ট্যাগ আর্কাইভঃ নিতাই বাবু

জীবনের গল্প-১৫

জীবনের গল্প-১৪-এর শেষাংশ: দুইদিন পর থেকে কাজ জয়েন্ট করবো বলে, অফিস থেকে বের হলাম। নিচে এসে সব তাঁতিদের সাথে দেখা করে মিল থেকে বের হওয়ার সময় মিস্ত্রি আমার হাতে ২০০/= টাকা দিয়ে বললো, এটা আজকের কাজের মজুরি। ২০০/= টাকা থেকে কানাইকে ১০০/= টাকা দিয়ে মিল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় গিয়ে বড় দাদাকে সবকিছু জানালাম। বড়দাদা খুশি হলেন। মাও খুশি হলেন। পরদিন সকালে ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কানাইকে নিয়ে কাজ করলাম। কাজ সেরে বড় দাদাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, আমি ফরিদপুর যাওয়ার পর যেই লোক কাজ করেছিলো; আগামীকাল থেকে ফতুল্লার ঐ লোকই এখানে কাজ করবে। জানানোর পর ম্যানেজার সাহেব রাগ করিনি। রাগ না করার কারণও ছিলো, কারণ হলো, ফাইন টেক্সটাই মিলের কাজ হলো চুক্তিতে। ভীম প্রতি ৭০ টাকা। এতে প্রতিমাসে আমি ২০০০/= টাকার বেশি রোজগার করতে পারতাম না। আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেতনভুক্ত। কাজ হোক আর না হোক, মাস শেষে আমার মূল বেতন হতে আসবেই। ম্যানেজার সাহেব আমার বেতন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, বেতন কত? বললাম, ‘বেশি না স্যার, মাত্র ৬০০০/=টাকা। তা শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হলেন।

এরপর ফতুল্লা গেলাম, কথা বলে রাখা ওই লোককে খুঁজতে। তাঁকে খুঁজে বের করে আগামীকাল সকাল থেকেই ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করার জন্য বললাম। তিনি তাতে রাজি হলেন, খুশিও হলেন। আমরা দুইজন বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পথেই কানাইর সাথেও ওঁর বেতন নিয়ে ফয়সালা করে ফেললাম। কানাইকে প্রতিমাসে ১৫০০/=টাকা দিতে হবে। ও অবশ্য ২০০০/=টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওঁর সারাদিনের টুকটাক খরচ আমার উপর নিয়ে ওঁকে ১৫০০/= টাকায়ই রাজি করলাম। কানাইরও এটা ছিলো প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। তাই আর ও বেশি মন খারাপ করেনি বরং খুশিই হয়েছিলো। এর পরদিন থেকেই ওয়েল টেক্সে কাজ করা শুরু করি। দুইদিন পরই মিলের দুইজন অপরিচিত শ্রমিক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো মিলের বাইরে। মিলের বাইরে গিয়ে এক চায়ের দোকানে আমাকে বসতে দিলেন, তাঁরাও বসলেন। তাঁদের একজনের নাম, মোহাম্মদ হাসেম মিয়া। আরেকজনের নাম, নূরমোহাম্মদ।

আমি মনে মনে ভাবছি, তাঁরা কি আমার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করবে নাকি! কিন্তু না, তাঁরা আমাকে বললো, ‘আপনি এখানে এসে সব শ্রমিকদের বাঁচালেন। এতে আমরা খুবই খুশি! তবে দাদা একটা কথা ছিলো–যদি কারোর কাছে না বলেন, তাহলে আপনাকে খুলে বলতে পারি!’ তাঁদের কতা শুনে আমি বললাম, ‘বলুন, কী বলতে চান?’ আমার কথায় তাঁরা হাসলে! বললে, ‘আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সাথে থাকবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এমন কী কাজ যে, আপনারা আমার সহযোগিতা চাচ্ছে?’ বললেন, ‘আমরা অলরেডি মিলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করে ফেলেছি! তার কাগজপত্র দুইএক দিনের মধ্যে হতে আসলেই, আমরা মিল গেইটে সাইনবোর্ড টাঙাবো। এখন খরচ বাবদ আপনাকে সবার সমতুল্য পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে।’ তাঁদের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি হলাম! তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাঁদা কত?’ বললো, ‘বেশি না দাদা, মাত্র ৭০০/=টাকা।’ আমি বললাম, ‘আমিতো কেবলমাত্র মিলে জয়েন করলাম দাদা। ৭০০/=টাকা নিতে হবে আমার বেতন হলে।’ আমার কথায় তাঁরা দুইজন খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা, তা আপনি বেতন হলেই দিবেন; কিন্তু এব্যাপারে কারোর সাথে কিছু বলবেন না। যদি বলেন, তাহলে হয়তো এক কান, দুই কান হতে হতে মালিকের কানে চলে যেতে পারে। তাতে আমাদের সকলের সমস্যা হতে পারে!’ এই বলেই চা দোকান থেকে উঠে মিলে গিয়ে কাজ করলাম।

মিলের কাজ সেরে সারাদিন পর বাসায় গেলাম। মিলের ইউনিয়নের ব্যাপারে বড় দাদার সাথে আলাপ করলাম। আমার কথা শুনে আমার বড়দাদা খুশি হলেন! এর কয়েকদিন পরই মিলের গেইটে বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা, ওয়েল টেক্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তা দেখে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মাথা নষ্ট হলেও, মিলের শ্রমিকদের হইহুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তি শুরু হয়ে হলো। মিল মালিক নিরুপায় হয়ে একসময় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনেও নিলো। মিলের সব শ্রমিকদের চাকরিও পাকাপোক্ত হলো। একসময় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের ঘন্টা বেজে উঠলে, ফাইন টেক্সটাইল মিল থেকে ঐ কালাম একদিন আমার সাথে দেখা করতে ওয়েল টেক্সে আসে। কালাম এসে এই ঈদে ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুরোধ করলো। আমি ঈদের ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কালামকে কথাও দিলাম। কালাম খুব খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এর দুইদিন পরই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এর আগেই কানাইকে বলে রেখেছিলাম, ঈদের দিন সকলেই সেজেগুজে ওঁদের বাসা থেকে আমার বাসায় চলে আসতে। কানাই আমার কথার বরখেলাপ করলো না, ঈদের দিন সকালে ঠিক সময়ে কানাই আমার চলে আসলো। আমি মায়ের কাছে বলে-কয়ে কানাইকে সাথে নিয়ে সুবচনীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মিনিবাসে চড়ে গেলাম ফতুল্লা। নামলাম ফতুল্লা লঞ্চঘাটের সামনেই। লঞ্চঘাটের টোল দিলাম জনপ্রতি আট আনা করে দুইজনের ১টাকা। বালিগাঁওর লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটেই যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলো। তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে দুইজন উপরেই দাঁড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো। ফতুল্লা থেকে সুবচনী যেতে কয়েকটি ঘটে যাত্রী ওঠানামা করে। ফতুল্লার পর বক্তবলী। এরপর কাঠপট্টি, বেতকা, তালতলা, সুবচনী। সবশেষে বালিগাঁও। কালাম এর আগের বার যাওয়ার সময়টা ঠিক রেখে সময়মতো লঞ্চঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লাঞ্চ সুবচনী ঘাটে ভিড়ানোর পর আমারা লঞ্চ থেকেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা লঞ্চ থেকেই কালামকে হাতে ইশারা দিয়ে সুবচনী ঘাটে নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই আমি কানাইর হাতে ৩০০/= টাকা দিয়ে বাজারের ভেতরে পাঠালাম, পান-সুপারি-সহ কিছু মিষ্টি ও কিছু ফলফলাদির জন্য। আমি আর কালাম একটা চা দোকানে ঢুকলাম, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। কানাই আমার কথামতো সবকিছু ঠিকঠাক মতো কেনাকাটা করে চায়ের দোকানে আসলো। চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে কালামদের নিজেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম নিজেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে।

বর্ষাকালে সুবচনীর খালটা ঠিক নদীর মতো দেখা যায়। সেসময় খালে খুব স্রোত থাকে। সুবচনীর খানটা যখন পাড় হচ্ছিলাম, আমার তখন ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মনের ভয়টা টের পেয়েছে আমার বন্ধু কানাই। কানাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসল। তবু আমার ভেতর থেকে ভয় যাচ্ছিল না। খাল পাড় হয়ে নৌকা যখন ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো, তখনই আমার মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। নৌকা চলছে, আর আমি নৌকা থেকে আশে-পাশে থাকা গ্রামের ঘরবাড়িগুলো দেখছিলাম, মন ভরে। নৌকা থেকে পানির নিচের দিকে চেয়ে দেখি, বর্ষার স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে কতরকমের উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলে-দুলে নাচছে। নৌকা চলছে, কথাও চলছে কালামের সাথে। আমি নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে জলকেলি খেলা খেলছি। কখনও আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছি। এভাবে নৌকা চলতে-চলতে একসময় আমরা কালামদের বাড়ির সামনে চলে আসলাম।

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ার আগেই কালাম বলছে, ‘এসে গেছি ওস্তাদ! কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি, এ কী কাণ্ড! এখানে এত মানুষ কেন? আমি কালামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালাম, বাড়ির ঘাটে এত মানুষ কেন?’ কালাম বলল, ‘ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আবার হলেন আমার ওস্তাদ! তাই এতো মানুষ! এর আগে আমাদের বাড়ি এসেই তো সবার মন জোগাড় করে ফেলেছেন। আপনারা আসবেন, তা আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেই গ্রামের সবাইর কাছে বলেছিলাম। আবার আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে সুবচনী যাওয়ার সময়ও বাড়ির সবার কাছে বলে গিয়েছিলাম। তাই পাশের বাড়ির পোলাপানও ঘাটে অপেক্ষায় আছে। নামেন নামেন ওস্তাদ!’ ১০/১২ জন ছেলে-বুড়ে দেখে নিজের কাছে কেমন যেন শরম-শরম লাগছিল আমার। তবু নির্লজ্জের মতোই কানাই আর আমি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠলাম। নৌকা থেকে নামার সময় মিষ্টি আর ফলগুলো কালাম হাতে নিয়ে নিল। সেদিন কালামদের ঘরটা আগে থেকেই পরি-পাটি করে রাখা হয়েছিল। ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস সরবত। সাথে আমাদের নেওয়া কিছু মিষ্টিও দিলো। কানাই আর আমি খেলাম। কালামের মা বড় ভাবীর সাথে কথা বললাম। কালামদের ঘর থেকে বের হলাম। সামনেই ঠাকুরবাড়ির বিশাল পুকুর। আমার উদ্দেশ্য হলো ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।

কালামদের নয়াবাড়ি গ্রামটি দেখতে ঠিক সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো। আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয়। পুরো গ্রামটির মাঝখানেই ঠাকুরবাড়ির এই বিশাল পুকুরটি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল পুরো গ্রামের লোক এই পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ড দেয়। খেলা-ধুলাও চলে। কেউ লুডু। কেউ ষোলগুটি। কেউ তাসখেলা।আমরা পুকুর ঘাটে আসার সময় কালামের বড়ভাই সালামও আমাদের সাথে ছিল। তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। বর্ষাকাল, গ্রামের মানুষের কাজকর্ম নেই, তাই সময় কাটানোর আড্ডা। আমাদের দেখেই সবাই তাকিয়ে আছে। দুই-একজন লোক আবার হাতের তাস রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি ঘাটলায় যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের নমস্কার জানালাম। যাঁরা এর আগের বার আমাদের দেখেনি, তাঁদের মধ্যে একজন লোক কালামের বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?’ আরও অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলো। কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরা একজন আমার ছোট ভাই কালামের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু। কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঈদের বন্ধ পেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে।’ কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে মুরুব্বি দুইজন হ্যাণ্ডশেক করলো। সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে বললো। আমরা দুইজন বসলাম।

আমি ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছিলাম। কারণ, বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই। আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর। আবার বাড়ির ভেতরে একটা বড় ঠাকুরঘ। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলা! বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি ভরা। আমরা ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো। ওদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা দুই বোন। ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বললাম, ‘কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটু জেনে নে।’ কালাম তখন ঘাটলায় ছিলো না। কালাম গেছে আবার সুবচনী বাজারে। আমাদের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া। আমার কথায় কানাই সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। কিছুক্ষণ পর কানাই আমার কাছে এলো।

আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কানাই, সালাম ভাই কী বললো?’ আমার কথার উত্তরে কানাই বললো, ‘সালাম দাদা বললো, ‘তোকে এই গ্রামেই বিয়ে করাবে, বুজলি।’ আমি বললাম, ‘বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল! যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি! আমার মায়ের খুবই কষ্ট হচ্ছে রে কানাই। বিয়েটা তাড়াতাড়িই করতে হবে।’ কানাই আমার কথার জবাবে বললো, ‘মেয়ে তো কয়েকবারই এখানে বসে বসে দেখেছিস। এবার বল, পছন্দ হয়েছে কিনা?’ আমি কানাইর কথায় অবাক হয়নি! কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছিল!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৬ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৪

জীবনের গল্প-১৩-এর শেষাংশ: দুইদিন পর থেকে কাজ জয়েন্ট করবো বলে, অফিস থেকে বের হলাম। নিচে এসে সব তাঁতিদের সাথে দেখা করে মিল থেকে বের হওয়ার সময় মিস্ত্রি আমার হাতে ২০০/= টাকা দিয়ে বললো, এটা আজকের কাজের মজুরি। ২০০/= টাকা থেকে কানাইকে ১০০/= টাকা দিয়ে মিল থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় গিয়ে বড় দাদাকে সবকিছু জানালাম। বড়দাদা খুশি হলেন। মাও খুশি হলেন। পরদিন সকালে ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কানাইকে নিয়ে কাজ করলাম। কাজ সেরে বড় দাদাকে সাথে নিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে জানিয়ে দিলাম, আমি ফরিদপুর যাওয়ার পর যেই লোক কাজ করেছিলো; আগামীকাল থেকে ফতুল্লার ঐ লোকই এখানে কাজ করবে। জানানোর পর ম্যানেজার সাহেব রাগ করিনি। রাগ না করার কারণও ছিলো, কারণ হলো, ফাইন টেক্সটাইল মিলের কাজ হলো চুক্তিতে। ভীম প্রতি ৭০ টাকা। এতে প্রতিমাসে আমি ২০০০/= টাকার বেশি রোজগার করতে পারতাম না। আর এখন যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেতনভুক্ত। কাজ হোক আর না হোক, মাস শেষে আমার মূল বেতন হতে আসবেই। ম্যানেজার সাহেব আমার বেতন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, বেতন কত? বললাম, ‘বেশি না স্যার, মাত্র ৬০০০/= টাকা। তা শুনে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশি হলেন।

এরপর ফতুল্লা গেলাম, কথা বলে রাখা ওই লোককে খুঁজতে। তাঁকে খুঁজে বের করে আগামীকাল সকাল থেকেই ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করার জন্য বললাম। তিনি তাতে রাজি হলেন, খুশিও হলেন। আমরা দুইজন বাসায় রওনা দিলাম। বাসায় যাওয়ার পথেই কানাইর সাথেও ওঁর বেতন নিয়ে ফয়সালা করে ফেললাম। কানাইকে প্রতিমাসে ১৫০০/= টাকা দিতে হবে। ও অবশ্য ২০০০/= টাকা চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওঁর সারাদিনের টুকটাক খরচ আমার উপর নিয়ে ওঁকে ১৫০০/= টাকায়ই রাজি করলাম। কনাইরও এটা ছিলো প্রথম বেতনভুক্ত চাকরি। তাই আর ও বেশি মন খারাপ করেনি বরং খুশিই হয়েছিলো। এর পরদিন থেকেই ওয়েল টেক্সে কাজ করা শুরু করি। দুইদিন পরই মিলের দুইজন অপরিচিত শ্রমিক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো মিলের বাইরে। মিলের বাইরে গিয়ে এক চায়ের দোকানে আমাকে বসতে দিলেন, তাঁরাও বসলেন। তাঁদের একজনের নাম, মোহাম্মদ হাসেম মিয়া। আরেকজনের নাম, নূরমোহাম্মদ।

আমি মনে মনে ভাবছি, তাঁরা কি আমার কাছ থেকে চাঁদা দাবি করবে নাকি! কিন্তু না, তাঁরা আমাকে বললো, ‘আপনি এখানে এসে সব শ্রমিকদের বাঁচালেন। এতে আমরা খুবই খুশি! তবে দাদা একটা কথা ছিলো–যদি কারোর কাছে না বলেন, তাহলে আপনাকে খুলে বলতে পারি!’ তাঁদের কতা শুনে আমি বললাম, ‘বলুন, কী বলতে চান?’ আমার কথায় তাঁরা হাসলে! বললে, ‘আমরা একটা কাজ করতে যাচ্ছি, আশা করি আমাদের সাথে থাকবে।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা এমন কী কাজ যে, আপনারা আমার সহযোগিতা চাচ্ছে?’ বললেন, ‘আমরা অলরেডি মিলে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করে ফেলেছি! তার কাগজপত্র দুইএক দিনের মধ্যে হতে আসলেই, আমরা মিল গেইটে সাইনবোর্ড টাঙাবো। এখন খরচ বাবদ আপনাকে সবার সমতুল্য পরিমাণ চাঁদা দিতে হবে।’ তাঁদের কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই খুশি হলাম! তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাঁদা কত?’ বললো, ‘বেশি না দাদা, মাত্র ৭০০/=টাকা।’ আমি বললাম, ‘আমিতো কেবমাত্র মিলে জয়েন করলাম দাদা। ৭০০/= টাকা নিতে হবে আমার বেতন হলে।’ আমার কথায় তাঁরা দুইজন খুশি হয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা, তা আপনি বেতন হলেই দিবেন; কিন্তু এব্যাপারে কারোর সাথে কিছু বলবেন না। যদি বলেন, তাহলে হয়তো এক কান, দুই কান হতে হতে মালিকের কানে চলে যেতে পারে। তাতে আমাদের সকলের সমস্যা হতে পারে!’ এই বলেই চা দোকান থেকে উঠে মিলে গিয়ে কাজ করলাম।

মিলের কাজ সেরে সারাদিন পর বাসায় গেলাম। মিলের ইউনিয়নের ব্যাপারে বড় দাদার সাথে আলাপ করলাম। আমার কথা শুনে আমার বড়দাদা খুশি হলেন! এর কয়েকদিন পরই মিলের গেইটে বড় একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হলো। সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা, ওয়েল টেক্স শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন তা দেখে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মাথা নষ্ট হলেও, মিলের শ্রমিকদের হইহুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তি শুরু হয়ে হলো। মিল মালিক নিরুপায় হয়ে একসময় শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনেও নিলো। মিলের সব শ্রমিকদের চাকরিও পাকাপোক্ত হলো। একসময় পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের ঘন্টা বেজে উঠলে, ফাইন টেক্সটাইল মিল থেকে ঐ কালাম একদিন আমার সাথে দেখা করতে ওয়েল টেক্সে আসে। কালাম এসে এই ঈদে ওঁদের বাড়ি বেড়াতে যেতে অনুরোধ করলো। আমি ঈদের ছুটিতে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কালামকে কথাও দিলাম। কালাম খুব খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলো।

এর দুইদিন পরই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর। এর আগেই কানাইকে বলে রেখেছিলাম, ঈদের দিন সকলেই সেজেগুজে ওঁদের বাসা থেকে আমার বাসায় চলে আসতে। কানাই আমার কথার বরখেলাপ করলো না, ঈদের দিন সকালে ঠিক সময়ে কানাই আমার চলে আসলো। আমি মায়ের কাছে বলে-কয়ে কানাইকে সাথে নিয়ে সুবচনীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মিনিবাসে চড়ে গেলাম ফতুল্লা। নামলাম ফতুল্লা লঞ্চঘাটের সামনেই। লঞ্চঘাটের টোল দিলাম জনপ্রতি আট আনা করে দুইজনের ১টাকা। বালিগাঁওর লঞ্চ ফতুল্লা ঘাটেই যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলো। তাড়াতাড়ি লঞ্চে উঠে দুইজন উপরেই দাঁড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো। ফতুল্লা থেকে সুবচনী যেতে কয়েকটি ঘটে যাত্রী ওঠানামা করে। ফতুল্লার পর বক্তবলী। এরপর কাঠপট্টি, বেতকা, তালতলা, সুবচনী। সবশেষে বালিগাঁও। কালাম এর আগের বার যাওয়ার সময়টা ঠিক রেখে সময়মতো লঞ্চঘাটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। লাঞ্চ সুবচনী ঘাটে ভিড়ানোর পর আমারা লঞ্চ থেকেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লঞ্চের যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা লঞ্চ থেকেই কালামকে হাতে ইশারা দিয়ে সুবচনী ঘাটে নামলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই আমি কানাইর হাতে ৩০০/= টাকা দিয়ে বাজারের ভেতরে পাঠালাম, পান-সুপারি-সহ কিছু মিষ্টি ও কিছু ফলফলাদির জন্য। আমি আর কালাম একটা চা দোকানে ঢুকলাম, চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকাল হতে চলছিল। কানাই আমার কথামতো সবকিছু ঠিকঠাক মতো কেনাকাটা করে চায়ের দোকানে আসলো। চা-বিস্কুটের দাম দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে কালামদের নিজেদের নৌকায় গিয়ে উঠলাম। নৌকার মাঝি সেজেছে কালাম নিজেই। নৌকা চলছে হেলেদুলে।

বর্ষাকালে সুবচনীর খালটা ঠিক নদীর মতো দেখা যায়। সেসময় খালে খুব স্রোত থাকে। সুবচনীর খানটা যখন পাড় হচ্ছিলাম, আমার তখন ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আমার মনের ভয়টা টের পেয়েছে আমার বন্ধু কানাই। কানাই আমাকে শক্ত করে ধরে বসল। তবু আমার ভেতর থেকে ভয় যাচ্ছিল না। খাল পাড় হয়ে নৌকা যখন ফসলি জমির ওপর দিয়ে ছুটলো, তখনই আমার মন থেকে কিছুটা ভয় দূর হলো। নৌকা চলছে, আর আমি নৌকা থেকে আশে-পাশে থাকা গ্রামের ঘরবাড়িগুলো দেখছিলাম, মন ভরে। নৌকা থেকে পানির নিচের দিকে চেয়ে দেখি, বর্ষার স্বচ্ছ পরিস্কার পানির ওপর থেকে জমির নিচ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পানির নিচে কতরকমের উদ্ভিদ ঢেউয়ের সাথে হেলে-দুলে নাচছে। নৌকা চলছে, কথাও চলছে কালামের সাথে। আমি নৌকার কার্নিশে বসে পানির সাথে জলকেলি খেলা খেলছি। কখনও আবার ভেসে থাকা জাতীয় ফুল শাপলা টেনে তুলছি। এভাবে নৌকা চলতে-চলতে একসময় আমরা কালামদের বাড়ির সামনে চলে আসলাম।

বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ার আগেই কালাম বলছে, ‘এসে গেছি ওস্তাদ! কালামের কথা শুনে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে দেখি, এ কী কাণ্ড! এখানে এত মানুষ কেন? আমি কালামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালাম, বাড়ির ঘাটে এত মানুষ কেন?’ কালাম বলল, ‘ওস্তাদ, আপনারা নারায়ণগঞ্জের মানুষ। আবার হলেন আমার ওস্তাদ! তাই এতো মানুষ! এর আগে আমাদের বাড়ি এসেই তো সবার মন জোগাড় করে ফেলেছেন। আপনারা আসবেন, তা আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়ি এসেই গ্রামের সবাইর কাছে বলেছিলাম। আবার আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি থেকে সুবচনী যাওয়ার সময়ও বাড়ির সবার কাছে বলে গিয়েছিলাম। তাই পাশের বাড়ির পোলাপানও ঘাটে অপেক্ষায় আছে। নামেন নামেন ওস্তাদ!’ ১০/১২ জন ছেলে-বুড়ে দেখে নিজের কাছে কেমন যেন শরম-শরম লাগছিল আমার। তবু নির্লজ্জের মতোই কানাই আর আমি নৌকা থেকে নেমে পাড়ে ওঠলাম। নৌকা থেকে নামার সময় মিষ্টি আর ফলগুলো কালাম হাতে নিয়ে নিল। সেদিন কালামদের ঘরটা আগে থেকেই পরি-পাটি করে রাখা হয়েছিল। ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে সামনে দিল দুই গ্লাস সরবত। সাথে আমাদের নেওয়া কিছু মিষ্টিও দিলো। কানাই আর আমি খেলাম। কালামের মা বড় ভাবীর সাথে কথা বললাম। কালামদের ঘর থেকে বের হলাম। সামনেই ঠাকুরবাড়ির বিশাল পুকুর। আমার উদ্দেশ্য হলো ঘাটে গিয়ে কিছুক্ষণ বসবো।

কালামদের নয়াবাড়ি গ্রামটি দেখতে ঠিক সেন্টমার্টিনের একটা দ্বীপের মতো। আয়তনে বেশি একটা বড় না হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে কম নয়। পুরো গ্রামটির মাঝখানেই ঠাকুরবাড়ির এই বিশাল পুকুরটি। প্রতিদিন সকাল-বিকাল পুরো গ্রামের লোক এই পুকুর ঘাটলায় বসে আড্ড দেয়। খেলা-ধুলাও চলে। কেউ লুডু। কেউ ষোলগুটি। কেউ তাসখেলা।আমরা পুকুর ঘাটে আসার সময় কালামের বড়ভাই সালামও আমাদের সাথে ছিল। তখন ঘাটলায় চলছিল গ্রামের ছেলে-বুড়োদের আড্ডা। বর্ষাকাল, গ্রামের মানুষের কাজকর্ম নেই, তাই সময় কাটানোর আড্ডা। আমাদের দেখেই সবাই তাকিয়ে আছে। দুই-একজন লোক আবার হাতের তাস রেখে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি ঘাটলায় যাদের দেখতে মুরুব্বির মতো, তাদের নমস্কার জানালাম। যাঁরা এর আগের বার আমাদের দেখেনি, তাঁদের মধ্যে একজন লোক কালামের বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কারা? বাড়ি কোথায়? কী করে?’ আরও অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করলো। কালামের বড়ভাই, মুরুব্বিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ‘এরা একজন আমার ছোট ভাই কালামের ওস্তাদ, আরেকজন বন্ধু। কালাম যেই মিলে কাজ করে, সেই মিলের ওস্তাদ। তাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঈদের বন্ধ পেয়ে আমাদের বাড়ি এসেছে বেড়াতে।’ কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে মুরুব্বি দুইজন হ্যাণ্ডশেক করলো। সিঁড়ি ঘাটলায় বসতে বললো। আমরা দুইজন বসলাম।

