মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট

মোঃ খালিদ উমর সম্পর্কে

কুয়াশা ঢাকা মানুষের মন বুঝতে চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা!

মায়াবিনী

114759823

মায়াবী মধুর প্রেম
তুমি এসেছ নীরবে
শিশির ঝরানো গান গেয়ে।

অবেলায় ঝরে গেল না ফোটা বকুল
যখন ফোটেনি আমার গানের মুকুল।
মানসী এসেছিল নীরব পথ চেয়ে
এলে তুমি হৃদয় সাগরে ভাঙ্গা তরী বেয়ে।

বসন্ত না গাহিতে প্রেমের গান
মিছে হলো স্বপন আমার
জুড়াল না শূন্য অবুঝ প্রাণ
মিলন তিথি খুলেনি দুয়ার।

তোমার কণ্ঠে উঠেছিল জেগে
গানের কথাগুলি হৃদয়ের সুর হয়ে
সজল আখির আকুল অভিমানে
আপন মনে প্রিয়তমা
রেখেছে তাই মুখ লুকায়ে।

অক্সফোর্ড এক্সপ্রেস-২/২ [শেষ পর্ব]

Choosing-a-college
পূর্ব প্রকাশের পর-
মাথা নিচু করেই চলে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগের কলকাতায়। সেই দিন আর ফিরিয়ে আনার উপায় নেই।
কলকাতার টালি গঞ্জের অতি সাধারণ একজন স্কুল মাস্টারের মেধাবী মেয়ে দোলা কলেজে যাবার পর পাড়ার ডাক্তারি পড়ুয়া অভিজিতের কাছে পড়ত আর সেই সময়ের সাথে একটা সুক্ষ সূত্র ধরে কখন যেন উভয়ের অজান্তে একজন আরেকজনের সাথে একান্ত নিবিড় ভাবে মিশে গিয়েছিল। চোখের ভাষা থেকে শুরু করে মান অভিমানের লেনদেন এবং একদিন না দেখার বিরহ যাতনার অনুভব সবই আঁকড়ে ধরেছিল। কিন্তু দুই জনের লেখা পড়া শেষ করে যখন অভিজিত ডাক্তারি শুরু করল তখন বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মাকে দোলার কথা জানাল কিন্তু মা নিচু ঘর এবং বাঙ্গাল বলে বিয়েতে মত দেয়নি। বাবারও একই কথা। দেখে শুনে বাবা মা অভিজিতের বিয়ে দিল কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল বছর না ঘুরতেই।

এমনি অবস্থায় দোলার মন ভেঙ্গে চুরমার হবার অবস্থা হচ্ছে জানতে পেরে প্রিয় বান্ধবী বিশাখার উদ্যোগে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দোলাকে এখানে রিসার্চ করার সুযোগ পাইয়ে দিল। এমন কি, এখানে আসার প্লেন ভাড়াটাও সেই দিয়েছিল। দোলার বিলাতে আসার সংবাদ জেনে অভিজিতের মা দোলার মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। দোলার মা অত কিছু না জেনে মেয়েকে অভিজিতের মায়ের প্রস্তাব জানাল কিন্তু মেয়ে তাতে সম্মতি দেয়নি। এত ভাল পাত্র, হোক না দোজবরে তাতে কি পুরুষ মানুষের এত খুত ধরতে নেই। বিশেষ করে তাদের মত অভাবের সংসারে অমন পাত্র যেন রাজযোটক। এই পাত্র হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে দোলার মা নানা ভাবে মেয়েকে সন্দেহ করে নানা রকম কটূক্তি করতেও দ্বিধা করেনি এমনকি এত দিনের চেনা নিজের গর্ভের শান্ত অথচ জেদী মেয়ের চরিত্রের খুঁত খুঁজে দেখতেও পিছপা হয়নি। কেন যে মেয়েকে এত পড়ালেখা শেখালাম এই ক্ষেদ তার মনে অহর্নিশ লেগেই থাকত। অসুস্থ বাবা সব কিছু দেখে শুনেও না দেখা না জানার ভাণ করেই পড়ে থাকত। এ ছাড়া রিটায়ার্ড বাবার আর কিই বা করার থাকে? মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেমন করে বাড়ি থেকে বের হতে পারে সেই চিন্তায় নানা ভাবে চেষ্টা তদবির করে বিলাতে আসার আগে টাটা কোম্পানিতে একটা চাকরি পেয়ে জামসেদপুরে চলে গিয়েছিল। বাবার পেনশনের কয়েকটা টাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মাসে মাসে টাকা পাঠাত কিন্তু কোন খোঁজ খবর নেয়ার মত ইচ্ছা হোত না।

বলেন কি! সময় হয়ে উঠেনি না কি?
দোলার ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে, আচ্ছা থাক এসব কথা, আপনি খুবই ক্লান্ত
দোলা চমকে উঠে আবার ফিরে এলো।
তার চেয়ে আপনার কথা বলুন, আমার কথা শুনতে ভাল লাগবে না তেমন কোন সুখের কথা নয়
আমার কথা আর কি বলব, আছি! খাই দাই ছেলেমেয়েদের পড়াই ব্যাস আর কি?
উইটনিতে কি আপনার নিজের বাড়ি? কে কে আছে ওখানে? মানে ছেলে মেয়ে
হ্যাঁ বাড়ি নিজেরই বটে তবে আর যা বললেন তার কিছু নেই
নেই! মানে?
নেই মানে নেই। কোনদিন ছিলও না আর হবেও না
কি আশ্চর্য, তা কেন হবে?
সে অনেক কথা। থাক এত শুনে কি হবে?
আপত্তি না থাকলে বলুন না!
শুনবেন? না আপত্তি নেই, তাহলে বলি
কেন যে রিজভী সাহেবের মত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অমায়িক, স্মার্ট এবং দুর্দান্ত প্রফেসর ঘর বাঁধেনি এ কথা নিয়ে আশেপাশে কানাঘুষা লেগেই আছে। তার কিছু যে রিজভী সাহেবের কানে যায়নি সে কথা বলার উপায় নেই কিন্তু রিজভী সাহেবের কোন মাথা ব্যাথা নেই। অনেকেরই জানার আগ্রহ থাকলেও কেও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি তবে একান্ত কাছের বা ঘনিষ্ঠ দুই একজন বাঙ্গালির স্বাভাবিক কৌতূহল নিবারণ করতে পারেনি তা বলা যাবে না। তবে জানতে চেয়েও এ যাবত কেও জানতে পারেনি। কিন্তু আজ দোলাকে দেখে তার কঠিন ব্যক্তিত্ব কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে, বরফ গলে পানি হয়ে শিশির কণার মত টলমল করছে। মনে যেন কিসের দোলা লেগেছে! মনে চেরি ফোটা বসন্ত এসেছে, ডেফোডিল, প্রিমরোজ, ব্লু বেল, টিউলিপের নানা রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে, বর্ষার প্রথম কদম ফুল ফুটেছে, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছে, জানুয়ারির স্নো মাখা নীলচে পূর্ণিমার চাদরে দেহ মন জড়িয়ে রয়েছে। কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যে কথা কাওকে কোনদিন বলা হয়নি! দোলার ‘আপত্তি না থাকলে বলুন না’ কথাটা শ্রাবণ ধারার সুরের মত মনে গুনগুন করছে।

আস্তে আস্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম দেখা শিরিনের সমস্ত কাহিনী একে একে সব খুলে বলল। জানেন, শিরিন এখন ভীষণ সুখী। ওকে সুখী করতেই আমি চেয়েছিলাম কিন্তু সে যে এভাবে সুখী হবে সে আমি কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি। আজ আর আমার কোন দায় নেই, আমি নির্ভার। কথা গুলা বলতে পেরে মনটা যেন অনেক হালকা হলো, এতদিনের সঞ্চিত কষ্টের বিষ বাষ্প বের হয়ে গেল। দারিদ্র্য জর্জরিত না পাবার বেদনা, হতাশার গ্লানি সব যেন এক নিমেষেই কোথায় কোন দূর মহাসাগরের অতলে হারিয়ে গেল। বলা শেষ হলে দোলার দিকে তাকাল। দোলা এক মনে কথা গুলা শুনছে। মনে হলো রিজভী সাহেবের বলা শেষ হয়নি তাই জিজ্ঞেস করল
তারপর?
তারপর আর কি, এইতো! আপনার সামনেই দেখতে পাচ্ছেন
কিন্তু এ ভাবে কতদিন চলবে? জীবন নদী কি কখনও একা পাড়ি দেয়া যায়? একজনে হাল ধরে আর একজনে বেয়ে চলে
যে ভাবে চলছে চলুক না, বেশ তো চলছে এই বেশ
না, তা হয় না, এ যে প্রকৃতির বিধান আমরা যে কেও এর বাইরে যেতে পারি না
তাহলে আপনি আপনার মিস্টারের কথায় অমন করে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন কেন?
সে অনেক কথা, থাক না
না, থাকবে কেন? আমি এতক্ষণ বকবক করলাম আর আপনি চুপ করে শুনবেন তাই কি হয়? বলুন শুনি
বললামতো সে কোন সুখের কথা নয়, শুনতে ভাল লাগবে না
আচ্ছা আমি যে এতক্ষণ বললাম এ কি সুখের কথা?
মোটেই না
তাহলে? আচ্ছা প্রথম আলাপেই এত কিছু বলাবলিতে আপনি কি দ্বিধা বা কোন সংকোচ করছেন?
একটু হেসে বলল, আপনি কিন্তু নাছোড় বান্দা
দোলার হাসিটাও শিরিনের মতই মনে হলো। মধুর ক্যান্টিনে বসে বলত দেখ শিরিন আমি এত দরিদ্র ঘরে জন্মেছি যে তোমার কথা তোমাদের মত ঘরের কথা চিন্তাও করতে পারি না। তখন এমনি করেই হেসে বলত আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি, আমিতো আর কিছু চাই না!
তাই যদি মনে করেন তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি?
আচ্ছা,
বলে তার ছোট বেলা থেকে শুরু করে এখানে আসার সমস্ত কাহিনী শোনাল। বিশাখাই আমাকে এখানে নিয়ে এসে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। মটর ওয়েতে চলন্ত কোচের ইঞ্জিন এবং হিটারের একটানা গুঞ্জণের শব্দ ছাপিয়ে দোলার কণ্ঠ শোনার জন্য রিজভী সাহেব দোলার মুখের কাছে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।

