চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

(পুরনো গল্প) বোকা বোকা লম্বা

মা
শীতের সকাল। বারান্দায় গ্রিলের পাশে আমি চমৎকার রোদে ব’সে আছি। না না, রোদ্দুরটা সুন্দর বলিনি কিন্তু। চমৎকার আমার নাম, এ-গল্পও এক বেড়াল-ফ্যামিলির। আজ মানুষের রোববার, কিন্তু বেড়ালের ক্যালেন্ডারে লেখা, “দেরিতে ব্রেকফাস্ট”। মনুষ্যজাতির মধ্যে যারা অফিসবাবু, ছুটির দিনে আটটার আগে তো বিছানা ছাড়েন না। আর সেই জন্যেই এখনও পর্যন্ত বিবিলের দেখা নেই, পাড়া টহল দিতে বেরিয়েছে। বাচ্চা মানুষ, স্যরি বেড়াল, খিদেও বেশি। তবে শুধু বয়েসের দোষ দেব কেন, বিবিলের ফিগারটাও মাথায় রাখা দরকার। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কসরত করতে গেলেই তারা আমার কাছে এসে কমপ্লেন ঠোকে : ছেলেকে সামলাও। আমরা সব তিন কেজি বিভাগের কুস্তিগির, অথচ বিবিল সাড়ে পাঁচ কিলো চেহারা নিয়ে লড়তে আসছে। আমাদের ঘাড় মটকে যাবে না!

মনের এই হতাশায় বেচারা আরও বেশি মানুষ-ঘেঁষা হয়ে পড়েছে। আমাদের আস্তানা, মানে এই দত্তবাড়ি-র ছোট মেয়ে বুন্নির ল্যাপটপের দিকে সারাক্ষণ হাঁ ক’রে তাকিয়ে ব’সে থাকে। বুন্নি গেমস খেলতে খেলতে হয়তো জিগেস করল, “বল তো এবার কোন বাটনটা টিপতে হবে?” ওমনি সে অ্যাত্তোখানি পায়ের থাবায় ভুল বোতাম প্রেস ক’রে দেয়। বুন্নি হেসে ফেলে, “তুই একরকমই থেকে গেলি, বোকা বোকা লম্বা, সংক্ষেপে বি বি এল, মানে…উঁ উঁ…আমার বিবিলসোনা”।

……….গল্প থামিয়ে চমৎকার উলটো দিকে ঘুরে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের সামনে। আজ এত সকাল সকাল গ্যাস ওভেনে চায়ের জল চাপানোর শব্দ শোনা যায় কেন? পেছনে হেঁটে সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। এটা বুন্নির ঘর। মেয়েটাও নেই বিছানায়। হয়তো কাল রাতে দোতলার স্টাডি রুমে আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেয়াল-ঘড়িটা উল্টো দিকের দেয়ালে, দেখা যায় না। কিন্তু ঘন্টা পড়ছে। চমৎকার গুনতে লাগলঃ আউ, সাউ, চিন কিত, অন্তা, মিউ, পার…। হা ভগবান, সবে সাতটা বাজে! টোস্টের কয়েকটা পোড়া টুকরো, তিন-চারটে বিস্কুট, কিছুটা ছানা, ডিমের কুসুম একটুসফোঁটা — এইটুকুমাত্র সকালের খোরাকের জন্যে আরও দেড়টি ঘন্টা চুপ ক’রে ব’সে থাকা পোষায়, বলো তো!

ছেলে
আমার মা যেদিন মারা যায়, এপাড়ার সব মা-বেড়াল গোল হয়ে আমাকে ঘিরে ব’সে ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের মধ্যে চমৎকারের কাছে গিয়ে ওর কোলে মাথাটা গুঁজে দিই। সেদিন থেকে চমৎকারই আমার মা, আর এই গল্পটাও আমরা মা-ছেলেতে মিলেমিশে বলব। যাই হোক, পাড়া ঘুরে দত্তবাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে নিমগাছের ডাল থেকে একলাফে নেমেই থতমত খেয়ে দেখি, ঠিক সামনে গৌরীশংকর দত্ত। কিন্তু আজ তার আমাকে তাড়া দেওয়ার মেজাজ নেই, জলের পাম্পের পাশে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে কী একটা খুঁজতে ব্যস্ত। পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, চেঁচিয়ে বলছেন, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা”। না না, গৌরীকাকু বাংলাতেই বলেছেন কথাটা, কিন্তু আমরা বেড়ালরা তো আর বাংলা জানি না, বলি না, বা বুঝি না। অথচ আমরা বেড়ালরাই আবার পৃথিবীর সব ভাষাই জানি এবং বুঝি। আসলে বেড়ালের মস্তিষ্কের কোষে এমন এক অটোম্যাটিক অনুবাদ ব্যবস্থা রয়েছে যাতে যে কোনও ল্যাঙ্গুয়েজ বেড়ালের নিজস্ব ভাষা “মার্জারিক”-এ পালটে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেই তার মার্জারিক অনুবাদ মস্তিষ্ক থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে আমাদের কানে পৌঁছোবে। ঠিক যেন মেট্রো রেলে ঘোষণা হচ্ছে, “অগলা স্টেশন গিরিশ পার্ক”।

যাই হোক, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা” মানে হল, কাগজটা তো এখানেও নেই।রোববারের সাত-সকালে বাড়িসুদ্ধ লোক উঠে পড়ে কী খুঁজছে তাহলে? ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেব ভাবছি, আমার মা রান্নাঘরের জানলার নিচ থেকে ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল। এসেই যথারীতি বকুনি, “কোথায় চরতে গেছিলি, হতচ্ছাড়াটা? এখন বেলা দুটো পর্যন্ত খালি পেটে ঘুরে বেড়াও গে”। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “বুন্নি আর ওর বাবা কলকাতায় যাবে। মেয়েটার কী যেন পরীক্ষা আছে”।
—রবিবারে পরীক্ষা!
— তাই তো বলল, “ইগুতিনো আঙরাসু চিয়াং ডলুমি”। কিন্তু বুন্নি “আডমিটিকার” খুঁজে পাচ্ছে না ব’লে হুলুস্থুল। সে আবার কী জিনিস রে!
আমিও তো জানি না। মনে হচ্ছে, শব্দটা গ্রীক বা ইতালিয়। মুশকিল হল, আমাদের ব্রেইন এখনও ততো উন্নত হয়নি ব’লে কেউ দুটো ভাষা মিশিয়ে কথা বললে শুধু প্রধান ভাষাটার অনুবাদই কানে পৌঁছোয়।
………… কিছু ক্ষণ চুপচাপ দুই থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকল বিবিল। তারপর হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গ’লে উঠোনে লাফিয়ে পড়ে তীরবেগে ছুট। “আবার কোথায় আড্ডা মারতে চললি?” ব’লে তার পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ল চমৎকারও।

মা
সরকারবাড়ির পুকুরে অর্ধেক জল, বাকি অর্ধেক ঢেকে গেছে কলমি-বেতো শাকে। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে লম্বা ঘাসভরা জমি, মুখ না তুলে হাঁটো যদি, নাকে সুড়সুড়ি খেয়ে হাঁচি আসতে বাধ্য। তারপর বাতাবিলেবু গাছ একটা, যেখানে সোমঋতাদের দুধেল গরু আব্বুলিশ বাঁধা থাকে। জগন্নাথ সরকার বারাসাতে বাড়ি ক’রে ফ্যামিলি সমেত উঠে যাওয়ার পর এই সবুজ মাঠের টুকরোটা পাড়ার বেড়ালদের আড্ডা বা সেমিনারের জায়গা। বিবিল সেখানে দাঁড়িয়ে বারবার তাকাচ্ছিল কীর্তনবাড়ির দিকে। মিনিট খানিক পরেই, ঠিক যা ভেবেছি, সে-বাড়ির গেট পেরিয়ে দিশা মেয়েটা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে সুড়ুত করে কাঠটগর গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। দিশার পুরো নাম অনেকগুলো সিংঘে, নায়েকে, আর্থার, পেরেরা দিয়ে বানানো, তিংসা বগির ট্রেনের মতো (তিংসা মানে বারো)। ও আসলে শ্রীলংকার খ্রিস্টান বেড়াল, কলোম্বোর বিখ্যাত উকিল মেন্ডিস পেরেরার কাছে মানুষ হয়েছে। ওই বাড়িতেই দুবছর ভাড়া ছিলেন কীর্তনবাড়ির ডক্টর রামবিলাস কীর্তনিয়া। দেশে ফেরার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।

