চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

অন্নকূট

যে খেতে দেয়, তার তত ক্ষিদেই থাকে না
দানে-দানে পাদুটো ভেজায়
এই দেখে সব্বাই দল বেঁধে তার
গোড়া খুঁড়তে বসে —
“আছে, মিষ্টিআলু আরও আছে!”

স্বাদ-গন্ধ ঘেঁটে ঘেঁটে জেনে গেছে খাবারের শিরাউপশিরা
চব্বিশ ঘন্টাকে বিতরণে বদলে দিয়েছে শুধু প্রস্তুত দাঁড়িয়ে থেকে…
থাকা বড় ক্ষণস্থায়ী — হাসি, ভেলকি, অস্ফুট কুকুর।
তাই তো সে দিয়েথুয়ে হাত-অবসর।
দেহ থেকে দুঃখী রক্ত চলে গেলে আরাম হবে না? তারপর সহাস্য খবর আসে, রোগি বেঁচে গেছে।

বেডরুম থেকে বড় সমর্পণ রান্নাঘরে।
অভিশাপ মাথায় নিয়েও ময়লা হাত —
গোটা গোটা গ্রাস মুখে তোলো।
একদম খারাপ হওয়া অব্দি মানুষ গিলতে পারে,
অসীম জাদুতে কোথাকার শস্যদানা জলতরংগের মতো কোন সবজিতে মিশে যায়…

যে দেয় সে হালকা হেসে শূন্য থালা গোছাতে গোছাতে বলে, পরে খাব। আছে!

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

দশ
নির্মল সহজে ঘন মেঘস্তর থেকে নেমে বৃষ্টি হয়ে কচুপাতার মৃণাল ঘিরে দাঁড়াতে পারে না। “সরল তরল হও, বিকাশের রীতিনীতি এই” এক কবি লিখেছিলেন; কিন্তু মায়া কখনও দুধ তৈরি করতে বললে সে এত মোটা ক’রে গুলত, খাওয়ালে বাচ্চাদের অবধারিত পেট ছেড়ে দেবে। নির্মল নিজেকে মেলে ধরে শিলাবৃষ্টির মতো; প্রথমে অপ্রবেশ্য, পরে হয়ত গ’লে জল হবে। ছোটদের জবান তার নয়, ভাবও কি বোঝে? সবাই জানে, এ-বংশের যতেক পুরুষ — সন্তানপাগল। রাতে বাচ্চারা নিঃসাড় ঘুমন্ত হলে নির্মল অন্ধকারে আন্দাজে-আন্দাজে ন’বছরের ছেলের হাঁটুর ঘা’য় মলম লাগিয়ে দিচ্ছে, কোমরে দাগ ব’সবে ব’লে ঢিলে ক’রে বাঁধছে তেরো বছরের কন্যার প্যান্টের ফিতে। সঞ্জু সব সময় টের পায় না, শিউলি লজ্জায় কাঠ হয়ে থাকে।

নির্মলের গল্পের ভাষাগাড়ি ছোট্ট শ্রোতাদের নানা সিগন্যালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগোচ্ছিল :
— সভায় তখন গুনগুন শুরু। আরে, ‘নির্গুণ আত্মজ্ঞান’ তো পাতঞ্জল-যোগের গোড়ার কথা, সবে দু’এক বছর নবদ্বীপ শান্তিপুর বা গোপালপাড়ার টোলে যাতায়াত করছে এমন ছেলেছোকরাও জানে। জমায়েত ধরতেই পারছে না হলটা কী! হঠাৎ সভায় বসা একটা লোক চট ক’রে উঠে দাঁড়িয়েছে, তারপর দে ছুট ভীমবেগে। ভিড় চেঁচিয়ে উঠল : ব্যাটা অশা, আরে মধুসূদনের বড় শালা পালাচ্ছে… পালিয়ে মুখ বাঁচাবি ভেবেছিস?

ডামাডোল বেশ বড় চেহারা নিল। গাঁয়ের মোড়লরা জোড় হাত উঁচু ক’রে “শান্তি শান্তি” বলেও ম্যানেজ দিতে পারছে না। এমন সময় দেখা গেল, ডবল জোরে দৌড়ে ফিরে আসছে সেই অশ্বিনীচন্দ্র। কিন্তু অশার হাতে ওটা কী, এ-বাবা, কচি বাচ্চাদের তেলচিটে সরষে-বালিশ একখানা। সেটা ফরাসের ওপর পেতে অশ্বিনী জামাইবাবুকে হাত ধ’রে টেনে শোয়াবেই, আর মধুসূদনও শোবেন না। আবার বিরাট হই হই। সব দেখেশুনে দশরথ মিশ্রের ব্যাঁকা হাসি থেকে করুণা ঝরে পড়ছে। তিনি হাত তুলে বললেন, শয্যাগ্রহণ করতে লজ্জা কী, সার্বভৌম মহাশয়? হয়ত তাতে আপনার শরীরটি কিঞ্চিৎ পরিতোষ লাভ করবে।

দশের ও দশরথের অনুরোধে শেষতক শুয়েই পড়লেন তারকনাথ। ওমনি এক আশ্চর্য পরিবর্তন, ঝিমুনিভাব কেটে গিয়ে জ্বলে উঠল চোখদুটো। মুখে মুচকি হাসি টেনে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু গলা খাঁখারি দিলেন :

ধর্ম দুই রকমের, প্রবৃত্তিধর্ম ও নিবৃত্তি বা মোক্ষধর্ম। যার সাহায্যে সুখলাভ, তাই প্রবৃত্তিধর্ম। এটা সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত আছে। কিন্তু শান্তিলাভের জন্যে নিবৃত্তিধর্মের অনুশীলন শুধু ভারতেই শুরু হয়েছিল। আত্মজ্ঞানও দু’প্রকার — সগুণ আর নির্গুণ। সগুণ আত্মজ্ঞানের ধারণা দিলেন বাগাম্ভৃণী ঋষি, কপিল ব্যাখ্যা করলেন নির্গুণ আত্মজ্ঞান। মাননীয় নৈয়ায়িক কপিল রাঢ়বঙ্গের সন্তান। আচ্ছা পণ্ডিত দরশরথ মিশ্র, বলুন তো…।

এর পর তর্কসভা মেরেকেটে পনেরো মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। মিথিলার মহামহোপাধ্যায় পক্ষধর মিশ্রের বংশজ টের পেলেন, স্মৃতি, কাব্য, ন্যায়, ব্যাকরণ ও তর্ক বিষয়ে মধুসূদনের জ্ঞানের যে প্রখরতা, তাতে অনায়াসে পঞ্চতীর্থ উপাধিতে ভূষিত হতে পারেন। কাজেই টিকি-কাছা আস্ত রেখে মানে-মানে সরে পড়াই শ্রেয়। বজরায় ওঠার আগে বিমূঢ় দশরথ মধুপণ্ডিতের কাছে এসে নীচু স্বরে প্রশ্ন করলেন, মহাশয়, স্মার্ত রঘুনন্দনের মতে তিনভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে — বাচিক বা উচ্চকন্ঠে পাঠ, উপাংশু বা অনুচ্চ স্বরে পাঠ এবং মানস বা মনেমনে পড়া। তো, আপনার এই শুয়ে শুয়ে পঠন-টি কোন ধারার অন্তর্গত?

এগারো
ঝড়ের বেগে সুধা ঢুকল ঘরে, রাতে যে কাঁথা নিয়ে ঘুমিয়েছিল সেটাই গায়ে জড়ানো।
— দিদিমা শুনিছ? টিপুদা বিয়ে ক’রে বউ নিয়ে আইছে!
— আমাগো টিপু? ওমা, আমার কী হবে! বউ পালো ক’নে?

সুধা ঠান্ডা মাটিতে ধেবড়ে ব’সে পড়ে। ওরে মুখপুড়ি, হাসবি পরে, আগে ঘটনা বল।

টিপু জলপাইগুড়ি গেছিল বন্ধু অসীমের মামাতো বোনের বিয়েতে। গেছে যদিও, বিয়েবাড়িতে কনের চাপা রঙ নিয়ে মহিলাদের ঠাট্টা-বোটকেরা, ছাদনাতলায় চ্যাংড়াদের মাতন, পাঁঠার মাংস খেয়ে মাটির গেলাসে হাত গোলা — কিছুই তাকে টানে না। সে কোনও রকমে কাঁধের ব্যাগ নামিয়েই আশপাশের বনপাহাড়ে ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। এদিকে বিয়ের আগে পণের পুরো টাকা হাতে না পেয়ে বরপক্ষ পাত্র উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। তখন টিপুকে জঙ্গল থেকে খুঁজে এনে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে অসীমের মামা। টিপু অনেক বাধা দিয়েছিল : এ-বিয়ে আমার মা মানবে না। বিশ্বাস করবে না একটা কথাও। বলবে, ওই মেয়ের সঙ্গে তোর আগে থেকেই ভাব ছিল।

তৃপ্তিমামিমার চিৎকার শোনা যাচ্ছে এ-বাড়ি থেকে। সেই শাপশাপান্তকে নতুন বউ দেখার আহ্বান মনে ক’রে ছেলেমেয়েরা ছুটল। এই ফাঁকে চুপ ক’রে ঘরে ঢুকে একটা সবুজ প্যাকেট চাঁদের কোলের ওপর ছুঁড়ে দিয়েছে দিদিমা।
— প্রত্যেক দিন সকালে-বিকেলে ঠোঁটে লাগাবা। ভাইবোনরা কেউ চালি আঙুলির মাথায় ক’রে এট্টু দিয়ে আবার রাখে দেবা নিজির কাছে।

ননীবালা খেয়াল করেনি তার জাঁদরেল মেয়ে পেছন-পেছন বড়ঘরে উঠে এসেছে।
— কী এডা, দেহি? বোরোলীন! এর তো অনেক দাম। টাকা পালে কোথায়, মা? তোমার পানের ডাবরখান দেখতিছি না দুই-তিন দিন।
— তোরঙ্গে তুলে রাখিছি।
— তোমার মুখ না পাইখানা? ডাবর বের করো, আমি দ্যাখবো।
— ভর সন্ধেকালে মা’র পেছনে না লাগলি কি তোর পেটের ভাত হজম হচ্‌ছে না, নাদু?
— এক ফোঁটা দুধির সর মাখলি ঠোঁটফাটা সারে যায়। সংসার চালাতি যে কী কষ্ট তুমি তার কী বোজ্‌বা? কথায় কয়, চালডাল তোমার ম্যাজমানি আমার। দিদিমা হয়ে নাতির ভবিষ্যত ঝজ্‌ঝরে ক’রে দেচ্‌ছো!

নির্মল সদ্য ‘গাঁদাফুল’ লেখা শেষ করল, কবিতাটা দাঁড়াল মোট আট স্তবক, চব্বিশ লাইন। এবার সে কিছুক্ষণ বউ-শাশুড়ির ঝগড়া শুনল মন দিয়ে। ওদিকে হঠাৎ বলরাম ঘোষের বাড়ির হাত্‌নে থেকে উঠোনে খ্যানখ্যান করে গড়িয়ে পড়েছে কাঁসার থালা আর বারান্দাময় লালচে মোটা মুড়ি — শালী, হারামির বাচ্চা, সারাদিন গাধার খাটনি খাটে আসব আর তুই আমারে এই ব্যাতানো মুড়ি খাওয়াবি! ভাবিছিসডা কী?

প্রদীপ থেকে প্রদীপে যাওয়ার মতো ঝগড়ার শিখা সন্ধের কলোনি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। বলরামের মুখখিস্তি ঢেকে গেল পাশের রেখা-রত্নার বাড়ির শাঁখশব্দ, অতি-গৌরাঙ্গী রেখার মায়ের তীব্র উলুতে।

বারো
প্রতিটা মানুষই তর্কে-বিবাদে নিজের মতকে জিতিয়ে আনতে চায়, আর অপরের ধারণাসৌধকে ধসিয়ে দিতে। প্রত্যেকে বিশ্বাস করে ঠিক-টা তার সঙ্গেই আছে, অন্য পক্ষ মিথ্যের রজনীগন্ধা। কলোনির গলাবাজি, কাশ্মীরের সংঘর্ষ বা রাষ্ট্রসংঘের শান্তিআলোচনা সব জায়গাতেই সবাই বোঝাতে রাজি, বুঝতে নয়। তাই শুরু যেখানে আরম্ভ করে, সমাপ্তিও সেখানেই শেষ হয়, একটা বড় গোল্লার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে মানুষের ভবিষ্যৎ।

আজাদ হিন্দ ক্লাবের মাঠে রামযাত্রার কনসার্ট শেষ হয়ে অভিনয় শুরু হল। সীতা খুব কাকুতিমিনতি করছে — প্রাণনাথ, তোমার সঙ্গে বনবাসে যাব। উত্তরে রাঘব : জীবনে চলার পথে, নারী নাহি নিব সাথে। ভাই লক্ষ্মণ, তোমার কী পরামর্শ? ভ্রাতা, তুমি যা বলিবে, কিন্তু আমারও মত : জীবনে চলার পথে, নারী… নারী নাহি নিব সাথে।

মায়া এসে ঠক করে এক কাপ চা খাটের কোনায় রেখে বলল, ছেলেডা এই নিয়ে দুবার জ্বরে-টানে পড়ল এক শীতে। আজ মাঘের মোটে তেরো দিন। আপনারে কতবার বলিছি, এইসব ছাইভস্ম না লিখে চাঁদের কুষ্টিডা বানান।

নির্মল উত্তর দেয় না, তার মাথায় সমাধানচিন্তা খেলে গেছে। আচ্ছা যদি এমন হয়, প্রতিটা মানুষ যে-কোনও মতবিনিময়ের সময়ে নিজের দোষ বা ভুলগুলো বলবে আর সমর্থন করবে তার বিরোধীর যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যকে, তাহলে এই ট্র্যাফিক জ্যাম খুলে বেরিয়ে আসা যায় না? কথা মানেই যদি হয় নিজের বিরুদ্ধে কথা, তাহলে শব্দ ঘিরে যে ক্ষমতার দুর্গ গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙে ফেলা সম্ভব। তখন মানুষের অহং নেমে আসবে গ্রীষ্ম-পুকুরের জলস্তরের মতো, অন্যকে ভালোবাসতে বাধা দেওয়া দেয়ালটা সরে যাবে। কিন্তু এই বুঝ মানুষের মাথায় ঢোকাবে কে?

নির্মল তার ছোট্ট শেলফের বইগুলোর দিকে তাকায় — উপনিষদ-সংহিতা, স্তোত্ররত্নাবলী, অ্যান্ড্রু মোশানের নির্বাচিত কবিতা কিটস, এ হিস্ট্রি অফ স্যানসক্রিট লিটারেচার, অমরকোষ, গীতবিতান, ব্রহ্মসূত্র সঞ্চয়ন, দ্য পিকচার অফ ডোরিয়ান গ্রে…।

— ও গৃহস্থ?
— শুনতিছি।
— কাল সকালে চাঁদরে নিয়ে যাব ইস্কুলে। ভর্তি করে দিয়ে আসব।

মায়া বিপদ আশঙ্কা করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
— এখনও আট মাস বয়েস কম ছেলেডার। তার উপর এই শরীর…।
— বাড়ি রাখলি আবার আমতলার শিশিরে গড়াগড়ি খেয়ে জ্বর বাধাবে। তার চেয়ে ইস্কুলই ভালো।

(শেষ)

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

সাত
— দাঁড়ায় জল খায় না, দিদি। বিষম লাগবেনে।
শিউলি খাটের ওপর খ’সে প’ড়ে গেলাসে চুমুক দিল।
দিদিমাবুড়িরা একটু বকর-বকর করেই থাকে :
— জীবনে আর তিন্‌ডে জিনিস মনে রাইখো। কেউ পান খাওয়াতি চালি খুলে দেখে মুখি দেবা। পাইখানা ক’রে মাটিতি হাত ঘষতি ভোলবা না। আর কোনও দিন ষোলোগুটি খেলার ধারেকাছে গেছো কি মোরিছো।

দু’একটা ক’রে হাবাগোবা মানুষ বাংলার প্রত্যেক গ্রামে পাওয়া যাবে, বুঝি কে বা কারা তাদের পানের রঙিন মশলায় শেকড়-বাকড় বেটে খাইয়ে দিয়েছিল। আর পায়খানা থেকে বেরিয়ে শ্যাওলাপেছল মাটিতে ভালো ক’রে ঘ’ষে নিলে বাঁহাত শুদ্ধ হয়ে যায়। ঘষতে ঘষতে কাঁকর-বালি উঠে চিনেবাদাম-রঙ মাটি বেরিয়ে পড়ে, ধরা যায় কোন হাতের মাপ বাড়ির কোন সদস্যের। বাকি থাকল ষোলোগুটি। পূর্ববঙ্গে এক দিবানা লোক সন্ন্যাস নেবে ব’লে মাঝসংসারে বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে গেরুয়া প’রে পিঠটান দিয়েছিল। তিন দিন তিন রাত জলেজঙ্গলে হেঁটে এক গ্রামে পৌঁছে পাকুড়তলায় জিরোতে বসেছে, বৈরাগী ভেবে কোনও গোয়ালা সদ্য দুয়ে আনা এক লোটা দুধ দিয়েছে তাকে। দুধে চুমুক দিতে দিতে, এই যেমন চাঁদভাই খাচ্ছিল আজ, দ্যাখে গাছতলায় ষোলোগুটি-র ছক কাটা। “কী হে, এক-হাত হবে নাকি” বলে সে কোনও পথচারীকে ডেকে বসাল। সেই যে বিবাগী মাতল খেলায়, না হল তার গ্রাম ছেড়ে এগোনো, না সন্নিসি হওয়া। পথিক আসে, পথিক যায়, আর লোকটা মাথা নীচু ক’রে খেলতে খেলতে জিতে গেলে জোকার দেয় বিশ্বেশ্বরের নামে, হারলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আবার ইঁটের ঢেলা দিয়ে কোট সাজায়। দেখতে দেখতে তার দাড়ি বুক পর্যন্ত, মাথার চুলে জট, খাওয়া বলতে ওই লোটায় ক’রে কাঁচা দুধ… গ্রামের মানুষ নাম দিয়েছে ঢেলামহারাজ। আশপাশের যোক্তা লোকজন এসে বলল, চলো গঙ্গাসাগর যাই, গেল না। ছ’মাস পরে খোঁজতলাশ করে তার বৌ-ছেলে এল, চিনতে পারল না তাদের। লোকটা পাকুড়তলাকে ‘ষোলোগুটির থান’ বানিয়ে ঢেলামহারাজ নামে কাটিয়ে দিল বাকি জীবন।

বেঁচে থাকা এমনই বিচিত্র কারসাজি, এক দেববিস্ময় মহাজনি কেতা। এইমাত্তর সে মৎস্যচক্ষু বোঝাটানা জীবন, আবার মুহূর্ত পরেই হেঁয়ালি-শিহরনে জম্‌জমা। শ্রীরামপুরের গঙ্গা যেন — কোথাও শ্মশানঘাটে পচা গাঁদাফুল আটকে প’ড়ে আছে তো আছেই; কোথাও কোলের শিশু খসামাত্র তলিয়ে যাবে, হদিশ করতে পারবে না।

এই যে পাড়ায় রামযাত্রা এল, যখন তের্‌পল গুটিয়ে হ্যাজাক নিভিয়ে চলে যাবে, দেখা যাবে তক্ষুনি গ্রামের দু’একটা মেয়েও গায়েব-লোপাট-অনুপস্থিত। প্রতিদিন ভিড় হতো, প্রতিদিন সংলাপমুগ্ধ যুবতীরা মঞ্চের সামনে ব’সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত রামের গভীর নাভিকুণ্ডলী, সীতার গলাভর্তি গয়নার দিকে…। তারপর কোন ফাঁকে বাতিল রেল কোয়ার্টার্সের পাশে জানকীবল্লভের অসভ্য ইয়ারকি শুনে ফেলল তারা, সীতার বুকের ঘন লোম তাদের ঝটকা দিয়ে দিল। তারা ডুবে গেল চুঁচড়ো বা অগ্রদীপ বা ধুলিয়ানের গঙ্গার ঘূর্ণিজলে।

আট
ঘরের ছাঁচতলায় গাঁদার চারা লাগিয়েছিল মায়া, তাতে খুব ফুল এসেছে। নির্মল অনেক দিন পরে রুলটানা, তিন ফুটো ক’রে সবুজ সুতোয় সেলাই — তার বাংলা, ইংরাজি আর সংস্কৃতে কবিতা লেখার খাতাটি বের করল বইয়ের তাক থেকে। তখন পাশের ঘরে মায়ার গলা :
— বাহ, বই মুখি দিয়ে সব খাটে শুয়ে পড়িছেন! গ্যাঁট হয়ে ব’সে পড়তি পারিস না? সাধে কী আর বলে, শোয়া-পণ্ডিতির বংশ?
— শোয়া-পণ্ডিত কী, মা?
— এই কাহিনিডা আমার চেয়ে তোমার বাবা অনেক ভালো কোতি পারবে।
মা’র চোখের ইশারা পেয়ে চাঁদ মরা গলায় ডাকে :
— বাবা, ও বাবা, শোয়া-পণ্ডিতির গল্পোটা বলেন না!

