লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী এর সকল পোস্ট

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

২৬ শে জানুয়ারি (প্রজাতন্ত্র দিবসের কবিতা)

২৬ শে জানুয়ারি (প্রজাতন্ত্র দিবসের কবিতা)
কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ছাব্বিশে জানুয়ারি মোরা পালন করি
প্রজাতন্ত্র দিবস আজিকে,
প্রভাতে উঠিল রবি মেঘেঢাকা লাল ছবি
আবীর মাখানো পূর্ব দিকে।

ভারত মৃত্তিকা পরে জাতীয় পতাকা উড়ে
প্রফুল্লিত সবাকার প্রাণ,
দেশের সকল জাতি পুলকে উঠিল মাতি
গাহে ভারতের জয়গান।

ভারতের অগ্নিশিশু নেতাজি সুভাষ বসু
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ,
বিনয় বাদল নাম দিনেশের সংগ্রাম
কত শহীদের প্রাণনাশ।

আজিকার দিনে তাই স্মরণ করিতে চাই
দিল যারা প্রাণ বলিদান,
সংগ্রাম আমরণ করিলেন অনশন
গাহি তাহাদের জয়গান।

বন্দে মাতরম ধ্বনি তাই দিকে দিকে শুনি
অরুণ প্রভাত আজি জাগে,
এক জাতি এক প্রাণ আজি গাহে জয়গান
উঠিছে অরুণ নব রাগে।

https://www.youtube.com/watch?v=Yucq4RrXbNk&t=64s

নেতাজী সুভাষ তুমি (দেশাত্মবোধক কবিতা)

নেতাজী সুভাষ তুমি (দেশাত্মবোধক কবিতা)
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

1

নেতাজী সুভাষ নাম হে বীর কর্মী মহান
তুমি লড়েছো দেশের তরে,
শ্রীজানকী নাথ পিতা প্রভাবতী তব মাতা
জন্ম নিলে কটক শহরে।

পরাধীন দেশমাতা স্বদেশের স্বাধীনতা
করেছো সংগ্রাম দেশহিতে,
রক্ত দাও স্বাধীনতা দৃপ্ত তব এই কথা
চেতনা জাগায় প্রতি চিত্তে।

আজাদ সেনা-বাহিনী করিলে গঠন তুমি
শৌর্য বীর্যে তুমি পরাক্রম,
স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা তুমি বীর দেশনেতা
দেখাইলে বীরের বিক্রম।

শিখাইলে সবাকারে স্বদেশ হিতের তরে
দেশ প্রেম আর স্বাধীনতা,
সংগ্রাম আমরণ লক্ষ্য মাতৃ-মুক্তি পণ
সত্য তুমি প্রিয় রাষ্ট্রনেতা।

আজি শুভ জন্মদিনে সকলেই মনে প্রাণে
স্মরি আজি নেতাজি তোমায়,
তোমার আসন শূণ্য তুমি সবার বরেণ্য
দেশবাসী প্রণাম জানায়।

https://www.youtube.com/watch?v=FJ1XrWIn4LM

বর্ষ-বরণ 2021 নতুন বছরের প্রথম কবিতা

নববর্ষ-বরণ 2021
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

1

প্রতিদিনের মত আজো সূর্য উঠেছে। শীতের কুয়াশা সরিয়ে উঁকি দিয়েছে উজ্জ্বল রোদ। কিন্তু অন্য যে কোনো দিনের চাইতে আজকের ভোরের আলোতে যেন বেশি মায়া মাখানো। যেন নতুন স্বপ্নের কথা বলছে। বলছে, সামনের দিনগুলোতে অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে শুভময়তা ছড়িয়ে যাবে দেশে, পৃথিবীতে। আশাজাগানিয়া সূর্যকিরণ যেন সে দ্যুতিই ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রত্যেকের প্রাণে, মনে।

আজ ২০২১ সালের প্রথম দিন। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মত আমরাও আমাদের অগণিত পাঠকদের জানাই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। নতুন বছরটি আনন্দে, শান্তিতে ভরে উঠুক–এই প্রত্যাশা।

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এ কথার মতই দুঃখ, কষ্ট সবকিছু কাটিয়ে নতুন জীবনের দিকে যাত্রার প্রেরণা নেবে মানুষ। নতুন বছরটি যেন প্রতিটি মানুষের মন থেকে সকল গ্লানি, অনিশ্চয়তা, হিংসা, লোভ ও পাপ দূর করে। রাজনৈতিক হানাহানি থেমে গিয়ে যেন আমাদের প্রিয় স্বদেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

গত বছরের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব খুঁজতে খুঁজতে নতুন বছরকে সামনে রেখে আবর্তিত হবে নতুন নতুন স্বপ্নের।
রাজনৈতিক সহিংসতা, নানা দুর্যোগ-দুর্ঘটনা আর ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইংরেজি ২০২০ সাল। মহাকালে মিলিয়ে গেল আরেকটি ঘটনাবহুল বছর। এলো নতুন বছর ২০২১- সারা বিশ্বের মানুষ আনন্দ-উল্লাস করে পালন করছে এই নতুন বছরের শুরুর ক্ষণটিকে বর্ষ-বরণ হিসাবে।

বর্ষ-বরণ 2021
নতুন বছরের প্রথম কবিতা

কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

3

নতুন বছর নতুন আলোয়
খুশিতে ভুবন ভরা।
আসুক আলোক ঘুচুক আঁধার
শোক তাপ গ্লানি জরা।

নতুন বছর নতুন আলো
মুছুক যত মনের কালো
দিনটি সবার কাটুক ভালো
এসো এসো সবে ত্বরা,
মধুর লগনে সবাকার সনে
খুশিতে নাচবো মোরা।

নতুন বছর নতুন দিনে
খুশিতে ভরা প্রাণ,
নতুন আলোয় নতুন সুরে
নতুনের আহ্বান।

তরুশাখে ডাকে পাখি
কিচিমিচি ডাকি ডাকি
রবি সোনা রং মাখি
পূরবেতে দৃশ্যমান।
তরুর শাখে পাখিরা ডাকে
প্রভাত পাখির গান।
নতুন বছর নতুন দিনে
খুশিতে ভরা প্রাণ।

প্রভাত রবি ছড়ায় কিরণ
মেঘে মেঘে রং লাগে,
রাখাল সুরে বাজায় বাঁশি
চিত্তে পুলক জাগে।

অজয় নদীর চরে
সোনাঝরা রোদ ঝরে
দেখি রাঙাপথ ধরে
আসে বধু কলসী কাঁখে,
কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি ধায়
বেলা বারোটার আগে।
নতুন রবি ছড়ায় কিরণ
মেঘে মেঘে রং লাগে।

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (পঞ্চম পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (পঞ্চম পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

6

ভারতীয় অর্থনীতি অবশ্য করোনার আগে থেকেই ধুঁকছিল। জিডিপি ঋণাত্মক বা সঙ্কোচন অর্থাৎ মন্দা না হলেও নিম্নগতিতে ছিল। বেকারত্বের হার নেমে গিয়েছিল ৪৫ বছরের সর্বনিম্ন হারে। ধুঁকছিল উৎপাদন ক্ষেত্র। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন ‘ঝিমুনি’। করোনা এসে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়েছে। যেন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কয়েক হাজার ফুট নীচের গিরিখাতে। মৃত্যু হয়নি। প্রাণটা কোনওরকমে ছিল। মাস তিনেক প্রায় সংজ্ঞাহীন থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা। তবে আবার কবে আগের অবস্থা ফিরে আসবে, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতেও ভয় পাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

এই ধরনের বিপর্যয় এবং তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোকে চারটি ইংরেজি বর্ণ দিয়ে ভাগ করেন অর্থনীতিবিদরা— ভি (V), ইউ (U), ডব্লিউ (W) এবং এল (L)। অক্ষরগুলির আকৃতি দেখেই অর্থনীতির উত্থান-পতন বোঝা যায়। ভি-এর ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরে পতন এবং একই গতিতে উত্থান। ইউ-এর অর্থ দ্রুত পতনের পর দীর্ঘদিন সেই অবস্থায় থাকা এবং দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী। ডব্লিউ অর্থাৎ গ্রাফ একই ভাবে বারবার ওঠানামা এবং এল-এর ক্ষেত্রে দ্রুত পতন এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া। ২০২০-র ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভারত এবং গোটা বিশ্বের অর্থনীতির এই উত্থান-পতনকে ‘ভি’-এর আকারের বলে ব্যাখ্যা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ভারত-সহ বেশ কিছু দেশে বৃদ্ধির গ্রাফ কিন্তু ডব্লিউ-এর আকারও হতে পারে। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার ফের বড়সড় নিম্নগতি আসতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশি। কারণ, করোনা সংক্রমণের আগে থেকেই ছিল অর্থনীতির ঝিমুনি।

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেন, অর্থনীতির ওঠাপড়া আগেভাগে আঁচ করতে পারে শেয়ার বাজার। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স একের পর এক দেশ লকডাউন ঘোষণা করছিল, শেয়ারবাজারে ধস নামতে শুরু করেছিল তখন থেকেই। সারা বিশ্বের সূচকের গড় পতন ছিল ২০ শতাংশের মতো। ভারতের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৫ শতাংশেরও বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বকালীন পতন হয়েছিল অপরিশোধিত তেলের দামে। লকডাউনের এক একটা দিন লগ্নিকারীদের পুঁজি যেন হাওয়ায় উবে যাচ্ছিল।

