ট্যাগ আর্কাইভঃ নিতাই বাবু

ইঁটের শহর

ইঁটের গাঁথুনিতে গড়া শহর
তপ্ত পিচঢালা পথ,
চারদিক ঘেরা বহুতল ভবন
যান্ত্রিক শব্দে জনপথ!

পথের ধারে ময়লার স্তুপ
বাতাসে বয়ে দুর্গন্ধ,
বৃষ্টিতে ভিজে দূষিত পরিবেশ
শহরবাসীর দম বন্ধ!

চৈত্রের কাঠফাটা রোদের তাপে
পথে উড়ে ধূলিকণা
দূষিত পরিবেশ দূষিত বায়ুতে
শহর পরিপূর্ণ ষোলআনা।

ইঁট- কাঠে গড়া শহরে আজ
নদীর কান্না শুনি,
কাঁদে গাছগাছালি কাঁদে পাখি
শুনি ধ্বংসের জয়ধ্বনি!

images (3)

লোভ-৫ শেষ পর্ব

লোভ-৪

গল্পের চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে হ, আমিও ত দেখতাছি। আহুক হালার বামনায়। আজগা অর শঙ্খ অর সামনেই আছড়াইয়া ভাঙুম! আগে দেহি বামনায় কী কয়!’

বামনাকে দেখে গণেশ বাবু হাসতে হাসতে বললো, ‘আয় আয়, ভগবান পাগলা আয় ব।’
বামনা গণেশ বাবুর সামনে গিয়ে একটু দূরে বসতে চাইলে গণেশ বাবু বামনাকে বললো, ‘আরে বেডা, তুই আমার লগেই ব। ক, কিল্লাইগা আইছত? টেকা পইসার দরকার আছেনি?’
বামনা গণেশ বাবুর একপাশে বসে বললো, ‘আরে বাবু, আমার টেকা পইসার দরকার অইবো ক্যা? আমিত আর আম্নের মতন অভাববা না।’
গণেশ বাবু বামনার কথা শুনে ধমক দিয়ে বললো, ‘এ-এ-এ, আমার জমিদার রে! তয় কি মনে কইরা এই সাত সকালে আমার বাইত আইলি?’
বামনা রাগ হয়ে বললো, ‘রাইতে চোর পাডাইয়া শঙ্খডা লইয়া আইছেন? শঙ্খডা নিতে আইছি।’
গণেশ বাবু বললো, ‘আমি চোর পাডাইছি তুই কেমনে জানছত?’
বামনা বললো, ‘হুনেন বাবু, আম্নের কেরানি রমেশ বাবু কাইলকা আমার বাইত যাইয়া ভগবানের শঙ্খডা দেইখা আইয়া আম্নের কাছে কইছে। আম্নে শঙ্খের লোভে পইড়া আমার বাইত চোর পাডাইছেন। চোরেরা শঙ্খডা চুরি কইরা আম্নের কাছে আইনা দিছে। এইডা দিয়া কিচ্ছুই করতে পারতেন না, বাবু। এইডা ভগবান নিজের আতে আমারে দিছে। আমার শঙ্খ আমারে দিয়া দেন। আমার বামনী না খাইয়া রইছে। দেন দেন, তাত্তাড়ি কইরা শঙ্খডা দিয়া দেন।’
বামনার কথা শুনে গণেশ বাবু হাসতে হাসতে বললো, ‘তুই বামনা ঠিকই কইছস। আমরা হগলতে হারারাইত তোর শঙ্খডা লইয়া পাড়াপাড়ি করছি। একটা ফুঁও দিতে পারি নাই। এইডা তুই কেমনে ফুঁয়াইছত?’
বামনা বললো, ‘এইডা ত বাবু ভগবান আমারে দিছে। আম্নেরে ত আর দেয় নাই। তয়লে আম্নে এইডারে কেমনে ফুঁ দিবেন? বেশি কথা না কইয়া বাবু আমার শঙ্খডা আমারে দিয়া দেন কইতাছি।’
গণেশ বাবু হেসে বললো, ‘তর শঙ্খ তরে দিমু ঠিকই! কিন্তু এনো দুইডা কথা আছে। কথা অইল গিয়া, আমার লগে তর শত্ত করন লাগবো।’
বামনা জিজ্ঞেস করলো, ‘চুরি কইরা শঙ্খ আনছেন, হেই শঙ্খ নিতে অইলে কী শত্ত করন লাগবো, বাবু?’
গণেশ বাবু বললো, ‘শঙ্খ ফুঁ দিয়া তুই যা চাইয়া আনবি, তর তুনে ডবল আমার বাইত আহন লাগবো।’
বামনা বললো, ‘আরে বাবু, আম্নে বহুত লোভে পইরা গেছেন গা-ও! আম্নেরে অহনে লোভে পাইছে বাবু। লোভ করন ভালা না। আম্নেরে কি ভগবান কম দিছে? এতকিছু থাকতেও আম্নের অন লোভ অইছে ভগবানের শঙ্খের লাইগা। লোভে পাপ অয়। পাপে কইলাম সাজা অয়, বাবু। বেশি লোভ কইরেন না। বাইত বইয়া বইয়া ভগবান ভগবান করেন। ভগবান খুশি অইলে আম্নেরেও একটা শঙ্খ দিয়াঅ দিতে পারে। পরের জিনিসের লাইগা লোভ কইরেন না, বাবু। আমার শঙ্খডা ভালভালাই দিয়া দেন।’
গণেশ বাবু বললো, ‘আইচ্ছা তর মতন ভগবান ভগবান আমিও করুম! আগে তুই আমার লগে ডবল ডবল শত্ত কইরা ল। হের পরে তর শঙ্খ তরে দিতাছি।’
বামনা জিজ্ঞেস করলো, ‘ডবল ডবল এইডা আবার কেমনে,বাবু?’
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে বেডা বামনা, তুই ডবল ডবল কেমনে এইডা বুঝছ নাই? শঙ্খ ফুঁ দিয়া কইবি, ভগবান আমার এনো একটা, গণেশ বাবুর বাইত দুইডা। এলা বুঝছত?’
বামনা এবার বুঝে গেল গণেশ বাবুর শর্তের কেরামতি। বুঝেও নিরুপায় হয়ে বামনা ভাবলো, দিবো ত ভগবানই। আমি খালি এট্টু ফুঁ দিয়া সেনা কমু! যাগগা, হের শত্ত মাইনা শঙ্খডা লইয়া লই।’
এই ভেবে বামনা গণেশ বাবুর শর্তে রাজি হয়ে বললো, আইচ্ছা বাবু, ঠিক আছে আমি রাজি অইলাম! অহনে আমার শঙ্খ দেন!’

গণেশ বাবু বামনার হাতে শঙ্খ দিয়ে বললো, ‘অহনে ফুঁ দিয়া ক, ভগবান আমার বাইত একটা বিল্ডিং, গণেশ বাবুর বাইত দুইডা বিল্ডিং। যদি আমার বাইত দুইডা বিল্ডিং অইয়া যায়, তয়লে আমি বুঝুম আমার লগে তর শত্ত করা ভগবানও রাজি অইয়া গেছে। হের পরে তুই তর শঙ্খ লইয়া বাইত যা-গা।’
সরল মনা বামনা চালাক গণেশ বাবুর কেরামতি শর্তে রাজি হয়ে শঙ্খ ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাইত একটা বিল্ডিং, গণেশ বাবুর বাইত দুইডা বিল্ডিং কইরা দেও!’
এই কথা বলতে দেরি, আর বিল্ডিং উঠে যেতে দেরি হয়নি। তা দেখে গণেশ বাবু মহা খুশি হয়ে বামনাকে শঙ্খ দিয়ে বিদায় করলো। বামনাও ভগবানের দেওয়া শঙ্খ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

এদিকে বামনী শঙ্খের শোকে যখন বাড়িতে বসে বসে কাঁদতেছিল, তখন দেখল হঠাৎ ফট করে একটা বিল্ডিং উঠে গেল! তা দেখে বামনী বুঝতে পেরেছে বামনার সাথে গণেশ জমিদার হয়তো কোনও শর্ত করেছে। আর বে-আক্কেল বামনাও হয়তো রাজি হয়ে গেছে। এমন সময়ই বামনা শঙ্খ নিয়ে বাড়িতে আসলো।

বামনা বামনীর সামনে গিয়ে বললো, ‘আরে বামনী তুই কাঁদছ ক্যা? এই দেখ আমি শঙ্খ লইয়া আইছি।’ শঙ্খ দেখে বামনী যতটা-না খুশি হলো, এর চেয়ে বেশি রাগও হলো। কারণ, বামনী তো আগেই টের পেয়েছে গণেশ জমিদার বামনার সাথে একটা চুক্তি করে শঙ্খ দিয়েছে। এছাড়া গণেশ বাবু এমনি এমনি শঙ্খ দিয়ে দেয়নি। তা না হলে আর হঠাৎ করে বাড়িতে বিল্ডিংও উঠেনি।
তাই বামনী বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘শঙ্খ কি তুমি যাওনের লগে লগে দিয়া দিছে? নাকি কোনও শত্ত করছে?’
বামনা সত্য কথাই বামনীর কাছে বললো, ‘হ, বামনী, গণেশ বাবু ত লোভী! খালি মাইনষের জমিজামার দিগে চাইয়া থাহে। আর এইডাত ভগবানের জিনিস। ফুঁ দিয়া কইলেই হগল অইয়া যায়। তয়লে এইডার লোভ হেয় কেমনে ছাড়বো, ক? শত্ত ছাড়া হেয় শঙ্খ দিতে চাই নাই। হিল্লাইগা আমি হের শত্তে রাজি অইয়া শঙ্খডা লইয়া আইছি। ইল্লাইগা কি অইছে? যারে যা দেওনের ভগবান দিবো। এনো আমার কি কিচ্ছু করনের আছে?’
বামনী জিজ্ঞেস করলো, ‘কী শত্ত করছে?’
বামনা বললো, ‘ডবল ডবল শত্ত করছে!’
বামনী জিজ্ঞেস করলো, ‘এইডা আবার কেমনে?’
বামনা বললো, ‘আমার এনো একখান আইলে, গণেশ বাবুর হেনো দুইখান যাইবো!’
তা শুনে বামনী বললো, ‘ভালা কাম করছ, গণেশ বাবুঅ ভালা করছ! শঙ্খডা যে আনছ, এইডাই চালাকের কাম করছ! অহনে দেইক্ক আমি বামনী হেরে কী মজা দেহাই?’
এই বলে বামনী চুপ করে রইল। এদিন বামনার সাথে আর কোনও কথা বলেনি। এভাবে দুইতিন গত হয়ে গেল। বামনা প্রতিদিন শঙ্খ ফুঁ দিয়ে যা আনে আর যা খায়, গণেশ বাবুর বাড়ি তার ডবল চলে যায়। গণেশ বাবুও এখন সকাল দুপুর রাত্র তিনবেলা শঙ্খ হতে আসা খাবার খেয়েই আরামসে দিন পার করতে লাগলো।

একদিন বামনী খুব বায়না ধরলো! বামনী সকাল থেকে কিছুই খাচ্ছে না। তা দেখে বামনার আর ভালো লাগছিল না। বামনা বামনীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও-ই বামনী, তর কী অইছেরে? তুই আজগা দুইডা দিন ধইরা আমার লগে রাগ কইরা রইছত ক্যা? ক, তর কী লাগবো? তরে সব আইনা দিমু! ক ক, তাততাড়ি কইরা ক দেহি!’
বামনী মুখ কালা করে বললো, ‘আমি ত যা চামু, তুমি ত হেইডা আমারে দিতা না। তয় আর চাইও লাভ নাই! থাকগা, আমার কিচ্ছু লাগত না।’
বামনা বললো, ‘আরে ক, তর কী লাগবো? কী দিলে তুই এট্টু খুশি থাকবি, ক?’
বামনী বললো, ‘আমার যা লাগবো, তুমি হেইডা হাছাই দিবা?’
বামনা বললো, ‘এই ল, তর মাতা’র মাধ্যে আত রাইখা কইলাম, দিমু! ক দেহি কী লাগবো?’
বামনী বললো, ‘আমাগো বাড়ির গেইটের সামনে একখান কুয়া লাগবো! তুমি শঙ্খত ফুঁ দিয়া কও ভগবান আমার বাড়ির সামনে একখান বড় কুয়া কইরা দেও!’
বামনীর কথা শুনে বামনা মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘আরে বামনী, তুই এইডা কছ কী? বাড়ির সামনে কুয়া থাকলে তুই মাইনষের বাইত যাইবি আইবি কেমনে?’
বামনী বললো, ‘আমি কি আর আগের মতন বড়কত্তাগো বাইত যাই? আমি অহনে বাইত তুনে বাইর অইনা। তুমি আমার কথা হুইনা একখান কুয়া কইরা দেও!’
বামনা বললো, ‘আইচ্ছা, ‘তুই যহনে চাইতাছত তয় কি আর না করতে পারি?’
এই বলেই বামনা শঙ্খ হাতে নিয়ে জোরে একটা ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাড়ির সামনে একটা বড় কুয়া কইরা দেও!’
ফুঁ দিয়ে বলতে দেরি, কুয়া হতে আর দেরি হয়নি। একইসাথে ফটাফট ফটাফট গণেশ বাবুর বাড়ির গেইটের সামনেও দুইটা কুয়া হয়ে গেল! রমেশ কেরানি তখন গেইটের সামনেই ছিল। ফটাফট দুইটা কুয়া হতে দেখে রমেশ কেরানি এক দৌড়ে গণেশ বাবুর কাছে গিয়ে বললো, ‘সর্বনাশ বাবু, সর্বনাশ অইয়া গেছেগা ও বাবু! সর্বনাশ অইয়া গেছেগা!’
গণেশ বাবু জিজ্ঞেস করলো, ‘আরে কী অইছেরে রমেশ? ভাইঙা ক দেহি? আমিত কিচ্ছু বুঝতে পারতাছি না!’
রমেশ কেরানি বললো, ‘তাততাড়ি কইরা আইয়া দেহেন, বামনায় কী করছে! আম্নের বাড়ির গেইডের সামনে একলগে দুইডা কুয়া কইরা থুইছে! আম্নে তাততাড়ি কইরা বামনার কাছে মাপ চাইয়া লনগা। নইলে আর উপায় নাই, বাবু! আম্নের এমুন্না লোভে অহনে আমাগো বেরাইয়া মরণ লাগবো!’
গণেশ বাবু রমেশ কেরানিকে ধমক দিয়ে বললো, ‘চুপ থাহ তুমি! খালি আমিই লোভ করি? লোভ ছাড়া কি মানুষ আছে? কেয় কম করে, কেয় বেশি করে। আমি নইলে এট্টু বেশিই করছি! হিল্লাইগা কি বামনার কাছে মাপ চাওন লাগবো? দুইদিন গেলে আস্তে কইরা সবই ঠিক অইয়া যাইবো, রমেশ। অহনে চলো দেহি বামনায় কী কামডা করছে!’
এই বলেই গণেশ বাবু রমেশ বাবুর সাথে ঘরের বাইর হয়ে দেখে, বাড়ির গেইটের সামনেই পরপর একসাথে দুইটা কুয়া! কুয়া দেখে গণেশ বাবু রমেশ কেরানিকে বললো, ‘কয়দিনের লাইগা কুয়ার উপ্রে লম্বা একখান তক্তা হালাইয়া রাইখা দেও। দুইডা দিন পর দেখবা সব ঠিক অইয়া গেছেগা। মনে অয় বামনায় জীবনে কুয়া দেহে নাই। হিল্লাইগা ভগবানের কাছে কুয়া চাইছে। দুইদিন পরে বামনায় নিজেওই কুয়া উডাই হালাইবো।’
রমেশ কেরানি বললো, ‘দেহেন কয়দিন পর বামনায় আবার কোন আকাম কইরা বয়!’
গণেশ বাবু বললো, ‘ধুরও রমেশ, কী আর করবো? কয়দিন ধইরা স্বর্গের খাওন ত আরামসে আইতাছি! যাও অহনে একখান তক্তা কুয়ার উপ্রে দিয়া দেও!’
গণেশ বাবুর কথামতো রমেশ কেরানি তা-ই করলো। কুয়ার উপরে লম্বা একটা তক্তা ফেলে রাখল। যাতে বাড়ির লোকজন কোনরকমভাবে আসাযাওয়া করতে পারে।

