জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

জলপুরুষ

আমার দুই চোখে একটাই কবোষ্ণ নদী আছে
ঝরনার মতোন চপল, শব্দের মতো চঞ্চল;
দীঘির শান্ত জল তাকে খুউব খুউব হিংসে করে
যখন কলকল শব্দের ঢেউ তোলে জলপুরুষ,
রাংতার কাজল হয় দোভাষী প্রেম! তখনও
আমি চেয়ে দেখি দু’পাড়ের খামাখা ভাঙন
আমি চেয়ে দেখি মাথার উপর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত
আর ঝড়ো হাওয়ায় উড়িনোকিছুটা উন্মাদ জল!

এখানে কেউ মুদ্রিত বাতাস কিনতে আসে না
সকলেই হাঁসফাঁস করে, একবার বাঁচে…,
আর একবার মরে দুদণ্ডের অতিথি! তবুও
চেনা পথ স্বয়ং বারবার পথ আগলে দাঁড়ায়
চয়নিকা জীবন এসবের তোয়াক্কা করে না!

ভুল আর ভ্রান্তি একসাথে আমার ছায়াসঙ্গী হয়
তবুও আমরা কেউ থামাতে পারি না তাকে
তখনও যাযাবর সময়ের অনুসঙ্গী হয় অবুঝ হাত
জল শহরের ভাঙাপথ মাড়িয়ে চলতেই থাকে!

তন্ত্রর-মন্ত্রর

তবুও ভাবি ট্যারাচোখ তুলে কিছু আলো আসবে…
নিদানকালে সমস্ত আকাশ-পাতাল দু’হাতে তুলে
আমায় ভালোবাসবে!

ছিন্নশেকড় যে তৃণলতা ছন্নছাড়া বাতাসে ভাসে
যে পাগল সারাদিন একলা একলা মুচকি হাসে
তারেও তো
কেউ না কেউ কোনো না কোনোদিন ভালোবাসে!

আমি কিছু অপ্রকাশিত মূক পঙক্তির কথা বলছি
কবি হওয়ার মতো
এমনি কিছু অজাতশত্রু দুঃস্বপ্নের কথা বলছি!

তবুও….
রাত গভীরে কবিতা নামের অবলা মেয়েটিকে ভাবি
ভাঙা ভাঙা হাতে জাতেওঠা শব্দদের কথা ভাবি!

তবুও কিছু কেউটে সময় উড়ু মনে কেটে যায় দাগ
যেই পৃথিবীর জনগণ কেবল মন্ত্র বুঝে,
তন্ত্র বুঝে না
সেই পৃথিবীর মাটিতে কি ফুটে না ফুলের পরাগ?

জনশুমারি

জানো, অনেক অনেক.. অনেকদিন পর দেখি
মনের ভেতর হঠাৎ দুরন্ত উল্কা ঝড়
চলন্ত সেতুটি দৈবাৎ ভেঙে গেলো
কে জানে না.. ভাঙা সম্পর্ক মানেই কবর!

সবাই জানে কতোদিন পর একটা জনশুমারি হলো
কেবল গণনা হল না… কে মানুষ আর কে অমানুষ
গল্প, ছড়া, কবিতা..ওরাও আসলে কিছু নয়
কেবলই বেদনার বেদীতে লুকানো ফানুস!

তবুও কিছু কিছু স্বঘোষিত চটকদার বিজ্ঞাপন
কিংবা বিলবোর্ডে ছাপা হয় মৃত কালো অক্ষর
সম্পর্ক নামক শাবকটির ইতিকথা লিখে রাখে
বাংলা ব্যঞ্জণের প্রায় সকল অবোধ যুক্তাক্ষর!!

তৃতীয় প্রহর

এমন রাত, যেখানে প্রতিটা স্বপ্নই অধরা থেকে যায়
মাকড়শার জালবন্দি পিলপিল জীবন কেবল কানাঘুষা
করে, দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপ থেকে কোনোভাবেই বেরুতে
পারি না, পুতুল নাচের মুদ্রাও ভুলে যাই; ভুলে যাই
কাগজে-কলমে চিত্রিত আটপৌরে রাতের তৃতীয় প্রহর!