তবে শেয়ার বাজার আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিতান্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা ভারতবাসীই লকডাউনের শেষে আবার বাজারমুখী। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। মানুষের হাতে টাকা আসতে শুরু করেছে। ভিড় বাড়ছে শপিং মল, দোকানে। চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে উৎপাদন। অতএব অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী। এপ্রিল-জুন প্রথম ত্রৈমাসিকে যেখানে জিডিপি সঙ্কুচিত হয়েছিল মাইনাস ২৩.৯ শতাংশ। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সেই সঙ্কোচন অনেকটাই কমেছে (মাইনাস ৭.৫%)। পরের ত্রৈমাসিকে এই হার আরও ভাল জায়গায় থাকবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলেছেন, যা আশা করা গিয়েছিল, তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২০-২১অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি সঙ্কোচনের হার বা মন্দা হতে পারে ৯.৫ শতাংশ। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের পর এই পূর্বাভাস কমিয়ে করেছে মাইনাস ৭.৫। সেনসেক্স-নিফটিও কোভিডের আগের জায়গায় তো ফিরেছেই, তার চেয়ে অনেক উপরে উঠে প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছে।

তবে কি কোভিডের ধাক্কা শুধু ২০২০-র কয়েকটা মাসেই সীমাবদ্ধ? কোভিডোত্তর যুগে প্রবেশ করে গিয়েছি আমরা? অন্তত অর্থনীতির দিক থেকে? অর্থনীতিবিদরা কিন্তু এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। তাঁদের মতে, অর্থনীতিতে কোভিডের এই ক্ষত কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর। সেখান থেকে সহজে পরিত্রাণের উপায় নেই। জেল থেকে ছাড়া পেলে যেমন মুক্তির প্রকৃত স্বাদ বা তাৎপর্য বোঝা যায়, তেমনই দীর্ঘ লকডাউনের পর তাৎক্ষণিক কিছু চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে কিছুটা গতি এসেছে বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে সেটা ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ।

আমরা চাইলেও ইতিহাস ভুলতে পারবে না ‘অর্থহীন’ ২০২০। যখনই অর্থনীতিতে ধাক্কা আসবে, তুলনা আসবে এই বছরের। শেয়ার মার্কেটে কয়েক দিনে কার কত টাকা উবে গিয়েছিল, রাতারাতি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোন শিল্পে লোকসানের বহর কত বেড়েছিল— সব উঠে আসবে আলোচনায়। ইতিহাস ভুলতে পারবে না, রাজপথে পরিযায়ীর পদযাত্রা, রেললাইনে ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকদের পিষে দিয়ে মালগাড়ি চলে যাওয়া। সরকার হিসেব রাখুক না রাখুক, ইতিহাসবিদের কলম এড়াতে পারবে না কয়েকশো কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে বাড়ির কাছে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া সেই ছেলেটার কথা।

ছর বারোর মেয়েটি লকডাউনের মধ্যে তেলঙ্গানা থেকে হেঁটে ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুর সংলগ্ন গ্রামের বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার আগেই সে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কবলে।

ওই কিশোরীর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই দেশ জুড়ে করোনা-আবহে পরিযায়ী শ্রমিকদের এ ভাবে নিজের রাজ্যে ফেরা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। তড়িঘড়ি তদন্তে নামে বিজাপুর পুলিশ। তদন্তে নেমে তারা জানতে পারে, ওই কিশোরীকে তেলঙ্গানার কান্নাইগুড়ায় লঙ্কা তোলার কাজে লাগিয়ে দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামেরই এক মহিলা। বুধবার পুলিশ কোতোয়ালি থানায় কিশোরীর গ্রামের দু’জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭০ নম্বর ধারায় মেয়েটিকে পাচারের অভিযোগ দায়ের করেছে।

বিজাপুরের কালেক্টর কেডি কুঞ্জম শুক্রবার এফআইআরের কথা স্বীকার করে জানান, ফেব্রুয়ারিতে আডেড গ্রামের সুনীতা মারকামি এবং তেলঙ্গানার ঠিকাদার সন্তোষ মাঞ্চল ওই কিশোরীর সঙ্গে আরও কয়েক জনকে তেলঙ্গানার পেরুরুতে নিয়ে যান শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোর জন্য। সেখানে শিশু শ্রমিক হিসেবে লঙ্কা তুলতে হত ওই কিশোরীকে। পুলিশ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, না-জানিয়েই মেয়েটিকে নিয়ে গিয়েছিল সুনীতা।

কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই শ্রমিকদের কোনও দায়িত্বই নিতে চায়নি ঠিকাদার বা কারখানার মালিক। ফলে খাবার না-পেয়ে অন্য কয়েক জনের সঙ্গে ১৫ এপ্রিল পেরুরু থেকে হাঁটতে শুরু করে ওই কিশোরী। তিন দিন হাঁটার পরে বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই অভুক্ত, ক্লান্ত মেয়েটি ১৮ তারিখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, শরীরে জলের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়াতেই মৃত্যু হয় মেয়েটির। বিজাপুরের কালেক্টর অবশ্য এ দিন তা অস্বীকার করে জানান, পড়ে গিয়ে চোট লাগাতেই ওই কিশোরীর মৃত্যু হয়।

তেলঙ্গানার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি জানার পরেই ২০ এপ্রিল তেলঙ্গানা মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের কাছে জানতে চাওয়া হোক, লকডাউনের মধ্যে ওই কিশোরী এবং তার সঙ্গীদের রাজ্যের সীমানা পেরোতে দেওয়া হল কী ভাবে? ১২ বছরের একটি মেয়েকে দিয়ে লঙ্কা তোলার কাজ করানোই বা হচ্ছিল কেন? পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে যথাযথ তদন্তের আবেদন জানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধি অচ্যুত রাও। তাঁদের দাবি, মৃত কিশোরীর পরিবার যাতে অবিলম্বে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পান, প্রশাসনকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু তবুও মানুষ নতুন আশার আলো দেখার প্রহর গুনছে। আসছে নতুন বছর ২০২১ । কান পেতে শুনি তাই নতুনের আহ্বান! নতুনকে স্বাগত জানানোর গান, কোটি কোটি কণ্ঠে উদাত্ত আহ্বান….
এসো হে নববর্ষ ২০২১ এসো এসো!

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (চতুর্থ পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (চতুর্থ পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

5

মহাসড়ক, রেললাইন ধরে অন্তহীন গন্তব্যের পথে হেঁটে চলেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। পৃথিবীর ব্যস্ততম শহরও যানহীন, জনশূন্য। মল থেকে মিল, সমতল থেকে হিল, কলকাতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, মুম্বই থেকে দুবাই— সর্বত্র এক ছবি। লকডাউন, আনলক পেরিয়ে, মাস্ক পরে, হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে প্রায় একটা বছর করোনার সঙ্গে সহ-বাস করার পর ২০২০ সালটাকে মনে হচ্ছে যেন ব্যর্থ প্রথম প্রেমের মতো। ভুলতে চাই। কিন্তু পারছি কই।

সংক্রমণ শুরু হয়েছিল ২০২০-র গোড়া থেকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে অর্থনীতির উপর করোনার প্রত্যক্ষ প্রভাব শুরু হল ২২ মার্চ থেকে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে ভারতবর্ষের মাটিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক উড়ান। ৩ দিন পর থেকে শুরু হয়েছিল ‘সম্পূর্ণ লকডাউন’। কোনও বিশেষণ, কোনও মাপকাঠি বা বর্ণনাতেই সেই লকডাউনের প্রকৃত রূপ বোঝানো সম্ভব নয়।

এত টুকরো টুকরো উপাখ্যান, যে সেগুলো যোগ করলে কয়েকটা রামায়ণ-মহাভারত হয়ে যাবে। সুনসান পথঘাট, ঘরবন্দি মানুষ, হাসপাতালে হাসপাতালে লাশের স্তূপ, মৃত্যুর পরেও দেখা করা যাবে না প্রিয়জনের সঙ্গে— এ সব তো ছিলই। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে চিত্রটা রাস্তায় নেমে এসেছিল, সেটা পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার দৃশ্য। হাজারে হাজারে, লাখে লাখে মানুষ হেঁটে, সাইকেলে বাড়ি ফিরছেন। রাস্তায় খাওয়া, পথেই ঘুম, প্রাতঃকৃত্য। পর দিন আবার হাঁটা। কত জন যে বাড়ির পথে মারা গিয়েছিলেন, ভারত সরকারের কাছে নাকি তার হিসেবও নেই!

