ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদু গান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

১৮৫৭ -র মহাবিদ্রোহে যে রাজারা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংহ দেও। পুরুলিয়ার প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক দিলীপ গোস্বামী বলেন, ‘লোককথা অনুযায়ী, নীলমণি সিংহের কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী বা ভাদু। তাঁর অকালমৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে ভাদু উত্সবের প্রচলন হয় রাজবাড়িতে।’

ভাদ্র মাসের পয়লা দিনে রাজবাড়িতে ভাদুর মূর্তি স্থাপন করা হত। অন্তঃপুরের মহিলারা প্রতি রাতে ভাদুর সামনে বসে গান করে ভাদু উত্সব করতেন। ভাদ্র সংক্রান্তির দিন সারা রাত জেগে হত ভাদু উত্সব। এই দিনটিকে বলা হয় ভাদুর জাগরণ। পয়লা আশ্বিন ভাদু বিসর্জন। কাশীপুর রাজবাড়িতে সুনসান গেটের সামনে নির্লিপ্ত বসেছিলেন অবাঙালি দারোয়ান। ভাদুর কথা উঠতেই বলে উঠলেন, ‘এখানে কে ভাদু করবে ? রাজকন্যা লখনৌতে থাকেন। আসেন পুজোর সময়৷’

লোককথা অনুযায়ী, কারাবন্দি প্রেমিক অঞ্জনের খোঁজে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন ভাদু। তাই মন্ত্রোচ্চারণ নয়, লোকায়ত সুরেই হয় ভাদুর বন্দনা। নিবেদন করা হয় খাজা -গজা, জিলিপি, লাড্ডু। নীলমণি সিংহের রাজত্ব বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশরা। সেই রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য নীলমণি ব্রিটিশ আদালতে আবেদন করেছিলেন। রাজার আইন উপদেষ্টার চাকরি নিয়ে সেই সময় পুরুলিয়া আসেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রাজবাড়ির ভাদু উত্সবে যোগ দিতেন কবি। লিখেছিলেন কয়েকটি ভাদু গানও।

ঐতিহ্যের এই ভাদু উত্সব এখন রাজবাড়ি থেকে হারিয়ে গেলেও টিকে রয়েছে কাশীপুরের কিছু মহল্লায়। সঞ্জয় সূত্রধর, ষষ্ঠীপদ বাউড়ি, বাবলু মোদক, সুশীল শা -রা এখনও ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদু গানের আসর বসান। তবে তা রাজকীয় মর্যাদা পায় না।

মানভূমের গ্রামাঞ্চলে ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা পুজোকেও ছাপিয়ে যায় ভাদু। মেয়েরা কুমোর বাড়ি থেকে ভাদু মূর্তি কিনে এনে গ্রামে স্থাপন করেন। ভাদু গানে কখনও দৈনন্দিন জীবন কখনও বা চাওয়া -পাওয়ার যন্ত্রণা ফুটে ওঠে।
‘ভাদু আমার ছোট ছেলে, কাপড় পড়তে জানে না’ (পুরুলিয়ায় শিশুদের লিঙ্গ নির্বিশেষে ছেল্যা >ছেলে বলা হয় )।
ভাদুর গীতে ক্রমশ উহ্য হয়েছেন খোদ ভাদুই। এসেছে রামায়ণ -মহাভারতের কাহিনি। ‘রামের মা সিনাতে গেল , রাম কাঁদে ধুলায় পড়ে / কেনে গরবি ধুলা দিলি / ধুলা ঝাড়ে লিই কোলে।’

বিদায় বেলায় যেন ডুকরে উঠলেন সেই অবাঙালি দারোয়ান, ‘সব উঠে গেল বাবু। ভাদু, আগমনী, পুজো, যাত্রাপালা সব …’তালাবন্ধ কাশীপুর রাজবাড়ি।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

2 thoughts on “ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- (প্রথম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

  1. শিল্প এবং সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না। শুভেচ্ছা মি. ভাণ্ডারী।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।