ট্যাগ আর্কাইভঃ মানবতা

মানুষের মর্যাদা কিসে?

মানুষের মর্যাদা কিসেমানুষ ভয়হীন, অশান্তিহীন, নিরাপদ সমাজে বাস করতে চায়। আসলে চূড়ান্ত সুখ-শান্তি (Ultimate happiness and peace) এখানে সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ সুখ হলো জান্নাতে। এখানে অর্থাৎ পৃথিবী হলো মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতার স্থান, পরীক্ষাস্থল। মর্যাদা কীসে?
.
মর্যাদা হলো আত্মার সংর্ঘষে। আপনি যত বেশি সংর্ঘষে লিপ্ত হবেন তত বেশি মর্যাদাবান হবেন। যত বেশি নির্বিবাদী জীবনযাপন করবেন তত কম মর্যাদাবান হবেন।
.
এটা দু’রকমের হতে পারে। একটা হলো ইচ্ছা করে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া, এটার আমি বিরোধিতা করি। ইচ্ছা করে আত্মাকে সংর্ঘষে নেয়ার দরকার নেই। ইচ্ছা করে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া নিষেধ, আল্লাহর নীতিমালা পরিপন্থী। বরং কোরআনে আল্লাহ পরীক্ষা থেকে পানাহ চাওয়ার, ক্ষমা চাওয়ার দোয়া দিয়েছেন।
.
আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহের মাঝেই যে পর্বগুলো আসে সেগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। এটাই যথেষ্ট আপনার মর্যাদা অর্জনের জন্য। টেনে টেনে বিপদ ডেকে আনার দরকার নাই।
.
প্রশ্ন হলো- সমস্যা নিবেন কি নিবেন না, মোকাবিলা করবেন কি করবেন না। প্রকৃতপক্ষে মোকাবেলা আপনাকে করতেই হবে। কারণ সময় এবং ঘটনা দুইটা একসঙ্গে লাগানো। সময় এবং ঘটনা দু’টি নিয়েই সৃষ্টি। সময় অতিবাহিত হচ্ছে মানেই ঘটনা ঘটবে। কারো জীবনই সরলরেখায় পথ চলবে না।
.
জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই। তিতা-মিঠা, রাত-দিন, আলো-আধাঁর, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব মিলিয়েই জীবন। এর মাঝে থেকে সে আত্মাই বেশি মর্যাদাবান হবে যে আত্মা ক্রমাগতভাবে আসা সংঘাতগুলোকে সবরের সাথে মোকাবেলা করেছে। সংঘাতে না জড়ানো পর্যন্ত আত্মা মর্যাদা লাভ করবে না। পরীক্ষাটা হলো এখানেই। পরীক্ষা দিবেন কি না দিবেন সে ব্যাপারে জোরাজুরি নেই, আপনি স্বাধীন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে মর্যাদা লাভ হবে না।
.
যেই না আপনার সামনে কোনো সংকট আসলো সংকটের মোকাবেলা করলে আপনি মর্যাদাবান হবেন। সময় ও ঘটনা স্বাভাবিক গতিতেই চলতে থাকবে। অতিক্রান্ত সময় ও অতিক্রান্ত ঘটনা শত চেষ্টা করলেও আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এটা একেবারে নির্ধারিত, হবেই হবে, এরই নাম ‘কদর’। সূর্য উঠছে, ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে, ১টা, ২টা, ৩টা আর থামবেনা চলবেই। ঘটনাও ঘটবেই।
.
কাজেই যে কোনো ঘটনাতেই হইচই করার বা হতাশ হবার কারণ নেই। আল্লাহর নির্দেশনা মতো সবর করেন, আপনি মর্যাদাবান হবেন। আর যে ব্যক্তি সবর করতে পারে নি, সে মর্যাদাও লাভ করতে পারে নি। এক সময় হয়তো দেখা গেল যে, ঘটনাও নেই, সময়ও নেই, মর্যাদাবান হবার সুযোগও নেই। অর্থাৎ প্রত্যেক ঘটনা, প্রত্যেক সময় প্রত্যেক মো’মেন বান্দার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সুযোগ।
.
এই হলো মানুষের মর্যাদার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। সে দৃষ্টিতে মো’মেনদের কোনো ঘটনাই হতাশার নয়, দুঃখের নয়, কষ্টের নয়। যদিও আপনার দুই হাতের কামাই আর কদর, দুটো মিলিয়ে ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আপনার এ কামাইটাকে আপনি পরবর্তীতে সুখময় করতে পারবেন এখনকার সবরের কারণে।
.
হেযবুত তওহীদের পথ চলায় বহু ঘটনা ঘটছে এবং একইসাথে সময়ও চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কেউ মর্যাদায় উপরে উঠে যাচ্ছে, কেউ নিচে নেমে যাচ্ছে। এই যে সময়টা, এটা কিন্তু প্রত্যেকেই ব্যয় করছে। কেউ সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারছে কেউ পারছে না।
.
যারা এ সময়ের প্রত্যেকটি ঘটনাকে মোকাবেলা করে চলেছে, সংঘাত থেকে পলায়ন করে নি, তারা ক্রমাগত মর্যাদার সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। আর যারা সংঘাত থেকে পলায়নপর হয়েছে তারা মানব ইতিহাসের অনেক বড় সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেছে।
.
সুতরাং বোঝা গেল, মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় সংঘাতে। ভাল-মন্দের সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের সংঘাত, গ্রহণ-বর্জনের সংঘাত। কাজেই সংঘাতপূর্ণ কাজ, অপ্রত্যাশিত কাজ, কষ্টের কাজ মো’মেনের জন্য দুঃখের নয়, এটা মর্যাদা বৃদ্ধির একটা উপায়।