ফাউন্টেন পেনের নিব খসখস করছে, নির্ঘাৎ সঞ্জু বা বাসু লুকিয়ে বাবার কলমে হাত দিয়েছিল। নির্মল ধ’রে ধ’রে লিখল :
শুষ্ক স্বর্ণ জিনিয়া বর্ণ,
সুষমার সার রূপ অতুল —
গাঁদাফুল!
তারপর অসমাপ্ত কবিতার জিম্মায় শীতের দুপুরকে রেখে এ-ঘরে এসে দ্যাখে সন্তানদের মুখে একরাশ লাবণ্য। গরীব ভালো থাকে যদি সে ভবিষ্যৎচিন্তা ভুলে যায়। তবে সে-কাজ মহাপুরুষদেরও অনায়াসসাধ্য নয়। তাই ঈশ্বর অসহায়কে আরও একটু সমস্যার মধ্যে ফেলে তারপর সেই অসুবিধেটি মোচন ক’রে দেন। কোনঠাসা লোক আবার পুরনো ঝুটঝামেলার জীবনে এসে পড়ে। কিন্তু খানিকটা নেমে আগের জায়গায় পুনর্স্থাপিত হওয়ায় সে নিজেকে জয়ী এবং সুখী ভাবতে থাকে। চাঁদের অসুখ থেকে ওঠা-ও বাড়িতে তেমনই এক ক্ষণবসন্তের জন্ম দিয়ে গেছে।

নয়
— আমার ঠাকুর্দা ছিলেন স্বর্গীয় শ্রীধর তর্কালংকার, স্বর্গীয় অমূল্যচরণ তর্কালংকার আমার প্রপিতামহ।
— আমিও বিয়ে হয়ে ইস্তক শুনিছি, শ্বশুরবাড়ির বংশে অনেক কাঁচালংকা শুকনো লংকা ছিল। ফোড়ন কাটে মায়া, মুখে আঁচল চাপা দেয়, তারপর বাচ্চাদের দিকে ফিরে : প্রপিতামহ মানে ঠাকুদ্দার বাবা, বুঝতি পারিছো?
নির্মল বাবু হয়ে ব’সে গোপার মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে যায় :
— মহা-মহা পণ্ডিত ছিলেন তাঁরা। তবে পাড়ার বয়স্করা এ-বাড়ির ছেলেমেয়েদের চিনত ‘শোয়া-পণ্ডিতের বংশ’ ব’লে। সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়ায় বিষ্ণুমন্দিরের মুখোমুখি স্কুলবাড়ির মতো লম্বা দোচালা। টানা বারান্দায় সার দিয়ে তক্তপোশ, ঘরের মধ্যে উঁকি দিলেও ওই খাটিয়া-সাইজ খাটই। তাতে আগাগোড়া বই ডাঁই করা রয়েছে। মাঝখানে খোঁদল ক’রে এক একজন শুয়ে। শুয়ে, ঘুমিয়ে নেই কিন্তু। বই পড়ছে।
এটা ন্যায়শাস্ত্রের খাট, পরেরটা স্মৃতির — দুই জ্যাঠাতো ভাইয়ের সংসার। ভেতরের ঘরে সুশ্রুত খাটে কবিরাজ ছোটকাকা, আবার গীতাভাগবতের পুরনো খট্টাঙ্গটি খোদ বাড়ির বড়কর্তার। দেখলে দূর থেকে বেশ মনে হবে জেলা হাসপাতাল।

যে কাহিনি বলতে যাচ্ছি, ছোট্‌ঠাকুরদার লেখা তালপাতার পুথি থেকে উদ্ধার করেছিলেন আমার বড়দা। চৈতন্যের আবির্ভাবের দুশো বছর পরে খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন মধুসূদন, তার মতো ন্যায়-বৈশেষিক শাস্ত্রজ্ঞ ও তার্কিক তখন গোটা বঙ্গদেশে নেই। সেবার বেনারস থেকে এসেছেন দিগ্বিজয়ী দশরথ মিশ্র, জাঁহাবাজ লড়ুয়ে, যাকে তর্কে হেরে যাবে ভয়ে লোকে সম্ভাষণ করতেই ভয় পায়। দশরথের বজরা গঙ্গা বেয়ে ভাটপাড়া কাটোয়ায় নোঙর রেখে শেষে বিজয়পতাকা উড়িয়ে পদ্মা বেয়ে কপোতাক্ষ হয়ে ভৈরবের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে ব’সে রইল। সে বজরার এ-মাথা ও-মাথা করছে বাদশাহের মতো আর ছোট-বড় কথা বলছে বাঙালির জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে। তখন সাতক্ষীরা খুলনার মাতব্বরেরা এসে ধরল — মহাশয়, আপনি রুখে না দাঁড়ালে তো বাংলার মান বাঁচে না। রাজি হতেই হল মধুসূদনকে।

বিতর্কের দিন মেহেরপুরের মাঠে বিরাট শামিয়ানার নীচে দুই পণ্ডিতের বসার ব্যবস্থা। চারপাশে গোল হয়ে এলাকার মান্যিগন্যিরা আসীন, পেছনে উৎসুক জনতা। এসে তো বসলেন, কিন্তু মধু পণ্ডিত একটু যেন উশখুশ করছেন মনে হচ্ছে? দশরথ শুরুর প্রশ্ন একটু হালকা চালে ছেড়েছেন :

— ধর্ম কয় রূপ?
মধুসূদন চুপ!

শুনতে পাননি। মেলা গোল ক’রো না, ওহে লোকজন। রিপিট করা হল প্রশ্ন। মধু এবারও নির্বিকার। দশরথের পাতলা লাল ঠোঁটে হাসি বঙ্কিম হল।

— নির্গুণ আত্মজ্ঞান কার আবিষ্কার?
মধুসূদনের পন্ডিতি ভেঙে ছারখার।

—- ও বাবা, কী বোলতিছেন, মানে বুঝি না তো!
যেন শিউলির গলায় নির্মলের সম্বিত। সে তালকাটা হয়ে তাকায় মায়া, তার অনুবাদিকার দিকে।

(চলছে)

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

তিন
আপনি তো বাজারে চলে গেলেন, এদিকে ছেলে আবার চোখ উলটোয় পড়িছিল।
তারক ডাক্তার স্টেথো দিয়ে রোগির বুক-পিঠ ছেনে যথারীতি বাঁহাতে তার কবজি ধ’রে নিজের রিস্টওয়চে ডুবে গেছে। আর দিদিমার বুক ঢিপ ঢিপ, তারক সেই উদ্‌ভুট্টি কথাটা ব’লে বসবে না তো — ঘ্যাঁজ্‌ড়া?

জর্দাপানের গন্ধলাগা পুরিয়া নির্মলের হাতে ধরিয়ে ডাক্তার চলে গেল। তা থেকে এইটুকুন হাফ ট্যাবলেট “ওঁ বিষ্ণু ওঁ বিষ্ণু” ক’রে খাইয়ে দিতেই গায়ে নড়াচড়া লেগে চাঁদের হাঁচি পড়ল একটা। নির্মল বলল, জীব!
কাহিল গলা শ্বাস টানতে টানতে জিগ্যেস করে :
— জীবো মানে কী?
— মানে জীব সহস্রং, হাজার বছর বেঁচে থাকো।
— কেউ হাঁচি দিলি আপনি বাঁচতি বলেন কেন?

উত্তর নেই। আলাম্‌-ফালাম্‌ কথা না ক’য়ে চোখ বুজে এট্টু শুয়ে থাক, বলে মায়া রান্নাঘরে পা বাড়ায়। ছেলে চোখে পলক টেনে দেয়, কিন্তু ভ্রূ কুঞ্চিত থাকে।

মায়ার পড়াশুনো প্রাইমারি স্কুলের চার কেলাস; ওই জ্ঞানবলে সে যে-কোনও বাংলা বই সগৌরবে পড়ে ফেলতে এবং পরিচ্ছন্ন চিঠি লিখতে পারে। তার ওপর শ্রুতি-বিদ্যেয় মহিলার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল — বড় বড় রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত বা কুসুমকুমারী ভাতের মাড় গালতে গালতেও টর-টরিয়ে ব’লে যাবে।
শুধু সেলাইফোঁড়াইটা বিশেষ আসে না ব’লে মায়ের ঠেলা খেয়ে জন্মের-মধ্যে-কর্ম একখানাই কুরুশকাঠির আসন বানিয়েছিল। সেটা বড়ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে — মুখোমুখি দুই সুতোর ময়ূর আর লেজের নীচে “বেদনার সাধনায় যে জন নির্ভয়, আজ হোক কাল হোক জয় তার জয়”। বর্গীয় জ-এর মাকড়ি কাঁচা হাতের টানে আ-কার হয়ে যাওয়ায় সঞ্জু প্রায়ই তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়ে — বেদনার সাধনায় যে ডান নির্ভয়, আডা হোক কাল হোক ডায় তার ডায়। ছেলে তো না, এট্টি পাকা কলা!

শোনা-বিদ্যেয় ধুরন্ধর মায়া জানত, অথর্ব বেদে বলা আছে — কেউ হাঁচি দিলে ওমনি জীব সহস্রং উচ্চারণ ক’রো, কেননা হঞ্ছিকাকালে মানুষ মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যায়। বাবা সে-কথা ভাঙতে চায়নি অসুস্থ ছেলের কাছে।

চার
— বন্ধুগণ, আগামি কাল সন্ধ্যা ছ’ঘটিকায়… আসুন দেখুন… দশরথ কেঁদে কেঁদে অন্ধ, ভরত শোকে পাথর… মা ইচ্ছাময়ী অপেরার পরিচালনায়… ধনীর দুলালি সীতা আজি পথের ভিখারি…কলোনির সমস্ত অধিবাসীবৃন্দের অনুরোধে… আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হল… রামের বনবাস, রামের বনবাস, রামের বনবাস।
মুখের সামনে খবরের কাগজের চোঙা ধ’রে ক্ষয়াটে চেহারার একজন ভ্যানরিকশায় যেতে যেতে চেঁচাচ্ছে। যেখানে দু’চারটে বাড়ি বা রাস্তার তেমাথা, সজনেগাছের গায়ে বিজ্ঞাপনের কাগজ চিটিয়ে দিচ্ছে লোকটা। তারপর ভ্যানের পেছনে ছোটা বাচ্চাদের একটা পোস্টারের জন্যে আবেদন অগ্রাহ্য ক’রে :
— একই সন্ধ্যায় রূপসী সীতা ও রাক্ষসী শূর্পনখা… সকলের বসিবার সুবন্দোবস্ত… হ্যাজাকের আলোয় দেখুন এই প্রথম গ্রামের মঞ্চে সোনার হরিণ… তাছাড়া ফুলুটে মালতীপুরের খলিফা শিল্পী স্বদেশ পাল… পালা শেষে মুক্ত হস্তে মালা-ডাকের সুযুগ আছে…।

— দিদ্‌মা, আমি রামযাত্রা দেখতি যাবো।
— যাবাই তো। বুকির কষ্ট এট্টু কি কোমিছে, দাদাভাই?

চাঁদ সোয়েটারের ওপর দিয়ে গলার অস্থি এমন আলতো ছোঁয়, যেন সাত দিনের বাসি গোলাপ, দোকা লাগলেই পাপড়ি ঝরে যাবে। তারপর দুবার নিঃশ্বাস টেনে চোখ বড় ক’রে বলে, ব্যথা লাগতিছে না! ঝুপড়ি ভেঙে রাস্তা পাকা করার মতো তার বুকের খাঁচার মধ্যে ফুসফুস হৃদপিণ্ড সব উড়িয়ে দিয়ে শুধু একটা তেলমাখা ঝাঁ-ঝাঁ করা ন্যাশানাল হাইওয়ে, যার ওপর বাতাসের অনন্তপ্রসূন শুধু ফুটেই চলেছে… কড়াইতে উচ্ছ্বসিত খইয়ের মতো। দিদিমা নিজের কপালে যুক্তকর তুলে আনে — জয় মা বিপত্তারিণী! তারকের ওষুদি কথা কয়! তখন বাসু বুড়ির কাঁধ জড়িয়ে ধ’রে ফিসফিসিয়ে জানাচ্ছে, ওষুধে কথা কোতি পারে, কিন্তু জানো, যে হাতঘড়িতি ডাক্তারবাবু রুগির নাড়ি পরীক্ষে করে, সেটা ডাহা অচল; সকালবেলা আড়াইটে বাজে ব’সে আছে। মা সরস্বতীর দিব্যি!

পাঁচ
— আমার চোখের দিকি তাকায় বল, রান্নাঘরে ঢুকে তালের ফোপ্‌ড়া খাইছিস?

চার ভাইবোন দাঁড়িয়ে, মা এক এক ক’রে জেরা করছে। যে হেসে দেবে, সে চোর।
— ভাইয়ের জ্বর ব’লে তার ভাগেরটা রাখে দিছিলাম, সেও গিলতি হ’লো!
আজ শিউলি হেসেছে, কিন্তু কথায় কথায় ফুটফুটে দাঁত দেখায় ব’লেই না সে শিউলি। সঞ্জুকে যেমন “ঘুর ঘুর স্ট্যাচু” খেলাতেও হাসানো যায় না, তার মানে সে সাধুপুরুষ? মা বিরক্ত হয়ে চার বাচ্চাকেই চড়াচ্ছে।

তারপর — বাসু, আমতলাত্থে আমের ডালটা উঠোনে নিয়ে থো, বাবা কুড়োল দিয়ে ফাড়ে দেবেনে। কয়লা ফুরোয় গেছে — ব’লে মায়া চাঁদের কপালে গাল ঠেকিয়ে জ্বর আছে কিনা দ্যাখে।
বাসু ওমনি মারধর ভুলে ভারি আমডালের এক দিক উঁচু করে “মাগো আমার দে না কেন একটি ছোটো ভাই” বলতে বলতে খানিকটা ছেঁচড়ে আনল, দম নিয়ে “দুইজনেতে মিলে আমরা বনে চলে যাই” ব’লে আরও খানিকটা। এভাবে কবিতা ফুরোতে ফুরোতে কাজও শেষ। কিন্তু আরও একটা ছোটো ভাইয়ের শখ নাকি বাসুর? আপ্‌নি শুতি ঠাঁই পায় না, শংকরারে ডাকে!

রান্নাঘরের উঁকি মেরে গোপা দেখল, মা ঠোঁটে হাসি চেপে জ্বাল দেওয়া দুধ একটা কাপে ঢালছে। ঘর জুড়ে যেন শিশুর মুখের গন্ধ…।
— মা, আমার পেটে কিচ্ছু নেই!
— সে কি, অ্যাক্‌খুনি চিঁড়ে দিয়ে কলা দিয়ে খালি যে?
— আমার দুধির ক্ষিদে পাইছে।
মায়া প্রথমে চোখ পাকায়, তারপর হাতছানি দিয়ে মেয়েকে ডাকে, ডেকচি থেকে দু’হাতা দুধ ব’ক্‌নো থালায় ঢেলে ফুঁ দিয়ে হাতে ধরিয়ে ভর্ৎসনা করে : সব দৃষ্টিক্ষিদে। মুখ পুড়োস না। খায়ে চুপ ক’রে বেরোয় যাও।… আগে ঠোঁট মোছ, ঠোঁট মোছ!

