ট্যাগ আর্কাইভঃ শাওনের গল্প

জীবন যেখানে যেমন

বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার সারাদিন মেস বন্ধ থাকে, যাদের সাথে মেসে খাই তাদের প্রায় সবার বাড়ি মোটামুটি কাছে হবার কারণে তারা সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে বাড়ি চলে যায় তারজন্যই মূলত মেস বন্ধ থাকে, আমার বাড়ি দূরে হবার কারণে যেতে পারিনা। সাধারণত এই সময়ের খাবারটা আমার হোটেলে খেতে হয়, শুরু থেকে ইচ্ছেটা এমন যে প্রতিবার নতুন নতুন হোটেলে খাবো এতে ঘুরাঘুরি হবে সাথে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদও পাবো।
.
প্রথম কয়েক সপ্তাহ এমনটাই করলাম কিন্তু এখন সেটা করিনা একটা ছেলের জন্য। মেস বন্ধ থাকলে এখন ওর ওখানেই যাওয়া হয়, আমি গেলে ওকে আর বলতে হয়না কখন কী খাবো। আর সম্ভবত ও আমার অপেক্ষা করে কারণ আজকে দুপুরে জিজ্ঞেস করলো “এত দেরি করলেন যে ?” আর আমাকে ও যতটা যত্নের সাথে খাওয়ায় আর কাউকে ততটা যত্নের সাথে খাওয়ায় কিনা জানিনা।
.
বিষয়টা পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে। সপ্তাহ দুই আগে ওই হোটেলে দুপুরে খাবার জন্য যাই, রীতিমতো খাওয়ার শেষের দিকে জিজ্ঞেস করলাম কোন পানীয় হবে কিনা ? একজন ওয়েটার বললো আমাদের এখানে নেই তবে বাইরে থেকে এনে দেয়া যাবে। যশোরে এতবেশী গরম যে দুপুরের দিকে ঠাণ্ডা পানীয় না খেলে চলেনা।
.
সে যাইহোক সর্দার টাইপের ওয়েটার একটা ছেলেকে ডেকে আমার জন্য পানীয় আনতে বললো। আমি ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটাকে দিলাম, বড় নোট দিলাম যাতে সেটা ভাঙতিও হয়। ছেলেটার বয়স ৯-১০ বছর, এই বয়সের একটা ছেলে পড়াশোনা আর খেলাধুলায় মত্ত থাকার কথা অথচ ও এই হোটেলের সবথেকে কনিষ্ঠ ওয়েটার, ছেলেটা রোদের ভিতর বাইরে চলে গেলো। এদিকে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পার হয়ে গেলো ছেলেটা আসছেনা, আমার খাওয়াও শেষ হয়ে গেলো।
.
যিনি তাকে বাইরে পাঠালেন তিনি এগিয়ে এসে বললেন হয়তো নোট খুচরা করতে পারেনি, আপনি ক্যাশে দিলেইতো খুচরা করতে পারতেন। আমি বললাম ওহ তাইতো আমার খেয়ালই ছিলোনা, মনে মনে ভাবলাম ছেলেটা কি চলে গেলো ? তারপর বললাম আমি তাহলে বাইরে যাই, পথেই নিয়ে নেবো ওর থেকে, আমার আবার একটু কাজ আছে। এই বলে বিল চুকিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
.
বের হয়ে একটু আগাতেই দেখি পাশের এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে ছেলেটা কোলাকোলার বোতল ওর গালে, কপালে ঘাড়ে চেপে ধরতেছে। আমাকে দেখতেই হচকয়িয়ে গেলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম দেরি করতেছো কেন ? ও কোন উত্তর দিলোনা, ওর থেকে বোতল আর টাকা বুঝে নিয়ে বললাম ঠিক আছে। আর মনে হলো হয়তো ওর কোক খেতে ইচ্ছে করতেছে তাই বললাম দাঁড়ায়ও আর আমি কিছুটা খেয়ে বাকিটা ওকে সাধলাম, ও বললো নিবেনা ওর জ্বর, ঠাণ্ডা খাওয়া যাবেনা। বললাম ওষুধ খাওনি ? মাথায় পানি দেওনি ? মাথা নেড়ে জানালো কিছুই করেনি।
.
