চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

ছোটলেখকি

কিছু ছড়া আর অল্প কিছু পদ্য নিয়ে ‘হিরের স্বপ্ন চারকোলে’ – একটা তিন ফর্মার সংকলন করেছিলাম ২০১১ সালের শেষে। তার শুরুতে এই চতুর্পদী ছিল –

রাত যদিও মূর্ছিত
সকাল জন্ম তার কোলে
ভাঙা ডানায় উড়ছি তো
হিরের স্বপ্ন চারকোলে

আমার তখন ভাঙা-ডানা নয়, মূর্ছিত দশাই। সেই বইয়ের বড়জোর পাঁচ কপি বিলিয়েছি বন্ধুদের। বাকিটা পড়ে থেকে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

গত আট-ন’ বছরে আমার কবিতা লেখার ক্ষমতাও হাত ফসকে জলডুব, আর টলমলে জাহাজডেকে দাঁড়িয়ে সেই অনুত্তীর্ণ হাতে ধরার চেষ্টা করেছি উড়ন্ত কিছু ঠাট্টাতামাশা, ছড়াপদ্যের রুমালে জড়িয়ে। এরাই আমার হালকাপুলকা ছোটলেখকি। আজকে নতুন-পুরনো লেখা থেকে বেছে একটা ‘ছদ্য’ সংকলনের কাজ গুছিয়ে রাখলাম।

কারও আপত্তি থাকলে ‘ছোটলেখকি’-র বদলে বইয়ের নাম হতে পারে –

‘ভালো হইতে সাবধান’

সমস্ত গাছ রাজনৈতিক, মাথায় পেরেক পতাকার
পাঞ্জাবিরঙ দিচ্ছে ব’লে কে কোন গানের কথাকার

ভাবুক চোখে ছাত্র পড়ায়… কী যেন ‘বিশ্বাস’ ছিল?
‘বিদ্বেষী’ ওর হাল-পদবী, মনে মেঘের চাষ ছিল!

আঙুরথোকায় ভক্তি রেখে দেশের সেবায় যোগদান
ঢোল বাজছে : “আমিই ভালো”। ভালো হইতে সাবধান!

বাংলা মায়ের কাঙাল ছেলে তাও তো পেলে সান্ত্বনা
পঞ্চধাতুর বিদ্যেসাগর আছাড় খেলে ভাঙত না

আমরা সড়কছাপ, শুধু এই পথের স্লোগান দেবো:
হাওয়াগাড়ি হে, সাইকেলকে মানুষ ব’লে ভেবো।

স্মরণার্থী

এক
কাল রাত্তিরে বাথরুমে ঢুকছি, ফটাস করে হাওয়াই চপ্পলের ফিতে গেল ছিঁড়ে। আর প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় এক মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথা প্রশ্ন করল, সেফটিপিন?
চৌকাঠে ঝিম হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দু’তিন মিনিট। মাটির ১২০ ফুট নীচ থেকে ভেসে উঠেছে “নিরাপত্তাকাঁটা” শব্দটা, আর মন কাঁকরবালি খুঁড়তে খুঁড়তে হু হু করে নেমে যাচ্ছে আরও অন্তত ২৩০ ফুট, আর্সেনিকহীন দ্বিতীয় স্তরের জলে — যেখানে শালুকপাতার মতো থাক-থাক সাজানো আমার শৈশব, স্কুলের পেতলের থালাঘন্টা, আমার আধপেটা রাতগুলো।

হাওয়াই চপ্পলের সঙ্গে শরণার্থী জীবনের সম্পর্ক নিয়ে কোনও না কোনও দিন প্রেমের এপিক লেখা হবে আমি জানি। মনে পড়ছে সদ্য চাকরি পেয়ে অডিট টিমে পোস্টিং হয়েছে, সবাই শিয়ালদায় একসাথ হই, তারপর গাড়ি নিয়ে অকুস্থলে রওনা। তো একদিন স্টেশানের “অনুসন্ধান-এ পৌঁছোতেই সিনিয়ার কোলিগ বললেন, ঠিক বুঝেছিলাম, এই যে ভিড়ের ঝাঁকটা বেরলো, এ চন্দনের ট্রেন না হয়েই যায় না।
— কী করে বুঝলেন!
— আমি তো প্যাসেঞ্জারের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। এইট্টি পার্সেন্ট হাওয়াই চটি মানেই বনগাঁ লোকাল।

দুই
আমরা রাবারের চপ্পল ফটফটিয়ে কলেজে বা সিনেমায় যেতাম; বিয়েবাড়ির ড্রেস হল ডেকরনের প্যান্টে টেরিলিনের ফুলহাতা শার্ট ইন করা এবং পায়ে বল-সাবানে মাজা হাওয়াই চপ্পল। আর ঝিঁঝিঁব্যাঙল্যাটামাছশামুককেঁচোখচিত ছোটবেলার সেই বিমানবিধ্বংসী বর্ষাকালে সবুজ শ্যাওলা অবুঝ এঁটেলমাটির ওপর দিয়ে আমরা যেভাবে আছাড়বিমুক্ত ছুটে যেতে পেরেছি পায়ে মসৃণ চটি, ততটা স্বচ্ছন্দ ডোবার জলে জলঢোঁড়া হয়ে দেখাক তো!
কিন্তু কখনও কখনও ওই এঁটুলি মাটিই চটির আত্মাকে ছাড়তে চাইতো না, তখন তাকে খিঁচকে সরাতে গেলেই উৎপটাং ব্যাপার। পা বেরিয়ে এসেছে, নগ্ন-একপদ বুদ্ধদেব চেঁচিয়ে উঠল:
— মা? ও মা! চটি ছিঁড়ে গেছে। সেপ্টিপিন নিয়ে আসো।
হন্তদন্ত এক ঘোরশ্যামা অনেকখানি লম্বা হেতু রান্নাঘর থেকে ঘেঁটি-নিচু বেরিয়ে আসে। দুহাতের শাঁখাপলা-সমৃদ্ধ কবজি হাতড়ায়।
—না রে মনা, সেপটিপিন তো নেই!
— ধুস, তোমরা যে কী কর না! এখন কী ক’রে ইশকুলি যাব?
দাঁড়া দেখতিছি, ব’লে মা আমার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বাড়ির দক্ষিণে লিচুগাছের ওপর বসা দোয়েলপাখির দিকে তাকায়, ওপরটি দিয়ে নিচের ঠোঁট আস্তে চেপে ধরে। আর বুকের কাপড়ের নিচে চালান করে দেয় হাতদুটো।
এমন কতবারই হয়েছে, কিন্তু তখন তো আমি ক্লাস এইট ছিলাম না, সমঝদার ছিলাম না। ঝটকা দিয়ে মুণ্ডু ঘোরাই।
— লাগবে না। তুমি বরং আমারে পাঁচ নয়া দাও, চটিসারা-র কাছ থেকে সেলাই ক’রে নিয়ে যাবানে।
মা প্রথমে বিমূঢ় হয়, তারপর তার মুখের সাগরতীরে “আচ্ছা, বুঝেছি”-র গোলাপি সূর্য উঠতে থাকে! নিজের শিশুসন্তান পরিণত ও যত্নবান পুরুষে বদলে যাচ্ছে টের পেলে আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজের নারীসত্তার দিকেও কি আর একবার ফিরে তাকায় সেই মা?
— অ মিনু, তোর কাছে সেপটিপিন থাকলি অ্যাট্টা নিয়ে আয় তো!
খোপের পড়ার ঘর থেকে বাড়ানো-হাত দিদি নেমে আসে, তার দিকে মা এক অসীম রহস্যভরা মুখে তাকায়।
— আমারে না, ভাইরে দাও। উনি আমার সেপটিপিন নেলেন না।
হাঁটু গেড়ে বসে চটিতে রিফুকর্ম শুরু করি আর বেশ বুঝতে পারি অন্ধকার আকাশে তরোয়াল ছুটে যাওয়ার মতো দুই নারীর সংকেতময় চোখ আমার মাথার চুলে অজস্র নরম তারা ঝরিয়ে দিচ্ছে।