ছয়
কাপের দুধে চুমুক দিতে দিতে কাঁথা-গায়ে চাঁদ জানলার ফোকর দিয়ে রাস্তা দেখছিল। সুপুরিগাছের শুকনো খোলার ওপর একটা কচি বাচ্চাকে বসিয়ে তিনটে খুদে টানছে। হ্যাঁচকা টান খেয়ে সে পেছনে উলটে প’ড়ে অপরিমেয় কাঁদতে লাগল। একটা ছেলে চলে গেল চটপটি বাজাতে বাজাতে। মনিদাও খুব সুন্দর চটপটি বানায় — কলাপাতার মোটা ডাঁটি এক-হাত মতো কেটে নিয়ে তার এক মাথা দা দিয়ে লম্বালম্বি তিন ভাগে চিরে দুপাশের ফালিদুটোর গোড়া একটু ভেঙে নিতে হবে। এবার ডাঁটির আর এক মাথা ধ’রে ঘন্টা বাজানোর মতো নাড়লেই চটপট চটপট…। এইসব লোক-চলাচলের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপিঠে চন্ডীবাবুদের জমিতে গেঞ্জি আর লুঙি পরা মানুষটাকে; দুটো ইঁটের ওপর ব’সে সামনের দুটো ইঁটে পা বিছিয়ে দু’পায়ের পাতার মাঝখানে ঝামা ইঁট রেখে হাতুড়ি চালাচ্ছে। তিনবার চারবার বাড়ি খেয়ে ইঁট শোকে পাথর না থেকে ভেঙে পড়ছে, হয়ে যাচ্ছে খোয়া।

এমনি ক’রে আস্তে আস্তে ছোট্ট খোয়াটিলা তৈরি হচ্ছিল আর লোকটাও ভেসে উঠছিল টিলার মাথায়… মাটি থেকে তার দূরত্ব বাড়ছে ধিকিধিকি। প্রত্যেকবার হাতুড়ির ঘায়ের সঙ্গে হ্যাহ্‌ নামের একটা গোঙানি বা গর্জন মিশিয়ে দিচ্ছে আর চাঁদের কানে সেই শব্দজোড় পৌঁছোচ্ছে হাতুড়ি ইঁটে পড়ার ভগ্ন-মুহূর্ত পরে। এভাবে সকালে যে ভূমিপুত্র, দুপুরে ভাত খেয়ে এসে তুমি দেখলে কিছুটা পাহাড়ি, আর বিকেলে খেলতে বেরোনোর সময়ে সে গোঁফেগেঞ্জিতে লাল সুরকি লাগা খোয়া-হিমালয়ের ঈশ্বর, শান্তিমতো একটা বিড়ি ধরাচ্ছে। ওদিকে রাস্তার ধারে কোনও বাচ্চা উবু হয়ে বসল, ন্যাংটো পাছার নীচে হলুদ ধোঁয়া-ওঠা অজগর-পাক, শেষে ছুঁচোলো ফনাটা। জানলায় মাজালি বিড়বিড় ক’রে চরে বেড়ায়, এখন রোদ্দুর গোধূমবর্ণ ত্যাগ ক’রে অল্প অল্প চাঁটি মেরে আমাদের পিঠ গরম করার উপযুক্ত। সেই অনবরত ধূপছাঁওয়ের মধ্যে একটা ঝিমধরা খট খট আওয়াজ শোনা গেল। পদপাতহীন কেঠো পা নিয়ে চাঁদের আমতলাবাড়ির পাশ দিয়ে বিজুখোঁড়া দুলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে স্টেশানের দিকে।

(আর একটু)

শোয়া-পণ্ডিতের গুষ্টি

এক
নিবাধুইয়ের সবজি বাজারটা কেমন যেন কম-রোশনি, চোখ-বোজা, মরা-মরা। ইঁটের দাঁত বের করা পিলারের ওপর টালির চাল, নীচে কাঁচা এবড়ো-খেবড়ো মাটিতে একটা চটের বস্তা পেতে ব’সে দুতিনটে বস্তার ওপর আনাজের ডাঁই তুলেছে দোকানদাররা, বিক্রির টাকাপয়সা চালান করছে হাঁটুর নীচে চাপা অন্য একটা দুভাঁজ করা বস্তায়।

আলু-পেঁয়াজের লাটের সামনে উবু হয়ে সওদা বাছছে লোকজন, তার মধ্যে লং ক্লথের সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতির ওই যে নির্মলচন্দ্র। জাহাজের মতো একজন খদ্দের হেলেদুলে এসে হাতের ডিবে থেকে চুন খুবলে লাল জিভে মাখিয়ে নিয়ে জিগেস করল, আলু ক’পহা? দোকানদার ব্যস্ত হয়ে হাতবোমা সাইজের আলুগুলো বেছে চুপড়িতে তুলতে তুলতে জবাব দিল, ক’কেজি লাগবে বলুন, মুখুজ্জেদা। হুগলি হাটের পাল্লা-দরে দিয়ে দোবো।

ওমনি পেছনে একটা ধাবমান আওয়াজ শোনা গেল, আলু ক’পহা? তোর বাপের পহা? ঢলঢলে ধুলোমাখা শার্টপ্যান্ট পরা, কোমরে নারকোল-দড়ির বেল্ট, হাতে কঞ্চির লাঠি — সীতাপাগলি হুশ করে বেরিয়ে গেল। বাজারের ও-মাথায় পৌঁছে কুচকাওয়াজরত সৈন্যের মতো মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসতে লাগল, মুখে সেই মন্ত্র, তোর বাপের পয়সা?

এই বাজারপাড়াতেই উন্মাদিনীর বিচরণ; বর কলেরায় ফৌত হওয়ার পরে ছেলেকে নিয়ে থাকত; কিশোরপুত্র রাস্তায় লরিচাপা পড়ায় সীতা রাতারাতি পাগল হয়ে যায়। তবে নির্মল দেখেছে, অনেক সময় গ্রামের গরীব মানুষেরা মাথাখারাপ হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। টিফিনে রুটিটা-মুড়িটা কি দুপুরে দুটো ভাত যেভাবে হোক নসিব হচ্ছে তাদের। ফলে কোনও কোনও খ্যাপা আপনা থেকে সুস্থ হয়ে গেলেও খ্যাপামির ভেক ছাড়তে চায় না। নির্মল দেখে বুঝতে পারে, অভিনয়ের ফাঁকে কখন তারা ব্রেক নেয় অথবা কখন পাগল ফাঁকি দিচ্ছে পাগলামিতে।

আলুর দোকান থেকে দু’নয়া ভিক্ষে পেয়ে সীতা চলে গেছে পারিজাত টকিজের দিকে, নির্মল ঢুকল মাছবাজারে। শোল, চ্যাং, কই, কাঁকড়া, কচ্ছপ আর প্রচুর পুঁটি-মৌরলার ঢেউ পার হয়ে তবে মাটির হাঁড়ি নিয়ে বসা মেছুনি। মেয়েটা তিতিলের সরা তুলতেই গোল্লা পাকানো চারটে গাঢ় বাদামি সর্পপ্রতিম কুচে মাছ; তা থেকে সবচে’ প্রশস্তটি নির্মল কিনে নিল থোক দামে। কুচেমাছ খেলে গায়ে রক্ত হয়, তাকে গরম মশলা দিয়ে মাংসের মতো রাঁধতে হবে। তার আগে কুচের গলা বরাবর গোল ক’রে পোঁচ দিয়ে গোটা চামড়াটা লেজের দিক দিয়ে টেনে ছাড়িয়ে ফেলাই হল আসল ক্যাপাকাইটি! আঁশ-নিরামিষ যাতে ঠেকে না যায়, দুই হাতে দুই ব্যাগ ঝুলিয়ে নির্মল বাজার থেকে বেরোতে যাবে — “আ রে, পণ্ডিতমসাই, পাঁটার মাংস কিনেছেন ভালো কতা, আমরা তো আর আব্‌নার বাড়ি যাচ্ছিনে নেমন্তন্ন খেতে। তাড়া কীসের?”

সুধাময়… ট্রেনে তারা এক বগিতে বারাসাত যাতায়াত করে। ব্লক-অফিসে-চাকরি সুধা ভাবতে পারবে না মাসের এগারো তারিখেও নির্মলের বেতন হয়নি। আজ ঘর-কুড়িয়ে টাকাক’টা হাতে দেওয়ার সময় মায়া জানিয়ে দিয়েছে, আগামি কাল থেকে মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত বাজার বন্ধ।

সুধাময় তার অসন্তুষ্ট হাসিটা হাসে :
— সান্তিপ্‌পিয়ো মানুস, এক মনে সঙ্‌সার কোচ্ছে। আজকের নিউজপেপার পড়েছ?

রবিবারের খবরের কাগজ নির্মল পরের দিন স্কুলে গিয়ে পড়তে পায়। তাদের বাড়িতে রেডিয়ো নেই।

—তাসখন্দো চুক্তি সই হয়ে গেল জানো নাকো! রাসিয়ার পেসিডেন্ট তো ভারতের হাতে হারিকেন ধরিয়ে দিয়েছে। দুই দেসের সোন্নোদেরকে নিজের এরিয়ার ফিরে যেতে হবে বলো।
— ভালোই তো হয়েছে।
— কী বলছ, মাস্টার? আজাত কাস্‌মির দখলের এত বড় চান্স হাতছাড়া হয়ে গেল! পাকিস্তানও সাওস পেয়ে গেল।

সুধাময় যে কীসে খুশি বোঝা মুশকিল। যুদ্ধ যখন বাধে সেই অগাস্ট মাসে, বলেছিল মানুষ এবার না-খেতে পেয়ে মরবে। আবার এখন থামাতে চাইছে না। হাঁটতে হাঁটতে তারা সিনেমাহলের উল্টোদিকে বিজু খোঁড়ার চা-দোকানে হাজির হয়েছে। পায়ের-পাতাহীন কাঠের পা-টা পাশে খুলে রেখে বিজু তোবড়া মুখে জমিদারের মতো বিড়ি টানে, আর তার বেঁটে-বামন বউ শান্তি চা বানিয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রেতে গেলাসগুলো বসিয়ে ছুটছে দোকানে দোকানে — মেহবুব রেডিয়ো-সারাই, পাশে সেলাই-মেশিন নিয়ে বসা চিরকেলে কথার খেলাপি হারাধন দর্জি, তারপর গমকলের সাধুখাঁ, আদ্যাশক্তি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পারিজাত হলের লাইটম্যান মোটরম্যান, এইসব।

বিশ্‌কুটের যুদ্দো… চায়ের যুদ্দো… ফুলুরির যুদ্দো…সন্নেসের যুদ্দো — কখন সীতাপাগলি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতের এস-বিস্কুটখানা তাকে সঁপে দিয়ে বিজুর বউকে আর একটা চা দিতে বলে নির্মল। শান্তি গেলাসে চামচ নাড়তে নাড়তে টাকরায় চটাস আওয়াজ করে : নামেতেই মেয়েটাকে খেয়ে নিল, বুয়েচেন? সীতা নামে ওবিসাপ নেগে আচে।

এসবে ভ্রূক্ষেপহীন সুধাময় বকবক করেই যায় :
— আমাদের উচিত ছিল লাহোর এয়ারপোর্ট কেড়ে নোয়া। পাকিস্তান যদি জম্মুর আকনুরের দখল পেতো, তাহলে আমেরিকা রাসিয়া কারও কথাতেই ভারত ছাড়ত না — আমি তোমাকে লিকে দিচ্ছি, মাস্টার।

বাড়ির গেটে বুগেনভিলিয়ার ডালের মতো একটা সামনে ঝোঁকা লোক দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। সে বলল, আয়ুব খান বলেছেল হিঁদুরা জ্যাগামতো দুএকটা শক্ত ঘা খেলিই ভেঙে পড়বে। ব্যাটা কচি-র হাতের খেলনা পেয়েচে!

সুধাময় জবাব দিল, খেলনা নয় তো কী? মনে নেই, গত সালের এপ্পিল মাসে কচ্চের রানে অ্যাটাক করেছিল পাকিস্তান? বলে, কচ্চের সাড়ে তিন হাজার মাইল এলাকা নাকি ওদের। তাই নিয়ে ইংল্যান কমিসান বসিয়ে দিয়েছে। দ্যাকো, সেকানে আবার কী হয়!

বুগেনভিলিয়া বলে, সাদিনতা হয়ে গেচে বিস বচোর, এখনও সীমানা নিয়ে বিবাদ কীসের? আইন মোতাবেক ধোল্লে এটা বেআইনি।
— আইন মোতাবেক মানে জানো? আইনকে মুতিয়ে ছাড়বে। ওর নাম পাকিস্তান। হা হা ক’রে হাসে সুধাময়।

এই শব্দখেলা কথা বলতে উৎসাহ দেয় নির্মলকে।
— খবরের কাগজে দেখবা, ভারত বলিছে আমরা যুদ্ধে পাকিস্তানের দু’হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি দখল করিছিলাম, আর ওরা মোটে সাড়ে পাঁশ্‌শো। আবার পাকিস্তান বলে, আমরা ষোলোশো বর্গ কিলোমিটারের দখল নিছিলাম, ভারত সে তুলোনায় কিছুই না। গড়ে দেখতে পাবা, দু’দেশেরই সমান-সমান ক্ষতি। আমরা মারামারি বাধালিউ বড় দেশ এসে থামায় দেবে। মাঝখান দিয়ে নিজেদের কয় হাজার সেনা মরল, গোলাবারুদ নষ্ট হল, বাজারে চালির দাম বাড়ে গেল।

এমন মন্তব্য জনপ্রিয় হয় না, উলটে শীত-সকালের চা জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু সুধাময়ের মন হল তিনচোখো মাছের বুড়বুড়ি কাটা ডোবা। মেহবুব রেডিয়োর কাউন্টারে বসা দাড়িওলা জামালভাইয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে সে বলল,
— ঠান্ডাটা যাক, পাকিস্তান আবার অ্যাটাক কোরবে, তুমি কাস্‌মির আগলে রাকতে পারবে নাকো।

দুই
বাজার নিয়ে ফিরতে ফিরতে পছন্দসই চেনা একাকিত্বের মধ্যে আবার ঢুকে পড়ছিল সে। শীতের রোদ কৈশোর পার হচ্ছে; উঠোনে উঠোনে এত গাঁদাফুল… বাচ্চারা তাদের ফেদার বানিয়ে পিচবোর্ড দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার পর পাপড়ির থ্যাঁতলানো গন্ধে বাতাস বাঘবন্দী। মুখে নরম হাসি নিয়ে একটা লোক সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। যার সঙ্গে আলাপ ক’রে ফিরছে, সে নিশ্চয় এই সুহাস উপহার দিয়েছে তাকে। এভাবে প্রত্যেক মানুষ অন্যের অনুভূতির জলছাপ বয়ে বেড়ায় বুকের ভেতর। যেমন সুধাময় তার মনে ঘুগনির শালপাতায় চানাচুরের মতো সন্দেহ ছড়িয়ে দিয়ে গেল।

চৌবাড়ি ময়দানের অশ্বত্থগাছে দল বেঁধে অনেক পাখি ডাকছে, উলের লেচিতে জট পাকিয়ে গেলে যা হয়। সে সাবধানে ছাড়াতে চেষ্টা করছিল — শালিখ, টিয়া, ছাতারে, ফিঙে, বউ কথা কও…। পাখি শুনতে শুনতে দেশভাগ পেছনে চলে যায়, টানাটানির সংসারও যেন পিঠে সুড়সুড়ি দেওয়া পালক। তারপর কাঁসর শোনা গেল মান্নাপাড়া কালীবাড়ির, নির্মলের মনও শিস থেকে ভেসে গিয়ে নোঙর করল সংগীতে। তিন বার টং-এর পরে একটা মাত্রা চুপ, তারপরে আবার টং টং টং। নির্মল কাঁসরঘন্টাকে ত্রিতাল বানিয়ে ওই লয়ে গুনগুন ক’রে বোলকারি গড়তে লাগল। কাব্যতীর্থ পাশ দেওয়ার পরপরই তার নড়াল-এর জমিদারবাড়িতে গৃহশিক্ষকের চাকরি জুটে যায়। মাস-মাইনে করা গোয়ালিয়র ঘরানার ওস্তাদজি থাকতেন পাশের ঘরে। সন্ধেবেলার মজলিশে সে মাঝেমধ্যে মৃদঙ্গ নিয়ে বসেছে।

একটু এগিয়ে নির্মল দেখল কলোনির একটা বাচ্চা, চাকা চালাতে চালাতে এতদূর এসে পড়েছে। লতপত ক’রে পাক-খাওয়া বাতিল সাইকেলের টায়ার সামান্য লাঠি দিয়ে পাকা ড্রাইভারের মতো সামলাচ্ছে সে; এই শীতে গায়ে কোনও রকম একটা ছিটের জামা, প্যান্টের বোতাম নেই ব’লে বাঁহাতের ছোট্ট মুঠোয় ঢাকা তার সংক্ষিপ্ত লজ্জাশরম, পা খালি আর ধারাবাহিক শিকনি নাক দিয়ে। বিষণ্ণতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় আবার মোর হয়ে গেল নির্মল। সে জানে এই শিশু বিপর্যয়ের মায়াহীন প্রতীক যার সারা গায়ে উল্কি ক’রে লেখা আছে চারটে অক্ষর — শরণার্থী।

(চলবে)

নিমতিতা সরকারি কলোনি

এগারো
“ও-গৃহস্থ, আমার কলোমডা কোথায় বোলতি পারো?… ও-গৃহস্থ, আমার চ্যাবোনপ্রাশের কৌটো পাচ্ছি না”। মনে হবে ভাষকের বয়েস পঁচিশ বছরে আটকে, তেমনি নেশাধরানো গলা। ‘ও-গৃহস্থ’ ডাকে ঘর-উঠোন ভ’রে আছে সারাদিন। মায়াও “একটা কাজ যদি করার উপায় থাকে” এই নকল উষ্মা ঠোঁটে নিয়ে রান্নাঘর থেকে এসে জিনিস খুঁজে দিয়ে যাচ্ছে – কলোম তো নিজির বালিশির তলেই চাপা দিয়ে রাখিছেন।… ডান হাতখান টেবিলের দিকি বাড়ালিই চ্যাবনপেরাশ পাওয়া যায়”। তারপর ফিরে যেতে যেতে মুচকি হেসে শুনিয়ে যাচ্ছে, “শিব মন্দিরটা নড়ে, তবু ওমুক ভট্টাচার্য নড়ে না”।

সেনহাটির সিদ্ধান্তপাড়া গ্রামে তাদের বারবাড়িতে এক গেরুয়া-রঙ শিবদেউল ছিল যার পেছনের বারান্দায় গুচ্ছের চামচিকের বাসা। কর্তাকে নিয়ে বউ যে পারিবারিক প্রবাদ তৈরি করেছে, তাতে মানুষের দেবত্ব (নড়ে না) আর ভগবানের জ্যান্তভাব (নড়ে) প্রমাণিত হয়।

আপাতত একজন মধ্যবিত্ত ভগবানের পেছনে ফোঁড়া উঠেছে। কলোনির অধিবাসীবৃন্দের গায়ে এমন ছরবেছর ফোট গজায় আর চোখে আঞ্জনি। বাসুদেব আর সঞ্জু তারক ডাক্তারের বাড়ি পৌঁছে দেখেছিল, তিনি লুঙি প’রে বেকায়দাভাবে উপুড়, উরুর শুরুতে সবুজ তেলে ভেজানো তুলো লাগানো। ফোঁড়ার মুখ বেরিয়েছে কিনা, বেরোলে ক’টা মুখ, পেকে গেছে কি, পাকলে ফাটবে কবে, কোন তোকমা লাগালে তখনি পুঁজ টেনে নিয়ে ঘা শুকিয়ে দেয় — এমন চর্চায় নিমতিতা সারাক্ষণ গমগম করে। কখনও স্কুল থেকে কোনও হাফ-ছুটি কিশোর খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছে, তার হাফ প্যান্টের ভেতর থেকে থাই বেয়ে নামা সরু রক্ত দেখে মেয়েরা হাতে মুখচাপা। তো উপুড়শোয়া ডাক্তার একটা ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে অর্ধেক ভেঙে বাসুর হাতে দিয়েছিল। ওই তাতেই চাঁদের জ্বর সর্বশান্ত হল।