কাঠটগর-বন পেরিয়ে জামরুল গাছের আড়াল দিয়ে দিশা খুব জোরে ছুটে এল মাঠটুকু। তারপর বিবিলের নজরে আসার ঠিক আগে থেমে গিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগল। মুখের আহ্লাদি ভাব লুকিয়ে চোখদুটো উদাসীন-মতো করে বলল, আবার কী হ’ল? ডাকছিলিস কেন!
—এই, “আডমিটিকার” মানে কী রে?
মেয়েটা তো হেসেই বাঁচে না। “ধুস, ওটা হবে অ্যাডমিট কার্ড, ওতে রোল নম্বর, ছবি, সব দেওয়া থাকে। না নিয়ে গেলে পরীক্ষার হলে ঢুকতেই দেবে না। আমাদের বাড়ির বন্দনাদিও ন’টা বেয়াল্লিশের ট্রেনে যাচ্ছে, বিধাননগর কলেজে সিট পড়েছে তো! আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদের হেলানো রশ্মি দেখতে পেলাম। মনে মনে অল্প একটু পরিমিতি ক’ষে নিয়ে বললাম, আর ঠিক আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এখন আমাদের আর কী-ই বা করার আছে!
— আছে অনেক কিছু। বুন্নিদির অ্যাডমিট কার্ড আমি গতকালই দেখেছি ওর হাতে। নিশ্চয়ই ওই ঘরের মধ্যে কোথাও….। এই ব’লে বিবিল যেন কুকুরের তাড়া খেয়েছে, শরীরটা এমন ছোট্ট করে ছুট দিল দত্তবাড়ির দিকে। দিশা চেঁচিয়ে উঠল, “ঝামেলা মিটল কিনা বিকেলবেলা এসে জানিয়ে যাস”। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে হাসল ক্যাবলার মতো, “আপনিও আসবেন, কাকিমা”।
কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই এখন। প্রাণপণ দৌড়ে বড়রাস্তা লাগোয়া কচুবাগানের কাছে ধরে ফেললাম বিবিলকে। তোর কি মাথা খারাপ হল যে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটছিস! ওরা এক্ষুনি বুঝতে পেরে যাবে আমরা বাংলা ভাষা জানি। তারপর বাকি জীবন কুকুর হয়ে কাটাতে পারবি তো?
— একটা অ্যাডমিট কার্ড খুঁজে দিলাম, আর এতকিছু ঘটে গেল!
— শোনো, তোমারই মতো বোকা একটি সারমেয় মানুষের কথা শুনে একবার শুধু আহ্লাদে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। বাকিটা ইতিহাস। এখন কুকুরদের সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিয়ে আবার ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির বুড়োবুড়িকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে ছুটতে হয়। তারপর সকালের খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে আসা থেকে বাজারের ব্যাগ বওয়া, দুপুরে বৌদি ঘুমোলে বাচ্চার নজরদারি, দুবেলা বাড়ির ছোটদের সঙ্গে ফুটবল প্র্যাক্টিস —এসব তো আছেই। রেডিও-টিভিতে, সিনেমায়, এমনকি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত খাটছে কুকুর, অথচ কোনও কুকুরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিস্টিতে একটা নোকিয়া বা স্যামসাং বা এলজি-র চোদ্দশো টাকার সেট-ও খুঁজে পাওয়া যাবে? আর, সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানিস? পুলিশ-মিলিটারিতেও কুকুর গিজগিজ করছে। মানুষ নিজের কাজ করাচ্ছে কুকুরকে দিয়ে!
আবেগে চোখে জল এসে গেছিল। বিবিল পেছনের দরজা দিয়ে দত্তদের ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলল, কেন, ওরা মোটা মাইনেও তো পায়? তাছাড়া কুকুর কতো বিশ্বাসী প্রাণী সেটা বল? পেট ভরা থাকলেও রান্নাঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দেবার কু-স্বভাবটা নেই।
শুনে মেজাজ এত গরম হয়ে গেল, বাঁ হাত তুলে ওর মাথায় এক থাবা বসালাম, “জিভ খসে পড়বে নিজের জাতের বদনাম করিস তো! আমাদের দেবতা বেড়াদাস বলেছেন, চুরিই হচ্ছে খাঁটি বেড়ালধর্ম। বুঝলি ইঁদুরটা?
— আমার অতশত বুঝে-সুঝে কাজ-টাজ নেই। বুন্নিদি আমাকে ভালোবাসে। দিদি পরীক্ষা দিতে না পারলে খুব কষ্ট হবে, ব্যাস।
দেখলাম, বিবিল দত্তভিলার পেছন দিকটায় চলে গেল। তার মানে পেঁপে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে স্টোররুমের ফোঁকর গলে দোতলায় ঢুকে তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। যে মানুষ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়, উনি চললেন তাদের উদ্ধার করতে। হুঁহ্‌!

ছেলে
শুনেছি, এর আগে তিন দফায় আমার মোট পাঁচটা দাদা-দিদি হয়েছিল। মা তখন যে বাড়িতে, সেই হালদারবাবুরা আড়াল দিলে ওরা হয়তো শেয়ালের পেটে যেত না। তারপর থেকেই মা একটু মানুষ-বিরক্ত। যাহোক, অনেকদিন পরে স্টোররুমে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এই ঘরই আমার জন্মস্থান কিনা! ওই তো সেই প্লাইউডের বাক্স যার মধ্যে খেলা করে আমার “বৈশব” (বেড়ালের শৈশব আর কি) কেটেছে। কিন্তু পুরনো খবরের কাগজ লাট করে রাখার জায়গাটা যেন কোথায়?

বুন্নিদির খাটের ওপর বইপত্র আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসার অভ্যেস। অ্যাডমিট কার্ড বইয়ের সঙ্গে উঠে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে শেলফ ঘেঁটে খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু রাঁধুনি নিরুমাসি বা অন্য কেউ যদি পেপারের সঙ্গে তুলে ফেলে? কাগজের স্তূপ থেকে এক একটা করে কামড়ে নামিয়ে ফের মুখে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। নাহ, কিচ্ছু নেই, শুধু ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল। হঠাৎ মনে হল, নতুন কাগজের ডাঁই হলে তো এত ধুলো জমার কথা নয়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি, বুন্নিদির গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ! ইস, মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে যে, সেই দিদিটার জন্যে কিছুই করতে পারব না! ঠিক এমন সময় সিঁড়ির ঠিক নিচে গৌরীকাকুর সাইকেল আর গ্যাস সিলিন্ডারের মাঝখানটায় চোখে পড়ল, আরও কিছু খবরের কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আর তার প্রথমটা ধরে টান দিতেই নিচে থেকে বুন্নিদির ছবি বেরিয়ে এসেছে। অ্যাডমিট কার্ড মুখে করে ছুটতে যাচ্ছিলাম ও-ঘরে, মনে পড়ল মা-র সাবধান-বাণী! আমাদের ধর্মগ্রন্থ (পড়ব পড়ব করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি) “বেড়াভাগবতে” নাকি লিখেছে, বেড়ালের বুদ্ধির কথা জানতে পারলে মানুষ তাদের রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানে তাদের গায়ের লোম ঝরে গিয়ে চেহারাটা ঝাঁটার শলার মতো হয়ে উঠলে নিজেরাই নিজেদের তেলাপিয়া মাছের কাঁটা ভেবে খেয়ে ফেলবে তারা। আমি অ্যাডমিট কার্ডের ওপরে বসে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলাম।

