ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

বিজয়ের জলচাদর

গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে অনুভব করি রক্তের ওম
এই চাদর গায়ে দিয়েই নদী পার হয়েছিলেন আমার
সহোদর, আমার বুকের ভেতর যে পাখি দম নেয়
প্রতিদিন, তার জন্য জমা রাখি অমর উষ্ণতা।

এই বিজয়ের ভোরে
আমি বার বার পাঠ করি সেই চাদরের ভাজ
বার বার খুলে দেখি কিছু নাম ও শিখা
যে বাতির ভেতর সাদা সলতে পুড়ে,
ঠিক তার মতোই,
জলানলে পুড়ে আমি উড়াই বিজয় পতাকা।

সূর্যবালার হাত

রাতের ভেতরে হারিয়ে যেতে যেতে আমি আবারো
খুঁজে ফিরি আঁধারের নিজস্ব ওম। যারা নিজেদের
সাম্রাজ্য বাড়াবে বলে খুঁড়েছে আমার ভিটে, তাদের
প্রেতাত্মা দেখে আমি হেসে উঠি। এরা একাত্তরে ঠিক
এভাবেই হেরে গিয়েছিল আমার পূর্বসূরীর কাছে। রক্ত
ও রোদের নিয়ন্ত্রণে জয়ী হয়েছিল সূর্যবালার দুটি হাত।
দিনের ভেতরে হারিয়ে যেতে যেতে আমি আবারো
দেখে নিই আমার কনুই। চামড়ায় জমে আছে কালো
দাগ। হামাগুড়ি দিয়ে মরণাস্ত্র বহনের ভার। আর উত্তর
সূরীসুত্রে প্রাপ্ত গেরিলা কৌশল। সময় হলে যে পাঁজর
বিষ্ফোরিত হবে যথাশীঘ্র, একান্তই আণবিক উত্তাপে।

বিজয়ের কবিতা: আমি বিশ্বাস করি

ima

আমি বিশ্বাস করি, এই বাংলার আকাশে প্রতিদিন সূর্য উঠে,
শহিদের ঘাম আর দম নিয়ে। যে গোলাপ
আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, অথবা-
যে শিশু সড়কে দাঁড়িয়ে কাঁদে, জানে সে ও,
এখানে একদিন মানুষের কান্নারও অধিকার ছিল না।

আমি বিশ্বাস করি, পিতারা যুদ্ধে গেলেই,
সন্তান দ্রোহী হয়।
মায়ের আঁচলে হাত মুছে যে মেয়ে স্ট্যানগান
তুলে নেয় কাঁধে, কোনো শক্তিই তাকে থামাতে পারে না।

জানি, যারা আমাদের এখনও অন্ধকারের
গল্প শোনান, তারা ভীরু- কাপুরুষ
তারা ভুলে যান, গুহা থেকে বেরিয়ে এখন
পথে হাঁটছেন। আর পথই মানুষকে,
মহাসড়কে পৌঁছে দেয়। গন্তব্যের নিশানা দেখায়।

আমি শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসীই থেকে যাব।
এবং এই বাংলার আকাশকে বলবো,
আমি আলোর উত্তরসূরি। একাত্তরের দহন
দেখা মানুষ। আমাকে হতাশার গল্প শোনাতে এসো না।

বৃষ্টিদ্রোহী

॥ক॥
নষ্ট আগুন নিয়ে কিছু লোক চলে গেল এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে। বিচ্ছিন্ন ঘাসের
কোলে ডুবে থাকা গ্রামগুলো ঘটনার সাক্ষী হয়ে লিখে রাখলো স্বরবর্ণের শোক।
প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো ক্ষমতা ছিল না বলে ভাসমান ডিঙিও মাঝির
হাত ধরে কাঁদলো পুনরায়। আমি কোনো কবি নই। তবুও পংক্তির পুনরাবৃত্তি
দেখে বৃষ্টির ঠোঁটে তুলে দিলাম কর্ণফুলীর সমস্ত জল। কানে ফুল দুলিয়ে যে
কিশোরী কবিতার জন্য সারারাত কেঁদেছিল, সে ও হেসে উঠলো ধানক্ষেতে
জোতদার কর্তৃক খোদাই করা ক্ষত দেখে। সে রাতে এই গ্রামে কেউ ঘুমোয়নি।
সবাই জেগে পাহারা দিয়েছে হলুদ ব্রিজের উত্তর-দক্ষিণ। শুধু ঘুমিয়েছিল নবীন চাঁদ।
তার সকল নির্জনতা আমাদের দিকে ঠেলে দিয়ে ভুলে যেতে চেয়েছিল
নষ্ট আগুনের খেলা। লিখতে চেয়েছিল ভাটিবোধ, মন জোড়া দেবার মজলিশি কৌশল।

