পাঁচ
শরীরগুলো মাঠে পড়ে আছে – ইঞ্জিন খুলে নিয়ে যাওয়া ওয়াগন; ঘাম, বর্ষার জল, গায়ের রঙ আর কাদা মিশে একাকার। শুধু বিকাশদা চটি-পাছায় ব’সে বিড় বিড় করছে, “পনেরো বছর সাব-ডিভিশান খেলছি, এমন গোল বাপের জম্মেও দেখিনি। বদমায়েশিটা কমালে ‘পোকা’ একদিন কলকাতা-মাঠ দাপাবে”। চাঁদ সেঁটে থাকে এদের পেছনে, প্রত্যেকটা কথা শুষে নেবে। যেমন, রজত হেড করতে উঠে দুবার কনুই মেরেছে অসীমের চোখে। “গান্ডু রতন কি বাঁশিটা পোঁদের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিল তখন?” শুয়ে শুয়ে নবদার জবাব, “বাজিয়েছিল, ছ্যাপ-ভর্তি বাঁশি, শোনা যায়নি”। ছ্যাপ মানে থুতু, নব সাহা খুলনার লোক।
খেলার মূল গল্পের সঙ্গে জড়ানো, তারই প্রান্তসীমা থেকে উঠে আসা এই সব টুকরো কাহিনি মিলেই গোটা আখ্যান; না শুনলে বোঝা যাবে না খেলোয়াড়ের মন, তার সাহস আর অসহায়তা, বল নিয়ে হু-হু করে উইং ধরে ওঠার সময় সে কী ভাবে, সকালে বাজারে মাছ নিয়ে বসা বাবুয়াদা আর বিকেলে হলুদ-সবুজ জার্সি-পরা বাবুয়াদার মধ্যে তফাত কোন জায়গায়!
হেরো টিম বেশিক্ষণ বসে না মাঠে, খেয়ালীও বেরিয়ে গেছে। বীণাপাণির প্লেয়াররা এবার টলতে টলতে মাঠ পার হয়ে পাশের রেলপুকুরের দিকে হাঁটল, তাদের কিটব্যাগ বহন করছে সঙ্গীসাথীরা, চাঁদের হাতেও কে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে – আছাড় খাসনে আবার!
রেল কোম্পানির তলাওটি প্রস্থে ছোট হলেও লম্বায় হ্রদের মতো। জলে বাতাস লেগে একটা তিরতিরে স্রোত সব সময়। পাড়ে দাঁড়ালে মাছের গায়ের গন্ধ; জলে নামলে শ্যাওলা-শামুক-জলঝাঁঝির পা এঁটে ধরা স্তব্ধতা। বর্ষায় টাপেটোপে ভরা সেই জলরাশিতে শরীর ছুঁড়ে দিতে থাকে ছেলেগুলো। এখান থেকে গল্পে আর চমক নেই। তোয়ালেয় মাথা মুছে ওরা নিজের নিজের কিট থেকে কোঁচকানো জামাপ্যান্ট পরে নেবে। ছোট চিরুনিতে চুল আঁচড়ে কেউ সোজা হেঁটে কেউ অল্প খুঁড়িয়ে গিয়ে বসবে কাশীকাকুর দোকানে। সেখানে গোগ্রাসে কাঁচা পাঁউরুটি-ঘুঘনি খাবার পর সবার হাতে তিরিশ টাকা ক’রে ধরিয়ে দেবে বীণাপাণির ম্যানেজার ষষ্ঠীতলা প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার কাল্টুদাস্যার। চাঁদের কলোনির পাশে চড়কপাড়ায় তারই স্কুলের বন্ধু ঋতুরাজদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেখানে সারাদিন কাজ করার পর দুটো মিস্তিরি আর তিনটে যোগাড়েও টিউবয়েলের জলে স্নান ক’রে শার্ট-ফুলপ্যান্ট প’রে পাতা-কেটে মাথার চুল আঁচড়ে নেয়। তারপর এসে বসে কাশীকাকুর দোকান থেকে একটু দূরে বাবলা ডেকরেটর্সে। সেখানে কনট্রাকটার শুকদেবজেঠু এসে ওদের মজুরি গুনে দেয়। দুই দল পাশাপাশি হাঁটলে ফট ক’রে বোঝা যাবে না কে রাজমিস্তিরি কে ফুটবল প্লেয়ার!
