বিভাগের আর্কাইভঃ শিল্পসংস্কৃতি

বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (অষ্টম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (অষ্টম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

চিৎপুরে যাত্রাপাড়ার অন্দরেও ঘুরে শোনা গেল হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস। কেন? বাঙালি সংস্কৃতির অনেক কিছুই বদলে গেছে। এক দশক আগেও শহরতলি, মফস্‌সলে চায়ের ঠেকের আড্ডায় শোনা যেত যাত্রার নানা গালগল্প। রঙিন পোস্টার দেখে অমুক অপেরা, তমুক পালার বায়না নিয়ে চলত ক্লাবে ক্লাবে জরুরি আলোচনা। বড়ো মাঠে প্যান্ডেল করে বাঁধা হত যাত্রার মঞ্চ। ভিড়ের চোটে সে প্যান্ডেল খুলেও দিতে হয়েছে কখনও। কিন্তু আজ মাঠে যাত্রা দেখার জন্য লোক হয় না। ক্লাবগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ফ্রিতে যাত্রা দেখালে তবেই মানুষ জমা হয়। তা-ও খুব ভিড় হয় না। বরং অনেক সস্তার অর্কেষ্ট্রা, চটুল নাচগানের প্রতিযোগিতা বাজিমাত করে দিচ্ছে। কী বলছেন যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন? মানুষ কেন বলছেন, ‘না, না, না আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না’? অনেকের মতে, যাত্রা দেখার সেই অভ্যেসটাই হারিয়ে গিয়েছে সন্ধের মেগাসিরিয়ালের দাপটে। আগে বাড়ির প্রমীলাবাহিনীর কাছে যাত্রাই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম এবং বাড়ির থেকে বেরোনোর উপায়।

ইদানীং প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হাতে উঠে এসেছে টিভির রিমোট এবং অল্প সময়ে অনেক চ্যানেল দেখার দেদার স্বাধীনতা। আবার এই প্রজন্ম স্মার্টফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মধ্যে খুঁজে নিচ্ছে যাবতীয় বিনোদন। তাই বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারক ও বাহক যাত্রাপালা রয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। সত্যি বলতে তো, বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও স্মার্টফোনের সঙ্গে লড়তে যাত্রা যে পরিমাণ আধুনিক হওয়া উচিত, তা কি যাত্রা হতে পেরেছে?

চিৎপুরের প্রযোজকদের অনেকেই মনে করেন, নবীন নাট্যকারদের কলমেও আগের মতো সংলাপ ফুটে উঠছে না। বরং যাত্রামঞ্চে হানা দিয়েছে অশ্লীলতা, উগ্রতা। অতীতে চিৎপুর ছিল যাত্রার একমাত্র সাম্রাজ্য। ইদানীং যাত্রায় ঘটেছে বিকেন্দ্রীকরণ। চিৎপুরের সীমানা ছড়িয়ে যাত্রা পৌঁছে গিয়েছে নন্দকুমার, তমলুক, নিমতৌড়ি, বেলদা, বারাসাতেও। ফলে চিৎপুরের একচ্ছত্র সাম্রাজ্যে থাবা পড়ছে অন্য তল্লাটের অপেরার। এর পাশাপাশি অনেকে মনে করেন যাত্রায় নতুন প্রতিভার যথেষ্ট অভাব। অশোক কুমার, বীণা দাশগুপ্তা, স্বপন কুমারের পরে যাত্রা তেমন নির্ভরযোগ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী পায়নি।

চিৎপুরের যাত্রাসাম্রাজ্য যে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে, তা অবশ্য মনে করেন না যাত্রাভিনেত্রী ও নির্দেশিকা রুমা দাশগুপ্তা। তিনি জানালেন, “নোট বাতিলের পরে পরেই বহু অসুবিধার মুখে পড়েছিল যাত্রাদলগুলো। তবে এখন তা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু তা বলে যাত্রা ক্ষতির মুখে পড়েনি। এই চার-পাঁচ বছরে প্রত্যেক দলই খুব ভালো শো পাচ্ছে।” জানা গেল, এ বার বন্যার প্রকোপে অনেক শো বাতিল হয়েছে। গত কয়েক বছরে চলচ্চিত্র এবং সিরিয়াল থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যাত্রায় ভিড় জমাচ্ছেন। ফলে বাজেটও বেশ বেড়েছে। সে জন্য কম খরচে বিচিত্রানুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে ক্লাব সংগঠনগুলো। নিউ যাত্রালোক অপেরার সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা কান্তিময় ভাণ্ডারী জানালেন অন্য রকম অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বললেন, “টেলি সিরিয়ালের শিল্পীদের পাশে যাত্রাভিনেতারা তো নস্যি। সেলফি তোলার হিড়িক, কথা বলার দৌড়ঝাঁপ থেকে ফিতে কাটার আমন্ত্রণ, সবটাই তাঁদের জন্য. অথচ তাঁদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রম দিই আমরা। ওঁরা গাড়ি হাঁকিয়ে আসেন, শো করে চলে যান, তার আগের বা পরের খবর তাঁরা রাখেন না। এমনকি আমাদের জন্য কোনো সহমর্মিতাও নেই।”

বিডন স্ট্রিট অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা যাত্রাপাড়ায় চিত্রবিচিত্র রঙিন পোস্টারের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, সময়টা যেন এখানে থমকে আছে। শপিং মল, ইন্টারনেট সংস্কৃতির পাশে শহরের বুকে টিকে রয়েছে এমন এক চলমান সংস্কৃতি। যাত্রার ইতিহাস তো সেই কবেকার, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সময়কার। কেষ্টযাত্রা, পৌরাণিক যাত্রার যুগ আজ আর নেই। তা-ও চোখে পড়ল দু’-একটা ইতিহাসাশ্রিত পালা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রযোজককে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, “এখন আর এ সব চলে না। পাবলিককে অন্য রকম না দেখালে কেউ আসবে না। আজকাল মানুষ ঘরোয়া জিনিস, স্ক্যান্ডাল, অ্যাকশন এ সব দেখতে চায়।

তাই বাধ্য হয়ে হটসিন রাখতে হয়।” কিন্তু একটা সময় ‘রূপবান’, ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ও তো চলত দীর্ঘদিন ধরে? উত্তর আসে, “সে সময়টা মানুষ পিছন ফিরে তাকাতে চেয়েছিল। তাই রাজারাজড়ার গল্পে আগ্রহ পেয়েছিল। আজ তো সে সব দেখার জন্য বেসরকারি টিভি চ্যানেল আছে। লক্ষ্মী, সারদা, সাঁইবাবা, শনিদেব সবই আছে সেখানে।” পাশ থেকে আরও একজন বলে উঠলেন, “সন্ধে হলেই টিভিতে রানি রাসমনি দেখতে বসে যাচ্ছে লোকে। যাত্রা দেখতে কে ভিড় করবে?” কথাটা ঠিকই।

প্রযুক্তির অগ্রগতি খুবই কোণঠাসা করে দিয়েছে যাত্রার মতো লোকসংস্কৃতিকে। মমতাময়ী অপেরার ম্যানেজার সুধাংশু পাত্র দীর্ঘ ৪০ বছর যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাঁর মতে, “যাত্রায় নতুন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। মেগাসিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যাত্রা সামাজিক প্রেক্ষাপট ছেড়ে ভীষণ রকম ঘরোয়া প্রেক্ষাপটে বন্দি হয়ে গিয়েছে।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি জানালেন, যাত্রাশিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।

শিল্পীর স্বীকৃতি নেই, পেনশন নেই, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতিও নেই। কিন্তু তা-ও যাত্রায় বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় এখন মোটামুটি ভাবে যাত্রা উৎসবের রং লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে যাত্রা উৎসব। টিভি সিরিয়াল কিংবা শহরের আর পাঁচটা বিনোদন ছেড়ে মানুষ যাতে এখানে আসে, সে জন্য সরকারি তরফে প্রচার, প্রচেষ্টা চলছে। যাত্রাপাড়াও খুব আশাবাদী। দেখা যাক, সময় কী বলে!

বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (সপ্তম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (সপ্তম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সাজ ঘরে কাজ করে। সারা মাস কাজ করে ঘরে আসে ৬-৭ হাজার। তাও শুধু সিজনেই। বাকি সময়টা কারও ক্ষেতে খেসারি শাক তুলে রোজগার করে। বাড়িতে ৬ টা পেট চলে ওই রোজগারে। কী করে চলছে ওর কে জানে!’ বলছিলেন কলকাতার যাত্রা পাড়ার অন্যতম পরিচিত মুখ, টেলি-শিল্পী পিয়ালি বসু।

ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ, এই সময়টাই যাত্রাপাড়ার সোনার সময়। গ্রাম বাংলা জুড়ে প্রচুর শো। কিন্তু ২১ মার্চের পর থেকে লকডাউনের জেরে সেই পাড়া এক্কেবারে শুনশান। ১০০-র শো বাতিল হয়ে গেছে এক-একটি দলের। করোনা পরিস্থিতিতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর শর্তে আগামী দিনেও অন্ধকার কাটার আশা দেখছে না বাংলার এই সনাতন লোকশিল্প গোষ্ঠী। সামনেই রথযাত্রা। ওইদিনই ধুমধাম করে চিৎপুরে শুরু হয় আগামী সিজনের বুকিং। খবরের কাগজে পাতায় পাতায় থাকে নতুন পালার বিজ্ঞাপন। এবার সে-সব কষ্টকল্পনা।

”এ বছর এখনও দল গঠনই হয়নি অনেকের। আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন প্রযোজকরাও। ফলে বড় শিল্পীদের সঙ্গ চুক্তি হয়নি এখনও। সেই সঙ্গে আশঙ্কা, অগ্রিম দিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেলে, তারপর যদি যাত্রার বুকিং না হয়? সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রেখে কি পালা করা সম্ভব, রিহার্সাল সম্ভব? নাকি দর্শক সমাবেশ সম্ভব? খুব চিন্তায় আছি জানেন!”, বলছিলেন যাত্রা অ্যাকাডেমির গভর্নিং বডির সদস্য কনক ভট্টাচার্য।

শুধুমাত্র তাঁর দলেরই সবমিলিয়ে ২৫-৩০ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে লকডাউনের ফলে। ধুঁকছেন যাত্রার দৈনিক রোজগার করা শিল্পীরা। তাঁদের যৎসামান্ন রোজগারের উপর ভরসা করে থাকেন পরিবারের অনেকে। মাঝে মাঝে বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানে নাচ করার ডাক মেলে। করোনা পরিস্থিতিতে বিয়েবাড়ির জমায়েতও বন্ধ। যাত্রাশিল্পী থেকে ম্যানেজার, সাজঘরের লোক থেকে ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি, এদের চলবে কী করে, চিন্তায় যাত্রাসমাজ।

যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করেন। তাঁদের রোজগারও বন্ধ লকডাউন শুরুর পর থেকে।
যাত্রার প্রয়োজক কনক ভট্টাচার্য জানালেন, ‘লকডাউন পরবর্তী অধ্যায়ে ভাবছি, যাত্রা ওয়েলফেয়ার বডি কমিটি তৈরি করে আমরা নিজেরাই একটা ফান্ড তৈরি করব। সেখান থেকে দুস্থ যাত্রাশিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আশা রাখছি রাজ্য সরকার আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বাঁচাতে সবসময়ের মতোই পাশে থাকবে বর্তমান সরকার, আশা রাখছি। আবেদন জানাব যাত্রা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান অরূপ বিশ্বাসের কাছে।’

‘এক-একটি দলে ৪০-৫০ জন যুক্ত থাকেন, তার সঙ্গে তাদের পরিবারের লোক। এতগুলো পেট চলে যাত্রা করে। তাই আশা রাখব, যদি আগামী সিজনে যাত্রার জন্য আরও বড় জায়গা নেওয়া হয়! তাহলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজটা অন্তত হবে।’ আশা রাখছেন যাত্রা পাড়ার স্বনামধন্য শিল্পী অনল চক্রবর্তী।

‘যাত্রাপাড়ায় বহু দরিদ্র শিল্পী আছেন, কর্মী আছেন, তাঁদের আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করছি। তবে সেটা তো কোনও সমাধান নয়, শুধু পাশে থাকা মাত্র। তাই সরকারের দিকেই তাকিয়ে আমরা।’, আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন যাত্রা শিল্পী কাকলি চৌধুরি।

করোনা নিয়েই এখন চলতে হবে আগামী বেশ কিছুদিন, মত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু কী হবে এই পেশার শ্রমিকদের, শিল্পীদের, তাদের পরিবারের, উত্তর দেবে সময়।

বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (ষষ্ঠ পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (ষষ্ঠ পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

দিকে দিকে চলছে লক ডাউন। বেশ ভালো বুকিং ছিল এই বছরের পালার। কিন্তু হঠাৎ করেই সব স্তব্ধ হয়ে গেছে। ভয়াল থাবা এসে সারা বিশ্বের উপর চেপে ধরেছে। করোনা, কি অসম্ভব তার সর্বগ্রাসী ছোবল মানুষের শরীরের উপর। যেটা নাকি আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ও দুরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে। কথাগুলো যেন একদমে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে গেলেন চিৎপুরের বিখ্যাত শিল্পী ও নির্দেশক অমিত কান্তি ঘোষ।

তিনি আরও বললেন যে, “কলকাতা ও মেদিনীপুর নিয়ে দেড় লক্ষাধিক মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আজ আমার মতো তাঁরাও এক নিগূঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত।“ এই প্রসঙ্গে জানাই তিনি যাত্রা শিল্পীদের সংগঠন যাত্রা প্রহরীর চেয়ারপারসনও বটে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, “লকডাউন উঠে গেলে যাত্রা প্রহরী একটা ফান্ড গঠনের ব্যাপারে চিন্তা করেছেন। যেটা নাকি তাঁদের অন্যান্য শিল্পী ও কলাকুশলীদের কিছু অংশেরও যদি সাহায্যে আসে।“

সুমহান এর ইতিহাস যেখানে নট্ট কোম্পানির মত শতাব্দী প্রাচীন দল ছিল শ্রদ্ধেয় মাখন লাল নট্টের মত প্রযোজক ছিলেন। আবার সেই সময় লোকনাট্য, শিল্পী তীর্থ,ভারতী অপেরা এদের মতো আরও ঐতিহ্যবাহী যাত্রা দল ছিল। আরও যেসব শিল্পের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা যায় অরুণ দাশগুপ্ত,বীনা দাশগুপ্ত, গুরুদাস নাড়া জ্যোৎস্না দত্ত, শান্তি গোপল, শিবদাস মুখার্জির মতন অসংখ্য গুণী শিল্পী যাদের নাম করতে গেলে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাবে। আজকে সেই যাত্রা শিল্পে আচমকা অমানিশার অন্ধকার।

সুপরিচিত অভিনেতা খলনায়ক ও নির্দেশক রাজু বড়ুয়া এই প্রসঙ্গে বলেন, “জানিনা এর শেষ কোথায়? পরপর শো এর বুকিং ছিল। কিন্তু সব শেষ করে দিল এই মারন রোগ। শেষ শো ছিল সুন্দরবন এর কাছে তার পরেই সব বন্ধ। জানিনা আবার কবে যাত্রার মঞ্চে পা দিতে পারব।“

গ্রাম শহরে দর্শকদের মনে ঝড় তোলা নায়িকা শ্রাবনী সরকারের গলায় ঝরে পড়ল বিষাদের সুর। বললেন, “গাছ থেকে একটা একটা করে ফুল মাটিতে ঝরে যাচ্ছে। এই অন্ধকার ময় সময় দাঁড়িয়ে দূর থেকে আরো দূরে চোখ রেখে দেখছি ক্ষীণ আলো চোখে পড়ে কিনা।“ জনপ্রিয় নায়ক দীপঙ্করের সেই একই আক্ষেপ। “অনেকগুলো অভিনয় বাতিল হয়ে গেছে জানিনা আবার কবে শো শুরু হবে।“