.
সংঘাত কীভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি করে? একটি উদাহরণ দেই। একজন দাবি করল- সে লোভী নয়। অর্থ-সম্পদের উপর তার কোনো লোভ নেই। এখন তার নির্লোভিতার কোনো পরীক্ষা না দিয়েই কি সে মর্যাদাবান হতে পারবে? না, পরীক্ষা তাকে দিতেই হবে। কারণ তার আত্মা তখনও সংঘাতে জড়ায় নি। যত ভালো ছাত্রই হোক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সার্টিফিকেট পায় না।
.
ধরা যাক, জনগণের এক লক্ষ টাকা ওই নির্লোভ ব্যক্তির কাছে আমানত রাখা হলো। শুরু হলো তার সংঘাতের পালা, অর্থাৎ পরীক্ষা। এখন বোঝা যাবে সে লোভী না নির্লোভ। আবার যদি সে জনগণের ওই টাকা আমানত হিসেবে রাখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে তার মানে সে মুত্তাকী বটে, কিন্তু আল্লাহ সংঘাত বা পরীক্ষা থেকে পলায়নমুখী মুত্তাকীকে পছন্দ করেন না।
.
আর যদি সে অন্তরের লোভকে দমন করে শেষ পর্যন্ত যথাযথভাবে সেই আমানত রক্ষা করতে পারে তাহলে ওই এক লক্ষ টাকা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিল। সে ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। সময়ের নিরন্তর প্রবাহে একটি ঘটনাকে সে তার মর্যাদা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারল। কিন্তু যদি সে এই ঘটনা থেকে পলায়ন করত, তাতে তার মর্যাদা বাড়ত না, আর যদি পরীক্ষায় ব্যর্থ হতো তাহলে মর্যাদাহানি ঘটত।
.
সংঘর্ষ থেকে পলায়নমুখী সবসময় কাপুরুষ। তার দ্বারা না নিজের উপকার হবে, না মানবজাতির উপকার হবে। যারা বলে বেশি সম্পত্তির দরকার নাই, বেশি সম্পত্তি হলে বিপদ, সংঘাত, পরীক্ষা; সে হলো কাপুরুষ। অবশ্যই সম্পদ দরকার আছে। নিজের জন্য দরকার নেই তো কী হয়েছে, মানবতার কল্যাণের জন্য সম্পদ দরকার আছে।
.
সুতরাং মানুষের জীবন প্রবাহ যে কত মূল্যবান, কত অর্থবহ, তা কল্পনাও করা যায় না। এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া বিশাল এক ভাগ্যের ব্যাপার। কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও এ জীবনপ্রবাহ পাওয়া যাবে না। এ জীবনকে কি আপনি অভিশাপ হিসেবে নিয়েছেন? মরে গেলে ভাল হতো এমন ভাবছেন? তাহলে আপনি জীবনের অর্থই বুঝেন নি।
.
জীবনের বিশাল অর্থ। হাশরের দিন দেখবেন কত মর্যাদা। প্রকৃত মো’মেনরা সংঘাত দেখলে পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ ওখানেই মরতবা, মর্যাদা। যারা আধ্যাত্মিক সাধনা করে, হুজরা খানকার বাইরে বের হয় না, তার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকে, পৃথিবীর যাবতীয় সংঘাত, সংঘর্ষ থেকে গা বাঁচিয়ে থাকে তাদের তো আত্মাই নাই। তাদের আত্মা মরে গেছে।
.
যে আত্মা ক্রমাগত ন্যায়-অন্যায়ের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে আসছে এবং তার মোকাবেলা করছে সে আত্মাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মা। মাহাত্মটাই হলো সংঘাতমুখী, জীবনটা নির্ধারিত হয়েছে সংঘাতের দিকে, মর্যাদা নির্ধারিত সংঘাতের মধ্যে, অথচ তারা সেখানে যায়ই নি। যত বেশি ছাত্র তত বেশি প্রতিযোগিতা। সেখানে ভাল করলে মর্যাদাও বেশি। যে ক্লাসে একজন মাত্র ছাত্র পড়ে, তাতে রোল নং এক হওয়ায় কোনো মর্যাদা আছে কি?
.
প্রতিযোগিতা যত কঠিন হবে ততই আপনার মর্যাদা বাড়বে। পৃথিবীতে যত বিকৃত সুফীবাদ আছে কখনই তা প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা নয়। প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হলো মো’মেনদের জীবনে যেটা ঘটে। দুনিয়াতে লোভ, কাম, ক্রোধ, ঈর্ষা, অহংকার যা আছে এগুলোর কেন্দ্রে দু’টি বিষয়। জান ও মাল এ দু’টোই যখন মো’মেনরা আল্লাহর রাস্তায় অর্থাৎ মানবতার কল্যাণে অন্য মানুষের শান্তির জন্য বিলিয়ে দেবে তখন তার মর্যাদা কত উপরে উঠে যাবে কল্পনাও করা যায় না।
.
আমাদের পারিবারিক সংকট আসলে, ব্যক্তিগত সংকট আসলে আমরা মুষড়ে পড়ি। এটা ঠিক না। সংকট আসলো মানে মর্যাদা বাড়ার একটা সুযোগ তৈরি হলো। এটা বিরাট একটা সুযোগ। এগুলো মোকাবেলা করব সব আল্লাহর হুকুম মোতাবেক। এই মাপকাঠি (standard) নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্যই নবী-রসুলগণের আগমন ঘটেছিল। কারণ মাপকাঠি লাগবে। কতটুকু পর্যন্ত কাজ করবে, কতটুকু পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এগুলোর মাপকাঠি।

