প্রথম পর্বের পর -নূহ (আ.) ও রাজা মনুহ্: মহর্ষী মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক। তিনিই হচ্ছেন কোর’আনে বর্ণিত নূহ (আ.)। পুরাণে মহাভারতে তাকে বৈবস্বত্ব মনু, রাজা ন্যূহ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর উপরই নাযেল হয় বেদের মূল অংশ। তাঁর সময়ে এক মহাপ্লাবন হয় যাতে কেবল তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি বড় নৌকায় আরোহণ করে জীবনরক্ষা করেন। তাদের সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে রক্ষা পায়। তাঁদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে আবার মানবজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্যই হাদিসে নূহ (আ.) কে দ্বিতীয় আদম বলা হয়। হিন্দু ধর্মের মৎস্যপুরাণ গ্রন্থে এবং মহাভারতেও একই ঘটনার বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বৈবস্বত মনুর জীবনে এমনটিই ঘটেছিল। সেই মহাপ্লাবনের পর এই মনু থেকেই মনুষ্যপ্রজাতির বিস্তার ঘটে। এজন্য সনাতন ধর্মে কেউ কেউ মনুকেও মানবজাতির আদিপিতা বলে থাকেন।
সনাতন ধর্ম ও দীনুল কাইয়্যেমাহ: ইসলামের এক নাম দীনুল কাইয়্যেমা। শব্দটি এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ শাশ্বত, সুপ্রতিষ্ঠিত, চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। সনাতন অর্থও তাই। যে নীতি বা ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে সেটাই হচ্ছে সনাতন বা কাইয়্যেমাহ।
দুই জীবন: উভয় ধর্মেই ইহকাল ও পরকালের ধারণা রয়েছে। মো’মেনদের জন্য জান্নাত আর কাফেরদের জন্য জাহান্নাম। সনাতন ধর্মেও রয়েছে ধার্মিকদের জন্য স্বর্গ ও অধার্মিকদের জন্য নরক। ইসলাম বলছে জান্নাতে যাওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পুলসিরাত পার হতে হবে, আর সনাতন ধর্ম বলছে বৈতরণী নদী পার হয়ে বৈকুণ্ঠে যেতে হবে।
উপাসনা পদ্ধতি: উভয় ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেও অনেক মিল। কোরবানি ও বলিদান, সিয়াম পালন ও উপবাস, সুরা ও মন্ত্রপাঠ, যিকির ও যপতপ, হজ্ব ও তীর্থযাত্রা, সেজদা ও প্রণিপাত, তসবিহ ও যপমালা, উপাসনার ওয়াক্ত ও তিথি বা ত্রিসন্ধা ইত্যাদি বহুকিছু একই রকম।
মালায়েক ও দেবদেবী: ইসলামে সৃষ্টিজগৎ পরিচালনার জন্য অসংখ্য ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে তেমনি হিন্দু ধর্মে আছে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। এই ফেরেশতা ও দেবদেবী এক বিষয় কিনা এ নিয়ে ইসলামের আলেমদের মধ্যে অবশ্য মতভেদ রয়েছে, যেমনটা অধিকাংশ বিষয়েই তারা করে থাকেন।
এরকম উদাহরণ দিতে থাকলে হাজার হাজার দেওয়া যাবে। বেদ ও কোর’আনের যে আয়াত ও শ্লোকগুলো হুবহু একার্থবোধক তার তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। এত মিল থাকা সত্ত্বেও এই দুটো সম্প্রদায় একত্রে থাকতে পারছে না যে বিষয়গুলো নিয়ে সেগুলো হচ্ছে নিতান্তই ধর্মের গৌণ বিষয় যেমন খাদ্যাভ্যাস, উপাসনা পদ্ধতি, পোশাক-আশাক ইত্যাদি নিয়ে। এক সময় এদেশের মুসলমানেরাও ধুতি পরত, কিন্তু ধুতিকে হিন্দুর পোশাক বলা হচ্ছে। এসব অতি তুচ্ছ বিষয়। অমিলের বিষয়গুলো খুবই দুর্বল, কিন্তু মিলের বিষয়গুলো খুবই মৌলিক। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত মুসলমানদেরকেই। কেন সেটা বলছি।
আমরা জানি, আমাদের নবী কেবল আরবের নবী নন, তিনি বিশ্বনবী। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে। আল্লাহ নিজেও পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, হে নবী আপনি বলুন, আমি তোমাদের সকলের জন্য (জামিয়া) আল্লাহর রসুল (সুরা আরাফ ১৫৮)। তাঁর টাইটেল হচ্ছে রহমাতাল্লিল আলামীন, সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কোনো ভেদাভেদ রাখা হয় নি। এক সাহাবির উপর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছেন, তুমি দেখবে অচিরেই এমন সময় আসবে যখন একা একটা সুন্দরী মেয়ে সর্বাঙ্গে অলঙ্কারপরিহিত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে সা’না থেকে হাদরামাউত চলে যাবে, তার মনে আল্লাহ ও বন্য পশুর ভয় ছাড়া কোনো ভয় থাকবে না। এখানে বলা হয় নি যে সেই নারী হিন্দু, নাকি মুসলমান, নাকি খ্রিষ্টান বা ইহুদি। কাজেই এটি পরিষ্কার যে, নবী এসেছেন সমগ্র মানবজাতির অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এ দায়িত্ব আল্লাহই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরাই সেরা জাতি। তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে মানবজাতিকে (নাস) ন্যায়ের আদেশ করবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে (সুরা ইমরান ১১০)। আল্লাহ ও তাঁর রসুল কর্তৃক উম্মাহর উপর অর্পিত সুস্পষ্ট দায়িত্ব এটি, এ থেকে পলায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। তাই সকল জাতি, ধর্মের মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য বনী আদমকে এক কাতারে নিয়ে আসা উম্মতে মোহাম্মদীর দায়িত্ব। এজন্যই এ দীনের অন্যতম একটি নীতি আল্লাহ ঠিক করে দিয়েছেন যে, লা ইকরাহা ফিদ্দীন অর্থাৎ দীন নিয়ে জবরদস্তি চলবে না। দীন নিয়ে বাড়াবাড়িও চলবে না।
তাছাড়া মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত সকল নবী-রসুলদের প্রতি এবং আল্লাহর নাজেল করা সকল ধর্মগ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা। পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি প্রত্যেকটি জনপদে, প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষের জন্য নবী পাঠিয়েছেন। তাহলে এত বিরাট ও প্রাচীন জনপদ ভারতবর্ষে কি কোনো নবী আসেন নি, কোনো কেতাব আসে নি? অবশ্যই এসেছেন, তবে কালের আঘাতে তাদের শিক্ষাও বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের প্রতিও মুসলমানদের বিশ্বাস রাখা বাধ্যতামূলক। আল্লাহ নবী-রসুল পাঠিয়েছেন এক লক্ষ চব্বিশ হাজার অথবা দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার। তার মধ্যে কোর’আনে এসেছে মাত্র সাতাশ/আটাশ জনের নাম। বাকিদের অনুসারীরাও তো পৃথিবীতে আছেন, তাদেরকেও হেদায়াতের পথে আনার দায়িত্ব মুসলমানদের উপরই আল্লাহ অর্পণ করেছেন। কারণ তাদের কাছেই আছে শেষ কেতাব যেটা কেউ বিকৃত করতে পারে নি এবং শেষ নবীর আদর্শ। সেই আদর্শ উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আজও মানবজাতির আকাশে জাজ্বল্যমান। শেষনবী বাস্তবে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে অন্যসব জাতিধর্মের মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়।
কাজেই আমাদেরকে ছাড় দিতে হবে বেশি, আমাদেরকে উদার ও সহনশীল হতে হবে বেশি। আল্লাহর এই দীনের ঘরের দরজা অনেক বড়। এখানে গোটা মানবজাতি প্রবেশ করবে। ঐ দরজায় খিল লাগিয়ে তা সংকীর্ণ করা হবে আত্মঘাতী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত কয়েক শতাব্দী থেকে তা-ই করা হয়েছে। আজকের মুসলিম জাতির এই হীনতার কারণ ঐ দায়িত্ব থেকে পলায়ন করে শরিয়ার টুকিটাকি বিষয় নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি আর জবরদস্তি।
হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির ভূমিকা অগ্রণী হলেও হিন্দু সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব কম নয়। এটা চরম মূর্খতার পরিচয় যে আমরা এক স্রষ্টা থেকে আগত, এক জাতি, এক বাবা মায়ের সন্তান হয়েও এভাবে একে অপরকে বিধর্মী মনে করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে চলেছি। আমরা এক ভাই আরেক ভাইকে অশুচি অপবিত্র মনে করি। আচারের নামে এইসব অনাচার ধর্মের সৃষ্টি নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্টি। আমাদেরকে বুঝতে হবে, স্রষ্টা শুধু মসজিদে মন্দিরে চার্চে প্যাগোডায় থাকেন না। স্রষ্টা আর্ত-পীড়িত, নির্যাতিত মানুষের আর্তচিৎকারে ব্যথিত হন। অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা এই নির্যাতিত মানুষের দায়িত্ব শয়তান, অত্যাচারী, ডেভিল, দুর্বৃত্তদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য