এভাবে ক’দিন যেতে-না-যেতেই, বামনী আবার বায়না ধরে বসলো! বামনী বামনার সাথে কথা বলে না! খাবার খেতে চায় না। এমনকি ঘরের লক্ষ্মীপূজাও দেয় না। বামনীর এই অবস্থা দেখে বামনারও ভালো লাগছিল না। তাই বামনা বামনীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে বামনী, দুইদিন ধইরা তর আবার কী অইলো, ক দেহি হুনি? তুই বেজার অইয়া থাকলে কি ভালা লাগে? ক দেহি, ক কি অইছে আর কি লাগবো?’
বামনী বললো, ‘আমি অনেক ধইরা লেংড়া মানুষ দেহি না। আগে কত লেংড়া মাইনষে ভিক্ষার লাইগা আইত। অহনে একজনও দেহি না। আমার একখান মানসী আছিলো। ভগবান আমগো একখান শঙ্খ দিছে। অহনে আমরা ভালভালাই চলতাছি। ইল্লাইগা আমি মানসী কইরা রাখছিলাম একজন লেংড়া ফইররে একবেলা খাওয়ামু।’
বামনীর কথা শুনে বামনা বললো, ‘তয়লে অহনে আমি লেংড়া ফইর কই বিছরাইমু?’
বামনী বললো, ‘তোমার আবর বিছরান লাগবো? তুমি শঙ্খ ফুঁ দিয়া কও, ভগবান আমার একখান পা লুলা কইরা দেও। তয়লে ত অইয়া যায়!’
বামনীর কথা শুনে বামনা বললো, ‘আরে বামনী তুই এইডা কছ কী? আমি লুলা অইয়া যাইতাম? তুই এমনডা চাইতে পারলি?’
বামনা রাগ করেছে দেখে বামনী কাছে এসে বললো, ‘আমার মনসী আছে দেইখা কইছি। তুমিত আবার ভগবানের কাছে কইয়া ভালা অইয়া যাইতে পারবা। আমার মনের আশা পুরা করনের লাইগা কয়ডা দিন লুলা অইয়া থাকতে পারতা না?’ না পারলে থাকগা?’
এই কথা বলেই বামনী মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে বামনা বললো, ‘আরে তুই কই যাছ? আইচ্ছা ঠিক আছে, আমি নিজে লুলা অইয়া তরে দেখাইতাছি। এই বলেই শঙ্খ হাতে নিয়ে একটা ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার একখান পা ভাইঙা দেও!’
ফুঁ দিয়ে বলার সাথে সাথে বামনার একটা পা অবস হয়ে গেল। সেসময় গণেশ বাবু বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রমেশ কেরানির সাথে কথা বলছিল। হঠাৎ গণেশ বাবু ঠাস করে মাটিতে পড়ে গেল।
রমেশ বাবু জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবু কী অইছে? আম্নে খারার তুনে বইয়া পড়লেন ক্যা?’
গণেশ বাবু বললো, ‘রমেশ, আমারে খাইছে!’
রমেশ বাবু জিজ্ঞেস করলো, ‘কেডা খাইছে, বাবু?’
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে রমেশ, বামনায় মনে অয় অর নিজের এক পা লুলা কইরা হালাইছে। অহনে আমার দুই পা একলগে লুলা অইয়া গেছেগা রে, বা-বা-বাবা!’ গণেশবাবু এই বলে কাঁদতে লাগলো।
রমেশ বাবু বললো, ‘খাইছে বাবু, ‘কন কী! তয়লে ত সামনে বহুত বিপদ আছে দেখতাছি! বামনা যদি শঙ্খ ফুঁ দিয়া ভগবানের কাছে কয়, ভগবান আমার অর্ধেক জান লইয়া যাও, তয়লে ত বাবু আম্নের পুরা জানই যাইবোগা! তাততাড়ি কইরা বামনার বাইত যাইয়া, বামনার আতে পায় ধইরা মাপ চাইয়া লনগা। নয়লে সামনে বিপদ আছে।’
রমেশ কেরানির কথা শুনে গণেশ বাবু বললো, ‘আরে রমেশ, হগল সুম মাগনা খাওন আইতাছে। দেহি না আর কয়ডা দিন! বামনাই বা কয়দিন লুলা অইয়া থাকবো?’
রমেশ কেরানি আর কিছু না বলে চুপ করে থেকে গণেশ বাবুকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গোল।

আবার ক’দিন পর বামনী বায়না ধরলো কানা মানুষ দেখার জন্য। বামনীর ইচ্ছা তাই বামনাও বামনীর কথামতো শঙ্খ ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার একটা চোখ কানা কইরা দেও! সাথে সাথে বামনার এক চোখ আর গণেশ বাবুর দুই চোখা কানা হয়ে গেল। গণেশ বাবু এখন রমেশ কেরানিকে ডেকে বললো, ‘আরে রমেশ,তাততাড়ি কইরা আমারে বামনার বাইত লইয়া যাও! আমি অহনে চোখে কিছু দেহি না। বামনায় মনে অয় এক চোখ কানা করছে। হিল্লাইগা অহনে আমার দুইডা চোখই কানা অইয়া গেছেগা। আমি অহনে চোখে কিচ্ছু দেখতাছি না। তাততাড়ি কইরা আরে বামনার বাইত লইয়া চলো।’
গণেশ বাবুর কথামতো রমেশ কেরানি তাড়াতাড়ি পালকি খবর দিল। পালকি আসলো। পালকিতে করে গণেশ বাবুকে বামনার বাড়িতে নিয়ে গেলো। বামনার বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে এক মস্তবড় কুয়া। কুয়ার উপরে গনেশ বাবুর মতো তক্তা দেওয়া আছে। সেই তক্তা দিয়েই খুব কষ্টে পালকি নিয়ে বামনার বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে রমেশ কেরানি বামনাকে ডাকতে লাগলো, ‘ও-ই বামনা, ও-ই বামনা। এট্টু আহ দেহি! কথা আছে!’

বামনী দেখে রমেশ কেরানির সাথে এক পালকি। বামনী বুঝতে পেরেছে পালকিতে গণেশ জমিদার বসা আছে। তাই বামনা বামনী দুইজনই রমেশ কেরানির ডাক শুনেও শুনছিলো না। আবার না শুনেও পারছিল না। বামনা বামনী দুইজনই সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী অইছে রমেশ বাবু? আবার কোন ফন্দি কইরা আমাগো বাইত আইছেন?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘কোনও ফন্দি কইরা আহি নাইগো বামনী। আইছি গণেশ বাবুরে লইয়া। দেহেন পালকিতে গণেশ বাবু বইয়া রইছে!’
বামনা বললো, ‘ক্যা, গণেশ বাবুর কী অইছে?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘হের অহনে দুই চোখ কানা, দুই পা লুলা। মরা মাইনষের লাহান কোনমতে পালকিত কইরা তোমাগো বাইত লইয়া আইছি।’
বামনি জিজ্ঞেস করলো, ‘আমগো বাইত কিল্লাইগা?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘গণেশ বাবু আইছে আম্নেগো কাছে মাপ চাওনের লাইগা।’
গণেশ বাবু পালকি থেকে ভাইগো, বোইনগো ডেকে বলতে লাগলো, ‘তোমরা আমারে মাপ কইরা দেও! আমি আর এই জীবনে ভুল করতাম না। তোমগো শঙ্খ থেইকা আমার বাইত যা গেছে, সব লইয়া যাওগা। খালি আমারে তোমরা মাপ কইরা দেও! আমি আর কারোর জিনিসের লাইগা লোভ করতাম না।’
বামনী বললো, ‘ক্যা,ফাউ খাইতে আর পরের জিনিসের লাইগা লোভ করনের সখ মিট্টা গেছেগা?’
গণেশ বাবু হাত জোর করে আঁকুতি মিনতি করে বললো, ‘আমারে আর শরম দিও না গো বইন! আমারে ভগবানের দিগে চাইয়া মাপ কইরা দেও! আমি আর লোভ করতাম।’
গণেশ বাবুর আঁকুতি মিনতিতে বামনীর মায়া লাগলো! বামনী মনে মনে বললো, ‘থাক, ভুল ত মাইনষেই করে। আবার ভুলের খেসারতও দেয়! গণেশ বাবু ভুল করে লোভ কইরা সাজাঅ পাইছে।অহনে আবার মাপ চাইতে অ আইছে। অহনে হেরে মাপ না দিলে স্বয়ং ভগবানই বেজার অইবো।’

এই ভেবে বামনী বামনাকে বললো, ‘তুমি জমিদার বাবুরে মাপ কইরা দিয়া ভগবানের কাছে কও, আগে কুয়া দুইডা উডাইয়া নিতে। হের পরে তোমার লুলা পা আর চোখ ভালা কইরা হালাতে কও! বামনীর কথামতো বামনা শঙ্খ ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাড়ির সামনের তুনে কুয়া লইয়া যাওগা! বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার লুলা পা ভালা কইরা দেও! বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার চোখ ভালা কইরা দেও!’

বলতে দেরি আর সব ঠিকঠাক হতে দেরি হলো না। গণেশ বাবুও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পালকি থেকে নেমে বামনার হাতে পায়ে ধরে বললো, ‘আমি বামনা লোভ কইরা ভুল করছি। আমারে তুই মাপ কইরা দে! আমি আর পরের জিনিসের লাইগা লোভ করতাম না। আমি অহনে বুঝলাম, লোভেই মানুষ ধ্বংসের পথে চইলা যায়।’
গণেশ বাবুর আঁকুতি মিনতিতে বামনা বামনী দুইজনই শেষমেশ জমিদার গণেশ বাবুকে মাপ করে দিয়ে বললো, ‘গণেশ বাবু, মাইনষেরে মরণের রাস্তায় লইয়া যায় এই লোভ। আজগার তুন আর লোভ কইরেন না। ভালা অইয়া যানগা। লোভ করবেন, তয়লে আবার মরবেন। লোভ করন ভালা না!’ সমাপ্তি!

লোভ-১ এখানে:

images (3)

লোভ-৪

লোভ-৩

গল্পের তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
বামনা বললো, ‘আইচ্ছা ঠিক আছে হেইডাই অইবো। তয় হুইনা রাখ, তর কইলাম এই পইযন্তই চাওয়া। আর কইলাম কিচ্ছু চাইতি পারতি না। বেশি লোভ করিছ না বামনী! লোভে পাপ অয় জানস না?’

বামনা বামনীকে বুঝাচ্ছে, ‘হুন বামনী, বেশি লোভ করবি, তয়লে আয়ু থাকতে মরবি। লোভে পাপ অয়, পাপে সাজা অয়। হেই সাজায় মানুষ ধ্বংস অইয়া যায়। আমার কিচ্ছুর লোভ নাই বামনী। আমার কিচ্ছুর দরকার অ নাই। ভগবান আমারে যেমনে রাহে, হেমনেই আমি খুশি।’

এই বলেই বামনা শঙ্খে ফুঁ দিয়ে জমিদার বাড়ি না বলে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাড়িডা সুন্দর কইরা সাজাইয়া দেও!’
বলতে দেরি, হয়ে যেতে আর দেরি হলো না। ফটাফট বামনার বাড়ি হয়ে গেল কোনোএক বড় গৃহস্থের বাড়ির মতন। এখন আর আগের মতো ভাঙাচুরা ঘর নেই। সব যেন নতুন করে তৈরি করা হয়েছে।
আবার আরেক ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বামনীর হারা শৈল সোনার জিনিস দিয়া ঢাইকা দেও!’
তাও ফটাফট হয়ে গেল। বামনীর হাতে, পায়ে, গলায়, মাথা-সহ সারা দেহে স্বর্ণালংকারে ভরে গেল। এগুলো দেখে বামনী এখন মনের আনন্দে নাচতে নাচতে বললো, ‘আহারে আমার দেবতা বামনারে! এতদিনে তুমি আমার মনের স্বাদ মিডাইছ। আমি অহনে পুরা গেরাম ঘুইরা ঘুইরা মাইনষেরে দেখাই আহিগা!’
এই বলেই বামনী গ্রামের সবাইকে দেখানোর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বামনাও বামনীর পেঁনপেঁনানি বন্ধ করে বাড়ির উঠোনে বসে বসে ভগবান ভগবান জপতে লাগলো।

বামনী পুরো গ্রাম ঘুরে সবার সাথে দেখা করে বাড়িতে আসতেই, গণেশ জমিদারের কেরানি রমেশ বাবুর সাথে দেখা। রমেশ কেরানি বামনীকে দেখে প্রথমে চিতে পারেনি। কিন্তু বামনী রমেশ কেরানিকে ঠিকই চিনতে পেরেছে। আর চিনবে-না-ই-বা কেন? থাকে তো একই গ্রামে। সবাই সকলের পাড়াপ্রতিবেশি ভেবে বামনী নিজেই রমেশ কেরানিকে বললো, ‘ভালা আছেননি কেরানি বাবু?’
বামনীর কথা শুনে রমেশ কেরানি বললো, ‘তুমি ঐ ভগবান বামনার বউ না?’
বামনী বললো, ‘হ, আম্নে এতক্ষণে আমারে চিনছেন? আমি ঐ ভগবান ভগবান করইন্না বামনার বউ।’
রমেশ কেরানি বামনীর শরীরে থাকা স্বর্ণালংকার দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘এত সোনা গয়না পাইলা কই? তুমি না বড়কত্তাগো বাইতে রান্দাবারির কাম কর? তয়লে এত সোনার জিনিস কই পাইলা?’
বামনী মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, ‘ভগবান খালি আম্নেগোই দিবো? আর কাররে দিত না? এডি যা দেখতাছেন, সব ভগবান দিছে।’
বামনীর কথা শুনে রমেশ কেরানির মনে পড়ে গেল গত দুইদিন আগের রাতের কথা। যেদিন বামনা ভগবানের বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে আসছিল। সেদিন রমেশ কেরানি বামনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কইতুন আইলি?’ উত্তরে বামনা বলেছিল, ‘ভগবানের বাইততুন আইলাম।’ সেদিনের কথা রমেশ কেরানির খুব ভালো করে মনে পড়ে গেল। এখন রমেশ কেরানি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো আসলে ঘটনাটা কী? রমেশ কেরানিকে চুপচাপ দেখে বামনী আস্তে করে বামনার বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। রমেশ কেরানিও আসল ঘটনা জানার জন্য বামনীর পিছনে পিছনে রওনা হলো।

বামনী হেলেদুলে বাড়িতে গিয়ে দেখে বামনা উঠানে বসে জপের মালা হাতে নিয়ে ভগবানের নাম জপছে। ভগবানের দেওয়া শঙ্খটা বামনার পাশেই পড়ে আছে। তা দেখে বামনী বামনাকে বললো, ‘এত সুন্দর একখান জিনিস ভগবান তোমারে দিছে। আর এইডা তুমি এনো এমনে হালাইয়া থুইছ?’
বামনা বললো, ‘আরে বামনী, ভগবান আমারে দিছে, আবার ভগবানের মন চাইলে লইয়াও যাইতে পারে! এইডা যত্ন কইরা কী অইবো? তর যত্ন করনের দরকার অইলে তুই এইডারে যত্ন কইরা রাখগা!’
বামনী মুখ কালো করে শঙ্খটা হাতে নিয়ে ঘরে যেতে-না-যেতেই রমেশ কেরানি বামনার বাড়ির অবস্থা দেখে অবাক হয়ে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘খাইছে আমারে! এইডা কী? কেমনে অইল? হায় হায়! যেই বেডায় খাওন পায় নাই! হেই বেডার বাড়ি এইডা?’
রমেশ কেরানি আস্তে আস্তে বামনার বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখে বামনা উঠানে বসে আছে। বামনা রমেশ কেরানিকে দেখে বললো, ‘আইয়েন আইয়েন, কেরানি বাবু। কী মনে কইরা গরিবের বাইত আইলেন? বহেন!’
রমেশ কেরানি বামনার সাথেই বসে বললো, ‘গণেশ বাবুর বাইত যাইতে লইছিলাম। নতুন বাড়িডা দেইখা মনে করছিলাম কেডা জানি নতুন বাড়ি বানাইছে। অহনে দেখি তরে। তয় বামনা কেমনে কী অইল রে? ক দেহি এট্টু হুনি!’
বামনা বললো, ‘বাবু, হগল কিছু ভগবানের ইচ্ছা। হেয় আমারে দিছে।’
রমেশ কেরানি বললো, ‘আরে বেডা তর লাইগা ভগবানের এমুন্না ইচ্ছা কেমনে অইল রে, বামনা?’
বামনা বললো, ‘হেদিন ভগবানের বাইততে আহনের সুম আম্নের লগে না দেখা অইছে? আমি না কইছিলাম ভগবানগো বাইত গেছিলাম! আসলেও বাবু আমি ভগবানগো বাইতই গেছিলাম। ভগবান আমার ডাহে খুশি অইয়া আমারে একটা শঙ্খ দিছে। অহনে শঙ্খডা ফুঁ দিয়া আমি যা কই হেইডাই অইয়া যায়।’
রমেশ কেরানি বললো, ‘কছ কী! ক-ই দেহি শঙ্খডা?’
বামনা খুশি হয়ে বামনীকে ডেকে বললো, ‘ও-ই বামনী, শঙ্খডা লই আয় দেহি! আরে জমিদারের কেরানি আমগো বাইত আইছে। হেরে কিছু খাওয়ান লাগবো। তাততাড়ি কইরা শঙ্খডা লইয়া আয়!’
রমেশ কেরানির কথা শুনে বামনী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। তারপরও বামনা যখন ডাকছে, না গিয়ে পারছিল না। তাই বামনী শঙ্খটা নিয়ে এসে বামনার হাতে দিলো। বামনা শঙ্খটা হাতে নিয়েই রমেশ কেরানিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কেরানি বাবু আম্নে কী খাইবেন?’
রমেশ কেরানি বোকার মতো হয়ে বললো, ‘তুই যা খাওয়াছ! হেইডাই খামু!’
বামনা হাসতে হাসতে শঙ্খে ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, কিছু খাওন পাডাও!’
রমেশ কেরানি ফুঁয়ের শব্দে বসা থেকে ঠাস করে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফটাফট কিছু ফলফলারি বামনার সামনে এসে গেল! রমেশ কেরানি তা দেখে হা করে খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রমেশ কেরানির এই অবস্থা দেখে বামনা বললো, ‘বাবু কি ঢরাইছেনও? ঢরাইয়েন না বাবু। ঢরের কিচ্ছু নাই! খান খান, খাইয়া জমিদারের বাইত যান। রমেশ কেরানি স্বর্গের খাবার ফল একটা চিবাইতে চিবাইতে জমিদার গণেশ বাবুর বাড়ির দিকে চলে গেল।

বামনী রাগ হয়ে বামনাকে বললো, ‘রমেশ কেরানি মানুষ বেশি ভালা না। হের সামনে শঙ্খডা আইন্না তুমি কামডাও বেশি ভালা করলা না।’
বামনা বামনীকে বললো, ‘আরে ধুর বামনী! তুই এত চিন্তা করিছ না ত! ভগবান এইডা আমারে দিছে। আবার হের ইচ্ছা অইলে হেয় লইয়া যাইবো গা! তর এত চিন্তা করনের দরকার নাই।’
বামনার কথায় বামনী আর বেশিকিছু না বলে শঙ্খটা ঘরে নিয়ে লক্ষ্মী দেবীর আসনে রেখে দিলো।

এদিকে রমেশ কেরানি গণেশ জমিদাদের বাড়ি গিয়ে গণেশ বাবুকে বামনার শঙ্খের কাহিনী শোনালেন। গণেশ বাবু তা শুনে অবাক হয়ে বললো, ‘আরে রমেশ তুই কছ কী? হাছা হাছাই?’
রমেশ বললো, ‘আরে হ বাবু, আমি নিজের চোখ দুইডা দিয়া দেইখা আইছি। বামনায় শঙ্খ ফুঁ দিয়া খাওন আনছে, হেইডাও খাই আইছি।
এসব শুনে জমিদার গণেশ বাবু শঙ্খের লোভে পড়ে রমেশ বাবুকে বললো, ‘ভগবান বামনার বাইত চোর পাডাও! আজগা রাইতের মধ্যে বামনার শঙ্খডা আমার আতে চাই!’

