ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বহির্জগতের ভিত্তিতে নয় অন্তর্জগতের ভিত্তিতেই মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। আর এ লক্ষ্যেই তিনি ‘মানুষ’ নামে উপস্থাপন করেছেন তিনটি কবিতা।
প্রথম কবিতায় তিনি মানুষকে সেমেটিক মীথের প্রতিফলনে খুঁজেছেন। ব্যর্থ ইঁদুরশিকারী (যে আবার ইঁদুরছানার কাতর চোখ দেখে শিকারে ক্ষান্ত দেয়), দুধমাছচোর, উঞ্ছজীবী বিড়ালকে উত্যক্ত প্রতিপালক দূর বালিচরে বস্তাবন্দি করে ছেড়ে দেয়। বিতাড়িত বিড়াল নিরিবিলি জীবন থেকে উৎপাটিত হয়ে নির্বাসিত হয় মরুরঙ চরভূমিতে।
মানুষ নামাঙ্কিত দ্বিতীয় কবিতাতেও তিনি মানুষকে দেখেন সেমেটিক আয়নায়। এখানে মানুষ চিহ্নিত হয়েছে আপেল চোর হিসাবে। পেছনে তাড়া করা সাপের ফণা ক্লান্ত চোর মানুষটিকে শান্ত থাকতে দেয়না। কবি মানুষের এমন হীন সংজ্ঞায় বিব্রত; এমন বিকটভাবে বিশেষায়িত নিজেকে স্থাপন করবার জন্য পাত্র খুঁজে পাননা। ‘মানুষ’ শীর্ষক তৃতীয় কবিতাটিতে কবি মানুষের এমন পূর্বনির্ধারিত অপমানকর বিশেষণকে প্রত্যাখ্যান করেন। সরাসরি অস্বীকার করেন নিজের আরোপিত চোরবংশজাত ঐতিহ্যকে।

“তোমাদের এই বংশের কেউ নই,
না তস্করকুলের কেউ।” (মানুষ)

নিবিড় পর্যবেক্ষণে তিনি জেনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক দাসদের মানসদিগন্ত। প্রতিষ্ঠানপ্রেমিক আমরা দাসখত লিখেছি জীবন ও সমাজের কাছে। জেনেছি মর্ম সত্য নয় রূপ সত্য। আমাদের কাছে এযুগে প্রকল্পব্যবসা মর্যাদা পায় সমাজসেবা বলে। ফলে-

“বীজায়ন প্রক্রিয়া, তারও পূর্বপার থেকে
জন্মদিন ভেঙেচুরে, দেহ তো হয়ই নি, দৌড়ে আসে সীমারেখা।
প্রকল্পের প্রভাবে জোরালো সোডিয়াম জ্বলে।” (প্রতিষ্ঠান)

বস্তুবাদী কবির উপলব্ধি বড়ই অমোঘ ও নির্মোহ। তাই প্রাত্যাহিক জীবনের শত দুঃখ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা থেকে আড়াল পেতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত জপ করার জন্য প্রদান করেন একটি সত্যমন্ত্র-
“শ্রবণ বধির ক’রে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া।”

t
m1 m2
কবিঃ মাসুদ খান ( জন্মঃ জয়পুরহাট ২৯/০৫/১৯৫৯ )
কৃতজ্ঞতায়ঃ সুশান্ত বর্মন। প্রাত্যাহিক পায়চারি ব্লগ।
থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

সঠিক লিন্ক সহায়তায় শ্রদ্ধেয় অ-সামাজিক ব্লগার। তাঁকে জানাই ধন্যবাদ।
আজ প্রথম পর্ব। আগামী পর্বে সমাপ্য।

‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… শেষ ভাগ

স্বপ্ন ও সময়: ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ১ম ভাগ।
স্বপ্ন ও সময়: ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ২য় ভাগ।

‘সপ্তক’ বেরিয়েছিল তো এভাবেই। সপ্তক নামে সাত জন। কারা তারা? দলিলে লেখাপড়া করে তো কিছু হয়নি। এই সপ্তকের কিছু ছিল আড়ালে, জনা কয়েক সামনে। সামনের লোকগুলোকে তো দেখতেই পাচ্ছি: জ্যোতিপ্রকাশ, সেবাব্রত, হুমায়ুন, হায়াৎ। বাকি ত্রিমূর্তি, তারা কি? এইখানে মনে ধন্দ লাগছে। শফিক খান যিনি তাঁর প্রেস থেকে বিনি পয়সায় ছাপিয়ে দিতেন, পরে ‘কণ্ঠস্বর’ও ছাপিয়েছেন, এখন খুব বড়ো কর্তা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে, অদ্যাবধি পূর্ববত্‍ ভালোবাসেন আমাকে- তিনি কি ছিলেন এই দলে? নাকি লিখতেন না বলে তাকে আমরা ধরিনি আমাদের মধ্যে? দেবুদা, সেবাব্রত চৌধুরীর জ্যেষ্ঠভ্রাতা, যিনি কবিতা লিখতেন, গল্পও লিখতেন, বিলেতের বাসিন্দা গত প্রায় তিরিশ বছর ধরে, সেখানে বসেই বছর দেড়েক-দুয়েক পূর্বে প্রকাশ করেছেন কাব্যগ্রন্থ, তিনি কি ছিলেন হিসেবের ভিতরে?

‘সপ্তক’-এর প্রথম সংখ্যায় দেবুদার কবিতা ছাপানো হয়েছিল। আর গোত্রভুক্ত কি ছিলেন আল মাহমুদ বা শহীদ কাদরী? হলে আল মাহমুদ হওয়ারই কথা। তখন আমরা সকলেই সকলের খুব কাছাকাছি ছিলাম। পরে দূরত্ব বেড়েছে। জীবনের রাস্তা একেকজনের একেক দিকে বাঁক নিয়েছে। কাদরী, আল মাহমুদ, আমি, জ্যোতি রাত বারটা একটা পর্যন্ত ফুলবাড়িয়া স্টেশনে আড্ডা দিচ্ছি- এমন দৃশ্য এখনও চোখে লেগে আছে। এমনি আরেকটা ছবি সেলিমাবাদ রেস্টুরেন্টে আল মাহমুদকে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজন। কাউকে ঐ রেস্তোঁরার চেহারা স্বভাব বলে বোঝানো যাবে না। ওয়েটারের সঙ্গে ভাব জমাতে পারলে বিনে পয়সায় খেয়ে চলে আসা যেতো। কারণ কাউন্টারে বসে থাকা মালিকের পক্ষে খদ্দেরের আসা-যাওয়ায় নজর রাখা অসম্ভব ছিলো, খদ্দেরের ভিড় এতখানিই ছিলো।