কপালে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি অনেক জ্বর, তখন বোঝলাম কেন কোকের ঠাণ্ডা বোতল ওইভাবে চাপতেছিলো। তারপর বললাম এই জ্বর নিয়ে তুমি কাজ করতেছো কেন ? মালিকরে বলে বাড়ি চলে যাও, ও বললো যেতে দিবেনা আর গেলে হাজিরা দিবেনা। তারপর ওর সাথে আরও কথা হলো, ওর বাবা বেঁচে নাই, ওর মা বাসায় কাজ করে, ও স্কুলে পড়েছে থ্রি পর্যন্ত আর ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে এখানে আছে। জোর করে ওকে একটা নরমাল কোক আর নাপা এক্সট্রা কিনে দিলাম, ও নিবেইনা, কারণ হিসেবে বললো মালিক জানলে বকবেনি, আমি বললাম এখানে খেয়ে যাও কোন সমস্যা হবেনা। ছেলেটা দ্রুত কোক খেলো, আমার সামনে টেবলেট খেতে বললাম, তারপর টেবলেট খেলো আমি বললাম হোটেলে গিয়ে মাথায় পানি দিবা। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো তারপর শরীরে জ্বর নিয়েই আবার হোটেলের দিকে চলে গেলো…
.
১০/০৬/২০২০

বোন

বোন…!
জীবনে এই একটা সম্পর্কের অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি আমার। তবে অনেকের জীবনে বোনের প্রভাব, স্নেহ, ভালোবাসা দেখে কতদিন আর কতরাত যে মন খারাপ করে কাটিয়েছি জানিনা, কখনো কখনো কেঁদেছিও। এইতো কয়েক বছর আগেও আম্মার সাথে বোন নিয়ে ঝগড়া করতাম। সবার বোন আছে আমার কেন নেই ? আম্মা হাসতো আর বলতো তাড়াতাড়িই বোন এনে দেবে যদি তাকে অনেক আদর করি এই শর্তে আর আব্বা বলতো পালক বোন এনে দেবে। এখন বড় হয়েছি তাই এসব আর বলিনা।
.
যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম তখন আমার এক ক্লাসমেটের বাড়িতে যেতাম মাঝে মাঝেই। দেখতাম ওর বড় বোন ওর জন্য কোনদিন আম ভর্তা করে রেখে দিতো, কোন দিন বড়ই বা জলপাই। তাছাড়া ওর স্কুল ড্রেস ওর বোনই ধুয়ে আয়রন করে রাখতো। কোনদিন সময় না থাকলে খাইয়ে দিতো আর টিফিন রেডি করে রাখতো তাছাড়া ওর হাত খরচের টাকাও ওর বোন দিতো। এতো গেলো স্নেহের কথা আবার অকারণে ঝগড়া করাটাও চোখে পড়তো, সম্পূর্ণ দোষ ভাইয়ের থাকলেও বকা খেতো বোনটা আর আশ্চর্যের বিষয় যে, সে মেনেও নিতো এমনকি কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধও করতোনা অথচ যেখানে বোনটার এক থাপ্পড়ের উপর কিছু করতে হতোনা সেখানে হামেশাই বোনটাই মার খেতো কিন্তু কখনোই ছোট ভাইটাকে মারতোনা। চোখের সামনে ওর বড় বোনের আদর দেখতাম, ঝগড়ার মাঝেও একটা বিশাল স্নেহের আকাশ ছিলো। সেই স্নেহগুলো ঠিক অন্যরকম, অন্যভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে সেগুলোকে।
.
এছাড়া আরেক বন্ধুর ছোট বোনের প্রতি ভালোবাসাটাও উল্লেখ করার মতো। একবার আমরা পিকনিকে যাই আমার ঐ বন্ধু ওর বোনের জন্য অনেকগুলো খেলনা কিনেছিলো আর আমি কিনতে পারিনি কারণ কাকে দেবো ? তখন আমার ছোট কোন কাজিনও ছিলোনা। তবে ওকে পছন্দ করে দিয়েছিলাম আর মনে মনে কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে, যদি আমারও ছোট একটা বোন থাকতো।
.