যেই কথা সেই কাজ। রাতেই বামনার বাড়িতে তিন চোর গেলো। চোরেরা সিঁদ কেটে বামনার ঘরে ঢুকে শঙ্খ চুরি করে এনে গণেশ বাবুর হাতে দিল। গণেশ বাবু শঙ্খ নিয়ে অনেক দাপাদাপি পাড়াপাড়ি করার পরও শঙ্খতে ফুঁ দিতে পারলো না। আবার হাত থেকে শঙ্খটা কারোর হাতেও দিচ্ছিল না। যদি ফুঁ দিয়ে নিজের জন্য কিছু চেয়ে বসে, তাই আর গণেশ বাবু কারোর হাতে শঙ্খ দিচ্ছে না। নিজেই ফুঁয়ের পর ফুঁ, ফুঁয়ের পর ফুঁ। কিন্তু শঙ্খ থেকে একটু শব্দও বের করতে পারছে না। এভাবে গণেশ বাবু সারারাত পাড় করে দিল। অথচ কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি। গণের বাবুর সাথে তাঁর কেরানি রমেশ বাবুও সারারাত জেগে থাকল কিছু কেরামতি দেখার জন্য। সেসব না দেখে সকালবেলা রমেশ বাবু বললো, ‘বাবু আমার আছে এট্টু দেন দেহি আমি ফুঁয়াইতে পারি-নি?’ গণেশ বাবু নিজে না পেরে অবশেষে রমেশ বাবুর কাছে শঙ্খটা দিয়ে বললো, ‘শঙ্খডা দিলাম ঠিক! যদি তুই ফুঁ দিতে পারছ, তাইলে ভগবানের কাছে কী চাইবি?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘তয়লে আম্নেই কইয়া দেন কী চাইতে অইবো!’
গণেশ বাবু বললো, ‘দুই মইন্না বোস্তার দশ বোস্তা সোনা চাইবি। দশ বোস্তা হীরা চাইবি। দশ বোস্তা মোক্তা চাইবি। দশ বোস্তা টেকা চাইবি। ক এডি চাইবি নি? যদি কছ হ, তয়লে ভগবানের শঙ্খের মাধ্যে ফুঁ দেয়, আর নয়লে শঙ্খ আমার কাছে দিয়া দেয়। পরে যাঁর শঙ্খ, হের লগে চুক্তি কইরা যা করনের করুম!’
রমেশ বাবু ফুঁ দেবার লোভে রাজি হয়ে শঙ্খটা হাতে নিয়ে ফুঁ-ফুঁ-ফুঁ দিতে শুরু করে দিলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না। অথচ রমেশ বাবুর মুখ ব্যথা করে ফেললো। এভাবে গণেশ জমিদারের চাকর-বাকর-সহ তাঁর পরিবারের সবাই চেষ্টা করে দেখল। কিছুতেই কেউ শঙ্খ ফুঁ দিয়ে শব্দ বের করতে পারলো না। এভাবে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত শুধু চেষ্টার পর চেষ্টাই করে গেল। শঙ্খ ফুঁ দিয়ে কেউ একটু শব্দও বের করতে পারেনি।

এদিকে সকালবেলা বামনী ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরে সিঁদ কাটা। ঠাকুরের আসনে শঙ্খ নেই! বামনী চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। বামনাকে বকাবকিও করে বলতে লাগলো, ‘ওই বামনা, আরে ঘুমের তুন উইডা দেহ গণেশ বাবু তোমার শঙ্খ চুরি কইরা লইয়া গেছেগা। কাইল বিয়ালে রমেশ কেরানি আইছিল কিল্লাইগা, হেইডা তুমি ত বুঝলা না। অহনে এলা বইয়া বইয়া কান্দ!’

শঙ্খ চুরির কথা শুনে বামনা ধীরেসুস্থে ঘুম থেকে উঠে দেখে বামনী হাউমাউ করে শঙ্খের জন্য কাঁদছে। বামনা বামনীকে শান্তনা দিয়ে বললো, ‘আরে বামনী তুই কান্দছ ক্যা? এইডা নিয়া কেউ কিচ্ছু করতে পারতো না, রাখতেও পারতো না। খালি ফুঁয়াইতে ফুঁয়াইতে মুখ বেথা করতে পারবো। খার, আমি অহনই যাইতাছি।’
বামনা গণেশ জমিদারের বাড়ি গিয়ে দেখে শঙ্খ হাতে নিয়ে গণেশ বাবু কাচারি ঘরে বসে আছে। সামনে বসে আছে রমেশ বাবু। রমেশ কেরানি বামনাকে দেখেই গণেশ বাবুকে বললো, ‘বাবু ঐযে বামনা আইছে!’
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে হ, আমিও ত দেখতাছি। আহুক হালার বামনায়। আজগা অর শঙ্খ অর সামনেই আছড়াইয়া ভাঙুম! আগে দেহি বামনায় কী কয়!’

চলবে…

লোভ-৩

লোভ-২

গল্পের দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশ:
ভগবানের মা-বাবাও তাঁদের বাড়ি থেকে ভগবান পাগল বিদায় করলো। বামনা ভগবান ভগবান বলতে বলতে নিজের বাড়ির পথে চললো।

বামনা নাচনভঙ্গিতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, আর মনে মনে বলছে, ‘হায়রে ভগবান! বামনী আমারে কতায় কতায় কয়, ভগবানগো বাইত যাওগা! আজগাত আমি ঠিকই ভগবানের বাইত গেছি! আইজগা বামনীরে ভগবানের খেইল দেখামু! বামনীরে কমু, ক তুই কী চাচ? তহনে দেখমু আমার বামনী কী চায়!
এভাবে বামনা মনে মনে অনেককিছু বিরবির করে বলতে বলতে যখন হেঁটে আসছিল। পথিমধ্যেই এক লোকের সাথে বামনার দেখা হয়ে গেল। লোকটি হলো বামনার গ্রামে থাকা জমিদারের কেরানি রমেশ। বামনাকে দেখে রমেশ কেরানি জিজ্ঞেস করলো, কিরে বামনা, তুই কইতুন আইলি?’
বামনা বললো, ‘আজ্ঞে কর্তা আমি ভগবানগো বাইত তুনে আইলাম।’
রমেশ কেরানি হাসতে হাসতে আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘ও-ই বেডা, হাছা কইরা ক কইতুন আইছস? খালি ভগবান ভগবান কইরা মরতাছত!’
বামনা বললো, কেরানি ময়শই, ‘ভগবানের দুইন্নাত থাইকা ভগবান ভগবান করুম না, তয় কি রমেশ রমেশ করুম?’
রমেশ কেরানি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিজের পথ ধরে চলে গেলো। বামনা আবার নাচতে নাচতে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বামনা নিজের বাড়ি উঠোনে পৌঁছে গেল। রাতও হয়ে গেল অনেক! বামনী তখন ঘরের ভেতরে ঘুমে বিভোর। বাড়ির উঠোনে পা রেখেই বামনা বামনীকে ডেকে বলছে, ‘ও-ই বামনী, দরজা খুল! এক ঘটি জল দে!’
কিন্তু না, বামনীর কোনও সাড়াশব্দ নেই! সাড়াশব্দ না পেয়ে ঘরের দরজার খুব সামনে গিয়ে বামনীকে আবার জোরে জোরে ডাকতে লাগলো, ‘ও-ই বামনী হুনছস! দরজা খুল! আমি ভগবানের বাইততে আইছি।’
বামনার এমন চিল্লা-চিল্লিতে সারাদিন হাড়ভাংগা খাটুনির পর খেয়ে-না-খেয়ে ঘুমানো ঘুমটা বামনীর মুহূর্তেই ভেঙে গেল। শুনতে পেল বামনার গলার তুই তাই শব্দ। রাগে গোস্বায় জেগে উঠে দরজা খুলে বলছে, ‘তুমি না-বলে আর আইতা না? ভগবানগো বাড়ি বিছরাইয়া পাও নাই? ভগবানের বাড়ি না পাইছ দেইখা কী অইছে? অন্য গেরামের একটা মন্দিরেও তো থাইকা যাইতে পারতা! আবার কিল্লাইগা আমারে জ্বালাইতে আইছ? এই মরার যন্তনা আমার কপাল তুনে আর যাইত না!’
এই বলেই বামনী আবার ঘরের ভেতরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বামনা হাসতে হাসতে বললো, ‘আরে বামনী, আমিত আইজগা ঠিকই ভগবানের বাইত গেছিলাম! আমি আইজগা হারাদিন ভগবানগো বাইত আছিলাম। ভগবানগো বাইততে স্নানধূতি কইরা, খাইয়া দাইয়া আস্তে-ধীরে এই আইলাম। তুই আমারে কষ্ট কইরা কদ্দুর জল দে, আমি আতমুখ ধুইয়া আহি।’

বামনার কথা বামনী যেন শোনেও শুনছিল না! কারণ এর আগেও বামনা অনেকবার হরির বাড়ির উদ্দেশ্যে গিয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজতেও গিয়েছিল। দুইতিন দিন বাড়ির বাইরে থেকে শেষমেশ আবার যে-খানকার মরা সে-খানেই এসে মরলো। তাই বামনী একটু রাগের ভাব ধরে আস্তে-ধীরে উঠে ঘর থেকে এক ঘটি জল বামনাকে দিয়ে বললো, ‘হায়রে আমার হোয়াদের বামনা রে! কতবার যে হে ভগবানরে বিছরাইতে গেছে! শেষমেশ এই মরা আবার আমার অভাইব্বা কপালে আইয়া জুটছে। ভগবান আমারে নেয়ও না! ভগবান যদি আমারে নিতো, তয়লে মইরা যাইয়াও একটু বাঁইচা থাকতে পারতাম।’
বামনা ঘরের বারান্দার কিনারে হাতমুখ ধুয়ে বামনীকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘লেঙটা ভগবান কি তোর কথা বুঝবো আর কি হুনবো। ভগবান থায়ে হের নিজের খেলা লইয়া। হের কি তোর কথা হুননের সময়-গময় আছে? দেইখা আইছি ভগবানরে! হেয় খুব কামে থায়ে।’
এই কথা বলেই, বামনা তাঁর থলি থেকে নতুন গামছা বের করে বললো, ‘দেখ বামনী, ভগবান আমারে আদর কইরা নতুন গামছা দিছে। জামা দিছে। খাওয়াইছে। আবার আহনের সুম একখান জিনিসও দিয়া দিছে।’
বামনার এসব বকবকানি বামনীর আর সহ্য হচ্ছিল না। বামনী রাগের মাথায় বললো, ‘ও-ই বামনা তুমি অহনে রাইত কইরা চুপ থাকবা? আমারে এট্টু ঘুমাইতে দিবা? হারাদিন বড়কত্তাগো বাইত কাম কইরা আইছি। অহনে খাইয়া-না-খাইয়া ঘুমাইয়া রইছি। অহনে আর ভাল্লাগে না। আমারে এট্টু ঘুমাইতে দেও!’
বামনা তারপরও বললো, ‘আরে বামনী, তুই এট্ট চাইয়া ও-ই দেখ! আমি কি হাছা কইতাছি, না মিছা কইতাছি! দেখ দেখ, ভগবান যে আমারে কি সুন্দর একখান জামা দিছে।’

বামনী এবার চোখ মেলে বামনার দিকে চেয়ে দেখে বামনার হাতে নতুন একখান গামছা, পরনে নতুন জামা। বামনী এর কিছুক্ষণ আগে বামনার পরনে নতুন জামা আমাবস্যা রাতের অন্ধকারের জন্য খেয়াল করতে করেনি। এখন ঘরে তেলের বাতির আলোতে দেখতে পাচ্ছে। বামনী এখন শোয়া থেকে উঠে বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘হাছা কইরা কও দেহি, তুমি কই গেছিলা?’
বামনা বললো, ‘আরে বামনী, আমি কি তোর লগে মিছা কইতাছি! আমি আইজগা হাছা হাছাই ভগবানগো বাইত গেছিলাম। ভগবানের মারে পাইছি, বাবারেও পাইছি। ভগবানরে জাবরাইয়া ধইরা মনের কতা হুনাইয়া দিছি।’
এই বলেই বামনা তাঁর থলি থেকে ভগবানের দেওয়া শঙ্খটা বের করে বামনীর সামনে নিয়ে বললো, ‘দেখ বামনী, এইডা ভগবান আমারে দিছে। শঙ্খডা সুন্দর না, বামনী?’
বামনী এবার মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, ‘এ-এ-এ, জব্বর একখান হবরের মাথা লইয়া আইছে রে! এই হবর তোমারে কেডা দিছে? পাগল জানি কোনানখার! কইতুন জানি পুরান একখান শঙ্খ টোগাইয়া আইন্না কইতাছে, হেরে এইডা ভগবান দিছে! আমার লগে ইয়ার্কি মারাইতাছ?’
বামনা হি হি করে হেসে বললো, ‘আরে বামনী, ইয়ার্কি নারে বামনী, ইয়ার্কি না। হাছাই এইডা ভগবান আমারে দিছে। এইডা আমার আতে দিয়া কইছে, এইডা ফুঁ দিয়া যা কমু, হেইডাই অইবো।’
বামনী কপালে থাপ্পড় মেরে বললো, ‘আরে ভগবান! কই যে যাইতাম, ভাইবা পাইতাছি না। শঙ্খ ফুঁয়াইয়া যা কইবো, হেইডাই বলে অইয়া যাইবোগা। আমারে তুমি বলদ পাইছ?’
বামনা এবার বামনীর উপর খুবই রাগ হয়ে বললো, ‘তুই কি ভগবানরে বিশ্বাস করছ না? ক, শঙ্খ ফুঁ দিয়া কি কইতাম! ক ক, তাত্তাড়ি ক!’
বামনীও খুব জেদ দেখিয়ে বললো, ‘খাওন আন, খাওন! যেইডা খাইয়া গুষ্টি বাঁচে, হেইডাই আন। দেহি, তোমার ভগবানের হোয়াদের শঙ্খের কেমন গুন। আমারে হিগাইতাছে। কইতুন জানি একটা শঙ্খ টোগাইয়া আইনা, কইতাছে, এইডা আমারে ভগবান দিছে। কও দেহি, খাওন দেও!’

বামনীর কথায় বামনারও জেদ উঠে গেল! শরীরে জেদ রেখেই রাগের মাথায় শঙ্খটা হাতে নিয়ে পূর্বদিকে ফিরে জোরে একটা ফুঁ দিলো। ফুঁয়ের শব্দে বামনার পুরো বাড়ি কেঁপে উঠলো। বামনী আচমকা ভয় পেয়ে বামনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে শুরু করলো। বামনীর কাছে মনে হলো পৃথিবীতে বুঝি ভূকম্পন শুরু হয়ে যাচ্ছে।
বামনা শঙ্খে ফুঁ দিয়েই বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমগো দুইজনের লাইগা খাওন পাডাইয়া দেও!’
বামনা শঙ্খে ফুঁ দিয়ে বলতে দেরি আর দুইজনের দুইভাগে নানারকম খাবার সামনে আসতে দেরি হলো না। বামনী তখনও বামনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে ছিল। এমন সময় আবার বামনা বামনী দুইজনের সামনে রাতের অন্ধকারে ফটাফট নানারকমের খাবার চলে আসলো। তা দেখে বামনী বামার পায়ে ধরে বসে রইল। বামনা বামনীকে শান্তনা দিয়ে বললো, ‘ডরাইছস? ডরানের কিছু নাইক্কা। তুই অহনে পেট ভইরা খাইয়া হুইয়া থাক। আমি এট্টু ভগবান ভগবান কইরা লই। আজগা দুইডা ফিন ধইরা আমার ভগবানরে মন দিয়া ডাকতে পারি না। ভগবানরে যদি না ডাহি, তয়লে আবার ভগবান রাগ করবো। তুই খাইতে থাক!’
ভগবানের ইচ্ছায় স্বর্গ থেকে আসা খাবারের ঘ্রাণে পুরো ঘর মুহূর্তেই সুঘ্রাণে ভরে গেল। বামনী এখন কী রেখে কী করবে দিশা হারিয়ে ফেলেছে। বামনী কাঁপা কাঁপা স্বরে বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি খাইবা না? তুমি আগে না খাইলে আমি খাইতাম না।’
বামনা বুঝতে পেরেছে, বামনী এই খাবার দেখে ভয় পেয়েছে। আবার এগুলো আসলেও সত্যিকারের খাবার কিনা, তাও হয়তো মনে মনে বামনী ভাবছে! তাই বামনা বামনীকে বললো, ‘আইচ্ছা, তয়লে এট্টু দেরি কর, আমি ভগবানের নামখান এট্টু লইয়া লই।’
এই বলেই বামনা কয়েকবার ভগবান ভগবান জপে ভগবানের ধ্যান শেষ করে বললো, ‘আয় খাইয়া লই।’
দুজনে হাত ধুইয়ে স্বর্গের খাবার হাতে নিয়ে ভগবান ভগবান বলে মুখে দিলো। আহা স্বাদ! কী স্বাদ! এই খাবার কি কারোর ভাগ্যে জুটে? বামনী মুখে দিয়েই গবর গবর করে গিলে ফেলছে। মুহূর্তেই বামনীর খাবার সাবাড় করে ফেলে, বামনার খাবারেও হাক মারলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবকিছু গুজগাজ করে রেখে মনের আনন্দে শুয়ে রইল।

