চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

অন্ধপ্রিয় মানুষের দিকে

আমাকে ফেলে গেছ যে ছাইয়ের গাদায়
সেখানে আরও অন্য বেড়াল রয়েছে
প্রথমে বুঝিনি; ময়লার শীর্ষে বসে ভাবতাম
নিজের অন্নপ্রাশনের ভাত
কীভাবে জোটাব? আকাশের চিল থেকে
গৃহস্থের ঢিল রোজ এ-শরীর
নতুন জন্তুতে বদলে দিয়েছে
যৌনকর্মীর মতো জড়িয়েছি
অচেনা বাইকের চাকার ফোকরে

তারপর সব ইহুদির সঙ্গে পরিচয় হল
শুনি, চোখ না ফোটা পর্যন্ত জীবনে শুশ্রূষা থাকে
ইশ, কেন তাকিয়েছিলাম
অন্ধপ্রিয় মানুষের দিকে

আজ মৃত্যুদিন — ভুরু লক্ষ্যে ক্ষিদের পেরেক
ছুটে এল। ওমনি পাঁচিল-পাশে
এক মেয়ে জানলা খুলেছে
স্তনে ভীষণ সামান্য দুধ, তাই ভাগ করে দেবে;
বাড়ির ফলকে লেখা — বেড়ালবসতি।

তখন তোমার কথা মনে এল
সব জেনেবুঝে এই সজল আদাড়ে,
জঞ্জাল ফেলার বাক্সে রেখে গেছ?

.
পরিত্যাগে স্নেহ ছিল (২০১১)

কথাসুরের করুণা

ভি-ওয়ান বাসের পেছনের সিটগুলো উঁচুতে থাকে। সেই উচ্চতার আবার দুই ধাপ: মাধ্যমিক, হায়ার সেকেন্ডারি। হঠাৎ চিৎকার শুনে দেখি হাতদুয়েক দূরে একটা মেয়ে আমাকে আঙুল তুলে হিন্দিতে শাসাচ্ছে — কী হল, পেছনে অতটা খালি জায়গা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমরা এখানে চাপ খেয়ে মরছি। এগোন ওপাশে!

অপমানিতের হাসি হেসে বললাম, ম্যাডাম ওই জায়গাটা উঁচু, দাঁড়াতে গেলে মাথায় আটকাবে, আপনিও পারবেন না।
— আপনি বুঝি সবজান্তা?
— তাহলে এসে দেখতে হয়।
— আপনার ঘাড়ের পর দিয়ে যাব নাকি? জায়গা দিন।

এই রে! পেছনে পেছন ঠেকিয়ে দু’সারি লোক দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনেই আবার এক ভদ্রমহিলা ব’সে, যার স্পর্শিত না-হওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকারের দিকে সব সময় সতর্ক নজর রাখতে হচ্ছে। তবু নৌলিমুদ্রা মনে ক’রে পেটে খাবোল দিলাম, সবাইকে গুঁতিয়ে আমার পেছন দিয়ে সেই বোমারু বিমান পার হয়ে গেল। তার সঙ্গে সর্বভারতীয় মিডিয়ার কাছে “বুড়োগুলো ভয়ানক ধান্দাবাজ, নিজেরা একগাদা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, অন্যকে এগোনোর সুযোগটুকু পর্যন্ত দেবে না, কত্তো বড় অসভ্য!” — এইরকম প্রেস রিলিজ।

কিন্তু উচ্চতর মাধ্যমিকের সিলেবাস দেখেই ফেল করল মেয়েটা, থেমে গেল সেই নীচের ধাপে, মানে আমার ঘাড়ের ওপর। প্রায় বেকেলাইটে তৈরি তার বগল-ব্যাগ শঙ্খ ঘোষের কবিতার পাঠক নিশ্চয়ই, আমার পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ না তুলে ছাড়বে না।

— ম্যাডাম, আপনি যে আমার জায়গাটায় দাঁড়িয়ে পড়লেন!
— ‘আমার জায়গা’ মানে!!! ইয়ে আপকা খরিদাহুয়া জগা হ্যায় কেয়া???