মাত্র ৩২টি পৃষ্ঠা সম্বল করে ‘সপ্তক’ বেরোয় সমকালীন সাহিত্য সংকলন হিসেবে। মাস মনে নেই, সাল ১৯৬৩। পিছন মলাটে মুদ্রিত হয়েছিল এইসব কথা। সমকালীন তরুণ সাহিত্যিকদের কবিতা, গল্প ও সাহিত্য চিন্তামূলক রচনার সংকলন সপ্তক। সপ্তকের প্রথম পুস্তিকায় সেবাব্রত চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, শহীদ কাদরী, দেবব্রত চৌধুরী, আল মাহমুদ এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সাম্প্রতিক সৃজনীচেতনার নিদর্শন গ্রন্থিত। সম্পাদক হিসেবে কারও নাম ছাপা হয়নি। জ্যোতিপ্রকাশ লিখেছিলেন গল্প: ‘আরো কয়েকটি পুতুল’। সেবাব্রতের কবিতা ছাড়াও ছাপা হয়েছিল ‘মতান্তর’ নামে গদ্য রচনা যেখানে ঐ প্রথম পুস্তিকাতেই গ্রন্থিত রচনাসমূহের নিরিখে লেখক চরিত্র বুঝে নেয়ার চেষ্টা ছিলো। ‘সপ্তক’ পরের সংখ্যা বেরোয় সমকালীন সাহিত্য সংকলন দ্বিতীয় পুস্তিকা হিসেবে আগস্ট ১৯৬৩-তে। প্রচ্ছদের ছবি এঁকেছিলেন চট্টগ্রামের আশীষ চৌধুরী, স্বশিক্ষিত চিত্রী ছিলেন চিত্রকর স্বপন চৌধুরী ও সংগীত শিল্পী তপন চৌধুরীর বড় ভাই।
এ সংখ্যাটি আয়তনে বড় ছিল, ৮০ পৃষ্ঠার এবং কবিতা ব্যাতিরেকে গল্প ছিল জ্যোতির, আলী আনোয়ার লরেন্স ডারেল বিষয়ে একটি রচনা লিখেছিলেন উমর হাবিব ছদ্মনামে ‘মতান্তর’ শিরোনামে। আর আল মাহমুদ লিখেছিলেন সেবাব্রত চৌধুরীর প্রথম সদ্যপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘স্বদেশ আমাকে নিসর্গ’ নিয়ে আলোচনা। নতুন মুখ ছিলো এ কজন- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মনজুরে মওলা, জিয়া হায়দার, উমর হাবিব। পূর্ববর্তী সংখ্যার ন্যায় এ সংখ্যার দাম রাখা হয়েছিলো এক টাকা।

আর তৃতীয় সংখ্যাটি ছিলো ‘সপ্তক’-এর শেষ সংখ্যা: সমকালীন সাহিত্য সংকলন, তৃতীয় পুস্তিকা, বিশেষ গল্প সংখ্যা। জুলাই ১৯৬৪ তে বেরুলেও মুদ্রণের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো তেষট্টির শেষেই। কিন্তু ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার সূত্র ধরে পূর্ব বঙ্গেও তুমুল দাঙ্গা বাঁধিয়ে তুললো উর্দুভাষা জনগোষ্ঠী-ডিসেম্বরের (১৯৬৩) শেষ থেকে জানুয়ারির (১৯৬৪) প্রথম দিক পর্যন্ত। এর অভিঘাতে আমাদের জীবনের সব সুস্থিরতা তছনছ হয়ে গিয়েছিলো।
অবস্থা শান্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সময় লেগেছিলো। এই জটিলতার ফলে পত্রিকা ছেপে বের করতে দেরি হয়েছিলো। দেরীর কারণে আমার অবশ্য লাভ হয়েছিলো। দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা গল্প দেয়া সম্ভব হয়েছিলো। এই শেষ সংখ্যায় গল্প লিখেছিলেন দেবব্রত চৌধুরী, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সেবাব্রত চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ ও হুমায়ুন চৌধুরী।

আমার স্থির ধারণা এ রকমের যে, আল মাহমুদ প্রথম ভালোভাবে সকলের নজর কাড়েন ‘সপ্তক’-এ প্রকাশিত হওয়ার পরে। ঘটনাটি সন্দেহ নেই, কাকতালীয়। কারণ তিনি পূর্বেও এদিক-ওদিক লিখেছেন। কিন্তু ‘সপ্তক’ বিশেষভাবে সকলের লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিলো। তার যে ঠিক কারণ কী, তা বলতে পারবো না। তবে আন্দাজ করতে পারি। কারণ হলো তরুণেরা নিজেদের লেখা নিজেরাই যোগারযন্তর করে একটি কাগজ বের করেছে এবং প্রবীণদের কারও কোনো লিখা নেয়নি। প্রবীণ তো ছিলেন অনেকেই।
‘সমকাল’ নিয়মিতভাবে বেরুচ্ছে কত আগে থেকে। তার একটি শিথিল লেখকগোষ্ঠীও ছিলো। ‘পরিক্রম’ বেরুচ্ছিল লেখক সংঘের কাগজ হিসেবে। ‘পূবালী’ ছিল, নিয়মিত মাসিক। এ রকম আরো দুই-চারটে। কিন্তু এই সাহস বা দুঃসাহসকে কেউ কুনজরে দেখেননি, স্পর্ধা মনে করেননি। সকলের মধ্যেই এক ধরনের মমতার বাঁধন ছিলো। লেখক- শিল্পী- কবি- সাহিত্যিক সংখ্যায় তখন কত জনই বা। সকলে সকলকে চিনতেন, জানতেন। মনের ছাঁচ ছিল গ্রামীণ। সামন্ততান্ত্রিক অনাগর।
১৯৬৩-র জানুয়ারীতে ‘সপ্তক’ বেরিয়েছিলো। আকারে যথেষ্ট চটি, এখন হলে কেউ ছুঁয়ে দেখতো না। আমরা সবাই কিন্তু ঐ কাগজটার দৌলতেই আর অখ্যাত থাকলাম না।