এই চিত্রই বুঝিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির অসংগঠিত চেহারা। অসংগঠিত ক্ষেত্রই যে ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড, সেই কঙ্কালসার সত্যিটা সে দিন ছাইচাপা আগুন থেকে হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। হিসেব বলছে, প্রায় ৮ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক কাজ হারিয়েছিলেন লকডাউনে। লকডাউন জারি রেখেও ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছিল জুনের শেষে। তার আগে টানা ৬৮ দিন চলেছিল লকডাউন।

পরিংসখ্যান বলছে, ৮ ডিসেম্বর কৃষকদের ডাকা ভারত বন্‌ধে ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছিল প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। তার আগে ২৬ নভেম্বর শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা দেশজোড়া ধর্মঘটে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। কোনও ক্ষেত্রেই ‘সর্বাত্মক বন্‌ধ’ হয়নি। অনেক রাজ্যে, অনেক শহরে তেমন প্রভাবও পড়েনি। তাতেই এত বিপুল ক্ষতি! ৬৮ দিনের লকডাউনে অর্থনীতির ক্ষত কতটা গভীর হতে পারে, এর থেকেই অনুমেয়।

পরিসংখ্যান কী বলছে?
একটি সমীক্ষা বলছে, লকডাউনেকাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ৮৩.১ শতাংশ মানুষ কাজ ফিরে পাননি। খাদ্যসঙ্কটে পড়েছেন ৮০.৮ শতাংশ মানুষ। ঘরে ফিরতে পারেননি ৪৭.৮ শতাংশ, অসুস্থ হয়েছেন ১৫.১ শতাংশ। সমস্যা এড়াতে পেরেছেন মাত্র ২.৪ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক।

পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা দেশবাসী স্বচক্ষে দেখেছিলেন। কিন্তু কার্যত আমজনতার অলক্ষ্যে লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছিল পর্যটন এবং অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্র। ঘটনাচক্রে, পর্যটন ক্ষেত্রে অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হোটেল, রেস্তরাঁ শিল্প। জুন মাস পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যানবলেছিল, অংসগঠিত শ্রমিক এবং স্ব-রোজগার বাদ দিয়ে এই শিল্পে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ। অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে বহু সংস্থা।

দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান পরিবহণ ‘অ্যাভিয়াঙ্কা হোল্ডিংস’, ব্রিটেনের ‘ফ্লাইবি’, আলাস্কার সবচেয়ে বড় সংস্থা ‘রাভনেয়ার’, সেন্ট লুইসের ‘ট্রান্স স্টেট এয়ারলাইন্স’, সুইডেনের ‘ব্রা’ ছাড়াও ‘ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া’, ‘মিয়ামি এয়ার ইন্টারন্যাশনাল’-এর মতো বহু বিমান পরিবহণ সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে করোনাকালে। ভারতীয় সংস্থা ‘ডেকান চার্টার্স’ কোভিডের সময় অপারেশন বন্ধ করে এখনও পর্যন্ত তা শুরু করতে করেনি।

জনশ্রুতি, দেউলিয়া হওয়ার পথে এই সংস্থাও। এ ছাড়া উৎপাদন থেকে পরিষেবা, খুচরো বিপণী শৃঙ্খল থেকে ছোট দোকানদার, ট্রেনের হকার থেকে ফুটপাতের ব্যবসায়ী— কোনও ক্ষেত্রই করোনার ছোবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ব্যক্তিগত ভাবে এক জন ভারতবাসী বা বিশ্ববাসীকেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কোভিডের কারণে আর্থিক সমস্যায় পড়েননি।

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (তৃতীয় পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (তৃতীয় পর্ব )

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

চেনাজানার বৃত্তে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে অতিমারি। যে পরিবর্তন দেখিয়েছে, পুলিশ অপারগের বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে পারে। গান গেয়ে করোনা সচেতনতা বাড়াতে পারে। অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে পারে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দোকান থেকে কিনে বাড়িতে দিয়ে আসতে পারে। খারাপ সময় চিনিয়ে দিয়েছে মানবিক পুলিশকে। নতুন বছরেও নিশ্চয়ই আইনরক্ষার পাশাপাশি পুলিশ নাগরিকের পাশে দাঁড়াবে সঙ্কটের সময়।

3

করোনা-সময়ে অদ্ভুত শারদীয়া কাটিয়েছে বাঙালি। মণ্ডপে ভিড় নেই। শুধু প্রতিমা। রাস্তায় দর্শনার্থী নেই। শুধু পুলিশ। করোনার উপসর্গ শ্বাসকষ্ট বলে দিওয়ালিতে আতশবাজিও তেমন ভাবে পোড়ানো হয়নি। নিন্দুকেরা বলবে আদালতের নির্দেশ ছিল। কিন্তু বাঙালির সদিচ্ছা ছিল না, বলা যাবে না। বাঙালির ইদও ম্যাড়মেড়ে করে দিয়েছে অতিমারি। বাঙালি রমজানের মাসে সন্ধেবেলা তারাবির নমাজ মসজিদে গিয়ে না পড়ে বাড়িতে বসে পড়েছে! জুম্মাবারেও বন্ধ থেকেছে মসজিদ! নতুন বছরে এমন আশ্চর্য উৎসব-কাল কাটাতে চাইবে না বাঙালি। ভুলে যেতে চাইবে উদ্‌যাপনের একাকিত্ব।
খেলার মাঠে পৃথিবী জুড়ে একের পর এক টুর্নামেন্ট, লিগ বন্ধ হয়েছে। পিছিয়ে গিয়েছে অলিম্পিক। বছরের শেষদিকে যখন চালু হল খেলাধুলো, তখন মাঠ দর্শকহীন। টিভিতে কৃত্রিম চিৎকার। কিন্তু ঘোলে আর কতটা দুধের স্বাদ পাওয়া যায়! শুরুর একটা শুরু হয়েছে বটে। কিন্তু নতুন বছরে খেলার আসর পুরোদমে বসবে তো? গ্যালারি ভর্তি দর্শক থাকবে তো?

দর্শক নেই বলে অনেকগুলো সিঙ্গল স্ক্রিন আনলক পর্বেও বন্ধ করে দিতে হল। ‘জনতা কার্ফু’র পর পরই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্স, থিয়েটার, অডিটোরিয়াম, রেস্তরাঁ, পার্ক— বিনোদনের সব দরজা। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের রমরমা বেড়েছে লকডাউন পর্বে। একের পর এক সিনেমা রিলিজ করেছে সেখানেই। গৃহবন্দি দর্শকদের কাছে খুলে গিয়েছে নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজনের ব্যক্তিগত পরিসর।

কাজের পরিসরেও বড়সড় বদল এনে দিয়েছে কোভিড-১৯। এক দল লোকের কাজ একেবারে চলে গিয়েছে। এক দলের কাজকর্মের গোটাটাই চলছে বাড়ি থেকে। তৃতীয় একটা দল মধ্যপন্থায়। অফিস দরকার মনে করে ডেকে পাঠায়। আর এক দলের কাজের ধরনটাই পাল্টে গিয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের এক বইবিক্রেতা এখন প্লাস্টিক কারখানায় রাত জেগে খেলনা বানান। দিনের বেলা সেই তিনিই দোকানে দোকানে পাঁউরুটি-লাড্ডু-বিস্কুট ফেরি করেন। রোজগার হয়েছে ৩ ভাগের এক ভাগ। বেসরকারি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। ভিন্‌রাজ্যে কাজে যাওয়া ‘পরিযায়ী শ্রমিক’দের কাজ হারিয়ে বেঁচে থাকা আর ঘরে ফেরার গল্প আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে।

একটা দীর্ঘ সময় মানুষ বাড়িতে বন্দি ছিল। একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া তার বাইরে বেরনো বারণ। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তো একেবারেই না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন সেটুকুই কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরে আসা। সেই কেনাকাটার ফাঁকেই বাঙালি বেদম ভিড় বাড়িয়েছে বাজারে। সামাজিক দূরত্বের দফারফা করে ছেড়েছে। কিন্তু বাকি সবই ঘরে বসে।

নির্ধারিত সময়ের বাইরে বেরোলেই পুলিশের ধমক, মার, অন্যের ভ্রূকুটি। তাতেই বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে। গোটা দুনিয়ায় চলতে থাকা নিয়ম-কানুনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে। বিষময় একটা বছর শুধু অদ্ভুত এক আঁধার পথে হাঁটিয়েছে, তা নয়। আলোকবর্তিকাও দেখিয়েছে। গোটা বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা সেখানেই। পরিবারকে সময় দেওয়া। অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। পুরনোকে ভুলে সেই বাড়ানো হাত ধরেই যাওয়া যাক নূতন বছরে।

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (দ্বিতীয় পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (দ্বিতীয় পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

2

এমন একটা অভিশপ্ত বছরকে ক্যালেণ্ডার থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয়। ভয়, আতঙ্ক, উদ্বেগ, শিহরণ, মনখারাপ, বিচ্ছেদ, শোক, ঘাবড়ে যাওয়ায় ভরপুর এ রকম বছর আগে কখনও আসেনি। তবে খারাপ সময়ও তো শিক্ষা দিয়ে যায়। সেটুকুই দিয়ে গেল ‘অভিশপ্ত বছর ২০২০ সাল’। ছোট ছোট ভাণ্ডে রাখা একটা মস্ত বড় শিক্ষার ভাণ্ডার। তার কতকটা ভুলে যাওয়ার। আর বাকিটা নিয়ে সরাসরি ২০২১-এ ঢুকে পড়া।