রাত পোহাতে-না-প্যহাতে বামনী ঘুম থেকে উঠে ভগবানের দেওয়া শঙ্খটা সামনে রেখে ভক্তি করলো। তারপর অনেকক্ষণ ভগবান ভগবান জপে, ঘরে থাকা ঠাকুরের আসনে শঙ্খটা রেখে, ঘরদোর লেপালেপি করতে লাগলো। বামনা তখনো রাজা জমিদারদের মতো ঘুমাচ্ছিল। বামনী ঘরদোর লেপে মুছে স্নান করে বামনাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠানোর চেষ্টা করছে। বামনা ঘুম থেকে উঠছে না দেখে বামনার হাত পা মালিশ করতে করতে বললো, ‘কি গো! এট্টু তাত্তাড়ি উঠো না। আমার জব্বর ক্ষুদা পাইছে। তুমি ঘুম থেইকা উইডা, আতমুখ ধুইয়া ভগবানের তুনে খাওয়ন চাইয়া আনো।’
বামনীর কাছে বামনা এখন খুবই আদরের। যেন রূপকথার রাজকুমার, আর স্বয়ং ভগবানের চেয়েও বেশি। বামনার সাথে বামনী দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে এই প্রথম বামনার জন্য বামনীর এতো দরদ উথলে পড়লো। বামনী বামনার হাত-পা টিপে দিচ্ছে, বামনা আরামসে ঘুমচ্ছে। তারপরও বামনা যখন ঘুম থেকে উঠছিল না, বামনী ভগবানের দেওয়া শঙ্খটা নিয়ে অনেকক্ষণ ফুঁ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু বামনী কিছুতেই শঙ্খ ফুঁ দিয়ে আওয়াজ তুলতে পারছে না। অথচ প্রতিদিন লক্ষ্মীপূজা দেওয়ার সময় ঘরে থাকা আগের শঙ্খ ফুঁ দেয়, শঙ্খ বাজায়। কিন্তু ভগবানের দেওয়া শঙ্খটা থেকে একটু শব্দও বের করতে পারছে না। বামনী একের পর এক ফুঁ দিতেই থাকলো। দিতেই থাকলো। এভাবে একপর্যায়ে যখন বামনীর মুখ ব্যথা হয়ে গেল, তখন শঙ্খটাকে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে আবার ঠাকুরের আসনে রেখে দিল।

অনেকক্ষণ পর বামনা মোড়ামুড়ি দিয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখে বামনী তাঁর পা ধরে বসে আছে। বামনীর এই অবস্থা দেখে বামনা বললো, ‘কি-রে বামনী, হারা রাইত ঘুমাস নাই? এই বেয়াইন্নাবেলা তুই আমার পা ধইরা বইয়া রইলি ক্যা? কি অইছে ক দেহি!’
বামনী মুচকি হেসে বললো, ‘আমার মেলা খিদা লাগছে। শঙ্খ ফুঁয়াইয়া খাওন চাইয়া আনো।’
বামনীর কথা শুনে বামনা বুঝতে পেরেছে বামনী শঙ্খ নিয়ে অনেকক্ষণ পারাপারি করেছে। শেষতক পারেনি বলেই, আমার হাতপা টেপতে বসেছে। বামনা মনে মনে বলছে, ‘হালার এইডা আইনাও মুশকিলে পড়লাম। অহনে দিনে রাইতে হগল সময় বামনী আমারে জ্বালাইয়া খাইবো। কদ্দুর পরপর কইবে, আমার এইডা লাগবো, ওইডা লাগবো। এইডা কইরা দেও, ওইডা কইরা দেও!’
মনে মনে এই বলেই বামনা বামনীকে বললো, ‘আইচ্ছা খার! আগে আমি আতমুখ ধুইয়া লই।’
এই বলেই বামনা বাড়ির উঠান থেকে একচিমটি মাটি তুলে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে গেল। বামনী ঘরের বারান্দায় সুন্দর করে বিছানা পেতে শঙ্খটা সামনে রেখে বসে রইলো। বামনা হাতমুখ ধুইয়ে এসে দেখে বামনী শঙ্খ সামনে নিয়ে বসে আছে। বামনা হেসে বললো, ‘রাইতে এতো খাওন খাইলি, হের পরও বেয়াইন্নাবেলা তর ক্ষুধা লাইগগা গেছেগা? দে দে, শঙ্খডা দে! আগে তর পেট ভরাইয়া লই!’
এই বলেই শঙ্খটাকে নমস্কার দিয়ে একটা ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, খাওন পাডাও!’
ওমনি ফটাফট ফটাফট বামনা বামনীর সামনে দুইজনের আন্দাজ খাবার চলে আসলো! তা দেখে বামনী বামনার পা টেপা শুরু করে দিলো। মাঝেমাঝে বামনার পায়ে নিজের দামী কপাল ঠেকিয়ে নমস্কারও করতে লাগলো। বামনা বামনীর এমন ভাব দেখে বললো, ‘থাকরে বামনীরে, তর আর কষ্ট কইরায়া আমার পা টিপন গালত না। তুই অহনে যেত পারছ খাইয়া ল।’

বামনী খাচ্ছে আর আক্ষেপ করে বলছে, ‘আমার মনে যে কত স্বাদ আছিল। থাকলে কী অইবো? আমারে আর কেডা দিবো! বিয়া অইছে ধইরা পরের বাইত কাম কইরা খাইতে খাইতে এই পইযন্ত আইছি। গেরামের বেডিগো দেহি কানে সোনাদানা দিয়া ঘুইরা বেড়ায়। আর আমার কান দুইডা হগল সুমকা খাইল্লা পইড়া থায়। আমার অত মন চায় কানের মাধ্যে বড়বড় দুল লাগাইয়া ঘুরতে। মন চাইলে আর কী অইবো? কেডা দিবো?’
বামনীর পেঁনপেঁনানিতে বামনার আর ভালো লাগছিল না। বামনা রেগেমেগে বললো, ‘ও-ই বামনী, তুই শঙ্খ দেইখা অহনে লোভে পড়ছত? এই সোনাদানা দিয়া কী অইবো? আর ক’দিন বাঁচবি? পোলাপাইন নাই! এডি খাইবো কেডা? সোনাদানা ছাড়া কি মাইনষের জীবন থাইমা থায়?’
বামনার এমন ধমকের পরও বামনি হু হু করে কেঁদে কেঁদে খাচ্ছে আর বলছে, ‘থাক থাক আমার কিচ্ছু লাগত না। হারা জীবন যেমনে আছিলাম, হেমনেই থাকুম!’
বামনা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আইচ্ছা, তর কী লাগবো ক? তুই অহনকা যেইডা চাস হেইডাই দিমু। ক কী লাগবো?’
বামনী বামনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমার অনেককিছু লাগবো। বাড়িডারে জমিদার বাড়ির লাহান কইরা দিতে অইবো। আমার কানে গলায় হিরা মুক্তা থাওন লাগবো।’
বামনা বললো, ‘আইচ্ছা ঠিক আছে হেইডাই অইবো। তয় হুইনা রাখ, তর কইলাম এই পইযন্তই চাওয়া। আর কইলাম কিচ্ছু চাইতি পারতি না। বেশি লোভ করিছ না বামনী! লোভে পাপ অয় জানস না?’

লোভ-৪ এখানে:

চলবে…

লোভ-২

লোভ-১ এখানে:

গল্পের প্রথম পর্বের শেষাংশ:
বামনা খুশি হয়ে উঠানের একপাশে হাতমুখ ধুইতে গেলো। হাতমুখ ধুইয়ে ভগবানের ঘরের বারান্দায় জলচকিতে বসলো।

ভগবানের মা কিছু নাড়ু মুড়ির সাথে এক গ্লাস জল এনে দিলেন, নতুন অতিথি বামনার সামনে। ভগবানের বাবা দৌড় দিলেন নিকটস্থ বাজারের দিকে।
ভগবানের বাবার চিন্তা হলো, ‘নতুন অতিথি বাড়িতে এসেছে। অতিথি হলো দেবতুল্য নারায়ণ। আবার এই আধপাগল অতিথি হলো স্বয়ং ভগবান পাগল। এই ভগবান পাগল অতিথিকে অন্তত একবেলা হলেও সুন্দরভাবে সমাদর করতে হবে এবং বিদায় দেওয়ার সময় অতিথিকে নতুন জামাকাপড় দিয়ে বিদায় করতে হবে। তাহলেই ভগবান সন্তুষ্ট হবে।’
এই ভেবেই ভগবানের বাবা ঘরে জমানো কিছু টাকা পকেটে ভরে চলে গেলেন বাজারে।

এদিকে বামনা তাঁর সামনে অনেকগুলো নাড়ু মুড়ি দেখে মনে মনে ভাবছে, ‘মনে অইতাছে ভগবানের মায়-বাবায় এগুলো খাওয়াইয়া, আমার মন ভুলাইয়া খালি আতে বিদায় কইরা দিবো। যদি এমুন ভাব দেহি, তায়লে আমি ভগবানরে কুলে কইরা বাইত লইয়া যামুগা। বাইত নিয়া পূজা করুম! দেহি হেগো ভাব-নমুনা!’
এই ভেবে বামনা জলের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ক’ফোঁটা জল হাতের তালুতে ঢালতে ঢালতে বলছে, ‘দেহেন গো ভগবানের মা, আমি খাওন দাওনের লোভে ভগবানের বাইত আহি নাই। আমি আইছি ভগবানের আশীর্বাদ পাওনের লোভে। অহনে আম্নেরা আমারে কি নাড়ু মুড়ি খাওয়াইয়া বিদায় করবেন? আমি কইলাম ভগবানের আশীর্বাদ লগে কইরা লইয়াই যামু। আশীর্বাদ ছাড়া খালি আতে যামু না। এইডা আম্নের ভগবানরে বুইজ্জা লইতে কইয়েন।’
এই বলেই নাড়ু মুড়ির থালার চারদিক হরি বলে জলের ছিঁটেফোঁটা দিয়ে খেতে শুরু করলো। ভগবানের মা সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো, আর ভাবতে লাগলো।
ভগবানের মা ভাবছে, ‘সর্বনাশ! এ আবার কোন পাগল আইয়া আমাগো কান্দে ভর কইরা বসলো? অহনে এই পাগল বিদায় করতে অইলে ঝামিলা বাঝবো। দেহি, বাজার থেইক্কা ভগবানের বাপে আহুক! হের লগে বুদ্ধি কইরাই একটা কিছু করতে অইবো।’
ভাবতে ভাবতেই ভগবানের বাবা বাজার থেকে কিছু সদাই-সহ নতুন অতিথির জন্য একটা ধূতি, একটা পাঞ্জাবি কিনে বাড়ি আসলো। বামনা তখনো ঘরের বারান্দায় জলচকিতে বসে বসে নাড়ু মুড়ি খাচ্ছিল।
ভগবানের বাবা বাজারের ব্যাগটা ভগবানের মায়ের হাতে দিয়ে কানে কানে জিজ্ঞেস করছে, ‘পাগলের খবর কী?’
ভগবানের মা ভগবানের বাবাকে হাতে ধরে চুপিসারে নিয়ে গেলেন ঘরে ভেতরে। ঘরের ভেতরে নিয়ে আস্তে আস্তে বলছে, ‘আগো, এইডা যে-সে পাগল না-গো! এইডা আসলও ভগবানের পাগল! অহনে এই পাগল বিদায় করবা ক্যামনে?’
ভগবানের বাবা জিজ্ঞেস করলো, ‘এইডা তুমি কী কইরা বুঝলা?’
ভগবানের মা বললো, ‘কতক্ষণ আগে পাগলে কইছে, দেহেন গো ভগবানের মা, আমি খাওন দাওনের লোভে ভগবানের বাইত আহি নাই। আমি আইছি ভগবানের আশীর্বাদ পাওনের লাইগা। অহনে কি আমারে নাড়ু মুড়ি খাওয়াইয়া বিদায় করবেন? আমি কইলাম আশীর্বাদ ছাড়া যাইতাম না।’
এই কথা ভগবানের বাবা শুনে চিন্তায় পড়ে ভগবানের মা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘অহনে কি-ডা করন যায়?’
ভগবানের মা ভগবানের বাবা’কে বললো, ‘দেহি কী করন যায়! আগে পাগলের লাইগা কিছু খাওন দাওনের ব্যবস্থা কইরা লই, হের পরে দেহুম!’
এরপর ভগবানের বাবা বামনার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘স্নান করবেন?’
বামনা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আরে দূর! আমি আইছি কিল্লাইগা, আর আমারে কয় স্নান করতে। আমি স্নান টান করতাম না। আম্নেগো ভগবান কই? হেরে আমার সামনে আইত কন! হের লগে আমার এট্টু বুঝাপড়া আছে। হেয় আমারে কিছু করে না ক্যা!’
বামনার এমন কথার পর ভগবানের বাবা বুদ্ধি করে বললো, ‘ভগবান হারা দুনিয়া দেখা হুনা করে। হের সময় আছেনি! হেয় আম্নেরে কইছে স্নান কইরা খাইয়া দাইয়া ঘরে যাইয়া বইতে। হেয় সময় মতন আইয়া আম্নের লগে দেয়া করবো। অন আম্নে যাইয়া স্নান কইরা আইয়া ভগবানের বাইত কিছু সেবা কইরা লন। হের পরে দেহেন ভগবান আহে কি-না?’
ভগবানের বাবার কথা বামনার মনোমত হওয়ায় বামনা বললো, ‘দেইক্কেন কইলাম! কামে কাইজে যহন মিল থাহে। দেন দেন, আমারে একখান গামছা আইনা দেন। আমি স্নান কইরা আহি।’
বামনার কথা শুনে ভগবানের বাবা ঘর থেকে নতুন একটা গামছা এনে বামনাকে দিয়ে বললো, ‘এই নতুন গামছাখান ভগবান আম্নেরে দিছে। আম্নে এইডা সবসুমকা ব্যবার কইরেন।’
ভগবানের দেওয়া নতুন গামছা হাতে পেয়ে বামনা খুশিতে আটখানা হয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘হাছাই কইতাছেন? এইডা ভগবান আমারে দিছে? ইল্লাইগাই মাইনষে কয়, ভগবান দয়ার সাগর।’
এই বলেই গামছা হাতে নিয়ে বামনা ভগবানের বাড়ির পুকুর ঘাটে স্নান করতে চলে গেল। ভগবানের বাবা গিয়ে ভগবানের মায়ের সাথে পাগল বিদায় নিয়ে শলাপরামর্শ করতে লাগলো, কী করে এই ভগবান পাগল বাড়ি থেকে বিদায় করা যায়! আবার দুইজনেই ভাবছে ভিন্নভাবে! তা হলো, যদি ভগবান পাগলকে খুশি না করা যায়, তাহলে সে আবার চলে আসবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই! কারণ, এই পাগল আমাদের বাড়ি চিনেছে। সে তাঁর দুঃখকষ্টে দৌড়ে চলে আসবে, এটা তাঁর ভগবানের বাড়ি মনে করে। তাই যা করতে হয় ঠাণ্ডা মাথায় বুঝেশুনে করতে হবে। তাহলে কী করা যেতে পারে? একে অপরকে জিজ্ঞেস করলো!
ভগবানের মা তাঁর স্বামীকে বললো, ‘আমাগো ঘরে আগেরদিনের একটা শঙ্খ আছে। পাগলরে এইডা দিয়াই বিদায় করতে অইবো।’
ভগবানের বাবা জিজ্ঞেস করলো, ‘এই শঙ্খডা দিয়া হেয় কিডা করবো? এইডা কি হেয় রাজি অইবো?’
ভগবানের মা বললো, ‘রাজি অইবো, আরো ভালাও কইবো!’
ভগবানের বাবা জিজ্ঞেস করলো, ‘এইডা আবার ক্যামনে?’
ভগবানের বাবাকে ভগবানের মা বললো, ‘হুনো, এই শঙ্খডা আমাগো ভগবানের আতের তুনে পাগলের আতে দিয়া কইবা, এইডা ভগবান খুশি অইয়া আম্নেরে দিছে। এইডা লইয়া আম্নে বাইত যাওগা।’
ভগবানের বাবা বললো, ‘পাগল যদি জিগায় এইডা দিয়া আমি কি করমু?’
ভগবানের মা বললো, ‘আমরা কমু এইডারে ফুঁ দিয়া আম্নে যা কইবেন হেডাই অইবো। এই কথা কইলে পাগলে হের মনের বিশ্বাসে লইয়া দৌড় দিবো, বুইঝলা!
ভগবানের বাবা বললো, এইডা না অয় বুইঝলাম! আর পাগলে যদি কয়, তয়লে একটা ফুঁ দিয়া দেইখা লই! তহনে কি অইবো?’
ভগবানের মা বললো, ‘তয়লে কমু এইডা দিয়া ভগবানের বাইত ফুঁয়াইলে কাম অইত না। এইডা ফুঁয়াইতে অইবো আম্নেগো বাইত যাইয়া।’
কথাটা ভগবানের বাবার মনোমত হলো। তারপর ঘরের কাড়ের উপর উঠে অনেক খোঁজাখুঁজি করে শঙ্খটা খুঁজে বের করা হলো। শঙ্খটি অনেক বড় এবং অনেক পুরাতন। তাই শঙ্খের গায়ে শেওলা পড়ে আছে। দেখতে দেখা যাচ্ছে কালো। এটাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে ঘরের এক জায়গায় যত্নসহকারে রেখে দিল। বামনাও পুকুর থেকে স্নান করে ঘরের বারান্দায় এসে হাজি হলো। এরপর ভগবানের বাবা বাজার থেকে কিনে নেওয়া নতুন একটা ধূতি, আর একটা নতুন পাঞ্জাবি একটা থালে করে বামনার সামনে এসে বললো, ‘এইগুলা ভগবান আম্নেরে দিছে। আম্নে এগুলা পইরা দুইডা অন্ন সেবা কইরা লন।’