এরপর যখন কলেজে গেলাম তখনও এমন অনেক ভাইয়ের জীবনে বোনদের ভালোবাসাটা অন্যরকমভাবে প্রতিফলিত হতে দেখেছি। সব কথা যেন অকপটে বোনের কাছে বলা যায়, গোপনীয়তা যেন একমাত্র বোনের কাছে এসেই ঠাঁই পায়, কিন্তু আমি আমার মনের কথা অভিভাবক স্বরূপ কাউকে বলতে পারিনি বড় বোন না থাকায়। অনেক দোষত্রুটি বোনের কারণে হাওয়া হয়ে যেতে দেখেছি অনেকের। একবার আমরা কয়েকজন ক্রিকেট খেলা নিয়ে ঝগড়া করেছিলাম তারপর আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। যখন বিচারটা ওদের বাড়ি পর্যন্ত গেলো তখন ওর বোন অনেককিছু বলে বিষয়টা মিটমাট করে দিলো। ওকে ঘরে রেখেই বললো আজকে আসুক হারামজাদা ওর ঠ্যাং ভাঙ্গমু, অথচ বাদীপক্ষ চলে গেলে ওকে শুধু শাসিয়ে দিলো আর কিছুই করলোনা এমনকি আমাদের সবাইকে মুড়ি ভর্তা করে খাওয়ালো সেদিন। দূরে কোথাও গেলে বোনের বারবার খোঁজ নেয়া দেখেছি তবে এগুলো অন্যদের জীবনে দেখা।
.
কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক আমি বিশ্বাস করি ভাই আর বোন কখনো এক না। ভাইয়ের সাথে খুব একটা বন্ধুত্ব হতে দেখিনি কারো জীবনে আর নিজের জীবনেতো নয়ই, নিজের ভাই থাকলেও আমার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত সে। ভাইয়ের সাথে সর্বোচ্চ যেটা হয় সেটা সাময়িক মিল। ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক মিল থাকলেও বছর কয়েক পরেই জমিজমা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ হতে দেখেছি কতশত তার কোন হিসেব নেই কিন্তু বোনের সাথে বোনের বা ভাইয়ের সম্পর্কটা স্বার্থের কারণে হতে বা ভাঙ্গতে দেখিনি কখনো।
.
নিজের বোন বলতে কয়েকটা কাজিন আছে তবে কোন এক অজানা কারণে ওরা আপন করে নিতে পারেনি আমাকে। এইতো একবার এক কাজিনের কাছে চিপস চেয়েছিলাম সে বলেছিলো তুমি কি আমার আসল ভাই? তোমারে দিমুনা (যদিও না বুঝেই বলেছিলো তবে কথাটায় গভীরে আঘাত পেয়েছিলাম)। বাবা আর চাচাদের মধ্যে সামান্য ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি কাদের বাড়িতে হয়না? এসবের কারণে অনেক সময় ওরা আমার কাছেও আসেনা।
সে যাই হোক এসব ব্যপারে আমি অভিমান করেও করিনা কারণ লাভ নেই।
.

আজ সকালে এক কাজিন কোথা থেকে কিছু খেঁজুর এনেছে জানিনা। আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে আর আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে খেঁজুরগুলো খাচ্ছে। আমি কেন জানিনা বাচ্চাদের মতো চেয়ে বসলাম কিন্তু ও দিবেনা। অনেক জোরাজুরির পরও রাজী হলোনা। পরে পাঁচ টাকা দিয়ে এই একটা খেঁজুর কিনে নিলাম ওর থেকে…!
.
২৭/০৬/২০১৯

সেই দিনগুলো

আমার এক বন্ধু ক্লাস এইটে পড়ার সময় ক্লাস সেভেনের এক মেয়েকে খুব পছন্দ করতো। আমাদের ক্লাসের পিছনেই ছিলো সেভেন ক্লাস আর দুই ক্লাসের মাঝখানে পার্টিশন ছিলো টিনের বেড়ার। আমার বন্ধু সর্বদা ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসতো আর যেখানে বসতো সেখানে খানিকটা টিন কেটে জানালার মতো করেছিলো তাছাড়া বেড়া অনেকটাই ভাঙ্গা ছিলো তখন। আর সেখান দিয়ে ও পিছনের ক্লাসের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েটাকে দেখতো। যদিও অনেকভাবে মেয়েটাকে বুঝাতে চাইতো কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ওকে পাত্তা দিতোনা। তারপরও ওর সাধ্যমত আমলে লেগেই ছিলো।
.
