জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

মায়ের কাছে ছেলের খোলা চিঠি

2811a

মাগো,
সালাম নিও। খুব জানতে করে তুমি কেমন আছ? কতদিন গেছে, কত রাত যাচ্ছে… একের পর এক সূর্য পূব আকাশে উঠছে আর পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছে। এ বিশ্বচরাচরের সবকিছু কোনো না কোনোভাবে চলছে…. চলে যাচ্ছে। কোনোকিছুই থেমে থাকছে না, কেবল থেমে আছে আমি। তোমাকে দেখতে যেতে না পারার অসহ্য কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে জড়িয়ে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, দেহে তবুও আমি রোজ রাতে ঘুমাই। ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়ার আগে কেবলই তোমার মুখ চেয়ে থাকি। মনে মনে তোমার মুখোমুখি বসি। তোমার কোলে আধশোয়া হই। আমার চোখে, মুখে, চুলে তোমার কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করি।

জানো মা, এই প্রবাস জীবনে আমি যতবার খেতে বসেছি, একবারও তৃপ্তি সহকারে খেতে পারিনি। কীভাবে তৃপ্তি পাব মা, তোমার হাতের রান্না যে একবার খেয়েছে… সেকি তা কোনোদিন ভুলতে পারবে? পারবে না। আমিও পারিনি। থানকুনি পাতার সাথে শিং মাছের ঝুল, মলা, ঢেলার চর্চরি, মিষ্টি কুমড়ার ফুলের বড়া, সজনে পাতার ফ্রাই, কলমি শাক… এসবের কথা মনে হলে এখনো আমার জিবে জল চলে আসে। ইচ্ছেঘোড়াটা লাগাম ছিঁড়ে তোমার কাছে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু পারে না।

জানো মা, এখানে এই মরুভুমির জীবন আমার মোটেই ভালো লাগে না। আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই। যতদুর চোখ যায় কেবল বালুকারাশি। মাঝে মাঝে খেজুর গাছ। থোকা থোকা খেজুর ঝুলছে। খাওয়ার কেউ নেই। মাঝে মাঝে সরকারি গাড়ি আসে, খেজুর নিয়ে যায়। এই নিঃশব্দ মরুভূমিতে আমরা ক’জন বাঙালি প্রবাসি একসাথে থাকি মা। মরুভূমির জাহাজ নামে বিখ্যাত উট চড়াই। তুমি শোনে খুশি হবে, আমরা একজন আরেকজনের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করি। একজন হাসলে সবাই হাসি, একজন কাঁদলে সবাই কাঁদি!

তুমি বলো মা… এমনটা কি হওয়ার কথা ছিলো? তুমি আর বাবা শরীরের রক্ত পানি আমাকে উচ্চ শিক্ষিত করেছিলে। আমাকে ঘিরে তোমাদের চোখে কত রঙিন স্বপ্ন ছিল। আমি সরকারি চাকুরি করব, মাস শেষে মোটা মাইনে পাব… আমাদের সংসারে আর কোনো দুঃখ থাকবে না। অথচ অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! অসংখ্য চাকুরির পরীক্ষায় প্রথম হয়েও স্বদেশে আমার ভাগ্যে চাকুরী জুটলো না। দালানের খপ্পরে পড়ে সেই আমি এখন সৌদি আরবের মরুভূমিতে উটের রাখাল।

জানি মা, আমার বকবক শোনতে শোনতে এতক্ষণে নিশ্চয়ই তোমার কান্না পাচ্ছে। তোমার পায়ে পড়ি মা, দুঃখ করো না। এতো কষ্টের মাঝেও আমি আল্লাহর রহমতে, তোমাদের দোয়ায় এই ভেবে ভালো আছি যে, প্রতি মাসে দেশের জন্য সামান্য হলেও কিছু রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছি। আমার জন্য দোয়া করো। কদমবুসি নিও।

ইতি
তোমার সৌদি প্রবাসী আদরের সন্তান
অচল ওরফে জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

দ্রাবিড় জীবন

এখন দিন কেমন বদলে গেছে, পোকা-মাকড়ের
ঘর বিলাস; একটা চিকেন গ্রিল ধরে সারাদিন সাড়া
গেছে, মধ্যবর্তী বধ্যভুমি তবুও ফিরে পেয়েছে
কিছু উন্মাদ বৃষ্টি, হয়ত সেও বড়ো কম কথা নয়;
কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে পেয়েছিলো দ্রাবিড়
জীবন; মনে মনে আজন্ম নিঃস্ব এই আমিও এখন
নির্বিকার চেয়ে দেখি পোড়ামাটির ক্যালিওগ্রাফি!

এমনি করেই বেশ চলছে উইপোকা জীবন, নির্মোহ
যাতনার রেশ এখনও জয় করতে পারিনি; অপারগ
বাস্তবতা মানসাঙ্কের জল পাহাড় ডিঙাতে পারে না,
তবু্ও ব্রাত্য জীবন শ্রুতি, বিশ্রুতি আর অভিশ্রুতির
উপনিবেশ, মন জানে না… তবুও মনে মনে করে
যাই দ্রাবিড় জীবনেই মনোনিবেশ……!!!