নতুন ধূতি, নতুন জামা দেখে বামনা খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আম্নেগো ভগবান কই। এইগুলা পইরা আমি আগে ভগবানরে নমস্কার দিমু! ভগবানরে ডাহেন দেহি! এই বলেই বামনা ভগবানের বাবার হাত থেকে নতুন ধূতি, নতুন পাঞ্জাবি নিয়ে সুন্দর করে পরে নিলো। এরমধ্যেই ভগবানের মা লেঙটা ভগবানকে একটা পরিষ্কার জামা প্যান্ট পরিয়ে বামনার সামনে নিয়ে এলো। বামনা নতুন জামাকাপড় পরে ভগবানের মা-বাবাকে নমস্কার করে লেঙটা ভগবানকে নমস্কার করলো। এরপর বামনা লেঙটা ভগবানকে কোলে নিয়ে বললো, ‘দয়াল ভগবান, আম্নের এইডা কেমন কাম? আম্নে রাজারে ফকির বানান! ফকিররে রাজা বানান! আমারে আম্নে কিছু করেন না ক্যা? আমি কি আম্নের নাম লই না? আমি বামনীর ঠেলা গুতা খাইতে খাইতে আমার জান শেষ কইরা হালাইতাছি! আইজগা আমারে কিছু একটা করতে অইবো, ভগবান। নাইলে আমি আম্নেগো বাইততে যাইতাম না। আমারে আম্নে বহাইয়া বহাইয়া হারাজীবন খাওয়াইতে অইবো। অহনে কন, আমারে কি করবেন?’
বামনার কোলে লেঙটা ভগবান তো ভয়ে মা মা বলে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। ভগবানের কান্নাকাটি আর বামনা সইতে না পেরে লেঙটা ভগবানকে তাঁর মায়ের কোলে দিয়ে বললো, ‘কি গো ভগবানের মা, আম্নের ভগবান এতো কান্দে ক্যা?’
ভগবানের মা ছিলেন খুবই চালাক মহিলা। তিনি বামনাকে বললো, ‘আম্নের ভগবান এ-ই দুনিয়ার কিছু অসহায় গরিব মাইনষের লাইগা কান্দে। এই যে আম্নে একজন দুখি! এমন আরও বহুত গরিব মানুষ আছে, ভগবান হেগো লাইগা হগল সুমকা কান্দে। ক’দিন আগে আম্নের লাইগাও কানছিল। আম্বে এনো আইবেন, এইডা ভগবান আরও ক’দিন আগেই আমাগো কাছে কইছে।’
ভগবানের মায়ের কথা শুনে বামনা তা-ই বিশ্বাস কললো। এরপর ভগবানের মা বললো, আহেন দুইডা ডাইল ভাত সেবা কইরা লন।’
এরপর বামনাকে খেতে দিলেন, বামবা পেটভরে মনের অানন্দে খেলেন। খাওয়াদাওয়া শেষে বামনা বললো, ‘আর দেরি করন যাইত না। আম্নেগো ভগবানেরে কন আমারে বিদায় করতে।’
ভগবানের বাবা বললো, ‘ভগবানগো বাইত খাইয়া দাইয়া এট্টু বন লাগে, জিরান লাগে। আম্নে খাডের উপরে যাইয়া এট্টু বনগা। ভগবান ভাইবা দেহুক, আম্নেরে কি দিবো।’
ভগবানের বাবার কথা শুনে বামনা তা-ই করলো। ভগবানদের খাটের উপরে গিয়ে আরামসে গা লেলিয়ে দিয়ে বসে বসে ভাবছে, ‘ব্যাপারটা কী? হেরা আমারে বিদায় দিতে এত দেরি করতাছে ক্যা? আমার বামনী একলা বাইত রাইত কইরা ক্যামনে থাকবো?’ এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে বামনা একসময় ভগবানদের ঘরের খাটের উপর ঘুমিয়ে পড়লো।
এদিকে ভগবানের মা বাবা ঐ পুরাতন শঙ্খটা নিয়ে ভাবতে লাগলো, যদি শঙ্খটা পাগলে গ্রহণ না করে? যদি জেদ করে বলে, আমি যাবো না? তখন কী হবে? ভগবানের মা-বাবা এসব চিন্তাভাবনা করতে করতে বামনা ঘুম থেকে জেগে উঠে বললো, ‘কি গো ভগবানের মা, আমি কি আমগো বাইত যাইতাম না? আম্নের ভগবান কই? হেরে ডাক দেন! আমার বাইত যাওন লাগবো।’
ভগবানের মা-বাবা একটা কাঁসার থালার মাঝে পুরাতন একটা শঙ্খ দিয়ে লেঙটা ভগবানকে নিয়ে বামনার সামনে এসে বললো, ‘এইডা ধরেন! এইডা ভগবান আম্নেরে দিছে।’
বামনা শঙ্খ দেখে রেগেমেগে বললো, ‘এইডা দিয়া আমি কি করমু? এই শঙ্খডারে আমি কি চাবাইয়া চাবাইয়া খামু? এইডা দিয়া কি অইবো?’
ভগবানের মা বললো, ‘আগো হুনেন, এডারে ফুঁ দিয়া যা কইবেন, হেইডাই অইবো। ভগবান বুইঝা হুইনাই আম্নেরে এইডা দিছে।’
বামনা বললো, ‘আইচ্ছা, ‘তয়লে আমি আগে একখান ফুঁ দিয়া দেইখা লই।’
এই কথা বলেই কাঁসার থাল থেকে শঙ্খটা হাতে নিয়ে যেই ফুঁ দিয়ে চাইলো, ভগবানের মা বামনার হাতে ধরে বললো, ‘ভগবানের জিনিস, ভগবানের বাইত ফুঁয়াইলে কাম অইত না। এইডা আম্নেগো বাইত নিয়া ফুঁয়াইতে অইবো।’
ভগবান পাগল বামনা তা-ই বিশ্বাস করে শঙ্খটাকে নমস্কার করে তাঁর ঝোলায় ভরে রাখলো। এরপর সবাইকে নমস্কার করে বামনা তাঁর বাড়ি রওনা হলো। লেঙটা ভগবানের মা-বাবাও তাঁদের বাড়ি থেকে ভগবান পাগল বিদায় করলো। বামনা ভগবান ভগবান বলতে বলতে নিজের বাড়ির পথে চললো।

লোভ-৩ এখানে:

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে। হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।

প্রহরীর সাথে কথা বলে হিরা যাচ্ছে রাজদরবারে। হিরা’র পিছনে পিছনে গেইটের প্রহরীও গেইট ফেলে রেখে দরবারের দিকে ছুটলো। প্রহরীর উদ্দেশ্য উজির আর ছেলের বাজারের কাহিনী শোনার জন্য। আর উজির সাহেব তো আগেই দরবারে এসে রাজার কাছে হিরা বিষয়ে সব বৃত্তান্ত খুলে বলেছে। উজিরের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে রাজাও একটু দুশ্চিন্তায় আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, আর ভাবছিল।

এমন সময় হিরা রাজদরবারে এসে হাজির। পিছনে পিছনে গেইট প্রহরীও। হিরা’কে দেখেই উজির জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘এই যে হুজুর বাটপারটা এসেছে। মনে হয় আবার পয়সা তিনেক নেওয়ার জন্যই দরবারে এসেছে। দিবেন না হুজুর, দিবেন না। আর একটি পয়সাও দিবেন না। আপনি পয়সা দিলেন সদাই কেনার জন্য। আপনার দেওয়া সেই পয়সা দিয়ে জিলাপি কিনে খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। কাকে যে সদাই আনতে দিলেন হুজুর, এটা আমার মাথায় কিছুতেই খেলছে না। শেষপর্যন্ত আমাকে থাপ্পড় মারার বিচারটাও করলেন না, হুজুর।’ এই বলেই উজির হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রাজা উজিরকে শান্তনার সুরে থামতে বললেন।

এরপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, এই ছেলে, ‘আমার উজির যা বলেছে, তা কি ঠিক?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, রাজা হুজুর। আপনার উজির সাহেব যা বলেছে সবই সত্যি।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে আমার পয়সা তুমি খেয়ে ফেলেছ?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, হুজুর। আমি পয়সা খেয়ে সদাইও কিনেছি।’ হিরা’র কথা শুনে উজির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো! উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! কখন সদাই কিনলি? তুই বেটা এক পয়সার জিলাপি খাইলি। এক পয়সা ফকিরকে দিলি। আর এক পয়সা দিলি কোমড় ঢুলানি ড্যান্স দেইখা। তিন পয়সা তো এখানেই শেষ! আবার সদাই কিনলি কোত্থেকে? এই বেটা, সদাই কই? সদাই বের কর? এখানে বাটপারি করতে আসছ? তেরো সিকে ঢুকাইয়া রাখুম, বুঝলি!’

উজিরের বাড়াবাড়িতে রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে হিরা’কে বললো, ‘এই ছেলে, সদাই যদি কিনেই থাক, তাহলে সদাই কোথায়? সদাই বের করো। নাহয় পয়সা বের করো! যেই তিন পয়সা তোমাকে দিয়েছি, সেই তিন পয়সা দিয়ে এক মুল্লুকের জমি কেনা যায়। তুমি বাবা সদাই দাও, নাহয় পয়সা বের করো।’ রাজার কথায় হিরা কিছুই বলছে না। হিরা চুপ চোরের মতো এক কোণে করে বসে আছে।

উজির হিরা’র দিকে টগবগিয়ে চাচ্ছে আর বলছে, ‘রাজা হুজুর, আপনি ও-কে বন্দি করে কারাগারে ঢুকিয়ে রাখুন। সকালে ওঁর ঠিকানামতো ওঁদের বাড়িত্তে গিয়ে, ওঁর বাবাকেও তিন পয়সা বাটপারির দায়ে বন্দি করে নিয়ে আসবো। তারপর পরের পয়সা দিয়ে জিলাপি খাওয়া বের করবো।’ এবার হিরা বসা থেকে উঠে হাত দুটো জোড় করে বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাকে সদাই তিনটি কী কী যেন আনতে বলেছিলেন? দয়া করে আবার একটু বলুন, সবাই শুনুক! আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।

রাজা বললো, ‘ওহ্! আচ্ছা, মনে হয় তুমি সদাই তিনটির নাম ভুলে গিয়েছ। তাহলে শুনো, আবারও বলছি! এক পয়সার এখন। এক পয়সার তখন। আর এক পয়সার এখনো না তখনো না। এবার শুনলে তো?’ হিরা বললো, ‘তাতো আমি এনেছি হুজুর! সদাই গুলো সব আপনার উজিরের কাছে আছে।’ এই কথা শুনেই উজির বসা থেকে দৌড়ে গিয়ে হিরা’র গলা চেপে ধরে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! আমার কাছে সদাই দিছস কখন? তুই বেটা আমাকে জিলাপি খাওয়াতে চাইলি, তাওতো আমি খাইনি! এখন বলছিস সদাই আমার কাছে?’ রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে বললো, ‘এই ছেলে, উজির সাহেবের কাছে সদাই গেলো কীভাবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমি যা করেছি, আপনার উজির সাহেবের সামনা-সামনিই করেছি। তাই সদাই তিনটিও উজির সাহেবের সহযোগিতায় করা হয়েছে।’ উজির উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘কই, সদাই কই হে? জিলাপি খাও! ফকিরকে দাও! ড্যান্স দেখো! আবার সদাই কিনছে? বেটা বাটপার।’

রাজা বললো, ‘কখন কীভাবে সদাই কিনলে? আর আমার উজির সাহেবের কাছেই বা কখন দিলে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, উজির সাহেব-সহ যখন আপনার বাড়ির সামনে বউ বাজার গেলাম। বাজারে ঢুকতেই দেখি এক লোক জিলাপি ভেজে রেখেছে। উজির সাহেবকে বললাম, আমি জিলাপি খাব। উজির সাহেব জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, জিলাপি গরম না ঠান্ডা? জিলাপি বিক্রেতা বললো, একেবারে টাটকা গরম জিলাপি। এখন ভেজে রেখেছি, এখন। উজির সাহেব একপোয়া জিলাপি দিতে বললেন, জিলাপি বিক্রেতা একপোয়া জিলাপি মেপে দিলেন। আমি এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে জিলাপি খেতে শুরু করলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে একটি সদাই, ‘এক পয়সার এখন’। কারণ, জিলাপি বিক্রেতা বলেছিল, এখন ভেজে রেখেছি এখন। তাই আপনার একটি সদাই, এখন।’

হিরা’র কথা শুনে উজির সাহেব এখন ভাবছে! আর মনে মনে বলছে, হায়! হায়! ঠিকই তো! রাজা তো এই এখনের কথাই বলছিল। এটা তো আমিও পারতাম! ছেলেটা তো ঠিকই করেছে।

হিরা’র কথা শুনে রাজা বললো, ‘তা মেনে নিলাম। বাদবাকি সদাই গুলোর হিসাব দাও।’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জিলাপি খাচ্ছি আর হেঁটে যাচ্ছি বাজারে ভেতরে। আপনাদের এখানকার বাজার খুবই সুন্দর হুজুর। হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম। এমন সময় এক ভিক্ষুক আমার কাছে ভিক্ষা চাইলো। যখন ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলো তখন আমি ভিক্ষুককে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে দ্বিতীয় সদাই, এক পয়সার তখন।’

এরপর গেলাম আপনার বউ বাজারের শেষ মাথায়। সেখানে যেতেই কানের সামনে বাজনার আওয়াজ এলো। একটু সামনে গিয়ে দেখি মানুষ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে নাচগান চলছে। আমি হুজুর নাচগানের পাগল। তাই আর বাইরে থাকতে পারিনি। ঠেলেঠুলে ভেতরে গেলাম। রূপবান গানের সাথে এক হিজরার ড্যান্স দেখে নিজেও কিছুক্ষণ নাচলাম। চমৎকার ড্যান্স হুজুর। আপনার উজির সাহেবও দেখেছে। উনি আমার পিছনেই ছিল। একসময় যখন ড্যান্স শেষ হলো, সবাই সবার সাধ্যমতো এক পয়সা আধা পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিচ্ছিলো। তা দেখে আমিও সাথে থাকা এক পয়সা হিজরাকে বকশিস দিয়ে দেই, হুজুর। আপনার দেওয়া তিন পয়সার মধ্যে এই এক পয়সার হিসাব পাপপুণ্য বা ইহকাল পরকালের কোনও কাজে লাগেনি। তাই এটা জাহান্নামই গেলো হুজুর। এটা হলো আপনার তিন পয়সার তিনটি সদাই’র মধ্যে তৃতীয় সদাই, এখনো না তখনো না। এই বলেই হিরা উজিরকে জিজ্ঞেস করছে, কি উজির সাহেব, আমি কি মিথ্যে কিছু বলেছি?’

উজির বোকার মতো চুপ করে বসে বসে ভাবছে, এই সদাই তো আমি নিজেও করতে পারতাম। কেন যে বোকার মতো অপারগতা স্বীকার করলাম! পারবো না বলে ছেলেটার হাতে ছেড়ে দিলাম! হায়রে কপাল আমার! এখন ছেলেটাই তো রাজ্যের সব নিয়ে নিবে!

হিরা’র কথা শুনে রাজা এবার মনে মনে ভাবলো, ছেলেটা তো আমার তিন পয়সার তিনটি সদাই ঠিকই কিনে ফেলেছে। এখন যদি আমি বলি সদাই তিনটি ঠিক হয়েছে, তাহলে তো আমার রাজ্যের অর্ধেক ছেলেটার হাতেই চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। না, তা হতে দেওয়া যাবে না। এই ভেবেই রাজা বললো, ‘শুনো ছেলে, এই তিনটি সদাই’র মধ্যে শেষ সদাইটি এভাবে হবে না। এটা অন্যভাবে হবে। তিনটি সদাই’র মধ্যে তুমি দু’টি সদাই ঠিকমতো করতে পেরেছ। তৃতীয় সদাইটি ঠিকমতো করা হয়নি।’

রাজার কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে হেল। কেউ খুশি হলো। কেউ রাগ হলো কেউ আবার দুঃখও পেলো। উজির এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো, ছেলেটা তো সদাই তিনটি ঠিকমতোই করেছে। কিন্তু, রাজা এখন অস্বীকার করছে কেন? ছেলেটা যদি কিছু বকশিস পায়, তাহলে তো আমিও সেই বকশিস থেকে কিঞ্চিৎ কিছু পেতাম। তা যে-ভাবেই হোক ছলে-বলে কলেকৌশলে ছেলেটার কাছ থেকে আদায় করতাম। কিন্তু রাজার কথায় মনে হচ্ছে, সব আশাই আমার বিফলে যাচ্ছে। তারপরও দেখা যাক, কী হয়! এই ভেবে উজির কালো মুখ করে হিরা’র দিকে চেয়ে থাকলেন।

হিরা রাজার কথা শুনে বললো, ‘রাজা হুজুর, তা যদি আপনার মনোমত না হয়। তাহলে তো আমার কিছুই করার থাকলো না। দয়া করে আমাকে মাপ করে দিন। যদি তিন পয়সার জন্য আপনার কোনও দাবি থাকে তাও বলুন! আমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে আপনার দেওয়া তিন পয়সা জোগাড় করে নিয়ে আসবো। তবে এরজন্য আমাকে অন্তত তিনদিন সময় দিতে হবে হুজুর।’ এই বলেই হিরা রাজদরবার থেকে বের হয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলো।

রাজাও দরবারে বসে বসে ভাবতে লাগলো, এরকম মিথ্যা কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। ছেলেটা তো আমার কথামতো তিনটি সদাই ঠিকই করেছে। কিছু চাওয়া-পাওয়ার জন্য এমন একটা বুদ্ধিমান ছেলেকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই ভেবে মনস্থির করলো হিরা’কে ফিরিয়ে আনতে ডেকে পাঠাবেন, উজিরকে। কিন্তু হিরা ততক্ষণে রাজবাড়ি থেকে অনেকদূর চলে গেছে। রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটাকে ডেকে আনুন! আমি ছেলেটাকে উপযুক্ত বকশিস দিবো। এমনকি, ছেলেটা যা চাইবে, তা-ই দিবো। ডাকুন ছেলেটাকে! এই বুদ্ধিমান ছেলেটাকে আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে ছেলেটাকে ডেকে আনুন।’ রাজার উপদেশ পেয়ে উজির সাহেব মনের আনন্দে দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে মনে মনে বুদ্ধি করলেন, ‘যে-করেই হোক, ছেলেটার কাছ থেকে বকশিসের অর্ধেক আমার পেতেই হবে।’

আসলেন গেইটের সামনে। প্রহরী বললো, ‘উজির সাহেব, তাড়াতাড়ি দৌড় দেন! ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনুন! ছেলেটা বকশিস পেলে আমিও কিছু বকশিস পেতে পারি। যান যান হুজুর, তাড়াতাড়ি যান।’ গেইট থেকে বের হয়ে উজির দৌড়াচ্ছে। হিরাও হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে। উজির দৌড়ে গিয়ে হিরা’র সামনে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, অনেক কষ্ট করে রাজাকে রাজি করিয়েছি। এখন তুই বাবা যা চাস, তা-ই পাবি! কিন্তু বাবা আগে আমার সাথে তোর একটা শর্ত করতে হবে৷’ হিরা বললো, ‘কী শর্ত করতে হবে উজির সাহেব? তা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন!’ উজির বললো, ‘তুই বাবা যা পাবি, তার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে। আমি বাবা রাজাকে তেল মাখতে মাখতে হাত দুটো বিষ করে ফেলেছি। আমি যদি রাজাকে না বলতাম, তাহলে রাজা আর রাজি হতো না, তোর কপালেও আর বকশিস জুটতো না। এখন বল, তুই আমার সাথে শর্ত করতে রাজি কি-না?’