॥ খ॥
যথার্থ সম্মান দিয়েই পড়ি লিখিত গানচিত্র। সুরের মালিকানায় আমার কোনো অধিকার নেই। তবুও ভাগ বসাবো বলে, হাতড়ে দেখি মেঘের তৈজস। মেঘ উড়ে
গেছে অনেক আগেই, শাদা বকের মতো পালক ফেলে সুখের বারান্দায়। আমিও পালক ভেবে কুড়িয়েছি বৃষ্টি, আর বলেছি ভিজে যাওয়া দুপুরের বিরুদ্ধেই আমার
বিদ্রোহ অমরতা পাক। কিংবা তোমাকে ভিজিয়ে দেবার মহেন্দ্রক্ষণ, সর্দি-জ্বরের
উষ্ণতায় পবিত্র হোক প্রেমের আচ্ছাদনে। ঢেকে রাখা আমার কাজ নয়, তবুও
বিভক্তির বিপরীতে বিছিয়েছি নরম উলের চাদর। চোখের ইশারায় বুঝাতে চেয়েছি,
এ নগরে বৃষ্টি যেন বারোমাস হয়। পাথরের শ্বেতশরীর, মেঘের ভ্রূণে লুকাতে লুকাতে যেন করে তোমার তালাশ। আর প্রেম-আফিম মুখে পুরে বৃষ্টিমেয়েরা
যেন বদলায় তাদের হাঁটার ভঙ্গিমা।

অনেক আলোর বিধান ঘিরে

শিশিরের সিক্ততা ছড়িয়ে হেমন্ত চলে যায়। ঘোরের
আভা নিয়ে বাঁচে যে রাখাল,তাকে তুমি বন্দি,
বলতেই পারো। অথবা লিখে রাখতে পারো-
জীবিতদের জন্যই জীবন, মৃতের জন্য- শুধু দীর্ঘশ্বাস

উত্থানের কাহিনি শুনিয়ে সূর্য ডুবে যায়। তপ্ত দুপুর
ছিল বুকের দুপাশে, তার সাক্ষী শুধুই থাকে নদী
আর প্রিয় পিপাসা- অনেক আলোর বিধান ঘিরে
রচিত রজনীগন্ধার ছায়ায় রুয়ে রাখে নিজ নাম

আমি বহুকাল থেকে জমাট হয়ে আছি- রাখালের
রক্ষিত জীবনে,কবিতার শোধবোধে পাশাপাশি
যে নিসর্গ, বেছে নিয়েছি তার দাসত্ব। আর কিছু
ঢেউয়ের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছি সেই ছায়ার প্রণাম

ভুবনপুর

ভুবনপুর ছেড়ে এসেছি অনেক আগে। এখন বসত করি নরকনগরে, পরখ
করে দেখি নক্ষত্রের চোখ, মুখ,তালু। আমাকেও যেনো দেখে কেউ কেউ, থির
সমুদ্রের ছায়ায় প্রথম যেদিন দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই দাঁড়াই। দেখে
পাখি, ভোর,ভাস্কর্য। শুধু তুমি বার বার চোখ ফিরিয়ে নাও! বাধ্যবাধকতা
নেই জেনেও আমাকে শেখাও জলখেলা। জলের বাহার আর বাষ্প হয়ে উড়ার
দক্ষতা। আমি তো দক্ষ নই। যজ্ঞ-জ্ঞানও নেই আমার। তবু কেন পরাতে চাও
এই পৈতা। কেন পড়াতে চাও ব্রক্ষ্মাণ্ডনগর !