ঐ সময় লাল রঙের স্প্রিন্ট মোবাইল আসে বাজারে। ২০০৯/১০ এর দিকে যারা মাল্টিমিডিয়া মোবাইল দেখেছেন তারা হয়তো মোবাইলটা সম্পর্কে জানেন। তো আমাদের ক্লাসের এক বন্ধু ঐ মোবাইল একটা কিনে ক্লাসে নিয়ে আসে। মাল্টিমিডিয়া মোবাইল তখন বাজারে একেবারে নতুন। ঐ একটা মোবাইল দিয়েই ক্লাসের সবাই ছবি তোলা, গান শোনা, ভিডিও দেখা ইত্যাদি খুব উৎসাহের সাথে এনজয় করতাম। আমার ঐ বন্ধু ঠিক করলো মোবাইলে মেয়েটার ছবি তুলবে যেমন কথা তেমন কাজ। ও ভাঙ্গা টিনের ফাঁক দিয়ে মেয়েটার ছবি তোলে আর সেটা ঐ মেয়েটা বুঝতে পারে। আমার বন্ধুও বুঝতে পারে যে মেয়েটা বুঝে গেছে। এর কয়েক মিনিটের মাথায় আমাদের গরম হুজুরের কাছে মেয়েটা আমার বন্ধুর নামে বিচার দেয়। এই হুজুরকে সবাই খুব ভয় পেতো আর খুব রাগি ছিলো তাই আমরা সবাই উনাকে গরম হুজুর বলতাম। উনার নাম ছিলো মাওঃ আঃ বারি (হাফি)।
.
এর মধ্যে পিয়ন আঃ আজিজ ভাইয়ের মারফতে জানতে পারি যে, টিফিন পিরিয়ডে বিচার হবে। সবাইতো খুব ভয় পেয়ে যাই, কেউ কেউ ওকে পালিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি দিতে থাকে ও বলে আমি যামুনা ও যদি আমারে মাইর খাওয়াইয়া খুশি হয় তবে আমি মাইর’ই খামু। আর মোবাইলটা যার ছিলো সে আগেই ভয় পেয়ে মোবাইল নিয়ে ভেগে যায়। তখন বিপদের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। কী করবো ভাবতে থাকি, একেকজন একেক বুদ্ধি দিতে থাকে কেউ কেউ মেয়েটার কাছে ওকে মাফ চাইতে বলে। এর মাঝে আমার মনে পড়ে আমাদের মাদ্রাসার কাছেই একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান আছে যেখানে তখন মোবাইলের ক্যাচিংও বিক্রি করা হতো। তো আমি নিজে গিয়ে সেখানে খোঁজ করে ঐ লাল স্প্রিন্ট মোবাইলের ক্যাচিং পাই আর বলি যে, এটা গরম হুজুর দেখতে চাইছে পছন্দ হলে এই মডেলের একটা মোবাইল কিনবে আমাকে পাঠিয়ে দিছে এটা নেয়ার জন্য। গরম হুজুর আবার ঐ দোকান থেকে মাঝে মাঝে বাকিতে ফ্লেক্সিলোড করতে আমাকে পাঠাতো তাই উনার কথা বলি যাতে দোকানদার দেয় কারণ আমাদের কারো কাছে তখন টাকা ছিলোনা।।
.
এরপর টিফিন পিরিয়ডে আমাদের ডাকা হয় আমাদের ক্লাস থেকে আমি, ঐ বন্ধু আরও দুজন যাবার অনুমতি পাই। আর ঐ মেয়ের সাথে ঘটনার সাক্ষী স্বরূপ দু/চারজন মেয়েকেও ডাকা হয়। যথারীতি বিচার শুরু হয় আমি আগেই আমার বন্ধুকে শিখিয়ে দেই তুই কিছু বলবিনা যা করার আমি করবো। ও আমার কথা মতো চুপ থাকে, বিচারের এক পর্যায়ে আগে জানতে চাওয়া হয় মোবাইলটা কার? তখন আমি বলি হুজুর, মোবাইলতো বড় ভাইয়ের আর ওর হাতে যেটা ছিলো সেটাতো ক্যাচিং বড় ভাই কিনে নিয়ে যেতে বলেছে। এইযে দেখুন, এই বলে হুজুরকে লাগানো ক্যাচিংটা দেই (যারা মোবাইলটা সম্পর্কে জানেন তারা এটাও জানেন যে পুরো ক্যাচিংটা লাগালে হুবহু মোবাইল’ই মনে হতো)। হুজুর কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে বলে আরে এটা দিয়েতো ছবি তোলা যায়না। আমিও বলি জ্বি হুজুর, এটা ক্যাচিং আমার বড় ভাই কিনে নিতে বলছিলো। তখন হুজুর উল্টা মেয়েটাকে ধমক দিয়ে বলে আজাইরা বিচার যেন আর দেওনা। মেয়েটা ভয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে যায় তখন আমার বন্ধু সব বলে দিতে চায়। আমি তখন ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে এনে বলি আর জানি আজাইরা কাম করস না…!!