তার আগে ঢুকে পড়া যাক অভিধানে। শব্দগুলো নিয়ে। প্যান্ডেমিক, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং, কোয়রান্টিন, আইসোলেশন, আনলক, কোমর্বিডিটি, কন্টেনমেন্ট জোন, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ভার্চুয়াল, সেফ হোম আরও কত কী! অন্য কিছু শব্দও গোটা করোনাকালে বাঙালির সুজন হয়েছে। হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপ্যাথি। আর্সেনিক অ্যালবাম এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। বাঙালির জীবনে এ ভাবে শব্দগুলো একমাত্রায় জড়িয়ে যায়নি কখনও। বাঙালি তার বাংলা প্রতিশব্দ নতুন করে ভাবতে বসেছে। অতিমারি, সামাজিক দূরত্ব, নিভৃতবাস ইত্যাদি শব্দ বছরভর মুখে মুখে ঘুরেছে। ঘুরছে। দৈনন্দিন জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে। এ সব শব্দের ব্যবহার নতুন বছরেও থেকে যাবে। ভোলা যাবে না সমাজযাপনে তাদের অভিঘাত।

বাঙালি কোনও কালেই স্বাস্থ্যসচেতন ছিল না। তারা ভিড়ে মুখচাপা না দিয়েই হাঁচি-কাশিতে অভ্যস্ত। যত্রতত্র থুতু ফেলাতেও কোনও অপরাধবোধ নেই। কিন্তু গোটা ২০২০ কেউ সামান্য হাঁচি-কাশি দিলেই তার দিকে ঘুরঘুর করেছে অবিশ্বাসী চোখ। সে দশা কাটেনি। তবে অতিমারি শিখিয়েছে, হাঁচি-কাশির সময় মুখের সামনে নিদেনপক্ষে হাতটা রাখতে হয়। রাখা উচিত। সর্বত্র থুতু ফেলা যায় না। মুখে মাস্ক রাখা চাই। হাতে সাবান বা স্যানিটাইজার দিতে হয়। বাইরের হাত মুখে দিতে নেই। নতুন বছর তো বটেই, এ সব অভ্যাস আজীবন থাকা উচিত। কিন্তু বাঙালি তাতেই বা কবে তোয়াক্কা করেছে! অনেক মুখই কিন্তু মুখোশহীন বছর শেষের প্রকৃত ছবিতে।

প্রকৃত আর ‘ভার্চুয়াল’ কি সমনামী? অফিসের বৈঠক। প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা। বন্ধুত্বের আলিঙ্গন। জন্মদিনের কেক কাটা। প্রধানমন্ত্রীর সভা। রাজনৈতিক কর্মসূচি। পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন। সব, সবই অভিশপ্ত বছরে ভার্চুয়াল। নতুন বছরে এই ‘ভার্চুয়াল’ বরং ‘অ্যাক্চুয়াল’ আসুক। তবে বাঙালি শিখে গিয়েছে, আড়ালের অন্য নাম অনলাইন।

অনলাইনে ক্লাস করা যায়, পরীক্ষা দেওয়া যায়, শিক্ষক পড়াতেও পারেন। এর আগে ইউটিউবে এমন চেষ্টা হয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যবহারিক ‘জ্ঞান’-এর ভিডিও সেখানে রয়েছে। প্রয়োজনে ছাত্রছাত্রীরা চোখ বুলিয়েছে। কিন্তু বাঙালি আবার সাহচর্য সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধাশীল। অতিমারি দিল সব ঘেঁটে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ার টোল থেকে প্রাইভেট টিউটর— সকলের দরজা বন্ধ। খোলা শুধু অনলাইন। মাধ্যম হিসাবে খুবই উত্তম।

জরুরি তো বটেই। আপৎকালীনও। কিন্তু সকলের কাছে পৌঁছনোর মতো পরিকাঠামো দেশে নেই। তাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, মূল স্রোত থেকে প্রান্তিক— সকল নাগরিক যদি নতুন বছরে এমন পরিকাঠামোর ভিতরে চলে আসতে পারে, তা হলে ভুলে না-গিয়ে ‘অন’ থাকুক এই চেনাজানা।

অভিশপ্ত বছর ২০২০ হেথা হতে যাও পুরাতন এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ (প্রথম পর্ব )

অভিশপ্ত বছর ২০২০… হেথা হতে যাও পুরাতন।
এসো এসো হে নতুন বছর ২০২১ ! (প্রথম পর্ব )
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

1

আজকের সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে আরেকটি খ্রিস্টীয় বছর ২০২০ বিদায় নেবে। বছরটি পৃথিবীকে দিয়েছে মহামারীর তাণ্ডব, মৃত্যুর মিছিল, কর্মহারা জীবন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এ পরিস্থিতির মধ্যেই রাত পেরিয়ে ভোরের সূর্য পৃথিবীর বুকে নিয়ে আসবে আরেকটি নতুন বছর। আর নতুন বছর নিয়ে মানুষ আশায় বুক বাঁধবে। করোনামুক্ত ঝলমলে একটি বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে পথচলা শুরু করবে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে/ঝরে ধুলায় ভোর বেলাতে/আমায় তারা ডাকে সাথে- আয় রে আয়।/সজল করুণ নয়ন তোলো, দাও বিদায়…।’ সব বিদায়ের সঙ্গেই লুকিয়ে আছে আনন্দ-বেদনার কাব্য। ২০২০ বছর বিদায়ের ক্ষণেও সেই একই কথা বাজবে সবার অন্তরে। আজ রাত ১২টা পেরোলেই শুরু হবে নতুন খ্রিস্টীয় বছর ২০২১। আর ভোরবেলাতেই উদয় হবে নতুন বছরের নতুন সূর্য।

আমাদের জীবনের সব কর্মকাণ্ড ইংরেজি সালের গণনায় হয়, তাই খ্রিস্টীয় বছর বিশেষ গুরুত্ববাহী। সেই বিবেচনায় বিদায়ী বছরটা কেমন গেল তার হিসাব কষবেন সবাই। ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো আরও একবার রোমন্থন করবেন। একইভাবে জীবনের সব ধরনের নেতিবাচক বিষয়গুলোকে দূরে ঠেলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় নতুন করে পথচলার প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন।

ফিরে তাকানও যাক কি ঘটেছিল ২০২০ সালে। বছরটি যখন শুরু হয়, তখন পৃথিবীর মানুষ নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্প করে। কিন্তু বছরের ২ মাসের মাথায় পৃথিবীর মানুষের সামনে আসে ভয়াবহ এক বিপদ। চীনের উহানে প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর খবরে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে। নড়েচড়ে বসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দেয় দেশগুলোকে। এরপরই একে একে বন্ধ হতে থাকে বিমান চলাচল। অনেক দেশের সীমানা বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশ অভ্যন্তরীণভাবে লকডাউন দিয়ে নাগরিকদের সুরক্ষার চেষ্টা করে। এতেও কাজ চলছিল না। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোতে বড় হতে থাকে মৃত্যুর মিছিল। বিদায়ী বছরের শেষে এসে বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ মানুষের মৃত্যুর খবর জানা যায়। আক্রান্ত হন আট কোটিরও বেশি মানুষ।

কিন্তু তবুও মানুষ নতুন আশার আলো দেখার প্রহর গুনছে। আসছে নতুন বছর ২০২১ । কান পেতে শুনি তাই নতুনের আহ্বান! নতুনকে স্বাগত জানানোর গান, কোটি কোটি বিশ্ববাসীর কণ্ঠে উদাত্ত আহ্বান….
এসো হে নববর্ষ ২০২১ এসো এসো!

বর্ষ-বিদায় ২০২০ ……শুভ নববর্ষের আহ্বান আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)

বর্ষ-বিদায় ২০২০ ……শুভ নববর্ষের আহ্বান
আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

1

বর্ষ শেষে নব বর্ষ আসে বসুধায়,
অভিশপ্ত বর্ষ আজি লইবে বিদায়।
করোনা আবহে বর্ষ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস,
বিশ্বজুড়ে করে খেলা বিষ ভাইরাস।

অভিশপ্ত বিশ বিষ নির্গত না হয়,
মারণ খেলায় হয় জীবনের ক্ষয়।
বিষ বর্ষ যাবে চলে কিছুক্ষণ পরে,
স্মৃতিবিষ রয়ে যাবে সবার অন্তরে।

এবর্ষে কিবা পেলাম শুধুই নিরাশা,
নববর্ষে পূর্ণ হবে নব নব আশা।
বর্ষশেষে বিশ্ববাসী প্রণতি জানায়,
অভিশপ্ত বিশ বর্ষ লউক বিদায়।

কবিতার আসরেতে গুণী কবিগণ
নববর্ষে ভালবাসা করিও গ্রহণ।
নববর্ষ আসে তাই হরষিত মন।
বর্ষবিদায় কবিতা লিখে শ্রীলক্ষ্মণ।

2

পূর্ব-প্রকাশিত বর্ষশেষের কবিতাগুচ্ছ ২০১৯ বর্ষ-বিদায় কবিতা
২০২০ বিদায়ের শুভক্ষণে পুনরায় প্রকাশিত হল।