গৌরীকাকু এসে “সোবাতাং জিয়াও মুনি” (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠের ওপর একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, “বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।“ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)। এই রে, পরীক্ষার প্রবেশপত্রও যে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে! তরুকাকি এলে তেড়ে যাব কিনা ভাবছি, বুন্নিদি এতক্ষণে সিঁড়ির ঘরে ঢুকল : “সব সময় একটা অবলা জীবের পেছনে লেগে আছো কেন! সকালে খেতে পায়নি বলে চিৎকার করছে সেটাও বুঝলে না?“

ইচিদং ত্রামে সোহা” (তোর জন্যেই এটা মাথায় উঠেছে) বলতে বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলে আমি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যাডমিট কার্ডটার চারপাশে পাক খেতে লাগলাম। বুন্নিদি তক্ষুনি লাফিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একদম অবাক হয়ে গেছে। “কোথায় পেলি এটা? এত বুদ্ধি তোর! এবার তো সিসিল বলে ডাকতে হবে ওস্তাদকে, মানে চালাক-চালাক-লম্বা! আমার কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহ হত বাংলা ভাষাটা তুই কব্জা করে ফেলেছিস…হ্যাঁ রে, হাঁ করে দেখছিস কী?

আমার মাথার অনুবাদ-যন্ত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বুন্নিদির কথা শোনামাত্র বুঝে ফেলছি আমি। তার মানে মানুষই হোক, বা পশু-পাখি বা গাছপালা, ভালোবাসার ভাষা সবার বেলাতেই এক। একজনের মুখ ফুটলেই আরেকজন টের পেয়ে যাবে। এমনকি উচ্চারণ করারও দরকার নেই। যেমন বুন্নিদি এখন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে মনে মনে বলছে, কিন্তু তুই ইংরিজি কী করে শিখলি, বিবিল? নিশ্চয়ই তোর সেই শ্রীলংকান বান্ধবীর কাছে!

সে কাহার জন্য

আমার ঠাকুরদার পরিবার ছিল, খুলনার ভাষায়, ধানী-পানি গিরোস্তো। দক্ষিণ-এ মানে সুন্দরবন এলাকায় তাদের আবাদ বেশ কিছু-ঘর প্রজা সমেত। এ-হেন ফ্যামিলিতে মেধাবী, সুপুরুষ কিন্তু বিবাগী প্রকৃতির ছোট ছেলেটিকে নিয়ে ছিল অগাধ দুশ্চিন্তা। বছর তেরো বয়েসে একবার বাড়ি পালিয়ে ঢাকায় হাজির হয়েছে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্নিসি হবে বলে। মাস কয়েক আগে তো কলকাতা পর্যন্ত ছুটেছিল রামকৃষ্ণ মিশনের মঠে গিয়ে থাকার ইচ্ছেয়। কাজেই অল্প বয়েসে সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ উপাধি পেয়ে দৌলতপুর স্কুলে মাস্টারি জুটে যেতেই বাড়ির লোকজন বাবাকে সংসারী করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঘটক খবর নিয়ে আসে — পালটি ঘর, সম্পন্ন পরিবার, সুন্দরী পাত্রী; কিন্তু বাবার সেই এক কথা, সংসার করার জন্যে তার জন্ম হয়নি!

এর মধ্যে এক বর্ষাভোরে সেনহাটির লাগোয়া গ্রাম মহেশ্বরবাসা থেকে বিধবা মহিলাটি এসে খুব করে ধরে বসলেন আমার ঠাকুরদাকে। তার দুই মেয়ের বড়কে যদি একটিবার দেখে আসা হয়। মেয়ের বাবা যাত্রাদলে বাঁশি বাজাত, হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে মারা গেছে গতবছর। তারা নিতান্ত গরীব, দেওয়া-থোয়ার সামর্থ্য নেই, মেয়ে যে রূপবতী এমন দাবীও করছেন না (পরে নাতিকে দেখলে মালুম হবে), কিন্তু তবু…।

টালির চাল ফুটো হয়ে বিছানা ভেসে যাচ্ছে, এদিকে ঘরে ডুগি-তবলা, হারমোনিয়াম, ফ্লুটবাঁশি… এক কোণে ছেঁড়া চাদরে জড়ানো একটা এস্রাজও। গান জানো, মা?
শ্যামরঙা রোগাসোগা মেয়েটা গাইবে, “দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল…”। শেষ হতে সে মুখ-নিচু ব’সে, আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে আমার বাবা, ঠাকুরদা, দুই পিসি…গোটা শ্বশুরবাড়ি টিম।

এরপর থেকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা সেনহাটির সেই ভদ্রাসনে হাঁক পড়ত, কি ছোটবৌমা, আজ আর রবি ঘটকের গান শুনতি পাবো না বুঝি!

একা রবীন্দ্রনাথ কেন হতে যাবেন, চৈত্র মাসে জামরুলপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোকিল, সুচিত্রা সেনের একটি অপাঙ্গ, ফিদা হুসেনের ক্যানভাস উপচে পড়া স্টাডি, কিটসের চার লাইন, শ্রাবণের বিস্ফোরণে নিহত কামিনীফুলের টুকরো হওয়া কিন্তু অটুট গন্ধের শবদেহ — এরা সবাই ঘটকালি করে যাচ্ছে সেই কবে থেকে, নারীপুরুষের শাঁসের ভেতর…।

টু জিরো টু ওয়ান

407pki

‘নতুন’ বসে আছে শীতের ভাঙা রোদে
সাজলো ‘গতকাল’ রঙ-ওঠা গরদে
‘পুরোনো’ আমাদের কষ্টে রেখেছিল
দু’সুর, দুটো ঠাট, বলিনি আন মিলো
ফুরিয়ে যাওয়া দিন উড়িয়ে দেবে ক্ষতি
আশার পায়ে নমো, অসাড় পায়ে গতি…

বন্ধুমিলন সংঘ

দশমীর নাচ থেকে পুজো শুরু হোক, ভবতোষ।
যখন ঢাকের পালক উড়ে উড়ে বাতাসে
মুরগির দোকান, বক্স ফেটে সাউন্ডের সাদা
ছোট নেকড়েরা আমাদের রান্নাঘরের
সামনে ব’সে আছে — বুকের ডালা-খোলা
পাঞ্জাবি লরি থেকে আবার পুজো শুরু করে দাও
তখন তো পুরোহিত রুটি-মাংস মেরে
বউয়ের সঙ্গে শুতে চলে যায়; ফেটে যাওয়া
বেলুনে বাচ্চাকে সাজানো কি সোজা কথা!
আর যে দুটো পাগল দেবীপক্ষে পড়ে থাকল বাজারে — মানুষচরে উলটে যাওয়া ডিঙি —
পথে যেতে এখনও তারে-সুতোয় তাদের মন্ত্রপাতের শব্দ। কারেন্ট ফেল ক’রে
গুটগুটিয়ে নতুন জুতো পায়ে হাঁটছে
জেনারেটার; বেদনাচক্রে থাবা বসাচ্ছে সিংহ; সব্বাই চেয়ার ধন্য ক’রে ব’সে, অথবা
চেয়ারগুলো এক একটি কাঠের কানাই
ইঁদুর দুহাত তুলে বলছে এক্কি করলেন,
আমার গলাতেও গাঁদাফুল! প্যান্ডেলে যাওয়ার রাস্তায় আবার ফিতে-ক্যাপের অর্ধেকটা হারাল, ডাবের মুন্ডু ভেঙে পড়ল সিঁদুরে
দেখো, এবার বৃষ্টি হ’লে ময়ূর কেমন মণ্ডপ ছেড়ে
একা ক্লাবঘরে উঠে আসে; চারদিন মাইক শুনে পাখিদের ডাকই পালটে যায়
ভব, দশমীর পরে এই হচ্ছে আদিগন্ত পুজো
পুজো হ’ল একমাত্র বন্ধুমিলন সংঘের।

