ফকির ইলিয়াস এর সকল পোস্ট

ফকির ইলিয়াস সম্পর্কে

কবিতা লিখি, থাকি নিউইয়র্কে।

মেঘের সাথে, মুহুর্তের সাথে

প্রতিদিন একজন মেঘভিক্ষুকের সাথে আমার
দেখা হয়। প্রতিরাতে আমাদের ডেরায় উঠে আসে
চাঁদগল্পের ছায়া। আমি চাষাবাদ জানি। তাই –
সাজিয়ে রাখি স্তরে স্তরে বিনীত কাশমৌসুম।
মেঘের সাথে মানুষের সম্পর্ক নতুন নয়। বরং
মুহুর্তের মহিমায় ডুবে থাকে যে জীবন;
সে’ ই লিখতে পারে অনন্ত উৎসের উপাখ্যান।
মেঘ তখন সেই জীবনকে দ্যুতি দিতে প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকে।

ডেকেছিলে, বাসন্তীবাদলে

তুমি আমার নাম জানতে না। জানতে না- কোথায় যেতে চাই
কিংবা বৃক্ষে হেলান দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়তে পারি-জানতে না
সেই সম্ভাবনাও। তবু ডেকেছিলে। হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলে,
কয়েক টুকরো সুরমার ঢেউ। কিংবা লেখকদের যেমন স্বপ্ন থাকে-
ঠিক তেমনি, তুমি হতে চেয়েছিলে স্বপ্নময়। কোনো এক বাসন্তীবাদলে।

আমি ফালগুণের অপেক্ষা কখনও করিনি। বরং যে চৈত্র আমার
বুক চৌচির করে গিয়েছিল-তাকেই বলেছি বসন্তের যৌবন। একক
যাত্রাপালায় কথন শুনে শুনে, আমিও হতে চেয়েছি রাজা-উজির।
ফাঁকা মাঠে নিজের ছায়া মাড়াতে মাড়াতে,
এক বিনয়ী দুপুরের কাছে হয়েছি সমর্পিত-থির।

না জানালেও পারি

মাঝে মাঝে জানান দিই আমার অস্তিত্ব। বলি, বেঁচে আছি
ভালো আছি কী না- জানি না, তবে আছি- এখনও আছি।

থাকা খুব জরুরি নয়,
ঘুম এবং ঘূর্ণির ভেতর
গদ্য এবং গন্দমের ভেতর
গহীন এবং ঘনত্বের ভেতর…

তবু চিরদিন থাকবো না বলেই, বলি-
আছি, আমিও আছি।

অনেক কথা না জানালেও পারি, অনেক
দুঃখের উষ্ণতা, না ছুঁয়ালেও পারি সমুদ্রের গায়ে
যারা প্রেমশাসিত বনের বাসিন্দা, যারা বিবাগী
পাহাড় পোষে বুকে, জানি তারা শুনতে চাইবে না
আমার অপ্রেমিক জীবনের মেঘগল্প,
তবু বলি, আছি- আমিও আছি সন্ধ্যের গল্পসভায়।

আমাকে দেখে যেভাবে কেঁদেছিল বৃষ্টির রাত

দর্শক হতে পারিনি আমি। তাই শ্রোতা হয়ে বসে পড়েছিলাম খোলা আকাশের নীচে।
আর নদীকে বলেছিলাম- তুমি বয়ে যাও, আমি স্থির থেকে যেতে চাই। নদী আমার
দিকে তাকিয়ে কেবল কেঁদেছিল। বলেছিল- তোমার দুইচোখ আমার হোক, কবি!

আমি নদীকে চোখ দুটি ধার দিতে চেয়েছিলাম। আমাকে দেখে এর আগে যেভাবে
কেঁদেছিল বৃষ্টির রাত, ঠিক সেভাবে সারারাত কেঁদেছিল এই বনবাদাড়। কিছু ঝড়
ডানায় বহন করে পাখিরা হয়েছিল নিরুদ্দেশ। কিছু ভালোবাসাহীন ছায়া আমাকে
অনুসরণ করে যেতে চেয়েছিল দ্বীপান্তরে। আর কিছু ভোর নিজেদের মৃত‌্যুদণ্ড চেয়েছিল।

আমি তখন সব পথ ভুলে গিয়ে অন্ধত্বের অধিবাস খুঁজেছিলাম। কারণ আমি জানতাম,
অন্ধ প্রাণের সকল পাপ খুব সহজেই বরণ করে নেয় আকাশ ও তার বুকের নক্ষত্রেরা।