যাত্রা লক্ষী রুমা দাশগুপ্ত বললেন, “মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজকের যাত্রা শিল্পে একটা জোয়ার এসেছে। কিন্তু করোনার এই করাল ছায়া সব স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু আমরা আবার জয়ী হয়ে এগিয়ে যাব এই প্রত্যাশা করি।“

রুমাদি গভীর বেদনার সঙ্গে বলেন,”আমরা যাত্রা শিল্পীরা সব সময়ই প্রযোজকদের কথা চিন্তা করি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি শিল্পী ও প্রযোজক একে অপরের পরিপূরক, সেই হিসেবে আজ আমাদের সঙ্গে তাঁরাও বড়ো একটা আর্থিক ধাক্কার সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। কথা বলতে বলতে তাঁর কন্ঠ যেন জড়িয়ে আসছে। সেই সব শিল্পী ও কলাকুশলীদের কথা বলতে গিয়ে যারা তুলনামূলক ভাবে অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে কাজ করে।

তিনি আশাবাদী এই লকডাউন উঠে গেলে ঐ সব শিল্পীদের জন্য তহবিল গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথা। যাত্রা প্রহরী থেকে এবং তিনি তাঁর নিজস্ব স্বল্প ক্ষমতার মধ্যে ব্যাক্তিগত ভাবে যদি কিছু করতে পারেন। গভীর চিন্তায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো দুটো কথা ” বড়ই অন্ধকার সময়”।

শিল্পীর থেকে আমিও দুটো লাইন ধার নিয়ে বলি – “অন্ধকারের প্রতিদ্বন্দ্বী, আকাশের ও আছে দুরভীসন্ধী মাঝ রাত্তিরে চাঁদের কাস্তে ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্ত আস্তে আস্তে”।
তথ্যসূত্র: খাস খবর: জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা… যাত্রাদলের অবক্ষয় (পঞ্চম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (পঞ্চম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

যাত্রাকে তা হলে বাঁচাবে কে? পুঁজি? একটু-আধটু হলেও, যাত্রা-পুনরুজ্জীবনে সহযোগিতার হাত কিন্তু বাড়িয়েছিল ব্যবসা সাম্রাজ্য। মাল্টিন্যাশনাল। তাঁদের প্ররোচনায় যাত্রার সংলাপে গুঁজে দেওয়া হচ্ছিল ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। কী ভাবে? ধরা যাক, বৃদ্ধ স্বামী নিরুদ্দেশ। অনেক দিন পরে ঘরে ফিরলেন তিনি। তাঁকে দেখে ছুটে এলেন স্ত্রী। ‘ওগো কোথায় ছিলে?’ স্বামীর উত্তর, ‘সে অনেক কথা, পরে বলছি, আগে জল দাও।’

শুনে স্ত্রীর জবাব, ‘জল খাবে কেন গো, তোমার জন্য অমুক কোল্ড ড্রিংক আনছি!’ বা, বাচ্চা ছেলে অসুস্থ। তার মা স্বামীর উদ্দেশে বললেন, ‘ছেলিডারে এট্টু তমুক এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানি লাগে। তা পাই কই?’ দরিদ্র স্বামী অনেক কষ্টে জোগাড় করে আনেন বলবর্ধক পানীয়টি এবং সারা স্টেজ ঘুরে স্ত্রীকে দেখাতে থাকেন।

স্পটলাইটের আলো পড়ে বোতলের গায়ে ব্র্যান্ডের উপর। অবশ্য, বেশি দিন এগোয়নি এই ব্যবস্থা। মরা গাঙে যে আর কখনও বান আসবে না, সেটা বুঝে গিয়ে ব্র্যান্ড মালিকরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন যাত্রা থেকে।

এখন কোনও আশ্চর্য নতুন এনার্জি ড্রিংক যাত্রাকে আবার চনমনে করে তুলবে, সে আশা কারও নেই। বাঙালির আদরের এক শিল্প, অতএব, এখন দাঁড়িয়ে লাস্ট সিনে।

যবনিকার অপেক্ষায়।
৫০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে নীরবে বেঁচে আছে যাত্রাপাড়া। জনপ্রিয়তার নিরিখে কি পিছিয়ে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতি? যাত্রার জন্মভিটে চিৎপুরে চোখ পেতে যা দেখা গেল, তার নির্যাস।

বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (চতুর্থ পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (চতুর্থ পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বাংলার জল-মাটির আপন ঐতিহ্যে গড়া যে বিনোদন শিল্প, সেই যাত্রা নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করে চলেছেন প্রভাত দাস। যাত্রা বাঁচবে? প্রশ্ন শুনে থমকে গেলেন প্রভাত। বললেন, ‘কী করে বাঁচবে বলুন? অন্ধকার রাতে বিশাল প্যান্ডেলের মধ্যে শয়ে শয়ে মানুষকে বসিয়ে রাখার মত গল্প কোথায়? মন মাতানো গল্প লেখার লোক কোথায়? একদা তেমন শক্তিশালী কলম নিয়ে ময়দানে এসেছিলেন ব্রজেন্দ্রকুমার দে। তাঁর উত্তরসূরি যদি কেউ হন, তিনি ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। তার পর? না, তেমন শক্তিশালী আর কেউ এলেন না। যাঁরা এলেন তাঁরা উপহার দিলেন কিছু নাচ-গান, হইহুল্লোড়। ব্যস, ওই দিয়েই ভাবলেন, বেশ সমসাময়িক করে তোলা গেল যাত্রাকে। ঘণ্টা! মানুষ শুনতে চায় গল্প। চরিত্র কিংবা আদর্শের সংঘাত। কেবল কিছু মানুষের স্টেজে হাঁটাচলা দিয়ে কিস্যু হবে না।’

মহাভারতে ভীষ্ম চোখের সামনে তিলে তিলে ক্ষয়ে যেতে দেখেছিলেন আস্ত এক রাজবংশ। বাঙালির যাত্রা শিল্পেও আছেন এক ভীষ্ম। ইন্ডাস্ট্রি তাঁর নাম দিয়েছে ‘বড়দা’। বড় ভাই নয়, প্রপিতামহ বলা যায় তাঁকে। বয়স ৮৩। তিনি মাখনলাল নট্ট। ঠিকানা শোভাবাজার। হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট। থাকেন যে বাড়িখানায়, তার বয়স সওয়াশো বছর, খসে পড়েছে পলস্তারা। সিঁড়িতে আলো নেই, দিনের বেলাতেই ঝুঁঝকো আঁধার। পা টিপে প্রায় হাতড়ে তিনতলায় উঠতে হল ভীষ্মের দেখা পেতে। ফোন করা ছিল। পৌঁছতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নট্ট কোম্পানির মাখনলাল। কী জানতে চাই, তা শুনে চোখের দিকে সোজা তাকালেন।

বিড়বিড় করে বললেন, ‘যাত্রার বাঁচার আশা নেই।’ বলছেন একটা শিল্প নিয়ে। কিন্তু কণ্ঠস্বরে আবেগ শুনে মনে হল যেন নার্সিংহোমে আইসিইউ-তে শয়ান আত্মীয়ের খবর দিচ্ছেন। মাখনলাল দায়ী করলেন যাত্রা কোম্পানির মালিকদের। বললেন, ‘অব্যবসায়ীর হাতে ব্যবসা পড়লে ফল যা হয়, তা-ই হয়েছে। মালিকরা ধরে ধরে আনছেন টিভি সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের। কই, যাত্রার হিরো-হিরোইনদের তো সিরিয়ালওয়ালারা ডাকছেন না! যাত্রা-মালিকরা টিভির হ্যাংলামি ছাড়বেন না, তাই যাত্রাও আর বাঁচবে না।’

বিশ্বত্রাস করোনাঃপৃথিবী জেলখানা-যাত্রাদলের অবক্ষয় (তৃতীয় পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (তৃতীয় পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