গুহাজীবন

আমার প্রতিবেশী ছিল আলখেল্লা পরা একটুকরো রাত, ডানপাশে
কয়েকটা মাকড়শা বুনছিল তাদের স্বপ্নজাল। আর শুকনো পাতার
মর্মরে বাজছিল অনাগত দিনের দ্যোতনা, কিছু সমবেত পিঁপড়ে
খুঁড়ছিল মাটি। মাঝে মাঝে এভাবে খুঁড়ে যেতে হয় – তা আমার

আগেই জানা ছিল। কালো বন্দুকটার গায়ে হেলান দিয়ে আমি
যে মমতার স্থির চিত্র আঁকতাম, সেও থাকতো বহুদূরে কারণ
এই গুহাজীবন তার কখনোই পছন্দ ছিলো না। কেবল আমিই
একটা পালিত পাঁজর সম্বল করে বেছে নিয়েছিলাম বেদনার তৎসমপর্ব।

একদিন গুহা থেকে বেরিয়ে আমি পেলাম সে এক অন্য মানব-
জীবন ! যেখানে মানুষ মাটি খুঁড়তে জানে না। দাঁড়াতে পারে না
ভালোবাসার স্বপক্ষে। দ্বেষের দ্বিতীয়জীবন নিয়ে তারা দেশ
ছেড়ে যায় – তবু সমবেত হয় না .. হতে পারে না ..হতে পারে না।

যারা পাহারা দেয় ঝড়

আমি তোমার পরিচিত নই, সেকথার ইতিবৃত্ত
না বললেও চলবে,
তুমি আমার পরিচিত- তা বলার জন্যই এই মুক্ত
আকাশের দিকে তুলেছি আঙুল
আর বলেছি- আকাশ নগ্ন হলে রমণীর দু’চোখ
ক্রমশ জলে ভিজে যায়।

বৃষ্টি একাই মধ্যরাতে দেখে সেই জলের প্রকার
যারা পাহারা দেয় ঝড়, যারা বজ্রের চারপাশে
লিখে রাখে নিজ প্রেমিকার নাম,
পরিণত আলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি শুধু
এটুকুই বলি–
একদিন আমিও পাতার আখরে সেই নাম
লিখে রেখেছিলাম।

কয়েকটি ভোরের ইতিহাস

আমাদের আলোচনা চলছিল ঘরের সমুদ্রসীমা নিয়ে। আর কীভাবে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়বে পাতার চালায়, তা নিয়েও ভাবিত ছিলাম আমরা। তবে এভাবে ঘর বদলে বাধ্য হবো, তা কখনো কল্পনায় ছিল না।

কয়েকটি ভোরের ইতিহাস’ও এর মধ্যে পড়ে নিয়েছিলাম আমরা। সূর্য উঠে কাকে প্রথম স্পর্শ করে, কোনো পতাকা মোড়া সকালে একজন যোদ্ধাকে কীভাবে সমাহিত করা হয় এর দৃশ্যাবলি’ও খুব কাছে থেকে দেখে নিয়েছিলাম। একটি রুমাল উড়াতে উড়াতে।

পোড়া ঘর, বিচ্ছিন্ন আগুনের ঘ্রাণ রেখে যাবার পরও মানুষ সেই ভিটেয় দাঁড়ায়। কিছু পায় কী না জানি না, তবে অন্যমনস্ক হয়ে চুম্বনে সিক্ত করে কালের নজর। তারপর বদলে দেবার অথবা বদলে যাবার প্রস্তুতি নেবার জন্য মুছে দেয় জীবনের শেষ আঁধার।

কয়েকটি পাতা,
সেই আঁধারে নিজেদের মুখ দেখে।

বাঁকপ্রহরী

দাঁড়িয়েছো নিঝুম ! যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলে
ঠিক সেখানেই থাকো। সেতু পার হয়ে আমি
আসছি, তোমাকে জড়িয়ে দেবো রোদের
রেশমে, বিনীত দুপুরের নদীতে ভাসিয়ে সব
খুচরো স্মৃতিপরাগ।

দাঁড়িয়েছো নিঝুম ! আমি ও একদিন ছিলাম
এই বাঁকের প্রহরী। রাতের পর রাত, শুধুই
চেয়ে চেয়ে দেখতাম নৌকোদের চলাচল। বাতি
জ্বালিয়ে ঢেউগুলোর বিনম্র প্রস্থান।
আবার দেখা হবে। দেখা হতেই হয়। কারণ ঋতু
এবং রতি- ই চক্রবাকে, মানুষের নমস্য প্রলয়।

যুদ্ধের প্রকার

যে জনম পুনরায় খুঁজি ড্রোনসভ্যতার ভেতর-
তার কোনো চৌহদ্দি নেই। অসীম আত্মার মায়া
আমাকে শিখিয়েছে যে প্রেম,
তাকে অনেক আগেই ভাসিয়েছি বিসর্জনসন্ধ্যায়—
আর পাঁজরকে বলেছি,

