মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

পথিকের গান

আমিও পথিক, গাই পথিকের গান
দেশ বিদেশে ঘুরেছি কত ইরান তুরান।
কত রঙ, আরও কত আছে তামাশা
আছে সবই শুধু নেই ভালবাসা।

পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট ইলোরা
প্যারিস রোম হয়ে এসেছি আগ্রা।
তেহরান কাবুল দুবাই সোমালিয়া
টেক্সাস টরেন্টো ফিলাডেলফিয়া।
পথে পথে ঘুরেছি, কত সাগর তীরে
হেঁটেছি সকাল সাঁঝে, জনতার ভিড়ে।
খুঁজেছি হৃদয়ের ঠিকানা, লোকালয়ের কাছে
পাইনি কিছু, হতাশ আমি কুহেলিকার মাঝে।

বেলা বয়ে যায় হাসি কান্নায়
শীত বসন্ত মিছে গান গায়।
কে আছ কোথায় বল শুনি বিধান
পশুতে মানুষে কী আছে ব্যবধান?

চীন জাপান হাওয়াই হংকং মালয়েশিয়া
ব্যাংকক ফিলিপাইন সিঙ্গাপুর ইন্দোনেশিয়া।
ওড়ে ওই আকাশে বাতাসে রঙ্গিন ফানুস
সাজান আছে সব দেখি নাই মানুষ।
এ কোন পৃথিবী দেখেছি এত দিন,
মনের জানালায় ওড়ে কি ধূলি রঙ্গিন?

সাগর তলে রূপ নগর

বাহরাইন সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে ব্রিটিশ পতাকাবাহী ট্যাংকার জাহাজ “কুইন অফ গালফ” এ ফুল লোড অর্থাৎ প্রায় ষোল হাজার টন হাই স্পিড ডিজেল নিয়ে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে শীতের কোন এক সন্ধ্যা বেলায় আমরা ওমানের মাস্কাট বন্দরের দিকে সেইল করেছি। মাত্র দুই দিন এক রাতের পথ। জাহাজ স্বাভাবিক গতিতে আরব্য উপসাগর দিয়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারণত এখানে সাগর উত্তাল থাকে তবে আজ সেইল করার সময় সাগর কিছুটা শান্ত ছিল বলা যায়। কিন্তু সেইল করার পর দিন ভোর থেকেই লক্ষ্য করছি আমরা যতই এগুচ্ছি ঢেউ এর উচ্চতা আস্তে আস্তে ততই বাড়ছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজের রোলিংও বাড়ছে। জাহাজে চাকরি করার অনেক সুবিধা যেমন: নানা দেশ দেখা যায়, তার সাথে নানা জাতির মানুষের সাথে মেশা যায়। জানা যায় তাদের জীবন যাত্রার ব্যবস্থা। পাশাপাশি কিছু অসুবিধা বা এক কথায় বলা যায় একটা দুঃসহ যন্ত্রণা রয়েছে আর তা হচ্ছে এই রোলিং। অনেকেই রোলিং মোটেই সহ্য করতে পারে না।

কাউকে এমনও বলতে শুনেছি যে, এই ভয়েজ শেষ হলেই আর আসব না। দেশে ফিরে গিয়ে পানের দোকান দেব তবুও এই রোলিং আর না। কিন্তু হলে কি হবে, সাগরের হাতছানির নেশায় যে একবার ডুবেছে তাকে যে আবার, বারবার সাগরের বুকে ফিরে আসতেই হবে। সাগরের যেন কেমন একটা মায়া রয়েছে। যে মায়াজালে সে সবাইকে আটকে ফেলে। সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাঁকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় মুক্তার মত সাদা ফেনার লুকোচুরি মানুষের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে নিজে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যখন নীল ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে কিংবা সাগর পাড়ে আছড়ে পরে সে এক মায়াবী দৃশ্য। একটা মনকাড়া মোহ। এই মোহজাল কেউ ছিঁড়ে বের হতে পারে না। এই মায়ার টানেই আবার ফিরে আসে, আসতে হয়।

সে দিন আস্তে আস্তে রোলিং বেড়েই চলেছে, সাথে বাড়ছে বাতাসের একটানা শো শো গর্জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগারে এমনি চলছে। স্টিয়ারিং করতে এসে ব্রিজে কেউ টিকতে পারছে না। এক এক করে তিন জন আউট। টিকবে কি করে? ওরা কেও ব্রিজে দাঁড়াতেই পারছে না। প্রতিটা ঢেউ এসে যখন জাহাজের গায়ে আছড়ে পরছে তখনই সমস্ত জাহাজটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ আর এ ভাবে চলা যায়? চার্টে দেখছি আমরা উপসাগরের পূর্ব পাড়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জাহাজ থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে কিনারা। পিছনে দুবাই এবং ডান পাশে ওমানের সীমা রেখা। সামনেই লিটল কুইন এবং লার্জ কুইন নামে ওমানের সীমানার ভিতরে সাগরের মাঝে প্রায় মাইল দুয়েক জুড়ে মাত্র মাইল খানিক দূরত্বে দুটি পাহাড় সারি অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়েই আছে। আবহাওয়া যখন ভাল থাকে তখন আমরা একটু মজা করার জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাতায়াত করি। তবে এই মাইল দুয়েক পথে খুব সাবধানে স্টিয়ারিং করতে হয় কারণ পাহাড়ের চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে ওখান দিয়ে যাতায়াতে জাহাজের কম্পাস কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বলে জাহাজের কোর্স ঠিক রাখা বেশ কঠিন কাজ। মোটামুটি খুব ভাল স্টিয়ারিং না করলে পাহাড়ের গায়ে যে কোন সময় ধাক্কা লেগে যেতে পারে। আর তেমন কিছু হলে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আজ এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারো তেমন মানসিকতা নেই। সবাই রোলিং এর দাপটে অস্থির। বমি করতে করতে

অসার। এই মধ্য সাগরে তো আর জাহাজ এমনি ছেড়ে দেয়া যায় না তাই যে কোন ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় ইঞ্জিন চালু রাখতেই হবে। ইচ্ছে করলেই পাড়ে এসে লগি গেড়ে বেঁধে রাখার উপায় নেই। সন্ধ্যার একটু আগে আমাদের ক্যাপ্টেন ডেভিড ল্যাম্ব ব্রিজে এসে বলল কাসাব বে আর কত দূর? চার্ট দেখে হিসেব করে বললাম ওই ত লিটল কুইন তার পরেই কাসাব বে, তা এখান থেকে চল্লিশ নটিকাল মাইল হবে। যেতে হয়ত চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। লিটল কুইন ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে কাসাব বে হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় চারদিকে ওমানের জন বসতি হীন মাইলের পর মাইল ধু ধু রুক্ষ পাথুরি পাহাড়ি এলাকা। শুধু সাগরের দিকে একটু খানি খোলা এবং ওই খোলা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই প্রায় মাইল পাঁচেক এলাকা জুড়ে ত্রিশ মিটার গভীরতা নিয়ে একটা আশ্রয় নেওয়ার মত জায়গা। সামুদ্রিক চার্টে দেখান আছে। আমরা এর আগেও এখানে বেশ অনেকবার এসে নোঙ্গর করে থেকেছি। ক্যাপ্টেন চারদিকে দেখে বলল তাহলে ওখানে ঢুকে নোঙ্গর করে থাকি, দেখি আবহাওয়া একটু শান্ত হলে পরে যাওয়া যাবে। বললাম তাই ভাল হয়। সাথে সাথে আমাদের বাহরাইনের কোম্পানির অফিসে কন্ট্রোল রুমের সাথে রেডিওতে যোগা যোগ করে জানিয়া দিলাম।

রাত প্রায় এগারটা নাগাদ আমরা কাসাব বের ভিতরে ঢুকে নোঙ্গর করলাম। এই এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যারা রোলিং শুরু হবার পর থেকে এতক্ষণ না খেয়ে শুয়ে ছিল তারা উঠে সবাই গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) গিয়ে যে যা পাচ্ছে তাই খেয়ে একটু সুস্থ হলো। সে রাতে আর তেমন কিছু করায় কারো মন ছিল না। কেবল মাত্র ব্রিজ ওয়াচে দুই জন ডিউটি করছিল আর বাকী সবাই যার যার বিছানায়।
পর দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আবহাওয়ার তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে মনে কটু খুশি হলাম যাক আজও হয়ত এখানেই থাকা যাবে। এখানে থাকার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। বড়শী দিয়ে প্রচুর মাছ ধরা যায়। আর জায়গাটাও চমৎকার। চারদিকে বেশ উঁচু নিচু নানা সাইজের পাহাড়। কোথাও খাড়া হয়ে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে আবার কোথাও ঢালু বালুকা বেলার মত মাঝে মাঝে কিছু কিছু ছোট বড় নানা আকারের পাথরের টুকরো দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে এমন মনে হতো। কোথাও কোথাও আবার এমন যে আকাশের মেঘেরা উড়ে এসে প্রায়ই এই সব কোন পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় নয়তো ধাক্কা দিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেখতে দারুণ লাগে। এখানে এসে যখন থাকি তখন আমাদের জাহাজে রাবারের একটা ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি বোট আছে ওটায় পাম্প করে ফুলিয়ে প্রায়ই কয়েক জন মিলে জাহাজ ছেড়ে ওই সব কিনারায় চলে যেতাম। অহেতুক নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে দেখার চেষ্টা করতাম। এখান থেকে উত্তরে এবং পশ্চিমে সাগর বা পিছনের পাহাড়ি তেপান্তর কেমন দেখায়। মনে হতো যেন মৌন পাহাড় গুলি আমাদের সাথে কত দিনের না বলা সঞ্চিত কথা বলে মনের আকুতি মেটাতে চাইছে। আমরাও নানা দেশের কয়েক জন পাহাড়ের সাথে চীৎকার করে নিজ ভাষায় কথা বলতাম। আবার কখন সাথে করে রঙের টিন আর ব্রাশ নিয়ে পাথরের গায়ে নিজেদের নাম লিখে রাখতাম। আজও হয়ত যারা ওখানে যায় তারা আমাদের নাম দেখতে পায়। মাইক, হ্যারি, কার্লো, অসীম, মহসিন, তিরু, গোল্ডি এমন আরও অনেক যা আজ এত দিনে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেছে।
সে দিন সকালে নাশতা করে বসে আছি এমন সময় ক্যাপ্টেন এসে বলল

“দেখছ এখন ওয়েদার চেঞ্জ হয়নি, আজ আর যাব না গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বলে দাও তারপরে চল মাছ ধরি”।
ক্যাপ্টেন নিজে এ কথা বললে আর ঠেকায় কে? যেই বলা সেই কাজ। সাথে সাথে ব্রিজে যে ডিউটি করছিল ওকে সু সংবাদটা দিয়ে বলে এলাম তুমি গ্রে বাহরাইনকে কল দিয়ে বলে দাও খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা আজ এখান থেকে বের হতে পারছি না। সাথে সাথেই হ্যারি রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকা শুরু করল ‘গ্রে বাহরাইন গ্রে বাহরাইন দিস ইজ কুইন অফ গালফ কলিং’। ওপাশ থেকে জবাব এলো
‘ইয়েস কুইন ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার’।
হাই স্টেনলি গুড মর্নিং, ডিউ টু ব্যাড ওয়েদার উই আর নট সেইলিং ফ্রম কাসাব বে টু ডে।
ওকে কুইন
এবার ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ওভার এন্ড আউট বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল আর আমি নিচে নেমে এসে মার্কিকে বললাম
চল আজ একটা নতুন এক্সপেরিয়ান্স নেয়ার চেষ্টা করি।
নতুন আবার কি, এখানে যা করার তা সব ইতো করা হয়ে গেছে!
না, আজ ডাইভিং করব। দেখছ না আজ পাহাড়ের কত কাছে নোঙ্গর করা হয়েছে। এত কাছে কি সাধারণত: নোঙ্গর করে?এই সুযোগ কি বারবার আসে?
ইয়া, ডাইভিং! বল কি?
হ্যাঁ তুমি যাবে না কি অন্য কাওকে বলব?
এদিকে আমাদের জাহাজে ডাইভিং সেট আছে মাত্র দুটা কাজেই এক সাথে দুই জনের বেশি যেতে পারব না।
না না আমি যাব। কখন নামবে?
যদি যাও তাহলে এখনি।
বেশ, চল। ডিঙ্গি রেডি করে ডাইভিং সেট রেডি করতে করতে আরও কয়েক জনের নজরে এলো যে আমরা আজ এখানে ডাইভ দিচ্ছি।
সবার এক কথা আমাকে বললে না কেন?
আরে এইতো বললাম। আমরা ফিরে আসি তোমরা এক এক করে সবাই যেও। কাওকে তো উপরে থাকতেই হবে। তোমরা আমাদের দেখবে ফিরে এসে আমরা তোমাদের দেখব, তাই না?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
বেশ। আমি আর মার্কি ডাইভিং স্যুট পরে ক্রেন দিয়ে নিচে ডিঙ্গি নামিয়ে দিলাম।

