আবু মকসুদ এর সকল পোস্ট

মকাইশা মোকাম্মিল

মোকাম্মিলকে আমি ডাকি ‘মকাইশা’, আমরা যখন ছোট তখন মকাইশা নামে এক অদ্ভুত, অলৌকিক মানুষ আমাদের পাড়ায় আসতেন। তিনি আমাদের খুব পছন্দের মানুষ ছিলেন; তাঁর বিচিত্র আচার-আচরণের জন্য। আমাদের পাড়ায় যতগুলো টিউবওয়েল ছিল প্রত্যেক টিউবওয়েলে তাঁর একছত্র রাজত্ব। টিউবওয়েলের পানি তাঁর কথা শুনতো তিনি যা চাইতেন টিউবয়েলের পানি তাই করতো, ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর মাথায় পানি ঝরতেই থাকতো, ঝরতেই থাকতো।

টিউবওয়েলের পানি যেভাবে তাঁর অনুগত ছিল, আমরাও ঠিক সেভাবে তাঁর অনুগত, ভক্ত ছিলাম। তিনি যা বলতেন আমরা তাই করতাম। আমাদের যে ছোটখাটো রাজত্ব ছিল, আমরা তাঁকে সেই রাজত্বের রাজা হিসাবে স্বীকার করেছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, তাঁর বাঁশির ডাকে আমরা ছুটে বেরিয়ে আসতাম। তিনি বললে আমরা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

আমরা বড় হতে শুরু করলে তিনি তিরোহিত হলেন, কিন্তু তাঁর চিহ্ন থেকে গেল আমাদের হৃদয়ে। বন্ধুবান্ধব যখনই একত্র হই মকাইশাকে খুঁজতে থাকি, ইচ্ছে করে পুনরায় শৈশবে ফিরে যাই, ইচ্ছে করে টিউবওয়েলে ঘন্টার পর ঘন্টা মাথায় পানি ঢালি।

মোকাম্মিলের মাঝে মকাইশার কিছু চিহ্ন আছে। সেও অদ্ভুত স্বভাবের, তার সম্মোহনের ক্ষমতা অসাধারণ! একদিন লক্ষ্য করলাম আমরা তাকে অনুসরণ করছি। একদিন সে আমাদের দলনেতা হিসেবে দেখা দিল।

দেশে গেলে মোকাম্মিল ছাড়া আমার জীবন অচল। বিশ্বাস করুন এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, মোকাম্মিল ছাড়া দেশের কোন আকর্ষণ নেই। আমি যদি বাসা থেকে এক ফুট দূরত্বে যাই, মোকাম্মিলকে সাথে থাকতে হয়। যদিও আমি দেশ থেকে বড় হয়ে এসেছি তবুও কেন জানি মনে হয় মোকাম্মিল সঙ্গে না থাকলে আমি হারিয়ে যাব। অথবা কেউ আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে। যতদিন দেশে থাকি নিজের চেয়ে মোকাম্মিলের উপর ভরসা করতে হয় বেশি।

ব্যক্তিগতভাবে মোকাম্মিল আমার ওস্তাদ। আমার জীবনের ‘প্রথম’ অনেক কিছু তার কাছে শিখেছি। দু একটা উদাহরণ দেই: সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর সবাই জানি, আমাদের পারিবারিক শৃঙ্খলার মাঝে সিগারেটের কোন স্থান নেই। এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকে। আমাদেরও ছিল; কিন্তু নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে স্বর্গচ্যুত না হওয়া কীভাবে সম্ভব মোকাম্মিল সেটা শিখিয়েছিল। সিগারেট খেয়ে কচি লেবুর পাতা কতক্ষণ চিবুলে সিগারেটের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়, হাতের আঙ্গুলেও যাতে নাসির বিড়ির দুর্গন্ধ না থাকে সেজন্য কচি লেবুর পাতার রস বানিয়ে হাতে মাখতে হয়।

দুই টাকার বিনিময়ে কুসুমবাগে সিনেমা দেখা যায় সেটাও তার কাছে শেখা। কুসুমবাগের তখনকার যে টিকেট কন্ট্রোলার ছিলেন, তাকে দুই টাকার ঘুষ দিলে তিনি আমাদের থার্ড ক্লাসে বসিয়ে দিতেন, বিরতির পূর্বে শুধুমাত্র ১৫ মিনিটের জন্য বাইরে আসতে হতো তখন হল মালিকের নির্বাচিত লোক পরিদর্শনে আসতো, পরিদর্শন শেষ হওয়া মাত্র পুনরায় সিনেমা দেখার সুযোগ পেতাম।

শবেবরাতের নফল নামাজের জন্য মসজিদের প্রতিটি কোনা যে কভার করা লাগে সেটাও মোকাম্মিলের কাজ থেকে শেখা। আল্লাহ তাঁর রহমত মসজিদের কোন কোনায় বর্ষণ করছেন সেটা আমরা জানি না, সব কোনা কাভার হয়ে গেলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হলাম না পরীক্ষা পাশও সহজ হয়ে গেল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক যে শেখ মুজিবুর রহমান এই সত্য সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছিল। তখন খাল কাটার জমানা, বাজারে সাধারণ জ্ঞানের অসংখ্য বই বেরিয়েছে। আমাদের জায়গীর মাস্টার চাকরির ধান্দায় এসব বই গোগ্রাসে গিলছে। সাধারণ জ্ঞানের এক বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে দেখেছিলাম সানগ্লাস মেজরের নাম।

মোকাম্মিল বলেছিল এসব মিথ্যা; মেজর কোনভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারে না তার সেই অধিকার নেই। স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার একমাত্র বঙ্গবন্ধুর, তখন গুগল জামানা ছিল না তাই দলিল, দস্তাবেজ দেখিয়ে প্রমাণ করার সুযোগ ছিল না কিন্তু যাকে সাক্ষী মেনে ছিল তাঁর সত্যবাদীতার কাছে হাজারটা গুগল পৌঁছাতে পারবে না। সাক্ষী ছিলেন সৈয়দ আমজাদ আলী, মোকাম্মিলের পিতা। সত্যবাদিতা এবং সৈয়দ আমজাদ আলী সমার্থক ছিলেন। আমাদের শহরে তাঁর সত্যের সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কেউ ছিল না। সত্যের মূর্তপ্রতিক যখন বললেন শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক; সন্দেহ করার তিল পরিমাণ অবকাশ থাকল না।

মোকাম্মিল সম্পর্কে আমার চাচা, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক কোনদিনই চাচা ভাতিজায় রূপ নেয়নি। সেরকম সম্ভাবনা ছিল না। আমাদের জন্ম প্রায় একসাথে দু-চার দিনের কম বেশি হতে পারে, বাসা পাশাপাশি। আমরা যখন বড় হই তখন কে কোন বাসার সে চিন্তা মাথায় আসেনি আমি যেমন অনায়াসে তাদের পাক ঘরে ঢুকে খাবার খেতে পারতাম, সে ঠিক তেমনি আমার সাথে এক পাতে খেতে বসে যেত। মোকাম্মিল আমার বন্ধু, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। যে গোপন কথা বিবাহিত বউকে বলা যায় না; সে গোপন কথা মোকাম্মিলের সিন্দুকে আজীবন নিরাপদ থাকে।