এই মরা কটালের যুগে একদম ব্যতিক্রম নেই তা নয়। অনল চক্রবর্তী-কাকলি চৌধুরী এই মুহূর্তে যাত্রার উত্তম-সুচিত্রা। ওঁদের পালা নাকি ফ্লপ হয় না। কলকাতায় যাত্রা উৎসবেও ওঁদের শো হাউসফুল। অনল আবার আওড়ান না অন্যের লেখা সংলাপ। পালার কাহিনিকার তিনি। পরিচালকও তিনি। কেন? জবাবে অনল শোনান এক কাহিনি। বছর দশেক আগে, গাঁয়ের মাঠে বসেছে আসর। এগিয়েছে কয়েক সিন। নায়ক অনল গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন ডায়ালগ। হঠাৎ থার্ড রো-এ বসে এক ছোকরা হাত উচিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘বেশ বেশ অনলদা। দারুণ হচ্ছে। এর পরে তো রাজা হিন্দুস্তানি? বুঝে গেছি।’

কোনও রকমে পালা শেষ করে সাজঘরে মাথা হেঁট করে বসে পড়েছিলেন অনল। ‘যুবকটি আমাকে নয়, গালে চড় মেরেছিল বাংলার যাত্রাশিল্পকেই। সে রাতে ধিক্কার দিচ্ছিলাম আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে। ভাবছিলাম, আমাদের পালার কাহিনি যা, তা তো সত্যিই বলিউডের ফিল্ম ‘রাজা হিন্দুস্থানি’র টুকলি। ছেলেটির কী দোষ? পালার কাহিনি যদি হয় চোরাই মাল, খদ্দের তা কিনবে কেন?’ সে রাতেই অনল ঠিক করেন, চিৎপুরে থাকুন যতই স্বঘোষিত সেলিম-জাভেদ, তাঁদের লেখা পালায় আর অভিনয় করবেন না তিনি। নিজেই লিখবেন কাহিনি। পরিচালনাও করবেন।

সেই ইচ্ছারই এক ফসল ‘সেদিন ঠিকানা হারিয়ে’। গল্প মিলনান্তক নয়। বরং ট্র্যাজিক। শেষ দৃশ্যে নায়ক-নায়িকা যখন বসবে বিয়ের পিঁড়িতে, তখন ফাঁস হয় এক মর্মান্তিক সত্য। ওরা ভাই-বোন। অতঃপর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু দু’জনের। এ কেমন পালা? ইচ্ছেপূরণ নেই, ফর্মুলা স্টোরি নয়। জার্ক বলে জার্ক! সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এ পালা হিট। কেন? প্রশ্ন শুনে খেপে গেলেন অনল।

বললেন, ‘খবর রাখেন কি, গত তিন-চার দশকে মানুষের মন কতটা বদলে গেছে? গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখন ফেসবুক করে। সস্তা কমেডি কিংবা জগঝম্পে ওরা আজ আর খুশি হতে পারে না।’

‘বিশেষ কোনও যাত্রা কোম্পানি কিংবা বিশেষ কোনও হিরো-হিরোইনের সাফল্যে বিভ্রান্ত হবেন না’, বললেন মঞ্জরী অপেরার নেপাল সরকার, ‘যাত্রাশিল্পের আয়ু আর বড় জোর কয়েক বছর। তার পর একে একে ঝাঁপ বন্ধ করবেন অনেক মালিক, ম্যানেজার। ডাউনফল শুরু হয়েছে অনেক দিন। চিৎপুরে ১০ বছর আগে যাত্রা কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৩৬। গত বছরেও ছিল ৬১টা। এ বার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৮-এ। আমার মনে হয়, সামনের বছর যাত্রাদলের সংখ্যা হবে ২৫।’

বিশ্বত্রাস করোনা….. পৃথিবী জেলখানা … যাত্রাদলের অবক্ষয় (দ্বিতীয় পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা ! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (দ্বিতীয় পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

এ বছর রথযাত্রা চলে গেল, কিন্তু খবরকাগজে দেখা গেল না ‘বিশেষ’ একটা জিনিস। অথচ, সে এক দিন ছিল, যখন রথের তারিখে কাগজ হয়ে উঠত বিশাল মোটা। মূল কাগজ যদি ১৬ পাতার, সঙ্গে ক্রোড়পত্রটি ২৪ পাতার! ঢাউস ঢাউস ফুল-পেজ অ্যাড। সে সব জুড়ে নায়ক-নায়িকাদের পমেটম-মাখা মুখ। কাজলটানা চোখ। সে সব দিনে রথযাত্রা উপলক্ষে চিৎপুর হয়ে উঠত যেন জগদ্ধাত্রী পুজোর চন্দননগর। অলিতে-গলিতে মন্ডা-মেঠাইয়ের গন্ধ। অপেরার গদিতে গদিতে অধিকারীরা ধোপদুরস্ত হয়ে বসে। অসম, ত্রিপুরা কিংবা এ রাজ্যের জেলাগুলি থেকে আসবেন কত লোক। যাত্রাপালার বায়না করতে। এ বার রথের দিনে চিৎপুর দেখল না ভিড়ভাট্টা। দেখল না উৎসবের আমেজ। ১৯৭০-’৮০-র দশকের সঙ্গে এই পরিবেশের কোনও তুলনাই হয় না। কেন? নয়নতারা অপেরার মালিক প্রশান্ত গোস্বামী বললেন, ‘মিছিমিছি কেন তুলনা টানছেন? তখন কি ডজন ডজন টিভি চ্যানেল ছিল? শয়ে শয়ে সিরিয়াল ছিল? রিয়েলিটি শো ছিল? দাদাগিরি, দিদিগিরি হাবিজাবি ছিল? কার ঘরে টিভি নেই বলুন তো? কে দেখতে পায় না সুইচ অন করলেই রণবীর কপুর কিংবা ক্যাটরিনা কাইফকে? বিনোদনের হাজারও পসরা নিয়ে টেলিভিশন যখন হাজির সুন্দরবনেও, তখন আর কে দেখবে যাত্রা? আসলে কি জানেন, বোকাবাক্সের পরদার চ্যালেঞ্জকে কী ভাবে রোখা যাবে, তা চিৎপুর বুঝে উঠতে পারল না।’

প্রশান্তর অভিযোগ পুরোপুরি মানেন না নটরাজ অপেরার হিরো ত্রিদিব ঘোষ। ‘চ্যালেঞ্জে কুপোকাত কি শুধু যাত্রা? চিৎপুরের পাশের পাড়া হাতিবাগানের কী হাল? রঙ্গনা কিংবা সারকারিনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার মনে হবে ওগুলো যেন পোড়ো বাড়ি। অথচ এক সময় বৃহস্পতি, শনি কিংবা রবিবার বিকেলবেলা ও সব হলের সামনেটা শালি-জামাইবাবুদের কলতানিতে মুখর হয়ে উঠত। আজ শালি আছে, জামাইবাবুও আছে, নেই রাসবিহারী সরকারের ‘সম্রাট ও সুন্দরী’। নেই মিস শেফালির নাচ। যাত্রাও সংকটে পড়েছে একাধিক কারণে। ভাল কাহিনি নেই, ভাল পরিচালক নেই, ভাল অভিনেতা নেই। খেয়াল করে দেখুন, সবই আছে সিনেমা, সিরিয়ালে।

বিনোদন মানে রসায়ন, রান্না। যাত্রা এখন মালমশলার অনটনে পড়ে বিস্বাদ রান্না হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী বলব মশাই, যাত্রাপালায় গান এখন একটা হাস্যকর উপাদান। পুরনো দিনে এক একটা পালায় থাকত বিশ-বাইশটা গান। সেগুলো লেখা হত শুধু যাত্রার জন্যই। গাওয়াও হত কাহিনির খাতিরে। আর এখন যাত্রার জন্যে আলাদা গান লেখার বদলে অনেক সময়েই থাকে সুপারহিট হিন্দি অথবা বাংলা সিনেমার মারকাটারি গান। তো সে সব গাইবে কে? নাহ্, পুরনো দিনের মত নায়ক-নায়িকা নয়। ডায়ালগের মাঝখানে হঠাৎ বাজবে টেপরেকর্ডার। চলবে গান। নায়ক-নায়িকা শুধু ঠোঁট নাড়বেন। বুঝুন অবস্থা! ধার করা অক্সিজেনে কত দিন বাঁচা যায়?’