.
[“আকাশের আন্ডারগ্রাউন্ড” গদ্যগ্রন্থ থেকে]

বিধানসভা

গ্রাম থেকে গোরুর নিঃঝুম মাথা বেরিয়ে এসেছে
গোরুর কপালে ঘোমটা হয়ে নেমেছে রোদ্দুর
এক ফড়িং-গোষ্ঠী তাকে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
খাদের চুড়োয় পৌঁছে দেবে বলেছিল
কিন্তু গ্রাম যা গভীর আর ক্লান্ত জামরুলে!

জরায়ুর মতো লাজুক এই গ্রামটায়
যেদিন প্রথম পা রাখলাম, হাতজোড় ক’রে :
নমস্কার বাঁশপাতা, নমস্কার শিশির
তোমরা দ্যাখো, গ্রামছাড়া একশো কাচপোকা
আমি ঘরে ফিরিয়ে এনেছি
আর আশ্চর্য লেগেছে, গ্রাম কী পাকা হয়েছে পেয়ারায়, কী অবশ করঞ্জাফুলে!
আমার পায়ে পায়ে ঘোরা হাঁসের বংশধর,
সদ্য পেট থেকে খসা কলাপাতাও
জমায়েতে ভিড় করে এসেছে
যেখানে করমচা-মায়ের হাতে আমি
তুলে দিচ্ছি করমচার লাশ…

রাত্তিরে সেই মাঠ ফাঁকা, দত্তদের মোটাসোটা চাঁদ
ডুবে গেল। আর কারা যেন গ্রামটাকে পিঁড়িতে ক’রে ঘুরিয়ে দিল আমার চারদিকে
তাকিয়ে দেখছি দু’হাত ভ’রে গ্রাম্য চিরকুট। সেখানে গণনার পর প্রজাপতি আর মথে
এক লক্ষ ব্যবধান
সেখানে হেরে যাওয়া শঙখের বাতাসে
হার-মানা উলুপাখি সাঁতার কাটছে

অপ্রেম সত্যের চেয়ে বেশি জানে

এক
মার্কেজের মেমারিজ অফ মাই মেলানকোলিক হোরস তার সেরা লেখাগুলোর মধ্যে পড়ে না নিশ্চয়ই, কিন্তু উপন্যাসের একটা লাইন আমার আট বছর ধরে মনে আছে। সংলাপটা ছিল বেশ্যালয়ের মালকিন রোসা-র গলায় : “আমি সব সময়েই বলে এসেছি যে ঈর্ষা সত্যের থেকে বেশি জানে”। প্রেমের উপন্যাস, তাই ঈর্ষা শব্দটা এসেছে। কিন্তু মনে হয় মার্কেজ একমত হবেন, এবং আপনারাও, যে ঘৃণা সত্যের থেকে বেশি জানে, বিদ্বেষ সত্যের থেকে বেশি জানে, অবিশ্বাস সত্যের থেকে বেশি জানে, সন্দেহ সত্যের থেকে বেশি জানে, প্রতিহিংসা সত্যের থেকে বেশি জানে। সব কিছু মিশে দাঁড়াল — অপ্রেম সত্যের থেকে বেশি জানে।

বলা বাহুল্য, সত্যের চেয়ে বেশি জানা মানে মিথ্যে জানা, ভুল জানা; যেমন এই উপন্যাসে লেখক তার অসমবয়সী প্রেমিকাকে ঈর্ষাকাতর হয়ে সন্দেহ করেন; পরে দ্যাখা যায় তার ধারণার সঙ্গে বাস্তবের কোনও যোগাযোগই নেই।

হয়তো এই অপ্রেম থেকেই ফোবিয়া জন্ম নেয়। ধরুন, কোনও মানুষের ট্রেন থেকে নির্দিষ্ট স্টেশানে নামতে পারা নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা আছে। সে পেছন থেকে সামনের সবাইকে ভয়াবহ ধাক্কা দিয়ে নেমে যাবে, যদিও সামনের লোকেরাও ওই স্টেশনে নামবে ব’লে তাকে আগেই জানিয়েছিল। লোকটার চোখের সামনে পরিসংখ্যান মেলে ধরুন — এই লাইনে ট্রেন থেকে ঠিক স্টেশানে না নামতে পারার ঘটনা হাজারে একটা। দুর্ঘটনার সম্ভাবনার কথা বলুন –– আপনার ধাক্কা খেয়ে কেউ প্ল্যাটফর্মের ওপর পড়ে দাঁতমুখ কাটতে পারে। মানবিকতার দোহাই দিন — কাউকে অভদ্রভাবে ধাক্কা মারা উচিত নয়। তার ভেতরে কিছুই সেঁধোবে না।

সে বলবে : আগে আমিও তাই ভাবতাম, কিন্তু ওই ভদ্রতা মানবিকতা ইত্যাদি করতে গিয়ে একদিন নামতে পারিনি (খারাপ অভিজ্ঞতা)। শুনে মনে হবে, সেই ব্যর্থ দিনের পর থেকে স্টেশানে নামার কাজে তার যাবতীয় মারপিট আইনসম্মত হয়ে গেছে। এবং অন্যদের প্রতিবাদ করার অধিকারও নেই যেহেতু লোকটা একদিন সত্যিই স্টেশান ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল যে! তার দ্বিতীয় যুক্তি হবে, সামনে থাকা প্যাসেঞ্জার বলে বটে স্টেশানে নামব, কিন্তু আসলে নামে না (অবিশ্বাস)। একই সঙ্গে জানাবে, সুমুখে দাঁড়ানো পাবলিক এত আস্তে আস্তে নামে যে ট্রেন ছেড়ে দেয় অথবা প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা উঠে পড়ে (অযোগ্য জনতা)। সুতরাং, ধাক্কা মেরেই নামতে হবে (আক্রমণাত্মক আচরণ)। আপনি বলুন, পরিসংখ্যান শুনেও এত ভয় পাচ্ছেন যখন, একটু আগে সিট ছেড়ে উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেই তো হয়! উত্তরে সম্ভবত লোকটা মুখ খারাপ করবে।