আমার গায়ের রং কৃষ্ণ অর্থাৎ কালো মোকাম্মিল ফর্সা, মহাভারতের জমানা হলে সব গোপিনী আমার জন্য পাগল হতো কিন্তু এটা কলিকাল। এটা বুক ফেটে যাওয়ার জমানা; আমার ভাগ্যে কোনদিনই কোন গোপিনী জোটেনি, যাকে পছন্দ করি সেও আমার সামনে দিয়ে মোকাম্মিলের হাত ধরে চলে যায়। তবে ভাতিজার জন্য, প্রাণের বন্ধুর জন্য মোকাম্মিল চেষ্টা করেছে অনেক, তাকে পছন্দ করা গোপিনীদের আমার কাছে ভিড়াতে চেয়েছে, কিন্তু কলিকালের কারণে কেউ রাধা হতে রাজী হয়নি।

আমার দুঃখের এক বয়ান দিয়ে এই লেখার সমাপ্তি করি। মোকাম্মিলের সাথে ঢাকায় যাচ্ছি, ট্রেনে শ্রীমঙ্গল থেকে। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে এমন সময় এক তরুণী আমাদের কামরায় উঠে এলো তরুণীর আলোয় ঝলমল করে উঠলো কামরা। মোকাম্মিল এবং আমি সামনাসামনি বসেছি। আমার পাশের সিট খালি, মোকাম্মিলেরও। তরুণী একবার আমার দিকে তাকিয়ে মোকাম্মিলের দিকে তাকাল, তারপর বলল ‘ভাইয়া আপনার পাশে কী একটু বসতে পারি’। মোকাম্মিল সায় দিলে বসে পড়ল, একটু ধাতস্থ হওয়ার পরে আমার দিকে চেয়ে বলল ‘চাচা কী ঢাকা পর্যন্ত যাচ্ছেন…’

আমার তখন মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা…

তিয়া কিংবা ফিরে আসা তেতুল গাছ

তিয়া তার মায়ের উপর রাগ করেছে, খুব কঠোর রাগ। অকারণে মা তাকে বকেছে। ম্যাক কে শুধু চুমু খেয়েছে, ফিজিক্যাল হয়নি; এতেই মা ম্যাডের মত ব্যবহার করেছে।

তিয়া জানে সে সতেরো, পুরোপুরি এডাল্ট নয়। মায়ের নিষেধ আঠারোর আগে কোন ছেলের সাথে ফিজিক্যাল হওয়া যাবে না। সে এডাল্ট নয় মনে ছিল, তবুও ম্যাকের অনুরোধ না করতে পারেনি। শুধুমাত্র ওয়ান লিপকিস, তাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য।

মা তার প্রতি অতিরিক্ত কঠোর, সব সময় চোখে চোখে রাখে। সে আঠারো নয় এজন্য তার যেন কোন স্বাধীনতা নেই। তার বয়সের অন্য মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডের সাথে অনেক আগে ফিজিক্যাল হয়েছে, সে এখনো ভার্জিন।

তিয়া মন খারাপ করে বসে আছে। সে অপেক্ষায় আছে কবে আঠারো হবে, কবে মায়ের পিঞ্জর থেকে মুক্ত হবে।

তিয়ার বাবা সামাদ এতো রক্ষণশীল নন, তিনি কারো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার ঘোর বিরোধী তবু স্ত্রীর সামনে তিয়ার পক্ষ নিতে পারেন না। আঠারো পর্যন্ত তিয়ার স্বাধীনতা সীমিত। মা-বাবার কথা শোনা ছাড়া অন্য উপায় নাই।

বাবা ফিরলে তিয়া মায়ের অভিযোগ করে। বাবাকে বলে ‘আমি তোমাদের চাকর নই, তোমাদের মেয়ে, আমার সাথে চাকরের মত ব্যবহার করতে পারো না। আই হ্যাভ নট ডান এনিথিং রং, শী শুড নট হ্যাভ সাউটেড অ্যাট মি, ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট মি হিয়ার আই ক্যান লিভ, আই ক্যান স্টে উইথ ম্যাক, হিজ প্যারেন্ট ওন্ট মাইন্ড’।

বাবা তিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। বুঝাবার চেষ্টা করেন মা তাকে ভালবাসে, তার ভাল চায়। এইজন্য একটু কঠোর হয়। বাবা বলেন ‘ইউ নো শী ওয়ান্ট দা বেস্ট ফর ইউ, শী ওয়ান্টস ইউ টু আন্ডাস্ট্যান্ড গুড এন্ড ইভল’। তিয়া বলে ‘আই নো হোয়াট ইজ গুড ফর মি’। বাবা বলে ‘সিওর ইউ ডু, বাট প্যারেন্টস ডিউটি ইজ টু বি কন্সার্ন’। মেয়েকে কোন রকম শান্ত করে স্ত্রীর কাছে যান।

দুপুর বেলা ম্যারি স্কচ হাতে নিয়ে বসে আছে, তার মুখ থমথমে। সামাদ ভয়ে ভয়ে বলে ‘ডোন্ট বি টু হার্স অন হার ম্যারি, শী ইজ অনলি এ চাইল্ড’। ‘একজ্যাক্টলি শী ইজ অনলি এ চাইল্ড, শী শুড নো হার লিমিট’।

‘বাট’ সামাদ আরো কিছু বলতে চাইলো। ম্যারি তাকে থামিয়ে বলল ‘উড ইয়োর সোসাইটি এক্সেপ্ট ইট’? ‘উই আর নট ইন আওয়ার সোসাইটি ম্যারি’। সামাদ বলে। ‘বাট শী ইজ স্টিল ইয়োর ডটার’ ম্যারির উত্তর। ‘হোয়াই ডাজ নট শী আন্ডারস্ট্যান্ড শী এজ ফ্রম এ ডিফরেন্ট কালচার, আই নো উই লিভ ইন ওয়েস্টার্ন ওয়াল্ড, উই ক্যান নট পুট টু মাচ প্রেসার অন হার, বাট শী ক্যান নট ডু হার উইল আনটিল শী ইজ এইটিন, দ্যাটস ফাইনাল’।
ম্যারির সাথে কথাবার্তা আর এগুনো যাবে না ভেবে সামাদ পুনরায় মেয়ের কাছে আসে, মেয়েকে বুঝায় আর মাত্র এক বছর। তারপর সে পূর্ণ স্বাধীন। তিয়া বলে সে যদি ম্যাকের সাথে ফ্লেক্সিবল না হয় ম্যাক অন্য কারো কাছে চলে যাবে। ‘প্লিজ বি প্যাসেন্স মাই ডটার’। সামাদ বলে।

