জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

কুরবানির শিক্ষা

যারা ভাবো কুরবানিটা উৎসব বই অন্যকিছু নয়
তাদের ষোলআনা জীবনের ষোলআনা-ই ক্ষয়।
এই কুরবানির রয়েছে যে গৌরবময় এক গাঁথা
তাকওয়ার পরাকাষ্ঠায় নবী ইব্রাহিম হলেন মাথা।
আল্লাহর রাহে নিবেদিত তাঁর প্রিয়পুত্র ইসমাইল
ত্যাগের এই মহিমায় সুখবর দিলেন জিবরাইল।
খুশি হলো গ্রহ-তারা,ফেরেশতারা এবং আকাশ
সেই খুশিতে খোদা কুরবানির নিয়ম করেন প্রকাশ।

তবুও কিছু কিছু খারাপ লোকেতে পশু হত্যা কয়
তারা সারাবছর মাংশ খায়, সেটা কি হত্যা নয়?
জীবন, মরণ সবকিছু আল্লাহর সৃষ্টি, তাঁরই দান
তাঁর তরে যে জীবন দিবে, সে-ই হবেন মহীয়ান।
আমরা কেবল শিক্ষা নেব, নেব দীক্ষা তাকওয়ার
তবেই মোদের করবেন ক্ষমা, মহান পরওয়ার।
আজ ঘরে ঘরে বিলিয়ে দেবো, জান্নাতি সেই সুখ
তবেই অন্ধসমাজ থেকে পালিয়ে যাবে ভাই দুখ।।

ন বর্ষার জল

জল গড়ানোর মতোন ভালোবাসারাও গড়ায়
গড়াতে গড়াতে উড়ন্ত চিল হয়, দুরন্ত শকুনি হয়,
এমনকি শকুনও তাও হয়…
অতঃপর একটা সময় সেই গড়ানো থেমে যায়!
তখন জীবনটা গুলিবিহীন বন্দুকের নল হয়
আমাজানের মতো নখ-দন্তহীন বনের দাবানল হয়
নাটক, কবিতা, ছড়া এবং ক্ষেত্র বিশেষে খেসারি,
মশুর অথবা মুগ ডালের বড়াও হয়!

তবুও আমরা সবাই ভালোবাসা ছাড়া বাঁচিনা…
এই যেমন ধরুন পাখি ছাড়া আকাশ বাঁচেনা
এই যেমন ধরুন মাছ ছাড়া কোনো নদী বাঁচেনা
অথবা শিল্পী ছাড়া যেমন সুর বাঁচেনা তেমন.!
অতঃপর আচম্বিত দোল খায় কদমফুল…
আবারও একদিন শখের পাথর গড়াতে শুরু করে
বর্ষার জলের মতো গড়াতে গড়াতে শেষের শুরু হয়
মানসাংকের কিম্ভুতকিমাকার জল পাহাড় হয়
যে জলের কেবল শুরু আছে, শেষ নেই…!!

কোনো এক বিদ্রোহী কবির কথা

28467

কিছু বিনিদ্র রাত্রির খতিয়ান পৃষ্ঠা আওড়াচ্ছিলাম
তেমন কাউকে পৃষ্ঠপোষক পাইনি…. না দেনাদার
আর না পাওনাদার!
আজ কোনো তরফ থেকেই তেমন কোনো সাড়া নেই
অবশেষে সপ্তর্ষিমণ্ডলে কিছুক্ষণ নিজেকে দেখলাম….
না সেখানেও কোনো উন্মাদনা নেই!
কেবল অনেক খান্দানী আলোকবর্ষ দূরে ঘোরাফেরা
করছে গুটিকয়েক শখের আলোকচিত্র শিল্পী,
ওরা নাকি আগে আরও একবার মরেছিলো
কেন জানি না, ওরা আবারও একবার মরতে চায়..!

