বিভাগের আর্কাইভঃ শিল্পসংস্কৃতি

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- সমাপ্ত পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- সমাপ্ত পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পৌষের সন্ধ্যা। শীত বেশ ঝাঁকিয়েই পড়েছে, বিশেষ করে রাঢ় বাংলায়। পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে অনেকক্ষণ আগেই সূর্য গিয়েছে ডুবে। শান্ত নীল সন্ধ্যা নেমেছে মধুকুন্ডা-মুরাড্ডি-রামকানালী-বেড়ো-জয়চণ্ডী পাহাড়-আদ্রা-আনাড়া-ছড়বা-টামনা-গড়ধ্রতবেশ্বর-কুমকি স্টেশন লাগোয়া গ্রামগুলিতে। ঘরে ঘরে তখন কেরোসিন কুপির আলোয় এ পাড়ার ও-পাড়ার মেয়েরা টুসু পেতেছেন। মেয়েরা টুসুর ব্রত পালন করবেন গান গেয়ে। তাৎক্ষণিক বাঁধা হবে সে গান। সে গানে থাকবে যেমন রঙ্গরস বা হাস্য পরিহাস, তেমনি থাকবে মেয়েদের আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, সুখ দুঃখ, হাসিকান্নার কথা। নিজেরাই বাঁধবেন, নিজেরাই সুর দেবেন, নিজেরাই গাইবেন। কোনো অনুষ্ঠানে গাওয়া হবে ভেবে নয়, শুধু মনের কথা খুলে বলতে। এসে যাবে সমসাময়িক ঘটনাও। ১৮৩৫ সালে যখন প্রিন্স দ্বারকানাথের কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি মাটি খুঁড়ে কয়লা তোলা শুরু করলো কুয়ো খোঁড়ার মতো করে তখন গান বাঁধলেন মেয়েরা—

‘চল টুসু জল খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা,
খেলতে খেলতে দেখতে পাবো কয়লা খাদের জলতোলা’

সে গান রেকর্ড হলো ১৯৬০ সালে। লতা মঙ্গেশকর গাইলেন সেই গান।

আবার তারও আগে কুলীন ব্রাহ্মণ যখন শতাধিক কুলীন কন্যার পাণিগ্রহণ করে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া সামলে উঠতে পারতেন না, তখন কুলীন কন্যার জননীর আর্তি ফুটে উঠতো টুসু গানে—

বাড়ির নামো নারকোল গাছটি কলসী ভরে জল দিব
একটি নারকোল ধরলে পরে তারে চিঠি পাঠাবো।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জামাতা না এলে তাঁকে চিঠি পাঠানো হবে। কিন্তু তাতেও কি মন ভেজে?

চিঠি পাঠাই ঘোড়া পাঠাই তবু জামাই আসে না,
জামাই আদর, বড়ো আদর তিনদিন বই আর থাকে না।

তখন শাশুড়িমা জামাতাকে প্রলুব্ধ করেন এই বলে—

আর কটা দিন থাকো জামাই খেতে দিব ছাঁচি পান
বসতে দিব শীতলপাটি সোনার মুকুট করবো দান।

কৌলিন্য প্রথার যুগের কী করুণ ছবি! সামন্ততন্ত্রেরও আরেক রূপ! এখানেই শেষ নয়। আরও আছে, তবে একটু অন্য ধরনের। বিষয়; মেয়ের শ্বশুরবাড়ি।

শ্বশুরবাড়িতে একটু সাজার উপায় নেই। শাশুড়ি-ননদ যদি খোঁটা দেন! সুন্দরী টুসু যখন প্রথমবার বাপের বাড়ি এল, তখন তার সঙ্গিনীরা প্রশ্ন করছে :
হলুদবরণ টুসু তুমি হলুদ ক্যানে মাখো না!
টুসু উত্তর দিচ্ছে :
শাশুড়ি ননদির ঘরে হলুদ মাখা সাজে না।

আসলে টুসু তখন আর দেবী নয়। মানভূম-বাঁকুড়া-পশ্চিম বর্ধমান-ধলভূম-সিংভূম-বীরভূমের গাঁয়ের মেয়ে। তোমার মেয়ে, আমার মেয়ের মুখে এই টুসু।

অখণ্ড বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তুষ তোষলা ব্রতের প্রচলন আছে। অনুমান, এই তুষ তোষলা ব্রতই মানভূম-ধলভূম-ঝাড়গ্রামের টুসু। ড. সুধীরকুমার করণ এ বিষয়ে মতামত দিয়ে জানিয়েছেন, এই প্রশ্নে তাঁর কোনো সন্দেহ নেই যে তুষ তোষলা ব্রতই টুসু। এই অঞ্চলের ভাষাগত কারণে তুসু আবার টুসুতে রূপান্তরিত হয়েছেন। অঞ্চল বিশেষে এই রূপান্তর স্বাভাবিক।

হেমন্তের শেষে ধানকাটা শেষ। শূন্য মাঠে, আকাশে বাঁকা চাঁদ, খামারে শিশিরের প্রাণ। শুধু খামারে ধানঝাড়া, ধান মাড়াই, ধানসিদ্ধ, ধান তোলার কাজ চলছে মণিহারা-লালগড়-বেড়ো রঘুনাথপুর-কাশীপুর-মৌতোড়-তিলুড়ি-সিরজাম- ঝাঁটিপাহাড়িতে। তখনই মেয়েরা টুসু পাতেন। কুলুঙ্গীতে থাকবে কালো দাগ শূন্য মাটির সরা, তাতে একশো চুয়াল্লিশটি গোবরের নাড়ু। নাড়ুর উপর পিটুলি গোলা ছড়ানো। তার উপর সাদা ফুল। হলুদ-কমলা-লাল রঙের গাঁদা ফুল, সরাটিই টুসুর প্রতীক। টুসুর কোনও মূর্তি নাই। কোনও কোনও অঞ্চলে ঘট পাতা হয়। কোথাও কোথাও ছোট একটা গোবরকুঁড় অর্থাৎ গোবরের কুণ্ড তৈরি করা হয়, সেখানে গোবর রাখা হয়।

কোথাও কোথাও মালাফুল, সর্ষেফুল, বেগুন ফুলও দেওয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে শস্যকামনার ইঙ্গিত। এক বছর শস্য উৎপাদনের পর ধরিত্রী তার উর্বরতাশক্তি হারিয়েছে, তাই আবার গোবর দিয়ে তাকে উর্বরা শস্যশালিনী হওয়ার জন্য টুসুকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। তাই অঘ্রাণের সংক্রান্তিতে টুসু পাতা হয়। পাড়ার কয়েকটি বাড়ির বা একটি অঞ্চলের কিশোরী আর তরুণীরা মিলে একটা বিশেষ বাড়িতে টুসু প্রতিষ্ঠা করে।

তারপর সন্ধ্যায় পাখপাখালি যখন বাঁশঝাড়ে কিচিরমিচির শব্দ তোলে, মুনিস-মাহিন্দাররা যখন গোয়ালে গোরুমোষের পরিচর্যা শুরু করেন, বড় উনুনে যখন কামিনরা তুষের আগুনে ধান সিদ্ধ করেন, ভানুদিরা ঢেঁকিশালে যখন ধান ভানেন, তখন সবাই সমবেত কণ্ঠে টুসু গাইতে আসেন। টুসুর কোনও মন্ত্র নেই। একই সুরে পর পর স্তবকের পর স্তবক গাওয়া হয়। এ গানের স্থায়ী, অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগ নেই। এ গানে হারমোনিয়াম-তবলা বা মাদল চোল-কাঁসি লাগে না। যাঁরা গান করেন তাঁরা কেউ সংগীতবিশারদ বা সংগীতপ্রভাকর নন। গান বাঁধতে গেলেও অনুমোদিত গীতিকার হতে হয় না। তবুও তাঁরা সমন্বয়ে গেয়ে ওঠেন :

আদাড়ে বাদাড়ে পদ্ম পদ্ম বই আর ফুটে নাই।
আমাদের টুসুর পায়ের পদ্ম গো ভ্রমর বই আর বসে নাই।

সেই ভ্রমর আর পদ্মের চিরকালীন প্রণয়। প্রেমিক আর প্রেমিকার চিরন্তন প্রতীক এই ভ্রমর আর পদ্ম।

ভ্রমর জানায় কমলমাধুরী অন্যে কি তাহা চায় গো,
সে রসে বিরস মণ্ডুকে যে হায় নিকটে থাকি না পায়গো
ঐজন প্রেম গূঢ় মরম, সখি, সকলে জানে কি তায়।

ঝুমুর পদকর্তা রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি খুঁজে পেয়েছেন ভ্রমর আর পদ্মের সম্পর্ক। আর আমাদের মেয়ে টুসুর চরণদুটিও পদ্মের মতো। ভ্রমর ভুল করে তার চরণ কমলের সুধা পান করছে।

বাস্তবিক, শাল-মহুয়া-বৈঁচি-পিয়াল-অর্জুন-বহেড়া-হরিতকি- কেঁদ-পলাশবনে ঢাকা পঞ্চকোট-জয়চণ্ডী পাহাড়ের সানু দেশে অবস্থিত মানভূম-ধলভূম-সিংভূম-ঝাড়গ্রাম-বাঁকুড়ার মানুষের কাব্যশক্তি এমনই প্রখর!

অঘ্রাণ সংক্রান্তি থেকে পৌষসংক্রান্তি পর্যন্ত টানা এই একটি মাস ধরে চলে এই টুসু ব্রত বা টুসু পুজো। টুসু পুজোর গোড়ার কথা অনেকেরই অজানা। তাই নানা জনের নানা মত। টুসু যদিও প্রাজ্ঞজনদের ধার ধারে না। পুরাণে টুসুর কোনো উল্লেখ নেই। স্বাভাবিকই। কারণ টুসু কোনো দেবী নয়। টুসু শস্য আহ্বানের বন্দনা মাত্র। তাকে রুখু-সুখু বাংলা বন্দনার নিমিত্তে কিছু অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মহিলারা টুসু ব্রত পালন করেন। কিন্তু এই বন্দনা গ্রামীণ সমাজের, ধর্ম ভেদাভেদ ভুলেই। বীজ বপন থেকে ফসল ঘরে তোলা কি সম্প্রদায়-সম্প্রদায়ের বিভাজন বোঝে?

তবে সময়ের কালে বিবর্তন ঘটেছে টুসু উৎসবের। অনেকেই শস্যকামনার এই উৎসবকে সংকীর্ণ গণ্ডিতে বেঁধে ফেলে নারীজীবনের সমষ্টিগত কামনা পূরণের উৎসব হিসাবে পালন করেন। তাই হয়তো কেউ কেউ গান বাঁধেন—

রাজ্যেশ্বর স্বামী চাই সভ্য-আলো জামাই চাই।
সভাপণ্ডিত ভাই চাই, দরবার শোভা বেটা চাই।
রূপকোটা ঝি চাই।

সামাজিক উৎসবকে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করে ফেলার প্রয়াস থাকে সমাজপতিদের। অথচ এইসব উৎসব ধর্মীয় আবেগ, জিগিরকে উপেক্ষা করেই সময় বা অঞ্চলভিত্তিক আপন স্বরূপে জড়িয়ে গিয়েছে গ্রামবাংলার জীবনে।

১৯৪৭ সালের পনেরোই আগস্ট দেশভাগ হলো। ক্ষমতা হস্তান্তর হলো। কিন্তু লর্ড কার্জনের আমলে পশ্চিমবাংলার পশ্চিম সীমান্তের যে জেলাগুলিতে শতকরা সাতাশিভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, সে অঞ্চল বিহারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সেই জেলাগুলি স্বাধীনতার পরেও বাংলার অন্তর্ভুক্ত হলো না। শুরু হলো লোকসেবক সংঘের আন্দোলন। পাঁচের দশকের গোড়াতে বিহার সরকার রাতারাতি নানা কৌশলে মানভূম-সাঁওতাল পরগণাতে জোর করে বাংলার বদলে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। ঠিক পূর্ব পাকিস্তানে যেমন উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলন যত তীব্র হলো দমনপীড়ন ততই বেড়ে গেল। লোকসেবক সংঘের পাশে এসে দাঁড়ালো কমিউনিস্ট পার্টি আর কমিউনিস্ট সাংসদরা। তখনও হাতিয়ার করা হলো টুসুগানকে। লোককবি গান বাঁধলেন—

আমার মনের মাধুরী—
তাই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি!