ত্রিদিবের কথা হয়তো ঠিক। সত্তরের দশকে রমরমিয়ে বিক্রি হত সুপারহিট যাত্রাপালার এলপি রেকর্ড। এখন যাত্রার বাজার নেই বলে বেরোয় না তার সিডি। অথচ ‘সোনাইদিঘি’ কিংবা ‘নটী বিনোদিনী’র এলপি এক সময় বিক্রি হত ‘শোলে’র এলপি-র পাশাপাশি, পাল্লা দিয়ে।

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা.. যাত্রাদলের অবক্ষয় (প্রথম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (প্রথম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

করোনার আবহে থমকে গিয়েছে চিতপুরের যাত্রাপালা। কবে হবে ফের তাদের পালা তা তারা নিজেও জানে না। কেবলমাত্র অনাহারই নয়,যে অনিশ্চয়তার মেঘ ওদের জীবনে এসে পড়েছে তাতে করে সেই মেঘ যে কবে কাটবে তা নিয়ে রীতিমতো দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন গুজরান করছেন ওরা। মানে যারা চিতপুরের যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত, কেউ একা নয়,যতগুলো অপেরা আছে সকলেরই একই অবস্থা।

ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এই চারটি মাস যাত্রা দলগুলির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই চার মাসে যাত্রা দলগুলি ১০০ থেকে ১৫০ পালা করে থাকে বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে। বুকিং শুরু হয়ে যায় আরো অনেক আগে থেকে। কিন্তু এবছর করোনা আবহে বাতিল হয়ে গিয়েছে সব পালা। গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন সংস্থা, ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিয়ে দিতে হচ্ছে টাকা।বড় যাত্রা দলগুলি তবু কিছুটা পালা করতে পারলেও, ছোট দলগুলি ২০-২৫ বেশি পালা করতে পারেনি চলতি বছরে। বছর শুরুতেই ২০ – ৩০ লাখ টাকা ঢেলে বসে আছে প্রযোজকরা।

রোজগার না থাকায় প্রযোজকরাও আর টাকা দিতে চাইছে না কর্মীদের। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত রোজ মজুরি ভিত্তিতে কাজ করা কর্মীরা। অনামী শিল্পী, মিউজিক-লাইট বয়, যাত্রা দলগুলির ম্যানেজার এদের অবস্থা শোচনীয়। যাত্রা দলগুলির সঙ্গে যুক্ত সাধারণ মানুষ কর্মচারী বেশিরভাগই গ্রাম থেকে আসেন কাজ করতে। গ্রামে ফিরে গেলেও অনেকেই অর্থকষ্টে ভুগছেন। চিৎপুর যাত্রা দলগুলির অফিসে অনবরত ফোন বেজেই চলেছে বিভিন্ন কর্মীদের টাকা চাওয়ার দাবিতে। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা একাডেমি পরিচালন কমিটির সদস্য কনক ভট্টাচার্য এদিন জানান, ‘অবস্থা খুব খারাপ অন্ধকারে চলে গেল যাত্রা দলগুলি। চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচুর শো হয়। এবার কিছুই হতে পারল না। আমরা প্রযোজকরা এক টাকাও ঘরে তুলতে পারেনি। আমার নিজেরই ৩০ লাখ টাকা লোকসান হয়ে গেল। কি করে অভিনেতা কলাকুশলী কর্মীদের টাকা দেবো।’

যাত্রাদল গুলি প্রতি বছর রথের সময় নতুন দল গড়ে। রথের দিন আত্মপ্রকাশ করে নতুন যাত্রা পালা নতুন দল। জুলাই মাসে রথ।চলতি বছরে রোজগার না হওয়ায় আগামী বছর কি হবে, কিভাবে নতুন যাত্রা পালা, নতুন দল করা হবে সে বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে চিৎপুর যাত্রা পাড়া। রথের দিন নতুন যাত্রাপালা নতুন দল নিয়ে আত্মপ্রকাশ না করতে পারলে, চিৎপুর যাত্রা পাড়ায় এটাই হবে প্রথম অঘটন। করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস গড়িয়ে যাবে বলেই মনে করছেন অনেকে। লকডাউন উঠে গেলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধি-নিষেধ জারি থাকবে। সে ক্ষেত্রে যাত্রা পালা বুকিং পেতেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে দলগুলিকে। তার উপর বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আর্থিক মন্দার সম্মুখীন হতে হবে সবাইকেই। তাই সেক্ষেত্রেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ক্লাব বিভিন্ন সংস্থা যাত্রা পালা বুকিং করবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে চিৎপুর যাত্রা পাড়া। তবু এবছর দুর্গাপুজো দেরিতে হওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে দলগুলি।

বাংলাদেশ সাহিত্য উৎসব ২০২০

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান একুশের চেতনায় উদ্ভাসিত বাঙালি জাতিসত্তার মাস ফেব্রুয়ারির ২২ ও ২৩ তারিখে কবিতাপত্র ‘দিকচিহ্ন’- এর উদ্যোগে দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিকের অংশগ্রহণে বাংলাদেশ জাতীয় গণগ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ, শাহবাগ, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ সাহিত্য উৎসব ২০২০’। এ উৎসবের থিম ‘ভেদাভেদহীন শান্তির পৃথিবী চাই’।

বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ, বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যিকদের সঙ্গে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকদের মেলবন্ধন এবং সাহিত্যের সঙ্গে গণমানুষের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করাই উৎসব আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

তিনদিনব্যাপী এ সাহিত্য উৎসবের আহ্বায়ক লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, যুগ্ম-আহ্বায়ক কবি ও সমাজ সংগঠক মোহন রায়হান। উৎসব উদ্বোধন করবেন লেখক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন লেখক ও সমাজতাত্ত্বিক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান।

উৎসবে বাংলা ভাষার গতি প্রকৃতি, কবিতাঃ ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বৈরথ, বাংলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা, বাঙালির ইংরেজি চর্চ্চা ও অনুবাদ সংকট, মাধ্যমের ভিন্নতা ও শিল্পের ঐক্য- শিরোনামের পাঁচটি পর্বে প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনায় অংশ নেবেন দেশ-বিদেশের শিল্প-সাহিত্যবোদ্ধা ও গুণীজন। এ ছাড়াও থাকবে দেশি-বিদেশি কবিদের স্বরচিত কবিতাপাঠ, আনুষ্ঠানিক সম্মাননা প্রদান ও আবৃত্তি অনুষ্ঠান।

বাংলাদেশ সাহিত্য উৎসব ২০২০-এ অংশগ্রহণের জন্যে আপনাকে আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনার অংশগ্রহণ আমাদের উৎসবকে আলোকিত করে তুলবে।

যাত্রাপালার আসর- সমাপ্তি পর্ব

যাত্রাপালার আসর- সমাপ্তি পর্ব
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

আমাদের দেশের অতি প্রাচীন ও বলবান শিল্পমাধ্যম হলো এই যাত্রাশিল্প। এ মুহূর্তে যাত্রাশিল্প মৌলিক শিল্প মাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। একবিংশ শতাব্দীর প্রত্যাশা ছিল এই যাত্রাশিল্প মাধ্যমটি আমাদের সংস্কৃতিচর্চার মধ্য দিয়ে সমাজে একটি নবজাগরণের সৃষ্টি করবে। কিন্তু এই শতাব্দীর শুরুতেই আমাদের লোকজ এই শক্তিশালী মাধ্যমটি মুখ থুবড়ে পড়ে। যাত্রাশিল্পকে নিয়ে আমাদের দেশের মৌলবাদীদের নানামুখী আগ্রাসন, অন্যদিকে এই যাত্রাশিল্পের আয়োজকদের অর্থলিপসার মোহে যাত্রামঞ্চে অশ্লীলতার অভিযোগে নানাভাবে এই লোকজ মাধ্যমটিকে কলুষিত করে তোলে। এদিকে এই সমস্যার গভীরে না গিয়ে দেশের প্রশাসনও পড়ে বিব্রতকর অবস্থায়, ফলে প্রশাসন ও যাত্রাশিল্পের মধ্যে বেড়ে যায় দূরত্ব। নানা প্রকার প্রজ্ঞাপন জারির ফলে যাত্রাশিল্পটি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে।