আবারও কোনোএক শুভক্ষণে কোনোএক বিদ্রোহী
কবির ছবি আঁকতে চায়, যে ছবিতে কোনো কথা নেই
কেবল অসমসাহসিক প্রতিবাদী চেতনার চাষ আছে।
আমরা সবাই জানি, পরনারীর প্রতি আমাদের যেমন
আসক্তি আছে, তেমনি পরপুরুষের প্রতিও কম নয়!
আমরা সবকিছু পারি..নিজেদের আখের যেমন গোছাতে পারি,
তেমনি নাক, মুখ, কান, চোখ বন্ধ করে
সবকিছু সহ্যও করতে পারি
কেবল প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারি..না
নিজেদের দাঁতের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি না…!

আমারও জল আছে

সখিনা, আমারও জল আছে, যতটুকুন জল থাকলে
নিদেনপক্ষে ডুবে মরা যায় ততোটুকুন জল আছে
তাও ভালো এইসব নাদান জলেরা ছল বুঝে না
বুঝে না মানুষের দাবারঘুটির মতোন জটিল পরিচয়
তবুও ভালো জল মানুষের মতোন দ্বিচারিণী নয়!

আমার জল আছে..যেই জলের ছায়ায় হাঙর বাঁচে
সেই জলের ছায়ায় নরখাদক কুমির আসে কাছে
তবে ওরা ক্ষিধের তাড়না পেলেই কেবল খায়
আর মানুষ… ক্ষিধের তাড়না ছাড়াও খাবলায়!

মানুষের ক্ষিধে যতোটা পেটে তারচেয়েও ঢের বেশি
মুখে, বুকে, পিঠে, হাতে, পায়ে আর যমজ চোখে..
ক্ষিধায় তাদের ক্ষিধে বাড়ে.. পোড়বাড়ির ঘাটে
এমনকি রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতির মাঠে
তবুও বানের জলের যেমন একেবারে সাদাসিধা মুখ
তেমনি…আমারও কোনো বল নেই, ছলও নেই
তবে আমার জল আছে, আছে সমাহিত জলের চোখ!

এভাবেই রাত্রি হেঁটে যায়

কেমন করে এমন লতা-গুল্ম-পাতা হয়,
কয়েকদিন বারকয়েক ইথারে কথা বলে
নিয়েছি গ্রীষ্মের চৌকাঠ, তবুও সে আকাশ
ছুঁতে পারিনি! এখন কী আর করি—?
বেরসিক সেই দিনগুলো দেয়ালে ঝুলানো
ক্যালেন্ডারের পাতায় লালকালির চুম্বন
সমেত রেখাবন্দি করে রেখেছি——!

অন্ধকার দিন সব সময় এক রকম থাকে
না, সকালের মৃত্যু হলে বিকালেই রোদের
শেকড় ভেঙে জেগে উঠে কৈবর্ত পাড়া,
সেসব ইতিহাস এক সময় নিরীহ অক্ষরের
যাদুতে কবিতার পক্তি হয়; নপুংসক অন্ধকার
তখন রাত্রির গ্রীবা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে!

এভাবেই দিন দিন প্রতিদিন
রাত্রি হেঁটে যায়, আমিও হাঁটতে থাকি!!

কেউ প্রাপ্তি স্বীকার করে না

283740

কোন্‌ দিক দিয়ে দিন যায়, কোন্‌ দিক দিয়ে
রাত যায়, কেউ গুনে রাখে না আঙুলের কড়;
তবুও তিলতিল করে গড়ে উঠে জীবন পাথর,
মাঝে মাঝে বুঁদবুঁদ ছুঁয়ে যায় স্মৃতির মিনার
অবলীলায় আমি হেসে উঠি একবার, আবার
কেঁদে উঠি আরেকবার; পালকের পর পালক
খসে খসে পড়ে, তবুও জোছনা রাতের সব
তারা গোনা হয় না!

এমনি করে দিনে দিনে কলেবর বাড়তে থাকে
জলপাই রঙ পাণ্ডুলিপি, তবুও ভুমিহীন চাষির
মতো আমারও কবিতার চাষ-বাস; তবুও অভি-
জাত বাঁধাই আর স্কেচ প্রচ্ছদ সব দীনতা কিনে
সোনালি শিকড় প্রত্যাশা করে, পেছনে পড়ে
থাকে কবিতাচাষি, তখন সব পাঠক সজোরে
তালি বাজায়, কেউ প্রাপ্তি স্বীকার করে না…!