ও! মনে হচ্ছে আমরা এক সাথে একই নদীতে দুই নৌকা ডুবিতে ডুবে গিয়েছিলাম আবার এক তীরেই ভেসে উঠেছি। নিয়তি আমি বিশ্বাস করি না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ যেন নিয়তির ই খেলা। নিয়তি অনেক কিছু পারে যা আমাদের ভাবনার সীমা রেখা থেকে অনেক দূরে।

কথা বলতে বলতে অক্সফোর্ড গ্লস্টার গ্রিন কোচ স্টেশনে চলে এসেছে, গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার মাইকে জানিয়ে দিল। রিজভী সাহেব পকেট থেকে তার কার্ড বের করে দোলার হাতে দিয়ে বলল তোমার ফোন নম্বরটা দিবে? কাল তোমার সাথে দেখা করব। কোচ থেকে এক সাথে নেমে দোলার লাগেজ সহ একটা টেক্সিতে তুলে দিয়ে বলল
কাল আমি না আসা পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টেই অপেক্ষা করবে?
টেক্সির সিটে বসে দোলা ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ফোন নম্বরটা লিখে রিজভী সাহেবের হাতে দিয়ে বলল
এসো, আমি তোমার অপেক্ষা করব
দোলার টেক্সি ছেড়ে দিল, টেক্সির পিছনের লাল বাতি ভিড়ে মিশে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থেকে রিজভী সাহেব আর একটা টেক্সি নিয়ে উইটনি চলে গেল।
২০১৫ বই মেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ “ষঢ়ঋতু থেকে”।
আবার দেখা হবে বন্ধু ভিন্ন কোন আয়োজনে কিংবা দোলার চায়ের নিমন্ত্রনে।

অক্সফোর্ড এক্সপ্রেস-১/২

X90coach18BakerStreet
ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের ডিপারচার টার্মিনালের পাশে দাঁড়ান গ্রিন লাইনের অক্সফোর্ড এক্সপ্রেসে বসার পরে পরেই কোচটা ছেড়ে বাকিংহাম প্যালেস রোড দিয়ে বেকার স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মটর ওয়েতে যাবার আগে বেকার স্ট্রিটে থেমে যাত্রী ওঠাবে। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। সামনে পিছনে দেখে কোচের পিছন দিকে গায়ের গরম জ্যাকেটটা পাশের হুকে ঝুলিয়ে রেখে একটা সীটে বসেছে। যাত্রী বেশি নেই। সাথের বড় লাগেজটা নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে দিয়ে দিয়েছে। হাতে ছোট একটা ব্যাগ। হাতের গ্লোভসটা খুলে ব্যাগে রেখে একটু গুছিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিংহাম প্যালেস রোড লন্ডনের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। এ পাশে হাতের বায়ে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশনের অ্যারাইভ্যাল এবং ডিপারচার টার্মিনাল আবার আর একটু এগিয়ে ডানে ভিক্টোরিয়া টিউব এবং রেল স্টেশন। মনে হয় লন্ডন শহরের ব্যস্ততা কোনদিন কোনও সময় কমবে না। ফুট পাথ দিয়ে নানা বর্ণের নানা দেশের মানুষ হেটে যাচ্ছে আসছে। সবাই ব্যস্ত, দেখলে মনে হবে হাঁটছে না সবাই দৌড়চ্ছে। রাস্তায় সাইকেল সহ নানা ধরনের গাড়ি যার যার গন্তব্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে। হাতের গ্লোভসটা রাখার সময় ব্যাগ থেকে চৌরঙ্গী বইটা বের করেছে কিন্তু এখনও খুলেনি হাতেই ধরে রেখেছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। লন্ডন শহরে প্রতিক্ষণেই কিছু না কিছু ঘটে, চলার পথে অনেক কিছুই দেখা যায়, তাই দেখছে কিংবা কে জানে হয়ত অতীত ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। মটর ওয়েতে যাবার পর যখন কিছু দেখার থাকবে না তখন বইর দিকে মনোযোগ দিবে।

দেখতে দেখতে বেকার স্ট্রিটে টিউব স্টেশন ছাড়িয়ে কোচটা থামল। কয়েকজন যাত্রী উঠল, সবাই পুরুষ মানুষ। উঠে যার যার মত বসে পড়ল কিন্তু সবার পরে যে ভদ্রলোক উঠেছে সে এখনও বসতে পারেনি। হয়ত তার সুবিধা মত একটা সিট খুঁজছে। লোকটা উপমহাদেশীয়! দেখেই বোঝা যায়। পাশে দিয়ে যাবার সময় দোলার হাতে বাংলা বই দেখে এক পলের জন্য থেমে বইটা দেখল। বাঙালি! বাংলাদেশি, নাকি ইন্ডিয়ান? যেই হোক!
বসব?
বাংলা শুনে দোলা চমকে উঠল। ইনি বাঙালি! একটু সরে বসল। বসুন
গায়ের জ্যাকেট খুলে দোলার জ্যাকেটের পাশের হুকে ঝুলিয়ে রেখে বসতে বসতে বলল আমি রিজভী, ডঃ রিজভী আহমেদ
ও! আমি দোলা রায়

এই লোক নিশ্চয় বাংলাদেশের, ওর চেয়ে পাঁচ ছয় বছরের বেশি হবে। ভাল স্বাস্থ্য, পৌরুষদীপ্ত ব্যক্তিত্ব এবং বলিষ্ঠ চেহারা, দীর্ঘ গড়ন, চোখে চশমা, গায়ের শ্যামলা রঙের সাথে স্বাস্থ্য বেশ মানিয়েছে। রিজভী সাহেবও লক্ষ করল পরনে সার্ট প্যান্ট হলেও দেখতে সুন্দর লাগছে, বিশেষ করে মাথার চুলগুলো হাত খোপা করে বাঁধা শুধু একটা সুন্দর ক্লিপ দিয়ে আটকানো। খুবই ভাল লাগছে। শিরিনও এমনি করেই খোপা বাঁধত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দূরের জার্নি করে এসেছে হয়ত তাই চেহারা একটু বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কিন্তু তার মধ্যেও অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের লাবণ্য ছড়িয়ে রয়েছে যেন মাত্র ভোরের সূর্য উদয় হয়েছে। তার জীবন থেকে শিরিনের নাম মুছে যাবার পর আর কোন নারীর মুখের দিকে এমন সরাসরি তাকায়নি। এমনকি নিজের মায়ের দিকেও না। শিরিন তার জীবন থেকে অনেক কিছু নিয়ে গেলেও নারী জাতটার উপরে কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণা দিয়ে গেছে।

যার কোন চাল চুলো নেই আছে শুধু একটুখানি মেধা। মেধা দিয়ে কি হয়? মেধা দিয়ে সুখের সাজান বাড়ি তৈরি করা যায় না, গাড়ি কেনা যায় না, স্ত্রীর গা ভরে অলংকার গড়িয়ে দেয়া যায় না, মাসে মাসে নতুন দামি শারী কেনা যায় না, চার পাশে দাস দাসী রাখতে পারে না, আপন জনকেও ধরে রাখা যায় না। এমনি এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সরকারি অফিসের সামান্য এক কেরানির ছেলের জীবন থেকে শিরিনদের অনেক দিন ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের বন্ধন ছিড়ে অন্যের হাত ধরে চলে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্র রিজভী আহমেদের আশেপাশে অন্তত ডজন খানিক শিরিন, ডলি, জলি, রাত্রি, নিশা, নিশিতা এমনি কতজনই ঘুরে বেড়াত, শেষ পর্যন্ত হত দরিদ্র মেধা সর্বস্ব রিজভীর সাথে কেমন করে যেন শিরিনই টিকে গিয়েছিল কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া রিজভীর হাতে শিরিনের বাবা তার মেয়ের হাত তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পাস করার পরে ইউনিভার্সিটিতেই মাস্টারি করার একটা চাকরি পেয়েছিল।

