গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি-
ধম্মং শরণং গচ্ছামি-
সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি’

গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম
গৌতম বুদ্ধের চারটি আর্য সত্যের (চতুরার্য সত্য) সব কটিই দুঃখকে কেন্দ্র করে। তাঁর শিক্ষা ও দর্শনের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে কীভাবে দুঃখের হাত থেকে বাঁচানো যায়। গৌতম বুদ্ধ দুঃখের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাননি, তিনি দুঃখকে জয় করতে চেয়েছেন। দুঃখের হাত থেকে বাঁচার জন্য গৌতম বুদ্ধ কারও কাছে সাহায্য না চেয়ে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও সংযমের মাধ্যমে দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করেছেন।

জগতে দুঃখের কথা শুধু গৌতম বুদ্ধ একাই বলেননি, বিভিন্ন উপনিষদে দুঃখ সম্পর্কে অনেক আলোচনা আছে। সাংখ্য দর্শনের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ সাংখ্যকারিকার প্রথম সূত্রই ত্রিবিদ দুঃখ নিয়ে শুরু করেছে। ভারতীয় দর্শনের একমাত্র চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া আস্তিক ও নাস্তিক সব কটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেছে এবং এর হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করাকেই জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য বলে মনে করেছে। তবে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের কোন দার্শনিকই গৌতম বুদ্ধের মত এত গভীরভাবে এবং যৌক্তিকতার সঙ্গে দুঃখ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেননি।

গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার সঠিক মূল্যায়নের জন্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মধ্যে Schopen Hauer, Nietzsche, Kierkegaard কী বলেছেন আলোচনা করে দেখা যাক।

Schopen Hauer একজন দুঃখবাদী দার্শনিক। তাঁকে অনেকেই‍‍‍ ‘Prince of Pessimism’ বলেন। তাঁর মতে, এ জগত দুঃখের আলয়। দুঃখই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। সুখ অকল্পনীয় ও অসম্ভব বস্তু। যতই আমাদের জ্ঞান বাড়ে, ততই আমাদের দুঃখ বাড়ে। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ দুঃখের কথা বললেও আশার বাণী শুনিয়েছেন, বাঁচার পথ দেখিয়েছেন। Schopen Hauer বৌদ্ধধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করলেও বুদ্ধের মূল শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে আছেন। বুদ্ধের শিক্ষা আমাদের আশার আলো দেখায়, আর শোপেন হাওয়ার তাঁর সামনে পর্দা টেনে আমাদের হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দেন।

Nietzsche ও দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর বক্তব্য আরও ভিন্নতর। তিনি প্রথম জীবনে Schopen Hauer দ্বারা প্রভাবিত হলেও পরে সে প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সে যাই হোক তিনি মায়া-মমতা, দয়া-সহানুভূতি ইত্যাদিকে অনেক ছোট করে দেখিয়েছেন। তাঁর কাছে মানবিক গুণের চেয়ে শক্তির গুরুত্ব বেশী। তিনি বলেন, উচ্চতর সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর সম্প্রদায়ের ধ্বংস হওয়া উচিত। গৌতম বুদ্ধের দর্শন ঠিক এর বিপরীত। তাঁর শিক্ষা ভালোবাসা আর দয়ার কথায় পূর্ণ। তাঁর কাছে ছোট-বড় কেউ নেই। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই শ্রেণী বিভাগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, জন্মগত কারণে মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। তাই Nietzscheর দর্শনের মতো উচ্চতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থে নিম্নতর শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের ধ্বংস বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনে অকল্পনীয়।

Kierkegaardও বুদ্ধের মত তত্ত্ববিদ্যায় উৎসাহী ছিলেন না এবং তাঁরও মূল লক্ষ্য মানুষের নৈতিক দিকটা। তিনিও বুদ্ধের মতো বলেছেন, কামনা-বাসনাই দুঃখ আনে। তবে তাঁর এ ব্যাখ্যা ঈশ্বরকেন্দ্রিক, কিন্তু বুদ্ধের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। বুদ্ধের মতো Kierkegaard বাসনার উর্দ্ধে যেতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন, বাসনা ত্যাগ বৌদ্ধিক আত্মহত্যার শমিল।

প্রত্যেকটি দুঃখের জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী, অন্য কেউ নয়। আরব দেশের এক কবি বলেছিলেন, ‘মারা যাওয়ার পর তাঁর কবরের ওপর যেন লিখে রাখা হয় যে, তাঁর পাপের জন্য তাঁর বাপ দায়ী। কারণ তাঁর বাপ না থাকলে তাঁর জন্ম হতো না এবং জন্ম না হলে তিনি পাপ করতেন না ।‘ কিন্তু বুদ্ধ কখনোই উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাননি। তাঁর মতে, আমার দুঃখ আমারই সৃষ্টি। শুধু দুঃখ নয়, এমনকি আমাদের জন্মের জন্যও আমরাই দায়ী। জন্মলাভের বাসনা থেকেই আমাদের জন্ম হয়েছে।