শান্তির সংসার

28321 শান্তির সংসারে শান্তি হল আকাশের বিজলির মতোন। এই আছে এই নেই। তবুও শান্তির মনে তেমন একটা অশান্তি নেই। ছিলোও না। সে তার স্বামী নাদিমকে খুব ভালোভাবে চিনে। লোকটা মানুষ হিসাবে একেবারে মন্দ না। মনের মধ্যে কোনো জিলাপির প্যাচ নেই। ভোঁতা দা এর মতোন রাগ নেই বললেই চলে। কিন্তু কোনো কারণে হঠাৎ যদি রাগ উঠে তাহলে আর রক্ষা নেই। শান্তিকে পিটিয়ে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে মক্কা পাঠানোর যোগাড় হয়। এখন পর্যন্ত নাদিমের পিটানোতে শান্তির তিন তিনবার হাসপাতাল বাসের সৌভাগ্য হয়েছে। একবার তো একহাত এবং একপায়ের হাড্ডি ভেঙেই গিয়েছিল। সেই থেকে প্লাস্টার করানোর কতটা জ্বালা সে বেশ ভালোই বুঝে। তবুও শান্তি নাদিমের উপর ডোমিনেট করতে ছাড়ে না। অবশ্য অনেকেই তখন নাদিমের সংসার ছাড়ার জন্য শান্তিকে সুপারিশ করেছিল। শান্তি সেসব কানে নেয়নি। শান্তি বরং গর্ব ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেশী করিমনকে বলেছিল, তোরা শুধু হের ( নাদিমের) মাইরটা চোখে দেখলি; কিন্তু মাইরের পরে যে শিশুর মতোন হাউমাউ কইরা কাঁদে, আমার দুই পা ধইরা একশ একবার মাফ চায়… সেসব দেখলি না। মাইরের সময় তোরা দশ চোখ বাইর কইরা দেহস, আর অন্যসময় চোখের মধ্যে কালা গামছা প্যাচাইয়া রাহস।

শান্তির স্বামী বেচারা নাদিম ট্রাকের হেলপার। বলা যায়, সেও ট্রাকের মতোই বেপরোয়া। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই সারাদিনই খালি গায়ে থাকে। প্যান্ট পরে না, লুংগি পরে না। একটা হাফপ্যান্টেই দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টা চলে। চলতে থাকে। একবার শান্তি নাদিমের জন্য রোজার ঈদে একটা টিশার্ট কিনে এনেছিল। সেকি ভুতুড়ে কাণ্ড! সেই টিশার্ট পরার পর নাদিমের সারাশরীরে বেশুমার চুলকানি। চুলকাতে চুলকাতে দফারফা। তবুও চুলকানি আর থামে না। সেই সুযোগে শান্তিও নাদিমের শরীরে নখের আঁচড় বসিয়ে মাইরের প্রতিশোধ নেয়। কিছুক্ষণ পরে আবার আফসোসও করে। মনে মনে ভাবে, “কাজটা আমি ভালা করি নাই। তওবা… তওবা… । আর কোনোদিন এমন করুম না।”

সেই শান্তি আর নাদিমের বিয়ের আজ তের বছর। শুভ হোক আর অশুভ হোক বিবাহবার্ষিকী বটে! নাদিমের মনে আছে কিনা.. কে জানে, তবে শান্তির ঠিক ঠিক মনে আছে। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে শান্তি নাদিমকে একটা ঘুষি দিয়েছিলো। আর আজ দিবে তেরটা ঘুষি! বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের এই অভিনব পন্থাটা প্রথম দিন বুঝতে না পারলেও এখন নাদিম মনে মনে প্রস্তুত থাকে। তবে শান্তিকে বুঝতে দেয় না। এই তেরটা বছর বড় কম সময় নয়। যদিও মহাকালের হিসেবে এর কোনো ধর্তব্য নেই। সময় নিজেও একটা চোরা ফাঁদ। একেকজনের কাছে একেকরকম। সুখের সময়গুলো তাড়াতাড়ি যায় আর অ-সুখের সময়গুলো যায় না। যেতে চায় না। এ যেন নাদিমের কুচকুচে কালো শরীরের মতোন। শান্তি যতই ঘষামাজা করে, ততই কালো বের হয়। ফর্সা হয় না। অবশ্য বিবাহের প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর শান্তির খারাপ লাগে না। শান্তি জানে, এই কালো মুখই কালো ভ্রমরের মতোন…ওতেই তার বাঁচা… ওতেই তার মরা।

