ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

নদীর ধারে একটু জটলা। দূর থেকে ভেসে আসে গান – “কাশীপুরের রাজার বিটি/বাগদি ঘরে কী কর?/কলসী কাঁখে লয়ে পরে/ সুখ সাগরে মাছ ধর।” সারিবদ্ধ মহিলাদের কোলে-কাঁখে ছোট্ট মূর্তি। যেন কচি মেয়েকে কোলে নিয়ে জলাধারে গিয়েছেন মায়েরা। কার মেয়ে কত ভাল, সেই নিয়ে গান বেঁধে লড়াই চলে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এই গানের রেশ কেটে যায়। জলে ফেলে মেয়ের বিসর্জন হয়ে যায়। চেনা লাগছে গল্পটা? দুর্গা বিদায়ের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন?
দেবী দুর্গার আবাহন-বিসর্জনের মতো শস্যদেবী আসেন, আবার চলে যান।

উমার মতোই ভাদুও আমবাঙালির ঘরের মেয়ে। লোক উৎসবের কাহিনিতে কান পাতলে শোনা যায়, কাশীপুরে পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা নীলমনি সিং দেও-র কন্যা ভদ্রেশ্বরী। যদিও এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ক সরিয়ে রেখেই শুধুমাত্র কাহিনির মাধুর্যেই এই পার্বণ হয়ে উঠেছে চিরায়ত, লোকায়ত। তো সেই রাজা নীলমণি সিং দেও কিশোরী কন্যার অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে ভাদু উৎসবের প্রচলন করেন। এখন তাই কাশীপুরেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে ভাদুর নিয়মনীতি পালন।

ভাদ্র সংক্রান্তির ঠিক আগে পুরুলিয়া, বাঁকু়ড়ায় পুরোদমে চলছে ভাদুর আরাধনা। তবে এই আনন্দের একতারাতেও আজকাল বিষাদ বেজে ওঠে। না আছে সেকালের গানের কথা, না আছেন গায়ক। ভাদু উৎসব যেন অনেকটাই পঞ্জিকায় পিঞ্জরাবদ্ধ। মেয়ে-বউদের প্রাণের সুর বসানো গানে গানে যেন হঠাৎই সজীব হয়ে উঠত চারপাশ। কিন্তু আজ গান আছে, প্রাণ নেই, সুর গেছে কেটে।

এখন ভাদুর সুরে শোনা যায় বিজ্ঞাপনের কথা – “সিম এসেছে জিও/ এবার কিন্তু যাবার আগেই আমায় একটা দিও/ গত বছর স্পিড ছিল না/ টুজি–থ্রিজির জন্য/ ফোর জি যখন এসে গিয়েছে/ এবার ব্যাপার অন্য।”
আগে পয়লা ভাদ্র থেকেই ভাদুর মূর্তি কিনে ফি সন্ধ্যায় প্রায় রাত পর্যন্ত গান গাইতেন মহিলারা। কাশীপুরের ন’পাড়ার বাসিন্দা শিবানী বাউড়ি বলেন, “আমাদের গান গাওয়ার সঙ্গীরা সব ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন। অনেকে মারাও গিয়েছেন। তাই আর আগের মত সমগ্র ভাদ্র মাস জুড়ে গান হয় না। এখন কেবল ভাদ্র শেষে জাগরণেই আটকে গিয়েছে ভাদু গীত।” লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর বলেছিল, ভাদু গানকে সংরক্ষণ করতে তারা একটা সংকলন করবে। কিন্তু আজও সেই কাজ এগোয়নি। তবে আমার কাছে সংগ্রহ করা আড়াইশো গান রয়েছে।” সেই গানে–গানেই হয়ত আজকের রাত্রি জাগরণ পঞ্চকোটের।

আর উৎসব মানেই তো পেটপুজো। তাই ভাদুকে সামনে রেখে খাজা, কোস্তা, লবঙ্গ লতিকা, গজা, মতিচুরের লাড্ডু, চিনির পুতুল। ভাদুর জাগরণ–বিসর্জনে এই হরেকরকম মিষ্টান্নতে ম–ম করত পঞ্চকোট। এই পঞ্চকোটের রাজসভায় ভাদু উৎসবে পঁচিশ কেজির লাড্ডু তৈরি হত। ভাদুকে দেওয়া হত একান্ন রকমের মিষ্টি। কিন্তু আজ সেসব অতীত। ভাদু জাগরণে মিষ্টি নিয়েও শোনা গেল গান। এই মিষ্টি নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। এই পরবের মিষ্টি চেখে দেখতেন স্বয়ং ছোটলাটও। তাই ভাদু পরবের মিষ্টি বানানোকে ঘিরে কম তোড়জোড় ছিল না এই ভাদুভূমে।

সেইসময় পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে যে দোকান থেকে মিষ্টি যেত, সেই দোকানের বর্তমান মালিক চিত্তরঞ্জন দাস মোদক বলেন, “ভাদু–র সময় ছোটলাটের কাছে মিষ্টি পাঠানো হত। দু’কেজি ওজনের লাড্ডু, থালার মত জিলিপি দোকানে সুতোয় বেঁধে ঝোলানো থাকত। এমনকি লাড্ডু–জিলিপির নিলাম হত। সারা ভাদ্র মাস জুড়ে যে কত রকমের মিষ্টি তৈরি করতেন বাপ–ঠাকুরদা! এখন সেসব শুধুই স্মৃতি।”

www.youtube.com/watch?v=FL5GaUk_zXI

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

7 thoughts on “ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (নবম পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

  1. লিখে যান, সাথে আছি। আপনার প্রতিটি লেখা পোষ্ট পড়ছি। শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।

    1. আপনার হৃদয়ছোঁয়া মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম।
      শারদ-শুভেচ্ছা রইল। জয়গুরু!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।