আকাশ জুড়ে বৃষ্টি নামে
মেটো সুরের কোন্‌ চুয়া।
বাংলা গানে ছড়া কেটে—
আবার মাপে ধান রুয়া

মনসানীতি, বাংলাগানে
শ্রাবণে জাঁত মঙ্গলে
চাঁদ বেহুলার কাহিনী পাই
চোখের জলে পাব বলে।

বাংলাগানে করিলো সই ভাদুপরব ভাদরে
গরবিনীর দোলা সাজাই ফুলে পাতায় আদরে।
বাংলা গানে টুসু আমার মকরদিনে সাঁঝরাতে।
টুসু ভাসান পরব টাঁডে টুসুর গানে মন ভরে।’

অরুণচন্দ্র ঘোষের লেখা এই টুসুগান কমিউনিস্ট সাংসদ রেণু চক্রবর্তী ইংরেজিতে অনুবাদ করে সংসদে শুনিয়েছিলেন। এছাড়াও মানভূমের গ্রামে গ্রামে তখন বাংলাভাষার সম্মান রক্ষার জন্য মেয়েরা টুসু গান বেঁধে সন্ধ্যাবেলায় গাইতেন। এ খবর পৌঁছেছিল বিহার সরকারের কানে। টুসু গান গেয়ে সত্যাগ্রহ করার অপরাধে হেমচন্দ্র মাহাতো, বাঁধু মাহাতো, কেরামত আনসারি, ভীমদাস গোস্বামী, বুধন মাহাতো, বিভাজান আনসারি, ভীমদাস গোস্বামী, নকুলচন্দ্র মাঝি এবং শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। টুসু তখন আর শস্যকামনা বা নারী জীবনের কামনাবাসনার দেবী রইল না, বাড়ির মেয়ে হয়ে গেল আন্দোলনের সাথী। টুসু শিল্পী বারো বছর বয়সি দৃষ্টিহীন কিশোর বাবুলাল মাহাতোও রেহাই পায়নি। নাকের বদলে নরুণ পাওয়া গেল। মানভূম জেলার পুরুলিয়া মহকুমা শেষে পুরুলিয়া জেলা নাম নিয়ে বাংলার মানচিত্রে ঠাঁই পেল। বাদ গেল চান্ডিল, ইচাগড়, পটমদা থানা। এই তিনটি থানাতেই বড় বড় ঝুমুর মহাজনদের বাস ছিল, এখানকার রাজদরবারগুলিতে দরবারী ঝুমুরের চর্চা করতেন রামকৃষ্ণ গাঙ্গুলি, চৈতন সিং, কানার্ড সিং, জগৎ কবিরাজ, শ্রীপতি দত্তরা। আজ বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ ঝুমুর গানের এই ধারাটি অবলুপ্তপ্রায়। টুসুগানেই মানুষ আক্ষেপ জানালো :

‘হায় ভালোবাসা,
আমার চলে গেল চাঁইবাসা।’

সারা পৌষমাস ধরে টুসুব্রত পালনের পর পৌষসংক্রান্তির আগের রাতে হয় জাগরণ দিনটিকে বলা হয় বাঁউড়ি। তারপর সাঁকরাইতের দিন চৌদোলাতে টুসুকে নিয়ে মকরের ভোরে সুবর্ণরেখা-কংসাবতী-দ্বারকেশ্বর-শিলাবতী-শালী-গন্ধেশ্বরী-দামোদর- বরাকর-অজয় অথবা স্কুলপাঠ্য মানচিত্রে উল্লেখ নেই এমনি কোনও ডুংরি, জোড় বা খাসালে বা বড় কোনও বাঁধে টুসুর বিসর্জন হয়। সারা মাস ধরে উৎসবের শেষে চোখে জল আসে সবার। টুসুর ভাসান বলে এইসব অঞ্চলে। টুসুকে ভাসিয়ে স্নান করে নতুন কাপড় পরে হলুদরাঙা মুড়ি, তিলের নাড়ু, নারকোলের নাড়ু খেয়ে তাঁরা গাইবেন :

এসো পৌষ যেওনা,
জনম জনম ছেড়ো না।

টুসু বিদায়ের সাথে পৌষকেও বিদায় দেওয়া হয় আসছে বছর আবার ফিরে আসার বাসনা নিয়েই।

লিখেছেন- অশোক দাস
তথ্যসহায়তায়: গণশক্তি পত্রিকা

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- দশম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- দশম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পাঁচখুরি হাটের এককোণে জনাপাঁচেক লোক। প্লাস্টিক আর চাটাই বিছিয়ে কিছু মুর্তি সাজিয়ে খদ্দেরের আশায় বসে আছেন। পাশাপাশি চলছে মুর্তি তৈরির কাজও। খদ্দের তেমন নেই। অথচ হাটের অন্য দোকানে চলছে জমজমাট পৌষ সংক্রান্তির বিকিকিনি। পিঠেপুলি তৈরির মাটির হাঁড়ি-সরা, বাঁশের ঝুড়ি, নতুন জামাকাপড় সবই বিকোচ্ছে দেদার। তাল কাটে শুধু টুসু মূর্তির বিক্রেতাদের কাছে।

‘‘আগের দিন আর নেইগো বাবু’’— আক্ষেপ রঞ্জন দে-র। প্রায় তিরিশ বছর ধরে পাঁচখুরির হাটে টুসু মূর্তি বিক্রি করছেন খড়্গপুরের বেনাপুরের রঞ্জন দে, বিষ্ণুপদ রাণারা। আগে মকর পরবের এই সময়ে প্রতি হাটবারে হেসেখেলে দু’শো থেকে আড়াইশো মূর্তি বিক্রি হত। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই সেই বিক্রি আর নেই। এ বার তো বাজারের হাল গতবারের থেকেও খারাপ। একশো মূর্তি গড়েও বিক্রি হবে কিনা চিন্তায় রয়েছেন শিল্পীরা। ঝাড়গ্রামের সরডিহা থেকে আসা টুসু শিল্পী গোপাল দাস জানালেন, কমবয়সীদের এতে তেমন আর উৎসাহ নেই। আর বছর বছর টুসু প্রতিমার বিক্রি কমার সেটাই কারণ।
৩০ টাকা থেকে টুসুর মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতা থাকলে ঘোড়ায় চড়া মূর্তিও কেনা যাবে। দাম ৩০০ টাকার কাছাকাছি। তবে তার খদ্দের কম। অথচ টুসুই দক্ষিণবঙ্গের পৌষ সংক্রান্তি পরবের প্রাণকেন্দ্র। সংক্রান্তির আগের সন্ধ্যায় বাড়ির মহিলারা উপোস থেকে সারা রাত ধরে গান গেয়ে টুসু বন্দনা করেন। ভোরে পুকুরে না নদীতে টুসুর বিসর্জন। টুসুর এই মৃন্ময় মূর্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত।

মেদিনীপুর শহরের চারপাশ, বেলপাহাড়ি, ঝাড়গ্রাম, বাকুঁড়া, পুরুলিয়া এরকম নানা এলাকাতে টুসুকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোককথা রয়েছে। কোনও গবেষকের কাছে টুসু উৎসবে গ্রাম বালিকার পুতুল খেলার প্রাধান্য বেশি, কারও মতে প্রাথমিক পর্যায়ে টুসুর কোনও মূর্তি প্রচলিত ছিল না। কালক্রমে তা চালু হয়। আবার কেউ মনে করেন টুসু নবান্ন নয়, তা আসলে আদিম জনজাতির শস্যকে পুর্নজীবন দানের উৎসব।

কোল গোষ্ঠীর টুসাউ শব্দের সঙ্গে টুসুর মিল থাকতে পারে বলে মনে করেন কেউ কেউ। টুসাউ মানে টাটকা ফুলের গোছা। আর চিরাচরিত টুসু উৎসবেও মূর্তির বিশেষ স্থান ছিল না । ছিল ফুল আর কাগজের ফুল দিয়ে তৈরী চৌদলের ব্যাবহার। চৌদল বলতে বাঁশ আর কাগজ দিয়ে তৈরী ছোট মন্দিরের মতো কাঠামো। পুরুলিয়ার দিকে এখনও এই ধরনের চৌদল ব্যবহার হয়। আবার ধান কেটে ঘরে তোলার পরে এই উতসবকে অনেকে অধিক ফলন বা সন্তান লাভের কামনা ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যসাধক ব্রত বলে মনে করেন। কেউ কেউ এর মধ্যে লক্ষ্মীব্রতের ও ছায়া দেখতে পান। তবে ফসল ঘরে তোলার পরে ধন্যবাদ জ্ঞাপনকারী উৎসব হিসেবে টুসুকে ব্যাখ্যা করেন অধিকাংশ গবেষক। নৃতত্ববিদ প্রবোধ কুমার ভৌমিকের মতে, “টুসু একান্তভাবে লোক উৎসব, কোন আচার বা ধর্মের অনুশাসনে আবদ্ধ নয়। টুসু আসলে জন-মানসের অনাবিল আনন্দের অভিব্যক্তি। উৎসবের প্রতীক টুসু একটি পুতুল।’’

টুসু নিয়ে নানা বিয়োগান্তক গল্প প্রচলিত রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই টুসুর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় নদী। তাই টুসু পরবের অন্যতম অনুষঙ্গ টুসুর বিদায় বা ভাসান। এই ভাসান পরবে আগে সারা সারা রাত ধরে টুসুর গান করে মহিলারা। বেশিরভাগ গবেষকই মনে করেন, প্রাথমিক পর্যায়ে টুসুর মূর্তি বলে কিছু ছিল না। সঙ্গীত নির্ভর বিমূর্ত এই লোক উৎসব ক্রমে বির্বতিত হয়ে মূর্তি কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। টুসুর মূর্তিও সাধারণ পুতুলের মূর্তি থেকে ধীরে ধীরে লক্ষ্মী প্রতিমার রূপ নিয়েছে।

তবে এ সবই ইতিহাস। মোবাইল আর নেটের যুগে টুসুর সাবেক গান আর নতুন প্রজন্মকে টানছে না। খড়্গপুরের মোহনপুরের নিয়তি রায় টুসুর মূর্তি কিনে ফেরার পথে জানালেন এখনকার ছেলেদের মাইকে গান বাজলেই হলো। তা টুসুর গান কিনা তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। তাই ‘তিরিশটি দিন রাখিলাম মাগো, তিরিশটি ফুল দিয়ে গো’ বা আমার টুসু একটা বিটি, মানবাজারে শ্বশুরঘর’— বছর বছর শুনে আসা এ সব গান গেয়ে বা শুনে রাত জাগতে অনেকেই আর রাজি হচ্ছে না। পরিণাম বাজার পড়ছে টুসুর। কয়েক বছর আগেও টুসুর মূর্তি নিয়ে সংক্রান্তির এক সপ্তাহ আগে থেকে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গান গেয়ে চাল, ফলমূল আর টাকা সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল। তা-ও দিনকে দিন কমে আসছে।

তথ্যাসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

পৌষ সংক্রান্তি শস্যোৎসব। খেতের পাকা ধান প্রথম ঘরে ওঠা উপলক্ষে পালিত হয় এই উৎসব। পাকা ধানের শিষ এনে নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। দু’-তিনটি খড় এক সঙ্গে লম্বা করে পাকিয়ে তার সঙ্গে ধানের শিষ, মুলোর ফুল, সরষে ফুল, আমপাতা ইত্যাদি বেঁধে ‘চাউরী- বাউরী’ তৈরি করা হয়। এই ‘চাউরী- বাউরী’ ধানের গোলা, খড়ের চাল, ঢেঁকি, বাক্স-প্যাঁটরায় গুঁজে দেওয়া হয়।
বাংলার পাটিসাপটা।

বাংলায় পৌষপার্বণের প্রধান অঙ্গ হল পিঠে খাওয়া। এই সময়ে নতুন ধানের পাশাপাশি বাংলার গ্রামে গ্রামে খেজুর গাছে রস আসে, তৈরি হয় নতুন গুড়, খেজুর গুড়। তাই নতুন চালের গুঁড়ো, নতুন গুড়, নারকেল আর দুধ দিয়ে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠে। তাই পৌষপার্বণের আরেক নাম পিঠেপার্বণ।
অসমেও এই সময়টা নতুন ধানের। তাই ‘ভোগালি বিহু’তে যেমন আছে উপবাস, তেমনই আছে ভোজ, অবশ্যই যার প্রধান অঙ্গ নতুন ধান।

লিখেছেন- শম্ভু সেন
তথ্যসহায়তায় : Khabor online

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- নবম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- নবম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

টুসু উৎসব এক প্রকার লোক উত্সব। এটি প্রচলিত বিশ্বাস ও শস্যকাটার আনন্দোৎসবের এক সমন্বিত রূপ। টুসু উৎসব শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে, আর শেষ হয় পৌষ-সংক্রান্তি বা মকর-সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে।

টুসু একজন লৌকিক দেবী এবং তাঁকে কুমারী বালিকা হিসেবে কল্পনা করা হয়। কুমারী মেয়েরা টুসুপূজার প্রধান ব্রতী ও উদ্যোগী। মাটির মূর্তি বা রঙিন কাগজের চৌদল দেবীর প্রতীকরূপে স্থাপন করা হয়। পূজার উদ্যোগী বালিকা ও তরুণীরা প্রচলিত আচারবিধি অনুযায়ী পূজার যাবতীয় কর্ম সম্পন্ন করে। টুসু অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য এক উৎসব।

টুসু অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেয়েরা টুসু সঙ্গীত পরিবেশন করে, যা এ উৎসবের বিশেষ অঙ্গ ও মূল আকর্ষণ। টুসু গান আকারে ছোট হয় এবং গ্রাম্য নিরক্ষর নারীরা সেগুলি তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে রচনা করে। গানগুলি পল্লিবাসীর লোকায়ত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার এক অনন্য প্রকাশ। উৎসবান্তে প্রতিমা বিসর্জন খুবই বৈচিত্র্যময় ও বেদনাদায়ক হয়। এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মেলাও বসে।

টুসু শব্দটির উদ্ভব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। ধানের তুষ থেকে ‘টুসু’ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত পৌষালি উৎসব ‘তুষতুষালি ব্রতকথা’র মধ্যে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। টুসু দ্রাবিড় অস্ট্রিক ভাষাবর্গের কোল, মুণ্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবী বলে সাধারণ জনমত প্রচলিত।

পশ্চিম বঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান ও হুগলি জেলার গ্রামাঞ্চলে টুসু পূজা প্রচলিত। বাংলার লোকসংগীত ও সংস্কৃতিতে টুসু গান ও টুসু উৎসবের বিশেষ স্থান রয়েছে।


লিখেছেন: [অঞ্জলিকা মুখোপাধ্যায়]
তথ্যসূত্র: বাংলা পিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ

বিশেষ প্রতিবেদন: পৌষ আসতে না আসতেই লখাই মাহাত, শান্ত আহিরদের খামার ভরে ওঠে সোনালি ধানে৷ সার দিয়ে পালই দিয়ে সাজানো হয় মাঠ থেকে কেটে আনা ধান৷ চারমাসের পরিশ্রম ও অপেক্ষার পর ফসল ঘরে তুলে টুসু ও বাঁদনা পরবে মাতে পুরো জঙ্গলমহল৷ শীতের শুরুতেই জঙ্গলমহলের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে টুসু৷ কিন্তু কে এই টুসু? কেনই বা একমাসের জন্য তিনি ফেরেন জঙ্গলমহলের গ্রামে?