এখন রাত এগারোটা একত্রিশ মিনিট। আর মাত্র ঊনত্রিশ মিনিট পরেই নাদিম-শান্তির তেরতম শুভ বিবাহবার্ষিকী। এই উপলক্ষে শান্তি মাছ, মাংস, মশলা, তেল এসব কিনতে বাজারে গিয়েছিলো। এই একটা দিন অন্তত ভালো খাবার খাওয়া চাই৷ নাদিম অত্যন্ত ভোজনরসিক মানুষ। কিন্তু সাধ্য আর সাধ্যের মধ্যে কেবল গড়মিল। নইলে যে সব খাবার বড়লোকেরা প্রতিদিন খায়… নাদিম-শান্তিও সেসব খাইত। কিছুমাত্র কমতি রাখতো না। আজ বাজারে এসে জিনিসপত্রের দশ তলা উঁচু বিল্ডিং এর মতোন চড়া দাম দেখে শান্তির শরীর ঘামছিল। এখন সে বুঝতে পারছে.. নাদিমকে কিছু একটা কিনে আনতে বললে কেন সে এতো ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে, কোচর-মোচড় করে..। নাদিমের অসহায় মুখের মানচিত্রটা চোখের সামনে ভাসতেই সে দুই চোখ বন্ধ করে দিল। তবুও নাদিমকে চোখের তারা থেকে সরাতে পারলো না। সে কৃষ্ণগহবরের মতো আরও বড় হতে লাগলো। আরও বড়…!

এই যখন শান্তির অবস্থা, ঠিক তখনই দরজায় ঠাস ঠাস করে তিনবার আওয়াজ হল। এই দিগম্বর আওয়াজ শান্তির খুব পরিচিত। নাদিম এসেছে। বাসর ঘরের মতো শান্তির সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে। এই কাঁপা-কাঁপির কোনো মানে শান্তি খুঁজে পেল না। যার সাথে সুখে-দুখে তেরটা বছর… তার এই সামান্য শব্দে এইরকম অযাচিত কাঁপার কোনো মানেই হয় না। শান্তি মনে মনে লজ্জার লাগাম টানতে লাগলো। পারলো না। তবুও সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল। কী আচানক ব্যাপার! নাদিমের হাতে মাঝারি সাইজের একটা গিফট বক্স। রেপিং পেপার দিয়ে সুন্দরভাবে মোড়ানো। নাদিমের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাথে সাথেই শান্তি চোখ নামিয়ে নিলো। কালো মুখটি আরও কালো লাগছে। তার সাথে ভর করে আছে কয়েক বস্তা বিষন্নতা, হতাশা আর গ্লানি। শান্তি কিছু একটা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু সাহস পেল না। নাদিমও কিছু বলল না। গিফট বক্সটি শান্তির হাতে দিয়ে ধড়াম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত তখন ঠিক বারোটা বেজে এক মিনিট। শান্তি আকাশ-পাতাল করতে করতে গিফট বক্সটি খুলেই চমকে উঠল। একটা পুতুল। যেন সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে একটি মেয়ে। মুহুর্তেই শান্তির ধবধবে ফর্সা মুখটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সে অন্ধকারের সাথে মিশে আছে শান্তির নারী জন্মের আজন্ম হাহাকার। এই তেরো বছরেও নাদিমকে একটি সন্তান উপহার দিতে না পারার হাহাকার….!

