পালাকীর্তন ও বাউল গান চতুর্থ অধ্যায়

পালাকীর্তন ও বাউল গান চতুর্থ অধ্যায়

বকাসুর বধ (কৌমরা লীলা): একদিন রাম ও কৃষ্ণ প্রাতরাশ সাথে নিয়ে গোপবালকসহ বৎসসকলকে জল পান করানোর জন্য জলাশয়ের নিকট গেল; বৎসদের জল পান করিয়ে নিজেরাও জল পান করল। তখন হঠাৎ গোপবালকগণ অদূরেই একটি পবতসম পাখি দেখতে পেল। পাখিটি আকারে প্রকান্ড ছিল। তার ঠোট ছিল তীক্ষ্ণ। পাখিটি দেখে বালকগণ ভয় পেল। সেটি পাখি নয় পাখিরুপধারী একটি মহাসুর যার নাম বকাসুর। সে অসুর কৃষ্ণকে দেখামাত্রই দ্রুত বেগে এসে তাকে গিলে ফেলল। গোপবালকগণ এ দৃশ্যে দেখে অচেতন হলো। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বকের মুখে মধ্যে অবস্থিত হয়ে অগ্নির ন্যায় বকের তালুমুল দগ্ধ করতে লাগল। তৎক্ষণাৎ তাকে বমন করে ফেলল। তারপর কৃষ্ণকে অবিক্ষত দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ঠোট দ্বারা আঘাত করার জন্য পুনরায় অক্রমন করল। তারপর শ্রীকৃষ্ণ দুই বাহু দ্বারা ঠোটদ্বয় ধারণ করে বালকগণের সম্মুখে ধীরণবৎ (তৃণের ন্যায়) বিদারণ করে ফেলল। সে সময়ে সুরলোকবাসী সমুদ্বয় লোক, নন্দন-কাননের মল্লিকাদি পুষ্পসকল বকশত্রু শ্রীকৃষ্ণের উপর বষণ করতে লাগল এবং শঙ্খ ও দুন্দভি ধ্বনি ও বিবিধ স্তোত্র দ্বারা স্তব করতে দেখে গোপবালকগণ যার-পর-নাই বিস্মিত হলেন।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বকাসুরের মুখ হতে বের হয়ে আসতে দেখে গোপবালকগণ খুশীতে আলিঙ্গন করল। ব্রজে আগমন করে গোপবালকগণ সকলকে এ ঘটনা বলল।

আজকের পালাকীর্তন শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা

পৌরানিক নাটক
বকাসুর বধ

নাট্যকারের নিবেদন

পৌরানিক কাহিনীর অবলম্বনে, দ্বাপর যুগের শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা এই লিখনীতে আংশিক তুলে ধরছি। শ্রীকৃষ্ণই যে পরমেশ্বর ভগবান তাঁর প্রমাণ শিশু বয়সের লীলা থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি জানতে পাচ্ছি যারা ধর্মে বিশ্বাসী, গীতায় বিশ্বাসী, ভাগবতে বিশ্বাসী তাঁরা বিশ্বাস নাও করতে পারেন। তবে আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি আর বিশ্বাস করলেই তাঁর আশির্বাদ আছে বলেই লেখার প্রেরণা পাচ্ছি। আমার এই লেখাটি যদি পাঠকদের বিন্দুমাত্র ভালো লাগে তাহলেই আমার লেখা সার্থক হবে। আত্মহংকার মানুষের অধঃপতনের মূল। কংসরাজ তাঁর অহংকারের দম্ভের কারণে কেমন পরিণতি হয়েছিল তাঁরই অংশবিশেষ এই লেখাটাতে দেখতে পাবেন।

কুশী-লবগণ

লক্ষ্মী ও নারায়ণ (দেব-দেবী)
কংস- মথুরার রাজা
বকাসুর- (বকরূপী অসুর)
কৃষ্ণ- (নন্দকুমার)
বলাই, গোপাল, বলরাম ও রাখালগণ
শ্রীদাম, সুদাম বালকগণ
নন্দরাজ ও যশোদা
তত্সহ যশোমতী, রোহিনী ও অন্যান্য গোপবালাগণ।

(প্রথম দৃশ্য)