আমি ঘাটে বসেই সত্যগুরুর বাড়িটির দিকেই বেশি ফলো করছিলাম। কারণ, বাড়িটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল, তাই। আগের দিনের তৈরি বাড়ি, সাথে তিন চারটা ঘর। আবার বাড়ির ভেতরে একটা বড় ঠাকুরঘ। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলা! বাড়ির চারদিকে গাছগাছালি ভরা। আমরা ঘাটে বসা থাকতেই ওই বাড়ি থেকে দুটি মেয়ে আসলো। ওদের দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, ওরা দুই বোন। ধারণা সঠিক কি না, তা যাচাইয়ের জন্য কানাইকে বললাম, ‘কানাই, মেয়ে দুইটি কে? তুই সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে একটু জেনে নে।’ কালাম তখন ঘাটলায় ছিলো না। কালাম গেছে আবার সুবচনী বাজারে। আমাদের সাথে বসা আছে কালামের বড়ভাই সালামা মিয়া। আমার কথায় কানাই সালাম ভাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটু আড়ালে। কিছুক্ষণ পর কানাই আমার কাছে এলো।

আমি কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে কানাই, সালাম ভাই কী বললো?’ আমার কথার উত্তরে কানাই বললো, ‘সালাম দাদা বললো, ‘তোকে এই গ্রামেই বিয়ে করাবে, বুজলি।’ আমি বললাম, ‘বলে কী? তো মেয়ে কোথায়? মেয়ে দেখাতে বল! যদি আমার পছন্দ হয় তবে বিয়ে করতেও পারি! আমার মায়ের খুবই কষ্ট হচ্ছে রে কানাই। বিয়েটা তাড়াতাড়িই করতে হবে।’ কানাই আমার কথার জবাবে বললো, ‘মেয়ে তো কয়েকবারই এখানে বসে বসে দেখেছিস। এবার বল, পছন্দ হয়েছে কিনা?’ আমি কানাইর কথায় অবাক হয়নি! কেন হয় নি? সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখা যাচ্ছিল!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৫ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১৩

জীবনের গল্প-১২-এর শেষাংশ: খেলাম শরবত। এরপর কালামের মা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য বললো। কলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য আমাদের নিয়ে গেলো, একটা পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে। পুকুরের সিঁড়ি ঘাটটা হলো এক হিন্দু বাড়ির। পুকুর ঘাট থেকে হাত-পা ধুয়ে কালামদের বাড়িতে আসলাম। ভাত খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম।

কালামদের ঘরে খাওয়া-দাওয়া করে মনে করেছিলাম, সেদিনই নারায়ণগঞ্জ ফিরে যাবো। কিন্তু বিশ্রাম করতে গিয়ে তা আর হলো না, ফেরা। ঘুম থেকে জেগে ওঠতেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমার সাথে কানাইরও একই অবস্থা। কানাইও আর সজাগ পায়নি। কানাইকে ডেকে ওঠালাম। বললাম, ‘তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নেয়, এখনই বের হবো।’ আমার কথা শুনে কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই রাত করে নারায়ণগঞ্জ যেতে বারণ করলে, আমরা দুইজন এক রাতের জন্য থেকে যাই কালামদের বাড়িতেই। এরপর কালাম আমাদের সাথে করে ঠাকুরবাড়ির পুকুর ঘাটে নিয়ে আসলো।

এই ঠাকুরবাড়িই বিয়ের উপযুক্ত একটা মেয়ে আছে, যা আগে কালাম আমার কাছে অনেক বলেছিল। কিন্তু মেয়ে দেখার মন-মানসিকতা নিয়ে কালামদের ওখানে আমরা যাইনি। আমরা গিয়েছি বেড়াতে। যখন কালামদের বাড়ি থেকে সন্ধ্যাবেলা এই ঠাকুরবাড়ির পুকুর ঘাটে আসি, তখন দেখলাম ঠাকুরবাড়ি থেকে কয়েকজন মহিলা আমাদের দেখে কেমন যেন হাঁকাহাঁকি করে চুপেচাপে দেখছিল। তখন ছিলো ভরা বর্ষা মৌসুম। নয়াবাড়ি গ্রমের চারদিকে পানি আর পানি। হাট-বাজারে যেতে হলে নৌকা ছাড়া আর কারোর উপায় ছিল না। আর রাতবিরেতে গ্রামের মানুষ অন্তত বর্ষাকালে অনেকেই বেশি একটা ঘোরা-ফেরাও করতো না। রাতের খাবারের আগপর্যন্ত এই ঠাকুরবাড়ি সিঁড়ি ঘাটেই বসে আড্ডা দিতো, সময় কাটাতো।

কালামের সাথে আমরা যখন পুকুর ঘাটে গেলাম, তখনও পুরো সিঁড়ি ঘাটলা ছিলো লোকে গিজগিজ। কালামের সাথে আমাদের দুইজনকে দেখে সিঁড়ি ঘাটলা থেকে কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়ে কানাই আর আমাকে বসতে দিলে, আমরা দুইজন বসলাম। ঠাকুরবাড়ি থেকেও একজন মুরুব্বি এসে আমাদের সাথেই বসলেন। কালামকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর ওস্তাদের বাড়ি কোথায়, ঘর কোথায়, জাত সম্প্রদায় কী, মা-বাবা আছে নাকি নেই, ভাই-বোন ক’জন, কী কাজ করে ইত্যাদি।’ আমি কিছুই বললাম না, যা বলার কানাই আর কালামই বলেছিলো। এরপর ঠাকুরবাড়ির ওই মুরুব্বি আমাদের দুইজনকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যেতে বললে, আমি আর গেলাম না, কালামের সাথে কানাইকে পাঠালাম। কানাই কালামের সাথে গিয়ে তাঁদের ঘরে গিয়ে বসলে, আমাকে ডেকে আনতে একটা ছোট শিশকে সিঁড়ি ঘাটলায় পাঠালো। কিন্তু তখনও আমি ওই ঠাকুরবাড়িতে আর পেলাম না, সিঁড়ি ঘাটলায় বসে আরও মানুষের সাথে কথা বলতে থাকি। আমার সাথে কালামের বড় ভাইও বসা ছিলো। কালামের বড়ভাইও বলেছিল, ‘যাও ঘুরে দেখে আসো।’ তারপরও আমি ঠাকুরবাড়ি গেলাম না, পুকুরঘাটেই ছিলাম।

কিছুক্ষণ পর কানাই আর কালাম বড় এক বাটি ভরে গাছের পাকা পেয়ারা সিঁড়ি ঘাটলায় নিয়ে আসলো। আমাকে দুটো দিয়ে বাদবাকিগুলো ঘাটলায় থাকা দুইএক জনকে দিলো। সবাই পেয়ারা খাচ্ছিল। আমি কানাইকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই বাড়িতে এতক্ষণ কি করলি?’ কানাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘তোর ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল।’ বললাম, ‘বলে কী পাগলটায়! আমার ব্যাপারে জেনে তাঁদের কী হবে?’ কানাই বললো, ‘তোর জন্য কালাম যেই মেয়ের কথা মিলে থাকতে বাবার বলেছিল, ওই মেয়েটাকে আজ দেখলাম! খুবই সুন্দর!’ আমি আর কোনও কথা বললাম না, সোজা পুকুর ঘাটে এসে কালামকে বললাম, ‘কালাম বাড়ি চলো, ঘামাবো।’ আমার কথায় কালাম আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে আমাদের নিয়ে ওঁদের বাড়ির দিকে রওনা দিলো। বাড়িতে আসার সাথে সাথেই রাতের খাবার রেডি হয়ে আছে কালামদের ঘরে। কোনরকম হাতমুখ ধুয়ে কালাম-সহ বসে রাতের খাবার সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হালকা কিছু খাবার খেয়ে কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির বাইরে আসলাম। এমন সময় কানাই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির সবাইর থেকে বলেকয়ে আসি।’ আমি কানাইকে আর ওই বাড়িতে যেতে দিলাম না, সোজা কালামদের নৌকায় উঠে বসলাম। কালাম-সহ কালামের বড় ভাইও আমাদের সাথে নৌকায় উঠলো। উদ্দেশ্য আমাদের ঢাকার লঞ্চে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কালাম আমাদের নিয়ে নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজারে আসলো। আমরা নৌকা থেকে নেমে কালাম-সহ ওঁর বড়ভাইকে সাথে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। লঞ্চ আসতে আরও দেরি হবে বলে অনেকেই বলছিল। সেই সময়টুকু কালামের বড়ভাইয়ের সাথেই কথাবার্তা বলে পাড় করতে চাচ্ছিলাম।

এমন সময় কালামের বড়ভাই বলছিল, “মেয়েটা ভালো। কিন্তু গরিব। ওঁদের নিজস্ব জায়গা-জমি নেই। বাড়িটাও সত্যগুরু নামে একজন ঠাকুরের। তবে সত্যগুরুর আরও অনেক বছর আগে মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পরিবারের সবাই একসময় এই বাড়ি তাঁদের দান হিসেবে দিয়ে যায়। তারপর থেকে তাঁরা আজ অনেক বছর যাবত গ্রামের আরও দশজন মুসলমানের সাথে মিলেমিশে এই বাড়িতে বসবাস করছে। বাড়ির মুরুব্বির নাম নারায়ণ সরকার। উনার চার মেয়ে দুই ছেলে। মেয়েগুলো বড়, ছেলে দুটো মেয়েদের ছোট। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরও অনেক আগে। ছেলের বাড়ি নোয়াখালী জমিদারহাট। এখন অবিবাহিত আছে তিন মেয়ে। করলাম আরও অনেক আগেই তোমার কথা বলেছিল। কিন্তু তুমি তো ওই বাড়িতে গেলেই না। কেন গেলে না, তা আমার মাথায় ঢুকছে না। মেয়ে যখন দেখতে এসেছ, তখন মেয়েদের বাড়িতে গেলে না কেন?”

আমি কালামের বড় ভাইয়ের কথা শুনে হেসে বললাম, ‘দাদা, আমিতো আপনাদের এখানে কোনও মেয়ে দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। আমি এসেছি কালামকে দেওয়া কথা রক্ষা করতে। অন্যকিছু মনে করে আমি আসিনি, দাদা। অবশ্য কালাম-সহ ফাইন টেক্সটাইল মিলের আপনাদেরই গ্রামের আবুল মুন্সি, আপনার চাচা জব্বার কাকাও এই বাড়ির কথা অনেকবার বলেছিল। কিন্তু আমি তাঁদের কিছুই বলিনি। কারোর সাথে কথাও দেইনি। তাছাড়া এখনো আমার বিয়ের বয়স হয়নি দাদা। এই বয়সে বিয়ে করবো, এ চিন্তা আমি কখনোই করি না। যদি কপালে থাকে তাহলে কেউ আবার বাধাও দিতে পারবে না, যেকোনো একভাবে-না-একভাবে হবেই হবে।’ কালামের বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে একসময় বালিগাও থেকে সুবচনী লঞ্চঘাটে লঞ্চ এসে ভিরলো। কানাই আর আমি লঞ্চে উঠে এক জায়গায় দাড়ালাম। লঞ্চ ছাড়লো।

ফতুল্লা লঞ্চঘাটে নেমে নারায়ণগঞ্জ গেলাম। এরপর কানাই গেলো ওঁদের বাসায়, আমি আমার বড়দা’র বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। এর একদিন পরই ঈদের ছুটি শেষ হয়ে মিল চালু হলো। সব শ্রমিকরা যাঁর যাঁর বাড়ি থেকে এসে মিলে হাজির হলো। তখন ফাইন টেক্সটাইল মিলের বেশিরভাগ তাঁতিই ছিল সুবচনী এলাকার। আমরা যে ঈদের বন্ধে কালামদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তা পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম-সহ ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিকের বাড়ি পার্শ্ববর্তী কড়পাড়া গ্রাম পর্যন্ত জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। মিল চালু হবার পর সে বলে, ‘আমাদের বাড়ি গেলে না কেন? ও বলে আমাদের বাড়ি গেলে না কেন?’ বললাম, ‘আরে দাদারা, আমাদের কি আর কারোর বাড়ি চেনা আছে? তাছাড়া সারা গ্রামই তো আমাদের কাছে সাগরের মতো মনে হলো। এই অবস্থা দেখে কারোর বাড়িতে আর যেতে মন চায়নি দাদা। আবার সুদিনে একবার যখন যাবো, তখন সবার বাড়ি খুঁজে খুঁজে বের করে ঘুরে আসবো।’ অনেকেই আবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি-না? মেয়েদের বাড়িতে গিয়েছিলাম কি-না ইত্যাদি।’ এরকম আলাপ আলোচনার মধ্যে এসব কথা আমার বড়দ’র কানে পৌঁছে গেলো। বড়দা বাসায় গিয়ে বৌদির কাছে বললো। এরপর বৌদি আমার মায়ের কাছে বললো।

বিক্রমপুর বেড়াতে যাওয়ার কথা, মেয়ে দেখার কথা বৌদির কাছে মা শুনে আমাকে আর কিছুই বলেনি। জিজ্ঞাসাও করেনি যে, কোথায় গেয়েছিলি! জিজ্ঞেস করেছিল আমার বৌদি। বিক্রমপুর থেকে আসার দুইদিন পর বৌদি আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ঠাকুরপো মেয়ে কেমন দেখলে?’ আমিতো একেবারে হক্কার-মা-টক্কা হয়ে গেলাম! বৌদিকে বললাম, ‘তোমার কাছে কে বলেছে যে, আমি মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম?’ বৌদি বললো, ‘চুপেচাপে কি আর বেশিদিন চলা যায়, ঠাকুরপো? চোরের দশদিন, গৃহস্থের একদিন। তো মেয়ে কেমন? পছন্দ হলে বলো, আমরা একদিন গিয়ে দেখে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে আসি!’ বললাম, ‘দূর বৌদি, সব মিথ্যে কথা। যেই বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই বাড়ির সাথে একটা ঠাকুরবাড়ি আছে। সেই বাড়িতে তিনটা মেয়ে আছে। কিন্তু আমিতো আর মেয়ে দেখতে যাইনি। তিনটা থাকুক আর দশটা থাকুক। তাতে আমার কী? আমার কথা বিশ্বাস না হলে কালই কানাইকে বাসায় নিয়ে আসবো, তুমি কানাইকে জিজ্ঞাসা করবে।’ এই বলেই সেদিনের মতো বৌদিকে বুঝিয়ে দিলাম।

পরদিন কানাইকে নিয়ে বাসায় আসলাম। আমার বড় বৌদি কানাইকে জিজ্ঞাসা করলে, কানাই বললো, ‘নিতাই তো ওই বাড়িতেই যায়নি। আমি গিয়েছিলাম বলে আমার সাথে ও অনেক রাগারাগি করেছিল। তোমরা যা শুনেছ, তা ভুয়া খবর।’ কানাইর কথা শুনে বৌদি ও মা বিশ্বাস করলো। এরপর এব্যাপারে আর কোনদিন কোনও কথা হয়নি। নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ গোয়ালপাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতেছিলাম।

একদিন হঠাৎ করে ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিল থেকে এক লোক এসে আমাকে খুঁজতে লাগলো। খুঁজে বের করে বললো, ‘মিলন টেক্সটাইল মিল এখন “ওয়েল টেক্স” নামে পরিচিত। মিলটি একজন পাকিস্তানি মালিক কিনে নিয়ে সেখানে নতুন কোরিয়ান মেশিন বসিয়েছে। বর্তমান ওয়েল টেক্সের মালিকের নাম নিয়াজ সাহেব। উনি খুবই ভালো লোক। এখন মিলের ম্যানেজার রমিজ উদ্দিন সাহেব তোমাকে অতিশীঘ্র দেখে করতে বলেছে।’ লোকটার কথা শুনে বললাম, আজ আর যেতে পারবো না। আপনি ম্যানেজার সাহেবকে বলবেন, নিতাই আগামীকাল বিকালবেলা এসে দেখা করবে।’ আমার কথা শুনে লোকটা চলে গেলো। কিন্তু আমি ভাবতেছিলাম! নতুন মিল। কোরিয়ান মেশিন। এখানেই বা কাকে দিয়ে যাই। এসব নিয়েই ভাবছিলাম!
চলবে…

জীবনের গল্প-১৪ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১২

জীবনের গল্প-১১-এর শেষাংশ: যদি কারোর মন চায়, তাহলে ব্লগ সাইট লিঙ্কে ক্লিক করে সেদিনের সেই লেখাটা পড়তে পারবেন। আশা করি ভালো লাগবে। আর আমার জীবনের গল্প-১২ পর্ব নিয়ে পরবর্তীতে হাজির হচ্ছি শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় মানুষগুলোর মাঝে।

বিয়ের পরদিন মেয়েটি বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার পর থেকে আমার আর কিছুই ভালো লাগছিল না। সেদিন আর মিলেও গেলাম না। কানাইকে সাথে নিয়ে চলে গেলাম বড় দাদার বাসায়। সেখান থেকে বাসায় ফিরলাম সন্ধ্যার পর। পরদিন সকালে কানাইকে সাথে নিয়ে দুইজনে মিলে গেলাম। আমি আর কানাই কাজ করছিলাম। এমন সময় মিলের দারোয়ান আমার সামনে এসে বললো, ‘তোর লোক এসেছে।’ দারোয়ানের কথায় হঠাৎ চমকে গেলাম! চমকে গিয়ে মিলের বাইরে গিয়ে দেখি ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল মিলের সাত্তার মিস্ত্রি। উনার সাথে মিলন টেক্সটাইল মিলে অনেকদিন কাজ করেছিলাম। এই সাত্তার মিস্ত্রিকে আমি ওস্তাদ বলেই ডাকতাম। মিলন টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাবার পর উনি চেলে গেলেন বাড়িতে। উনার বাড়ি কুমিল্লা। এরপর থেকে উনার সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ। অনেকদিন পর উনার সাথে এ-ই দেখা।

সাত্তার ওস্তাদের সামনে গিয়ে হাত জোড়ে নমস্কার জানালাম। উনি আমার নমস্কার গ্রহণ করে বললো, ‘তোমার বড়দাদা নিমাই বাবু কোথায়?’ বললাম, ‘দাদা তো মিলের ভেতরে কাজ করছে।’ উনি সাত্তার মিস্ত্রি আমার বড় দাদাকে ডেকে আনতে বললো। আমি কানাইকে মিলের ভেতরে পাঠালাম, বড় দাদাকে ডেকে আনতে। এই ফাঁকে সাত্তার ওস্তাদের সাথে অনেক কথা হলো। কীভাবে আমাদের ঠিকানা সংগ্রহ করলো। কীভাবে এখানে আসলো। এখন কোথায় কী করছে ইত্যাদি বিষয়ে। সাত্তার ওস্তাদ বললো ‘তিনি ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী নামে এক জায়গায় একটা মিলে কাজ করছে। মিলের নাম, আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিল। মিলটি দুই বছরের জন্য মিলন সাহেবের ভাড়া নেওয়া। এখানে এসেছেন আমাকে সেই মিলে নিয়ে যেতে।’ এরমধ্যেই আমার বড় দাদা মিল থেকে বেরুলো। সাত্তার ওস্তাদকে দেখে কোলাকুলি করলো।

তারপর সাত্তার ওস্তাদ-সহ আমরা মিলের সাথে থাকা একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। চা-বিস্কুটের ওর্ডার দিলাম, চা-বিস্কুট আসলো। চা-বিস্কুট খেতে খেতে সাত্তার ওস্তাদ আমার বড় দাদাকে বললো, ‘নিমাই দা, আমি এখন মিলন সাহেবের ভাড়া নেওয়া এক মিলে চাকরি করি। মিলটা ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী। সেখানে ভালো ড্রয়ার ম্যান নেই। ড্রয়ার ম্যানের অভাবে মিলে ঠিকমতো উৎপাদন হচ্ছে না। তাই মিলন সাহেব নিতাইকে ওই মিলে নিতে পাঠিয়েছে। এখন আপনার সম্মতি পেলেই আমি নিতাইকে সাথে নিয়ে ফরিদপুর রওনা হবো।’ আমার বড়দাদা সাত্তার ওস্তাদের সব কথা শুনে বললো, ‘ও-তো এখানে পার্মানেন্ট চাকরি করছে। আবার বর্তমানে মা’কে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছে। তাছাড়া ও এখান থেকে হঠাৎ চলে গেলে, মিল বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবণা আছে। যদি ও ওখানে যাতে চায়, তাহলে এই মিলের জন্য ওঁর মতো একজন ড্রয়ার ম্যান এখানে দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে, ওঁর বেতনের টাকা মিল মালিক আটকে দিবে। আর ওযদি ওখানে যায়, তাহলে ওঁর ভাড়া নেওয়া বাসাও ছেড়ে যেতে হবে। তারজন্য ওঁকে অগ্রীম বাবদ অন্তত ২০০০/= টাকা দিতে হবে। যাতে ও এদিকের দেনা-পাওনা সবকিছু মিটিয়ে যেতে পারে।’

বড়দা’র কথায় সাত্তার ওস্তাদ বললো, ‘ঠিক আছে দাদা, আমি আজই এ-বিষয়ে মিলন সাহের সাথে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করে আগামীকাল আবার আপনার কাছে আসছি।’ এই বলেই সাত্তার ওস্তাদ সেদিনের মতো আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা চলে গেলো। এরপর আমার বড়দাদা আমাকে বললো, ‘তুই মিলের কাজ সেরে এই মিলের জন্য আজই একজন ড্রয়ার ম্যান খুঁজে বের কর। যাতে এই মিলের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।’ বড়দা’র কথামতো আমি মিলের কাজ সেরে কানাইকে নিয়ে চলে গেলাম, ফতুল্লা আগের মিলন টেক্সটাইল মিল এলাকায়। সেখানে গিয়ে পরিচিত একজন ড্রাইভার ম্যানের সাথে কথা বলি। উনি কিল্লারপুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে আমার কাজের জায়গায় যেতে রাজি হলো। পরদিন সাত্তার ওস্তাদ আমার জন্য মিলন সাহেব থেকে ২০০০/= টাকা অগ্রীম বাবদ নিয়ে ফাইন টেক্সটাইল মিলে আসলো।

মিলে এসে আমার বড়দা’র হাতে ২০০০/=টাকা দিয়ে বললো, ‘নিমাই দাদা আমি নিতাইকে নিয়ে আগামীকালই ফরিদপুর রওনা দিতে চাই।’ আমার বড়দা বললো, আগামীকাল যেতে পারবে না। দুইদিন পর যেতে পারবে। এই সময়ে মধ্যে মিলে একজন ড্রয়ার ম্যান দিতে হবে এবং ওঁর বাসা ভাড়া পরিশোধ করে বাসা ছেড়ে আমার বাসায় সবকিছু পৌঁছাতে হবে। তাহলেই আমি এই ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিক ও ম্যানেজারের কটুকথা থেকে রেহাই পাবো।’ আমার বড় দাদার কথায় সাত্তার ওস্তাদ রাজি হয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গোলো। তারপর বড়দা সাত্তার ওস্তাদ থেকে পাওয়া ২০০০/= টাকা আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘এই মিলের জন্য একজন ড্রয়ার ম্যান আগামীকালই নিয়ে আসতে। আর বাসা ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে বাসার মালা-মাল গোয়ালপাড়া বাসায় নিয়ে যেতে।’ দাদার কথামতো আমি তা-ই করলাম। এই দিনই শ্যামসুন্দর সাহার বাসার ভাড়া পরিশোধ করে রাতা-রাতিই বাসার মালা-মাল দাদার বাসায় নিয়ে গেলাম। মাকেও ফরিদপুর যাওয়ার ব্যাপারে সবকিছু বুঝিয়ে বললাম।

পরদিন সকালবেলায় ফতুল্লা গেলাম। ফতুল্লা থেকে ওই ড্রয়ার ম্যানকে সাথে নিয়ে কিল্লারপুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে আসলাম। আমার কাজটা ওই লোককে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলাম। তারপর আমার পনেরো দিনের মতো কাজের পাওনা টাকা বড়দা’র কাছে দিয়ে দিতে ফাইন টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার সাহেবকে অনুরোধ করলাম। তারপর ম্যানেজার সাহেব ও মিলের সবার কাছে বলেকয়ে মিল থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় গেলাম। পরদিন অগ্রীম পাওয়া ২০০০/= টাকা থেকে ১০০০/= মায়ের হাতে দিয়ে কাঁথা-বালিশের গাট্টি-সহ কানাইকে নিয়ে সাত্তার ওস্তাদের কথামতো ঢাকা ফুলবাড়িয়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডেই সাত্তার ওস্তাদ আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে বলে বলেছিল। আমরা ফুলবাড়িয়া পৌঁছার আগেই সাত্তার ওস্তাদ আমাদের জন্য টিকিট সংগ্রহ করে আমাদের জন্য অপেক্ষা দাঁড়িয়ে করছিল। আমরা ফুলবাড়িয়া পৌঁছার সাথে সাথে সাত্তার ওস্তাদ আমাদের সামনে এসে নাজি হলো। তারপর ফুলবাড়িয়া থেকে কিছু হাল্কা-পাতলা খেয়ে বাসে উঠে নিজেদের সিটে গিয়ে বসলাম।

বাস থেকে ফফরিদপুর রাজবাড়ীর পৌঁছালাম সন্ধ্যার একটু আগে। বাস থেকে নেমে রিকশা চড়ে গেলাম, গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে। এই মিলটি ফরিদপুর শহরের এক বড় ব্যবসায়ীর। শখ করে নিজের বাবার নামে মিলের নামকরণ করে। মিলের মেশিনগুলো ছিলো ইন্ডিয়ান। সেদিন মিলের শ্রমিকদের ম্যাচে রাতের খাবার সেরে শুয়ে থাকলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মিলের পাশে থাকা একটা চায়ের দোকান থেকে চা-পানি খেয়ে মিলের ভেতরে গেলাম। মিলের সবাই আমাদের দুইজনকে দেখে কেমন যেন হাঁকা-হাঁকি করতে ছিল। মিলের শ্রমিকদের ধারণা ছিল, আমরা হয়তো দুইদিনও এই মিলে কাজ করতে পারবো না। এরকম ধারণা নিয়েই শ্রমিকরা হাঁকা-হাঁকি করেছিল। যখন আমরা দুইজনে আমাদের কাজ রেডি করে কাজ করা শুরু করলাম, তখন মিলের সবাই আমাদের দুইজনের চারপাশে এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজের নমুনা দেখছিল।

