ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

সেফটিপিন

ছেঁড়া শাড়ির নিরাপত্তা সুরক্ষায় আরেকটি সেফটিপিন
গেঁথে দিতে চাইছেন আলপনা মিত্র,
হায়েনার রক্তাক্ত চোখ যেভাবে হরণ করতে চেয়েছিল
জলের আব্রু, তা দেখে ভয় পাচ্ছে নদীও। আর শাদাবকুল
ক্রমশ নীল হতে হতে বুকে পুষছে অনন্ত বেদনা।

আমরা যারা এতকাল বেদনাকে ভালোবাসতাম, তারাও
ঘর থেকে বের হতে ভীষণ ভয় পাচ্ছি। এই কালোরাত ঘেরা
গুমের নগরে যেন হার মানছে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ।
এ শহরে নারীর অশ্রু বার বার ভিজিয়ে দিচ্ছে তারামার্কা
দেয়াশলাই বাক্সের কাঠি। তাই দুষ্প্রাপ্য আলো ও আগুনের জন্য
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটোছুটি করছে সুবোধ শিশুরা।
ব্যাকুল তৃষ্ণায়,
জল, জল বলে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন একজন অগ্রজ।

বসন্ত, রিডিংক্লাসের জানালায়

328

বললে, চলো- আরেকবার রিডিংক্লাসে ঢুকে পড়ি!
বললাম, সঙ্গে তো আনি’নি রিডিংগ্লাস!
বললে, তাহলে শ্রুতিপাঠ হোক…
বললাম, তবে কী হিম হাওয়া ভেদ করে, এই শহরে
জেগে উঠলো বাসন্তী অশোক…

#

নিউইয়র্ক / ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সোমবার

শাস্ত্রীয় শর্তাবলী

আমি জানি শাস্ত্রীয় বৃষ্টিসমগ্র, কোনোদিনই ভেজাতে পারবে না আমাদের
পরিদেশ। কোনো ফুলের স্পর্শই এই মেঘমোগল-কে করতে পারবে না,
নতজানু। শুধুমাত্র যে বাষ্প আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবে, তারাই
পারবে দিয়ে যেতে কিছু উষ্ণতা। কিছু জমে থাকা পাথর, পারবে সরে যেতে।

ছাড় দেবার জন্য কিংবা সরে যাবার জন্য- যেদিন প্রথম নিরুদ্দেশ হয়েছিলাম,
সেদিনের কথা আজ মনে পড়ছে খুব বেশি। সেসময় আমার প্রতিবেশে কোনো
ফেসবুকার নদী ছিল না। ছিল না ডিজিটাল সূর্যের ছড়াছড়ি। এনালগ চাঁদের
সহযাত্রী হয়ে আমি যেদিন প্রথম চেয়েছিলাম সুরমার মুখের পানে, সেদিনও
আমার হাতে ছিল না কোনো নেটবুক। অথচ কয়েকটি সাদা-কালো ছবি ছিল,
আর ছিল দুচোখে শ্রাবণের লালিমা। নৌকোর উজানে ছিল একগুচ্ছ বৈঠার টান।

যৌবনের উজানপর্ব শেষ হলে বসন্তকেও বিদায় নিতে হয়। আমরা যারা পূর্ণ
জোয়ারের সাথে পাল্লা দিয়েছিলাম, তাদেরও ঘরে ফেরার ডাক পড়ে, চিত্রপুরে।

একটি গান

আমার মহল মাঝে

আমার মহল মাঝে, কে বিরাজে সখি-
নাম তার জানি না।
আমি মুদে আঁখি, বুকে রাখি
কাছে টানতে পারি না ।।

১। অনেক ছবি আত্মভোলা
অনেক কথাই হয় না বলা, গো..
জগতপতির ছলাকলা
আমার সাধন হলো না ।।

২। কোন নামে সে কোন ঠিকানায়
কাউকে হাসায়, কাউকে কাঁদায়, গো
সব কেড়ে নেয় চোখ ইশারায়
বুঝে না, প্রেম-বেদনা ।।

৩। জল-আগুনের সংমিশ্রণে
বানিয়ে পুতুল ঘরের কোণে, গো
ফকির ইলিয়াস কয় আনমনে
আমি কী তার বেগানা ।।