তবুও আশায় বুক বাঁধে কিছু অবরুদ্ধ উল্লাস, কোনো
রকমে বেঁচে থাকা স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়,
কিছুতেই কিছু হয় না, কেবল কিছু বাঁক বদল হয়, আর
আমি নির্বাক ইতিহাস হই; তবুও সহাস্যে টিপ দেই
জোড়া নক্ষত্রের কপাল, যদি কোনোদিন ফেরে আমার
চাতাল, দু’হাতে গ্রীবা জড়িয়ে আদর করে!
আচ্ছা, তোমরাই বলো, হতে পারে না জীবনের কোনো
আক্ষরিক অনুবাদ? তাহলে এইসব মৃত স্বপ্নের প্রসব
থেকে বেশ বড়ো বাঁচা বেঁচে যেতাম!!

পুঁজিবাদী অভিশাপ

আগে মাঝে মাঝে একটানায় পড়তাম….
এখন দু’টানা, তিনটানায় পড়ি….
বাগবিধিতে শাখের করাতের কথা যেমন আছে
তেমনি আছে দু’মুখো সাপ;
অথচ আজকে ঘন্টা ছাড়াই যেভাবে ছুটি হচ্ছে
এ সব আসলে পুঁজিবাদের জ্যান্ত অভিশাপ!

অবশ্য সবকিছুকে অভিশাপ বলে উড়িয়ে
দেওয়ার মতো মহাজ্ঞানীও আমি নই;
আমি চাই ছাত্র, শিক্ষক সবার হাতে কেবল
থাকুক….খাতা, কলম, বই আর বই…!!

ডিকশনারি ঘেঁটে শাপ, অভিশাপ এবং সাপ
শব্দত্রয়ীকে কেটে বাদ দেওয়া হউক
যেমন করে আমরা দারিদ্র্য জয় করেছি
যেমন করে আমরা মহাকাশ জয় করেছি
তেমন করেই পুঁজিবাদী অভিশাপও জয় হউক!!

বন্যার জল হতে ইচ্ছে করে

আধো আধো ভাঙা জলধোয়া রাস্তায় অনেকটা প্রহর
কেটে গেলো আজ, কোথাও কোনো অসঙ্গতি নেই!
সত্তরের দশকের একটা জারুল গাছ সেও দেখলাম
সেও বেশ আছে, একজন তালপুকুর তার কাছে পাওনা
চাইতে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে,
তালপুকুর জানে ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে;
সেদিকে জারুলের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সে বেশ আছে!

এতো বড়ো হয়েছে, এতো বড়ো বড়ো বুলি আওড়াতে
শিখেছে.. তবুও সে মানুষ হতে শেখেনি!
আর একজন জারুলের ছায়াসঙ্গিনী, বেশ কবিতা লিখে
তুকতাক যাদুটোনাও তার ভালোই জানা আছে
কেবল নাগরিক মন বন্যার জলের মতো ছেড়ে দিয়েছে
সেখানে একবার ইবলিশের ছায়া দেখা যায়
আরেকবার হস্তিনী এসে কায়া সমেত ঘুরে যায়…
তখন আমারও সে বন্যার জল হতে খুব খুব ইচ্ছে করে!

বৃত্তের বাইরে

যা কিছু নশ্বর তাতেই আমি বারবার নিজেকে খুঁজি
উদয়াস্ত, তাতেই আমি — তাতেই আমার সমস্ত জীবন চক্র;
অথচ–কতো সহজেই দিন রাতকে পরিত্যাগ
করে যায়…. এই যেমন
কতো সহজেই রাত দিনকে পরিত্যাগ করে যায়!

