ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

তুষারপাতের ঘ্রাণ

তুষারের গন্ধ পেলেই আমি হয়ে উঠি, বারুদময়।
রোদ দেখবো না জেনেও আকুতি রাখি, সূর্যের চরণে
আহা! বিগত পৌষ! তুমিও আমার জন্য-
রেখে গেলে না কিছু উষ্ণ হিম, কাঁথার করুণা!

আগামী চব্বিশ ঘন্টা এই নগরের সড়কে সড়কে
ঝরবে যে বরফ, কিংবা যে ঝড়োহাওয়া
উড়িয়ে নিয়ে যাবে পুরনো বৃক্ষের বাকল,
কি দিয়ে মোচন করবো তাদের দুঃখ,
অথবা কি দিয়ে বরণ করবো
স্নো-বলের জমাট বেদনা, শাদা শাদা সমুদ্রের দাগ!

তুষারপাতের আগাম সংবাদ এলেই আমি
প্রাচীন শামুকের মতো নিজেকে গুটাতে থাকি,
কিছু পাথর আমাকে ভেদ করে যায়,
কিছু পাথরকে আমি;
কাছে টানতে টানতে নতুন করে লিখি
হিমার্দ্র ঘুমের নামতা।

প্রণীত প্রান্তর

দাগ দেখে আগের মতোই সনাক্ত করতে পারি জন্মের আবাস। কিছু ভুলতৃণ
ঢেকে দিয়েছে যে ভগ্নাংশ, সেই নদীভাঙনের রাতকেও ধরে রাখি বুকের আঁচলে।
আর বলি,
চুম্বনের কামাংশ হয়েই থাক এই মরুচিহ্ন, এই প্রণীত প্রান্তর।
প্রণয়নের বীরত্ব আমার একার নয়। কিংবা আমি একা নই, এই
সমুদ্ররেখাগুলোকে জোড়া লাগাবার অংশীদার। একদা যে হ্রদে ভালাবাসার
মৃদু ঢেউ ছিল – সেই সুনিবীড় ঢেউছায়ায় গড়ে উঠেছিল পাখিদের প্রেমখতিয়ান।
আমি আজ কোনো অতীত তত্ত্বতালাশে যাবো না। আবার হাত ধরবো বলে,
যে চাঁদকে সাক্ষী মেনেছি – তার কাছেই পৌঁছে দেবো প্রণীত জলের রুহানী।

বিদ্রূপগুলো অন্যরকম

সামন্ত সমুদ্রের দিকে তাকাও
দেখবে, কিছু বাষ্প উড়ে যাচ্ছে। কিছু ফেনা,
হয়ে যাচ্ছে বিলীন। অথচ একদিন ঢেউয়ের সমান্তরালে
তারা কাঁপিয়ে তুলতো জাহাজের পাটাতন।

মাঘের কুয়াশার দিকে তাকাও। জানি তা
কোনোদিন স্পর্শ করেনি তোমার পা।
হাতে নিয়ে দেখা হয়নি মর্মর পাতার যে রেখা,
তাকাও তার দিকে। দেখবে অনেকগুলো
পথচিহ্ন একা পড়ে আছে। আর তুমি বরাবরই
অবজ্ঞা করেছো মানবকল্যাণের সেই পথ।

এবং পথের বহুবিধ আলো।
গরল ভেলকিকে আকাশ, সবসময়ই উড়িয়ে দেয় ঝড়ে ঝড়ে-
প্রকৃতির প্রতিশোধকে তুমি বিদ্রূপ ভাবতেই পারো,
কিন্তু একথাটি তো সত্য, এর আগে যারা
খুন হয়েছিল-
তারাও সেদিন কেঁদেছিল খুব।

শীতের ওজনগুচ্ছ

fog-5


অবশেষে তুমিই আমাকে
শিখিয়ে দিলে-
শীত ও ঠাণ্ডার পার্থক্য!


তোমার কাছে এলেই
আমি ক্রমশ
মাইনাস আঠারো হয়ে যাই!


মাপার যোগ্যতা না থাকার পরও
তুমি,
আমাকে বললে, নব্য ওজনদার!