অনাগত বসন্তের হাট

একদিন পথ যেখানেই পেতে দেবে নোঙর..
সেখানেই আমার ঠিকানা, অতঃপর সেখান
থেকেই আবার শুরু হবে নতুন স্বপ্ন বোনা;
জালি লাউয়ের মাচা বেয়ে একদিন অংকুর
হবে ময়না, টিয়া; বসবে ফুল ও ফসলের
বাসর; রচিত হবে মেদহীন নতুন সভ্যতার
ছায়াপথ, পাখির কাকলিতে মুখরিত হবে
উজান গাঁয়ের মেঠোপথ, সবুজের রোদে
মাখামাখি হবে কবিতার মাঠ, পথ-ঘাট কথা
বলবে অনাগত বসন্তের হাট…!

যখন এই দুর্দিনে বসে লেখা আমার কবিতা
গুলো ফেরি হবে নিশ্চিন্তপুর; পক্তিতে পক্তিতে
মেতে উঠবে নিঝুমদ্বীপ, তখন এই কুক্ষণে
লেখা যত্তো সব দুর্বাসা মুনি তারাও পালানোর
কোনো পথ পাবে না….. তবে কি সেদিন
অবরুদ্ধ বোধের দরজায় কড়া নাড়বে রোদ্দুর
নাকি আমার দুরগামী চোখ তখনও সমুদ্দুর?

একজন ঋণগ্রস্ত কবির কথা

একজন আজন্ম ঋণগ্রস্ত অসহায় কবির কথা বলি
তাঁর ছেঁড়া পকেটের ভাংগা পকেট ঘড়িটার কথা বলি
যে কবি জন্মের কাছে চিরঋণী তাঁর কথা বলি
যে কবি সুবেহ সাদিকের কাছে ঋণী, তাঁব কথা বলি!

যে কবি মেঠোপথে নতোমুখে বিকারহীন হাঁটেন….
পিপঁড়ের মতোন নিরবে- নিঃশব্দে হাঁটতেই থাকেন..
হাঁটতে হাঁটতে মাটির সোঁদাগন্ধ গায়ে মাখেন
আমি সেই বাহুল্য কবির আজন্ম শব্দঋণের কথা বলি!

কবিতার জন্য যে কবি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকেন
সজনে পাতার নগদানগদি সবুজ চোখে মাখেন
সমাহিত জলে যে কবি প্রিয় স্বদেশের ছবি আঁকেন
আসন্ন ঈদে যে কবির নতুন জামা কেনার খেমতা নেই
আমি সেই কবির আজন্ম বাক্যঋণের কথা বলি!

যে কবি মাটিতে হাঁটতে হাঁটতে আকাশে ওড়তে থাকেন
যে কবি পদদলিত পিঁপড়ের কথা ভাবতে ভাবতে
প্রলেতারিয়াতদের কথা ভাবেন….. ভাবতেই থাকেন
যে কবি তাঁর কবিতায় গণমানুষের মুখচ্ছবি আঁকেন
আমি সেই নিরীহ কবির অনাদায়ী ঋণের কথা বলি!

নির্বাসিত কবির নির্বাচিত কবিতা

যখন মেঘের কান টেনে বৃষ্টি নামিয়ে আনে মঙ্গার
পোড়া কপাল, তখন উত্তরে বাতাস কেউকেটা হয়
আরশ্রাবণের জল মিছেমিছি চলে যায় বানপ্রস্থ,
কবি তখন কলম মুখে রাংসার বুকের দিকে তাকিয়ে
সে বুকে আজ আর কোনো আব্রু নেই…কেবল
মুখরা রমণীর মতোন ঝাঁঝালো নিঃশ্বাস আছে!

অথচ একদিন কবি রাংসার জল হতে চেয়েছিলেন
হতে চেয়েছিলেন জয়নুল, পিকাসো, কামরুল…আর
বিশাল আয়োজন করে নেমতন্নও করেন লিওনার্দো;
শরতের কাশফুলগুলো কবি আর কবিতার সব ভুল
ভেঙে দিয়েছিলো; অথচ কী আশ্চর্য!
সেই কবি-ই এখন স্বেচ্ছা নির্বাসিত!
কবির সাথে সাথে নির্বাসিত কাশফুল, রাংসার জল!

যেমন করে ধরণীর বর্ধিষ্ণু উত্তাপ অহর্নিশি কানাকানি
করে, দোর্দণ্ড প্রতাপে কামনা বাসনার সকল অঞ্জলি
হাসতে হাসতে মিটিয়ে নেয় ধুবলার চর…
যেমন করে পৃথিবীর সব বরফ গলা নদী কিনে নেয়
বুকের জমিন, কবিও তেমন করে নির্বাচিত কবিতার
পসরা সাজাতে চান; কোমেনের মতো আচানক বিদ্রোহ
করে বসে কবির শব্দের নদী, কবির কথা শোনে না
কবির কান!! নিরুপায় কবি ঠিক তখনই স্বেচ্ছা নির্বাসন চান….!! আর
তাঁর নির্বাচিত কবিতাও বন্যার জলে ভেঙে খানখান!