বিয়ের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল কিন্তু এতদিন রিজভীর অবস্থার কথা ভেবে শিরিন সম্মতি দেয়নি। শুধু বলেছিল সময় হলে আমি বলব। এতদিন বাবাকে রিজভীর কথা কিছু বলেনি ভেবেছিল রিজভীর একটা চাকরি হলে বাবা অরাজি হবে না কিন্তু রিজভীর চাকরি হবার পর বাবাকে যখন বলল তখন বাবা রিজভীদের বাড়ি এসে নাক সিটকিয়ে চলে গিয়েছিল। এক কাপ চা খেতেও তার প্রবৃত্তি হয়নি। আর শিরিন! সেও তার বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেনি। বাবার ব্যবসার পার্টনার সুফিয়ান সাহেবের আমেরিকা প্রবাসী ছেলে রিয়াদের হাত ধরে পারি দিয়েছে কলম্বাসের দেশ আমেরিকায়। ও দেশে নাকি সুখ শান্তি সমৃদ্ধির অভাব নেই পয়সা দিয়ে সব কিছু কেনা যায়। শিরিন এখন প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে আছে। এদিকে বছর দুয়েক চাকরি করে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়ে সেই যে এখানে এসেছে আর ঘরমুখো হয়নি। ইচ্ছে হয়নি, কার জন্য যাবে? বিয়ের জন্য মা বাবা উভয়েই তাগিদের পর তাগিদ দিয়ে এসেছে কিন্তু শিরিনের জায়গায় আর কাওকে স্থান দেয়ার মানসিকতা রিজভীর মনে স্থান পায়নি। নিয়মিত মা বাবাকে টাকা পাঠিয়ে দায় শেষ করতে চেয়েছে, আর কোন ভাই বা বোন কেও নেই বলে কোন পিছুটানও নেই।

ভদ্রলোক বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, লন্ডনেই থাকেন বুঝি?
না, অক্সফোর্ডে থাকি তবে আমি এখন কলকাতা থেকে আসছি
তাই নাকি? তাহলেতো আপনি খুবই ক্লান্ত, দেখেই মনে হচ্ছে। আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না আমি বরঞ্চ অন্য কোন সিটে বসি আপনি রেস্ট করুন
না না, কি বলছেন? আমি ভাবতেও পারিনি একজন বাঙ্গালির সাথে এভাবে যেতে পারব। বলুন আপনি কথা বলু্‌ন, আপনি না হলেতো আমি এই যে বলে হাতের বইটা দেখাল, জার্নি যত বড়ই হোক আমি ঘুমাতে পারি না। সেই যে কাল কলকাতা ছেড়ে আসার পর এ পর্যন্ত একটুও চোখ লাগেনি
বেশ, তাহলে বলুন কলকাতার কি খবর?
ভালই
বাড়িতে যাদের রেখে এলেন তারা কে কেমন আছে?
ভাল, সবই ভাল এখন, বাবা মা সবাই ভাল আছে। বাবার কিডনিতে পাথর হয়েছিল তাই অপারেশন করাতে আমি কয়েকদিনের জন্য গিয়েছিলাম। আপনি কি বাংলাদেশের?
হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশের, আমার বাড়ি ঢাকা। অক্সফোর্ডে কোথায় থাকেন?
কুইন স্ট্রিটে, আপনি?
উইটনি। কতদিন হলো এখানে?
এইতো বছর খানিক, উইটনিতে কোথায় থাকেন?
কোথায় থাকি মানে কি আপনি চেনেন?
হ্যাঁ ওখানে আমার এক বান্ধবীর বাড়ি, মাঝে মাঝে যাই। বাসস্ট্যান্ডের পাশে যে তাজ রেস্টুরেন্ট, তার পাশেই
ও আচ্ছা, আপনার বান্ধবীর হাজব্যান্ডের নাম কি অতীশ দে আর বান্ধবীর নাম বিশাখা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি চেনেন?
চিনি মানে অতীশ আমার বন্ধু। উইটনি এই এলাকার রিটায়ার্ড ডিফেন্স অফিসারদের বসতি, অধিকাংশই এদেশের, বাঙালি খুবই কম তাই যে কয়জন আছি সবাই সবাইকে চিনি।
ও, আচ্ছা
দেখতে দেখতে কোচ M25 মটর ওয়েতে চলে এসেছে। একভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অক্সফোর্ডের রাস্তায় যাদের দেখা যায় তারা সাধারণত ছাত্র নয়ত শিক্ষক। পথে যেতে কেও পথ ভুল করে ফেললে বা চিনিতে না পারলে কাওকে জিজ্ঞেস করলে যে কথাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোনা যায় তা হচ্ছে ‘সরি আমি ভিজিটর’ বা ‘নিউ কামার’। পুরো শহরটাই বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এখানে এই ফ্যাকাল্টি, ওখানে ওই ডিপার্টমেন্ট সেখানে অমুক স্কুল এমনি। এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় প্রায় হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে এদেশে বিশেষ করে এই শহরে ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে বাস সার্ভিস খুবই ভাল। অনেক দূরে দূরে একেকটা বিল্ডিং। অনেক দিনের পুরনো শহর, দালান কোঠা, রাস্তা, দোকানপাট এসব দেখেই বোঝা যায়। ওয়েলিংটন স্ট্রিটে ইউনিভার্সটির মুল ভবন আর আশেপাশে ছড়ানো সব শাখা প্রশাখা।

এখানে কি করছেন?
আর্থ সাইন্স নিয়ে রিসার্চ করছি
কার সংগে আছেন?
ডঃ রিচার্ড
কোন রিচার্ড, পার্কার?
হ্যাঁ হ্যাঁ রিচার্ড পার্কার
আপনি?
কি আর করব মাস্টারি করি, ছেলেমেয়েদের বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই
ও! স্যার আপনি…………………
কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল
নো নো, নট স্যার। স্যার বলবেন না। you are not my student! এবার বলুন আপনার মিস্টার কোথায়? কি করে, সঙ্গেই আছে?
এমনিতেই বিশাল জার্নির ধকলে মুখ শুকিয়ে ছিল তারপরে আবার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা যদিও কোচের ভিতরে হিটার চলছে। দোলার মুখ এই কথা শুনে আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল এমন কেও নেই। [আগামীর জন্য অপেক্ষা করুন] ২০১৫ বই মেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ষঢ়ঋতু থেকে।

রেশমি-৩/৩ [শেষ পর্ব]

bede-1
পূর্ব প্রকাশের পর, রেশমি-২/৩,
৮।
রতন সে রাতের মত আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সর্দারের কথায় বুঝতে পারল না কাকে পাঠাবে। যাকেই পাঠাক রেশমির আস্তানা চিনতে পেরেছে। দেখা যাক, এখন সকালের অপেক্ষা। রেশমির স্বপনে মগ্ন হয়েই কোথা দিয়ে যেন সারা রাত চলে গেল কিছুই বুঝতে পারল না। কি মায়া ভরা চোখ! এই চোখ দিয়ে যাকে দেখবে সেই ধন্য হয়ে যাবে। বারবার বাম থুতনির নিচের তিলের কথাও মনে হচ্ছিল। মনে মনে সমস্ত চেহারা দেখে এসে ওই তিলেই চোখ আটকে যায়। ভোরে যখন মোরগের বাগ শুনে উঠে বাড়ির বাইরে এসে পথের দিকে চেয়ে আছে কে আসে, কখন আসে! পুব আকাশ লাল হয়ে গেছে একটু পরেই বেলা উঠবে। রতনকে বলে দিয়েছে বেলা ওঠার আগেই দাঁতের পোকা বের করতে হবে। পথ থেকে দৃষ্টি সরছে না। হঠাৎ চমকে উঠল কালকের ওই শারী পরে রেশমি হাতে একটা থলে নিয়ে দুই পাশের ধান ক্ষেতের মাঝের রাস্তা দিয়ে ভোরের আলো হয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখল মাথার এলো চুল আলতো করে খোঁপা বাধা। গলায় মালাও নেই হাতেও চুরি নেই। এই নিরাভরণ দেহে সত্যিই ভোরের আলোর মতই মনে হচ্ছে। জাম গাছের নিচে রতনকে দেখে রেশমি চমকে দাঁড়াল!
বাবু, আপনার ভাতিজা কোথায় ওরে নিয়া আসেন, সময় বেশি নাই, বেলা উঠার আগেই সারতে হইব।
তুমি আসবে আমি ভাবতেও পারিনি
দেরি কইরেন না, তাড়াতাড়ি নিয়া আসেন
কাকে আনব? আমার কোন ভাইই নেই তো ভাতিজা আসবে কোথা থেকে?
তাইলে যে রাইতে কইয়া আসলেন!
বলেছি শুধু তোমাকে দেখার জন্য
বাবা যদি মায়েরে পাঠাইত তাইলে কি করতেন?
একটা কিছু বলে দিতাম আর সে ফিরে যেত
কামডা ভাল করেন নাই, বাবা শুনলে রাগ করবো। একটু ভেবে, তাইলে আমি যাইগা?
যাবার জন্যেতো তোমাকে আসতে বলিনি!
তাইলে কি করুম?
আস, এই খানে একটু বসি। ডর নাই বাড়ির মানুষ উঠতে দেরি আছে। এতক্ষণ তোমার সাথে গল্প করি
রতন ওর হাত ধরে টেনে এগিয়ে গেল বাংলা ঘরের পাশে খড়ের গাদার আড়ালে যাতে সামনের রাস্তা থেকে ওদের দেখা না যায়।
বাবু, আপনে কামডা ভুল করতেছেন, দেহেন আমরা নিচা জাতের বাইদা আমাগো কেও মানুষ বইলা মনে করে না। আমাগো কোন ঠিক ঠিকানা নাই আমাগো সাথে এত মেলামেশা ভাল দেখায় না। আপনে আর এমন কাম কইরেন না, আমাগো নায়েও আর যাইবেন না।
তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে কেমন করে?
কইলামতো আপনে এই পথে পাও বাড়াইয়েন না। মনে যা আইছে মুইছা ফালান
বললেই কি তা হয়?
কেন হইব না? আপনে জানেন এর ফল কি হইতে পারে? আপনের কিছু হইব না কিন্তু আমার মরণ ছাড়া কোন উপায় থাকবো না। আমার বাবারে কেও সর্দার বইলা মানব না, বাবার মান সম্মান থকব না
রেশমি, তুমি কি বল! দরকার হলে আমি তোমাকে নিয়ে দূরে অনেক দূরে কোথাও চলে যাব
তাই কি হয়? আপনের ঘর আছে ঠিকানা আছে সংসার আছে সমাজ আছে, আপনে শিক্ষিত মানুষ
আমার কি আছে কোন? না জানি লেখা পড়া না আছে ঘর, ঠিকানা, সমাজ কিছুই নাই। খড় কুটার মত গাঙ্গের জলে ভাইসা বেড়াই। তেলে জলে কি কোনদিন মিশ খায়?
ভয়ে রেশমির গলা শুকিয়ে এসেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে, দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, বুক ওঠা নামা দেখে বোঝা যাচ্ছে। কথা বলার সময় ঠোট কাঁপছিল, বাবু আমি যাই
বলেই পিছনে ঘুরে দাঁড়াল
কি হলো কোথায় যাচ্ছ? বলে আঁচল টেনে ধরল
নায়ে যাই
টাকা নিয়ে যাবে না?
না
তাহলে সর্দারকে কি বলবে?
একটা কিছু কমুনে
না শোন তোমার সাথে আবার কখন কোথায় দেখা হবে?
বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার ছায়া উদয় হয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ নামের পাহাড়ের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এ পাহাড় ডিঙ্গানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বসন্ত তার মত বাইদার মেয়ের জন্যে নয়। যে পুরুষের দাতে সাপের মত বিষ আছে, যে পুরুষ কাল নাগের মত ফণা তুলতে পারে তেমন কাল কেউটেইতো সে চেয়েছিল। তার অপেক্ষায় সে দিন গুনে জসীমকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু! বাবু, আপনে আমারে বিপদে ফালাইয়েন না, আপনের পায়ে ধরি
বলে সত্যি সত্যি রেশমি নিচু হয়ে রতনের পা ধরে বলল
বাবু আপনে এই পাগলামি কইরেন না, আমারে রেহাই দেন
রতন রেশমির বাহু ধরে টেনে তুলে বলল
না রেশমি আমি পাগলামি করছি না, আমি তোমার আশায় থাকব
জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষের ছোঁয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য রেশমিকে অনেক দূরের ঝর্ণা ধারার তান শুনিয়ে দিল কিন্তু রেশমি হাত ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দৌড়ের মত ছুটে পালাল
রতন ওর পথের দিকে চেয়ে রইল। আবার দেখা পাবার সুযোগ খুঁজছিল মনে মনে। নৌকার কাছাকাছি থাকলেই হবে। সকালে গাওয়ালে যাবার সময় কিংবা সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসবে তখন পেতেই হবে।