জানুয়ারির এই ভোরে
দেখলে সূর্যের নিক্তি,
মনে হয় শীতের সাথেই
হয়েছে শেষ চুক্তি!


ভালোবাসি বলে
হাত বাড়িয়ে দিলেই
আমার দিকে এগিয়ে আসে
গুচ্ছ গুচ্ছ সুবর্ণ শীত।


শীতসংগ্রহের রাতে,
আমিও আছি তোমার পাশে
রাগ ভরা প্রপাতে!

চূর্ণচয়নগুচ্ছ ♥

water

কাঁথা

প্রচণ্ড শীত এলেই,
আমি পেয়ে যাই
তোমার ভেতরে ঢুকে যাওয়ার
অবাধ অধিকার।

কম্পন

হাত না ধরলেও চলে,
কিংবা না ছুঁলেও ওষ্ঠ
তবু কাঁপতে কাঁপতেই
ভুলে যাই-
নাম ভুলানো শীতের এই কষ্ট!

আঁধার

জড়াজড়ি করে থাকি
দুপুরের এই আঁধার
তবু কেন বুকের
উত্তাপ বাড়ে না!

বিকল্প

শীতের বিকল্প
তোমার বুক,
মাটি হে!
আরেকবার পাঁজর খুলে দাও।

সিঁদুর

বহুদিন দেখিনি
আগুনের ওজন,
শীতের সিঁথিতে যে
লাল,
আমি তাকেই উৎসর্গ করে যাবো
আমার জলমহাল।

ভূমিকম্পের আগে

তোমার কাঁপন দেখলেই বুঝতে পারি, কেউ
সমুদ্রে গভীর রাতে খেলেছে ঢেউখেলা। দিগন্তের
আড়মোড়া ভেঙে উঠছে পূবের সূর্য। কামকুয়াশায়
ভেজা পৌষের শেষ সন্ধ্যা- কয়েকটি রক্তজবা হাতে
অপেক্ষা করেছে আরেকটি কাঁপনের।

পৃথিবী কেঁপে উঠলে ভয় পায় মানুষ। মানুষ কেঁপে
উঠলে গোলাপ ছড়িয়ে দেয় তার প্রথম পরাগ।

পরাগায়ণের প্রথম নিশীতে- একটি উটপাখি কাঁধে
তুলে নিয়েছিল পৃথিবীর ভার। সেই পাখিটির একটি
পালক খসে পড়লেই আমাদের চারপাশে ভূমিকম্প
হয়। আমাদের প্রেমিকারা স্পর্শের বিজলীতে আবার
খুলে দেয় তাদের খোঁপার সম্ভার।

১২॥ ১২॥ ২০১২

বারোটি ফুলের কাছে জমা রেখে সবগুলো ভুল
বারোটি আকাশ থেকে তুলে আনি আলোর খোয়াব
বারোটি জোনাকী জানে তুমি-আমি করেছি যে ভাব
বারোটি কবিতা আঁকে সেই ছবি, প্রেমের সমূল।

বারোটি দূরের রেখা কাছে এসে বলে- লিখে যাই
বারোটি ঘুমের রাত আমাদের রক্তমাংস ছুঁয়ে
বারোটি বিরহী পাখি উড়ে যায়, পাতাগুলো নুয়ে
বারোটি মাসের ঢেউ ভালোবেসে বাজায় সানাই।

বারোটি কালের ছবি এ নগরে তারও বহু আগে
বারোটি নক্ষত্র থেকে খসে গিয়ে প্রেমিকার চোখে
বারোটি আগুনলাগা ভোর হয়ে- জলটুকু বুকে
বারোটি পদ্মের দেশে সাথী হয়ে দিনমান জাগে।

বারোটি গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে রবো আজ সারাক্ষণ
বারোটি উষ্ণতা নিয়ে দেবো নারী- বারোটি চুম্বন।

@
[ * কবিতাটি ১২ ডিসেম্বর ২০১২, তারিখে লেখা ]