মনে রাখা দরকার, ‘সপ্তক’ ছিল বাংলাদেশের তখনকার পূর্বপাকিস্তানের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন যাতে গল্প- কবিতা- প্রবন্ধ আলোচনা সবই ছাপা হতো। শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দিন তারও পূর্বে ‘কবিকণ্ঠ’ বের করেছিলেন। ১৩৬২-র ২৫শে বৈশাখ কিন্তু সেটি ছিলো শুধুই কবিতার লিটল ম্যাগাজিন। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ বেরোয় ১৯৬৪-র শেষ দিকে কি ১৯৬৫ সালের প্রথমার্ধে কোন সময়ে। এ দুয়ের মধ্যবর্তী কালে প্রকাশিত হয়েছিলো ‘স্বাক্ষর’৷ সম্পাদক হিসেবে প্রথম সংখ্যায় কারো নাম ছাপা হয়েছিলো আজ মনে পড়ে না। তবে বৃত্তের কেন্দ্র শক্তি ছিলেন প্রশান্ত ঘোষাল, মুন্সীগঞ্জের ছেলে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র, গল্প লিখতেন; অনন্তকাল হলো সাহিত্যজগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। সাংবাদিকতায় এখনও লেগে আছেন ইত্তেফাকে।
‘সাম্প্রতিক’ প্রকাশ করেছিলেন কবি সিকদার আমিনুল হক ও সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদু মিলে। যদি আয়ুষ্কাল বিবেচনায় আনি তবে সবচেয়ে ক্ষীণায়ূ ছিল ‘সপ্তক’। তারপর ‘স্বাক্ষর’। দুটোকেই শিশুমৃত্যুর পর্যায়ে ফেলা চলে। কিশোর বয়সে মারা যায় ‘সাম্প্রতিক’, শৈশব ও বাল্য পার হয়ে এসে। আর বৃদ্ধ বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু ‘কণ্ঠস্বরে’র। জ্যোতি ও আমি পরে ‘কালবেলা’ বের করি। ‘সপ্তক’ এর আসর ভেঙে যাওয়ার অনেক পরে। ‘কালবেলা’র প্রথম সংখ্যা হারিয়ে ফেলেছি। ‘সপ্তক’ অনেকের ভাবনা ও শ্রমের যৌথ ফসল ছিলো বলে সম্পাদনা দায়িত্বে কারোরই নাম ছাপা হয়নি। কিন্তু ‘কালবেলা’য় হল জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত।

জ্যোতির প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দুর্বিনীত কাল’ ততদিনে বেরিয়ে গেছে। আমার কোন বই বেরোয়নি। ‘কালবেলা’র দ্বিতীয় সংখ্যার তারিখ (এপ্রিল ১৯৬৬) আর সম্পাদকদের নিবেদন অংশ পড়ে হিসেব করে দেখতে পাচ্ছি প্রথম পুস্তিকা মানে ১ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫-র সম্ভবত অক্টোবর মাসে। দ্বিতীয় পুস্তিকায় বলা হয়েছিল সাম্প্রতিক কবিতার অনিয়মিত সংকলন কিন্তু তৃতীয় পুস্তিকায় দেখতে পাচ্ছি ঘোষণা করা হয়েছে সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক সাম্প্রতিক রচনাবলীর সংকলন। বেরিয়েছিল ১৯৬৭-র ফেব্রুয়ারিতে। এই সর্বশেষ সংখ্যাটিতে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ আলোচনা সবই ছিল। বয়ঃপ্রবীণ থেকে নবীন সকলকেই স্থান দেয়া হয়েছিলো। এক প্রান্তে সৈয়দ আলী আহসান, সিকান্দার আবু জাফর তো অন্য প্রান্তে মহাদেব সাহা, আবুল হাসান।
দ্বিজেন শর্মা লিখেছিলেন বিজ্ঞান ও অপচয়িত ধী আর করুণাময় গোস্বামী গান নিয়ে কণ্ঠ- সংগীতে রসস্বরূপ। গল্প ছিল শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক ও জ্যোতিপ্রকাশের। হায়াৎ মামুদের ছিল নব্য ভাবনা।

এবার একটা বিষয় মনে হয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সেটি আর কিছুই নয়, এই কথাটা বলা যে; ‘সপ্তক- স্বাক্ষর- সাম্প্রতিক- কণ্ঠস্বর’ মূলত একটিই পত্রিকা ছিল। অর্থাৎ যেসব মানুষজন এদের পিছনে ছিলেন তাঁরা প্রায় সমচিন্তারই লোক সবাই, একসঙ্গে মিলে একটা মাত্র কাগজকে (নাম তার যাই হোক) ঘিরে জোট বাঁধতেই পারতেন। তবে, সেটা ঘটে ওঠেনি, এই যা। এর পশ্চাৎপটে কোনো বৈরীতা, প্রতিযোগিতা, মতাদর্শগত (শিক্ষা বা সংস্কৃতি সংক্রান্ত) ভিন্নতা কাজ করেছিলো বলে আমার মনে হয় না।

মানুষগুলো কমবেশি এখনও ঢাকাতেই রয়ে গেছি, এখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয় কম- বেশি, শোকে- দুঃখে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। বয়স বাড়ায়, জীবন ও জীবিকার তাগিদ ও দাবিতে, এখন বরং দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেই বয়সে তেমন ছিলো না। অন্তত আমার গণনায় তা বলে না। তবে, ঈর্ষার অস্তিত্ব ছিল না এমনও হয়তো নয়। সে তো হতেই পারে। ঈর্ষার যে কারণ থাকবেই এমনও তো নয়। কিন্তু তার পরিমাণ বা তীব্রতা এরকম কখনও হয়নি যে, সকলের সামাজিক বন্ধুত্ব সম্পর্ককে বিপন্ন করে তুলতে পারে।