আমি যেই কাজটা করতাম, সেই কাজে আমি খুবই দ্রতগামী ছিলাম। একসময় পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার মধ্যে যতগুলো প্রাইভেট টেক্সটাইল মিল ছিলো, সেসব মিলে যত ড্রয়ার ম্যান ছিলো, সবার থেকে আমিই ছিলাম সেরা ড্রয়ার ম্যান। তাই ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলেও আমার দ্রুত কাজ করা দেখে মিলের সবাই অবাক হয়ে গেলো। প্রথম কাজটা করেই প্রশংসার ফুলঝুরি কুড়িয়ে ফেললাম। সাত্তার ওস্তাদও খুশি হয়ে গেলো। এরপর ওই মিলে আমিই হয়ে গেলাম সবার পছন্দের মানুষ। মিলের বাইরেও ছিল আমার প্রশংসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা তো ছিলোই। যেখানেই যেতাম, সম্মান পেতাম। মিলের ভেতরেও থাকতাম স্পেশালভাবে। সেই মিলের পাশের বাড়িঘরের অনেক ছেলেকেও কাজ শিখাইয়েছিলাম। ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে প্রায় ছয়মাসের মতো ঠিকমতো কাজ করেছিলাম। এরপর একসময় মিলন সাহের ওই মিলে সূতা দেওয়া বন্ধ করে দিলে, সাত্তার ওস্তাদ-সহ আমি আর কানাই নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।

ক’দিন ঘুরে-ফিরে আবার কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়ে নিই। ফাইন টেক্সটাইল মিলেও আমি সবার প্রিয় মানুষ ছিলাম। মিলের অধিকাংশ শ্রমিক ছিলো বিক্রমপুর মালিকের পাড়াপ্রতিবেশি ও নিকটাত্মীয় স্বজন। তখনকার সময়ে এদেশে এতো গার্মেন্টস ছিলো না। ছিলো শুধু প্রাইভেট টেক্সটাইল মিল। তাই তখন কাজের যেমন চাহিদা ছিলো, কাজের লোকের সম্মানও ছিলো। সেই সম্মানের সুবাদে অনেক শ্রমিকদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ পেতাম। অনেকের বাড়িতে যেতাম। আবার অনেকের বাড়িতে যেতাম না। তো ফাইন টেক্সটাইল মিলেরই আমার এক সাগরেদের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর তালতলা সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামে। ওঁর নাম ছিল কালাম মিয়া। কালাম ছাড়াও আরও অনেক লোকই ছিলো সুবচনী এলাকার। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল কালাম মিয়া। কালাম আমাকে ওস্তাদ ওস্তাদ বলের ডাকতো। ঈদ আসলে ঈদের বন্ধে ওঁদের বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করতো। এক ঈদকে সামনে রেখে ওঁদের বাড়িতে যাবো বলে কথা দিলাম। চার-পাঁচ দিন পরই ঈদ-উল-ফিতর। একসময় মিলের সবাই ঈদের বন্ধ পেয়ে যাঁর যাঁর বাড়ি গেলো। কালামও বাড়ি যাবার আগে বারবার আমার হাতে ধরে ওঁদের বাড়িতে যাওয়া জন্য অনুরোধ করলো। তখন কালামকে বলেছিলাম, ‘ঈদের দিন যেকোনো সময় আমি আর কানাই তোমাদের বাড়িতে হাজির হয়ে যাবো। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।’

আমার কথা বিশ্বাস করে কালাম মিল থেকে ঈদের আগের দিন বাড়ি গেলো। বাড়ি গিয়ে ওঁর মা-বাবার কাছে বললো, ‘ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ওস্তাদ আসবে।’ ওই কথা এক কান দুই কান তিন কান হয়ে পুরো নয়াবাড়ি গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। ওঁদের বাড়ি যেতে হলে ফতুল্লা লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে চড়ে সুবচনী বাজারে নামতে হয়। তারপর সুবচনী থেকে নৌকায় চড়ে নয়াবাড়ি গ্রামে যেতে হয়। তাই কালাম ঈদের দিন সকালবেলা সুবচনী বাজারে এসে পরিচিত সব নৌকার মাঝিদের বলে রেখেছিল, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার ওস্তাদ আসবে। ওস্তাদের কাছ থেকে যেন নৌকা ভাড়া রাখা না হয়।’ ঈদের দিন আমি মায়ের কাছে বেড়াতে যাবো বলে কানাইকে সাথে নিয়ে সকালবেলা বাসা থেকে বের হয়ে ফতুল্লা লঞ্চঘাটে আসি। তখন ফতুল্লা থেকে সুবচনীর ভাড়া ছিলো মাত্র ১৭ টাকা। লঞ্চঘাটে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ঢাকা থেকে লঞ্চ ছেড়ে এসে ফতুল্লা লঞ্চঘাটে ভিড়লো। আমরা লঞ্চে উঠলাম। সুবচনী যেতে যেতে দুপুর পার হয়ে গেলো। লঞ্চঘাটে লঞ্চ ভিড়লো। আমরাও লঞ্চ থেকে নামলাম। সামনেই দেখি কালাম দাঁড়িয়ে আছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছো?’ কালাম বললো, ‘আমি ওস্তাদ অনেকক্ষণ যাবত এখানে আনাগোনা করছিলাম, আপনাদের অপেক্ষায়।’ তারপর কালামকে নিয়ে এক চায়ের দোকানে গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে বাজারের ভেতরে গেলাম। কালামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে মিষ্টির দোকান কোথায়? কালাম আমাদের মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলো। দুই সের মিষ্টি নিলাম। কালামের মা-বাবার জন্য পান-সুপারি কিনলাম। বেশি করে সিগারেট কিনে নিলাম। তারপর ওঁদের নিজেদের নৌকা চড়ে ওঁদের বাড়ির ঘাটে নামলাম। আমরা কালামদের বাড়িতে যাবার আরও অনেক আগে থেকেই আমাদের দেরি দেখে ওঁর মা-বাবা, বড় ভাই-সহ বাড়ির সবাই পায়চারি করতে ছিল। আমরা ওঁদের বাড়ির ঘাটে যাবার সাথে সাথে পুরো নয়াবাড়ির ছোট-বড় অনেক মানুষ ঘাটে জড়ো হয়ে গেলো। এতো মানুষ দেখে আমি যেন লজ্জায় পড়ে গেলাম! মাথা নিচু করে কালামের সাথে ওঁদের ঘরে গিয়ে বসলাম।

ঘরে গিয়ে বসার সাথে সাথে ওঁর মা-বাবা, বড় ভাই ও বোনের সাথে পরিচয় হলো। তারপর চিনির সাথে লেবুর শরবত সামনে এসে গেলো। আসলো আমাদের টাকা দিয়ে কেনা মিষ্টিও। খেলাম শরবত। খেলাম মিষ্টি। এরপর কালামের মা আমাদের হাতমুখ ধুয়ে আসার জন্য বললো। কলাম হাতমুখ ধোয়ার জন্য আমাদের নিয়ে গেলো, একটা পুকুরের সিঁড়ি ঘাটে। পুকুরের সিঁড়ি ঘাটটা হলো এক হিন্দু ঠাকুর বাড়ির। পুকুর ঘাট থেকে হাত-পা ধুয়ে কালামদের বাড়িতে আসলাম। ভাত খেলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১১

জীবনের গল্প-১০-এর শেষাংশ: তখনকার সময়ে টেক্সটাইল মিলে আমার এই কাজের প্রচুর চাহিদা ছিলো। একটা টেক্সটাইল মিলে মনোমত ১০০জন তাঁতি থাকলেও একজন মনের মতো ড্রয়ার ম্যান থাকতো না। ড্রয়ার ম্যান বা রেসিং ম্যানের কাজটা ছিলো খুবই খেয়ালি ও ধৈর্যশালী কাজ। এই কাজটা করতে হয় নির্ভুলভাবে!

ফতুল্লা কাঠেরপুল “মিলন টেক্সটাইল” মিলে আমরা দুই ভাই কাজ করে যা পাচ্ছিলাম, তা দিয়ে খুব সুন্দরভাবেই আমাদের সংসারটা চলছিল। হঠাৎ একসময় মিলের মালিক ‘মিলন সাহেব’ আর্থিক সংকটে পড়ে মিল বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, আমরা পড়ে গেলাম বিপাকে! তখন আমার বড়দাদা হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল “ফাইন টেক্সটাইল” নামে নতুন এক মিলে কাজ নিয়ে নেয়। মিল মালিকের নাম ‘ফারুক সাহেব’। ফারুক সাহেবের বাড়িও ছিল বিক্রমপুর। কাপড়ের ব্যবসা ছিল ঢাকা ইসলামপুর। ফাইন টেক্সটাইল মিলটা সবেমাত্র নতুন। তাই মিলে তাঁতি-সহ আরও অন্য সেকশনেও লোকের অভাব ছিল। তাই আমার বড়দাদা আমাকে ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করতে বললে, আমি বড়দা’র কথামতো ফাইন টেক্সটাইল মিলে প্রথমে তাঁতের কাজই করতে থাকি।

ফাইন টেক্সটাইল মিলের ড্রয়ার ম্যান ছিল নরসিংদীর একজন। তিনি একবার ছুটি নিয়ে বাড়িতে গেলে উনার আর মিলের খবর থাকতো না। তখন মিলের তাঁতি-সহ মিল মালিকেরও বারোটা বেজে যেতো। এই ঝামেলার কারণে মিল মালিক ওই লোককে বাদ দিয়ে অন্য একজন লোককে নিয়োগ দিতে বলে। মালিকের কথামতো মিল ম্যানেজার মিলের সকল শ্রমিকদের বিষয়টি জানালে, আমার বড়দাদা ম্যানেজার সাহেবকে বললো ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে দিতে। বড়দা’র অনুরোধে ম্যানেজার “রাজু আহমেদ” ইন্টারভিউ হিসেবে দুই-তিন দিনের জন্য ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে করতে বললে, আমি পড়ে যাই বিপাকে। কারণ, সেসময় আমার সাথে কাজ করার হেলপার ছিল না। আর হেলপার ছাড়া ড্রয়ার ম্যানের কাজটাও করা যায় না। মিলন টেক্সটাইল মিলে যেই হেলপার ছিল, সেই হেলপারকে আমি নিজেই মিলন টেক্সটাইল মিল সংলগ্ন আরেকটা মিলে আরেকজন ড্রয়ার ম্যানের সাথে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলাম।

উপায়ন্তর না দেখে আমি নিকটস্থ নগর খাঁনপুর গিয়ে আগের পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে একজন লোকের দরকার বলে জানাই। তখন নগর খাঁনপুর মহল্লার পরিচিত এক বেকার ছেলের সন্ধান পাই। ওই ছেলেকে বলে-কয়ে সাথে নিয়ে ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে থাকি। যেই ছেলেটাকে আমার সাথে কাজ করার জন্য এনেছি, সেই ছেলেটা টেক্সটাইল মিলের কাজ আর কখনো করেনি। আমার সাথেই প্রথম টেক্সটাইল মিলে কাজে আসা। ছেলেটার নাম, “কানাই লাল সাহা।” নতুন হেলপার কানাইকে নিয়েই ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ শুরু করি। প্রথম দিনের প্রথম কাজেই মিলের তাঁতিদের অনেক প্রশংসা আর বাহাবাহা কুড়ালাম। তিন-চার দিন পর ফাইন টেক্সটাইল মিলের মালিক মিলে আসার পর আমার ব্যাপারে তাঁতিদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে, মিলের সকল তাঁতিরা এই কাজে আমাকেই রাখতে বললো। তাঁতিদের কথা শুনে মালিক ফারুক সাহেব আমাকে সবসময়ের জন্য ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে বললে–আমি কানাইকে নিয়ে রেগুলার ফাইন টেক্সটাইল মিলে ড্রয়ার ম্যানের কাজ করতে থাকি।

কানাইকে সাথে নিয়ে কাজ করতে করতে একসময় কানাই হয়ে গেলো আমার প্রিয় বন্ধু। অবশ্য কানাই আমার বয়সের দিক দিয়ে চার-পাঁচ বছরের ছোট ছিলো। কিন্তু হাতে-পায়ে ছিলো আমারমতো উঁচা-লম্ব। দুইজন একসাথে চলাফেরা করলে কে বড় আর কে ছোট, অনেকেই বুঝতে পারতো না। যেখানেই যেতাম কানাইকে সাথে নিয়েই যেতাম। যখন যা-কিছু খেতাম, কানাইকে নিয়ে খেতাম। এভাবে দুই-তিন মাস কাজ করার পর আমার আর নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়ালপাড়া থেকে আসা-যাওয়া করে কাজ করতে ভালো লাগছিল না। বিষয়টি আমার মাকে জানালাম। মা আবার বড়দা’কে জানালো। বড়দাদা মা-কে বললো, ‘ওঁর যদি এখান থেকে আসা-যাওয়া করতে সমস্যা হয়, তাহলে ওঁকে বলবেন মিলের সাথে নগর খাঁনপুর আগের মহল্লায় একটা বাসা নিতে। আমি এখেই থাকবো।’ বড়দা’র কথা মা আবার আমাকে বললো। আমি তখন কানাইকে বললাম, ‘আমার জন্য একটা বাসা ঠিক করতে।’ কানাই নগর খাঁনপুর পুকুরপাড়ে ওঁদের বাসার সাথেই শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে আমার জন্য একটা বাসা দেখে। এরপর আমি কানাইকে সাথে নিয়ে শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে গিয়ে বাসা দেখি। বাসা ভাড়া প্রতিমাসে ১৫০ টাকা। বাসাটা ছোটো ছিলো বলেই বাসা ভাড়া ১৫০/= টাকা। আমার পরিবারের সদস্য বলতে ছিলাম আমি, মা, আর বোন মরা ভাগ্নী। বাসাটা ছোট হলেও, আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিলো মনে করে বাড়িওয়ালাকে কথা দিলাম, এই বাসা আমিই নিবো।

তখন কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইলে কাজ করে প্রতিমাসে বেতন পেতাম ২০০০/=টাকার মতো। বাজারে চাউলের মূল্য ছিল প্রতি সের ৫-৬ টাকা। তাতে হিসাব করে দেখলাম, যেই টাকা বেতন পাবো, তাতে মাকে নিয়ে সুন্দরভাবে চলতে পারবো। সময়টা ছিলো বোধহয় ১৯৮৪ সালের। একসময় বাসা ভাড়া ঠিকও করে ফেললাম। বাসা ভাড়া ঠিক করে যেদিন বাসায় ঢুকবো, সেদিন ছিল শুক্রবার, ঠিক দুপুরবেলা। সেদিন দাদার বাসা থেকে কিছু দরকারি মালা-মাল নিয়ে ভ্যানগাড়ি করে নগর খাঁনপুর মহল্লায় আসলাম। মালা-মালের মধ্যে তেমন কোন দামী কোনও আসবাবপত্র ছিলো না। তারপরেও মোটামুটি যা ছিলো, গরিব সমাজে চলনসই ছিলো। আমি আর কানাই, দুইজনে মিলে মালা-মালগুলো ভ্যানে করে বাসার সামনে আনলাম। বাসার সামনেই ছিলো পুকুর। পুকুর পাড়েই ছিলো শ্যামসুন্দর সাহার বাড়ি। বাড়ির সামনে যখন ভ্যানগাড়ি রাখলাম, তখন অমার চোখ পড়ল শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতেই থাকা একটা মানুষের উপর। মানুষটা ছিলো এক মেয়ে মানুষ।

মেয়েটা খুবই সুন্দর ও রূপসী ছিলো। গায়ের রং ছিলো ফর্সা। মায়াবী চেহারা। যেন হাতে গড়া এক মাটির মূর্তি দেবী দুর্গা। হাটু পর্যন্ত তাঁর মাথার চুল। অপরূপ এক রূপবতী। আমি চেয়ে চেয়ে মেয়েটাকেই শুধু দেখতেছিলাম। মেয়েটার নজরও ছিলো আমাদের দিকেই। মেয়েটা খানিক পরপর শুধু আমাদের দিকেই আনা-গোনা করতে লাগলো। মেয়েটির এমন আনা-গোনা দেখে আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। তখন আর ভ্যানগাড়ি থেকে এই সামান্য মালামাল নামাতে ভাল লাগছিল না। লজ্জা লাগার কারণও ছিলো। কারণটা ছিলো, যেই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়িতে আরো দুই-তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া ছিলো। তাঁরা সবাই ছিলো ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাঁদের ঘরে জিনিসের অভাব ছিলো না। তাঁদের সাথে তো আমার মত গরিব মানুষের খাপ খাবে না বলেই, আমার কাছে কেমন যেন লজ্জা- লজ্জা লাগছিল। ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম,কী যে করি! কানাই’র কথায় কেন এই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম! অবশ্য এর আগেও আমরা সপরিবারে এই নগর খাঁনপুরেই ভাড়া ছিলাম। সেই আগের চেনাজানা বলেই কানাই’র কথায় আবার এই এলাকায় শ্যামসুন্দর সাহার বাড়িতে আসলাম বাসা ভাড়া নিয়ে। কিন্তু এখন তো এই বাড়িতে আমার মতন অধমেকে মানাবে না। এসব নিয়ে একা একাই ভাবছিলাম।

এমন সময়ই কানাই বলছে, ‘কি রে! মালগুলি ধর! তাড়াতাড়ি করে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাই। খানিক পর তো আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আবার বাজারে যেতে হবে না? নতুন বাসা, কতকিছুর দরকার হবে! সবই তো তোর আস্তে আস্তে কিনতে হবে।’ কানাই’র কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে দুইজনের দ্রুত টুকিটাকি মালা-মাল ভ্যানগাড়ি থেকে নামানো শুরু করলাম। একটু পরে ওই মেয়েটা আমাদের সামনে আসলো। সামনে এসেই বললো, ‘আপনারা দুইজনে না পাড়লে আমিও কিছু-কিছু নিয়ে যাই? মামা (শ্যামসুন্দর সাহা) আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের সাথে ভ্যানগাড়ি থেকে ধরা-ধরি করে নামাতে।আমি চুপ করে ছিলাম, কোন কথা’ই বলিনি। কানাই বললো, ‘না না থাক, তোমার লাগবে না, যা আছে সেটা আমরা দুইজনেই পারবো, তুমি যাও।’ তারপরেও মেয়েটা হাড়ি-পাতিলের বোস্তাটা হাতে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আমার ভাড়া করা বাসায় নিয়ে রাখলো। বাকি মালগুলো কানাই আর আমি দুইজনে নিলাম। সাথে সাহায্যকারি রিকশওয়ালাও ছিলো।

আমার মা গোয়ালপাড়া থেকে আসলো বিকালবেলা। মা আসার আগেই দুইজনে জিনিসপত্রগূলো ঘরের ভিতরে সব গোছ-গাছ করে রেখেছিলাম। মালপত্রগুলি গোছানোর সময়ও মেয়েটা বারবার একটু পরপর আমাদের সাহায্য করার জন্য আমার ঘরের সামনে যাওয়া-আসা করছিল। কিন্তু আমরা কিছু বলছি না দেখে, আমার ঘরের ভেতরে আসছে না, বাইরে থেকেই আনা-গোনা করছিল। একটু পরে মা বললেন, ‘যা রান্না করার জন্য কিছু বাজার-সদাই করে নিয়ে আয়।’ মাকে বললাম, ‘বাজারের ব্যাগটা দিন, আর কী কী আনবো বলেন।’ কী কী লাগবে মা বললেন, আর ওমনি ব্যাগ নিয়ে কানাই আর আমি দুইজনে বাজারের চলে গেলাম। মজিদ খাঁনপুর বাজার থেকে কিছু বাজার-সদাই করে বাসায় ফিরলাম। মা রাতের খাবার তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাতের খাবারে কানাইকে আমাদের সাথে খেতে বললাম। কানাই ঠিক সময়মত আমার বাসায় এসে হাজির হলো। মা দুইজনকে ভাত খেতে দিলেন। আমরা দুইজন ভাত খাচ্ছিলাম। এমন সময় আবার মেয়েটা এসে মাকে বললো, ‘মাসিমা কী রান্না করলেন এত তাড়াতাড়ি?’ ‘ইরি চাউলের ভাত, মুশরের ডাইল রান্না করেছি।’ মা জবাব দিলেন। মেয়েটা বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁসার বাটি করে কিছু তরকারি এনে দিলেন, আমার মায়ের হাতে। মা প্রথমে রাখতে চায়নি। মেয়েটা তখন রাখার জন্য অনুরোধ করলো। তখন মা ওর অনুরোধে তরকারির বাটি রাখলো। সেই তরকারি আমাদের দুইজনকে ভাগ করে দিলো। আমরা দুইজন খেলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে হাত-মুখ ধুয়ে বাহিরে গেলাম। বাড়ির সাথেই চা’র দোকান, মুদি দোকান ছিলো। দোকান থেকে দুইজনে চা-সিগারেট টেনে আমি বাসায় আসলাম। কানাই ওঁদের বাসায় চলে গেলো।

এরপর মেয়েটার বিষয়-আশয় জানলাম। মেয়েটা কে? ওঁদের বাড়ি কোথায়? ওঁরা কয় ভাই, কয় বোন। মেয়েটি ছিলো এক দুখিনী মায়ের দুখিনী। মেয়েটার নাম মণিকা, (ছদ্মেমনাম) ৷ মেয়েটার বাবা জীবিত ছিলো না! মেয়েটা এই বাড়িওয়ালার বাসায় থেকে কাজ করে। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুর। ওঁরা একভাই একবোন। মা জীবিত আছে। ওঁর মা-ও অন্য একজনের বাসায় কাজ করে। একসময় মেয়েটি আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু আমি কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছিলাম না। তারপরও আমি বাসায় গেলে মেয়েটা সবসময় আমার পেছনে পেছনেই থাকতো। আমি ভীষণ ভয় পেতাম! কারণ, যদি কিছুর থেকে কিছু রটে যায়? তাই সবসময় ভয়ে ভয়ে মেয়েটাকে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আমার মা মেয়েটাকে খুভ ভালোবাসতো, পছন্দও করতো।

আমারও পছন্দ হতো, ভালো লাগতো। তারপরও আমি বান্দা পাত্তা দিতাম না। এড়িয়েই যেতাম। একসময় মেয়েটি নিজেই কানাই’র কাছে আমার প্রতি ওঁর ভালোবাসার কথা বললো। কিন্তু না, আমি সবসময়ই দূরে দূরেই থাকতাম। কারণ, আমি মনে করতাম, সেসময় আমার বিয়ের বয়স হয়নি। তারপর ছিলো সংসারের অস্বচ্ছলতা। একসময় মেয়েটার বিয়ে ঠিক হলো। মেয়েটি রাজি ছিলো না। শেষমেশ মেয়েটিকে আমি নিজের বলেকয়ে বিয়েতে মত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করি। আমার অনুরোধে মেয়েটি বিয়েতে রাজি হয়। বিয়ের দিন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পর, মেয়েটিকে বরের হাতে আমি নিজেই উঠিয়ে দেই। এই নিয়ে গত কয়েক বছর আগে অনলাইনে থাকা এক ব্লগ সাইটে “এক বিকেলের ভালো লাগা সারাজীবনের স্মৃতি” শিরোনামে একটা ব্লগ লিখেছিলাম। তা লেখার মাঝে লিংক দিয়ে দিলাম। যদি কারোর মন চায়, তাহলে ওই ব্লগ সাইট লিঙ্কে ক্লিক করে সেদিনের সেই লেখাটা পড়তে পারবেন। আশা করি ভালো লাগবে। আর আমার জীবনের গল্প-১২ পর্ব নিয়ে পরবর্তীতে হাজির হচ্ছি, শব্দনীড় ব্লগের প্রিয় মানুষের মাঝে।
চলবে…

জীবনের গল্প-১২ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-১০

জীবনের গল্প-৯-এর শেষাংশ: এভাবে চলতে চলতে একসময় নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব অনেক হয়ে গিয়েছিল। একসময় চানাচুর বিক্রি বাদ দিলাম। নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সীদের সাথে রিকশা চালানো শিখলাম। রিকশা চালানো শিখে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

সংসারে অভাব দূর করার জন্য প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত রিকশা নিয়ে শহরের আনাচে-কানাচে পড়ে থাকতাম। রিকশা চালিয়ে যা পেতাম, মায়ের কাছে এনে দিতাম। মা সংসারে খরচ করতো। তখন হঠাৎ করে এদেশে এক ধরণের নতুন রোগ দেখা দিলো। রোগের নাম ‘ঝিনঝিনা’ রোগ। এই রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ হঠাৎ করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যেতো। ওই রোগের একমাত্র ঔষধ ছিলো, রুগীর শরীরে পানি ঢালা। তখন আমরা নগর খাঁনপুরেই থাকতাম। সেসময় ‘ঝিনঝিনা’ রোগের ভয়ে প্রতিদিন ঠিকমতো রিকশা চালানো হতো না। ভয়ে ভয়েই বেশি থাকতাম। মহল্লায় থাকা আরও বন্ধু-বান্ধদের সাথেই সারাদিন ঘুরাফেরা করতাম। মহল্লার কেউ ‘ঝিনঝিনা’ আক্রান্ত হলে তাঁকে সবাই ধরাধরি করে পুকুরপাড় সিঁড়ি ঘাটলায় বসিয়ে রুগীর শরীরে পানি ঢালতাম। রুগী যতক্ষণ না পর্যন্ত সুস্থ না হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত রুগীর গায়ে-মাথায় পানি ঢালতেই থাকতাম। এভাবে আমরা ‘ঝিনঝিনা’ রুগীকে সুস্থ করে তুলতাম।

আমরা কয়েকজন বন্ধু ছিলাম নগর খাঁনপুর মহল্লার সেচ্ছাসেবী হিসেবে। তখন ওই রোগের ভয়ে মহল্লার হিন্দুরা দলবেঁধে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরির নাম সংকীর্তন করতে করতে পুরো মহল্লার আনাচে-কানাচে চক্কর দিতো। মহল্লার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও সকাল-বিকাল আল্লাহু আল্লাহু জিকির করতে করতে মহল্লার আনাচে-কানাচে ঘুরতো। প্রায় দিনেক ১৫ দিন পর একসময় ওই রোগ আস্তে আস্তে নিস্ক্রিয় হলো। যাঁর যাঁর সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমিও আবার নিয়মিত প্রতিদিন রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

আমি যেই মালিকের রিকশা চালাতাম, উনার নাম ছিলো, লেচু মহাজন। সবাই উনাকে লেচ্চা মহাজন নামেই চিনতো। নতুন রিকশা চালানো শেখা থেকেই আমি লেচ্চা মহাজনের রিকশাই চালাতাম। একসময় আমার সাথের অনেক রিকশাওয়ালারা রিকশা চালানো বাদ দিলেও, আমি আর বাদ দিতে পারছিলাম না, অন্যকোনো ভালো একটা কর্ম না জানার কারণে। তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ নতুন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। দেশের চারদিকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে শুরু করলো। কারোর মাথায় লম্বা চুল দেখলে চুলের মুঠি ধরে কেচি দিয়ে ধানকাটার মতো কেটে দিতো। মায়ের জাতি নারীদের পেট দেখা গেলে পেটে আলকাতরা লাগিয়ে দিতো।