টুসু জঙ্গলহলের নিজের মেয়ে৷ তাঁর বাপের বাড়ি আসাকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয় টুসু পরব৷ ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়৷ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন৷

তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়৷ পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন৷ পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন৷ টুসু গান লোকগীতি হিসেবেও বিশেষ জনপ্রিয় জঙ্গলমহলে৷

আর পাঁচটা পুজোর থেকে কোথায় আলাদা এই পুজো? সাধারণত আমরা পুজো করে থাকি দেবতাদের সন্তুষ্ট করে কাঙ্খিত বর লাভের উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু টুসু পুজো সেখান থেকে একেবারেই আলাদা৷ চারমাসের পরিশ্রমির পর সাধারণ চাষিরা কাঙ্খিত ফসল ঘরে তুলতে পেরে আনন্দে মেতে ওঠেন এবং টুসু দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উৎসবে মাতেন৷ কবে টুসু পুজার প্রচলন হয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি৷ তবে প্রথম দিকে টুসু পুজোতে মুর্তি পুজোর চল ছিল না৷ এখন নতুন ধানের শিষের সঙ্গে মাটির মুর্তিও ব্যবহার হচ্ছে টুসু পুজোতে৷ জঙ্গলমহলের মেয়েরা নিজেরায় টুসু পুজো করে থাকেন৷ সাধারণ লৌকিক আচারেই এই পুজো হয়৷

জঙ্গলমহলে বিশেষ জনপ্রিয় টুসু পুজোর পরদিন থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামে মেলা বসে৷ অনেক জায়গাতে যা ‘আখান মেলা’ নামে পরিচিত৷ আখানের আগের রাতে টুসু পুজোর শেষদিনে সারা রাত ধরে টুসু গান গাওয়া চলে৷ প্রতিযোগিতা চলে কার টুসু ঠাকুর সবচেয়ে ভালো৷ দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের কথা উঠে আসে এই টুসু গানে৷ তবে বয়স হয়ে যাওয়া লখাই মাহাতদের আক্ষেপ ডিজে এবং ফেসবুক , টুইটারের সংস্কৃতির যুগে ক্রমশ ঔজ্বল্য হারাচ্ছে গ্রাম বাংলার এই প্রাচীন উৎসব৷

তথ্যসুত্র: কলকাতা ২৪X৭

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- অষ্টম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- অষ্টম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
(তথ্য সহায়তা ফেসবুক থেকে)

★ টুসু পরব ★
———————
টুসু পার্বণ (টুসু পরব বা টুসু পুজো নামেও পরিচিত) গ্রাম বাংলা, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও আসামের এক উপজাতিক পার্বণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া প মেদনিপুর ও বাঁকুড়া জেলা এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগণা, ধানবাদ, রাঁচি ও হাজারিবাগ,সিংভূম-সেরাইকেলা জেলার, উড়িষ্যা রাজ্যের কেওয়নঝর, রাউলকেল্লা, সুন্দরগড়, ময়ূরভঞ্জ প্রভৃতি জেলা এছাড়া আসামের চা-বাগান কেন্দ্রীক কৃষিভিত্তিক উৎসব।যেখানেই কুড়মী-মাহত সেখানেই টুসু::

অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকে শুরু হয়ে যায় টুসু পরবের প্রস্তুতি, টুসু কোনো দেবী নয়। নতুন ধানের তুষ দিয়ে ভরা হয় মাটির সড়া। আকন্দ ও গাদা ফুলের মালা, গারুলি আটা, বাছুরের গোবর রেখে দেওয়া হয় তুষের সাথে। প্রতি সন্ধ্যায় কথায়, সুরে, গানে বন্দনা করা হয় সরাটিকে। দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, চলমান ঘটনা নিয়ে মহিলারাই মুখে মুখে গান রচনা করেন। সমস্ত মহিলারাই তখন যেন টুসু হয়ে ওঠে। টুসু পরবের অন্যতম প্রাণশক্তি হলো টুসু গান।

★ নামকরণ ★

টুসুর নামকরণ সম্বন্ধে সর্বজনগ্রাহ্য কোন মত নেই। ডঃ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে। দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে তিষ্যা বা পুষ্যা নক্ষত্র থেকে অথবা উষা থেকে টুসু শব্দটি এসেছে, আবার কখনো তিনি বলেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রজনের দেবতা টেষুব থেকে টুসু শব্দটি তৈরী হয়েছে। আবার অনেকেই বলে থাকেন পুরুলিয়ার কাশিপুরের রাজার দুই মেয়ে ছিল ভাদু ও টুসু। সেই টুসুর জন্ম দিবস স্মরণ করা হয় টুসু পরবে।

★ পালনরীতি ★

টুসু উৎসব অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয়। ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মন্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গীর ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশ্যে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।

টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে চালের গুঁড়ো তৈরী করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন। এই রাতে টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।

পৌষ সংক্রান্তি বা মকরের ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরী রঙিন কাগজে সজ্জিত চৌডল বা চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি বক্রোক্তি করে গান গাইতে দেবী বিসর্জন করে থাকেন। টুসু বিসর্জনের পরে মেয়েরা নদী বা পুকুরে স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। ছেলেরা খড়, কাঠ, পাটকাঠি দিয়ে ম্যাড়াঘর বানিয়ে তাতে আগুন লাগান।

★ টুসু গীত ★

টুসু উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টুসু সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাঁদের সাংসারিক সুখ দুঃখকে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, অভীপ্সা, দ্বেষ, ঘৃণা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। এছাড়া সমকালীন রাজনীতির কথা ব্যাপক ভাবে এই গানে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এই সমস্ত গানে পণপ্রথা, সারক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধতা প্রভৃতি সামাজিক দায়িত্বের কথাও বলা হয়।

টুসু গীতকে ভনিতাযুক্ত ও ভনিতাবিহীন এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। ভনিতাবিহিন টুসু গীতকে মূল টুসু পদ এবং টুসু পদের রঙ এই দুইটি অংশে ভাগ করা যায়। টুসু পদের রঙ অংশটি কখনো মূল পদের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রচনা করা হয়, কখনো বা স্বতন্ত্র ভাবে রচিত হয়। ভনিতাবিহীন টুসু পদ মূলত চার চরণে বাঁধা থাকে, যার মধ্যে রঙের জন্য মাত্র দুইটি চরণ নির্দিষ্ট থাকে।
পৌষ সংক্রান্তির দিন রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি চৌউল বা চতুর্দোলায় সেই তুষ ভর্তি সরাকে বসি‌য়ে মাথায় নিয়ে নতুন বস্ত্র পরিধান করে বাড়ির মহিলারা টুসু গান গাইতে গাইতে স্থানীয় কোনো নদী বা জলাশয়ে যান এবং জলে ভাসিয়ে দেন। টুসু ভাসানের দিন তাই কান পাতলেই শোনা যায় টুসু গান

****
ঝাড়খণ্ড রাজ্য ও পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ স্থানে পুরাতন প্রথা অনুযায়ী টুসু উৎসবে কোন মূর্তির প্রচলন নেই সাধারনত পাট কাঠিতে রংবেরঙের কাগজ, রঙিন কাগজের কারুকার্য করা হয়। কিন্তু পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানা এবং বাঁকুড়া জেলার খাতড়া থানার পোরকুলের টুসু মেলায় টুসু মূর্তির প্রচলন রয়েছে।

লিখেছেন: সুদীপ মাহাত
আদিবাসি কুড়মি সমাজ

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- সপ্তম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- সপ্তম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

An important part of the Sakrat celebrations for Santhals is the gaandi-aasen.Gaandi is Santhali for monkey while aasen means a stroll; together, gaandi-aasenmeans taking the monkey out for a stroll. In villages, group of men carry the baanaam, a string instrument similar to the sarangi, and go from house to house singing songs. They also carry with them a straw effigy, which is the monkey, being taken out on its yearly walk. The men make the monkey dance by jiggling it. There are songs that go with it. One song I have heard sung in my village and by my father goes thus:
Bolay bolay bolay bolay
Bhitar re ma taang haandi, duar re ma
bodoij-sodoij
Em khan do ema lepe go
Bang khan do moray maha le basa
apeya
Kocha rinij poond saandi le jomay
tapeya
Ding dang ding lutkulutum
Medang daang medang daal kakar
chang pitha

Most of this is gibberish, but the part that makes some sense means: ‘You have hidden the best haandi (the homebrew made of rice) in the house and kept the leftovers at the door. You better give us the best haandi or else we will stay in your house for five days and eat up the white chicken you have in the corner.’

It is difficult to ignore this hilarious threat. So the troupe is given puffed rice, meat, haandi, pitha, etc. as gifts, after which they move on to the next house.

I have grown up listening to the Tusu songs my father sings. Tusu is the goddess who is worshipped during the week preceding Makar Sankranti. She is primarily a deity of the marginalised communities. In my village, people belonging to the castes of Kamar (blacksmiths) and Kunkal (potters) worship Tusu.

I cannot really say which department of life Tusu looks after, but I assume she is an avatar of Lakshmi, the Hindu goddess of prosperity. Makar Sankranti is, after all, a harvest festival and worshipping Lakshmi makes sense at this time.

Tusu is imagined as a beautiful woman with a round face, fair complexion, long, black, curly hair, sharp nose, large eyes and perfect lips.

She is decked up in a bright red sari and jewellery. On the day of Makar Sankranti, her clay idol is immersed in water.

Of all the Tusu songs my father sings, two seem to be his favourite: the hopeful “Toder kantha-kapor jogar kor/ Aschhe Mokor du din sobur kor” — “Gather your quilts and clothes/ Makar Sankranti is in two days” and the somewhat escapist “Thakbo nai ar Bharot-e/ Chol sojoni jaabo bilat-e” — “We will not live in India anymore/ Beloved, let us move abroad.”

Stay, Tusu

Most of the Tusu songs I have heard seem to have originated with the Mahatos, who are a major community in the Ghatsila-Jamshedpur area. They have a distinctive way of speaking Bengali and the songs are in this dialect.

One song sounds possessive:“Amra char poisay aani nai/ Amder Tusu jol ke jaabek nai” — “We haven’t purchased her for a measly four paisa/ We won’t let our Tusu be immersed in water”. Another one is full of love: “Toke khawabo kori joton/ Mokor dinay roilo nimontorn” — “I will feed you with care/ I invite you to a feast on Makar Sankranti.” Another is inquisitive: “Tokay ke dilo lo nil sari/ Ishtishoner budha Punjabi” — “Who gave you this blue sari / The old Punjabi gentleman at the station?”

The sari in this song could either be nil (blue) or lal (red), but the old gentleman at the station could vary from Punjabi to Marwari, Bihari, Gujarati, Assami or Madrasi. And this is chiefly because all these words rhyme with sari.

These songs — both funny and poignant — have the same tune. Only the lyrics change, as with nursery rhymes. I looked up Tusu songs on YouTube and found this touching and funny one written by Rohin Mahato — “Bhalobasar bhitor monay khol/ Aamar aasa-jawa hoye biphol” — “There is something wrong in our love/ My visiting you again and again is of no use.” I was surprised to discover that this song too has the same tune as some of the Tusu songs my father sings.
Most Tusu songs on YouTube have their origin in Purulia, a Mahato-dominated district in neighbouring West Bengal. One line is sung twice and then the chorus takes over. It is quite an experience listening to Tusu songs sung with rustic vigour. It is much like listening to jhumur, the folk music that accompanies the dance of that name and also has a Mahato and Purulia connection.

তথ্য সহায়তায় : The author, who won the Sahitya Akademi Yuva Puraskar in 2015 and had both his books shortlisted for The Hindu Prize, is waiting for his suspension to be revoked by the Jharkhand government.

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- ষষ্ঠ পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- ষষ্ঠ পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

Tusu, a harvest festival, is one of the three major festivals of the Kurmi community in West Bengal, Jharkhand and Odisha. The other two festivals are Karam and Bandna. These are all annual festivals and come one after another. From the middle of November to the middle of December (according to the Bengali calendar, from the last day ofAghrahayan to the last day of Poush), Tusu is celebrated throughout Jharkhand, the Rāṛh region of West Bengal, and in some parts of Odisha. Not only the Kurmis, but many other communities celebrate Tusu. In a personal interview with the author, the Bengali poet Nirmal Halder says, ‘In my childhood, in our family, we used to sing Tusu songs and worshipped Tusu for an entire month.’ In the words of Sadhan Mahato, poet and cultural activist based in Purulia, ‘Unlike most of the festivals, Tusu is not a religious festival . . . Tusu is a secular festival and is celebrated by people of all castes and religions, like Christians, Muslims, Hindus, non-Hindus, Adivasis, everyone.’

The festival is mainly about the collection of songs sung by the unmarried girls during the nights, throughout the month of Poush. As Sadhan Mahato says in his interview taken during the project, ‘Every day the women start praising the goddess by singing Tusu songs . . . the Tusu is prepared and worshipped at homes by chaste virgin girls. Married women do not worship Tusu’. In a personal interview with the author, independent researcher and folk singer Kiriti Mahato says:
All celebrations in our culture are related to singing and dancing and Tusu has a significant role in it . . . We can see only one Pada songs in the Jawa festival and two Pada songs or Doha in Tusu. In those two Padas it reflects all the feelings, ‘বল মা আমার মন কেমন করে/ যেমন শোল মাছে উফাল মারে.’ (‘O mother, do you know the state of my mind/It is like the thrust of the Shol fish.’)
In his interview Nirmal Halder explains:

The innumerable Tusu songs have enriched the culture of Purulia . . . the source of culture in Purulia that we get from Tusu, Bhadu and Jhumur is beyond comparison. There are remarkable extempore songs which if published will do wonders in our literature, but should not be categorized and kept at a distance in the name of folk literature . . .
As we know, Tusu is a harvest festival; and the main components of this festival are paddy and rice. After cutting off all the paddy stacks, the last stack that remains in the field is called dinimai. This dinimai is Tusu. The head of the family brings the dinimai from the agricultural field and on that same day the young girls establish Tusu. It marks the beginning of the celebrations of a month-long festival. In his interview, Sadhan Mahato describes it:

Since Tusu has no structure, we make kulungi or a hole in the wall. The main ingredients for Tusu are tush or rice husks. Some rice and flowers are placed inside the kulungi. They (unmarried girls) worship the kulungi for the whole month in the home altars, in the wall niches decorated with alpona (designs painted on walls and floors with a semi-liquid paste made of soaked rice). The choudal is something liketazia, but smaller than that, it is made of jute sticks. Inside the choudal, all the things required for worship are placed, and then carried in a procession for immersion in the river, pond or any water body.
Choudal or choural is used as the vehicle for the immersion of Tusu. This choural symbolizes the sun. Kurmi activist Siripada Bansriar says in his interview:
Choural is not Tusu, choural is the vehicle by which Tusu could go towards her marital family from her father’s house. In ancient period it was a matter of great pride for the Kurmis to send their daughter to her marital family, after she started menstruating. This was also a sign that her body was physically capable of bearing a child. Tusu is worshipped with this same feeling and Tusu finally leaves the house for immersion. Chou means four sides. Ural means flying. Choural means who can fly in all directions at the same time, and who can do that…the sun rays.

According to Kurmi rituals, Tusu is similar to unmarried girls. As a girl grows up with care in her family, the grains and seeds are also taken care of by the family which worships Tusu. The immersion of Tusu in the water is same as the leaving of a newly married girl for her marital family. Since a grain or seed can flourish only after it gets water, a newly married girl can become pregnant only after copulating with her husband in her in-laws’ house. Tusu is seen as the harbinger of life and prosperity. As a Tusu song says, ‘জলে হেল, জলে খেল, জলে তোমার কে আছে? /মনেতে বুঝিয়ে দেখো জলে স্বসুরঘর আছে’. The meaning is ‘You are joyful in the water; you are playing in the water, who is yours in the water? /Ask yourself in your mind, water is the marital family’. Rice grain is offered to the water because water is the most important element for cultivation and living.