এবং যোগ-বিয়োগ করে এখন বুঝি কেনো ‘কণ্ঠস্বর’ সবচেয়ে বেশিদিন টিকেছিলো। প্রধান কারণ সম্পাদকের চরিত্র বৈশিষ্ট্য। আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ নিঃসন্দেহে আমাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক, সাংগঠনিক, প্রসন্নচিত্ত খুঁতখুঁতে মানুষ ছিলেন। তবে, আমার বিচারে ‘কণ্ঠস্বর’ পরে ছোট কাগজের (লিট্ল্ ম্যাগ) চরিত্র থেকে সরে এসেছিলো। আর, ‘সপ্তক’ ভেঙেছিল দৈব দুর্বিপাকে। প্রধান কারণ ছিলো, যা কেউ জানে না, ১৯৬৪-র দাঙ্গা। শেষ সংখ্যা বেরোয় দাঙ্গা থেমে গেলে। আমার ‘অবিনাশের মৃত্যু’ গল্প তাতে ছাপা হয়। গল্পকার না হওয়া সত্ত্বেও প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত হই ঐ গল্পের জোরে। কারফিউ তোলার পর প্রথম যেদিন প্লেন চলল সেবুকে সবাই মিলে উড়োজাহাজে চড়িয়ে দিয়ে এলাম। চাকরি বাকরির টানে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়লাম। মনের ভেতরের সুরটা একেবারেই আর আগের মতো থাকলো না।

আর এখন? কিছুই আর আগের মতো নেই। প্রতিটি দিন একটা থেকে আর একটা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সেসব দিন মনে হয় কোন পূর্ব জন্মের।

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ। Munshigonj.com

‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ২য় ভাগ

স্বপ্ন ও সময়: ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ১ম ভাগ।

ইতিহাস তো আর কিছু নয়, তা স্থান-কাল-পাত্রের সমন্বয়ে গড়ে-ওঠা ঘটনাপ্রপঞ্চ। নাকি, গড়ে তোলা? আমি নিজে ‘গড়ে-ওঠা’ বলবার দলে। ষাটের দশকটাকে ভাবা যাক না। কেমন ছিল সে-সব দিন? এই ঢাকা শহরটা তখন কেমন ছিল? আর শিল্পের চিন্তা মাথায় পুরে যাঁরা ঘুরে বেড়াতেন, প্রবীণ ও নবীন, কারা তাঁরা?

তখনকার ঢাকা শহর মানে এখনকার পুরনো ঢাকার চৌহদ্দি। তারই মধ্যে অভিজাত-অনভিজাত এলাকা, উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের গা ঘেঁষাঘেঁষি ভাব- ভালোবাসা। পঞ্চাশের শেষ আর ষাটের প্রথম দিকে বনেদি পাড়া তো ছিল মাত্র দুটো- গেণ্ডারিয়া আর ওয়ারী। এখনকার গুলিস্তান এলাকার ওদিকটায় আর শহর যায় নি; ফাঁকা জায়গা, মাঠ, বনবাদাড় এইসব। নটরডেম কলেজে ক্লাস করতে সাইকেলে চেপে গেছি ধেনো জমির ওপর তৈরি নতুন সড়ক ধরে। এখন যেখানে ইত্তেফাক অফিস (তখনও কি ওখানেই ছিল? মনে পড়ছে না) তার সামনেটা আর গোপীবাগের তল্লাট সবই তো ফাঁকা ধু-ধু: সামনের দিকটায় ধানক্ষেত-আখক্ষেত কমলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত, আর ডানদিকে ডাঙ্গা উঁচু জমি ফাঁকা পুকুর দু’ একটা ঘরবাড়ি দু’ একটা ছড়ানো-ছিটানো পার হয়ে গেলে একদম দক্ষিণের শেষপ্রান্তে ‘রোজ গার্ডেন’ প্রাসাদবাড়ি। সত্যি বলতে, রমনা কি পুরনো পল্টন একঘরের মতো বাইরে পড়ে থাকত। অর্থাৎ জীবন জ্যান্ত ছটফট করত, নানান ছন্দে মাতামাতি করতো এদিকটাতেই যা এখন পুরনো ঢাকা। তারও মুখের দুটো পাশ, নাকের দু’দিকে গণ্ডদেশ যেমন। নাকটা হল নবাবপুর রাস্তা চওড়া কপাল হল সদরঘাট-বুড়িগঙ্গা। ঐ মুখাবয়বের সীমা টেনে দিয়েছিল, আমার বিবেচনায়, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকার যোগসূত্রের একটি অংশ- গেন্ডারিয়া থেকে ফুলবাড়িয়া (অর্থাৎ ঢাকা রেলস্টেশন পর্যন্ত বিছানো রেললাইন) গেন্ডারিয়াই তো একটা দিকের শেষ সীমানা ঢাকা শহরের।

এক দিকে রইল বুড়িগঙ্গার জলরেখা, আরেক দিকে কলের গাড়ির যাত্রাপথ; এ দুয়ের মধ্যিখানে জায়মান রাজধানী সেই সুদূর পঞ্চাশ-ষাটে তখন প্রাণকল্লোলে কম্পমান। নতুন শিক্ষিত এলিট দানা বাঁধবার রসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে তখন পড়ে গেছে। পুরনো এমন কিছু ছিল না যা কালাপাহাড়ি বিক্রমে দুদ্দাড় করে ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। সবই নতুন। দল মত পথ সবই নতুনদের নিয়ে, নতুনদেরই মধ্যে। এই চালচিত্রে সেই সময়টিকে বুঝে নিতে হবে। আমার কাছে এক মহাদূর্লভ ছবি আছে, ভাগ্যগুণে শিল্পী আমিনুল ইসলামের সংগ্রহ থেকে পেয়েছিলাম। আমি মাঝেসাঝে বের করে দেখি।
সকলের বয়স বিশের একটু এদিক-ওদিক। পঞ্চাশ দশকের মহারথী সকলেই: আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শিল্পী হামিদুর রহমান (শহীদ মিনারের পরিকল্পক-রূপকার), শিল্পী আমিনুল ইসলাম। সকলেরই বয়স তখন বিশ-বাইশের কোঠায়। এখনকার মুখ ছবির মুখগুলোর ওপরে বসাতে গেলে মেলে না। তাতে কী?