এপার-ওপার

আজকাল ভাবনাদের সিংহভাগই প্রতিবন্ধী…..
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেও যায়!
অথর্ব জলের মতো আমি কেবল তাকিয়ে থাকি
দেখি একবার আসা আর একবার যাওয়া….
অথচ একদিন ভেবেছিলাম সবকিছু ভেঙেচুরে
হবেই হবে… হতেই হবে হাতের দশ আঙুল পাওয়া!

খেলা তো কম হয়নি, বেলাও পেকেছে অঢেল
হিসাবের খাতাটা খুলে দেখি এখনও গাছে কাঁঠাল
আর গোঁফে তেল!
তবুও বসে থাকেনি দিন-মাস-বছর, কতোবার যে
তিতো হয়েছে ভূতের আছর; তবু চলছে তথাকথিত
করোনার কাল– এখনও কেউ কেউ আঙুল ফুলে
তালগাছ হয়, আর কেউ হয় পুরনো কংকাল..!!

তবুও গজব আর গুজবে সয়লাব বাজার.. রাজা
হউক অথবা ভিক্ষুক হোক মহাকালের কাছে সবাই
সমান; যে দু’দন্ড সময় এখনো হাতে আঁকা আছে
যতটা পারো অপর পৃষ্ঠায় দাগিয়ে নাও কামান!

ঈদ আনন্দ

যদিও করোনাকাল, তবুও থামবেনা কোনোকিছু
রোজকার মতোন সূর্য হাসবে, চাঁদও নেবে পিছু
কালের ছায়ায় ছাওয়া মেপল পাতারাও হবে খুশি
গুটিগুটি পায়ে আমরাও যাবো ঈদগাহে. বলবো
ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সাম্য খুব খুব ভালোবাসি..!

দ্রাবিড় জীবন আজও ভুলিনি, পরাজিত হবেই
এই করোনাকাল, মুক্ত জীবনে আবারও ফিরব
সাথী হবেই জারি, সারি, ভাটিয়াল!
বিলিয়ে দেবো ঈদ আনন্দ, ভাসবো আনন্দলোক
সবার মুখে ফুটুক হাসি, দীপ্ত হউক সবার চোখ।।

বাজারে তেল নাই

কবিতার কথা মনে হলেই বুকের ভেতর ধুঁক করে উঠে
বলা নেই, কওয়া নেই এমনি নিরুদ্দেশ হয় কেউ …
তবুও জেগে থাকি … জেগে থাকে অসম রাত্রির ঢেউ!

সে আসবে বলেই কিনা জানি না পাস্তুরিত হয় অন্ধকার
সমস্ত রাজপথ জুড়ে শামুক হাঁটে
সমস্ত কানাগলিতে হাঁটে কচ্ছপ
কেবল বুঝতে পারি না কোনটা কার, কোনটা আকার
তবুও সবকিছুতেই বাদ সাধে দুঃখী সখিনার হাহাকার!

আমিও আজকাল বাজির দরে শব্দ পোড়াই
সানকি পাড়া কাঁচাবাজারে নুন কিনতে টাকা ওড়াই …
অথচ হররোজ কতো কতো ঘুড়ি আকাশে উড়ে
শব্দের যতই যোগাড় দিই না কেন … বাক্য তবুও দূরে …!

আসলে এসব উড়ো কথার তেমন একটা মানে নাই …
বাজারে তেল নাই … তবুও অনেকেই কবিতায় তেল চায়!

আরশি মনির ঈদ

27911

আজ খুশিতে ফিঙে নাচে
নাচে রে বুলবুল
আরশি মনি ঈদে যাবে
চড়বে যে দুলদুল।

একটি মাসের সাওম শেষে
করবে খুশির ঈদ
এই খুশিতে দু’চোখ থেকে
হারিয়ে গেলো নিদ।

বাবুই দোয়েল ওরাও খুশি
করবে কোলাকুলি
আজকে যে আর নেই ভেদ
মুটে, মজুর, কুলি।

আজকে সবাই গাইব গান
সাম্য, সাম্য বলি
কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে
সরল পথে চলি।।

পালানোর কোনো পথ নাই

ভালোবাসার নামে আজকাল কোনো কিছুই আর নাজায়েজ নেই… এই
যেমন তেমন কবিতা, গল্প, নাটক কিংবা নাটিকা
বিশ্বাস পাস্তুরিত হওয়ার আগেই মাটি পুড়ে যায়
পুড়ে যায় আকাশগঙ্গা…
নক্ষত্ররাত চন্দ্রবিন্দুবৎ পাহাড়িকায় এসে কেঁদে
কুটে আগুন হয়
এরপর আর পালানোর কোনো পথ খুঁজে পায় না!