মানবসমাজ ও পশুর সমাজের মধ্যে পার্থক্য

এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, আড়াই বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?
.
মানুষ পশু নয়, তাই মানব সমাজ আর পশুর সমাজও এক নয়। মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, স্রষ্টা প্রদত্ত রূহের ধারক, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন অসাধারণ এক সৃষ্টি। তার সম্মান, মর্যাদা অন্য যে কোনো সৃষ্টির চেয়ে বহুগুণ বেশি। একই কারণে মানবসমাজও সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো কেবল মানবসমাজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যে সমাজে অনুপস্থিত থাকে তাকে কখনও মানবসমাজ বলা যায় না।

মানবসমাজের প্রধানত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ‘মানুষ তার স্বীয় ধর্মকে ধারণ করে সে সমাজ নির্মাণ করে। সমাজ পরিচালিত হয় ধর্মের ভিত্তিতে।’ মানুষের ধর্ম হলো মানবতা, মনুষ্যত্ব তথা মানবীয় গুণাবলী, যেমন অন্য মানুষের জন্য তার সহানুভূতি, ভ্রাতৃত্ব, দয়া, মায়া, সহমর্মিতা ইত্যাদি। ধার্মিক ব্যক্তি তার সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয় অন্যের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। অন্যের কষ্ট দেখলে, দুর্দশা দেখলে, বিপদ-আপদ দেখলে তার নিজের আত্মায় সে কষ্ট অনুভূত হয়। সমাজের সকল কিছুতেই সে কেবল নিজেকে দেখতে পায়। সমাজের কোনো মানুষ তো দূরের কথা কোনো জীবেরও এতটুকু দুঃখ তাকে পীড়া দেয়, আর সুখ তাকে আনন্দ ও সন্তুষ্টি প্রদান করে। ধার্মিক ব্যক্তি তার জীবন নির্বাহ করে শুধুই অপরের দুঃখ নিবারনের চেষ্টায়। কারণ সে জানে- অপরের কল্যাণে কাজ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবজনমের সার্থকতা। এটাই জেহাদ, এটাই ধর্মযুদ্ধ, এটাই ধর্মের সর্বোত্তম কাজ। এই যে মানসিকতা, সর্বভূতে হিত সাধনার্থে প্রয়াস, অপরের মাঝে নিজেকে দেখা- এটাই মানবসমাজের বৈশিষ্ট্য। এ সমাজে কোনো স্বার্থচিন্তার স্থান থাকে না, শুধু থাকে বিনিময়হীন সেবা। স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেখে যে যত বেশি সেবা প্রদান করতে পারে সে তত বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়, তত বেশি তার কীর্তি প্রাপ্ত হয়।