আমাদের মানসিক সমস্যাগুলো যে নানারকম চেহারা নেয়, তার একটা রূপ সাম্প্রদায়িকতা। ট্রেন থেকে নামার সময়ের আতংককে যদি ওই ভাষায় অনুবাদ করেন — আমি সংখ্যালঘু-প্রেমীই ছিলাম, কিন্তু আমার জীবনে অমুক ঘটনাটা ঘটার পর বা তমুক ঘটনা দেখে, পড়ে কিম্বা শুনে পালটে গেছি (খারাপ অভিজ্ঞতা)। ওরা ভারতকে ভালোবাসে না, একদিন দেশটা দখল ক’রে নেবে (অবিশ্বাস)। ওরা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান না প’ড়ে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যযুগীয় কথাবার্তা মেনে চলে (অযোগ্য জনতা)। কাজেই এদের উৎখাত করাই উচিত, অথবা দাবিয়ে রাখতে হবে (আক্রমণাত্মক আচরণ)।

এভাবে অপছন্দের অপর-কে একটা শ্রেণি বা দলে ফেলা হয় যাদের প্রত্যেকের চরিত্র একই রকম, আশাআকাঙ্খাও অভিন্ন। ধরুন, মুসলমান মানেই তেলাপিয়া মাছ বা দলিত মানে মৌরলা। (যেখানে মুসলমানেরা সংখ্যায় বেশি, তারা হিন্দুদের ফ্যাঁশা মাছ বলছে)। তেলাপিয়া তেলাপিয়াই, সাইজে ছোট বা বড় হতে পারে শুধু। এমন চিন্তার বিপজ্জনক সুবিধেটা হল, আপনাকে মাথা খাটাতে হবে না। পরীক্ষার হলে অংকের ফর্মুলা পাশ থেকে কেউ ফিসফিস ক’রে ব’লে দিচ্ছে। কোনও ধর্ম বা ইডিওলজি বা দলের অন্ধ অনুসরণ মানেই না-পড়ে লেটার নম্বর।

কেননা, এই সমীকরণ অনুযায়ী যদি দুটো শিখ একজন মেয়েকে ধর্ষণ ও খুন করে পালিয়ে যায় তবে অন্য যে-কোনও দুজন শিখকে ধরে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে, যেহেতু ওরা একই সম্প্রদায়ের। দাঙ্গার যুক্তি, দাঙ্গার আদর্শ, দাঙ্গার গঠনতন্ত্র এটাই। টুপিতে-টুপিতে তিলকে-তিলকে বা পাগড়িতে-পাগড়িতে মিলে গেলেই একের প্রাপ্য সবক অন্যকে শিখিয়ে দাও। ধরুন, বাংলাদেশে আমার ঠাকুরদার জমি কোনও মুসলমান কেড়ে নিয়েছিল ব’লে আমি এদেশে মুসলমানদের তিষ্ঠোতে দেব না। আবার আমার ঠাকুরদাদার বাবা ওদের মানুষ জ্ঞান করত না — সেই রাগে কোনও মুসলিম হিন্দু দেখলেই তার সর্বনাশের প্ল্যান ভাঁজবে। ব্যক্তির ইতিহাসের এক ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাই ঘৃণার প্রথম প্রেক্ষাপট। এইভাবে অনেক এককের অসম্পূর্ণ ইতিহাসসমীক্ষা জুড়তে জুড়তে দাঙ্গার মন তৈরি হয়।

কিন্তু যে ভালোবাসতে জানে সে ইতিহাস মনে রাখে না।
.
(পুরোনো পোস্ট)

জাতীয়সংগীত নিয়ে আলোচনা

53

জাতীয়সংগীত নিয়ে আলোচনা

আপনি কী?
আমি হিন্দু।
আপনি কী?
আমি মুসলমান।
আপনি কী?
আমি ক্রিশ্চিয়ান।

এইরকম চলছে….

অনেকে বলেন, প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল —
আপনার কী অসুখ?
আমি হিন্দু।
আপনার কী অসুখ?
আমি মুসলমান।
আপনার কী অসুখ?
আমি ক্রিশ্চিয়ান।

ইত্যাদি…

অবশ্য আধুনিক শিক্ষিত মানুষ এসব বস্তাপচা উত্তর দেয় না।
আপনি কী?
আমি গান্ধীবাদী।
আপনি কী?
আমি মার্ক্সবাদী।
আপনি কী?
আমি লাদেনপন্থী।

অনেকে তবুও বলেন, প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল —
আপনার কী অসুখ হয়েছে?
আমি গান্ধীবাদী
আপনার কী অসুখ হয়েছে?
আমি মার্ক্সবাদী
আপনার কী অসুখ হয়েছে?
আমি লাদেনপন্থী।

মার্ক্সবাদী হওয়ার অর্থ তুমি মার্ক্স হওয়ার রাস্তাটা বাইপাস করলে। খ্রিস্টান হয়েছ মানে আর যিশু হওয়ার ঝুঁকি নিতে হল না।

আস্থা (trust) আর বিশ্বাস (faith) শব্দদুটো খুব আলাদা। কোথাও আস্থা থাকুক অথবা অনাস্থা, ক্ষতি নেই; কিন্তু কখনও কোনও কিছুতে বিশ্বাস যেন না আসে, অবিশ্বাসও।

বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের বুদ্ধি, বোধ বা ইন্টুইশানের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু বিশ্বাস করতে পছন্দ করি, কারণ আরও অনেকে করছে। দলের সঙ্গেই যাওয়া ভালো; সেখানেই নিরাপত্তা, সম্মান, স্বীকৃতি। আর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বললে সবাই বিরোধী হয়ে যাবে — বন্ধু, প্রতিবেশী, বউ বা সোয়ামি, ছেলেমেয়ে পর্যন্ত।

আস্থা আমাদের মধ্যে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে। আর বিশ্বাস ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। সে বহিরাগত।

আরও একটা ব্যাপার এই যে, ফেইথ-এর প্রতিপক্ষ চাই। অন্যকে অবিশ্বাস করার ভেতর দিয়েই নিজের বিশ্বাসে জোর আনতে হবে। শুধু বন্ধু নিয়ে তো আসর জমে না, শত্রু না পেলে অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটাব কার মাঠে!

আমাদের কাজ হোক প্রশ্ন করা, তাতে যদি নিজের ও অন্যের মনে কনফিউশান তৈরি হয়, তবুও। মরার সময় ফাঁকা মাথা আর শূন্য হৃদয় নিয়ে যাওয়ার চেয়ে এ অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, মান্না দে-ই আমাদের জাতীয়সংগীত: সন্দেহে ভরা হোক তোমার দুচোখ।

(পুরোনো পোস্ট)

আমি আর প্লক্ষতরুণী (শেষ অংশ)

এগারো

পাড়ার ক্লাবের পুজো, মিষ্টি প্যান্ডেল
কাল ফুলটু মজা, আজ জাগছে ক্যান্ডেল
পুজো-খসা দুব্বো ওড়ে, বাতাসে করাত
দেবীর আহারপাত্রে শেষ-খণ্ড রাত

আবাসন-গেট খুলে সহসা কে নামে?
ঘুমের ভেতর, কোনও দণ্ডিত আরামে
বিদ্যুৎরেখার নাক, হাসলে টোল পাবে
তিন সহস্রাব্দ স্থির কোমল রেখাবে