তবুও আমি কেবল পারি না আমাকে ছেড়ে যেতে
আমি কেবল পারি না বৃত্তের বাইরে পা ফেলতে
আমি কেবল পারি না নিয়ন্ত্রণ রেখা ছুঁড়ে ফেলতে!
অথচ আমি কতো কিছু জানি—-
জন্মবেলা যেমন জানি, তেমনি জানি মৃত্যুবেলাও
জন্ম এবং মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এই উপত্যকা তাও !!

তবুও আমি মান কিনি, আত্মসম্মান কিনি..
যতটা পারি কুঁড়িয়ে নিই সম্পদ, নারী আর সম্পত্তি
জানি এরা কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না
এরা কোনোদিন আটকাতে পারবে বা বিপত্তি!
তবুও এই নকল আমি কতোকিছু বুঝি নামি-দামি
কেবলই বুঝতে চাই না বৃত্তের বাইরের কে আমি..!!

তবুও আমি আমাদের ভাগ্যবান বলি

হিসাবের কড়িকাঠ সামান্য একটু বেসামাল হলেই…
যখন জলে আগুন জ্বলে; তখন ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো
কিছুকিছু শব্দও টিপ্পনীর মতোন করে কথা বলে!

আলহামদুলিল্লাহ.. আমি ছাতিম গাছের তলায় যেদিন
প্রথম পুরোদস্তুর একটা রাজপথ ঘুমাতে দেখেছিলাম
পাতাঝরার শব্দে শেষবার যেদিন শুনেছিলাম কবি
থেকে রাজপুত্র হয়ে উঠার সারস গল্প; আমার জানা
মতে, সেদিনের পর আর কোনো চাঁদ পোয়াতি হয়নি!

আর আজকাল হিসাব ছাড়াই আমরা চামড়ার
গায়ে বিবস্র সভ্যতার সীলমোহর এঁকে দিতে পারি
জলের ভেতরে জলের কবর কোদাই করতে পারি
রাজপথ থেকে মেঠোপথ…… এদের সবাইকে
একই সারিতে, একই বৈঠকে গণকবর দিতে পারি.!!

আমি জানি, আমরা সবাই আমড়া কাঠের ঢেঁকি
তবুও আমি আমাদের বড়ো ভাগ্যবান বলি…..
কারণ আমরা সবকিছু ভুলতে যেমন শিখে গেছি
তেমনি আমরা সবকিছু সহ্য করতেও শিখে গেছি!!

জলের সাতকাহন

আজ আর কোনো দীনতা যেমন নেই তেমনি কোনো
দৈন্যও নেই; অবশ্য এও একপ্রকার মানসিক ব্যাধি
শব্দের মারপ্যাঁচে নিজেকে এড়িয়ে যাওয়া, পরাজয়ের
বৃত্তে আটকে থেকেও বিজয়ী হওয়ার ভান করা!
দিনদিন সবকিছুর ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রের জল; আরও বাড়ছে
যে সব মানুষের হাত, পা, বুক, পেট থেকেও নেই…
সেইসব অভাগাদের, হতভাগাদের ক্ষুধার অনল…!

কেবল বাড়ছে না আমাদের ত্যাগ, উদ্বেগ….
তবু্ও আমরা ভালো আছি ; যেমন ভালো থাকে শুকনো
মৌসুমের নদী; যেমন ভালো আছে ও, এবং, কিন্তু, যদি!
আমরাও এখন ওদের মতোন অব্যাহত অব্যয়….
ওদের যেমন কোনো ঝরা নেই, ক্ষয় নেই, ব্যাধি নেই
আমাদেরও তেমনি মুখ আছে, কেবল মুখের ভাষা নেই
আমাদেরও দুঃখ আছে, কেবল দুঃখের অনুভূতি নেই!

আমি বিশ্বাস করি, এরপর আর কবিতায় বলার মতোন
তেমন কিছু থাকতে নেই; জল কিছুদিন কানামাছি
খেলবে, কিছু মুখ জলটুপটুপ কথা বলবে….এরপর
আবার সড়কপথে রাজহাঁস পতপত করে উড়বে…!!

