বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপন্যাস হলো আধুনিক যুগ সচেতন শিল্পকলা। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ বেনিয়া শাষিত কলকাতা এবং তৎকালীন মফস্বল জীবনের যে বিন্যাস, সেই বিন্যাসের টানাপোড়নের বাস্তব আকর্ষণেই জন্ম নেয় বাংলা উপন্যাস। সেই সময়ে কলকাতাকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে জীবন গ্রহের যে বীজ অংকুরিত ও সঞ্চীবিত হচ্ছিল, তারই প্রচণ্ড আলোড়নে মধ্যবিত্ত চিরাচরিত জীবনবোধ এক নতুন আশা আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়। ফলে জীবন ভাবনায় দেখা দেয় তীব্র সংকট। যুগ চেতনার সেই প্রক্ষাপটেই সৃষ্টি হয় ‘নববাবু বিলাস’ ও ‘আলালের ঘরে দুলাল’।
এর মাধ্যমে বাংলা উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়।
প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের যথার্থ লক্ষণ প্রত্যক্ষ করা গেলেও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক। উপন্যাস রচনার কলা-কৌশল আয়ত্বের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম সার্থক শিল্পী। এ জন্য তাঁকেই বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়।
বঙ্কিম পরবর্তীকালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হলেও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তার অধিকারী। উপন্যাস রচনায় তাঁর উপাধি ছিল অপরাজেয় কথাশিল্পী। শরৎচন্দ্রের পরে আরও অনেকেই উপন্যাস রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাস রচনায় তিনি ছিলেন নানান কৃতিত্বের অধিকারী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের যে চরম সংকট দেখা দিয়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলা কথা-সাহিত্যে আমূল পরিবর্তনের এক ধারা সূচিত হয়। যে কয়েকজন লেখকের হাতে এ বৈপ্লবিক ধারার সূচনা হয় মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রিয়ালিটি বা জীবনবাদী শিল্পী। কারণ সম-সাময়িক কালের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের ট্রাজেডি, এতো নির্মম বাস্তবতা ও শিল্প-কুশলতায় আর কোনো লিখক ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। নিম্নবিত্ত ও সর্বহারা সমাজের মানুষের ক্ষয়-ক্ষতি, মনুষ্যত্বের অপচয়, ক্লেদ-হতাশা ও দুঃখ বেদনায় তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও আদর্শ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্রধারায় চিরভাস্বর।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সমালোচক নারায়ণ চৌধুরী বলেছেন, ‘মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অভ্যন্তরিক রিয়ালিজম ঘেঁষা মনোভাব তাঁকে শিল্পজীবনের সৌন্দর্যের আদর্শ থেকে দৃষ্টি গ্রাহ্যভাবেই বিচ্যূত করেছে। এমন কি মধ্য ও শেষের দিকের লিখায় তিনি সচেতনভাবেই অসুন্দরের পূজারী হয়ে উঠেছিলেন বললেও অন্যায় হবে না।’ (নারায়ণ চৌধুরীঃ সমকালীন সাহিত্য পৃষ্টা-১২৩-২৪)।
কালের বিচারে মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিশের যুগের বাংলা ঔপন্যাসিকদের অন্যতম প্রধান পুরুষ। এই ত্রিশের কালের যুগেই বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মানসে চিন্তা চেতনাকে বিজ্ঞান মনস্ক করে তোলার জন্য যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়; তাঁর একদিকে যেমন রয়েছে বিশ্ববীক্ষা স্বদেশকে বিশ্বের অংশ হিসেবে উপলব্ধি করা, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে মানুষ পরিবেশ ও মনোজগত সম্পর্কে নানা প্রশ্নের ক্রিয়াশীল ভূমিকা।
সে কারণেই ত্রিশের বুদ্ধিজগতে জীবনের সার্বিক সংকটে স্বীকৃতি যেমন স্পষ্ট, তেমনি সেই সংকটকে শিল্প সৃষ্টিতে পরিহার না করার দৃঢ় প্রবণতাও লক্ষণীয়। এই দৃঢ়তার মূলে ছিল জীবন সম্বন্ধে প্রবল আশাবাদ।