মুগ্ধ হয়ে গেলাম! চোখের ওপর গাঢ় হল ন’-হাজার ফুট ওপরের সূর্যাস্ত, যেখান থেকে একের পর এক কুয়াশার ফিতে নেমে পাইনবনের মাথা জড়িয়ে ধরছে…। ওই প্রকৃতির যেমন কোনও ব্যাখ্যা চলে না, তেমন এই যুক্তিরও। ডোকরা শিল্প অথবা পটের ছবির মতো বিরল হয়ে ওঠা জটিল মেয়েলিপনার চিহ্ন পেয়ে আমি ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখি গনগন করছে তার নাকের পাটা, গোল তরোয়ালের মতো ঝলসাচ্ছে হাতের কব্জি।

কয়েক নিঝুম মুহূর্ত পার হয়।

অচ্ছা চলতা হুঁ দুয়ায়োঁ মে ইয়াদ রখনা
মেরে জিক্‌র কা জুবাঁ পে সুয়াদ রখনা

প্রথমে বাসের কেউ কিছু খেয়াল করে না, ইনক্লুডিং মাইসেলফ।

দিলকে সন্দুকো মেঁ মেরে অচ্ছে কাম রখনা
চিট্‌ঠি-তারোঁ মেঁ ভি মেরা তু সলাম রখনা

তারপর দু’একজন কান থেকে হেডফোনের রিসিভার খুলে আমার দিকে বিচিত্র চোখে তাকায়। তখন বুঝতে পারি, গান গাইতে শুরু করেছি! সর্বনাশ! এই বাসেই আমার চার-পাঁচজন কোলিগ ব’সে, অফিসে রাষ্ট্র হয়ে গেলে…? নিজের আবেগকে দ মানে দমন করা দরকার, কিন্তু গান ততক্ষণে আমাকে চিৎ করে বুকের ওপর চেপে বসেছে।

সুতরাং একদিকে “সন্দুকোঁমেঁ” শব্দে তার-ষড়জ থেকে লোলেগাঁওয়ের দড়ির সেতুর মতো এক ঝুল দিয়ে কোমল নিষাদে গিয়ে দাঁড়াই, অন্যদিকে আমার মন বিড় বিড় করতে থাকে: এই নাও, কথাসুরের করুণা পান করো। কেন এত রাগ তোমার জানি না। নির্যাতিত শিশু, বাড়িতে স্বাধীনতা না পাওয়া, অফিসে হয়রানি, নাকি তুমি এই রকমই — এক কোপে মুন্ডু নামানোয় বিশ্বাসী! যে হও সে হও, দ্যাখো শুধু তোমারই জন্যে কেউ লিখে গেছে, কেউ গেয়ে রেখেছে…

অন্ধেরা তেরা ম্যায়নে লে লিয়া
মেরা উজলা সিতারা তেরে নাম কিয়া

শোনো, গান আরও বলছে কতবার তার সকালকে তোমার উঠোনে বসে বসে সন্ধে করেছে সে। গুনেগেঁথে নাও গানের “ও পিয়া” ডাকের ভেতর যত লক্ষ প্লিজ-প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়!
মেয়েটার চোখে খুব আস্তে আস্তে জ্যোৎস্না ফুটছে দেখতে পাই। চিবুকের সব খর-রেখা মরে যাচ্ছে; দুটো ঠোঁট মুখের মধ্যে মুড়ে নিয়ে বাসের ছাদে কল্পিত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে…।

[‘গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত’ গদ্য থেকে]

বারীনীয়

আমরা সব একা ফুল। আবার কোনও ফুল সঙ্গে আনে সুতোও।

স্কুলযুগের শেষকালে আমি এক রাজনৈতিক মতবাদ মিক্সড উইথ চিন্তাধারা-র ‘ছোঁয়া’-য় পড়েছিলাম। ছোঁয়া প্রথমে ছদ্মবেশে সাহিত্য-সমালোচনার সরু লাইন ধরে এগোল, তারপর বিজ্ঞান-দর্শন-অর্থনীতি করতে করতে হঠাৎ তুলে দিল সব পর্দা-হ্যায়-পর্দা: এতদিন তোমাকে যা বলেছি, সব দলের তত্ত্ব। ঠিক মনে হচ্ছে তো আমাদের পার্টি জয়েন করো।

চিরকালের অসৎ, ভিতু, ফাঁকিবাজ ছেলেটি পলায়ন করে। সে বড় হয়, চাকরি আসে, সংসারধারণ, কিন্তু সেই ছোঁয়া একইরকম ছিল — রোগা, কালো, চোখের জায়গায় কাদামাটিতে দুটো মার্বেল-গুলি বসানো — মা দুর্গার সিংহ যেন।

খবর পেতাম, স্পর্শ আবার নতুন কিছু ছেলে ধরেছে, যাতায়াত করছে অন্য কোনও স্কুল কি কলেজে। অভ্যস্ত প্রেমিক যেভাবে প্রত্যেক সঙ্গিনীর একই আদরের নাম রাখে, ছোঁয়া তার পূর্বোক্ত স্কিম নিয়ে ফিরফিরতি এগোতো পা টিপে টিপে…শুধু এইটুকু আবিষ্কার করার জন্যে যে জাল ফুটো ক’রে “পক্ষী উড়িয়া পলায়”।

কমিউনে তার সামান্য বিছানার কোনে বসে জিগ্যেস করেছি, শংকরদা, (স্পর্শ বা ছোঁয়ার আর এক নাম শংকর ঘোষ) আপনার স্বপ্ন তো সফল হওয়ার নয়। তবু কীসের আশায় লেগে থাকেন? বিষণ্ণ এক ভালোবাসার হাসি হাসতেন: একটাই তো জীবন। নয় ভুল আদর্শের পেছনেই বইয়ে দিলাম!