৯।
প্রায় দৌড়েই নৌকায় ফিরে এলো। নৌকার সামনের গলুইতে বাবাকে দেখে বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। কি বলবে বাবাকে? এতক্ষণ কিছু ভাবেনি দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। কাছে এসে বাবাকে দেখে আপনা আপনি গতি কমে গেল। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়!
কি রে কি হইছিল?
না বাবা রুগীরে পাই নাই, কাইল বিকেলে মামা বাড়ি গেছেগা, ফিরা আইলে খবর দিব কইছে
ও, ঠিক আছে যা দেখ রান্ধনের যোগার দেখ তর মায়ের জ্বর আইছে
ডিম, ডাল ভাত রান্না করে সঙ্গীদের নিয়ে আবার বের হলো গাওয়ালে।
ওই, আইজ কুন দিকে যাবি?
চল আইজ ওই তাল গাছ দেহা যায় ওই দিকে যাই।
চল।
বাজারের শেষ প্রান্তে বড় তাল গাছের নিচে দিয়ে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের বাঁধানো রাস্তা ধরে পশ্চিমে মালচির দিকে চলে গেল। রেশমি হাঁটছে আর সকালের ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনার স্রোতে ভাসছে আবার কখনও ডুবেও যাচ্ছে। জীবনের প্রথম বসন্তের স্পর্শ! ষোল বছরের রেশমির মনে ঘোর লেগে আসছে। তাদের বহরে এই বয়সেই ফুলি দুইজনের মা হয়েছে। মাস্টার বাবুর মুখ কিছুতেই দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না। অন্যমনস্ক ভাবে কয়েকবার হোঁচট খেল দেখে প্রিয় বান্ধবী সুফি জিজ্ঞেস করল
কিরে আইজ তর কি হইছে মুখে কথা নাই আবার হাঁটতে হাঁটতে উস্টা খাইলি কয়বার। ওই ছেমরি গান ধর!
রেশমির মুখে কোন কথা নেই। স্বপ্নের ছায়া তরী মন যমুনায় ঘোরা ঘুরি করছে কিন্তু কিছুতেই কোন ঘাটে ভিড়াবার ঠাই খুঁজে পাচ্ছে না। এ কি সম্ভব? মাস্টার বলেছে দূরে কোথাও চলে যাবে! কোথায় যাবে? এতদিনে আশেপাশের পুরুষদের চাউনি দেখে রেশমি তার রূপের কথা বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই রূপ যৌবনের মোহ কয়দিন থাকবে? মোহ ফুরিয়ে গেলে! তখন সে কোথায় দাঁড়াবে?
সেদিনের মত সন্ধ্যায় বাইদানীর দল ফিরে এসেছে। আসার পথে মাস্টারকে দেখল বাজারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। এক পলকের জন্য চোখাচোখি হলো।

১০।
পরের দিন বিকেলের আড্ডা বাদ দিয়ে নদীর পাড় থেকে বাজারের ও মাথা পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘোরা ঘুরি করছিল আর রেশমি কোন পথে ফিরে আসে দেখছিল। তাদের গ্রামে যাবার পথে না যেয়ে উত্তরে গেলে কৌড়ি যেতে পারে, তাদের গ্রাম ছাড়িয়ে চালা, মানিক নগর, আবার ঝিটকা থেকে উত্তরে গেলে কান্দা লংকা, ধুসুরিয়া, গালা, পশ্চিমে মালচি, বাল্লা যেতে পারে। আজ কোন দিকে গেছে? রাজার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর পথ পাহারা দিচ্ছে। বেলা ডোবার আগে তাল গাছের নিচে দিয়ে ঝাঁকা মাথায় ওদের আসতে দেখল। সামনে দিয়ে যাবার সময় থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইল সর্দারকে কি বলেছে কিন্তু ভারী দল দেখে নীরব রইল। শুধু এক পলকের জন্য একটু দৃষ্টি বিনিময় হলো।
আবার প্রতীক্ষা। কাল সকালে স্কুলে না গিয়ে ইউনিয়ন অফিসের সামনে ঝাউ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। আজ যেদিকেই যাক পিছনে অনুসরণ করবে। বেলা নয়টা দশটার দিকে একে একে দলের সবাই নৌকা থেকে নেমে এসে উত্তর দিকে যাচ্ছে। একটু দূরত্ব রেখে রতন পিছু নিল। ওরা কান্দা লংকার পথে যাচ্ছে। রতন ঘুরে বাস স্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে, গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে কান্দা লংকার পথে গরু হাটের বট গাছের নিচে দাঁড়াল। ওরা এখনও আসেনি। হ্যাঁ ওইতো দেখা যাচ্ছে। সামনেই রেশমি।
ও বাইদানী, কি আছে তোমাদের কাছে?
ওরা ওর সামনে এসে থামল। রেশমি বাবুকে দূর থেকেই দেখেছে। মনের ভিতর উথাল পাথাল শুরু হয়েছে কিন্তু সামনে এসে কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করল
কি গো বাবু কি নিবা? বৌর লিগা নিয়া যাও, পুতির মালা আছে, কাজল আছে, কপালের টিপ আছে
বলে মাথার ঝাঁকাটা বট গাছের নিচে পথের পাশে নামিয়ে বাবুর সামনে মেলে ধরল। দলের ওরা সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল রেশমি তর ভাগ্য ভাল, আইতে না আইতেই কাস্টমার পাইলি। তুই বাবুরে সামলা আমরা যাই। ওরা এগিয়ে গেল।
আপনেরা না কইছি আমার পিছ ছাড়েন! এইহানে খারাইয়া রইছেন কেন?
কেন দাঁড়িয়ে আছি তুমি বুঝ না?
বুঝি দেইখাইতো না করি। এইটা সম্ভব না মাস্টার বাবু, আমরা নিচু জাতের আমাগো দিকে নজর দিতে নাই
বলেছিতো তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব কেও কিছুই জানবে না। আমাদের ঘর হবে, সংসার হবে তুমি বৌ হবে
কিন্তু
কিন্তু বলেই রেশমি থেমে গেল। মনের মাঝ দরিয়ায় উত্তাল ঢেউ উঠেছে সে ঢেউ কিছুতেই সামাল দিতে পারছে না। মুখে কোন কথা নেই। এমন সময় রাস্তা দিয়ে লোকজন বাজারের দিকে আসছে দেখে রেশমিকে বলল দাও দেখি আজ কি দিবে! যন্ত্রের মত রেশমি কিছু চুরি বের করে দিল আর রতন তার দাম দিয়ে বলল কাল আবার দেখা করব। রতন দেখল টুপ করে রেশমির চোখ দিয়ে এক ফোটা জল পড়ল।
১১।
সূর্য তার প্রতিদিনের উদয় অস্তের সাথে রতন রেশমির সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর করে প্রায় দুটি মাস কেমন করে কোথায় নিয়ে গেছে ওদের কেও বুঝতে পারেনি। কেও কাওকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না। নানা রকম ফন্দি করে অন্তত একবার হলেও দেখা হতেই হবে। রেশমি তার এত দিনের সমস্ত ভয় দূরে ঠেলে দিয়ে নির্ভয় হতে পেরেছে। স্বপ্ন দেখতে পারছে। মাস্টার বাবুর উপর আস্থা রাখা যায়, সে ওকে ঠকাতে পারে না। মাস্টার বাবুর মত মানুষ শুধু রেশমি কেন কাওকেই ফাঁকি দিতে পারে না। বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া এত দিনে হাতের কাছে এসে ধরা দিতে চাইছে।
এদিকে যেমন ধীরে ধীরে চাঁদটা পূর্ণতা পেয়েছে, পূর্ণিমার চকচকে জোসনার আলোতে দুইজনে স্নান করছে ওদিকে তেমনি বাজারের ঘাটের বেদের বহরের এক উঠতি বয়সের বেদেনীর সাথে রতনের মাখামাখির কথা ছড়িয়ে গেছে। রতনের বাড়ি, স্কুল এবং বেদের বহরও বাদ পড়েনি। জনাব আলির কানেও কথাটা গেছে। স্কুলের অন্যান্য মাস্টার, বাজার কমিটি জনাব আলিকে ডেকে ইউনিয়ন পরিষদের এক রুমে বসে সালিশ করেছে। জনাব আলিকে তিন দিনের মধ্যে এখান থেকে তার বহর নিয়ে চলে যেতে বলেছে।