তৃতীয় প্রহর

এমন রাত, যেখানে প্রতিটা স্বপ্নই অধরা থেকে যায়
মাকড়শার জালবন্দি পিলপিল জীবন কেবল কানাঘুষা
করে, দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপ থেকে কোনোভাবেই বেরুতে
পারি না, পুতুল নাচের মুদ্রাও ভুলে যাই; ভুলে যাই
কাগজে-কলমে চিত্রিত আটপৌরে রাতের তৃতীয় প্রহর!

তবুও আশায় বুক বাঁধে কিছু অবরুদ্ধ উল্লাস, কোনো
রকমে বেঁচে থাকা স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়,
কিছুতেই কিছু হয় না, কেবল কিছু বাঁক বদল হয়, আর
আমি নির্বাক ইতিহাস হই; তবুও সহাস্যে টিপ দেই
জোড়া নক্ষত্রের কপাল, যদি কোনোদিন ফেরে আমার
চাতাল, দু’হাতে গ্রীবা জড়িয়ে আদর করে!
আচ্ছা, তোমরাই বলো, হতে পারে না জীবনের কোনো
আক্ষরিক অনুবাদ? তাহলে এইসব মৃত স্বপ্নের প্রসব
থেকে বেশ বড়ো বাঁচা বেঁচে যেতাম!!

তেঁতুলগাছের ভুত

2880 উজাড় বাড়ি আসলে উজাড় নয়। একটা সময় গভীর জংগলে ছাওয়া ছিল। এই বাড়ির নাম শোনামাত্রই এখনও মানুষের গা ছমছম করে। যদিও আগের মতোন ঝোপ-ঝাড় এখন আর নেই। তবে এখনো যে পরিমাণ গাছগাছালি আছে, তাও একেবারে কম নয়। বিশেষ করে নাম না জানা কয়েকটি বড় বড় গাছ। এদের ডালপালাগুলোও এতো বিশাল যে, মাঝারি আকারের গাছের চেয়ে বড়। এখনো এই উজাড় বাড়িতে এমন কয়েকটি জায়গা আছে, যেখানে সূর্যের আলো-কেও অনেক কষ্ট করে প্রবেশ করতে হয়। সেই উজাড় বাড়ির উত্তর পাশে একটি তেঁতুলগাছ আছে। ইয়া বড়সড়। সেই তেঁতুলগাছের তলায় একটা ধানী জমি। সেই জমিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ডাকসই খেলে। মাগরিবের আজান হলেই যে যার বাড়িতে ফিরে যায়।

প্রতিদিনের মতোন আজও সবাই সেখানে খেলাধুলা করছে। তাদের আনন্দের যেন আর সীমা নাই। কখন যে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি। এমন সময় তেঁতুলগাছের ভেতর থেকে একটি আচানক আওয়াজ বেরিয়ে এলো। আর সেই আওয়াজটা হল, তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…! এই ভয়ংকর কথা গুলো সবার আগে যার কানে ঢুকল, তার নাম ঐশী। ঐশী তখন চিৎকার করে বলল, সবাই খেলা বন্ধ কর। আমি তেতুলগাছের ভেতর একটি ভয়ানক আওয়াজ শুনেছি। সাথে সাথে সবাই খেলা বন্ধ করে ঐশীকে ঘিরে ধরে বলল, তুমি কি শুনেছ.. তাড়াতাড়ি বল। আমাদের আর তর সইছে না। এমন সময় আরো জোরসে সেই আওয়াজটি আবার স্পষ্ট শোনা গেলো।

তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…!