ম্যারি প্রায় বলে ‘ইউ হ্যাভ ফরগটন ইয়োর রুটস সামাদ’। সামাদ কিছু বলে না। একচল্লিশ বছরের মাঝে একবারও দেশে যায়নি, ম্যারি মিথ্যা বলে না। সামাদের কোন রুটস অবশিষ্ট নেই। গ্লাসে স্কচ ঢেলে বসার ঘরে চলে যায় সামাদ। অনেককাল আগে সে যখন দেশে থাকত তখন সতেরো বছরের একটা মেয়ে তেতুল গাছে ঝুলে ছিল, আত্মহত্যা না মেরে কেউ ঝুলিয়ে ছিল জানতে পারেনি। সে তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার বয়স তখন আঠারো হয়নি।

সামাদ পালিয়ে ইংল্যান্ড চলে এসেছিল, রিয়াকে তার বাবা চাচারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তার লাশ ঝুলেছিল তেতুলের গাছে।

সঞ্জীবনী বুবাই এবং নিম গাছ

আমাদের বাসার সামনের দিকে এক চিলতে উঠান ছিল, এক চিলতেই। সেই উঠানে জাম গাছের পাশাপাশি নিম গাছ ছিল। জাম গাছের ব্যাস, ব্যাসার্ধে নিম গাছকে অন্ত্যজ মনে হত। আমাদের সবার দৃষ্টি জাম গাছের দিকে ছিল, অর্থাৎ জাম গাছ ঘিরে আমরা যেভাবে শোর তুলতাম সে তুলনায় নিম গাছের দিকে ফিরেও তাকাতাম না।

জাম মৌসুমি ফল, স্থায়িত্ব খুব বেশি নয়। তবু বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাস জামের মাস; জিহ্বা রঙিন করতে জামের কোন বিকল্প নেই। এই দুই মাস জাম গাছের তলায় উৎসব হত, আমাদের সেই এক চিলতে উঠান জাম কলরবে সরব হয়ে উঠতো।

পক্ষান্তরে পাশের নিম গাছ নিজের আভিজাত্যহীনতায় এই দুই মাস আরো কুঁকড়ে যেত। আমাদের জীবনে জামের প্রয়োজন থাকলেও নিমের প্রয়োজন তেমনভাবে কোনদিন অনুভব করিনি। নিম ঔষধি গাছ কিন্তু অসুখ হলে আমরা সোজা ডাক্তারের চেম্বারে দৌড় লাগাই, নিমের কোন চিন্তা মাথায় আসে না।

ছোটবেলা অসুখ-বিসুখ আমার লেগেই থাকতো, খোস পাঁচড়া, সর্দি কাশি নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। আমি প্রায় সময়ই মাটিময় থাকতাম, অর্থাৎ মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খুব ভালো লাগতো। আম্মা কিংবা বড় আপা হয়তো আমাকে গোসল করিয়ে স্নো পাউডার মাখিয়ে বাবু সাজিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসিয়ে রেখে গেছেন। তারা ফিরে আসতে আসতে দেখা গেল আমি যুদ্ধ জয় করে বারান্দায় উঠে আসছি। আমার গায়ে এবং কাপড়ে কাদামাখা। গতকাল বৃষ্টির পরে উঠানে যে পানি জমেছিল এইমাত্র সেখান থেকে সাঁতরে এলাম।

আমাকে পুনরায় গোসল করানো অহেতুক ভেবে বড় আপা অথবা আম্মা টাওয়াল ভিজিয়ে গা মুছে দিতেন। আমি আমার জগতে খুব সুখী ছিলাম খোস পাঁচড়া, সর্দি কাশি তেমন কাহিল করতে পারত না। যদিও আমার নাসিকা অন্তহীন নদীর মত ছিল তবু যেকোনো জলাধার আমাকে আকর্ষণ করত, সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সেটা উঠানের গর্ত হলেও।

একবার আমাকে বেশ বড়সড়ো অসুখে ধরলো, সারা গায়ে গুটি গুটি ফোড়া দেখা গেল। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলল পানি বসন্ত। বসন্ত যদিও আমার পছন্দের ঋতু ছিল কিন্তু এই বসন্ত কোনভাবেই পছন্দ হলো না। সারা গায়ে চুলকানি, দিনে দুই তিনবার জ্বর আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই অসুখের কারণে আমি মাটি থেকে দূরে আছি, বাসার কেউ আমাকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দিচ্ছে না। আমি ডাকঘরের অমলের মত জানালায় বসে তৃষিত দৃষ্টিতে উঠানে চেয়ে থাকি যেখানে গতকালের বৃষ্টি এখনো জমে আছে।

পানি বসন্তের যত রকম ঔষধ তখনকার সময়ে উপলব্ধ ছিল সব ব্যবহার করে দেখা হয়ে গেছে, কাজে লাগছে না। এলোপ্যাথিক ছাড়াও হোমিওপাত, কবিরাজি প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমাদের বাসায় আম্মার যে সহকারি ছিলেন আমরা সবাই থাকি ‘বুবাই’ বলে ডাকতাম। ‘বুবাই’ অর্থ বড় বোন। আমার জন্মের পরে আম্মা কিছুদিন সুতিকা রোগে ভুগেছিলেন। তখন আমাকে রক্ষণাবেক্ষণ, লালন পালন করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই ‘বুবাই’।

আমার অসুখে পুনরায় ক্রাতা হয়ে এলেন এই ‘বুবাই’। তিনি আম্মাকে বনজ সমাধান বাতলে দিলেন। তখনই নিম গাছের প্রয়োজন পড়লো। যে নিমগাছ বছরের পর বছর অবহেলিত ছিল, সেই নিম গাছ আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো। গরম পানিতে নিম পাতা ভিজিয়ে রেখে সেই রস হালকা প্রলেপে সারা গায়ে মাখিয়ে নিলে পানি বসন্ত উপশম হয়। অন্তত আমার জন্য এই টোটকা খুবই কার্যকরী ছিল।

আমার মারাত্মক রকম পানি বসন্ত হয়েছিল, সারা গায়ে চামড়া দেখা যেত না এমন। আমার এই অসুখে আব্বা, আম্মার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছিল। আমি হাত পা নাড়ছি, কাপড়ে কাদামাটি মাখছি অর্থাৎ বাসা জেগে আছে, আমি মনমরা হয়ে বসে আছি অর্থ বাসা বড় কোন বিপদে পড়েছে। আব্বা, আম্মা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে।

‘বুবাই’ এবং নিমের বদান্যতায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। যে নিম গাছের প্রতি আমাদের অবহেলার শেষ ছিল না সেই নিম গাছ আমাদের প্রার্থনা পেতে থাকলো বিশেষ করে আব্বা, আম্মার।

আমরা এখন নিয়মিত নিমের পরিচর্যা করি, আগাছা উপড়ে ফেলি, পানি ঢালি। নিম গাছ দীর্ঘদিন আমাদের এক চিলতে উঠানের গৌরব ছিল। তাকে আমরা প্রচুর কাজে লাগিয়েছি। খোস পাঁচড়া, পেটের পীড়া, ত্বকের নানায় সমস্যার তার স্মরণাপন্ন হয়েছি সে সাধ্যমত উপশম দিয়েছে। কালের পরিক্রমায় সেও একদিন চলে যায়, জাম গাছ আগেই গিয়েছিল। সেই এক চিলতে উঠান আর নেই, ইটের দালান তার দাপট দেখিয়ে জাম নিমকে সাবার করেছে।