মানিক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন সেই আশাবাদী জীবনের একজন সচেতন শিল্পী। তাই তাঁর উপন্যাস সমূহে ধ্বনিত হয়েছে সমকালীন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালির আশাদীপ্ত জীবনচেতনার চঞ্চল প্রেরণা ও তীব্র বেদনাবোধ।
জীবন আশাবাদী শিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায় মোট ১৯টি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস “দিবারাত্রির কাব্য”। প্রকাশকাল ১৯৩৫। প্রকাশের দিক থেকে এটি দ্বিতীয় প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ জননী। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘মাটির ছেলে’। প্রকাশকাল-১৯৬০। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
বিষয়বস্তু ও মনোদৃষ্টির ভিন্নতার কারণে তার রচিত উপন্যাস সমূহকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পুতুল নাচের ইতিকথা এবং পদ্মানদীর মাঝি। দ্বিতীয় ভাগে চতুস্কোন সরীসৃপ অহিংসা প্রভৃতি এবং তৃতীয়ভাগে পড়ে শহরতলী চিহ্ন আরোগ্য ইত্যাদি।
এরই তিনভাগের রচনায় তিনি যদিও তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবস্থা করেছেন, তথাপি তাঁর মনোভঙ্গি ও জীবন গ্রহণের পদ্ধতি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় অপরিবর্তিত থেকে গেছে। শিল্পী হিসেবে মানিক বন্দোপ্যাধায়ের শক্তি এবং দৌর্বল্যের উৎস এই অপরিবর্তনীয় মনোভঙ্গির মধ্যেই নিহিত।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে তাঁর উপন্যাসের শিল্প-সংকটের যে অভিযোগ আনা হয়, সে সংকট তাঁর পক্ষে মূলত মতবাদেরই সংকট। এই সিদ্ধান্তের কথা মনে রেখেই মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসের বাস্তবতা এ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত।
বাংলা সাহিত্যের ধারায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, বক্তব্য ও প্রকরণ ব্যাক্তিত্বমণ্ডিত ও স্বচিহ্নিত জীবনের অন্তর্গত এবং বহির্গত বিষয়ের উন্মোচনে বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনার সীমানাকে তিনি অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন মানুষের মনোবিশ্ব ও বহির্বাস্তবতার সঙ্গে নিজস্ব জীবনাবেগ ও তত্ত্বাবেগের সুষম সমন্বয় সাধনের অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে।
সেজন্যই তাঁর উপন্যাসে বিন্যাস মনোবিশ্ব যেমন স্বতন্ত্র ও নিগূঢ়, অভিনিবেশ্য বিশেষত্বপুর্ণ। এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই রাবীন্দ্রিক উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য তাঁর শিল্প-চেতনার স্বাতন্ত্র্যময় সম্ভাবনাকেই ধারণ করেছে।
বিষয় ও প্রকরণে এই উপন্যাসে তিনি যেমন নিরীক্ষাধর্মী ও ব্যতিক্রম তেমনি জীবনের প্রতি একটা গভীরতার স্বরূপ এবং জীবনের এই অন্তর্লোক সন্ধানী শিল্প দৃষ্টি সহজ-সরল গ্রামীন জীবনের গভীরতার স্বরূপ উন্মোচনেও উৎসুক।
জীবনের এই অন্তর্লোক সন্ধানী শিল্পদৃষ্টি তাঁর উপন্যাসে সহজ-সরল গ্রামীন জীবনের জটিলতা চিত্রিত করেছেন। বৃহত্তর গণজীবনের সার্থক রূপচিত্র অঙ্কনে এবং শক্তিময় অন্তস্রোত সৃষ্টিতে তিনি বাস্তব মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়েছেন।
ত্রিশের দশকে আঁকা তাঁর এই গ্রামীণ জীবন চিত্র প্রত্যক্ষ সংগ্রামের শ্রেণী সচেতনায় শাণিত না হলেও জীবন সংগ্রাম সেখানে কখনো প্রতীকের আড়ালে, কখনো অদম্য উত্তীর্ণ তার স্পৃহায় সীমাবদ্ধ।