অগ্নিসহকারী

একটা বরফীকৃত ঘর, আলো-পেছল। দেয়াল কত পুরু হবে, পঞ্চাশ ইঞ্চি? এই পুরুকে সে হারাতে পারবে আলেকজান্ডার? তখন মাইকে দৈববাণী —মহান ভয়যোগ্য ঘরে স্বাগত। পৃথিবীতে ফিরে আসতে আপনার যে ঐকান্তিক চেষ্টা, তার পেছনে আমাদের অনবরত শুভকামনা রইল।

মাথা খুলে নামিয়ে রাখার জন্যে একটা টেবিল। তিনটে হ্যাঙার থেকে দুটো আলখাল্লা ঝুলছে। দেয়াল ভ’রে ফোন নাম্বারের শুঁয়োপোকা : আমার কিছু হয়ে গেলে মনীষাকে… অরিজিৎকে… ছোটভাইকে… প্লিজ জানিয়ো তোমরা। চেয়ারে বসলাম — লিওনার্দো। ওমনি চেয়ারের ঠান্ডা শূন্যতায় এসে বসল সুবিনয়। আমার বাবা এক সময় পাগল হয়ে গেছিল, শিউলিফুলের মতো পাগল। ঘুম থেকে উঠেই বলত : এক দুই তিন, সুন্দর দিন। আমার নাম শুভময়।
শুভময়ের ছেলে সুবিনয় হওয়া খুবই সম্ভব।

তোমাকে একটা নাম দিতে চাই, নেবে তো — জিগ্যেস করেছিল এক মেয়েও। যখন ডাক শুনতে চেয়েছি, নামে আপত্তি কেন থাকবে? বুবু, সে বলল। হাসপাতালের কাউন্টারে প্রোজ্জ্বল কালো জিগ্যেস করা মাত্র আমি তক্ষুনি প্রোজ্জ্বল কালোকে চেঁচিয়ে : লিওনার্দো সুবিনয় বুবু। নিজের পুরো নাম আবিষ্কারের জন্যে আমার দরকার হল মাথার টিউমারটা খাটানোর, মানচিত্রের বাইরে থেকে উড়ে এসে হাসপাতালের শীতল নিস্তরঙ্গ দয়া দরকার হল, হায় দইয়া…!

পেরোতে লেগেছি ঘরের পর ঘর, স্তব্ধতার পর শূন্যতা, সাদা মেঝের ফতুর-এ ন্যাপথলিনের ছাদ। দাঁড়িয়েছি মাঠঘরের চৌকো পৃথিবীতে; প্রতিদ্বন্দ্বী এক হলুদ বাইসন, হাঁমুখের ঘন আঠালো রশ্মি থেকে তার অস্থিজিভ বেরিয়ে আসছে। হাড়ের ওপর উঠে শুয়ে পড়ে আমার পেনসিলস্কেচ, বাইসন ব্যাঙ-জিভে তাকে মুখজঠরে টেনে নেয়। চোখের মণি পুড়ে যাচ্ছে এত আলোআগুন, নার্সের জীবাণুমুক্ত গলা শুনতে পাই, “চেষ্টা করুন ঘুমিয়ে পড়তে”। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কনডেমড সেলে এক মরহুম নিদ্রা চাইছে, সেতারে দক্ষিণী রাগ…

তোকে ঘুম পাড়ানোর সময়েও হংসধ্বনি চালিয়ে দিতাম। একদিন না বাজলে মাঝঘুমে কেঁদে উঠে বসতিস, মনে আছে? আজ সে আমাকেই সুপ্তি দেওয়ার অজুহাত, শুধু একটু পরপর অজুহাতে পক্ষাঘাত লেগে এসএলআর থেকে নাগাড়ে গুলিধারা। ভেড়ির শিয়রবর্তী চাঁদের উদ্গম হলে সারস যেভাবে মাটি থেকে ডানা তোলে — করোটি সূক্ষ্মভাবে উড়ে গেছে। পাখির স্তনের চেয়ে লাজুক ঘিলু নগ্ন দাঁড়িয়ে, লাল পুরুষাঙ্গআলো তার কমলালেবু-কোষ একটু ক’রে মুখে পুরছে। আর বিশ্রামে যাচ্ছে যখন শুক্রপাতক্লান্ত কিরণ, ওই হংসধ্বনি। পরপর গানে ও ধর্ষণে এভাবে কার্তুজের অপব্যয় … একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা আমি একাই নষ্ট ক’রে গেলাম!

কেঁচোমুখ দিয়ে মল উগরে দেবে বাইসন। রোগি শায়িত; অজ্ঞান কি? না। বন্দী কি? হ্যাঁ। বন্দিত্বের মধ্যেও আপাত-মুক্ত? হ্যাঁ। দরজাপ্রতিম কোনও অস্পষ্টতায় হাত ছোঁয়ালাম। ঘরের কুহেলি থেকে বাইরের কুয়াশায়, ঘরের বরফ থেকে বাইরের নভেম্বরে আবার অন্তহীন সাদা পথ আর মাথার যৌনাঙ্গ থেকে অদ্ভুত রক্ত চুঁইয়ে পড়া। খুলির অন্তর্বাস ফেলে আসছি না তো ভেবে পেছনে তাকাই, এমআরআই ফুটে থাকতে দেখি দরজায়; সে মৃ হলে ত্যু তাহলে পাশের হলুদ ঘরে ফালি করে কাটা ফুলকির স্তূপ — আমার শেষ যজ্ঞে অগ্নিসহকারী…

মাছ-ভাত

এক
যা ভাত রেঁধেছি, বাকি জীবন এতেই হয়ে যাবে
প্রেশারে রাঁধতে পারি না, তার চেয়ে
শান্ত গোল-গলা হাঁড়িতে চাল নেওয়া ভাল
এরকম কত মেয়ে উদ্বেগঅসুখে ভোগে
রান্নাঘরে বঁটি সোজা রেখে সেই পথে
ছুটে গিয়ে গ্যাস নিভিয়ে দেয়
দুধের বদলে তার উথলে ওঠে পা
সাঁড়াশি হারিয়ে ফেলে আঁচলে নামাতে যায়
ভোরের মোরগ, আর পোড়ে বিয়ের আংটি আশিভাগই। কিন্তু এত কেরিপোকা অনাহার থেকে সার দিয়ে হেঁটে এসে বাঁশকাঠি ফসলে ঢুকে গেছে, আমি বড় ব’কনো থালায় চাল ঢেলে সাবধানে সংশোধন করতে বসি। ওমা, মেরে ফেলা কীট ফের দু’পা বেয়ে উঠে আসছে যে!

দুই
যে ধান ফলায় সে বিস্তীর্ণ নায়ক, যে ভাত রাঁধে
সে অন্তরাল নায়িকা। বাকি ব্যবসায়ি, বিজ্ঞানী, কবি পেছনে না নাচলেও সিনেমা বন্ধ হবে না।
যখন কাঁচা তেলে কাঁচা ফোড়ন প’ড়ে নাগাসাকি,
রান্নাঘরের মাথায় প্রপেলার চালিয়ে দিলে
বাড়ি আস্তে ক’রে নেমে যাচ্ছে সমুদ্রে…
সেখানে কড়াইনৌকোয় পরাশরমাছ মিলিত হবেন জেলেনিমাছের সঙ্গে। আমি তাতে আকাশঢাকনা বসিয়ে স’রে আসি; পাঁচ মিনিট পর গরগর শব্দ পেয়ে দেখা যায় গোটা একটা দ্বৈপায়ন প্রসব হয়েছে নুনে নুন, হলুদে হলুদ…
যদি এই দ্বীপবিশ্ব ভেঙে ভেঙে
রাহুগরাস-কেতুগরাসে মেখে ছুঁড়ে দিই, বেড়ালেরা সহাস্যে খাবে তো?