এখন ভাবি, মতাদর্শ মানুষের তৈরি, তার ভুল বা ঠিক হয় না, হয় মানুষের। তাই একই কথা আমি বললে ভস্ম, তুমি উচ্চারণ করলে ভাস্বর!

তো ভাস্বরের সঙ্গে আমার দ্বিতীয় জন্মের দেখা হল আলোকিত কোম্পানি বাগানে, যার চেনা নাম কলকাতা বইমেলা। দেখি একটা ফুল সুতো হাতে ঘুরছে, মালা তৈরির নেশায়। আলাপ হয়, ঠিক তেমনই ঝাঁকুনি দিয়ে হাত আঁকড়ে ধরা, আমার অবাক লাগে! কালো নয়, রোগাও নয়, তাহলে কে… কে আবার, বারীন ঘোষাল — পাশ থেকে বন্ধু বলে দেয়। আমি এতক্ষণে মুখের দিকে তাকিয়েছি — চোখের কাদামাটিতে গাঁথা দুটো মার্বেল-গুলি, মা দুর্গার সিংহ যেরকম।

অরণ্যের নাগরিক

আমার প্রেমিকারা হারিয়ে যায় শীতের শুরুতে
যখন পুরোনো ফুলহাতা শার্ট হেসে উঠছে আলনায়
রোদ এমন থেবড়ে বসেছে সমাজে — সিদ্ধেশ্বরী চমচমের প্যাকেট খোলা হল
আর আমি ভাবছি, এখানেই তো রেখেছিলাম — চোখের ড্রয়ারে

আমার প্রেমিকারা হারিয়ে যায় শীতের কারগো
শহরে নামতেই
মুন্নাভাই কুয়াশা লেগে রয়েছে গাড়ির জানলায়
ওরা জানে, এত গানের ধুলো ঘেঁটে প্রেম খুঁজতে পারব না, শ্বাসকষ্ট অশ্রুকষ্ট হবে
অথবা নিজের হাতেই আখরোটা-খোসা
ছুঁড়ে ফেলিনি তো
ইশ, ভেতরে আখরোট বসে ছিল!

প্রতি নভেম্বরে পিচরাস্তা ধরে উড়ে যায় প্রেমিকারা — শুকনো মহুয়া পাতা
আর আমি অরণ্যের নাগরিক কিনা এই প্রশ্ন নড়ে ওঠে

(২০১১)

সেপারেশন

কতদিন পরে ওই ঘরের দরজা খুলে দিই
ঘুমন্ত বিছানা, শুকনো চানঘর,
ব্রেকফাস্ট ফেলে গিয়েছিল
মুখে তুলি, কিচ্ছু তো পচেনি!
একটা তিতির বন্ধ জানলায় ঠোঁট বাজিয়ে চলেছে
কাচের এপিঠে জটিল ওষ্ঠ চেপে ধরি
ব্যথা নয়, বুকে এসে লাগে
ব্যথার গৌরব

.
(২০১১)

গয়ন্ত জাঙ্গুলি

যত সব সোকাবোকা ছেলে নিয়ে জেরবার
স্যার বলতেন
জয়ন্ত গাঙ্গুলি, হায়মন্ড ডারবার
ফা হিয়েন লেন

স্বামী-স্ত্রী দুইজন আর এক বোন ঘরে
অবিবাহিতা
বেথুন কলেজে পড়ে, পাঠ করে অবসরে
কেষের শবিতা

সেই মেয়ে হায় হায় ফেল হ’ল বাংলায়
অঘটন কী এ!
স্যার কান্নায় ভিজে — বোনটির শুখটি যে
গিয়েছে মুকিয়ে

স্টুডেন্ট ভালোই, যত বোকাসোকা টাসমার
স্যার বললেন
গয়ন্ত জাঙ্গুলি, ডায়মন্ড হারবার
(অহিফেন নেন)

[“হিরের স্বপ্ন চারকোলে” বইয়ের ছড়া]

মস্তান ফুলওয়ালি

এক
হাঁ-ঘুমে সব গাড়ি পালকি…

বস্তা ঝুলছে পোয়াতির পেট — যত ঘাড়ভাঙা মানুষ মালিক
কার কনুই কার জঠরে ঢুকে গেছে
এক আধবুড়োর পিঠে ঠেসান দিয়ে ঘুমোচ্ছ
ও-তুমি কার বউ?

বউ বুঝি সবজান্তা!