The sun is also worshipped in this festival because without the presence of the sun no germination could take place. Makar is just another name of the sun. In the day of Makar Sankranti or Poush Sankranti, which is the last day of the Bengali month Poush, people of various communities throughout India celebrate Makar festival or the festival of Sun God, which is mostly a bathing festival. In his personal interview Kiriti Mahato mentions, ‘G. Possehl has said in his bookThe Indus Civilization that the people of Indus used to celebrate a bathing event, and also it can be seen that till today people from all over this country celebrate this day and worship the Sun God on this day of Makar.’
The festival of Tusu is also named as Makar festival. Therefore, it is clear that this festival is connected to the sun. In the same interview Kiriti Mahato says:

Now we know the scientific reason behind movement of the sun but the ancient people were also aware of it and this was celebrated by them. If we see Tusu just as a local event then it’s a failure of understanding Tusu and also of us. Tusu also has the scientific significance as the ancient people could relate the movement of sun with agriculture and they worshipped Tusu to celebrate the power of sun in the agriculture.
There are various opinions on the etymology of the word ‘Tusu’. Santi Sinha, in his book Tusu, has said: এই শস্যোৎসবে ধানের খোসা তুষ একটা বড় উপকরণ। তাই ‘তুষ–এর সঙ্গে আদরার্থক উ-প্রত্যয়যোগে ‘তুষু’ নামটি এসেছে।. . . ‘তুষু’ থেকে ‘টুসু’—দন্ত্যবর্ণের এই মূর্ধন্যবর্ণে পরিণত হওয়া নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোন বিরোধ নেই. (Sinha n.d.:32–33).

Sinha (n.d.:33) has quoted Dr. Suhrid Kumar Bhowmik’s opinion in his book Tusu:
‘টুসু’ নামকরণের পিছনে কোল (Austro Asiatic) গোষ্ঠীর ‘টুসা’ (টুসাউ) শব্দটির প্রভাব থাকতে পারে। কোল ভাষায় এর অর্থ হল—ফুলের গুচ্ছ। এই অভিমতের অন্যতম প্রবক্তা ডঃ সুহৃদকুমার ভৌমিক। তিনি Bulletin of the Cultural Research Institute-এর ‘Tusu Songs’-এ বলেছেন, “Perhaps ‘tusu’ is a non-Aryan word coming from Austro-Asiatic Kol origin, to mean flower, bunch of flowers, bud etc. In Santali ‘bahatusu’ means a bunch of flowers, ‘tusa’ means simply bud, a leaf of bud-a symbol of youth and beauty.

Siripada Bansriar says in his interview, ‘Tusu was made by the connection of two words, tu and su. The meaning of the word tu is maturity and su means husband.’ His designated words belong to the vocabulary of Kurmali language. It refers to the association of crop and water. But there are other references from the same vocabulary which make the meaning different. In Kiriti Mahato’s interview, he explains:

Though there are many opinions by various authors regarding Tusu but as an intellectual person of the society I think this Tusu word is derived from our Kurmali word tui and su. ‘Tui’ means the highest position of the sun and ‘su’ means the sun. Tusu means the final or highest position of the sun . . .

These opinions reflect that it is quite difficult to locate the actual meaning of the word Tusu.
There are five things which are commonly used to establish and worship Tusu. The things are, one dhakon or earthen pot, alochaal or boiled rice seeds, durva or scotch grass (scientific name is cynodondactylon), the badu flower which grows on the sal tree and one cow-dung ball. It is mainly girls who take responsibility for performing all the rituals of this festival. They establish and worship Tusu, prepare prasad (religious offering) at home, which is puffed rice or flattened rice, and finally the immersion takes place. In the interview, Kiriti Mahato says:

Women have a much more significant role than the men in all the rituals, including seeding, painting the alpona, establishing Tusu by tush, grinding rice with cow-dung balls and one small stick of paddy . . . Women from the whole family used to gather there (in front of Tusu) for one month, offer their prayers and give it for immersion on the day of Makar through choural.

Other customs of worship are also found. During his interview, Nirmal Halder spoke about the rituals of Tusu that used to take place in his Bengali household in Purulia town, around 50 years ago. He says, ‘In a clay pot, seven lamps were lighted with tush and were decorated with flowers. In the evening, my sisters sang Tusu songs and offered sweets. Later in the evening after the worship, the sweets were distributed.’

After the labour of the whole year, people enjoy some prosperity at home during this period. Therefore, they have time and money to celebrate the festival. That might be a reason behind the celebration which takes place on a huge scale. Sadhan Mahato, in his interview, emphasizes:
I think India witnesses the highest numbers of fairs during this Tusu festival in the month of Poush. There is no community (in the area) where Tusu festival is not celebrated; at least a cock fight would be there. On this occasion, all the cultural activities like songs, dramas and different kinds of tribal dances such as nachni dance, chhoudance are performed to explore the diversity of this festival.

With time, Tusu songs are becoming outmoded with the onset of different forms of entertainment. The hegemony of mainstream culture took a toll not only on the folk cultural activities but also on other aspects of the culture. In his interview, Nirmal Halder says:
Tusu festival and Tusu songs of our childhood were completely different from those of the present time . . . However, with modernization, urbanization and technological developments all these festivals are slowly becoming obsolete. Moreover, with my advancing age, it turns out that the folk festivals are slowly moving towards the villages . . . while associating ourselves with modernity, we say that we are not involved in these festivals or we are not connected to them. But these are always connected with the people of Purulia, be they Brahmin, Baidya, Kayastha, Haari, Muchi or Bauri (castes). All the people were involved with it. With passing days, we are letting ourselves drift away from these festivals . . .

He pointed to a few more critical issues:
Another point is, nowadays the folk festivals are being organized by the corporate houses, which look bad. Now we see people from the city are coming to enjoy Tusu. Since Tusu is a festival, people come for fun. They sing, dance and have party and that is all. However, they don’t know the significance of Tusu which all of us carry in our mind. For the urban people Tusu is only a festival for enjoyment which the rural people celebrate, but they do not know the roots of Tusu.

Tusu songs are still an important part of popular culture and new songs are being written. These songs include mythological stories, contemporary political issues, local issues, etc. The two stanzas below reflect the mood of a contemporary Tusu song based on the Ramayana:
দৈয়বের নির্বন্ধ দেখ নাহয় কোভু খন্ডন।
শ্রীরাম রাবনে দেহে বাজিল ভায় মহারণ।।
বানের উপরে বান আকাশে করে গমন।
দেবগনে বলে প্রভু রক্ষা কর নারায়ন।।
কুপিল রাবন রাজা যত ছিল বীরগণ।
অন্তরীক্ষে দেবগনে দেখে সবে মহারণ।।
রাবনে বলিছে আজি বধিবরে তোর জীবন।
অভয় বলে অহংকারে অবশেষে হয় মরন।।
বীরহনুমান কাঁদে কাঁদে যত সৈন্যগণ।
হারাইলাম আমিও ভাই প্রাণের অনুজ লক্ষণ।।
কেন বা রাবন সঙ্গে করিলাম মহারন।
আমার প্রাণের নিধি হরিয়া নিল সমন।।
অন্তরিক্ষে ডাকি বলে ইন্দ্র যত দেবগণ।
অভয়ে বলিছে আমায় খমা কর নারায়ন।।

There are popular local music videos which follow the Tusu’s tune and these are also called Tusu songs. Apart from the tune and rhythm, these songs do not have any other resemblance with the ‘traditional’ Tusu songs. A few such songs are—‘মনে পড়ে তোর মুখের হাঁসি, তোকে ধনী ফাঁকা যদি পাই’ (‘Mone Pode tor Mukher Haansi’) by Birochon Mahato and Anima Mardi; ‘টুরকু ছঁড়াই তোকে ভুলাইল’ (‘Turku Chhodai toke Bhulailo’) by Rohin Mahato and Mrityunjoy Mahato; ‘মকর পরব আসছে ঢেউ মাইরে’ (‘Makar Parba Aaschhe Dheu Maire’) by Paresh Mahato and Anjana Mahato.
Tusu songs are sung today through these new age songs, which reflect the traditional ways of singing. Gradually, the new songs will become part of the tradition. This is how Tusu remains an important part of folk culture and people’s life. Although the form of the festival, the songs and their content have changed with time due to technological advancement, corporatization, and an evolving notion of entertainment—Tusu continues to be a source of happiness, celebration and festivity.
(The cover image of this article is courtesy of Pinki Biswas Sanyal.)
তথ্য সংগ্রহ ও সহায়তায়: Bibliography
Bardhan, Mani. 2014. ‘Bangalar Lokosangeet o Geetika’, in Paschim Banga Patrika, Bishesh Sankhya: 167.
Basu, Gopendrakrishna. 1987. Banglar Loukik Debota. Kolkata: Dey’s Publishing.
Bhattacharya, Asutosh. 1965. Bangalar Lokosahityo. vol. 3. Kolkata: Calcutta Book House.
Bhowmik, Suhrid Kumar. 1984. ‘Tusu Songs’ in Bulletin of the Cultural Research Institute 16.1-4:137.
Karan, Sudhir Kumar. Seemanto Bangalar Lokojaan.
Mahato, Bankim Chandra. Jharkhander Lokosahityo.
Possehl, Gregory L. 2002. The Indus Civilization: A Contemporary Perspective. UK: Altamira Press.
Sinha, Santi. n.d. Tusu. Lokosanskriti o Adibasi Sanskriti Kendro, Tothyo o Sanskritik Bibhag, Paschim Banga Sarkar.

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- পঞ্চম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- পঞ্চম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

গ্রাম বাংলার লৌকিক পরবগুলি বাঙালির জীবনের এক অমূল্য সম্পদ | শহুরে সভ্যতার করাল গ্রাসে যখন আস্তে আস্তে বাংলা ও বাঙালির পূর্ব ঐতিহ্য, ইতিহাস ও গৌরব স্তিমিত হয়ে আসছে তখন গ্রামের তুলসিতলার প্রদীপের শিখায় টিম টিম করে জ্বলছে বাংলার পরবের প্রাণ |
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত জনপ্রিয় পরব বা উত্সজব টুসু উত্স্ব | বাংলার এই দুই দীন দুঃখিনী মেয়েকে গৌরীর মত ঐশ্বর্যমন্ডিত না হলেও বাংলার বর্ষীয়সী নারীরা তাদের নিজেদের মেয়েদের মতই আদর যত্ন করে পুজো করেন |

প্রথমে বলা যাক টুসুর কথা | টুসু হলেন লৌকিক দেবী, ফসলের দেবী। আমন ধান ঘরে আসার পর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত একমাস ধরে টুসুদেবীর পূজো করেন মহিলারা। এ অনুষ্ঠানে দরকার হয় না কোন পুরোহিতের। পুরুষতন্ত্র এখানে হার মেনেছে। মেয়েরাই এর ব্রতী।

বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে টুসুকে তোষলা দেবী বলে। তার পরণে লাল, নীল কাগজের শাড়ি। হাতে – গলায় সোনালী রাংতার গয়না। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যায় বাড়ির মেয়েরা বেদি তৈরী করে মাটির। মেয়েরা পিটুলি গোলা দিয়ে তার উপর আঁকে আলপনা। শাঁখলতা, ঝুমকো লতা, পদ্ম, চাঁদ, সূর্য, ধানের ছড়া সহ আরও বহু কিছু গ্রাম বাংলার ছোট ছোট চিহ্ন আঁকা হয়। আঁকা শেষ হলে বেদির ওপর সাজিয়ে রাখে নিজের নিজের টুসু দেবীকে, তারপর আরম্ভ করে গান।

” উঠ উঠ উঠ টুসু
উঠাতে এসেছি গো
তোমারি সেবিকা মোরা
পূজিতে বসেছি গো। ”

টুসুগানের প্রায় সবই কবি গানের মতো হঠাত্‍ রচনা। কোন গানই মেয়েরা আগে থেকে তালিম দিয়ে তৈরি করে আসে না। এ গানে মেয়েরা তাদের মনের কথা টুসুকে জানায়। দৈনন্দিন খবরাখবর, দেশের সাধারণ সুখ-দুঃখের কথাও উঠে আসে গানে। এই সঙ্গীতের মূল বিষয়বস্তু লৌকিক ও দেহগত প্রেম। এই গান গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে।

” যমুনার জলে
বাঁশি বাজে গো রাধা বলে।
যদি আমি থাকি ঘরে বাঁশি বাজে নাম ধরে।
শাশুড়ী ননদী ঘরে, কেমনে যাব চলে।
না জানে প্রেমের মরম, যাও সখি কর বারণ।
অসময়ে বাঁশি বাজে, যাব আমি কোন ছলে। ”

টুসু উত্সব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে চালের গুঁড়ো করা হয়। বাঁউড়ির দিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরী করে তাতে চাঁচি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠা নামে পরিচিত। বাঁউড়ির রাত দশটা থেকে টুসুর জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়েরা জাগরণের ঘর পরিষ্কার করে ফুল, মালা ও আলো দিয়ে সাজায়। এই রাতে কিশোরী কুমারী মেয়েরা ছাড়াও গৃহবধূ ও বয়স্কা মহিলারাও টুসু গানে অংশগ্রহণ করেন। এই রাতে টুসু দেবীর ভোগ হিসেবে নানারকম মিষ্টান্ন, ছোলাভাজা, মটরভাজা, মুড়ি, জিলিপি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়।

গোটা পৌষ মাস ধরে এই ভাবে টুসুদেবীর কাছে নিজেদের সুখ-দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করে দেশের দশের খবর জানিয়ে সংক্রান্তির দিন তাকে ভাসিয়ে দেওয়ার পালাও এসে যায়। এর আগের দিন রাতেই হয় টুসু-জাগরণ। মকর সংক্রান্তির দিন ভোর হবার আগেই ব্রতী মেয়েরা যে যার টুসুকে কোলে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলতে থাকে নদীর ঘাটের দিকে। যেন সবাই তার আদরের দুলালীকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে। টুসুকে ভাসিয়ে দেওয়া হল গাঙের জলে । একে একে সকলের টুসু চলল গাঙ দিয়ে ভেসে ভেসে । ভেসে যেতে থাকে এদের সংস্কৃতি, হারিয়ে যেতে থাকে এদের গান।