পরবর্তীতে আমার আর পানি বসন্ত হয়নি। অনেকদিন পরে আমার ছেলের যখন পানি বসন্ত হল দেখলাম সেও আমার মত ছটফট করছে। ডাক্তারের পরামর্শে ক্যালামাইন লাগিয়েও যখন উপশম হচ্ছে না তখন ইচ্ছে করলো উড়াল দেই পেড়ে আনি কিছু নিমপাতা। কিন্তু চাইলেই উড়াল দেওয়া যায় না, নিম গাছও আর অপেক্ষায় বসে নেই…

সর্পবিদ কিংবা গুরু

নাগেশের সাথে প্রথম পরিচয় ভীতিকর ছিল। স্কুলের সীমানা দেয়াল ঘিরে যে প্রাচীন বটগাছ তার ফাঁকফোকরে সাপের আস্তানা। নাগেশ প্রায় দিন স্কুলের সামনে দিয়ে কোর্টে যায়, কোর্টের সামনে বাবার সাথে সাপের খেলা দেখায়।

বটগাছের নীচে বাদামওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা, আচারওয়ালা। তাদের ঘিরে আমরা। হঠাৎ এক পাতালতি গাছ থেকে নেমে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। আমরা যারা নিজেদের বিজয়ী ভাবি, যাদের অভিধানে ভয় বলে কোন শব্দ নেই; তারা পিচ্ছি এক সাপ দেখে প্রাণের ভয়ে পালাতে থাকি।

সাপ দেখে আত্মা প্রায় খাঁচাছাড়া এমন সময় রিক্সা থেকে নেমে নাগেশ আসে, পোষা বেড়ালের মত সাপকে মুঠোবন্দী করে ঝুড়িতে ভরে। দূরত্বে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে নাগেশকে দেখি, এই প্রথম আমাদের মস্তক নত হয়ে আসে। নিজেদের নির্ভয় ভাবনায় এই প্রথম সন্দেহ লাগে, এই প্রথম মনে হয় নাগেশের সাহসের তুলনায় আমরা অতি নগন্য। তার কাছে আমাদের আত্মগরিমা খাক হয়ে যায়।

আমাদের বয়সী একটা ছেলে সাপকে কাবু করতে পারে এটা একটা বিস্ময়। আমরা নাগেশের বন্ধু হওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠি। তাকে গুরুর আসনে স্থান দিতে ব্যগ্র হয়ে উঠি। যে সাপকে জয় করতে পারে তার কাছে অজেয় কিছুই থাকবে না এই ভাবনা আমাদের উদ্বেলিত করে। তাঁর নেতৃত্বে আমরা অজেয় কে জয় করব।

নাগেশ আমাদের বন্ধু হয়ে যায়। বন্ধু না হলেই ভাল হত। যে উৎসাহ, যে উদ্দীপনা, যে আগ্রহে তাকে বন্ধু বানাই সে আগ্রহ দুদিনেই ফুটো হয়ে যায়। সাপের খেলা ছাড়া নাগেশের আর কিছু আসে না। সে অংক কষতে পারে না, দুই ভাগ হাইড্রোজেন এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে কি হয় জানে না। আহ্নিক গতি কাকে বলে তাও জানে না।

তাকে নিয়ে পৃথিবী জয়ের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম; মরে যায়। দেখা যায় সে অতি সাধারণ, সাপ বশ ছাড়া কোন বিশেষত্ব নেই। আমরা আমাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

স্কুল থেকে কলেজ। আমাদের রাজ্যের পরিধি বেড়ে যায়। সহপাঠিনীর ওড়না কার মুখের ঘাম মুছে দেবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ি। প্রতিদিন মিছিল মিটিং নাগেশের সাথে সঙ্গ কাটানো, সাপ খেলা দেখার সময় হয় না।

তখন এরশাদের জমানা। বিশ্ব বেহায়া এখানে সেখানে লাশের বিছানা ফেলছে। আমরাও বদ্ধ পরিকর; যেকোনো মূল্যে এই বেহায়াকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

এরশাদ বিরোধী মিছিলে গগনবিদারী স্লোগান দিচ্ছি, আজ তাকে সরে যেতে হবে। এরশাদও শেষ কামড় দিতে প্রস্তুত। তার পোষ্য পুলিশ মিছিলে গুলি চালিয়েছে, সবাই ছত্রভঙ্গ; যে যার মত পালাচ্ছে।

পালিয়ে যাব এই চিন্তা যখন মাথায় এসেছে তখনই দেখতে পেলাম একটা তপ্ত সীসার বুলেট আমার দিকে ধেয়ে আসছে, কিছু বুঝার আগেই রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কে যেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সীসার বুলেট নাগেশের বুক বিদীর্ণ করে গেল।

নাগেশ সাপের খেলা দেখাত। সাপকে কিভাবে পোষ মানাতে হয় জানত কিন্তু বন্ধুর প্রাণ বাঁচাতে সেই সাপের ছোবলে মারা গেল।

এরশাদ সরে গেছে কিন্তু মরে যায় নি। কিছুদিন গর্তে অবস্থান করে বিপুল বিক্রমে ফিরেছে। আহ্নিকগতির জ্ঞান রাখা অনেকে তার সঙ্গী হয়েছে। একদিন যারা তার ছবিতে থুথু ছিটাত তারাই এরশাদের থুথু ভক্ষণ করেছে।
আমরা অংক কষি, বিজ্ঞান চষি। অনেক বিষয়ে পারদর্শী কিন্তু আমাদের চরিত্র বেহায়ার চেয়েও খারাপ। নাগেশ সাপ সঙ্গ পছন্দ করেছিল, চরম অবিশ্বাসী সাপ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করলেও আমাদের নগর সাপ তাকে লাশ বানিয়ে ছাড়লো।

আমরা তাকে নেতা হিসাবে চেয়েছিলাম, গুরু হিসাবে চেয়েছিলাম; সে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে। আমরাই যোগ্য শিষ্য হতে পারিনি…

শান্তিপদ

নীতি কথার শান্তি বাবার অশান্তি ধরা পড়েছে, তাকে টেবিলের পায়ার সাথে দড়ি দিয়ে বাধা হয়েছে। স্কুলের সভাপতির কাছে খবর গেছে তিনি এলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত।

শান্তি বাবু স্কুলের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক। স্কুলে যেভাবে সমাজের ভালমন্দ নিয়ে উপদেশ দেন, স্কুলের বাইরেও তার উপদেশ বর্ষণের জ্বালায় টিকা মুশকিল।