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বর্তমান বর্ষ হবে পুরাতন আজি,
নববর্ষ আসে তাই নবরূপে সাজি।
বর্তমান বর্ষ শেষ আজিকার পরে,
নুতন প্রভাত জাগে নুতন বছরে।

দিন যায় রাতি আসে হয় অবসান,
নুতন প্রভাত হয় পাখি গাহে গান।
দিনশেষে সন্ধ্যা হয় রজনীপ্রভাতে,
দিবস শর্বরী বর্ষ এই মতে কাটে।

সারাবর্ষ ধরি আমি করিয়াছি ভুল,
ভুল প্রায়শ্চিত্ত আজ তাই সমতুল।
বর্ষশেষে সবাকারে করি নমস্কার,
করুন গ্রহণ সবে প্রণাম আমার।

এবর্ষ চলিয়া যাবে কিছুক্ষণ পরে,
অগ্রিম শুভেচ্ছা নিন শুভ অবসরে।

পূর্ব-প্রকাশিত বর্ষশেষের কবিতাগুচ্ছ ২০১৯ বর্ষ-বিদায় কবিতা
২০২০ বিদায়ের শুভক্ষণে পুনরায় প্রকাশিত হল।

আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)
বর্ষশেষের কবিতা -১

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

সময়ের কাঁটা ঘোষিছে চৌদিকে,
শোন বিশ্ববাসীগণ;
পুরাতন বর্ষ যাবে চলে শেষে,
নববর্ষের আগমন।

বর্তমান বর্ষ যাবে কেটে
আর কয়দিন পরে,
পুরাতন বর্ষ লবে বিদায়,
সময়ের হাত ধরে।

দেয়ালে টাঙানো ক্যালেণ্ডারে
লাস্যময়ী এক ছবি,
কপালেতে তার শোভিছে যে টিপ,
ঠিক যেন ভোরের রবি।

হাসিভরা মুখ সয়েছে সুখ দুখ,
বিষাদে আজি মলিন,
আর কিছুদিন গত হলে তার
ঠাঁই হবে ডাস্ট-বিন।

সযতনে রাখা ফুলদানি সব,
শুধু মনে মনে ভাবে;
সব কিছুর স্মৃতি মন থেকে
চিরতরে মুছে যাবে।

এইভাবে হয়ে গেছে পার,
বহু পুরাতন বর্ষ,
বিদায় বেলায়, হারায় হেলায়,
সবাকার সংস্পর্শ।

স্মৃতির আয়নায় ধুয়ে মুছে যায়
পুরোনো দিনের স্মৃতি,
মনের গভীরে বেজে উঠে সুরে
বর্ষের বিদায় গীতি।

আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)
বর্ষশেষের কবিতা -২

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বিদায়ের অশ্রুজলে হয় অবসান,
বর্তমান বর্ষস্মৃতি হয়ে যাবে ম্লান।
নববর্ষ আসে তাই হরষিত মন,
পুরাতন বর্ষ করে অশ্রু বিসর্জন।

এ বর্ষে কিবা পেলাম? শুধুই বিষাদ,
নববর্ষে পূর্ণ হবে সব মনোসাধ।
পুরাতন বর্ষ শেষে, নববর্ষ আসে,
বিদায়ের কালে বর্ষ আঁখিজলে ভাসে।

এ বর্ষ চলিয়া যাবে কিছু দিন পরে,
প্রফুল্লিত মন তাই নববর্ষ তরে।
পুরাতন বর্ষ পরে হইবে বিগত,
নববর্ষের অগ্রিম জানাই স্বাগত,

বর্তমান বর্ষ যবে হবে সমাপন,
বর্ষশেষে ভালবাসা করিও গ্রহণ।

আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)
বর্ষশেষের কবিতা -৩

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

রূপ রস ও গন্ধ ময়,
পৃথিবী হতে বিদায় লয়,
পুরাতন বর্ষ শেষ হয়।

কচি নব কিশলয়,
চির সবুজ নাহি রয়,
বর্ষশেষে বৃন্তচ্যুত হয়।

সবুজ বনানী ছায়,
পাখি সব গান গায়,
উত্তরে হিমেল হাওয়া বয়।

মুকুলিত সব আশা,
স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা,
জীবনে চির স্মৃতি হয়ে রয়।

বর্তমান বর্ষ বিদায় লয়,
নববর্ষের আগমন হয়,
বয়ে চলে অজয়ের ধারা।

নববর্ষের আগমনে
নব আশা জাগে মনে
বর্ষ শেষে হয় স্মৃতিহারা।

আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)
বর্ষশেষের কবিতা -৪

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বর্ষে বর্ষে কোলাহলে
আসে এই ধরাতলে
অবশেষে বর্ষ হয় পার,

এই বর্ষে কি পেলাম
পেয়ে সব হারালাম
বর্ষ শেষে ধরণী মাঝার।

রূপ রস ও গন্ধময়,
পৃথিবী হতে বিদায় লয়,
পুরাতন বর্ষ শেষ হয়।

কচি নব কিশলয়,
চির সবুজ নাহি রয়,
বর্ষশেষে বৃন্তচ্যুত হয়।

সবুজ বনানী ছায়,
পাখি সব গান গায়,
উত্তরে হিমেল হাওয়া বয়।

মুকুলিত সব আশা,
স্নেহ, প্রেম, ভালবাসা,
জীবনে চির স্মৃতি হয়ে রয়।

বর্তমান বর্ষ বিদায় লয়,
নববর্ষের আগমন হয়,
বয়ে চলে অজয়ের ধারা।

নববর্ষের আগমনে
নব আশা জাগে মনে
বর্ষ শেষে হয় স্মৃতিহারা।

আমার কবিতাগুচ্ছ (বর্ষ শেষের কবিতা)
বর্ষশেষের কবিতা -৫

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

এই বর্ষ হবে গত কিছু ক্ষণ পরে,
স্মৃতি শুধু রয়ে যাবে চিরদিন তরে।
এইভাবে কত বর্ষ হয়ে গেছে পার,
স্মৃতি শুধু ভেসে রয় মানসে আমার।

বর্ষশেষে নববর্ষ করে পদার্পন,
নববর্ষে বিশ্ববাসী খুশিতে মগন।
বর্তমান বর্ষশেষে অন্তিম সময়,
শুভক্ষণে নববর্ষ আগমন হয়।

বর্ষশেষে সুধীজন নিও ভালবাসা,
নববর্ষে সবাকার পূর্ণ হবে আশা।
ক্ষমা কর গুণীজন যদি করি ভুল,
বর্ষশেষে দিতে চাহি ভুলের মাশুল।

অসমাপ্ত কার্য যত করি সমাপন,
বর্ষশেষের কবিতা লিখেন লক্ষ্মণ।

পরিত্রাতা যীশু

পরিত্রাতা যীশু
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

2

প্রভু যীশু ফিরে এসো,
আমাদের ভালবাসো,
প্রভু তোমারই হউক জয়,
প্রভু তোমারই হউক জয়।

ভালবাসার বিনিময়ে,
সবাকার পাপ লয়ে,
ক্রুশেতে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ
দিলে ওগো জোতির্ময়,
প্রভু তোমারই হউক জয়,
প্রভু তোমারই হউক জয়।

সবারে বেসেছো ভালো,
তুমি জগতের আলো,
তোমার অপার মহিমা।
মানুষকে ভালবেসে,
মানুষের কাছে এসে,
শিখাইলে করিতে ক্ষমা।

প্রভু যীশু ফিরে এসো,
আমাদের ভালবাসো,
প্রভু তোমারই হউক জয়,
প্রভু তোমারই হউক জয়।

হিংসা দিয়ে নয়,
ভালবাসা দিয়ে তুমি
করেছো জয় সবাকার হৃদয়।
প্রভু তোমারই হউক জয়,
ওগো প্রভু, তোমারই হউক জয়।

তুমি অন্তর্যামী,
মোর জীবনস্বামী,
পরম পিতা তুমি যে মহান।

তব ভালবাসায়,
তব স্নেহছায়ায়,
তব করুণায় পাপী পায় পরিত্রাণ।

হে প্রভু তুমি যে মহান।
মৃতজনে কর জীবন দান।
পাপীরে করহ পরিত্রাণ।

প্রভু যীশু ফিরে এসো,
আমাদের ভালবাসো,
প্রভু তোমারই হউক জয়,
প্রভু তোমারই হউক জয়।

https://www.youtube.com/watch?v=_Mi6fzusSeQ

অঘ্রানে ধানের খেতে….. সোনা ধানের হাসি বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (চতুর্থ পর্ব)

অঘ্রানে ধানের খেতে….. সোনা ধানের হাসি
বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (চতুর্থ পর্ব)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

2

অঘ্রানে নবান্ন পর্ব মহা ধূমধাম,
নবান্নের উত্সবে মেতে উঠে গ্রাম।
নতুন ধানের খই চিঁড়ে গুড় আর,
খেজুর, নলেন গুড় বিবিধ প্রকার।

কাস্তে হাতে আসে চাষী মাঠে কাটে ধান,
ভেসে আসে মিঠা সুরে রাখালিয়া গান।
খেজুরের রস ফুটে, সুগন্ধ ছড়ায়,
নতুন আখের গুড়ে মন ভরে যায়।