শীতের বিচ্ছেদ-গন্ধ, পকেটে দু’হাত
ছেলেটি হাঁটছে, দেবীদৃষ্টি ফলো করে
অন্তর্বাস আড়ালের স্তনদুটি তার
নম্র ক’রে মুখ তুলল কবির ওপরে
ফিরে যাবে, তবু কেন হঠাৎ নেউটি
পেছনে তাকায়, বুকে শিহরণ ফোটে
কিচ্ছু নেই, প্যান্ডেলের দেবীপীঠ ফাঁকা
একটি মেয়ে হেঁটে আসছে সাদা হাউজকোটে

বারো
অনেক আনন্দশব্দ নিয়ে বাতাস নীল রঙ আপনাচ্ছে
তোমাকে খালি পায়ে দেখে আমিও স্লিপার খুললাম
খুব কাছে এসেছ ব’লে চোখে পড়ল তুমি ত্রিনেত্রী, মূর্তিকার শেষ তুলির টানে কপাল মুছে দেয়

কিশোরের মারদাঙ্গা থেকে যুবকের ভিখিরিপনা
এক একটা ময়দাভর্তি টিনের ড্রামে পড়ে গিয়ে, ভ্রূ পর্যন্ত সাদা, আমি যে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি
সে তোমার সঙ্গে চা-বাগানের রাস্তায় হাঁটব বলেই
যার ভেতরে চিতাবাঘিনী টুঁ শব্দে বাচ্চা দিচ্ছে

খুব কাছে এসেছ বলে ভুলে গেছি সব প্রার্থনা
শুকতারা, ভেগা নক্ষত্র… পরিচিত চ্যানেলগুলো জুম করছে
বরং প্রশ্নই রাখি —
কবিতা কি মিনিংয়ের সীমা পার হয়ে যাবে? তাহলে, আর্ট আর অ্যাট্রাকটিভনেস হাত ধরে থাকবে না কোনওদিন!

আকাশ প্রান্তঘুমে পাশ ফিরে শোয়ার শব্দ করল
তাছাড়া পিঁপড়ে, রঙপেনসিল, ওষুধের খালি টিউব — যাদের কখনও দুচোখের পাতা এক করতে নেই, সবার দিকে একবার নির্ভারযোগ্য চোখে তাকিয়ে তুমি বললে
“পাখি যখন পাখি, তার কাছে
প্যারাশুট লাগেজ মাত্র”।

ডান হাতে ঝিকমিক মুকুট, আস্তে ক’রে হাতে নিই বাঁ করতল
ওমনি মুখ নীচু, হাসিরক্তে শরীর ডুবে যাচ্ছে — “লেখা শেষ হোক। আমি ঘরে ফিরব না!”

তেরো
জরির মুকুট তার সঁপে দিয়ে গেল
আমার কাতর হাতে। এরপর জিনা
বদলে যাবে কতদূর, ভেবে ভয় করে!
পুজোমাঠে ফিরে যাচ্ছে উষ্ণীষহীনা…

কাব্যপাতা বন্ধ করি ভোরের হাওয়ায়;
বাক, দিদা, মৃতজন প্রণাম করতঃ।
আবার মিলিত হবো কোনও অকেশানে;
অন্তরীক্ষ, বাকি ফুল উজাড় করো তো!

.
[গ্রন্থ : ‘ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক’]

আমি আর প্লক্ষতরুণী

150405

এগারো

সমভঙ্গ তিনি, একটি শ্বেত পুণ্ডরীকের ওপর পঞ্চরথ ভদ্রপীঠে দাঁড়িয়ে আছেন
অয়ি বজ্রকুণ্ডলমণ্ডিতা, দৃষ্টি দক্ষিণ দিকে, জটামুকুটে আধাচাঁদও;
হাতে বসেছে ব্যাখ্যানমুদ্রা, পাশ ও অঙ্কুশ, চতুর্থ-য় অক্ষমালা নাচে
বাগীশ্বরী ভাঙতে ভাঙতে বাসুলী, এবার চণ্ডীদাস কাব্য ভ’রে কাঁদো

গুহার ভেতরে যাচ্ছি — স্বপ্ন, আত্মা, তুরীয়-র তিনখানি অপ্রকট বাক
যাজক গাইডবৃত্তি, গঙ্গাইকোণ্ডের কথা শুনতে রাজি একশো মৌচাক
অতিভুজ বৃদ্ধি হয়, নয়-দশ হাতে চিন্তা, ব্রহ্মকপাল
আহ, ইনিই নিষ্পন্না চণ্ডী, মহাদুর্গা, শ্রুতদেবী, সরস্বতীকাল…

সন্ধেয় হোটেলে ফিরে খেতে ইচ্ছে করছে না… টিভি দ্যাখা, একটি স্নান, ঘুম
রাত দুটোতে জাগ্রত, রাস্তা-আলো বিছানায়, গায়ে তাপ কুসুম-কুসুম।
টি-শার্ট গলিয়ে নামি, বেয়ারার স্বপ্নদেহ মেঝেয়, দরজা নেই এঁটে
শূন্য থেকে অটো এসে তুলে নিয়ে ছেড়ে দিল (ফের উধাও) মন্দিরের গেটে


তার সামনে উবু হয়ে মাটিতে বসেছি
পাথরে নখের দাগে কর্ণিকা আঁকলাম
চার বর্ণ কর্ণিকাতে, বাইরে গোলক
গোলক না বৃত্ত, তুমি বলো মনস্কাম।
আটখানা পদ্মপাতা, তাদের কেশর
দুটো ক’রে স্বর দিয়ে নির্মিত, আটটা —
বর্গ আট পদ্মপত্র ধারণ করেছে
বাইরে লিখি চতুর্দ্বার, চতুষ্কোণ কাটা।
“ওঁ মেধায়ৈ নমঃ” ক’য়ে মেধান্যাস করি
বাগীশ্বরী-যন্ত্রে হয় শঙ্খস্থাপন
আকাশে অমৃত, তাতে কামনা মিশুক
প্রলয়সমুদ্রে বীজ ফেলে যাচ্ছে মন

এই গর্ভঘরে রাত টেনশানে স্থির
অন্তরীক্ষ-ব্যালকনি ভেঙে পড়বে না তো!
বাক-এর তিনটে স্তর গুটিয়ে শুয়েছে
এবার তুরীয় — তুমি নিনাদ-সংযত।
“সামান্য আঙুল ঠোঁট ছুঁতে ইচ্ছে করে”
বলি আমি শ্বাস চেপে, মুখোমুখি দেহ,
এবং ইশারামাত্র ওষ্ঠ আধখোলা
মধ্যে শ্বেতপাপড়ি যেন হাসল — “ক্ষিদে হোক”।
ডান বুকে হাত রাখি — নম্র পাথর,
নীল শিরা তৈরি হয় জতু ব্রা-র নীচে;
চোখনৌকে ছইরূপ মণি জন্ম নিল
চুমুই পতিত চুম্বনের বিচোঁবিচে।
আমার ফুসফুস থেকে কন্ঠ আকাশ,
তারার নিষাদ-ব্যাধ বাজছে সেখানে।
সূক্ষ্ম নীল ধকধক জ্যোতিপ্রভা তার,
দৃশ্য ঘুরে চলে যায় আরেক সোপানে…

.
[গ্রন্থ : ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক]