এখানে পানির গভীরতা প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিটার হলে কি হবে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে একেবারে সমুদ্রের তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্বচ্ছ কাচের মত পরিষ্কার টলটলে পানি। কত রকমের কত কি পানির তলে দেখা যায় তা কাছে থেকে দেখার লোভ ছিল অনেক দিন থেকেই। আজ তা হতে যাচ্ছে বলে মনে এক ধরনের চমক বোধ করছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে ডিঙ্গিতে নেমে এলাম। দুই জনের কোমরে রশি বেঁধে রশির এক প্রান্ত ধরে উপরে পাহারায় থাকবে দুই জন। ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রথা অনুযায়ী রশির টানের মানে নিয়ে একটু আলাপ করে নিয়েছি।

ডিঙ্গিতে নেমে পিঠের অক্সিজেনের টিউব, পায়ের ফিনস, হাতের গ্লোভস, ডাইভার্স নাইফ, পানি রোধক চশমা সব কিছু ঠিক আছে কি না দেখে ডিঙ্গির পাশে বসে পিছনে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে ঝুপ করে নেমে গেলাম। নিচে সাগর তলে এগিয়ে যাচ্ছি। সাঁতরে সাঁতরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর নিচে নামছি। কত রকমের মাছ আশেপাশে দিয়ে আসছে যাচ্ছে। কেউ একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছে। এরা আবার কারা এলো আমাদের এই স্বর্গ রাজ্যে? এমন একটা ভাব। একটু কাছে এসে ভাল করে দেখে সুড়ুত করে দিক বদলে চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে এসেছি। এবার আর সাঁতার নয় হাঁটছি। পানিতে সাঁতরানো যত সহজ হাঁটা ততটাই কঠিন। হাঁটছি আর দেখছি। ফিনস পরা পায়ের নীচে পাথুরি তল বলে হাঁটা যাচ্ছে না লাফিয়ে সাঁতারের মত করে এগুচ্ছি। ভয় ভয় লাগছে কিন্তু দুর্বার কৌতূহলের কাছে এই ভয় কিছুই নয়।

কত রকমের প্রবাল, মাছ, নানা রকম সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রাণী এর কিছুই আগে দেখিনি। একটা ঝোপের মত মনে হচ্ছে প্রায় মানুষের সমান উঁচু। প্রবাল ঝোপ হবে নিশ্চয়! মার্কিকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলাম চিনেছ? ও তেমনি হাত নেড়ে নিষেধ করল। কি এটা? দেখতে হবে। কাছে গেলাম। নিচে থেকে ঝাঁক ঝাঁক ছোট ছোট স্বাধীন মাছ বের হয়ে গেল। আরও কত কি মাটি ঘেঁষে বসে ছিল তারা সবাই সুড়ুত সুড়ুত করে এদিক ওদিক চলে গেল। অবাক হয়ে দেখছি। কত রকমের রঙ্গিন মাছ। অদ্ভুত সব কারুকাজ তাদের গায়ে। লাল, কাল, ধবধবে সাদা, লাল কাল ডোরা কাটা, হলুদের মাঝে সাদা বা কালো ডোরা। কত যে রঙের বাহার তা আমাদের দেশের কাঁটাবনের একুরিয়ামের মাছের বাজারেও নেই। বিশাল ফিনস, গায়ের চেয়ে ফিনস বড়, বিশাল। কাকচি মাছের চেয়েও ছোট এক রকম মাছের ঝাঁক। সবাই মনের আনন্দে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানে হাঙ্গর বা ছোট ছোট মাছ খেয়ে ফেলে এমন কেউ নেই তাই এরা এত স্বাধীন। এক রকম ছোট্ট মাছ দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে যাদের শরীরের এ পাশ থেকে ও পাশ ভেদ করে পানি দেখা যাচ্ছে, কোন রঙ নেই। গায়ের ভিতরে শুধু লাল কিছু রক্তের সরু অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সাগর তলের বিছানায় কত রকমের স্টার ফিস সহ আরও কত নাম না জানা প্রাণী নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আমাদের সারা পেয়ে ঝট পট এদিক ওদিক নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল।

একটা প্রবাল ধরে তুলে দেখলাম আমদের কক্সবাজারের দোকানে যেমন দেখা যায় তেমন নয় মোটেই। বিশ্রী শেওলা জড়ান। পানির হালকা স্রোতে শেওলা গুলি একটা ছন্দ তুলে দুলছে। নানা রকম নানা রঙের লতা পাতা স্রোতে দুলছে। এ যেন স্বর্গ রাজ্যের রূপনগর। পানির নিচে এত সুন্দর সে তো শুধু এত দিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি কিন্তু আজ নিজে চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না। অথচ নিজের চোখকে কি করেইবা অবিশ্বাস করি? আস্তে আস্তে কিনারার দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের নিচে যেতে চাইছি এমন সময় মার্কির পায়ের ছোঁয়া লেগে ঝোপের বেশ খানিকটা ভেঙ্গে গেল। পিছনে ঘুরে উঠিয়ে হাতে নিলাম। আরে এত প্রবাল! প্রবালের এত বড় ঝোপ? সারি সারি অনেক। হাতে নিয়ে শেওলা সরিয়ে দেখি এগুলি সাদা নয় ভিন্ন রঙ, একটু লালচে ধরনের। দেখতে দেখতে নানা ঝোপঝাড় পার হয়ে একটু দূরে লক্ষ্য করলাম অন্ধকার মনে হচ্ছে। থমকে দাঁড়ালাম। মার্কি ইশারা করল। কি হয়েছে? ওকে ওই অন্ধকার দেখিয়ে বোঝালাম। ইশারায় বলল ওটা পাহাড়ের নিচের দিক।
তাই নাকি?

আরও একটু ভয় ভয় নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছি। দুই জনের কোমরে দুইটা আলাদা রশি বাধা। রশির আরেক মাথা ধরে জাহাজের ডেকে দুই জনে সজাগ রয়েছে কোন রকম একটু সিগন্যাল পেলেই টেনে জাহাজের দিকে নিয়ে যাবে। আবার এদিকে দুই জনের সাথে আলাদা যে রশি দুই জনকে বেধে রেখেছে যেন দুই জন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। স্রোত বা অন্য কোন উপায়ে বিচ্ছিন্ন না হতে পারে। এগিয়ে যাচ্ছি আর এই রূপনগরের রূপ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। মাটির পৃথিবী এবং সাগর তলের পৃথিবীর মধ্যে যে কত তফাত তা আজ এখানে না এলে কোন দিন জানা হত না। পানির নিচেও বাগান, বন জঙ্গল, নানা জাতের নানা ধরনের প্রাণী রয়েছে। অবশ্য সব প্রাণী যে নিরীহ বা হিংস্র নয় তা আমরা জানি। এখানেও ভয়ঙ্কর, হিংস্র বা বিষাক্ত বিভিন্ন প্রাণীও বাস করে। এ নিয়ে তেমন আনন্দিত বা দু;খিত হবার কিছু নেই।

পাহাড়ের যতই কাছে যাচ্ছি ততই কেমন যেন গা ছম ছম করা একটা ভাব হচ্ছিল। ভয়ের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল, কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। বারবার হাতের ডাইভিং নাইফ এবং রশির অস্তিত্ব ঠিক আছে কিনা পরখ করছিলাম। কিছু হলেই যাতে জাহাজে সংকেত পাঠাতে পারি নিজেকে সেই ভাবেই রেডি রাখছিলাম। যদিও জানি হাতে যে ছুড়ি আছে ওটা দিয়ে হাঙ্গর বা তেমন কোন সামুদ্রিক হিংস্র মহাশয়কে কাবু করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবুও হাতে রাখা। তবে মার্কি কি ভয় পাচ্ছিল না কি স্বাভাবিক ছিল তা আর জিজ্ঞাসা করিনি। আমি বুদ্ধি করে ওর পিছনেই থাকছি। এর মধ্যে জাহাজের তলা থেকে প্রায় দুইশত মিটার চলে এসেছি। আসার সময় জাহাজের নোঙ্গর দেখেছি। একটা শেওলা জড়ান বিশাল পাথরের ফাকে আটকে আছে।

এগিয়ে যাচ্ছি আর এই নতুন দেখা রূপনগরের রূপের শোভা দেখছি। এক সময় পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণ আর কি দেখেছি? এখানে আরও সুন্দর। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি মাটির উপরে এমন কোন সাজানো বাগান নেই যা এখানকার চেয়ে সুন্দর। কিন্তু কথা হচ্ছে এই বাগানের মালী কোথায়? পানির উপর থেকে সূর্যের আলো এসে যেন সমস্ত বাগান আলোকিত করে রেখেছে। এখানেই এত সুন্দর তাহলে লিটল কুইন এবং লার্জ কুইনের নিচে বা বন্দর আব্বাসের পূর্ব দিকে সমুদ্রের পাড়ে যেখানে পাহাড় সাম্রাজ্য বিস্তার শেষ করে সাগরে মিশেছে সেখানে কেমন হবে? ভাবনার সাগরে ডুবে আবার কোথায় হারিয়ে গেলাম জানি না। হঠাৎ মার্কির সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেলাম। অক্সিজেনের মিটারের দিকে চেয়ে দেখি প্রেশার যথেষ্ট আছে। মার্কি দাঁড়িয়ে পরেছে। কি ব্যাপার? ও তখন সামনে একটু বাম দিকে দেখিয়ে দিল। দেখে আমার হৃৎপিণ্ড থেমে গেল শ্বাস নিতে ভুলে গেছি। বিশাল একটা কি যেন আশেপাশের সব কিছু নিতান্ত তাচ্ছিল্য ভরে মুখ হা করে এগিয়ে আসছে আর তার চার দিকে নানা আকৃতির নানা প্রজাতির মাছ ঘুর ঘুর করছে। কেউ কেউ আবার ওটার গায়ে জমা শেওলা ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। ওটা হাঙ্গর নয় চিনতে পেরেছি কারণ হাঙ্গর হলে এই এত গুলি মাছ ওর কাছে থাকার সাহস পেত না। প্রাণীটা যে হিংস্র নয় তা তার চলা ফেরা এবং তার সঙ্গীদের দেখেই বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝে ওটা নিজেও আসে পাশের গাছ পালা, লতাপাতা মুখে দিয়ে এবং পাথর আর প্রবাল থেকে একটু আধটু শেওলা চেখে দেখার ভাব করছিল। ওটার আকার প্রায় পাঁচ ছয় মিটার ব্যাসের একটা গোলাকার চাকতির মত, পিছনে প্রায় তিন মিটার লম্বা চিকন লেজ, সামনের অর্ধেকটাই প্রায় মুখ আর পিঠে উপরে ত্রিকোণাকৃতির আইর মাছের মত একটা প্রায় দুই মিটার উচ্চতার কাটা,

মুখের দুই পাশে চার পাঁচটা কুলার আকারের ফিনস। সারা গায়ে সবুজ শেওলা জমে রয়েছে আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। দেখে ভয়ংকর দর্শন মনে হলেও মোটেও হিংস্র মনে হচ্ছে না। তবুও অচেনা মহাজন বলে মন থেকে ভয় দূর করতে পারছি না। কি করব?মার্কি ইশারা করে বোঝাল এখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, কোন নড়াচড়া করবে না। এমন বিকট এবং ভীষণ দর্শনের কোন প্রাণী দেখাতো দূরের কথা কোন দিন ছবিও দেখিনি। যাক, আমরা দুই জনেই চুপ করে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মাত্র অক্সিজেনের বোতল থেকে শ্বাস নেয়ার পর বুদ বুদ বের হচ্ছে অথচ রূপনগরের মহাজন সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আস্তে আস্তে আমাদের কয়েক মিটার সামনে দিয়ে যেমন গতিতে আসছিল তেমনি গজেন্দ্র গতিতে তার হেলাফেলা ভাব নিয়ে চলে গেল । সামনে দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করলাম উনার চোখ মাত্র একটা। মুখের সামনের দিকে একটু উপরে এবং গোলাকার পাতা সহ। মানে উনি চোখ বুজে ঘুমাতে পারেন।