দুই
কলকাতার লেডিজেরা গায়ে গরম জল ঢেলে দেয়
কিন্তু আমি রাজপুত্তুর রাত তিনটে কুড়ির বনগাঁ লোকালে
কাটা সৈনিক চারদিকে, গুড়াকু আর বিড়িসৈনিক
তার মাঝখানে আমি এক উচ্চ পর্যায়ের দাঁড়িয়ে থাকা
চুলে শ্যাম্পু, দাড়ি কামানো, ক্রিম পাচ্ছ গালে

মস্তান ফুলওয়ালির ঘুম-ছেঁড়া মুচকিফুল ঝরছে মাথায়

তিন
টেরেনে আমার মোটে আসতি ইচ্ছে করে না
টেরেন কি, ঘর থেকি দাওয়ায় নামতি খাইশ জাগে না
এই যে ব্যবসায়িভাব দেখাচ্ছি, পুরোটা নকল
গাছের পাতা নড়েচড়ে, বউয়ের কথা মনে পড়ে

বউ যেন কাতলা মাছ
কী পেটি, কী তেল!

চার
মাল নিয়ে যাবে আবার ঘুমিয়ে যাবে
বাপের জমিদারি?

কাঁপতে কাঁপতে নামছে মাথা, মাথায়
গোটা অন্ধকার রাত পুঁটুলি-করা
এই শেষ রাত্তিরে কোথায় বসবে, কাকে বেচবে গো ফুল?

সেলের না, গাছে গাছে লাগানোর ফুল এইসব…

পুশকিনের কবিতা অনুবাদ

[পুশকিনের এই কবিতাটা কোথাও যেন উর্দু শায়েরির সঙ্গে মিলে যায়।
আমার খুব প্রিয়। বাংলায় ভাবানুবাদের এক অক্ষম চেষ্টা চালানো হয়েছে]

১.
ভালোবেসেছিলাম তোমাকে। সেই প্রেম মৃত্যু-অস্বীকারী।
কে জানে হয়তো আজও বুকে ছটফট জ্বলছে চিঙ্গারি…..

২.
প্রার্থনা রাখি, কষ্ট পেয়ো না। নিজে থেকে আমি কোনও দিন
বিশ্বাস করো, দিইনি তোমাকে মর্মবেদনা-নদী !
ভালোবেসে গেছি অনুক্ত, চাপা, আশাহীন আর প্রকৃত;
আমার লাজুক অথচ তপ্ত দরদটি আলো দিত।
আমার তো ছিল ঈর্ষা-আবেগ, অনুরাগ বিধি-না-মানা,
ওকে দিয়ো, প্রভু, আর এক পুরুষ এত দূর প্রেম জানা!

[“I loved you, and that love, to die refusing,
May still — who knows ! — be smouldering

in my breast
Pray be not pained — believe me, of my choosing
I’d never have you troubled or distressed.
I loved you mutely, hopelessly and truly,
With shy yet fervent tenderness aglow;
Mine was a jealous passion and unruly …..
May God grant that another will love you so !”]

সন্ত ফরিদ

এক
এগারো শতকের মানুষ কাজী শু’এব ছিলেন কাবুলের এক রাজ-পরিবারের সদস্য। অন্যমত বলে, রাজ-আমাত্য তিনি। আফগানিস্তানে তখন শাহ শারুখের শাসন। কিন্তু গজনীর মামুদ কাবুল দখল করে নিতেই পরিবারটির কপাল পুড়লো। এখনকার পাকিস্তানে চলে এলেন এই কোরান-সাহিত্যে সুপণ্ডিত ভদ্রলোক, আর শেষ পর্যন্ত ডেরা বাঁধলেন লাহোরের কছাকাছি কসুর-এ। শু’এব-এর তিনটি সন্তানের একজন জামাল-উদ-দীন। আর, জামাল-উদ-দীন-এর তিন ছেলের মধ্যমজন ফরিদ মসউদ, জন্ম ১১৭৩ সালে। তিনি চিস্তি-পরম্পরার তৃতীয় প্রমুখ এবং স্বয়ং এক সন্ত। জীবন জুড়ে নানা অলৌকিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উপাধি পেয়েছিলেন ‘গঞ্জ-এ-শকর’, মানে, মাধুর্যের ভাণ্ডার।