ইউশা বলল, এটা নিশ্চয়ই ভুতের গলার আওয়াজ। আমি ইউটিউবে ভুতের গল্প শুনেছি। একদম সেইরকম কন্ঠস্বর। ভুতেরা সব সময় কাঁপাকাঁপা গলায় কথা বলে। এখানে আর থাকা ঠিক হবে না। সবাই চল… আমরা বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু ছোট্ট মেয়ে আরশি বলল, আমি ওসব ভুতপ্রেত এ বিশ্বাস করি না। বাবা বলেছেন, ভুত বলতে আসলে কিছুই নেই। ওরা কেবল গল্পেই থাকে, বাস্তবে থাকে না। আরশির কথায় সায় জানিয়ে পড়শি বলল, এটাই সঠিক কথা। আমিও শুনেছি। তখন ইউশা বলল, তাহলে তোমরা থাক, আমি চলে গেলাম। এই বলে ইউশা বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। এমন সময় ঐশী বলল, চলো আমরা দাদাভাইকে নিয়ে আসি। দাদাভাই অনেক জ্ঞানী আর সাহসী মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই এই রহস্যের একটা কিনারা করতে পারবেন। সবাই তখন সমস্বরে বলল, সেটাই ভালো হবে। সবাই চলো..চলো..। যাওয়ার সময় সবাই আবার শুনতে পেলো, তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…!

যাক অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ঐশীর দাদাভাই আবদুল হামিদ সাহেবকে নিয়ে ফিরে আসলো। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সবকিছু শোনে ঐশীর দাদাভাই জিজ্ঞেস করলেন, আওয়াজটা কি তেঁতুলগাছের কাণ্ড থেকে এসেছে নাকি শাখা-প্রশাখা থেকে? অন্য কেউ জবাব দেওয়ার আগেই আরশি বলল, আমার যতটা মনে হয়েছে আওয়াজটা তেঁতুলগাছের গোড়ার দিক থেকেই এসেছে। আরশির কথা শেষ হতে না হতেই আবার সেই আওয়াজটি শোনা গেলো। এখন আরও স্পষ্ট এবং পরিষ্কার। তেতুল.. তেতুল.. তেতুল বড় টক রে, তোদের সবাইকে চিবিয়ে খেতে আমার বড় শখ রে…! ঐশীর দাদাভাই বললেন, কোনো সমস্যা নেই। আমি সবকিছু বুঝতে পেরেছি। তেঁতুলগাছের গোড়ার দিকে একটা বিশাল গুহা আছে। সেখান থেকেই আওয়াজটা এসেছে। ঐশী আমার টর্চলাইটটা দাও তো বোন। ঐশী দাদাভাইয়ের হাতে টর্চলাইটটি দিয়ে মনে মনে গৌরব বোধ করলো।

সাথে সাথে শুরু হয়ে গেলো তেঁতুলগাছের ভুত ধরার এ্যাকশন। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারপাশে সুনশান নীরবতা। সবাই বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে তেঁতুলগাছের সেই গুহাটার মুখের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঐশীর দাদাভাই সাথে সাথে গুহার ভেতরে টর্চ জ্বালিয়েই হেসে উঠলেন। বললেন, আরে… সাজিদ যে! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয় বলছি। সাজিদ ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে এলো। মাটির দিকে মুখ। সবাই হা হা করে হাসতে লাগলো। ঐশীর দাদাভাই বললেন, সাজিদ কাজটা তুমি ভালো করনি। ভয় দেখানো দুষ্টু ভালো মানুষের কাজ নয়। তাছাড়া এসব গাছের গুহার ভেতরে বিষধর সাপ থাকে। আর কোনোদিন এমন কাজ করো না। সাজিদ মুখে কিছু বলল না, কেবল মাথা নেড়ে সায় জানালো।

আমার চোখে শ্রাবণ নেমেছে

আজ দেখি শ্রাবণের হাতে কৈলাস থেকে উঠে আসা
বোধিবৃক্ষের বাঁশি, সাগর বেষ্টিত রাজকন্যার দুই হাতে
ভালোবাসার মায়া কাজল!
সে এক অনন্য নজির কাব্য অঙ্গনে ছড়িয়ে দিয়েছে!