তথ্য সহায়তায়: dailyhunt

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- চতুর্থ পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- চতুর্থ পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ঝাড়গ্রাম যদি জঙ্গল মহলের রানি হয় তাহলে বেলপাহাড়ি অবশ্যই রাজকন্যে৷ টুসু পূজা ও তাকে ঘিরে উৎসব বেলপাহাড়িতে চলে আসছে অনেক বছর ধরে৷ বেলপাহাড়ি সহ সংলগ্ল কানাইশহর পাহাড়ের কোলের ছোট ছোট গ্রামগুলোতে টুসু পুজোর আগে বসে হাট৷ যেখানে টুসু মূর্তি থেকে নতুন জামা কাপড় এবং নানা রকমের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হাজির হন পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষ৷ তবে বেলপাহাড়ির টুসু হাট ধারে ও ভারে বেশ বড়৷

আসছে মঙ্গলবার মকর সংক্রান্তি এবং পিঠে পুলির উৎসবে ডুব দেবে জঙ্গলমহল৷ তার আগে সোমবারই টুসু পুজোর শেষ দিন৷ সারাদিন এবং রাত পুজোর পর বিকেল নাগাদ টুসুর বিসর্জন৷ এই সময় বেলপাহাড়ি এবং সংলগ্ন গ্রামগুলিতে গেলে শোনা যাবে টুসুকে ঘিরে লোকগীতি৷ টুসু জঙ্গল মহল ও রাঢ় বাংলার মেয়ে হিসেবে পরিচিত৷ তাই তাঁকে গ্রামের মহিলারা মিলে নদী কিংবা পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় গেয়ে ওঠে, ‘‘আমাদের টুসু নাইতে নেমেছে…’’৷
টুসু পুজোর আগের বুধবার বেলপাহাড়িতে বসে টুসু হাট৷ বেলপাহাড়ি থেকে সঁন্দাপাড়া যাওয়ার রাস্তা পাশে ফাঁকা জমিতে এই হাটে টুসু মূর্তি, পুজোর সরঞ্জাম এবং নতুন জামাকাপড়ে পাশাপাশি বিক্রি হয় মাটির নানা রকমের আসবাবপত্র৷ বেলপাহাড়ির আশেপাশের গ্রাম থেকে হাটে আসা অনেক মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করার পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন৷

বেলপাহাড়ির হাটে এরকমই একজন টুসু মূর্তি বিক্রেতা হলেন চন্দন মাহাতো৷ হাটে ঢুকতেই টুসু মূর্তির পসরা সাজিয়ে বসা চন্দন অপেক্ষা করে চলেছে- কখন বিক্রি শেষ হবে৷ সব মূর্তি বিক্রি হয়ে গেলে দিনের রোজগারের একটা অংশ দিয়ে বাড়িতে থাকা মেয়ে বৌয়ের জন্য হাট থেকেই নতুন জামাকাপড় কিনে বাড়ি ফিরবে সে৷

জঙ্গল মহল এখন অনেকেরই পছন্দদের ‘ট্যুর ডেস্টিনেশন’৷ ভাইফোঁটার পর থেকে অল্প অল্প শীত পড়তে শুরু করলে কলকাতা এবং আশেপাশের জেলা থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা পৌঁছে যান ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার সতেজ বাতাসে শ্বাস নিতে৷ এই জঙ্গল মহলের সঙ্গে নাড়ির যোগ রয়েছে ‘টুসু’র৷ শীতের শেষে টুসু পুজো এবং তাকে কেন্দ্র করে মেলা এটাই বিশেষত্ব মালাবতি, ভান্ডারু, কেশদা, সাহাড়ির মতো বেলপাহাড়ির সংলগ্ন গ্রামগুলিতে৷
টুসুর বাপের বাড়ি আসাকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয় পরব৷ আবার কোথাও মকর সংক্রান্তির আগের দিনেই শুধু টুসুর পূজা করা হয়৷ বেলপাহাড়ি এবং সংলগ্ন গ্রামগুলিতে এই একদিনের টুসু পুজোয় প্রচলিত রয়েছে৷ শেষ ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়৷ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন৷

তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মণ্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গির ওপর রেখে স্থাপন করা হয়৷ পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন৷ পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন৷ টুসু গান লোকগীতি হিসেবেও বিশেষ জনপ্রিয় জঙ্গলমহলে৷

আর পাঁচটা পুজোর থেকে কোথায় আলাদা এই পুজো? সাধারণত পুজো হয় দেবতাদের সন্তুষ্ট করে কাঙ্ক্ষিত বর লাভের উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু টুসু পুজো সেখান থেকে একেবারেই আলাদা৷ চারমাসের পরিশ্রমের পর চাষিরা ফসল ঘরে তুলতে পেরে আনন্দে মেতে ওঠেন এবং টুসু দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উৎসবে মাতেন৷ কবে টুসু পূজার প্রচলন হয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি৷ তবে প্রথম দিকে টুসু পুজোতে মূর্তি পুজোর চল ছিল না৷ এখন নতুন ধানের শিষের সঙ্গে মাটির মূর্তিও ব্যবহার হচ্ছে টুসু পুজোতে৷ জঙ্গল মহলের মেয়েরা নিজেরায় টুসু পুজো করে থাকেন৷ সাধারণ লৌকিক আচারেই এই পুজো হয়৷

লিখেছেন: শেখর দুবে

তথ্যসহায়তায়: কলকাতা 24 X 7

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- তৃতীয় পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- তৃতীয় পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাসন্তীঃ- টুসু পূজোর আর এক নাম লক্ষী পূজো, ভূমি বা মাটি পূজা। এই পূজো কে অনেকে আবার ভারত মায়ের পূজো বলেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক জায়গায় বাঁশের ডউল তৈরী করেন। আবার দুই ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবন এলাকার আদিবাসীরা টুসু ঠাকুর পটুয়ার কাছ থেকে তৈরী করে তা পূজোর স্থানে এনে পূজো করেন।

এই পূজোয় সরিষার তেল, প্রদীপ ধূপ ধূনা সিঁদুর সলতে, পেঁপে ফলমূল সহ নানান উপকরণ এই পূজোর প্রধান দ্রব্য। এ পূজোয় বাড়ীতে ছেলে মেয়েদের দল কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীরা সকলেই মিলে একত্রিত হয়ে পূজো করে থাকে। পূজার দিন পৌষ মাসের শেষের রাত্রি পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন। পৌষ সংক্রান্তিতে প্রতি বাড়ীতে পিঠে-পুলি তৈরী হয়ে থাকে। শীতকালে নতুন গুড় দিয়ে পিঠে খেতে কার না ভালো লাগে।

একদিকে গঙ্গাসাগর মেলা ও স্নানযাত্রা। প্রত্যেকেই কাজের অবসর পায়।ছেলে বা মেয়ে যে কেউ করতে পারে এই টুসু পূজো।যিনি পূজোর কর্তা হন তিনি সাধারণত পূজো করেন। আদিবাসীদের পূজায় কোন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয় না। যে পূজোয় পূজারী লাগে সে পূজোয় আদীবাসীদের পূজারী বা “পাহান” থাকে।
পূজোর সন্ধ্যায় পূজার মেরাপে টুসু ঠাকুর আনা হয়। বেদীতে ঠাকুর বসিয়ে ফুল পাতা দিয়ে সাজানো হয়। সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে পূজোর মালিক থালায় করে পূজোর সামগ্রী নিয়ে এসে ঘটস্থাপন, সিঁদুর লেপন, ফল মিষ্টি খই পেঁপে চিড়া সামনে রেখে পূজো শুরু করেন। পূজোর সময় শাঁখ বাজানো হয়। পূজো হয়ে গেলে পেঁপে বলি দেওয়া হয়। এই হল প্রথম প্রহরের পূজো।

পূজোর পর ছেলে মেয়ের দল আলাদা আলাদা ভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে টুসু গান করেন। সাংস্কৃতির আসরও বসে। একদল গান গেয়ে অপর দলকে গান চাপান দেয় । এভাবেই এক এক সময় একটি দল এসে টুসু ঠাকুরের সামনে গান গায়।

দ্বিতীয় প্রহরের পূজোয়ও পেঁপে বলি হয়। পুজোর পর শুরু হয় টুসু গান ও ঢোল বাজনা। দ্বিতীয় প্রহর প্রায় প্রথম প্রহরের মতো। আসে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহর প্রায় একই। চতুর্থ পূজোয় ভোর হয়ে আসে। এক টুসুর কর্মকর্তা, অন্য টুসুর কর্মকর্তার পূজোয় হাজির হয়ে মিতালী পাতায়। ছেলে হলে ছেলে, মেয়ে হলে মেয়ে টুসু সই পাতায় চতুর্থ প্রহর গানবাজনা চলে। একটা পূজোর দল আর একটা পূজোয় উপস্থিত হয়ে টুসু গান গেয়ে মনোরঞ্জন করেন।

সুন্দরবনের বাসন্তী, ক্যানিং, গোসাবা, কুলতলী, নলিয়াখালী, জয়রামখালি, ছোটদুমকী তে একাধিক টুসু পূজো হয়। তাই একে অপরের সঙ্গে শত দুঃখের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেন। বর্তমানে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়ায় আগের মতো র ধূমধাম নেই তা স্বত্বেও আদিবাসীরা তাঁদের সম্প্রদায়ের রীতি রেওয়াজ কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।

রাত কেটে প্রভাত হয় ।প্রভাতের পর সকাল বেলায় গান গাইতে গাইতে কাঁসার ঘন্টা,বাজনা,শাঁখ বাজাতে বাজাতে বাড়ী বাড়ী টুসু ঠাকুর নিয়ে ভ্রমণে বের হন। বাড়ীর মহিলারা ধান, দুর্বা, প্রদীপ নিয়ে টুসু ঠাকুর বরণ করেন। বেলা হলে পাড়ার সকল লোক একত্রিত হয়ে টুসু ঠাকুর নিয়ে একস্থানে জোট করেন। একটা টুসুর কর্তার সাথে আরেক জন মোকর পাতায়। গানবাজনা চলে। এরপর দুঃখের মধ্য দিয়ে পুকুরে টুসু ঠাকুর বিসর্জন করেন। বিকালে বা তারপরের দিন বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রীতি, প্রণাম, শুভেচ্ছা জানিয়ে আসেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন। এরপর আবার চলে একটি বছরের প্রহর গোনার অপেক্ষায়।

তথ্য সহায়তায়: Daily Hunt

সাদা পোশাক (পথ নাটক) প্রথম অংক প্রথম দৃশ্য

সাদা পোশাক (পথ নাটক)
প্রথম অংক প্রথম দৃশ্য

নাট্যকার- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

স্থান গাঁয়ের পথের একাংশ। সময় মধ্যরাত্রি মঞ্চের এককোণে একফালি আলোক রেখা। আলো আঁধারী পথে রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। চকিতে নেপথ্যে জন কোলাহল – “চোর চোর — চোর এসেছে চোরকে ধরো “।
চকিতেই নেপথ্যে ভেসে আসে–

পুরুষ কণ্ঠস্বর: হ্যালো! ডায়মণ্ড হারবার পুলিশ স্টেশন। আমি কাঁকরডাঙা গাঁয়ের চৌধুরী পরিবার থেকে বলছি। এখানে একটা চোর এসে মাঝরাতে চুরি করে পালাচ্ছে। গাঁয়ের লোকেরা ছুটে বেরিয়ে এসেছে। চোর ধরা পড়বে নিশ্চয়ই। শীঘ্রই আসুন। নইলে ………

মহিলা কণ্ঠস্বর: ডোন্ট ওয়্যারি। আমরা আসছি।

ফোন কাট হয়ে যায়।

নেপথ্যে পুনরায় জন কোলাহল- ঐ ঐ চোর পালিয়ে যাচ্ছে। তাকে ধরো তাকে ধরো।
বস্তা কাঁধে মি. চোর প্রবেশ করে। পরণে সাদা হাফ সার্ট, সাদা পায়জামা। পায়ে চটিজুতা।
মঞ্চের আলো জ্বলে ওঠে।

মিঃ চোর: না না, আমি চোর নই, আমি চুরি করি নি। কে বলেছে আমি চোর, আমি যদি চোর হতাম তাহলে কি আমি গাঁয়ের লোকদের কাছে ধরা পড়তাম। ঐ ঐ ওরা ছুটে আসছে। আমি পালাই আমি পালিয়ে যাই। কিন্তু কোথায় পালাব। যেদিকে যাবো সেদিকেই আমি ধরা পড়ে যাবো। চারদিকে ওরা সবাই ঘিরে ফেলেছে। কোনদিক দিয়ে পালাই…

(নেপথ্যে পুলিশের ভ্যানের শব্দ। পুলিশের ভ্যান থেকে কয়েকজন সেপাই সহ
নেমে আসেন মহিলা সাব ইন্সপেক্টর পুলিশ কমিশনার।
উদ্যত পিস্তলহস্তে মঞ্চে প্রবেশ করেন)

ইন্সপেক্টর: হ্যাণ্ডস্ আপ! হাত তোল তোল হাত। নো নো পালাবার চেষ্টা করবে না। সেপাই, ওর হাতে হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে দাও। (একটু পরে) ওর বস্তায় কি আছে বের করো।

(মিঃ চোর হাত তুলে দাঁড়ায়। সেপাই মিঃ চোরের হাতে হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে দেয়। অন্য একজন সেপাই বস্তা থেকে বের করে দুটি থালা, দুটি বাটি একটি গেলাস আর একটি ঘটি)