যাত্রাদলের মহাজনরা দিনের পর দিন যাত্রা উৎসবের অনুমতি না পেয়ে অনেকে যাত্রা দলের যবণিকা টানছেন। কে শুনাবে তাদের আশার বাণী, “ওঠো মা ওঠো মুছো তোমার অশ্রুজল”। দীর্ঘদিন পরে হলেও সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মহোদয় রাব্বী মিয়া বলেন, সম্মিলিত প্রয়াসে যাত্রাপালাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের এ কথার উপর যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, সৎ সুন্দর সৃষ্টিশীল কর্মের মন-মানসিকতা প্রশংসার দাবি রাখে। আশাহত যাত্রাশিল্পীদের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটেছে। যাত্রাশিল্পী মৃণাল কান্তি দে তার এই শিল্প জীবনে যাত্রাশিল্পকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বহু সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ দীর্ঘদিন যাবত লোকসংস্কৃতির শক্তিশালী মাধ্যমটি টিকিয়ে রাখার জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে, সুশীল সমাজের, সরকারের, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, সাংস্কৃতিক সংগঠনের, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছে বহুবার ঘুরে ঘুরে আলোচনা ও সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করে; কিন্তু খুব বেশি সহযোগিতা তারা পায় না।

যাত্রাকে অশালীনতা থেকে মুক্ত করতে এবং যাত্রা শিল্পকে বাঁচাতে সংস্কৃতিবান্ধব বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার প্রণয়ন করে যাত্রা নীতিমালা। ২০১২ সালে এই যাত্রা নীতিমালা গেজেটভুক্ত হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮৮টি যাত্রাদলকে নিবন্ধন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এখনকার নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্যসংস্থা, মাগুরার চৈতালি অপেরা, নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, রঙমহল অপেরা, ফরিদপুরের মধুচ্ছন্দা যাত্রা ইউনিট, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট ইত্যাদি। বর্তমান সরকার ৭টি বিভাগীয় শহরে শিল্পকলার মাধ্যমে এবং যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সহযোগিতায় যাত্রা উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

যাত্রা একটি শিল্প এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার যে কর্মকাণ্ডের উদ্যেগ নিয়েছেন সরকার সেটা সত্যিই সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। আমরা আরো বলতে চাই এই যাত্রাপালার সাথে জড়িত অনেক শিল্পী। সুতরাং যাত্রাপালা বাঁচলে শিল্পী বাঁচবে এবং মানুষ সঠিক দিকনির্দেশনাও পাবে এই যাত্রাপালার মধ্য দিয়ে। যাত্রা মানুষের কথা বলে ও গল্পের মধ্য দিয়ে তারা দেশ, জাতি ও সমাজের কথা বলে। যেমন একজন শিক্ষিত মা তার সন্তানকে সুশিক্ষায় গড়ে তুলেন; ঠিক তেমনিভাবে শিল্প সংস্কৃতিই একটি দেশের সুনাম অর্জন করে দেশ থেকে বিদেশের মাটিতে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। তাই দেশ ও জাতির কল্যাণে শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতিক বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং শিল্পের মতামত মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই সোনার বাংলায় সোনা ফলবে।

তথ্যসুত্র: দৈনিক খবরের আলো

যাত্রাপালার আসর- পঞ্চম পর্ব

যাত্রাপালার আসর- পঞ্চম পর্ব
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনীর অভিনয় শুরু হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মুকুন্দ দাশ। তার প্রকৃত নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। তিনি বিক্রমপুর থেকে বরিশাল গিয়ে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী অশ্বিনী কুমারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মুকুন্দ দাশ যাত্রার মাধ্যমে দেশপ্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করেন। তিনি সমাজ সংস্কারমূলক বক্তব্য, পণপ্রথা, জাতিভেদে ইত্যাদির বিপক্ষেও বক্তব্য প্রচার কররেন। তিনি ‘স্বদেশী যাত্রা’র সূচনা করেন। সে কারণে তাকে কারাবন্দিও থাকতে হয়। মুকুন্দ দাশের প্রেরণায় আরও অনেক স্বদেশী যাত্রার দল গড়ে ওঠে। তারা গ্রামে গ্রামে যাত্রার প্রদর্শন করে দেশপ্রেমমূলক কাহিনী প্রচার করতে থাকে।

সে সময় ঈশা খাঁ, প্রতাপচন্দ্র, বারো ভূঁইয়া, সোনাভান, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, ক্ষুদিরাম, টিপু সুলতান ও অন্যান্য বিপ্লবীর নামেও কাহিনী অভিনয় হতে থাকে। স্বদেশী যাত্রা একসময় ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়ে। মুকুন্দ দাসের আগে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী নামে একজন পালাকার ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘বিচিত্রবিলাস’ পালা লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন। ১৮৬০-৭৮ এর মধ্যে তার পালা গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় এবং ঢাকাতেই প্রথম মঞ্চায়ন হয়। মনোমহন বসু নামেও আরেকজন পালাকার বেশ বিখ্যাত ছিলেন। নওগাঁ জেলার ধামুরহাট থানার শ্রামপুর গ্রামে নফরউদ্দিন নামে আরেকজন পালাকার প্রথমে রাজনীতিকেন্দ্রিক পালা লিখে বেশ খ্যাতি পান। পরে তিনি মধুমালা, সাগরভাসা, কাঞ্চনবতী, বিন্দুমতি, পুষ্পমালা ইত্যাদি রূপকাথাভিত্তিক পালা লেখেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনও পালা লিখেছেন। তিনি বেহুলা নিয়ে যাত্রাপালা লেখেন।

সে সময় গ্রামে-গঞ্জে বিষাদসিন্ধুর কাহিনী নিয়েও যাত্রা অভিনয় হতো। কারবালার কাহিনী নিয়ে যাত্রাপালা লেখা হতো। মানিকগঞ্জের ধানেশ্বরের আবদুল করিম, নরসিংদীর জালাল উদ্দিন, হিরেন্দ্র কৃষ্ণদাস, মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলী, ঢাকার কেরানীগঞ্জের রফিকুল, পটুয়াখালীর দুধল গ্রামের মাস্টার সেকেন্দার আলি, খুলনার ডুমুরিয়ার এমএ মজিদ (অগ্রদূত), ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইলের কফিল উদ্দিন ও মানিকগঞ্জ সদরের ডা. আবেদ আলীসহ অনেকেই সে সময় যাত্রাপালা লিখতেন। বিশ শতকে রূপবান, রহিম বাদশাহ, মালকা বানু, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কমলা রানীর বনবাস, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি পালা বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর অনেক পালাকার ও যাত্রাদল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। পাকিস্তানি শাসকরা এ দেশের লোকজ সংস্কৃতিকে কখনও সু-নজরে দেখেনি। যাত্রাপালা ধর্মবিরোধী কাজ এমন ফতোয়াও জারি হয়েছে কখনও কখনও। অনেক গ্রামে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল নতুনভাবে গড়ে ওঠে। মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, সোজন বাদিয়ার ঘাট, লালন ফকির ইত্যাদি পালা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। অমলেন্দু বিশ্বাস, জ্যো¯œা বিশ্বাস, টাঙ্গাইলের ভবেশ চন্দ্র দাস, কোমল ঘোষ, শিক্ষক মতি লাল সাহাসহ অনেক যাত্রাশিল্পী ছিলেন নামকরা। সত্তর দশকের শেষভাগ এবং বিশেষ করে আশির দশকে যাত্রাশিল্পে অবক্ষয় শুরু হয়। তখন যাত্রার নামে অশ্লীল নৃত্য পরিবেশিত হতে থাকে। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এই শিল্প ধ্বংসের মুখোমুখি হয় যাত্রার আসরে জুয়া ও অশালীন নাচের কারণে। যাত্রার আসরে সখী নৃত্য একসময় প্রচলিত ছিল যা কিছুটা অসংস্কৃত হলেও তাকে ঠিক অশালীন বলা যেত না। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রামগঞ্জে পর্নোগ্রাফির প্রভাবে প্রিন্সেসের নাচের নামে যাত্রার আসরে অশালীনতা ছড়িয়ে পড়ে। পরে যাত্রার প্রিন্সেস, সখীনৃত্য ইত্যাদির নামে চলে অশালীন নৃত্য।