কংস : মথুয়ায় কেউ কি নেই যে নন্দ পুত্র কৃষ্ণকে বধ করতে পারে?
বকাসুর : কংসায়ে নমোঃ কে বলছে কেউ নেই নন্দপুত্র কৃষ্ণকে বধ করতে পারবে না।
মহারাজ, আমি তো আছি।
কংস : কে বললে এ কথা সামনে এসো?
প্রাপ্তি : (কংসের ছোট পত্নী) সে কি মহারাজ! এ যে পুতনা। মথুরা জোড়ে রটে গেছে পুতনাকে নন্দপুত্র কৃষ্ণ বধ করেছে। কিন্তু আপনার সামনে জলজন্তু দন্ডায়মান এ যে শুধু ছলনা মাত্র।
কংস : তোর এত বড় স্পর্ধা আমার সম্মুখে এসে কথা বলছিস।
বকাসুর : হে মহারাজ! আমি পুতনা নই আমি বকাসুর।
কংস : তবে তুমি তোমার রূপ ধারণ করো।
বকাসুর : হে মহারাজ! আমি পুতনা নই আমি বকাসুর।
কংস : তবে তুমি তোমার রূপ ধারণ করো।
বকাসুর : হে মহারাজ! আপনার শত্রু যে সেতো আমারও শত্রু আমার বোন পুতনাকে বধ করেছে, ভাই বৎসাসুরকে বধ করেছে আমি আমার শত্রুকে বধ করতে পিছপা হব না।
কংসা পরীক্ষা করতে অগ্নি নিক্ষেপ করলে বকাসুর তাঁর নিজ রূপ ধারণ করে।
কংস : অগ্নি নির্বাপিত করলেন।
কংস : হে বকাসুর কি করে কেমনভাবে নন্দপুত্র কৃষ্ণকে বধ করবে? তাঁর একটি প্রমাণ দাও।

তখন বকাসুর তাঁর বিরাট টেঠি প্রসারিত করে রসিকাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে তাঁর উদরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল।
রসিকা : সে কি বকাসুর! আমি তো কোনো দোষ করিনি। তবে কেন আমাকে গিলতে চাচ্ছ। তাঁরপর
{রসিকাকে বকাসুর ছেড়ে দেয়}

কংস : বা বকাসুর বা তুমি পারবে আমার শত্রুকে বধ করতে কিন্তু তোমার যে, অগ্নিতে ভয় আছে, যদি পাছে কৃষ্ণ জানতে পারে?
প্রাপ্তি : মহারাজ এটা অসম্ভব! শিশু বালক সে কি করে জানবে। বকাসুরের অগ্নিতে ভয় আছে?
কংস : না প্রাপ্তি তুমি যতোই সামান্য ভেবে কথাটা বলছ তা কিন্তু মোটেও সামান্য নয়। তুমি দেখতে পাচ্ছ না একে একে কেমন করে সবাইকে বধ করছে কৃষ্ণ।
বকাসুর : মহারাজ সেটা নিয়ে আপনি কেন বিচলিত হচ্ছেন? আমাকে অনুমতি দিন। আমার অন্তরেও দাবানল জ্বলছে।
কংস : যাও বকাসুর সফল হয়ে ফিরে এসো।

{বকাসুর তখন কংসকে প্রণাম জানিয়ে আকাশ পথে যাত্রা করছে বিরাট দেহ ধারণ করে। বৃন্দাবনে এসে মনুষ্য দেহ ধারণ করে নন্দ মহারাজের বাড়ি এসে পৌঁছায়।}

(দ্বিতীয় দৃশ্য)

যশোমতী : তুলসি তলায় প্রদীপ দেখিয়ে আসি। সে কি! হঠাৎ করে ধমা বাতাস বইছে কেন? নাকি কোনো অশুভ লক্ষণ।
{বকাসুর আড়াল থেকে বলছে কৃষ্ণ কি, কোন ভাবে জেনে গেছে আমার আগুনে ভয় আছে। দ্যাৎ আমি কি অবান্তর কথা ভাবছি। ঐ ছোট একটি প্রদীপ শিখা এতো কিছুক্ষণ পরেই নিভে যাবে। ঐ ময়ূর পুচ্ছ শিশু বালক দেখতে পাচ্ছি তবে কি এই সেই কৃষ্ণ। বকাসুর হাসছে আর মনে মনে বলছে হে কৃষ্ণ তোমার মৃত্যু ঘণ্টা বাজছে তৈরি থেক। }

কৃষ্ণ : ঐ লোকটি আবার কে রে বাবা! দাঁত বের করে হাসছে।
যশোমতী : গোপাল বলরাম ঘরে চলে এসো উল্কা বাতাস বইছে চোখে ধুলো পরবে।
রোহিনী : যশোদা তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন কি হয়েছে গো?
যশোদা : রোহিনী দিদি মনটা বড় কুডাকছে গো দেখতে পাচ্ছেনা হঠাৎ করে ধমকা বাতাসে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।
রোহিনী : সবটাতেই তোমার বাড়াবাড়ি। বাতাস বইছে তো কি হয়েছে।
যশোমতী : রোহিনী দিদি ঐ তো একটা বিরাট ছায়া, তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? না জানি আবার আমার গোপালের কোন বিপদ অপেক্ষা করছে! কংসের কোন চর নয় তো?
রোহিনী : সড়ে চলো তো যশোদা, সবটাই তোমার মনের ভুল

(দৃশ্যান্তর)

{রাতে নন্দ যশোমতী গোপাল ও বলাইকে নিয়ে শুয়ে আছে এমন সময় যশোমতী স্বপ্নে দেখলেন তাঁর গোপালকে কে জানি গিলছে ফেলছে। হয়তো এটাই মায়ের মনে হওয়া স্বাভাবিক। কথায় বলে না কোনো বিপদ যখন সন্তানের হয় পাড়াপড়শি জানার আগে জানে তাঁর মায়। কিন্তু যশোমতী আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন নি। বাধ্য হয়ে নন্দরাজকে জাগাতে চাইছেন।}