ওই বিপদে আমি নিজেও একবার পড়েছিলাম। রিকশায় প্যাসেঞ্জার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ২ নং রেল-গেইট সংলগ্ন ডায়মন্ড সিনেমাহলের সামনে গেলাম। হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর আমার রিকশার সামনেই গাড়ি থামালো। তখন আমার মাথার চুল অনেক লম্বা ছিলো। আমাকে দেখামাত্রই দুইজন সেনাবাহিনী আমার চুলের মুঠি ধরে ঘেচাং ঘেচাং করে কেটে দিলো। এমনভাবে ঘেচাং ঘেচাং করলো, তখন মাথা ন্যাড়া করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সেদিনের রোজগার মাটি দিয়ে গ্যারেজে রিকশা জমা দিয়ে গেলাম সেলুনে। সেলুনের নাপিত আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। বললাম, ‘ভাই হাসাহাসি বাদ দিয়ে মাথাটা ন্যাড়া করে দিন।’ নাপিত আমার মাথা ন্যাড়া করছে, আর বিস্তারিত জানতে চাচ্ছে। বললাম, নাপিতের কাছে বিস্তারিত ঘটনা। মাথা ন্যাড়া করে বাসায় আসলাম। মহল্লার সবাই আমাকে দেখে হাসতে লাগলো। সাথে বন্ধুরা জানতে চাইলো, ‘ঘটনা কী?’ সব বৃত্তান্ত খুলে বললাম। বাসায় আসার পরও ওই হাসা-হাসির পালায় পড়লাম। বৌদি হাসে, বড়দিদি হাসে। বড় দাদাও হাসতে লাগলো। এরপর আর ভয় করতাম না, নির্ভয়ে বুকেরপাটা টান করে রিকশা নিয়ে শহরে ঘুরতাম। অবশ্য এর কয়েকদিন পর সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর আনা-গোনাও কমে গেলো। যে যাঁর মতো শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে কাজ করতে লাগলো।

এর কিছুদিন পর হঠাৎ করে ফেনী থেকে আমার অবিবাহিত বড় বোনের বিয়ের সম্বন্ধ আসলো। ছেলে পক্ষের কোনও দাবি-দাওয়া নেই, কোনরকম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দিতে পারলেই হলো। ছেলেটা আমার মায়ের গুরুদেবের পরিচিত ছিল বলে আমার মা মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু হিন্দু বিয়ে বলে একটা কথা তো ছিলোই। একেবারে গাছ-পা খালি-পা করে করে তো, বিয়ে দেওয়া যায় না। তাই আমার মা নগর খাঁনপুর মহল্লার হিন্দু মুসলমান সকলের হাতে-পায়ে ধরে মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে শুরু করলো। আমাদের বাড়িওয়ালা আমার বোনের বিয়ের সাহায্যের জন্য আমাদের হয়ে নগর খাঁনপুররের বিশিষ্টজনদের কাছে গেলো এবং বিয়ে যাতে সুন্দরভাবে হয়, সেজন্য তাদের পরামর্শ চাইলো। তখন নগর খাঁনপুর মহল্লায় থাকা বিশিষ্টজনরা সম্মিলিতভাবে গরিবের মেয়ের বিয়ের জন্য সকলকে সাহায্য করার অনুরোধ করে একটা সাদা কাগজে দরখাস্তের মতো লিখে দিলো। সেই কাগজ সাথে নিয়ে আমি আর আমার মা বোনের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরের অলিগলিতে, মার্কেটে মার্কেটে গিয়ে ধনী-গরিব সকলের কাছে সাহায্য চাইতে লাগলাম। কেউ দিতো, কেউ আবার দিতো না। তবুও দ্বারেদ্বারে যাওয়া বন্ধ করলাম না, যেতেই লাগলাম। সাহায্য উঠাতে লাগলাম।

এভাবে বেশকিছু টাকা সংগ্রহ করলাম। আর নগর খাঁনপুর থেকেও কেউ লেপ, কেউ তোশক, কেউ ঘটি-বাটি, কেউ নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করতে লাগলো। যে যা দিতো সব আমাদের বাড়িওয়ালার স্ত্রীর কাছেই জমা থাকতো। একসময় বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হলো। বিয়ের ১০/১২ দিন বাকি থাকতে আমি বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য উঠাতে চলে গেলাম, নোয়াখালী নিজের গ্রামে। গ্রামে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের কাছে বোনের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইলে, গ্রামের সব হিন্দু বাড়ির লোকজন একত্রিত হয়ে কেউ ২০ টাকা, কেউ ২৫ টাকা এমন করে ২০০টাকার মত মিলিয়ে আমার হাতে তুলে দিলো। তারপর গেলাম, আমার মাসিমা’র বাড়িতে। মাসিমা’র বাড়ি ছিলো নোয়াখালী সোনাপুর রেলস্টেশনের পূর্বদিকে রাজুরগা গ্রামে। আমার বোনের বিয়ের কথা শুনে আমার মাসিমা আর মাসতুতো ভাই-বোন মিলে আমাকে ২০০টাকার মতো হাতে দিলো। আমি সেই টাকা নিয়ে তিনদিন পর নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি। তারপর কোনোএক সুন্দর লগ্নে কোনও ঝায়-ঝামেলা ছাড়াই সবার সাহায্য সহযোগিতায় বোনের বিহাহের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরদিনই জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে ফেনী ফুলগাজী নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়। এরপর থেকে আমাদের সংসার কিছুটা স্বচ্ছলভাবে চলতে থাকে। বড়দাদা কাজ করতো কিল্লার পুল এলাকায় এক টেক্সটাইল মিলে। আর আমি প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে শুরু করে রাতদুপুর পর্যন্ত রিকশা নিয়েই পড়ে থাকতাম নারায়ণগঞ্জ শহরের পাড়া-মহল্লার আনাচে-কানাচে।

একসময় আমার বড়দাদা কিল্লার পুল সংলগ্ন টেক্সটাইল মিলের কাজ ছেড়ে হাজীগঞ্জ আইইটি স্কুল নামক স্থানে এক নতুন টেক্সটাইল মিলে কাজ নেয়। সেসময় আমি রিকশাই চালাতাম। আমার বড়দাদা আমার পরিশ্রম দেখে আমাকে প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বড় দাদার সাথে কাজ শেখার জন্য বললো। কাজ শিখে রিকশা চালানো ছেড়ে দিতে বললো। বড় দাদার কথামতো আমি তা-ই করতে থাকি। সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রিকশা চালাতাম, আর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে বড়দা’র সাথে টেক্সটাইল মিলের তাঁতের কাজ শিখতাম। একসময় তাঁতের কাজ পুরোপুরি শিখেও ফেললাম। তখন রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়ে বড়দাদা যেই মিলে কাজ করতো, সেই মিলেই কাজ করতে লাগলাম। আমি তখন ২০ বছরের এক যুবক। হাতে-পেয়েও ছিলাম উঁচা-লম্বা। শরীরের দিক দিয়েও ছিলাম আরও দশজনের চেয়ে স্বাস্থ্যবান এক জবরদস্ত যুবক।

সেসময় বাংলাদেশে নতুন একধরনের পলিয়েস্টার সূতার আগমণ ঘটলো। পলিয়াস্টার সূতার কাপড়ের খুবই চাহিদা ছিলো। রেডিওতে প্রতিদিন পলিয়েস্টার সূতার গুণাগুণ প্রচার করা হতো। সেসময় এই বঙ্গদেশের জেলা-শহরগুলোর আনাচে-কানাচে কচুগাছের মতো টেক্সটাইল মিল গড়ে উঠতে শুরু করলো। কোরিয়া, জাপান থেকেও কাপড় তৈরির অত্যাধুনিক মেশিনপত্র আসতে লাগলো। কাপড়ের কারিকর (তাঁতি)-সহ টেক্সটাইল মিলের বিভিন্ন কাজের লোকের চাহিদা বেড়ে গেলো। ঠিক সে-সময়ই আমি হলাম একজন সুদক্ষ তাঁতি। তাঁতের কাজ যেখান থেকে শেখা, সেখানেই অনেকদিন মনোযোগ সহকারে তাঁতের কাজ করলাম। একসময় আমার আর তাঁতের কাজ ভালো লাগছিল না। কারণ তাঁতের কাজ করতে হয়, দিনে-রাতে। এক সপ্তাহ দিনে, এক সপ্তাহ রাতে। রাতজাগা কাজটা আমার ভালো লাগছিল না। শিখলাম উইভিং ডিপার্টমেন্টের (তাঁত বিভাগ) অন্য এক কাজ। সেই কাজটা শুধু দিনেই করতে হয়। তাই খুব মন দিয়ে ওই কাজটা শিখেছিলাম। কাজটার নাম রেসিং ম্যান। কেউ ড্রয়ার ম্যানও বলে। আবার কেউ বলে, ব-গাঁথা বা বয়া-গাঁথা বা হানা-ব ভরা বা শানা-ব ভরা। কাজটা শিখেছিলাম ঠিক, কিন্তু এই কাজটা কোনও মিলে পার্মানেন্ট করতে পারছিলাম না। ওই কাজ শিখেও কাজ জোগাড় করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তাঁতের কাজেই করতে লাগলাম।

একসময় বড়দাদা নগর খাঁনপুর থেকে বাসাও ছড়ে দিলো। নতুন করে বাসা ভাড়া নিলো নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা এলাকায় গোয়ালপাড়া। বড়দাদা বাসা ছাড়ার সাথে সাথে নতুন করে ফতুল্লা কাঠের পুল এলাকায় থাকা একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ নিয়ে নিলো। আমাকেও সাথে নিলো। ওই মিলে মাত্র ৭টা পাওয়ার লোম (তাঁত) ছিলো। মিলের নাম ছিলো, মিলন টেক্সটাইল মিলস্। মালিকের নাম ছিলো, মিলন সাহেব। মালিকের বাড়ি ছিলো বিক্রমপুর। দোকান-সহ ব্যবসা ছিলো ঢাকা ইসলামপুর। ওই মিলে আমরা দুই ভাই একজোড়া তাঁত পার্মানেন্ট নিয়ে নিলাম। আর বাদবাকি তাঁত আরও কয়েকজন কারিকর (তাঁতি) চালাতো। আমার বড় দাদা করতো দিনে, আমার কপালে পড়লো, সেই রাতেই ডিউটি। তবুও বাধ্য হয়ে করতাম। কিন্তু রাতের কাজ আমার ভালো লাগতো না। তাই শখ করে যেই কাজটা আরও আগে শিখেছিলাম, সেই কাজটা আমাকে দেওয়ার জন্য একদিন মালিক মিলন সাহেবকে বললাম। কিন্তু সেই কাজটা তখন মিল এলাকার আবুল নামের একজন লোকে করতো। সেই লোক আবার আরও দুই-একটা মিলে চুক্তিতে কাজ করতো।

একসময় আমার বড়দাদা ওই আবুল নামের লোকটার সাথে আমার ব্যাপারে আলাপ করলো। তখন ওই লোক নিজের ইচ্ছায় মিলন টেক্সটাইল মিলের ড্রয়ার ম্যানের কাজটা আমাকে বুঝিয়ে দিলো। আমি স্থানীয় একটা ছেলেকে(হেলপার) নিয়ে ওই শখের রেসিং-এর কাজটা করতে থাকি। মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতে করতে একসময় নারায়ণগঞ্জ শহরে আনাচে-কানাচে থাকা ছোট-বড় প্রাইভেট টেক্সটাইল মিলে আমার নাম ছড়িয়ে পড়লো। যেখানে যেই মিলেই নতুন পাওয়ার লোম (তাঁত) আসতো আমাকে সেই মিলে কাজ করার জন্য মালিক পক্ষ থেকে অফার দিতো। কিন্তু কোনও মিলে পার্মানেন্ট কাজ বা চাকরি করার কথা দিতাম না। তবে মিলন টেক্সটাইল মিলের কাজের ফাঁকে ফাঁকে হেলপার নিয়ে অন্য মিলে গিয়ে চুক্তিতে কাজ করে দিতাম। তখনকার সময়ে টেক্সটাইল মিলে আমার এই কাজের প্রচুর চাহিদা ছিলো। একটা টেক্সটাইল মিলে মনোমত ১০০জন তাঁতি থাকলেও একজন মনের মতো ড্রয়ার ম্যান থাকতো না। ড্রয়ার ম্যান বা রেসিং ম্যানের কাজটা ছিলো খুবই খেয়ালি ও ধৈর্যশালী কাজ। এই কাজটা করতে হতো নির্ভুলভাবে!
চলবে…

জীবনের গল্প-১১ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৯

জীবনের গল্প-৮-এর শেষাংশ: বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

বোনের মৃত্যুর পর, আর বাবার মৃত্যুর পর আমার মা একরকম আধ-পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি। বোন মরা ভাগ্নীটা আমাদের সংসারে থেকে আস্তে আস্তে হাঁটি-হাঁটি পা-পা, করতে লাগলো। আমিও লেখাপড়া বাদ দিয়ে বড় দাদার সাথে সংসারের বোজা ভাগাভাগি করে মাথায় নিয়ে নিয়মিত কাজ করতে ছিলাম। এরমধ্যে কতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হয়, আসে-যায়! ওইসব ধর্মীয় উৎসবে মিলের ভেতরে থাকা সমবয়সীরা কতো নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে, আনন্দ-উল্লাস করে! কিন্তু আমাকে সবসময়ই থাকতে হয় কাজের ধান্দায়। ঘরে এসে বসে থাকি একমুঠ ভাতে আশায়। এভাবে চলতে চলতে একসময় আদর্শ কটন মিল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা আসলো, মিলের পুরাতন মেশিনপত্র বিক্রি করে মিল আধুনিকায়ন করা হবে। এই ঘোষণার ফলে মিলের সব শ্রমিকরা ছাটাই হয়ে গেলো। শ্রমিকরা চাকরি ছেড়ে যাঁর-যাঁরমতো হিসাব বুঝে নিতে লাগলো। আমার বড় দাদার অবস্থাও আরও দশজনের মতো হলো। কিন্তু তখনো মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ভেতর থেকে ফ্যামিলি কোয়ার্টার ছাড়ার কোনও ঘোষণা দিচ্ছিল না। তাই মিল থেকে বড় দাদার হিসাব বুঝে পেলেও, আমরা মিলের ভেতরেই থাকতে ছিলাম।

তখন মিলের ভেতরে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে বাসাভাড়া ছিল না ঠিক, কিন্তু বড় দাদা চাকরি ছিল না বলে সংসারের অভাব আরও বেড়ে গিয়েছিল। বড় দাদা সার্ভিসের যে ক’টা টাকা এককালীন পেয়েছিল, তা সুদের টাকা আর দোকান বাকি দিতে গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সংসারের বড় বোঝাটা তখন আমার মাথার উপরেই ঠেসে বসেছিল। আমি তখনো আদর্শ কটন মিলে ডেইলি কাজে ছিলাম। সেসময় ১২ টাকা থেকে দৈনিক মজুরি ১৫ টাকা হয়েছিল। একদিন ঠিক দুপুরের আগে একটা বাঁশের মাচার উপর দাঁড়িয়ে একজন মিস্ত্রিকে টিন উঠিয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ বাঁশের মাচা ভেঙে আমার ডান হাতের তালুর একপাশে নতুন টিনের কোণা ঢুকে হাত কেটে যায়। সাথের লোকজন ধরাধরি করে মিলের ভেতরে থাকা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার প্রথমেই আমার হাতে ৭টা সেলাই করলো। তারপর ব্যথা কমানোর জন্য ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে লোক মারফত বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমার এই অবস্থা দেখে আমার মা জ্ঞানহারা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শুনেছিলাম, আমার জ্ঞান ফেরার পর বৌদির কাছে, বড় বোনের কাছে। সেই হাত এক্সিডেন্টে আমি অন্তত একমাস কাজ করতে পারিনি। তবে এক্সিডেন্ট হওয়ার চার-পাঁচ দিন পর মিলে গিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে মিলের সরদার দয়া করে আমাকে প্রতিদিন অর্ধেক হাজিরা হিসাব করে সপ্তাহের দিন দিয়ে দিতো। ওই নামমাত্র টাকা পেয়ে সাথে সাথে বড় দাদার হাতে দিয়ে দিতাম। বড় দাদা তা দিয়ে নগদ-বাকিতে মিলিয়ে সংসার চালাতেন, আর সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতেন।

বড় দাদা ঘুরতে ঘুরতে একসময় একটা কাজও পেয়ে গেলেন। কাজ পেয়েছেন আদর্শ কটন মিল ঘেষা মাউরা মিল নামে একটা ছোট কাপড়ের মিলে। সেই মিলে দিনরাত কাজ করে যেই টাকা পেতো, সেই টাকা দিয়েই কোনরকমভাবে সংসার চলতে লাগলো। আমিও আস্তে আস্তে সুস্থ হতে লাগলাম। একসময় আমি যখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠি, তখন আমার বড় দাদা ওই এক্সিডেন্টের ভয়ে আমাকে আর আদর্শ কটন মিলের ডেইলি কাজে যেতে দিতেন না। দাদার ইচ্ছা আমাকে তাঁর সাথে রেখে কাপড় বুনানোর (তাঁতে) কাজ শেখাবেন। তাই সুস্থ হয়ে দাদার কথামতো প্রতিদিন বড় দাদার সাথে নিকটস্থ মাউরা মিলে যেতাম। দাদার সাথে কাজ শিখতাম।

একদিন হঠাৎ করে বড় দাদার এক বন্ধুর ছেলে মুন্সিগঞ্জ রিকাবি বাজার সংলগ্ন কমালাঘাট থেকে আদর্শ কটন মিলে তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসে। লোকটার নাম সুনিল। ওই লোক (সুনিল) বড় দাদার সাথে দেখা করে আমাদের সংসারের ভালো-মন্দের খবর নেয়। আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বড় দাদা সব বৃত্তান্ত খুলে বলে। তারপর সুনিল কাকা আমাকে কমলাঘাট একটা বড় বাণিয়া দোকানে চাকরি দিতে পারবে বলে বড় দাদাকে কথা দেয়। সুনিল কাকার কথায় আমার বড় দাদা খুশি হয়ে আমাকে সুনিল কাকার সাথে কমলাঘাট যেতে বলে। আমার ইচ্ছা না থাকা স্বত্বেও বড় দাদার কথায় সুনিল কাকার সাথে আমাকে বানিয়া দোকানে চাকরি করতে কমলাঘাট যেতে হয়।

গেলাম মুন্সিগঞ্জ কমলাঘাট। লাগলাম বাণিয়া দোকানে কর্মচারীর কাজে। খাওয়া-দাওয়া দুপুরে রাতে বাণিয়া দোকানের মালিকের বাসায়। সকালের খাবার দোকানের সাথে থাকা এক মিষ্টির দোকানে। প্রতিদিন নাস্তা বাবদ ১ টাকা। তখনকার সময় কমলাঘাটে থাকা মিষ্টির দোকানগুলোতে একটা পরোটার দাম ছিল চারআনা। পরোটার সাথে ডাল-ভাজিও চারআনা। আমি প্রতিদিন নগদ ১টাকা হাতে পেয়ে দুটো পরোটা আটআনা, আর ডাল অথবা ভাজি নিতাম চারআনার। মোট বারো আনা নাস্তা, আর বাকি থাকা চারআনা দিয়ে আধা প্যাকেট কমলাঘাটের নামকরা হোসেন বিড়ি কিনে নিতাম। রাতে দোকানের দোতালায় ঘুমাতাম। সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা খেয়ে দোকানে থাকতাম। দুপুরের একটু আগে মালিকের বাড়ি থেকে মাথায় করে খাবারের ভাত নিয়ে আসতাম। আবার রাতে দোকান বন্ধ করে মালিক-সহ আমরা আরও দুইজন কর্মচারী মালিকের বাড়িতে যেতাম। রাতের খাবার একসাথে খেয়ে আবার দোকানে এসে ঘুমিয়ে পড়তাম।

কমলাঘাট ওই বাণিয়া দোকানে যে-ক’দিন ছিলাম, খাওয়া-দাওয়ার দিক দিয়ে ভালোভাবেই ছিলাম। কিন্তু মাকিল কিছুর থেকে কিছু হলেই গালমন্দ করতে, বকা-ঝকা করতো। এতে আমার মনটা সবসময় খারাপ হয়ে থাকতো। একদিন সুনিল কাকার সবকিছু খুলে বললাম। আমার কথা শুনে সুনিল কাকা তেলে-বেগুনে জেলে উঠলো। ওইদিনই সুনিল কাকা আমার জন্য আরেক মালিকের সাথে আলাপ করলে। তখন মালিক আমাকে তাঁর দোকানে নিয়ে যেতে বললো। পরদিন সুনিল কাকা আমাকে ওই দোকানে নিয়ে গেলেন। এই দোকানের কাজ হলো, তেলের টিনে মুখ ঝালাই করার কাজ। এখানে আরও ৮জন কর্মচারী আছে। ওঁরা কেউ লেখাপড়া জানতো না। মালিকও লেখাপড়া জানতেন না। মালিকের নাম জগদীশ বাবু। উনার এক ভাইও এই কাজে মালিকের সাথেই থাকতো। থাকা, খাওয়া-দাওয়ার জন্য বড় এক গোডাউনে মতো দোকানঘর ছিল। আমার সম্বন্ধে সুনিল কাকা থেকে আগেই শুনেছিল, আমি একটু-আধটু লেখা-পড়া জানি। তাই কাজের মালিক আমাকে এখানে রাখতে চায় এবং এ-দিনই তাঁর এখানে চলে আসতে বলে। মালিকের কথা শুনে সুনিল কাকা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখানে থাকবো কি-না?’ আমি সুনিল কাকার কথায় রাজি হলাম। সাথে সাথে সুনিল কাকা আমাকে নিয়ে আগের বাণিয়া দোকানে যায়। বাণিয়া দোকানে গিয়ে দোকান মালিককে জানিয়ে দেয়, ‘নিতাইকে আমি অন্য জায়গায় কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি। নিতাই আজ থেকে আর আপনার দোকানে কাজ করবে না।’ এরপর আমাকে তেলের মুখ ঝালাইয়ের মালিকের দোকানে এনে দিয়ে যায়। ওই তেলে মুখ ঝালাইয়ের দোকানে আমি প্রায় মাসেক ছয়মাস কাজ করে একবার জগদীশ দাদাকে বলে-কয়ে ছুটি নিয়ে আমাদের বাসায় আসি।

আদর্শ কটন মিলে আসার পর দেখি আমার সমবয়সীরা আদর্শ কটন মিলে নতুন কন্ট্রাক্টারের আন্ডারে কাজ করছে। তা দেখে আমি আর কমলাঘাট ঝালাই কাজে গেলাম না। আমি সমবয়সীদের সাথে আদর্শ কটন মিলে দৈনিক ১৫ টাকা মজুরিতে কাজ করতে থাকি। তখন আদর্শ কটন মিলের পুরাতন মেশিনপত্র বিক্রির পর নতুন মেশিনপত্র আসতে শুরু করলো। মিলের ডিপার্টমেন্টগুলো নতুন করে মেরামত করার জন্য নতুন করে কাজ শুরু হলো। যেই কন্ট্রাক্টর সাহেব এই কাজ পেয়েছিল, উনার নাম ছিল মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন। আমরা কাজের সাইটে সব লেবাররা তাঁকে বিল্লাল ভাই বলেই ডাকতাম। উনি আমার কাজের খুব প্রশংসা করতেন এবং সব লেবারদের চেয়ে আমাকেই বেশি আদর করতেন। আমি ছিলাম ঢালাই মাল বানানোর জন্য এক্সপার্ট। তাই যেদিন ঢালাই কাজ হতো, সেদিন কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাকে হাত খরচ বাবদ ৫-১০ টাকা খুশি হয়ে দিয়ে দিতো। আমিও খুশিতে নিয়মিত প্রতিদিন কাজ করতে লাগলাম।

একসময় আদর্শ কটন মিল কর্তৃপক্ষ মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টার থেকে সবাইকে বাসা ছেড়ে দিতে বললে, আমরা পড়ে যাই বিপাকে। তখন আমার বড় দাদা শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় নগর খাঁনপুর এলাকায় বাসা ভাড়া ঠিক করে। এরপর আমরা সপরিবারে আদর্শ কটন মিল থেকে নগর খাঁনপুর ভাড়া বাসায় গিয়ে উঠি। আমি নগর খাঁনপুর থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করে আদর্শ কটন মিল ওই বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করতে থাকি। আমার কাজ করার এমন ইচ্ছা দেখে সম্মানিত বিল্লাল কন্ট্রাক্টর সাহেব প্রতিদিন মিলের কাজ শেষে আমাকে চার-পাঁচ টাকা করে গাড়িভাড়া বাবদ দিয়ে দিতো। রোজের মজুরি তো থাকতই। সপ্তাহে কাজ করে যা পেতাম, তা বাসায় এসে মায়ের কাছে, নাহয় বড় দাদার কাছে দিয়ে দিতাম। তারপরও আমাদের সংসার চলছিল না। কারণ আদর্শ কটন মিল থেকে আসার পর বড় দাদার কাজ ছিলো না। তখন আমার মা নগর খাঁনপুর মহল্লায় থাকা এক বাড়িতে রান্না-বান্না করার কাজ নিলো। এর ক’দিন পরই বড় দাদাও নগর খাঁনপুরের সাথেই কিল্লার পুল সংলগ্ন একটা টেক্সটাইল মিলে কাজ জোগাড় করে সেই মিলে কাজ করতে লাগলো। আর আমি কাজ করতে থাকি আদর্শ কটন মিলে বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের কাজ।

প্রতিদিন নগর খাঁনপুর থেকে আদর্শ কটন মিলে সকাল-সন্ধ্যা আসা-যাওয়ার মাঝে নগর খাঁনপুর মহল্লার কয়েকজন সমবয়সীদের সাথে পরিচয় হলো। ওঁরা কেউ রিকশা চালক, কেউ ঝালমুড়ি বিক্রেতা, কেউ ভ্যানগাড়ি চালক, কেউ কমলাপুর রেলস্টেশনের চানাচুর বিক্রেতা। একদিন সন্ধ্যাবেলা আমি আদর্শ কটন মিল থেকে নগর খাঁনপুর বাসায় আসছিলাম। আসার পথে রুহিদাস নামে একজন সমবয়সী চানাচুরওয়ালা আমাকে ডাক দিলো, ‘এই শোন!’ আমি ওঁর সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ভাই? বলেন, কি বলতে চান!’ আমাকে বললো, ‘তুই কোথায় কাজ করিছ?’ বললাম, ‘নদীর ওপার আদর্শ কটন মিলে।’ আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কাজ?’ বললাম, রাজমিস্ত্রীর যোগালি কাজ।’ আমার কথা শুনে চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস হাসতে লাগলো। ওঁর হাসি দেখে আমার মাথাটা চেন করে গরম হয়ে গেলো। আমি তখন রাগের মাথায় ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হাসলেন কেন, ভাই?’ আমার রাগ দেখে ও তখন থতমত হয়ে বললো, ‘আরে না, এমনি হাসলাম! যোগালি কাজ করে কি আর পেটের ভাত জুটবে? এর চেয়ে বরং তুই আমার সাথে চানাচুর বিক্রি কর, ভালো ইনকাম হবে।’ তখন আমার মাথা কিছুটা ঠাণ্ডা হলো! আমি বললাম, ‘চানাচুর বিক্রি করতে কত টাকা চালান লাগে, ভাই?’ চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস বললো, ‘তোর কাছে টাকা না থাকলে, আমি নিজেই তোকে চালান-সহ সবকিছু ঠিকঠাক করে দিবো।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা, বাসায় গিয়ে আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করে নিই।’ এই বলেই চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাস থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এসে মাকে সবকিছু বললাম! মা বললো, ‘তুই যেটা করতে পারবি, সেটাই করবি।’