অজয়ের ঘাটে ঘাটে যাত্রীদের ভিড়,
নদীতটে সোনারোদ বহিছে সমীর।
নদীতীর সুশীতল পাখি গাহে গান,
নদীবাঁকে ধানখেতে চাষী কাটে ধান।

রাঙাপথ গেছে চলে নদী ধার দিয়ে,
চলিছে গরুর গাড়ি ধান আঁটি নিয়ে।
মাঠে মাঠে সোনা ধান খুশি সব চাষী,
আঙিনায় ভরে গোলা ধান রাশি রাশি।

অঘ্রানে ধানের খেতে….. সোনা ধানের হাসি বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (তৃতীয় পর্ব)

অঘ্রানে ধানের খেতে….. সোনা ধানের হাসি
বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (তৃতীয় পর্ব)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

1

অঘ্রানে নতুন ধান পায়েস রন্ধন,
ঘরে ঘরে নবান্নের হয় আয়োজন।
নতুন আখের গুড় এই মাসে হয়,
নতুন চালের পিঠে খেলে পেটে সয়।

সকালের সোনারোদ আঙিনায় ঝরে,
নবান্নের উত্সব প্রতি ঘরে ঘরে।
খেজুরের রস আর নলেনের গুড়,
বাতাসে গুড়ের গন্ধ স্বাদে ভরপুর।

অঘ্রানে ধানের খেতে চাষী ধান কাটে,
রাখাল বাজায় বাঁশি, অজয়ের ঘাটে।
আর পারে তালবন, খেজুরের গাছে,
নতুন মাটির ভাঁড় গাছে বাঁধা আছে।

ধান কেটে আসে চাষী সাঁঝের বেলায়,
চাঁদ উঠে তারা ফুটে আকাশের গাঁয়,
জোছনায় নদীজল ঝলমল করে,
কল কল বহে নদী সারারাত ধরে।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (তৃতীয় পর্ব)

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (তৃতীয় পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিবিধ বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের পাণ্ডিত্যের জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেছিলেন।পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম ভগবতী দেবী। স্ত্রীর নাম দীনময়ী দেবী। তাঁর পিতামহের নাম রামজয় তর্কভূষণ। পণ্ডিত হিসাবে রামজয়ের সুনাম থাকলেও, তিনি অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। ভাইদের সাথে মনমালিন্য হওয়ার জন্য রামজয় গৃহত্যাগ করলে, তাঁর স্ত্রী দুর্গাদেবী (বিদ্যাসাগরের পিতামহী) পুত্রকন্যা নিয়ে দুরবস্থায় পড়েন এবং তিনি তাঁর পিতার বাড়ি বীরসিংহ গ্রামে চলে আসেন। এই কারণে বীরসিংহ গ্রাম বিদ্যাসাগরের মামার বাড়ি হলেও পরে সেটাই তাঁর আপন গ্রামে পরিণত হয়। আর্থিক অসুবিধার কারণে দুর্গাদেবী জ্যেষ্ঠ সন্তান ঠাকুরদাস কৈশোরেই উপার্জনের জন্য কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে তিনি অতি সামান্য বেতনে চাকুরি গ্রহণ করেন। পরে তেইশ-চব্বিশ বৎসর বয়সে তিনি গোঘাট নিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের কন্যা ভগবতী দেবীকে বিবাহ করেন। আর্থিক অনটনের জন্য তাঁর পক্ষে সপরিবার শহরে বাস করা সাধ্যাতীত ছিল। তাই শৈশব ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী ও ঠাকুরমা দুর্গাদেবীর কাছেই প্রতিপালিত হন।

খুব দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হলেও বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী ও সচেতন। পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি হন। এই পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি তাঁর পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে সংখ্যাচিহ্ন শিখেছিলেন। এই সময় ঠাকুরদাশ এবং বিদ্যাসাগর কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে আশ্রয় নেন।

১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন সোমবার, কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে তিনি ভর্তি হন। ঈশ্বর চন্দ্র সন্ধ্যার পর রাস্তার পাশে জ্বালানো বাতির নিচে দাঁড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন ছাত্রাবস্থায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ ও নদিয়া নিবাসী মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায় মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণীতেও ভর্তি হন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি পান এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা উপহার পান। উল্লেখ্য তৎকালীন সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কাব্য শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই সময় তিনি শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবে মাসিক ৫ টাকা পেতেন।

১৮৩৪-৩৫ খ্রিষ্টাব্দের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য তিনি ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক উপহার পান। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অলঙ্কার শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে তিনি শিক্ষক হিসাবে পান পণ্ডিত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশকে। এই শ্রেণিতে তিনি এক বৎসর শিক্ষালাভ করেন। ১৯৩৫-৩৬ বৎসরের বাৎসরিক পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এই কারণে তিনি কলেজ থেকে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশী ও মৃচ্ছকটিক গ্রন্থসমূহ উপহার পান। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণীতে ভর্তি করে নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন এবং ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে, তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণীতে। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ।

১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল মাসে হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে, ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এরপর তিনি কৃতিত্বের সাথে ‘ন্যায় শ্রেণী’ ও ‘জ্যোতিষ শ্রেণী’তে শিক্ষালাভ করেন। ১৮৪০-৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘ন্যায় শ্রেণী’তে পাঠ করেন। এই শ্রেণীতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা – সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন।

ভাইফোঁটা নয় যমদ্বিতীয়া (পৌরাণিক গল্প) দ্বিতীয় পর্ব

ভাইফোঁটা নয় যমদ্বিতীয়া (পৌরাণিক গল্প) দ্বিতীয় পর্ব
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

3

এই সবে গেল ভাই ফোঁটা, তার আগে দীপাবলীর আগের দিন ভুত(নরক) চতুর্দশী, তারও আগের দিন ধনতেরস। প্রতিটি দিনের মাহাত্ব সম্পর্কে আমরা কম বেশি জানি। কিন্তু, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? এই যে ধনতেরস থেকে ভাইফোঁটা, প্রতিটি অনুষ্ঠানে একজন “কমন” তিনি হলেন যমরাজ। উত্তর ভারতের প্রচলিত লোক কথা অনুযায়ি, বৈশ্য হিমার পুত্রব্ধু, স্বামীর অকালমৃত্যু ঠেকাতে, ধনতেরসের রাতে আলো আর সোনার স্তুপ সাজিয়ে রেখে স্বামীর প্রাণ নিতে আসা যমরাজের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে, নরক চতুর্দশীর দিন, দরজার পাশে “যমদীপ” দেওয়ার প্রথা আছে, যাতে পরিবারে কেউ অকাল মৃত্যুর শিকার না হ’ন। মা কালী যে কাল-হন্ত্রী সে ত সবাই জানি, সঙ্গে এ ও জানি যা “কাল” হল যমরাজের অপর নাম। এরপর ভাইফোঁটা, এর সাথে যমরাজের সম্পর্ক আর নতুন করে বলতে হবে না। এছাড়া কিন্তু যমের পুজার আর কোন অনুষ্ঠান সারা বছরে আর হয় না। যম হিন্দু মতে মৃত্যুর দেবতা, তাই হয়ত কিছুটা ভয়ে, কিছু অস্বস্তিতে তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা।

যমের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋক বেদে। দশম মন্ডলের, দশম, চতুর্দশ এবং পয়ত্রিশ সংখ্যক সুক্ত তাঁর উদ্দেশ্যে রচিত। এখানে তাঁর পরিচয় তিনি মৃত্যুর দেবতা, পিতৃলোকের অধিপতি এবং দক্ষিণ দিকপাল। তিনি বিবস্বান (সুর্যের আরেক নাম) এবং সরণ্যু এর জমজ পুত্র, তাঁর জমজ বোন যমী। যমের আর এক ভাই আছেন তিনি শ্রাদ্ধদেব মণু ( ইনিই কি বৈবস্বত মণু?)। শনিদেব তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই। ঋক বেদে একথাও বলা হয়েছে যম মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন এবং প্রথম মানুষকে তার নিজস্ব মনোবৃত্তি অনুসারে নিজের জীবন পথ নির্ধারণের স্বাধীনতা প্রদান করেন। এখানে একটা আকর্ষণীয় তথ্য দিতে চাই, পার্শীদের ধর্ম Zoroastrianism এ মৃত্যুর দেবতার নাম Yima (য়িমা), কি অদ্ভুত মিল !! তাই না?