যশোমতী : ওগো তুমি ওঠ, আমি এক বিভৎস স্বপ্ন দেখেছি!
নন্দরাজ : সারাক্ষণ গোপালকে নিয়ে চিন্তা করো তো তাই রাতে ও এমনটি দেখ। এখন রাত প্রায় ভোর হতে যাচ্ছে শুয়ে পড়। তাছাড়া তোমার গোপাল তো তোমার কাছেই শুয়ে আছে।

(তৃতীয় দৃশ্য)

{পরদিন সকালবেলা}

যশোমতি : রোহিণী দিদি ঐ আমি গোলালকে বেঁধেছি পাছে আবার ছেড়ে না দাও বলে রাখলাম।
রোহিনী : হাঁসালে যশোমতী।
গোপাল : মা, মাগো আমার যে বড় কষ্ট হচ্ছে মা! বাঁধা হাতে কি করে খাই বল?
যশোমতী : এটাই তোমার শাস্তি। ধর খেয়ে নাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি ননী।
কৃষ্ণ : জেঠাই মা, ছেড়ে দাও না গো তুমি তো আমায় খুব ভালোবাসো তাই না?
রোহিনী : আহা রে! বাচায় খুব কষ্ট হচ্ছে। যশোমতী ওকে ছেড়ে দাও না। তাছাড়া বলাই তো কানাই-এর সঙ্গেই থাকবে।
যশোমতী : আর শত বললেও ছাড়বো না। তুমিও কিন্তু ওর মিষ্টি কথায় ভুলে যেও না।
{যশোমতী চলে যাবার পর}
রোহিনী : নাও হাতের বাঁধন ছেড়ে দিলাম দু’ভাই আঙিনায় বসে খেলা করো। বলাই ভাইকে দেখে রেখ কিন্তু যেন কোথাও না যায়।
বলাই : আচ্ছা মা, ভাইকে দেখে রাখবো কোথাও যেতে দেবো না।

(চতুর্থ দৃশ্য)

শ্রীদাম সুদাম রালক গণ : ঐ কৃষ্ণ মাঠে খেলতে যাবি না?
কৃষ্ণ : যাব তো।
বলরাম : ঐ ভাই কি বলছিস! খুড়ি মা বকবে তো।
কৃষ্ণ : চল দাদা চল মাঠে না গেলে কি হয়!

{কৃষ্ণ বলরাম লুকিয়ে রাখাল বালকদের সঙ্গে মাঠে চলে গেল কিন্তু যশোমতী জানতেই পারলেন না।}
মাঠে রাখালগণের সঙ্গে যখন কৃষ্ণ খেলায় মগ্ন সেই সময় বকাসুর নিচে নেমে এলো দুই ঠোঁট প্রসারিত করে। ভয়ে বালকগণ তটস্থ। কিন্তু কৃষ্ণ বকাসুরের কাছে এগিয়ে গেল)

রাখালগণ: যাসনে কানু ও তোঁকে গিলে ফেলবে দ্যাৎ দ্যাৎ কানু এগিয়ে যাচ্ছে চল আমরা সবাই মিলে নন্দ বাবা ও নন্দ মাকে গিয়ে বলি।

{সবাই চলে গেল কিন্তু বলাই ভাইকে ছেড়ে যেতে পারল না সেও রয়ে গেল ভাইয়ের কাছে}

বলাই : যাস নে ভাই চলে আয় এযে ভয়ংকর প্রাণী আমরাও বাড়ি চলে যাই।
কৃষ্ণ: ভয় পাস নে দাদা ও আমাকে কিছু করতে পারবে না।
বলরাম : যা বাবা তোর একটুও ভয় নেই আমার যে ভয়ে শরীর কাঁপছে।

(কৃষ্ণ হেটে হেটে যাচ্ছিল আর বক তাঁর বিশাল ঠোট দিয়ে গিলে ফেলল)

(দৃশ্যান্তর)

এদিকে লক্ষ্মী নারায়ণ বৈকুণ্ঠ থেকে সব দেখছেন। কিন্তু লক্ষ্মীর মলিন বদন দেখে নারায়ণ স্মিত হাসছেন।

নারায়ণ : দেবী কমলা তোমাকে এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন?
লক্ষ্মী : হে প্রভু! শিশু কৃষ্ণকে বকাসুর গিলে ফেলছে আর আপনি দাড়িয়ে দাড়িয়ে তামাশা দেখছেন, আর হাসছেন।
তবে কি কৃষ্ণ আপনা থেকে ভিন্ন।
নারায়ণ : হে কমলা দেখই না শিশু বালক কৃষ্ণ কি করতে পারে।
লক্ষ্মী : হে প্রভু! আপনার লীলা বোঝা বড় ভার।

(বকাসুর আকাশ পথে ঘুরছে আর শিশু কৃষ্ণ দিব্য তাঁর উদরে বসে এসে ভাবছেন কি করে কেমন করে বের হতে পারেন। এদিকে বকাসুরেরও উদরে উপদ্রব দেখা দিল পরক্ষণেই ভূমিতে লুঠিয়ে পড়ে বকাসুর তখন শিশু কৃষ্ণ তাঁর কোমল হস্তে বকাসুরের দুই ঠোঁটে ধরে ছিড়ে ফেললেন)