®
নিউইয়র্ক / ২০ জানুয়ারি ২০২৩
শুক্রবার

আরেকটি ভাঙনের আগে

দূরে থাকো। আয়ত্ব করো উৎকীর্ণ আঁধার। আর সমূল
সকালগুলোকে তুলো রাখো হাতের মুঠোয়। কেন নেই
সেই গান, কেন নেই বিন্যাসিত ক্রন্দনের বাতি; জেনে
নিতে খুলে দ্যাখো পরিশুদ্ধ মানববিধান! এখানে প্রস্থান
নেই। আছে ফেরার প্রত্যয়। তাই দূরে থাকো, ফিরবে বলে।

দূরে থাকো। দ্যাখো মনের সংসদে বসে মৌমাছিরা কি
আনন্দে সাজায় সংসার।বিন্দু ফুলের রেণু চাক বেঁধে
তুলে রাখে ঘরে। আরেকটি ভাঙনের আগে, প্রেমও জেনে
যায় তার প্রান্তপরিণাম ! নক্ষত্রের বেলা ছুঁয়ে রাত নামে
আলোর বাহুতে। তাকেও জড়ায় নদী, বিভাজিত স্রোতসমগ্রে।

চাকুরি বিষয়ক তিন নম্বর বিজ্ঞপ্তি

আমারও একটা চাকরি দরকার। ফায়ার ব্রিগেডের মেম্বারশীপ।
অগ্নি নির্বাপক হয়ে নেভাতে পারবো কিছু আগুন-
এমন নিশ্চয়তা। দমকল বাহিনীর সদস্য হিসেবে ঠিক আগুনের
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিটাতে পারবো জল। জলের পরাগ। বৃষ্টির পরমাণু।

আমারও একটা চাকরি দরকার। এ বিষয়ে দৈনিকের পাতায়
আমিও দিতে চাই আরেকটি বিজ্ঞপ্তি। কেউ না পড়ুক-
তারপরও জানাতে চাই, বেকার আছি বহুদিন।মানুষের মনের অনল
নেভাতে না পেরে যে প্রেম ভুলে যায় মানবিক ইতিবৃত্ত লিখার
কৌশল, আমি তার অধীনেই কেরাণি হতে চাই।

আমারও একটা চাকরি দরকার। মুচি’র।
পৃথিবীর জুতা সেলাইয়ের কাজটুকুই করে যেতে চাই।
তারপরও পৃথিবী যদি জুতোপায়ে একটু সবল হয়ে দাঁড়াতে পারে !

শীতের সন্ধ্যায়

হামগুড়ি দেয়া সূর্যটা প্রচণ্ড শীত গায়ে নিয়ে ডুবে গেলো।
এই নিউইয়র্ক শহর তার হাত ধরে রেখেছিল সারাদিন-
বরফ পড়ে নি। তবু হাড় কাঁপানো বাষ্পের মাঝে
আমাদের নিঃশ্বাসগুলো বার বার হচ্ছিল দ্বিখণ্ডিত।

আমরা এর আগেও অনেকবার পড়েছি খণ্ডনকাব্য
এর আগেও, শীতের রাতে বিনিময় করেছি পাঁজর
তবু যেনো মনে হয়, এমন শীত আর আসেনি কখনও
এমন মিলনের গান গায় নি কোনোদিন
পরিযায়ী সবুজ দোয়েল।

পেনড্রাইভ

জমা হয়ে আছে সূচালো দু’খের ধার। বরফে বিদ্ধ হচ্ছে
শীতের সূর্যকণা। কোথাও পুড়ছে জীবন- কোথাও
থেমে যাচ্ছে চুল্লীর আগুন, তা দেখে হাসছে চাঁদ, কাঁপছে
নক্ষত্রের সংসার।

চারপাশে ঝুলে থাকছে অনেকগুলো মহাকাল।
অনেকগুলো মৃত বসন্ত,
অনেকগুলো শাদা পাপড়ির কফিন
যারা বিদায়ী বর্ষাবরণে জলে নেমেছিল, কেবল
তারাই দেখছে এসব দৃশ্য। বাকী সবাই নজর রাখছে
তাসের পাতায়।

কয়েকটি বজ্রবিন্দু জমে আছে একটি ধাতুকুটুরিতে।
ক্রমশ উৎস খুঁজে দু’খীরা জয়ী হচ্ছে। আর সুখীরা
তাদের পরাজয়ক্রম সংরক্ষণ করছে দ্বিধার পেনড্রাইভে।