অতি আদরের মেয়ে রেশমির সম্পর্কে এমন একটা সিদ্ধান্ত শুনে জনাব আলি হতভম্ব হয়ে গেছে, নির্বাক হয়ে গেছে। দলের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে? পরিষদ থেকে বের হয়ে এসেই নদীর পাড়ে বসে ছিল। দুপুরে খেতেও আসেনি। কি চেয়েছিল আর কি হলো তাই ভাবছে। কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। কারো সাথে পরামর্শ করার নেই কারণ সে যে এই দলের সর্দার সে কার সাথে আলাপ করবে? সে নিজে সবাইকে বুদ্ধি দেয় কিন্তু তাকে কে দিবে? সেদিনের মত শুয়ে পরল। যা হয় কাল সকালে দেখব। ঘুম আসেনা তবুও শুয়ে থাকতে হয়। এতদিন এই ঘাটে থাকাটাই মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এর আগে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি বলে এদিকটা জনাব আলির মাথায় আসেনি তাই নিশ্চিন্তায় ছিল।
রেশমি এবং রতনও সালিশের রায় সাথে সাথেই জানতে পেরেছে। এখন কি হবে? পরদিন স্বাভাবিক ভাবে যখন রেশমি সঙ্গীদের সাথে গাওয়ালে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন বাবা বলে দিল আইজ থিকা এই ঘাটে যদ্দিন আছি তর আর গাওয়ালে যাওন লাগব না।
কেন বাবা?
জানস না কি করছস? এত বড় সর্বনাশ কইরাও তর হুশ হয় নাই?
বাবা, ওই মালচির কয়ডা বাড়িতে কিছু পাওনা আছে হেগুলি আইজ নিয়া আসি তারপরে আর যামু না
জানসনা আমরা বাইদার জাত, যে কোন সময় ঘাট ছাইড়া যাওন লাগে তুই বাকি থুইয়া আইছস কেন?
ভুল হইছে বাবা, আর থুমু না
যা, তয় ঝাঁকা নেওন লাগব না, পাওনা যা আছে দিলে দিব না দিলে আইসা পরবি
ঝাঁকা নিয়া গেলে কি হইবো, নিয়া যাই?
একটু ভেবে জনাব আলি সম্মতি জানাল, আইচ্ছা যা, তাড়াতাড়ি আইবি
আচ্ছা বলে ঝাঁকা নিয়ে রেশমি বেরিয়ে পড়ল।
ঘাটে নেমে একটু আড়ালে যেয়ে এদিক ওদিকে দেখল, রতন যে দোকানে চা খায় ওখানে দেখল কিন্তু সে কোথাও নেই। চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে পরল। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অনেকক্ষণ ধরে চা খেল কিন্তু এর মধ্যেও রতনের দেখা নেই। দোকানি একটু ইয়ার্কি করল,
কি বাইদানী আইজ যে বড় চা খাওনের ইচ্ছা হইছে?
শরীরডা ভাল না একটু জ্বর জ্বর লাগতেছে তাই
১২।
ওদিকে রতন ঘাটে আসার পথে দেখে বেদেনীরা আজ ওদের পথে সম্ভবত চালার দিকে যাচ্ছে কিন্তু দলের সাথে রেশমি নেই। মুখোমুখি হলে একটু দাঁড়াল।
কি গো নাগর কারে খুঁজ? আইজ তুমার রেশমি আসে নাই
সবাই একসাথে খিল খিল করে হেসে উঠল
কেন? আসে নাই কেন?
ওর বাবায় অরে আইতে দেয় নাই, আমরা কাইল এই ঘাট ছাইরা যামু তাই রেশমি আইজ পাওনা আদায়ের জন্যে মালচি গেছে
কথাটা শুনেই রতন এক মুহূর্ত দেরি না করে হন হন করে হেটে মালচির পথে পা বাড়াল। বাজারের উত্তর দিক দিয়ে এসে বাজারের পশ্চিম পাশের তাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল।
১৩।
অনেকক্ষণ বসে থেকে মাস্টার বাবুর দেখা না পেয়ে মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে কিন্তু আর কতক্ষণ বসে থাকবে? এক সময় উঠে পড়ল। কোথায় যাবে? বাবাকে বলে এসেছে মালচি যেতে হবে। যাই একবার মালচি থেকে ঘুরে আসি। মনে করেই উঠে এগিয়ে চলল মালচির দিকে। বাজার ছাড়িয়ে দূর থেকে তাল গাছের নিচে রতনকে দেখে স্বস্তি পেল। কাছে এসে মাথার ঝাঁকাটা এক পাশে নামিয়ে লোকজনকে দেখাবার জন্য বোচকা খুলে জিনিসপত্র নারা চারা করে একটা হাতে নিচ্ছে আবার সেটা নামিয়ে আর একটা দেখাচ্ছে আর এর ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে।
মাস্টার বাবু সবতো হুনছ, এখন কি করবা? বাবা আইজ থিকা আমারে গাওয়ালে আসা বন্ধ কইরা দিছে আমি বুদ্ধি কইরা পাওনা আদায়ের কথা কইয়া বাইর হইছি। আমারে একশ টাকা দেও আগে, বাবারে দেওয়া লাগব
শোন, এটা সহজে কেও মেনে নিবে না তাই আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমরা দূরে কোথাও চলে যাব
কেমনে যাইবা, কোথায় যাইবা? তুমি আমারে কিসের মধ্যে জড়াইলা মাস্টার বাবু, আমি এখন কি করুম? বাবার মুখের দিকে দেখতে আমার ডর করতেছে। ওদিকে বাবা সবাইরে কইয়া দিছে আমরা কাইল এই ঘাট ছাইড়া চইলা যামু
কোথায় যাবে জান?
না, কেউ জানে না, বাবাও জানে না
চিন্তার বিষয়, কি করা যায় বলতো, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। চল আমরা আজ রাতেই পালাই!
রাইতে কেমনে পলাইবা? রাইতে তুমি বাইর হইতে পারবা কিন্তু আমি কেমনে নাও থিকা বাইর হমু?
তাহলে? বলেই রেশমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল
একটু ভেবে রেশমি বলল
একটা বুদ্ধি পাইছি, পারবা তুমি আমারে উদ্ধার করতে? খুব কঠিন কাজ! পারবা?
কি করতে হবে বলই না!
পলাইতে হইব দিনে দুফুরে
দিনে? বল কি!
হ্যাঁ দিনের বেলা। আমি যখন গোসল করতে গাঙ্গে নামুম তখন তুমি একটা নাও নিয়ে চালা যাইয়া বইসা থাকবা আর আমি ডুব দিয়া অনেক খানি যাইয়া তারপরে সাঁতরাইয়া স্রোতের সাথে ভাটিতে চালা পর্যন্ত যাইয়া কিনারে উঠুম। পারবা আমারে উদ্ধার করতে?
বল কি? এত দূর সাঁতরে যাবে? পারবে? আর ডুব দিয়েই বা কতদূর যাবে?
শুনে রেশমি হো হো করে হেসে উঠল, কি যে কও মাস্টার বাবু! আমরা বাইদা না? ডুব দিয়া আমরা গাং পার হই, পানিতে আমাগো বসবাস আর এইটুক সাঁতরাইয়া যাইতে পারুম না? কি যে কও! তুমি আমারে উদ্ধার করতে পারবা নাকি তাই কও
আমার ভীষণ ভয় করছে রেশমি
কিসের ভয়?
তোমাকে এত দূর সাঁতরে যেতে কি করে বলি? কিছু হয়ে গেলে?
কইলামতো এইডা আমাগো জন্যে কিছুই না, আমি পারুম, তুমি পারবা নাকি তাই কও
ঠিক আছে তাহলে এই কথাই ফাইনাল! কি বল
হয়, কাইল দুফুরে, এখন আমারে একশ টাকা দিয়া তুমি বাড়ি যাও।