আমাদের ছেড়ে কিছু দূর যাবার পরেই মার্কির হাতে চিমটি দিয়ে ইশারা করে হাতের ঘড়ি দেখালাম আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে। চল যথেষ্ট হয়েছে, আর না। রশিতে টান দিয়ে জাহাজে সংকেত পাঠিয়ে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে যাবার জন্য উপরে ভেসে উঠলাম। আর আমাদের দেখা মাত্র জাহাজ থেকে যারা আমাদের পাহারায় ছিল ওরা রশি টেনে আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ওই রূপ নগরের কথা আজও ভুলতে পারিনি। এখনও মনে হয় এইতো সেদিন দেখে এসেছি।

সাগর সেচা প্রাণ

গত কালের দেয়া সেইলিং অর্ডার অনুযায়ী আজ বিকেলে মাস্কাটে তেল আনলোড করে হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিয়ে জাহাজে খাবার পানি এবং টুকিটাকি যা কিছু প্রয়োজন ছিল তা নেয়া হয়েছে। ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ফুল লোডিং চলছে, বাকিটা চলতি পথেই দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে নেয়া হয়ে যাবে। সাগরের অবস্থা বেশ শান্ত। কোন অসুবিধা হবার সম্ভাবনা নেই। কাস্টম, ওমান ইমিগ্রেশন এবং মাস্কাট পোর্ট কন্ট্রোলের ছাড় পত্র নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে প্রায় সাড়ে ছয়টায় জাহাজ ইরানের আবাদান বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছি। হারবার এলাকা থেকে বেড় হয়ে আরব্য উপসাগর দিয়ে ফুল এহেডে চলছে। একটু পরে ন্যাভিগেশন লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। সামনে আশে পাশে দুই একটা জাহাজ আসছে যাচ্ছে তাদের ন্যাভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে। রাডারে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ আবার আরও কিছু উত্তর দিয়ে আরবসাগরের দিকে যাচ্ছে।

ব্রিজের পিছন দিকে চার্ট টেবিলের পাশে ইলেকট্রিক কেটলিতে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে স্টিয়ারিং করছিল ডেভিড ওকে এক কাপ দিয়ে আমার চিরাচরিত অভ্যাস মত ব্রিজের বাইরে সাইড লাইটের উপরে বসে রাতের নীলসাগরের বুকে খোলা আকাশের নীচে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলছি। এই অভ্যাস একদিনের নয়। যত দিন থেকে নাবিক জীবন চলছে বলতে গেলে সেই থেকে এক ভাবে চলছে।এক কাপ কাল কফি না হলে যেন ব্রিজে ডিউটি করা যায় না!

রাত বারোটায় চীফ অফিসার লুইস এর ডিউটি। নিয়ম অনুযায়ী ঠিক পাঁচ মিনিট আগে লুইস ব্রিজে এলো। ওকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলাম ঘুমের ঘরে। এর পরে আবার সকাল আটটা থেকে ডিউটি।সকালের ডিউটিও নিয়ম মত দুপুর বারোটায় শেষ করে কেবিনে ফিরে এসেছি। গোসল করে দুপুরের লাঞ্চ করে একটু গড়িয়ে নেবার ইচ্ছে হলো। আরব দেশের জুন মাসের এই প্রচন্ড গরমে আমাদের দেশের আম কাঁঠাল পাকার গরমের কথা মনে এলো। কিন্তু মনে এলেই কি আর গাছের আম পেড়ে খাওয়া যায়? মনে মনে ভাবতে ভাবতে এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শুয়ে পরেছিলাম, কখন যেন একটু ঝিমানি ভাব এসেছিল। স্বপ্নে দেখছিলাম গ্রামের বাড়িতে আম বাগানের ছায়ায় বসে আছি আর ছোট ভাই বোনেরা আধাপাকা আম পেড়ে এনে দিচ্ছে। মুখে দিতে যাব এমন সময় কাছেই কার চিৎকারের শব্দ কানে এলো। চিৎকার শুনে চাচাত বোন নীলাকে কার কি হলো দেখতে বললাম।হাতের আম হাতেই ধরা রয়েছে এখনও মুখে দেইনি। সঙ্গে সঙ্গে নীলা চ্যাঁচিয়ে বলল দাদা পারুল গাছ থেকে পরে গেছে! কি? বলার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙ্গে দেখি জাহাজের কেবিনে শুয়ে আছি। এটা নিজের গ্রামের বাড়ির আম বাগান নয় আরব্য উপসাগরের উপর দিয়ে আমার জাহাজ ইরানের আবাদান বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সেই কবে দেশ ছেড়ে এসেছি আবার কবেই যে যাব?মনটা খারাপ হয়ে গেল।একটু শুয়ে রইলাম। হঠাৎ করে কেন যেন মুখে কোথা থেকে এক রাশ থু থু জমে গেল।ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না কিন্তু মুখে থু থু নিয়েই শুয়ে থাকি কি করে? তাই বাধ্য হয়েই উঠে পোর্ট হোল (জাহাজের কেবিনের এক রকম গোল জানালা) খুলে মাথাটা বের করে থু থু ফেলছি হঠাৎ জাহাজের পিছন দিকে চোখ যেতেই নীল সাগরের বুকে কি যেন কাল একটা ফুট বলের মত দেখলাম। একটু চমকে উঠলাম! কি ব্যাপার, এখানে এটা কি? গতকাল মাস্কাট বন্দর ছেড়ে আসার পর প্রায় দুই শত নটিক্যাল মাইল চলে এসেছি এখানে এই সাগরের মাঝে এটা
কি?একটু অস্বাভাবিক মনে হলো। নিতান্ত কৌতূহল নিয়ে দেখার জন্য কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে জাহাজের পিছনে

এসে দেখি কে একজন মানুষ। নিশ্চয় কেউ পরে গেছে! কে পড়েছে?জাহাজ প্রায় বার নটিক্যাল মাইল বেগে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে দুই শত মাইলের মধ্যে কোন কূল কিনারা নেই।
জাহাজ থেকে মানুষ পরে গেলে যার নজরে আসে তাকে “ম্যান ওভার বোর্ড” বলে চিৎকার করতে হয়, এটাই নিয়ম। সেই অনুযায়ী চিৎকার করছি কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আতঙ্কে ভয়ে আমি দিশাহারা। কি করব? কি করব?দৌড়ে ব্রিজে চলে গেলাম। আমার ওই উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা দেখে ব্রিজে যারা ছিল তারা জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে?কথা বলছ না কেন?আমি কিছুই বলতে পারছি না, আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে তা ভুলিনি। তাড়াতাড়ি ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাম টেনে জাহাজের গতি থামিয়ে দিলাম এবং উইলিয়াম স্টিয়ারিং করছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের হাতে স্টিয়ারিং নিয়ে জাহাজটা সম্পূর্ণ ডানদিকে ঘুড়িয়ে দিয়ে ওকে টেনে ব্রিজের বাইরে এনে হাতের ইশারায় পিছনে যে মাথাটা দেখেছিলাম সেটা দেখিয়ে দিলাম। পিছনে সেকেন্ড অফিসার ম্যাক্স এসে দাঁড়িয়েছে।ম্যাক্স জিজ্ঞেস করল “হু ইজ দ্যাট”? বললাম চিনতে পারিনি।

লোকটা এতক্ষণে বেশ পিছনে পরে গেছে। শান্ত সাগর বলে এখনও দেখা যাচ্ছে। একটু অশান্ত হলে আর দেখা যেত না।এবার উইলিয়াম এবং ম্যাক্সকে নিয়ে ব্রিজ থেকে নেমে মেইন ডেকে এলাম। এই খোলা সাগরে মাঝপথে হঠাৎ জাহাজ থেমে গেল কেন জানার জন্য প্রায় সবাই বাইরে চলে এসেছে। সবার মুখে প্রশ্নের ছায়া, কি হয়েছে? গত পরশু সকালে মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে ছিলাম তখন আমাদের রাবারের ডিঙ্গি বোট নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য পাশে নোঙ্গর করা ‘প্যাসিকফিক ম্যারিনার’ গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সেই ডিঙ্গি ক্রেন দিয়ে তুলে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তাতে পেট্রোল সহ সব কিছুই রেডি ছিল।
এর মধ্যে জাহাজ ঘুরে থেমে গেছে। ওরা সহ ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গিটা নামিয়ে আমি, ম্যাক্স আর উইলি এই তিন জন ডিঙ্গিতে নেমে এক টানে ডিঙ্গির ইঞ্জিন স্টার্ট করে ফুল স্পিডে এগিয়ে গেলাম। প্রায় সমুদ্র সমতলে নেমে এসেছি বলে আর ওই মাথা দেখা যাচ্ছে না। জাহাজের উপরে পিছন দিকের কোয়র্টার ডেকে যারা ছিল ওরা দেখিয়ে দিল ওই দিকে যাও।

এগিয়ে গেলাম। অল্প একটু পরেই ওই লোককে দেখা গেল।তাড়াতাড়ি আরও তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দ্রুত গতিতে শ্বাস বইছে, বুক ঢিব ঢিব করছে, জিহ্বা শুকিয়ে গেছে। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না, সবাই চিন্তিত।ডিঙ্গির হ্যান্ডলের থ্রটল ঘুড়িয়ে স্পীড বাড়াতে চাচ্ছি কিন্তু এর চেয়ে বেশি স্পীড নেই। কাছে চলে এসেছি। এইতো আর একটু। আর একটু। হ্যাঁ আরও কাছে চলে এসেছি প্রায় ধরা যায়। ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই এতক্ষণে চিনতে পারলাম। আমাদের জাহাজের টোপাস (ক্লিনার) ভারতের বিহার এলাকার অর্জুন।

যাক, সাঁতার জানত বলে এই এতক্ষণ ভেসে থাকতে পেরেছে। আমি হলে কি করতাম? আমি তো সাঁতার জানি না! এ কথা মনে হতেই আর এক দফা আতঙ্ক এসে ভর করল। তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে ডিঙ্গির স্পীড কমিয়ে আস্তে আস্তে কাছে এসে ওকে ধরা মাত্রই হাত পা ছেড়ে দিয়ে একেবারে সেন্স লেস। সমস্ত শরীর নোনা পানিতে ঠান্ডা বরফের মত হয়ে গেছে। সবাই মিলে টেনে ডিঙ্গিতে উঠিয়ে শুইয়ে দিলাম। এবার ডিঙ্গি ঘুড়িয়ে জাহাজে ফিরে এসে অর্জুনকে ওই ডিঙ্গিতে রেখেই ডিঙ্গি সহ আমাদের সবাইকে ক্রেন দিয়ে তুলে নিল। জাহাজে উঠে দেখি ক্যাপ্টেন, চীফ ইঞ্জিনিয়ার, চীফ অফিসার সহ সবাই ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ক্যাপ্টেন বলল ওর কাপড় বদলে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা রুমে নিয়ে গরম কম্বল গায়ে দিয়ে দাও আমি আসছি। একটু পরে ক্যাপ্টেন এসে হিটার চালাতে বলল। রুমটা গরম হবার পর অর্জুন একটু মিট মিট করে তাকাল। পাশে থাকা সবাই যেন হাতে চাঁদ পেলাম।কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোন কথা নেই। যেমন ছিল আবার তেমনি আসার দেহে পরে রইল। প্রায় আধা ঘণ্টা পরে আবার মিট মিট করে তাকাল। বির বির করে প্রথম কথাটা বলল- ম্যায় মার গিয়া কিয়া (আমি কি মরে গেছি)?আরে না অর্জুন তুমি মরনি। এইতো আমরা সবাই তোমার পাশে। তুম লোগ কিয়া অবতার হ্যাঁয়? না না, আমরা সবাই তোমার কলিগ। এবার নরে চরে উঠে বসল। ওকে উঠতে দেখে গ্যালি (কিচেন) থেকে ব্রান্ডি মেশানো গরম কাল কফি এনে দিলাম। তবুও ও বিশ্বাস করতে চাইছে না যে ও এখনো এই ধরণীর বুকে বেঁচে আছে। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মত আস্তে আস্তে ওকে বোঝাতে চাইলাম যে তুমি জাহাজ থেকে পরে যাবার পরই আমরা দেখতে পেয়ে সাথে সাথে ডিঙ্গি নিয়ে তোমাকে তুলে এনেছি, তুমি মরনি। সাগর সেচে আমরা তোমার প্রাণ ফিরে পেয়েছি। অর্জুন কাঁদবে না হাসবে না কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে সবার মুখের দিকে দেখছে। এবার ওর মুখে কফির কাপটা তুলে বললাম একটু একটু খেয়ে নাও।