চোখ রাখলেই আমার কৈশোরের ঢাকা পেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। আমরা এরই ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে ষাটের যুগে পা রেখেছিলাম। এইভাবে মনের মধ্যে তৈরি করে নিতে হবে সময়টাকে নইলে তখনকার আনন্দ উত্তেজনা ভালবাসা রোমাঞ্চ কিছুই বোঝা যাবে না।

ঢাকা তো মফঃস্বল শহর তখনও। যে-কোন ঘটনার ঢেউ আছড়ে পড়ে সকলের গায়, ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না। সংখ্যায় সবই অল্প। ব্যবসায়ী, লেখক, সাংবাদিক, ডাক্তার, উকিল-সবই যেন হাতেগোনা। দৈনিক কাগজও ওরকমই সংখ্যায়। সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কোনো সাময়িকী যাই বেরুক না কেন, চারদিক তোলপাড়। গোষ্ঠীই-বা এত কোথায় !! দু’চারটে বেশি হলে, কিন্তু যাই ছিল সংহত ছিল।
পঞ্চাশের দশকে অভিজাত গ্রন্থবিপনী আমার হিসেবে ছিল কুল্যে একটি এবং তাও আবার বইপাড়া বাংলাবাজারে নয়। “ওয়ার্সি বুক সেন্টার” আরমানিটোলায়, মাঠের পাশের এক রাস্তার ওপরে। গ্রন্থপ্রকাশেও তাঁরা হাত দিয়েছিলেন, যদিও বেশি বই তেমন বেরোয়নি।
সাহিত্যের আড্ডা ছিল ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিসে, পাটুয়াটুলিতে, জগন্নাথ কলেজের, খিড়কী দুয়োরের প্রায় মুখোমুখি। আর ছিল আড্ডা ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকা অফিসে, সেটারই পরবর্তী সময়ে রূপান্তর ঘটে “বিউটি বোর্ডিং”। প্যারীমোহন দাস রোডে ঢুকেই বাঁ দিকের গলিতে। ও-সব স্থানে যাওয়ার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি।

তো, এই আবহাওয়ারই তো সম্প্রসারণ ষাটের দশক অবধি চলে গিয়েছিল। কী নবীন স্নিগ্ধ সুবাসিত রূপসীই-না ছিল আমাদের ঢাকা, আজকের প্রজন্মের কাউকেই তা বিশ্বাস করানো শক্ত হবে। হেঁটে বেড়াতে কী আনন্দ ছিল। বিশেষ করে হেমন্তে। ম্লান অপরাহ্নে বিশ্ববিদ্যালয় (এখন মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ যে-চত্বরে) থেকে বেরিয়ে নিমতলির পথ ধরে জাদুঘর বা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাচীন ভূতুড়ে দালানের পাশ দিয়ে হাঁটছি, ছাতিমের গন্ধ স্নায়ু রোমকূপে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। কত অবসর ছিল জীবনে।

ঐ অবসর ঘিরেই বীজ বোনা চলতো শিল্পভাবনার, চলতো জটলা বন্ধুতে বন্ধুতে, ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টের অনতিপরিসর ছোট্ট ঘরে। টেবিলের ওপরে চা আর মোগলাই পরোটা (ভীষণ বিখ্যাত ছিল, আহা, সেদিন আর আসবে না) সামনে নিয়ে। রেসকোর্সের ময়দানে পা ছড়িয়ে আড্ডা দেয়া গেছে, রমনা কালীবাড়ির শান-বাঁধানো ঘাটে বসেও। সে-সব দিনের মতো বর্ষাও তো আজকাল আর নামে না। বর্ষা যে আর উপভোগ্য নেই তার কারণ কি জনস্রোত, চতুর্দিকে মানুষের ঢল? শীতের হি-হি কাঁপনও তেমন নেই যেন। যে-কোনো মেয়েকেই কী-যে রূপবতী মনে হত, পথেঘাটে মেয়েদের তো আর দেখা মিলতো না তেমন, আমাদের সেকালে মেয়েদের আনাগোনা ছিল মুখ্যত কল্পনায়। সে অন্য গোত্রের আনন্দস্বাদ। তাও বুঝবে না আমার বয়সীদের সন্তানসন্ততি। আমাদের সময়টা ছিল, আজ মনে হয়, সত্যি সত্যিই জীবন-আনন্দের ঘোর লাগা।

আমাদের সকল কর্মোদ্যম, যাবতীয় বাসনা ও স্বপ্ন ঐ আনন্দের অমলতা মেখেই বেরিয়ে আসতো। আমরা তখন যে যা-ই করেছি সবই নিখাদ ভালোবাসা থেকে করেছি। মতের গরমিল থেকে মনের অমিল হতো না।

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ। Munshigonj.com

‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ১ম ভাগ

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ ১ম ভাগ।

ভালোবাসা, আমার অদ্যবধি প্রত্যয়, অহৈতুকী। তুমি তোমার ভেতরের গুণে ভালোবাসো; কেউ ভালোবাসার যোগ্য বলে তাকে ভালোবাসা দিচ্ছো এমন নয়। হেতু তার মধ্যে নেই, আছে তোমার নিজেরই ভিতরে। ভালোবাসার আবদারেই অনেকেই অনেক দিন ধরে ঝোলাঝুলি করে আসছেন- এবারে নাকি আমার উচিত স্মৃতিকথা জাতীয় কোনো কিছু রচনায় হাত দেয়া। তাঁদের এই চাওয়ায় আমার যোগ্যতা প্রমাণ হয় না, প্রকাশ হয় তাঁদেরই ভালবাসা। সংগোপনে হয়তো বা লুকিয়ে থাকে একটু আশংকাও।