ফরিদের তিন গুরু : নিয়মনিষ্ঠ ধার্মিক মা করসুম বিবি, কোরানের অতি উৎসাহী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি পাঠক বাবা জামাল-উদ-দীন আর প্রখ্যাত সুফী সাধক কুতুব-উদ-দীন বক্তিয়ার কাকী। দিল্লিতে তার সুফী আশ্রম বা ‘খানকাহ’ বানিয়ে কাকী সুফীবাদের প্রচার করতেন। খানকাহগুলোর নিয়ম নিয়ন্ত্রণ ছিলো খুব কঠিন। ফরিদ এখানে অনাহারে তপস্যা শুরু করলেন। সুফীরা ভারতীয় যোগীদের কাছ থেকে নানা প্রক্রিয়া আর অভ্যাসের পাঠ নিয়েছিলেন — যেমন প্রাণায়াম শেখা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, সংসারে বৈরাগ্য আনার চেষ্টা ও মনকে একাগ্র করার উপায় জেনে নেওয়া ইত্যাদি। শোনা যায়, ফরিদ ‘চিল্লাহ-এ-মাকুস’ পালন করেছিলেন। এতে চল্লিশ দিন একটা কুয়োর মধ্যে উলটো হয়ে ঝুলে আল্লাহ-এর নামে ধ্যানমগ্ন থাকতে হয়। অনেকে সন্দেহ করেন, সত্যিই এমন ঘটেছিল কিনা। বিষয়টা নিয়ে অবশ্য স্বয়ং একটা দোঁহা লিখেছেন ফরিদ :

ফরীদা তনু সুকা পিঞ্জুরু থীআ তলীআঁ খুঁডহি কাগ।
অজৌ সু রবু ন বাহুড়িও দেখু বন্দে কে ভাগ।। (৯০ নম্বর দোঁহা, গুরু গ্রন্থসাহিব)।
[অনুবাদ : ফরিদ, আমার শুষ্ক কায়া কংকালসার হয়ে গেছে। দাঁড়কাকেরা আমার হাত আর পায়ে ঠোক্কর দিয়ে গর্ত করে ফেলেছে। (অথচ) এখনও পর্যন্ত ঈশ্বর আমার সাহায্যে আসেননি। দেখ, তার সেবকের কী দুর্ভাগ্য!]

কাজেই, এমন সাধুচরিত্র, ধর্মপরায়ণতা, কঠোর তপস্যা আর প্রার্থনার ক্ষমতার জন্যে ফরিদের নাম দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে উঠলেন তিনি। ডাকা হতে লাগল বাবা ফরিদ।

পাঞ্জাবি সুফীকাব্যের তিনটে ভাগ। ফরিদ তার প্রথম ধারার কবি। এখানে শরিয়তকেই সবচেয়ে পবিত্র আর গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়। ফরিদ শরিয়ত আর চরম আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোনও বিরোধ খুঁজে পাননি, যা পরবর্তী সময়ের সব সুফী কবিরাই অনুভব করেছেন।

সে যাই হোক না, গুরু গ্রন্থসাহিবে তার চারটে গান আর একশো বারোটা দোঁহা পড়লে ফরিদের সন্ত-কবি পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠবে পাঠকের চোখে। ফরিদ লিখতেন মুলতানী পাঞ্জাবিতে।

ফরীদা জঙ্গলু জঙ্গলু কিআ ভবহি বনি কণ্ডা মোড়েহি।
বসী রবু হিআলীএ জঙ্গলু কিআ ঢুধেহি।।
(অর্থাৎ — ফরিদ, পায়ের তলায় কাঁটা দ’লে কেন তুমি বনে বনে ঘুরে মরছো? ঈশ্বর হৃদয়ে বাস করেন, তাঁকে নির্জন ভূপ্রান্তরে খুঁজো না।)

.
[উৎস — বাবা ফরিদ : বলবন্ত সিংহ আনন্দ। সাহিত্য অকাদেমি।]

ছড়া হাতে গড়া

বেহালার ছড় বেতালার ছড়া
আনা তড়খড় ডাক-হরকরা

ট্রেন-সিঙ্গার মৌলানা কাজি
আদাজিঞ্জার জাহাজের মাঝি

ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রোদ ছাতা-খোলা শীত
আকাশগারদে ফাঁসিসংগীত

সবুজের খোপে জল চারকোনা
এটুকু জগত, বাকি হাতে বোনা

চোখে চিৎকার গায়ে বাঘনখ
মুখভরা পেস্ট গলায় পদক

অপমান, আয়ু, বাজারের দেনা
সব শোধ হয়, “বিদায়” ফেরে না

ভূত-ভবিষ্য-রুটি হাতে গড়া
আজ হবিষ্য, কাল লিখি ছড়া

বেতালার ছড় বেহালার ছড়া…

ক্যারোলিন বিয়ার্ড হুইটলোর আর একটা কবিতা

আমার দাদা হাভার্ডে গেল,
আর বাবা কিনলেন একটা বন্দুক

৯জুলাই
লক্ষ্যভেদের অভ্যেস ছাড়া অন্য কাজে
বন্দুক ব্যবহার করার কথা সেনেটর অস্বীকার করেছিলেন