.
০৭/০৭/২০১৯

আমাদের মায়েরা

তখন আমি একটা কোচিংয়ে জব করি, সংগত কারণেই কোচিংয়ের নাম এবং জায়গার নাম গোপন করছি। একদিন কোচিংয়ের নির্বাহী পরিচালক আমাকে ডেকে পাঠালেন, সন্ধ্যা পিরিয়ডের দুটো ক্লাস নিয়ে পরিচালকের সাথে দেখা করলাম। তিঁনি আমাকে বললেনঃ স্যার, একটা কাজে যেতে হবে। বললামঃ কিসের কাজ আর কখন ? তিঁনি জবাবে বললেনঃ আজ রাতেই ছুটির পরে এক ছাত্রের বাড়িতে যেতে হবে। ছাত্রের পরিচয় জানার পর বললামঃ আমিতো স্যার নতুন, তাছাড়া ওদের বাসাও চিনি না আর সেতো বেশ কয়দিন ধরে কোচিংয়েও আসেনা ঘটনা কী ? পরিচালক বললেন আমিও যাবো আপনার সাথে, ছেলেটার মা আমাকে কয়েকবার ফোন করেছে, আমাকে আর আপনাকে যেতে বলেছে বিশেষভাবে। ঘটনা কিছু বুঝতে পারলাম না, তবে আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, পরিচালক নিজে যাবে তাও আবার এখনই যেতে হবে কী এমন কাজ! আর এও আন্দাজ করলাম ঘটনা হয়তো গুরুতর হতে পারে।।
.
ছুটির পর স্যারের সাথে ঐ ছাত্রের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলাম, যেতে যেতে স্যার আমাকে নিয়ে গেলেন উপশহরের মূল এরিয়া থেকে একদম বাইরে একটা গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে, আমি মনে মনে বললাম এতদূর থেকেও আমাদের কোচিংয়ে স্টুডেন্ট যায়। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা নির্জন জায়গায় বাড়িটা, সেই বাড়ির আশেপাশে তেমন কোন বাড়ি নেই, ছিমছাম তবে অগোছালো একটা বাড়ি। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই মাছের বাসি উৎকট গন্ধ নাকে ভেসে এলো, দেখলাম বাড়ির উঠোনে মাছ ধরার জাল আর খাড়ি পড়ে আছে, বুঝতে বাকি রইলোনা এটা একটা জেলে বাড়ি। তারপর পরিচালকের ডাকে ছাত্র বেড়িয়ে এলো কুশল বিনিময় করতে করতে আমাদের একটা রুমে নিয়ে গিয়ে শক্ত একটা তক্তপোশে বসতে বলে ছাত্রটা গিয়ে তাঁর মাকে ডেকে আনলো। মধ্য বয়স্কা একটা রোগা মহিলা এলেন, দেখেই মনে হলো তখনও হয়তো কোন রোগে আক্রান্ত উঁনি। কুশল বিনিময়ের পর তিঁনি পরিচালককে বললেনঃ স্যার, আপনাদের ইংরেজির নতুন স্যারকে নিয়া আইছেন ? স্যার আমাকে দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি আমাকে দেখে আরও আবেগ তাড়িত হয়ে পড়লেন। বললেন আপনার কথাই সজীব (ছদ্মনাম) সবসময় বলে, আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো আমার। আমার বিষয়ে আরও অনেক কথা বললেন যেগুলো এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন।।
.