মরা-বাঁচার কথা কেইবা বলতে পারে? এই যে সৈয়দ আলী আহসান ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন, অনেক শারীরিক কষ্ট ও নিজ দোষে সামাজিক অবহেলা পেয়ে, জানতেন তো না যে চলে যাবেন। তোমারই যে অমনটা হবে না, কি হতে পারে না, কে বলবে? মোটামুটি তো বাঁচলে মন্দ দিন নয়-বাঙালির গড়পড়তা আয়ুর মাপে, নিজেকে নিয়ে বলবার কিছু থাকলে এখনই বলে নাও, পরে সময় না পেলে- তখন? হয়তো মনের আড়ালে এসব চিন্তা উঁকিঝুঁকি মারে তাঁদের, নইলে স্মৃতিচারণিক লিখা লিখতে আমায় তাঁরা বলেন কেন? কিন্তু তারা যা জানেন না, আমি সেই মোক্ষম কথাটি জানি; … তাহলো, আমার সে যোগ্যতা নেই। লিখার যোগ্যতা আছে কি নেই, আমার কাছে তা ধর্তব্যের বিষয়ই নয়। সমস্যাটি অন্যত্র। স্মৃতিচারণ মানুষ করে কী দিয়ে? মালার্মে হলে হয়তো বলতেন- কলম দিয়ে। যেমন তিনি বলেছিলেন কবিতা লিখা হয় শব্দ দিয়ে। কথা তা নয়। লিখতে হলে তো কলম দিয়েই লিখতে হবে; আমার ছাই টাইপরাইটার বা কম্পিউটার কোনোটিই নেই। কিন্তু তারও আগে? লিখতে হবে তো সবচেয়ে আগে স্মৃতির পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে। আমার জানা চৌহদ্দিতে আমাপেক্ষা বিস্মৃতিপরায়ণ মানুষ আমার অন্তত জানা নেই। এ নিয়ে আমার ভারি মনোকষ্ট আছে।

বিশেষ করে আমি এমন দু’-চারজনকে জানি যাঁরা স্মৃতিধর, একবার কিছু দেখলে ছবির মতো ধরা পড়ে থাকে মনের মধ্যে; শুধু দেখলেই না, শুনলেও- সে অর্থে তাঁরা শ্রুতিধরও। মজার কথা, এ ব্যাপারটি আয়ত্বসাধ্য বা চর্চাসাপেক্ষ নয়। বিদ্যাচর্চা বা জ্ঞানবুদ্ধির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত আমি চাক্ষুষ করিনি। আমার পিতৃষ্বসা, বসন্তপক্ষে আবার মাতৃস্বরূপাই-কারণ এর হাতেই আমি মানুষ, একেবারে আদ্যান্ত নিরক্ষর থাকলে কি হবে, সারা গাঁয়ে পুঞ্জিকার ভূমিকা পালন করতেন।

আমাদের জনসন-দা, মান এককালে মস্কোয় রাষ্ট্রদূত খান সামসুর রহমান, উত্তর কৈশোরে পঠিত কবিতা মধ্যপ্রৌঢ়ত্বে বসে আড্ডার আসরে মুখস্ত শুনিয়েছিলেন আমাদের। ডক্টর জি.সি দেবকে দেখেছি একবার কাউকে দেখলে পনের-বিশ বছর পরে দেখলেও তাকে চিনতে পারতেন, নাম-ধাম বলে দিতেন। আমাদের এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, গল্পলেখক, হুমায়ুন চৌধুরী, এখন দীর্ঘকাল কুয়ালালামপুরে প্রবাসী মিডিয়ায় কর্মসূত্রে, কী ঈর্ষণীয় স্মৃতিশক্তির অধিকারীই না ছিলেন !!
আমরা তখন ‘সপ্তক’ বের করছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুদা-র ক্যান্টিনে চা-সিঙ্গাড়া খেতে খেতে কী-যেন একটা খসড়া করা হল-একটা লিখা, এক পৃষ্ঠার মতো। আমিই লিখলাম, পাশে বসে ধরতাই যোগাতে লাগলেন জ্যোতি (গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত), সেবু (দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক ও কবি-নাট্যকার সেবাব্রত চৌধুরী, সম্ভবত এখন অবসরপ্রাপ্ত), শামসু (অধ্যাপক শামসুল হক, এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক) আর হুমায়ুন।

কাজের সময় দেখা গেল ঐ লেখাটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই মিলে হুমায়ুনকে ধরলাম- দেখুন তো মনে করতে পারেন কিনা। আশ্চর্য, হুমায়ুন প্রায় সবটুকুই স্মৃতি থেকে তুলে এনে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আনিস স্যারের (ড. আনিসুজ্জামান) স্মৃতিচারণ বেরুচ্ছে তখন দৈনিক প্রথম আলো‘তে। একদিন কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করি- স্যার, আপনি কি ডায়েরী রাখতেন? অবাক হয়ে বললেন- না তো, কেন? আমি তার একশ’ গুণ বেশি অবাক হয়ে যাই শুনে যে সবই তিনি স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে লিখছেন, তবে খট্কা লাগলে সম্পৃক্ত দু-একজনকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নেন। দুঃখ করলেন- স্মৃতিশক্তি পড়ে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে তো।

আমার মনে ক্রমে এ বিশ্বাসই দৃঢ় হয়েছে দিনকে দিন যে, আমি প্রায়- স্মৃতিহীন মানুষ, ভবিতব্য এভাবেই আমাকে তৈরি করে দিয়েছে, এতে আমার কোনো দায়ভাগ নেই, আমার করণীয় যেমন কিছু নেই দুঃখশোক করারও কিছু নেই হারিয়েছি বলে। কিন্তু মন তো মানে না। যাই হোক, মানুষ বটে তো আমি। অন্যের ভাগ্যে একটু ঈর্ষে হয় একটু হিংসে, দৈবের ওপরে অভিমানও হয়। আর রাগ হয় আমার সেইসব প্রিয় জনদের ওপরে যাদের ধারণা আমি চাইলেও স্মৃতিকথা লিখতে পারি।

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ। Munshigonj.com

বাংলা উপন্যাসের স্বরূপ সন্ধানে : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

cd254e30775072c755877672d66d061e

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপন্যাস হলো আধুনিক যুগ সচেতন শিল্পকলা। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ বেনিয়া শাষিত কলকাতা এবং তৎকালীন মফস্বল জীবনের যে বিন্যাস, সেই বিন্যাসের টানাপোড়নের বাস্তব আকর্ষণেই জন্ম নেয় বাংলা উপন্যাস। সেই সময়ে কলকাতাকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে জীবন গ্রহের যে বীজ অংকুরিত ও সঞ্চীবিত হচ্ছিল, তারই প্রচণ্ড আলোড়নে মধ্যবিত্ত চিরাচরিত জীবনবোধ এক নতুন আশা আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়। ফলে জীবন ভাবনায় দেখা দেয় তীব্র সংকট। যুগ চেতনার সেই প্রক্ষাপটেই সৃষ্টি হয় ‘নববাবু বিলাস’ ও ‘আলালের ঘরে দুলাল’।
এর মাধ্যমে বাংলা উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়।