মায়ের কথা শুনে আবার বাসা থেকে বের হয়ে চানাচুর বিক্রেতা রুহিদাসের খোঁজ নিয়ে ওঁদের বাসায় গেলাম। মায়ের সম্মতির কথা জানালাম। রুহিদাস আমার কথা শুনে বললো, ‘তোর কাছে অল্পকিছু টাকা আছে?’ আমি সত্য কথা বললাম, ‘না!’ আমার কথা শুনে রুহিদাস বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আগামীকাল তোকে চানাচুর বিক্রি করার সবকিছু ঠিক করে দিবো। তুই সকালে আমার সাথে দেখা করবি।’ পরদিন সকালে রুহিদাস আমাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গেলো। নারায়ণগঞ্জ থেকে একটা টুকরি, ছোট একটা দাঁড়িপাল্লা, ছোট ছোট কয়েকটা বাটখারা, চানাচুর বানানের জন্য একটা পট, বড় সাইজের দুই প্যাকেট চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ছটাকখানি ভিট লবণ, সরিষার তেল, পেঁয়াজ কাটার জন্য ছোট একটা ছুড়ি কিনলো। মোট খরচ হলো, ১০০ টাকার মতো। এরপর দুইজনে আবার বাসায় আসলাম। বাসায় এসে রুহিদাস সবকিছু টুকরিতে সাজালো। এরপর আমাকে রুহিদাস বললো, ‘তুই বাসা থেকে খেয়ে আয়। আসার সময় একটা গামছা নিয়ে আসবি। তারপর আমরা আস্তেধীরে চানাচুর নিয়ে বের হবো।’ আমি বাসায় গেলাম। ভাতা খেলাম। ভাত খেয়ে একটা গামছা কাঁধে ফেলে রুহিদাসের বাসায় আসলাম। তারপর সন্ধ্যার একটু আগে দুইজনে একসাথে চানাচুর সাজানো টুকরি মাথায় নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন গেলাম। রুহিদাস রেলস্টেশনে বসে চানাচুর সাজানো টুকরির দুইপাশে ছিদ্র করে গামছা বেঁধে দিয়ে বললো, ‘ট্রেন আসলে তুই এক বগিতে উঠবি। আমি অন্য বগিতে উঠবো। প্রত্যেক স্টেশনে নামবি। ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে উঠবি। এভাবে ট্রেন যখন কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দুইজন একসাথ হবো।’

একসময় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে ট্রেন আসলো। যাত্রী ওঠা-নামা করার সময় রেলস্টেশনেই ১০/১২টাকা বিক্রি হয়ে গেলো। ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে সামনে লাগানো হলো। আমরা দুইজনে ট্রেনের দুই বগিতে ওঠালাম। রুহিদাস যেভাবে আমাকে বলেছিল, ঠিক সেভাবেই চানাচুর চানাচুর বলে চিল্লাতে চিল্লাতে ট্রেনের বগিতে বগিতে চানাচুর বিক্রি করতে করতে একসময় কমালাপুর গিয়ে পৌঁছলাম। রুহিদাস আর আমি একসাথ হলাম। রাত তখন ৮টার মতো বাজতে লাগলো। কিন্তু তখনও সব চানাচুর শেষ হয়নি। আমদানি করলাম ৬০ টাকার মতো। রুহিদাস বললো, ‘চিন্তা করবি না! ট্রেন আবার নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার সময় সব চানাচুর শেষ হয়ে যাবে।’ এর কিছুক্ষণ পরই আবার ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার ট্রেন ছাড়ার সময় হলো। আমরা দুইজন দুই বগিতে উঠে গেলাম। ট্রেন ছাড়লো। আবার চানাচুর বিক্রি করা শুরু করলাম।

সেদিন চানাচুর বিক্রি হয়েছিল ১২০ টাকার মতো। আমি রুহিদাসকে ১০০ টাকা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রুহিদাস তখন ওঁর ১০০টাকা ফেরত নেয়নি। রুহিদাস বললো, ‘এই টাকা দিয়ে আগে নিজের চালান করে নে। তারপর আমার টাকা পরিশোধ করবি।’ এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ টু কমলাপুর– কমলাপুর টু নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনে আমি চানাচুরওয়ালা সেজে ট্রেনের এই বগি থেকে ওই বগিতে চানাচুর বিক্রি করতে লাগলাম। অনেক সময় সারারাত পর্যন্ত কমলাপুর রেলস্টেশনে ঘুরে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করতাম। এর মাঝেই একদিন আদর্শ কটন মিলে গিয়ে বিল্লাল কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে চার-পাঁচ দিনের পাওনা টাকা নিয়ে আসলাম। রুহিদাসের দেওয়া চালান বাবদ ১০০টাকা ফেরত দিলাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব অনেক হয়ে গিয়েছিল। একসময় চানাচুর বিক্রি বাদ দিলাম। নগর খাঁনপুর মহল্লার সমবয়সীদের সাথে রিকশা চালানো শিখলাম। রিকশা চালানো শিখে নারায়ণগঞ্জ শহরে রিকশা চালাতে শুরু করলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-১০ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৮

জীবনের গল্প-৭- এর শেষাংশ; আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।

রাস্তার কাজ ছেড়ে মনে অনন্দ নিয়ে ১২ থেকে ২৫ টাকা হাজিরায় গিয়ে লাগলাম, লবণের মিলে। কিন্তু লবণের মিলের কাজ যে ছিল এতো কষ্টের, তা আর আমরা তিনজনের একজনও কাজে লাগার আগে বুঝতে পারিনি। আমাদের দুইজনের আগে থেকে কাজ শুরু করা লোকমানও আমাদের কাছে কিছু খুলে বলেনি। যদি লোকমান আমাদের বলতো, ‘যেই কাজে আছিস সেই কাজেই থাক; লবণের মিলে কাজ করার আশা করিছ না’ তাহলেই আমরা বুঝে নিতাম যে, লবণের মিলে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমরা আর লবণের মিলে গিয়ে কাজে যোগদান করতাম না।

কিন্তু লোকমান তা না বলে, ও আমাদের প্রতিদিনই কাজে যোগদান করার জন্য তোষামোদ করেছিল। কেন তোষামোদ করেছিল, তা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, লোকমানও আমাদের কাছে তা খুলে বলেছিল। আমাদের দুইজনকে ছেড়ে লোকমানের একা-একা লবণের মিলে ভালো লাগছিল না, তাই। যাইহোক, এরজন্য লোকমানের সাথে আমাদের কোনদিন মনমালিন্য হয়নি। আমরা তিনজনই মিলেমিশে একসাথে জাকিরিয়া সল্ট মিলে মনোযোগ সহকারে কাজ করতে ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না, অতিরিক্ত খাটুনির কারণে আর শরীরে ঘা হয়ে যাওয়ার কারণে। এই কাজ করতে গেলে মিলে ঢোকার আগেই সমস্ত শরীরের পান খাবার ‘খয়ের’ মাখিয়ে কাজ করতে হয়। নাহলে শরীরে থাকা একটা ঘামাচি থেকে বড় আকারে ঘা হয়ে যাবে-ই-যাবে। তবু্ও একদিন কাজ করে, আর দুইদিন বসে থেকে অতি কষ্টে কাজ করে যাচ্ছিলাম।

আমাদের শরীরের এ-অবস্থা দেখে সবাই তখন বললো, কাজ করতে করতে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। একসময় হয়েছিলও তা-ই।। কাজের সাথে নিজেদের শরীরও মানিয়ে গিয়েছিল। আমরা যে কাজটা করতাম, সেই কাজের নাম ছিল ‘দৌড়’। লবণের মিলের কাজের এমন আরও নাম আছে। যেমন–খালাসি কাজ, বোজা কাজ, খামালি খাজ, কাচানি বা বেলচা কাজ, দৌড় কাজ, মিস্ত্রি, ফোরম্যান ও রপ্তানি বা ডেলিভারি কাজ। যিনি কাজ চলাকালীন সময়ে দেখবাল করতো, তাঁকে বলা হতো মাঝি বা সরদার। আমরা তিনজনই ছিলাম দৌড়ে। যিনি আমাদের কাজে লাগতে সহায়তা করেছিল, তিনি ইসমাইল মিয়া খামালি কাজ করতেন। উনার নাম ইসমাইল হলেও, মিলের সবাই তাঁকে ইসলাম ভাই বলেই ডাকতো। আমরাও ইসলাম ভাই বলে ডাকতাম।

ইসলাম ভাই’র আরো তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন৷ তখন ইসলাম ভাই বলতেন, ‘আজ থেকে আমরা সাত বন্ধু’। আমরা এক সাথে খেতাম, এক সাথে ঘুমাতাম। মোট কথা সাত মাথা মিলিয়ে হলাম এক মাথা৷ মিলে কাজ করতে হতো আট ঘন্টা৷ ছুটি হতো বিকাল ৫ টায়৷ ছুটি’র পর গা-গোসল করে আর দেরি করতাম না, চলে যেতাম মহেশখালী বাজারে৷ তখন প্রতি কাপ চা’র দাম ছিল চারআনা (২৫) পয়সা৷ সাতজন মিলে চা খেতাম পৌনে দুই টাকা, আর চারআনা দিয়ে চট্রগ্রামের আবুল বিড়ি কিনে নিতাম৷ একেক দিন একেকজন প্রতিদিন বিকাল বেলার চায়ের বিল দিতে হতো। তারপর যেতাম আদিনাথ পাহড়ের উপরে থাকা আদনাথ মন্দিরে। আদিনাথ মন্দিরটি ছিল মহেশখালী বজার হতে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর দিকে। মাঝপথেই জাকিরিয়া সল্ট মিল। সেখানে যাওয়াটা সবার চাইতে আমার একাই যাওয়া হতো বেশি! কারণ, আদিনাথ মন্দিরে নিয়মিত আসা-যাওয়া ফলে মন্দিরের পুরোহিতের সাথে আমার একরকম সখ্য গড়ে উঠেছিল। তখন এমন হয়েছিল যে, আদিনাথ মন্দিরে যদি এক বিকাল যাওয়া না হতো, পরদিন সকালবেলা ঠাকুর মশাই নিজে এসেই আমার তালাশ নিতো। বিকালবেলা মন্দিরে যেতে বলতো। আমিও যেতাম। মন্দিরের পরিবেশটা আমার খুবই পছন্দ হতো তাই। সেসময় আদিনাথ মন্দিরে বসে মন্দিরের ঠাকুর কর্তার সাথে বসে আমার অনেক সময় কেটেছিল।

অনেক সময় সন্ধ্যার পর ঠাকুর কর্তা নিজে অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। এদিকে একটু দেরি হয়ে গেলেই ইসলাম ভাই-সহ মিলের সবার আমার জন্য অস্থির হয়ে যেতো। কারণ লবণের মিলের ভেতরেও আমি ছিলাম সবার পছন্দের একজন মানুষ। মিলের মাঝি, মিস্ত্রি, ম্যানেজার-সহ শ্রমিকদের কাছে আমি ছিলাম খুবই আদরের এবং পছন্দের। এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল শুধু একটুখানি লেখাপড়া জানতাম বলে। কিন্তু তাদের এই আচরণ দেখে আমার খুবই লজ্জা হতো। আমি তাদের সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু না পারতাম না৷ সবাই আমাকে স্নেহ ভালোবাসার চোখেই দেখে রাখতো। কারোর বাড়িতে চিঠি পাঠাতে হলে, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর খাতা-কলম নিয়ে আমাকে বসতে হতো। অনেক সময় কার আগে কারটা লিখবো, এই নিয়েও বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হতো। পরে অবশ্যই সবই ঠিক হয়ে যেতো। এভাবেই মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে কেটে গেলো প্রায় চার মাসের মতো। একসময় লবণের মিল-সহ মহেশখালী বাজারে থাকা বেশকিছু দোকানদার ও এলাকার কিছু স্থানীয় লোকদের সাথে আমার খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। যদিও মিল কর্তৃপক্ষের নিষেধ ছিল, এলাকার কারোর সাথে সখ্যতা বা বন্ধুত্ব না করার, তবুও আমরা কয়েকজন ছিলাম এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। এলাকার কিছু মানুষের সাথে ছিল সুগভীর ভালোবাসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা আর সুনাম তো ছিলোই। সেই সুবাদে মিলেও ইজ্জত পেতাম, মিলের বাইরেও ইজ্জত পেতাম। চলতাম, ফিরতাম, ঘুরতাম, খেতাম, কাজও করতাম সমানতালে।

একসময় ঈদু-উল-ফিতরের আগমণ ঘটলো। রোজা আরম্ভ হলো। হঠাৎ করে বাজারে লবনের দাম কমে গেল৷ ছয়-আনা থেকে চার আনায় নেমে আসলো। মিলের কাজও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। এরমধ্যেই আমার সাথে আসা দুইজনের বাড়ি হতে তাদের ফিরিয়ে নিতে লোক এসে হাজির হলো৷ আমি তাদের দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মায়ের কথা। তাদের কাছ থেকে উত্তর মিলল, ‘তোমার মা আসার সময় আমাদের কিছু বলেনি।’ পরদিন সকালবেলা আমার সাথে আসা দুইজন জাকিরিয়া সল্ট মিল হতে বিদায় নিয়ে মহেশখালী ত্যাগ করলো। ওঁরা চলে যাবার পর আমি হয়ে গেলাম একা৷ তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁরা বলতেন, ‘তুই নিতাই আমাদের আপন ভাইয়ের মতো, আমরা খেলে তুই না খেয়ে থাকবি না।’ তাদের এই শান্ত্বনায় কিছুতেই আমার মন ভরছিল না৷ শুধু অামার মায়ের কথাই মনে পড়ছিল। সেদিন মিলেও তেমন কাজ ছিল না, আমিও আর কাজের ধান্দায় থাকলাম না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লাম মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখতে। চিঠি লিখে দুপুরের আগেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে পোস্ট অফিস থেকে একটা এনভেলপ কিনে ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলে চলে আসলাম মিলে।

মিলে এসে শুনতে পেলাম, মিল কর্তৃপক্ষ লবণের দাম ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মিল বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে কাউকে মিল ত্যাগ করার জন্য চাপ দিবে না। যে থাকার থাকবে, যে যাবার সে অন্যত্র যেতে পারবে। বন্ধ মিলে কেউ থাকলে খাওয়া খরচ মিল কর্তৃপক্ষ থেকে বহন করা হবে। পড়ে গেলাম বিপাকে! সাহস দিচ্ছিলেন, ইসলাম ভাই ও সাথের আরও তিনজন। তাঁরা যেকোনো সাইটে কাজের জোগাড় না করে আর মিল থেকে কোথাও যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছে। আমি থেকে গেলাম তাঁদের সাথেই। এরমধ্যেই মিলের ফোরম্যান সাহেব মিলে যাঁরা-যাঁরা থাকবে তাঁদের নিয়ে নিজ খচরে ঈদ উপলক্ষে মিলের ভেতরেই একটা যাত্রানুষ্ঠান করার কথা জানালেন। এতো আমরা সবাই খুশি হলাম ঠিক, কিন্তু কাজ ছড়া নিজেদের হাত খরচ চালাবো কী করে, তা-ই নিয়েও পড়ে গেলাম দুঃশ্চিন্তায়! তখন মিল বন্ধ হলেও মিল কর্তৃপক্ষ শুধু দুইবেলা খাওয়াতো। দুপুরে আর রাতে। সকালের খাবার ছিল যাঁর-যাঁর কাঁধে। তখন আমরা পাঁচজন সকালের খাবার ও নিজেদের হাত খরচ চালানোর জন্য একটা বুদ্ধি করলাম। বুদ্ধি হলো, মিলের সাথেই একটা খাল ছিল। সাগরের জোয়ার-ভাটার সময় সেই খালের পানিও বাড়ত-কমতো। জোয়ারের পানির সাথে প্রচুর মাছ খালে চলে আসতো, আবার ভাটার সময় পানির সাথে মাছগুলো সাগরেই নেমে যেতো। খালটা ছিল খুবই চিকন। কিন্তু গভীর ছিল।

একদিন আমারা পাঁচজন সেই খালের কিছু অংশ দুইদিকে বাঁধ দিয়ে রাখলাম। জোয়ারের সময় পানি এসে খাল ভরে টবু-টুবু হলো। একসময় ভাটা লাগলো। বাঁধের ভেতরে পানি জমা হয়ে থাকলো। আমরা চারজন দুই ভাগে ভাগ হয়ে খালের পানি সেঁচতে লাগলাম। পানি সেঁচে দেখি, মাছ-আর-মাছ! অনেক মাছ! সেই মাছ টুকরি ভরে মহেশখালী বাজারে নিতেই পথিমধ্যেই সব মাছ বিক্রি হয়ে গেল। প্রথম দিনই মাছ বিক্রি হলো ৫০ টাকার মতো। আহা্! এতো টাকা খাবে কে শুনি! এরপর থেকে আমাদের দেখাদেখি মিলের আরও কয়েকজন ঠিক আমাদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে শুরু করে দিলো। সাথে মিল এলাকার স্থানীয় মানুষেও। সেসময় আমরা বন্ধ মিলের ভেতরে যাঁরা ছিলাম, তাঁরা সবাই দিনের বেলা থাকতাম খালের মাছ ধরার ধান্দায়, আর সন্ধ্যার পর থাকতাম নিজেদের যাত্রাপালার রিয়েসাল নিয়ে ব্যস্ত।

যাত্রার নাম, ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। একসময় আমাদের রিয়েসাল শেষ হলো। ডাইরেক্টর ছিল স্বয়ং মিলের ফোরম্যান সাহেব নিজেই। ঈদের বাকি আছে দুইদিন। ফোরম্যান সাহেব যাত্রা করার জন্য মেকাপম্যান-সহ বাজনা দল ও প্রয়োজনীয় যা লাগে তা আনতে গেলেন চট্টগ্রাম। ঈদের আগের দিন থেকে এলাকায় মিলে যাত্রানুষ্ঠান নিয়ে পড়ে গেলো শোরগোল। ঈদের আগের দিন থেকেই যাত্রানুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরি করা-সহ অনেক বড় জায়গা জুড়ে উপরে তেরপাল দিয়ে ছাউনি দেওয়া হলো। সেই যাত্রাপালায় আমি একাই নিলাম দুই চরিত্র। আমাদের সাথে কোনও মেয়ে অভিনেত্রী ছিলো না। মেকাপম্যান ছিলো খুবই দক্ষ। “চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে” যাত্রাপালায় আমাদের থেকেই এক ছেলেকে নায়িকা বেছে নেওয়া হয়েছিল। ছেলেটাকে এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল, তা দেখে এলাকার সবাই ছেলেটিকে মেয়েই ভেবে নিয়েছিল। আমার চরিত্র ছিলো, চাঁদ কুমারীর সখী। আমাকেও এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল যে, আমাকে আর কেউ চিনতেই পারছিল না। আমার একা দুই চরিত্রের মধ্যে আরেকটি চরিত্র ছিল দাদা নাতি। ঈদের দিন সেই যাত্রানুষ্ঠান শেষ হতে রাত ভোর হয়ে গিয়েছিল। পরদিন এলাকার পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘নায়িকা কোথা থেকে আনা হয়েছিল।’ আমার বলতাম, ‘চট্টগ্রাম থেকে বায়না করে নায়িকা আনা হয়েছে।’ এটাই এলাকাবাসী বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সত্য কথা কেউ বলিনি যে, নায়িকা তো আমাদের মধ্যেই একজন ছিল। বলিনি এলাকার দুশ্চরিত্র কিছু মানুষের ভয়ে। সেই মনের ভয় ক’দিন পরে এমনিতেই কেটে গিয়েছিল। এলাকার কেউ তখন আর এসব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতো না। কিন্তু দেখা দিলো খালে মাছ ধরা নিয়ে নতুন বিপদ!

একসময় মাছ ধরা নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে মিলের শ্রমিকদের মারপিট লেগে যাওয়া মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেলো। তখন আমরা কেউ আর বাজারে যেতে পারতাম না। যদিও বাজারে যেতেম, তাহলে থাকতাম এলাকার কিছু লোকের ভয়ে ভয়ে, গা ঢেক। আবার এলাকাবাসীর সাথে গণ্ডগোল সৃষ্টি হবার পর মিল কর্তৃপক্ষও একরকম ঘাবড়ে যায়। তখন মিল কর্তৃপক্ষ সবাইকে হুশিয়ার করে দেয় এভাবে– “যদি কেউ মিলের বাইরে এলাকার লোকের হামলার শিকার হয়, তাহলে মিল কর্তৃপক্ষ তার দায় নিবে না।” তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে, এখানে আর থাকা যাবে না। এই ভেবে একদিন আমরা পাঁচজন মিল থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাওয়া হবে কালুরঘাট। ইসলাম ভাই-সহ আরও তিনজন এর আগে কালুরঘাটই থাকতো। কাজ করতো চট্রগ্রাম পোর্টে জাহাজ থেকে মাল নামানোর কাজ। তাই মহেশখালী থেকে আবার সেখানেই কাজ করার জন্য যাওয়া হচ্ছে।

আমরা মহেশখালী থেকে চট্রগ্রাম কালুরঘাট গিয়ে ইসলাম ভাইয়ের পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা করলাম। আগের বাসা নেই। নতুন করে একটা বাসা ভাড়া করা হলো। রান্নাবান্না করার জন্য সবকিছু সংগ্রহ করা হলো। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আলরেডি কাজ করা শুরু করে দিলো। আমি জাহাজ থেকে চাল, গম, ভুট্টা-সহ আরও অন্যান্য মালামাল মাথায় করে নামাতে পারবো না দেখে, তাঁরা আমাকে বাসায় রান্না করার দায়িত্ব দিয়ে কাজে চলে যেতো। এর চার-পাঁচ দিন পর একদিন বিকালবেলা আমার বড়দাদা মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তখন মিল ম্যানেজার আমার বড় দাদাকে আনুমানিকভাবে কালুরঘাটের ঠিকানা-সহ ইসলাম, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের নাম লিখে দেয়। আমার বড়দাদা সেই ঠিকানা মতো গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে এবং ইসমাইল, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনই দিবাগত রাতে বড়দাদা আমাকে টিকেট-সহ ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। বড়দাদা চলে যায় আমার ছোট কাকার বাড়ি পার্বত্যচট্টগ্রামের রামগড় গুইমারা বাজার।

আমি পরদিন ভোরবেলা কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে নারায়ণগঞ্জের ট্রেনে চড়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর পায়ে হেঁটে চলে যাই আদর্শ কটন মিলে। মিলে পৌঁছার সাথে সাথে শুরু হয় ঘরে থাকা মা-বাবা, বড় এক দিদি ও বৌদির কান্না-কাটি। বাবা তখন প্রায়ই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। এর দুইদিন পরই আবার শুরু করলাম আদর্শ কটন মিলে ১২ টাকা রোজে ডেইলি কাজ। এর দুইমাস পর-ই বাবা পর-পারে পাড়ি দেয় স্বর্গের ঠিকানায়। আমি তখন আদর্শ কটন মিলে ছিলাম না। আমি ছিলাম, কুমিল্লা দাউদকান্দি থানাধীন গৌরীপুর সংলগ্ন মলয় বাজার সন্নিকটে চিনামুড়া গ্রামে সেজো দিদির বাড়ি। বাবার মুখখানা আর শেষ দেখা আমি দেখতে পারিনি। মেজো দিদির বাড়ি থেকে আসলাম এর পরদিন। বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

চলবে…

জীবনের গল্প-৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৭

জীবনের গল্প-৬-এর শেষাংশ: সেখানেই ওঁরা কাজ করবে।’ এই বলেই কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের এই নির্মাণাধীন ভবনে রেখে উনার বাসায় চলে যায়। আমারা রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁরমতো ঘুমিয়ে পড়ি। রাত পোহালেই যেতে হবে মহেশখালী।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমারা তিনজন একসাথে ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। আমরা তিনজন চলে যাবো বলে ম্যানেজার সাহেব স্বইচ্ছায় আমাদের নিয়ে চলে আসলো টিলার নিচে চায়ের দোকানে। চারজন একসাথে বসে চা-বিস্কুট খেলাম। চা-বিস্কুটের দাম ম্যানেজার সাহেব নিজেই দিয়ে দিলেন, আমাদের কাউকে আর দিতে দিলেন না। তিনি আগেও পকেট খরচ করার জন্য নিজের পকেট থেকে সময় সময় আমাদের এক টাকা দুই টাকা করেও দিতেন। কিছুক্ষণ পর হয়তো কন্ট্রাক্টর সাহেব এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। তাই আমাদের জন্য ম্যানেজার সাহেব খুবই আফসোস করলেন। বিশেষ করে আমরা তিনজন ঢাকাইয়া হওয়াতে ম্যানেজার সাহেব আমাদের খুবই পছন্দ করতেন, আদরও করতেন। কাজের ফাঁকে খোঁজখবর রাখতেন। আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়েও আলাপ করতেন। আমাদের কাজ করার সাহস দিতেন। আমরাও ম্যানেজার সাহেবকে সম্মান করতাম। উনার কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হয়তো আমরা আর এখানে থাকছি না। তাই ম্যানেজার সাহেবের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। মহেশখালী গিয়ে সেখানে ভালোভাবে কাজ করার জন্যও ভালো উপদেশও দিলেন। ভালোভাবে চলার জন্য বললেন। মহেশখালী এলাকার স্থানীয় লোকজনের স্বভাবচরিত্র কেমন এবং তাঁদের সাথে কীভাবে চলাফেরা করবো, সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনাও দিলেন।

চায়ের দোকানে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে বলতেই কন্ট্রাক্টর সাহেব বেবিট্যাক্সি চড়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন। আমাদের তাড়াতাড়ি করে টিলায় গিয়ে বেডিংপত্র নিয়ে আসতে বললেন। আমরা টিলার উপরে গিয়ে বেডিংপত্র গোছগাছ করে বেঁধে সবার সাথে দেখা করে টিলার উপর থেকে নিচে নেমে আসলাম। ম্যানেজারের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম। বেবিট্যাক্সি চড়ে আসলাম কক্সবাজার যাওয়ার নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ডে। তখনকার সময়ে চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজারের বাস ভাড়া ছিল জনপ্রতি ১০ টাকা। বাসে ওঠার আগে কন্ট্রাক্টর সাহেব এক হোটেলে নিয়ে আমাদের নাস্তা খাওয়ালেন।