Pragmatism সম্প্রতিক কালের আর একটি দর্শন। এ দর্শনের মূল বক্তব্য হলো, যা কাজে লাগে এবং যা প্রয়োজনীয় ত-ই সত্য, তা-ই আলোচ্য ও বিবেচ্য হওয়া উচিত। সম্ভবত গৌতম বুদ্ধই প্রয়োগবাদেরও পুরোধা। মালুক্য পুত্রের তত্ত্ববিদ্যা বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে তিনি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, কেউ যদি তীর বিদ্ধ হয় তাহলে কী তার প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত ? যেহেতু সে কষ্ট পাচ্ছে, সেহেতু সে প্রথমে তীরটা খুলবে। এর আগে সে নিশ্চয়ই ভাববে না, তীরটা কী গতিতে এল, তীরটা কে মারল, তীরটা কীসের তৈরী। তাই আমরা যেহেতু দুঃখের সাগরে ভাসছি, আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত এই দুঃখের হাত থেকে কিভাবে বাঁচা যায় তার চেষ্টা করা। বুদ্ধের মতে, আমাদের কাছে এর চেয়ে বড় সত্য আর নেই।

সমকালীন দর্শনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো Logical positivism. এ মত অনুসারে principle of verification হচ্ছে সত্যের মানদণ্ড। যে বাক্যকে পরখ করা যায় না তা অর্থহীন। তাঁদের মতে, তত্ত্ববিদ্যাবিষয়ক অবধারণ এই পরখনীতির আওতায় পড়ে না। তাই এরা অর্থহীন।

গৌতম বুদ্ধ পরখনীতির উল্লেখ না করলেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তত্ত্ববিদ্যায় আলোচ্য বক্তব্য প্রমাণও করা যায় না আবার অপ্রমাণও করা যায় না। গৌতম বুদ্ধ সর্বপ্রকার চরম মত ও পথের বিরোধী ছিলেন। সম্ভবত এটা তাঁর ব্যক্তি জীবনেরই অভিজ্ঞতার ফল। তিনি মধ্যমা প্রতিপদ বা মধ্যম পথকেই উত্তম পথ বলে স্বীকার করেছেন। অ্যারিস্টটল যে Golden Mean এর কথা বলেছেন তা তাঁর ২০০ বছর আগে গৌতম বুদ্ধই বলে গেছেন। বস্তুত বুদ্ধের মধ্যমা প্রতিপদ ও অ্যারিস্টটলের Golden Mean এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা কঠিন।

অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের আর একটি শাখা বলে মনে করেন। কেউ আবার মনে করেন, বৌদ্ধধর্মের মধ্যেই হিন্দুধর্ম পূণর্তা লাভ করেছে। যেমন, স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় বলেছেন, ‍’ Buddhism is the fulfillment of Hinduism.’ অনেকে আবার বৌদ্ধধর্মের সাথে খ্রীষ্ট ধর্মের মিল খুঁজে পেয়ে এদের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্বন্ধ আছে কিনা তা খুঁজতে চান।

বুদ্ধ ব্যবহৃত উপমাগুলি এবং যিশু খ্রীষ্টের প্যারাবেলস –এর মধ্যে সাদৃশ্য এত ঘনিষ্ঠ যে, তাহা শুধু chance coincidence বলে যেন সন্তুষ্ট হওয়া যায় না। যেমন বুদ্ধের উপমাগুলি ভারতের পূর্ববর্তী সাহিত্যে পাওয়া যায় না তেমন যীশুর প্যারাবেলস বাইবেলের পূরাভাগে পাওয়া যায় না। গৌতম বুদ্ধ ও যীশু খ্রিষ্টের শিক্ষার মিল আমাদের চিন্তাকে নাড়া না দিয়ে পারে না।

আমার জানা মতে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোন মনীষীর আবির্ভাব ঘটেনি যিনি গৌতম বুদ্ধের মতো একাধারে নৈতিক শিক্ষার প্রবক্তা ও সমাজ সংস্কারক এবং যার দর্শনকে অস্তিত্ববাদ, প্রয়োগবাদ ও যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সব ধর্মের শিক্ষিত প্রবক্তাদের কাছে তিনি সমাদৃত এবং এ বিষয়ে তিনি সত্যিই অনন্য। রাজত্বের লোভ ত্যাগ করে তিনি সত্যের সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। আজ তাই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়সিংহাসনে তিনি সমাসীন।

তথ্যসূত্র : গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন।

আঁকা : রিয়া দাশগুপ্ত।

10 thoughts on “গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম

  1. ইতিহাস ঐতিহ্য আর ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ পড়লাম কবি রিয়া রিয়া। ছবিটি অসাধারন।

    1. নিরন্তর শুভেচ্ছা প্রিয় বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম। সন্দে নেই কবি রিয়া রিয়া। অভিনন্দন আপনার আঁকা ছবিটির জন্য। অসাধারণ হয়েছে। 

    1. ধন্যবাদ কবি সুমন আহমেদ দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অন্যতম।

    1. নিঃসন্দেহে কবি দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  4. বেশ লাগলো। শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।   

  5. আপনার লেখা পাঠ করে অন্য ধরণের অনুভূতি আসে। আপনার লেখা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও বিদ্রোহী কবি নজরুল শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করে অনেক অজানা
    তথ্যের সন্ধান পাই।

    আজও এই ধর্মমূলক লেখা পাঠ করে বুদ্ধের সারকথা জানলাম।
    সুন্দর লেখেন আপনি। সাথেই থাকবেন এটা প্রত্যাশা করি।
    আন্তরিক অভিনন্দন প্রিয়কবি ও লেখিকা।

    শুভেচ্ছা রইল সবসময়।
    জয়গুরু!

    1. আপনার জন্যও শুভেচ্ছা রইল সবসময় কবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।