প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের যথার্থ লক্ষণ প্রত্যক্ষ করা গেলেও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক। উপন্যাস রচনার কলা-কৌশল আয়ত্বের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম সার্থক শিল্পী। এ জন্য তাঁকেই বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়।
বঙ্কিম পরবর্তীকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হলেও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার অধিকারী। উপন্যাস রচনায় তাঁর উপাধি ছিল অপরাজেয় কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্রের পরে আরও অনেকেই উপন্যাস রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাস রচনায় তিনি ছিলেন নানান কৃতিত্বের অধিকারী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের যে চরম সংকট দেখা দিয়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলা কথা-সাহিত্যে আমূল পরিবর্তনের এক ধারা সূচিত হয়। যে কয়েকজন লেখকের হাতে এ বৈপ্লবিক ধারার সূচনা হয় মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রিয়ালিটি বা জীবনবাদী শিল্পী। কারণ সম-সাময়িক কালের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের ট্রাজেডি, এতো নির্মম বাস্তবতা ও শিল্প-কুশলতায় আর কোনো লিখক ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। নিম্নবিত্ত ও সর্বহারা সমাজের মানুষের ক্ষয়-ক্ষতি, মনুষ্যত্বের অপচয়, ক্লেদ-হতাশা ও দুঃখ বেদনায় তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্রধারায় চিরভাস্বর।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমালোচক নারায়ণ চৌধুরী বলেছেন, ‘মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অভ্যন্তরিক রিয়ালিজম ঘেঁষা মনোভাব তাঁকে শিল্পজীবনের সৌন্দর্যের আদর্শ থেকে দৃষ্টি গ্রাহ্যভাবেই বিচ্যূত করেছে। এমন কি মধ্য ও শেষের দিকের লিখায় তিনি সচেতনভাবেই অসুন্দরের পূজারী হয়ে উঠেছিলেন বললেও অন্যায় হবে না।’ (নারায়ণ চৌধুরীঃ সমকালীন সাহিত্য পৃষ্টা-১২৩-২৪)।

কালের বিচারে মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিশের যুগের বাংলা ঔপন্যাসিকদের অন্যতম প্রধান পুরুষ। এই ত্রিশের কালের যুগেই বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মানসে চিন্তা চেতনাকে বিজ্ঞান মনস্ক করে তোলার জন্য যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়; তাঁর একদিকে যেমন রয়েছে বিশ্ববীক্ষা স্বদেশকে বিশ্বের অংশ হিসেবে উপলব্ধি করা, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে মানুষ পরিবেশ ও মনোজগত সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ক্রিয়াশীল ভূমিকা।
সে কারণেই ত্রিশের বুদ্ধিজগতে জীবনের সার্বিক সংকটে স্বীকৃতি যেমন স্পষ্ট, তেমনি সেই সংকটকে শিল্প সৃষ্টিতে পরিহার না করার দৃঢ় প্রবণতাও লক্ষণীয়। এই দৃঢ়তার মূলে ছিল জীবন সম্বন্ধে প্রবল আশাবাদ।

মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন সেই আশাবাদী জীবনের একজন সচেতন শিল্পী। তাই তাঁর উপন্যাস সমূহে ধ্বনিত হয়েছে সমকালীন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালির আশাদীপ্ত জীবনচেতনার চঞ্চল প্রেরণা ও তীব্র বেদনাবোধ।

জীবন আশাবাদী শিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায় মোট ১৯টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস “দিবারাত্রির কাব্য”। প্রকাশকাল ১৯৩৫। প্রকাশের দিক থেকে এটি দ্বিতীয় প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ জননী। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘মাটির ছেলে’। প্রকাশকাল-১৯৬০। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

বিষয়বস্তু ও মনোদৃষ্টির ভিন্নতার কারণে তার রচিত উপন্যাস সমূহকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পুতুল নাচের ইতিকথা এবং পদ্মানদীর মাঝি। দ্বিতীয় ভাগে চতুস্কোন সরীসৃপ অহিংসা প্রভৃতি এবং তৃতীয়ভাগে পড়ে শহরতলী চিহ্ন আরোগ্য ইত্যাদি।
এরই তিনভাগের রচনায় তিনি যদিও তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবস্থা করেছেন, তথাপি তাঁর মনোভঙ্গি ও জীবন গ্রহণের পদ্ধতি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গেছে। শিল্পী হিসেবে মানিক বন্দোপ্যাধায়ের শক্তি এবং দৌর্বল্যের উৎস এই অপরিবর্তনীয় মনোভঙ্গির মধ্যেই নিহিত।

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে তাঁর উপন্যাসের শিল্প-সংকটের যে অভিযোগ আনা হয়, সে সংকট তাঁর পক্ষে মূলত মতবাদেরই সংকট। এই সিদ্ধান্তের কথা মনে রেখেই মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসের বাস্তবতা এ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত।

বাংলা সাহিত্যের ধারায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, বক্তব্য ও প্রকরণ ব্যাক্তিত্বমণ্ডিত ও স্বচিহ্নিত জীবনের অন্তর্গত এবং বহির্গত বিষয়ের উন্মোচনে বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনার সীমানাকে তিনি অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন মানুষের মনোবিশ্ব ও বহির্বাস্তবতার সঙ্গে নিজস্ব জীবনাবেগ ও তত্ত্বাবেগের সুষম সমন্বয় সাধনের অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে।
সেজন্যই তাঁর উপন্যাসে বিন্যাস মনোবিশ্ব যেমন স্বতন্ত্র ও নিগূঢ়, অভিনিবেশ্য বিশেষত্বপুর্ণ। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য তাঁর শিল্প-চেতনার স্বাতন্ত্র্যময় সম্ভাবনাকেই ধারণ করেছে।

বিষয় ও প্রকরণে এই উপন্যাসে তিনি যেমন নিরীক্ষাধর্মী ও ব্যতিক্রম তেমনি জীবনের প্রতি একটা গভীরতার স্বরূপ এবং জীবনের এই অন্তর্লোক সন্ধানী শিল্প দৃষ্টি সহজ-সরল গ্রামীন জীবনের গভীরতার স্বরূপ উন্মোচনেও উৎসুক।