শুভ হউক শান্তি ও নাদিমের আগামী বিবাহবার্ষিকী।।

এলিয়েনের সঙ্গে এক বিকাল

28868

এখন পড়ন্ত বিকাল। ছাদের বাগানে একা একা বসে আছে আকিব। সে পুরাতন ঢাকার একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসাবে তার সুখ্যাতি আছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, আকিবের আই কিউ অনেক বেশি। ক্লাসে টিচার যখন পড়ান, তখন সে একটি শব্দ শোনার পর পরের শব্দটি বলে দিতে পারে। একটি বাক্য শোনার পর পরের বাক্যটি বলে দিতে পারে। এজন্য ক্লাসের সকল ছাত্রছাত্রী এবং টিচার সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। খুব পছন্দ করে। তাকে নিয়ে গৌরব বোধ করে।

সেই আকিবের কাছে আজকের বিকালটা খুবই নীরস নীরস মনে হচ্ছে। প্রাণহীন লাগছে। বাসার আশেপাশে কোনো খেলার মাঠ নেই। একটু জোরে নিশ্বাস ফেলার মতোন জায়গা নাই। এমনকি রাস্তার ফুটপাত.. তাও নাই। রাস্তার মধ্যে কেবল খানাখন্দ আছে। গাদাগাদি রিকশা, ভ্যান, অটো আছে। ফলে আকিবের মতোন অনেক কোমলমতি শিশুদের আজকাল একই অবস্থা। তার উপর আকিবের স্কুলেও মাঠ নেই। ক্যাম্পাস নেই। বিল্ডিং এর উপর বিল্ডিং। এইরকম পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ভালো লাগার কথাও নয়। সে প্রজাপতির মতোন উড়তে চায়। মেঘের মতোন এদিক-সেদিক ঘুরতে চায়। রাজহাঁসের মতোন সাঁতার কাটতে চায়। কিন্তু কিছুই আর হয়ে উঠে না। যে বিকেলগুলো রঙিন হওয়ার কথাছিল, সেই বিকেলগুলো ছাদের বাগানে কাটছে। কাটাতে হচ্ছে।

এমনি মানসিক অবস্থায় আকিব কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাল। সাথে সাথে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ঠিক মাথার উপরে একটি উড়ন্ত সসার। দ্রুতবেগে তার দিকেই নেমে আসছে। আকিবের শরীরের সমস্ত লোম এক মুহুর্তেই দাঁড়িয়ে গেল। তার ভাবনার চেয়ে কম সময়ে উড়ন্ত সসারটি একেবারে তার ছাদের ঠিক উপরে চলে এলো। চোখের পলক পড়ার আগেই সসারটি থেকে একজন এলিয়েন বেরিয়ে আসলো। ভুতপ্রেতের মতোন এতো বিশাল আকারের নয়। আকিবের সমবয়সী হতে পারে। এলিয়েনটি সোজা আকিবের দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। আকিবও ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালো। করমর্দন করতে করতে এলিয়েনটি বলল, হাই… আকিব, আমি ইকুচু। নেপচুন থেকে এসেছি। তুমি কেমন আছ?
আকিব বলল, আমি খুব ভালো আছি।

ইকুচু বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছো। তুমি মোটেই ভালো নেই। তোমার মন খুউব খারাপ। একা একা ছাদের বাগানে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগে না। আমি নেপচুন থেকে তোমার উপর দৃষ্টি রাখছিলাম। কারণ তুমি আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকায় আছো। তোমার আই কিউ অত্যন্ত বেশি। আচ্ছা আকিব, তোমাদের পৃথিবীতে কি মিথ্যা বলার ট্রেনিং সেন্টার আছে?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শোনে আকিব খুব বিস্মিত হল। কিন্তু মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে জানাল, নেই।

তাহলে তোমরা এতো সুন্দর করে ইনিয়েবিনিয়ে কীভাবে মিথ্যা বল? তোমরা কি জান না, মিথ্যা বলা মহাপাপ?