হাউ স্ট্রেঞ্জ। টাকা পয়সা কিছু নেই? কোন দামী অলংকার বা অন্য কিছু।

জনৈক সেপাই: এছাড়া আর তো কিছুই নেই ।
মিঃ চোর: না না, আমায় আপনারা ছেড়ে দিন। আমি চোর নই, আমি চুরি করি নি, চুরি করেছে আমার বিবেক, আমার শিক্ষা, আমার শালীনতাবোধ। আমি আ – আমি—
ইন্সপেক্টর: গায়ে তোমার সাধারণ সাদা পোশাক। মনে হচ্ছে সহজ সরল সাধারণ মানুষ, ভদ্র সন্তান। শিক্ষিত?
মিঃ চোর: ইয়েস! অনার্স গ্রাজুয়েট, শুধু পয়সার অভাবে এম. এ পরীক্ষাটা দিতে পারি নি।
ইন্সপেক্টর: ও আই সি।
মিঃ চোর: জানেন ইন্সপেক্টর, আমার দুইচোখে ছিলো বড়ো হবার স্বপ্ন। লেখাপড়া শিখে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। কিন্ত আমার দুর্ভাগ্য।
ইন্সপেক্টর: আফশোষ, বহুত আফশোষ। তোমার জন্য আমার দুঃখ হয় মিঃ চোর ।
মিঃ চোর: দুঃখ হয়? ফিল করতে পারেন অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়।
ইন্সপেক্টর: কিছুটা পারি ।
মিঃ চোর: কিছুটা পারেন। সবটা পারেন না। অভাবে পড়ে শিক্ষিত ছেলেরা যদি চুরি করে আপনাদের উঁচুতলার সমাজ তাদের বলবে সমাজ বিরোধী।
ইন্সপেক্টর: হোয়াট, কি বলতে চাও তুমি?
মিঃ চোর: বলতে চাই, মানুষ সমাজ বিরোধী হয়েই জন্মায় না। পরিবারের অভাব, অনটন, আর পারিপার্শিক পরিবেশ তাকে সমাজবিরোধী করে তুলতে বাধ্য করে।
ইন্সপেক্টর: তোমার কথাগুলো হয়তো ঠিক মিঃ চোর। বাই দি বাই জানতে পারি তোমার নামটা কি?
মিঃ চোর: আমার কোন নাম নেই। আমি একটা নামহীন জ্বলন্ত উল্কা। অথচ একদিন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আমার গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে বলেছিলেন – তোমরা জাতির ভবিষ্যত। আগামীদিনের পৃথিবী তোমাদের কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করে। স্বপ্ন সে সব বোধ হয় সবই স্বপ্ন। আজ আমার একমাত্র পরিচয় আমি একজন সমাজবিরোধী। (আবেগে বলে ওঠে) হ্যাঁ, হ্যাঁ , আমি চোর। আমি চুরি করবো, আমি ছিনতাই করবো। জন-জীবনকে আমি বিষিয়ে তুলবো।
ইন্সপেক্টর: কার সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলছো মিঃ চোর। আমার মাত্র একটা গুলিতে তোমার বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যেতে পারে তা কি তুমি জানো?
মিঃ চোর: জানি ইন্সপেক্টর। কিন্তু উপোষ করে মরতে আমি রাজি নই। আমি চাই- হাউইয়ের মত দপ করে জ্বলে উঠে মূহুর্তে নিঃশেষ হয়ে যেতে। সুকান্তের দেশলাই-এর মতো অসতর্ক মূহুর্তে হঠাত্ জ্বলে উঠে সাবা বিশ্বকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে।
ইন্সপেক্টর: চ্যালেঞ্জ করো না মিঃ চোর, ফল ভালো হবে না।
মিঃ চোর: কি করবেন? গুলি?
ইন্সপেক্টর: প্রয়োজন হলে তাই করতে হবে। সমাজবিরোধীদের কাছে আমি কিছুতেই মাথা নত করবো না। তুমি সহজ সরল সাধারণ ঘরের ছেলে। তোমার শিক্ষা আছে, আছে শালীনতাবোধ। কেন অনেস্টিকে বিসর্জন দিয়ে অসত্পথে নেমেছো?
মিঃ চোর: আপনার সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ ইন্সপেক্টর। কিন্তু ওই শিক্ষা, আর শালীনতাবোধই আমার দুর্ভাগ্যময় জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
ইন্সপেক্টর: মিঃ চোর!
মিঃ চোর: জানেন ইন্সপেক্টর! শিয়ালদা স্টেশনে কুলির কাজ করবো বলে গিয়েছিলাম। কত লোক স্টেশন থেকে নামলো। কিন্তু কাউকে আমি মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। একটা লাগেজ আমাকে দিন, আমার স্ত্রী আজ তিনমাস রোগ শয্যায় শায়িতা। আজ তিনদিন ধরে আমার ছেলেমেয়েরা না খেয়ে আছে।
ইন্সপেক্টর: হোয়াট ডু ইউ মীন— কি বলছো তুমি?
মিঃ চোর: যখনই ভাবি, কাউকে বলবো আমার দুঃখের কথা, তখনই মাইকেল বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের মানসরূপটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে. ওরা যেন আমাকে ধিক্কার দিতে চায়।কিন্তু ওরা তো জানে না আমার মতো কতো সহস্র শিক্ষিত ছেলেরা অভাবের তাড়নায় বেছে নিয়ে অন্ধকারের পথ।
ইন্সপেক্টর: কিন্তু!
মিঃ চোর: প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষিত বেকারদের জন্ম দিচ্ছে ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি। শিক্ষার অভিমান নিয়ে তারা প্রবেশ করছে নতুন জগতে। না পাচ্ছে ভালো চাকরি। বলতে পারেন ইন্সপেক্টর এরা কি করবে? অথচ গোটা পরিবার তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী কে? দায়ী রাষ্ট্র, দায়ী সমাজ, দায়ী পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই।
ইন্সপেক্টর: মিঃ চোর! আমি যদি তোমাকে সরকারী চাকরি দিই, পারবে তুমি চোর্য্যবৃত্তি ছেড়ে দিতে।
মিঃ চোর: না ইন্সপেক্টর, কারণ….
ইন্সপেক্টর: কারণ?
মিঃ চোর: কারণ আমি যা করি তা আমার জন্য নয়, আমার পরিবারের জন্য। অভাবের তাড়নায় আমি ভুলে গেছি আমি সহজ সরল, সাধারণ মানুষ। ভুলে গেছি আমি শিক্ষিত, অনার্স গ্রাজুয়েট। পেটের খিদে নীতিবাক্য মানে না ইন্সপেক্টর। সমাজ দেহের এই ক্ষতটাকে যদি নিরাময় করতে চান, তাহলে মানুষের অভাবকে আগে দূর করুন। নইলে এরাই একদিন সমাজবিরোধী হয়ে জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে।
ইন্সপেক্টর: অভাব মানুষের আছে, থাকবে. তাই বলে শিক্ষিত তরুণেরা হবে সমাজদ্রোহী? না মিঃ চোর, তোমার সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারি না। মানবো না।
মিঃ চোর: বিপ্লব আসছে গ্রাম বাংলার ক্ষেতখামার থেকে। দিনে দিনে অভাবী মানুষের পেটের ক্ষুধা যত বাড়ছে, দিনে দিনে বিপ্লব ততই দানা বাঁধছে। এমনি করতে করতে এমন একদিন আসবে, যেদিন, আমার মতো হাজার হাজার, লাখো লাখো শিক্ষিত তরুণ বেরিয়ে আসবে সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা গ্রামবাংলার প্রতিটি কোণ থেকে। পুলিশের লাঠি, বন্দুক, আর পিস্তল দিয়ে তাদের দমন করতে আপনি পারবেন না মিস অনামিকা। আই মীন…..
ইন্সপেক্টর: সাট আপ! একজন পুলিশ অফিসারকে কেমন করে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয় তা কি তুমি জানো না?
মিঃ চোর: এ্যা না না মানে… আমি ভুল করছিলাম ম্যাডাম, আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া সেই অনামিকা যাকে কলেজ জীবনে আমি ভালোবাসতাম। আজ পাঁচ- পাঁচটা বছর ধরে তাকে আমি তন্ন করে খুঁজেছি, কিন্তু পাই নি।
ইন্সপেক্টর: কে অনামিকা? তার সঙ্গে তোমার কিসের পরিচয়?
মিঃ চোর: আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় জন্ম-জন্মান্তরের। দুটি অভিন্ন হৃদয়ের ভালোবাসার অটুট বন্ধন।
ইন্সপেক্টর: তোমার নাম সু শান্ত ! সু শান্ত রায় । সেই সুশান্ত কি করে অশান্ত হয়ে ওঠে।
মিঃ চোর: আপনাদের সীমাহীন অভাব কেড়ে নিয়েছে আমার শিক্ষা, আমার সম্ভ্রম, আমার সামাজিক মর্যাদা। তাই আমি শিক্ষিত হয়ে সবার কাছ থে্কে পেয়েছি ঘৃণা আর অপমান। আপনাদের সুসভ্য সমাজ আমাকে কিছুই দেয় নি। নাথিং- কিচ্ছু না। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কেমন করে?
ইন্সপেক্টর: তোমার চোখ, তোমার মুখ তোমার কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে তুমি সুশান্ত… আমি জানি তুমি চুরি করো নি। তুমি চুরি করতে পারো না।
মিঃ চোর: জানেন ইন্সপেক্টর, ঘরে চাল নেই। স্ত্রীর তিন মাস ধরে ওষুধ কিনতে পারছি না। ছেলেমেয়ে দুটো খিদের জ্বালায় ছটফট করছে। রাত তখন এগারোটা। হঠাত্ ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি স্ত্রী ঘুমুচ্ছে, ছেলেমেয়ে দুটো খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাবলা্ম এই সুযোগ। এই রাতের মধ্যেই আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। তা না হলে আমার গোটা পরিবারটা অনাহারে খেতে না পেয়ে মারা যাবে। তাই বাধ্য হয়ে রাতের আঁধারে ঢুকে পড়লাম চৌধুরী পরিবারে। কিন্তু দেখলাম। দরজা জানালা বন্ধ করে সবাই ঘুমাচ্ছে। উঠোনে পড়ে আছে দুটো থালা, বাটি, গেলাস আর ঘটি। তাই সেগুলো নিয়েই পালাতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সামনে পেছনে বামে ডাইনে চারদিক থেকেই গাঁয়ের লোক আমাকে তাড়া করলো। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
ইন্সপেক্টর: সমাজের চোখে তুমি অপরাধী হলেও আমার কাছে তুমি নিরপরাধী। সেপাই। ওর হাতের হ্যাণ্ডকাপ খুলে দাও।
মিঃ চোর: (বিস্ময়ে) ইন্সপেক্টর!
ইন্সপেক্টর: সমাজের বিচারে তুমি অপরাধী হলেও মানবিকতার বিচারে তুমি নিষ্পাপ। তাই তোমার হাত হ্যাণ্ডকাপ খুলে দিলাম। কিন্তু তবুও মুক্ত তুমি নও। আমি তোমাকে কর্তব্যের শৃঙ্খলে তোমায় বন্দী করলাম। আজ থেকে তোমার সাদা পোশাক আমি বদলে দেব। তোমায় পরতে হবে পুলিশের ইউনিফর্ম। আজ থেকে তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যাণ্ট। তুমি হবে আইনের রক্ষক কর্তব্যপরায়ন পুলিস অফিসার।
মিঃ চোর: ইন্সপেক্টর!
ইন্সপেক্টর: বিস্ময়ের কিছু নেই বন্ধু! (মাথার টুপি খুলে) চেয়ে দেখ আমার দিকে। চিনতে পারো কে আমি? আমি তোমার চির পরিচিতা অনামিকা সেন। সেদিনের অনামিকা সেন আজকের কর্তব্যপরায়ন মহিলা পুলিশ কমিশনার। তুমি আমার হাত ধরো সুশান্ত। (হাত এগিয়ে দেয়)
মিঃ চোর: (উভয়ে করমর্দন) বলো অনামিকা কি চাও তুমি?
ইন্সপেক্টর: আমি চাই একটা ফুটন্ত সকাল।
মিঃ চোর: আকাশ যে অমানিশার অন্ধকারে ঢাকা।
ইন্সপেক্টর: রাত্রিশেষে আমি নতুন আলোর ঠিকানা এনে দেবো।
মিঃ চোর: অনামিকা!
ইন্সপেক্টর: তোমাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাবো। অন্ধকার রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। আর দেরি নেই। চেয়ে দেখো পূর্ব দিগন্তে আলোর রক্তিম আভা। নতুন সকাল সূচনা করবে নতুন পথের ঠিকানা।

উভয়ে একসাথে ফ্রিজ হয়ে যায়। নেপথ্যে মাইকে গান বেজে ওঠে।

একদিন সূর্যের ভোর
একদিন সত্যের ভোর আসবেই
এই মনে আছে বিশ্বাস
আমরা করি বিশ্বাস
একদিন সূর্যের ভোর আসবেই।

We shall over come
We shall over come
We shall over come someday,
Oh deep in my heart
We do believe
We shall over come someday.

য ব নি কা

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- তৃতীয় পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- তৃতীয় পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাসন্তীঃ- টুসু পূজোর আর এক নাম লক্ষী পূজো, ভূমি বা মাটি পূজা। এই পূজো কে অনেকে আবার ভারত মায়ের পূজো বলেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক জায়গায় বাঁশের ডউল তৈরী করেন। আবার দুই ২৪ পরগণা জেলার সুন্দরবন এলাকার আদিবাসীরা টুসু ঠাকুর পটুয়ার কাছ থেকে তৈরী করে তা পূজোর স্থানে এনে পূজো করেন।

এই পূজোয় সরিষার তেল, প্রদীপ ধূপ ধূনা সিঁদুর সলতে, পেঁপে ফলমূল সহ নানান উপকরণ এই পূজোর প্রধান দ্রব্য। এ পূজোয় বাড়ীতে ছেলে মেয়েদের দল কিংবা পাড়াপ্রতিবেশীরা সকলেই মিলে একত্রিত হয়ে পূজো করে থাকে। পূজার দিন পৌষ মাসের শেষের রাত্রি পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন। পৌষ সংক্রান্তিতে প্রতি বাড়ীতে পিঠে-পুলি তৈরী হয়ে থাকে। শীতকালে নতুন গুড় দিয়ে পিঠে খেতে কার না ভালো লাগে।

একদিকে গঙ্গাসাগর মেলা ও স্নানযাত্রা। প্রত্যেকেই কাজের অবসর পায়।ছেলে বা মেয়ে যে কেউ করতে পারে এই টুসু পূজো।যিনি পূজোর কর্তা হন তিনি সাধারণত পূজো করেন। আদিবাসীদের পূজায় কোন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয় না। যে পূজোয় পূজারী লাগে সে পূজোয় আদীবাসীদের পূজারী বা “পাহান” থাকে।
পূজোর সন্ধ্যায় পূজার মেরাপে টুসু ঠাকুর আনা হয়। বেদীতে ঠাকুর বসিয়ে ফুল পাতা দিয়ে সাজানো হয়। সন্ধ্যার প্রথম প্রহরে পূজোর মালিক থালায় করে পূজোর সামগ্রী নিয়ে এসে ঘটস্থাপন, সিঁদুর লেপন, ফল মিষ্টি খই পেঁপে চিড়া সামনে রেখে পূজো শুরু করেন। পূজোর সময় শাঁখ বাজানো হয়। পূজো হয়ে গেলে পেঁপে বলি দেওয়া হয়। এই হল প্রথম প্রহরের পূজো।