সে আমার সাথে সারাদিন একটিও কথা বললো না…
অথচ কথার যেনো কোনো শেষ নেই!
হাতের ইশারায়, চোখের ভাষায় দ্বীপ রাষ্ট্রটির সমস্ত
সাদা পায়রা জল যেনো মেঘের মতো আমার মাথার
উপর দিয়ে শামিয়ানার মতোন টাঙ্গিয়ে রেখেছে!
যেনো হাজার বছর পর বনলতার মতো কেউ এসে
আমার দু’হাত ছুঁয়ে দিয়েছে!

এখন আর আমার চোখ খোলার কোন দরকার নেই
বাতাসের স্পর্শেই বলে দিতে পারি জলকন্যার দুচোখের
পাতা আমায় ছুঁয়ে নিয়েছে!
অনেকদিন পর আবার আমার দু’চোখে শ্রাবণ নেমেছে!

খসড়া জলের দাগ

2950

কবিতারা আর কবে গণমুখী হবে…?
যেভাবে রাস্তার ধারে ভাঁপ-ওঠা পিঠারা গণমুখী হয়
যেভাবে সাত-সকালে কাঁচাবাজার গণমুখী হয়
ঠিক ঠিক সেভাবে…।

সময়ের মৃত শরীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ মশা-মাছি ওড়ে
কাব্যের কালো অক্ষরগুলো কাব্য থেকে বেশ দূরে
তবুও কপালকুণ্ডলারা খিলখিল হাসে
মোটাদাগে খসড়া জলের দাগ ভালোবাসে
এভাবেই একদিন মরাগাঙে চির ধরে
তবুও ওরা চিরদিন একসাথে বাঁচে একসাথে-মরে!

ডাংগুলি খেলার দিন

2873 ছোট্র বন্ধুরা, আজ তোমাদের একটি গল্প শোনাবো। গল্পটি তোমাদের স্মৃতির পাহাড়ে বেড়াতে সাহায্য করবে। হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি সম্পর্কে তোমরা বিশেষভাবে জানতে পারবে। তাহলে চলো, গল্পটি শোনা যাক। অনেক অনেকদিন পর আমজাদ সাহেব পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। গ্রামে এসে ইউশা, ঐশী এবং আরশির আনন্দ আর ধরে না। উনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় থাকেন। একটি কারখানায় উচ্চ পদে মোটা বেতনে চাকুরি করেন। বলা যায়, একজন ছেলে, দুইমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে তার সুখের সংসার। সমস্যা একটাই কারখানায় প্রচুর কাজের চাপ থাকে। মালিক পক্ষ ছুটি দেয় না। ছুটি দিতে চায় না। সেইজন্য আমজাদ সাহেবেরও আর গ্রামে যাওয়া হয়ে উঠে না। এবার অনেক বলে-কয়ে পাঁচ দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়েছেন।

আমজাদ সাহেবের গ্রামের বাড়ি অত্যন্ত মনোরম। চারপাশে সবুজে ঘেরা। সারি সারি সুপারি আর নারকেল গাছ। এদের ফাঁকে ফাঁকে আম, জাম, লিচু, কাঁঠালসহ অন্যান্য সকল ফলবান গাছ। এখন মধুমাস৷ প্রতিটি গাছেই থোকা থোকা ফল ঝুলছে। কোনটা পাকা, কোনটা আধাপাকা আর কোনটা কাঁচা। এইসব ফল খেতে গাছে গাছে পাখপাখালির মেলা। কিচিরমিচির আওয়াজ শুনতে কার না ভালো লাগে! এমনি মনোহর পরিবেশে আমজাদ সাহেব দুপুরের খাবার শেষে বাহির বাড়িতে মাদুর পেতে বসে আছেন। বাবার পাশেই বসে আছে আরশি, ঐশী, ইউশা। বিকেল সবেমাত্র শুরু হয়েছে। আমজাদ সাহেব যখন বাপ-দাদাদের স্মৃতি রোমন্থন করা শুরু করেছেন, তখনই দল বেঁধে আসল পাড়ার সকল ছেলেমেয়ে। তাদের হাতে ক্রিকেট খেলার বল আর ব্যাট। নিমিষেই তারা দু’দলে ভাগ হয়ে খেলা শুরু করে দিল। ইউশাও তাদের সাথে খেলায় যোগ দিল। যারা খেলছে না, তাদের প্রায় সবার হাতে হাতে মোবাইল। কেউ গেমস খেলছে আর কেউ ফেসবুক, ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাদের যেন দুনিয়ার কোনো খেয়াল নাই। আমজাদ সাহেব আপন মনে প্রিয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হঠাৎ কী মনে করে সবাইকে কাছে ডাকলেন।