ছয়
কলপুকুরের জল অতিরিক্ত কালো হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি নামবে ভেবে চাঁদ আকাশে তাকিয়ে খেয়াল করল বিকেল এখন পাস্ট টেন্স, জাঁকিয়ে সন্ধে নেমে গেছে চারপাশে। সর্বনাশ! অন্ধকার মানে সেজদার খটাস গাঁট্টা, মায়ের জোয়ারিপূর্ণ মুখনাড়া। কিটব্যাগ নামিয়ে রেখে চাঁদ রেলপুকুর প্রায় উড়ে পার হয়ে উল্টোদিকের ইঁটবাঁধানো রাস্তায় এসে পড়ে। ট্রেন-প্যাসেঞ্জারের যাতায়াতে সমৃদ্ধ জনপথ এখন নেতিয়ে আছে, একফোঁটা মানুষ নেই কোথাও, বটগাছের শেকড়ের প্যাঁচে দমবন্ধ হয়ে মরা রেল-কেবিনটা শুধু হাঁ ক’রে দেখছে তাকে।
এমন দৃশ্য থেকে ভয় জন্ম নেয়, স্পষ্ট জেনে গেল সে। ভয় একইসঙ্গে ওই ফাঁকা রাস্তা এবং কেবিনের ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে এসে তার শরীর ছুঁল, সেঁধিয়ে গেল ভেতরে। এই আতঙ্ক সম্পূর্ণ স্বাধীন, তার সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ বা বাড়ির শাসনের একটুও জানাশুনো নেই। পড়তে বসার সময় যেমন সকাল, ভয়ের সময় হল সন্ধেবেলা। কারণ সায়ংকালে সবাই একা – টিউশান থেকে দেরি ক’রে ফেরা ছাত্রী, বাঁশবাগান অথবা জীবনসন্ধের মানুষ।
হাওয়ার বেগে ছুটছিল চাঁদ, এই রাস্তাটুকুর অভিশাপ পার হয়ে রেলস্টেশানে পৌঁছোতে পারলে গন্নাকাটা চা-ওলা ছেলেটা, ঢোলা খাকি হাফপ্যান্ট পরা হুড়ুমভাজার দোকানদার সব তার কাছে জীবনদায়ী ওষুধ। অর্ধেকটা ছোটার পর হঠাৎ খেয়াল করল এক দিদিমাবুড়িকে, রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোমর সামনে ঝুঁকিয়ে কিছু তুলে নিচ্ছে রাস্তা থেকে। পথে ঘাটে পড়ে থাকা গোবর কুড়িয়ে নিয়ে যায় অনেক গরীব মানুষ, কিন্তু বুড়ি যেন তার অপেক্ষাতেই ওই পোজে স্থির হয়ে আছে। চাঁদ কি রেললাইন টপকে রেলকোয়ার্টার্সের পাশের রাস্তা ধরবে, যে রাস্তা আরও নিঃঝুম বড় বড় আম-জামরুল গাছে? আপাতত গতি কমানো যাক ভাবল সে, কিন্তু খেয়াল করল কোনওভাবেই দৌড় থামাতে পারছে না, হাওয়ার বেগে ভেসে যাচ্ছে বুড়ির দিকে।
সাত
ফুল ভলুমে চলা রেডিয়োর সেন্টার বদলাতে গেলে দুটো ব্যান্ডের মাঝখানে যে তীক্ষ্ণ ভয়ের চিৎকার ওঠে, হঠাৎ তেমন কান ফুটো করা শিসে সন্ধের নিশ্চুপ বাতাস ভ’রে গেল। বুড়ি তার তড়িৎক্ষেত্রে চাঁদকে ছুঁড়ে দিয়ে জাল গুটিয়ে আনছে দ্রুত, এভাবে যখন তাদের মধ্যে এক হাতের তফাত, তড়াক ক’রে মাথা তুলল বৃদ্ধা। চাঁদের নিঃশ্বাস-দূরত্বে সাদা ঘোমটার নীচে পোড়া কাঠকয়লা রঙের মুখ, চোখের কোটরে চোখ নেই, হাঁমুখের ভেতরে শুধু অন্ধকার। জ্বরের তড়কা এল তার শিরদাঁড়ায়, শীত করে উঠল গা, বুড়িকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে পালাতেই হবে। স্বপ্নের মধ্যে আমরা যেমন দৌড়োই, সেই রকম ভারশূন্য ঋদ্ধিশূন্য ছুট দিতে চাইল একটা, আর সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে আছাড় খেল। বুড়িই কি তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে? মাটিতে পড়ে চাঁদের মাথা একটা ড্রপ খাচ্ছে, দুটো ড্রপ খাচ্ছে, প্রত্যেকটা ড্রপের সঙ্গে রক্তছোপ লেগে যাচ্ছে রাস্তায়। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে তার দুচোখে কৃতজ্ঞতা লেগে থাকল সব ধড়শরীরের জন্যে, ধড় না থাকলে আমাদের মাথা কোথাও থামত না, গড়িয়ে গড়িয়ে গোল লাইন পার হয়ে যেত…।
(শেষ)