পূজোর পর ছেলে মেয়ের দল আলাদা আলাদা ভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে টুসু গান করেন। সাংস্কৃতির আসরও বসে। একদল গান গেয়ে অপর দলকে গান চাপান দেয় । এভাবেই এক এক সময় একটি দল এসে টুসু ঠাকুরের সামনে গান গায়।

দ্বিতীয় প্রহরের পূজোয়ও পেঁপে বলি হয়। পুজোর পর শুরু হয় টুসু গান ও ঢোল বাজনা। দ্বিতীয় প্রহর প্রায় প্রথম প্রহরের মতো। আসে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রহর প্রায় একই। চতুর্থ পূজোয় ভোর হয়ে আসে। এক টুসুর কর্মকর্তা, অন্য টুসুর কর্মকর্তার পূজোয় হাজির হয়ে মিতালী পাতায়। ছেলে হলে ছেলে, মেয়ে হলে মেয়ে টুসু সই পাতায় চতুর্থ প্রহর গানবাজনা চলে। একটা পূজোর দল আর একটা পূজোয় উপস্থিত হয়ে টুসু গান গেয়ে মনোরঞ্জন করেন।

সুন্দরবনের বাসন্তী, ক্যানিং, গোসাবা, কুলতলী, নলিয়াখালী, জয়রামখালি, ছোটদুমকী তে একাধিক টুসু পূজো হয়। তাই একে অপরের সঙ্গে শত দুঃখের মধ্যে আনন্দ ভাগ করে নেন। বর্তমানে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়ায় আগের মতো র ধূমধাম নেই তা স্বত্বেও আদিবাসীরা তাঁদের সম্প্রদায়ের রীতি রেওয়াজ কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছে।

রাত কেটে প্রভাত হয় ।প্রভাতের পর সকাল বেলায় গান গাইতে গাইতে কাঁসার ঘন্টা,বাজনা,শাঁখ বাজাতে বাজাতে বাড়ী বাড়ী টুসু ঠাকুর নিয়ে ভ্রমণে বের হন। বাড়ীর মহিলারা ধান, দুর্বা, প্রদীপ নিয়ে টুসু ঠাকুর বরণ করেন। বেলা হলে পাড়ার সকল লোক একত্রিত হয়ে টুসু ঠাকুর নিয়ে একস্থানে জোট করেন। একটা টুসুর কর্তার সাথে আরেক জন মোকর পাতায়। গানবাজনা চলে। এরপর দুঃখের মধ্য দিয়ে পুকুরে টুসু ঠাকুর বিসর্জন করেন। বিকালে বা তারপরের দিন বাড়ী বাড়ী গিয়ে প্রীতি, প্রণাম, শুভেচ্ছা জানিয়ে আসেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন। এরপর আবার চলে একটি বছরের প্রহর গোনার অপেক্ষায়।

তথ্য সহায়তায়: Daily Hunt

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- দ্বিতীয় পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- দ্বিতীয় পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

এবার টুসুর কথা
লিখেছেন: শেখ সাদী

উৎসবের নাম টুসু। আর, টুসুর প্রাণভ্রমরা ‘গান’।
একদল বলেন ‘টুসু পূজা’।

টুসু নামে কোন দেবতা নেই। টুসু আসলে জনজীবনের এক অতি আপনজন।
দেবতা না হলেও অনেক বাড়িতে টুসুর মূর্তি দেখেছি। যদিও সাথে ধর্মের কোন যোগসূত্র নেই টুসুর।
সম্পর্ক নেই পুরাণের সঙ্গেও। টুসু অপৌরাণিক। অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য গানের উৎসব, যে গান কেবল নারীদের। এখন পর্যন্ত কোন পুরুষকে দেখিনি টুসু গাইতে।

সম্প্রতি শুনছি পুরুষরাও নাকি টুসুর দল গড়েছেন।

টুমু নামের জন্ম ঊষা বা ওষা ব্রত থেকে।

উড়িষ্যার পাহাড়ি অঞ্চলে এখনো এই ব্রত পালন করা হয়। ধরা হয় ‘ঊষা’ বা ‘ওষা’ শব্দটি এই অঞ্চলের কথ্যভাষার হয়ে যায় টুসু। নামকরণে নিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য কোন মত নেই। একদল মনে করেন, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে।
নানা জনের নানা মত। তর্ক চলছেই।

একদল বলেন তোষলা ব্রতর নাম হয়েছে টুসু। একদল বলেন তুষার শব্দ থেকে এসেছে টুসু।
টুসুর শুরুটা কবে সেকথা জানা যায় না। লিখিত প্রথা বা মন্ত্রও নেই।

কেবল গানের মধ্য দিয়ে চলে টুসুর আরাধনা। দেবী নয় বরং রাঢ় বাংলার ঘরের মেয়ে টুসু।
তাই নিজের জীবন যাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে টুসু আরাধনার নিয়ম কানুনও ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। তবে সবক্ষেত্রেই মিল রয়েছে মন্ত্রে তন্ত্রে নয়। খালি গলায় সুরেলা গানেই খুশি রাঢ় বাংলা।

টুসু গান কোন লিখিত গান নয়। পুরনো শ্যামা গানের মতোই শুনে শুনে মনে রাখতে হয়। আর সেভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম পার হয়ে এখন হাজার বছরেরও বেশি বয়স হয়েছে টুসুর। তবে সময়ের সাথে পাল্টেছে গানের কথা। পাল্টেছে সুর।

এখন মনে পড়ছে অবন ঠাকুরের তোষলা ব্রত নিয়ে একটি লেখার কথা।

লিখেছেন ‘অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি থেকে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতি সকালে স্নান সেরে গোবরের ছ গন্ডা বা একশ চুয়াল্লিশটি গুলি পাকিয়ে কালো দাগশূন্য নূতন সরাতে বেগুন পাতা বিছিয়ে উপরে গুটি কয়টি রাখতে হয়। প্রতি গুটিতে একটি করে সিঁদুরের ফোঁটা এবং পাঁচখানি করে দূর্বাঘাস গুঁজে দিতে হয়। তার উপরে আলোচালের তুষ ও কুড়ো ছড়িয়ে সরিষা, শিম, মুলো ইত্যাদি ফুল দিয়ে ছড়া বলা হয়।’

অবন ঠাকুর আরো বলেছেন, ‘ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যে দশা-বিপর্যয় ঘটত সেইগুলোকে ঠেকাবার ইচ্ছা ও চেষ্টা থেকেই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি। বিচিত্র অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মানুষ বিচিত্র কামনা সফল করতে চাইছে। এই হল ব্রত। পুরাণের চেয়ে নিশ্চয়ই পুরোনো, বেদের সমসমায়িক কিম্বা তারও পূর্বেকার মানুষের অনুষ্ঠান।’

এখানে একটা প্রশ্ন মাথা তোলে। সেটা হলো তোষলা ব্রতের সঙ্গে টুসুর সম্পর্ক নেই। সাধারণত ব্রত হয় সকালে। গোসল সেরে। শুদ্ধাচারে। আর টুসু হয় রাতে।
টুসুর গান আগে থেকে লেখা থাকে না। তাৎক্ষণিকভাবে নারীরা মুখে মুখে গান রচনা করেন।

কথার মধ্যে জমে থাকা ব্যথা বেদনা পারস্পরিক ঝড়গা বিবাদের কথাও শোনা যায়। অন্যসব লোকগানের মতো নিরক্ষর লোকজনের মুখে মুখে রচনা করা ও গাওয়া বলে এতে নান্দনিকতার খুব একটা পরিচয় না পাওয়া গেলেও সুরের মাদকতা মন ভরিয়ে দেয়।

নবান্ন উৎসবের সঙ্গে টুসুর আত্মিয়ের সম্পর্ক। বিশেষ করে ভাদ্র মাসে ফসলের ক্ষেতে গাছগুলি ধানের ভারে নুয়ে পড়ে। ওই সময় সকালে গোসল করে নতুন বা ধুয়ে পরিষ্কার করা কাপড় পরে যেতে হয় ধান ক্ষেতে। নিয়ে যান একটি শাঁখ। হলুদ রঙের কাপড় আর একটি মাটিতে তৈরি পানির পাত্র বা কলস। ধান ক্ষেতে পৌছে আড়াই মুঠি ধান গাছ কেটে হলুদ কাপড়ে বেঁধে নেন। এর নাম ‘মুঠ আনা’।

এই সময় ধান গাছের গোড়ায় জমে থাকা পানি ভরে নেয়া হয় সাথে নিয়ে আসা পানির পাত্রটি। ধানের গাছ বাঁধা পুটলি ও পানিভরা পাত্রটি মাথায় নিয়ে চলে আসেন টুসুর দল। আসার সময় মৌন থাকতে হয়। সোজা চলে আসেন গৃহস্তের সদর দরজায়। এসে শঙ্খধ্বনি দেন। এটি আসলে আহবান। শঙ্খধ্বনী শুনতে পেয়ে যেন গৃহিনী বের হয়ে আসনে বাড়ির বাইরে। ধানগাছ বাঁধা পুটলি ও পানির পাত্র ঘরে নিয়ে যেয়ে লক্ষ্মী দেবীর বেদীর ওপরে রাখেন।

এই মুঠির ধানেই অগ্রহায়ণ মাসের কোন একদিন হবে নবান্ন। এই ধানের তুষগুলিই হলো টুসু। এমন কথাও চালু আছে।

এসেছে পৌষ মাস।

গৃহকর্তী তার আশেপাশের বাড়ির নারীদের সঙ্গে নিয়ে একটি নতুন মাটির পাত্র নিয়ে বসেন। গ্রামে পাত্রটির নাম ‘মালসা’।
পাত্রটি সাদা রঙ করা হয়। সাদা রঙ শুকিয়ে গেলে এর উপরে অসংখ্য লাল ও সবুজ রঙের দেয়া হয় ফোঁটা।
এই মালসায় ‘মুট আনা’ ধানের তুষ ভরে এর উপরে রাখেন আকন্দ ও গাঁধা ফুল।

কোন কোন এলাকায় মাটির ভাঁড়ের মধ্যে রাখা হয় পাঁচটি গোবরের ঢেলা। আবার কোন এলাকায় টিনের কৌটোর মধ্যে একটি প্রদীপ রাখার চল আছে। এ-ও দেখা গেছে কোন কোন এলাকায় প্রায় দেড় ফুট উচ্চতার একটি মাটির প্রতিমা। এর সারা অঙ্গে থাকে হলুদ রঙ।

গৃহকর্তী তুষ আর ফুল দিয়ে সাজানো মালসা নিয়ে বসেন।
পাশে থাকে খৈ, মুড়ি, নাড়ু ভরা বড় একটি-দুটি পাত্র।

আশেপাশের বাড়ির নারীরা সাথে আনেন অন্তত একটি করে পাত্র। থাকে খৈ, মুড়ি, চিড়া, নারিকেল বা তিলের নাড়ু। চলে প্রাক সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত।
এরপর সংক্রান্তির রাতটি টুসুর। জাগরণের রাত। উৎসবের রাত। রাতভর নারীরা গান করেন। গানের সুরে আর কথায় সারাগ্রাম মুখর হয়ে ওঠে।
রাত শেষে মানে প্রথম প্রভাতে কোন পুরুষ মাথায় করে মালসা নিয়ে যান। নদী বা জলাশয়ে বিসর্জন দিতে। কোন কোন এলাকায় চৌদলে করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে শুনেছি। দেখিনি।

আরার ফিরে যাই টুসু ও তোষলা ব্রতের কথায়।
তোষলা ব্রত একটি প্রার্থনার। একটি কামনার। শষ্য নয়তো ধন।
টুসুতে প্রার্থনা নেই। আছে আশা পূরণের আনন্দ। উচ্ছ্বাস।
যারা টুসুর গান করেন তারাই সুর বসিয়ে দেন কথায়।

একসাথে এক দল নারীর গাওয়া গান। কোন বাদ্যযন্ত্র থাকে না। মনের আনন্দে মিয়ে যায়। আনন্দ উপচে ওঠে কষ্টের ফসল তোলার সময়ে।
এই আনন্দ ধরা থাকে টুসুর কথায়। টুসুর সুরে। এলাকা ভেদে কথার রূপ বদলে যায়।

তথ্যসূত্র: সারাবাংলা/পিএম

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড প্রথম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- প্রথম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কথিত আছে টুসু একমাস বাপের ঘরে আর এগারো মাস শ্বশুর ঘরে থাকে। কৃষক কুড়মির শুধু পৌষমাসে ধান খামারে থাকে। আর মাঘের পয়লা দিনেই হালচার করে জমির ঈশান কোনে স্থাপন করা হয় ধান বীজ, আষাঢ়ে “পাঁচগাছি” করা হয় জমির উত্তর-পূর্ব তথা ‘ঈশান’ কোনে৷
সেই পাঁচগাছি ধান “ডিনি আনা” হয় সমস্ত পাকা ধান কেটে আনার পর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি বা ছোটো মকরে৷
সেই ডিনি’র ধান নিয়ে স্থাপিত হয় “টুসু”৷ টুসু এত বড় একটা পরব বা পর্ব৷

টুসু পরব কুড়মিদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বড় পরব..কারণ কুড়মিরা হচ্ছে কৃষিজীবী আর সেই কারণে কুড়মিদের সকল পরব হচ্ছে কৃষিভিত্তিক আর টুসু পরব যে কৃষিভিত্তিক তা আমরা সহজেই বুঝতে পারছি কেননা

1) টুসু পাতা(স্থাপনা) হয় অগ্রহায়ন মাসের(কুড়মালিতে মাইসর মাস)শেষে খেতের সমস্ত ধান খামারে আনার পর৷
2) ঘরের দিরখাতে মাটির সরাতে মেয়েরা কিছু ধান রেখে টুসু পাতে আর সারা পৌষ মাস চলে টুসুর আরাধনা৷
3) ধান মাড়াই এর কাজ শেষ হওয়ার পর পৌষ মাসের শেষে সেই সরার ধানকে(আরাধ্য টুসু) চৌড়লে চাপিয়ে নদীর জলে বিসর্জন করা হয়৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে টুসু এখানে ধানকেই বলা হচ্ছে। টুসু কখনও মাটির পুতুল নয় বা কাগজের পুতুল হিসাবে দেখা উচিত নয়৷