পদচিহ্নাবলী

সে দৃশ্য আবার ফিরে আসুক। সে সমতল ভূমির মন লিখে
রাখুক নাগরী হরফে তাদের পদচিহ্নাবলী। আর যারা পদাতিক
পাতার আড়ালে বার বার লুকিয়েছে নিজেদের কৃতিদিন-স্মৃতিরাত,
প্রভাত হবার আগে জেগেছে চৈতন্যে। বনকে ভালোবেসে সেজেছে
পুষ্পে, নদীকে ভালোবেসে বয়ে গেছে নৈঋতে। দিতে কিছু মন আর
নিকষিত কালের কদম, হিজল – জারুল ফুলে সাজানো বাসরে। ফিরে এসে
বলেছে – সোহাগী আমার ! দ্যাখো এই পুষ্ট ধানদুধে আগামীর সঞ্চিত সম্ভার।

বিজয়ের জলচাদর

গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে অনুভব করি রক্তের ওম
এই চাদর গায়ে দিয়েই নদী পার হয়েছিলেন আমার
সহোদর, আমার বুকের ভেতর যে পাখি দম নেয়
প্রতিদিন, তার জন্য জমা রাখি অমর উষ্ণতা।

এই বিজয়ের ভোরে
আমি বার বার পাঠ করি সেই চাদরের ভাজ
বার বার খুলে দেখি কিছু নাম ও শিখা
যে বাতির ভেতর সাদা সলতে পুড়ে,
ঠিক তার মতোই,
জলানলে পুড়ে আমি উড়াই বিজয় পতাকা।
#

সূর্যবালার হাত

রাতের ভেতরে হারিয়ে যেতে যেতে আমি আবারো
খুঁজে ফিরি আঁধারের নিজস্ব ওম। যারা নিজেদের
সাম্রাজ্য বাড়াবে বলে খুঁড়েছে আমার ভিটে, তাদের
প্রেতাত্মা দেখে আমি হেসে উঠি। এরা একাত্তরে ঠিক
এভাবেই হেরে গিয়েছিল আমার পূর্বসূরির কাছে। রক্ত
ও রোদের নিয়ন্ত্রণে জয়ী হয়েছিল সূর্যবালার দুটি হাত।

দিনের ভেতরে হারিয়ে যেতে যেতে আমি আবারো
দেখে নিই আমার কনুই। চামড়ায় জমে আছে কালো
দাগ। হামাগুড়ি দিয়ে মারণাস্ত্র বহনের ভার। আর উত্তর
সূরীসুত্রে প্রাপ্ত গেরিলা কৌশল। সময় হলে যে পাঁজর
বিস্ফোরিত হবে যথাশীঘ্র, একান্তই আণবিক উত্তাপে।

আমি বিশ্বাস করি

আমি বিশ্বাস করি,এই বাংলার আকাশে প্রতিদিন সূর্য উঠে,
শহিদের ঘাম আর দম নিয়ে। যে গোলাপ
আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, অথবা-
যে শিশু সড়কে দাঁড়িয়ে কাঁদে, জানে সে ও,
এখানে একদিন মানুষের কান্নারও অধিকার ছিল না।

আমি বিশ্বাস করি, পিতারা যুদ্ধে গেলেই,
সন্তান দ্রোহী হয়।
মায়ের আঁচলে হাত মুছে যে মেয়ে স্ট্যানগান
তুলে নেয় কাঁধে, কোনো শক্তিই তাকে থামাতে পারে না।

জানি, যারা আমাদের এখনও অন্ধকারের
গল্প শোনান, তারা ভীরু- কাপুরুষ
তারা ভুলে যান, গুহা থেকে বেরিয়ে এখন
পথে হাঁটছেন। আর পথই মানুষকে,
মহাসড়কে পৌঁছে দেয়। গন্তব্যের নিশানা দেখায়।

আমি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসীই থেকে যাব।
এবং এই বাংলার আকাশকে বলবো,
আমি আলোর উত্তরসূরি। একাত্তরের দহন
দেখা মানুষ। আমাকে হতাশার গল্প শোনাতে এসো না।
#

নদীশাসন বিষয়ক

জীবনের গল্প লিখতে পুনরায় খুলে বসি খাতা।
গতরাতে শব্দটি নিয়ে ভেবেছি বেশ। ‘নদীশাসন’-
একধরনের পেশীবাজীর ঝলক আছে শব্দটিতে,
রাষ্ট্রশাসকের কথা শুনতে শুনতে, মনে হয়েছে
একদিন যে নদী মানুষকে শাসন করতো-
আজ সেই নদীই শাসিত হবে মানুষের হাতে,
আর মানুষ নদীতেই মিশিয়ে দেবে সকল অর্জিত বিনয়