১৪।
পরদিন বাড়ি থেকে টাকা পয়সা যা কাছে আছে পকেটে নিয়ে সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে রতন মালচির পথে রওয়ানা হলো। ওখান থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। ঝিটকা থেকে কোন নৌকা নেয়া যাবে না, এখানকার মাঝিরা সবাই চেনা। মালচি এসে বাজার থেকে একটা শারী, পেটিকোট, ব্লাউজ, গামছা আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে জিজ্ঞেস করে দূর এলাকার মাঝি দেখে হরিরামপুর যাবার জন্য একটা নৌকা ভাড়া করল। রেশমির কথামত ঝিটকা বাজার এবং বেদেদের বহর পার হওয়া পর্যন্ত ছৈয়ের ভিতরে বসে রইল। রেশমি কি ওর প্ল্যান মত ডুব দিতে পেরেছে? সাঁতরে অত দূরে যেতে পারবেতো? ভয়ে চিন্তায় রতন ঘামছে। ওদের পার হয়ে বেশ কিছুটা দূরে এসে নিরাপদ মনে করে ছৈয়ের বাইরে বসে নদীর দিকে চোখ রেখে এগুচ্ছে। চালার কাছে এসে দেখে সত্যিই এক মেয়ে ভাদ্র মাসের ভরা গাঙ্গের মাঝ গাং দিয়ে সাঁতরে সামনে যাচ্ছে। মাঝিকে ইশারা করে ওই মেয়ের কাছে যেতে বলল। মাঝি মেয়েটার কাছে যেতেই দেখল রেশমি। নৌকায় তুলে একটু শান্ত হলে গামছা এবং সদ্য কেনা কাপড়ের প্যাকেট এগিয়ে দিল।
উহ্! আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কি ভয়েই ছিলাম তুমি আসতে পারবে কি না!
এখন কোথায় যাইবা?
আগে হরিরামপুর তারপর ওখান থেকে সোজা ঢাকা।
দুইজনেই চুপচাপ। কারও মুখে কোন কথা নেই। ঘণ্টা খানিক পরে নৌকা হরিরামপুর ঘাটে এসে ভিড়ল। নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুইজনে বাস স্ট্যান্ডে এসে ঢাকা গামী বাসে উঠে পিছনের দিকে সুবিধাজনক সীট নিয়ে বসার অল্প পরেই ওদের নিয়ে বাস ছুটে চলল ঢাকার পথে।
২০১৫ বই মেলায় প্রকাশিত গ্রন্থ “ষঢ়ঋতু থেকে।
আবার দেখা হবে বন্ধু! হয়ত রেশমি আর রতনের রান্না ঘর থেকে যেদিন রাজহাসের ভূনা মাংশের গন্ধ ভেষে বেরাবে আকাশে বাতাসে।

রেশমি-২/৩

bede-1
পূর্ব প্রকাশের পর, রেশমি-১/৩,
৪।
ঠিকানা হীন ভাসমান জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বেদেরা ইসলাম ও হিন্দু উভয় ধর্মই মেনে চলে তবে তারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে এবং অনেকেই ওয়াক্তিয়া নামাজ সহ জুম্মার নামাজ এবং ঈদের নামাজ মসজিদে আদায় করে কিন্তু রোজা রাখার ব্যাপারে এদের অনীহা। উপার্জনের মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করে। বিয়ে শাদীর সময় হিন্দু রীতিনীতি পালন করে, বিয়ের পরদিন সূর্য ওঠার আগে কনের মাথায় সিঁদুর দেয়া হয় যদিও বিয়ে পড়ানো হয় ইসলামি মতে মওলানা দিয়ে। মেয়ে যে পুরুষকে পছন্দ করবে সে পুরুষের সম্মতি থাকলে সে বিয়ে হবে। বিয়ে করতে হলে কনেকে যৌতুক দিতে হয়। যার যেমন সামর্থ্য, সে তাই দেয়। এ অর্থ বেদেনীর কাছে জমা থাকে শত বিপদ আপদেও খরচ করতে চায় না। বিয়ে এবং তালাক উভয়ই হয় কনের ইচ্ছায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কারণে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি সহ ছেলে-মেয়েও ভাগাভাগি হয় এবং তালাকের সময় স্বামীর দেয়া যৌতুকের অর্ধেক স্বামীর পরিবারকে ফেরত দিতে হয়। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে, ততদিন স্বামী-সন্তানের প্রতিপালন করে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর নৌকায় যায়। স্ত্রীর নৌকাই স্বামীর নৌকা। ঈদের চেয়ে এরা বিয়েতেই বেশি আনন্দ করে তবে বিয়েতে আপ্যায়ন বা উপহার দেয়ার কোন রীতি নেই। এমনিই নাচ গান করে এই আনন্দ করে। বিয়েতে বর কনেসহ উপস্থিত সবাইকে নাচগান করতে হয়। বাইরের কেউ এলে তাকেও নাচতে হয়। এসব নাচ গান একান্তই বেদে সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি। অবিবাহিত মেয়েরা আকর্ষণীয় জমকালো সাজ গোঁজ করে কোমর দুলিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্য তুলে ধরে অন্য যুবকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। তরুণ-তরুণীরা এভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজেদের সঙ্গী খুঁজে নেয়। ভিন্ন সমাজের কোনও যুবক উপস্থিত থাকলে তাকেও বেদে নারীরা বিয়ের জন্য প্রলুব্ধ করে এবং সে তরুণ যদি বেদে তরুণীকে বিয়ে করে, তাহলে তাকেও বেদেদের গোত্রভুক্ত হতে হয় নতুবা তাদের সমাজচ্যুত করা হয়। মৃত্যুর পর ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী দাফন করে এবং চল্লিশা বা কুলখানির আয়োজন করে। আবার সর্প দংশন থেকে বাঁচতে মা মনসার পূজা করে এবং শিব, ব্রহ্মাও বিশ্বাস করে।

৫।
ঝিটকা আসার আগে শিবালয় ঘাটে যখন ছিল তখন থেকে লক্ষ করছে আসা যাওয়ার পথে নৌকায় বা ঘাটে বসে কেমন করে চোখ বাকিয়ে জসীম তাকিয়ে থাকে। ইশারায় ইঙ্গিতে কিছু বলতে চায়, একা থাকলে এটা সেটা কিনে দিতে চায় কিন্তু রেশমি পাত্তা দেয় না তবে মনে মনে বসন্তের আনাগোনা অনুভব করে। ইশারার তোয়াক্কা না করে সেদিন বলেই ফেলল চল না ওই গাছের নিচে একটু বসি! রেশমি কোন জবাব না দিয়ে চলে এসেছিল। সমবয়সী ফুলির বিয়ের সময় নাচতে নাচতে কখন যেন জসীম কাছে এসে হাতটা ধরে ফেলল।
কি হইলো আমার কাছে আসছস না কেন?
চমকে উঠে বলল, হাত ছাড় কইলাম, তুই আমারে ছুবি না
কেন, কি হইছে আমি কি তোর যোগ্য না?
আগে হাত ছাড় পরে অন্য কথা
হাত ছাড়ার জন্যে ধরছি মনে করছস?
হাত ছাড় নইলে সবাইরে ডাক দিমু আমি

দলের নিয়ম অনুযায়ী জোর করে প্রেম হয় না। নালিশ হলে কঠিন শাস্তি। তাই ভয়ে হাত ছেড়ে দিল কিন্তু ওর কথা ভেবে দেখার এবং অনেক যৌতুক দেয়ার লোভ দেখাল।
সারা জীবন তোর গোলাম হয়ে থাকব রে রেশমি তুই শুধু আমার কথা একটু ভেবে দেখবি।
তুই আমার দিকে তাকাবি না, আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না
সেদিনের মত ছাড়া পেল কিন্তু তার পরে থেকেই রেশমি বুঝতে পারে তার মনে জোয়ার এসেছে, পরিপূর্ণ টইটুম্বুর জোয়ার টলমল করছে। গায়েও তেমনি নতুন জোয়ারের ঢেউ এসে দোলা দিয়েছে। বাড়ন্ত গড়নের জন্য মায়ের কড়া নির্দেশে অনেকদিন আগেই ফ্রক ছাড়তে হয়েছে। শারীর আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে শিখিয়েছে মা। বসন্তের সদ্য ফোটা কৃষ্ণচূড়ার থোকা থোকা লাল ফুলের আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে রেশমির দেহে মনে। চারদিকে যা দেখে সব কিছু রঙ্গিন মনে হয়। রেশমি বুঝতে পারে সে এখন বড় হয়েছে। পনের থেকে ষোলয় পা দেয়া রেশমি জসীমকে নিরস্ত করতে পেরেছে কিন্তু তার মনে রঙ ধরাবার মত কাওকে দেখা যাচ্ছে না! কে আসবে তার কাল নাগ হয়ে? যে ছোবল দিতে জানে! এমন কাওকে দেখছি না! আমাদের এই দলে এমন কেও নেই। এই ঘাট ছেড়ে অন্য ঘাটে গেলে খুঁজতে হবে। জসীম একটা ঢোঁরা সাপ! ওর মধ্যে কিছু নেই ওর ডাকে সারা দেয়ার চেয়ে গলায় কলশী বেঁধে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক ভাল।