আকিব বলল, সব মানুষই এটা জানে। তবুও তারা মিথ্যা বলে। কারণ মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আমিও এটা পছন্দ করি না। তবুও মাঝে মাঝে বলি। বলতে হয়।

ইকুচু বলল, মিথ্যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি… এটিও একটি বড় মিথ্যা আকিব। যাক আসল কথা বলি, আমি একটি মিশনে এসেছি। তোমাকে আমাদের নেপচুন গ্রহে নিয়ে যাওয়ার মিশন। তুমি কি স্বেচ্ছায় যাবে নাকি জোর করে নিয়ে যেতে হবে?

আকিব এবার মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু মুখের মানচিত্রে ভয়-ডর কিছুই প্রকাশ করল না। বুদ্ধি খাটাতে লাগলো। হঠাৎ তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় জেগে উঠল। আকিবকে কিছু নির্দেশনা দিলো। সে মোতাবেক আকিব বলল, তোমাদের গ্রহে তো মিথ্যার কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমি এখনো মিথ্যা মুক্ত হতে পারিনি। তবে আমি চেষ্টা করছি। যদি আমি সে চেষ্টায় সফল হতে পারি, তাহলে আমার নেপচুন যেতে আপত্তি নেই।

এমন সময় ইকুচুর স্যুটের ভেতর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ হল। আকিবও সেই আওয়াজ শুনতে পেল, কিন্তু কিছুই বোঝে উঠতে পারল না। ইকুচু বলল, হাইকমান্ড নির্দেশ দিয়েছে, তুমি এবার সঠিক বলেছ। আমরা তোমার মিথ্যা মুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমার হাতে আর সময় নেই। বাই আকিব…. বাই…

আকিবের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। তবুও ইকুচু’র দিকে হাত নেড়ে জানালো, বাই ইকুচু… বাই।।

শহর থেকে এক কবি এসেছেন

শহর থেকে এক কবি এসেছেন কতোদিন পরে,
— এতোদিন ধরে কবির বুকে ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছিলো চৈতের
চিতা, আজ আর কবিকে আটকে রাখতে পারেনি
শহরের সুনন্দ ভোগাস সৌন্দর্য; ছন্দের কাঁটাতার, শতাব্দীর লৌকিক শোভাযাত্রার ঢেউ!

এসব ছেড়ে ছুঁড়ে কবি এসেছেন, এখন তাঁর দুই হাত
খালি, তবুও কবি ভুলে গেছেন সব রিক্তের বেদন!
ভুলে গেছেন রাজপথের ক্লান্তি, এগারসিন্ধুর নামীয় আন্তঃনগর লোকাল ট্রেনের ঝকঝক শব্দ..যানজটে,
ট্রেনজটে আঁটকে পড়া, নাকাল হওয়া স্পর্ধিত বর্ধিত
সময়..এই সব কিছু কবি এখন ভুলে গেছেন!

আসতে আসতে কবির মনে যতিবিহীন কতো কথা
মূর্খ আকাশকে সাক্ষী রেখে কবির কতো কী ভাবালুতা
আজ তিনি শিক্ষিত –অশিক্ষিত, আবাদী-অনাবাদী জমিতে হাঁটবেন….
কাউনের মিহি দানা আঙুলে ঘষে নাকে শুঁকবেন
দুইহাত ভরে বুনোফুল, করমচা ছিঁড়ে কোঁচর ভরবেন
ধানক্ষেতের আলপথে হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত হবেন
তখন বয়সী বটের ছায়ায় বসে মান্দারের কাঁটা গুনবেন
অতঃপর ঝাঁসির নদীতে যতোক্ষণ না সর্দি নামে
ততোক্ষণ একটার পর একটা পানকৌড়ি ডুব দিবেন!

তারপর গোগ্রাসে গিলে খাবেন মায়ের হাতে রান্না
একসেদ্ধ বিরই ধানের ধোঁয়াওড়া ভাত,
কাঁচা লংকার সাথে মলা-ঢেলার চর্চরী, কলমি শাক, সজনে পাতার ঝাল ফ্রাই… ইত্যাদি!

অবশেষে কবি হতাশ হলেন। কবির নলিনের বিল নেই,
দইয়ার খাল নেই শিমূলের ছায়ায় বেঁচে থাকা পোড়া
বাড়িটি নেই, বেতের কাঁটা নেই আজন্ম খেলার সাথী
মাঠ নেই, ঝোপ-ঝাড় কিছুই নেই
কেবল ছনের ঘরের বদলে কবির শহরের মতোন ইট-পাথর-সুরকি আছে….
কবির শহরের মতোন প্রাণহীন কিছু মানুষ আছে!!