(পঞ্চম দৃশ্য)

বলাই : ভাই তুই কেমন করে এত বড় পাখিটার ঠোঁট ছিড়লেরে?
বালকগণ: নন্দ বাবা, নন্দ মা তোমরা দেখবে চল বিশাল বড় পাখি। কৃষ্ণকে এতো করে বললাম সরে আয় কিন্তু সে আসে নি আরও বলে সে নাকি ভয় পায় না, তাঁকে নাকি কিছু করতে পারবে না।
যশোমতী : হায় বিষ্ণু! সেখানে কৃষ্ণের যে কি হচ্ছে একমাত্র তুমিই জানো।
নন্দরাজ : যশোদা কেঁদ না শীঘ্রই সবাই মিলে চল যমুনার তীরে।
উপানন্দ : চল নন্দ চল হয়তো কংসের কোন চর হবে। হে শ্রী বিষ্ণু তুমি রক্ষা করো আমার কৃষ্ণকে।
নন্দরাজ : শ্রীধাম সুদাম এবার বলতো কৃষ্ণ বলরাম কোথায় আছে।
রাখালগণ : ঐ দিক টায়।
সানন্দ : সবাই ওদের কথামতো ঐ দিকেই চল।
যশোমতি : গোপাল ও গোপাল কোথায় বাঁছা আমার।
রোহিনী! যশোদা ঐ তো কৃষ্ণ বলরাম দাড়িয়ে আছে। বলাই ও বলাই ঐ পাখিটা কি করে বধ হলরে! তাছাড়া ঠোটগুলো ও ছিটিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে।
বলরাম : জানো মা, ভাই পাখিটাকে দুই ঠোঁটে ধরে বধ করেছে তাঁর কত শক্তি!
রোহিনী : কানাই তুই ঠায় দাঁড়িয়ে আছিস কোনো কথা বলছিস না যে।
কৃষ্ণ : কি কথা বলবো জেঠাই মা, ওর মৃত্যু যে আমার হাতে।

(সবাই মিলে কৃষ্ণের জয়ধ্বনি দিতে লাগলো সবাই বলাবলি করছে কৃষ্ণ কোন সামান্য শিশু বালক নয়! নন্দরাজ আপনি বিষ্ণু পূজার প্রস্তুত করুন তিনিই যে রক্ষাকর্তা।)

গীত: (সকলে)

এসো গিরি গোবর্ধনধারী!
নাশিতে রাক্ষসভার, রামরূপে অবতার,
ওগো প্রভু দানব সংহারী।।

নন্দমহারাজ : জয় শ্রী বিষ্ণুর জয়।

(সকলে একসাথে গেয়ে ওঠে)

গীত:

“ হে কৃষ্ণ কেশব মধুকৈটভ-ঘাতন।
জয় কেশিমর্দ্দন হে গজেন্দ্রমোক্ষণ।।
জয় পদ্মপলাশ-লোচন দৈত্য-অরি।
জয় গোপ-পালক হে গোবর্দ্ধনধারী।।
জয় মধুসূদন হে মুকুন্দ মুরারী।
জয় বনমালী ব্রহ্ম জয় বংশীধারী।।
জয় সৃষ্টি-পালক হে শ্রীবৎসলাঞ্ছন।
জয় জগন্নাথ জয়দীশ জনার্দ্দন।।
জয় কুঞ্জবিহারী হে গোলক-পালন।
জয় গোপীবল্লভ হে নন্দের নন্দন।।
জয় জয় ভগবান ভূভার-খন্ডক।
জয় কংসাসুর আদি দুষ্টের অন্তক।।
জয় জয় রমানাথ রক্ষ ভবদায়।
এই নিবেদন করি প্রভু রাঙ্গা পায়।। “

য ব নি কা

তথ্যসূত্রঃ সিলেটের ডাক

বাউল গানের শিল্পী পূর্ণদাস বাউলের একটি সাক্ষাত্কার

নবনী দাস বাউলকে খ্যাপা বাউল নামে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর থেকে তিনি নবনীদাস খ্যাপা বাউল বলেই পরিচিত হয়ে যান। তাঁর লেখা বহু গানের ভনিতাতেই দেখা যায় পদকর্তা হিসেবে ‘খ্যাপা বাউল’-এর নাম। একটার পর একটা আখড়া পাল্টেছেন নবনীদাস, বাউল গান সঙ্গী করে চষে বেড়িয়েছেন গাঁ-‌গঞ্জ। তার মধ্যে ছিল বোলপুর, শান্তিনিকেতনও।