জীবনের এই অন্তর্লোক সন্ধানী শিল্পদৃষ্টি তাঁর উপন্যাসে সহজ-সরল গ্রামীন জীবনের জটিলতা চিত্রিত করেছেন। বৃহত্তর গণজীবনের সার্থক রূপচিত্র অঙ্কনে এবং শক্তিময় অন্তস্রোত সৃষ্টিতে তিনি বাস্তব মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়েছেন।
ত্রিশের দশকে আঁকা তাঁর এই গ্রামীণ জীবন চিত্র প্রত্যক্ষ সংগ্রামের শ্রেণী সচেতনায় শাণিত না হলেও জীবন সংগ্রাম সেখানে কখনো প্রতীকের আড়ালে, কখনো অদম্য উত্তীর্ণ তার স্পৃহায় সীমাবদ্ধ।
‘পদ্মানদীর মাঝি’তে তা গতিমুখর হলেও পুতুল নাচের ইতিকথায় সে স্পৃহা বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি জীবন অন্বেষার পথ ধরে জনজীবনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।

তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ মূলত শহরতলী এবং গ্রামের এক মিশ্র পরিচয়। শহরতলীতে বসবাসরত শ্যামার পারিবারিক জীবন যেন অনেকাংশেই গ্রামীণ জীবনাচরণ বহন করে চলেছে। তবুও একথা বলতে হয় যে, জননী অংশত পুতুল নাচের ইতিকথার এবং পরিপূর্ণ পদ্মানদীর মাঝিকে বাংলার গ্রাম তার রূঢ় বাস্তব নিসর্গ এবং চলিষ্ণু মানুষের কাহিনী নিয়ে আশ্চর্য রকম সজীবতায় মূর্ত। গ্রামীন জীবনের দৃশ্যচিত্র নির্মাণের এবং প্রধান প্রধান চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি যে সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।

পুতুল নাচের ইতিকথা ও পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস দুটিতে তিনি এক সুতীব্র ও বহমান নদীর দ্বন্দ্ব উপস্থিত করেছেন। এই দ্বন্দ্বস্মৃতির সঙ্গে বিস্মৃতির সীমার প্রসারতার বসতির সঙ্গে ভ্রমণের শোষন পীড়িত শ্রেণীদ্বন্দ্বের অসংগতিতে বিভক্ত সমাজে সাহিত্যিকের কাঁচে মার্কসবাদ একটি একটি আদর্শ ও স্বপ্ন।

তিনি ছিলেন সেই স্বপ্ন ও আদর্শে বিশ্বাসী এক নিষ্ঠাবান শিল্পী। তাই তাঁর উপন্যাস এর যথার্থ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বেঁচে থাকার আশা ও স্বপ্ন নিয়ে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে প্রতি নিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে।

উপন্যাস রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সত্য-সন্ধানী। তাঁর উপন্যাসে যে গভীর সত্য প্রকাশিত হয়েছে তার স্বরূপ হলো মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মানুষের বাস্তব জীবনের প্রতি ভালোবাসা। এই ভালোবাসার চিত্র অঙ্কন করেছেন পদ্মাপাড়ের জেলে-মাঝিদের জীবন ও ওদের সুখ-দুঃখ নিয়ে। তাঁর পূর্বে আর কোনো লেখক এমন তীক্ষ্মভাবে, এমন মমতার রসে সিক্ত হয়ে ওদের জীবন-চিত্র অঙ্কন করেননি।

বাংলা সাহিত্যে তাঁর উপন্যাসেই প্রথম সমাজের নীচুতলার মানুষের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর শোনা গিয়েছে। ওদের জীবনের এমন বাস্তব চিত্র তাঁর পূর্বে আর কেউ অঙ্কন করতে সাহস করেননি। পুতুল নাচের ইতিকথার দেখা দেখা যায় গ্রাম বাংলার সেই রিক্ত পল্লী জীবনের এক অবিস্মরণীয় চিত্র সমকালীন জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি বই আর কিছু নয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কথা সাহিত্যের পরিধিতে যোগ করেছেন এক অচেনা ও অবহেলিত জনপদের জীবন কথা। তাঁর হাতেই বাংলা উপন্যাসে যৌনজীবন ও অন্তর্জীবন একটি সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যে নরনারীর যৌন সম্পর্ক এতোদিন নিষেধ বা রোমান্সের ঘেরাটোপে ঢাকা ছিলো। সে অবস্থায় তিনিই প্রথম নির্ভীকচিত্তে তীর্যক সন্ধানী আলো নিক্ষেপ করেন সেই ধারাবাহিক অন্ধকারের উপর। প্রেম ও যৌনতাকে তিনি বিশেষণ করেছেন বিজ্ঞান নিরাসক্ত তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে অস্তিত্ববাদী এবং চৈতন্য প্রবাহের লক্ষণ মুক্ত চরিত্রের তিনিই প্রথম স্রষ্টা।

দিবারাত্রির কাব্য, চতুস্কোন এবং পুতুল নাচের ইতিকথা তাঁর এই তিনটি উপন্যাসই মগ্ন-চৈতন্যের বিশেষণ ভিত্তিক সাহিত্য। পূর্বে যে মার্কসবাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা তাঁর হাতেই এর প্রথম সার্থক প্রয়োগ হয়েছিলো। তাই মার্কসবাদী লেখক হিসেবেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমধিক পরিচিত।

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় তাঁর শিল্পকর্ম এক স্বতন্ত্র প্রতিভার স্বাক্ষর। ত্রিশের লেখকদের মধ্যে যার গদ্যরীতি পরবর্তী দশকে শক্তিমান লেখকদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল, তিনি হলেন কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপ্যাধ্যায়।

manik
মানিক বন্দোপ্যাধ্যায়।
(জন্মঃ ১৯শে মে ১৯০৮ইং। মৃত্যুঃ ৩রা ডিসেম্বর ১৯৫৬ইং।)

কৃতজ্ঞতায়ঃ প্রফেসর মোহম্মদ আশরাফ।
প্রফেসর মোহম্মদ আশরাফ। পদ্মা পাড়ের মানুষ। মুন্সীগঞ্জ, সাহিত্য থেকে শেয়ার করা হলো।
podma1podma