পৃথিবীর সমস্ত দেনা নিমিষেই মাটি হয় অঙ্কুরোদগম
আহাজারি গুলো জমাট বাঁধে চক্রবৃদ্ধিহার
পরিশেষে কিছু দহনবায়ু পরিযায়ী হয় বন্ধ্যা সড়ক
লাওয়ারিশ কিছু কুকুর ঘেউ ঘেউ করে নাজাতের আশায়
সমৃদ্ধ আতশবাজি কেবল সম্মুখীন সমুদ্রের ফেনা
বাড়ায়!

সারবাঁধা শামুক সারঙ ওরাও ওরাংওটাং হতে চায়
এই শতাব্দীর কাছ ঘেঁষে মুখস্ত পড়ে থাকে কাঁঁচবালি
হৃদয়, ভালোবাসারা ছাইপাঁশের মতো বাতাসি হয়
কেউ নাগাল পায়, আর কেউ পায় না!

গম্ভীরাটা অনেককাল গম্ভীর হয়ে আছে মাকুর প্রদেশ
সুর ছাপিয়ে এখন সুরা-ই সুরাটের সম্রাট
সবাই ছেঁড়া দ্বীপে নঞর্থক ভালোবাসার খুঁজে আসে
খুজলি-প্যাচরা ওরা যেভাবে পড়ে আছে সেভাবেই
পড়ে থাক… থাক…? জীবন থেকে যারা পালিয়ে
বাঁচতে চান, তাদের জানা উচিত… আরে মশাই
পালাবেন কোথায়? পালানোর কোনো পথ নাই.. !!

ইচ্ছেবমি

অতঃপর আমি আর কবিতার মায়াজালে বন্দি না .
ভালোবাসার কবিতা, প্রেমের কবিতা, অভিমান
অথবা বিরহের নামতা…….কোনোটারই না!

তবুও ওরা লোমশ বুকের ভেতর তোলপাড় করে
খটাখট শব্দের আচানক ঢেউ তুলে
পাহাড়ি ঝর্ণার মতোন নিয়ত কান্নার সুর তুলে
তবুও আমি আমার কবিতার কথা গিয়েছি ভুলে!

অতঃপর….
আমি আবার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির কথা ভাবি
জীবনের গল্পটা ধুয়ে-মুছে নতুনের কথা ভাবি
মুখ থুবড়ে কাঁহাতক পড়ে থাকা কাকবন্ধ্যা সময়কে
অঞ্জলি ভরে জলাঞ্জলি দেওয়ার কথা ভাবি!

অতঃপর আমি মুখভর্তি ইচ্ছাবমির কথাও ভাবি
তবুও বের হয়ে যাক পাকস্থলীর সমস্ত অশিষ্ট
শব্দ পোড়া গন্ধে ছাই হোক যত সব উচ্ছিষ্ট…!!

তবু্ও জাগুক ধরা

আট মাস পর চলো একটা অচল কবিতা লিখি
বেড়িবাঁধ ভাঙা আগুন জলে যেভাবে
ডুবে মরেছে কৃষকের বৈশাখ… যেভাবে ডুবতে
ডুবতে খেই হারিয়েছে লকলকে পুঁইশাক
চলো সেভাবেই কেটে দিই অশুভ কবিতার ঝাঁক!

তবুও কেটে যাক এই মরার খরা….
কালবৈশাখী হলে হোক… তবুও জাগুক ধরা!

শুদ্ধ শব্দে… নিপাত যাক গুড়ুম গুড়ুম বজ্রপাত
চলো… এই বৈশাখে সব ভুলে যাই… ভুলে যাই
আকাঙ্খা, আসক্তি, যোগ্যতার জাতপাত….!!

কালবোশেখী

tanzi

আমরা খুশি বোশেখ মাস
বাংলায় নববর্ষ
ছেলে-বুড়ো, খোকাখুকি
সবার একই হর্ষ।

গ্রামে গ্রামে জমছে মেলা
বাউল গাইছে গান
একতারা আর দোতারাতে
প্রাণ যে পায় তান।

বোশেখ এলে কালবোশেখী
ক্ষিপ্র বেগে আসে
গাছের ডালে পাখির বাসা
জীবন বুঝি নাশে।

তাইতো ওরা কুঁকড়ে থাকে
মনে বড়ই ডর
ওদের মতোন ভয়ে তারাও
যাদের কাঁচাঘর।।

গল্পের রুপালি রুপান্তর

হাঁটতে হাঁটতে যখন উড়তে থাকি তখন ভাবি
এ আর এমন কী? মশা ওড়ে, মাছি ওড়ে…
পাখি ওড়ে, তেলাপোকা ওড়ে… ওড়ে আরও
এমনি কতো কিছু… ভুলে-বেভুলে যে নেয় কিংবা
যারা নেয় তিব্বতের রুপালি গল্পের পিছু… !!

আসলে জীবন কেবল দু’আঁটি পাটের বোঝা
সরল অংক কেবল নামেই, নয় এতো সোজা!
তবুও ডেকে আনি ঢেকুর বেদনা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
অন্তর, আমি জানি আজ হোক, কাল হোক
একদিন ঘটবেই গল্পের রুপালি রুপান্তর..!