হিরা হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ উজির সাহেব, আমি রাজি আছি। তো, এভাবে মুখের কথার কোনও গ্যারান্টি নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো বকশিস পেয়ে আমিও অস্বীকার করতে পারি। সেজন্য একটা কাগজে লিখে সই-স্বাক্ষর করে রাখা ভালো।’ উজির মনের আনন্দে রাজি হয়ে গেলেন। হিরা একটা দোকান থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ সংগ্রহ করে কাগজে লিখল, “রাজা থেকে আমি যা পাবো, তার অর্ধেক সম্মানিত উজির সাহেব পাওনা।” এরপর লেখার নিচে উজিরের স্বাক্ষর রাখলো।

এদিকে রাজবাড়ির গেইট প্রহরী গেইট খুলে আগে থেকেই তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে, কখন উজির-সহ ছেলেটা আসবে। উজির-সহ হিরা যখন রাজবাড়ির গেইটের সামনে আসলো, গেইট প্রহরী হিরা’কে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মালিশ করেছি। এখন তুই যা পাবি আমাকে অর্ধেক দিবি। বকশিস কিন্তু আমার কারণেই পাচ্ছিস।’ হিরা বললো, ‘আমি যা পাবো তা থেকে তো অর্ধেক উজির সাহেবকে দিতে হবে। তাহলে আপনাকে আমি কীভাবে অর্ধেক দিবো?’ প্রহরী বললো, ‘তাহলে উজির সাহেবকে অর্ধেক দিয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক আমাকে দিবি।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। তবে এই কাগজে একটা স্বাক্ষর দিতে হবে।’ গেইট প্রহরী মনের আনন্দে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে গেইট ফেলে তিনজন মিলে চললো রাজদরবারের দিকে।

তিনজন মিলে দরবারে যেতেই দেখা হয় এক মহিলার সাথে। তিনি রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী। সেই মহিলা হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মেখেছি। তারপরও রাজা কি-আর রাজি হয়! অনেকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছি তোকে বকশিস দিতে। এখন বাবা তুই যা পাবি, আমাকে এর অর্ধেক দিবি।’ হিরা হেসে বললো, ‘আমার বকশিসের ভাগিদার আপনার মতো আরও দুইজন আছে। তাহলে আপনাকে দিবো কীভাবে?’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা বললো, ‘তাঁদের দিয়ে থুইয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক দিলেই হবে বাবা।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। এখানে একটা স্বাক্ষর দিন!’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা স্বাক্ষর জানতেন না। তাই কলমের কালি মহিলার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে টিপসই নিয়ে নিলো। এবার চারজন গিয়ে হাজির হলো রাজদরবারে।

রাজদরবারে তখন অনেকেই উপস্থিত ছিল। যত লোকই থাকুক-না-কেন, হিরা’ই এখন দরবারের হিরো। সবার দৃষ্টি হিরা’র দিকে। হিরা’কে রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ছেলে, বাজার থেকে তোমার এনে দেওয়া তিন পয়সার তিনটি সদাই আমি খুশি মনে গ্রহণ করেছি। আমি যা চেয়েছি আর যেভাবে চেয়েছি, তুমি ঠিক সেভাবেই করতে পেরেছ। তাই আমি তোমাকে উপযুক্ত বকশিস দিতে চাই। এখন বলো তুমি কী চাও! তুমি এখন এই মুহূর্তে যা চাইবে তা-ই আমি তোমাকে দিতে রাজি আছি। বলো তুমি কী চাও!’

রাজার এই ঘোষণা শুনে উজির হিরা’র কানে কানে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, ‘তুই বাবা রাজার সিংহাসনটা চা! তাহলে আমি রাজ্যের অর্ধেক পেয়ে যাবো। এই রাজার উজিরগিরি আর ভালো লাগে না। তুই বাবা তাড়াতাড়ি সিংহাসনটা চা।’ উজিরের এরকম পরামর্শে হিরা বললো, ‘চাচ্ছি উজির সাহেব, চাচ্ছি! চাইতে আমি আর কম চাচ্ছি না। একটু বেশি করেই চাচ্ছি। যাতে আপনাদের দিয়ে আমারও কিছু থাকে।’ হিরা’র কথা শুনে উজির খুশিতে তাইরে-নাই-রে নাই-রে-না করে নাচতে লাগলো!

হিরা’র চাইতে দেরি দেখে রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার! চাও তুমি, কী চাইবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, চাইতে আমার কেমন যেন দ্বিধাবোধ হচ্ছে। আমি যা চাইবো, তা যদি আপনি না দেন, তাই।’ হিরা’র এমন কথায় রাজা খুব রেগে বললো, ‘কি, আমার মুখের কথার কি কোনও দাম নেই? চাও তুমি কী চাইবে!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার কাছে ধনসম্পত্তি, রাজ সিংহাসন এসব কিছুই চাই না।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তুমি কী চাও? যা-কিছুই চাও, তা-ই তোমাকে দেওয়া হবে। বলো কী চাও!’ হিরা বললো, রাজা হুজুর, ‘আমি আপনার দরবারে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি চাই!’

হিরা’র মুখে এই কথা শুনে রাজা-সহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে হিরা’র দিকে তাকিয়ে রইল। উজির কাঁপতে কাঁপতে হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘আরে বাবা, তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?’ হিরা উজিরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আবারও বললো, ‘রাজা হুজুর, ‘আমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি দেওয়ার ঘোষণা দিন!’

রাজা অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে ভেবে দেখলো, ছেলেটার জুতার বাড়ি চাওয়ার পিছনে কোনও কারণ থাকতে পারে। তাই ছেলেটা জুতার বাড়ি চাচ্ছে। দেখি এর পিছনে কী থাকতে পারে? এই ভেবে রাজা বললো, ‘ঠিক আছে, আমি আজকে এ-ই দরবারে সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিচ্ছি, তোমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়িই দেওয়া হবে।’ রাজা ঘোষণা দেওয়ার পর উজির কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে কপালে থাপ্পড় মারতে লাগলো। গেইট প্রহরী রাজ দরবার থেকে বাইরে যেতে চাইলে, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জুতার বাড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার রাজদরবার থেকে কেউ যেন বের হতে না পারে। দয়া করে আপনি তাড়াতাড়ি ঘোষণা দিন!’

হিরা’র জুতার বাড়ি চাওয়ার বিষয়টি আর রাজার বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাজা দরবারের গেইটে থাকা দুইজন সিপাহিকে বললো কেউ যেন দরবার থেকে বেরুতে না পারে। যেই কথা সেই কাজ। দরবারের গেইট মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। জুতার বাড়ি দেওয়ার জন্য জল্লাদ এসে হাজির হলো। (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারার জন্য রাজার পুরানো গোডাউন থেকে রাজার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিদের ব্যবহার করা সব পুরাতন জুতা খুঁজে বের করে দরবারে আনা হলো। জুতার বিশাল স্তুপ দেখে উজির-সহ গেইট প্রহরী আর পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলার এখন জীবন যায় যায় অবস্থা! এর মধ্যে উজির কয়েকবার অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছিল।

রাজা জল্লাদকে হুকুম দিলো, ‘এই জল্লাদ, ছেলেটাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারো।’ রাজার হুকুম পেয়ে জল্লাদ দুইহাতে দুটি জুতা নিয়ে হিরা’র দিকে এগুতেই, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার কিছু কথা আছে। রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কথা?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, এই বকশিস’র মধ্যে কিছু ভাগবাটোয়ারা আছে।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘জুতার বাড়ির মধ্যে কেমন ভাগা-ভাগি থাকতে পারে?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আমাকে এই বকশিস দেওয়ার জন্য আপনার উজির নাকি আপনাকে তেল মালিশ করে রাজি করিয়েছে? তাই উনি আমার কাছে বকশিস’র অর্ধেক দাবি করেছে। দেখুন, আমার সাথে উজিরের শর্ত করার কাগজ। যেই কাগজে আপনার উজিরের স্বাক্ষর আছে। তাই আমি উনার সেই দাবি পূরণ করতে চাই, রাজা হুজুর। দয়া করে (৫.০০০) পাঁচ হাজার জুতার বাড়ি আপনার সম্মানিত উজিরকে আগে দেওয়া হোক। হিরা’র কথামতো রাজা তা-ই হুকুম দিলেন। জল্লাদ আগেকার দিনের পুরাতন জুতা দিয়ে ঠাস্ ঠাস্ করে শখানেক বাড়ি উজিরের গালে মাথায় বসিয়ে দিলেন। উজিরের এখন জীবন যায় যায় অবস্থা। শেষতক হিরা’র অনুরোধে পাঁচ (৫.০০০) হাজার জুতার বাড়ি থেকে বাকি থাকা সব মাপ করে দিলেন। জল্লাদ বেটা জুতা মারা বন্ধ করলেন।

রাজা আর বাদবাকি (৫.০০০) জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারতে বললে, হিরা তাতেও আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘রাজা হুজুর, এই (৫.০০০) পাঁচ হাজারের মধ্যেও ভাগ আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ভাগটা কাকে দিতে হবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, এই ভাগিদার হলো আপনার গেইট প্রহরী।’ রাজা অবাক হয়ে বললো, ‘এই গেইট প্রহরী মানে দারোয়ান। দারোয়ানও তোমার কাছে বকশিসের ভাগ চেয়েছে?’ হিরা বললো, ‘হ্যাঁ রাজা হুজুর! উনিও নাকি আমার বকশিসের জন্য আপনাকে তেল মেখেছে? তাই উনাকেও থেকে যাওয়া বাদবাকি বকশিসের অর্ধেক দিতে হচ্ছে।’ রাজা রেগে-মেগে জল্লাদকে বলললো, ‘ও-কে আড়াই হাজার জুতার বাড়ি খুব জোরে জোরে মারবে। রাজার আদেশ বলে কথা। তাই জল্লাদ গেইট প্রহরীকে ঠাস্ ঠাস্ করে দুইহাতে মারতে শুরু করলো। শখানেক মারার পর গেইট প্রহরীর জীবন যায়। তখন হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, গেইট প্রহরীকে মাপ করে দিন।’ হিরা’র কথামতো রাজা মাপ করে দিয়ে জল্লাদকে বললো, ‘থেকে যাওয়া বাকি আড়াইহাজার জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারো।’

হিরা বললো, রাজা হুজুর, আরও একজন ভাগীদার আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘সে কে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী এই মহিলা।’ রাজা একেবারে ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, ‘এই সুইপার মহিলাও তোমার কাছে ভাগ চেয়েছে? কী আশ্চর্য! আমার দরবারে কি সবাই চোর বাটপার? এতো দিন মনে হয় এঁরা রক্তচোষা হয়ে আমার রক্ত তো চুষে খেয়েছেই, সাথে আমার রাজ্যের সকলের রক্ত চুষে খেয়েছে। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। আজ তোমার কারণে সবাইকে আমার চেনা হয়ে গেল। এই বলেই জল্লাদকে বললো, ‘এই সুইপার মহিলাকে পুরো ১২৫০ টি জুতার বাড়ি মেরে, আরও ৫০টি জোতা বেশি মারবে। একটিও যেন কম না হয়।’ জল্লাদ সাথে সাথে শুরু করে দিল ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ বাড়ি। সুইপার মহিলা মরে যাবে ভেবে হিরা গিয়ে জল্লাদের হাতে ধরে জুতার বাড়ি থামালেন। জল্লাদ থামলেন।

এবার হিরা রাজাকে বললো, ‘রাজা হুজুর, (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি থেকে আর যা বাকি আছে সব আমাকে মারতে হুকুম দিন।’ এই বলেই হিরা তাঁর শরীরের জামা খুলে খালি গায়ে দরবারের মাঝখানে দাঁড়ালো। তখন রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে হিরা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ থেকে তুমিই আমার এই সিংহাসনে বসবে। আমি যে ক’দিন বেঁচে থাকি, তোমার পাশে বসে থাকবো। আজ থেকে তুমিই রাজ্যের রাজা। আমি তোমার প্রজা।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

এখানেই সমাপ্তি।

দুই অন্ধ ভিক্ষুক যখন এক রাস্তায়

বর্তমানে প্রত্যেক জেলা শহরে অনেক ভিক্ষুক দেখা যায়। যাঁদের সংসার চলে ভিক্ষায়, তাঁদেরই আমরা ভিক্ষুক বলে থাকি। এঁদের মধ্যে শহরে থাকা ভিক্ষুকদের ভিক্ষা বা খয়রাত করার স্টাইল একরকম, আর গ্রামগঞ্জের ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করার সিস্টেম ভিন্নরকম। শহরে ভিক্ষা করা অনেক ভিক্ষুক নিজস্ব পদ্ধতিতে বানানো বিশেষ ধরনের তিনচাকা বিশিষ্ট গাড়ি চড়ে ভিক্ষা করে। কেউ কেউ আবার পাঁচ-সাতজন মিলে দলবেঁধে নির্দিষ্ট এক জায়গায় বসে গানের সুর তুলে ভিক্ষা করে। দলীয় ভিক্ষুকদের গানের সুর হলো–
‘আমার আল্লা রসূলের নাম
দিলে পরে সার,
আমার আল্লা রসূলের নাম।
কত টেকা কত পইসা হারাইয়া যে যা-য়-য়-য়,
অসহায়রে দান করিলে আখেরাতে পা-য়-য়।
আমার আল্লা রসূলের নাম।’

এমন আরও অনেকরকমের গানের সুর তুলে শহরের দলীয় ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করে থাকে। কেউ কেউ চিৎপটাং হয়ে শুয়ে শুয়ে আল্লা আল্লা করতে থাকে। আবার কোনও কোনও ভিক্ষুকরা তিন-চারজন একসাথে লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে আল্লা রসূলের নামে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। কেউ কেউ আবার দলবল না করে একা একাই প্রতিদিন পায়ে হেঁটে ভিক্ষা করে। এঁদের মধ্য আছে কিছু মহিলা ভিক্ষুক। এঁরা প্রতি শুক্রবার সকাল হতে-না-হতে ঘর থেকে বের হয়। এঁরা প্রত্যেক দোকানে, আর হাঁটাচলার মাঝে মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চায়। এসব মহিলা ভিক্ষুকরা এখন বাসাবাড়িতে বেশি যায় না। গেলেও, বাসাবাড়ির গৃহিণীদের দেওয়া চালডাল আগের মতো নিতে চায় না। এঁরা এখন চায় নগদনারায়ণ টাকা। যে যা-ই দিক, তা-ই নিবে, কিন্তু তাঁরা চালডালের বোঝা বইতে নারাজ।

আর গ্রামের ভিক্ষুকরা কষ্ট করে পায়ে হেঁটে গ্রামের বাড়ি বাড়ি আর হাট বাজারে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে। এসব গ্রাম্য ভিক্ষুকরা মানুষের কাছে হাত পাতার আগে বলে থাকে–
‘ভিক্ষা দেন গো মা লক্ষ্মীরা,
খারা কইরা রাইখেন না।’
তখন যে যা দেয়, তা-ই তাঁরা নিয়ে নেয়। তাঁদের কোনও আপত্তি থাকে না, নামমাত্র ভিক্ষা পেলেই মহাখুশি!