কিন্তু ইঁট পর পর থিয়ে ক’রে সাজিয়ে ঠেলে দিলে যেমন ধারাবাহিক পতনের লাইন আঁকা হয়, তেমনিই ছেলেটার শরীর। জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর মায়ের হাতে তিনচার গাল হাঁসের ডিমের ঝোল-ভাত খেয়ে শুয়ে পড়েছিল, এখুনি কেঁদে জেগে গেল বুকে সাঁই-সাঁই শব্দ নিয়ে। আঁতকে উঠল সন্তান পাহারা দেওয়া দুই মহিলা : “সব্বোনাশ! ও নাদু, ছেলের যে হাঁপির টান উঠিছে!” কাজেই, ব্যস্ত হাতে রান্নাঘরের দরজার শেকল খোলার শব্দ হয়। ফুলকাটা পেতলের বাটিতে সরষের তেল নিয়ে তাতে একমুঠো মাষকলাই ফেলে জনতা স্টোভে বসিয়ে দিল দিদিমা। আর মা ক্রমাগত “চাঁদ আস্তে… চাঁদ চুপ কর…অ্যাখোনি কমে যাবেনে, শোও সোনা… ঘুমোনোর চেষ্টা করো, আচ্ছা, কাল সকালে উঠে অ্যাট্টা নতুন জিনিস খাওয়াবানে তোমারে, ও চাঁদ, শুনলি?…”।

মা তো বোঝে না, শুতে গেলেই দম বন্ধ হয়ে যাবে। মুখ দিয়ে বাতাস টানার চেষ্টা করতে করতে চাঁদের গলা শুকিয়ে এখন কাশি হচ্ছে, প্রতিধ্বনিময় ঘং ঘং — স্টেশানে লোহার তারে ঝোলানো কাটা রেললাইনে হাতুড়ির বাড়ি মারলে যেমন ঘন্টা বাজে। যত শ্বাসকষ্ট বাড়ে, তত সমস্ত পৃথিবীর ‘পরে রাগ তৈরি হয় তার। বোন অবহেলায় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, মহানন্দে নাক ডাকছে দিদি, অথচ আমার বুকই আমার শত্রু! পিপারমেন্টের মতো ঠান্ডা হাওয়া চারদিকে, শুধু আমার জীবনেই কেন বাতাস বাড়ন্ত হয়ে যায়? দিদিমা শীতল আঙুলে গরম মাসকলাইয়ের তেল মাখিয়ে তার বুকেপিঠে ড’লে দেয়, তালে তালে ফুসফুস-অ্যাকর্ডিয়ান থেকে নানা সুরের সিম্ফনি…ফুসফুস-জারুলগাছে অনেক পশুপাখালির ডাক। কারও কোলে কোলাব্যাঙের মতো ঝুলে থাকলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেত, কিন্তু দিদিমার কাঁখ থেকে তাকে পিছলে যেতে হয় বারবার, মাও একটু পরে হাঁপাতে থাকে, “নাম বাবা, আমি কি পারি, তুমি না বড় হয়ে গেছো!” এখন নিঃশ্বাস নিতে গেলেই চাঁদের পিঠের পেশিতে খিঁচ লেগে দম আটকে আসছে। তখুনি হালকা খুটখুট শব্দ হয় কোথাও, আর মায়া মাথায় ঘোমটা টেনে বসে।

— ও মা, তোমার জামাই দরজায় টোকা দেচ্ছে!
— ওরে না, কালো মেনিডা রাতবিরেতে অমোন দুয়োর হাঁচড়ায়।

নিজের স্বামীকে কীভাবে কতটা চিনেছে, বাইশ বছর বয়েসে বৈধব্যগ্রস্তকে সে বোঝাবে কী ক’রে! একশোটা কাঠের ডাঁটিওলা ছাতা থেকে মায়া স্বামীর ছাতাটি এক মিনিটে চিহ্নিত করে দেবে। স্কুলে যাওয়ার পাঞ্জাবি প’রে ভুলুকভালুক তাকালেই বোঝে হাতঘড়িটা খুঁজছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন কলবল করতে করতে হেঁটে আসছে ট্রেনযাত্রীরা, একজন নীরব মানুষের জুতোর আওয়াজ সে মোড়ের মাথাতেই শনাক্ত ক’রে ফেলে। তিন মাসের পোয়াতি জানলায় ব’সে যেমন দূর-মাঠের ঘাসের গন্ধ পায়, স্বামীর ব্যাপারে দিনরাত তেমন গভীর ইন্দ্রিয়শক্তি নিয়ে জেগে থাকে মায়া।

ঘরে ঢুকে নির্মলচন্দ্র ছেলেকে কোলে তুলে নিজের গায়ের লম্বা পুরোনো শালটি তার পিঠের ওপর জড়িয়ে নেয়। পাশের ঘরে ফিরে যেতে যেতে বলে, রাত দুটো বাজে গেছে, তোমরা হেরিকেন নিভোয় শুয়ে পড়ো।

বারো
বাবার গায়ে সারাক্ষণ পুজো-পুজো গন্ধ। যদিও নির্মল বাড়ির পুজো আর স্কুলের সরস্বতীঅর্চনা ছাড়া কোথাও পৌরোহিত্য করে না। কেউ অনুরোধ করলে বলে, আমাদের বংশে যজমানিবৃত্তিতে নিষেধ আছে। বাবার কাঁধে কন্ঠার হাড়দুটো জেগে থাকে। সেই খোঁদলে নিজের থুতনি বসিয়ে নেয় চাঁদ। বাবার তলপেট সামান্য উঁচু, সেখানে তার পাছাটি আশ্রয় পায়। যেন এক উল্টোনো ইজিচেয়ারে শুয়ে সে এই প্রথম সুষুপ্তির ভাবনা ভাবতে পারে।

এদিকে সারা রাত ঘুম ভাঙে আর ঘুম জোড়ে মায়ার, পাশের ঘরে মৃদু পদপাত তবু থামে না। প্রতি অর্ধ-প্রহরে ছেলেকে বিছানায় শোয়াতে যায় বাবা, আর সে চিৎকার ক’রে কেঁদে আবার কোলে উঠে আসে। বাচ্চা কোলে এই অনন্ত পায়চারির মধ্যে শুকনো পাতা মশ-মশ ক’রে বাড়ির পেছন দিয়ে শেয়াল দৌড়ে যায়, রাতের পাখি ডেকে ওঠে আজাদ হিন্দ সংঘের বটগাছে, আর ভেসে আসে মান্নাপাড়া থেকে কীর্তন-আসরের গান — ও মন, ওরে পাগল মন, তুই চিনলি না আপন। পদকর্তার গলা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে :
গৌরীদাসের সঙ্গে চৈতন্যের মিলন হল কোথায়? এ-নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর বহুমত, কেউ বলছেন শ্রীখণ্ডে, কেউ কাটোয়ায়, কেউ বা কাঞ্চননগর। আমরা বলি, কোন কালে দেখা? কেননা, স্থান গুরুত্বের নয়, কথা হল কাল।
যেথা যেথা নিত্য হরিনাম-সংকীর্তন।
সেথা নিত্য নবদ্বীপধাম, নিত্য বৃন্দাবন।।

বাণীনাথ ভট্টাচার্যের দুই ছেলের ছোট নির্মল, দাদা করুণাময়। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি করুণা ভাইকে বললেন, নিমু আমি হিন্দুস্তানে চলে যাব সপরিবারে। তুই আমার সম্পত্তির অর্ধেক অংশ বাবদ টাকা দিয়ে দে। নির্মল নগদ যা ছিল কুড়িয়েবাড়িয়ে ব্যাংকের জমা টাকা ভেঙে দাদাকে দিয়ে দিয়েছে। কয়েক বছরের মধ্যে তাকেও ভিটে ছাড়তে হল। নারায়ণশিলার নিত্যপুজোয় যাতে বাধা না পড়ে, এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে বাড়িতে বসিয়ে পরিবর্তে কিচ্ছুটি না নিয়ে দেশ ছাড়ল লোকটা।

তখন পদাবলী-কথকের গলা :
শ্রীচৈতন্য নিত্যানন্দাদি বন্ধু ও শিষ্যদের নিয়ে নগর-পরিক্রমায় বেরিয়েছেন, বদনে হরিনাম — এমনি সময়ে গৌরীদাস উপস্থিত। তাঁকে দেখেই গৌরাঙ্গের মনে পড়েছে শ্রীরাধার কথা। কেননা, এই গৌরীদাস তো আর কেউ নন, তিনি বৃন্দাবনের সুবল। মহাপ্রভু গৌরীকে জড়িয়ে ধরে “রাধা রাধা” ব’লে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে লেগেছেন।

তাদের হিন্দুস্তানে চলে আসার তোড়জোড় চলছে, পাশের গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে মাদারে মুখুজ্জে এসে বলে কি, নির্মল আমাকে তুমি কিছু টাকা দাও তো দত্তপুকুরে ভালো জমি পাওয়া যাচ্ছে, তোমার জন্যে রাখি। নির্মল তার হাতে নিজের শেষ সম্বল দু’হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়েছিল। এ-বঙ্গে এসে দ্যাখে কলোনির জমি সরকারি, কিনতে এক পয়সাও লাগে না। আদাড়ে নামে বেশি পরিচিত মাদারেকে সে আর টাকার কথা শুধোয়নি। যা গেছে, গেছে।

তখন মান্নাপাড়ার কথকঠাকুর :
আহা, সে কী অশ্রু! দৃশ্য দেখে কোনও ভক্ত বলছেন, প্রভুর দুচোখ বেয়ে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে। আবার কোনও ভক্ত বলছেন — না না, গড়িয়ে পড়ছে মুক্তি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যের ভক্তিরূপ গাল বেয়ে মুক্তি গড়িয়ে পড়ছে গো!

এবার জোকার উঠল — হরে হরে কৃষ্ণ, নিতাই নিত্যানন্দে জয় জয়! বলো শ্যামো অঙ্গে, গৌর অঙ্গে বলো জয়। নির্মল টের পায়, শ্বশ্রূমাতা মাটির হাঁড়িতে গোবরজল নিয়ে ছড়া দিচ্ছে উঠোনে। ফার্স্ট ট্রেন ঘটঘট ক’রে স্টেশানে ঢুকল। মাঘী পূর্ণিমা লাগবে সকাল সাতটায়। বচ্ছরকার দিন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। তবু তার গলার বাঁশি-শব্দ এখন অনেক আবছা। সন্তর্পণে শোয়াতে গিয়ে নির্মল দেখে গাল ভিজে ভিজে, কয়েক দানা কৃষ্ণপ্রিয় অশ্রু বাবার চোখ থেকে খ’সে গিয়ে লেগেছে সন্তানের মুখে।

সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি-র মানুষটা বিড়বিড় করে গীতগোবিন্দ ভাঁজছিল — চন্দনচর্চিত নীল কলেবর পীত বসন বনমালী। কিন্তু জয়দেবের দ্বিতীয় চরণ কেলি চলন্মণি কুণ্ডল মণ্ডিত গণ্ডয়ুগস্মিত শালী-র জায়গায় হঠাৎ মাথায় এল — মাটির বুকে চাঁদের নিমাই, ধরতে গিয়ে জাত খোয়ালি। এটা কোনও বাউলগানের লাইন, নাকি নিজেই সে লিখেছে কখনও! অযাচিত এমন এক সৃষ্টিমুহূর্তেই হয়ত ছোটছেলের নাম রাখা হয়েছিল অযাচক। এখন ঘুমে বিভোর তীক্ষ্ণ-করুণ মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, কে জানে জীবনের কাছে কত-কতবার হাত পাততে হবে এই শেকড়-ওপড়ানো শিশুকে; প্রার্থনা, মাঙন, কাতর অনুরোধে ভ’রে থাকবে কিনা এর পরমায়ু! বৈরাগী নামের বোঝা চাপিয়ে একটা দুর্বল ফুসফুসকে আগে থেকেই ক্লান্ত ক’রে তুলব?

চাঁদের ভালো নাম তবে চন্দন, যে সব রকম সৎকারেই লাগে — এই ভেবে তাকে বিছানায় নামাল নির্মলচন্দ্র। বালিশে নতুন নামের গন্ধ নিয়ে সে স্বপ্নের দিকে বয়ে যাক…।

(শেষ)

নিমতিতা সরকারি কলোনি

আট
অনেক দূরের নক্ষত্রমণ্ডল থেকে ফিরে আসছিল চাঁদ, রিকশা ক’রে। অন্ধকার মহাজগতে চাকার নীচে খোয়ার মতো ছায়াপথ আর গ্রহাণুপুঞ্জের ঝাঁকুনি খেয়ে, রিকশার হ্যান্ডেলের লাগানো টেমি-র আলোয় রাস্তা দেখে দেখে…। হঠাৎ এক একটা উল্কা ছুটছে চারদিক সাদা ক’রে দিয়ে। তখন বোঝা যাচ্ছিল, ধ্রুবলোকের কোথাও ব’সে সিংহ কেশর ঝাঁকাচ্ছে; কোথাও রথের মেলায় তেলেভাজার দোকানে বেসন ফ্যাটানো হচ্ছে; কোথাও পাহাড়ি কেল্লার ছাদ থেকে জরির পোশাক পরা একটা মেয়ে হাত নাড়াচ্ছে তার দিকে।

রিকশাওলা তাদেরই স্টেশান-বাজারের মোতিউরদা, যার কাঁধের গামছায় জ্বলছে নিভছে অনেক জোনাকি। “তারাক’টা বেঁদে নিয়ে আসলাম বলো, কেরোসিনির যা দাম!” ব’লে সে এতক্ষণ বাঁহাতের ব্রেকে আটকে রাখা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র খুলে দেয় আর শোঁ-শোঁ ক’রে নীচে নামতে থাকে তিনচাকা গাড়ি। চাঁদের বাড়ির হারিকেন বাধ্য হয়ে রাত ন’টাতে নিভে যেত, কেননা রেশানে এ-সপ্তাহে ‘কেরাসিন’ দেবে তো পরের সপ্তাহে দেবে না, আর মা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, “বেলাক-এ তেল কেনা অন্যাই”। দারিদ্র সবচেয়ে ভালো মুখ লুকোতে পারে নৈতিকতার পিঠে। এখন, থকথকে কুয়াশার মধ্যে অবতরণ করতে করতে সে গুনতে থাকে — বড়ঘর, রান্নাঘর, খোপের ঘর, পায়খানা। মোট চারটে তারাজোনাকি যেই চাইতে যাবে মোতিউরদার কাছে, দেখা যায় রিকশা আলো ক’রে চাঁদের গা ঘেঁষে সেই মহাকাশ-দুর্গের মেয়েটা!

নয়
ঘোষপাড়া, চড়কপাড়া, মান্নাপাড়া — এভাবে চলল এ-দেশিয়দের ফাঁকাফাঁকা দালান, সাধারণত হলুদ রঙের, রোয়াকবিশিষ্ট, নিঃঝুম। চওড়া কাঁচা রাস্তাগুলো খেঁকিকুকুর-প্রধান; দুচার পা অন্তর ছোট ছোট মাঠ; আর আছে হরিসভা, ক্লাব নয়তো পুষ্করিণী। বাসিন্দাদের মধ্যে ভুঁড়িয়াল টাকমাথা লোক বেশি; কোমরে আলগোছে ফিতেবাঁধা পাজামা, মাথার চুল-টানা বা পিঠ চুলকোনোর জন্যে বিকেলে কচুরি কিনে দেওয়ার শর্তে বাচ্চাদের ডাকছে। খুব খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া হয় এখানে, সকালে কর্তা, তারপর ছেলেমেয়ে, দুপুরে গিন্নি, শেষে সেটি চলে যায় পাশের বাড়ি এবং শ্লীলতাহানির সংবাদের মতো বিধ্বস্ত হয়ে রাতে ফেরত আসে।

অঞ্চলের নাম নিবাধুই। অদ্ভুত নামে আকৃষ্ট হয়ে সুকুমার সেন খোঁজতলাশ ক’রে জানিয়েছিলেন, দুশো বছর আগে আশশ্যাওড়া, আলকুশি, জার্মানিলতার ঝোপে ঢাকা; শিমূল, বাবলা, অক্ষয়বট, বেল, টককুলের বৃক্ষে ছাওয়া এলাকাটির নাম রাখা হয়েছিল নির্বান্ধবপুর। সেখান থেকে নিবন্ধপুর… নিবদ্ধপুর… নিবধই…নিবাধই হয়ে আপাতত নিবাধুই-তে থেমেছে। পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু গ্রামটি ১৮৪৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় ছেলেদের হাইস্কুল পেয়েছিল। চার বছর পরে তিনি এখানে বালিকা বিদ্যালয়ও বসিয়ে দিয়ে যান। বিদ্যাসাগরের নিজের সঞ্চয় থেকে অর্থসাহায্য আসত স্কুলদুটোয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও দীর্ঘদিন ভাতা পাঠিয়েছেন। বর্তমানে এই লোকবসতি “তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া” গাইছে, শরিকি সম্পত্তি ভাগ হতে হতে এক ভিটেতে তিন-চার পরিবার মাথা গুঁজলে কী আর করা! পাড়ায় কত-না শিক্ষকের বাস, নাট্যকারের ভদ্রাসন; তবু ধরা যাচ্ছে না বাউন্ডারি ওয়ালের সংস্কার, বাড়ির কলি ফেরানো বা পুকুরঘাটে সিঁড়ি মেরামতির কাজগুলো। বাথরুমের কাঠের দরজা ভাঙলে পুরোনো ফ্রেমে একপাল্লার টিন যোতা চলছে।

মোতিউরের রিকশা প্যাঁক ক’রে হর্ন মারে, সাড়ে দশটার অন্ধকার শূন্য রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়ায়, আর ডান হাতে ভেসে ওঠে দোলপূর্ণিমার ফাংশানের মাঠ। তারপর জোড়াবটতলা পার হল, যেখানে সারা দুপুর গাছের ঝুরি ধ’রে ঝুল খেতে খেতে এতবার বটনিম্নস্থ পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চারা যে এই শুনশান রাতেও দুটো পরিচ্ছন্ন ঝুপ শব্দ শোনা গেল। চমকে উঠে মোতিউর দ্যাখে পুকুরের ওপর তির্যক ফলবাগান থেকে নারকোলমুন্ডু খ’সে পড়ে হাসতে হাসতে ভেসে যাচ্ছে জলে।

মান্নাপাড়ার কালীবাড়ি পৌঁছে রিকশা থামবে জানা কথা; এখানে প্রণাম না সেরে কোনও নতুন বউ শ্বশুরবাড়ি ঢোকে না। কিন্তু ভগবানই জানে কখন কোন বৃষ্টিতে চাঁদের সারা গা জবজবে ভিজে আর অসম্ভব বাতাসে জামাটা খুলে উড়ে যেতে চাইছে… গেলও বোধ হয়। এদিকে চুমকিপাড় ওড়নার রাজবালিকা মা-কালীকে গড় ক’রে উঠে দাঁড়াতেই চাঁদ দেখল তার ছিপছিপে গলায় দিদিমার মুখ বসানো! অবাক হওয়ার সময় নেই, উড়নচন্ডে হাওয়া এবার খুলে ফেলেছে তার হাফপ্যান্টের প্রথম বোতামটা…।

দশ
লেপের নীচে অসুস্থের ঘেমো শরীর মুছিয়ে দিতে দিতে সঞ্জু ভাবছিল — সেরে উঠুক, তারপর যা খ্যাপাবো না! একটু আগে রোগি দিদিমাকে জিগেস করেছে, সিঁদুর পরোনি কেন? সন্ধেবেলা কাঁদল আমার মাথাটা খুঁজে পাচ্ছি না ব’লে। যখন পাশ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কী রাগ —“আস্তে চালাও, মোতিউরদা”, অথচ একমাস হয়ে গেল রিকশাওলা মোতি ট্রেনে কাটা পড়েছে। ধুম জ্বরের মধ্যে এত মজার মজার প্রলাপ বকছিল চাঁদ যে শীতলাতলায় চার আনার বাতাসা মানত করতে হল ছোটভাইকে সারাক্ষণ চড়-থাপ্পড় মারা ছেলেটার।
তখন মা বলল, কাঁদতিছিস কেন, এই সঞ্জু? এই বোকা, ভাইয়ের জ্বর নামে গেছে ব’লেই তো ঘাম দেচ্ছে। কালই দ্যাখবা, তোমারে আবার চিমটি কাটবেনে পড়তি ব’সে।

জননী তারপর রান্নাঘর থেকে এইমাত্র আসা দিদিমার সঙ্গে ইশারাময় সংলাপে ডুবে গেল।
— পালি, নাদু?
— ও মা, কী পাবো!
— সত্যি কোচ্ছিস, গন্দো পাসনি?
— তুমি পাইছো?
— একছিটেও না। আমি ভাবলাম আমার বুঝি সোদ্দি…।
— উনোনে ক’টা মরিচ পোড়াইছিলে?
— তিন-তিনডে। ডালি অ্যাট্টা ফ্যালায় সোম্বোরা দিলিই কাশতি কাশতি পেরান যায়! ফাটানে ঝাল।
— তার মানে তুমি যা ভাবিছো তাই!
— নালি আর কলাম কী?