তবুও…
সারাদিন কতোকিছু আঞ্জাম দিই বাড়ি, গাড়ি,
নারী; আচ্ছা, যে পথে হেঁটে যাই, সেপথ কি চিনে
আমায়? নাকি সবকিছু কেবল লজ্জাবতীর লজ্জা..
আশা, ভয় ও শংকার আলো-আঁধারী ফুলশয্যা!!

তথাপি থেমে নেই মধ্যরাতের উড়নচণ্ডী ভুল
হাঁটতে হাঁটতে ওড়তে ওড়তে ফিরে ফিরে আসে
মৃতনদীর দুকূল; অথচ আজকাল আর
কেউই বুঝে না, বুঝতে চায় না… লাটাইবিহীন ঘুড়ির
পাস্তুরিত ভুল..বুঝতে চায় না নদীর ভাঙা দু’কুল!!

জলে জলাঞ্জলি

2782

০১
বিকেলটা জলে দেব ঠিক করেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু এমনিভাবে জলাঞ্জলি হবে কোনোদিন ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। আজকাল মাঝেমাঝেই ব্রহ্মপুত্র দেখতে যাই। যদিও সে এখন আর দেখার মতোন কেউ নেই। হাতি ছোট হতে হতে চামচিকা হলে যেমন কদাকার দেখায়; ব্রহ্মপুত্রকেও এখন তেমনি দেখায়। এর না আছে গুণ, আর না আছে রুপ। তবুও ব্রহ্মপুত্রের মায়া কাটাতে পারিনা। তবুও পৈতৃক বাড়ির মতো সে আমাকে বারবার কাছে টানে। এখানে আকাশ যতোটা কাছে পৃথিবীর অন্য কোথাও ততোটা না। ব্রহ্মপুত্রের বাতাস যতোটা খানদানী ততোটা পৃথিবীর আর কোনোখানে নেই। দুই পড়ের কাশফুলগুলো যেন অষ্টাদশী নর্তকীর মতো আমার হৃদয়ে চোরাগোপ্তা ঝড় তুলে। কানের কাছে আনত মুখে ফিসফিসিয়ে জীবনের কথা বলে। যদিও আমার জীবন এখন বেশির ভাগ সময় মেঘলা আকাশের সাথে মিতালি পাতাতে ব্যস্ত থাকে।

আমার প্রিয়তমা ময়মনসিংহ শহরে একটু জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোন জায়গা খুব একটা নেই। তবুও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের দুই ধার বেশ লাবণ্যময়। এখানে প্রতিদিনই অতিথি পাখির মতো হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। তাদের পায়ের ধূলিতে যেমন সাইমুম সৃষ্টি হয়; তেমনি তাদের কথার কাকলিতে নিষ্প্রাণ ব্রহ্মপুত্র সেও ধন্য হয়। বিশেষ করে গাঙের পানিতে যাদের নতুন পানির জোয়ার এসেছে তাদের কথা না বললেই নয়। শ্রুতি আর প্রতিশ্রুতির মেঘ ডাকে, মুষলধারে বৃষ্টি সেও বসে থাকে না। এমনি পাগলা হাওয়া কার না ভালো লাগে? আর আমার মতোন আলো-আঁধারির আধামানুষ হলে তো কোনো কথাই নেই!

ব্রহ্মপুত্রে যদিও এখন মন ভরানো জল নেই; তবুও পায়ে হেঁটে ওপারে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও নেই। অনেকদিন ধরে যে ব্রীজটি হওয়ার কথা আকাশে-বাতাসে ভাসছে; তারও কোনো সুগন্ধ নেই। যা আছে সেটা সেই সনাতনী পদ্ধতি! খেয়া করে একবার ওপারে যাও; আরেকবার এপারে আসো। অবশ্য এই পদ্ধতিটা ভ্রমণ বিলাসী মানুষের জন্য মন্দ নয়। মোটামুটি একটা নৌ-এ্যাডভেঞ্চার হয়ে যায়। বাকি থাকে কেবল দুই পাড়ের অগণিত আমজনতা। অবশ্য তাদের কষ্টের নামতা শোনার মতো মানুষের অভাব এই দুনিয়ায় নেই; কেবল কষ্ট দূর করার তেমন কোনো মানুষ নেই। এ নিয়ে দুই পাড়ের মানুষের যেমন হতাশা আছে, তেমনি বুক ভরা আশাও আছে। দু’চোখ উপচানো স্বপ্ন আছে। আর সেই স্বপ্ন যেমন-তেমন স্বপ্ন নয়। একদিন তারা ব্রহ্মপুত্রের বুকের উপর দিয়ে জুতা পায়ে মচমচ করে হেঁটে এপার-ওপার করবে! মস্তবড় জলহস্তীর মতোন বড় সেই জলজ্যান্ত স্বপ্ন! শত হতাশার মাঝেও আমার তালগাছ সমান বিশ্বাস আছে- আজ হোক, কাল হোক কিংবা পরশু হোক একদিন না একদিন তাদের সেই স্বপ্নের পাখা গজাবেই!