আমি আর প্লক্ষতরুণী

(উন্মেষ কবিতা)
অন্তরীক্ষ দরদালান, ধুলোমেঝেয় বাচ্চা ছেলে হয়ে ছুটছে
নোনার শুকনো পাতা, লেজখসা টিকটিকি, ভাঙা চুড়ির রুবাই
ওদের এনো না। চাবি হাতে নেমে এসো মা, বাবা, দিদিমা, দু’ভাই

ব্যথা-শব্দে দরজা খোলে, দোতলার ঝুল বারান্দায়
চটের আসন পেতে বসো শান্ত ক’রে মৃতের হরমোন
আর ডাকছি দু’জনকে — পুষ্পল কুমার বসু, শৌণক বর্মন

আস্থা রেখেছিল যারা। নিরুদ্দেশ জ্যাঠা ঋষি অরবিন্দসম,
পদ্মপিসি — পুব-পাকিস্তান থেকে যেন মুকুর
বিনিময় করে পেল ঘর (গতকাল পর্যন্ত নিকোনো), পানিফলের পুকুর…

শোনো, আমি রাতে একতলার ছাদে এই বইটি হাতে
উঠব… টবে অনেক ঘৃতকুমারী, গোলাপবাগান, মাথার পেছনে —
যেখানে লাগলে মানুষ বাঁচে না — আধখোলা চাঁদ ঝুলে আছে, তাই জোছনের

চারদিকে কাশ্মিরী শালের ছই, আমরা যে উপনিবেশের
ছেলেমেয়ে! আর পাঠ করছি নিজের শোলোক
আত্মসুমুখে, ভাবতে পারিনি অন্তরীক্ষে এত লোক!

দিদা, তুমি ওভাবে রেলিংয়ে ঝুঁকো না, পড়ে যাবে
কী বলছ? শরীরে চারটে স্তন, পাশের সাদাছায়া মেয়েটা কে?
বলব লেখার শেষে গিয়ে, পরিশিষ্টে সে-ই থাকে

তাহলে আসন্ন শুরু, মাথার ওপর ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক

আমি আর প্লক্ষতরুণী

নয়
তিনের পিঠে তিনটে চাঁদ নেমে গেছে। আমাকে ছাড়ো, ব্রাহ্মণ।
সবক’টা আঁতুড়ঘরে উঁকি দেবো, সাহায্য করো ঋষি শৌণকের তিনজন দেবতা।
পাঁচ বছর আরও বিরহভোগ, তারপর ঘোর ইশারায় সায়নাচার্য এক অট্টালিকাধাম হন
ভেতরে তাকিয়ে আমার যোগশ্বাস কেন রুদ্ধ হয়ে আসে, ভেবো তা

সেই চোখে কোমল শিউলির ভার, বিদ্যুতের ছিলা এক নাসা।
নতুন শ্রেণীতে আজ হেডমিস সবাইকে রোল নাম্বার বলছেন
— তোর নাইনটি টু, বি সেকশান; তুই একশো তিন, সি।
— আমারটা কত, মিস? দাঁড়িয়ে জিগেস করল সবচেয়ে ছোট উচ্চাশা

“তোমার তো মোট্টে এক!” ঠোঁট টিপে মুখ ফেরানো হাসি।
বিষাদ নেমেছে দেহে — যে বৈশিষ্ট্যে পরমায়ু-খ্যাত হ’লে;
চোখের গবলেটও ভরা কানায় কানায়? ওলে বাবা লে!
এমন দৃশ্যে “হায় ম্যায় মর জাওয়াঁ” বলতে ভালোবাসি

ছুটে গিয়ে হাত ধরব? “কাছে থাকতে এসেছি, আর অন্য শর্ত নেই
মনে করো তোমার সে-লেখা ঋক: উত স্যানঃ সরস্বতী ঘোরা হিরণ্যবর্তনী…”
মুখ ঘোরালো এবার, স্কুলের হলঘরে গত বছরের প্রতিমা
চোখ ফিরে যাচ্ছে ব্ল্যাকবোর্ডে …ব্রহ্মা বলেছিলেন: শোন, না শুনলে ক্ষতি, মা

ও থাকবে অন্ধ প্রেমিক, তুই নিষ্ক্রিয় তারা
কোনওদিন দৃষ্টি পেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াস…

.
[গ্রন্থ : ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক (২০১৪)]

বাংলাভাষার জনয়িত্রী

এক
আমার শিক্ষক বাবা সংস্কৃত, বাংলা আর ইংরাজি তিনটে ভাষাতেই ছন্দোবদ্ধ কবিতা লিখতেন। ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি, কবিতার নামে আমার দুর্বল মকশোকাজ শুরু হল আর তক্ষুনি বাড়িতে বিদ্রূপ-নাম জুটে গেল — কপি। কে দিলেন? কে ডাকতেন সবচেয়ে বেশিবার সেই নামে? বাবা।

কবি একটা হাস্যকর, অপদার্থ উপাধি। বাংলায় সবচেয়ে বেশি কবি — তবু এবং সেই জন্যেই। কবিরা মোটামুটি দেখতে ভালো হয় না, অসুস্থ, অপরিচ্ছন্ন খুব খারাপ জামাকাপড়ের। তারপর একগাদা বাউন্ডুলে, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত, সবজান্তা, ইগোপ্রিয়, ভনিতাপূর্ণ বিনয়ী, বিশ্বাসের মর্যাদা না রাখা নেশাড়ু বুড়ো কিম্বা বুড়ি (কবি বনতে বনতে প্রায় সবারই যৌবন ঢলে যায়)। কিন্তু কবির সবচেয়ে বেশি যা নেই তা টাকাপয়সা। কবিরা মূলত ভালো চাকরি করে না (উল্টোটাও বলতে চেয়েছি), রোজগার করলেও বড়লোক হয় না, প্রেম পেলেও ধরে রাখতে পারে না অথবা আমার এই হেরে যাওয়াতেই আনন্দ।

নিজের সম্পর্কে কবির ধারণা ওপরে যা লেখা হল, তার চেয়েও বহু ভয়ানক খারাপ। সে লিখতে ব’সে ভাবে মেয়েটাকে পড়তে বসানো উচিত ছিল, বাবাকে ডাক্তারখানায়, অতি-আবশ্যক ছিল একটা ওয়াক-ইন ইন্টারভিউয়ে হাজিরা। অন্তত বর-বউ-প্রেমিকা-প্রেমিক-সন্তান-বন্ধু-আত্মীয়-পাড়ারচায়েরদোকানের পিঠে ঠেস দিয়ে ব’সে কিছুক্ষণ আজুড়ে গল্প আর হাসাহাসি। কিন্তু আদতে এসবের কিছুই করে না এবং আস্তে আস্তে সমাজ ও পরিবারের আলোবৃত্তের বাইরে বেরিয়ে যায়।

সিনেমার নায়ক মেয়েকে নায়িকা তৈরিতে প্রাণমন ঢেলে দিয়েছে, উকিল চায় ছেলে অ্যাডভোকেট, নেতার ফ্যামিলি জন্মেই হাফ-নেতা, গাইয়ে বুলি ফোটার আগে সন্তানকে রেওয়াজে বসিয়ে দিল… একমাত্র, একমাত্র কবি ঘুণাক্ষরেও চাইবে না আত্মজ ধারেকাছে যাক তার প্রবৃত্তির। কবির খুব মিল সমাজবিরোধীর সঙ্গে। খুনি তোলাবাজ মস্তানদেরও স্বপ্ন থাকে ছেলেমেয়ে মস্ত চাকরি পেয়ে সমাজে বাঁচবে মাথা উঁচিয়ে।