সিক্ত অনুরণন

জোছনার রংধনু থেকে চন্দন এনেছি তোমায় সাজাব বলে,
আকাশের তারা এনেছি মালা গেঁথে তোমায় পড়াব গলে।
সাগর তলে রূপ নগরে বেঁধেছি তোমার জন্যে ছোট্ট বাসা,
বাঁকা চাদের কানের দুল পড়াব তোমায় সেই তো ছিল আশা।

নীল যমুনার জলে ভেজা নীলাম্বরী শাড়িতে ঢেকে দেহ লতা
জোনাকির দ্বিপ জ্বেলে মেঠো পথের ধারে বসে কইব যত কথা।
পারিজাতের গন্ধ ভরা ফাল্গুনি হাওয়ায় দুলব দুজনে ঝুলন মেলায়
দূর গগনে শুক্লা তিথির চাঁদ থাকবে চেয়ে তারাদের ছায়ায়।

বরষার মেঘ ডেকে আনে যদি শুভ্র বসনা ঝুর ঝুর কামিনী
হেমন্তিকা ছড়াবে হেসে গোধূলির পরে মধু গন্ধ ভরা মধু যামিনী।
ফাগুন বলবে এসে কি কথা বল এত শুনি শুধু দুজনার কানাকানি
সপ্ত ঋষি বলবে হেসে নিরালায় কইবে কথা নয়ত হবে জানাজানি।

শুকতারা ভালবেসে বসবে এসে সোহাগ করে তোমার কপালের টিপে
সাগরে ভেসে যাব তুমি আর আমি দুজনে মিলে দূর অচেনা দ্বীপে।
যেখানে শুধু ভালবাসব তুমি আর আমি নিরবধি কারণে অকারণে
দুরন্ত নীল ঢেউ দুলবে হাওয়ায় নীল জোছনায় সিক্ত অনুরণনে।

শরতের নিমন্ত্রণ

দুপুরের রোদে কপোতীরা উড়ে যায়
শরতের শেষে দূরের ওই নীলিমায়।
বসে বসে দেখি তাই একা বাতায়নে
কোন বাঁধা মানে না দুই নয়নে।

দেখি সুন্দর কত এই নীল আকাশ
পাখা মেলেছে যেন মৃদুমন্দ বাতাস।
ফুটে আছে কাশফুল লাগে শিহরণ
ছোট ছোট মৌ মাছি তোলে গুঞ্জরন।

এলোমেলো মেঘগুলি উড়ে যায় দূরে
নেমে আসে ঘুম রাখালি বাঁশির সুরে।

শুভ্র বসনা শিউলি ডাকে যে আমায়
যেন চাদের কণা হাসে রাতের নিরালায়।
এ দেশের এই রূপ দেখেছি যে তাই
মরণের পরেও যেন দেখিতে পাই।

উত্তাল সাগরে দুরন্ত ঢেউ

১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে আমার সপ্তম ভয়েজে যাত্রার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে দুবাই তারপর দুবাই থেকে গালফ এয়ারে বাহরাইন এসে পৌঁছলাম। ব্রিটিশ পতাকা বাহি ট্যাংকার জাহাজ ইলেক্ট্রা কুয়েত থেকে লোড করে শারজাহ যাবার পথে আমাকে বাহরাইন থেকে নিয়ে যাবে এবং সেকেন্ড অফিসার জাকিরকে নামিয়ে দিয়ে যাবে। জাকির সাইন অফ করে দেশে যাবে, ওর জায়গায় আমি এসেছি। জাহাজ আসতে আরও দুই বা তিন দিন দেরি হবে এ কয় দিন কোম্পানির খরচে বাহরাইনের মানামায় একটা হোটেলে থাকি, খাই দাই ঘুরি ফিরি আর কোন কাজ নেই।
দুই দিন পর রাতে বাইরে থেকে হোটেলে ফিরে এলে রিসিপসনস্ট জানাল যে তোমার অফিস থেকে ফোন করে বলেছে তুমি আগামী কাল সকাল আটটায় রেডি হয়ে থাকবে এজেন্ট এসে জাহাজে নিয়ে যাবে। বেশ, পর দিন সকালে উঠে যথারীতি রেডি হয়ে রইলাম। একটু পরেই এজেন্ট এসে তার গাড়িতে করে নিয়ে গেল। পোর্টে ঢুকে ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি সেরে জাহাজে উঠে পরলাম জাকির সাইন অফ করে নেমে গেল। আগেই জানতাম এই জাহাজে আমার কয়েক জন বন্ধু আছে। আমি ওঠার পরে পরেই জাহাজ ছেড়ে দিল। আমার ডিউটি দুপুর বারোটা থেকে। চীফ অফিসার সুধাংশু’দা আমার কেবিন দেখিয়ে দিল, উনার কাছেই জাহাজের মাপ জোক স্বভাব চরিত্র জেনে নিলাম এটার ধারণ ক্ষমতা প্রায় ১৫,০০০ টন, গ্রস টনেজ প্রায় ৭,০০০ টন, ঘণ্টায় বার নটের বেশি ক্রুজ করতে পারে না এবং এরাবিয়ান গালফের মধ্যে ক্রুড ওয়েল বাদে নানা গ্রেডের তেল নিয়ে এর চলাচল সীমিত।

দিন গুলি বেশ কেটে যাচ্ছিল। এখান থেকে ওখানে। রাতের ন্যাভিগেশনের সময় ব্রিজের রেডিওতে কাছাকাছি যে সব জাহাজে অন্যান্য বন্ধুরা আছে তাদের সাথে ইয়ার্কি ফাজলামি, গল্প গুজবের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে নভেম্বরের শেষ দিকের কোন এক সময়ে ইরানের আবাদান রিফাইনারি থেকে Jet A1 বা জেট কেরাসিন এনে আবুধাবির এডনক কোম্পানির অফ শোর বয়াতে মুরিং করে ডিসচার্জ করা হয়ে গেছে। পাইপ লাইন ডিস কানেক্ট করে পাইপের মুখ বন্ধ করে সাগরে ছেড়ে দিয়েছি।
খালি ট্যাংকার জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে যাত্রা সম্ভব নয় বলে সি ভাল্ভ খুলে পাম্পিং করে পুরো জাহাজ আবার সমুদ্রের পানি দিয়ে বোঝাই হচ্ছে। এবার পানীয় জল নেবার জন্য হারবারের ভিতরে ঢুকতে হবে।

আবুধাবির এজেন্ট গ্রে আবুধাবিকে ডাকলাম,
গ্রে আবুধাবি গ্রে আবুধাবি দিস ইস ইলেক্ট্রা কলিং।
গ্রে আবুধাবি সাথে সাথেই উত্তর দিল।
ইয়েস ইলেক্ট্রা, দিস ইস গ্রে আবুধাবি, ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার।
আমাদের আনলোড হয়ে গেছে, পাইপ লাইন ছেড়ে দিয়েছি, পানির কি করেছ?
এখানে ফ্রেস ওয়াটার নেই তোমরা দুবাই চলে যাও ওখান থেকে পানি নিয়ে বাহরাইনের সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে হাই স্পিড ডিজেল লোড করে মাস্কাট যাবে।

আমরা আগের ধারনা অনুযায়ী আবুধাবি থেকে বাহরাইন যাবার চার্ট রেডি করে রেখেছি, এখন আবার দুবাইর পথ বের করতে হবে আবার দুবাই থেকে বাহরাইনের পথ বের করতে হবে, ঝামেলার ব্যাপার। যথারীতি চীফ
অফিসার এবং জাহাজের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেনকে জানালাম। ক্যাপ্টেন তার রুম থেকে ভিতরের সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে এসে কালচে আকাশ দেখে থমকে গেল। আমরাও যে লক্ষ করিনি তা কিন্তু নয়। ব্যারো মিটারে বাতাসের চাপ অসম্ভব কমে গেছে। নিম্ন চাপের পূর্বাভাস। আরব্য উপসাগরের স্বভাব আমাদের বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহা সাগরের মত নয়। ওখানে শীত কালে সাগর অশান্ত থাকে আবার গরমের সময় শান্ত থাকে, আমাদের উলটো। এর মধ্যে সাগরের পানি একেবারে থমথমে ভাব ধারণ করেছে, ঠিক যেন মনে হচ্ছে বড় কোন সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরের কাচের মত। যেন কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু পারে না, একে বারে সুবোধ বালক।

ক্যাপ্টেন নিজেই রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে গ্রে আবুধাবি কে ডেকে বলল তোমরা ওয়েদার রিপোর্ট নিয়েছ?
হ্যাঁ দেখেছি, ওয়েদার ভাল।
আমি দেখছি ওয়েদার খারাপ তোমরা ভাল রিপোর্ট পেলে কোথায়?
না না ওয়েদার ভাল তুমি তারা তারি সেইল কর।
ঠিক আছে আমি সেইল করছি তবে আমার মনে হচ্ছে আবার ফিরে আসতে হতে পারে।
ক্যাপ্টেন এক রকম নিরুপায় হয়ে নোঙ্গর তোলার অর্ডার দিল। পিছনের রশি খুলে নোঙ্গর তোলা হয়ে গেলে জাহাজ ঘুড়িয়ে দুবাইর উদ্দেশ্যে ফুল এহেড ইঞ্জিন চালাবার নির্দেশ দিয়ে দিলাম। কে যেন স্টিয়ারিং করছিল মনে নেই। ক্যাপ্টেন আমাকে চার্ট চেঞ্জ করার কথা বলে আর কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে নিচে চলে গেল। সুধাংশু’দা ও তার সাথে সাথে চলে গেল। বেশি না, আবুধাবি থেকে দুবাই মাত্র ঘণ্টা তিনেকের পথ। জাহাজ চালিয়ে দিয়ে গ্রে দুবাইকে বললাম আমরা সকাল এগারোটায় পৌঁছব, আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা কর।

ওরা বলল হ্যাঁ আমরা জানি, গ্রে আবুধাবি বলেছে। তোমরা এসে দুবাই পোর্ট কন্ট্রোলের সাথে কথা বলে সরাসরি হারবারের ভিতর ঢুকে যেও। এক সময় দুবাই এসে পানি নিয়ে দুপুর দুইটায় গ্রে দুবাই এবং দুবাই পোর্ট কন্ট্রোল কে জানিয়ে জেটি ছেড়ে হারবারের বাইরে চলে এলাম। গ্রে বাহরাইনকে ডেকে আমাদের ETA জানালাম আগামী কাল সন্ধ্যা ৭টা। কোর্স ঠিক করে আবার ফুল এহেড, গন্তব্য বাহরাইনের সিতরা পোর্ট। দুবাই আসার পথেই চার্ট রেডি করে রেখেছিলাম। আকাশ তখন ওই রকম, সাগর জলও নিস্তরঙ্গ। গুমোট থমথমে ভাব। ক্যাপ্টেন আকাশের অবস্থা, ব্যারোমিটারের রিডিং দেখে ভুরু কুচকে এবার মিডল ইস্টে আমাদের প্রধান অফিস গ্রে বাহরাইনের সাথে নিজে কথা বলে যাত্রা বিরতির কথা জানাল। কিন্তু গ্রে বাহরাইনেরও সেই একই কথা, না না, যত তারা তারি সম্ভব এসে লোড নিয়ে যাও।