নবনীদাসের পুত্র পূর্ণদাস বাউল ঘটনাক্রমে গাঁ-‌গঞ্জ, পথ-‌ঘাট, ট্রেনে-‌ট্রেনে গান গেয়ে মাধুকরী কিংবা ভিক্ষা করতে করতে একদিন এসে পৌঁছন কলকাতা শহরের দোরগড়ায়। বাউল গানে মন জয় করেন শহরবাসীরও। শতাধিক দেশে ঘুরেছেন বাউলগানকে সঙ্গী করে। মার্চ মাসে ৮৫ বছর পূর্ণ করা পূর্ণদাস বাউল এখন থাকেন দক্ষিণ কলকাতায়। দীর্ঘ বাউল-‌জীবনযাত্রার পরেও তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কেউ অভিযোগ করেন, বাউল গানকে তিনি ‘শহুরে’ করে তুলেছেন। সেই অভিযোগের উত্তর তাঁর কাছ থেকে শোনার আগে তাঁর পরিক্রমার কথা শুনতে আমরা প্রবীণ বাউল পূর্ণদাসের মুখোমুখি একটি সাক্ষাত্কার।

• আপনার গান শেখার শুরু কি আপনার বাবার কাছেই?

•• দেখো বাবা, বাউলের আখড়ায় আমার জন্ম। জন্ম থেকেই গান শুনছি। বাবা নবনীদাস খ্যাপা বাউলের আখড়া নানা সময় নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে। আমি জন্মেছিলাম তারাপীঠের কাছে বিষ্টুপুর বসোয়ার আখড়ায়। সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা। অনেক পরে হিসেব-‌টিসেব করে দেখা গেছে ১৯৩৩ সালের ১৮ মার্চ আমার জন্ম। তবে, জন্ম থেকে বাবার গান শুনলেও প্রথম তিনটে গান আমাকে শিখিয়েছিলেন আমার মা ব্রজবালা দাসী।

• মনে আছে গানগুলো?

•• সে গান কি ভোলবার? প্রথম গানটা ছিল ‘মেরো না মেরো না মাগো/‌ ধরি তোমার শ্রীচরণ/‌ মা মলে মা মেলে না মা, খুঁজিলে মা ত্রিভূবন’। বড় সত্যি কথাটা গানের ভেতর দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছিলেন মা।

• আর দুটো গান?

•• একটা হল—‘নিতাই আমার নাকের ব্যসর, গৌর গলার মালা’।

• ‘ব্যসর’টা কী?

•• নাকে ‘নথ’ পড়ে না? সেই নথ। তিন নম্বর গানটা ছিল ‘হরি বলো মন পাখি’। এই তিনটে গান শিখিয়ে মা আমাকে সুরের পথে ঠেলে দিয়েছিলেন।

• সব গানই তো হরি, গৌর, নিতাই সংক্রান্ত।

•• আমাদের তো বৈষ্ণবের বাড়ি। আমার দাদু অক্রূর গোঁসাই ছিলেন খুব বড় সাধক। আমরা নিত্যানন্দ গোঁসাইয়ের বংশধর।

• আপনার বাবা নবনীদাস বাউলকে তো রবীন্দ্রনাথ খুব ভালবাসতেন?

•• হ্যাঁ, খুব ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। বাবাকে রবি ঠাকুর বলতেন, খ্যাপা বাউল। সেজন্যে বাবার তৈরি করা বহু গানেই ভনিতায় বাবার পরিচয় কখনও ‘নবনীদাস খ্যাপা বাউল’, কখনও শুধু ‘খ্যাপা বাউল’। বাবা তো শান্তিনিকেতনে ঘরে ঘরে গান গাইতেন। খুব আদর-‌যত্ন পেতেন। বাবার গান শুনতে ঠাকুর খুব ভালবাসতেন।

• আপনিও নিশ্চয়ই দেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে?

•• খুব ছোট তখন। বাবার সঙ্গে গেছি। উনি কোলে বসিয়েছেন। বলেছেন, একটা গান শোনাবি নাকি? আমি গুনগুন করে দু’এক কলি শুনিয়েওছিলাম।

• আপনার বাবার কাছে রবীন্দ্রনাথের গল্প তো অনেক শুনেছেন?

•• সে তো শুনেইছি। সব থেকে বড় কথা কি জানো, আমার বাবা নবনীদাসকে, তাঁর ‘খ্যাপা বাউল’কে একটা বাউল গানও লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই গানটা বাবা খুব গাইতেন। ভৈরবীর ওপর সুর।

• কী গান সেটা?

•• ‘কোন ফুলে পূজিলে বলো পূজা হয় তোমার।’ এই গানের ভনিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিচয়ও দিয়েছেন। ‘ঠাকুর রবি বলে পুরুষ নারী/‌ কে হে তোমায় চিনতে পারি/‌ ও-‌পদে রাখো বা না-‌রাখো হরি/‌ কোন ইচ্ছা তোমার।’ রবীন্দ্রনাথের আর কোনও গানে এমন ভনিতা নেই।

• আপনার বাবার সঙ্গে অন্য কোনও লেখক কবির যোগাযোগ ছিল?