স্বাভাবিক শত্রু কিন্তু আপৎকালে একজোট দুই রমণী গালে-হাত চোখ-দীঘল ক’রে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একজনের ঈষৎ গর্বিত গলা শোনা যায়, “আমার চাঁদ হয়ত এট্টু রোগা, কিন্তু মুখটা-মাথাটা টলটল করে”। দিদিমা, যেন নিজেরই প্রশংসা হল, ব্লাশ করে যথারীতি : “বোলতি নেই, যা ফনফনায় উঠিছে, তোর মতোন নাম্বা হবে”। তারপরই মুলিবাঁশের বেড়া কেটে বানানো জানলা দিয়ে কুটিল দৃষ্টি ছোঁড়ে বলরাম দাসের বাড়ির দিকে : “বলা-র বউখান তো না, য্যান্‌ পুতোনা রাক্ষসী”।

এখন সব চোখই দৃষ্টিহীন এই উপনিবেশে। শুধু বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পা-দুটো ছাড়িয়ে নিল মা-মেয়ে। অসুস্থ সন্তানের মাথার কাছে ব’সে তারা কত রাত ভোর করেছে তার হিসেব হয় না।

(আর একটু)

নিমতিতা সরকারি কলোনি

পাঁচ
জ্বর, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? খগবতীর মৃত্তিকা হইতে। মাটি থেকে মানুষের পায়ের আঙুল বেয়ে আস্তে আস্তে উরু, কোমরে উঠে যাই। ওদিকে হাতের তালু থেকে নাক-গলা হয়ে মাথায়। তারপর দুই ঢেউ এক সঙ্গে ভেঙে পড়ি বক্ষতটে।
এই তরঙ্গ উইপোকার, তার আস্তরণে ঢেকে গেছে সমস্ত শরীর। ভেতরে ব’সে বন্ধ-চোখ গাঢ়-শ্বাসের বাল্মীকি।

— তারক ডাক্তাররে একবার খবর দি’, নাদু? আমার কাছে দেড্‌টা টাকা আছে।
— তুমি থোও দিন! সোদ্দি-গাগরোম; রাত্তিরি সাবু খাক, কাল সকালে ঝজ্‌ঝরে হয়ে যাবেনে।

বিকেলবেলা হঠাৎ শরীরে তাত এসে চাঁদের চলাফেরার সংবিধান বদলে দিল। এখন রঘুনাথের মাঠে বালক-বালিকাদের কিট্টু আর গাদি খেলা; রাস্তা দিয়ে ছেলেরা ঢ্যাব-ঢ্যাব ক’রে বল ড্রপ খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চৌরাস্তার মুচির কাছ থেকে সেলাই ক’রে পাম্প দিয়ে মাঠে নামাবে। এখন পড়ন্ত রোদে পাখির ডাক থেকে মনখারাপ খুঁটে নেওয়ার সময় নয়। বরং মা চমকে উঠে জিগ্যেস করবে, আমাদের বাড়ির মাথার ওপর দিয়েই ডেকে গেল নাকি? না না, ফুলিদের বাড়ির ওপর দিয়ে। “বড় বাঁচা বাঁচিছি। মাসের শেষে আসোজন-বসোজন সামলাতি হোলি আর দেখতি হ’তো না!”

জ্বরে ঘুম পায়, ঘুমে দেহতাপ বাড়ে আর আকাশে থইথই করে ফুল্লকুসুমিত অন্ধকার। সেই তমসা কেন্নোর মতো উথলে চাঁদের নাকমুখ দিয়ে ঢুকে যায়, ফুসফুস ভ’রে ওঠে আলকাতরার পাপড়িতে। দিদিমা গল্প করেছে, একবার ঘুমে-কাদা কোনও বাচ্চার কান দিয়ে কেন্নো ঢুকে তার মগজে বংশবিস্তার করেছিল। তারপর পড়া পারেনি ব’লে মাষ্টারমশাই যেই ছেলেটার চুলের মুঠো ধ’রে টান দিয়েছে, চুল সমেত ব্রহ্মতালু, মানে নারকেলের অর্ধেকটা মালা স্যারের হাতে উঠে এল। তখন দেখা যায়, ঘিলুর জায়গায় গিজগিজ করছে শুধু কেন্নো!
সেই থেকে কেউ চুলের মুঠি ধরলে চাঁদ সামান্য চিন্তায় থাকে! কিন্তু এখন যে ত্রস্ত মেয়েলি আঙুল তার মাথার ঢেউয়ে ডুবে গেল… নেমে এল কপালে, গলায়… সে যেন নিজেরই উদ্বিগ্ন হাত :

— ও শিউলি, শিগরির মারে ডাক। ভাইয়ের গা তো পুড়ে যাচ্ছে!

ছয়
প্রথমে জলেচুলে সোহাগ জমবে না, মাথাভর্তি গাঁজানো কেশরাশিতে জল স্লিপ ক’রে বেরিয়ে যাবে। তখন, তিমিরের বাবাকে এতদিন ডাকা হয়নি কেন ব’লে দানা বাঁধবে একটা বিক্ষোভ। ছেলে রেলে গ্যাংম্যানের চাকরি পেলেও আশি-পার বৃদ্ধ এখনও জাত-ব্যবসা ছাড়েনি, হাতে নাপিতের বাক্স দুলিয়ে কুঁজো-হেঁটে চলে আসে কেউ খবর পাঠালেই, আর প্রাণভয়ে ছোটদের কান্না শুরু হয়। ক্লিপ-মেশিনে পটাং পটাং করে ঘাড়ের চুল ছিঁড়তে থাকে অসিত পরামানিক, রক্তকুচি ফোটে সার দিয়ে; তখন স্কন্ধে ফটকিরিপাথর ঘ’ষে একগুচ্ছ জ্বলুনি ফ্রিতে উপহার। এবার সে ময়লা ধুতি গুটিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে শিশু-মাথা চেপে ধরল — চুলে কাঁচি চালাবে। অপরিচ্ছন্ন উরু ও কুঁচকির গন্ধে সেই জানু মধ্যবর্তী স্থানে হাঁচতে থাকে বাচ্চারা।

রাত যত বাড়ের দিকে, চাঁদের শরীরে ঘুমের বদলে ঘোর জন্ম নিচ্ছিল। বাবা স্কুল ছুটির পরে অপারিশ্রমিকের কোচিং পড়িয়ে ফিরেছে, মা ডাকল : এট্টু জপ ক’রে দিয়ে যান না ছেলেডার মাথায়। নির্মলচন্দ্র নিজের জ্বর-সমান উষ্ণ করতল সন্তানের কপালে রেখে অতি মৃদুস্বরে শ্লোক আওড়ান। উপনয়ন হওয়ার আগে গায়ত্রী-আদি কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করা নিষেধ। কিন্তু অবাধ্য ছেলের কানে একবার পৌঁছোলে সে হাজার কানমলা খেয়েও সারাদিন ওটাই চেঁচিয়ে বেড়াবে।

আসলে, কনিষ্ঠ পুত্র প্রায় বাবার মতো স্মৃতিধর। আজ থেকে অর্ধ শতক আগে খুলনার অন্তঃপাতী সেনহাটি গ্রামে নির্মলের স্মরণশক্তি ছিল সুবিদিত। যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, এমনই এক শীতের দিন স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছেন পরিদর্শনে। ক্লাসে ঢুকে প্রথম বেঞ্চে বসা ছোট্টখাট্টো চেহারার ধপধপে সাদা বালকটিকে দাঁড় করালেন : বলো, বর্ণপরিচয় বলো। খোকা বুঝতে পারল না কোন ভাগ তাকে আবৃত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব অ, আ, হ্রস্ব ই, দীর্ঘ ই থেকে শুরু হয়ে ঝরঝরিয়ে রাখালের দুষ্টুমির গল্প পর্যন্ত ব’লে প্রথম ভাগ শেষ করল। পরীক্ষককে তবু অপেক্ষমান দেখে সে ঐক্য-বাক্য-মাণিক্যে মহরত ক’রে দ্বিতীয় ভাগ ধ’রে এগোয়, একদমে মুখস্থ বলতে বলতে শেষ অধ্যায় “চুরি করা উচিত নয়”-এর অন্তিম লাইন “তা-হা ক-র না-ই, এ-জ-ন্য, তো-মা-র এ-ই পু-র-স্কা-র।” উচ্চারণ-শেষে হাঁ ক’রে শ্বাস নিচ্ছে যখন, ইন্সপেক্টর এগিয়ে এলেন কয়েক পা, হাত বাড়িয়ে ছাত্রের কপালে রগের ওপর এক দুই এবং তিন — তিনটে টোকা দিয়ে নিশ্চুপে কক্ষত্যাগ করলেন।

সাত
বাসি বেলিফুলের মতো দুমড়ে গেছে ঠোঁটদুটো, দুই গাল ভস্মে-আগুনে মিশে নিভুনিভু উনুন। জ্বরের তাড়সে কাঁপছে গোটা মুখ। মা ক্রমাগত মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে, ঘটি থেকে ধারানি-করা স্রোত কচুপাতা বেয়ে নীচের বালতিতে প’ড়ে চক্রবৎ ঘটিবাহিত হয়ে উঠছে মাথায়। আর দিদিমা গেলাসের জল থেকে চাঁদের চোখের পাতা, ঠোঁট ভিজিয়ে চলেছে।
— ও ভাই, খুব কষ্ট হচ্ছে? এই অ্যাখোনি তোমার জ্বর নামে যাবেনে। কিছু ক’বা নাকি, ও সোনা?

রোগি জাগন্ত কিনা বোঝা যায় না। ঘরে টিনের চালের নীচে পুরোনো শাড়ির যে নিরাপত্তামূলক পর্দা টাঙানো (টিকটিকির লাদি বা আরশোলার ডিম যাতে বিছানায়-খাবারে না পড়ে), তার চোখ সেখানে স্থির। পর্দায় দেখা যাচ্ছে, জলের শিরা-উপশিরা চাঁদের মুণ্ডটি সমস্ত কোণ থেকে জাপটে ধরল — যেমন বলখেলার মাঠে যাওয়ার রাস্তায় রেলের পরিত্যক্ত ভীমবাহু কেবিনকে একটা ধৃতরাষ্ট্র অশত্থগাছ মরণ-আলিঙ্গনে আঁকড়ে থাকে। চাঁদ লক্ষ করছিল, এই বলশালী জাপটাজাপটি তার পাতলা ঘাড় আর নিতে পারছে না। একটু পরেই জলের তোড়ে চাঁদের মাথা ঘাড় থেকে খুলে বালতিতে পড়ে ডুবে গেল। ওমনি তারও দুচোখ দৃষ্টিহীন…।

বাড়িতে একটা কান্নার কোরাস উঠল কি তখুনি? কেউ কি চেঁচিয়ে বলছে, ওরে বাসু দৌড়ে যা বাবা, তারকডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়? বলরাম দাসের বাড়ির রেডিয়োতে এখনও অনুরোধের আসর শুরু হয়নি, আর সাড়ে ন’টার আগে তারক ঘুমোবে না। কিন্তু বুক-ভরা ইচ্ছে থাকলেও বাসু এক-পা নড়তে পারছে না! ডাক্তারের প্লটের ঠিক আগে ডানহাতে যে-বাড়ির দরজায় মরচেপড়া তালা, আগাছা গজিয়ে গেছে উঠোন জুড়ে, যেখানে দিনেদুপুরে চন্দ্রবোড়া সাপের বাচ্চা কিলবিল করে, সুতরাং সন্ধে থেকে রাস্তাটুকু বড়-বড় হাতহালি দিয়ে হাঁটে সবাই, সেই আস্তানার ইতিহাস কীভাবে ভুলবে বাসুদেব? দেবী — তারই-বয়েস ফর্সা সুন্দরী মেয়েটা সুইসাইড করেছিল সরস্বতীর পুজোর দুপুরে। স্কুল থেকে একপেট খিচুড়ি বেগুনভাজা খেয়ে এসে খবরটা শোনে বাসু এবং ছুটে গিয়ে ডেকরনের ফ্রকপরা মেয়ের ভারি সাদা দুই পা, বগলের বাদামি লোম আর মুখ থেকে ডান দিকে বেরিয়ে যাওয়া কালো জিভ… সব অনুপুঙ্খ দেখে ফ্যালে। এখন এই গভীর রাতে বাসু হাততালি দিলে যদি তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে পাল্টা ক্ল্যাপিং-এর শব্দ ওঠে! পাড়ায় এমন প্রহেলিকা ঘটে যাচ্ছে বারবার। কেলেকুষ্টি বাপ-মায়ের কালোকোলো শিশুদল জন্ম নিতে নিতে হঠাৎ এক খইসাদা সন্তান প্রকাশ পায়। উপনিবেশের জনতা অবাক হয়ে দ্যাখে, খাওয়ায়-পরায়, তারপর একদিন অপঘাতে বা আচম্বিতে মৃত্যু হয় তার। যেমন বাসন্তীপুজোর তিন দিন পর বলরামের মেয়ে শীলা নাকমুখ দিয়ে কৃমি উঠে চিতেয় উঠল; “আমি পাপী, তাই বিদায় নিলাম” লিখে রেখে দেবী দিল গলায় দড়ি; মনসাবাড়ির রাজপুত্র মানিক ঢলে পড়ল গোখরোর বিষে…।

বলব সেসব কথা, চাঁদের জ্বরটা আগে ফণা নামিয়ে নিক।

(অসমাপ্ত)

নিমতিতা সরকারি কলোনি

তিন
তারক অধিকারীই উদ্বাস্তু-মোকামে বাস করা একমাত্র বদ্যি। কেউ কোনওদিন তার ডিগ্রি জানতে চায়নি; ‘নেয়েচি’-খেয়েচি’ বলা ঘটি পরিবার সরকারি কলোনিতে ভিড়ল কীভাবে, সে রহস্যের গিঁট খুলতেও লোকের বয়ে গেছে। কামদেবপুরে তার ডিসপেনসারি, সেখানে গরীব মুসলমানদের সাক্ষাৎ খোদা এই তারকেশ্বর। দুহাতের আঙুলে সাতখানা পাথর আর সমান সংখ্যক সন্তানের মালিকটির কলম ব্যবহারের অভ্যেস নেই, ট্যাবলেট ফয়েল থেকে ছিঁড়ে খবরের কাগজে মুড়ে রোগির হাতে ধরায়, সঙ্গে ঝাঁঝালো মিষ্টি ‘মিক্‌চার’। সবাই তার হাতযশের কথা মানে, এবং যারা চিকিৎসা সত্ত্বেও মরে গেল, তাদের আপনজনের পাশে দাঁড়িয়ে তারক স্বগতোক্তির মতো ব’লে দেয় — রোগটা ঘ্যাঁজ্‌ড়া হয়ে গেছলো। খুলনা-যশোর এই শব্দ চেনে না, ঘ্যাঁজ্‌ড়াকে মহাভারতের কোনও অপরাজেয় রাক্ষস ভেবে নিয়ে মানুষ সংযত থাকে।

চাঁদ যখন অধিকারীবাড়ির পাশ দিয়ে বায়ুবেগী, চেম্বার সেরে বাড়ি পৌঁছে সবে সাইকেল থেকে নামছিল ডাক্তারবাবু। তার ফেরার খবর কীভাবে যেন পেয়ে যায় পাড়ার বাচ্চারা, সাইকেলের পেছনে এর মধ্যেই দশ-বারো জনের জমায়েত। কাগজের ঠোঙা থেকে লজেন্স বের ক’রে সে প্রত্যেকের মুঠোয় একটা ক’রে গুঁজে দিতে লাগল। একটু পরে এসে জুটবে রাস্তার কুকুরের দল, খেয়ে উঠে এক-থাবা ক’রে মাছের কাঁটামাখা ভাত তাদের মুখে ধ’রে দেবে ডাক্তার। চাঁদকে দেখতে পেয়ে সে যেই হাত বাড়িয়েছে, কেঁপে পিছিয়ে গেল ছেলেটা। বাইরের কারও কাছ থেকে কিছু নেওয়া ব্রাহ্মণবাড়িতে মুরগির মাংস তোলার মতোই কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। কেননা, দানগ্রহণ মানে নিজেকে ভিখারি প্রমাণ করা, পরিবারের সম্মান ধুলোয় মেশানো। এর শাস্তিও পিঠে বেত ভাঙার মতো সর্বোচ্চ রকমের হয়ে থাকে।