বিসর্জিত প্রতিমা পেয়েছি

শোকযোগ্য এই সকাল যেন সবার
অফিসে যাওয়ার ব্যাগে মৃতদেহ
যে আনন্দ ক্যালেন্ডারগলি ধরে এসেছিল, গায়ে
গ্রহণের ছায়া ফেলে সরে গেছে।
কালীপুজোয় আমরা কেন ফ্যামিলি নিয়ে
বেরোনো বন্ধ করলাম, আজ আর মনে পড়ে না
আমারও চাকরি ছিল স্বপ্নভাঙা কারখানায়
হাতুড়ি চালানো। উদ্বাস্তু হয়েছি তবু শরণার্থী নই।
দম চুরি করিনি চু-কিতকিতে, দু’ঘর বাড়িয়ে
গুনিনি এক ছক্কা পাঁচ, আমি সফল আমার পরাজয়ে। সত্যের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করেছি স্ত্রীসত্য না পুরুষসত্য। উট উড়ে যায় আকাশে, মাথার ঢাকনাখোলা পাখি…আমিও কলেজের রাস্তায় মেয়ে দেখতে গিয়ে খেলাম বাসের ধাক্কা, ধড় থেকে খসে যাওয়া মুন্ডু আর ফেরত পাইনি
সেই থেকে বাকিতে কেটে যাচ্ছে জীবন…কখনও
বুদ্ধঘুম বাকি পড়ে তো কখনও রক্তবিশ্বাস
পুরনো সাইকেলে চেপে যদি পৌঁছোতে পারতাম
ভেঙে যাওয়া তুলসীমঞ্চে! সন্ধেবেলা
আমাদের চাঁপাতলায় প্রেম দাঁড়াত, আনন্দের একটা শাখা চলে যেত যোশিমঠ হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ…
শোকযোগ্য এই সকাল যেন সবার ব্যাগে
অফিসে যাওয়ার মৃতদেহ
জীবনের একটা ভুলকে একান্ন পাতায়
পেজমার্ক ক’রে ঘুমিয়ে পড়েছে গল্পরেখা
আলো নিভে গেলে কাজের মাসির মতো
বৃষ্টি নামে, ঝাঁট দিয়ে সাফা করে আমাদের
বিকলাঙ্গ জ্ঞান। তখনও ছোট ছোট সাপ
গা থেকে ছাড়িয়ে বালিশের নীচে রেখে
মানুষ সঙ্গমে যাচ্ছে
তুমিও তো হাতের অমৃতপাক বালাদুটো
খুলে রাখতে, বলো?

সন্তানপ্রণাম

এগারো

লক্ষ্মীর পাঁচালির বাবু-আসন থেকে আমি উঠে এসেছি ব্রহ্মসূত্রের পাঁচশো টাকার নোটে। ক্লাস টেনের মনোজগতে ফুটে গেছিল কাফকার বিষ,
তবু কে কাকে গ্রেট ডিবেট ক’রে দিল, কে কাকে ট্রাফালগার স্কোয়্যার — দেখতে দেখতে মনে হয় বাবাটা চলে গিয়ে কী ভুলই করেছে!
জানতেও পেল না বাদামফুরোনো বিটনুন থেকে আমার স্ফটিকের গণেশে বাসাবদল
তাকে প্রণাম তো করেছি বহুবার, এক প্যাকেট
কর্তব্যপ্রণাম; অথচ লুকিয়ে-পড়ার আগে না পেলাম ফোনে দীর্ঘাঙ্গ হাসি, না স্পিড পোস্টে তালশাঁস চোখদুটো। আমি তখন ভেবে যাচ্ছি চেনার গাছের লম্বাঈ আনব কবিতার লাইনে,
তার দুদিকে বাজারভর্তি ব্যাগ ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।
যদি ভল্ল দুলতে থাকে শত্রুদের হাতে, আমার শ্লোক ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে যতক্ষণ না রক্তধারা নেমে ওদের মুঠো পেছল করে দেয়।
আগুনের গালে একটা চড়; তৃষ্ণাফলের ভেতরে যে তৃপ্তিবীজ, তাকে নাচিয়ে অক্ষরসভায়
কবিতার লাখ লাখ অর্থ তুলে দেব
তোমার হাতে — চিকিচ্ছে করাও
ভাবিনি মেসেজ পাব : মরে গেছি, ফেলে দিয়ে যাস
মৃতের পায়ের স্বর গুনে গুনে কবিতার ওপরে হাঁটি, হাঁটু ভেঙে পড়ে…
কানে আসে জাতিস্মর ফিসফিস —
নিজের জননী হও, হে পুরুষ, নিজের জননী!

চটকপুর

এক
যত বিনোদ-অরণ্য পার হলাম… ওপরে
মহাফার্নের উড়োসেতু, নীচে জলখোয়ার শিঞ্জিনী;
ওপরে চিতাবাঘিনীর পা, নীচে ওর ঠাকুরপো
বাঁদরলাঠি ফুল — সবই তোমার সামান্য ধন;
রাতে পাহাড়ের দরজা খোলা রেখে
সকালে জ্বর বাধানো বিজুবন…
হাসপাতালে বাবার শ্বেতমর্মর মুখ মনে এলে
আমি মেঘের গলা জড়িয়ে শুই; ঝুলন্ত দু’পা-র
শতকোটি নীচে খাদের অসীম ডিগবাজি —
সমস্তই তোমা থেকে পাওয়া দেহরূপ;
যত প্রজাপতিডাকা ঘাসের গোছ,
মধ্যে সঞ্চিত জলনিধি, আর ডাকবাক্সের মতো
পুরোনো পাথর
আমাকে অসুস্থ করা এই যে সুন্দর…

দুই
নিস্তব্ধতার ন’মাত্রা ভেতরে বসে আছি
মনের পাঁজর বহু উঁচুতে উঠে গিয়ে হোম স্টে,
সেখানে ওরা দুহাতে ধ’রে টবে বসাল আমাকে —
হায়াসিন্থচারা। পাশে পাশে চড়াইঘুঙুর ,
টাল খেয়ে মাটাল হওয়া জলফোঁটার রেজাই…
করমর্দন করলাম কিছুটা বৃষ্টির সঙ্গে।
সঙ্গীর জন্যে সব সময় খোঁজ, তারই নাম
একাকিত্ব… একটা চেয়ার রেখেছি চিতা
আসে যদি, ক্লান্ত থাকলে পাশের খাটে
লাল ব্ল্যাংকেট; মাথার পেছনে পড়াশুনোর বাতি।
হতে পারে সে বাথরুমের স্কাই লাইট ভেঙে এল
আমার শরীরে যে অরণ্যসিক্ত গন্ধ, যে এলোমেলোতা মাথার চুলে — তার টানে,
একই দাঁতের বন্ধু দেখে কামক্রোধাতুর…