•• পাণ্ডবেশ্বরের কাছে ইসগড়ায় যখন বাবার আখড়া ছিল, তখন কাজি নজরুল ইসলাম খুব আসতেন। চুরুলিয়া তো ইসগড়া থেকে দূরে নয়। নজরুলের একটা গানও বাবা খুব গাইতেন। বাবাকে মনে রেখেই উনি লিখেছিলেন, সুর করেছিলেন। মনে আছে আমার। (‌কথা বলতে বলতে একতারা বাজিয়ে গেয়ে ওঠেন পূর্ণদাস)‌ ‘আমি ভাই খ্যাপা বাউল/‌ আমার দেউল/‌ এ যে আমার আপন দেহ।’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসতেন বাবার কাছে। বাবার আখড়া তখন লাভপুরের কাছে দোনাইপুরে। তারাশঙ্কর ‘রাইকমল’ উপন্যাসে বক বাবাজির চরিত্রটা আমার বাবাকে দেখেই লিখেছিলেন।

• আপনি প্রথম একা-‌একা গান গাইতে শুরু করেন কবে থেকে?

•• সেটাও খুবই ছোটবেলায়। বাবা তখন সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ক’বছর বাদে যদিও ফিরে আসেন, কিন্তু সেই সময়টা আমার দিদি রাধারানীর সঙ্গে আমিও ভিক্ষা করতে বেরোতাম। দিদি গান গাইত, আমি খমক বাজাতাম। দিদির গান শেষ হলে, যখন বলতাম, ‘মাগো, ভিক্ষা দাও’, তখন সেই সব বাড়ির মা, কাকিমারা বলতো, ‘মুখপোড়া, তুই একটা গান শোনা। এসেছিস কী করতে? গান না গাইলে তোকে আলাদা ভিক্ষে দেব না।’ দিদির ঝুলিতে চাল, আলু, পটল থালায় করে এনে ঢেলে দিত। এটাকে সিধে বলে। আমাকে শুধু একটা বাটিতে করে মুড়ি খেতে দিত। তখন-‌ই বাড়ি ফিরে এসে মাকে বললাম, আমাকে গান শিখিয়ে দাও। আমি একা ভিক্ষে করব। তখন-‌ই ওই তিনটে গান মা শিখিয়ে দিয়েছিল।

• একা গান গাইতে গিয়ে মন আর ঝুলি, দুটোই ভরল?

•• (হাসতে হাসতে)‌ হ্যঁা গো বাবা, দুটোই ভরল। দেখলাম, আমার গান শোনার জন্যে বাড়ির দোরগোড়ায় ভিড় হচ্ছে। গানের আর সুরের মহিমা যেন টের পেলাম। ঝুলি-‌ভর্তি চাল, আনাজ নিয়ে আখড়ায় ফিরতাম। দেখলাম, দিদির চেয়েও বেশি হচ্ছে। (‌হাসতে হাসতে)‌ দারুণ‌ আনন্দ হল। এমন কি, দু-‌একটা বাড়ি থেকে শিশি করে সরষের তেলও দিয়ে দিত। কিন্তু একদিন একটা বিপদ হল।

• কী বিপদ?

•• একদিন দুপুরে একটা বাড়িতে গান গাইছি। খুব ভিড় হয়েছে। গান শেষ হতে সেই বাড়ির মা এসে বলল, ‘তোর জন্যে আমার রান্না পুড়ে গেছে। দুপুরে আর আসবি না। সকালে বা বিকেলের দিকে আসবি।’ এই হল আমার বিপদ।
• বিপদ থেকে উদ্ধার পেলেন কীভাবে?

•• আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমার জন্যে ওদের রান্না পুড়ে গেল। ওরাই আমাকে ভিক্ষে দিচ্ছে, আবার আমার জন্যেই ওদের রান্না নষ্ট হচ্ছে। ঠিক করলাম, বাড়িতে গিয়ে আর গাইব না। ভাবলাম, ট্রেনে যদি গান গেয়ে ভিক্ষা করি, তাহলে তো রান্না পুড়িয়ে দেবার অপরাধ হবে না। ট্রেনে-‌ট্রেনে গাইতাম। ট্রেনে তো চাল, গম, আনাজ নেই, লোকে টাকা পয়সা ভিক্ষে দিত। গান গাইতে গাইতে দেখতাম, আমার খমক-‌টা টাকা পয়সায় ভর্তি হয়ে যেত। কিন্তু সারাদিন ট্রেনে কেটে যেত। খেলার সময় পেতাম না। তখন রানীগঞ্জের দিকে কোলিয়ারিতে গান গাইতে যেতাম। ওখানে সবাই রেশন পায়, ‘হপ্তা’ তোলে। আমাকে ঝুলি ভর্তি করে চাল, ময়দা, আনাজ কোনাজ দিয়ে দেয়। সংসারটাও চলল, আমি খেলার টাইম-‌ও পেয়ে গেলাম।

• ট্রেনে এখন তো অনেক বাউলই গান করেন। শুরু করেন আপনি?

•• হ্যঁা গো বাবা, তখন তো আমি একাই ট্রেনে ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করতাম।

• কলকাতায় এলেন কীভাবে?