একজন কাপুরুষ কবির আত্মকথন

যখনই একটা সার্থক কবিতা লিখতে চেয়েছি
তখনই কোনো না কোনো অজানা ভয় এসে
আমার দু’হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে!
অথবা ক্ষুধার্ত বাঘের মতো নখ বিস্তার করে
আমার গলা টিপে ধরতে চেয়েছে; হাত, পা, বুক,
মুখ, চোখ কাঁপতে কাঁপতে আমি তখন আছি
কি নেই…. কিছুই জানিনা!

আমি জানি আমার মতো কাপুরুষ কোনোদিন
কবি হতে পারেনা….কোনোদিন না!
যে কবির সত্য লিখতে বুকের পাটা ধুঁকধুঁক করে
যে কবি কারো রোষানলে পড়ার ভয় পায়
যে কবি জেলের ভাত খাওয়ার ভয় পায়
যে কবি বউয়ের চোখ রাঙানির ভয় পায়
যে কবির সমাজের পুটি, বোয়াল মাছ..সবকিছুতে
এতো কাড়িকাড়ি ভয়, বস্তা বস্তা রাস্তা ভরা ভয়;
সে আর যা-ই কিছু হোক, সে কবি নয়!!

যে আমি স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় উপমা দিয়ে, অলংকার
দিয়ে, অনুপ্রাস দিয়ে দিবালাকের মতো জলজ্যান্ত
সত্যকে আড়াল করে দিই; সহজ, সরল বক্তব্যকে
কেবল রক্তচক্ষুর ভয়ে দুর্বোধ্য করে তুলি…..
আমি জানি, সেই কাপুরুষ আমার কবি হওয়ার
কোনো অধিকারই নেই!!

আমি এও জানি, তবুও আমার কবিতা লেখা চলবে
কিছু শখের খরিদ্দারের বাহবা ও হয়ত মিলবে…
কিন্তু সত্যকে আড়াল করা, ছাইপাঁশ দিয়ে আগুন ঢাকা
এসব কবিতা কোনোদিনই সার্বজনীন হবে না!!

বধির জলের মুখ

এখন আমরা সবাই শামুক অথবা ঝিনুক
হাত নেই, পা নেই, মুখ নেই..তীর নেই, নেই ধনুক;
আছে কেবল শামুকের মতো, ঝিনুকের মতো
শক্ত খোলসবন্দী পিঠ আর মৃতপ্রায় বুক!

যে বুকে কবরের মতো সুনশান নীরবতা আছে
আছে দীঘল দীঘির বন্দিজল.. যেখানে জমাট
আছে কেবল অপরিশোধিত কালের কোলাহল…
তবুও কোনো সাড়া নেই, নেই কোনো আওয়াজ;
কেবল প্রান্তরে প্রান্তরে শোনা যায় লোনাজলের
অলীক কুচকাওয়াজ!

এভাবেই চলুক… চলতে থাকুক মৃতপ্রায় নদী
পথের উপর চাপা পড়তে থাকুক পথের দাবী…
নিয়ত আর নিয়তি কোনোকালে কখনও এক
হয় যদি… সেদিন আমিও আরশিতে দেখবো
বধির জলের মুখ…
যেখানে একদিন মুখ থুবড়ে পড়েছিলো
অগণিত পাঠকের মৃতপ্রায় বুকের ধুঁকধুক..!!

আমার শহরে রাত নামে না

আমার শহরে এখন আর জলের কোরাস শুনি না..
কেবল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ভেসে আসা দূর পাহাড়ের
নিঃশব্দ কান্না শুনি! আচানক…
আমার সবকিছু বাসি হয় ভাত, তরকারি, শিকারি
কাবাব; কেবল ইট-পাথরের রোদন বাসি হয় না;
আমার শহরে সকল পাখির সাক্ষাৎ বোধন হয়
কেবল আমার মতোন কিছু দ্বিপদীর বোধন হয় না!