৬।
গোপীনাথপুর থেকে ফিরে আসার পরের দিন রেশমি দলের সাথে বের হয়েছে। আজ তার পরনে সবুজ পাড়ে কুসুম রঙ শারী, হলুদ ব্লাউজ, গলায় আগের মত পুতির মালা, হাতে লাল চুরিতে দারুণ মানিয়েছে। জরিনা বলেই ফেলল
তরে আইজ খুউব সুন্দর লাগতেছেরে রেশমি, তুই যে আজ কারে পাগল করবি কে জানে! দেখিস সাবধানে থাকবি নাইলে কিন্তু সর্দার দল থিকা বাইর কইরা দিবনে।
এই শুনে সুফি বলল
দেখস না একটু কাজল দেয় নাই কপালে একটা টিপও নাই তাও কি সুন্দর লাগতেছে!
হিরা খিল খিল করে হেসে বলল
অরে আবার দল ছাড়া করব কেরা ওতো সর্দারের মাইয়া!
এমনি হাসি আনন্দে এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে ওপাড়ে যাব না চল ওইদিকে যাই বলে ঝিটকা স্কুল ছাড়িয়ে পুব দিকে গেল। যেতে যেতে হুগলাকান্দি এসে পৌঁছল। গ্রামে ঢুকে হাঁক দিল
চুরি নিবেন চুরি! রেশমি চুরি বেলোয়ারি চুরি আরও আছে ফিতা, কাটা, আলতা, কাজল!
মাঝে মাঝে সুরেলা গলায় গান গাইছে
সঙ্গীরা নানা দিকে ছড়িয়ে গেল। এক সাথে থাকলে কে বেচবে কে দেখবে তাই এদের এই রীতি। এক সাথে বের হয়ে পরে যার যার সুবিধা মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আবার বেলা শেষে এক জায়গায় জড় হয়ে এক সাথে ঘাটে ফিরে আসে।
গ্রামের ভিতরের দিকে একটু এগিয়ে যেতেই এক বাড়ি থেকে ডাকল
এই বাইদানী!
রেশমি শব্দ অনুসরণ করে বাড়ির উঠানে ঢুকে মাথার ঝাঁকা নামিয়ে ডাকল
কইগো বিবি সাবেরা আহেন
বাড়ির মেয়েদের একে একে তার পণ্য সম্ভার দেখাচ্ছে। বাড়ির মেয়ে মহিলা সহ বুড়িরা পর্যন্ত সবাই ঘিরে ধরেছে। পাশের বাড়ি থেকেও বৌ ঝিরা এসেছে।
রতন এই বাড়ির ছেলে, ঝিটকা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে। স্কুলে যাবার জন্য বের হয়ে দেখে উঠানের মাঝখানে মা বোন এবং ভাবিদের জটলা। কি ব্যাপার এরা সবাই কি দেখছে? পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এক বোনকে সরিয়ে দাঁড়াল। বেদেনীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক স্তব্ধ হয়ে গেল। আগেও অনেক বেদেনী দেখেছে কিন্তু তারা শুধুই বেদেনী আর কিছু নয়। কিন্তু এ যেন ভিন্ন কেও, এ কি আসলেই বেদেনী? এত সুন্দর! মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? অবাক চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। বোন ভাবিরা নানা কিছু কেনা কাটা করছে কিন্তু রতনের কোন দিকে হুশ নেই। স্কুলের দেরি হচ্ছে সেদিকেও মন নেই। হঠাৎ করেই এক ভাবির চোখে রতনের কাণ্ড ধরা পরল। সে আবার বড় জা কে দেখাল। কিরে রতন বাইদানীরে এত দেখার কি আছে? মনে ধরেছে নাকিরে রতন? ভাল করে দেখ, পছন্দ হলে বল, কি সুন্দর বেদেনী! সবাই এদিকে রতনের অবস্থা দেখে অনেকক্ষণ হাসাহাসি। ওরাও বলাবলি করছিল মেয়েটা খুব সুন্দর। আহারে, কি জন্যে যে এই মেয়ে বাইদার ঘরে জন্মেছে! এই রূপ নিয়ে কি গাও গেড়ামে ঘুরে ফেরি করা যায়? কবে কি হবে কে জানে! রতন বুঝতে পেরে স্কুলের পথে পা বাড়াল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে আসার পরেই তৃষ্ণার্ত মন আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বাড়িতে ওঠার পথের পাশে বড় জাম গাছের নিচে বেদেনীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। বেচা বিক্রি করে বেদেনী বাড়ির বাইরে এসে জাম গাছের নিচে রতনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
কি গো বাবু, তুমি যে কিছু নিলা না?
কি নেব, আমার কিছু কি তোমার কাছে আছে?
কি যে কও, কত কি আছে, বিবি সাবের জন্যে চুরি নেও খুশি হইব, কও কি নিবা বলেই মাথার ঝাঁকা আবার নামাল
আচ্ছা নেব, আগে বল তোমার নাম কি?
আমরা হইলাম ছোট জাত, আমার নাম দিয়া কি করবা
তোমরা কোন ঘাটে থেমেছ
ওইতো ঝিটকা বাজারে
বল না তোমার নাম কি?
কইলামতো আমার নাম দিয়া কি করবা? আমারে বিয়া করবা?
আহা! বল না!
রেশমি। কইলামতো এহন কি নিবা কও
রতন বিপদে পড়ল। এখন কি করে? বোনেরা তাদের সব নিয়ে নিয়েছে। কার জন্যে নিবে?
নিরুপায় হয়ে ছোট বোনকে ডাকল
এই ঊষা
ঊষা বাইরে এসে ভাইকে দেখে অবাক, দাদা তুই স্কুলে যাসনি?
তোরা কি কি নিয়েছিস? আর কিছু নিবি?
তুই কিনে দিবি?
দেখ আর কি লাগবে
ঊষা সুযোগ পেয়ে আরও অনেক কিছু কিনে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
রতন পকেট থেকে টাকা বের করে বেদেনীর হাতে দিতে দিতে বলল
কাল কোন গ্রামে যাবে?
কি যে কও বাবু! আমাগো কি কোন ঠিক ঠিকানা আছে যেদিন যেদিকে মনে চায় সেদিকেই যাই, কেন? আবার কি নিবা?
আশেপাশে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে সাহস করে রতন বলেই ফেলল
আর কি নিব? আমি তোমাকেই নিতে চাই
কি কইলা বাবু?
আমতা আমতা করে রতন আবার কথাটা বলল, আমি তোমাকে নিতে চাই
রেশমি অবাক চোখে বাবুর আপাদমস্তক দেখল। বাবুর ঠাট আছে, শরীরতো নয় যেন এক্কেবারে কেউটে সাপ! দাতে বিষ আছে! এরেই কয় পুরুষ মানুষ। পুরুষ হইলে এমনই হইতে হয়। এর আগে গাওয়ালে এমন কথা কেও বলেনি। তবে ঠারে ঠারে চাউনি দেখেছে, পুরুষ মানুষের চাউনির মানে রেশমি বুঝতে শিখেছে। নানান প্রস্তাব শুনেছে, ইতর প্রস্তাব। ওকে দেখে কোথাও কোথাও আবার শীষ দেয়, গানের কলি আওড়ায়। এই বাবু তেমন বাবু না। মনে ঘোর লেগে আসছিল, বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার বনে কে যেন উঁকি দিতে চাইছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
ছি! ছি বাবু! তোমরা হইলা গেল খেনুস (ভদ্রলোক মানুষ), তুমি এইডা কি কইলা? কইলাম না আমরা ছোট জাত আমাগো দিকে নজর দিতে নাই। আমার বাবা আমাগো দলের সর্দার, লোকে জানলে বাবা আমারে আস্ত থুইবো না, কাইটা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিব।
বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কে যেন যাচ্ছিল তাকে দেখে রতন থেমে গেল। বলল
আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও
রেশমি খুচরা টাকা বাবুর হাতে দিয়ে ঝাঁকা গোছান শুরু করল আর রতন স্কুলের পথে পা বাড়াল।

৭।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে প্রতিদিনের মত বের হলো। ঝিটকা আসবে, বন্ধুরা মিলে রাজার চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়। রাত আটটা নয়টা বাজলে যার যার বাড়ির পথ ধরে। আজও বের হলো। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বেলা ডোবার পরেপরেই আমার কাজ আছে বলে আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসে বেদের ঘাটে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজছে। ২০/২৫ টা নৌকার মধ্যে রেশমি কোন নৌকায় রয়েছে কে জানে! নৌকার ভিতরে মিট মিট করে হারিকেন জ্বলছে, সবাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, কেও আবার শুয়ে পড়েছে। কি করেই বা কাকে জিজ্ঞেস করবে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে না পেয়ে হঠাৎ মনে হলো রেশমি বলছিল না ওর বাবা ওদের দলের সর্দার? সর্দারের নৌকা খুঁজে পেতে আর এমন কি!
একজনকে পাছা নৌকায় বসে বিড়ি ফুকতে দেখে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল
এই যে শুনছেন
আমারে কইলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাদের সর্দারের নৌকা কোনটা?
কেন? সর্দাররে দিয়া কি হইব?
কাজ আছে, একটু ডেকে দিবেন?
ওই যে ডাইনের তিন নাও বাদের নাও
রতন এগিয়ে গেল নৌকার কাছে। বুক ঢিব ঢিব করছে, কি বলবে? এতক্ষণ ভাবেনি! কিছু না ভেবেই হঠাৎ ডাকল
সর্দার নায় আছে?
কে ডাকে?
বলতে বলতে লুঙ্গি পরা ফতুয়া গায়ে মাঝ বয়সী এক লোক ছৈয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে রতনকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আপনে, কি হইছে, কি চান?
আপনে কি এই দলের সর্দার?
হয়, কি হইছে?
আপনার কাছে দাঁতের পোকা বের করার ওষুধ আছে?
আছে, কার জন্যে?
আমার ভাতিজার
ও! কাইল সকালে বেলা ওঠার আগে নিয়া আইতে পারবেন?
বাবার কথার শব্দ শুনে রেশমি আর তার মা বাইরে এসে দেখে কে একজনের সাথে সর্দার কথা বলছে। রেশমি চিনতে পারল সকালে যার সাথে কথা হয়েছে সেই লোক। একটু অবাক হলো। কি ব্যাপার? এর মধ্যে নায়ে এসে হাজির! বসন্তের সেই টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া আবার উকি দিতে চাইল কিন্তু আকাশ কুসুম ভেবে নিজেকে বোঝাল। লোকটা না হয় ভাবের মোহে পইড়া মনে যা আইছে কইয়া ফালাইছে আবার এই খানেও আইসা পরছে কিন্তু যা সম্ভব নয় তারে প্রশ্রয় দিতে নাই। আমরা বাইদার জাত আমাগো এত স্বপ্ন দেখতে নাই।
আপনের বাড়ি কোন গ্রামে?
এই ফাঁকে রতন দেখল ছৈয়ের ভিতর থেকে বের হয়ে রেশমি বোকার মত আগা নায়ে তার দিকে চেয়ে বসে আছে। আল আধারিতে আরও বেশি সুন্দর লাগছে
না আনা যাবে না, আপনারা বাড়ি যেতে পারবেন না? বেশি ফি দেব! যাবেন না?
আপনের বাড়ি কনে?
কাছেই, হুগলাকান্দি, এই রাস্তা দিয়ে সামনে গেলে যে গ্রাম পড়বে সেখানে রতন মাস্টারের বাড়ি বললেই দেখিয়ে দিবে। আমি এই যে এই প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করি।
বুঝলাম
যাবেনতো?
আইচ্ছা, আমি যামু না তয় আর কেউরে পাঠাইয়া দিমু।[অপেক্ষা করুন] প্রকাশিত গ্রন্থ “ষঢ়ঋতু থেকে।