আমি সেই ব্রহ্মপুত্র নদের যে পাড়ে ঈশ্বর আছেন; সেই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আশেপাশে ছেলেবেলার দেখা আখড়ার মেলার মতোন এলোপাথাড়ি মানুষের খেলা। কেউ হাসছে। কেউ হাসতে হাসতে কাঁদছে। আর কেউ কারো হাত থেকে উষ্ণতা ছিনিয়ে নিচ্ছে। মশা তাড়ানোর ছল করে গাল লাল করে দিচ্ছে। আর আমি একজন নিতান্ত আলাভোলা আধাআধি মানুষের মতোন প্রিয়তমা ব্রহ্মপুত্রের দিকে দুই চোখ মেলে উদাস চেয়ে আছি। আমার সেই চোখ যখন ব্রহ্মপুত্রের হারানো যৌবন খুঁজে ফিরছে; ঠিক তখনই কাউনের মিহি দানার মতোন সরু একটি অচেনা কণ্ঠস্বর আমার দিকে ধেয়ে আসলো। স্যার ওই পাড়ে যাবেন নাকি?

০২
যেই জল আমাকে সবসময় সতেজ ঘাসের মতোন সুতীব্র আকর্ষণ করে, সেই জলই হল এই আহবানের উৎসমুখ। সাধারণতঃ মেয়েদের কণ্ঠ এমন মিহি হয়। কিন্তু এ যে দেখছি সাক্ষাৎ খেয়া পাড়ের মাঝি! ব্রহ্মপুত্রের সমাহিত জলের উপর শান্ত, সৌম্য, মোলায়েম এক চেহারার সুঠামদেহী তরুণ। চোখে, মুখে নগদ দীপ্তির ছাপ মুদ্রিত অক্ষরের মতো শোভা পাচ্ছে। প্রথম দর্শনেই আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা হোঁচট খেলাম। ছেলেটিকে মাঝি ভাবতে কিছুতেই আমার মন সায় দিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে কিছু একটা গণ্ডগোল তো অবশ্যই আছে। যা আমাকে জানতে হবে। জানতেই হবে।

মাঝির প্রশ্নের জবাব মুখে না দিয়ে নৌকায় আরোহন করলাম। নৌকাটি মাঝারি গোছের। না ছোট। না বড়। তবে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষদের জন্য চমত্কার উপযোগী। দুই পাশে পাটাতন দিয়ে বসার সুব্যবস্থা আছে। রঙিন পাল বাতাসে উড়ছে। এতোসব আয়োজনের মাঝেও আমাদের দু’জনের মধ্যে অস্বাভাবিক নিরবতার কাফন মুচকি মুচকি হাসছে। এই অবস্থার অবসান কল্পে আমি যেই মুখের লাগাম খুলে দিতে উদ্যত হলাম, তখনই আমাকে হারিয়ে দিয়ে মাঝি ছেলেটি বলে উঠল, আপনাকে আমি চিনি স্যার। আপনার নাম অচল। আপনি খুব ভালো কবিতা লিখেন। আমি মন ভালো করার জন্য আপনার কবিতা সবসময় পড়ি। আপনার কবিতায় হতাশা আর আশা সমান তালে পথ চললেও জীবনের সুগন্ধ পাই; দিক-নির্দেশনা পাই। মাঝ নদী থেকে কীভাবে তীরে ভিড়তে হয়, ভিড়তে হবে, সেই অনুপ্রেরণা পাই।

পৃথিবী থেকে একলাফে চাঁদে পৌঁছে গেলে একজন সাধারণ মানুষ যতটা আনন্দিত হবে, মাঝির কথা শুনে আমি ঠিক ততোটাই পুলকিত হলাম। এরচেয়ে এক আঙুল কমও না; আবার বেশিও না। তবুও এতো খুশি ধরে রাখার কোনো বন্দোবস্ত আপাতত আমার কাছে নেই। জামার বুক প্যাকেট, বুকের ইন পকেট, প্যান্টের সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সব পকেটে কেবল খুশি আর খুশি। অতঃপর কিছু খুশি চোখে, কিছু মুখে মাখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী উদাস মাঝি?

কবিতার প্রসঙ্গ না টেনে নাম জিজ্ঞেস করায় মাঝি কিছুটা না হতাশ হয়েছে, আমি তার নাম বলে দেওয়ায় এরচেয়ে কয়েক কোটি গুণ বেশি অবাক হয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, জী স্যার আমার নাম উদাস। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?

আমি উদাসের প্রশ্নের জবাব দিলাম না। জবাব দেওয়ার জন্য ভেতর থেকে তাড়া অনুভব করলাম না। উদাস নামটি কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন মনে হলেও আমার কাছে খুব লাবণ্যময়। আমি বিশ্বাস করি, শিল্পের যেখানে শেষ হয়, লাবণ্যের সেখান থেকে শুরু হয়। মনের ভাবনা মনের ভেতরেই তালা মেরে মুখে বললাম, পড়াশোনা কর বুঝি?