তিন
তার গল্প সব্বার মুখে… চিতওয়া-বাচ্চাদের
কোন হ্রদের কিনারে দ্যাখা গেছে। বড় মেয়ে সোনাদাস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, ছুটিতে তার
কালো ছোপ ছোপ মাথা রান্নাঘরে চোখে পড়ে — গেস্টদের বিকেলের চাট বানিয়ে দিচ্ছে
তোমরা পাহাড়ে সারাদিন লোহার টিনে পেরেক ঠুকে দ্বিতীয় পাহাড় তোলো, তাতে সবুজ অ্যাক্রিলিক মেরে গাছপালা। এখনও একজন রোদ আকাশের ব্যালকনিতে ব’সে কাজ করে যাচ্ছে,
আর আমি জীবনপশমিনা থেকে কাঁটা বাছতে গিয়ে ছিঁড়েকুটে ফেললাম, ইচ্ছেগুলোর ফাটলে বটচারা
ঘরে ফিরে শুনছি চিতা মেসেজ করেছে —
যদি কোনওদিন তোমাদের কুকুরের গলাব্যথা করে, আমি ডেকে দেব সারারাত, অল্প খরচায়

চার
ওই দ্যাখো টাটা গোল্ড আর রোগা লম্বা
শেরপা ড্রাইভার। এক-ঝাড় মেঘ দ্যাখো,
গোছা গোছা কুয়াশার পিঠ; এই তাকাও ঘাসলহরী আর ডেকেডুকে নিয়ে আসা পাতাঝরনা জল, বুনো শুয়োরের দাঁতে ওপড়ানো গোবি-র ফসল;
মন থেকে চপ্পল পর্যন্ত তৃণাচ্ছাদিত মানুষেরা।
ওই দ্যাখো খাবারের টাকা দেব না ব’লে বাঙালি ট্যুরিস্টের দিক্‌কত, আর দীর্ঘরোমা বাদামির
ভেতর থেকে পেনিসের লাল মুন্ডু…
আজ তিনমাস চিতা আমার সাথীকে
নীচের হোম-স্টে থেকে তুলে নিয়ে গেছে

পাঁচ
দর্শনমিনার — আমি তার জানলা থেকে সবুজ পতাকা নাড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে তুলছিলাম…
পৃথিবী কীটশান্ত শব্দশান্ত হয়ে এলে মাটিতে চুপচাপ কেউ চারকোনা ধূসর মেশিন নামাল। কোনও তার বাতাসের নাভিতে, কোনওটা গাছের ঠোঁটে গুঁজে দিলেই বিনবিন ঘামের মতো সন্ধে চালু হয়ে যাবে
তখন চিতা কার্তিকঘাসের নীচে জলের হাল্কা স্বেদে
জিভ দিচ্ছে, বুকের ওপর লেজ গুটিয়ে শুয়ে
রবীন্দ্রসংগীত। আমি বিকেলের খাবার মুখে
তুলতে গিয়ে দেখি তালা খুলে ফাঁকা আকাশঅফিসে ঢুকল চাঁদ — ছায়াচোখ,
থ’কে যাওয়া চেহারা। “আগে তুমি নাও” —
তার দিকে বিস্কুটহাত উঁচু করেছি…

খইয়ের অভিবাদন

এক
মৃত্যুর ঘোলাটে কেবিনে এই প্রথম পা রাখা হল
বসার গদিটা দেখছি জীবনেরই মতো —
ঘরোয়া, অগোছালো, কোনওরকমের।
কেবিন বলতে পারো, বা নীচে চাকা লাগানো সিনেমামহল, এবং গোটা ঘরটা মৃতের শিল্প-নির্দেশনার ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে
ধড়াদ্ধড় হুটার বাজিয়ে
প্রয়াতের কীসের এত তাড়া, তার কোথায় পৌঁছোতে দেরি হয়ে যাবে আমি, স্বয়ং মরহুম, বুঝতে পারি না

দুই
পিঠে হাত রেখে যারা ট্রাকে তুলে দিল, তাদের
আঙুলে কনকচাঁপা, পকেটে খুচরোর বওছার।
তারা একটা টিম হিসেবে কাজ করে; সে গাড়ির
পেছন ধরে আসা হোক গঙ্গা পর্যন্ত,
কি জগদ্দল গেটে থেমে ভুয়ো চা, ভেজিটেবিল প্যাটিস; আর এখানেই মরুভূমির শিল্পাঞ্চল মিশতে থাকে কৃষিযোগ্য কান্নাকাটির সঙ্গে।
চিরকাল দেখেছি হাসপাতাল থেকে সকালের
একটা ফোনেই সন্ত্রাসবাদের শুরু; যেহেতু
মৃত জীবিতের মাঝখানে তেমন কোনও
ম্যাকমোহন লাইন নেই;
শুধু আজকের নেতার দিকে মুষ্টিবদ্ধ খইয়ের অভিবাদন; রাজনীতি এভাবেই আগুন কিম্বা মাটিপন্থী হল, ঘাসিরাম কোতল হল
নাটকের পাঁচমা দৃশ্যে এসে

তিন
যারা কাছের মানুষে পায়নি, কুকুরের চোখে
খুঁজছে বিশ্বাস। কাছের দোকানে পায়নি যারা
সাদা থান, রেল গেট পেরিয়ে যেতে যেতে
ভাবছে লেভেল ক্রসিংও একটা মৃত্যু…।
আমরা যে পুশ করলাম এত এত ফোয়ারা,
আর শরীরের ভেতর মনিটারে
ফুটে উঠল রামধনু…
অসুখ ধর্ষণ হলে সভ্যতা ধর্ষণান্তে খুন আমি
বলতে চাইনি কিন্তু জিভ সুড়সুড় করছে।
সরি, বিজ্ঞানের সঙ্গে আমার
উনষাট বছরের যৌনতা, কিন্তু শেষ মুহূর্তের পর
সে এভাবে বুকের ভেতর থেকে বের করে নেবে
পুরুষপাইপ, ভাবিনি মাইরি
যে কানে আসবে — রিল গোটাও, প্যাক আপ,
ভরো বিল, গাড়ি লাগাও…

চার
যাওয়ার আগে অসহায়তাকে একবার
নমস্কার করি, একবার সহানুভূতিকে। সবাই
যেন বলে ব্যবহার ভাল ছিল,
এইটুকুই তো থাকবে।
যাওয়ার আগে এই-পথ-যদি-না গাইছে
দূষিত ডানলপ-বরানগর, আমার ভাইয়ের রক্তমাংসহাড় মানে একুশবাইশতেইশে ফেব্রুয়ারি
ভুলতে পারছি না গো!
রাস্তায় ডাগর ডাগর আলো, আকাশের চুল পর্যন্ত
ঝকঝক করছে, বাকি সব অন্ধকার…
স্তম্ভের নৃমুণ্ডে আলো, কুয়াশার হোর্ডিং জ্বলে,
বাকি সব অন্ধকার…
আর আগেও বলেছি, চিরনিদ্রা এত জোরে ছুটছে
যেন বিধানসভার মুখ্য সচেতক;
‘শব্দ’ উচ্চারণ করলেই প্রতিবার
‘শবদেহ’ হয়ে যাচ্ছে কেন!