শিক্ষক মানুষ উপদেশ দিতে চাইলে শুনতে হয়; না শুনে উপায় থাকে না। স্কুলে এবং স্কুলের বাইরে তাকে ভাল, আদর্শবান মানুষ হিসাবে সবাই চিনে, জানে।

মুশকিল হল যারা অতি মাত্রায় আদর্শ কপচায় তাদের নিজের ভিতরে থাকে অন্ধকার। শান্তিপদ শর্মা নিজের ভিতরের অন্ধকার আড়াল করতে অন্যকে উপদেশ বর্ষণ করে।

নন্দিতা ক্লাস সিক্সের ছাত্রী দেবতুল্য শান্তিপদ তার জামা খুলতে চেয়েছে, এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ক্রমাগত কাঁদছে তার বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়েছে।

শান্তিপদের স্বরূপ উন্মোচিত হলে সবাই অবাক হয়, বিশেষ করে তার ছাত্ররা; যারা তাকে দেবতা জ্ঞানে পুজা করত।

বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে প্রথমেই উপরের ক্লাসের ছাত্রছাত্রী কিলঘুসি দিতে এগিয়ে আসে। শিক্ষকেরা দ্বিধান্বিত বাধা দেবেন কী দেবেন না। স্কুলের দপ্তরী জগদীশ দড়ি জোগাড় করে টেবিলের পায়ার সাথে বেধে ফেলে।
স্কুলের সভাপতি এসেছেন; আসার পথে পুলিশকে ফোন করেছেন। কিছুক্ষণ পরে পুলিশও হাজির। শান্তিপদ শর্মা পুলিশের মেহমান হয়ে চলে গেল।

শান্তিপদের মেয়ে স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী, বাবা চলে যাওয়ায় তার ভীষণ মন খারাপ। জামা খুলতে চাওয়ায় পুলিশে দিতে হবে কেন! বাবাতো প্রায়ই তার জামা খুলে…

মানুষ

আমাকে যখন বলা হয় মানুষের কাছে যাও
আমি ঘাসের কাছে মনের দুঃখ বলি…

যখন বলা হয় দেখ মানুষের মুখ
আমি উড়ন্ত পাখির ডানায় নীলাকাশ দেখি

মানুষের তৈরি ভজনালয়ে যখন মাথা ঠেকানোর
উপদেশ বর্শিত হয়
আমি নদীর আঁজলা আঁজলা জলে
মুখ ধৌত করি

মানুষ পাঠের ইচ্ছা মরে গেছে
মরে গেছে মানুষ হওয়ার ইচ্ছা

একটা পতঙ্গ যতটুকু কল্যাণ করতে পারে
তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারে না মানুষ

তবু কেউ কেউ মানুষের পুজা করে
আর মানুষ সেই পুজারিকে হত্যা করে…

হৃদয়ের পোস্টমর্টেম

‘আমার শরীরে ব্রিটেনের রক্ত’ এই কথা শুনে আতকে উঠেছে আমার প্রাণের বন্ধু। যদিও পরিষ্কার কিছু বলেনি তবু বোঝা যায় সে আমাকে লোভী ভাবছে। একটু আরাম-আয়েশ আর ক’টাকার লোভে নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে আছি। তার ধারণা আমি আপাদমস্তক একজন লোভী তাই দেশ নিয়ে কোনো কথা আমার খাটে না। দেশ নিয়ে কোন মন্তব্য করা আমার সাজে না।

আমি লোভী অস্বীকার করছি না। একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, ভালো পরার লোভ আমাকে দেশান্তরি করেছে এটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এর বিপক্ষে বা পক্ষে আমি হাজারটা যুক্তি দিতে পারি কিন্তু সেসবে না গিয়ে শুধু বলব আমি দেশান্তরি হয়েও এক মুহূর্তের জন্য দেশ ত্যাগ করতে পারিনি। ৩৫ বছর ধরে দেশ থেকে দূরে আছি কিন্তু দেশ আমি থেকে দূরে নেই।

এখনো প্রতিটি সকাল আমি দোয়েলের ভোর দেখি, এখনো প্রতিটি দুপুরে ঘোর লাগা ঘুঘুর ডাক শুনি, এখনো প্রতিটি গোধূলি পশ্চিমের সূর্য হয়ে মনে ধরা দেয়, এখনো প্রতিটি রাত জোনাকির আলো হয়ে লেগে থাকে হাতের তালুতে।

আমি দেশ থেকে দেশান্তরি হয়েছি কিন্তু পালিয়ে আসিনি। দেশ থেকে পালানোর মতো কোনো কারণ ঘটেনি। স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাসী হয়েছি কিন্তু আমার মন এখনো প্রবাসে অভ্যস্ত হতে পারেনি।

‘৩৫ বছর ধরে ব্রিটেনে আছি’ স্বাভাবিকভাবেই আমার রক্তে ব্রিটেন ঢুকে গেছে। আমি তাদের নুন খেয়েছি, তাদের ব্রেড, বাটারে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছি। আমি নিমকহারাম নই; আমার জীবনে তাদের অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করব না। আমি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কুণ্ঠিত নই।

ব্রিটেন আমার রক্তে ঢুকে গেছে বলে বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার রাখি না এটা খুবই বালখিল্য চিন্তা বলে আমার মনে হয়। আমি প্রত্যেক বছর কিংবা দু’বছর অন্তর একবার দেশে যাই, লক্ষ্য করেছি যারা ষাট, সত্তর, আশি বছর ধরে বাংলাদেশে আছে তাদের বুকে বাংলাদেশ নেই। তারা বাংলাদেশে থাকে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশ ধারণ করে না। আমি অনেক লোককে জানি যারা দেশের নুন খায় ঠিকই কিন্তু গুণ অন্য দেশের গায়। ১০০ বছর ধরে দেশে থেকেও দেশকে তারা আপন ভাবতে পারেনি।

‘আরাম আয়েসের লোভে দেশান্তরী হয়েছি’ এই বাক্য ১০০ ভাগ সত্য নয়। মানুষ কাজের জন্য, সুবিধার জন্য জায়গা বদল করে। আমিও কিছুটা ভালো সুযোগ সুবিধার জন্য জায়গা বদল করেছি।

দেশান্তর বা জায়গা বদল করলেই দেশের সাথে সম্পর্ক চুকেবুকে যায় না। বরং দেশ থেকে দূরে থাকলে দেশকে আরো গভীর ভাবে পাওয়া যায়, দেশকে আরো গভীরভাবে অনুভব করা যায়। প্রেমের মর্যাদা বিরহী প্রেমিক বুঝে। আমার কাছে দেশের কী মর্যাদা সেটা বুঝতে হলে হৃদয়ের পোস্টমর্টেম করতে হবে কিন্তু সে পোস্টমর্টেমেও দেশের প্রতি গাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ পাবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়।

ব্রিটেন আমার রক্তে এজন্য আমার বাঙ্গালীত্ব খারিজ হয়ে গেছে এটা সেই ভাবতে পারে যার দেশ প্রেম দোদুল্যমান, যে এখনো দেশ নিয়ে সন্দেহ মুক্ত নয়। যে বাংলাদেশের আলো বাতাসে শ্বাস নেয় কিন্তু অন্য দেশকে মনিব ভেবে সেজদা করে।