ভদ্রমহিলার সাথে মোটামুটি অনেক কথাই হলো কথার এক পর্যায়ে বললেন বাপে যা করে ছেলেরও তাই করতে হবে এমন কোন কথা আছে গো স্যার ? ওর বাপে না হয় জাইলা (জেলে) তাই কি ওরও জাইলা হতে হবে ? ওর বাপে ওরে পড়াবোনা তয় আমি পড়াবো। আমি কোচিংয়ে যেতাম অসুস্থ বলে ঘর থেকেই বের হতে পারিনা, না হলে আমি নিজে গিয়ে বলে আসতাম আপনাদের, তাছাড়া সব কথাতো আর ওখানে বলা যাবেনা তাই আপনাদের আসতে বলেছি। ভদ্রমহিলা আরও অনেক কথা বললেন যে কথাগুলোর সারমর্ম এটাই যে, ছেলেটার বাবা পড়াশোনা নিজেও করেনি ছেলেকেও করাবেনা। তিঁনি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন, ছেলেকেও একই পেশাতে নিতে চান। মায়ের কথা হলো, না! ছেলে তাঁর পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবে সরকারী অফিসার হবে। ভদ্রমহিলা আরও অনেক কথা বললেন, এক পর্যায়ে পারিবারিক নানা টানাপোড়েনের কথা বলতে বলতে কান্নাকাটিও করলেন। এও বললেন যদি ওর বাপে টাকা পয়সা না দেয় তবে তিঁনি নিজেই দিবেন সেটা যেভাবেই হোক। আর আমাদের টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে না করলেন। তিঁনি শেষমেশ বললেন দরকার হলে গয়না বেঁচবেন তবুও ছেলেকে পড়াবেন।।
.
ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে বললেনঃ বাবা, আমার পোলাডারে দেইখেন। আমি বললাম আপনার ছেলের প্রতি আমাদের নজর এমনিতেই বেশি, কারণ ও সবথেকে ভালো ছাত্র পি.এস.সিতে যেমন ভালো রেজাল্ট করেছে এবার জে.এস.সিতেও ভালো রেজাল্ট করবে আমরা আশা করি, ভদ্রমহিলা চোখ মুছলেন। বললেন আমি বাবা বড় অসুখে পড়ছি, জানিনা কতদিন বাঁচমু। আমি মরলেইতো ওর বাপে ওরে আর পড়াবোনা। আপনারা আমার পোলারে দেইখেন, ট্যেকা পয়সার চিন্তা করবেন না। আমি সব দিমু গত মাসের বেতন দিতে পারিনাই তাই ও কোচিংয়ে যেতে চায়না আপনেরা ওর কাছে কোন টাকা চাবেন না ও শরম পায়, এই বলে আমার হাতে কয়েকটা নোট গুজে দিলেন আমি টাকাটা পরিচালকের হাতে তুলে দিলাম, তিঁনিও টাকা দেখলেন না, উঠে আসার সময় তক্তপোশের উপর রেখে দিলেন আর বললেন ওর দায়িত্ব কোচিং এর, ও খুব মেধাবী ছাত্র নিয়মিত যেতে বলবেন আর ওকে ডেকে আমরা পরেরদিন থেকে নিয়মিত কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বললাম। খেয়াল করলাম ছেলেটা লজ্জায় মাথা নিচের দিকে দিয়ে চোখ মুছতেছে আর তখন ভদ্রমহিলা কিছুটা জোরেই কেঁদে উঠলেন।।
.
তখন রাত প্রায় ১০ টা বেজে গেছে, ছাত্রটা আমাদের উঠোন পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলো তবে তখন আর প্রথমবারের মতো মাছের গন্ধবোধ করলাম না এতক্ষণ থেকে হয়তো গন্ধটা আমার সওয়া হয়ে গিয়েছে। আমরা বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাড়ির বাইরে থেকে ছেলেটার পড়ার শব্দ শোনা গেলো সে জোরে জোরে পড়তেছে The national flag is the symbol of independence…
.