এই আত্মঅবমাননা কবির সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞান। আমার বাবা নিশ্চয়ই ভেবেছেন, কবিতা না লিখে টুইশানি করলে সংসারে দুটো বাড়তি পয়সা আসত। আমাকে বাঁদর ডাকার ভেতর দিয়ে নিজের প্রতি অমর্যাদাবোধকেই প্রতিষ্ঠা দিতেন তিনি।

দুই
গ্রামে ওরা রাত বারোটায় নিষ্মানুষ রেলস্টেশানের পাথুরে বেঞ্চিতে, বিকেল পাঁচটায় নদীর পাড়ের বালিমাটিতে চপ্পল পেতে ব’সে, সকাল সাড়ে ছ’টায় বন্ধুর বাড়ি উদয় হয়ে কবিতা পড়ে। আর শহরে ভাঙা ঝুরঝুরে চায়ের দোকানে জড়ো হয় সন্ধেয় অশথগাছের ডালে পাখির গুনগুনের মতো। আমি পাশ দিয়ে এক পলক তাকিয়ে যেতাম আর আশ্চর্য লাগত — মানুষ এমন দীনতার সাধনায় লেগে থাকতে পারে প্রজন্ম ধ’রে! কী তার ইন্ধন? কালোকুষ্টি চা আর তামাক-এ খিদেকে হারাতে না পারলে কাঁচা ত্যাকতেকে হাফপাঁউরুটি-টোস্ট। নিজেদের সব রঙ এরা ঢেলেছে ভাষার গায়ে; ভাষা — যা ছাড়া আমরা ভালোবাসতে পারব না, আঘাত করতে পারব না, দুটো খেতেপরতে পাবো না… ইঁটভাঁটার চিমনির মতো নিঃসঙ্গ। কবি পোষ্য হয়ে পাহারা দিচ্ছে আর গর্ভধারিণীর মতো জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। মুখের আর লেখার ভাষা ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে জায়গা বদলিয়ে আক্রমণে উঠছে সবরকম শয়তানির বিরুদ্ধে।

যে কবিকে পড়িনি কোনওদিন, নামও শুনিনি যার, সেও অসাড়ে আমাকে ভাষা যুগিয়ে যায়। এই সূত্র বাজার-অর্থনীতির চেয়ে অনেক জটিল ও নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য। শিল্প নিয়ে ব্যবসা অথবা কমার্শিয়াল সাহিত্য-পত্রিকার ধারণাকে সফল করা হল অন্ধ রাইফেল শ্যুটারের অলিম্পিকে সোনার মেডেল। কেননা, একজন কবি সব দিকেই গুলি চালিয়ে দিতে পারে। তার সাহিত্য-কার্তুজ কোচ, সহপ্রতিযোগী, বিচারক, ট্যুর্নামেন্ট কমিটির চেয়ারপার্সন, দর্শক…যে কোনও বুকে বিঁধে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

যে প্রাণী যত ভয়ংকর, তার সন্তানের বেঁচে থাকাও তত বিপদসংকুল। তাই এটা আশীর্বাদের মতো যে, কবির রিচ খুব কম (ফেসবুকে যতই বন্ধুসংখ্যা বাড়িয়ে যাও না কেন)। দ্বিতীয়ত, নিট মদে সোডা মেশানোর কাজে কবি আর মেজরিটি পাঠকের মাঝখানে সংস্কৃতি নামের একটি বাফার নিরত রয়েছে। মাংস রান্নার সময়ে পাঁঠার হাড়ের ভেতরের মজ্জা যেমন কিছু লঘু হয়ে ঝোলের মধ্যে মেশে, তেমনি সংস্কৃতিও কালে কালে কবিলেখকের সাহিত্যের সহজতর আর জনপ্রিয়তার কাছাকাছি থাকা অংশকে নিজের তরলতায় টেনে নেয়। লেখার সারভাগ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে আরও সময় লাগবে। হয়তো বা হবেই না। সাধারণ মানুষ সংস্কৃতির প্রভাব আর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে তার ভাষা নির্মাণ করে। সেই ভাষাকে আশ্রয় করে কবি। তাকে পালটায়। আবার ফেরত পাঠায় সংস্কৃতি মধ্যস্থের ভেতর দিয়ে।

কবি তার সারাটা জীবন বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে। ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে করজোড় তুলে আনেনি। সে সমাজকর্মী নয়, এবং কবিকে ‘সাহসী’ ব’লো না, ‘বেশিবেশি’ বলতে পার। ভালোবাসা, দুঃখ, সাহস, ভয়… সবই অধিক পরিমাণ। সবচেয়ে বড় তার উদাসীন। সে খ্যাতিকে মঞ্চকে সাফল্যকে অর্থকে করে উদাসীনতা, নিরাসক্তি করে। পয়সাচেতা সম্পাদক প্রকাশক এক-ধারসে ঠকিয়ে যাচ্ছে; আমি উদ্বৃত্ত মূল্যের আলোচনায় গেলাম না, প্রতিশ্রুত সংগ্রহমূল্য-ই ঝেড়ে দেওয়া হয়; কবির সাহায্য তবু পরোক্ষ এবং চিরপ্রসারমান। সাহিত্যই পুঁজি; সেই মূলধন বিস্মৃতির ফিক্সড ডিপোজিটে পড়ে থাকলেও প্রতি মাসে যে স্বয়ংক্রিয় সুদ পাঠায় আমাদের দিনাতিপাতের সেভিংস অ্যাকাউন্টে, তাই সংস্কৃতি। ৯৯ ভাগ মানুষের চেতনার খাদ্য সংস্কৃতি, সাহিত্য নয়। মাকে সে চেনেই না, জানে সন্তানকে। আবার বলি, ইহা আশীর্বাদ। কবিকে জনতা মাথায় তুলে নাচছে না বলেই তার পঞ্চাশ বছর আগে লেখা পংক্তিতে টোকা দিলে আজও রক্তচিহ্ন ফুটে ওঠে।

কবিকে দেখলে আমরা যেন বুঝি সে কাকপুচ্ছ ময়ূর, ভেড়ার ছাল প’রে থাকা মৃগরাজ। তার চেয়েও যেন বেশি করে জানতে পারি — যে কবিতালেখা মেয়ে ভুল সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আত্মহত্যা করল, যে অর্ধেক-পাকা-দাড়ি উনপাঁজুরে লোক নড়বড়ে অন্ধকার টেবিলে বসে নিজের লেখার প্রুফে ছুরি চালাচ্ছে — ওরা মা, বাংলাভাষার।

আমি আর প্লক্ষতরুণী

আট
দুজনের এইমাত্র মিল
নেক্সিটো, সুরোমন্টিল
লোনাজেপ, নাইট্রোসান টেন
ডোরবেল নিদ্রায় আছেন
ক্যুরিয়ারে পাঠ্যে দিছি বই
টেলিফোনে কথা শুনবোই
মুঠোর লবন ফেসবুক
নাম খ’সে খ’সে সাঁচিস্তূপ
যত মুখ দেখেছি সায়দ
সব্বাই প্রিঅকুপায়েড
দিন আর রাত বহুগামী
প্রশ্ন করো — ‘আধিপত্যকামী’
মিথ্যে কথা আঁকে অ্যাক্রিলিক
কারও প্রেম পুরোনো প্রেমিক
দিব্যি কেটে প্রতারণা কয়
পথনাটিকায় অভিনয়
পড়ো স্বার্থপর ঋকবেদ
সব্বাই প্রি-অকুপায়েড

একদিন অফিস-ফেরতা
নেমে গেছি ব্রিজের শাখায়
রিকশওলা যেটুকু টেনেছে
নীচে অন্ধ সিকিভিক্ষে চায়
এই সেই বারান্দা, গোঁসাই
এখানে জানলাঘেঁষা খাট
চারপ্রহর ধুনি জ্বলেছিল
আহুতি, আগুনশ্লোক পাঠ
দরজা খুলে মেয়েটি দাঁড়াল
“বাবু, তুই তেইশ বছর!
আজও ক্যাডবেরি নিয়ে আসি?
কোলে তুলে যথেষ্ট আদর?”