এখানে মানুষ জাগ দেওয়া পাটের আঁটির মতোন
গাদাগাদি…এখানে কেবল সাড়ম্বরে ভোর হয়
এরপর আর নৈঃশব্দের বিহারী রাত নামে না…!
অতঃপর রাতের মোড়কে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে
দিন পা থেকে মাথা–কেউ ঘুমায়, কেউ ঘুমায় না;
ফুটপাত, রেলস্টেশন, অথবা খাড়া ব্রিজের উপরে
তবুও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে অচিন্ত্যপুরের মতি
এখানে কোনোরকমে মরে বেঁচে থাকে আহ্নিকগতি!

এ জীবনের অবশিষ্ট দেনা

রোজ রোজ যদি কবিতা কবিতাকে গিলে খায়
ঊষর পড়ে থাকে হেমন্তের রাত, আঘ্রাণের গন্ধ
শুঁকতে শুকতারা এসে বারবার ফিরে যায়, তবে
কিভাবে হবে কবিতার চাষ? সৈকতে এসে ভিড়
করে সমুদ্রের সফেদ লোনা, মৃণালকাঁটায় পাস্তুরিত
হয় এ জীবনের অবশিষ্ট দেনা!

শহরের ট্রামগুলোর মতোন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যায়,
বিস্ময় ডেকে আনে এইসব অনাহূত ছায়াদিন,
তবুও ভেতরের আমি জেগে উঠে না; কপালের
বলিরেখায় পোয়াতি হয় এ জগতের চিন্তারাশি,
তবুও আমার মনে হয় আমি তোমায় ভালোবাসি!

কেউ প্রাপ্তি স্বীকার করে না

কোন্‌ দিক দিয়ে দিন যায়, কোন্‌ দিক দিয়ে
রাত যায়, কেউ গুনে রাখে না আঙুলের কড়;
তবুও তিলতিল করে গড়ে উঠে জীবন পাথর,
মাঝে মাঝে বুঁদবুঁদ ছুঁয়ে যায় স্মৃতির মিনার
অবলীলায় আমি হেসে উঠি একবার, আবার
কেঁদে উঠি আরেকবার; পালকের পর পালক
খসে খসে পড়ে, তবুও জোছনা রাতের সব
তারা গোনা হয় না!

এমনি করে দিনে দিনে কলেবর বাড়তে থাকে
জলপাই রঙ পাণ্ডুলিপি, তবুও ভুমিহীন চাষির
মতো আমারও কবিতার চাষ-বাস; তবুও অভি-
জাত বাঁধাই আর স্কেচ প্রচ্ছদ সব দীনতা কিনে
সোনালি শিকড় প্রত্যাশা করে, পেছনে পড়ে
থাকে কবিতাচাষি, তখন সব পাঠক সজোরে
তালি বাজায়, কেউ প্রাপ্তি স্বীকার করে না..!

আট-কপালেদের কথা বলি

আজকাল সবখানে বান্ডিল অফারের ছড়াছড়ি দেখি
আর মনে মনে গাছ-পাথর কষি
সবাই জানে ঠুনকো আঘাতেই ভেঙে যায় রোহিঙ্গা চাঁদ
তবে কি বান্ডিল অফারের সবগুলোই নিছক ফাঁদ?

ডানা ছাড়াই যত্রতত্র কতো কতো পাখি ওড়ে
ওড়তে ওড়তে সাত-সমুদ্দুর তেরকাদা আসে ঘুরে
কেবল মানুষ হওয়ার কেউ বান্ডিল অফার দেয় না
সবাই নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র উঁচিয়ে এগিয়ে আসে
যতটা ভালোবাসার এরচেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে!

একটা নিরাক পড়া সময় দুই হাত দশ হাত হয়
দশমিক ভগ্নাংশও বাক দেওয়া উঠতি বুদ্ধিজীবীর
মতোন কথা কয়; তখন হাওয়া লাগে পালে
আমিও বান্দানাছোড় এরই নাম দিয়েছি আট-কপালে!!