বিয়ার্ড বলেছিল, গাড়ির মেঝেয় পড়ে থাকা
মেয়েকে নিয়ে সে জায়গাটা ছেড়ে চলে যায়

এক শ্বেতাঙ্গ পরিবার ওদের অনুসরণ করে
রাস্তা পর্যন্ত আসে, বিয়ার্ডের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার
প্রস্তাবও দেয়
রাজ্যপুলিশের নিরীক্ষক হাওয়ার্ড সিলার
বলেছিলেন যে, ঘোড়সওয়ার পুলিশ বেমেন্ট
ঘটনাস্থলেই গ্রেপ্তারটা করলে সেটা
ন্যায়সঙ্গত হত না

বিয়ার্ড বলেছে, সে স্ফটিক হ্রদে মাছ ধরছিল
স্ত্রী এথেল আর চোদ্দ বছরের মেয়ে সিনথিয়ার সঙ্গে
এমন সময় এক শ্বেতাঙ্গ তাকে বলে,
“নিজেদের লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে তুমি বাধ্য”

রাজ্যপুলিশ এক অভিজাত মিশিগানবাসীকে
গ্রেপ্তার করেছে যিনি গত ৪ঠা জুলাই
ডেট্রয়েট-এ বসবাসকারী এক নিগ্রো পরিবারকে
বন্দুকের ডগায় “ধার্মিকদের আমোদ-প্রমোদের এলাকা”
ছেড়ে যেতে আদেশ করার দায়ে অভিযুক্ত।
এই ২৮ বছর বয়েসি সেনেটর গত রাতে
গ্রেপ্তার হয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের সার্জেন্ট
জেরাল্ড কোরি আর গোয়েন্দা জ্যাস্পার ব্রায়ারস-এর হাতে

জামিন ধার্য হয়েছে পনেরোশো ডলার

১৫জুলাই
সকালের ডাকে একটা খাম এল
ভেতরে খবরের কাটিংটার ওপর দিয়ে
হিজিবিজি ক’রে লাল কালিতে প্রৌঢ় হাতের লেখা:

…..ওকে অবশ্যই ছেড়ে দেওয়া উচিত। নিষ্পাপ মানুষটা !
ও যথার্থ কাজই করতে চেষ্টা করেছিল —
কাফ্রিদের নিজেদের জায়গায় থামিয়ে রাখার কাজ।
যদি আমাদের এইরকম আরও কিছু লোক থাকত!

এগারো শতাংশ সম্ভাবনা: ক্যারোলিন বিয়ার্ড হুইটলো

তার দুকোটি তিরিশ লক্ষ কারণ আছে
কেন আমি ভিক্ষে করব
চুরি করব
বা ধার করব
তোমার মানুষটাকে
এক রাত বা সারা জীবনের জন্যে

ও-আমার বোন, আমার মেয়ে……

দায়িত্ব বিষয়ে : বড় বেশি, বড্ড তাড়াতাড়ি
খুব অল্প, খুবই দেরিতে/ক্যারোলিন বিয়ার্ড হুইটলো

অজ্ঞতা আর অনিয়ম থেকে তোমার জন্ম হয়েছিল
তোমার জন্ম হয়েছিল অস্বচ্ছন্দে

ঋতুস্রাব এমন এক বিশৃঙ্খল ব্যাপার—–
হিসেব রাখা যায় না
কোনও ছন্দই নেই ওর

আমার মা আমাকে যা বলেছেন
আমিও তাই বলব তোমায়
কিস্যু না
…………………………………………..
(ক্যারোলিন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী কবি। অনুবাদ আমার)

শুভকামনা খেলনা

তোমাকে পাঠাতাম ‘পয়লা বৈশাখ’
ভোরের ফার্স্ট ট্রেন, বাতাস-ক্যুরিয়ারে
অথবা রাধা-নামে খোলের মেঠোপথ
বাহক যতটা শুভকামনা নিতে পারে

‘এ শুধু গানের…’ দিকে আকাশ বেঁকে যেত
আবীর, কচি আমপাতায় ফুল বোনা
স্নানের ভিজে চুলে নতুন সুতিপাড়
একটা মিষ্টি কি গো মুখেও তুলবে না?

কাঠের ময়নারা গাড়িতে পাশাপাশি
আনখা ড্রাইভার বেভুল, হন্যে
সেদিন কারও আর মিটারে মন নেই
দু’চোখে চারতারা শপিং চালু থাক

ভেঙেই গেছে কবে শুভকামনা খেলনা
হাজার ‘সেন্ড’ মারো, ‘এরর’ দেখাবে
প্রথম বইটা আর পয়লা বৈশাখ
আউট অফ প্রিন্ট — তুমি, এ-বাবা, জানো না!

ছড়া : জন্মদিন

হুশ বলতেই ভ্রমণ ছিল, রোদের গায়ে হলুদ রিবন;
এখন ফেরিওলা ডাকে — ব্যাগভর্তি বন্দিজীবন।

জীবন টাইপমেশিন, ও-তার সুখদুখ আলাদা চাবি;
লেখায় দাঁড়ি… ভ্যানিশ হব, যেদিন দুটোয় জড়িয়ে যাবি।

যাদের কোলে ম্যাওপুষি নেই, পিঠে সাবান ঘ’ষে দেওয়া
হাতের অভাব; তাদের সুরে বাঁধবে — আছে এমন রেওয়াজ?

রাত বারোটার দরজাকে সে দোলনচাঁপার ধাক্কা দেবে;
রাগে কান্না মেশে কিনা জটিল শ্রাবণ দেখছে ভেবে।

উলুভর্তি টিফিনকৌটো ব্যাগে মেয়ের, মুখোশপরা;
আমিই তো তোর মাথার অসুখ, আমি তোমার বসুন্ধরা…

দুভাবে রাঁধা পশুমাংস

এক
গত বছর ঠিক এই মার্চেই আমার অচেতন শরীর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ডঃ কল্যাণ, কার সঙ্গে জানি না, তিনদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ভাসিয়ে তোলেন আমায়। চতুর্থ সকালে বেডের কোনায় বসে গলাটাকে এক্সটেনশান কর্ড বানিয়ে কানের কাছে ফিসফিসানি: কী সমস্যা আপনার, খুলে বলুন তো? খামোখা বিষ খেতে গেছিলেন কেন!

আমি তো মাল্টিস্টোরিড থেকে পড়লাম: বলছেন কী ডাক্তারবাবু! বিষ খাব, পাগল হয়েছি নাকি?

পাঁচ পাটকাঠি-আঙুল নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলেন: না না, অবসাদ-এর রোগিকে ক্লিনিক্যালি পাগল বলা যাবে না। কিন্তু বোতলের গায়ে ‘পয়জন’ লেখা দেখেও তো আপনি ওটা গলায় ঢেলেছেন?

— হ্যাঁ, ডঃ কল্যাণ, লেখা ছিল। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারিনি!
এক্সটেনশান কর্ড এবার স্প্রিংপাত্তির টান খেল: “ক্কী বলছেন! বিষ লেখা, তবুও অবিশ্…!
— কেননা আমি আমার জীবনে যখনই কাউকে বিশ্বাস করেছি, তখনই ঠকেছি।

দুই
আমাদের যত বয়েস বাড়ে, শিখতে থাকি কীভাবে অন্যের ওপর থেকে ভরসা তুলে নিতে হবে, সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়তে হবে কোন সিজিএস-এফপিএস পদ্ধতিতে। এটা আমার ভেতরে এত ছোট ছোট ডোজে চালু হয়েছিল যে শুরুতে ধরতেই পারিনি! এখন তো করার কিছু নেই, সুতরাং “অবিশ্বাস” শব্দটাকে আপগ্রেড করে আমি তার নাম দিয়েছি “অভিজ্ঞতা”। অবিশ্বাস নিয়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না — না সম্পর্কে, না খেলার মাঠে। মিলন-বিচ্ছেদ সমান যন্ত্রণার মনে হবে, হার-জিত জিভে ঠেকবে দুভাবে রাঁধা একই পশুমাংস। অভিজ্ঞ সে-ই — যে হৃদয়ের সঙ্গে সব যোগাযোগ সফলভাবে ছিঁড়ে ফেলতে পেরেছে। তাকে এবার কেউ ঠকাক দেখি?

তবু মোপাসাঁর গল্পে মায়ের হৃদপিণ্ডের মতো মাঝে মাঝে মৃত্যুমুখী মনের গলা শুনতে পাই: তুমি প্রতারিত হওয়ার দায়িত্ব অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নিজের হাতেই তুলে নিলে বুঝি!

তিন
মানুষের ‘পরে অবিশ্বাসহেতু কেমিস্ট্রির প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া মেনে আমি জিনিস-এর ওপর নিশ্চয়তা রেখেছি। এখন আমার বাড়ি, আমার ছোট্ট মারুতি জেন আর ব্যাংকের টাকাক’টাকে ভালোবাসি। আমার ধারণা, প্রত্যেকটা বাড়িই একরকম স্মৃতিসৌধ আর এও খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করি যে জগতে শুধু স্মৃতিতোরণই অমর হওয়ার ক্ষমতা রাখে। দ্বিতীয়ত, সম্পর্কের চেয়ে গাড়ি অনেক বেশি নাইলোগ্রিপ। আর টাকা কখনও নিজের ইচ্ছেয় খরচা হয়ে যেতে পারে না। নোট তো মৃত, তাই সে সব সময় আমার মুঠোতেই থাকবে।