সেসব গ্রাম্য ভিক্ষুকদের মধ্যে আনোয়ার নামের একজন গ্রাম্য অন্ধ ভিক্ষুক ছিল। ভিক্ষুক আনোয়ার জন্ম থেকেই ছিলো অন্ধ। ভিক্ষুক আনোয়ার যখন রাস্তায় বের হয়, তখন তাঁর হাতে একটা লাঠি থাকে। তাঁর হাতে থাকা লাঠিটা জাতিসংঘ থেকে দেওয়া বিশেষ ধরনের এক লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে আনোয়ার গ্রামের হাটবাজার-সহ বাড়িতে বাড়িতে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করে। ভিক্ষুক আনোয়ার যখন ঠুক ঠুক করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তখন ভিক্ষুক আনোয়ার আল্লাহ রাসূলের নাম ধরে সুর তোলে–
‘হায় আল্লা তুই ছোবাহান
হায়াতের মালিক।
হায় আল্লা তুই ছোবাহান
হায়াতের মালিক।’

ভিক্ষুক আনোয়ার’র মুখে সেই মধুর সুর শুনে মানুষ তাঁর হাতে টাকা দেয়, পয়সা দেয়। কেউ কেউ রুটি কলা খাবারও কিনে দেয়। একদিন আনোয়ার বাড়ি থেকে ভিক্ষা করতে বের হলো। সকাল থেকে ভিক্ষা করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া ভিক্ষা করার মাঝে পরের বাড়িতেই হয়। দুপুরের পর বিকাল হতে লাগলো। এখন তো ভিক্ষুক আনোয়ার’র বাড়ি ফেরার পালা। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার বাড়ি আসার পথ ধরে ঠুক ঠুক করে হেঁটে আসছিল–
‘হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক” বলতে বলতে।’

যেই রাস্তা দিয়ে ভিক্ষুক আনোয়ার হেঁটে যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দুইপাশে গাছ-গাছালি, একটু পরপর খাল-বিল, ডোবা-নালা। রাস্তার পাশে যা-ই থাকুক, রাস্তা কিন্তু ভিক্ষুক আনোয়ার’র খুবই পরিচিত ছিল। কারণ, এই রাস্তা দিয়েই সবসময় ভিক্ষুক আনোয়ার হাঁটা-চলা করে থাকে, তাই রাস্তাটি তাঁর চেনা-জানা। ভিক্ষুক আনোয়ার হেঁটে যাচ্ছে নিজের মতে। সেই রাস্তা দিয়েই পাশের গ্রামের এক অন্ধ ভিক্ষুক বিপরীত দিক দিয়ে হেঁটে আসছে। সেও সারাদিন ভিক্ষা করে তাঁর বাড়ি ফিরছিলো।

পাশের গ্রামের ভিক্ষুক ভিক্ষা করার সময় আল্লাহ রাসূলের নামে মুখে কোনও সুর তোলে না। এই ভিক্ষুক শুধু জিকিরের সুরে বলতে থাকে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’
এছাড়া আর কিছুই সে বলতো না। এতেই মানুষ বুঝে নিতো অন্ধ ভিক্ষুকটা ভিক্ষা করতে এসেছে। তারপর কেউ ভিক্ষা দিতো, কেউ মাপ চেয়ে নিতো। এখন এই দুইজন অন্ধ ভিক্ষুক যার যার ভাবে একই রাস্তা দিয়ে দুইদিক থেকে হেঁটে আসছে। পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’
এই বলতে বলতে ভিক্ষুক তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসছে, ভিক্ষুক আনোয়ার’র দিকে।

ভিক্ষুক আনোয়ার বাঁশ আনি বাঁশ আনি শুনে মনে করলো কেউ হয়তো লম্বা বাঁশ কাঁধে করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। এই ভেবে ভিক্ষুক আনোয়ার আস্তে আস্তে রাস্তার কিনারে চাপতে লাগলো। যাতে বাঁশের খোঁচা-খাঁচি শরীরে না লাগে। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার রাস্তার কিনারে চাপতেই থাকলো, চাপতেই থাকলো। আর পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও জিকিরের সুরে বলতে লাগলো–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’

ভিক্ষুক আনোয়ার এবার চিন্তা করতে লাগলো, শালার বাঁশ মনে হয় লম্বালম্বি করে না এনে আড়াআড়িভাবে নিয়ে আসছে। তাই হয়তো জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে, বাঁশ আনি, বাঁশ আনি। এই ভেবে ভিক্ষুক আনোয়ার তাঁর গায়ে বাঁশ লাগার ভয়ে তাড়াতাড়ি রাস্তার ঢালে নামতে শুরু করলো। নামতে নামতে একেবারে খালের পানিতে গিয়ে নামলো। তারপরও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।’

এভাবে ভিক্ষুক আনোয়ার পাশের গ্রামের ভিক্ষুককে সাইট দিতে দিতে যখন খালের মাঝামাঝি গেল, তখনও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও আমি ভাসানী।’

এবার অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার ভীষণ ক্ষেপে গেল! রেগেও গেল! আনোয়ার রেগে-মেগে বললো–
‘আরে মিয়া আম্নের কান্দের বাঁশখান কত লম্বা হে? আমি হালায় অন্ধ মানুষ। চোক্ষে দেখি না। শল্লের মাধ্যে বাঁশের খোঁচ-খাঁচি লাগবো দেইখ্যা, রাস্তা তুনে নাইমতে নাইমতে খালের মধ্যখানে যাইয়া খারাইয়া রইছি। হের পরেও কইতাছেন দেইখেনও ভাই বাঁশ আনি, দেইখেনও ভাই বাঁশ আনি? আমি কি অখনে খাল হাতরাইয়া হেপাড় যাইয়া বইয়া থাকুম?’

আনোয়ার’র মুখে বাঁশের কথা শুনে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও বাঁশের ভয়ে কাঁপছে! শালার বাঁশ! কোনদিক দিয়ে যে আশছে! আবার শরীরে বাঁশ লাগে কিনা, সেই ভয়ে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও রাস্তার কিনারে চাপতে লাগলো। কাঁপতে কাঁপতে আর চাপতে চাপতে আনোয়ার’র সামনা-সামনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলো–
‘দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।
দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।’
এভাবে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও শরীরে বাঁশ লাগার ভয়ে ভিক্ষুক আনোয়ার’র কাছাকাছি চলে গেলো। এবার খালের মাঝখান থেকে ভিক্ষুক আনোয়ার বলছে–
‘আরে ভাই আপ্নের বাঁশ নেওয়া অইছেনি ও?’
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
‘দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।’
ভিক্ষুক আনোয়ার এবার আরও ভয় পেয়ে গেল! কারণ, বাঁশ আনি বাঁশ আনি কথাটা খুবই সামনা-সামনি শোনা যাচ্ছে। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার খালের আরও গভীরে যেতে যেতে বললো–
‘হালার আজগা যে কোন অলক্ষ্মীর মুখ দেইখা ঘরের তুন বাইর অইছি, কইতে পাইল্লাম না। আইজগা কি আল্লা আমারে বাঁশেই পাইছে? এই হালার বাঁশ কতক্ষণে যাইবো রে, মাবুদ?’
ভিক্ষুক আনোয়ার’র এই কথা পাশের গ্রামের ভিক্ষুক শুনে বললো–
‘ভাই, মনে অইতাছে আরও অনেক সময় লাগবো।’ ভিক্ষুক আনোয়ার বললো–
‘ভাই তাড়াতাড়ি আম্নেগো বাঁশ সরান। আমারে বাইত যাইতে দেন। রাইত অইয়া গেলে ক্যামনে যামু গো ভাই!’

এবার পাশের গ্রামের ভিক্ষুক এখন আনোয়ার’র সামানা-সামনি এসে জিজ্ঞেস করলো–
‘ভাইসাব বাঁশ আনতাছে কেডা ও? আপ্নে কি তাগো চিনেন? এই রাস্তা দিয়াই কি বাঁশ আনতাছে? নাকি নৌকা কইরা খাল দিয়া বাঁশ নিতাছে?’
ভিক্ষুক আনোয়ার’ রেগে-মেগে বললো–
‘ও-ই মিয়া, এতক্ষণ বাঁশ আনি বাঁশ আনি কইরা চিল্লাইছে কেডা ও?’
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক নরম সুরে বললো–
‘আমিই ত ভাসানী ভাসানী কইয়া আইতাছিলাম। তয় ভাই সাব, আমার লগে ত কোনও বাঁশ টাস নাই। আম্নে বাঁশের ডরে খালে নাইম্মা রইছেন কিল্লাইগা?’
ভিক্ষুক আনোয়ার বললো–
‘আরে মিয়া আম্নে না কইলেই বাঁশ আনি বাঁশ আনি? ইল্লাইগা আমি হালায় আম্নেরে সাইড দেওনের লাইগা রাস্তার তুনে নাইমতে নাইমতে খালের মধ্যে যাইয়া খারাইয়া রইছি। এহনে কইতাছেন আম্নের গলে বাঁশ টাস নাই। ফাইজলামি করনের আর জাগা পান না মিয়া? আমি অন্ধ দেইখা আমার লগে ইয়ার্কি করেন? আল্লায় বিচার করবো মিয়া। আল্লায় বিচার করবো। এক দিনকা আম্নেও কানা অইবেন, কইয়া দিলাম।’
ভিক্ষুক আনোয়ার’র কথা শেষ হতে-না-হতে পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বললো–
‘আরে ভাইসাব আমি এমনেই জনমের কানা। ইল্লাইগা হারাদিন ভইরা ঘুইরা ঘাইরা খাই। বাঁশ টাস পামু কই? আমিতো বাঁশের কথা কিচ্ছু কই নাইক্কা। আম্নে হুদাহুদি কিল্লাইগা খালে যাইয়া নাইমছেন? আম্নের মুহে বাঁশের কথা হুইন্না আমিও হালায় খালের কিনারে আইয়া খারাইছি।’

এবার ভিক্ষুক আনোয়ার ভিজা কাপড়ে খাল থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে আর বলছে–
‘ও-ই মিয়া আম্নে কই? হাতের লাডি দিয়া আম্নেরে লাগুর পামু নি? কই আম্নে, কই?’
এই বলেই ভিক্ষুক আনোয়ার হাতে থাকা জাতিসংঘের লাঠি এদিক সেদিক ঘোরাচ্ছে।
আর বলছে, ‘আম্নেরে আগে দুইখান বাড়ি মাইরা লই। হালা মিত্থুক! এতক্ষণ বাঁশ আনি বাঁশ আনি কইরা চিল্লান নাই? আমি চোক্ষে দেখি না দেইখা কী অইছে? কানেও কি আর কম হুনি?’

পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বললো–
‘আরে ভাই আম্নে এতো চেত্তাছেন কে হুনি? এনো চেতনের কী অইলো? চেইতেন না ভাইসাব, চেইতেন না! আমার নামই ত ভাসানী। আমিও আম্নের মতন অন্ধ ভাইসাব। অন্ধ দেইখা রাস্তায় আঁডাচলার মাধ্যে এই কথা কইয়াই চলি। যাতে মাইনষে বুঝবার পারে আমি ভাসানী আইতাছি।’

এবার অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার নিজের কপালে নিজে থাপ্পড় মারতে মারতে বলতে লাগলো–
‘হায়রে কয়াল আমার! যেই বাঁশের ডরে নাইমতে নাইমতে খালে যাইয়া নামছি। হেই বাঁশ অইছে ভাসানী। আবার এই হালাও নাকি আমার মতো কানা। হালার নামও নাকি ভাসানী। অন সেনা বুঝলাম বাঁশ টাশ কিছুই না, আসলে এই হালার নাম ভাসানী। আর আমি হালায় কোন আহাম্মকের আহাম্মক! হালার বাঁশ আনি বাঁশ আনি হুইন্না বাঁশের ডরে নামছি খালে।’ এইডা কি একটা কাম অইলো? হালার দুই কানার কারবার!’ এই কারবার মাইনষে হুনলে কি কইবো?’ এই বলেই অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার ‘হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক, হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক।’
বলতে বলতে বাড়ি রওনা হলেন। পাশের গ্রামের অন্ধ ভিক্ষুকও বাড়ি রওনা হলেন।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।

হিরা উজির সাহেবকে সাথে নিয়ে রাজবাড়ীর গেইটের বাইর হলো। তাঁদের সাথে নেওয়া হলো সদাই রাখার জন্য একটা বড়সড় টুকরিও। হিরা উজির সাহেবকে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি আমার আগে আগে হাঁটুন, আমি আপনার পিছনে পিছনে হাঁটি। বাজারে টুকরিটাও আমার সাথে থাকুক। আপনি বুড়ো মানুষ। কষ্ট করার দরকার কী! আপনি শুধু আমাকে আপনাদের এখানকার ধারে কাছে একটা বাজারে নিয়ে চলুন!’ হিরা’র কথা শুনে রাজার উজির খুবই খুশি হলেন। আবার বেজারও হলেন। বেজার হয় তখন, যখন থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে তখন। সেই থাপ্পড়ের কথা মনে পড়লেই, উজিরের আর ভালো লাগে না। তবুও রাজার হুকুম বলে কথা। তাই আর রাগ থাকতেও রাগ করতে পারছে না, হিরা’র কথা মতোই চলতে হচ্ছে।

এদিকে রাজদরবারে বসে কোতোয়াল সাহেব রাজাকে বললো, ‘হুজুর, চেনা নেই জানা নেই, অচেনা অজানা একটা ছেলের হাতে তিনটি পয়সা দিয়ে দিলেন! কাজটা কি ঠিক হলো?’ রাজা হেসে বললো, ‘এই ছেলে মাত্র তিন পয়সার পাগল নয় বলে আমার বিশ্বাস। এই কারণেই এমন কঠিন সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলেছি। আমি জানি এই সদাই তিনটি ছেলেটা কিছুতেই আনতে পারবে না। যদি সদাই তিনটি না আনতে পারে, তাহলে আমার করণীয় কাজ করে ফেলবো। চলে বলে কলে কৌশলে, যেভাবেই হোক, আমি ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে গোলামের মতো করে রেখে দিবো।’ কোতোয়াল জানতে চাইলেন, ‘আর যদি ছেলেটা সদাই তিনটি কিনে এনে দিতে পারে, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘আমি জানি ছেলেটা তা পারবে না। আর যদি আনতেই পারে, তাহলেও তা হবে না। আমি যা-ই বলবো, তাইতো হবে।’ এই বলেই রাজা দরবারে থাকা দেয়াল ঘড়ির দিকে রাজা তাকালেন। তখন সময় বিকাল চারটার কাছাকাছি বাজতে লাগলো। রাজা ভাবছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উজির-সহ ছেলেটা বাজার থেকে ফিরে আসছে। রাজা সেই অপেক্ষাতেই বসে থাকলেন।

উজির-সহ হিরা যেই বাজারে যাবে, সেই বাজারের নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। এই বাজারে গ্রামের বউঝিরা কেনাবেচা বেশি করে থাকে বলে, বাজারটার নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। উজির আগে হিরা উজিরের পিছনে পিছনে। বাজারে ঢুকতেই একজন জিলাপি বিক্রেতা জিলাপি ভেজে ডালার উপর সাজিয়ে রেখেছে। হিরা তা দেখে উজিরকে ডাক দিল, ‘উজির সাহেব, উজির সাহেব।’ উজির পিছন ফিরে দেখলো ছেলেটা ডাকছে। উজির হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘কী ব্যাপার! ডাক দিলে কেন?’ হিরা উজিরকে বললো, উজির সাহেব, অনেকদিন ধরে গরম গরম জিলাপি খাই না। আজ হাতের কাছে যখন পেয়েছি পোয়া খানিক জিলাপি দুইজনে মিলেমিশে খেয়ে নিই। কি বলেন উজির সাহেব?’

উজির হিরা’র কথা শুনে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘শালার পো, তোমাকে রাজা তিন পয়সা দিয়েছে তিনটি সদাই করার জন্য। সেই পয়সা থেকে তুমি জিলাপি কিনে খেতে চাইছ। আবার আমাকেও খাওয়াতে চাচ্ছো। তাহলে সদাই নিবে কী করে?’ এই বলেই উজির হিরা’কে বললো, ‘না রে বাবা রে, আমার পেট ভালো না। আমি জিলাপি টিলাপি খাবো না। খেতে মন চাইলে তুমিই খাও!’ হিরা বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে উজির সাহেব, আমিই খাবো। তো আপনি দামদর করে কিনে দিন। আপনাদের এখানকার বাজারের ভাবসাব তো আমি বুঝবো না। এঁরা আমার কাছ থেকে দাম বেশি নিবে।’

হিরা’র কথামতো উজির জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেটা জিলাপি কি গরম না ঠান্ডা রে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আরে হুজুর, এখন ভাজলাম এখন। একেবারে টাটকা জিলাপি।’ উজির বললো, ‘তাহলে ঠিক আছে। তো কত করে সের বিক্রি করছো হে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আজ্ঞে হুজুর, মাত্র চার পয়সা সের।’ উজির সাহেব বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। একপোয়া জিলাপি দাও তাড়াতাড়ি করে।’ জিলাপি বিক্রেতা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে একপোয়া জিলাপি মেপে উজিরের হাতে দিলো। উজির সেই জিলাপি হিরা’র হাতে দিয়ে বললো, ‘দে বাবা এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দে।’ হিরা তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে এক পয়সা বের করে জিলাপি বিক্রেতার হাতে দিয়ে সামনে এগুতে থাকলো। হিরা হাঁটছে আর মনের আনন্দে জিলাপি খাচ্ছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বাজার দেখছে। দোকানপাট দেখছে। আর জিলাপি খাচ্ছে, হাঁটছে।

এমন সময় এক ভিখারি হিরা’র সামনে এসে হাত পেতে বসলো। হিরা গরিবের সন্তান হলেও মানুষের প্রতি হিরা’র খুব মায়া। মানুষের কষ্ট হিরা সহজে সইতে পারে না। তাই যখন ভিখারি হিরা’র কাছে ভিক্ষা চাইল, তখন হিরা সাথে সাথে ও-ই ভিখারিকে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলো।

হিরা’র এইরকম দরদী কারবার দেখে, উজির সাহেব মনে মনে বলছে, ‘ছাইরা দে মা কাইন্দা বাঁচি। হায়! হায়! করছে কি! রাজা দিলো সদাই কেনার জন্য। আর ও করছে দান খয়রাত! জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। বাঃ দারুণ তো! দেখি, আর আছে এক পয়সা। এই এক পয়সা দিয়ে ছেলেটা কী করে, তা দেখেই দিবো এক দৌড়।’

ফকিরকে এক পয়সা দিয়ে হিরা উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, মানুষের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তাই ফকিরটা যখন ভিক্ষা চাইলো, তখন এক পয়সা ফকিরটাকে দিয়ে দিলাম। এর জন্য আল্লার দরবারে একটু হলে ছোয়াব জমা রেখে গেলাম। কি বলেন উজির সাহেব?’ উজির বললো, ‘ভালো করেছিস বাবা। একেবারে বুদ্ধিমানের কাজ। তো রাজার সদাই কিনতে হবে না? এভাবে ঘুরলে কি হবে? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সন্ধ্যা যে হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে হবে।’

হিরা বললো, ‘উজির সাহেব, রাজা হুজুর যেই সদাই তিনটা কিনতে বলেছে, তাতো আপনাদের এই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো ঘুরে ঘুরে সদাই খুঁজে বেড়াচ্ছি। দেখি সামনে পাওয়া যায় কি-না?’ এই বলেই হিরা সামনে এগুতে লাগলো। হিরা’র পিছনে উজির বোকার মতো হাঁটছে আর ভাবছে। ‘হায়রে রাজা, কাকে দিলি পয়সা! এই ছেলেটা কি আর রাজবাড়ি ফিরে যাবে? মনে হয় না! রাজার এক গৃহস্থের এক বছরের খাজনা মাইর!’ উজির ভাবলেন।

একটু সামনে যেতেই হিরা দেখলো মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাজনার শব্দে পুরো বাজার মুখরিত হয়ে উঠছে। হিরা ভাবলো হয়তো সাপুড়িয়ারা সাপের খেলা দেখাচ্ছে। এই ভেবে হিরা গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষজন ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকলো। উজির টুকরি হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, ‘কার সাথে যে বাজারে আসলাম রে আল্লাহ! এ দেখি বড় বাটপার। রাজার কাছ থেকে বাটপারি করে তিন পয়সা এনে কি না করতেছে। পরের পয়সা খরচ করতে তো আর গা জ্বলে না। তাই জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। এখন আবার রূপবান গান দেখার জন্য গোলচক্করে ঢুকছে। দেখি কী করে!’