‘পদ্মানদীর মাঝি’তে তা গতিমুখর হলেও পুতুল নাচের ইতিকথায় সে স্পৃহা বুদ্ধিদীপ্ত। তিনি জীবন অন্বেষার পথ ধরে জনজীবনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জননী’ মূলত শহরতলী এবং গ্রামের এক মিশ্র পরিচয়। শহরতলীতে বসবাসরত শ্যামার পারিবারিক জীবন যেন অনেকাংশেই গ্রামীণ জীবনাচরণ বহন করে চলেছে। তবুও একথা বলতে হয় যে, জননী অংশত পুতুল নাচের ইতিকথার এবং পরিপূর্ণ পদ্মানদীর মাঝিকে বাংলার গ্রাম তার রূঢ় বাস্তব নিসর্গ এবং চলিষ্ণু মানুষের কাহিনী নিয়ে আশ্চর্য রকম সজীবতায় মূর্ত। গ্রামীন জীবনের দৃশ্যচিত্র নির্মাণের এবং প্রধান প্রধান চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি যে সচেতনতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।
পুতুল নাচের ইতিকথা ও পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস দুটিতে তিনি এক সুতীব্র ও বহমান নদীর দ্বন্দ্ব উপস্থিত করেছেন। এই দ্বন্দ্বস্মৃতির সঙ্গে বিস্মৃতির সীমার প্রসারতার বসতির সঙ্গে ভ্রমণের শোষন পীড়িত শ্রেণীদ্বন্দ্বের অসংগতিতে বিভক্ত সমাজে সাহিত্যিকের কাঁচে মার্কসবাদ একটি একটি আদর্শ ও স্বপ্ন।
তিনি ছিলেন সেই স্বপ্ন ও আদর্শে বিশ্বাসী এক নিষ্ঠাবান শিল্পী। তাই তাঁর উপন্যাস এর যথার্থ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। বেঁচে থাকার আশা ও স্বপ্ন নিয়ে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে প্রতি নিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে।
উপন্যাস রচনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সত্য-সন্ধানী। তাঁর উপন্যাসে যে গভীর সত্য প্রকাশিত হয়েছে তার স্বরূপ হলো মানুষের প্রতি ভালোবাসা। মানুষের বাস্তব জীবনের প্রতি ভালোবাসা। এই ভালোবাসার চিত্র অঙ্কন করেছেন পদ্মাপাড়ের জেলে-মাঝিদের জীবন ও ওদের সুখ-দুঃখ নিয়ে। তাঁর পূর্বে আর কোনো লেখক এমন তীক্ষ্মভাবে, এমন মমতার রসে সিক্ত হয়ে ওদের জীবন-চিত্র অঙ্কন করেননি।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর উপন্যাসেই প্রথম সমাজের নীচুতলার মানুষের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর শোনা গিয়েছে। ওদের জীবনের এমন বাস্তব চিত্র তাঁর পূর্বে আর কেউ অঙ্কন করতে সাহস করেননি। পুতুল নাচের ইতিকথার দেখা দেখা যায় গ্রাম বাংলার সেই রিক্ত পল্লী জীবনের এক অবিস্মরণীয় চিত্র সমকালীন জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি বই আর কিছু নয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের কথা সাহিত্যের পরিধিতে যোগ করেছেন এক অচেনা ও অবহেলিত জনপদের জীবন কথা। তাঁর হাতেই বাংলা উপন্যাসে যৌনজীবন ও অন্তর্জীবন একটি সুস্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। বাংলা সাহিত্যে নরনারীর যৌন সম্পর্ক এতোদিন নিষেধ বা রোমান্সের ঘেরাটোপে ঢাকা ছিলো। সে অবস্থায় তিনিই প্রথম নির্ভীকচিত্তে তীর্যক সন্ধানী আলো নিক্ষেপ করেন সেই ধারাবাহিক অন্ধকারের উপর। প্রেম ও যৌনতাকে তিনি বিশেষণ করেছেন বিজ্ঞান নিরাসক্ত তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে অস্তিত্ববাদী এবং চৈতন্য প্রবাহের লক্ষণ মুক্ত চরিত্রের তিনিই প্রথম স্রষ্টা।
দিবারাত্রির কাব্য, চতুস্কোন এবং পুতুল নাচের ইতিকথা তাঁর এই তিনটি উপন্যাসই মগ্ন-চৈতন্যের বিশেষণ ভিত্তিক সাহিত্য। পূর্বে যে মার্কসবাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা তাঁর হাতেই এর প্রথম সার্থক প্রয়োগ হয়েছিলো। তাই মার্কসবাদী লেখক হিসেবেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমধিক পরিচিত।
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় তাঁর শিল্পকর্ম এক স্বতন্ত্র প্রতিভার স্বাক্ষর। ত্রিশের লেখকদের মধ্যে যার গদ্যরীতি পরবর্তী দশকে শক্তিমান লেখকদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল, তিনি হলেন কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপ্যাধ্যায়।
মানিক বন্দোপ্যাধ্যায়।
(জন্মঃ ১৯শে মে ১৯০৮ইং। মৃত্যুঃ ৩রা ডিসেম্বর ১৯৫৬ইং।)
কৃতজ্ঞতায়ঃ প্রফেসর মোহম্মদ আশরাফ।
প্রফেসর মোহম্মদ আশরাফ। পদ্মা পাড়ের মানুষ। মুন্সীগঞ্জ, সাহিত্য থেকে শেয়ার করা হলো।