তারক ডাক্তারের ভাইয়ের নাম নারায়ণ ছবিয়ালা। কপালে অনেকগুলো চিন্তাশীল ভাঁজ সমেত শিবনেত্র চোখ, দাদার কাছে আসা-যাওয়া করে একই রকম একখানা সাইকেলে চেপে। দুজনের জামাকাপড়ও সেম টু সেম : টেরিকটনের পাঞ্জাবি, ধুতি; পাঞ্জাবিতে কান্তা সেন্ট আর চারটে ক’রে পেতলের বোতাম লাগানো। নারায়ণ অধিকারী আগে ছিল ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার : বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে ছবি তুলিয়া থাকি। আচমকা ক্যামেরা বিক্রি ক’রে ফটো বাঁধানোর দোকান দিয়েছে কাশিমপুর বাজারে। পেছনের গল্পটা টিপুদা জানে।

কলোনির আপামর কাজে ডাক-পড়া, জলেস্থলে চরকি-কাটা ছেলের নাম টিপু, যার পদবি বলতে লাগে না, পাড়াসুদ্ধু মানুষের জন্যে ইয়োরস ফেথফুলি হয়ে আছে। কোনও বয়স্থা মেয়ে যদি মায়ের কাছে যাত্রা বা গানের জলসা দেখার জেদ ধরে — “পা খুব লম্বা হইছে, না? বাবা শুনতি পালি ঠ্যাং কাটে নেবে। ও আচ্ছা, টিপু নিয়ে যাবে? তালি যাও, ঘুরে আসো”।

টিপু ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন বাড়ি-বাড়ি ভাইফোঁটা নিয়ে কুল করতে পারে না। মাথার চুলে ধানক্ষেত, কপাল মোটা হয়ে যায় ঘি-চন্দনে।

তো, মাস দুয়েক আগে চাঁদের শিউলিদিদি তাকে ফোঁটা দেওয়ার পর খাটে বসে লুচি-আলুরদম খেতে খেতে টিপু শুনিয়েছিল :
মুখার্জিপাড়ায় সিতু মুখার্জির মা মারা গেল না? ছবি তোলার জন্যি নারানকাকুরে ডাকে (ভালো কথা। তারপর?)। কাকু সেদিন ঠিক মার খাতো (ওমা, কেন!)। সিতুর বড়ভাই কংগ্রেস তো! সে শাসানি দিছিল, “ফেরার সময়ে ক্যামেরাটা নন্দসায়রের জলে ফেলে দিয়ে যাস। আর কোনওদিন ফটো তুলতে দেকেচি তো তোর খবর আচে! ফ্রেমে বাঁদিয়ে জবার মালা পরিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দোবোখুনি” (হি হি, টিপু তো জোরদার ঘটিভাষা শিখে গেছে! কিন্তু নারানদার দোষটা কী হলো, কোবি তো?)।

কাকুর সেই প্রথম মরা মানুষির ফটো তোলা। ক্যামেরার পেছনে যেয়ে ডেডবডিরে ব’লে বসিছে “রেডি”? শুনে সবাই হয়রান (ধ্যাস্‌, টিপু বানায় বানায় কচ্ছে)! কিন্তু তাতেও নারানকাকুর চেতনা হয়নি। মাথা তো কালো কাপড়ে ঢাকা। সে এবার আরেট্টু গলা তুলিছে, “এস্‌মাইল”!

চার
যিশুর রুপোলি ক্রসের মতো জেট প্লেন ঝিলিক দেয় আকাশে। তার ধোঁয়া-লেজ প্রথমে কেকের সাদা ক্রিম, আস্তে আস্তে ছানাকাটা দুধ হ’য়ে আকাশেই ভাসতে থাকে। রাস্তায় কমলালেবুর খোসা দেখে চাঁদ তুলে পকেটে পুরে নিল (বোনের চোখে রস দিয়ে দেব), তারপর ঢুকে পড়ল লখাইদিদির বাড়ি। বারান্দায় কেউ নেই, দরজা খোলা পেয়ে সে সোজা ঘরে পৌঁছে দ্যাখে মাসিমাও জেট-প্লেনস্বরূপ, মুখ দিয়ে কড়া গন্ধের ধোঁয়া বেরচ্ছে। ভট্‌চাজবাড়ির পোলাকে দেখে সেই বাষ্প থতমত, আর কোথা থেকে লখাই এসে প’ড়ে “কী হইছে রে, দিদিমা আমাগো বাড়ি আসলি দেখতিই তো পাতিস” বলতে বলতে তাকে ঠেলে ঘরের বাইরে ক’রে দেয়।

এভাবে বারবার চাঁদের ব্যর্থতায় দুঃখিত রোদ্দুর তেঁতুলগাছের পাতা বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। যেমন পাড়ার নাইটগার্ডদের একদল ঘুমোতে গেলে অন্যদল পাহারায় দাঁড়ায়, রোদ রেখে যাচ্ছিল ছায়াকে। ব্যাপারটা বাবার মুখে শোনা জয়দ্রথের উপাখ্যানের সঙ্গে পুরো মিলে যাচ্ছে। সূর্যাস্তের পর বিধবাদের ভাত খাওয়ার নিয়ম নেই ব’লে অভিমানী বৃদ্ধা সন্ধে পর্যন্ত আত্মগোপনে, তাকে জটিল ব্যূহের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে পাড়ার কোনও দুর্যোধন পরিবার! সুতরাং দিদিমাকে বের ক’রে আনার একমাত্র উপায় হল… নিজের ডানহাতের তর্জনীর দিকে তাকায় চাঁদ, কিন্তু সেখানে কোনও সুদর্শন চক্র দেখতে না পেয়ে আবার মুষড়ে পড়ে।

বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এখানে রাস্তা চারভাগ হয়ে কলোনির অচেনা চার দিকে ছড়ানো। সে মরিয়া হয়ে বড় রাস্তা ধ’রেই ধাবমান, হঠাৎ কী মনে হতে ডান দিকে তাকায়… একটা চেনা চেহারা সরকারবাড়ির দুর্গামণ্ডপে পা ঝুলিয়ে বসে আছে না! কষ্টিপাথর গায়ের রঙ, বেঁটেখাটো শরীর, শুধু চোখদুটো যেন কালিপুজোয় চোদ্দপ্রদীপের ঢল থেকে বেছে এনে বসানো। যত অশ্রুই রাখো, ধ’রে যাবে।

— ওই যে দিদি, বর অ্যাতোক্ষণে তুমারে নিতি আসিছেন।
দিদিমার চেয়েও বয়স্কা সরকারজেঠুর ফোকলাদাঁতি কোলকুঁজো মা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
— তুমি কীরম জামাই, বউ ঘোনো ঘোনো পলায় যায় ক্যান!”
— আমি কিছু করিনি। মা’র সঙ্গে ঝগড়া…।
— তা বোল্লি তো শোনবো না, মোনি। নিজের ইস্‌তিরি যহোন, যত্ন ক’রে রাখতি হবে। বড় হয়ে ছুঁড়ি বউ অনেক পাতি পারো, কিন্তু কথাডা মিলোয় নিয়ো, এই বুড়ির মহোব্বতের মোটে ধারেকাছেও কেউ আসতি পারবে না।

চাঁদ দ্যাখে, দিদিমা কিশোরীর মতো লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। মাথার ঘোমটা আর একটু টেনে সারাক্ষণের সহচর পানের ডাবরটি হাতে সে নাতির পেছন পেছন নিঃশব্দে মণ্ডপ থেকে নেমে যায়।

রাস্তায় পড়তেই ওদের দুপাশ দিয়ে যেন ভূতের তাড়া খেয়ে ফোঁশ ক’রে উড়ে গেল দুই কিশোর; যাদের চালু নাম বাবু-হাবু। এবং অচিরেই তাদের পাঁচ-ছয় তুলসী চক্রবর্তী দূরত্বে ফুটে উঠল তৃতীয়জন — ভুঁড়ি, ফটফটিয়া চপ্পল, হাতে কঞ্চি আর কোমর থেকে বিপজ্জনক নেমে যাওয়া লুঙি নিয়ে; প্রচলিত নাম জুতোনিমাই। বাচ্চা মানুষ করাকে কেন্দ্র ক’রে কলোনিতে খুবই জনপ্রিয় এই দৌড় প্রতিযোগিতা সারাদিনে দু’ থেকে তিন বার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

শোনা যাচ্ছিল, নিজের ছেলেদের পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জানোয়ারের বাচ্চার নামে ডাকার পর হাঁফাতে হাঁফাতে তাদের কেটে কুচিকুচি ক’রে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে জুতোনিমাই। ধরতে পারলে তবে তো ভাসান? যমজ ভাইদুটো ঘুম ভাঙতেই আজাদ হিন্দ ক্লাবের চাতালে এসে বসে, পাশের শীতলা মন্দিরের ঘট থেকে পয়সা গেঁড়িয়ে মটরভাজা কিনে খায়, কুকুর পেলেই ঢিলোয়, দাঁড়াশ সাপ দেখলে ডান্ডাপেটা ক’রে মারে, শেষে শান্ত হয়ে চাতালে ইঁট দিয়ে ঘর কেটে মাথা গুঁজে ষোলোগুটি খেলতে লেগে যায়। সাধারণত এই সময়েই চিতবাঘের চরিত্র নিয়ে দুজনের ঘেঁটিভাঙার লক্ষ্যে গুঁড়ি মেরে এগোয় তাদের জনক, অথচ ঠিক আগের সেকেন্ডে কীভাবে টের পেয়ে ছাগলের বাচ্চার মতো তিড়িং ক’রে লাফিয়ে পালায় ওরা। তারপর তিনজনের ছুট ক্রীড়াসূচি মেনে।

রান্নাঘরে লোহার মতো ভারি গাঢ় খয়েরি রঙ কাঁঠালপিঁড়িতে বসে বড় বড় ভাতের দলা মুখে পুরছিল দিদিমা। সম্পত্তি বলতে এই পিঁড়ি আর ওই পানের ডাবরই সে ওদেশ থেকে আনতে পেরেছিল। চাঁদ কোলের ওপর লেপ টেনে বড়ঘরের খাটে বসে আছে। ছেলেদের পাকড়াতে আবারও ব্যর্থ জুতোনিমাই বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তখন :
“আমি শালা পেত্যোহো পঞ্চাশটা লোকেরে জুতো পরাই, এদিকি হারামিদুটো কিছুতি একজোড়া চটি পা’য় দেবে না, গোড়ালিতি বাবলাকাঁটা ফুটোয় খোঁড়াতি লাগিছে! ইচ্ছে ক’রে ছাড়ে দিলাম…।”

(আর একটু)

নিমতিতা সরকারি কলোনি

এক
নিমগাছে নতমস্তক হয়ে পড়েছে রোদ্দুর। পুকুরপাড়ে পোঁতা খুঁটির ডগায় ব’সে মাছরাঙা ভাবছে, মাছ ধরতে গেলে সেই তো পায়ে ঠান্ডা লাগবে। কার বাড়ি যেন রেডিয়োতে “বলো না সহজ ক’রে আমায় পেরেছ তুমি বুঝতে”, আর প্রত্যেক গাছের নীচে শুকনো পাতার কবিতাপাঠ।
তখন কলোনির রাস্তা দিয়ে একটা বাচ্চা ছুটছিল।
— ও চাঁদ, কুথায় যাস?
— দিদ্‌মারে খুঁজতি।
ব’লে সে দুটো হাঁচি দেয়। আবার ছোটে।

বলরাম দাসের ভিটের দিকে যাওয়া নেই। শত্তুর পরিবার, দিদিমা হাজার ম’রে গেলেও ও-মুখো হবে না। পরের বাড়ি নবীন বিশ্বাস।
— ও নবীন, তুমি কী কাজ করো?
— মাসিমা, আমার ব্যারাকপুর টেশেনের গা’য় টেশেনারি দোকান।
— কী নারী ক’লে? ভগোবান য্যান্‌ তোমারে সুবুদ্ধি দেন!

হলুদ গায়ের রঙ আর টানা নাকচোখের নবীন; তার সুবুদ্ধি আছে, আবার নেইও। বিক্রিবাটার পয়সা ঘরেই এনে রাখে, তারপর পাড়া-টহলে বেরোয়। প্রত্যেক বাড়ির পাশ দিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াবে আর উঠোনে কি কলতলায় মেয়েমানুষ দেখলেই এগিয়ে এসে, “বুঝলে, আজ আমার চোখির সামনে তিনডে লোক এক বুড়ির হার ছেনতাই ক’রে দোড় মাল্লো”। এভাবে নীচু গলায় বিরামহীন গল্প শুরু হল, ওদিকে সে-মেয়ে একগাদা জামাকাপড়ে বল-সাবান মাখিয়ে রেখেছে, কাচবে কখন? অথবা,
— দাদা যাই, উনোনের ভাত এইবার পুড়ে যাবেনে!
— আরে, কী ঘটনা হইছে শোনো…

নবীনের বউ কাজল বাইরে থেকে খুব সাদামাটা আর রুগ্ন, কিন্তু তার হৃদয়পিঞ্জর মানুষের জন্যে ভালোবাসা আর একটা মানুষের ’পরে অভিমানে টাপেটোপে ভ’রে আছে। সূর্য মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল তবু কাজল কিছু খাবে না, গ্যাসের অসুবিধে কিন্তু ডাক্তার-কবিরাজ করবে না; আধো-অন্ধকার রান্নাঘরে বসে শুধু রেঁধে যায় — পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে ভুরভুর গন্ধের মুসুরির ডাল, বড়ি দিয়ে কচি লাউডগার তরকারি, গোটা সরষে দিয়ে ডুমো কুমড়োর ছেঁচকি, পোস্তো দিয়ে কড়কড়ে পলতা পাতার বড়া…। কাজলের মেয়ে সুধা সারাক্ষণ পাড়াময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে গলাভর্তি অট্টহাসি নিয়ে। মিন্টুর ঠাকুমা যে বলেছিল, “ও সুদা, শুদা শুদা হাসিস ক্যান”, সেটাই তার এক-লাইনের আত্মজীবনী। সোনাব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে সবার ঘরে ঢুকে পড়ছে সুধা — কমলাপিসি, আজ কী রাঁধলে গো? মান্তির মা, নিমবেগুন আর পেঁপের ঝোল খেয়ে খেয়ে তোমার অরুচি ধরে না? এক ঘন্টা পরে সে তরকারির বাটি হাতে আবার পৌঁছে যাবে — মা দেছে বিশ্বনাথমামার জন্যি… মা দুঃখীপিসিরে খাতি বোল্লো।

চাঁদকে ছিটে-বেড়ার গেট ঠেলে ঢুকতে দেখে থমকে দাঁড়াল সুধাদিদি :
— কী ব্যাপার, বিদ্যেসাগোর?
— তোমাগো বাড়ি আমার দিদ্‌মা আইছে?
— যাহ, চাঁদের বুড়ি হারায় গেছে!
সুধা পাকা ফুটির মতো ফেটে পড়ল হাসিতে।

দুই
শীতের দুপুরে বাতাস এত ঝাঁঝরা হয়ে থাকে শূন্যতায়, প্রজাপতি উড়তে গিয়ে একটুতেই থ’কে যাচ্ছে। সব উঠোনের রোদ্দুরেই চুলের উকুনবাছা নারীসমাজ দৃশ্যমান। ভক্তবাড়ির পুঁচকে ছেলে কালিদাস ঘেঁটুফুলের ঝোপে নিজের পেছছাপের ধারা দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টায় ব্যস্ত। ফোঁত ক’রে নাক ঝেড়ে রাস্তা দিয়ে আবার ছুটল চাঁদ। এবার বীরেন-ধীরেনের খোলা বাড়ি, মানে দু’হাত অন্তর কচাগাছ পোঁতা নেই প্লটের সীমানা ঘিরে। কয়েক মাস ওদের বাবা মারা গেছে।

আস্তে আস্তে মরে যাওয়াটা কলোনির দস্তুর। যে কাশে, কেশেই যায়; যার হাগা, বারবার গিয়ে বসছে চাড়ি বসানো খাটা-পায়খানাতে। একদিন চাঁদের মা বিকেলে চুল বাঁধতে বাঁধতে বলবে, মালাকারবাড়ির প্রভাতের বুকির রোগডা আবার ঠ্যালা দেছে। ঠোঁট দিয়ে ফিতের একটা দিক চেপে থাকায় কথাটা ভালো বোঝা যাবে না। তারপর একরাতে ভাত খেতে ব’সে গরাস মুখে তুলতে গিয়ে আবার পাতে নামিয়ে রাখবে, “বিরু-ধিরুর বাবা মনে হয়…”। সকালে এবাড়ি থেকে একজন, ওবাড়ি থেকে আর একজন ধীর পায়ে হাজির হচ্ছিল মালাকার-বাড়ির দরজায়। মাতব্বর-গোছের কেউ, প্রায়ই যার নাম বলরাম দাস, চেঁচিয়ে বলছিল, “ওরে বের ক’রে উঠোনে এনে শোয়াও। ঘরের মোদ্দি থাকলি পেরানডা বেরোতি পাত্তিছে না”। শোনামাত্র প্রভাতের বউ কুক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। যেন পুজো শুরু হবে কিন্তু দুব্বো তোলা হয়নি মনে পড়ায় কেউ ডেকে আনছে পাড়ার ডাক্তারটিকে। সে আসলে হিন্দি সিনেমার পুলিশ অফিসার, শেষ দৃশ্যে নায়ক ভিলেনকে মেরে পাট-পাট করে দেওয়ার পর হাজির হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত খলনায়ককে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।

বাঁহাতের তিন আঙুলে আলগোছে রোগির কব্জি ধরে নিজের কব্জির ঘড়ির দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিল তারকডাক্তার। তারপর মাথা নেড়ে ঠোঁট উল্টোয় — ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।

প্রিয় টিম হেরে যাওয়ার শোক বুকে বয়স্ক প্রতিবেশীরা ফিরে আসছিল — মৃত্যুর সঙ্গে ফাইনাল ম্যাচে পরাজয় নিয়ে মাঠ বা রেফারিকে দায়ি না ক’রেই। তখনও বীরেন-ধীরেনের মা উঠোনে উবু হয়ে শবদেহের পরামর্শ নিতে ব্যস্ত। “বাড়িতি চাট্টে পেট, কী করি কও তো! কোইলকাতায় বাসনমাজার কাজ ধরবো? না আড়তে যেয়ে পচা আলু পচা পেঁয়াজ বাছার জোন খাটতি শুরু করি? আড়ত ভালো, দিনিদ্দিন টাকা; কিন্তু তোমার বেয়াই জগন্নাথ সাহা গা পর্‌শো ছাড়া কথা কোতি পারে না। হারামির হাতদুটো জগন্নাথ ঠাকুরির মতোন ঠুঁটো হয়ে যায় না ক্যান!