মসজিদ, মন্দির, গির্জায়, প্যগোডায় ঢুকেছেন। তারা ধর্মকে বাস্তবজীবনের সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে না দেখে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা, উৎসব, উপাসনা, পূজা-প্রার্থনার বস্তুতে পরিণত করেছেন। তারা নবী-রসুল ও অবতারদের প্রাণান্তকর সংগ্রামকে অবজ্ঞা করে চলেছেন। তারা ধর্ম ত্যাগ করে লেবাস ধরেছেন। তারা মানুষকে জানতে দিচ্ছেন না যে, সকল ধর্মেই ধর্মব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমরা যারা প্রকৃতপক্ষেই স্রষ্টার সান্নিধ্য চাই, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোজা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানুষের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের লক্ষ্য, সকল ধর্মের আত্মা। তাইতো ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, ইসলাম শব্দের অর্থও শান্তি। এজন্য মানুষের কল্যাণসাধনই প্রকৃত এবাদত। যে ধর্ম মানবসমাজে শান্তি দিতে পারে না, সেটা প্রকৃত ধর্ম নয়, সেটা ধর্মের লাশ। আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোকে প্রাণহীন লাশ বানিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই লাশকে নিয়েই ব্যবসা করছেন কথিত আলেম ও পুরোহিত গোষ্ঠী। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকেও যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে চার বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় তখন সেই অন্যায় অবিচার বন্ধ না করে, তার ন্যূনতম প্রতিবাদও না করে যারা মসজিদে-মক্কায় গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, মন্দিরে গিয়ে দুধ-কলা দিয়ে, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। চলমান … পর্ব তিন
'সকল ধর্মেই ধর্মব্যবসা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আমরা যারা প্রকৃতপক্ষেই স্রষ্টার সান্নিধ্য চাই, তাদেরকে বুঝতে হবে যে, নামাজ, রোজা, উপবাস, উপাসনা, পূজা অর্চনা ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মানুষের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠাই সকল ধর্মের লক্ষ্য, সকল ধর্মের আত্মা। তাইতো ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, ইসলাম শব্দের অর্থও শান্তি।' আপাত দৃষ্টিতে পাঠক হিসেবে বলতে পারি, পোস্টে বর্ণিত কথায় যুক্তি আছে।
ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় ।
যে ভাবে গুছিয়ে এবং তাত্মিক দিক গুলোন বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনার পোস্ট থেকে কেবল শেখারই আছে। বিতর্কে যাওয়াটা সমীচিন মনে হবে না। কেননা অতো শিক্ষা আর মগজ আমার নেই। লেটস্ গো।
ধন্যবাদ দাদা …
ভয় ধর্মের উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেও অনেক মিল। কোরবানি ও বলিদান, সিয়াম পালন ও উপবাস, সুরা ও মন্ত্রপাঠ, যিকির ও যপতপ, হজ্ব ও তীর্থযাত্রা, সেজদা ও প্রণিপাত, তসবিহ ও যপমালা, উপাসনার ওয়াক্ত ও তিথি বা ত্রিসন্ধা ইত্যাদি বহুকিছু একই রকম।
হুম কথায় যুক্তি আছে। লেখাটি হাল্কা মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে এটা কোন প্রকাশনা।
ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবো না … শ্রদ্ধা জানবেন।
আমি আসলে এবিষয়ে কোন তর্কে যাবো না । আমি চেষ্টা করছি উভয় ধর্মের মিল গুলো তুলে ধরার জন্য। এ বিষয়গুলো যে আপনাকে মানতেই হবে এমন কিছু নয়। পোস্টগুলো পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার একটি পোস্টে হেযবুত তওহীদ এর লক্ষ্য এবং কর্ম পদ্ধতি পড়েছিলাম। এই পোস্ট কি বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক সংগঠনের প্রচার বা বিশ্বাসীদের মুখপত্র (সাইকোলজিকেল) কিনা জানাবেন। আগ্রহ বোধ করছি। ধন্যবাদ ভাই।
প্রথমে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি পোস্টটি পড়ার জন্য। আপনি যে বিষয়টি আগ্রহ বোধ করছেন নিশ্চয় আপনাকে সে বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করবে ।