বন্ধুর মন্তব্য পড়ে আমার মনে হল সে আস্থাহীনতায় ভুগছে। দেশ নিয়ে সে সন্দেহ মুক্ত হতে পারছে না অথবা অন্য কোন দেশ তার মনে এমন ভাবে আসন গেড়েছে যে সবাইকে তার মত ভাবছে।

দেশ নিয়ে কিংবা দেশ প্রেম নিয়ে যার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আছে সে হীনম্মন্য হতে বাধ্য, আমরা জানি হীনম্মন্যতা হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। আমার বন্ধুর সুস্থতা কামনা করছি…

শিল্পীত বাবুই

যেদিন চাইনিজ একটা গুলি
বাবুইয়ের শিল্পীত ঘরে আঘাত হানে
সেদিনই বুঝে গেছি এরা অসুন্দর,
শিল্পের মর্যাদা আশা করা
অবান্তর। এদের কুৎসিত মুখ অসুস্থ চিন্তা;
আমাদের মানসিকতায় মিশ খায় না।

আমাদের পৃথক যাত্রা। অসুন্দর মুখে
কিছু কালিমা মেখে দিতে হবে;
তিলে তিলে জড়ো করা শিল্প ধ্বংসের
প্রতিশোধ নিতে হবে।

নাজায়েজ হানাদার শিল্প বুঝে না,
সুন্দর বুঝে না। সত্য বুঝে না। তারা
মানুষ বুঝে না। অমানুষ, বর্বরদের
দিতে হবে শিল্প স্বাদ।

হানাদার বাহিনী যখন নালায়,
নর্দমায় হাবুডুবু খাচ্ছিল তখন শিল্পীত
বাবুই এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছে
বুনছিল নতুন কুটির।

শিল্পের ধ্বংস নেই, সত্যের মৃত্যু নেই
মানুষ ফিনিক্স মত পাখির মত; ধ্বংস থেকে উঠে
দাঁড়ায়। হানাদার পালিয়েছে, বাঙালি
শিল্পের গর্বে উঠে দাঁড়িয়েছে।

নীতির মা

আজ আমাদের ঘরে ‘নীতি’র মা এসেছিলেন। তিনি আশা মানে ভীতিকর পরিস্থিতি। আমাদের যাপিত জীবনে তিনি উৎপাতের মত। তিনি এলে আমরা চুপ করে থাকি; যা বলার তিনি বলে যান; তার বলে যাওয়া অখাদ্য সহ্য করি অথবা গিলি। তিনি চলে গেলে আটকে যাওয়া শ্বাস ছাড়ি, সাথে ছাড়ি তার জোর করে খাওয়ানো নীতি-বাক্য।

তিনি অবশ্য ঘন ঘন আসেন না, মাঝেমধ্যে উদয় হন। তার আসা আমাদের পছন্দ নয় তবু তার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না। একবার চেষ্টা করে দেখেছি। জানালা দিয়ে সামনের রাস্তায় দেখলাম তিনি আসছেন আমাদের ঘরই টার্গেট করে আসছেন কিনা নিশ্চিত ছিলাম না তবুও তিনি যাতে অনায়াসে ঘরে ঢুকে পড়তে না পারেন সেজন্য দরজার ট্রিপল লক লাগিয়ে নিলাম। ভেবেছিলাম দরজা খুলতে পারছেন না তাই চলে যাবেন; কিন্তু এমন নির্লজ্জ যে যাওয়ার নামই নিলেন না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে আমাদেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো; দরজা খুলে তাকে ভিতরে আসতে দিতে বাধ্য হলাম। ঢুকেই যথারীতি অযাচিত লেকচার। একই লেকচার বারবার কাহাতক স্বচ্ছ করা যায় বলুন, তবু ‘নীতি’র মা বলে কথা চোখ শরমের কারণেও মুখ বন্ধ করতে বলতে পারি না। তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার কথাগুলো বলে যেতে থাকেন।

আমরা তাকে এড়িয়ে যেতে চাই তিনি তা ভালো জানেন তবু কেন বারবার অসফল চেষ্টা করেন! তার উপস্থিতিতে আমাদের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি ফুটে উঠে, তাকে কিন্তু কোনদিন এ নিরুৎসাহিত হতে দেখি না। আমাদের মনে মগজে তার কথাগুলো পৌঁছে দিতে বিন্দুমাত্র কসুর তিনি করেন না। মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে যাই মনে হয় তার কথাগুলি মেনে নিলে মন্দ হয় না। মন যখন কিছুটা দুর্বল থাকে তখন তার কথাগুলোকে প্রাণবন্ত এবং প্রয়োজনীয় মনে হয়। কিন্তু এ দুর্বলতা ক্ষনিকের। বাস্তবের মাঠে নীতির মায়ের হাত ধরে চলা অসম্ভব। অনেকেই চেষ্টা করেছে; কেউ সফল হয়নি।

তার লেকচারে আমরা সাধারণত প্রতিউত্তর করি না, চুপচাপ শুনে যাই। একবার শুধু জানার জন্য জানতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম ‘মা জননী এই যে প্রতিবার কষ্ট করে আসেন, এই যে সময় নষ্ট করে দীর্ঘক্ষণ নীতিবাক্য শুনিয়ে যান আপনার শ্রম যে প্রতিবারই পণ্ডশ্রম হচ্ছে সেটা কী বুঝতে পারেন না’! তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে পুত্র স্নেহে বলেন ‘আমি শুধুই সম্ভাবনা দেখি’!

নীতির মা তার মত চেষ্টা করে যান তার কথায় প্রভাবিত হতে অন্তর তাগিদ অনুভব করি। কিন্তু ঘরের বাইরে যেখানে পৃথিবী নামক গ্রহ থাকে সেখানে পা রাখার সাথে সাথে নীতির মায়ের কথা ভুলে যেতে হয়। সেখানে তার কোন অস্তিত্ব থাকে না।

শীতের ভোরে বিষণ্ণতা

আমার বিষণ্ন জানালার ওপারের আকাশ বিষণ্ণ হয়ে আছে। সে কী আমার মনের কথা জেনে আমার সাথে সহমর্মিতা দেখাচ্ছে! আজ আমার মন বিষণ্ণ। কোন কোন দিন অকারণে মন খারাপের ঘটনা ঘটে; আজ কারণে ঘটেছে। গত দুই তিন দিন ধরে শরীরের অবস্থা ভালো না; মাথা ব্যাথা, জ্বর, কফ শীতকালে সাধারণত যা হয়। জ্বর, কফে সাধারণত বিছানাবাসি হতে হয় না কিন্তু এইবার একটানা চৌদ্দ ঘন্টা বিছানায় কাটাতে হলো; মাথা তুলতে পারিনি।