সুতরাং কলোনিতে বিধবা গিজগিজ করছে। তাদের বরেরা কেন যে এমন আপোষে মরে যায়! চারদিকে সাদা থান আর প্রত্যেক আঁচলের নীচে তিন-চারটে শুকনো কিশোর মুখ। সময়ের অনেক আগে ডিমের খোলা ভেঙে গেছে, তলতলে কুসুম হয় ভ্যান টানছে কাদা রাস্তায়, নয় দাদ-হাজার মলম নিয়ে উঠে পড়েছে লোকাল ট্রেনে। আর বারো-তেরো বছর থেকেই মেয়েদের জিভের নীচে তরল থলি, অপছন্দের শব্দ শুনেছে কি তাক করে নীল থুতু ছিটিয়ে দেবে। যে বাড়িতে দুতিনটে মেয়ে, খবরদার তাদের লেজে পাড়া দিতে যেয়ো না।

(আরও আছে)

গুড়ের চা

সাত
সকাল থেকে এই নিয়ে চার নম্বর ভিখারি। পেট ডুগ্‌রে গলা সরু একটা ন্যাংটো বাচ্চা কোলে তার মা এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাটার দু’নাক দিয়ে মোটা হলদে সিক্‌নি। মাঝেমাঝে নাক টানলে বেরিয়ে পড়ছে সিক্‌নির নীচে দুটো লম্বা লাল ঘায়ের দাগ।

প্রতিবার রান্নার চাল নেওয়ার পর হাঁড়ি থেকে যে ছোট দুই মুঠ তুলে একটা কলসিতে রাখা হয়, সেখান থেকে রেকাবিতে চাল নিয়ে ছোড়দা ঢেলে দিল বৌয়ের পেতে ধরা গায়ের কাপড়ে। চালসমেত শাড়ির অংশ কোমরে গুঁজে নিল সে। তখন মনে হল, কোলের মতো তার পেটেও এক সন্তান।

অন্ধ সেজে আসে অনেকে, ভিক্ষে নিয়েই দে হনহন ক’রে হাঁটা; অনেকের হাতটান খুব, এদিক-সেদিক গেছ কি রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বাচ্চার তেলমাখার বাটি নয়ত উঠোনে ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটি নিয়ে গায়েব হয়ে যাবে। এমন তাদের মরিয়া সাহস, চার-পাঁচ দিন পরে আবার তোমার বাড়ি, আর ভুলুক-ভালুক তাকাচ্ছে, যদি আরও কিছু গ্যাঁড়ানো যায়।

তবু কোনওভাবে দেশ থেকে দেশে লাখ লাখ মানুষের এই মহাঅভিসরণ, তাদের ক্ষিদে, তাদের মাঙনের হাত-পাতা আর অপমানিত হওয়ার পাঠক্রমকে লঘু করা যাবে না। খালি পায়ে বাদাবন পার হয়ে, রেল লাইন টপকে, দিনে কচুরিপানা-ভর্তি পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে রাতে গ্রামের পর গ্রামের ঘুম না ভাঙিয়ে পোয়াতি বউ, দুধের শিশু বা অশক্ত বাবাকে আঁকড়ে এই নিঃশব্দ স্থানান্তর! তারপর অনেকের চুপচাপ মরতে থাকা… রাতে ঘুমের মধ্যে যেমন শিউলি ঝ’রে পড়ে আর সকালে উঠে এক একটা বুক-কাঁপানো “বলো হরি, হরিবোল”, কাঁচা বাঁশের চালির ওপর শুয়ে কেউ চলে যাচ্ছে শুঁটি নদীর গায়ে জুবলিঘাটা শ্মশানের দিকে। উদ্বাস্তু জীবনের মতো শুকিয়ে গেছে সেই সুবর্ণবতীও, যেখানে এক সময় চাঁদ সদাগরের ডিঙা ভাসত। অন্যদিকে দুটো চাল, একবাটি ফ্যান বা একটা তামার পয়সার জন্যে কলোনি জুড়ে বিষণ্ণ পদক্ষেপ। ভিখারি এসেছে ভিখারির কাছে ভিক্ষে চাইতে!

চতুর্থ কাঙাল স’রে গেছে কি যায়নি, একটা রব উঠল কলোনির বাঁ হাতে মান্নাপাড়ার দিক থেকে। ওমনি বড় রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো পিটি করার মতো “সাবধান”। মুহূর্তের মধ্যে এক পাল শুয়োরের কালো প্রবাহ এসে পড়ল রাস্তায়। ঘোঁত ঘোঁত শব্দে কান ভ’রে উঠছে, বানের জলের মতো এপাশ-ওপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে দু’চারটে, তখন পালের পেছনে যে দুজন রাখাল, তারা মুখে চুঃ চুঃ ক’রে লাঠির প্রহারে তাদের তুলে আনছে রাস্তায়।

ঢেউটা এগিয়ে আসতেই চাঁদের বাড়ির দুদিকের দুই কচুবাগানে “শুয়োরে চেনে কচু” প্রবাদ মনে রেখে বরাহদল আক্রমণ শানাল। ওমনি কলোনির মেয়েরা অভিশাপ দিতে শুরু পশুর পালকে, আর ছেলেরা তেড়ে গেল তাদের পরিচালকদের দিকে। এই কচুবনদুটো কলোনির বেশ কয়েকটা বাড়ির খাদ্যভাণ্ডার — কচুপাতাবাটা, নুন-লংকা মাখা কচুভাতে, কচুর সব্জি দেওয়া ডাল অথবা অল্প সরষের তেল খরচ করতে পারলে কচুর লতির বাটিচচ্চড়ি। আবার, বাড়িতে মূল্যবান অতিথি এসেছে তো সদ্য-গজানো অর্ধেক মোড়া কচুপাতার মধ্যে ডালের পুর দিয়ে ভেজে এক উচ্চপর্যায়ের ঝোল-তরকারি হতে পারে। বাজার করার পয়সা না থাকলেও ঘরে বসে তুমি চার-পাঁচটা রান্নার পদ পেয়ে যাচ্ছ।

কাদাজমিতে ঢুকে জানোয়ারগুলো পড়পড় ক’রে কচুগাছের গোড়া ওপড়াতে শুরু করেছে, এদিকে বাতাসে শিস কেটে লাঠির বাড়ি পড়ছে পিঠে, গোঙাচ্ছে তারা। কষ্টে ঘেমে যাচ্ছে চাঁদের বুক। ভগবান এইমাত্র ম্যাজিক ক’রে তাকে ওই চার-পাঁচ ডজন শুয়োরের কোনও একটা বানিয়ে দিলেন, চাঁদের চাম-মাংস-হাড় কেটে কেটে বসছিল লাঠির পরিত্রাহি সপাংগুলো!

আট
জাঙাল লণ্ডভণ্ড ক’রে এগিয়ে যায় ইতরসমাবেশ, মেয়েদের গজগজানির তখনও বিরাম নেই।
এ এক বড় ঘেন্নার জীব — চাঁদের মা দত্তকাকুর বউকে বলছে।
— কলতলায় সবে ঠাকুরির বাসন নামাইছি, যদি আসে মুখ দিয়ে দিতো, ক’ন দিদি! পাপটা তো আমারই লাগতো?
— কাওরাগো ব’লে-বোঝায় তুমি কিছু কোত্তি পারবা না, শান্তর মা। ওগো আবাহোনও নেই, বিসজ্জোনও নেই।

কায়পুত্র নামে ডাকলে তারা খুশি হয়, তবু সবাই কাওরাই বলবে। মান্নাপাড়া পেরিয়ে বাজারের ঠিক আগে চৌবাড়ি ময়দান, মাঠের গায়ে লাগানো কাওরাপাড়া। হয়ত মেরেকেটে দশ ঘর, পঞ্চাশ মানুষ। সব্বাই তীক্ষ্ণ কালো আর শুঁটকো, ছেলেরা নেংটি প’রে পায়খানা সাফাই করে, পোষা জীবগুলোর মতোই পাঁক ঘেঁটে মাছ ধ’রে বেচে বাজারে, মেয়েরা খাটছে ঠিকে-ঝি। ছেলেপেলে স্কুলে যায় না, সিগারেটের খোল দিয়ে তাস বানিয়ে জুয়ো খ্যালে, বিড়ি টানে, নিজেদের মধ্যে মুখখারাপ আর মাথা-ফাটাফাটি সারাক্ষণ।

বয়স্করা বাড়িতে পচাই আর তাড়ি বানাচ্ছে, পাশ দিয়ে হাঁটলে বোঁটকা গন্ধ পাবে। কিন্তু আজকাল ভদ্র সমাজও সন্ধেবেলা বড় রাস্তা এড়িয়ে ঘন দাঁতনগাছের ঝোপ ঠেলে কাওরাপাড়ায় হাজিরা দেয়। এভাবে কালে-কালে গোটা এলাকাই মাতালের দখলে চলে যাবে — এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে দত্তবাড়ির বউ ঠাকুরের বাসন মেজে ঘরে ওঠে। চাঁদের মা কনিষ্ঠ সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছিল, যা, দিদ্‌মারে ডাকে নিয়ে যায়। দ্যাখো গে, কলোনির কোন বাড়িতি যেয়ে ব’সে আছেন। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের ভাতের থালাটি আগাম সাজিয়ে হাঁড়ির বাকি ভাত নিজের পাতে তুলে নিল। তখনই আজকের ছ’নম্বর ভিখারির শুভ মহরত।

অল্প বয়েসি বউটা রান্নাঘরের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে মা দরজার পাল্লা অর্ধেক ভেজিয়ে এক চিলতে মুখ বাড়ায় — কী চাই?
— দুটো ভাত দেবা, মা গো? কাল দুফোরেত্থে কিসু খাইনি।
— নাম কী তোমার?
— মালোতী
ভেজানো পাল্লা দমাস ক’রে খুলে গেল।
— মিথ্যে কথা কও কিসির জন্যি? তুমি তো মোছলমান।
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
— যাও, একখান কলাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসো।

পাতিলেবুগাছের নীচে উবু হয়ে বসে পড়ে মালতী… না, মোমতাজ। মা নিজের থালা হাতে বেরিয়ে এসে অর্ধেক ভাত কলাপাতায় ঢেলে দেয়, কুমড়ো-পুঁইশাকের ঘ্যাঁট এক খাবলা রাখে ভাতের পাশে, এবং যে মুসুরির ডাল ঢালে পাতের ওপর, তাতে এমন নিফুটি জল যে পাতা ছাপিয়ে উঠোনের ধুলোয় মিশে যায় ডালের অর্ধেক। লেবুগাছের চারটে পাতা ছিঁড়ে চটকে মেখে খাওয়া সেরে মুখ ধুয়ে মোমতাজ যখন আঁচলে হাত মুছছে, মা গিয়ে সামনে দাঁড়াল :

— তোমরা তো পাকিস্তান থে’ আমাদের খ্যাদায় দিছিলে নিজেরা আরামে থাকপা ব’লে। কিন্তু থাকতি পাল্লে কই? সেই তো হিঁদুগো পেছোন পেছোন ইন্ডিয়ায় চলে আসতি হ’লো!
— কাজ জোটে না মা, ভিক্কেও দেয় না কেউ, কিন্তুক সব্বোনাশ করার লোক আছে। যেই মেয়ে হল অ্যাট্টা, খসোম ছাড়ে দে’ চলি গ্যালো। পাকিস্তান-ইন্ডে দিয়ে আমি কী করবো, পেরানে বাঁচা নিয়ে কথা।
— তোমার মেয়েডা কই?
— সে-কবে তার গোর দেয়া সারা!
ব’লে এমনভাবে উঠোনের একদিকে তর্জনী বাড়ায়, যেন ওখানে খুঁড়লে এখুনি মেয়ের মাটিমাখা হাড়গোড় বেরিয়ে আসবে।

চাঁদ দিদিমাকে খুঁজতে বেরোনোর সময় পেছন ঘুরে দেখছিল — শীতের ফ্যাকাসে দুপুরের ভেতর দাঁড়ানো দুই নারী শূন্য চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে…।

গুড়ের চা

চার
মা কোনওদিন হেডমিস হতে পারবে না। হেডমিসের কেমন দূর-ময়না গলার আওয়াজ, যে-কোনও “ভাল্লাগে না” সারিয়ে দেওয়া হাসি, পাট-পাট শাড়ির কুচি, রাস্তা দিয়ে এক-ঢেউয়ে হেঁটে যাওয়া… আর মা তো ব্লাউজই পরে না। চাঁদের দিদি প্রতিদিন মিসের সঙ্গে স্কুলে যায়। চাঁদও হেডমিসের পাশাপাশি এক-ঘোরের মধ্যে হেঁটে যেতে চাইছে অল্প হোঁচট খেতে খেতে; শিবুকাকুর দোকানদার ছেলেরা, বটতলায় বসে আড্ডা মারা তার যত পায়ে-ঘা, প্যান্টের-ইলাসটিক-ঢিলে বন্ধু, সব হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। শিমূলগাছ, তৃণাঙ্কুর ঘাস আর তাতে দড়ি-বাঁধা ছাগল ফিসফিস ক’রে বলবে, ইশ খুব ভুল হয়ে গেছে আপনাকে “এই চেঁদো” ব’লে ডাকা-টা! চাঁদ তখন প্রভাতীদির ছাত্রবন্ধু, সেই বড়দিমনি রাস্তায় যার মুখোমুখি পড়ে গেলে প্রণাম করে কেটে পড়তে হয়।

সরস্বতী পুজোয় গিয়ে সে দেখে এসেছে এক চুপিসাড় অচেনা পৃথিবীকে যেখানে দিদি প্রতিদিন পাঁচ ঘন্টার জন্যে গুম হয়ে যায়। পুট পুট ক’রে ভেঙে যাওয়া চক, ধুলোময় ডাস্টার, তিন কাঠির স্ট্যান্ডে বসানো ব্ল্যাকবোর্ড, একসঙ্গে জোড়া চেয়ার-টেবিল আর বিরাট পেতলের ঘন্টায় নির্মিত সেই রহস্য অমনিবাস। প্রতিদিন সকালে উঠে চাঁদ মাকে জিগ্যেস করেছে, আজ আমারে ইশকুলি ভোত্তি ক’রে দেবা তো, আর মা জবাব দিয়েছে, আজকে না, কালকে। কিন্তু সেই চিরকালীন আজ-এর একদিন যখন দিদি দিদিমনির সঙ্গে রওনা দিচ্ছে, মা হাসছে সৌজন্যমূলক ঘোমটার ভেতর থেকে, চাঁদ পায়খানায় বসে কোঁৎ পাড়ার মতো ক’রে চেঁচাল — আমিও ইশকুলি যাব। পরিবেশে প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে না দেখে সে দ্বিতীয়বার চিৎকার শানালো বুনো গলায়, যেমন আর ডি বর্মন, আর তারপরেই ছেলেটার শরীরে ভেঙে পড়ল কান্না। উঠোনে আমগাছের ছায়ামুগ্ধ কোনে বড় বড় দুব্বোঘাস, তার ওপর শুয়ে পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। শিশিরে জব্‌জবে নীল সোয়েটার, ছোট ঢিল আর খড়কুটো ফুটতে লাগল পিঠে। মা তার একটা ডানা ধরে টানছে, উঠোনের উনুনে ধানসেদ্ধ ফেলে দিদিমা ছুটে এল, ছোড়দা ভাবছে, ওহ, আজ যা পেটানি খাবে না…! চাঁদের মাথার চুলে আমের শুকনো পাতা; সর্দি, চোখের জল আর শিশিরে ধুয়ে গেছে মুখ; কোঁচকানো ভুরুর ওপরে ছোট্ট কপাল, লম্বা চোখদুটো, ঠোঁট, থুতনি … সব পুরোনো মধুর মতো বিষণ্ণ লাল।

পাঁচ
— ছেলেটারে শুদু শুদু কষ্ট না দিয়ে ইশকুলি ভোত্তি করে দিচ্ছিস না কেন, নাদু?
— যা বোজো না, তা নিয়ে কথা বোলতি আসে না, মা। ওর বয়েস হইছে ইশকুলি পড়ার?
— তালি মিথ্যে মিথ্যে আশা দিস ক্যান্‌?
— যার ছল তারে ভাবতি দাও। মার চেয়ে দরদ মাসির, তারে বলে সব্বোনাশী!
— মানলাম, ছল তোর। কিন্তু ওরম ঠাস ঠাস ক’রে কোনও মা’য় তার বাচ্চারে চড়ায় নাকি! ব্যাচারা কাঁদতি কাঁদতি বাড়িত্থেকে বেরোয় গ্যালো।
— তোমার মোতন গায়ে ফুঁ লাগায় ঘুল্লি আর একচোখোমি কল্লি আমার চলে না। দোষের শাস্তি মার। আমার পরিষ্কার কথা, খাওয়াবো তত্ত্ব, হাগাবো রক্ত।
— ওরে আমার তত্ত্ব-খাওয়ানি রে! সকাল থেকে বাচ্চাগুলোরে দিছিস তো এক কাপ চা আর এক খুরি মুড়ি।
— আমার মাথা গরম ক’রে দিয়ে না, মা। এতগুলো হাঁ ভরাতি হলি মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও টান পড়ে। তারপর যদি থাকেন একজন ঘরশত্রু বিভীষণ!
— তুই বিভীষণ কারে বোলিস, নাদু?
— যারে কওয়ার তারেই কোইছি! এক বেলার জন্যি বারাসাতে ছোট্‌ঠাকুরপোর কাছে গিছিলাম। আসে দেখি, সরষেত্তেলের বোতল অদ্দেক খালি! সাধের ছোট নাতিরে মুসুরির ডালের বড়া ভাজে খাওয়ানো হয়ে গেছে। আজ মাসের দশ তারিক, বাকি মাস এই তেলে চলবে কী করে? নিজির সংসার হলি এ-কাজ কত্তি পাত্তে?
— আমি বড়া ভাজিনি। তোর সরষেত্তেলের বোতলে হাতও দিইনি আমি।
— আর দুদিন পরে তো চোখ বোজবা, এখনও মিথ্যে কথা ছাড়তি পাল্লে না। বাচ্চাগুলোর স্বভাব বিগড়ে দিয়ে যাচ্ছ, ছোটোটার মাথা তো খাইছ এর মদ্দিই, সবক’টা অমানুষ হবে। তার ভোগ ভুগতি হবেনে আমার।
— আমি তোর চক্ষুশূল হয়ে উঠিছি, তাই না? অন্ন ধ্বংস করতিছি তোর! তো সে কথাডা অ্যাতো ঘুরোয়ফিরোয় কওয়ার দরকার কী? পাকিস্তান থে’ আসার সুমায় সঙ্গে না নিলিই পাত্তিস।
— তা তো কোইনি। খাবা-দাবা, সংসারের এক কোনে পড়ে থাকবা। গা-জ্বালানি কথা বোলতি আসো ক্যানো? এ-মাসে নিতাই টাকা পাঠায়নি, তোমার জামাইয়ের মাইনে হোতি আরও এক সপ্তা, কাল রবিবার র্যাোশান তোলার পয়সা নেই। তোমার আর কী! সেদিন বললাম, মা উনোনে কয়লা পুড়তিছে, আমার হাত আটকা, কলাইয়ের ডালটা চাপায় দ্যাও। কী কোলে? এখন পারব না, পোড়ে কয়লা পুড়ুকগে! এই কথাডা আমি জীবনেও ভোলবো ভাবিছো! পিঠে খাও পিঠের ফোঁড় গোনো না, না?
— পুরোনো বিত্তান্ত তুলে তুই আমার পায়ে পা বাদায় ঝগড়া কোত্তিছিস, নাদু! তোমার কোন পাকা ধানে মই দিছি যে কারণে-অকারণে খোসবা; আমি কথা বোল্লিই অপরাধ! বাড়িতি এট্টা গরু থাকলি সেও হাম্বা করে, অথচ এ-বাড়িতি আমার কিছু কওয়ার জো নেই! ওনুমোতি দে, আমি তোর সংসার ছাড়ে চলে যাই।
— আমি ওনুও দেব না, মোতিও দেব না। তোমার যা মোনে চায় কোত্তি পারো।
— এমন এট্টা দিন যায় না যেদিন তুই বালবিধবা মা’রে না কাঁদায় জল খাইছিস। যদি এক ফোঁটাও বাওনের রক্ত আমার গায়ে থাকে, তাহলি এই মুখ আর এ-জীবোনে দেখতি পাবি না।
— ওমা, আমি আবার কী বল্লাম তোমারে! আমি তো মুখ বুজেই আছি। সকাল থে’ তুমিই গাচ্ছো, তুমিই বাজাচ্ছো! বেরোয় একবার দেখে আসো, কোনও চুলোয় জায়গা হবে নানে। এই জামাইয়ের হোটেলেই ফিরে আসতি হবে।