আমি জানি, একজন মাঝিকে করা আমার এই প্রশ্নটা কোনো প্রশ্ন নয়। বলা চলে হালের আধমরা বলদের মতোন জীর্ণ-শীর্ণ একটি প্রশ্ন। উদাসও আমার প্রশ্নের নগদ কোনো জবাব দিলো না। কেবল সুপারি গাছের মতো সুদীর্ঘ একটি দীর্ঘশ্বাস ব্রহ্মপুত্রের জলের সাথে মিশিয়ে দিয়ে বলল, স্যার ঐ পাড়ে যাবেন? নাকি….

আমি বললাম, না। আমি কোন পাড়ে-টারে যাব না। দিনমণি ডোবার যতক্ষণ সময় বাকি আছে, ততক্ষণ তোমার যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যাও। তাছাড়া তুমি এটাও করতে পার যে, ব্রহ্মপুত্রের ঠিক বুক বরাবর নৌকাটি নিয়ে যাও। অতঃপর বৈঠা নৌকার উপর রেখে দাও। নৌকা তার ইচ্ছে মত চলবে। চলুক। যে পৃথিবীতে সবাই স্বাধীনতা প্রিয়; তাই আমি মনে করি তোমার নৌকারও কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার আছে। তুমি কি বল উদাস? উদাস বলল, অবশ্যই স্যার।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এজন্য তোমাকে কত টাকা দিতে হবে উদাস?
আমার কথা শোনে উদাস যেন লজ্জাবতী লতার মতো মাটিতে মিইয়ে গেলো। কিন্তু উদাসের মুখ বসে থাকলো না। সে সাফ জবাব দিল, মাফ করবেন স্যার। আপনার কাছে আমি কোনো টাকা-পয়সা নিতে পারব না।
এবার আমি নিশ্চিত না হয়ে পারলাম যে, উদাস কোনো সাধারণ মাঝি নয়। একজন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের যতটা বিশালতা থাকা দরকার এই ছেলের এরচেয়ে ঢের বেশি আছে। প্রকৃত পক্ষে ধন থাকলেই যে মানুষ ধনী হয় না, মন থাকতে হয়—এই কথার সত্যতা আবারও আমার কাছে দিবালাকের মতো স্পষ্ট হল।

০৩
আমি জানি, আবেগের জায়গায় খোঁচা পড়লে মানুষ এমন কিছু বলে যা স্বাভাবিক অবস্থায় বলে না। বলতে পারে না। তাই আমি উদাসের এই জায়গাটিতে খোঁচা দিয়ে বললাম,
এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা ছবি এবং প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এই তোমাকে আর যাই কিছু হোক মাঝি হিসাবে একেবারেই বেমানান উদাস।

উদাস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দুই, তিন চিমটি মাত্র সময় নিল। অতঃপর কী মনে করে জানি না একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে সাথে সাথেই একটা গভীর অনুশ্বাস সংগোপনে গোপন করে বলল, দুঃখের কথা কী বলব স্যার, আমি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স, মাস্টার্স পাশ করেছি। দুটোতেই প্রথম শ্রেণি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমারও দু’চোখে হাজার চোখের স্বপ্ন ছিল। আমাকে ঘিরে বাবা-মায়ের আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা ছিল। দরিদ্র পিতামাতার একমাত্র ছেলে সন্তান হিসাবে একটি চাকুরির জন্য কম চেষ্টা করিনি স্যার। কিন্তু কিছুতেই আমার ভাগ্যের ছেঁড়া শিঁকে জোড়া লাগেনি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইনি এমন কোন রেকর্ড আমার অভিধানে নেই। আমার জানা এবং বিশ্বাস মতে, প্রতিটি ভাইভা যেভাবে ফেস করা উচিত, আমিও ঠিক সেভাবেই ফেস করেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। রাগে দুঃখে, অপমানে একদিন আমি কী করেছি জানেন স্যার?

যৎসামান্য ঔষধেই এমন ভালো কাজ হবে আমি ভাবতেই পারিনি। তবুও আমি মুখে কিছু না বলে উদাসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলতে থাকলো, একদিন হঠাৎ রাত্রিবেলা বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন।

পরদিন সংসার চালানোর মত ঘরে তেমন কিছুই নেই। বাবা খুব কাঁদছিলেন। অবশ্য বাবার চেয়ে মা আরও বেশি কাঁদছিলেন। অতঃপর আমি বাবা-মাকে না জানিয়েই বৈঠা হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা, মা, ছোটবোন দুটি না খেয়ে থাকবে এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না স্যার। অবশ্য আগের দিন আমার সরকারী চাকুরির বয়সও শেষ হয়েছিল। সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছি। একফোঁটাও ঘুমাইনি। অতঃপর সমস্ত রাত্রি অন্ধকার ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। ভোর বেলায় সমস্ত জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ঠিক মাঝখানে আসলাম। তারপর চোখের জলে ভিজতে ভিজতে সবগুলো সার্টিফিকেট কুটিকুটি করে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিলাম। সেই থেকে আমি ব্রহ্মপুত্রের মায়া কাটাতে পারি না স্যার। যেই জলে আমি আমার সমস্ত জীবনের অর্জন জলাঞ্জলি দিয়েছি, বাবা, মা এবং আত্মীয়-স্বজনের স্বপ্ন যেই জলে সমাহিত করেছি; আপনিই বলুন স্যার সেই জল আমি কীভাবে ছাড়তে পারি?