পাঁচ
পায়ের বুড়ো আঙুলে আঙুলে গিঁট বেঁধে দিয়ে
লিফটে নামিয়ে সাদা খামে মুড়ে সেলোটেপ এঁটে
বাড়ির বেল বাজিয়ে নিজের হাতের পেন
বাড়িয়ে দিয়ে গিফট হিসেবে যাকে রিসিভ করিয়ে নিল, তুমি সেই সোনাদার কাছে এক উত্তরায়ণ
বাস করেছিলে — যখন হাফপ্যান্ট ছুটছে পৃথিবীর বিকেলের ফুটবলমাঠে, হাফ প্যাডাল
ফুল প্যাডালে পরিণত হচ্ছে, দূরদেশে যার
অসহায় স্কুল পুড়ে ছাই নকশালতায়।
দহনের সেই গল্প ফিরে এল সুবীভৎস ঢাকে — কালীথানের আরতি, বুক থেকে স্টেথো তুলে
মাথা নাড়ানোর পরেও ট্রেনের ফুরনো মান্থলি
এই সর্ববারোয়ারি জিভ…!
খুলে নাও, ছিঁড়ে ফ্যালো, মুখ তুলে
দ্যাখো বলশালী —
যে ডেথ সার্টিফিকেট সে-ই পাটকাঠির সাপ্লাই
সে-ই ৯০৬ টাকার রসিদ সে-ই ঘটপুরোহিত
সে-ই বিশ্বকর্মাধিপতি সে-ই খোলা মাঠের নীচে
ফোলা ক্যারামবোর্ড

ছয়
রাস্তা দেখি। একটা মেয়ের স্তন এক মিলিমিটারও
নিচু হয়নি শোকে, পেচ্ছাপরতের প্যারাবোলা কোনও কষ্টে কেঁপে উঠছে না।
এতদিন বেঁচে ছিল সে-সবুদ গুছিয়ে রেখেছ? আজ যে পুড়িয়ে দেবে কই তার প্রণামযোগ্য প্রমাণেরা? এই ভর রাত্রিকালে ময়লাকালো তিল, বুড়ো আলোচাল, পচকুটে ঘি, নদীর পাঁকের জল মুখে দিচ্ছ; ভুলে গেলে বারবার কীরকম শ্বাসকষ্ট পেটখারাপ হতো? কী রকম ফিটফাট
চুল-আঁচড়ানো বাবু, দার্জিলিং চা-টি ছিল,
হ্যাঁ রে ভুলে গেলি…‌!

সাত
প্রত্যেক পুরুষ রাজত্ব করেছে পরিবারে, তারপর
যুবরাজকে কোলে তুলে বসিয়েছে সিংহাসনে, এবং তার পরেও ধমকাতে ছাড়েনি। তাই কখনও বাপকে বন্দী করে বক্সা দুর্গে নিক্ষেপ করেছি। তবু ওই ভূতপূর্ব রাজা ভূত ব’নে যাওয়ার আগেই দেবতা হয়েছে সমবেত কান্না আর হাতপাছোঁড়ায়। দেখে প্রত্যেকের এক মিনিটের জন্যে সূক্ষ্মভাবে দেবত্বের ইচ্ছে পায় — যেভাবে সামান্য সুতোয় ভর দিয়ে শূন্য থেকে শূন্যে উঠে যায় মাকড়সা

আট
যারা পোড়া কয়লা থেকে নম্রমুখে বেলচা মেরে
তুলল বকশিশ, যারা বন্ধুর বিনা-ডাকে ছুটে এসে
হাসপাতালে দাঁড়ায়, ওদের বাইক ছড়িয়ে পড়ুক
শেষরাতের শহরে। যারা নদীকে এতদিন নৌকো
ব’লে জেনেছে, আবিষ্কার করুক সেটি
নাভি-গোরস্থান। মৃত্যুর ভেতরে এইটুকু পাওয়া — ইহুদির মতো শোকার্তকে বুকে চেপে ধরে অচেনা মেয়েরা। ধর্মের বোবাঘট ভেঙে দেখব আর কী জমানো ছিল…নিকটে অন্ধ দেখলে মুদ্রাদোষে পাঞ্জাবির পকেটে ডুবে যাওয়া হাতের আঙুল?

নয়
চিহ্ন রেখে গেল, ছিন্ন রেখে গেল সন্তানসত্যকে। আবার ছানা কাটবে দই জমবে ধীরে, গলায়
টাই বাঁধবে অশৌচেরা।
আমরা একার ইতিহাস, আমাদের পাঠকও একজনা — উবেরওলার কাছে ইয়াদ নেহি, শাড়ির দোকানে খোঁজ সেই সামনের পুজোয়।
মৃত্যুর শোক ঢাকের শব্দের কাছে হারে, পার্টির পথসভা অতিক্রম করতে পারে না। পৃথিবী বলতে রাস্তার ধুলো ছাড়া আমাকে অন্য কিছু বোঝাতে এসো না। বাঁচা বলতে শূন্যতাসঙ্গম। গড়িমসি করি প্রেমে, শুধু মনমতো বহুতল খুঁজে জীবন কাটল।
জীবনের বাসস্থানে একটা ঝাঁপ দেওয়ার
ঘর চাই কিনা? আমার মৃত্যুর মুখ আমি-টাইপের;
আমার মৃত্যুর হাত একটু বেশি ক্লান্ত, এই যা!

দশ
তোমার বাড়ির কাছে কৃষ্ণগহ্বর আছে, তোমার পাড়ায়, দেখতে পাও না। যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটো,
শাড়িতে লেগে যায় ব্ল্যাকহোলের ছাইরঙ কাদা,
পেছল ইঁট… আর ছায়া। এপার-ওপার ছায়া,
এ-জেলা থেকে ও-জেলা পর্যন্ত। ভেবো না কালো গর্তে আলো নেই, হলুদ বাল্বের নীচে সেই ক্যারামবোর্ড পাতা।
দেওয়ালের উপত্যকায় ঘেরা পৃথিবী, দেয়ালেই
ছোটবড় মানমন্দির। এক পাঁচিলের আড়ালে শব নামিয়ে রাখো, এক ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে মাথাঠোকা কান্না রেখে দিতে।
ক্যারামবোর্ডের দুপাশে লোকদুটো মুখ তুলছে না। শুধু উল্টোদিকের বাক্যহীন কাঠচাপা গুটি টেনে আনছে সেকেন্ড পকেটে, সেন্টারের রেড নিখুঁত এ্যাঙ্গেল করছে, আর কেউ থমথমে গলায়
ব’লে উঠল : গুড শট।
গুটি পড়ে যেতে যেতে বলে গেল নাকি?
গুঁড়ো গুঁড়ো হলুদ আলো পা ধুতে
নেমে যাচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরে…।

[উৎসর্গ : সোনাদা]

সব সাপ গর্ত পেয়ে গেছে

আমার কিলবিল দশা এই শীতে;
ঘুমের মধ্যে হাত বারবার নিচে নেমে
গিয়ার বদলায়
রাস্তার ধারে কে বেড়ালের লোমে
আগুন ঠুকে দিয়েছে; রাস্তায় বিপাশা ব্লাউজ
চাদরের ভেতর থেকে ওপরে
ভেসে উঠছে চন্দ্রমল্লিকা
এই শীত, কেউ মানবে না বললে —
কিন্তু ঋষিগোত্র, রাক্ষসগণ!
ইশ আমি বহুদিন পরে লজেন্স মুখে নেব,
হালকা ভারত বনাম ওজনদার ভারতের খেলায়
জিভে কচকচ ক’রে কাঁপবে সেকেন্ডের কাঁটা!
পাঁচিলের ওপর বসে বান্ধবী ডাকছে, ওগো বড়ঘরের দরজা খুলে দাও
ওর গলায় ভাঙন মাছের কাঁটা,
আমি ছাড়া আর কেউ খুলতে জানে না
সব সাপ ফোকর খুঁজে নিচ্ছে এই শীতে
শুধু আমি মরুভূমির ওপর দিয়ে টেনে আনছি
পঙ্গু মোটরসাইকেল
একবার বসেছিলাম ছড়ানো বজ্রাসনে,
স্ফিংকসের মতো — নিচে নদীখাত;
সারা রাত যেভাবে অক্লান্ত খবরের কাগজ
ছাপা হয়…।
যদি তুমি আমাকে হাজতে নিতে একদিনের জন্যে;
কড়া পাহারায় পাহাড়ের হোম স্টে-তে
তুলে এনে বলতে দৃশ্যটির পুনর্নির্মাণ করো
তেমন একটা রানিমিস্তিরির ফোন নাম্বার চাইছি
যে সোমবার বলবে তো সোমবারই;
কপালের ভাঙা ইঁটে চুমু খেয়ে এস্টিমেট দেবে
আর ঝত্‌খন না ইনসাইড পুরো রঙ হচ্ছে
দু’পা দিয়ে জড়িয়ে থাকবে আমার কোমর