•• জীবন তো একটা পরিক্রমা। যেখানে যাবার, সেখানে ঠিক টেনে নিয়ে যাবে। তারপর বহু বছর তো হাটে, মেলায় গান গাইতাম। জয়দেবের মেলায়, দুবরাজপুরের মেলায় গিয়ে গান গাইতাম। জয়দেবের মেলা থেকেই আমাদের মতন কয়েকজন বাউলকে ক্ষিতিমোহন সেন নিয়ে যান শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায়, শ্রীনিকেতনের কৃষিমেলায়। এখান থেকেই কলকাতার মার্কাস স্কোয়ারের মেলায় আমাদের ডেকে নিয়ে যায়। ততদিনে বাবা তাঁর সাধনা শেষ করে আখড়ায় ফিরেছেন। বাবার সঙ্গে মার্কাস স্কোয়ারে গান গাই। অনেকে ভালবাসা দিল, খাতির দিল। নবনীদাস বাউল তার ছেলেকে নিয়ে প্রোগ্রাম করছে, এটা অনেকে আলোচনা করতে লাগল। উল্টোরথ পত্রিকায় আমার ছবিও বের হল বাবার সঙ্গে।

• সেটা কোন সনয়?

•• ৬০-‌এর দশকের গোড়ার দিকে। তারপর কলকাতার নানান উৎসবে গান গাওয়ার ডাক পাই। যুব উৎসবে গান গাইলাম। রঞ্জি স্টেডিয়ামে আমার গানের খুব প্রশংসা হল।

• কলকাতায় থাকতেন কোথায়?

•• মৌলালিতে যুব উৎসবের অফিস ছিল। রাতে সেখানকার বেঞ্চে শুতাম।

• কলকাতায় ওইভাবে তো থাকা সম্ভব নয়?

•• দু’একদিন কলকাতায় থেকে আবার গ্রামের আখড়ায় ফিরে যেতাম। কিন্তু কলকাতায় তখন মাঝে মাঝেই গান গাওয়ার ডাক আসত। আমি বেঞ্চে ঘুমোই দেখে একজন আমায় বলল, আমি তোমার কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করব। এখানে না থাকলে তুমি এখানে নিয়মিত গাইবে কী করে। তিনি হলেন কালী দাশগুপ্ত।

• উনি তো লোকসঙ্গীতের শিল্পী ও গবেষক ছিলেন?

•• সেটা পরে। তখন কালীদা বক্সিং করতেন। কালীদা তখন হিন্দুস্তান পার্কে নিয়ে যান অভিনেতা অভি ভট্টাচার্যের সেজ বোনের বাড়ি। আমি ওঁকে সেজদি‌ বলতাম। সেই বাড়ির পাম্প–ঘরের পাশে একটা খুপড়িতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। আমি ভিখিরি বাউল, আমার কোনও অসুবিধে হত না। সেজদির ঘর–টর মুছে দিতাম, জামা–কাপড় ইস্তিরি করে দিতাম, রান্নাও করে দিতাম। মাথা গোঁজার ঠাঁইটা পেয়েছিলাম তো। কলকাতা শহরে সেটা কি চাট্টিখানি কথা। আমি খেয়ে নিতাম বাইরে, ‘দাস কেবিন’–এ। তারপর ৬২ সালে মস্কো যাবার সুযোগ হল।

• গ্রাম থেকে কলকাতা ছুঁয়ে সোজা বিদেশ?

•• তখন মস্কোয় যুব উৎসবে গান গাওয়ার জন্যে আমি নির্বাচিত হই। খুব প্রশংসা পায় আমার গান। তারপর কত দেশে, কত যুব উৎসবে গান গাইলাম। যুব থেকে বৃদ্ধ হয়েছি। তার মাঝখানে ১০০–র ওপর দেশে গিয়ে বাংলার বাউল গান শুনিয়েছি। কত বিদেশি মানুষ এসেছে গান শুনতে, গান শিখতে। আমেরিকার লস এঞ্জেলেসে একটা অ্যাকাডেমিও করতে হয়েছিল। প্যারিসেও সবাই ধরেছিল অ্যাকাডেমি করার জন্যে। কিন্তু দেশের টান বড় টান। কত দেশ তো ঘুরেছি, গান গেয়েছি। আমাদের বাউল গান সব দেশের মানুষের মনকে নাড়িয়ে দেয়। এই গান যে হৃদয়ের গান, মাটির গান। সেই দেশের মাটি, দেশের হৃদয়ের বাইরে গিয়ে থাকতে কখনও মন চায়নি।

• আপনি তো বাউল গানের অনেক রেকর্ডও করেছেন।

•• হ্যাঁ, বড় কোম্পানিতে বাউল গানের রেকর্ড আমিই প্রথম করি। আমার গান শুনে তারাপদ লাহিড়ী আমাকে নিয়ে যান এইচএমভিতে। এইচএমভি প্রথমে আমার অডিশন নিয়ে বাতিল করে দিয়েছিল। বলেছিল, তোমার মেয়েলি গলা। তোমার গান রেকর্ড করা যাবে না। পরে, হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে রাইচাঁদ বড়াল আমাকে ডেকে পাঠালেন রেকর্ড করার জন্যে। আমি ওঁকে বললাম, আমার গলায় তো রেকর্ড হবে না। উনি চমকে তাকিয়ে বললেন, কে বলেছে এই কথা? বললাম, এইচএমভি–র কর্তারা বলেছেন। রাইচাঁদবাবু হেসে বলেছিলেন, দেখি, আমরা পারি কিনা।

• কী গান রেকর্ড করলেন?