“আপনাকে চিনতে পারছি না”
“মীন… আমার মীনকেতন নাম।
ফোন করার ছোট অনুরোধে
একটা বই পাঠিয়েছিলাম।“

“মা তো কথা বলেছিল জানি
রিসিভারে কেঁদেছিল খুব!
চিরকাল হাই ইমোশান
আর বাংলা কবিতায় মুভড”

“হ্যাঁ, এক বৃদ্ধা ফোন করেন
আমি তো ভেবেছি তোর দিদা
বলেছিল শক্ত ইমেজারি
একটু লেখো না সিধা সিধা”
কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল
ঠোঁটে চেনা টান ছিল? ভাবি —
যে প্রবাদ উচ্চারণে কাঁদো
“কেন ছেড়ে চলে গেলে বাবি!”

.
[গ্রন্থ : ‘ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক’]

আমি আর প্লক্ষতরুণী

ছয়
দেখে মনে হবে রেস্তোরাঁ। আসলে বাইরের ঘর।
মুখোমুখি ব’সে প্রেমকাহিনি বাড়িয়ে নিচ্ছিলাম
একবারও দৃষ্টি সরাচ্ছে না উজ্জ্বল আনন্দিত
চোখ সে মেয়ের। অল্প নিউরটিক কি ঝিলাম?

তাকানোর মধ্যে একটা গোগ্রাস আছে। সে যেন
প্রেমের কাছে পিণ্ডদান চায়। আঙুলে আঙুলের
শেকড় জড়ানো, উঠতে গিয়ে মন অপরাধী।
‘চলে যাচ্ছ! ভেবেছিলাম আজ দুজনে ধরা দিই’।

সে ও তার ল্যাব্রাডর — দুজন বলতে। ঝিলামের
ধূসর দাদাও ভেতরের ঘরে থাকে, প্রতিবেশীসম।
একদিন চা খেয়েছি একসঙ্গে, সিপগুলো গুনে
…এগারোটা। এ-বাড়িও পৃথিবীর একাদশ কোণে।

আসতে আসতে একবার দুম ক’রে দাদাশূন্য ঘর
সিল্কের শাড়িটা ওর ত্বক থেকে পায়ের নুপূর…
মরু-পরিশ্রম শেষে বর্ষা নামে দ্বিগুণে চৌগুণে
ঝমঝম শব্দে ডুবছে চেন-বাঁধা খ্যাপা ল্যাব্রাডর

আমি সেই বৃষ্টিজল থেকে মুখ তুলে দেখি, ঠোঁটে
জোয়ারির হাসি, কপালে কুর্নিশে উঁচু ডান হাত!
কোথাও কামনা নেই, কামনার তৃপ্তি ছেঁড়া পাতা
সে আমাকে দিল তার ইয়ারকির মতো যৌনতা…

ছিটকিনি খুললেই কুকুর লাফিয়ে এসে ঢোকে
চন্দ্রদীঘল নারী, যেরকম স্কেচবুকে পাও
সামান্য আর্তির মতো ঘাসজমি শরীরে যেখানে
সন্তান-সজল চোখ, জিভ নেমে যায় বীতশোকে

বেরিয়ে এসেছি। সর্বস্ব হারিয়ে এই বেরিয়ে আসাকে
সি-অফ করে না কেউ। দুই বন্ধু অন্তরঙ্গে আছে
সে-কোনও সত্তায় ওরা সুগভীর, যেমন বোর্হেস
অন্ধ হয়ে যান, তবু হলুদ আলোটি পাশে থাকে

এই নীলোৎপল একা — না বুঝি, না বোঝাতে সক্ষম
নাল ছিঁড়ে গিয়ে শুধু ঘূর্ণিদশা, শুভদৃষ্টি কম

.
[ গ্রন্থ “ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক” (২০১৪)]

আমি আর প্লক্ষতরুণী

চার
প্লক্ষতরুর পাশে ঝরনা, পাহাড়শ্রেণি তরুণ শিবালিক
যাত্রাকুশল পাঠ করোনি; কালো বেড়াল দেখছি, এক শালিক!
তবুও স্রোত দু’ধারি অসি, নদীগতর কামিন মেয়েছেলে
কুরুপাঞ্চাল, দুর্গসমান এমন তাজা তীর্থ কোথায় পেলে?
জনক ব্রহ্ম আমার তটে যজ্ঞে বসেছিলেন পূর্ণকাম
ভরতবংশ গঠন হল — নাও পৃথিবী, তোমারই মোকাম।
রাজসন্তান শিখতে আসে গুরুর কাছে ব্রহ্মচারণ যোগ
শ্রুতিআগুন ঝলসে দেবে কিশোরকন্ঠ, ভয়ে বুজছি চোখ!
ওমনি শুনি সূর্যসমান অগ্নিভ তার সুরের সংঘারাম
নতুন যে এক দেবতাজন্ম, নতুন শ্লোকে তক্ষুনি বুঝলাম
যদি এখন ইঁট না পাতি, প্রেমচিঠিতে প্রোপোজ করি জোশ-এ
ছোঁ মারবেই প্রবল কোনও দেবী, তুমি দেখিয়ো ব’সে ব’সে

সকালবেলা আমার হিরো আমার জলে শুদ্ধ হতে এলে
তিনচোখো মাছ ঠুকরে দিলাম নরম কোনও কঠিনবজ্র পেলে!
শিউরে উঠে হাঁ-মুখ খোলে সবুজলতা দেহ-ব্যালকনির
তিনটে ঘন্টা কাটল সোনা নদীবিছানায়, দুধ-মধু-পনির
খেয়ে এবার পড়ায় ব’সো, সূক্তগুলো বাজাও তো একদিনে!
কিন্তু প্রবীণ অশথসম ঋষি, তাদের বুঝতে বাকি নেই।
ভারতীস্নান নিষেধ হল। বন্ধ হল শুক্লরক্তপাত?
তিন সহস্র বছর ধ’রে অশ্বী, অজা, উন্নতা, কুজাত…
আমার প্রপাত জেগে উঠলে তোমার শুধু সঙ্গম ধেয়ান
‘শাস্ত্রপাঠে অনধিকার, জঙ্গলে যা, সমিধ কেটে আন!’