তথ্যসুত্র: দৈনিক খবরের আলো

যাত্রাপালার আসর- চতুর্থ পর্ব

যাত্রাপালার আসর- চতুর্থ পর্ব
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নিজস্ব প্রতিনিধি, মেদিনীপুরঃ রাজ্যের অন্যান্য অংশের মতোই জঙ্গলমহল থেকেও উঠে যেতে বসেছে বাংলা সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্যশালী যাত্রাপালার অনুষ্ঠানl
কলকাতার নামিদামী অপেরা গুলির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে দুর্গাপূজা কমিটিগুলি নিজস্ব উদ্যোগে এতদিন গ্রামীণ শিল্পীদের নিয়ে যাত্রাপালা করতl কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে তা আর চোখেই পড়ছে নাl জঙ্গলমহলের নয়াগ্রাম, গোপীবল্লভপুর, ঝাড়গ্রাম জামবনি, বেলপাহাড়ি, শিলদা, বিনপুর, লালগড়, রাইপুর, ফুলকুসমা, সারেঙ্গা, বান্দোয়ান, ঝিলিমিলি, ও খাতড়া এলাকায় এক দশক আগেও গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালার আসর বসতl

ঝাড়গ্রামের শিলদা এলাকার প্রবীণ যাত্রা অভিনেতা বরেণ হাজরা বলেন, এই প্রজন্মের যুবকেরা বিমুখ হওয়ায় যাত্রা আমোদী মানুষের সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। মানুষ ক্রমশ ব্যান্ড অর্কেস্ট্রা ও ডিজের মত চটুল সংস্কৃতিতে মজেছেl ফলে যাত্রা, নাটক, ছৌ ও পাইক নাচের মতো বাংলার ঐতিহ্যশীল সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে শিবরাত্রির সলতের মতো টিম টিম করে জ্বলছেl

তথ্যসুত্র: কোলকাতা টাইমস 24

যাত্রাপালার আসর- তৃতীয় পর্ব

যাত্রাপালার আসর- তৃতীয় পর্ব
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

স্টাফ রিপোর্টারঃ ‘যাত্রা’ এই শব্দটির সাথে বাঙালির দীর্ঘকাল ব্যাপ্ত শিকড় বিস্তারী সংস্কৃতির আনন্দ-বেদনার সম্পর্ক রয়েছে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শিল্প-ভাবনার পথ-পরিক্রমায় অযুত চিত্রকল্প হয়ে আজও টিকে আছে যাত্রা। বাঙালির বিনোদনের একটি প্রধান অনুষঙ্গ ছিল যাত্রাপালা। যাত্রাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে- পৌরাণিক, ইতিহাস ও সামাজিক। এর মধ্য দিয়ে শুধু বিনোদন নয় পুরাণ, ইতিহাস, লোকজ সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষাগ্রহণ চলত। এখন সিনেমা, টেলিভিশনের কল্যাণে বিনোদনের রূপ পাল্টেছে। কিন্তু যাত্রার আবেদন গ্রামের মানুষের কাছে এখনও রয়েছে। রাতের পর রাত জেগে যাত্রার কাহিনী, অভিনয়, গানের মাধ্যমে লোকজ নীতিবোধ, শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে শিক্ষা নেয় দর্শকরা। যাত্রা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান সম্পদ। রাতের পর রাত জেগে বাংলার সাধারণ মানুষ কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে দেখেছে যাত্রায় কাহিনী আর মেতেছে পালাগানের সুরে। কখনও ভক্তি, কখনও ভালোবাসা, কখনও দেশপ্রেম তাকে কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে। আবার সামন্ত রাজা, জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির মানুষও যাত্রা দেখেছে। জমিদার বাবু তো আর সাধারণ প্রজার সাথে যাত্রার আসরে গিয়ে বসবেন না। বরং তার প্রাসাদের নাটম-পেই বসবে যাত্রার আসর। জমিদার বাড়িতে থাকত বিশাল নাটম (নাটমঞ্চ)। সেখানেই যাত্রা, পালাগান, কীর্তনের আসর বসতো। চিক বা পর্দাঘেরা বারান্দায় বসতেন জমিদার গৃহিণী, রানিমা, পরিবারের নারী সদস্যরা। তারা চিকের আড়াল থেকেই দেখতেন যাত্রাপালা। একসময় নারায়ণগঞ্জের লক্ষীনারায়ণ কটন মিলসে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে সপ্তাহব্যাপী কলকাতার শিল্পীদের দিয়ে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হতো। আজ যাত্রাশিল্পীদের বড়ই দুর্দিন। যাত্রাশিল্পীদের সুদিন আসবে কবে?

যাত্রাপালার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। অষ্টম ও নবম শতকেও এ দেশে পালাগান ও পালার অভিনয় প্রচলিত ছিল। শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, প্রুন্ড, চন্দ্রদ্বীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখ-ে পালাগান ও কাহিনী কাব্যের অভিনয় প্রচলিত ছিল। ধর্মীয় বা কোনো উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি সেখান থেকেই যাত্রা শব্দটি এসেছে। এদেশে শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টযাত্রা, সীতার বারোমাসী, রাধার বারোমাসী প্রচলিত ছিল। সে সময় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী অভিনয় করে দেখানো হতো। সেখান থেকেই যাত্রার উৎপত্তি। নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পর কৃষ্ণযাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। কৃষ্ণযাত্রায় মূলত রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, কৃষ্ণের বাল্যকাল, মা যশোদার সঙ্গে কৃষ্ণের বাল্যক্রীড়া, কৃষ্ণের কংসবধ, মথুরা জয় ইত্যাদি কাহিনী অভিনয় ও গানের মাধ্যমে দর্শকদের পরিবেশন করা হতো। দর্শকরা তা দেখে ভক্তিরসে সিক্ত হতেন। রুক্ষিণী হরণ নামে একটি কৃষ্ণযাত্রায় চৈতন্যদেব নিজেই অভিনয় করতেন। তিনি রুক্ষিণী সাজতেন।

অষ্টাদশ শতকে (১৭০০ সাল) যাত্রা বাংলা ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারী, সুবল দাস ছিলেন যাত্রার জগতে প্রসিদ্ধ। ঊনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক যাত্রা খুব জনপ্রিয়তা পায়। মতিলাল রায় ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল প্রসিদ্ধি পায়। সে সময় কৃষ্ণলীলা এবং রামায়ণ-মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি বিদ্যাসুন্দর, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, বেহুলা লখিন্দর, মা মনসা, লক্ষ্মীর মহিমা, কমলাবতী রানী ইত্যাদি প্রেমকাহিনী ও লোকজ কাহিনীর অভিনয়ও প্রচলিত ছিল।
তথ্যসুত্র: দৈনিক খবরের আলো

যাত্রাপালার আসর- দ্বিতীয় পর্ব

যাত্রাপালার আসর- দ্বিতীয় পর্ব
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

দ্য ওয়াল ব্যুরো, পূর্ব বর্ধমান: রাজনীতির মঞ্চ মাতাতে বরাবরই সিদ্ধহস্ত তিনি। এ বার যাত্রাশিল্পকে অক্সিজেন জোগাতে আসরে নামলেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিলেন দর্শকদের। কালীপুজো উপলক্ষে যাত্রার আসর বসেছিল পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুরে। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’ যাত্রাপালায় শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন স্বপনবাবু। গঙ্গার ভূমিকায় বিশিষ্ট অভিনেত্রী রুমা চক্রবর্তী।