4

হিন্দুদের নানা পুরাণে যমকে বিভিন্ন বিষয়ের অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তা এক এক উপাখ্যানে এক এক রকম। যেমন ব্রহ্মাপুরাণে তাঁকে ধর্ম ও বিচারের অধিপতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, অন্য পুরাণে কিন্তু তাঁকে ধর্মাধিপতি হিসাবে বলা হয় নি। ঋকবেদ অনুসারে যম হলেন প্রথম মানুষ যাঁর মৃত্যু হয়। সেই ভাবেই তিনি পিতৃলোকের প্রথম অধিবাসী, এবং যেহেতু তাঁর কোন সন্তানাদি নেই তাই তিনি কখনো পিতৃলোক থেকে মুক্তি পান না। এই সন্তানাদি ও পিতৃলোক থেকে মুক্তি বা পুনর্জন্ম নিয়ে ভবিষ্যতে কথা বলা যাবে, আজ অন্য প্রসঙ্গ।

ঋকবেদের এক কাহিনী দিয়ে শুরু করিঃ

যম ও যমী হলেন পৃথিবীর প্রথম মানব ও মানবী। একবার যমী কামনার্ত হয়ে যমের প্রেমাকাংক্ষায় আকুল হলেন। যমীর ইচ্ছা যম তাঁর গর্ভে সন্তানের সুচনা করেন। যম বললেন “কোন নারী ও পুরুষ, যাদের মধ্যে রক্ত সম্বন্ধ আছে (অর্থাৎ তারা একই পিতা মাতার সন্তান), তাঁদের মধ্য শারিরীক সম্পর্ক আমার পছন্দ নয়, ভগবান সব দেখছেন।” যমী মিলন কালে ভগবান দেখছেন, এই নিয়ে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হলেন না এবং ভগবান এর কথা উপেক্ষা করে বললেন “এর মধ্যে লজ্জার কি আছে? স্বাভাবিক ব্যবহার নিয়ে আপনি চিন্তিত কেন?”

একদিকে যমী সত্যই বলেছিলেন, অতীতে দেবতারা পরস্ত্রীহরণ, বহুগমন সহ বহু পাপকার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা সন্তান উৎপাদন করেন নি। যম মুলতঃ, যমীর সঙ্গজাত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। যম বললেন “পূর্ব পুরুষেরা যে ভূল করেছেন, আমরা তা পুনরাবৃত্তি করতে পারি না, বরং আমাদের তা সংশোধন করে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।“

তখন যমী বললেন “ প্রজাপতি ব্রহ্মা আমাদের দুজন কে সংযুক্ত করেই মাতৃগর্ভে স্থাপন করেছেন, তিনি আমাদের মিথুন হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন, তাহলে আমরা কেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাচ্ছি?”

যমী আরও বলেন “আপনি যে পাপের ভয় পাচ্ছেন, তা কখনোই পাপ নয়। তাছাড়া কে আমাদের মিলন দেখতে পাচ্ছে? তাহলে পাপ কিসের?”

অর্থাৎ যমী ইশারা করছেন যে যদি কোন সমাজ বর্জিত কার্য কেউ প্রত্যক্ষ করেন তবে তা পাপ, নইলে নয়। কোনটা পাপ আর কোনটা নয়, তা সমাজ তৈরি করে, যে সমাজ মানুষেরই সৃষ্টি।

এরপর যমী বলেন “আমি আপনার সাথে মিলনের জন্য উৎগ্রীব, আমি আমার শরীর আপনাকে পত্নি রূপে সমর্পণ করতে চাই।” লক্ষনীয়, যমী কিন্তু এখানে বিবাহের কথা বলছেন না, কিন্তু তিনি পত্নি কথাটা ব্যবহার করছেন। যম তখন যমীকে বলেন যে, তিনি যমীর ইচ্ছাপুরণ করতে অপারগ, কিন্তু যমী অন্য কারোর সাথে মিলিত হতে পারেন। দেখা যাচ্ছে যে যম কিন্তু শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিরুদ্ধে নন, তিনি শুধু দুইজন রক্ত সম্পর্কিত স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, বিশেষতঃ সন্তান উৎপাদনের বিরুদ্ধে।

এছাড়াও, ঋকবেদে (১০/১২/৬) পাওয়া যায় যে যম একবার তাঁর মাতাকে শারীরিক আঘাত করেন। কেন তা করেন তার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। ধারনা করা যেতে পারে যে তাঁর মা হয়ত, তাঁর বোন যমীর মতই মিলনেচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিম্বা কন্যা যমীর ইচ্ছাতে সহমত পোষন করেন। ঘটনা যাই হোক, এই সমস্ত কথার মধ্যে দিয়ে, আমরা যমের এবং সেই সুত্রে ঋকবেদের সমকালীন ভারতীয়দের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ধারার প্রকাশ দেখতে পাই।

আজকের Genetics বলে যে, সমগোত্রীয় বিবাহ বা শারীরিক সম্পর্কের ফলে যে সন্তানাদির জন্ম হয়, তাদের মধ্যে বংশগত রোগ, বিকলাঙ্গতা হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । শুধু তাই নয়, এর ফলে পুরুষের Y Chromosome খর্ব হয়ে যায় (shrinks), যা মানব বিলুপ্তির কারন হতে পারে। সেই সুদূর অতীতে, কোন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই তাঁরা Genetics এর এই মহাসত্য উৎঘাটন করেন, সম্ভবত শুধুমাত্র পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে। আবার যমের কথায় আসা যাক, এর পরে যম ভবিষ্যত-বাণী করেন এই বলে যে “ সময় আসছে, ভাবীকালে একই পিতা-মাতার সন্তান ভাই বোনের মধ্যে বিবাহ বা সেইরূপ সম্পর্ক সম্পুর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ হবে”।

শেষপর্যন্ত যম মানব কল্যাণে নিজের অমরত্বকে অস্বীকার করেন। (ঋকবেদ ১০/১৩/৪), তিনি ‘বৃহস্পতি যজ্ঞে’, নিজের প্রিয় শরীর আহুতি দেন ও মৃত্যু বরণ করেন। তিনিই প্রথম মানব যিনি মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এর পরেই তিনি দেবত্ব লাভ করেন ও পিতৃলোকের অধিপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

এদিকে প্রিয় ভাই এর মৃত্যুতে যমী কান্নায় ভেঙ্গে পরেন, তখন দেবতারা এসে তাঁকে সান্তনা দেন ও তাঁকে ‘যামিনী’ নামে অভিহিত করে, রাত্রির অধিষ্ঠাত্রী দেবীতে উন্নিত করেন। বলা হয় এর আগে শুধুমাত্র দিন ছিল এবং সময়ের পরিমাপ সম্ভব ছিল না। যমী, যামিনী রূপে অনন্তকাল ধরে দিবা রুপী যমকে (সূর্যের পুত্র হিসেবে?) অনুসরণ করতে থাকেন। ফলে দিবা-রাত্রি হিসেবে সময়ের একটি এককের সৃষ্টি হয় এবং সময়ের পরিমাপ সম্ভব হয়। অন্য এক মতে দুঃখিনী যমী এক নিরুচ্ছাস নদীতে পরিণত হন, যাকে আজ আমরা যমুনা বলে থাকি।

এদিকে প্রিয় বোনের যন্ত্রনা দেখে যম পিতৃ লোক থেকে এসে, যমীকে বলেন যে প্রতিবছর কার্তিক মাসের দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার পর দ্বিতীয় দিনে তিনি তাঁর বোনের সঙ্গে দেখা করে যাবেন এবং এই দিনে যে বোন ভাই এর মঙ্গল কামনায় তাকে তিলক করবেন, যম তাঁর দিকে অসময় দৃষ্টি দেবেন না। এই হল আমাদের “ভাই ফোঁটা” এর উৎস। এদিকে যম তাঁর বোনের গর্ভে সন্তান উৎপাদনে অসম্মত হলেন, ফলে মনুষ্যজাতির বংশবৃদ্ধির কি হবে? সে এক অন্য কাহিনী, এবার সে প্রসঙ্গে আসি।

যম ও যমীর এই কাহিনী দেখে, ব্রহ্মা চিন্তিত হয়ে পরলেন, যে সৃষ্টি কিভাবে সম্ভব?

এরপর তিনি সপ্ত ঋষির এবং তাঁদের স্ত্রীদের সৃষ্টি করেন, তাঁরা হলেন গৌতম, ভরদ্বাজ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ এবং শান্ডিল্য। এই ঋষিদের সন্তান- সন্ততি থেকেই প্রাথমিক ভাবে গোত্রের শুরু, তা সংখ্যায় ছিল ৪৯। তার সঙ্গে সমাজে সগোত্র বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। এই ক্ষেত্রে গোত্র মুলত, পিতৃ শোনিত সম্বন্ধিত, ফলে, সগোত্র নারী এবং পুরুষকে একই পিতা-মাতা উৎপন্ন ভাই-বোনের সম্পর্ক বলে মনে করা হয়। পরবর্তিতে এই সপ্তঋষির সন্তান-সন্ততি এবং তাঁদের শিষ্যদের থেকেও বহু গোত্রের উদ্ভব হয়, বর্তমানে হিন্দুদের এক এক ভাগে এক এক সংখ্যক গোত্র, যেমন রাজপুত ও জাঠদের মধ্যে প্রায় ৩০০০ গোত্র আছে এবং আজও সগোত্র বিবাহ নিষিদ্ধ।

ঋকবেদের কাল আজ থেকে আনুমানিক ৪০০০ বছর আগে। সেই সময়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও বিভিন্ন সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল। দেখে নেওয়া যাক, সেই সব সমাজে রক্ত-সম্বন্ধিত বিবাহের (Incest) ব্যাপারে কি মত পোষন করা হত। প্রথমেই আসি মিশরীয় সভ্যতায়, এই সমাজে ভাই বোনের মধ্যে এমন কি মা-ছেলের মধ্যে বিবাহ (বা সম্পর্ক) অনুমোদন পেত।