২৭/০৪/২০১৯
#StayAtHome #StaySafe

বোধ

ঘটনা অনেক আগের, তখন আমার শৈশবকাল, বৈশাখের পাকা ধান কাটা হয়ে গেলে খোলা মাঠে ঘুড়ি উড়াতাম। গোপালপুর হাঁট থেকে দাদাকে দিয়ে লাল, নীল কাগজ আনিয়ে, বল্লা গোটার আঠা দিয়ে একটা ঘুড়ি বানিয়েছিলাম। তখন সাধারণত গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকতো, পড়াশোনার চাপও থাকতোনা তাই কাজ বলতে ছিল ঘুড়ি উড়ানো। সারাদিন উদাম গায়ে দৌড়ে দৌড়ে ঘুড়ি উড়াতাম, বিকেলে ঘুড়ির নাটাই গাছের সাথে বেঁধে সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম, কোনদিন আবার বৃষি্ট হলে ঘুড়ি উড়ানো হতোনা তবে ফুটবল খেলা হতো ঠিকই আর দিন শেষে দিঘীতে গোসল করে বাড়ি ফিরতাম।
.
একদিন আমার শখের ঘুড়িটা ভুল করে বারান্দায় রেখে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি, মাঝরাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি একটা ছোট বাচ্চা কুকুর আমার ঘুড়ির উপর আয়েশ করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, এটা দেখে আমার প্রচন্ড রাগ চাপে মাথায়। কী করা উচিত না ভেবেই মোটা একটা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত কুকুরটাকে দিলাম কষে এক বাড়ি। বাচ্চাটার মাজায় লাগলো আর লাফিয়ে পড়ে গেলো দু/তিন হাত দূরে, আর তার অসহায় সুরে কেঁউ-কেঁউ করে উঠলো কয়েকবার, তার করুণ আর্ত চিৎকারে হয়তো সেদিনের অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছিলো, হঠাৎ কান্নার শব্দে উঠানের আম গাছে থাকা কয়েকটা পাখিও চেঁচা-মেচি শুরু করে দিয়েছিলো কিন্তু এরপরও সেটাকে আর সেখানে থাকতে দেইনি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সকালে দেখলাম বাচ্চাটা ঠিকমতো হাঁটতে পারছেনা।
.
তারপর কয়েক বছর কেটে গেছে, তখন আর সেই দূরন্ত শৈশব নেই, ঘুড়ি উড়ানো, মাঠে ফুটবল খেলা সব কালের যাত্রায় হারিয়ে গেছে। একদিন কুষ্টিয়া থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম, মধুপুর বা গোপালপুরের কোন গাড়ি পাইনি। অগত্যা টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত আসতে হলো অন্য একটা গাড়িতে। এলেঙ্গা নেমে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় ১০ টা ছুঁই ছুঁই, কিছুক্ষণ রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু আমার গন্তব্যের কোন গাড়ি আসলোনা। তখন গাড়ির আশা ছেড়ে ভাবলাম মাসজিদে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালে চলে যাবো এই ভেবে ওখানের একটা মাসজিদের বারান্দায় গিয়ে ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হালকা তন্দ্রা আসছে এমন সময় কারো ডাকে তন্দ্রা কাটলো মাথা তুলে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ। তারা মাসজিদ কমিটির লোক, তারা আমাকে চলে যেতে বললো, এটা হলি আর্টিজেনে জঙ্গি হামলার পরের ঘটনা তখন দেশ ব্যাপী সতর্কতা চলছিলো। কোন ভাবেই তাদের বুঝাতে পারলাম না কিছু। নিরাপত্তার অজুহাতে তারা অবশেষে তাদের অপারগতার কথা জানালো, দু/একজন ক্ষিপ্তও হলো। রাগে দুঃখে বেড়িয়ে পড়লাম ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তায়, ভয়ে শঙ্কায় চোখ দিয়ে পানি আসছিলো, রাস্তায় এসে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে একটা কুকুর দু/তিনবার ডেকে উঠলো। তখন কেন জানিনা মনের অজান্তেই সেই কুকুরটার কথা মনে পড়ে গেলো….
.
৩০/০৩/২০২০
#StayAtHome #StaySafe

অন্তরালে

তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, বাড়ী থেকে যেয়েই পরীক্ষা দেই। সকাল ৯ টার দিকে বের হলে ফিরতে ফিরতে ৯ টা বা কোন কোন দিন আরও বেশি রাত হয়ে যায়। নাসীরাবাদ কলেজে পরীক্ষা হচ্ছে যার কারণে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড হয়ে আসতে কিছুটা দেরী হয় তাছাড়া প্রান্তিক পরিবহণের সার্ভিসও খুব একটা ভালোনা। তাই আমি আর আমার বন্ধু কামরুল বরাবরই আকুয়া বাইপাস হয়ে আসি।
.