থেকেই যাত্রাপ্রেমী স্বপনবাবু। আগে নিয়মিত অভিনয়ও করতেন। কিন্তু ইদানিং একে দায়িত্ব, তায় স্বাস্থ্য, এই দুইয়ের চাপে অভিনয় করা বড় একটা আর হয়ে ওঠে না। বছর দুয়েক আগে বর্ধমান উত্সষবেও মঞ্চ মাতিয়েছেন তিনি। এ বার অনেকদিন পরে আবার পালার টানে মঞ্চে উঠেছেন তিনি। তবে সামাজিক পালা নয়, স্বপনবাবুকে টানে পৌরাণিক পালাই। জানালেন, যাত্রাপালা নিয়ে গ্রামগঞ্জের মানুষের একটা আলাদা টান রয়েছে । কিন্তু নানা কারণে এখন গ্রামীণ এলাকায় যাত্রা পালা আর সে ভাবে হতে দেখা যায় না । প্রায় ষোলো বছর হল শ্রীরামপুরে কোনও যাত্রাপালাই হয়নি। তাই যাত্রাশিল্পকে নতুন করে চাঙ্গা করতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ”মুখ্যমন্ত্রী যাত্রাশিল্পকে চাঙ্গা করতে অনেক পরিকল্পনা নিয়েছেন। একে আঁকড়ে জীবিকা নির্বাহ করেন বহু শিল্পী ও কলাকুশলী। সরকারের উদ্যোগে যাত্রা শিল্পের সুদিন যে ফিরছে তার প্রমাণ করছে দর্শকের উপচে পড়া ভিড়।”

এক সময়ে গ্রামে কোনও অনুষ্ঠান মানেই বসতো যাত্রাপালার আসর। দুর্গাপুজো থেকে লক্ষীপুজো কিংবা কালীপুজোয় যাত্রা শিল্পীদের নাওয়া খাওয়ার সময় থাকতো না। সে সব এখন ইতিহাস। বদলে গেছে মানুষের রুচি। তারসঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে গত এক দশকে ছোট বড় বহু অপেরা দলের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। কাজ হারিয়েছেন শিল্পীরা। অনেকে পেটের টানে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাই গ্রাম বাংলার মানুষের একসময়ের খুব কাছের এই শিল্প এখন ধুঁকছে। বায়না নেই, কাজ নেই। চলছে চরম সংকট। মন্ত্রী অবশ্য এ বার অভিনয় করছেন চিত্পুারের শ্রীচৈতন্য অপেরায়। তাঁদেরই পালা ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’। একেধারে রাজ্যের মন্ত্রী। হাতে অনেকগুলি দফতরের দায়িত্ব। আবার জেলায় দলের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। এত সবের পরও যাত্রাপ্রেমিক পূর্ব বর্ধমান জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি স্বপন দেবনাথ। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি সুদিন ফেরানো যায় যাত্রার। সখের যাত্রা আসরেও তাঁর পেশাদারিত্বে মুগ্ধ দর্শকরা। সে তালিকায় নাম রয়েছে জেলা পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখার্জীরও।

তথ্যসুত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

যাত্রাপালার আসর- প্রথম পর্ব

যাত্রাপালার আসর- প্রথম পর্ব
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নামটা কি চেনা চেনা। হয়তো বা। কেন না এই রকম চণ্ডী তলা দিয়ে নাম তো আর ও আছে কি না। যাইহোক এই চণ্ডী তলা বসুধা মৌজা য় ; থানা- কাঁকসা ; প: বর্ধমান। এখানে দেবী চণ্ডী – রূপাইচণ্ডী। তন্ত্রমতে তাঁর পূজা। নিত্যপূজা ছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তি তে তাঁর বার্ষিকী বিশেষ পূজা অনুষ্ঠান।

বৈশাখের ৩ তারিখ থেকে কলকাতার যাত্রাদল এর পালাগান। এলাকার মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন। এই যাত্রা দেখার জন্যে।চারদিক থেকে মানুষজন ছুটে আসেন।কমপক্ষে দু তিন হাজার মানুষ। চারদিকে মানুষ আর মানুষ।রূপাই দহের পাড়ে ; ঝোপের ধারে।এমন কি গাছের উপরে ও। তখন তো ঘন জংগল। বড় বড় অর্জুনগাছ। পলাশের ঝোপ।আরো কত গাছপালা। এই এখানের যাত্রা পালাগানের আসর বসছে- সে তো অনেকদিন থেকে ই।

প্রায় একশ বছর হতে চলল। কে না এসেছেন এখানে? নামী কোন না দল। প্রায় সবাই। রথী – মহারথী সব যাত্রা অভিনেতা অভিনেত্রী রা। কত বড় বড় সব নাম।ছোট ফণী ; বড় ভোলা; ছোট ভোলা; পান্না চক্রবর্তী ; গুরুপদ ঘোষ; দ্বিজু ভাওয়াল;শেখর গাঙ্গুলী; জ্যোৎস্না দত্ত; গুরুদাস ধাড়া; রাখাল সিংহ;নির্মল মুখার্জী ইত্যাদি ইত্যাদি সব নাম।

পৌরাণিক পালা ই বেশী হত। পরে এল সামাজিক পালাগান।ঐতিহাসিক পালা ও হয়েছে অনেক।
প্রাচীন তম সত্যম্বর অপেরা র বাঁধা আসর। অত মানুষ। পেট্রোম্যাক্স; হ্যাজাক এর আলো।তখন মাইক নাই। খোলা গলা য় গান। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ এর মতো শুনেছে- দেখেছে।। রাত এগারো টায় শুরু হয়ে সেই ভোর রাত। সারা রাতের আনন্দ অনুষ্ঠান। এলাকার এই ঐতিহ্য এখন ও বেঁচে আছে।
তবে সেই যাত্রা আর নেই।সব দিক দিয়েই তার মান নেমে গেছে।

পৌরাণিক যাত্রাপালা- রাজা হরিশ্চন্দ্র।
তথ্যসংগ্রহ, সম্পাদনার কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পৌরাণিক যাত্রাপালা রাজা হরিশচন্দ্র এর কাহিনী দর্শকদের মন কাড়ে। অযোধ্যার রাজা হরিশ্চন্দ্র সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। তপোবনে ঋষি বিশ্বামিত্রের ত্রিবিদ্যাযজ্ঞে বিঘ্ন ঘটানোর দায়ে রাজা হরিশচন্দ্রকে ক্ষতিপূরণবাবদ বিশ্বামিত্রকে রাজ্য দান করতে হয়। স্ত্রী শৈব্যা পুত্র রোহিতাশ্বকে নিয়ে একবস্ত্রে রাজ্য ছেড়ে কাশীবাসী হন। এরপর ঋষি বিশ্বামিত্র দানের দক্ষিণা চাইলে রাজা তাঁর স্ত্রীকে সাধারণ ব্রাহ্মণের কাছে এবং নিজেকে চণ্ডালের নিকট বিক্রি করে ঋষির ঋণ পরিশোধ করেন। ওই ব্রাহ্মণের গৃহে রাণী শৈব্যা ও পুত্র রোহিত লাঞ্জনা-গঞ্জনা সহ্য করে জীবন ধারণ করতে থাকে। একদা রাজকুমার রোহিত সাপের দংশনে প্রাণ হারায়। মৃত পুত্রকে নিয়ে রাণী শৈব্যা চণ্ডালের কাজ করা রাজা হরিশ্চন্দ্রের শ্মশানে নিয়ে যান। সেখানে পুত্রকে চিতায় তুলতেই ঋষি বিশ্বামিত্র হাজির হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে ঋষিত্ববলে মৃত রোহিতের জীবনদান করেন এবং হরিশ্চন্দ্রকে রাজ্যপাট বুঝিয়ে দেন। দানের মহিমায় উদ্ভাসিত হরিশ্চন্দ্র পুনরায় রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন।