এ্যারিস্টটলের মতে মানুষ কোনো পাপ কাজ করতে পারে না, সে যাই করে তার নিজের জন্যই করে। তখনকার গ্রীক দার্শনিকরা পাপকে আক্রাশিয়া নাম দিয়েছিলেন। প্লেটো এ্যারিস্ট টল যতই পাপের অস্তিত্ব অস্বীকার করুক না কেন, আকিনাস, দেকার্ত সবাই এই আক্রাশিয়ার অস্তিত্বের ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেন। কেউ কেউ নিজের বিবেকের বিপরীতে কিছু করাকেই পাপ বলতেন, কেউ কেউ খোদ বিবেকের উৎস এবং তার পঠন পাঠন নিয়েই প্রশ্ন তুলতেন।
তখন আমাদের ভার্সিটির গেটের সামনে বাঁচা বাবা নামের একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। রান্নায় তেমন বাহারী স্বাদ না থাকলেও হলের একই রকম খাবার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমাদের একমাত্র উপায় ছিলো এই রেস্টুরেন্ট টি। কারো জন্মদিন, বা কোনো বান্ধবী প্রপোজ করেছে অথবা সেমিস্টার ফাইনালে টপ করলেই চল বাঁচা বাবা। পাশ করে বের হয়ে জবে ঢুকলাম, ওর বেশ কয়েকবছর পর কনভোকেশনের ডাক পেলাম। তখনও গিয়ে দেখলাম দিব্যি গম গম করছে বাঁচা বাবা। কনভোকেশনের বিশাল ভূড়িভোজের পরেও বাঁচা বাবাতে বসে চা বা পরোটার সাথে এক বাটি সব্জি এখনো স্মৃতির মানসপটে। যেসব ৯-১০ বছরের ছেলেগুলো কাজ করতো তারা তখন জোয়ান। আর যারা যুবক ছিলো, অনেকেই বিয়ে শাদী করেছে, রেস্টুরেন্টের পাশেই একটা ঘর করে সংসার জাকিয়ে বসেছে। ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে যখন দেশ জুড়ে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের আয়োজন চলছিলো, সেসময় রাঙ্গুনিয়ার সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্ট টির ওপর বুলডোজার পড়ে। এরপর সেখানে রেস্টুরেন্ট টি দাড়াতে পারেনি। জানি না যারা ওই প্রতিষ্ঠান ঘিরে নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলো, তারা এখন কেমন আছে।
তখন পুরো ঢাকা শহর ঘুরে বুঝলাম, হঠাৎ করে দুর্নীতি যদি বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে প্রায় কয়েক কোটি সংগ্রামী মানুষ পথে বসে যাবে। যদিও একসময় মানুষ ঠিকই মানিয়ে নেয়, কিন্তু মানুষ না খেয়ে বেচে থাকতে পারে মাত্র তিনদিন। আর একটা ঘুনে ধরা সিস্টেম ঠিক হতে লাগে বছরের পর বছর। তখন আরো একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেলো পাপ আসলে কি জিনিস? আসলেই কি এর অস্তিত্ব আছে?
এই যে এতগুলো সংগ্রামী মানুষ, তারা চুরি করছে না, হত্যা রাহাজানী ডাকাতি করছে না। তারা খুব সাধারন ভাবেই ব্যাবসা করছে সিস্টেমের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। কারন এটা তাদের জন্য সস্তা এবং তার চেয়ে বড় কথা সাধ্যের নাগালে। রাস্ট্র পারেনি বলেই তারা বেচে থাকার এরকম সৎ পথ বেছে নিয়েছে। এটা কিভাবে পাপ হতে পারে?
তাহলে পাপ বলে কি কিছু নেই? সেটা কিভাবে হয়? হত্যা খুন ধর্ষন এগুলো পাপ, তাই না?
মধ্যযুগের লেখক অগাস্টিনের মতে আমরা পাপ করি যখন কোনো কিছু করার সদিচ্ছা যদি দুর্বল হয়। প্রায় সমসাময়িক একিউনাস বিশ্বাস করতেন আমরা পাপ করতে পারি কারন আমাদের ইচ্ছাগুলো কল্পনা রং এ মেশাতে পারি এবং তাকে যুক্তি সংগত করতে পারি যাতে করে আমাদের মনে হয় এটাই ছিলো সর্বোত্তম যার ফলে নিজেকে বোঝাতে পারি যে আমি এটাই করতে চাই।
তার মানে পুরো ব্যাপারটাই নিজের স্বার্থে ভাবা বা নিজের জন্য করা। যখন মানুষ অপরের জন্য না ভেবে নিজের স্বার্থে কিছু করে তাহলেই কি পাপ হবে?মনে হয় না, যখন কারো কোনো ক্ষতি করে বা কোনো কিছু ক্ষতি হয় তাহলেই পাপ বলে ধরে নেয়া যায়, তাই না? কিন্তু যদি এমন হয় যে পরের ভালো করতে গিয়ে নিজের ক্ষতি হয় তাহলে সেটাই বা কেমন বুদ্ধিমানের কথা?
তখন প্রশ্ন আসতে পারে কোনো কিছু বিচার করার অধিকারটা কার আছে? ঈশ্বর?
সেক্ষেত্রে পাপ ব্যাপারটাকে দুভাগে ভাগ করা যেতে পারে। নৈতিক মূল্যবোধ যেটা কিনা মানুষ সম্পূর্ন স্বাধিনভাবে বিচার করতে পারে এবং যার ফল সবার জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে, যদি তা নাও হয়, তাহলে ক্ষতি করবে না। একে নৈতিক পাপাচার বা দর্শনগত পাপ। ধর্মীয় পাপের ব্যাপারটা পুরোপুরি ঈশ্বর বা তার প্রদত্ত পথপ্রদর্শক বা ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে নৈতিক পাপাচারের অনেক কিছু ধর্মীয় পাপাচারের লিস্টে থাকে না। এই যেমন দাসপ্রথা, শিশুকাম, বাল্যবিবাহ, লুট, ধর্মের নামে হত্যা ইত্যাদি।
ব্যাক্তিগতভাবে পাপের কনসেপ্টটা একটা হাস্যকর কৌতুক মনে হয়। একটা শিশুর সামনে আপনি দুটো মুস্টিবদ্ধ হাত ধরলে তাকে কিছু বলার আগেই সে একটা হাত বেছে নিয়ে তা খোলার চেস্টা করবে। সেটাতে কিছু না থাকলে আরেকটা হাত ধরে বসবে। আপনি যদি আবার আগের হাতটি মুস্টিবদ্ধ করেন সে আবার ওটা ধরবে। তখন তার কাছে ব্যাপারটা অভ্যাসগত খেলায় পরিনত হয়। যতক্ষন না টডলার পরিপক্ক হবে তার সামনে প্রতিদিন এই মুস্টিবদ্ধ হাত ধরুন, সে আনন্দের সাথেই খেলবে।
বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মানুষ এমনই। মানুষ এত বিশ্বাসী কেন এটা ভাবতে গিয়ে দেখলাম দর্শনের চাইতে এর সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারে নিউরোসায়েন্স বা এনাটমি। মানুষের মাথার ডানে ভেন্ট্রোলেটারাল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স অংশটির জন্য মানুষ বিশ্বাসী হয়। তাহলে ধর্মের উৎপত্তী এত পড়ে আসলো কেন? এর প্রধান কারন যখন নিয়েনডার্থালরা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াতো অর্থাৎ মানুষের বিবর্তন শুরু হয়নি, তখন তারা ছিলো বেশ ক্ষিপ্র এবং পঞ্চইন্দ্রিয় সমূহ খুব শক্তিশালী কারন তাদের মস্তিস্কের এই অংশগুলো বেশ বড় ছিলো। তারা খুব শিকারী ছিলো, এবং মাথার পেছনের দিকটা অপেক্ষাকৃত বড় হওয়ায় তারা বুদ্ধিমান ছিলো। তাদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এতটা উন্নত না থাকায় তারা মৃত সৎকারের আচারেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ঈশ্বরের কনসেপ্ট তাদের মধ্যে আসেনি। মানুষের ঐশ্বরিক ধারনা অনেক পরে আসে যখন নিয়েনডার্থালরা বিলুপ্ত হতে থাকে এবং মানুষ সমাজবদ্ধ হতে থাকে। সমৃদ্ধির ফলে তখন মৃত ব্যাক্তির সৎকারের সাথে সাথে আত্মা, মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
আর ঠিক এমসয়টাতেই প্রচলন হয় সভ্যতার কুৎসিত দাসপ্রথা। বলা হয়ে থাকে বর্নবাদ, জাতিগত বিদ্বেষ থেকে শুরু করে হানিকারক বিষয় সমূহের উৎপত্তি ঠিক এখান থেকেই।
চলবে….
শিরোনামে ক্রমিক সংখ্যা বসে আছে। তার মানে চূড়ান্ত করে কিছু বলা সঠিক হবে না। তবে প্রথম পর্বের শেষাংশ কিন্তু যুক্তির কাছাকাছি চলে এসেছে। শুভেচ্ছা মি.স্বপ্ন।
আপনি কেমন আছেন? মাঝে দেখেছিলাম আপনি হাসপাতালে। তখন আমি নিজেই শোকে পাথর ছিলাম। এখন কেমন অনুভব করছেন? নিজের দিকে যত্ন নেবেন প্লিজ
পাপ আসলে কি জিনিস? আসলেই কি এর অস্তিত্ব আছে? আপনার নিবন্ধে জানার চেষ্টা করবো। ভালো আলোচনা।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। আসলে মনটাকে একটু অন্যদিকে নেবার জন্য আবারও পড়ালেখা শুরু করলাম দীর্ঘ বিরতি নিয়ে। কেন যেন দর্শন পড়তে ভালো লাগছে যদিও এটা কখনোই আমার প্রিয় কোনো বিষয় ছিলো না
আপনার উপস্থাপনের উপর ভরসা আছে। মনযোগ দিয়ে পড়লাম। চলুক।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য
পড়লাম দাদা।
কেমন আছেন? নতুন বছরের শুভেচ্ছা অগ্রিম
চলুক ভাইজান। জানতে চাই।
অসংখ্য ধন্যবাদ মন্তব্য দিয়ে উৎসাহ দেবার জন্য