এরপরই কন্ট্রাক্টর সাহেব-সহ চারজন বাসে উঠে বাসলাম। তখন চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে কয় ঘণ্টা সময় যে লেগেছিল, তা বলতে পারবো না। তবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে আবার এক হোটেলে গিয়ে চারজনে ভাত খেয়ে মহেশখালী যাওয়ার ট্রলার ঘাটে আসলাম। তখন কক্সবাজার থেকে মহেশখালী যেতে ট্রলারে জনপ্রতি ২ টাকা করে ভাড়া ছিল। ট্রলারে চড়ে মহেশখালী যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ট্রলার থেকে নেমে আবার এক চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে কন্ট্রাক্টর সাহেব লোক মারফত উনার ম্যানেজারকে খবর পাঠালেন। ম্যানেজার সাহেব আসলেন। দুইজনে আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন।

থাকার জায়গায়টা হলো, মহেশখালী বাজার থেকে নতুন বাজার যাওয়া রাস্তার পাশে থাকা সরকারি খাদ্য গোডাউন। সেই গোডাউনে তখন সরকারি কোনও খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না। অনেক বড় পাকা দালানের গোডাউন। সেই গোডাউনেই হলো আমাদের তিনজনের থাকার জায়গা। সাথে নেওয়া বেডিংপত্র গোডাউনের এক কোণে রেখে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে বাজারে আসলাম। তিনি আমাদের হাঁড়িপাতিল-সহ ১০-১২ দিনের চাল, ডাল, তেল, লবণ যা লাগে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিলেন। তিনজনকে নগদ ১০০ টাকা করে হাত খরচ দিলেন। সেখানকার কাজের সাইটে থাকা ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং কবে থেকে কাজ শুরু হবে তা ম্যানেজার সাথে বুঝ পরামর্শ করতে বললেন। আর আমাদের যখন যা দরকার হয়, তা ম্যানেজারকে দিতে বললেন। এরপর তিনি মহেশখালী থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলেন। আমরা থেকে গেলাম মহেশখালী।

কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর, আমরা তিনজন মহেশখালী বাজার থেকে মাছ-সহ কিছু কাঁচা তরিতরকারি কিনলাম। সাথে রান্না করার জন্য এক গাট্টি লাড়কিও কিনলাম। গোডাউনে এসে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রান্না করার চুলা তৈরি করলাম। একজন মাছ কাটছে। একজন ভাত রান্না করতে চাল ধুয়ে নিচ্ছে। আমি চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। এক তরকারি-সহ ভাত রান্না হয়ে গেল। তিনজনে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁর বিছানা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার আলুসিদ্ধ ভাত রান্না করে খেয়ে-দেয়ে কাজের ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। ম্যানেজার সাহেব উনার সাথে আমাদের কাজের সাইটে নিয়ে গেলেন। আমাদের যেই কাজের জন্য মহেশখালী নেওয়া হলো, সেই কাজটা হলো মহেশখালী থেকে সোজা পশ্চিমে নতুন বাজার পর্যন্ত মোট ১৩ মাইল সিসি ঢালাই রাস্তা তৈরির কাজ।

ম্যানেজারের সাথে কাজের সাইটে গিয়ে দেখা গেল, সেখানকার স্থানীয় লেবাররা সেদিন তখনো কেউ সাইটে আসেনি। ম্যানেজার সাহেব কাজের সাইটে কোথায় কী কী মাল আছে তা দেখিয়ে দিলেন। সেদিন সেখানে ম্যানেজার-সহ আমরা সেখানকার স্থানীয় লেবারদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু কারোর কোনও খবর হচ্ছিল না দেখে ম্যানেজার সাহেব সেদিনের জন্য কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে আমাদের নিয়ে সোজা মহেশখালী বাজারে চলে আসে। সেদিনের জন্য আমরা পুরোপুরি ফ্রি হয়ে গেলাম। আমাদের কাছ থেকে ম্যানেজার বিদায় হবার পর, আমরা মহেশখালী পুরো বাজারটা ঘুরে-ফিরে দেখে চা-বিস্কুট খেয়ে দুপুরের আগে আমাদের গোডাউনে চলে আসি। নিজেরা রান্নাবান্না করে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার তিনজনে মহেশখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সাগর পাড়ে ঘুরা-ঘুরি করে করে সন্ধ্যাবেলা চলে আসলাম নিজেদের থাকার জায়গা গোডাউনে।

পরদিন সকাল হতে-না-হতেই সেখানকার স্থানীয় লেবাররা গোডাউনে এসে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে ওঠালো। তাড়াতাড়ি ভাত রান্না না করেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে নাস্তা করে তাঁদের সাথে কাজে যোগদান করি। সেদিন কাজ করে স্থানীয় লেবারদের সাথে পরিচিত হলাম। পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আর থামছিল না। সারাদিন গোডাউনে আর বাজারে ঘুরা-ঘুরি করে সময় শেষ করলাম। এভাবে সেখানে প্রতিদিন হাঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির কারণে সেই কাজ আর আমরা বেশিদিন করতে পারিনি। প্রতিদিন সারাদিনের মধ্যে একবেলাও ঠিকমতো কাজ চলছিল না। ম্যানেজার সাহেবও আমাদের ঠিকমতো বাজার সাদাই করার খরচ দিচ্ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবেরও খবর ছিল না। তখনকার সময়ে এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোনও ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবের ডাক ঠিকানাও আমাদের জানা ছিল না। তাই নিজেদের পকেট খরচের কথা চিন্তা করে গোডাউনে থেকেই কাজ না থাকলে অন্য কাজ খুঁজতে থাকি।

একসময় বাজারে আসা-যাওয়ার মাঝেই এক লোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। লোকটির নাম মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া । তিনি মহেশখালী বাজারের উত্তরে জাকিরিয়া সল্ট নামে এক লবণের মিলে কাজ করতো। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের সব বিষয়-আশয় জানলেন, শুনলেন। আমাদের কোনপ্রকার চিন্তা না করার পরামর্শ দিলেন এবং জাকিরিয়া সল্টে তাঁদের সাথে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তিনি জাকিরিয়া সল্টে গিয়ে উনার আরও তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আমাদের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। এরপর দুইদিন যেতে-না-যেতেই তিনি ইসমাইল মিয়া আমাদের কাজ রেডি করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু আমরা গোডাউন খালি রেখে তিনজন একসাথে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এরমধ্যেই যদি কন্ট্রাক্টর সাহেব চট্টগ্রাম থেকে এখানে এসে আমাদের খুঁজে না পায়, তাহলে হয়তো আমাদের গার্ডিয়ানের ভয়ে মহেশখালী বাজারে থাকা থানায় জিডিও করতে পারে। সেজন্য আমরা তিনজন একসাথে এখান থেকে সরাসরি লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে রাজি হয়েছিলাম না।

তখন ইসমাইল মিয়া আমাদের বুদ্ধি দিলেন সপ্তাহে একজন করে রাস্তার কজা ছেড়ে লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে। আমরা তা-ই রাজি হয়ে আগে আমাদের সাথে থাকা লোকমান নামে লোকটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজ করার জন্য সুপারিশ করি। প্রতিদিন কাজের মজুরি ২৫ টাকা। আহা্! শুধু টাকা আর টাকা! এতো টাকা খরচ করেও শেষ করা যাবে বলে আমারা তিনজনই মনে মনে হিসাব কষতে ছিলাম। পরদিন সকালে লোকমান নামে বন্ধুটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে পাঠালাম। লোকমান লবণের মিলে কাজে লেগে গেলেন। আমরা দুইজন রাস্তার কাজেই থেকে গেলাম কন্ট্রাক্টর সাহেবের আগমণের আশায়। কিন্তু না, বেশকিছু দিন গত হয়ে গেলেও যখন আর কন্ট্রাক্টর সাহেব আসছিলেন না, তখন একদিন জাকিরিয়া সল্ট মিলের ইসমাইল মিয়ার শরণাপন্ন হলাম। ওই রাস্তার কাজ থেকে সরিয়ে আনতে আমাদের পক্ষ হয়ে ওই কাজের ম্যানেজারের সাথে আলাপ করার জন্য অনুরোধ করালাম।

তখন ইসমাইল মিয়া তাঁর আরও দুইতিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়ে একদিন বিকালবেলা ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে আমাদের দুইজনকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজে লাগিয়ে দেয়। আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।
চলবে…

জীবনের গল্প-৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-৪

জীবনের গল্প-৩ এর শেষাংশ: বারবার মনে পড়ছে বই কেনার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার কথা। টাকার জন্য আমার তখন শোকে ধরে গেল। বই কেনা হলো না, অথচ টাকা খরচ করে ফেললাম! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই টাকা যে করেই হোক জোগাড় করবোই। গেলাম বন্ধুদের সাথে টেলিভিশন দেখতে। বাসায় ফিরে সেদিন আর পড়তে বসিনি। দুইটা আটা রুটি খেয়ে শুয়ে রইলাম।

রাত ভোর হওয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে প্রতি দিনের মতো ঘরে বসে স্কুলের পড়া শেষ করি। তারপর, কিছু খেয়ে বই নিয়ে স্কুলের চলে যাই। বই কিনতে গিয়ে সিনেমা দেখে বাসায় আসার পরও আমার কাছে অবশিষ্ট ৭ টাকার মতন থেকে যায়। সেই টাকা আর খরচ করি না, সাথে করেই স্কুলে যাই। আবার সাথে করে নিয়ে আসি। মায়ের কাছেও দেই না, বড় দিদিদের কাছেও না। উদ্দেশ্য ২০টাকা মেলাতে পারলে মায়ের কাছে দিয়ে দিবো, বাবাকে দিয়ে দিতে।

এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে ঘনিষ্ঠ ক্লাসমেট যে-ক’জন ছিল, ওঁদের সাথে পুরান ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র বই-সহ বাদ থাকা বইগুলো কারোর কাছে পাবো কিনা আলাপও করি। উদ্দেশ্য যদি কারোর কাছে বাদ থাকা বইগুলো পাওয়া যায়, তাহলে আর বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হবে না, অল্প টাকায় হয়ে যাবো। এভাবে নিজেও বাদ থাকা বইগুলো সংগ্রহ করার জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি, কিন্তু পাইনি। যেই বইগুলো আমার কাছে ছিল না, সেই বইয়ের পড়া ক্লাসের ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের বই থেকে কিছু কিছু করে রাফখাতায় লিখে রাখতাম। বাসায় এসে সেগুলো পড়তাম। এভাবেই চলতে থাকলো আমার স্কুলের ক্লাস। একসময় প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও ঘনিয়ে আসতে লাগলো। পড়ে গেলাম দুশ্চিন্তায়! আমি শিওর ছিলাম পরীক্ষা দিলে আমি পাস করতে পারবো না, একশো পার্সেন্ট ফেল। তারপরও নিজের চেষ্টা নিজেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

এরমধ্যেই একদিন স্কুল ছুটি হওয়ার পর বাসায় আসার পথেই আদর্শ কটন মিলের ডেলি লেবারদের সাথে দেখা। তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকে সন্ধ্যার পর কোনও কাজ আছে কিনা?’ একজন বললো, “আছে, কয়েক হাজার ইট নৌকা থেকে নামাতে হবে। টাকা নগদ নগদ। মানুষ কম দেখে এখনো মিলের সরদারের কাছে কেউ গিয়ে আলাপ করিনি। যে-কয়জন আছি তাতে নৌকা থেকে এতগুলো ইট নামানো সম্ভব হবে না। তুই যদি কাজ করতে চাস, তাহলে বাসায় গিয়ে খেয়ে-দেয়ে তাড়াতাড়ি করে মিলের গেইটে চলে আয়, আমরা সবাই মিলের সরদারের খোঁজে গেইটের সামনেই আছি।

ওঁদের কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কোনরকম দু’চারটা খেয়ে, বন্ধুদের সাথে খেলা-ধুলার চিন্তা বাদ দিয়ে সোজা মিল গেইটে গিয়ে হাজির হলাম। ওঁরা ছিল ছয়জন। আমি-সহ হলাম সাতজন। নৌকা ভর্তি ইট। মিলের সরদারের সাথে কথা হলো, সব ইট নৌকা থেকে নামিয়ে মিলের ভেতরে জায়গামতো খামাল দিয়ে রাখতে হবে। আমরা রাজি হলাম, তা-ই করে দিবো। টাকা দিতে হবে ১৫০ টাকা। সরদার এতে রাজি হলো না। সরদার ১২০ টাকা দিতে রাজি। আমরা তা-ই রাজি হয়ে নৌকা থেকে ইট নামানোর জন্য যাঁর যাঁর মতো প্রস্তুতি নিয়ে নৌকার উপরে চলে গেলাম।

সাথের লেবারদের চেয়ে আমি বয়সে সবার ছোট ছিলাম বলে, ওঁরা আমাকে সবসময় হালকা-পাতলা কাজ দিয়ে রাখতো। ওইদিনও আমার কাজ ছিল অন্য লেবারদের মাথায় ইট সাজিয়ে দেওয়া। ওঁরা সবাই আদর্শ কটন মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা শ্রমিকদেরই ছেলে-পেলে। মিলের ভেতরেই থাকতো। কিন্তু লেখাপড়া করতো না। সারাদিন ঘুরে-ফিরে সময় কাটাতো। নানারকম কাজ করে নিজেদের পকেট খরচ জোগাড় করতো। আদর্শ কটন মিলের ভেতরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার পর থেকে এমনিতেই ওঁরা আমাকে কাছে ডাকতো। ওঁরা সবাই বিড়ি-সিগারেট টানতো। চা-পানও খেতো। কিন্তু আমি তখনো এসবের ধারেকাছেও ছিলাম না।

ওঁরা আরও অনেক আগে থেকে আমাকে মাঝেমধ্যে বলতো, “আরে বেডা, লেখাপড়া কইরা কী অইবো? আমাগো লগে থাইক্কা কাম কর! নিজের পকটে টেকা থাকলে হগলতে জিগাইবো, ডাকবো।” কিন্তু আমি আগে ওঁদের কথায় কান দিতাম না, নিজের লেখাপড়া নিয়েই টেনশনে থাকতাম। কিন্তু সংসারের অভাব অনটনের জন্য পেরে উঠতে পারছিলাম না। অনেক পরে হলেও শেষমেশ ওঁদের কথাই আমার কান দিতেই হলো। তাই ওইদিন গৌরাঙ্গ কাকার হাতে মার খাওয়ার পর থেকে ২০ টাকা মেলানোর জন্যই আমি ওঁদের পিছনে ঘুরঘুর করি। টুকটাক কাজও করি। ওইদিনের কাজটা হলো অন্যসব দিনের চেয়ে বড় কাজ এবং বেশি খাটুনির কাজ! পুরো একটা বড় নৌকা থেকে অনেকগুলো ইট নামাতে হচ্ছে।

একসময় নৌকা ভর্তি ইটগুলো আমরা খালি করে ফেললাম। রাত তখন আনুমানিক ১০ টার মতো হবে। আমি সেদিন টাকা পেলাম ২০ টাকা, ওঁরা নিয়ে নিলো ১০০টাকা। আমি ২০ টাকা হাতে পেয়ে মনের আনন্দে বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে ২০টাকা দিলাম। মা ২০ টাকা হাতে পেয়ে হা করে আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললো, “এতো টাকা এত রাতে কোথায় পেলি? চুরি করেছিস নাকি?” আমি হেসে বললাম, ‘না মা, চুরি করিনি। নৌকা থেকে মিলের ইট নামিয়েছি।’ বাবা তখন বাসায় ছিল। আমার কথা শুনে বাবা আমার সামনে এসে বললো, “তাহলে তো তোর আর লেখাপড়া হবে না। তোর মন এখন টাকার দিকে চলে গেছে।” বাবার কথার উপর মা আবার বলে উঠলো, “টাকার দিকে মন যাবে না তো কোথায় যাবে? ওঁর বই নেই, খাতা নেই, কলম নেই, স্কুলের নামমাত্র বেতন দিতে পারি না। সামনে ওঁর পরীক্ষা। তাহলে ছেলে কী করবে? ও ঠিকই করেছে। এখন থেকে ওঁর নিজের খরচ নিজেই জোগার করে নিতে পারবে। ওঁর পেছনে আর কারোর দুই টাকা খরচ করতে হবে না।” এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “যা গামছাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি গাঙ থেকে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাও।” বাবার কথার উত্তর আমার আর দিতে হয়নি। যা বলার মা-ই বলে দিয়েছে। বাবা চুপ করে ঘরে গিয়ে শুইয়ে রইল। আমি গামছা কাঁধে নিয়ে সোজা শীতলক্ষ্যা নদীর ঘাটে স্নান করতে চলে গেলাম।

এদিকে মা তাড়াতাড়ি গৌরাঙ্গ কাকার বাসা থেকে একবাটি ভাত চেয়ে এনে আমার জন্য রেডি করে রেখেছিল। তারপর মা আমাকে দুটো রুটি-সহ চেয়ে আনা ভাতগুলো সামনে দিলো। আমার মা সেদিন বুঝতে পেরেছিল যে ছেলে আমার কঠিন খাটুনির কাজ করে এসেছে। এখন ঘরে থাকা এই দুটো রুটিতে আমার ছেলের পেটের এক কোণাও ভরবে না। তাই আমি স্নান করার জন্য ঘরের বাইর হতেই, মা গৌরাঙ্গ কাকার বাসা থেকে ভাত এনে রেখে দিয়েছিল। ভাত খেতে বসে মাকে আস্তে আস্তে বললাম, ‘মা, আজ দেখছি রুটি আবার ভাত? রুটিও করেছ, ভাতও রান্না করেছ?’ মা বললো, ‘আরে না, রুটিই বানিয়ে ছিলাম। তোর জন্য দুটো রুটি রেখেছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে তোর গৌরাঙ্গ কাকার ঘর থেকে একবাটি ভাত হাওলাৎ এনেছি, তুই খা।” আমি আবার আস্তে আস্তে মাকে বললাম, ‘মা, বই কিনতে গিয়ে যেই টাকা হারিয়েছি, তা আজ অনেক কষ্ট করে আপনার কাছে এনে দিলাম। এই ২০টাকা বাবাকে দিয়ে দিবেন।’ মা বললো, “তোর বই নেই। আগে বই কিনে আনবি।” আমি বললাম, ‘মা, আর দু-এক দিন কাজ করতে পারলে বই কেনার টাকা আমার এমনিতেই হয়ে যাবে। আপনি এই টাকা বাবাকে দিয়ে দিবেন।’ আমার কথা শুনে মা বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, আগে তুই ভাত খেয়ে নে।” রুটি আর ভাত খেয়ে নিজের শোবার জায়গায় গিয়ে চুপচাপ শুইয়ে রইলাম।

পরদিন সকালে যথারীতি ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে যখন ঘরে বই নিয়ে পড়তে বসলাম। আমার এক বোনের বড় মায়াদি সকালের খাবার নিয়ে আমার সামনে রাখলো। খাবার রেখে রাতে মায়ের কাছে দেওয়া ২০টাকা আমার পড়ার টেবিলের উপর রেখে বললো, “বাবা বলেছে এই টাকা দিয়ে বই কিনে আনতে। নাহলে বাবা রাগ করবে।” আমি আর দিদিকে কিছুই বললাম না, দিদির রাখা ২০টাকা বইয়ের ভেতরে রেখে দিলাম। স্কুলের সময় হলে স্কুলে চলে গেলাম। সাথের ক্লাসমেটদের সাথে নতুন বই কেনার ব্যাপারে আলাপ করলাম। ওঁরা বললো, “নতুন বই কিনতে হলে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে না। ২নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের বাজারেই পাওয়া যাবে।” নিশ্চিত হলাম। স্কুল ছুটির পর একজন ক্লাসমেটকে অনুরোধ করে বললাম, ‘আমার সাথে একটু ২নং ঢাকেশ্বরী বাজারে যেতে হবে।’ ও রাজি হয়ে বললো, “চল যাই।” ওমনি দেরি আর না করে গুদারা নৌকা করে নদী পার হলাম। দুইজনের গুদারা ভাড়া পাঁচ পয়সা করে দশ পয়সা আমি দিবো মনে করে ভাড়া আদায়কারীর সামনে গিয়ে এক টাকার একটা নেট দিতে গেলে ভাড়া আদায়কারী আর রাখলো না।বললো, “যাও!” কিছুই বোঝার চেষ্টা না করে দশ পয়সা বেঁচে গিয়েছে, সেই আনন্দ মনে নিয়ে দুইজনে হাঁটতে হাঁটতে ২নং ঢাকেশ্বরী বাজারে চলে গেলাম, বইয়ের দোকানে।

আমার সাথে টাকা ছিল ২৬ টাকার মতন। চারটা নতুন বইয়ের দাম হয়ে গেল ২৭ টাকার মতো। কিন্তু আমার কাছে আছে এক টাকা কম! সাথে যাওয়া স্কুলের বন্ধুটি বললো, “তোর কাছে কত আছে?” বললাম, ‘এক টাকা কম আছে।’ ওমনি লাইব্রেরির মালিক বললো, “দাও দাও, এক টাকা আর দিতে হবে না, বই নিয়ে যাও।” ২৭ টাকা দোকানদারকে দিয়ে বইগুলো নিয়ে নিলাম। সাথের স্কুল বন্ধুটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই তোর কাছে যাবার গুদারা ভাড়া আছে?’ ও বললো, “আমাদের গুদারা ভাড়া প্রতিদিন দিতে হয় না। আমরা মাসে একবার দেই। তাও সেটা দেওয়া হয় মিল থেকে। দেখলি না, আসার সময় যে গুদারা ভাড়া নেয়নি!’ ওঁর কথা শুনে চিন্তামুক্ত হয়ে দুইজনে আবার নদী পার হলাম। ওঁকে অনেকখানি পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। আমি নতুন বই সাথে করে বাসায় পেলাম। বাসায় গিয়ে আগেই নতুন বইগুলো মাকে বড় দিদি ও বৌদিকে দেখালাম। তাঁরা বই দেখে খুশি হলো। মা জিজ্ঞেস করলো, “বইয়ের দাম কত?” আমি বললাম, ‘বেশি না, ২৭ টাকা।’ মা বললো, “দিলাম ২০ টাকা, বইয়ের দাম ২৭ টাকা। বাদবাকি টাকা কোথায় পেলি?” বললাম ‘আমার কাছে সেদিনের ৭/৮ টাকা ছিল। ওই টাকা মিলিয়ে সব বই একবারেই কিনে আনলাম। আমার আর বইয়ের চিন্তা করতে হবে না।’ আমার কথা শুনে বাসার সবাই খুশি হয়ে গেলো। আমি নতুন বই নতুন করে পড়ার ইচ্ছায় তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে যা ছিলো তা খেয়ে বই পড়তে বসে পড়লাম। সেদিন সন্ধ্যার পরও বাসা থেকে আর বের হইনি। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ার টেবিলেই ছিলাম। কারণ ক’দিন পরই পরীক্ষা।

তাই একটু মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া-সহ স্কুলে যাওয়া-আসাও ঠিকমতো করছি। যাঁদের সাথে মাঝেমধ্যে কাজ করি, ওঁদের সাথে আমার আগেরেই কথা; বিকালবেলা যদি কোনও কাজ থাকে, তাহলে যেন দয়া করে আমাকে কাজ দেয়। তাই সময় সময় ওঁরা বিকালবেলা কোনও কাজ পেলে, লোকের শর্ট থাকলেই আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যেতো। আমি ওঁদের সাথে কাজ করতাম। যা কয়টা টাকা পেতাম মায়ের কাছে এনে দিতাম। এভাবে চলতে চলতে একসময় পরীক্ষার দিনতারিখ নির্ধারণ হলো। এক এক করে সব পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট বের হলো। স্কুলের নোটিশ বোর্ডের সবার নিচে আমার নাম দেখলাম। মানে টেনেটুনে পাস করলাম। তাতে আমি একটুও মন খারাপ করিনি, বরং খুশি হয়েছি। এর ক’দিন পরই আমার বাবা দুপুরবেলা উনার কর্মক্ষেত্রে অ্যাক্সিডেন্টে করলো। বাবা কাজ করতো শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের আউট অফ সাইড ক্যালেন্ডারে। বাবার বাম হাতের চারটে আঙুল থেঁতলে গিয়েছিল।

দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই একদিকে তাড়াতাড়ি করে বাবাকে মিলের গাড়ি দিয়ে নিয়ে যায়, নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল। আরেকদিকে লোক মারফত খবর পাঠায় আদর্শ কটন মিলের ভেতরে আমাদের বাসায়। আমি ছিলাম স্কুলে। বড় দাদা ছিল আদর্শ কটন মিলে নিজের কাছে। খবর পেয়ে আমার মা বড় দুই বোন বৌদি কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গিয়ে বড় দাদাকে খবর দিলো। বড় দাদা গেইটপাস নিয়ে তাড়াতাড়ি মিল থেকে বের হয়ে মাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয়। আমি স্কুল থেকে আসার পথেই লোকমুখে বাবার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে দৌড়ে বাসায় এসে দেখি, আমার বড় দিদি দুইজন বৌদি, ভাতিজি-ভাতিজা, বাসার সামনে বসে বসে কাঁদছে। আমাকে দেখে তাঁদের কান্না আরও বেড়ে গেলো। তাঁদের সাথে আমিও হাউমাউ করে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম। ওইদিন সবার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ! বড়দাদা আর মা বাবাকে ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল থেকে প্রথমে চিত্তরঞ্জন কটন মিলে আনে। তারপর বাসায় আসলো রাত দশটার সময়। বাবার অবস্থা তখন বেশি ভালো ছিল না। ওইদিন বাসার সবাই মিলে সারারাত বাবার পাশে বসে রাত পার করেছিলাম।

চলবে…

জীবনের গল্প-৫ এখানে।

জীবনেরগল্প-১ এখানে।

জীবনের গল্প-২

জীবনের গল্প-১-এর শেষাংশ: থাকতাম মিলের শ্রমিক ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। সময়টা তখন হতে পারে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর নাহয় ডিসেম্বর মাস।

গ্রামের বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পর প্রায় মাসখানেক পর্যন্ত আমার কোনও বন্ধুবান্ধব ছিল না এবং মিলের ভেতরে থাকা শ্রমিক কোয়ার্টারের কোনও সমবয়সী ছেলে আমার সাথে কথাও বলতো না। আমিও মিলের ভেতরে থাকা ওঁদের সাথে বেশি মিশতাম না। কারণ আমার নোয়াখালীর ভাষা ওঁরা কেউ বুঝতো না। আমি কিছু বলতে গেলেই আরও চার-পাঁচজন হিহিহি করে হাসতো। ওঁরা আমাকে দেখলেই নোয়াখাইল্লা নোয়াখাইল্লা বলে হাসাহাসি করতে। আবার আমার চেহেরাটা বেশি সুশ্রী ছিল না বলে, ওঁরা আমাকে দেখে ভেংচি দিতো।