পলাশের চিতাচিহ্ন

প্রতিবেশে হায়েনা শকুন আর পরিবেশে মৃত ফসফরাস, দেহ
থেকে ঝরে যাওয়া শিশুর পাঁজর। আমি ছুঁয়ে দেখি, এই কফিনে
আমিও শুয়েছিলাম বিগত জনমে আর সিজোফ্রেনিয়া ঘেরা আকাশ
ছিল আমার সহচর। ভালোবাসা দেবে বলে কেউ আসেনি কাছে,
ডাকেনি ধরে নাম। বিধি বাম ছিল না জানি, তবু কেন এই মানব
নির্মিত বলয় ঢেকে দিয়েছিল আমার স্বপ্নদেশ। আমার সবুজ ললাট…

আমারও গন্তব্য ছিল আর ছিল বিশাল মৃত্তিকাকোষ। সে ভিটায় এখন
পলাশের চিতাচিহ্ন। সমাগত ঢেউয়ের আঘাত ভাসিয়ে নিয়ে গ্যাছে
সব। তোমাকে কি দেবো বলো ! কোন অশ্রুঅনলে পোড়াবো আমার
জমাট শোকছত্রাবলি। প্রিয় স্বজন, প্রিয় রাষ্ট্রনায়ক আমার ! এখানে
হাত দিয়ে দ্যাখো ভিয়েতনাম, কুয়েত, ইরাক, আফগান, ফিলিস্তিন সহ
তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে আমার রক্তের দাগ। আর পলাশগুলো
ফোটে আছে সেই রঙে, তুমি আসবে বলে, ধীর পায়ে এই শ্বেতাঙিনায়।

তুষারপাতের ঘ্রাণ

323

তুষারের গন্ধ পেলেই আমি হয়ে উঠি, বারুদময়।
রোদ দেখবো না জেনেও আকুতি রাখি, সূর্যের চরণে
আহা! বিগত পৌষ! তুমিও আমার জন্য-
রেখে গেলে না কিছু উষ্ণ হিম, কাঁথার করুণা!

আগামী চব্বিশ ঘন্টা এই নগরের সড়কে সড়কে
ঝরবে যে বরফ, কিংবা যে ঝড়োহাওয়া
উড়িয়ে নিয়ে যাবে পুরনো বৃক্ষের বাকল,
কি দিয়ে মোচন করবো তাদের দুঃখ,
অথবা কি দিয়ে বরণ করবো
স্নো-বলের জমাট বেদনা, শাদা শাদা সমুদ্রের দাগ!

তুষারপাতের আগাম সংবাদ এলেই আমি
প্রাচীন শামুকের মতো নিজেকে গুটাতে থাকি,
কিছু পাথর আমাকে ভেদ করে যায়,
কিছু পাথরকে আমি;
কাছে টানতে টানতে নতুন করে লিখি
হিমার্দ্র ঘুমের নামতা।

ভূমিকম্পের আগে

323

তোমার কাঁপন দেখলেই বুঝতে পারি, কেউ
সমুদ্রে গভীর রাতে খেলেছে ঢেউখেলা। দিগন্তের
আড়মোড়া ভেঙে উঠছে পূবের সূর্য। কামকুয়াশায়
ভেজা পৌষের শেষ সন্ধ্যা- কয়েকটি রক্তজবা হাতে
অপেক্ষা করেছে আরেকটি কাঁপনের।

পৃথিবী কেঁপে উঠলে ভয় পায় মানুষ। মানুষ কেঁপে
উঠলে গোলাপ ছড়িয়ে দেয় তার প্রথম পরাগ।

পরাগায়ণের প্রথম নিশীতে- একটি উটপাখি কাঁধে
তুলে নিয়েছিল পৃথিবীর ভার। সেই পাখিটির একটি
পালক খসে পড়লেই আমাদের চারপাশে ভূমিকম্প
হয়। আমাদের প্রেমিকারা স্পর্শের বিজলীতে আবার
খুলে দেয় তাদের খোঁপার সম্ভার।