তারপর দখলের মন্ত্র ভুলে জড়িয়ে ধরবে সেই নদীবাহু
ভালোবাসবে ঢেউ- ভালোবাসবে পলি

আবার আমরা আনন্দে আত্মহারা হতে হতে
বলবো-
তুমি খুব সুখে থাকো পদ্মা, তুমি খুব ভালো থেকো
তোমার বুকেই বড় হোক
আমাদের সবক’টি রুপোলী ইলিশ!

অষ্ট্রেলিয়া

আকাশে আকাশে মহড়া দিচ্ছে যুদ্ধবিমান।
টাইম স্কোয়ারে হাজারও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে
আমিও বলে এসেছি, যুদ্ধ নয় – শান্তি চাই
বলেছি, এই শীতার্ত দুপুরে যে মার্কিনী শিশু
ব্যানার হাতে এখানে এসেছে তার কথা পড়ুন
মাননীয় প্রেসিডেন্ট! বুঝতে চেষ্টা করুন
তার চোখের ভাষা।
.
যারা বিশ্বনীতির সর্দারি করেন, তারা আমার
মতো নিরীহ কবি’র কথা শুনবেন না জানি,
তবু আমি আমার চোখজোড়া’ কে সাক্ষী রেখে
সনাক্ত করি নিজের অশ্রু।
সিরিয়া,ইয়ামেন কিংবা কাশ্মীর থেকে-
সরিয়ে নিতে চাই দৃষ্টি!
অথবা ভারতের গ্রামে গ্রামে যারা হাত তুলে
করছেন রাজনৈতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদ-
তাকাতে চাই না তাদের দিকেও!
কী হবে তাকিয়ে আর!
.
কাঁদি,কেঁপে উঠি। অষ্ট্রেলিয়ার ঘন বনাঞ্চলে
দীর্ঘ দাবদাহে পুড়ে ছাই হয়ে আছে যে প্রাণীগুলো
সেই ছবি দেখে আঁতকে উঠি!
যে উদ্ধারকারী পুড়ন্ত ক্যাঙ্গারুর গলায় ধরে
কাঁঁদছেন, আমি পরখ করতে চেষ্টা করি
তার মুখ!
.
কাঁদি আর ভাবি…
যে সভ্যতা প্রাণীকূলকে বাঁচাতে পারে না-
যে প্রযুক্তি নেভাতে পারে না অগ্নিগিরির আগুন
তার কাছে মানুষ কতটা নিরাপদ!
তার কাছে আমি কেন চাইবো
মানবসমাজের আমূল নিরাপত্তা!
√ # ☘️

স্বপ্নের লালসুতো

২০২২ সালের প্রথম কবিতা 🌹

স্বপ্নের লালসুতো

সূর্যেরা ছায়া রেখে ডুবে যায় অন্য গ্রহে। যে পাতা
এই সূর্যকে ঢেকে রেখেছিল- সে’ও প্রকাশ্যে লিখে
রাখে আগামী পৃথিবীর স্বপ্ন! আর লালসুতো দিয়ে
মোড়া আরোগ্যের কথাবিতান!

বিশ্ব একদিন ফিরে পাবে তার সেই পুরোনো জৌলুস!
আবার মানুষ হাসবে প্রাণখুলে! আবার ভালোবেসে
ফুলের সুবাস; পাখিরা উড়বে ডালে ডালে- আর
মধ্যবয়সী নদী সংরক্ষণ করে রাখবে তার সকল
সঞ্চিত জল ও ঢেউ।

যে ঢেউ এসে ভাসিয়ে নেবে সকল বিষাদ,
যে ঝড় এসে উড়িয়ে নেবে সকল আঁধার
আমরা তারই বন্দনা গেয়ে ফিরবো নগরে-
পুনরায় সকল মানুষের শান্তির বাসগৃহ ঘিরে।

#
০১ জানুয়ারি ২০২২
নিউইয়র্ক