প্রথমে ইসলাম পরিবহণ অথবা রাজিব পরিবহণে মুক্তাগাছা পর্যন্ত আসি তারপর সেখান থেকে সিএনজি হয়ে কালিবাড়ী তারপর সেখান থেকে আবার সিএনজি অথবা মাহিন্দ্রায় আসি মধুপুর পর্যন্ত। ছাত্র হবার অজুহাতেই হোক আর টাকা কম থাকার কারণেই হোক বরাবর ভাড়া দিতে আমরা একটু কার্পণ্যই করি, মানে দশ/পাঁচ টাকা করে কম দেই। এতে করে জন প্রতি কোন কোন দিন মূল ভাড়া থেকে প্রায় ২০ টাকা করে বেঁচে যায় তা দিয়ে আবার মধুপুর থেকে বাড়ী পর্যন্ত আসা যায়।
.
মুক্তাগাছা থেকে সিএনজিতে চড়লাম, তখন ট্রাফিক পুলিশ একটা আইন করে দিয়েছে, সিএনজিতে চারজনের বেশি নেয়া যাবেনা। অথচ তখনও কেউ কেউ পাঁচজন পর্যন্ত নেয়াটা বহাল রেখেছে। আমরা যে সিএনজিতে উঠলাম তিঁনিও প্রথমে চারজন তুলে পরে কিছুদূর এসে আবার পাঁচজন মিল করে রওয়ানা হলেন। যার কারণে কিছুটা দেরী হলো আর এর জন্য পিছনের ছিটে বসা এক ভদ্রলোক ড্রাইভারকে অনেক বকা ঝকাও করলেন কিন্তু তিঁনি কিছু বললেন না।
.
কিছদূর আসার পর ড্রাইভারের ফোন বেজে উঠলো, তিঁনি ফোন রিসিভ করে কানে দিলেন আর তাতেও পিছনে থাকা ভদ্রলোক বিস্তর রেগে গেলেন যার কারণে তিঁনি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে হ্যান্ডেলের উপরের দিকে সিএনজিতে যে একটু গর্তের মতো জায়গা থাকে সেখানে লাউড স্পিকার দিয়ে রেখে গাড়ীর গতি কমিয়ে দিলেন। ও পাশ থেকে ছোট একটা মেয়ের গলা শোনা গেলো সে তখন বলছেঃ
-আব্বা, তুমি কোনসুম আবা…? আম্মারতো অসুখ বাড়ছে, আমার জোন্যে আইজকা ব্যাগ আনবাই… লোকটা আস্তে করে “আচ্ছা আনমুনে” বলে বললো তোমার মার কাছে দেও। ওপাশ থেকে পিচ্চির মা বলতেছেঃ
-তোমারেতো আইজকা যাবার না করলাম, এহনতো আমার জ্বরটা বাইড়া গ্যাছেগা, ডাক্তার কইছিলো সেলাইন দেওন লাগবো, আর ও এহন ব্যাগের জোন্যে কান্দিতাছে…
-আমি আওয়ার সোময় ডাক্তার নিয়া আমুনি, এইডা শেষ ট্রিপ, এহন রাহো চলতি গাড়ি।
এই বলে লোকটা ফোন রেখে দিলো, সামনের ছিটে বসার কারণে তাঁদের কথোপকথন আমি ভালোভাবেই শোনলাম। পরে সিএনজি থেকে নামার সময় তিঁনি একা একাই বললেন “আমি চারজন করেই আনি আর চলতি গাড়ীতে মোবাইলও ধরিনা, আসলে আইজকা বাড়ীতে সমস্যা।” সেদিন আর অন্যদিনের মতো কম টাকা দিতে পারিনি। আর জানিনা পিছনের ভদ্রলোক কথোপকথনগুলো শুনেছিলেন কিনা…
.
১৫/০৪/২০২০
#StayAtHome #StaySafe
বিঃদ্রঃ করোনার এই কঠিন সময়ে এই শ্রেণীর মানুষের কাজ কর্ম নেই, আসুন খোঁজ নেই তাঁরা কিভাবে দিন কাটাচ্ছে, আসুন আমরা সবাই যার যার সাধ্য অনুযায়ী এদের পাশে দাঁড়াই…