ঘণ্টা তিনেক এর মধ্যে ডিউ ওয়েস্ট অর্থাৎ ২৭০ ডিগ্রিতে হেডিং করে আমরা ঘণ্টায় ১২ মাইল বেগে দুবাই পিছনে ফেলে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছি। পিছনে ৩২ তলা দুবাই হিলটন হোটেল ছায়া ছায়া দেখাচ্ছে, দুবাই শহরের অন্যান্য দালান কোঠা আজ আর দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে সাধারণত ৩৫/৪০ মাইল পর্যন্ত দিগন্ত রেখা বেশ স্পষ্টই দেখা যায়। আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে। আমার ডিউটি শেষের পথে। আমার জায়গায় থার্ড অফিসার পর্তুগীজ কার্লো আসবে। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি কার্লোকে কি কি বুঝিয়ে দিতে হবে তার একটা তালিকা বানাচ্ছি মনে মনে। এমন সময় হঠাৎ উত্তরের দিকে দৃষ্টি গেলে এক অস্বাভাবিক দৃশ্য নজরে এলো, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম সাথে একটু ভয়।

নীল সাগরের জল অনেকক্ষণ ধরেই রঙ বদলে ফেলেছে, দুবাই হারবার থেকে বের হয়েই লক্ষ্য করেছি। এখন দেখলাম সেটা কাল হয়ে গেছে, উত্তর থেকে একটা বিশাল কাল পাহার আকাশ বেয়ে রকেটের গতিতে যেন আমাদের দিকে উড়ে আসছে। আবার ঠিক সাগরের ঢেউ এর মত যেন ইরানের আস্ত কুহে তুর পাহার মাথায় সাদা মুকুট পরে শত সহস্র মাইল বেগে ধেয়ে আসছে। সাগরে এবং আকাশে দুই পাহাড় দেখে ভয় পেলাম। যদিও এই অবস্থায় ভয়ে অস্থির হলে চলবে না। শীতের বেলা একটু তারা তারি বিদায় নিয়েছে, অন্ধকার হয়ে আসছে। ন্যাভিগেশন লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছি। কি আসছে এমন করে?মেঘ?ঢেউ?না, মেঘের রঙ কি এমন কাল হয়?নীল সাগরের নীল জল কি এমন কাল হয়?দেখতে দেখতে কার্লো এসে পরেছে। ওকে বুঝিয়ে দিয়ে আমার চলে যাবার কথা। ওকে দেখালাম, কার্লো দেখ, কিছু বুঝতে পারছ?ওর চেহারা দেখে ওকে বিস্মিত মনে হোল, হা করে চেয়ে আছে। উভয়েই হতবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই এলাকায় সমুদ্রের গভীরতা একটু কম তাও প্রায় ২০০০ ফুটের মত হবে।

ডিউ নর্থ থেকে ওই ঢেউ আর আকাশের কাল পাহাড় এগিয়ে আসছে, আসছে একে বারে কাছে এসে পরেছে প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার কাল ঢেউ আর তার পিছনে আরও ঢেউ আর ঢেউ, সবার মাথায় সাদা হিরের মুকুট জ্বল জ্বল করছে প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আকাশে যে মেঘের পাহাড় ছিল সেও এই ঢেউ এর সাথে জাহাজের ডান দিকে এগুচ্ছে। এই ঢেউ জাহাজকে পাশ থেকে ধাক্কা দিলে নির্ঘাত আজ এই শেষ নিশ্বাস নেয়া। জাহাজে থাকা এত লাইফ সেভিং ইকুইপমেন্ট কোন কাজে লাগাবার সুযোগ কেউ পাবে না। কোন ভাবেই জাহাজের পাশে এই আঘাত লাগতে দেয়া যাবে না। সামনে বিপদ দেখে মানুষ দিশা হারিয়ে আবোল তাবোল কিছু করে বসে যাতে বিপদ আরও বেশি সুযোগ পায়। এই মুহূর্তে মাথা গুলিয়ে ফেললে হবে না, কিছু একটা করতেই হবে। সমুদ্রে যাদের বসবাস তাদের ষষ্ট ইন্দ্রিয় বলে একটা ইন্দ্রিয় থাকে যা দিয়ে বাতাসের গন্ধই বলে দেয় কি করতে হবে তা বুঝতে পারে। এই ক্রান্তি কালের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরি হলে বা উলটা পালটা সিদ্ধান্ত নিলে জীবন নিয়ে আর কোন দিন মাটিতে হেটে চলার উপায় থাকবে না একে বারে সলিল সমাধি বা হাঙ্গরের পেটে স্থায়ী নিবাস হয়ে যাবে। আজকের এই লেখা আর কেউ কোন দিন লিখতে পারত না।

ক্যাপ্টেন বা চীফ অফিসারকে ডাকা তো দূরের কথা যে স্টিয়ারিং করছে তাকেও কমান্ড দেবার সময় নেই। চট করে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে স্টিয়ারিং নিজের হাতে নিয়ে জাহাজের হেড ঢেউ এর দিকে করে দেয়ার জন্য হার্ড স্টার বোর্ডে (ডান দিকে) টার্ন করে দিলাম। চেয়েছিলাম ৯০ ডিগ্রী টার্ন নিয়ে ঢেউ এর মুখোমুখি হতে কিন্তু এত বড় জাহাজটা ঘুরতে কিছু সময় নিবেই, সম্পূর্ণ টার্ন নেবার আগেই প্রায় ৬০ ডিগ্রী ঘুরেছে এমন সময় প্রথম ঢেউ জাহাজের মাথায় কোণা কুনি ভাবে আছড়ে পড়লো, জাহাজের মাথা ঢেউ এর সাথে উপরে উঠেই প্রায় সাথে সাথেই দ্বিতীয় ঢেউ এর ফাকে নিচে চলে গেছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, প্রথম ঢেউ এগিয়ে আসছে ব্রিজের দিকে, পুরো জাহাজ পানির তলে, তার সাথে প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটা না কি বলি বুঝতে পারছি না, ঝড়ের বেগে এসে জাহাজ কে পোর্ট সাইডে (বাম দিকে) প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কাত করে ফেলল। ব্রিজে কেউ দাঁড়িয়ে নেই যে স্টিয়ারিং করছিল সে ছিটকে পরল পোর্ট সাইডের দরজায়, কার্লো পড়লো রাডারের উপর আমি স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখেছিলাম বলে আমাকে ফেলতে পারেনি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জাহাজের ট্রিমিং ঠিক হোল কিন্তু নোনা জলের ঢেউ একের পর এক ব্রিজের ওপর দিয়ে পিছনে যাচ্ছে। কোন একটা জানালা যদি খোলা থাকত তা হলে ব্রিজের ভিতর পানি ঢুকে যেত। শীত কাল বলে সব জানালা বন্ধ ছিল। গাড়িতে যেমন সামনের কাচ মোছার ওয়াইপার থাকে জাহাজে থাকে ঘুরন্ত কাচ, ওটা এমন তীব্র গতিতে ঘুরে যে পানি বা কিছু জমার সুযোগ পায় না কিন্তু ওটা অন করবে কে?আর অন করেই বা কি হবে সম্পূর্ণ জাহাজটা পানির নিচে ডুবছে আবার ঢেউ এর সাথে একটু ক্ষণের জন্য ভেসে উঠছে। আমি স্টিয়ারিং হুইল ধরে ব্যালেন্স রাখার জন্য দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছি এর মধ্যে স্টিয়ারিং হুইল হাত থেকে ছুটে গেলে কি যে হবে কে জানে কাজেই কোন অবস্থাতেই হুইল ছাড়া যাবে না। কত টুক ঘুরাতে পেরেছিলাম জানি না হুইল ইন্ডিকেটর বা কম্পাসের দিকে তাকাবার মত মানসিক ভারসাম্য নেই। তবে ঢেউ যা আসছে এখন সামনে থেকে আসছে। অন্তত পাশে থেকে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে না। ওরা কে কি করছে কিছুই দেখার মত শক্তি বা সুযোগ কিছুই নেই।

মনে হচ্ছিল যেন পুরো জাহাজ সহ ডুব সাতার দিচ্ছি। সামনে দিয়ে ঢেউ এসে ব্রিজের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। কয়েকবার এমনি করে চুবানি দিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাণ্ডব লীলা কমে গেল। যা হবার এই পাঁচ মিনিটই যথেষ্ট। সমুদ্র তখনও গর্জাচ্ছে, জাহাজ প্রতিটি ঢেউ এর আঘাতে থর থর করে কাঁপছে। ভাগ্য ভাল আবুধাবি থেকে ফুল লোড করে পানি নিয়েছিলাম। এমনি সাধারণত বাহরাইন যাবার পথে অর্ধেক লোড নেই আজ আকাশের অবস্থা দেখে ফুল লোড করেছিলাম ওদিকে খাবার পানির ট্যাঙ্ক ও ভর্তি। জাহাজ সম্পূর্ণ বোঝাই ছিল বলে রক্ষা না হলে যে কি হতো কে জানে।
স্টিয়ারিং ওর হাতে দিয়ে দিলাম এর মধ্যে কার্লো রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে গ্রে দুবাইকে ডাকছে। আরে বুদ্ধু, কাকে ডাকছ, রেডিওতে কোন শব্দ পাচ্ছ? বলে বাইরে এলাম। সামনের মাস্তুলের উপরের অর্ধেক ভেঙ্গে কোথায় গেছে কে জানে, ব্রিজের ছাদে দেখলাম রেডিও, জিপিএস, ডেকা ন্যাভিগেটর এবং রাডার এর এরিয়েল কিছুই নেই। মনকে প্রবোধ দেবার জন্য রাডার স্ক্রিনে দেখলাম, কমলা রঙের একটা গোল চাকতি ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, জিপিএস কথা বলছে না, ডেকা মিটার শুধু ক্লিক ক্লিক শব্দ করছে কিন্তু কোন স্টেশনের সিগন্যাল দেখাতে পারছে না।

প্রকৃতি যে এত ভয়াবহ কঠিন হতে পারে তা আমার এর আগের ছয়টি সমুদ্র যাত্রায় কখনো দেখিনি বা পুরনোদের কাছে শুনিনি। বিশাল ঢেউ হয়, সমুদ্র অশান্ত হয়ে নানা রকম দুর্যোগ ঘটায় জানতাম, কিছু দেখেছি ও কিন্তু এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে কল্পনাও করিনি। ক্যাপ্টেন বলল আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কোথায় আছি কিছু বুঝতে পারছ?চার্ট টেবিলে এসে দেখালাম সর্ব শেষ পজিশন ছিল এখানে। এর পর এখন কোথায় বুঝতে পারছি না।
আমাদের কোর্স কত ছিল?
২৭০ ডিগ্রি
ওই কোর্স রাখার চেষ্টা কর তবে অবস্থা বুঝে ঢেউ এর সাথে হেডিং রেখে যেও যেখানে যায় যাক, জাহাজ তো বাচাতে হবে। জাহাজ না বাঁচলে আমরা বাঁচব কি করে।
চাঁদ তারা দেখে সাবেক কায়দায় ন্যাভিগেশন করার উপায় নেই, আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া আমরা যন্ত্র নির্ভর হয়ে পরেছি বলে সে চর্চাও নেই। আমার ডিউটি শেষ হলেও কার্লোর সাথে কিছুক্ষণ রইলাম। বিপদ তো সবার, ৫টা দেশের ১৭ জন নাবিক। ক্যাপ্টেন বলল তুমি যাও শুয়ে পর, রাতে আবার আসতে হবে। কার্লোর
সাথে আমি থাকি। চলে এলাম। এসে কাপড় বদলে বিছানায় শুয়ে আর ঘুম আসে না। বার বার ওই জ্যান্ত বিভীষিকা কাল দুই পাহাড় শুধু তেড়ে আসছিল। ভোর চারটায় ডেকে দিল। ব্রিজে এসে দেখি সাগরের মাতলামি অনেকটা কমেছে তবে এখনো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ অশান্ত।