•• দু–পিঠে দুটো গান ছিল। ‘এত লোক পেরিয়ে গেল/‌ ভাঙা তরী কেউ বলে না।’ আর একটা— ‘মাঝি-‌গিরি জানি ভাল, মনে ভয় খেও না ব্রজাঙ্গনা’। দুটো গান খুব জনপ্রিয় হল। বলা যায়, এই দুটো গানই পূর্ণদাসকে চেনাল শ্রোতাদের কাছে।

১৯৬৫তে আমেরিকায় গিয়ে লালনের গান, ভবা পাগলার গান রেকর্ড করি। পরে এইচএমভিতেও গান করেছি।

• আপনি দেশ বিদেশ প্রচুর ঘুরেছেন, নানান দেশে গান গেয়েছেন, এখন আছেন কলকাতায়। আপনার সম্পর্কে কেউ কেউ অভিযোগ করেন, বাউল গানকে আপনি শহুরে করে তুলেছেন।

•• দেখো বাবা, ‘শহুরে’ কী জিনিস, আমি জানি না। আমি যখন যেখানে থাকি, সেটাই আমার আখড়া। কিন্তু কলকাতায় আছি বলে আমার চামড়া, শরীর, হাড় কি পাল্টে গেল? পাল্টে গেল আমার প্রাণ? আমার বাপ, মায়ের শিক্ষা? আমি এখনও গ্রামের ভিখিরি বাউল–ই আছি। তবে, ট্রেনে–ট্রেনে, পথে–পথে ভিক্ষা করতে বেরতে পারি না। দেশের বাউল গানকে বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া কি অপরাধ?

• নতুন প্রজন্মের অনেকে ব্যান্ডের গানের সঙ্গে বাউল গানও করেন, নানান যন্ত্রানুষঙ্গও ব্যবহার করেন। আপনি এটাকে কীভাবে দেখেন?

•• দেখো, আজকের ছেলেপুলেরা যদি ভালবেসে বাউল গানকে শ্রোতাদের সামনে পরিবেশন করে, তাতে দোষের কী আছে? যে ক্ল্যাসিক্যাল গায়, সেও তো বাউল গাইতে পারে। যদি সুরযন্ত্রকে ঠিকঠাক ব্যবহার করা যায়, যে কোনও গানেই সেটা মানানসই। কিন্তু ‘ভাব’টা আসল। গানের ‘ভাব’ যদি ঠিক থাকে, গান তো নষ্ট হবে না। শুধু ভাব চাই, আর প্রেম চাই।
• বাউল গান নিয়ে আজও কোন স্বপ্নটা দেখে যান?

•• শরীরের বয়স হয়েছে ঠিকই। কিন্তু স্বপ্নের তো বয়স হয় না। আমি চাই একটা বাউল অ্যাকাডেমি গড়তে, যেখানে নতুন দিনের ছেলেমেয়েরা আমাদের গানগুলো হৃদয় দিয়ে শিখবে। আমার ছেলে দিব্যেন্দু আমাকে ‘অভিভাবক’–এর মতো উৎসাহ দেয় আমার স্বপ্ন পূরণে। ছোট থেকেই দিব্যেন্দু আমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গান গায়। আমি চাই, শুধু তাকেই নয়, আজকের নতুন ছেলেমেয়েদের আমার গানের ভাণ্ডার দিয়ে যেতে। তারাই তো বাঁচিয়ে রাখবে এই গানের ধারাকে। এই গান বড় ভালবাসার গান। ভাবের গান। রসের গান।

কথা বলতে বলতে, ৮৫ বছরের পূর্ণদাসের আঙুলের ছোঁওয়ায় একতারায় তার নড়ে–চড়ে ওঠে। তিনি গাইতে থাকেন, ‘সেই রসেতে যে–জন মাখা, মরে না সে জনমে।’ কথা শেষ। গান শেষ হয় না। ‌‌

তথ্যসূত্র: আজকাল

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

6 thoughts on “পালাকীর্তন ও বাউল গান চতুর্থ অধ্যায়

  1. উপযুক্ত পোস্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মি. ভাণ্ডারী। গুড জব। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। সাথে থাকবেন।
      অনুপ্রেরণা দিয়ে উত্সাহিত করবেন।
      আশা রাখি। জয়গুরু।

  2. পালাকীর্তন ও বাউল গান নিয়ে পোস্ট সুন্দর হয়েছে কবি ভাণ্ডারী দা। :)

    1. আপনার সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। সাথে থাকবেন।
      অনুপ্রেরণা দিয়ে উত্সাহিত করবেন।
      আশা রাখি। জয়গুরু।

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম প্রিয় কবিবোন আমার। সাথে থাকবেন।
      অনুপ্রেরণা দিয়ে উত্সাহিত করবেন। শুভেচ্ছা রইল।
      আশা রাখি। জয়গুরু।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।