শীতের ভোরে শীতের পুকুরে কেউ কী সাঁতার কেটেছেন! আমি কেটেছি, পুরো তারুণ্য শীতের পুকুর আমার দখলে ছিল। এখন তাপমাত্রা আঠারোর নিচে নেমে গেলেই ঠান্ডা লেগে যায়। পুকুরে সাঁতার তো দূরের কথা; মুখ ধোয়ার জন্য টেপের পানি প্রায় ৩০ সেকেন্ড ছেড়ে রাখতে হয়; যতক্ষণ না গরম পানি পাওয়া যায়। শার্টের বোতাম খুলে শীতের ভোরে হাটা তখনকার সময়ে স্টাইল ছিল, এখন ৪/৫ প্রস্থ কাপড় পরেও শীত আটকাতে পারি না। আমি প্রায় নিজেকে আঠারো বলি, বলি বটে কিন্তু বয়স যে আঠারোয় আঁটকে নেই সেটা বেশ জানি। অনেকেই মনের বয়সের কথা বলে কিন্তু সে কেবলই কথার কথা। মনের বয়স দিয়ে আপনি কিন্তু জ্বর এবং কফ আটকাতে পারবেন না।

এত গেল আমার শরীর যন্ত্রের কথা, বয়স হয়েছে শরীর খারাপ হবে এটাই ভবিতব্য। কিন্তু আজকের বিষণ্ণতা শুধুমাত্র শরীর খারাপের জন্য নয়। বিছানায় একটানা অনেক ঘন্টা ঘুমের কারণে বেশ কিছু আজগুবি এবং সম্ভাবনার স্বপ্ন আমাকে দেখতে হয়েছে। একটা স্বপ্ন আমাকে বেশ আন্দোলিত করেছে। লেখালেখিতে একঘেয়েমি চলে আসছিল, নতুন কিছুই যেন হাত থেকে বেরুচ্ছে না। সব চিন্তা জড় চিন্তায় পর্যবসিত হচ্ছে। এই স্বপ্ন আমাকে নতুন চিন্তার খোরাক দিচ্ছিল। আমি তরতর করে লিখছিলাম। স্বপ্নে খুব উত্তেজিত ছিলাম। নতুন কিছু সৃষ্টির উন্মাদনায় কাঁপছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোর সাড়ে তিনটা। এখনই লিখে না রাখতে পারলে সব হারিয়ে যাবে ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে এলাম। বাথরুমে কয়েক মিনিট প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়ে সব হারিয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও কিছুই ফিরিয়ে আনতে পারলাম না।

স্বপ্নে আমি যে মন্ত্র গুলো পেয়েছিলাম লিখতে পারলে আমাকে আটকানোর সাধ্য থাকতো না কারো। আফসোস অমিত সম্ভাবনার একজন লেখক শুধুমাত্র স্বপ্ন থেকে বের হতে পারেনি বলে বাংলা সাহিত্য অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হলো। আজ আমার মন খুব বিষণ্ণ; একটাই সান্তনা ভোরের আকাশ আমার মনের খবর জানতে পেরেছে। আমার সহমর্মী হয়ে সেও বিষণ্ণ হয়ে আছে।

এই স্বপ্নের মানে কী

কাল রাতে আজগুবি স্বপ্ন দেখেছি, স্বপ্নের লেজ মাথা খুঁজে পাইনি। আমি একটা পিৎজা সঁপে কাজ করি, কিছুদিন হল আমাকে শিফট ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়েছে। স্বপ্নে দেখলাম আমি পিৎজা বানাচ্ছি, লার্জ স্টাফক্রাস্ট হাফ এন্ড হাফ খুব সহজ, শুধু টপিং গুলো দেখে পিৎজার উপর রাখতে হবে। বানাতে গিয়ে দেখলাম যে টপিং চেয়েছে কিছু আমার সামনে নেই, অথচ এমন হওয়ার কথা না। ফ্রিজ থেকে এনে বানান হল; ওভেন থেকে নামিয়ে যখন কাটতে যাব দেখি আমি যে টপিং দিয়েছিলাম সেগুলো গায়েব। ওভেনে তখন অন্য কোন পিৎজা ছিল না। এদিকে কম্পিউটার স্ক্রিন লাল হয়ে গেছে, অর্থাৎ অর্ডার পাঠাতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কি আর করা ভুল পিৎজা তো পাঠাতে পারিনা, তাই ফেলে দিলাম। পুনরায় মেকিং টেবিলে গিয়ে পিৎজা বানাবো দেখলাম কিছুক্ষণ আগে যে টপিং গুলো এনে রেখেছিলাম সব গায়েব। পিৎজা বানাতে গিয়ে পুনরায় যখন অর্ডারে ট্যাপ করলাম দেখি যে পিৎজা ভুলের কারণে ফেলে দিয়েছিলাম সেই টপিং এখন দেখাচ্ছে। পুনরায় পিৎজা বানালাম, ডেলিভারি ড্রাইভার এড্রেস ট্যাপ করতে গিয়ে দেখল এটা আমার এড্রেস; অর্থাৎ আমার ঘর থেকে কেউ অর্ডার করেছে। ঘরে ফোন করে দেখলাম ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী কেউ কিছু বলতে পারল না। এমনিতেই আমি থাকি ডেলিভারি এরিয়ার বাইরে, আমার ঘর থেকে অর্ডার আসার সম্ভাবনা নেই। কি আর করা ডেলিভারি ড্রাইভার আমার ঘরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। খাবার পৌঁছে দিয়েও আসল কিন্তু পুনরায় ফোন করে দেখলাম আমার ঘরে খাবার পৌঁছেনি।

কিছু সময় পরে ফোন আসল, পিৎজা ভুল দেওয়া হয়েছে। সামনের স্টাফ আমাকে ফোন সমঝিয়ে দিল ভুল সংশোধন করার জন্য। আমি হ্যালো বলতেই অপর পাশে যে আওয়াজ দিয়ে উঠল সে আমি।

ভয়ে আমার অন্তরাত্মা বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা, ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখলাম পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে।

নাচতে না জানলে

আমি আসলেই খুব ভালো নাচতে জানি। কিন্তু উঠান বাঁকার কারণে নাচতে পারি না। আমাকে নিয়ে যারা অহেতুক ট্রল করছেন, মুখ লুকিয়ে হাসাহাসি করছেন তারা অপেক্ষা করুন। উঠান সোজা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তখন দেখিয়ে দিব ভরতনাট্যমে আমি কতটুকু পারদর্শী।

আচ্ছা না হয় নাচতেই জানি না; কিন্তু নৃত্য বিষয়ে আমার জ্ঞান নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না। দীর্ঘ গবেষণার পরে নৃত্য সাধক হয়েছি, কোনটা নাচ আর কোনটা নাচ নয় সে বিষয়ে ধারণা রাখি। তাই যদি নাচ নিয়ে দু এক কথা বলেই ফেলি মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে।

এই যে আমার সামনে লাফালাফি করছেন এটা নাচ নয় এটা শুধুই লাফালাফি। নাচ নামে অভিহিত করতে চাইলে আমাকে অনুসরণ করুন আমি ছাড়া আর কেউ ভালো নাচতে পারে না।

‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ বলে আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন এই আমি গত কয়েকদিন আগে নৃত্য শিরোমনি পদকে ভূষিত হয়েছি। তারা নাচের সমজদার; আমার খরচ মাত্র দুই হাজার সাত’শ। নাচের নোবেল আমাকে অফার করেছিল আরো হাজার দুই এক খরচ হত; কিন্তু আমি বিদ্বেষী অনেকে সুযোগের অপেক্ষায় আছে। নোবেল নিয়ে তাদের সে সুযোগ দিতে চাইনি বলেই অফার ফিরিয়ে দিয়েছি।

নৃত্য আমার জন্য কোন ব্যাপারই না উঠানের কারণে মাঝে মাঝে মার খাই বটে তবে উঠান সোজা হয়ে গেলেই বিদ্বেষীদের মুখে ঝামা ঘষে দেব।

ঈর্ষা এবং অগ্রজ

ঈর্ষা কত প্রকার এবং কী কী জানতে হলে আমাদের তথাকথিত শ্রদ্ধেয় অগ্রজদের পানে একটু তাকাতে হবে। শ্রদ্ধেয় এর আগে তথাকথিত লাগানোয় অনেকে নাখোশ হবেন কিন্তু একদিন যাদের পরম আরাধ্য ভাবতাম তারা যে শেষ পর্যন্ত ঊনমানুষ হয়ে দেখা দিবেন ভাবতে পারিনি। এতদিন অপাত্রে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এসেছি ভেবে নিজেকে ধিক্কার দেই।

প্রিয় কিছু কবিতার পুনর্পাঠ শুরু করেছিলাম। যে কবিতাগুলো বোধের গভীরে গেঁথে আছে ভেবেছিলাম সেগুলো এক এক করে মুক্ত করবো।

প্রথম কবিতা মুক্ত করার সাথে সাথেই ঈর্ষাকাতর কতিপয় অগ্রজ হামলে পড়লো। তারা ভাবল তাদের হেও করা হচ্ছে। ঈর্ষার এমন রূপ আগে আর দেখিনি।

লেখকের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে অনেক কথা বলি কিন্তু অধিকাংশই এটা বিশ্বাস করি না। লেখক কী লিখবেন কাকে নিয়ে লিখবেন সেটা কেউ ঠিক করে দিতে পারে না।

এক লেখক কে নিয়ে লিখলে অন্য লেখক যদি তেল-বেগুনে জ্বলে ওঠে তাহলে সেই অন্য লেখক লেখক হওয়া তো দূরের কথা ভালো করে মানুষই হতে পারেনি।

আমি কাকে নিয়ে লিখব সেটা আমার অধিকার তোমাদের জ্বলনে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য হৃদয় ব্যথিত হবে কিন্তু তোমাদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য ভালোও লাগবে।

হে বদ অগ্রজ তোমাদের ঈর্ষা অন্যকে পোড়াবে না নিজেরাই ভস্ম হয়ে যাবে।

মনু

শৈশবে মনু নদীর সাথে কথা বলতাম
অবিশ্বাস্য মনে হলেও
মনু আমার কথা বুঝতে পারত।

একবার চকলেট চুইয়ে মুখ
ভিজে গেছে, ধুতে হবে
মনুর পাড়ে পৌঁছে দেখলাম জল
অনেক দূরে বললাম
‘আমি তোকে ছুঁতে এলাম;
তুই দূরে চলে গেলি’।

মনু বলল ‘দাঁড়া এক মিনিট’
মিনিট খানেকের মধ্যে জল চলে
এলো পায়ের কাছে। মুখ ধুয়ে
ধন্যবাদ না বলেই চলে যাচ্ছি
হঠাৎ কে যেন জল ছিটকে
পিঠ ভিজিয়ে দিল।

পিছন ফিরে দেখলাম
মনু খিলখিলিয়ে হাসছে
তার সেকি আনন্দ।

মনুর সাথে বন্ধুত্ব ছিল
আমরা একসাথে অনেক পথ হেঁটেছি।

জীবনের বাঁকে হঠাৎ মনুর
সাথে বিচ্ছেদ ঘটে গেল
দীর্ঘদিন কারো সাথে
কারো দেখা নেই। অনেক বছর পরে
আবার যখন দেখা বুঝলাম
বন্ধুত্বের সেই উষ্ণতা নেই।
দু’একবার ডাক দিলাম
সাড়া দেয়ার কোনো দায় দেখলাম না।

মনু অভিমান করে বসে আছে
আমারও গরজ নেই
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছি
জীবনের অন্য পর্বে কে আর
শৈশবের বন্ধুকে মনে রাখে।

রাজনীতি

রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন লেখি না, এখন সেইফ সাইডে থাকতে ভাল লাগে। বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা নষ্ট হয়েছে বলে বুঝানো যাবে না, এখানে আমার মতের বিপরীত অর্থাৎ আমার শত্রু। আওয়ামী শাসনের সমালোচনার অর্থ রাজাকার, দেশদ্রোহী। এতিম আত্মসাৎ অথবা খাম্বা নিয়ে প্রশ্ন করার অর্থ নাস্তিক।

আমি অনেক ভেবে দেখলাম ফুল পাখি লতা পাতা নিয়ে মগ্ন থাকার চেয়ে আরামের কিছু নেই। অহেতুক গালি খেতে কারই বা মনে চায়, তারচেয়ে বরং ‘লাল দোপাট্টা মলমল কা’ শুনে শুনে সহপাঠীনির লাল ওড়নায় জীবনের দিক নির্দেশনা খোঁজাই নিরাপদ।

কিন্তু দিকনির্দেশনা পাই না; মনে প্রশ্ন জেগে উঠে লাল দোপাট্টা আওয়ামীলীগ না বিএনপি। সহপাঠিনী কোন বিশ্বাসে বিশ্বাস করে।

আমার চোখ ফুল, পাখি, লতা, পাতা নিয়ে থাকতে চায় কিন্তু মন সন্দেহ প্রবণ হয়ে যায়, ফুল পাখি কী কোন দলের প্রতি অনুগত, তারা কী ইতোমধ্যে দলকানা হয়ে গেছে।

রাজনীতি মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে, আমরা কোন কিছুই দলছাড়া কিংবা রাজনীতি ছাড়া চিন্তা করতে পারি না।

আমি কবিতার সাধনা করি কিন্তু শেষে দেখা যায় সাধনার কোন কোন মূল্য নেই কবিতা আদতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি হয়ে গেছে।

আমাদের দেশে যত শিশুর জন্ম হয় তারা এখন আর মানুষের বাচ্চা হয়ে জন্মে না, হয় আওয়ামী লীগ নয় বিএনপি হয়ে জন্মে।

আমি রাজনীতি নিয়ে লেখি না, লিখতে ভালো লাগে না কিন্তু আমার সব লেখাই রাজনৈতিক দুর্গন্ধে ভরপুর। হাজার চেষ্টা করেও এই বদ গন্ধকে দূরে রাখতে পারি না।