সুধাংশু’দাকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু বুঝতে পারছেন কোথায় আছি?
না।
তা হলে কি কানার মত চালাচ্ছেন?
এ ছাড়া আর উপায় কি?
কোন জাহাজ দেখেছেন?
না।
কোর্স কত?
ওই, তখন যা ছিল তাই রাখার চেষ্টা করছি কিন্তু মাঝে মাঝেই ঢেউ এর সাথে হেডিং করতে হচ্ছে।
ড্রিফট হয়েছে বলে কিছু বুঝতে পারছেন?
ড্রিফট হচ্ছে বুঝতে পারছি কিন্তু কোথায় কোন দিকে যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না শুধু সামনে যাচ্ছি।
ক্যাপ্টেন কিছু বলেছে?
কি আর বলবে, কোন জাহাজ দেখতে পেলে ডাকতে বলেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাক, কাল দিনের আলো না হলে কিছু বোঝা যাবে না। আচ্ছা আপনি যান ঘুমান দেখি আমি কত দূর নিতে পারি।
ভোর হবার একটু আগে ডান দিকে দূরে একটা সুপার ট্যাংকারের ন্যাভিগেশন লাইট দেখে বুঝলাম ওরা লোড নিয়ে এরাবিয়ান গালফ ছেড়ে ইন্ডিয়ান ওসেনের দিকে যাচ্ছে। একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। খুব বেশি হলে ওই জাহাজ আমাদের থেকে ৫ মাইল দূর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওর যে স্পিড তাতে দৌড়ে ওকে ধরা সম্ভব নয়। কি করা যায়?রেডিও বা ওয়ারলেস কোথায় পাই, ভাবতে ভাবতে মনে হোল, লাইফ রেফটে (life raft) যে ছোট ওয়ারলেস থাকে সেটা বের করে ওকে ডাকতে হবে। তারা তারি ক্যাপ্টেনকে ডেকে দেখালাম ওই জাহাজ। বললাম আমি একটা রেফট খুলে ওয়ারলেস বের করে ওদের ডেকে দেখি।

ক্যাপ্টেন স্টিয়ারিং করছে। আমি আর হেল্মস ম্যান দুই জনে একটা রেফট খুলে ওয়ারলেস বের করে ওই নাম না জানা জাহাজকে ডাকলাম। ভাগ্য ভাল। ওরা আমাদের ডাক শুনে জবাব দিয়েছে। ওরা কুয়েত থেকে ক্রুড অয়েল লোড করে কোথায় যাচ্ছে। আমাদের বিপদের কথা খুলে বললাম, এমনকি আমরা কোথায় আছি তাও জানি না। ওরা আমাদের দেখেছে, ওদের রাডারে বিয়ারিং নিয়ে আমাদের পজিশন বলে দিল। আমাদের গ্রে বাহরাইনকে জানাবার অনুরোধ করলাম। বললাম বল যে তোমাদের ইলেক্ট্রা ওই পজিশনে আছে, আমাদের ইঞ্জিন সব ঠিক আছে কিন্তু কম্যুনিকেশন এবং ন্যাভিগেশন ইকুইপমেন্ট কোন টাই কাজ করছে না তাকে রেস কিউ কর। গত কাল দুবাই থেকে সেইল করার পর থেকে গ্রে বাহরাইন বা গ্রে দুবাইর সাথে যোগাযোগ না হওয়ায় ওরা চিন্তিত ছিল। এখন খবর পেয়ে গ্রে বাহরাইন জানাল যে ইলেক্ট্রাকে বলে দাও ওরা যেখানে আছে ওই খানেই যেন ভেসে থাকে আমরা গ্রে সুইফটকে পাঠাচ্ছি, গ্রে সুইফট ওদের পাইলটিং করে নিয়ে আসবে। ওরা আমাদের খবর পৌঁছে দিলে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।

চার্টে ওই জাহাজের দেয়া লঙ্গিচুড/ল্যাটিচুড মিলিয়ে দেখি আমরা বাহরাইন বামে রেখে কুয়েত যাবার পথে চলে গেছি।
এবার গ্রে সুইফটের আসার অপেক্ষা। গ্রে সুইফট আমাদের সাপ্লাই বোট। ঘণ্টায় ১৮ নট স্পিডে চালিয়ে প্রায় বিকেল চারটা নাগাদ এসে আমাদের পাশে ভিড়ল।
তারপর? তারপর আর কি, গ্রে সুইফট আমাদের স্পিডের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের আগে আগে আর আমরা ওদের পিছনে ওদের ফলো করে বাহরাইন এসে পৌঁছলাম তার পর দিন সকালে। সারা পথেই সাগরের উন্মত্ততা কমে নি। কার উপর যে এই ক্রোধ কিছু বুঝলাম না। এখানে ডকে তুলে জাহাজের কীল, বটম প্লেট, প্রপেলার, রেডার সব কিছু চেক করে কিছু প্রয়োজনীয় মেরামত করে এন্টেনা লাগিয়ে আবার জলে ভাসিয়ে দিল। আমরাও আবার সমুদ্রের পরবর্তী কোন আক্রোশের পথ চেয়ে তা মোকাবিলা করে নাবিক জীবনের অ্যাডভেঞ্চার সংগ্রহের আশায় জাহাজ লোড করে আবার যাত্রা করলাম মাস্কাটের পথে।

ফাগুন বেলা

দিগন্ত বিস্তৃত মেঠো প্রান্তর
সময়ের হাত ধরে চলে নিরন্তর।
আকাশে ওড়ে সাদা মেঘের ভেলা
শান্ত অশান্ত উদাসী বালুকা বেলা।

ছোট ছোট গাং চিলে করে কানাকানি
এমনি হলো তোমার আমার জানাজানি।
বাসব ভাল, বুকের কোণে প্রদীপ শিখা জ্বেলে
যেখানে মিশেছে আকাশ আর সাগরের নীলে।

তেমনি করে শুধু চেয়ে রব নীরব আমি
তোমার মুখপানে, নিরবধি অবাক বিহ্বলে।
গুন গুন শোনাবে ঘুম পারানি গান
মায়াবী রাতে আঁধারের কলতান।

ঝিরি ঝিরি বইবে বাতাস, আসবে যখন ফাগুন
হৃদয় মাঝে জ্বালব তখন ভালবাসার আগুন।
সেই আগুনের পরশ নিয়ে একটু দিও ছোঁয়া
দিবানিশি দেখবে তাই ভুবন ভরা মায়া।

আমায় তুমি দিও শুধু একটু সময় ঋণ
তোমায় আমি দেব তাই ভালবাসার দিন।
ফুরাবে না এই জনমে রেখ যতন করে
যত্নে ভরা সোহাগ মেখে সোনার খাঁচায় ভরে।

দুই দেশে এক ঈদ

অনেক অনেক দিন আগের কথা। যখন ঢাকা শহরে দুই টাকায় একটা প্রমাণ সাইজের পদ্মার ইলিশ পাওয়া যেত এবং আমার মা সেই ইলিশের কোর্মা ও ইলিশ পোলাও রান্না করতে পারতেন। আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে অতি উপাদেয় খাদ্য হিসাবে ওগুলির স্বাদ আস্বাদন করতাম। আমি তখন পত্নী হীন (দয়া করে কেউ আবার বিপত্নীক ভাববেন না) তবে সহসা আমাকে সপত্নীক করার জন্য ছন্দা নামে এক হবু ভদ্র মহিলা ওরফে আমার সবে ধন নীলমণি একমাত্র প্রিয়তমা, যিনি দেশে বাস করতেন এবং কেন যেন আমার সাথেই যুগল বাঁধার স্বপ্নে বিভোর থাকতেন।

তখনকার প্রেম ভীষণ কঠিন প্রেম ছিল। অনেক কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে তবেই কোন প্রেমিকার কাছ থেকে একেবারে তারাহুরো করে লেখা একটা প্রেম পত্র পাওয়া যেত। সে সময়ের প্রেম প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে একটু নির্জনে আলাপ, দূর থেকে সামান্য চোখের ভাষায় বা একটু ইশারা ইঙ্গিতে তোমার আমার ভালবাসা বাসির মধ্যেই সীমিত ছিল, এবং এই ছিল অনেক। এর বেশী ভিন্ন কোন উষ্ণতার আশা করা ছিল আত্মঘাতী মূলক আচরণ। তখন মোবাইল, ফোন বা ইন্টারনেটে আলাপ করার কোন কিছুই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি বলে তারা প্রেমিক প্রেমিকাদের ভর্তসনা ছাড়া আর কিছু পেত না। রাতের আঁধারে মিটমিটে হারিকেনের আলোতে পড়ার টেবিলে নোট তৈরির ছুতায় সবাইকে ফাঁকি দিয়ে প্রেমপত্র লিখে আবার সেই চিঠি লুকিয়ে পোস্ট অফিসে যেয়ে পোস্ট করে এসে মাস দুয়েক পরে উত্তর পাবে সে আশায় পথের দিকে চেয়ে থাকা ছিল আরও কঠিন। প্রতীক্ষার প্রতিটি প্রহর যেন আর শেষ হতে জানত না। দুই বা তিন মাস পর কোন রকমে উত্তর পেয়ে সহজেই কি আর তা পড়া যেত? সুযোগ খুঁজতে হত কখন এই চিঠি পড়ার শুভক্ষণ আসবে। রাতের অন্ধকারে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরত তখন বালিশের কাছে হারিকেন বা মাটির প্রদীপ এনে সামান্য আলোতে কিংবা শেষ বিকেলে সবাই যখন নানা কাজে ব্যস্ত তখন পুকুরের পাড়ে বেতের ঝোপে মশার কামড়ের সাথে বা খড়ের পালার পাশে বসে প্রেমিকের চিঠি পড়ার আনন্দ ছিল ভিন্ন স্বাদের। বুক ঢিব ঢিব করত, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলে! তবুও কি যে না বলতে পারার মত একটা ভিন্ন ধরনের স্বর্গীয় আনন্দ তা বোঝান যায় না। সে চিঠি এক বার, দুই বার তিন বার পড়েও যেন আশ মিটত না। কাছেই কারো সারা পেয়ে চিঠি লুকবার যে কি চেষ্টা তা আজকাল কেউ বুঝবেই না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমার এই লেখালেখির হাতে খড়ি দিয়েছে আমার ছন্দা। তাকে লিখতে হত বিশাল উপন্যাসের মত চিঠি। যাতে কবে কি খেয়েছি, কোথায় গিয়েছি, সে দেশের সুন্দরীরা দেখতে এবং শুনতে কেমন, এ ছাড়া আর কি কি দেখেছি এবং দিনের মধ্যে কতবার তার কথা মনে হয়েছে সব ইনিয়ে বিনিয়ে না লিখলে পরের চিঠিতে তার বকুনি নির্বিবাদে হজম করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকত না। তখন ব্রিটিশ এয়ার এর নাম ছিল BOAC বা ব্রিটিশ ওভার সিজ এয়ারওয়েজ কর্পোরেশন। আমি তখন আয়ারল্যান্ডের তৈরি এরিনমোর নামের হলুদ রঙ টিনে ভরা অতি মহনীয় সুগন্ধযুক্ত তাম্রকূট দিয়ে বিড়ি বানিয়ে ধূমপানে অভ্যস্ত ছিলাম। এই বিড়ি বানানোর কাজে আমার সূ দক্ষতা সারা জাহাজে সর্বজন বিদিত ছিল। সেই তখনকার কথা বলছি। আজকের কথা নয়। আমি তখনও জাহাজের ডেক ক্যাডেট। আমার এই ভয়েজের ‘ওশেনিয়া’ জাহাজ খানার মালিক ছিল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি।

একবার কুরবানির ঈদের মাস খানিক আগে সউদি আরবের রাস্তানূরাহ থেকে কাঁচা তেল (ক্রুড ওয়েল) নিয়ে স্পেনের একটি বন্দরে আনলোড করেছি। এর পর জাহাজটা গ্যাস ফ্রি করে ডকিং করার জন্য ইংল্যান্ডের প্লিমাউথে যাবার কথা। হিসাব অনুযায়ী প্লিমাউথে যাবার পর আমার রিলিভার আসবে এবং আমি দেশে ফিরে এসে সবার সাথে আনন্দে ঈদ উদযাপন করব আর এরই এক ফাঁকে ছন্দার সাথে এক পলকের দেখা আর একটু খানি হাতে হাত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করার ইচ্ছা নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। সেই এক ফাঁকে ওর জন্য কেনা জিনিষগুলি দিয়ে আসব। এমন কিছু দেয়া যাবে না যা দেখে ওকে প্রশ্নের সামনে পরতে হয়। কোথায় পেলি বা কে দিয়েছে? মনের এমন একটা আশা বুকের মধ্যে ভরে রেখেছি, দিন গুলি যাচ্ছে একেকটা বছরের মত।

স্পেনের মাদ্রিদে তেল নামিয়ে চলে আসছি আর রাস্তায় গ্যাস ফ্রি করছি। কয়েক দিনের মধ্যে জাহাজ প্লিমাউথে এসে পৌঁছেছে। শুনলাম আমার রিলিভার রহিম ভাই লন্ডনে চলে এসেছে। দেশে আসার পোটলা বোচকা বাঁধাবাঁধির ঝামেলা সেরে ফেলেছি। জাহাজ তখনও ডকে আসেনি, মাত্র আউটার এঙ্কারেজে অপেক্ষা করছে। চিফ অফিসার জানিয়ে দিল রেডি হয়ে থাকতে কাল বিকেলে তোমার রিলিভার আসছে।
জাহাজ নোঙ্গরেই ছিল।