.
গ্রন্থ: [‘সন্তানপ্রণাম’ থেকে]

সন্তানপ্রণাম … নয়

এই পৃথিবী শিক্ষিত ছাত্র হয়ে যাক
বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ লাগাও রেলের দু’আনা বস্তিতে
আমি দেখেছি, তিনতলা লেডিজ হস্টেল থেকে
যে টিফিনকৌটো নেমে এল, ছেলেরা তাকে
লুফে নিয়ে হাসে
বইয়ের মুখেরা সব এক-মায়ের সন্তানের মতো,
বিদ্যের মুখেরা; প্রাণ ভ’রে ডালসবজি খেতে পারে জানার মুখেরা।
যদি তুমি অন্তর্লীন দুপুর-বাতাসে হাঁটো
যত রোদ আর পড়াশুনোর শিউলিঝারি থেকে
মেয়েদের গলা টোপাচ্ছে — সব ইংরাজি, সব মুসলমানস…
এতদিনের চেনা তবু যেমন চোখ সরানো যায় না গ্র্যামারবই থেকে;
যারা শ্লোক উচ্চারণ করে আর জল খায়
কাতারে কাতারে — ওদের গলায়
পার্লামেন্টের ছ্যাদলা তোলার বাটালি আছে কি?
সূর্যের ছানি কাটানো স্প্যাচুলা?
এখানেই বিনয়ের হাতগুলো পাবে
গবেষণা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না ছায়াচ্ছন্ন এসবিআইয়ের ভেতরে
কতদিন ধ’রে আর হোস্টেলের টাকা
জমা দেবে বলো!
তাকে গেট খুলে বেরিয়ে আসতে হয় বাসরাস্তায়
এরা বিউগল বাজাতে পারে মাঝরাতে
রোগা রোগা কঠিন শার্পেরা
সব ডেমোক্র্যাসি ক’রে দিতে জানে

একজন দার্শনিক হিসেবে বলতে পারি…

নয়

তোমার-আমার তুলনা করতে গেলেই আশ্বিনফুলের সঙ্গে অসময়ের বৃষ্টির তুলনা
এসে যায়। এক মাঠ পড়ে আছে শায়িত,
তার ওপর এক-আবরণ হলুদ। ছোট দিগন্তের
দিক থেকে উঠবে কুয়াশা; সন্ধেবেলাকে অরণ্য ধরলে কুয়াশা বাঘ, অরণ্যশাসন। পুটুশ করে সন্ধ্যাতারা জাগবে। জাগবেই গো!
তুমি সবসময় পরিণতি খুঁজেছ —ছড়া থেকে প্রবন্ধের দিকে, রাবাংলা থেকে লালিগুরাশের দিকে। তাই তোমার জীবনে বারবার সৃষ্টি আর প্রলয় নেমে আসছে। তুমিও আমার মতোই অনন্ত, কিন্তু লক্ষ্যের দিকে ছোটা অনন্ত তুমি। তুমি আমাদের প্রেম শেষ হলেও থেকে যাবে। আমি প্রেমের শেষে থাকব এবং থাকব না।
আমি যে সবার রোদ্দুরের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি না — এই সত্যকে অচিখ্যান করেছি, আমি যে টাকা নদীজঙ্গলে নষ্ট ক’রে ফেলি — এই ধারণাকে দেশনা করেছি, আমি যে আজও যোনিজনপদে একটা ছাতা হাতে ঘুরতে যেতে চাই —এই ইচ্ছেকে উত্থানীকৃত করেছি। জড় আর নিঃশ্বাসীদের তৈরি খামের মধ্যে ঢুকে মাঠের দুই শেষে দেখছি জন্ম আর মৃত্যুকে। মাঠের মধ্যেও জলকীটের ভেতর, সাপের অস্তগামী চলাচলের মধ্যে, এই উত্থিতগুচ্ছ তো ওই পরিণামদর্শী নোয়ানো ধানশীষে অসংখ্য জীবন আর চ’লে যাওয়া। হৃদয়ে কৃষ্ণ আসেন, স’রে যান। শীতার্ততায় বুদ্ধের ছায়া পড়ে, তারপর তিনিও অবলেশ। আমার মধ্যে আমি প্রবেশ করি শেষ অবধি।

এই ঘটনাকে “সমুদ্রের শুরু আছে” ব’লে জানলে তুমি দুঃখ থেকে মুক্ত হবে না। এই বুঝ-কে “সমুদ্রের শুরু আর শেষ আছে” ব’লে জানলে
তুমি দুঃখ থেকে মুক্ত হবে না। এই সহজকে “সমুদ্রের শুরু আর শেষ আছে, কিন্তু ঢেউ অন্তহীন” ব’লে জানলে তুমি দুঃখ থেকে মুক্ত হবে। যেহেতু প্লাইউডের ভেতরে কাঠের টুকরোর মতো তোমাকে ছোট ছোট নিত্যের সমাহার বলা যায়, তাই তুমি মৃত্যুর পরে থাকো না।
আমি মৃত্যুর পরে থাকি…
…নাহ!

বকুলগাছের নীচে

থেকে যেতে পারতাম বকুলগাছের নীচে সারারাত।
পরদিন পলিথিন, কাচের বোয়েম কিনে
টফি-বিস্কুট দোকান লাগালে বেশুমার
ঝড়বৃষ্টি এসে যেত। আমি জ্যান্ত-পাঁকাল ওই বিদ্যুৎপাত
বয়েমে সাজিয়ে ভিজে স্কুলশিশুদের
হাতে দিতে দিতে ভাবতাম
এই কি তোমার মেয়ে? এই কি… আমার!

চাঁদপোড়া

আমার মুখ আমি দান করে যাব
সুপুরিগাছের জঙ্গলে
দোকানদার মারা গেলে দোকানে তার বউ
বেরিয়ে আসে, আর কালো ভিজে অফিসফেরত ছাতাদের ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয় হয়ে যায়।
আমারও মুখের আঁশে পিঁপড়ে বেয়ে উঠবে,
‘পুচ’ ক’রে দেবে পাটশালিখ পাখিতে।
যখনই ভাঙা নিমডাল ছুঁলে, তোমার হাত
টের পাবে উঁচুমতো আমার নাকের বাঁশি।
তার আগে জানলাকে নিজের হাতে
বাতায়ন বানিয়ে দেব। ছবির ফ্রেমের
দুদিকে রাখব এক রুদ্র সুশীতল জল
আমার জীবনোত্তর হাসিগুলো আমি ফেলে এসেছি
নলেনগুড়ের পাখির কাছে
এবার মুখোমুখি ব’সে থাকব গুল্মসভ্যতার,
চক্রাসন করা কলাপাতার পায়ের নিচে
কম্বল পেতে দিয়েই বালির ঢিপির আদেশে
এক-ছুটে তাকে ভাঁড়ের চা এনে খাওয়াব
সচ্চাষীপাড়া থেকে ভেসে আসা মাইক
পরিচয়পত্র বানিয়ে দেবে; আমার
মাসকাবারি মাইনে হবে পালবাড়ির
দেয়ালে বসা শ্যাওলা-অফিসে
আর এতকিছুর মধ্যে একদিন
ত্যাগ ক’রে দেওয়া নিজের মুখ মনে পড়বে
তাকে আমি সারা সন্ধে ডিঙি পেড়ে খুঁজব
হলুদ মেহগনিপাতায়, চাঁদপোড়া ঢেলে দেওয়া আকাশগেলাসে। ডাকব বৃষ্টির মতো
দূরে দূরে ছুঁড়ে দেওয়া হরিবোল দিয়ে…
জ্যোৎস্না থেকে নর্দমা থেকে উঠে যদি
মুখ আবার মুখে ব’সে যায়