শেখ রাসেলের কররেখা

ikh-R

বিশ্বের এই অভিযাত্রী আলোয় আরও একজন মানুষের নাম
যুক্ত হতে পারতো বড় গর্বের সাথে। আরও দুটি হাতের
কররেখা দেখে পুলকিত হতে পারতো টুঙ্গিপাড়ার আকাশ।
না- ভুল বললাম,
আলোকিত হতে পারতো এই বাংলার মাটি, বিশ্বে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি বাঙালীর রোজনামচার পাতা।

সিলিকন ভ্যালি থেকে পুরো দুনিয়ায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে যে
জ্ঞানের জ্যোতি, একজন শেখ রাসেলের চোখ ধারণ করতে
পারতো সেই ঝলক। সেই বিনয়ী চাঁদের সাথে জীবনের
গল্প বলতে বলতে একজন শিশুর জানা হয়ে যেত
মহান একাত্তর, প্রিয় বিজয়ের অমর উপাখ্যান।

পঁচাত্তরের সেই রক্তাক্ত ভোরে, জনক ও মা-ভাই হারিয়ে
আমরা যারা কেঁদেছিলাম- তাদের দাবী একটিই ছিল
এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিচার চাই। চাই এমন এক স্বদেশ,
যেখানে আমরা শোধ করতে পারবো মুজিবের রক্তঋণ।

আজকের এই বাংলায় আমি কোটি তরুণের চোখে
শেখ রাসেলের সেই স্বপ্ন দেখি। দেখি সোনার ফসলে
ভরে যায় যে বাংলাদেশ- সেই জমিনে জমিনে লুকিয়ে থাকে
তাঁর ছায়া। পদ্মা-সুরমা-যমুনার হাওয়ায় ভেসে যাওয়া নিঃশ্বাস।

আপনি সেই নিশ্বাস বহন করে চলেছেন, হে গণমানুষের নেত্রী।
তাঁর কররেখায় আপনি আঁকছেন এই প্রজন্মের জন্য
যে সবুজ সীমারেখা- তার মাঝেই জেগে উঠছে আমাদের
আস্থা ও অস্তিত্ব। জেগে উঠছে জাতির জনকের সেই শাণিত আঙুল।

সিজোফ্রেনিয়া

হাত রেখে দিয়েছি, ডিপ ফ্রিজে। বরফের মতো
আপন কিছুই নেই জেনে, ভুলে যেতে চাইছি
বিগত বিষণ্ণতা। ভোর আমার দরজার প্রহরী
ছিল বহুকাল- লিখছি এমন ঘটনার উপসংহারপর্ব।

দেখছি, মৃত মানুষগুলো হয়ে উঠছে আমার বন্ধু
আর জীবিতেরা চোখে কালো কাপড় বেঁধে
কেবল গাইছে আদিম হিংস্রতার গান।
আগুন পুড়ছে ঝরণা বুকে নিয়ে। ভালোবাসা-
বলে যে জগতে কোনো গ্রহ ছিল না- সেই
জাগতিক ব্যাসার্ধে ঝুলে থাকছে কয়েকটি হুইস্কিসন্ধ্যা।

কুসুমপুরের কুসুমগুলো, আর ঝরবে না বলে
করছে প্রতিজ্ঞা। ঝরায় বীরত্ব নেই- ঘোষণা দিয়ে
মেঘ, আকাশেই জন্ম দিচ্ছে পাথরপ্রজন্ম।

বীজ ও বর্তমান

অসমাপ্ত ছায়া রেখে বিদায় নিল চাঁদের গ্রহণ
আমি যে রাতকে আলিঙ্গন করবো বলে
এসেছিলাম নদীকূলে,
সেই নদীও আমাকে দেখালো একান্ত ভাটিতন্ত্র
একা হয়ে যাবার আগে
আমি সবিনয়ে পরখ করতে চাইলাম
আমার পদছাপ।

এই পথে হেঁটেছে এর আগেও কেউ।
এই বীজপত্রে লেগে আছে যে বৃষ্টির ফোঁটা- তা দেখে
আমি ইতিহাসকন্যার কাছে,
জাতে চাইলাম রক্ত ও রঙের
পার্থক্য। জানতে চাইলাম- আমার পূর্ববর্তী
পথিকেরা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে।

আমার সদ্যপ্রেমিকা ইতিহাসকন্যা মুখ ফিরিয়ে নিল।
বললো-
‘তুমি পঠনের পরিণাম জানো না,
চেনো না ঘটনা অতিক্রম করার অবিকল্প পথ।
যদি জানতে-
তবে চন্দ্রবীজেই খুঁজে নিতে পারতে
তোমার বর্তমান ঠিকানা।’