মিশরীয় পুরাণে দেবী-দেবতাদের মধ্যে ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের বহু কাহিনী পাওয়া যায়। ফলে রাজ পরিবারে তা অনুকরন করা হত বলাই বাহুল্য।রাজা যেখানে দেবতার বংশধর। তাছাড়া, রাজ পরিবারে, রক্তের শুদ্ধতা কঠোর ভাবে রক্ষা করা হত। এর অতি বিখ্যাত নমুনা হল, বিখ্যাত বালক ফ্যারাও টুট-আনখ-আমুন। আধুনিক DNA পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, যে টুট-আনখ-আমুন এর বাবা ফ্যারাও আখ-এটন-আটেন এবং মা, বাবার সৎ বোন (তাঁর নাম জানা যায় না)।

আবার অন্য এক মতে টুট-আনখ-আমুন এর মা হলেন তাঁর ঠাকুরমা, বাবা আখ-এটন-আটেন এর মা, রানী টিয়। টুট-আনখ-আমুন এর স্ত্রী ছিলেন তাঁ নিজের বোন আনখ-সেন-আমুন। সুতরাং বলা যাচ্ছে যে মিশরীয় সভ্যতায় রক্ত-সম্বন্ধিত বিবাহ অনুমোদিত ছিল, হয়ত বা বহুল প্রচারিত ছিল, বিশেষত উচ্চপদস্থ ও উচ্চবর্গীয় মানুষদের মধ্যে। অনেক প্রত্নতত্ববিদ টুট-আনখ-আমুন ও তাঁর বাবার চেহারার (বিশেষতঃ করোটির আকার) বিকৃতি ও বিবিধ অসুস্থতার পেছনে এই রক্ত সম্ভধিত বিবাহ ও তার ফলে Genetic Disorder/ Chromosomal Abarration কে দায়ী করেন। টুট-আনখ-আমুন ছিলেন এক বিকলাঙ্গ কিশোর, তাঁর পা দুটো গোড়ালি থেকে ভেতর দিকে ঘোড়ানো ছিল (Clubbed foot), ফলে খুঁড়িয়ে হাটতেন ও লাঠি ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। সঙ্গে মুখের উপরের ঠোট এবং তালু দুইভাগ করা, আর মাথার খুলির অদ্ভুত গঠন। তাঁরা বাবা আখ-এটন-আটেনও ছিলেন অস্বাভাবিক চেহারার মানুষ। ছিল মাথার খুলির অদ্ভুত গঠন ও সঙ্গে Gynaecomastia, অর্থাৎ তাঁর বক্ষ ছিল মহিলা সুলভ।

এবার আসি মেসোপটামিয়াতে, এই সভ্যতার পুরাণেও মিশরের মত দেব-দেবীদের মধ্যে ভাই-বোন, বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, এমন কি ঠাকুরদা –নাতনির মধ্যে বিবাহের বর্ণনা পাওয়া যায়। সুতরাং এই প্রথা মানুষের মধ্যে, বিশেষত রাজ-পরিবারে অনুসরন করা হত বলাই বাহুল্য। এই প্রথা চলে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত, যখন পারস্য রাজত্ব শুরু হয়।

ব্যাবিলনিয়াতে বিখ্যাত রাজা হামুরাবীর আইন (Hammurabi Code) খ্রীঃ পূঃ ১৭৯২-১৭৫০ এ রচিত। এই আইনে সগোত্র বিবাহ কঠোর ভাবে শাস্তিযোগ্য ছিল। কিন্তু হামুরাবির আগে এ ব্যাপারে সেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এতটা কঠোর ছিল কি না বোঝা যায় না।

সব মিলিয়ে এটা ধারনা করাই যায় যে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক সন্ধানের বহুযুগ আগে ভারতে রক্ত-সম্বন্ধিত বিবাহের কুফল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল এবং তা নিষিদ্ধ ছিল।

অঘ্রানে ধানের খেতে….. সোনা ধানের হাসি বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (দ্বিতীয় পর্ব)

অঘ্রানে ধানের খেতে….. সোনা ধানের হাসি
বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উত্সব (দ্বিতীয় পর্ব)

কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

6

নবান্ন বাংলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। এই নবান্ন শব্দটির মধ্য দিয়েই বোঝা যায় এক সময় সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা ছিল বাংলা। আর সেজন্যই হয়তো নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। তবে গোটা বাংলার থেকে ভিন্ন রীতিতে নবান্ন উৎসব পালন করে উত্তরবঙ্গের প্রাচীন রাজবংশী সমাজ। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে এই উৎসব কে বলা হয় নয়া খাওয়া বা নয়া খই উৎসব। কেউ বা বলে অগনলক্ষ্মী। অঘ্রান মাসের পয়লা তারিখে রাজবংশী মহিলারা সকাল সকাল ঘরদোর পরিষ্কার করে লেপে মুছে শুদ্ধাচারে জমিতে যান ধানের গুচ্ছকে বরণ করে আনার জন্য।

কুলায় ধূপ, ধুনা, গোছা (প্রদীপ), গুয়া পান (পান সুপারি), ফুল, জল, নিমচ পাত সাজিয়ে একটি কলার ম্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয় জমিতে পূজো দিতে। সেখানে পাকা ধানের একটি গুচ্ছকে নিমচ পাত (কলার পাতার উপরের দিক টা) দিয়ে মুড়িয়ে তাতে সিদুঁর লাগানো গুয়া পান ফুল, জল নৈবেদ্য দিয়ে পূজা দেওয়া হয়। সেই গুচ্ছটিকেই আবার তুলে নিয়ে কলার ম্যান্ডতে ভরে মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসেন বাড়ির গৃহকর্ত্রী। বাড়ির ঠাকুরমারিতে মাটি খুঁড়ে সেই ধানের গুচ্ছ লাগানো হয়। আর দুধ, দই, চিড়া, ফলমুল দিয়ে পূজা করে গৃহকর্ত্রী কাচি দিয়ে সেই ধানের গুচ্ছ কেটে নিয়ে ঘরে তোলেন। এই রীতিকে বলে “ধানের শিষ” নেওয়া। উত্তরবঙ্গে মূলত হেউতি ধানের শিষ নেওয়ার প্রচলন ছিলো।

এরপর অধিকারী ঠাকুর বা ব্রাহ্মণ ঠাকুরকে দিয়ে করানো হয় পার্বণ শ্রাদ্ধ। বাড়ির কর্তা নতুন ধানের চিড়া, আতপ চাল, দই দুধ, ফলমূল নিবেদন করেন তার পূর্বপুরুষ কে। সবার আগে নতুন ধানের খাদ্য সামগ্রী পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যেই গতান করে দেওয়া হয়। নয়া খাওয়ার দিন বাড়িতে দিনের বেলায় প্রসাদ, দই চিড়া এসবই খাওয়া হয়। সন্ধ্যার সময় নতুন চালের ভাত রান্না করা হয়। ভাতের সাথে থাকে ঠাকুরি কলাই বা মাষকলাই এর ডাল, সরিষা শাক, মাছ বা মাংস আরো নানান রকম তরিতরকারি। রান্না হয়ে যাওয়ার পর একটি চেলার উপর কতগুলি কলার ঢোনা রেখে তাতে নতুন ধানের ভাত, সবজি, জল সাজিয়ে বাড়ির বাইরে জমিতে নিয়ে যায় গৃহকর্তা।

সেখানে সেই ঢোনার খাবারগুলি মাটিতে রেখে শেয়াল কুকুরের উদ্দেশ্যে ফুল, জল দিয়ে ভক্তি নিবেদন করে খাবার গুলি রেখে আসা হয়। পশুপাখিদের উদ্দেশ্যে এই যে খাবার ঢোনা নিবেদন করার রীতি একে বলে মাহাবারিকের পূজা। মাহাবারিকের উদ্দেশ্যে নিবেদনের পর বাড়ি এসে সবাই মিলে একত্রে নতুন ধানের অন্ন গ্রহণ করে।

নতুন খাওয়া উৎসবে রাজবংশী সমাজে এক অদ্ভুত শ্রদ্ধার পরিমণ্ডল দেখা যায় যা সম্পূর্ণভাবে মৌলিক।বিশ্ব চরাচরে পূর্বপুরুষের যে আত্মা বিলীন হয়ে গেছে তাঁকে সবার আগে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে প্রথম নতুন খাদ্য নিবেদন করা হয়। সেই সাথে দেখা যায় মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজন্তুর যে সহাবস্থান তার দিকে লক্ষ্য রেখে ভালোবাসার সাথে তাদের উদ্দেশ্যেও নিবেদন করা হয় মাহাবারিকের ঢোনা যা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসাকেই পরিস্ফুট করে। এই নয়া খাওয়া উৎসবের মধ্য দিয়ে রাজবংশী সমাজের জীবাত্মা পরমাত্মার প্রতি শ্রদ্ধার এক অনন্য দিক ফুটে ওঠে আমাদের সামনে।