আসলে ওঁদের কোনও দোষ ছিল না। দোষ ছিল আমার কুশ্রীত চেহারার। আমার মুখমণ্ডল আরও দশজনের চেয়ে অন্যরকম ছিল। মানে কুশ্রী। চেহারা কুশ্রী হওয়ার কারণ হলো, আমার বয়স যখন চার বছর; তখন নাকি আমি গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিনমাস পর্যন্ত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে রোগমুক্ত হয়েছিলাম। শুনেছিলাম মা-বাবা ও বড়দাদা আর বোনদের মুখে। এই তিন মাসে গুটিবসন্ত রোগে আমাকে নাকি কঠিনভাবে আক্রান্ত করে ফেলেছিল। সেসময় আমাকে নাকি বাঁচিয়ে রাখার কোনও উপায়ই ছিল না। তবুও মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় নাকি বেঁচে গিয়েছিলাম।

আমার শরীরে নাকি বসন্ত রোগের সাত জাতের মধ্যে সাত জাতই দেখা দেয়েছিল। আগেকার মানুষে বলতো, একজন মানুষের যদি একসাথে সৈয়দ, দাউদ, বরণ রোগ দেখা দিতো, তখন নাকি ওই মানুষটার মরণই হতো। তাই কথায় আছে, “সৈয়দ, দাউদ, বরণ, এই তিন জাত উঠলে হয় মরণ।” আমার শরীরে উঠেছিল সাত জাত। এগুলো হলো, “সৈয়দ, দাউদ, বরণ, ছালাকাটা, মসুরিকাটা লুন্তি ও বসন্ত।” এই রোগ ছিল ছোঁয়াচে রোগ। একবার এক গ্রামে বা মহল্লায় দেখা দিলে, তাহলে পুরো গ্রামের ঘরে ঘরে এই রোগ ছড়িয়ে পড়তো এবং শতশত মানুষ মারা যেতো। কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছিলাম, আমার মা-বাবার আপ্রাণ চেষ্টার কারণে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায়। বলে বলে রাখা ভালো যে, আমার এই রোগের কারণে অন্যকোনো পরিবারের মানুষ তখন এই ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হয়নি। এই রোগের রুগী শুধু আমি একাই ছিলাম।

আমার শরীরে যখন এই রোগ দেখা দেয়, তখন আমি গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। সাতদিন পর্যন্ত আমার মা গ্রাম্য কবিরাজ থেকে ঝাড়ফুঁক, ঔষধ ও পানি পড়া খাওয়ানোর পরও যখন আমি ভালো হচ্ছিলাম না, তখনই আমার মা নিকটস্থ পোস্ট অফিস থেকে বাবাকে টেলিগ্রাফ করে পাঠায়। বাবা তখন মায়ের পাঠানো টেলিগ্রাফ পেয়ে সাথে সাথে ধারদেনা করে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে এসে মা-সহ আমাকে অতি কষ্টে আমার সুচিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যায়। মা আমাকে নিয়ে উঠলো, আদর্শ কটন মিলের শ্রমিকদের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে থাকা পরিচিত একজনের বাসায়। আমাকে নিয়ে যাঁর বাসায় গিয়ে উঠল, ওই লোক ছিল আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বাবার সাগরেদ। আমার এই ছোঁয়াচে রোগ হওয়ার পরও ওই লোক তাঁদের একটা রুম আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। যাতে আমার কোনো সমস্যা না হয়। ওই বাসায় থাকা খাওয়ার কোনও সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল শুধু আমার চিকিৎসার সমস্যা। তখন আমার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, আমাকে দেখে সবাই বলেছিল, আমাকে আর বাঁচানো যাবে না। নিশ্চিত মৃত্যু। আমার মা-বাবাও আমার আশা একরকম ছেড়ে দিয়ে নিকটস্থ ১নং ঢাকেশ্বরী কনট মিলের শ্রমিক কলোনিতে থাকা একজন কবিরাজের শরণাপন্ন হলেন। তিনি শুধু এই রোগেরই চিকিৎসা করতেন। গ্রামের বাড়ি থেকে আমাকে নারায়ণগঞ্জ আনাও হয়েছিল এই কবিরাজকে দেখানোর জন্য।

তখনকার সময়ে এদেশে এই রোগের কবিরাজি চিকিৎসা ছাড়া অন্যকোনো সুচিকিৎসা ছিল না। আমাকে যে কবিরাজ চিকিৎসা করেছিল, তিনি ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তিনি মাশীতলা দেবী’র সাধন করতেন এবং যেখানেই এই রোগ দেখা দিতো, সেখানেই দৌড়ে যেতেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। উনার চিকিৎসায় এই রোগ থেকে সেরে ওঠলে নামমাত্রও কিছু নিতেন না। আমার এই রোগ হওয়ার আগে থেকেই ওই সাধকের পরিবারের সাথে আমার মা-বাবার খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাই এই চিকিৎসক আমার সু-চিকিৎসার জন্য এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের বাসায় বসেই মা শীতলা দেবী’র পূজা করতেন এবং আমাকে চিকিৎসা করতেন। উনি প্রচুর মদপান করতেন। শীতলা দেবী’র পূজা সেরে উনি মদ পানের সাথে আমার শরীরও নাকি চেটে খেতেন। শুনেছি মায়ের মুখে।

সেসময় এই গুটিবসন্তের কারণে আমার সমস্ত শরীরই পচন ধরে গিয়েছিল। শরীরের পুরো অংশই ছিল মাংসবিহীন। চৌকির উপর কলাপাতা বিছিয়ে তিলের তেল কলাপাতায় মেখে সেখানে আমাকে শোয়াইয়ে রাখতো। এমনিতেই এই রোগ হলে একরকম চুলকানির মতো রোগ। এই রোগ হলে সমস্ত শরীরই চুলকায়। শরীর চুলকানির কারণে আমি নাকি সবসময়ই আমার দুইহাত দিয়ে মুখমণ্ডল-সহ সারা শরীর সারাক্ষণ খামচাতাম। এজন্য আমার হাত পা চৌকির চার পায়ার সাথে বেঁধে রাখা হতো। যাতে আমি হাত পা দিয়ে শরীর না খামচাতে পারি। তবুও মাঝে মাঝে হাত দিয়ে খামচানোর ফলে, আমার মুখমণ্ডলের মাংস (ত্বক) হাতের নখের খোঁচায় এদিক-সেদিক হয়ে গিয়েছিল। সাথে দু’চোখের মনিতেও গুটিবসন্ত উঠেছিল। তিনমাস মৃত্যুশয্যা থেকে সেরে উঠার পর অন্তত বছরখানেক আমি অন্ধ মানুষের মতো দু-হাত নেড়ে-চেড়ে চলতাম। ওই কবিরাজের সাজেশন মতো পুকুরে জন্মানো বড় আকারের শামুকের জল প্রতিদিন তিনবেলা কয়েক ফোঁটা করে দেওয়ার পর আমার চোখ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুখমণ্ডল থেকে সরে যাওয়া মাংস(ত্বক) আর সমান হয়নি। আমার চেহারা এখনো কুশ্রী।

এই কুশ্রী চেহারা আর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষার কারণে আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে থাকা সমবয়সী ছেলেরা আমাকে দেখে একরকম ঘৃণাই করতো। হাসতো, ভেংচি দিতো। এতে আমার খুব রাগ হতো। অনেক সময় বেশি রাগ হয়ে যেতো। তখন মিল অভ্যন্তরে অনেক ছেলেকে ধামধুম মেরে নিজেদের বাসায় এসে বসে থাকতাম। আর বাড়ি থেকে সাথে আনা পুরানো বইগুলো নিজে নিজেই পড়তাম। এভাবে আস্তে আস্তে নিজে নিজেই নারায়ণগঞ্জের কিছু আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করে ফেললাম। বাসার বাইরে যেতাম। মিলের ভেতরে স্থায়ীভাবে থাকা সমবয়সী ছেলেরাও আস্তে আস্তে আমাকে কাছে ডাকতে শুরু করলো। ওঁদের সাথে খেলতে বলতো। আমিও ওঁদের সাথে মিশতাম, খেলতাম। যখন যা-ই করতাম, বাসায় এসে নিয়মিত পুরানো বইগুলো একা একা নেড়ে-চেড়ে পড়তাম। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য মায়ের কাছে কেঁদে কেঁদে বলতাম। মা শুনতেন, কিন্তু আমার কথায় সায় দিতেন না। কারণ আদর্শ কটন মিলের ফ্যামিলি কোয়ার্টারে সব ফ্যামিলিদের মধ্যে আমরাই ছিলাম একেবারে নিকৃষ্ট ফ্যামিলি। মানে অভাবগ্রস্ত ফ্যামিলি।

তখন আমাদের সংসার ছিল মা-বাবা, দাদা-বৌদি, দুকজন ভাতিজা, একজন ভাতিজী, অবিবাহিত দুই বোন ও আমি-সহ মোট নয়জন সদস্যের বিরাট এক সংসার। ইনকাম করার মতো ছিল আমার বাবা আর বড়দাদা। তাও ছিল নামমাত্র বেতন। মাসের প্রত্যেক দিনই তিনবেলার মধ্যে শুধু দুপুরবেলাই আমাদের কপালে ভাত জুটতো। আর দিনের দুইবেলার মধ্যে কোনো-কোনো সময় শুধু একবেলা খেতে পারতাম। আর একবেলা থাকত হতো আকাশ পানে চেয়ে। তখন মিল কর্তৃপক্ষ থেকে প্রত্যেক শ্রমিক ও স্টাফের রেশন কার্ড দেওয়া ছিল। আমাদেরও ছিল। বাবারও ছিল। বড় দাদারও ছিল। রেশন কার্ডে শুধু চাল, গম, চিনি পেতাম। আমাদের সংসার মাসের অর্ধেক সময় রেশন কার্ডের উপর নির্ভর থাকতো। কোনো-কোনো সময় নগদ টাকা না থাকার কারণে রেশন তুলতে পারতাম না। তখন সামান্য লাভে রেশন বিক্রি করে দিতে হতো। ওই রেশন বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে অন্য কারোর রেশন থেকে গম কিনে নিতাম। সেই গম থেকে আটা করে সকাল-বিকাল আটার রুটি খেতাম। সময়টা তখন ১৯৭৩ সালের শেষদিকে। এরই মধ্যে দেশে দেখা দিতে শুরু করলো দুর্ভিক্ষ। এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করানো যেন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ালো। তবুও আমার পড়ার আগ্রহ দেখে সংসারের অভাব অনটনের মধ্যেও ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে আমার বড়দাদা নিকটস্থ দক্ষিণ লক্ষ্মণ খোলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেয়।

তখন দেশের চারদিকে দুর্ভিক্ষ! জায়গায় জায়গায় মানুষ না খেয়ে মরছে, এমন খবর সবসময়ই সবার মুখে মুখে থাকতো। সেসময় আমাদের মতো কষ্ট এদেশে আর কেউ হয়তো করেনি। দুইবেলা আটার জাউ ছিল আমাদের সংসারের নিয়মিত খাবারের তালিকায়। আর দুপুরবেলা চালের সাথে বেশি করে আলু কুচি দিয়ে ভাত রান্না করা হতো। মানে চালের উপর চাপ কমানো। চাল কম, আলু বেশি। সেসময় অভাব অনটন যে কী তা আমি এতো বুঝতাম না। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় তামার দুই পয়সার জন্য মায়ের কাছে চেয়ে কাঁদতাম। কোনও দিন পেতাম। কোনও দিন আবার পেতাম না, কাঁদতে কাঁদতে বই বগলে নিয়ে স্কুলে চলে যেতাম। স্কুলে গিয়ে দেখতাম আরও দশজন সমবয়সী মনের আনন্দে আইসক্রিম খেতো, বুট ভাজা খেতো, এটা খেতো, সেটা খেতো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখতাম, আর চোখের জল ফেলতাম। তবুও পারতপক্ষে কোনও দিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করিনি। আমি আমার ক্লাসে সবসময়ই নিয়মিত ছিলাম। ঘরে খাবার না থাকলেও, আমি বান্দা স্কুলে যেতাম।

সেই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের হাইস্কুলে ভর্তি হলাম ঠিক, কিন্তু সংসারের অভাব অনটন আমাকে দুর্বল করে তোলে। স্কুল থেকে বাসায় আসার পর যখন দেখতাম ভাতের হাঁড়িতে ভাত নেই, তখন কাউকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা আদর্শ কটন মিলের খেলার মাঠের এককোণে নিরিবিলি বসে থাকতাম অথবা সমবয়সী বন্ধুদের সাথে খালি পেটে খেলায় মেতে থাকতাম। অনেকসময় সন্ধ্যাবেলা বন্ধুদের সাথে লক্ষ্মণখোলা জনতা ক্লাবে টেলিভিশন দেখতে চলে যেতাম। তখন আদর্শ কটন মিলে টেলিভিশন ছিল না। তখনকার সময়ে টেলিভিশনের খুবই দাম ছিল, মান ছিল, সম্মান ছিল। এখনকার মতো ঘরে ঘরে, মহল্লার আনাচে-কানাচে, হাটবাজারে টেলিভিশন ছিল না। টেলিভিশন ছিল সাতরাজার ধন, মানিক রতন। যা ছিল স্বপ্নের ব্যাপার-স্যাপার।

অনেকসময় টেলিভিশন দেখতে গিয়ে লক্ষ্মণখোলার স্থানীয় ছেলেদের হাতে মাইর-গুতা খেয়ে বাসায় ফিরতাম। বাসায় এসে দেখতাম রাতের খাবার তখনও জোগাড় হয়নি। না খেয়ে ওমনি বই নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে থাকতাম। অনেক রাতে বড় দিদিরা ভাত খেতে ডাকতো। কোনও দিন ওঠে খেতাম। কোনও দিন আর উঠতাম না। না খেয়েই ঘুমিয়ে থাকতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে জল দেওয়া পান্তাভাত খেয়ে আবার পড়তে বসতাম। স্কুলে যাবার সময় হলে শীতলক্ষ্যা নদীতে স্নান করে তাড়াতাড়ি স্কুলে চলে যেতাম। স্কুল ছুটির পর বাসায় এসে কোনও দিন দেখতাম ভাতের হাঁড়িতে ভাত আছে, কোনও দিন দেখতাম ভাত নেই। এভাবেই সেসময়কার দিনগুলো আমাদের অতিবাহিত হতে লাগলো। দেশের দুর্ভিক্ষও তখন আস্তে আস্তে হাত নেড়ে দূরে যেতে লাগলো। কিন্তুক আমাদের সংসারে লেগে থাকা দুর্ভিক্ষ তখনও দূর হয়নি। বারোমাসি দুর্ভিক্ষ আমাদের সংসারের লেগেই থাকলো। সেসময় স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাকও আমার ছিল না। বাবা ও বড়দাদা মিল থেকে পাওয়া রিজেক্ট কাপড় দিয়ে বড়দি’র হাতে বানানো জামা- হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। পায়ের স্যান্ডেলও ছিল না।

চলবে…

জীবনের গল্প-৩ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

কান্নার প্রতিযোগিতা

করোনা কালে চলছে কান্নার প্রতিযোগিতা,
কান্নার চাপে হারিয়ে গেছে সহমর্মিতা
কাঁদছে কবিদের লেখা কবিতা
কাঁদছে বিশ্বের মানবিকতা
পর্যটনে নীরব নিস্তব্ধতা
কান্নার প্রতিযোগিতা।

কান্নার প্রতিযোগিতায়,
কাঁদে স্বজন হারানোর বেদনায়
কেউ কাঁদে ভুগে ঘাতক করোনায়
কেউ কাঁদে দ্বারে-দ্বারে ক্ষুধার জ্বালায়
কাউ কাঁদে রাস্তায় সন্তানের অবহেলায়
কেউ কেউ নীরবে কাঁদে ধুঁকে ধুঁকে লজ্জায়।

কাঁদছে কেউ নিজের আখের গোছানোর ধান্দায়,
টাকার পাহাড় গড়তে কাঁদছে বসে অট্টালিকায়
জনপ্রতিনিধিরা চোখ মুছে চালের বস্তায়
কেউ কাঁদার অভিনয়ে পরকে ঠকায়
অসাধু ব্যক্তিরা সুযোগে কাঁদায়
কন্নার প্রতিযোগিতায়।

কান্নার প্রতিযোগিতায়,
কান্নায় ভেঙে পড়ছে নমুনা পরীক্ষায়
কান্না থামছে না হাসপাতালের বারান্দায়
চলছে কান্নার প্রতিযোগিতা জায়গায় জায়গায়
কেউ কাঁদে সুখে, কেউ দুখে, কেউ কাঁদে ধান্দায়
প্রতিদিন নতুন যোগ হচ্ছে কান্নার প্রতিযোগিতায়।

ছবি গুগল থেকে।

জীবনের গল্প-১

নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন একটি ছোট গ্রামের নাম মাহাতাবপুর। মাহাতাবপুর গ্রামটি হলো নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে। সেই গ্রামের এক হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম। আমার জন্ম ৮ই জুন, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। আমার বাবার বাপদাদার আমলটা নিজের চোখে না দেখলেও, তাঁদের সময়টা খুবই ভালো ছিল বলে মনে হয়। কারণ, মাহাতাবপুর গ্রামে আর কারোর বাড়িতে দালান ঘর ছিল না। দালান ঘর শুধু পুরো গ্রামের মধ্যে আমাদের বাড়িতেই ছিল। তাও আবার ঘরগুলো ছিল চাটগাঁর (চট্টগ্রামের) পাহাড়ি মাটির দিয়ে তৈরি। ঘরগুলো দেখতে হুবহু গুদামঘরের মতনই দেখা যেতো। যার কারণে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় আমাদের বাড়ির নাম ছিল মাইডগা গুদাময়ালা বাড়ি। আমার দাদার নাম ছিল পঞ্চনন্দ পাল। বাবার নাম শচিন্দ্র চন্দ্র পাল। আমার বাবার আরও দুই ভাই ছিল। মেজো কাকা যতিন্দ্র চন্দ্র পাল। ছোট কাকার নাম ছিল, শান্তিরঞ্জন পাল। আমরা ছিলাম চার বোন, দুই ভাই। নিমাই চন্দ্র পাল, রাধা (রাধু) রাণী পাল, মায়া রানী পাল’ জ্যোৎস্না রানী পাল, মিলন রানী পাল ও আমি নিতাই চন্দ্র পাল ছিলাম সবার ছোট।

মায়ের মুখে শুনেছিলাম আমার ঠাকুরদা’র কথা। আমার ঠাকুর’দা ছিলেন তখনকার সময়ে ছোটখাটো ব্যবসায়ী। তিনি চাটগাঁ (চট্টগ্রাম) থেকে বিভিন্ন মালামাল পাইকারি এনে নোয়াখালী চৌমুহনী বাজারে বিক্রি করতেন। ঠাকুরদা’র চৌমুহনী বাজারে দোকানও ছিল। মাল রাখার গোডাউনও ছিল। ঠাকুরদা মাসের মধ্যে অন্তত ৬/৭ দিন চট্টগ্রামে থাকতেন। আমাদের বাড়ির দালান ঘরগুলো যেই মাটি দিয়ে তৈরি হয়েছিল, সেই মাটি তখনকার সময় আমার ঠাকুরদা নৌকা যোগে চট্টগ্রাম থেকেই এনেছিলেন। ঘর তৈরির কারিকরও ছিল চট্টগ্রামের। ঘরের দেয়াল ছিল দুইহাত পাশ। ঘরের ভেতরে প্রয়োজন মতো কোঠাও ছিল। বর্ষাকালে বন্যা থেকে রেহাই পেতে ঘরগুলো ছিল বাড়ির উঠোন থেকে অনেক উঁচু। আমার ঠাকুরদা’র দেখাদেখি আমার বাবার কাকা জেঠারাও চাটগাঁ থেকে মাটি এনে একই পদ্ধতিতে তাঁদের সীমানায় মাটির ঘর তৈরি করেছিল।

আমার ঠাকুর’দা চাটগাঁ থেকে মাটি এনে ঘর তৈরি করার একটা কারণ ছিল। কারণ হলো, তখনকার সময়ে রড সিমেন্টের খুবই অভাব ছিল। যা ছিল, তা কেবলমাত্র বিদেশে, আর এদেশে যাঁদের তেমন অর্থকড়ি ছিল তাঁদের জন্য ছিল। তবুও বিদেশের মত এই বঙ্গদেশে তখন ঘরের আনাচে-কানাচে সিমেন্ট পাওয়া যেতো না। যাঁদের অট্টালিকা তৈরি করার সামর্থ্য ছিল, তাঁরা দেশীয় তৈরি ছোট আকারের ইট পেক-মাটি দিয়ে অট্টালিকা বা ইটের দালানঘর নির্মাণ করতো। তা আগেকার সময়ের তৈরি পুরানো স্থাপনাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। আগেকার দিনের পুরানো দালান ঘরগুলোতে দেখা যায়, দোতলা ঘর তৈরি করা হয়েছে লোহা বা কাঠের মাচার উপর। দেওয়াল বা প্রাচীর বা বাউন্ডারির ওয়াল করা হয়েছে সিমেন্টের পরিবর্তে মাটি দিয়ে। তখনকার সময়ে যদি সিমেন্ট পাওয়া যেতো, তাহলে আমার ঠাকুর দাদাও ইট-সিমেন্টের সমন্বয়ে বাড়ির ঘরগুলো তৈরি করতো। সিমেন্টের অভাবের কারণেই আমার ঠাকুরদা দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতো বাড়ির ঘরগুলো তৈরি করেছে চাটগাঁইয়া মাটি দিয়ে। এই মাটির ঘর আমাদের বাড়ি ছাড়া গ্রামের আর কারোর বাড়িতে ছিল না বলেই, আমাদের বাড়ির ডাকনাম হয়েছিল মাইডগা গুদামওয়ালা বাড়ি। আমি সেই মাইডগা গুদামওয়ালা বাড়ির ছেলে। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম! পাঁচ বছর বয়সে সেখানেই আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি।

আমি ছোট থেকে একটু বড় হয়ে দেখেছি, আমার বাবার জেঠাতো ভাই’রা স্বচ্ছল স্বাবলম্বী থাকলেও; একই বাড়িতে আমাদেরই ছিল অভাব অনটনের সংসার। আমার বাবার দুই ভাই শান্তি রঞ্জন পাল ও যতিন্দ্র পাল। তাঁদের মধ্যে শান্তি কাকা একসময় আমার বাবার সাথে নারায়ণগঞ্জই চাকরি করতেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি তিনি পার্বত্যচট্টগ্রাম রামগড় গুঁইমারা বাজার নামক স্থানে সপরিবারে বসবাস করছে। যতিন্দ্র কাকা মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে চাঁদপুর থাকতেন। চাঁদপুরেই তিনি বিয়ে-সাদী করে সেখানেই ছিল তাঁর স্থায়ী বসবাস। যদিও খুব ছোটকালে যতিন্দ্র কাকা আমাকে দেখেছিল, কিন্তু আমি বুঝের হয়ে যতিন্দ্র কাকাকে একবারও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুধু জানতাম যতিন্দ্র নামে আমার আরেকজন কাকা আছে। আমি বুঝের হয়েও আমার ঠাকুরমাকে দেখেছি। ঠাকুরমার আদর পেয়েছি। কিন্তু আমার ঠাকুরদা’কে কখনো দেখিনি। আমার ঠাকুরমা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে দেশ স্বাধীন হবার কয়েকমাস পরেই পরপারে পাড়ি দিয়ে স্বর্গীয় হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ যখন স্বাধীন হয়, আমি তখন সাত/আট বছরের নাবালক এক শিশু। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সময়কার স্মৃতিগুলো এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে সময়কার কথা আমার মৃত্যুর আগপর্যন্তই মনে থাকবে বলে মনে হয়। মনে পড়ে সে সময়ের কথা। তখন আমাদের সংসারে খুবই অভাব অনটন ছিল। এর আগে থেকেই ছিল আমাদের সংসারে অভাব। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ! আমাদের গ্রামে আমাদের মতো এতো অভাব অনটন আর কারোর সংসারে ছিল না। পুরো মাহাতাবপুর গ্রামে সবকটা পরিবারে মধ্যে আমাদের পরিবারই ছিল সবসময়ের জন্য অভাবগ্রস্থ। কারণ বাড়ির একটা মাটির ঘর ছাড়া আমাদের আর কোনও জায়গা-জমি ছিল না, তাই। আমাদের সংসার চলতে বাবা এবং আমার বড়দা’র চাকরির বেতনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে বাবা ও বড়দা’র টাকা পাঠানো একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আমাদের সংসারে থাকা সবাই দিনের পর দিন বেশিরভাগ সময় না খেয়েই থাকতে হতো। সময়তে সকালের খাবার রাতে মিলতো। আবার দুপুরবেলায় জুটলেও রাতে জুটতো না।

মুক্তিযুদ্ধের আগে গ্রামের অন্যসব গৃহস্থের জমিতে ধান কাটার সময় আমরা ভাইবোন মিলে ধান কুড়াতাম। সেই কুড়ানো ধানের কিছু চাল দিয়ে পূজাপার্বণে চিড়ামুড়ির চাহিদা মেটাতাম। বাকি চালগুলো নিজেদের সংসারে কয়েকদিনের খোরাকও হয়ে যেতো। এছাড়াও সময় সময় আমিও বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড় থেকে কচুর লতি, আর সুপারিগাছ থেকে ঝরে পরা সুপারি কুড়িয়ে বড় জেঠার সাথে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। যা পেতাম, তা মায়ের কাছে অথবা বড়দি’র কাছে বুঝিয়ে দিতাম। সেই পয়সা থেকে মা আমাকে পহেলা বৈশাখের আগে চৈত্র-সংক্রান্তির মেলায় কিছু পয়সা দিতেন। আর কিছু দিতে দুর্গাপূজা শেষে লক্ষ্মীপূজার সময়। আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যা দু’চার পয়সা থাকতো, তা আমার মা সংসারেই খরচ করতো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গ্রামের কোনো গৃহস্থেরা জমিতে চাষাবাদ করেনি। আর আমিও আগের মতো কিচুর লতি, সুপারি কুড়িয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারিনি। তাই সেসময় আমাদের সংসারে ছিল দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা। অবশ্য এই অবস্থা ছিল, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে বাবা বাড়িতে না আসা পর্যন্ত।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে বাবা খালি হাতে বাড়ি ফিরল। তখন মায়ের শেষ সম্বল একজোড়া কানের দুল বন্ধক রেখে কিছু টাকা সংগ্রহ করা হয়। সেই টাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাবা মড়ি বিক্রি শুরু করেন। এই মুড়ির ব্যবসা করেই সেই সময়টা কোনওরকমে টেনেটুনে পাড় হয়েছিল। একসময় দেশ হানাদার মুক্ত হয়ে স্বাধীন হলো। বাবার চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে যায়। ছোট কাকা সপরিবার নিয়ে চলে যায় পার্বত্যচট্টগ্রামের রামগড় গুঁইমারা বাজার। বড়দাদাও শরনার্থী জীবন ত্যাগ করে ভারত থেকে দেশে ফিরে এসে আবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