আমি অসহায়ের মতো আর্তনাদকেই-
লুকিয়ে রাখতে চাইলাম পাঁজরের অবিকল প্রচ্ছদে।

চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের আগে

পৃথিবীর পা থেকে এখনও খসে পড়েনি ফুলঘুঙুরের ছায়া
যারা অভিমানী রাতের সাথে কাটিয়েছিলাম যৌথবাসর,
তারা কেউই ভুলে যাইনি চন্দনের ঘ্রাণকাহিনি। তবু কেউ
যুদ্ধের দামামা বাজাবে বলে, শাণাচ্ছে সঙ্গিন। রোবটের
প্রলম্বিত পাঁজরের পাশাপাশি সাজিয়ে দীন মানুষের পাঁজর
পর্যবেক্ষণ করছে পারমাণবিক সন্ধ্যার হাসি।

কবিতার কোনো প্রতিপক্ষ নেই জেনেও, একদল মতলববাজ
লিখে রাখছে কবিতার আদলে কিছু জঙ্গল। কিছু জুয়াড়ি,
জুয়া খেলা বারণ রেখে- কাটাকুটি খেলা খেলছে সমুদ্রের সাথে।

পাহাড়ের চূড়া থেকে এখনও মুছে যায়নি মানুষের পদছাপ,
আমরা যারা অনুসরণে বিশ্বাসী- তারা সকল অন্ধকার
অস্বীকার করে দাঁড়াতে চাইছি,
একটি কালো জিরাফ শুধুই গলা বাড়াচ্ছে
আমাদের দিকে…… আমাদের দিকে।

প্রকাশিত সূর্যরাষ্ট্র

ধরো—আজ বৃষ্টি হবে না
সবপাখি ঘরে আসবে ফিরি
কেউই পথ ভুলে নদীতীরে যাবে না আর—
দুপুরের সাথে প্রকাশিত সূর্যরাষ্ট্র করবে না লুকোচুরি
কেউ দেখবে না কারও মুখ বলে,
প্রতিজ্ঞা করেছিল যারা,
ফিরে আসবে তারাও এই জলভেলা মাখা তুমুল বর্ষায়
লেনাদেনা সেরে মাঝিও নৌকোর গলুইয়ে বসে
গাইবে মহাজনী গান—
শান্ত ঢেউ যেমন মাঝে মাঝে চোখের দেখা পায়।
তুমি কি সেদিনও ছবি আঁকবে বসে এই নির্জন সূর্যের
রঙের সমাহারে—
উড়িয়ে দেবে আলো, বাঁশির ভুবনে
যেখানে কিছুই প্রকাশিত নয়—
তোমার হস্তছাপ মাখা মগ্ন অরণ্যের।

কম্পনের প্রথম পদ্ধতি

নদীটা কাঁপছে। পাশে, দাঁড়িয়ে আছো নারী
শিখে নিতে কাঁপনের প্রথম পদ্ধতি
আমি এঁকে যাচ্ছি সেই ভোরের বিনয়
আর একঝাঁক বালিহাসের উড়ার গতি……..

আঁকছি মেঘ, মোহর,আর মমির বাসর
যে বাসরে একান্তে, ডুবে থাকে রক্তজবা রাত
কিছু পাখি ঘুমিয়ে থাকে, কিছু পুষ্প
নুয়ে নুয়ে অপেক্ষায় সাজায় প্রভাত।

কখন নুয়েছো প্রথম, মনে পড়ে? কার হাত ধরে
পেরিয়েছো ঘাটবৃত্ত, পরনদী- প্রণয়ের জল
আকাশ দেখবে বলে কার ছায়া পথে পথে ফেলে
একদিন একা রাতে, সাজিয়েছো হেমন্তমহল।

আমি তো ছিলাম পাশে, সে মহলের পাহারাদার
ডাহুকীর ছবি আঁকা রুমালের, প্রণীত সুতোর বাহার।

পেরেকপাত্রে একা

আমাকে যে আপেলবাগানে নিয়ে যেতে চাইছো,
সেখানে অনেকগুলো কালো ভোমর থাকে।
আমাকে নিয়ে যেতে চাইছো যে আখক্ষেতে, সেখানে
এক মধ্যরাতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল চন্দ্রের শবদেহ
আর কয়েকটি পিঁঁপড়ে, সেই শবদেহ টেনে নিয়ে
ফেলে দিতে চেয়েছিল নদীতে।