আমজাদ সাহেবকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ছোট হউক কিংবা বড় হউক এভাবে সবার সামনে বসে বসে কথা বলা সমীচীন হবে না। এই ভেবে তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, বাবুরা তোমরা কী কী খেলা খেলতে পছন্দ কর?

সবাই সমস্বরে জবাব দিল, আমরা বছরের বেশির ভাগ সময় ক্রিকেট খেলি। তবে বর্ষাকালে ফুটবল আর শীতকালে ব্যাডবিন্টন খেলি।

আমজাদ সাহেব ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, আমরা তোমাদের বয়সে কি খেলতাম, তা কি তোমরা জান?
সবাই মাথা নেড়ে জবাব দিল, জী না।
আমজাদ সাহেব আবার বললেন, আমরা ডাংগুলি, বউচি, কানামাছি, ডাকসই, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, হা ডু ডু এসব খেলতাম।

আমজাদ সাহেবের কথা শোনে ছেলেমেয়েরা সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। ভাবখানা এমন যে, তারা কোনোদিন এসব খেলার নামই শোনেনি। বিষয়টি বুঝতে পেরে আরশি বলল, বাবা আমার মনে হয় ওরা এসব খেলে না।

আমজাদ সাহেব বললেন, বুঝতে পেরেছি মা আরশি। আর বাবুরা সবাই শোন, তোমরা ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেল… আমার তাতে আপত্তি নেই। তবে মনে রেখো এগুলো আমাদের দেশীয় খেলা নয়। এগুলো বিদেশি খেলা। আমি যে খেলাগুলোর নাম বললাম সেগুলো হল আমাদের দেশীয় খেলা। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। তোমরা যদি আমাদের নিজ দেশের খেলাগুলো না খেল, তাহলে তো সেগুলো হারিয়ে যাবে। কিন্তু সেসব খেলা কে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমরা দেশ-কে যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাদের দেশীয় খেলা। তোমরা কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?

সবাই মাথা নেড়ে সায় জানালো। কেবল সাজিদ নামের একজন ছেলে বলল, আমরা এসব খেলতে জানি না।

আমজাদ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, এ বিষয়ে তোমরা কোনো চিন্তা করো না। আমি যে কয়দিন বাড়িতে আছি, প্রতিদিন বিকেল বেলা আমি তোমাদেরকে সেসব খেলা শেখাবো। শুধু তাই নয়; আমি তোমাদের সাথে খেলবোও৷ তবে আরও একটি কথা এখন থেকে তোমরা কেউ মোবাইলে গেম খেলতে পারবে না। কি সবাই রাজি তো?

আমজাদ সাহেবের কথা শোনে সবাই খুব খুশি হল। করতালির মাধ্যমে সবাই উল্লাস প্রকাশ করলো।

ফিঙের বাসা

ঝিঙে গাছে ফিঙের বাসা
লতায় পাতায় ছাওয়া
দালান নয় কোটাও নয়
এটাই পরম পাওয়া।

খড়কুটোয়, পাতা-লতায়
বেঁধেছে আপন ঘর
নিজের ঘরে সবাই স্বাধীন
নাই যে কোনো ডর।

তবুও একদিন এলো ঝড়
তার কী ভীষণ মতি
ফিঙেরা সবাই দিশেহারা
দেখে ঝড়ের গতি।

কালবৈশাখী এমনি রকম
কোন দয়া মায়া নাই
যেদিকে খুশি ভেঙে চুরে
হাতির মতোন যায়।।