এর ছয়মাস পরই আমার চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বিয়ে ঠিক হয়েছে নারায়ণগঞ্জই। ছেলে (জামাই) নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড় লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের শ্রমিক ছিল। ছেলে লোকমুখে আমার এই বোনের গুনগান শুনেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। যৌতুক বা অন্যকোনো লেনা-দেনার আবদার ছিল না তাঁর। শুধু বিয়ের কার্যসম্পাদন সম্পন্ন করে দিতে পারলেই হলো। আমার বাবা ও বড়দাদা তাতেই রাজি হয়ে বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি করে ফেললো। বিবাহের কার্যসম্পাদন হবে নারায়ণগঞ্জই। এই বোনের বড় রাধারাণী নামে যেই বোন ছিল, ওঁর বিয়ে আরও অনেক আগেই হয়েছিল। রাধু দিদির যখন বিয়ে হয়, তখান আমার বয়স হয়েছিল মাত্র দেড়বছর। সে বোনের বিয়ের কাহিনি শুনেছি মায়ের মুখে। কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র মনে নেই, স্মরণেও নেই।

তবে এই মেজো বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানে আমি আমার মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম। মেজো বোনের বিয়ের চার-পাঁচ দিন আগে আমার বড়দাদা নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে এসে মেজো বোন-সহ মায়ের সাথে আমাকেও নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গিয়েছিল। দেখেছি এবং মনেও আছে। বোনের বিয়েতে গিয়ে মায়ের সাথে নারায়ণগঞ্জ মাসেক খানেক থেকে, আমাদের গ্রাম ও বাড়ি দেখানোর জন্য বোন-সহ জামাইবাবুকে সাথে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। তখন দেশের অবস্থা বেশি ভালো নেই! তখন চোর ডাকাতের উপদ্রবে সারা দেশের গ্রাম শহরের মানুষ একরকম অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। আমার মেজো বোনের জামাই(জামাইবাবু) বাড়িতে থাকাকালীন সময়েও একবার ডাকাতদল আমাদের বাড়িতে হানা দিয়েছিল। সেই ভয়ে আমার জামাইবাবু মেজো বোনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আমাদের গ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে যায়।

সেসময় চোর ডাকাতদের উপদ্রবে আমরা আর গ্রামের বাড়িতে বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। আমাদের গ্রামে আরও অন্যান্য বাড়ির মধ্যে আমাদের বাড়িতেই ডাকাতদের হানা ছিল বেশি। এর কারণ হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীদের আড্ডা ছিল। এতে আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের অনেকেই মনে করতো যে, আমাদের বাড়িতেই মুক্তিবাহিনীরা ক্যাম্প স্থাপন করেছে। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের বাড়িতেই ডাকাতদের হানা ছিল সবচেয়ে বেশি। ডাকাতদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় আমরা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে চলে এলাম নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে। থাকতাম মিলের শ্রমিক ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। সময়টা তখন হতে পারে ১৯৭৩ সালের নভেম্বর নাহয় ডিসেম্বর মাস।

চলবে…

জীবনের গল্প-২ এখানে।

স্বপ্ন দেখা

স্বপ্ন প্রতিটি মানুষই দেখে। কারণে অকারণে দিনে-রাতে স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছে। কেউ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের ডানা মেলে এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমিও স্বপ্ন দেখি প্রতিদিন, প্রতি রাতে। স্বপ্ন দেখি দিনের বেলাতেও। স্বপ্ন দেখা আমার নতুন কিছুই নয়। স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই দেখছি। ছোটবেলা ঘুমের ঘোরে যদি স্বপ্ন দেখতাম, আর যদি সেই স্বপনের দৃশ্যগুলো মনে থাকতো; সেই দৃশ্যগুলো মায়ের কাছে বলতাম। আগেকার সময়ে স্বপ্ন দেখা নিয়েও অনেক কুসংস্কার ছিলো। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখাও অনেকে বিশ্বাস করে থাকতো। আমার মা-ও একজন কুসংস্কার প্রিয় মানুষ ছিলেন। মায়ের কাছে যখন স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর কথা বলতাম, তখন আমার মা সেসব দৃশ্যগুলোর বিশ্লেষণ করতেন।

যদি স্বপ্নে কোনও সাপ দেখতাম, তাহলে মা বলতেন, ‘সাবধানে থাকিস! বিপদ হতে পারে।’ যদি মৃত: মানুষ দেখতাম, তাহলে মা বলতেন, ‘আপনা দেখলে পরের হয়, পরেরটা দেখলে নিজেদের হয়। তুই কি মরা মানুষ নিজের কাউকে দেখেছি?’ যদি বলতাম, ‘না মা, আমি স্বপ্নে অপরিচিত একজনকে মরতে দেখেছি।’ তাহলে মা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলতেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে রে! কী জানি হয়! জিজ্ঞেস করতাম, ‘কি হবে মা?’ মা ধমক দিয়ে বলতেন, ‘স্বপ্নে পরের মরা দেখা ভালো না! এতে নিজেদের ঘাড়ে বিপদ এসে ভর করে।’ এরপর থেকে আমার মা খুব টেনশনে থাকতেন। ক’দিন পর দেখতাম আমাদের কারোই কোনও বিপদ হয়নি! তখন মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘মা, তুমি না বলেছিলে স্বপ্নে পরের মরা দেখলে নিজের কাঁধে বিপদ এসে ভর করে! আজ কয়েকদিন গত হলো, কই আমাদের তো কারোই কোনও বিপদ হয়নি।’ তখন আমার মা আমাকে শান্তনা দিয়ে বলতেন, ‘বিপদ কেটে গেছে,বাবা। সব সময় কি আর স্বপ্ন ফলে? তবে এসব দেখা ভালো না। স্বপ্ন শয়তানেও দেখায়।’ জিজ্ঞেস করতাম তা আবার কেমন স্বপ্ন মা?’ মা বলতেন, ‘শয়তানে তোকে ঘরের বাইরে নিয়ে বলবে হিসু দেয়। তুই যদি শয়তানের কথায় হিসু দিস, তাহলে সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখবি যেই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলি, সেই বিছানায় হিসু দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছিস।’

আসলেও এমন আকাম-কুকাম মাঝে মাঝে আমার ঘটে যেতো। এরজন্য আমার মা ঠাকুর, মোল্লা, মুন্সি, ওঝা বৈদ্য, গ্রাম্য কবিরাদের কাছ থেকে কেজি খানেক তাবিজ-কবজ আমার গলায় বেঁধে রাখতেন। সেই তাবিজের গাট্টি গলায় ঝুলিয়ে মাসের পর মাস আমার বিছানা ভিজানোর দায়ে সাজা ভোগ করতে হতো। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ শয়তানের প্রবঞ্চনায় পড়ে বিছানা ভিজিয়ে রাখতাম। অবশ্যই ছোটবার সেই শয়তান মনে হয় বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাকে ছেড়ে অন্য কারোর কাঁধে চড়েছিল। কিন্তু সেই ছোটবেলার স্বপ্নের শয়তানের শয়তানির কথা আমার আজও মনে আছে। ছোটবেলার স্বপ্নগুলোর কথা যখন মনে পড়ে, তখন একা একা ভাবি!

সেই ভাবনা থেকে আমি এখনো ঘুমের ঘোরে খুবই সাবধানে থাকি। কারণ, ঘুমের ঘোরে সেই ছোটবেলার শয়তানটা যদি আবার ওইসব আকাম-কুকাম ঘটায়! তাই খুব সাবধানে স্বপ্ন দেখি। মা বলতেন, ‘ঘুমের ঘোরে কখনো খাবার খাবি না। ঘুমের ঘোরে খাবার খেলে পেটখারাপ হবার সম্ভবনা থাকে।’ তাই আমি ঘুমের ঘোরে কখনো কোনও রাজপ্রাসাদে যেতাম না। কারণ সেসব রাজপ্রাসাদে অনেকরকমের দামী-দামী খাবার থাকে। যদি লোভে পড়ে খেয়ে ফেলি! তাহলে তো আমার পেটের পীড়া নিয়ে ভুগতে হবে। তাই আমি ওইস নামি-দামি রাজ-রাজাদের প্রসাদে না গিয়ে থেকে যেতাম গরিবের ভাঙা ঘরে। নহয় বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা কোনও বস্তিতে। বস্তিঘরে কোরমা, পোলাও, চিকেন বিরিয়ানি থাকে না। বস্তি ঘরে থাকে পান্তাভাত। ভূলবশত জল ঢালা পান্তাভাত খেয়ে ফেললেও, অন্তত পেটখারাপ হবে না। গরিবের পান্তা ভাতে ভিটামিন আছে। শান্তা ভাতে পেটখারাপ হবার কোনও লক্ষ্মণ দেখা দিবে না।

আবার আমি স্বপ্নে কখনোই প্যারিস, লন্ডন, আমেরিকার শিকাগো শহরেও যাই না, যাইওনি। কারণ আমি গরিব মানুষ! লেখাপড়া কম জানেওয়ালা একজন অধম মানুষ! লন্ডন, আমেরিকা, ফ্রান্স, প্যারিসের ইংরেজি ভাষা আমি জানি না, বলতেও পারি না। ভাষা না জানলে, আর না বুঝলে যে বিপদে পড়তে হয়, সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে। তাই আর ঘুমের ঘোরে স্বপ্নেও ওইসব ইংরেজি ভাষাভাষীদের দেশে আমি যেতাম না। আমি বাঙালি। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা। তাই আমি স্বপ্নের মাঝে থেকে যেতাম, আমাদের নারায়ণগঞ্জ শহরের চাঁনমারি বস্তি কিম্বা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশে যত্রতত্র ফেলে রাখা দুর্গন্ধময় বর্জ্যের পাশে থাকা বস্তি ঘরে।

ঘুমের ঘোরে কখনো বিমানে চড়িনি, দমবন্ধ হয়ে যাবে বলে। আমার ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে চড়া হতো আগেকার সময়ের গরুগাড়ি, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, আর গরিবের ভাঙাচুরা রিকশায়, নাহয় নারায়ণগঞ্জ টু সদরঘাট মুড়িরটিন বাসে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে সাবমেরিন চড়ে মহাসাগরের তলদেশে যাইনি কখনো, নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো বলে। যদি সাবমেরিনে চড়ে পানির নিচে গায়েব হয়ে যাই, তাহলে আমার দুখিনী গিন্নী সারাজীবন আমার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে। তাই অসহায় গিন্নীর কথা চিন্তা করে স্বপ্নে কখনো সাবমেরিনে চড়িনি।

তবে হ্যাঁ, একবার নাসার মহাকাশযান যানে চড়তে চেয়েছিলাম। অত্যাধুনিক রকেটে চড়ে চাঁদের দেশে যেতে চেয়েছিলাম, চাঁদের বুড়ির সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য ছিলো, চাঁদের বুড়ির যুগযুগ ধরে কাটা সুতাগুলো পাইকারি দরে কেনার। অনেকেই বলতে পারেন, ‘এই সুতা দিয়ে কী হবে?’ কী হবে শুনুন তাহলে–
:আমাদের দেশে এই কাটা সুতার প্রচুর চাহিদা আছে। এদেশের জুট ব্যবসায়ীরা এগুলোকে জুট বলে। এই জুট মেশিনের সাহায্যে আবার তুলা তৈরি হয়। সেই তুলা দিয়ে আবার সুতা তৈরি হয়। আবার লেপ-তোষক তৈরি হয়। আরও নানারকম পদ্ধতিতে নানারকম কাজে ওইসব জুট ব্যবহার করা হয়। গার্মেন্টসের টুকরো কাপড়ের জুট থেকে বড়-বড় কাপরের টুকরা বেছে নিয়ে, ঐগুলা দিয়ে ছোটদের জামা-প্যান্ট-সহ আরও অনেককিছু তৈরি হয়। তাই বর্তমানে আমাদের দেশের অনেক স্থানে এই জুটের জন্য সময়-সময় খুন-খারাবির মতো কাণ্ডও ঘটে যায়। গার্মেন্টসের জুট আর টেক্সটাইল মিলের জুটের জন্য দলা-দলি সৃষ্টি হয়! সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়! মারা-মারির সৃষ্টি হয়!

এসব জুট একসময় গার্মেন্টস টেক্সটাইল মিলের মালিকরা ময়লা আবর্জনার সাথে ফেলে দিতো। সেই ফেলানো ময়লা আবর্জনার জুট এখন লক্ষলক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশের শিল্পনগরী এলাকায় এই জুটের জন্য সিন্ডিকেটেরা বড়-বড় নেতাদের পায়ে-পায়ে ঘুরছে। এসব দেখে মনে মনে ভাবতে থাকি, ইশ! যদি চাঁদের দেশে গিয়ে বুড়ির কাটা সুতাগুলো এদেশে নিয়ে আসতে পারতাম! তাহলে তিনদিকে উপকার হতো, লাভবানও হতো।
প্রথমত: ☛ চাঁদের বুড়ি তো যুগযুগ ধরে দিনের-পর-দিন, রাতের-পর রাত সুতা কেটে বোঝাই করে রাখছে। এতে করে চাঁদের বুকে কাটা সুতা হয়ে যাচ্ছে পাহাড় সমান। এর কারণে দিন-দিন রূপালি চাঁদটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে ঐগুলা কিনে আনলে, চাঁদের বুড়িও বেশকিছু টাকা হাতে পাবে। সেইসাথে চাঁদের কিরণ আরও উজ্জ্বল দেখা যাবে এবং চাঁদের ভারসাম্যও কিছুটা রক্ষা হবে।
দ্বিতীয়ত: ☛ চাঁদের বুড়ির কাছ থেকে কাটা সুতাগুলো আমাদের দেশে আনতে পারলে এদেশে জুটের চাহিদা অনেকাংশে মিটে যাবে। জুট নিয়ে খুনা-খুনি, মারা-মারি, দলা-দলি কম হবে। বড়-বড় নেতারাও একটু আরামে ঘুমাতে পারবে। জুট ব্যবসায়ীদেরও ভালো ব্যবসা হবে।
তৃতীয়ত:☛ চাঁদের বুড়ি থেকে নামমাত্র মূল্যে জুটগুলো কিনে এনে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলে বেশকিছু টাকা লাভ তো অবশ্যই হবে। সেই টাকা দিয়ে আমার মতো অনেক অভাবী সংসারের অভাব দূর হবে।
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমের ঘোরে ঠিকই নাসার মহাকাশ যানে চড়ে চলে গেলাম চাঁদের দেশে।

নাসার মহাকাশযান থেকে রোবট সাজে সজ্জিত হয়ে রকেট থেকে নেমে যখন চাঁদের বুড়ির সামনে গেলাম, তখন চাঁদের বুড়ি তেড়ে এসে আমার দুইগালে ঠাস-ঠাস দুটো থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞাসা করলো–
:তুই না নেহাৎ গরিব মানুষ? গরিব হয়েও নাসার মহাকাশযান যানে চড়ে পৃথিবী থেকে এখানে আসলি কেন?’
চাঁদের বুড়ির প্রশ্নের জবাবে আমি কান ধরেই বললাম–
:বুড়ি মা, আমিতো আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আগে আপনার পা ছুঁয়ে নমস্কার করে নিই, তারপর নাহয় এখানে আসার উদ্দেশ্যটা বলি!’
আমার কথা শুনে চাঁদের বুড়ি বললো–
:নমস্কার লাগবে না। তুই আমাকে ছুঁতেও পারবি না। তোর সাথে করোনাভাইরাস আছে। তুই আমাকে ছুঁলে আমিও আক্রান্ত হয়ে পড়বো। তাই যা বলার দূরে থেকেই বল! বল উদ্দেশ্যটা কী?
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম–
:বুড়ি মা, আপনার কাটা সুতাগুলো পাইকারি দরে কিনতে এসেছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি আপনার সূতো কাটার কৃতিত্বের কথা। তাই ভাবলাম! আপনার কাটা সুতাগুলো পৃথিবীতে নিয়ে আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামে বিক্রি করে দিবো। এতো আমাদের দেশের জুট ব্যবসায়ীদেরও জুটের চাহিদা মিটবে, আর আমার সংসারে লেগে থাকা অভাবও দূর হবে।
এই কথা বলার পরই চাঁদের বুড়ি আমাকে আরেকটা জোরে থাপ্পড় দিয়ে আমার এক কানের কানের পর্দা ফাটিয়ে দিলো। তারপর বললো–
:তুই কি বোকা? এখানে কি কোনও সুতা তৈরির ফ্যাক্টরি আছে? আমার কি খেয়ে-দেয়ে আর কাজ নেই? আমি কি বসে বসে শুধু সুতাই কাটবো?
আমি বললাম–
:তাহলে বুড়ি মা, আমি যে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আপনি একটা বটগাছের নিচে বসে বসে যুগযুগ ধরে শুধু সুতাই কাটছেন! তাহলে আমি কি ভুল শুনেছি?
আমার কথা শেষ হতে-না-হতে আমাকে আরেকটা থাপ্পড় মারতে চাইলো। তা দেখে আমি একটু সরে দাঁড়ালাম। থাপ্পড় আর আমার গালে লাগলো না। দ্বিতীয় থাপ্পড় থেকে রক্ষা পেলাম। তারপর চাঁদের বুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বললো–
:আমি এখানে আছি চাঁদকে দেখে রাখার জন্য। যাতে রাহু চাঁদকে গিলতে না পারে। আমি হলাম মা বুড়ি। চাঁদকে পাহারা দিয়ে রাখি। তুই যা এখান থেকে!
এই বলেই আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে চাঁদ থেকে নিচে ফেলে দিলো। আমি সেদিন বায়ুমন্ডলে ঘুরতে ঘুরতে খুব কষ্টে বআসায় পৌঁছেছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম একটুও টের পেলাম না। সকাল ১০টায় গিন্নীর পাগলা ঘণ্টার আওয়াজে ঘুম থেকে ওঠে নিজে নিজেই বলতে লাগলাম, আমি বাসায় এলাম কী করে? এই ভাবেই একা একাই হাসতে থাকি। মনে মনে বলি, ‘এ আমি কী দেখলাম! সত্যি কি স্বপ্ন দেখলাম?’

নদী দূষণ নিয়ে দেশি-বিদেশি ভাবনা

দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু! কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারে না। কেউ কাউকে কয়েক ঘণ্টার জন্য না দেখলে অস্থির হয়ে ওঠে। কারণ ছোটবেলা থেকে ওঁরা দুইজন একই স্কুলে লেখাপড়া। একসাথে আসা-যাওয়া। একসাথে খেলা-ধুলা। একসাথে চলা-ফেরা। একসাথে ঘোরা-ফেরা। একসাথে খাওয়া-দাওয়া। একসাথে ওঠা-বসা করে বড় হয়েছে। দুইজনই সমান বয়সী। হঠাৎ এক বন্ধু চলে গেলো দেশের বাইরে। মানে বিদেশ যাকে বলে।
আরেক বন্ধু থেকে গেলো নিজের দেশেই। নিজ দেশে থেকে যাওয়া বন্ধুটির বাড়ি শীতলক্ষ্যা নদী ঘেঁষা এক এলাকায়। তাই সে সবসময়ই নদী নিয়েই বেশি ভাবে। কারণ, কোনোএক সময় এই শীতলক্ষ্যা নদীতে গোসল করতে। ছাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতো। শীত মৌসুমে নদীর পাড়ে লাউয়ের চারা, কুমড়া চারা, টমেটো চারা-সহ আরও অনেক রকমের চারা রোপণ করতো। বর্তমানে নদীর পানি দূষিত হয়ে যাওয়ার কারণে সেসব আর করা হয় না। তবু সে প্রতিদিন সকাল বিকাল নদীর পাড়ে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে। চিরচেনা নদীর বর্তমান করুণ অবস্থা দেখে মনখারাপ করে বসে থাকে।

এদিকে ৩০ বছর পর বিদেশ থেকে বন্ধুটি দেশে আসলো। দেশে এসে ছোটবেলার খেলার সাথি বন্ধুটির বাড়ি গিয়ে দেখা করে বললো, ‘কেমন আছিস দোস্ত?’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘ভালো আছি! তো তুই কেমন আছিস?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘আমিও বেশ আছি!’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘এতদিন কোন দেশে ছিলি?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘বিশ্বের এক উন্নত দেশ আমেরিকায়।’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘সে-দেশের নদীগুলোর কী অবস্থা? তা কি আমাদের দেশের নদীগুলোর মতো?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘আমি অনেক বছর পর দেশে এসেছি। শহরের আশে-পাশে থাকা নদীগুলো না দেখে কিছুই বলতে পারছি না। তবে সে-দেশের নদী এবং নদীর পানি আয়নার মতো পরিস্কার।’
দেশের বন্ধুটি বললো, ‘তাহলে চল, একদিন ঘুরে দেখে আসি শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী নদী।’
দুই বন্ধু মিলে একদিন শীতলক্ষ্যা, একদিন বুড়িগঙ্গা, একদিন তুরাগ, একদিন ধলেশ্বরী নদী ঘুরে দেখতে গেলো। চারদিন রাজধানী ঢাকার আশ-পাশে থাকা চারটি নদী ঘুরে দেখলো।
এরপর দেশি বন্ধু বিদেশি বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘দোস্ত আমাদের দেশের নদীগুলো কেমন দেখলি?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘দেখে তো এলাম রাজধানী ঢাকার আশ-পাশের নর্দমাগুলো।’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘কী বললি! শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী এগুলো কী নদী না?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘দেখে মনে হয় এগুলো নদী না!’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে এগুলো কী?’ বিদেশি বন্ধুটি বললো, এগুলো মনে হয় রাজধানী ঢাকার বড়সড় নর্দমা!’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘নদীকে তুই বলছিস নর্মদা? কিন্তু কেন?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘নদীর পানিতে মিশ্রিত বিষাক্ত কেমিক্যাল। এই পানি তো মনে হয় পান করা যায় না! এমনকি কোনও ফসলী জমিতেও মনে হয় দেওয়া যায় না। তাই বললাম, এগুলো নদী না। এগুলো হচ্ছে, একেকটা নদী শহরের একেকটা ঢাকনা বিহীন বিশালাকার ড্রেন। এছাড়া আর কিছুই না।’
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা দোস্ত, বিদেশে এসব বড় বড় ঢাকনা বিহীন ড্রেনগুলো কি এভাবেই নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘তা বলতে পারছি না। কারণ, বিদেশে এসব বড় বড় খোলা ড্রেনগুলো কারোর চোখেই পড়ে না। এসব বড় আকারের ড্রেনগুলো থাকে মাটির নিচ দিয়ে।’
দেশি বন্ধুটি আক্ষেপ করে বললো, ‘এসব নদীগুলোর এরকম অবস্থা যে কারা করলো, তা আমার মাথায় খেলছে না। তুই কি দোস্ত বলতে পারিস, আমাদের দেশের নদীগুলোকে ড্রেন বানাচ্ছে কারা?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘যাঁরা পারে তাঁরা! মানে, বড় বড় শিল্পপতিরা।
দেশি বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলো, ‘তা কীভাবে করছে?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘ক্ষতার বলে আর দাপটে। শিল্পপতিদের টাকার কাছে প্রশাসন তো সবসময়ই দিশেহারা!
দেশি বন্ধুটি আক্ষেপ করে বললো, ‘একসময় বাংলার নদীগুলোর পানি ছিল পরিস্কার টলটলা! শুনেছি বাংলাদেশের নদীর পানি দিয়ে বিদেশিরা ঔষধে ব্যবহার করতো। আর এখন সেই নদীর পানি আর স্বচ্ছ টলটলা আয়নার মতো পরিস্কার নেই! নদীর পানি এখন কালো কুচকুচে। পানের অযোগ্য। পানিতে পচা দুর্গন্ধ। পানির পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যায়। যার কারণেই শহরবাসী রোগে ভুগে প্রাণ হারায়! তাহলে দোস্ত এখন উপায়?’
বিদেশি বন্ধুটি বললো, ‘উপায় হলো যেসব শিল্পপতিরা মনের আনন্দে নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি ফেলছে, সরকারের উচিৎ হবে তাঁদের কাছ থেকে লিটার প্রতি হিসাব করে জরিমানা আদায় করা। এরজন্য সরকার তাঁদেরকে লিটার প্রতি একটা দাম নির্ধারণ করে দিবে। এরপর সেসব শিল্পপতিরা যতখুশি তত বিষাক্ত পানি নদীতে ছাড়বে বা ফেলবে।

‘তারপর তাঁরা প্রতিদিন যত লিটার বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি নদীতে ফেলবে, সরকারের কাছে তার একটা হিসাব থাকবে। প্রতি মাসে ঠিক তত লিটার পানির ন্যায্য দাম সরকারকে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। সরকার সেই টাকা দিয়ে ভুক্তভোগী মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। যেমন: নদীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানিতে মাছ নেই। জেলেরা জাল ফেলে মাছ পাচ্ছে না। কৃষকরা নদীর পানি ফসলী জমিতে দিতে পারছে না। তাই আগের মতো জমিতে ফসল হচ্ছে না। নদীর দূষিত পানি শোধন করার পরও পানিতে দুর্গন্ধ থেকে যায়। সেই পানি পান করে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। নদীর দূষিত পানির কারণে নদী এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে গাছপালা মরে যায়। পানির দুর্গন্ধে নানারকম রোগব্যাধির সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যার জন্যই সরকার শিল্পপতিদের কাছ থেকে লিটার প্রতি জরিমানা আদায় করবে। আদায়কৃত সেই অর্থ সরকার যদি এসব ভুক্তভোগীদের মাঝে খরচ করে, তাহলেই কিছুটা সমস্যার সমাধান হতে পারে। তা না হলে শত চিল্লাচিল্লি করেও কোন লাভ হবে না। শিল্পপতিরা ক্ষেপে গেলে, আরও বেশি করে বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি নদীতে ফেলবে। তাহলে সামনে আরও বিপদ হবে।’
দেশি বন্ধুটি বললো, ‘আমাদের দেশের সরকার কি কখনো এরকম নীতিমালা তৈরি করবে? মনে হয় না, দোস্ত! তারচেয়ে বরং এবিষয়ে আর কোনও কথা না বলে, চুপচাপ থাকাই ভালো মনে করি!’