অন্যদিকে পশুর সমাজ হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সমাজ পরিচালিত হয় স্বার্থচিন্তার ভিত্তিতে। সেখানে প্রত্যেকেই আত্মস্বার্থে কাজ করে। সবসময় নিজেকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকে। অন্যের প্রতি কোনো অনুভূতি থাকে না। এমন কি নিজের স্বার্থ হাসিলের পথে যত অন্যায়-অবিচার, যুলুম দরকার হোক তার কোনো বাছ-বিচার করা হয় না, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য থাকে না। এ সমাজে শক্তিই পরিণত হয় ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডে। প্রত্যেকের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় যে করেই হোক নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায় করে নেওয়া। এখানে আত্মার কোনো স্থান থাকে না, থাকে শুধু দেহ। তাই দেহের প্রয়োজন পূরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পশু বেঁচে থাকে শুধু উদরপূর্তি করার জন্য। সে সারাদিন চিন্তা করে কোনো পশুকে আক্রমণ করবে, পরাভূত করবে, মাংস ভক্ষণ করবে। পাশাপাশি শঙ্কিতও থাকে এই বুঝি তার ওপর হামলা হলো, এই বুঝি তার থেকে শক্তিশালী কেউ তাকে ঠুকরে ঠুকরে খেল।

আপনি যদি পশুর সমাজে যান, অর্থাৎ কোনো ভয়ংকর বনে-জঙ্গলে প্রবেশ করেন তখন অবশ্যই আপনি খালি হাতে যাবেন না। কারণ সেখানে নিরাপত্তা নেই, যে কোনো সময় প্রাণ চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। বন্য পশুর সামনে হাতজোড় করে দয়াভিক্ষা করলেও নিস্তার পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে দরকার পড়ে পাহারার। কিন্তু যে সমাজ, যে জগতে একজন আরেকজনের জন্য নিজের সত্ত্বাকে বিলিন করে দেয়, অপরের মাঝে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে, অপরের সুখে নিজের তৃপ্তি খুঁজে পায় এমন সমাজে কি পাহারার দরকার পড়ে? বস্তুত পাহারা দিতে হয় পশুর সমাজে, মানবসমাজে তো কেবল সৌহার্দ্র্য, ভ্রাতৃত্ব, দয়া-মায়া, ভালোবাসার সমাহার। সেখানে অনিরাপত্তার ছোঁয়াও লাগে না, তাই পাহারারও দরকার হয় না।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আজকের মানবজাতির! দুর্ভাগ্য কথিত মানবসমাজের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে কী না করতে হয়। এ সমাজে মানুষের নিরাপত্তার জন্য বাহিনী গঠন করতে হয়, চৌকি বসাতে হয়, দিবা-রাত্রি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মানুষের জীবন-সম্পদ পাহারা দিতে হয়; বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির জন্য আবার প্রয়োজন পড়ে বিশাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার, বডি গার্ডের বা পুলিশ ভর্তি গাড়ি বহরের। এর অর্থ কী দাঁড়ায়? এর অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, যেখানে মানুষ মানুষের রক্তে হোলি খেলছে, উদায়াস্ত একজন মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে, ক্ষুধার্ত বাঘের মতো যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে দুর্বলকে আক্রমণ করছে, একজন আরেক জনকে জীবন্ত আগুনে দগ্ধ করছে, বাবা মেয়ের ইজ্জতের হানি ঘটাচ্ছে, মেয়ে তার জন্মদাতা পিতা-মাতার গলায় ছুরি চালাচ্ছে, চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হচ্ছে সে সমাজ আর মানুষের সমাজ নয়? কথিত এই মানবসমাজ আর পশুর সমাজের মধ্যে কার্যত কোনো তফাৎ আছে কি?

সোজা কথা হলো মানবতা-মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজকের মানবজাতি ধর্মহীন পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের সমাজ পরিণত হয়েছে পশুর সমাজে। কারণ পাহারা দেওয়ার দরকার হলেই সে সমাজ আর মানুষের সমাজ থাকে না। এ কারণেই যুগে যুগে যখন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখা গেছে তখন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাহারা বসানোর দরকার পড়ে নি, অস্ত্রের লাইসেন্স করার দরকার পড়ে নি, অস্ত্রব্যবসার জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদনের দরকার পড়ে নি। অথচ সমাজে কোনো অন্যায়-অবিচার ছিল না, অনিরাপত্তা ছিল না। এমনটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখন প্রতিটি মানুষ ছিল মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত। আর আজ এমন আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কারণ এখন প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে নিয়োজিত।

মুঠোফোন – 01722 606045।