ক্যাপ্টেন হিসাব নিকাশ করে জাহাজ থেকে আমার যা প্রাপ্য তা দিয়ে দিল সাথে আমার সিডিসিটা আর একটা প্রশংসাপত্র। আমি ডলারের পরিবর্তে কিছু ব্রিটিশ পাউন্ড চেয়ে নিলাম। ভাবলাম ব্রিটেন থেকে সাইন অফ করছি যদি কিছু কেনা কাটা করি তাহলে আবার ডলার ভাঙ্গান এক ঝামেলার ব্যাপার হবে। বিকেল চারটায় সবাইকে see you again বলে হাতে বুকে মিলিয়ে আপাত বিদায় (নাবিকেরা সাধারণত বাই বাই বলে না) নিয়ে বাক্স পেটরা ডেকে এনে রেখে ব্রিজে গেলাম। ওয়াচ ডিউটি করছিল ক্যাভেন।
কি খবর ক্যাভেন কোন খবর পেয়েছ?
জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই রেডিওতে ডাকছে
“ওশেনিয়া ওশেনিয়া দিস ইজ প্লিমাউথ কলিং’ ।
ক্যাভেন জবাব দিল
‘প্লিমাউথ বল, আমি তোমাকে পরিষ্কার শুনছি”
বাংলাদেশ থেকে তোমাদের লোক এসেছে, প্লিমাউথ পাইলট ২ তাকে নিয়ে তোমাদের দিকে যাচ্ছে ওকে রিসিভ কর। আচ্ছা প্লিমাউথ, আমরা রেডি আছি। লন্ডন আমাদের জানিয়েছে। তুমি ওদের পাঠিয়ে দাও।
হ্যাঁ হ্যাঁ ওরা আধা ঘণ্টা আগে সেইল কর চলে গেছে।
ক্যাভেনকে আবার দেখা হবে বলে নিচে এসে ডেকে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে দেখি প্লিমাউথ পাইলট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওটা দেখেই ছন্দার মুখটা বুকের ভিতরে কোথায় যেন ভেসে এলো। না না না শুধু বুকে নয় এ তো দেখছি সারা আটলান্টিক জুড়েই ছন্দার মুখ! যেদিকে তাকাই শুধু ছন্দা ছন্দা আর ছন্দা! কি আশ্চর্য!

রহিম ভাই এলো। ছোট্ট করে একটু কুশল জেনে এবং জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম। এজেন্টের ব্যবস্থা অনুযায়ী সে রাতে প্লিমাউথের একটা হোটেলেই থাকতে হল। পরদিন লন্ডন থেকে আমাদের এজেন্ট ফোন করল। ওপাশে হ্যারি বলছে। আগামী কাল ১৩ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় BOAC তে প্লিমাউথ থেকে এথেন্স এবং তারপরে এথেন্স থেকে তোমাদের বিমানে ডাইরেক্ট ঢাকা।

ঢাকার ল্যান্ডিং কখন?
কিছু একটা দেখে বলল
উম, সকাল ৫টা
গুড হ্যারি, তুমি জান ১৪ তারিখে আমাদের গ্রেট ফেস্টিভাল এবং আমি তাহলে আমার ফ্যামিলির সাথে সময় মত দেখা করতে পারব।
আশা করি তুমি এর আগেই ঢাকা পৌঁছে যাবে। আজ সন্ধ্যার পর তুমি টিকেট পেয়ে যাবে।
ঠিক আছে, পৌঁছালেই হল। বিকেলে একটু বের হলাম। প্লিমাউথ ব্রিটন সাইড বাস স্টেশনের কাছের মার্কেট থেকে টুকি টাকি কিছু কেনাকাটা করলাম ছোট বোন আর ছন্দার জন্য। পাশের বুটস থেকে আমার নিজের জন্য একটা সানগ্লাস কিনলাম ১৪ তারিখে বাংলাদেশে ঈদ হলে এখানে ১৩ তারিখ মানে আগামী কাল ঈদ হবার কথা। এখানে ঈদের নামাজ পাব না, কোথায় মসজিদ জানি না আর তাছাড়া এই প্লিমাউথে পরিচিত কেউ নেই। তবে শুনেছি লন্ডনের ব্রিকলেনের জামে মসজিদে সাধারণত সকাল ৮টা থেকে জামাত শুরু হয়ে ১০ টা পর্যন্ত কয়েকটা জামাত হয়। তখন ওই এলাকায় ওটাই সবচেয়ে বড় মসজিদ। এখন ইস্ট লন্ডন জামে মসজিদ হয়েছে, প্রায় ৫০০০ মুসুল্লি এক জামাতে নামাজ পড়তে পারে।

এখানকার জামাত ধরার কোন সুযোগ নেই। ফ্লাইটটা এখান থেকে দুপুর বা বিকেলে হলেও চেষ্টা করতে পারতাম। ওকে নো প্রবলেম! দেশে গিয়ে জামাত ধরতে পারব মনে হচ্ছে। এক ঈদ দুই জায়গায়! এমন অবাক কাণ্ড কয়জনের ভাগ্যে হয়?ঢাকায় যদি ভোর ৫টায় নামতে পারি তাহলে ইমিগ্রেশন, কাস্টম ইত্যাদি এয়ারপোর্টের ঝামেলা সেরে একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে মিরপুরে যেয়ে কাটায় কাটায় জামাত ধরতে পারব আশা করি, যদি কোথাও কোন বিভ্রাট না হয়। তবে এথেন্স থেকে বিমান যদি কোন ঝামেলা না করে শিডিউলে থাকে। অবশ্য এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার হবে কারণ বিমান লেট করবে না তাই কি হয়? অন্তত এর আগের ফ্লাইটগুলিতে যা দেখেছি।

এজেন্টের গাড়ি এসে সকালে সাড়ে চারটায় প্লিমাউথ সিটি এয়ারপোর্টে নিয়ে গেল। তখন সিকিউরিটির এত ঝামেলা ছিল না। চেক ইন, ইমিগ্রেশন এসব সেরে সময়মত প্লেনে উঠে বসলাম। একটু পরেই সীট বেল্ট বাঁধা, আস্তে আস্তে প্লেনের রান ওয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে এক দৌড়ে আকাশে উড়ে যাওয়া। দিনের বেলা বলে সব দেখলাম জানালার পাশের সিটে বসে। সকালের নাস্তা আর চায়ের পাট শেষ। এখানে প্লেনে বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছি দেশে যাবার পথে এথেন্সের দিকে আর পিছনে রেখে এলাম যেখানে ঈদ করছে কত জনে! কি আশ্চর্য এই বিশ্ব! একই সাথে কত জায়গায় কত কি ঘটে যাচ্ছে! আমি রয়েছি এখন আকাশে!
নাস্তা করার সময় ভাবছিলাম ভাগ্য ভাল যে আজকের টিকেট পেয়েছে, না পেলে আজ যদি এখানে থাকতে হত তাহলে এখানেই ঈদ করে যেতে পারতাম। ইংলিশ ঈদ কেমন একটু দেখা হত। সারা রাতে চোখ বুজতে পারিনি। হোটেলের রুমে বসে টেলিভিশনে এই চ্যানেল ওই চ্যানেল করেছি। যদি ঘুম এসে যায় আর এজেন্ট এসে ডাকাডাকি করে সেই ভয়ে। একটু চোখ বন্ধ করেছি আর ওমনিই বিমান বালার সুললিত মার্জিত ইংরেজি কণ্ঠ। লেডিজ এন্ড জ্যান্টল মেনো আপনারা আপনাদের সিট বেল্ট বেঁধে নিন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এথেন্স বিমান বন্দরে নামব ইত্যাদি ইত্যাদি। রাতের অনিদ্রার জন্য মাথা টনটন করছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখি এড্রিয়াটিক সাগর পিছনে রেখে প্লেন আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে। সামনে গ্রিসের এথেন্স এয়ারপোর্ট এর রাডার টাওয়ার দেখা যাচ্ছে। হাতের ঘড়িতে দেখি কোথা দিয়ে এই পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম তার কিছুই টের পেলাম না? তাইতো বলি, এর মধ্যে ছন্দা এসেছিল কি করে? তাহলে কি স্বপ্ন দেখেছি ছন্দাকে? হ্যাঁ তাই হবে। যাক হাতের ব্যাগ গুছিয়ে শীতের কাপড় গায়ে চড়িয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম।

নিয়ম অনুযায়ী ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রানজিটে থাকলে সেই এয়ারলাইনের পক্ষ থেকে লাঞ্চ এবং হোটেল দেয়ার কথা কিন্তু নিয়ম থাকলেও বিমানের কাউকে খুঁজে না পেয়ে নিজের পকেটে থাকা পাউন্ড দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। এর মধ্যে নাস্তা, চা কফি কয়েকবার খেয়েছি। কোন চিন্তা নেই, পকেটে অনেক ডলার আর পাউন্ড রয়েছে। আরও কয়েক জায়গা থেকে আসা বেশ কয়েকজন এবং এখানকার স্থানীয় কয়েকজন বাঙালি জমা হয়েছে দেখলাম। তাদের মধ্যে যারা আমার মত ট্রানজিট লাউঞ্জে আছে তাদের সাথে খুচরা গল্প করে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি আর বুকের মধ্যে ঢোল বাজছে, দেশে ফিরে ঈদের চিন্তায় ছটফট করছি।
ফ্লাইট রাতে বলে রাতেও এখানেই খেতে হবে। পাউরুটির মত ও দেশের এক রকম রুটি, সবজি সেদ্ধ আর ডিম। দুই বেলায় এই একই খাবার খেয়েছি। ভয়ে অন্য কিছু নেইনি, কি জানি বাবা কি না কি, হালাল হারামের ব্যাপার। কি আছে নাম জানি না, চিনি না।

রাতে খাবার পর বিমানের কাউন্টারে এক লোককে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম
চেক ইন কখন করবেন?
ফ্লাইট ডিলে কাজেই এখনও কিছু বলতে পারছি না
কাল ঈদ, একথা কি আপনারা জানেন না?
একটু বান্দর হাসি দিয়ে (অন্তত তখন আমার তাই মনে হয়েছে)
আমরা এখানে আজই ঈদ করেছি!
কিন্তু আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তারা দেশে যেয়ে ঈদ করব, তার কি হবে?

দেখুন, এ ব্যাপারে আমি বলতে পারছি না, আসলে ফ্লাইট নিউইয়র্ক থেকেই লেট
সাথে জুরিখ থেকে আসা এক ভদ্রলোক বলেই ফেলল তাহলে আর দেশে ঈদ করা হয়েছে, দেখুন এই এয়ারপোর্টেই ঈদ করতে হয় কিনা!
আমারও তাই মনে হচ্ছে!
নানা জনে নানা ধরনের কথা বলাবলি করছি। রাতে খেয়ে এসে শুনলাম প্লেন আগামী কাল দুপুর একটার আগে আসছ না।
বাহ! দারুণ খবর শোনালেন ভাই, এবার বাড়ি গিয়ে এক ঘুম দেন, ঈদ তো করেই ফেলেছেন, আর চিন্তা কি?
যান কাউন্টার বন্ধ করে দিন!

