ট্যাগ আর্কাইভঃ মুক্তগদ্য

কাঠের ঘোড়া

আমারও যদি থাকতো একটা ‘টিন ড্রাম’ অস্কারের মতো! এমনকি প্রত্যেকটি মানুষেরই দরকার একটি টিনড্রাম অথবা ট্রাম্পেট জাতীয় কিছু একটা বাস্তবতার যাবতীয় অনাকাঙ্খিত কষাঘাত থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য।

থাকলে বেশ হতো। নেই। তাতে কি? আমারতো আছে একটি কাঠের ঘোড়া। যখন তখন পালিয়ে বেড়ানো যায় দেশ থেকে দেশান্তরে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, সাত সাগরের তীর পেরিয়ে খেয়ালখুশীর বাড়িটিতে ঢুকে পড়া যায়। এটাই আমার আজীবনের সঙ্গী। আমার মুক্তি।

খট্‌ খটা খট্‌। বর্তমান থেকে অতীত, অতীত থেকে অনাগতের স্বপ্নে ঢুকতে একটুও দেরী হয়না। জানি একদিন আচমকা শুরু হবে ফুরিয়ে যাবার বেলা। ঘোড়া থেমে গেলেই শুরু হবে সেই চিরন্তনের খেলা। সেদিনটি কবে ? জানিনা।

মুক্তগদ্য
৭ম সংখ্যা, বইমেলা ২০১৭।

হ্যালুসিনেশন

কুয়াশার চাদরে মোড়া ওই বনভূমি, ওই নদী, হরিণের জলপানের ওই দৃশ্য ; এক বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো। মনে হয় ওই দৃশ্য কোথাও ছিলনা। অথবা ছিল। তারপরেও ওই দৃশ্যটাকে নেহাতই একটা রং-তুলিতে আঁকা ছবি বলেই ধরে নেই। কিন্তু এখনো সেই জলের গন্ধ, সেই পিপাসার্ত হরিণের ব্যাকুল ছুটে আসার আনন্দ-উল্লাস একদম টাটকা—-জীবন্ত।

কুয়াশামগ্ন জল-জঙ্গলের ভেতরেই কি ছিল সে স্বপ্নের কুটির?

আমরা যা সত্যি বলে ধরে নেই তার অনেকটাই হয়তো স্বপ্ন অথবা হ্যালুসিনেশন। এই হ্যালুসিনেশনেরও একটা স্মৃতি থাকে। রঙ্গীন অথবা বিষাদাচ্ছন্ন। স্মৃতিবন্দি মানুষের পরাধীনতার কষ্ট অন্যরকম। অনুতাপ। নিজেকে এক মস্ত তোরঙ্গে বন্দি করে ফেলে নিজে নিজেই। তারপর সেই সিন্দুকের চাবি হারিয়ে ফেলে। আজীবন পিছুটানের পঙ্গুত্ব। এমনি হয়।

অন্ধকারে যাত্রা

গতকাল এখানে কী ভীষণ অন্ধকার গেছে। মানুষজন। হৈ চৈ! যেন দোযখের চিৎকার। বাঁচার জন্য মানুষের সেকি চেষ্টা। সবাই বাঁচতে চায়। নিরন্তর সংগ্রাম। অতঃপর হাড়িতে উঠলো চাল। মৃত্যুর দূতকে আমাদের বড় হয়। তবুও ব্যথা বাড়ছে। ক্রমশ! আশ্বিনের রাতের মতো। শিয়ালের ডাক। পিলে চমকে গেলে পিছনে তাকিয়ে দেখি ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে আছে দাঁতালো আজরাইল। মৃত্যুর পরওয়ানা হাতে। আমরা পালিয়ে বাঁচি শালা শয়তানের মতো। তবুও রেহাই নেই। ছোট্ট ঘর। জগৎ সংসার। বউ, বাচ্চা। হাতছানি দেয় ভালোবাসার। অন্ধকার! অতঃপর একমুঠো আলোর জন্য আমাদের অন্তহীন অপেক্ষা।

অন্ধকার

আমার আঁধার ভালো। রাত্রিকে কেন ঢেকে দাও নকল আলোর বন্যায় ? শোন গন্ধরাজের সৌরভের সাথে কেমন হু হু বেজে যাচ্ছে
আঁধারের নিজস্ব সুর, আপন কোলাহল।

এ আগুন ফিরিয়ে নাও। ভুলে যাও পাথরে পাথর ঘষা সভ্যতার এই উন্মেষ। যুগযুগ সাধনালব্ধ কৃত্রিম আলোর এই ফোয়ারার উদ্ভাস ভুলে যাও। রাতকে থাকতে দাও তার নিজের মতো। রাতের এই স্বতস্ফুর্ত নিজস্বতাকে আড়াল করতে জ্বালিওনা কোন প্রদীপ অথবা ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব। রাতচরা পাখিগুলোকে উড়তে দাও তাদের প্রিয় আকাশে।