ছয়
গাছি উঠেছে নারকোল গাছে; গাছ খোড়োনো হবে, পাড়া হবে ঝুনো নারকোল। গাছিভাইয়ের সারা গায়ে উদ্ভিদের গুঁড়ো গুঁড়ো আঁশ আর ঘাম মিলে ঝাঁঝালো গন্ধ। গোড়ালিতে একগাছি গোরুর দড়ি, এক ফালি ধুতি ল্যাঙোট ক’রে পরা, পাছার দুটো আঁটিই দেখা যায়। চাঁদ আর তার এক বছরের ছোট বোন গোপা, যাকে অজানা কোনও কারণে সে গোপু বলে ডাকে, হেসে এ ওর গায়ে পড়ে যাচ্ছে। বলা হয়নি, এক ঘন্টা আগে চাঁদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার আজাদ হিন্দ সংঘে একটা চেয়ারে হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে শীতে ঠকঠক ক’রে কাঁপছিল। মায়ের নির্দেশে মনিদা ওই অবস্থাতেই তাকে পেছন থেকে ধ’রে তুলে আনে। এখন সে ঘি দিয়ে এক থাল ফ্যানাভাত খেয়ে দিদির ঘরে-পরার সোয়েটারটা গা’য় স্কুলে ভর্তি হতে না পারার দুঃখ ভুলে নারকোলনাড়ু খাওয়ার আশায় উঠোনময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে।

গাছি শুকনো ডেগো আর ফ্যাতরা কেটে ফেলছে নীচে আর চোখের সামনে ধক ধক ক’রে বড়ো হয়ে যাচ্ছে গাছটা! ফ্যাতরা দিয়ে ন্যাড়া পোড়া হবে দোলের আগের দিন। আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া/কাল আমাদের দোল/পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে/বলো হরিবোল। সব কবিতাতেই চাঁদের নাম, দেখেছ?

গাছি এক কাঁদি নারকোল মাটিতে নামিয়ে দিল দড়ি বেঁধে। আরে এ কী করলে গাছিভাই, এগুলো তো এখনও ঝুনো হয়নি, দুমড়ো! তখন মনিদা — দুমড়ো নারকোলের সেই গল্পটা বলো না, মা। আরে, আমার এখন অনেক কাজ। আচ্ছা, শোন। পাকিস্তানে আমাদের বাইরির কাজ করার, এই ধর ছাড়া-কাপড় কাচা, ঢেঁকিতে ধান ভানা এসবের এট্টা মুসলমান মেয়ে ছিল, আমারই বয়েসি, সালমা। তাকে একদিন জিগ্যেস করিছি, এই তোরা যে গোরুর মাংস খাস, খাতি কেমন লাগে রে! স্বাদ কেমন? তা সালমা বলে কী,
— ও ঠারোন, দুম্মো নায়েল খায়েসো?
— খাইছি তো!
— অ অ অ অ অ অয়, তবে তুমি গোরুর মাংসও খায়েসো।
— দূর হ’ মুখপুড়ি!

এই গল্পে হাসির কী আছে, চাঁদ বুঝতে না পেরে তাকিয়ে দ্যাখে বোন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ছোদ্দা জানিস, মা’র সঙ্গে দিদ্‌মার ঝগড়া হয়ে গেছে। মা বলল, তুমি রাবণ। দিদ্‌মা বলল, না, আমি বাওন। বলে বাড়িত্থেকে চলে গেল।

দিদিমা বিদায় নিলে চাঁদের অনেক ক্ষতি — প্রথম কথা শোয়া। সে খোপের ঘরে বুড়ির সঙ্গেই ঘুমোয় এবং যেটা পৃথিবীতে কেউ জানে না, ঘুমোনোর আগে তার কিশমিশের মতো শুকনো কচকচে মাই পুরে নেয় মুখে। তারপর রসগোল্লা-ক্ষতি তো আছেই। বাড়িতে মিষ্টি এলে দিদিমা নিজের ভাগেরটা রেখে দিয়ে মাকে লুকিয়ে তাকে খাইয়ে দেয়। মা দেখতে পেলেই ঘেন্না দেবে — খাসনে চাঁদ, তোর দিদ্‌মা ওটা বাঁধানো দাঁতের কৌটোয় রাখে দিছিল। সে আড়চোখে নারকোল-কাঁদির দিকে তাকিয়ে দুর্বল গলায় গোপুকে বলল, আমিও বাওন, আমিও চলে যাব।

(ধারাবাহিক)

গুড়ের চা

এক
শীতকাল পুরোনো নীল সোয়েটারের শক্তিপরীক্ষা নেয়।
শুরুতে মনিদার ছিল, তারপর ছোড়দা পরতো, এখন চাঁদের গায়ে। ক্যাশমিলনের তৈরি, কিন্তু তাতে বিচ্ছেদের ভাগ বেশি; ক্ষার-কাচায় আর টান খেতে খেতে উলগুলোর ফেস্টো বের হয়ে গেছে, হাওয়া পাস করে মাছের-চোখ ডিজাইনের ভেতর দিয়ে।

লেপেরও তুলো সরে গেছে স্থানে স্থানে; মুড়ি দিলেও যখন চোখে আলো আসছে, বুঝতে হবে ভোর হল মশারি খোলো। ঘুম থেকে উঠেই চলো রান্নাঘর, রাতের বাসি উনুন থেকে ঘুঁটের ছাই অধিকার করি, দাঁত মাজি যতক্ষণ না হাতে-দাঁতে কিচকিচ আওয়াজ। কিন্তু বিছানা ছাড়ার আগে হি-হি করতে করতে ওই নীল সোয়েটার পরে নেওয়া, যে সব সময় সমকালীন শীত থেকে পিছিয়ে আছে। তার নীচে হাফ প্যান্ট, থাইয়ের লোমগুলো যেন কাঁটানটে গাছ। এই পৃথিবীতে পাঁচ বছর বয়েসে পাজামা পরার নিয়ম বা পয়সা নেই।

বাইরে এসে দাঁড়ালে নতুন দিনের দরজা খোলার খুটখুট কানে আসবে। সেই শব্দ উঠোনের শালিখদল, পতিত কিন্তু ঝলমলে আমড়াপাতা আর সমতল কুয়াশার পাহাড়ি হয়ে ওঠার স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। রোদের রশ্মি এতক্ষণে পৃথিবীতে নামছে, তাকে রাস্তা চিনিয়ে আনছে গুলকয়লার ধোঁয়া। তবু এখনও আমগাছের পল্লবে মাকড়সার জাল বিয়ের কনের মুক্তোমুকুটের মতো নেহার ফোঁটায় সেজে আছে। আবার পেয়ারাকুঁড়ির গা-য় সাদা তুলো জমাট-বাঁধা, নখ দিয়ে খুঁটেছ কি নীচে হোমিওপ্যাথ দানার চেয়েও ছোট ছোট পতঙ্গের ডিম, টিপলে দুধ বেরিয়ে আসে। এসব দেখতে দেখতে রোদের ফালিগুলো বড় হল, পুব দিকের ডোবা পেরিয়ে চাকা নামাল চাঁদের উঠোনে। তখন হাতে বোনা এক একটা খেজুরপাতার পাটি ওই রোদের স্লাইসগুলোর ওপর পেতে বই নিয়ে বসে যায় ছেলেমেয়েরা, আর গ্যাঙোর গ্যাঙ শুরু চার-পাঁচটা নিনাদিত গলায়। কেউ নিজের পড়া শুনতে পাচ্ছে না-র মধ্যে চাঁদ শুধু নিশ্চুপ হয়ে থাকে। মা টের পায়।
— মন কোথায় তোর?
— আমার ক্ষিদে পায়ে গেছে।
— বাহ, ঘুম থেকে উঠতি না উঠতিই ক্ষিদে! পেটে কী ভস্মকীট বাসা করিছে?

সোয়েটারের ওপর দিদিমা তুষের চাদর পরিয়ে দিয়েছিল ঘাড়ে গিঁট বেঁধে, তার মধ্যে কিছু একটা নড়ে ওঠে। “আবার তুই বিড়েল নিয়ে বসিছিস? এই তোর পড়াশুনো? দেখিসকানে, কোনওদিন ইস্কুলে ভোত্তিই করবো না তোরে, সারা জীবন মুখ্যু হয়ে ঘরে ব’সে বিড়েল ঘাঁটিস”।

এই শাসানি গণপ্রহারের চেয়েও সাংঘাতিক; চাঁদ প্রাণীটিকে তড়িঘড়ি মুক্ত করে দেয় — একটা ফুটফুটে সাদাবাদামি শিশু, যে চাদরের ওম হারিয়ে অখুশি মুখে এক লাফে আবার চাঁদের কোলে উঠে আসছিল। তখন ঘাতকের মতো তার ঘেঁটি ধ’রে শূন্যে ছুঁড়ে দেয় চাঁদ, আকাশে তিনচার ডিগবাজি খেয়ে বেড়াল ক্যাঁক ক’রে পেট দিয়ে পড়ে শুকনো উঠোনে।

দুই
এই দৃশ্যের গায়েই লেগে আছে বাড়ির খেজুরগাছ বেয়ে মনিদার উঠে যাওয়া। ঝট ক’রে রান্নাঘর থেকে একটা অ্যানামেলের গেলাস হাতে নিয়ে সেও ছোড়দা আর বোনের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। মাটির ঠিলে গাছ থেকে নামিয়ে মায়ের শাড়ি-ছেঁড়ার ছাঁকনি দিয়ে মনিদা সবার গেলাসে কিছুটা করে প্রথম-কাটানের খেজুররস ঢেলে দিচ্ছে, ওমনি ছাঁকনি থেকে তিন চারটে কালো বোলতা ফড়ফড় ক’রে বাতাসে ওড়ে। নাক-জ্বালা-করা ঝাঁঝালো কিন্তু মিছরির মতো ঠান্ডা সেই রসে শিরদাঁড়ায় শীতের কাঁপুনি ফিরে আসে চাঁদের, লাফ দিয়ে খেজুরপাতার চাটাইয়ে উপনীত হয়। কিন্তু রোদে ব’সেও দাঁত-ঠকঠকি কমছে না কেন! পেছনে তাকিয়ে দ্যাখে ছোড়দা বেমালুম তার রোদ্দুর আড়াল ক’রে দাঁড়িয়ে! রাগে অন্ধ ছেলে “সর, শালা” ব’লে দাঁত-বের-করা দাদাটির দিকে ইঁটের টুকরো তোলে। ওমনি সে চেঁচিয়ে, “দ্যাখো মা, ভাই আমাকে শালা বলল”।

তাহলে কলোনির গাঙ্গুলিবাড়িতে খবরের কাগজ পৌঁছনোর আগেই দিনের প্রথম এফআইআর রুজু হয়ে গেল চাঁদের নামে। প্রতিদিন ছোট-বড় মিলিয়ে এরকম সাত-আটটা। বেলা যতই আকাশ বেয়ে ওঠে, তার নামের সঙ্গে অপহরণ, রাহাজানি, খুনের প্রচেষ্টার মতো অভিযোগ জড়িয়ে যায়; একটা টাটকা-ফ্রেশ সকাল শুধু চাঁদের অপকর্মের জন্যেই ক্রমে দুপুরবিকেল থেকে স’রে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে অপরাধগুলো না করলে পৃথিবীতে… পৃথিবী না হোক, দত্তপুকুরে রাত নামত না কখনও। আর রাত্রি অনুৎপন্ন হলে কাজ থেকে ফিরে বাড়ির বড়রা কীভাবে আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবে, আর কী ক’রে ভাইকে মার খাওয়ানোর আনন্দে খ্যা-খ্যা ক’রে হাসবে দাদা-দিদি?

তিন
তবে বিদ্যাভ্যাসে আকর্ষণীয় সব বাধা আছে। “দুউউউধ” ব’লে বড় রাস্তা থেকে একটা ফাটা গলা চিৎকার দিতেই তিন লাফে কলতলার পাঁচিলের ওপর রাখা বাটিটা হাতে তুলে নেয় চাঁদ। গোয়ালা হারানকাকুর দুধের ড্রামে খেজুরপাতা বসানো, সে মাসকাবারি যোগান হিসেবে এক ঘটি মানে আধ সের দুধ চাঁদের হাতে ধরা বোকনো বাটিতে ঢেলে দিল। তারপর তাদের টিউবয়েল থেকে ঝক-ঝক ক’রে জল ভ’রে নিল ক্যানে। এইভাবে চোখের সামনে দুর্নীতি দেখলে বাবা খুবই আপত্তি করেন। কিন্তু বাবা আর মা যথাক্রমে আদর্শ এবং তা থেকে দুশো মাইল দূরের বাস্তববাদ। মা-র পরিষ্কার কথা, জল তো ওরা মেশাবেই মেশাবে। পুকুরের পচা জলের বদলে বরং কলের ভালো জলই ঢালুক।

আসলে, ঘোষেরা কলকাতায় সাপ্লাই দেবে ব’লে ভেন্ডারে ক’রে দুধ নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন তারা লেট, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে ব’সে থাকে, ছাড়ো-ছাড়ো ভাব, তখন রাস্তা দিয়ে বাঁক কাঁধে দৌড়োবে, মুখে এক প্রবল “ও ও ওয়, ও ও ও ও ওয়”। গার্ড সেই ফুসফুস-ফাটানো চিৎকারের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় ট্রেন, বদলে সে ফ্রিতে কিছুটা দুধ পেল কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু আজ স্টেশানে পৌঁছনোর আধ ঘন্টা পরেই দেখা গেল গোয়ালার ঝাঁক বাঁক কাঁধে মন্দ-মন্দ পায়ে আবার কলোনিমুখো। মছলন্দপুরে ট্রেন লাইনচ্যুত, এতক্ষণ কোলে মার্কেটে তাদের মহাজন ব’সে থাকবে না ব’লে অর্ধেক দামে গ্রামেই সব দুধ বেচে দেবে ঘোষ সম্প্রদায়। তখন দিদি স্কুলের যাওয়ার জন্যে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে “আর এক সের দুধ কেনো না মা, পায়েস খাবো!” অনুনয় রাখলে ঘরে চিনি বাড়ন্তের জন্যে মা কিন্তু-কিন্তু করেও শেষে আঁচলের গিঁট খুলে ফ্যালে। চাঁদ অবাক হয়ে দ্যাখে তাদেরই কলের জল দুধ হয়ে তাদেরই ঘরে ঢুকে গেল।

“ও মা, খাতি দেবা না?” ডাকে সেই ক্ষোভ মিশিয়ে দেয় সে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই “আসে নিয়ে যাও” শুনে ভাইবোনদের দুমদাম দৌড় রান্নাঘরে। চাঁদ মুড়ির বাটি আর হাতলভাঙা কাপে চা সন্তর্পণে ধ’রে ফেরত আসে খেজুরপাটিতে। গুড়ের চায়ে প্রথম চুমুকেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল, আহ কী মিষ্টি! এক মুঠো মুড়ি ফেলে দেয় চায়ের কাপে, তারপর কানের কাছে কাপ তুলে আনে। এখন কিছুক্ষণ সে খাওয়া ভুলে শোঁ-শোঁ সমুদ্রগর্জনে মোহিত হয়ে থাকবে।

(চলবে)

রিস্কি

সবাই নিজের স্বার্থ দ্যাখে
মানছে মনে মনে
স্বীকার করতে বলো – ওদের
কিল-ঘুষি কে গোনে!
নিজের সুখের ব্যস্ত খোঁজে
তোমার ভালো দেখছে না
চোট-ধাক্কা দিনের মেনু
হও গে’ যতই মুখচেনা
লোকাল ট্রেনের চতুর্থ সিট
হিসেব- বহির্ভূত
তেমনি সবাই সবার কাছে
রুক্ষ হওয়ার ছুতো

এই জনতাই ব্রহ্ম, জান-এ
সাপটে নিতে হবে
নিলেই চোরা ছুরি বুকের
বাইপাস-উৎসবে
কিশোর, তবু হোক না তোমার
গঠিত উচ্চাশা
ভালোবাসা, ভালোবাসা
রিস্কি ভালোবাসা

.
[“ছোটলেখকি” বই থেকে]

বাউল

ধুলোবালির রাস্তা উজোয়
ডাইনে ডাঙা, বাঁয়ে অজয়
জনমানুষ পাখির মতো প্রাণ

নদীর চরে সূর্যথালা
মেজেঘ’ষে কৃষ্ণআল্লা
তাতে সিকি-আধুলি ভিখ চান

শীত পড়েছে এবার বেশি
আমরা সবাই প্রতিবেশী
অচিন ছেলে কাঁথায় ভাগ্যবান

তুমি জাতবাউলের ব্যাটা
নেই ঘরসংসারে চ্যাঠা
বোল-নাচ-ভাবের সাম্পান

সুরের শিরে দাঁড়াও, গুরু
জগৎ তোমার পায়ে শুরু
কপাল জুড়ে আকাশ ওড়ে
চন্দ্র শোভা পান

.
(“ছোটলেখকি” বই থেকে)