জেন্দ আবেস্তা গুটিয়ে গেল, দরজা খোলে মিশর সভ্যতা
তুমি কিচ্ছু জানলে না গো, রাখলেও না কথার পিঠে কথা
কেন না পিঠ রক্তভাসি যিশুর মতো নিজের বওয়া ক্রুশে
রাতের বাসা খোলা আকাশ, তখন থেকেই অসুখ ফুসফুসের।
গা ঘেঁষে যায় বাঘের রোমশ, পেটের ওপর বিড়ে পাকান সাপ
সারারাত্রি শত্রু তাড়াই, কুণ্ডলিনী এবার জেগে যাক
মরণকুণ্ড জিকির দিল, তখন আমি আচমকা তন্দ্রায়
ঝুপুস শব্দে আমার পুরুষ, যা হবে হোক, আমার বুকে আয়
কিন্তু এ-যে মরা বাঁশির হাড় ক’খানা, আদুরে বর কই!

মর্ত্যে মানুষ, স্বর্গপতি — বিহানকালে সবার শাপ কুড়োই :
‘শুষ্ক হবি, লুপ্তধারা, দেবতা নোস, সামান্য কামিনী
মাথা ও পা স্রোতোসিদ্ধ, বাকি শরীর পাতালগামিনী’
মুণ্ড-চরণ প্রবাহ দেবে, বাকি শরীর পাতালগামিনী…

.
[ গ্রন্থ “ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক” (২০১৪)]

আমি আর প্লক্ষতরুণী

তিন
ন্যাশানাল লাইব্রেরি গিয়ে একটা বই পেয়েছি পাশের চেয়ারে
শান্তিপুরী প্রচ্ছদের, চার কালার, তাতে শ্যাম ও বাঁশির ভাগ বেশি
পুটে কার নাম লেখা? করপুটে ঢাকা দিল মুখ টিপে ছদ্মবেশী
ছ’ফর্মার ছিমছাম দিন, যেন সোমদত্তা মিস স্কুলের প্রেয়ারে

তাকে আমি ‘বরো’ করব কি, সেই তুলে নিয়ে গেছে ছাপাখানা লেন
“এই আমার কম্পোজিটার” — আঁচলে-চিবুক-মা থতমত নমস্কার দেন
“গ্যালি প্রুফ দেখেছিল, আমার তিনটে ভুল যার জন্যে, ওই যে সে”
চৌকো এক ছায়ামুখ সূক্ষ্ম কোণ করে দুলছে দেয়াল-বাতাসে

এবার অসংখ্য হাঁটি, যেন বইপাড়া দু’পায়ের অনর্গল লম্বা এপিসোড
দিদিমা বকুলগাছ পার্ক স্ট্রিটে, ঘাসে ঝরছে যুক্ত-অক্ষরের রোদ
চার দিনে জেনে গেছি ভাঙা প্রেম, অপযশ, ব্ল্যাকমেইলিংকাহিনি
আবার জাতীয় গ্রন্থাগারে ফিরে বই জমা, তবু কেউ বিদায় গাহিনি

ছায়াপ্রায় কেয়াঝোপ, পাশে সে বসেছে, শাড়িতে পায়ের পাতা ঢাকা
“এত কষ্ট পাচ্ছ, সোনা?”— বলতেই বৃষ্টিজল দু’গাল বেয়ে দে পাড়ি!
সে-অবাক প্রজাপতি হরিণী-স্টাইলে তাকিয়ে, মুখ সূর্যাস্তমাখা
কাঁপা মুঠো চেপে ধরল এই হাত —“আমিও খুব ভালোবাসতে পারি!”

.
[ গ্রন্থ “ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক” (২০১৪)]

‘আমি আর প্লক্ষতরুণী’ কবিতার একটু অংশ

এক
এক দাঁড়ে পাশাপাশি আমি-প্রাণপাখি
আমার উন্মাদ হতে অল্প কিছু বাকি
বাইরে বসন্তশিলা, সরানো যাবে না
আলো তার ধর্ষক, অত্যাচারী সেনা
ডায়েরি নেয় না তবু থানা, মনোবিদ
আমার উন্মাদদশা কত দূরে, নবী?

দেখি আজ রাতে তুমি কোন স্বপ্ন দাও
নিজে আসো, না ভাড়ার মেয়েকে পাঠাও
নৈবেদ্য, তাঁতের শাড়ি, কাঁসায় পালিশ
ঝুরো ফুল, জলশঙ্খ, যেন ঘিষ নদী
সাদা বাতাসা কই গেল, প্যাকেট খোলোনি?
সবুজ সুহৃদ বাড়ি, পুরোনো কলোনি
ধূপশান্ত ঘরে আজ গড়প্রণাম রাখি
চন্দন উন্মাদ হতে চন্দ লমহে বাকি

আমারই পূজন, আর আমি বধ্য বলি
হাড়িকাঠ জন্ম — যেই দুভাগ অঞ্জলি
এবার পাগল হলে কত কাজ আছে
আকাশ ঘুরিয়ে আনা বাড়ির কানাচে
নস্‌ কেটে বাঁচিয়ে দি’ মৃত্যুসারিগান
আমার বিভোর টানে দেবী চমকে যান

সমস্ত পড়ার ভালো উন্মাদ-পাশ
সূর্য সানস্ক্রিন মেখে ভোলে রাহুগ্রাস
তবুও বলো তো তুমি ঢালতে পারো কি
যে সুধা বসুধা, তার অণুকণাটি?
যে গোঁজ তোমার পিছে বিচুলিপ্রতিমা
আজও ঝরে পড়ছে তার গলনমহিমা
তীর্থঘরে দরজা দিই, পুজোপাঠ সারা
নিজেই নিজের আমি অনন্ত পাহারা
ডান হাতে ছুরি ফোঁসে, বাঁহাতে ঠেকাই
‘পথে আছি’, ‘পৌঁছে গেছি’ আজন্ম দু’ভাই

দুই
প্রাণ বড় উল্কাদলা, আকাশ চেতনা
চেতনা থাকলে মা বাচ্চাকে খেত না
বেঁচে থাকা প্রতিদিন মৃত্যু-অন্তাক্ষরী
ব্যাঙের গোঁফের নীচে ঘুমোচ্ছে ফড়িং

মনের গাছটা ঝরা, টাক পড়েছে মনে
ভূলোকের দুঃখনাশ করিব কেমনে?
ভূলোক চুলোয়, খুঁজছি এসকেপ রুট
পাগলামি-মৃত্যুস্বাদমাখা ডালমুট
হাতে নিই, মুখে পুরবো, তক্ষুনি মেগ্যালো-
ম্যানিয়াক প্রজাপতি ধাঁধাঁ শুনিয়ে গেল
“কোন দেবী এসেছিল নাস্তিকের ঘরে?’
ঘাসের ভেতর জুনিপোকা নড়েচড়ে
ধাঁধাঁর পেছনে হেঁটে আকাশে দাঁড়াই
সুখ নেই, নাহি কোনও শোকেরও বালাই
মাগো শোনো, দিদা শুনছো? তিত্‌লি শুন না!
ফেড আউট করে যাচ্ছে আমার উন্মাদ…

.
[‘আমি আর প্লক্ষতরুণী’ কবিতার একটু অংশ। গ্রন্থ ‘ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক’]