মুছতে চাইনা নকল আলোর উৎসবে অন্ধকার রাতের এই চাকচিক্য। আঁধারের নিজস্ব সুরটুকু শুনতে চাই, দেখতে চাই তমসার একান্ত আপন সৌন্দর্য। আরো আরো আরো গাঢ় হোক তমিস্রা। শ্লেটের কালোর মতো। হতাশার মতো। সারারাত অন্ধকার দেয়ালের গায়ে একের পর এক ফুটে উঠুক ছবি। অতীত। দীর্ঘশ্বাস। এভাবেই একসাথে জেগে থাকবো আমি ও আমার অন্ধকার। সারারাত।

মানুষ !

আদতে আমি কি ? কতটা মানুষ ? মানুষ হিশেবে কতটা স্বার্থক – কতটা ব্যর্থ ? কতটা ভাবায় আমায় ?
এই যে আমার পৃথিবী , সত্যিই আমার ?

মানুষের পৃথিবী শুধুই কি মানুষের ? আর কারও নয় ?

আমরা পৃথিবীর মানুষ নই , পৃথিবীটাই একান্ত মানুষের,আবার পৃথিবীটা বিভক্ত – একটা ভূখন্ড আমার – কিছু মানুষের – ৭০০ কোটি মানুষের নামে পৃথিবী কয়েকশো খন্ডে লেখা হয়ে গেছে। কারও আবার তাও নেই । এ-খন্ডের মানুষ ও-খন্ডে যেতে হলে বিশেষ অনুমতি লাগবে – কেননা ও-খন্ডে অন্য মানুষ থাকে – তারা আর তুমি এক নও , আলাদা,ভিন্ন ।

দেখ – তোমরা দেখতে আলাদা, এক হলেও বর্ণ আলাদা, এক হলেও ভাষা আলাদা , এক হলেও ধর্ম আলাদা, এক হলেও…

দেখ- কিছু একটা আছে …কাঁটাতারটা দেখছো না …

এই যে আমি, আমি কিন্তু পৃথিবীর নই –

একটি দেশের – স্রেফ একটি দেশের –

দেশেরও আবার অনেক অঞ্চল – চালচলন, রেওয়াজ,কথার ধরন – বেমিল ।

আমি এবার – কোথাকার ছোকড়া !

অতঃপর আমি একটা অঞ্চলের – অমুক জায়গার – তমুক গ্রামের – অমুক পাড়ার – তমুক বাড়ির -অমুক ঘরের !

হা-হা-হা । চমৎকার !

অতঃপর আমি রাস্তার অভিমুখে, নর্দমার ধারে হাঁটছি – দেখছি কীট, বাড়ন্ত-জীবন্ত কীট ।

রিকশা আর গাড়িবহরের ঝগড়া –

উঁচু তলা, নিচু তলা –

৪ তলা, ৬ তলা,১০ তলা আর টিনের ছাবড়া – বসতি থেকে বস্তি – নাক্‌ সিটকানো বস্তি –

৪ তলা ৬ তলা হয়, ৬ তলা বাড়ে, ১০ তলাও বাড়ে , টিনের চালে কেবলই ফুটো হয় –

তারপর রাত হয়, মাতাল-নেশাখোরেরা জাগে – সেখানেও দেখছি বার আর মাটির ভাঁড় , সভ্য আর অসভ্য ইতর – তফাৎটা ঠিক কোথায় -?

অবক্ষয় কাকে বলে ? কুকুরগুলো ঘুমানোর পরও যারা জেগে থাকে, তারা অবক্ষয় ? অবক্ষয় বেপর্দা নারী ? প্রতিটি স্বাধীনচেতা মানুষ ?

রাস্তায় কোনো-কোনো পুরুষ সফেদ শাড়ির ভেতরে কি যেন খোঁজে – সেখানে নাকি অবক্ষয়ের সূত্রপাত – আর সেই সফেদ শড়ির ভেতরে থাকা মানুষ অবক্ষয়ের কারন –

অতঃপর আন্দোলন , মানুষের, মানবিকতার –

অথচ, দুই হাতে তালি বাজানো মানুষগুলোর রাতের বালিশ কি করে ভিজে – কি করে শুকিয়ে যায়, তার খবর কেউই রাখে না –

অবশেষে আমিও বোধহয় মানুষই – !

আমরা মানুষ !কাক আর কোকিলের তফাৎ শিখতে-শিখতে বেড়ে ওঠা মানুষ –

বৈষম্য যার অস্থিতে, এমনকি মজ্জায় ।