বিনম্র বিষের মায়া

323

সাক্ষী দিতে গিয়ে দেখি আমার ছাউনি সরিয়ে নেয়া হয়েছে
বেশ আগে। দংশনের বিপক্ষে কথা বলার আগে, আমিই হয়েছি
দংশিত লখিন্দর। বিনম্র বিষের মায়া আঁকড়ে ধরেছে আমার
সর্বাঙ্গ।ভঙ্গ করে সকল অঙ্গীকার আমি দাঁড়িয়েছি জলের
কাটগড়ায়। বৃষ্টিতে ভিজে একটি আশ্বিন খুঁজে বার বার গিয়েছি
সমবেত শরতের কাছে। এভাবে চিনে নিতে হয়, ঠিক এভাবে
অতিক্রম করে যেতে হয় সময়ের দংশনকাল। মহাল করায়ত্ব
না-ই বা হলো। তবুয়ো নীল অমরতা এলে তাকেই দেখানো
যাবে শবদেহের মুখ। স্তরে স্তরে সাজানো প্রেমের শববৃত্তান্ত।

পরজীবী পথের প্রান্তে

যে মেঘ মেরুদণ্ডহীন উড়ে যায়, তার
কোনো গন্তব্য থাকে না। কিংবা যেজন
রাত না চিনেই খোঁজে অন্ধকারের প্রকার-
তাকে নিয়েও ভাবে না কেউ!

কিছু ছায়া মিশে যায় পরজীবী পথের প্রান্তে;
আর কিছু মানুষ রক্তরেখার ভোর
দেখেই করে উল্লাস! কেউ কেউ-
চূড়ায় আরোহন করবে বলে,
ক্রমশ ভাঙতে থাকে মোহের সিঁড়ি।

কিছু কিছু সিঁড়ি নির্মিত হয় মূলত
ছায়াগ্রহণের রাতকে স্বাগত জানাবার জন্যে।
কালের কবন্ধে এই যে চাঁদের কিরণ
তুমি দেখছো, তা গতপক্ষে বিগলিত
জোসনার অশ্রু-
যে অশ্রু দিয়ে মানুষ সাজায় নতুন
বছরে,
তার প্রেমকাননের নবম অক্ষর।

# # #
* ২০২২ সালে লেখা শেষ কবিতা

৩১ ডিসেম্বর ২০২২, নিউইয়র্ক ♪

সব দুঃখই পাখি হয়ে যায়

সব দুঃখই পাখি হয়ে যায়।সকল বেদনাই চৈতন্যের
জল হয়ে সমুদ্রে ভাসে। কোনো পরদেশী জাহাজের
পাটাতন তা ছুঁতে পারে, কখনও থেকে যায় অস্পর্শের অতল।

ঝড়গুলো বিভক্ত হয়ে প্রদক্ষিণ করে উত্তর এবং
দক্ষিণ মেরু। যারা পূর্বে থাকে, তারা তাকায় পশ্চিমে।
সূর্য ডুবলো বলে, জোনাকিরা গায়ে জড়ায় রাতের সন্ন্যাস।

দুঃখের অপর নাম সন্ন্যাস-সমুদ্র
বেদনার অন্য নাম কাকাতুয়া পাখি

যারা দুঃখ পেতে চায় না, তারা নির্বাক হাসে
যারা হাসতে ভুলে গেছে, তারা স্মরণ করতে
পারে না কান্নার সর্বনাম।

অথচ আমরা জানি,
আদম-হাওয়া একদিন কাঁদতে কাঁদতেই
পৃথিবীর পথযাত্রী হয়েছিলেন!

ইহা কোনো লিখিত অক্ষর নয়

পাথরদানার নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য থাকে না। এমন কী জলেরও, অনন্ত
জীবন পাবার থাকে না কোনো বাসনা। নদীর ঢেউ আর চোখের অশ্রুর
পার্থক্য দেখে যে চিত্রকর আঁকেন তার মূল্যবান চিত্রকর্ম, তিনি কি জানেন—
এই লিখিত অক্ষরগুলো একদিন রক্তলেখায় ব্যবহৃত হয়েছিল, এই শব্দের ফিনকি
সেরেছিল আমাদের ভালোবাসার সর্বশেষ উদ্ধার। যে কাহিনি পড়ে কেঁদেছিল
নক্ষত্রনগর— সেই মাটির বুকে এর আগেও হারিয়ে গিয়েছিল কিছু পাথর,
যাদের আকার ছিল অনেকটা অক্ষরের মতো।

ইহা কোনো লিখিত অক্ষর নয়। এই যে দেখা যাচ্ছে কালো কালো দাগ—
তা স্মৃতিমিত্র সেন-এর চোখের কাজল। কাঁদতে গিয়েই তা কাগজের বুকে
ঠাঁই নিয়েছিল। স্বভূমি ছেড়ে যাবার আগে—
এই নদীও তাকে বলেছিল, বিদায়— বন্ধু বিদায় !