এরপর উদাস আর কিছুই বলল না। বলতে পারলো না। ঘামে ভেজা হাত দিয়ে বারবার কেবল চোখের জল মুছতে লাগল। আর আমি জীবনে এই প্রথমবারের মত নিজের কাছে নিজেই হেরে গেলাম। আমাদের দেশে যেভাবে হাটে-বাজারের মতোন যেখানে-সেখানে পাত্র-অপাত্র না দেখে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা হচ্ছে, আমি জানি না পরিকল্পনা বিহীন এই উচ্চ শিক্ষার বিড়ম্বনা আদৌ হালে পানি পাবে কিনা! এই হতাশার বোঝা জাতি বইতে পারবে কিনা? প্রকৃত মেধাবিরা যেখানে চাকুরি পাচ্ছে না; সেখানে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা এমনকি শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ভয়ে যে ছাত্রটি সারা ছাত্রজীবন ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে মুখ লুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো, পেছনের দরজা দিয়ে সে-ই আজ দেখা পেয়ে যাচ্ছে চাকুরি নামের সোনার হরিণটির। আমি জানি না, এর মাশুল আমাদের আরও কত প্রকারে গোনতে হবে!

০৪
আমি জানি, উদাসের এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি এই মুহূর্তে আমার নেই। আমি এখন কালিহীন কলমের মত হতবুদ্ধি। তবুও কথার পিঠে কথা ছাড়া যেমন প্রেম হয় না, প্রেম ছাড়া যেমন বৃষ্টি হয় না; তেমনি এই উদগীরিত লাভার অবস্থান থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। অংশুমালি পশ্চিম দিকে যাত্রার আয়োজন যথারীতি প্রায় সুসম্পন্ন করে নিয়ে নিয়েছে। আমি বিদায়ের আয়োজন করার জন্য উদাসকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা কেমন আছেন?

উদাস বলল, স্যার আপনি যেভাবে বাবার কথা বললেন, মনে হচ্ছে আপনি আমার বাবাকে চিনেন। জানেন। আসলেই কি তাই স্যার?

আমি বললাম, না উদাস। তুমি বলছিলে তোমার বাবা অসুস্থ। তাই আমার এই জিজ্ঞেস করা। উদাস বলল, বাবার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ স্যার। বিছানা ছেড়ে একেবারেই উঠতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। কাউকে তেমন চিনতে পারেন না। সবকিছু গুলিয়ে ফেলেন।

উদাসের কথা শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরে হিমালয় হিমালয় ভাব জেগে উঠছে। আমি জানি, এই অবস্থায় আমি যা বলব, তাই ফলে পরিণত হবে। এই আমি মূলত আমি না। আমার মাঝে অন্য কেউ। এখন আমার সব কথার উড়ন্ত ডানা থাকবে। আমার কথারা দোয়েল পাখির মতোন গান গাইবে। ব্রহ্মপুত্রের হারানো স্রোতের মতো অব্যর্থ হবে। বললাম, তোমার বাবা বিগত তিন বছর তের দিন ধরে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় আছেন। তাই না উদাস?

চোখের সামনে প্রেতাত্মা দেখলেও উদাস এতোটা হতবাক হতো কিনা আমি জানি না। হাতের বৈঠা গলুইয়ে রেখে তাড়াতাড়ি করে আমার দু’পা ছুঁয়ে সালাম করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নৌকা তার নিজের মতো করে যেদিকে খুশি চলছে। আর এমনি এক মোবারক সময়ে আমার মুখ থেকে একটি আচানক তাঁরছেঁড়া কথা বের হয়ে আসলো। আমি বললাম,
”উদাস, তুমি বাড়িতে ফিরে দেখবে তোমার বাবা উঠানে পায়চারি করছেন। আর এক আঙুল সময় দেরি না করে তুমি ঝটপট বাবার কাছে চলে যাও। এই নাও পাঁচশত টাকা। এই টাকা দিয়ে তোমার বাবার জন্য এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও। তোমার বাবা মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করেন।‘’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় উদাস কী করবে আর কী করবে না— তেমনি এক সিদ্ধান্ত সাগরে হাবুডাবু খাচ্ছিলো। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি যাও উদাস। তাড়াতাড়ি যাও…. তোমার বাবা তোমাকে খুঁজছেন…..। সাথে সাথে উদাস নিজেকে ফিরে পেলো। দৌড়ের নৌকার মতোন বাড়ির দিকে প্রাণপণে ছুটতে লাগলো!!