সত্যিই একটু পরে দেখি সেই ভদ্রলোক আর নেই, সারা এয়ারপোর্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর তাকে পেলাম না।
যারা এথেন্স এর যাত্রী তারা যার যার বাসায় চলে গেল আর আমরা যারা ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার তারা ১০/১২ জন হবে মনে হয় ঠিক মনে পরছে না, ওয়েটিং লাউঞ্জের এক পাশে একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে ফ্লোরে বসলাম। পরিষ্কার চকচকে ফ্লোর। কি করব, রাত কাটাতে হবে আর আগামী কাল ঈদ করতে হবে। মিটিং শুরু হল, সাইপ্রাস থেকে আসা এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নেতা বানান হল। তখন বড় ভাই কথাটার খুব প্রচলন।
আচ্ছা বড় ভাই আপনি এখন আমাদের নেতা, বলুনতো এখন কি করা যায়?
কি আর করবেন, এখন সবাই ঘুম দিন কাল সকালে যা করার করব।
এখনই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলে ভাল হয় না?
কি সিদ্ধান্ত নেব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
আমি বললাম আচ্ছা আমি না হয় হটাত করে এসেছি, আমার টিকেট করেছে আমার এজেন্ট তাই এই দিনে এই ফ্লাইটে আসতে হল কিন্তু আপনারা কেন এলেন?
নানা জনে নানা সমস্যা নিয়ে বলল।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল
নামাজ পড়ার কথা ভুলে যান, পথে এভাবে কি আর ষোল কলা পূরণ হয়?
কাল সকালে এখানে পুডিং বা ফ্রুট কাস্টার্ড বা এপল পাই জাতীয় মিষ্টি যা আছে তাই সবাই মিলে একসাথে বসে খেয়ে ঈদ করব। ঠিক আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভাল আইডিয়া! তাই হবে।
এত রাতে ওয়েটিং লাউঞ্জ সবটাই প্রায় খালি, বিশেষ কেউ নেই। কাছাকাছি সময়ে আর কোন ফ্লাইট আছে বলে মনিটরে দেখা যাচ্ছে না।

আমরা একে একে একেকটা সোফা দখল করে হাতের ব্যাগ মাথার নীচে রেখে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম কি আর এত সহজ? মাঝে মাঝে এ ওকে ডাকছে একটু ইয়ার্কি চলছে কেউ আবার উঠে বসে সিগারেট টানছে আর সময়মত বাড়িতে যেতে না পারার দুঃখে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছে। এই এত লম্বা সময় একসাথে থাকার ফলে নানান শহর থেকে আসা সবার সাথে মোটামুটি একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে।

কারো ঘুম আর আসছে না। ভোরে এথেন্সের পুব আকাশ একটু একটু করে লাল হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে সূর্য উঠতে শুরু করল। এর মানে হল আমাদের দেশের ঈদ শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই কুরবানির গরু জবাই করে ফেলেছে। আমরাও সবাইকে ডেকে ওয়াস রুম থেকে মুখে হাতে পানি ছিটিয়ে গেলাম রেস্টুরেন্টে। ঢোকার সময় কাউন্টারে বসা মুটকি বুড়িকে গুড মর্নিং জানিয়ে বললাম আমাদের ঈদের দুর্দশার কথা। বুড়ি শুনে খুব উহ আহ করল। আমরা কিচেনের পাশে অর্ডার দেয়ার জন্য এগুচ্ছি আর তখন বুড়ি এক সুন্দরী ওয়েট্রেসকে ডেকে গ্রীক ভাষায় কি যেন বলল। সুন্দরী ঘার কাত করে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। গতকাল লক্ষ করিনি, আজ দেখলাম অনেক মিষ্টি জাতীয় খাবার। আমাদের যার যা ইচ্ছা অর্ডার করে অপেক্ষা করছি। একটু পরে সবারটা এক সাথে দু/ তিনটা ট্রেতে সাজিয়ে দিল আর ট্রে নিয়ে আমরা জানালার পাশে পূর্ব দিকে এসে বসলাম। গ্রীসের সকাল দেখে ঈদ করব।
আমরা নাস্তা খাচ্ছি। একটু পরে দেখি সেই সুন্দরী দুই হাতে দুইটা ট্রে নিয়ে আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল। একটু অবাক হয়ে ওকে বললাম
আমরা আর কিছুর অর্ডার দেইনি, আমাদের সব কিছু নিয়ে এসেছি
সুন্দরী গ্রিক উচ্চারণে বলল
আমি জানি, কিন্তু এগুলি আমাদের ম্যানেজার ইশারা করে দেখিয়ে দিল ওই বুড়ি তোমাদের ফেস্টিভ্যালের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে
তাই নাকি? বেশ বেশ!

আমরা খুব খুশী হয়ে ওর হাতের ট্রে থেকে একে একে পেয়ালাগুলি নামিয়ে নিলাম। দেখলাম আইসক্রিম।
সুন্দরীকে বলে দিলাম তোমাকে এবং তোমাদের সবাইকে আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ। আমরা খুব খুশী হয়েছি।
এর পর সবাই কফির পেয়ালা নিয়ে বসলাম। আমি পকেট থেকে সেই আইরিশ তামাক এরিনমোরের টিন খুলে বসলাম।
তামাকের গন্ধে অনেকেই যারা অধূমপায়ী তারাও দেখলাম একটু লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখে বলল
ভাই আমাকেও একটা বানিয়ে দিন।
জানতাম এমন হবে তাই বেশি করেই কয়েকটা বানালাম।

কফি সিগারেট খেয়ে যখন বাইরে এলাম দেখি বিমানের কাউন্টারে দুই জন লোক দেখা যাচ্ছে। একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
কি ভাই, কোন খবর পেলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ প্লেন লন্ডন থেকে টেক অফ করেছে। এখানে একটার দিকে পৌঁছাবে আর তার ৪৫ মিনিট পরে আপনাদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফ্লাই করবে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। একটু পরেই চেক ইন শুরু করব।
হিসেব করে দেখলাম লোকটা যেমন বলেছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে বিকেল নাগাদ ঢাকায় পৌছাতে পারব। তার মানে সেদিন আর ছন্দার সাথে দেখা হবে না। দেখা হবে তার পরদিন মানিকগঞ্জে।

নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট-Gyro Compass

SIM RGS 50

Gyro Compass


Magnetic Compass


আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত একটি জাহাজের ব্রিজ (যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ/পরিচালন করা হয়)।

জাইরো কম্পাস একটি অ-চুম্বকীয় কম্পাস যেখানে পৃথিবীর সঠিক উত্তর (True North) প্রদর্শনের জন্য ক্রমাগত বিদ্যুৎ চালিত জাইরোস্কোপ দ্বারা পরিচালিত হয় যার অক্ষটি ঘূর্ণন এর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অক্ষের সমান্তরাল থাকে এবং পৃথিবীর দিকটি (pole) স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুঁজে পেতে সহায়তা করে যা চৌম্বকীয় “উত্তর দিক” প্রদর্শনের চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য এবং এতে নানা কারণে উদ্ভূত পৃথিবীর কোন বিশৃঙ্খলা বা প্রভাব পড়েনা।

এই জাইরো কম্পাস ( সাগর ও আকাশে) জাহাজ নেভিগেশন করার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, জাইরোকম্পাস লৌহ নির্মিত জাহাজের চৌম্বক শক্তি/ক্ষেত্র এর উপরে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা বলে এটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। এগুলি আকাশ ও নৌ পথের জন্য বিশেষ উপযোগী। তবে জাইরো কম্পাস যতই থাক না কেন এর সঙ্গে একটি magnetic compass অবশ্যই থাকতে হবে কারন ম্যাগনেটিক কম্পাস কখনওই অক্ষমতা প্রকাশ করবেনা।

আজ এই পর্যন্তই, আগামীতে হয়তো দেখা হবে কোন কাক ডাকা ভোরে গরম চায়ের ঘ্রাণে (অবশ্য যদি কেও নিমন্ত্রণ করেন)।

নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট-AUTO PILOT




অটোপাইলট জাহাজের (আকাশ বা জলপথের) জাহাজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। আধুনিক অটোপাইলটগুলি জাহাজের নিয়ন্ত্রণে কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহার করে। সফ্টওয়্যারটি জাহাজের বর্তমান অবস্থান (অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ) পড়ে, এবং তারপর জাহাজকে তার দিক নির্দেশ করে তার পরিচালন কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে।

অটোপাইলট জাহাজের স্টিয়ারিং কন্ট্রোল সিস্টেম যা জাহাজের ডিউটি অফিসারকে ক্রমাগত স্টিয়ারিং নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই জাহাজের দিক বা কম্পাস কোর্স অনুযায়ী চলার ব্যবস্থা নেয়। স্টিয়ারিং কন্ট্রোল সিস্টেমে সংকেত প্রেরণ করে একটি অটো সিস্টেম কাজ করে।

ডিউটি অফিসার তার চলা পথের দিক নির্দেশনাগুলি ইনপুট/কমান্ড নির্দেশ করে দেয় অর্থাৎ যে মোড তারা চান, এবং সেই অনুযায়ী হেডিং করে এই অটোপাইলট স্ব্যংক্রিয় ভাবে জাহাজের দিক পরিচালন করে। তবে এই ব্যবস্থা কেবল মাত্র গভীর সমুদ্রে বা আকাশের জন্য নিরাপদ। হারবার বা বন্দরে ভেড়া বা প্লেন ওঠা বা নামার সময় ব্যবহার করা হয়না।
আগামীতে কি নিয়ে লিখব বলে দিবেন নইলে………………………………………

নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট-VHF


নতুন প্রজন্মের VHF


সাবেক আমলের VHF

VHF (Very high frequency) জাহাজ -জাহাজ- বন্দর ইত্যাদির সাথে কথা বলে যোগাযোগ করার এই যন্ত্র অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এর সীমা ৫ মাইল থেকে ১০০ মাইল পর্যন্তো হয়ে থাকে। calling channel হলো 16 অর্থাৎ এই ১৬ নম্বর চেনেল শুধু মাত্র কাওকে ডাকার জন্য, সে সাড়া দিলে তাকে ভিন্ন কোন চেনেলে গিয়ে কথা বলতে হয় মানে চ্যানেল ১৬ কখনওই ব্যস্ত রাখা যাবে না। এটা শুধু মাত্র ডাকার জন্য ব্যবহার হবে। সাধারনত এই যন্ত্রে duel watch ব্যবহার করার ব্যবস্থা রয়েছে যেমন আপনি ২১ নম্বর চেনেলে কথা বলছেন আবার এই সময়ে্র মধ্যে আপনার চ্যানেল ১৬ ও কাজ করবে অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে যদি কেও আপনাকে ডাকে তাহলে আপনি শুনতে পাবেন এবং কথা থামিয়ে নতুন যে ডাকছে তার ডাকে সাড়া দিতে পারবেন।
অনেক কিছু নিয়েই সংক্ষিপ্ত প্যাচাল পারলাম একয়দিন এর বেশি আরও কিছু জানতে আগ্রহি হলে দয়া করে জানাবেন। কিছুদিন বিশ্রাম (কাজের দিকে মন দিয়ে) আবার হ্যতো ফিরে আসব আশা করছি। ধন্যবাদ!

সাগরে চলাচলকারী জাহাজ


আধুনিক কন্টেইনারবাহী জাহাজ


সাগরের রূপ

প্যেসাঞ্জার জাহাজের একটি ডেক এর অংশ


ODC (over dimension cargo) বা অতিরিক্ত ওজনবাহী submergible জাহাজ


আধুনিক equipment সজ্জিত জাহাজের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বা navigation bridge


জাহাজের saloon বা dinning room


যাত্রীবাহী এবং cargo বা tanker জাহাজের galley বা রান্নাঘর

বিঃদ্রঃ প্রতিটি ছবিতে ডবল click করলে ছবিগুলি বড় মাপে দেখা যাবে।
ছবিঃ internet থেকে নেয়া, আসলে আমার এমন কোন জাহাজ নেইতো তাই গুগল মিয়াভাইয়ের সাহায্য নিয়েছি, অন্যায় করেছি কি?

নেভিগেশন ইকুইপমেন্ট-Chart Plotter


Electronic Chart Plotter


Chart of Approaching to Mongla Port


Manual Chart work (Table) in a vessel

এই chart plotter দিয়ে সাগরে চলাকালিন আপনি যে এলাকায় চলছেন সেই এলাকা চিনিয়ে দিলে সে নিজেই মাপ-জোক করে আপনার নিখুত অবস্থান দেখিয়ে দিতে পারে এবং আপনার চলা পথ দেখিয়ে দিবে অর্থা আপনি যে পথ পেরিয়ে এসেছেন সেই পথ। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ/ বিগত এক ঘন্টায় কতটা দুরত্ব অতিক্রম করলেন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য আপনাকে জানিয়ে দিবে। পরে এই তথ্য দেখে বা আপনার চার্ট টেবিলে রাখা চার্টের সাথে মিলিয়ে দেখে নিবেন ইনি সত্যি বলছে নাকি বেঠিক বলছে।
এগুলি অতিশয় শিক্ষিত যন্ত্র তাই না? তাই বলে এরা যতই শিক্ষিত হোকনা কেন আপনাকে কিতু সাথে সাথে কাগজে বা চার্টে সমান তালে কাজ করে যেতে হবে।
ধন্যবাদ!
এর পরে আসছে VHF.