এই বলেই উজির সাহেবও ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে রূপবান গান গেয়ে এক হিজরা ড্যান্স দিচ্ছে। ড্যান্সের তালে তালে হিরাও নাচতে দিতে শুরু করলো। ড্যান্স শেষ হলে উপস্থিত সবাই এক পয়সা দুই পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিতে লাগলো। হিরাও ড্যান্সার হিজরাকে এক পয়সা বকশিস দিয়ে দিলো। উজির সাহেব তা দেখে বললো, ‘খাইছে রে আমারে।’ খাইছে খাইছে বলতে বলতেই হাতের টুকরি ওখানেই রেখে সোজা এক দৌঁড় রাজবাড়ির দিকে। হিরা এখন উজিরকে খুঁজছে। উজির সাহেব নেই। কোথাও নেই। অথচ টুকরি পড়ে আছে, উজির নেই। হিরা বুঝতে পেরেছে উজির সাহেব ভয় পেয়েছে। তাই আগেভাগে উনি রাজদরবারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। হিরাও বাজার থেকে আস্তে ধীরে হেলেদুলে রাজবাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলো।

উজির সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে রাজবাড়ির গেইটের সামনে গেলো। গেইটে টোকা দিলো। প্রহরী গেইট খুলে দিলো। উজির সাহেব ভেতরে ঢুকলো। গেইটে থাকা প্রহরী উজির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব ছেলেটা কোথায়?’ আপনারা গেলেন দুইজন মিলে, অথচ আপনি আসলে একা!’ উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘দূর! বাটপার, বাটপার! রাজার মাথা খারাপ হয়েছে রে, রাজার মাথা খারাপ হইছে। কারে দিয়েছে তিন পয়সা রে।’ প্রহরী আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আসল ঘটনাটা কী?’ উজির বললো, ‘আরে বেটা, রাজার পয়সা দিয়ে জিলাপি খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। এসব কি একটা কাজ? যাচ্ছি রাজার কাছে। ঈশ! আমার থাপ্পড়ের বিচারটা পেলাম না রে!’

এই বলেই উজির রাজদরবারের দিকে রওনা হলো। বাইরে থেকে গেইটে টোকা লাগলো। প্রহরী গেইট খুলেই দেখে হিরা’কে। প্রহরী হা করে হিরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ব্যাপার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন যে?’ প্রহরী বললো, ‘না, মানে উজির সাহেব বললো তুমি আর আসবে না। তাই অবাক হলাম!’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব কোথায়?’ প্রহরী বললো, ‘এইতো এইমাত্র রাজদরবারের দিকে চলে গেলো। তুমি নাকি জিলাপি খাও, ফকিরকে ভিক্ষা দাও, রূপবান গান শুনো?’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘এসব আপনার কাছে কে বলেছে?’ প্রহরী বললো, ‘কেন, উজির সাহেবই বলেছে! নাহয় আমি শুনবো কোত্থেকে?’ হিরা বললো, ‘উনি ঠিকই বলেছে।’ প্রহরী বললো, ‘তো রাজা যে তিন পয়সা দিলো সদাই আনতে, সদাই কোথায়?’ হিরা বললো, ‘তিন পয়সা দিয়ে কি আর সদাই আনা যায়? বাজারে জিনিসপত্রের যেই দাম! তবুও কিছু সদাই কিনেছিলাম। উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে।’ হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব

চলবে…

স্বাধীনতা তুমি বন্দী বাহুবলে!

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের আবিস্কারে
ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণে,
তুমি ভোরের উদিত রক্তিম সূর্যের আলোর ঝংকারে
মা-বোনের সম্ভ্রমের অবদানে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় গাওয়া
আমাদের জাতীয় সংগীতে,
তুমি পদ্মা মেঘনা সুরমা যমুনার স্রোতে বয়ে যাওয়া
নজরুলের রণসংগীতে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি এসেছ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ চেষ্টার বিনিময়ে
জাগ্রত বিজয় দিবসে,
তুমি এসেছিলে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে
নয়মাস যুদ্ধ শেষে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি এখন রাজনীতির জাঁতাকলে ছাত্রলীগ ছাত্রদলে
দলেবলে গণতন্ত্রের কৌশলে,
তুমি এখন ক্ষমতার ছত্রছায়ায় নেতা নেত্রীদের দখলে
স্বাধীনতা বন্দী বাহুবলে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি শুধু কাগজে কলমে ইতিহাস হয়ে আছ সারাবিশ্বে
আর জাতীয় স্মৃতিসৌধে,
তুমি পৌঁছাওনি প্রতিটি ঘরে জনগণের মনের বিশ্বাসে
তাই সকলে কাঁদে।

স্বাধীনতা তুমি!
তুমি নেই স্বাধীনভাবে মুক্তভাবে মুক্তমনে মতপ্রকাশে
অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে,
তুমি এখনো দাওনি কাউকে স্বাধীনতা ভোগ-বিলাসে
বন্দী তুমি রাজপ্রাসাদে।

ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশ:
রাজার কথা শুনে বুড়ো উজির সাহেব খুবই খুশি হলেন। রাজদরবারে থাকা সবাই হাততালি দিলেন। হিরা চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলো, সাজা থেকে কীভাবে বাঁচা যায়!

কী সাজা হতে পারে এমন চিন্তা নিয়ে হিরা বসে বসে ভাবছে! দরবারে উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে রাজার দিকে, কখন সাজার ঘোষণা দিবে। এমন সময় হিরা বসা থেকে উঠে হাত জোর করে রাজাকে বললো, ‘হুজুর, আপনার দরবারে আমি ছোট্ট একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, যদি দয়া করে আপনি অনুমতি দেন।’ হিরা’র কথা শুনে রাজা বললেন, ‘কী এমন প্রশ্ন করবে? করো শুনি!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার প্রশ্ন হলো আপনার রাজদরবার-সহ রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব আইনকানুনগুলো বলবত আছে, এসব আইনকানুন বা নিয়মকানুনগুলো কে তৈরি করেছিল? এগুলো কি আপনি নিজেই তৈরি করেছিলেন? নাকি আপনার রাজদরবারে থাকা অন্য কেউ তৈরি করেছিল?’ হিরা’র করা প্রশ্নে রাজা থমকে গেল! আবার ভাবতেও লাগলো! রাজা মনে মনে বললো, ‘সাংঘাতিক তো!’

রাজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আমি শুধু হুকুমের মালিক, হুকুম দিয়ে থাকি। রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব আইনকানুন আছে সেসব আইনকানুন প্রণয়ন করেছিল আমার উজির, নাজির, কোতোয়াল-সহ রাজ্যে থাকা বড়বড় পণ্ডিতগণ। আমি শুধু অনুমোদন দিয়েছি। তো হঠাৎ তোমার এমন প্রশ্ন কেন?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার রাজ্যে যেসব নিয়মকানুন চালু আছে, সেসব নিয়মকানুনগুলোর মধ্যে আপনার রাজবাড়ীর গেইট খোলার নিয়মটা মানুষ ভোগান্তির নিয়ম। তা কি আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন?’ রাজা বললো, ‘কেমন ভোগান্তি?’ হিরা বললো, ‘আপনি আমার রাজা। আমি আপনার মুল্লুকের একজন। প্রতিবছর আপনাকে আমি খাজনা দিয়ে আসছি। না দিলে আপনি আমার বাড়িতে সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেন খাজনা আদায়ের জন্য। অথচ আমার কোনও সমস্যায় আমি আপনার সাথে দেখা করতে হলে আপনার রাজবাড়ির গেইটে খেয়ে-না-খেয়ে দুইতিন দিন বসে থাকতে হয়। জনসাধারণের জন্য এরকম ভোগান্তি নিয়ম হবে কেন? আমারা কি মানুষ না? আমরা কি বন্য জানোয়ার? আপনার কাছে গরিব মানুষের কোন মূল্যায়ন নেই? দয়া করে প্রশ্নের উত্তর দিন, রাজা হুজুর!’

হিরা’র কথা শুনে উজিরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। নাজির-সহ কোতোয়াল সাহেবের অবস্থাও খারাপ। আর রাজা তো একেবারে চুপ হয়ে বসে রইলেন রাজ সিংহাসনে। রাজাকে চুপ দেখে হিরা আবার বলতে শুরু করলো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাদের মুল্লুকের রাজা। সমস্ত প্রজাদের অভিভাবকও। প্রজাদের কোনও আপদ-বিপদে আপনার কাছে আসবে। আপনাকে তাঁদের সমস্যা জানাবে। তখন যদি আপনার বাড়ির এই বিশাল গেইটখানা বন্ধ থাকে, আর যদি দুইতিন দিন অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে কেমন হয়? প্রজারা কার কাছে গিয়ে তাঁদের সমস্যা জানাবে? আর আপনার বাড়ির গেইট দুইদিন পরপর খোলা হয় কেন? জনসাধারণের জন্য প্রতিদিন আপনার বাড়ির গেইট খোলা থাকলে আপনার সমস্যাটা কী?

‘আজ যদি আপনার এই মানুষ ভোগান্তি নিয়ম বহাল না থাকতো, তাহলে আজ আর এই ঘটনার সূত্রপাত হতো না। আমাকেও আপনার বাড়ির গেইটে দুইদিন বসে থাকতে হতো না। আপনার উজির সাহেবও আমার থাপ্পড়ের কবলে পড়তো না। তাই আজকের এই ঘটনার জন্য তাঁরাই দায়ী, যাঁরা এই নিয়মটা করেছে। আমি সরাসরি তাঁদেরকেই দায়ী করছি, হুজুর। যদি আপনি করে থাকেন, তাহলে আপনিই দায়ী থাকছেন। এখানে আমার কোন দোষ নেই বলেই আমি মনে করি। এরপরও যদি আমাকে সাজা ভোগ করতে হয়, তাহলে আমি মনে করবো বিনা দোষে আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই দয়া করে এই বিষয়টি আপনাকে একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি, হুজুর।’

হিরা’র কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করে দিল। উজির সাহেব চুপচাপ এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো। রাজা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সবাইকে শান্তভাবে বসতে বললো। সবাই চুপ করে বসে রইলেন। রাজা হিরা’কে কাছে ডাকলেন। হিরা রাজার সিংহাসনের সামনে গেলে, রাজা হিরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। আজ তুমি আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছ। আজকের এই ঘটনার জন্য আমিই দায়ী থাকলাম। যদিও আমি এই নিয়মগুলো করিনি, তবুও। কারণ, আমি কেন রাজ্যের রাজা হয়ে এসব নিয়মকানুনগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখলাম না। আর কেন-ই-বা উজির নাজির কোতোয়াল-এর উপর বিশ্বাস করে রাজদরবারে বসে থাকলাম। দোষ তো আমারই!

‘আমি ঘোষণা দিচ্ছি, আজ থেকে আমার বাড়ির গেইট কোনও দিন রাত বারোটার আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে না। দেশের মানুষের জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে। আসলে এসব তো আমি কখনো খেয়াল করিনি। আমি যখন বাড়ির বাইরে কোথাও যাই, তখন গেইট খুলে। বাড়ি আসলে গেইট বন্ধ হয়। আমি থাকি অন্দরমহলের ভেতরে। অন্দরমহল থেকে বাড়ির প্রধান গেইট অনেক দূরে থাকার কারণে এসব আর আমার চোখে পড়ে না। এসব ব্যাপারে তুমি ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত আমার কাছে নালিশও দেয়নি। তাই আজকের এই ঘটনার জন্য প্রথমত আমি আমার উজিরকেই আমি সরাসরি দায়ী করছি। সেই সাথে আজকের এই ঘটনার জন্য তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করছি। আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি যা করেছ জেদের মাথাই করেছ। তুমি নির্দোষ।’

রাজার ঘোষণা শুনে উজির মনে করছে আজ বুঝি আমার চাকরি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, তা আর হিরা হতে দেয়নি। হিরা এর আগেই উজিরের সামনে গিয়ে হাতে ধরে বললো, ‘উজির সাহেব, আপনি আমার পিতৃতুল্য। আমি আপনার সাথে সত্যি খারাপ ব্যবহার করেছি। আপনি আমাকে আপনার ছেলে মনে করে ক্ষমা করে দিন।’

হিরা’র এমন ব্যবহারে রাজা খুবই খুশিও হলেন, অবাকও হলেন। ভাবলেন, ছেলেটার তো উপস্থিত বুদ্ধি আছে। সাজা মওকুফের কথা শুনেও নিজের ভুল স্বীকার করে উজিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। চমৎকার বুদ্ধি। এই ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে সবসময়ের জন্য দরকার। এই ভেবে রাজা হাসতে হাসতে উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, আর কী করা! ছেলেটা নিজের ভুল যখন নিজেই স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে, আপনি নিজের ছেলে মনে করে ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিন।’ উজির রাজার কথা আর অমান্য না করে হিরা’কে ক্ষমা করে দিয়ে হিরা’র সাথে বুকে বুক মিলিয়ে নিলেন। তারপর হিরা রাজা-সহ রাজদরবারে উপস্থিত থাকা সকলকে সালাম জানিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেন। কিন্তু রাজা তখন হিরা’কে যেতে দিলেন না। রাজা হিরা’কে বললেন, ‘আমাকে তোমার একটা কাজ করে দিতে হবে। হিরা জানতে চাইলেন, ‘কাজটা কী হুজুর?’

রাজা বললো, ‘কাজটা তেমন কিছুই না। তবে আবার ফেলনাও না। কাজটা হলো বাজার থেকে তিন পয়সা দিয়ে তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে হবে।’ হিরা জানতে চাইল সদাই তিনটি কী কী?’ রাজা বললো, ‘সদাই তিনটি হলো, “এক পয়সার এখন, এক পয়সার তখন, এক পয়সার এখনো না তখনো না।” আমি জানি তুমি এই তিনটি সদাই কিনে আনতে পারবে।’ হিরা তখন অভিনয় করে দাঁড়ানো থেকে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার? তুমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লে কেন?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, যে তিনটি সদাই’র নাম আপনি বলেছেন, এই সদাই তিনটি বাজারে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এই সদাই তিনটি যেমন মূল্যবান, তেমন আবার খুবই ভারী।’

রাজা বললো, ‘তা যা-ই থাক, আর যেভাবেই হোক সদাই তিনটি আমার দরকার! যদি এই তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে পার, তাহলে তোমাকে আমি উপযুক্ত বকশিস দিবো।’ হিরা প্রশ্ন করলো, ‘কী বকশিস দিবেন, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘যদি চাও, আমার রাজ্যের অর্ধেক তোমার নামে লিখে দিবো। এ-তে-ও যদি না হয়, তাহলে তুমি যা চাও, তা-ই আমি দিতে রাজি আছি। এসবকিছুর বিনিময়েও আমার আকাঙ্ক্ষা এই তিনটি সদাই চাই চাই। তা কি তুমি পারবে?’ রাজার কথা শেষে হিরা বললো, ‘হুজুর পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কাজ বলতে কিছুই যদি না থাকে, তাহলে আমি এই সামান্য কাজটুকু করতে পারবো না কেন? আমিও পারবো, হুজুর। তবে এখানে আমার কিছু কথা আছে। কথা হলো, প্রতিদিন আপনার সাংসারিক বাজার-সদাই কে করে? যিনি করে, তাকেই আগে এই সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলুন। যদি সে না পারে তাহলে আমি কিনে এনে দিবো, কথা দিচ্ছি!’

হিরা’র কথা শুনে রাজা ভেবে দেখলেন, এ-তো ভালো কথা! আমার বাজার সদাই তো আমার উজির সাহেবই করে। তাকেই আগে জিজ্ঞেস করা দরকার। এই ভেবে রাজা উজিরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব, আপনি কি তিন পয়সা দিয়ে বাজার থেকে হোক আর যেখান থেকেই হোক, এই তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে পারবেন?’ উজির সাহেব বললেন, ‘রাজা হুজুর, এই তিনটি সদাই’র নাম আমার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিও কোনদিন শুনেনি। আমিও শুনিনি হুজুর। মাফ করবেন হুজুর, আমি এটা পারবো না।’ রাজা তখন হিরা’কে বললেন, ‘আমার উজির তা পারবে না। এই কাজ তোমাকেই করতে হবে।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে হুজুর, আমিই বাজার থেকে তিন পয়সা দিয়ে আপনাকে তিনটি সদাই কিনে এনে দিবো।’ হিরা’র কথা শুনে রাজা খুবই খুশি হলেন। হিরা’কে রাজ অতিথির মতো সমাদর করে খাওয়ালেন। হিরা তো এমনিতেই দুইদিনের না খাওয়া। তাই হিরা পেট ভরে খেলো।

তারপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘সদাই তিনটি আনতে হলে তোমার কী কী দরকার?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আপনার নিত্যদিনের বাজার করা লোকটিকে আমার সাথে দিবেন। আমি সদাই কিনবো লোকটি দেখবে, আর শিখবে।’ রাজা ভেবে দেখল এ-তো চমৎকার বুদ্ধি? লোকটারও তো শেখার দরকার আছে! রাজা বললেন, ‘তা-ই হবে। আমার উজির সাহেব তোমার সাথে যাবে।’ এই বলেই রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটার সাথে বাজারে যাবেন। ছেলেটা কীভাবে কী করে, তা দেখবেন, শিখবেন।’ নিরুপায় উজিরের এখন মরি মরি অবস্থা! না পারে রাজি হতে, না পারে হিরা’র সাথে যেতে। উপায়ন্তর না দেখে উজির বললো, ‘হুজুর, ছেলেটার হাতে থাপ্পড়ও খেলাম, এখন আবার ছেলেটার চাকরগিরিও করতে হবে?’ রাজা উজিরকে দিলেন এক ধমক! ধমক দিয়ে বললেন, ‘থাপ্পড় তো আপনাদের ভুলের কারণেই খেলেন, উজির সাহেব। এখন আমি যা বলছি, তা-ই আপনাকে করতে হবে।’ উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

চলবে…