কারন কুড়মিদের কোনো দেব-দেবীর মাটির মূর্তি নেই আর এই টুসুর আরাধনা বা স্থাপনার জন্য কোন মন্দিরের দরকার হয় না। চাষীর ক্ষেত থেকে খামার আর খামার থেকে ঘরেই টুসুর বাস..তাই তো টুসু এই কৃষিজীবী কুড়মিদের কখনও মা আর কখনও মেয়ে৷ কিন্তু ধানকেই যদি এই কুড়মি কৃষিজীবিরা টুসু হিসাবে আরাধনা করে তাহলে তাঁকে জলে বিসর্জন কেন? কেননা ধানের বংশবৃদ্ধি হয় তখনি যখন জলের স্পর্শে আসে, তাই তো টুসুকে জলে বিসর্জন দেয়৷

আমরাকে ভাবতে হবে সেই ধান চাষের আবিষ্কারের সমকালীন সময়ের ঘটনা যখন সেই কৃষিজীবী মানুষের কথা যারা প্রকৃতির কাছ থেকে ধানের বীজ আরোহন করে কৃষি করত৷ কিন্তু তখন তাঁরা জানত না ধানবীজ সংরক্ষনের৷ তাই তাঁরা প্রকৃতির কাছ থেকেই ধানবীজ আরোহন করে কৃষি করত। আর এই কারণেই তাঁরা পরিপুষ্ট ধানের মধ্যে কিছু ধান সেই প্রকৃতিকেই ফেরত দিত৷ সকলেই আনুষ্ঠানিক ভাবে জলে বিসর্জন দিত এই আশাই তাঁরা যেন পরবর্তী বছরেও চাষের জন্য বীজধান পায়৷

টুসু “তুষ”শব্দ থেকে কখনও আসে নি কারন তুষ শব্দটি কুড়মালি শব্দ নয়। তুষকে কুড়মালিতে বলে ভুসা। কুড়মালিতে “টুসটুইসা” শব্দটি থেকে টুসু শব্দ আসাটাই স্বাভাবিক, কারন “টুসটুইসা” শব্দের বাংলা অর্থ হলো পরিপূর্ণ। কুড়মালিতে¬ টুসু শব্দের সাথে সম্মন্ধযুক্ত আর একটি শব্দ হলো ঠুসল। এই ঠুসল শব্দের অর্থ হলো পরিপূর্ণ। তাই টুসু শব্দের অর্থ হচ্ছে “পরিপূর্ণ ধান”, যা বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম। পরিশেষে বলা যায় টুসু হচ্ছে এমন এক শক্তি যে শক্তির দ্বারা কৃষিজীবি সহ সমগ্র মানবজাতির শক্তির সঞ্চার হয়।

তাই এই টুসুর পূজা তথা বিসর্জন করে যারা তাঁরাই কৃষির আবিষ্কর্তা-কুড়মি কৃষিজীবি।

তথ্য সূত্র:-ওয়েস্ট বেঙ্গল কুড়মালি একডেমি
লিখা:-বিপ্লব মাহাত ও ভূপেন মাহাত।

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দশম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দশম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার বাড়িতে বাড়িতে যে কতকাল ধরে টুসু পরব হয়ে আসছে, মকর সংক্রান্তির দিন মেলা বসে আসছে পরকুল, পরেশনাথ, কেচন্দা, লক্ষীসাগর, বীরপাট ও সুইসা ও মানবাজার কাশীপুর, হুড়া, ঝালদা, বলরামপুর, তালতলায়, তার খবর আমরা ক জনই বা রাখি। আমাদের দৌড় তো ওই সৌখিন বইমেলা বা পৌষমেলা অবধি।

যখন আমরা পাঁজি পুঁথি দেখে আমাদের চেনা দেব দেবীর পুজো করি, তখন ভয়ে হোক আর ভক্তিতে হোক আমাদের থাকে একশো ভাগ নিয়ম-নিষ্ঠা , আর চেষ্টা করি সেই হাজার হাজার বছর আগে রচিত বেদে যে মন্ত্র বলা আছে তা যেন যথাবিহিত উচ্চারিত হয়। যে মানুষ টি ভক্তি ভরে পূজায় অংশ নিচ্ছে তার কাছে সে মন্ত্র বোধ্যই হোক আর অবোধ্যই হোক , তার সঙ্গে আমাদের আজকের জীবনের যোগ থাক অথবা নাই থাক।

কিন্তু এই যে টুসু পুজোর গান , এখানে ওরা নির্ভয়ে আজকের জীবনের সুখ দুঃখের কথা শোনান তাদের আরাধ্য দেবীর কাছে।
আমাদের বোধহয় নতুন করে ভাবা দরকার কারা বেশি আধুনিক আমরা না ওরা !

এই মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা জীবনের দর্শন , এই সরলতায় সমৃদ্ধ গান , যা শুনে বার বার মনে হয় –
…সে গানে বিদ্ধ বুক রক্তে অশ্রু ছল ছল
এ যদি আমার দেশ না হয় তো কার দেশ বল ?

আর ভাবতে ভালো লাগে আর কেও না হোক রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন
এই আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির এই ‘নিম্ন- অংশ’টিকে – ‘গাছের শিকড়টা যেমন মাটির সঙ্গে জড়িত এবং তাহার অগ্রভাগ আকাশের দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তেমনি সর্বত্রই সাহিত্যের নিম্ন-অংশ স্বদেশের মাটির মধ্যেই অনেক পরিমাণে জড়িত হইয়া ঢাকা থাকে; তাহা বিশেষরূপে সংকীর্ণরূপে দেশীয়, স্থানীয়। তাহা কেবল দেশের জনসাধারণেরই উপভোগ্য ও আয়ত্তগম্য, সেখানে বাহিরের লোক প্রবেশের অধিকার পায় না। সাহিত্যের যে অংশ সার্বভৌমিক তাহা এই প্রাদেশিক নিম্নস্তরের থাক্‌’টার উপরে দাঁড়াইয়া আছে। ’

আচ্ছা, এই যে ওদের আরাধ্য দেবী কে ঘিরে, চলমান জীবন থেকে উপকরণ নিয়ে নির্বিশেষ মানুষদের গান বাঁধার উৎসব, আর সেই সুযোগে আরো একটু সবাই মিলে বেঁধে বেঁধে থাকার চেষ্টা, এমন উৎসব আমাদের, মানে যারা তথাকথিত ‘উচ্চ বর্গ’র মানুষ, তাদের নেই কেন ? বোধহয় আমরা সেই অকৃত্রিম সরলতা টুকু হারিয়ে এসেছি কৃত্রিম সভ্যতার রাজপথ দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে।
তথ্য সহায়তায়: অবসর পত্রিকা

টুসু কে, পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন বিদায় দিতে হবে, এক মাস ধরে সে ঘরে ছিল। তার সঙ্গে মনের প্রাণের কথা হয়েছে, তাই তাকে বিদায় বেলার মালা খানি, গান দিয়েই পরিয়ে দেওয়া –

আমার টুসু ধনে
বিদায় দিব কেমনে
মাসাবধি টুসুধন কে
পুজ্যাছি যতনে।
শাঁখা সাড়ি সিঁদুর দিলাম
আলতা দিলাম চরণে।
মনে দুঃখু হয় বড়
ফিরে যেতে ভবনে
দয়া কইরে আসবে আবার
থাকে যেন মনে
ভুইলনা ভুইলনা টুসু
আসবে আমার সনে।

টুসু গান বা কবিতা হয়তো অনেক পরিশীলিত। ছন্দের বাঁধুনি অনেক মজবুত , গান অনেক সুরেলা। তবে ভাবনায় এই টুসুর গানেরই সমগোত্রীয়। সেই একই আবেদন – পুনরাগমনায়চ-স্থাপিতাসী জলে ময়া।

তথ্যসহায়তায়: আনন্দবাজার পত্রিকা

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান নবম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
নবম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শহুরে মানুষদের কজনই বা খোঁজ রাখেন টুসু পরবের কথা, যে উৎসব রাড় বাংলার একটা বিরাট অংশের মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের কাছে শুধু ধর্মীয় রীতিনীতির আবদ্ধতার বাইরে গিয়ে একটি যথার্থ হৃদয়ের উৎসব।

‘আমাদের’ বলতে এই আমরা যারা নিজেদের ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে পড়ি বলে মনে করি তাদের ‘টুসু ’ নামে কোনো আরাধ্য দেবী নেই। এক মাস ধরে এই রাঢ় বাংলার, বিশেষ করে মানভূম অঞ্চলে পূজিত হবার পরে মকর সংক্রান্তির দিন যে টুসু প্রতিমাকে কে খড়কাই , সুবর্ণরেখা , কাঁসাই , গেঁদাই , শীলাই নদীতে বিসর্জন দেওয়া হবে তার সঙ্গে আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পর্ক আমরা তেমন করে স্বীকার করি না। সুরেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য মহাশয় রচিত সাম , যজু ও ঋক বেদের থেকে সংগৃহীত সর্ব প্রকার পূজাপাঠের যে একমাত্র ম্যানুয়ালটি পাওয়া যায় তাতে এই টুসু পূজার জন্যে কোনো মন্ত্র নির্দিষ্ট করা নেই। কারণ টুসু উৎসব এক অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য উৎসব। আমাদের পাঁজিতে এ উৎসবের নির্ঘণ্ট দেওয়া থাকে না।
টুসু নামের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ধানের তুষ , শীতের সময় যা জ্বালিয়ে আমাদের গ্রামে গঞ্জে লোকেরা আঁচ পোহায় , সেই তুষ থেকেই টুসু নামটি এসেছে।ফুল বেল পাতা নয় এই তুষ দিয়েই এ পূজার ডালি সাজানো হয়।

টুসু এক কুমারী কন্যা। এর পূজাও করেন কুমারী কন্যারা। আমরা যাদের নিম্নবর্গের মানুষ বলি সেই তাদের বাড়ির কুমারী কন্যারা। কিন্তু এ পূজার কোনো মন্ত্র তন্ত্র , নেই নির্ধারিত ক্রিয়া-কর্ম , কোনো বিশেষ উপাচারও নেই। অঘ্রান মাসের শেষ দিন থেকে পৌষ মাসের শেষ দিন অবধি রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে এই টুসু পূজিত হন ।যে হেতু মন্ত্র তন্ত্র নেই , তাই এ পূজায় কোনো ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয় না। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মেয়েরা নিজেদের সাজানো রঙিন কাগজের চৌদলের উপর প্রতিষ্ঠিতা পোড়ামাটির টুসুর মূর্তির সামনে বসে নানা রকমের গান বাঁধেন আর সেই গান করেন কখনো সম্মিলিত কখনো একক কণ্ঠে। সে গানে টুসুর মহিমা কীর্তন শুধু নয়, থাকে তাদের যাপিত জীবনের সাধ আহ্লাদ, আশা নিরাশ, ঠাট্টা তামাশার কথা। এবং তাতে ছায়া ফেলে তাদের ঘিরে থাকা আধুনিক সময়, এবং তাদের গাঁ-ঘরের পারিপার্শ্বিক।

কখনো থাকে ক্ষোভ প্রতিবাদ, কখনো থাকে দুঃখ বিষাদ। এক মাস ধরে এই মন্ত্রহীন পূজার শেষে মকর সংক্রান্তির দিন ব্যথিত হৃদয়ে তাদের ঘরের মেয়ের প্রাণের প্রতিমা কে তারা বিসর্জন দিয়ে আসে তাদের কাছের কোনো এক নদী অথবা পুকুরে। কোল, মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো, বাউরী বাগদী মহিলারা এই পুজো করেন। কিন্তু আশ্চর্য লাগে এই ভেবে গোটা পূজার্চনার ব্যাপারটা পরিচালিত হয় এই শ্রেণীর মহিলাদের দ্বারা আর এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এই মেয়েদের তাৎক্ষনিক ভাবে রচিত রচিত গান। নতুন ফসল ঘরে আসার খুশি উদযাপনের এর চেয়ে সুন্দর রূপ আর কি বা হতে পারে।

এ তাদের প্রাণের গানের ভাষা আর সে গানে কখনো তাদের টুসু একেবারে আটপৌরে মেয়ে,
তাদেরই মতন –
‘টুসু সিনাচ্ছেন, গা দলাচ্ছেন,
হাতে তেলের বাটি
নয়ে নয়ে চুল ঝাড়ছেন
গলায় সোনার কাঠি…’
আবার কখনো তাকে নিয়ে গ্রাম্য কোন্দল –
আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝনঝন করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মাগি, আঁচল পাইত্যে মাগে গো।

গাঁয়ের মেয়ে যখন শহরে চলে যায় লেখা পড়া শিখতে তখন সে কিছুটা শহুরে হয়ে যায় , হয়তো তার গ্রামের প্রতি টান কমে যায়, তেমনি একটা অভিমানের জায়গা থেকে গান বেরিয়ে আসে –
‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু যাবেন ইবার শহরকে
আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দিবে না পা ডহর কে
গীত গাহিবেন অবাক কলে , পান কিনিবেন দোকান লে
বছর বছর সাধ জাগিলে আসতে পারেন উখান লে
গঙ্গা সিনান , সিনেমা টকি , গড়ের মাঠ আর কালীঘাট
বতর পাইলে লেখাপড়ায় হরেক কিসিম লিবেন পাঠ ‘

আবার টুসু যেন তাদের প্রিয় সখী, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান –
‘চল টুসু খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা
অমনি পথে দেখাই আইনব কয়লাখাদের জল তুলা
উলোট পালট ফুলুট বাঁশিতে
আমার মন মানে না ঘরেতে …’

আবার এ গানেরই শেষের লাইনে সেই জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার ব্যথা, টুসুর কাছে কিন্তু কোনো চাওয়া নেই , রূপণ দেহি , ধনং দেহি নেই , জমিতে ধান না হওয়ার জন্যে কোনো অভিযোগ নেই , বরং তাকে সঙ্গী করেই চলুক জীবন সংগ্রাম –
‘ চল টুসু চল টাটা যাবো
ধান হইল না কি খাবো ’

রোদ বৃষ্টির মধ্যে বনে জঙ্গলে যাদের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে হয় তাদের দেবতাকে তো নেমে আসতে হবে তাদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে। তাই টুসুর গানে উঠে আসছে-
বড় বোনের লতা পাতা
ছোটো বোনের শাল পাতা
কুন বনে হারালো টুসু
সোনার বরণ লালছাতা
চিড়কা রোদে ধরেছে মাথা।

তথ্যসহায়তায়: আনন্দবাজার পত্রিকা