পেরেকপাত্রে এতোদিন একা পড়েছিল আমার যে
মৃত আত্মা, তুমি তাকে দিতে চেয়েছিলে যে প্রেম-
আমি এমন ভালোবাসা কখনও চাই’নি।
অংশীদারিত্বের প্রকরণে যে হিসেব- নিকেশ থাকে,
কবিতা তার পাশে বসতি গাড়ে না,
কবি জীবনেও হতে পারে না শাসনের তাবেদার।

সৈয়দপুত্র, তোমাকে

তুমি বংশী বাজাচ্ছো নদী! তুমি গাইছো বিচ্ছেদী গান!
এখন এখানে রাত হচ্ছে,জোনাকীরা আরও কিছু আলো
দেবে বলে, লুকাচ্ছে পাতার আড়ালে।পদ্মা তার প্রণয়
সাজিয়ে প্রতীক্ষা করছে পানশীর।মাঝি এসে
ছলাৎছলাৎ শব্দে- যে ঢেউয়ে ফেলবে বৈঠার বিনয়।

তুমি নক্ষত্র সাজাচ্ছো চাঁদ! তোমাকে মধ্যমণি করে
বিলাপ কীর্তনে, মাতবে যারা- দ্যাখো, তার জন্য কারা
সাজাচ্ছে শরতের শোকপত্র।

আমি বহুদূরে দাঁড়িয়ে একটি পাখিকে….
না, বিদায় জানাচ্ছি না। বলছি, এভাবে যেতে নেই বন্ধু!
দেহেরক্ষা মানেই, প্রাণ থেকে প্রাণের বিচ্ছেদ নয়।

সাফ গেমস এ বিজয়ী নারীদের জন্য একটি গান

ima

জিতেছে আজ বাংলাদেশ,
জিতেছে বাংলার নারী
হে আকাশ আজ উল্লাস করো,
পারি আমরাও পারি॥

মুজিবের এই বাংলায় দেখো
সবুজের প্রাণে প্রাণে
জয়ের উল্লাস জাগিয়েছে আশা
প্রজন্মের কলতানে।
জয় বাংলা – হেঁকে হেঁকে উড়ে
বিজয়ী পাখিদের সারি॥

একাত্তরের চেতনায় যারা
দিয়ে গেল তাজা প্রাণ
তারাই আজ এসেছে ফিরে
করতে শক্তি দান
বিজয়ী বাংলার নারী
বিজয়ী বাংলার নারী
এসো আজ মিলিত উৎসবে মাতি
আবার হাত উঁচু করি॥

বুড়বক

এই যেমন ধরো, তুমি
সৈয়দ মুজতবা আলী’র এক-দুইটা
বই পড়তে পারছিলা।
এই যেমন ধরো,তুমি
শামসুর রাহমানের পিছে পিছে
ঘুরছিলা, শাহবাগের রাস্তায় রাস্তায়।

এই যে তুমি দুই চাইর লাইন
বাংলা লেখতে পারো,
পড়তে পারো বাংলা বর্ণমালা-
এর লাইগাই তুমি জুকারবুকে
একটা একাউন্ট খুলতে পারছ,

আর মাঝে মাঝে গালি দিতে
পারতেছ রাহমান কে,
মাঝে দাঁত বিলকাইয়া
কইতে পারতেছ,
মুজতবা কে ডা !

নয় এগারো বাইশ

usa

ওরা আমাকে তুলে নিয়ে গেল।

– তোমার বাংলা লেখা যে আমরা
পড়তে পারি, তা কি তুমি জানো?
– জানি!
বলতেই সামনে বসা একজন,
বাদামী রঙের একটি ফাইল
আমার সামনে মেলে ধরলো।
আমি পড়লাম।

– এখানে সই করো!
আমি ইতস্তত করতেই ডানে
বামে দাঁড়ানো দুজন,
কিছুটা শাসনের সুরেই বললো,
সাইন ইট!

আমার হাত কেঁপে উঠলো।
পাশের কামরা থেকে কালো
সানগ্লাস আর হাতে নীল গ্লোবস
লাগানো একজন,
বেশ কড়া সুরেই বললো,
মেক শিওর, ইউ আর নট রাইটিং
এনি থিং এলস,
এবাউট নাইন ইলেভেন!

আমি উপরের দিকে তাকাতে
চাইলাম।
দুটো ফ্লাশলাইট আমাকে অন্ধ
করে দিতে চাইলো!