চার
আজকাল কোনও মেয়েকে ভালো লেগে গেলে আমি তাকে জিনিস-এ কনভার্ট করার চেষ্টা করি। মানে একটা ভূমিকা দিই, ধরা যাক, বিয়ে করে ফেলতে চাই। তাকে আমার বউয়ের চরিত্র প্রদান করলাম আর কী। প্রেমিক বা প্রেমিকার চেয়ে একজন স্ত্রী অথবা স্বামী অনেক বেশি সলিড ব্যাপার। রাষ্ট্রের আইন, কোর্ট, সবার ওপরে পুলিশ রয়েছে চরিত্রটাকে ঘনত্ব দেওয়ার জন্যে। প্রেমিক যেন অনেকখানি স্বপ্ন, তাই যেইমাত্র কেউ প্রেমে পড়ল, ওমনি বিয়ের চিন্তা মাথায় ঢুকে যায় — ভালোবাসা কী মারাত্মক ভয়ের বস্তু ভেবে দেখুন! বিয়ে হলে তবেই না আমরা একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার যুদ্ধে মেতে উঠব? যে সম্পর্কের কোনও নাম আছে — বাবা-ছেলে, বোন-ভাই, বন্ধু-বান্ধব, সেখানেই এই কাহিনি। কে কাকে সংজ্ঞায়িত করবে, কে কাকে কমিয়ে আনবে, কে প্রভু হবে কে দাস?

পাঁচ
এত কথা মনে পড়ছিল আজ বাসে চেপে পুরোনো হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তায়। না, “জেনেশুনে বিষপানের একবছর” পালন করতে আমাকে ডাকেননি কর্তৃপক্ষ। রুটিন চেকআপে যাচ্ছি — ছোটখাটো রক্ত পরীক্ষা, খুব তেমন বুঝলে একটা সাইকোমেট্রি।

ডঃ কল্যাণ বুকে স্টেথো বসিয়ে আচমকা চমকে দিলেন: আপনি আমার কাছে আসার আগে ডঃ সঞ্জয়কে দেখাতেন?

কোথায় সঞ্জয় মানে কেন সঞ্জয়.., ধরা পড়ে আমি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে উঠি।

— আমাদের দুই ব্যাচমেটের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কেসগুলো নিয়ে এখনও কথাবার্তা হয়। আপনার ব্যাপারে খুব দরকারি ইনপুট দিল, অথচ নিজে পুরোটা চেপে গেছেন!

কল্যাণ এবার স্টেথো রেখে নাকের সামনে মেটে-হাতুড়ি উঁচু করলেন: আপনার জীবনে গত কুড়ি বছর একটা স্টেডি প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, এদিকে লোকজনকে বলে বেড়ান আমি নিঃসঙ্গতায় ভুগে ভুগে ডিপ্রেশানের শিকার হয়েছি। ছিঃ!
— যাব্বাবা! বিশ্বাস করুন, এসব গুজব একেবারেই ভিত্তিহীন।
— আপনার মুখে বিশ্বাসের কথা!
একেফর্টিসেভেন হাসি সাতচল্লিশ সেকেন্ড ব্রাশ ফায়ারিং করার পর ডাক্তার আবার গলা এগিয়ে দিলেন আমার চোখের কর্নিয়ার কাছাকাছি: আরন্ট ইউ ইন লাভ উইথ ইওর আমব্রেলা?

ছয়
— হ্যাঁ, আমি ছাতা পছন্দ করি। ওর শ্যামা রঙ আমাকে মায়ের কথা মনে পড়ায়। মা সব সময় মুখনাড়া দিত, কী ছাতামাথা লিখিস! শেষ পর্যন্ত সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল, দেখুন! ও আমার জন্যে অনেক কিছু করেছে, আর আমি দুহাত পেতে নিয়েই গেলাম। আমি হারিয়ে না ফেললে ছেড়েও যায়নি কোনওদিন। আই রেসপেক্ট মাই আমব্রেলা, রোদবৃষ্টি শুধু নয়, ঝড় বা খুব গভীর জ্যোৎস্নাতেও ওর সঙ্গ ভালো লাগে আমার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি ছাতার প্রেমে পড়েছি, প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।

মুখ নিচু করে বসে থাকলাম। সৃষ্টি মানে কি উন্মোচন নয়, ক্রমাগত নিজেকে পর্দার আড়ালে নিয়ে যাওয়া? সত্যি থেকে সরে আসতে থাকা চাঁদের কলাক্ষয়ের মতো, আর তাই মনের অসুখ? চিকিৎসা মানে নিজেকে না-জেনেও জয়েসের উপন্যাসে স্টিফেন ডিডালাসের মতো হিমঠান্ডা স্বীকারোক্তিবাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো! দুরারোগ্য একা…

(পুরোনো পোস্ট)