যুদ্ধে না থাকলে মন ভালো থাকে না। প্রেমযুদ্ধ, অস্ত্রযুদ্ধ, অর্থযুদ্ধ,
আরও কত প্রকারের যুদ্ধ। সব যুদ্ধই দখলের। সব হত্যাই
ক্রন্দন ও ধ্বংসের প্রতিভূ …
আমি মাঠ’কেই আমার কাছে ফিরে আসতে বলি।

রক্তাক্ত প্রেমিকার মুখছবি দেখে আমি আবার তাকে
শিখিয়ে যেতে চাই আদিম খোঁপাতন্ত্র।

দ্রোহ নেই,শুধুই পাথর

নিক্ষেপ করার জন্য যে জল আমার হাতে
তুলে দিয়েছিলে, তা হয়ে গিয়েছিল শিলা।
দ্রোহের ধানে ধানে সাজাতে চেয়েছিলে যে হেমন্ত,
তা হয়ে গিয়েছিল ধূসর কার্তিকের সূর্য।

আমি সেই সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটি পলাতক
দোয়েলের চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার
অনটন, আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল
সকল উৎসব থেকে।

একদিন নদীর বুকেও অসংখ্য পাথর ভেসেছিল..
দেখেছিলে তুমি?
সবকিছু হারাতে হারাতে মানুষ যেটুকু কুড়ায়,
তার নাম পাথর
মাঝে মাঝে বসন্তকে ভেদ করে যে দমকা হাওয়া
তার নামও ঝড়।

যন্ত্রস্থ যমুনার মুখ

স্বকালকে সাজিয়ে রেখেছি বিদ্যুতপাথরে। চাইলেই ছুঁড়ে
দিতে পারি। আর পারি স্বীকার করে যেতে শান দেয়া চাঁদের
জনম। নিদ্রার নিমগাছ জড়িয়ে জেগে থাকা ভাদ্রের বিবরণ।
পারি আরো অনেক কিছুই। শোকের সংযোগ খুঁজে যে নদী
বয়ে যায় উজান, তার গতিপথ আটকে দিয়ে আমিও হতে
পারি ঝড়ের সমান। তাবৎ তীক্ষ্ণতার তিমিরে ঝলসানো মুখ
আর মৃত মুক্তোগুলোকে হাতে নিয়ে করতে পারি তাদেরও
ভাগ্য গণনা। গণক নই, তবুও দেখলেই চিনে নিতে পারি
বিশাল বৈরাগ্য ভরা পরবের প্রতিবেশী যন্ত্রস্থ যমুনার মুখ।

দেহের দূরভাষ

সবশেষে গৃহীত থেকে যায় দেহের দূরভাষ
দূরত্ব পরখ করে পাখি দেখে– এই বিকেলের গায়ে
লেপ্টে আছে আমাদের দেহধর্ম, আর উষ্ণতার
আলো জমা হতে হতে যে অতীত হয়েছে বিগত,
সেও কাছে এসে দেখায় সম্মোহন, বলে —
হে জীবন চলিষ্ণু হও, পুনরায় আঁকো চুম্বনের গতিরেখা।

এঁকে রাখো এমন কোনও গ্রহের নাম
যেখানে মৃত্যু নেই,মড়ক নেই
যেখানে প্রাণ বাঁচে বিশ্বাসে, আর ভালোবাসায়-
যেখানে দেহ দেখে আকুল নদী বলে
আমার যৌবন দেখো ঢেউ,
দেখো আমার উত্তাল কামঘোর-
কীভাবে যুগে যুগে বিলীন হয়ে যায়।

চে গুয়েভারার হাত

বিনাশী আগুন দেখো কবি। দেখো বিরাগসমগ্রের দুটি হাত।
স্ট্যানগান পড়ে আছে দূরে। গুলির আওয়াজ শুনে কাঁপতো
যে জঙ্গল তার পাখিরাও আজ সাহসী কেমন! পোড়ামেঘ
বুকে নিয়ে আকাশও কী প্রত্যয়ে মেলেছে চোখ। কত নির্মোহ
ভালোবাসায় জেগে আছে অধিকারের আলো।

বিনম্র গোলাপ দেখো কবি। দেখো হলুদ চাঁদের যৌবন
পাহারা দিচ্ছে যে সময়- তার নামই যুদ্ধ, তার নামই বাহু
প্রিয়তম জীবনের জন্য রেখে যাওয়া ভস্মের গর্বিত বিলাপ।