রেশমি-১/৩

bede-1
১।
ভরা ভাদ্র মাস। নদী নালা খাল বিল জলে থৈ থৈ করছে। ইছামতী নদীও তেমনি থৈ থৈ করছে। ছলাত ছলাত বৈঠা বেয়ে কত নৌকা চলে যাচ্ছে, কোনটা পশ্চিমে মালচি, বাল্লার দিকে আবার কোনটা পুবে হরিণা, হরিরামপুরের দিকে। কোনটায় আবার লাল নীল রঙ বেরঙের পাল তুলে মাঝি শুধু পাছা নায় হাল ধরে ভাটিয়ালি সুর তুলে দূরের কোন গায়ের নাইয়রি নিয়ে যাচ্ছে, ছৈয়ের সামনে পিছনে একটু খানি কাপড় দিয়ে পর্দা দেয়া। জনাব আলি নদীর পাড়ে বসে বিড়ি টানছে আর তাই দেখছে।
দেড় দুই মাস হলো এই ইছামতীর পাড়ে ঝিটকা বাজারের ঘাটে তারা লগি গেড়েছে। নদীর পাড়ে বাজারের পরেই ইউনিয়ন অফিস তারপরে হাইস্কুল। হাইস্কুলের পাশেই প্রাইমারি স্কুল। হাই স্কুলের সামনে নদীর পাড়ে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই জনাব আলি বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে।
দেখতে দেখতে পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে আসছে, সূর্যটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ডুবে যাবে। এর মধ্যে তাদের বহরের কোন কোন নৌকায় হারিকেন ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাজারের ঘরে ঘরে বাতি দিয়ে দিয়েছে। দুই পাড়ের গ্রামেও দুই একটা বাড়িতে আলো দেখা যাচ্ছে। আর একটা বিড়ি জ্বালাল। কিছুতেই উপযুক্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।
অন্ধকার হয়ে আসার আগেই ছোট মেয়ে কলি ডাকতে এলো
খেপতে, (বাবা) নায় যাইবা না? এহানে আর কতক্ষণ বইসা থাকবা? চল নায় চল আমরি (মা) চিন্তা করতেছে, ভাত খাইবা চল
বলেই হাত টেনে উঠিয়ে দিল। মেয়ের পাশে পাশে হেটে এসে পা ধুয়ে নৌকায় উঠল। নৌকার এক পাশে ব্যবসার বিক্রির জিনিস পত্র আর এক পাশে সংসারের জিনিস পত্র। মাঝে শোবার জায়গা। পিছনে গলুইর কাছে রান্নার আয়োজন। জনাব আলির বহরের অধিকাংশই বেচাকেনা করে। হরেক রকম চুরি, আলতা, মেন্দি, মালা, কানের দুল, মাথার ক্লিপ, মুখ দেখার ছোট আয়না, চিরুনি, উকুনের চিরুনি, কপালের টিপ, কাজল, বাচ্চাদের খেলনা এমনি কত কি! আবার কেও কেও শিঙ্গা লাগানো, দাঁতের পোকা বের করা, তাবিজ কবচ ঝাঁর ফুকের কাজও করে। সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখান, সাপের ব্যবসা করা, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা, জাদু দেখানো, মাছ ধরা, বানর খেলা দেখানো, পাখি শিকার ইত্যাদি। এদের মধ্যে দুই একজন যে এদিক সেদিক কিছু করে না সে কথা বলা যায় না। নানা জনে নানা রকম ফন্দি ফিকির করে তবে তা জানাজানি না হলে কেও আর ও নিয়ে মাথা ঘামায় না।
ঝিটকা বাজারের পুঁটি মাছ আর করল্লা দিয়ে চচ্চড়ির মত করেছে। জনাব আলি কি খাচ্ছে সেদিকে তার মন নেই। খেতে বসেও ভাবছে দেখে জয়নব বেগম তাড়া দিল
কি হইছে, এমনে ভাবলেই হইব? মাইয়ারেতো আর গাঙ্গে ফালাইয়া দিতে পারুম না। আমি কই কি চল আমরা এহান থিকা চইলা যাই। অনেক দিনতো হইল, আর কত দিন এই ঘাটে থাকুম?
বলেই স্বামীর মুখের দিকে তাকাল কিন্তু তার মুখের কোন ভাবান্তর দেখতে না পেয়ে একটু হতাশ হলো।
জনাব আলি শুধু জিজ্ঞেস করল
রেশমি কনে?
আছে ওই নায়
কি করে?
কি আর করব, হুইয়া রইছে
খাইছে?
হ, তুমি আহার আগেই খাইয়া গেছে।

২।
জনাব আলির নৌকার বহর ইছামতী নদী দিয়ে যাচ্ছিল, ওদের ধারনা ছিল হরিরামপুর যাবে কিন্তু পথে রাতে অমাবস্যার অন্ধকারে পথ দেখতে না পেয়ে ঝিটকার কাছে দিয়ে যাবার সময় কি মনে করে এই ঘাটেই ভিড়িয়ে দিল।
কি হইল জনাব ভাই, থামলা কেন?
ভিড়া, এই ঘাটেই দেইখা যাই।
এইতো, সেই থেকে তারা এখানেই আছে আজ প্রায় দুই মাস। বেদেরা সাধারণত কোন ঘাটে এত দিন থাকে না কিন্তু এখানে ভাল ব্যবসা হচ্ছে বলে কেমন করে যেন রয়ে গেল। ঘাটে বাধার পরের দিন সবাই যার যার ঝাঁকা নিয়ে গ্রামে বের হলো ফেরি করার জন্য। জনাব আলির মেয়ে রেশমি। দেখতে সুন্দরী। বেদের ঘরে এমন মেয়ে দেখা যায় না। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবই যেন বিধাতার নিপুণ হাতে বানানো। কাচা হলুদের মত গায়ের রঙ, মাথায় লম্বা কাল কুচকুচে গোসলে (চুল), বাড়ন্ত গড়ন, হরিণের মত গোঙকুরি (চোখ), সদা ধবধবে সুন্দর খোঁজ কুই (দাঁত), থুতনির বাম পাশে কাল তিল, অর্ধ প্রস্ফুটিত গোলাপ। যৌবনের পথে পা দিয়েছে কিন্তু এখনও গন্তব্যে পৌছাতে পারেনি, এগিয়ে যাচ্ছে। রেশমি অন্য নেমারিদের (মেয়ে) মত নামড়াদের (ছেলে) দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সাজগোজ করে না। ওকে সাজতে হয় না। সুফি সবসময়ই বলে ঈশ আমাগো যে আল্লায় কি দিয়া বানাইছে! তর মত একটুখানি পাইলেই আমাগো আর কিছু লাগত না। রেশমির চোখে কাজল কিংবা কপালে টিপ কিংবা খোপায় ফুল গুজতে কেও কখনও দেখেনি তবুও রেশমি যেখান দিয়ে যায় পথের কেও এক নজর না তাকিয়ে পারে না। পথে যেতে যেতে চোখ যেন এমনি এমনিই আটকে যায়। সেদিন দলের আগে আগে রেশমি আর বাকিরা সবাই ওর পিছনে। অন্য সব বেদেনীর মত গোড়ালির উপরে তোলা লাল পাড় হলুদ শারী, লাল ব্লাউজ, গলায় পুতির মালা, হাত ভরা প্লাস্টিকের লাল চুরি, কোমরে আঁচল জড়ান মাথায় চুরির ঝাঁকা গলায় গানের সুর ‘মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বাড়ি আরেক ঘাটে খাই মোদের ঘরবাড়ি নাই’ আরও গাইছে ‘আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই নাগেরই মাথায় নাচি’ সবাই ওর সাথে সাথে গলা মেলাচ্ছে।
অনেকেই অনেক কিছু বিক্রি করলেও জনাব আলির পরিবার মেয়েদের এই সব সাজ প্রসাধনী জিনিষ পত্র ছাড়া আর কিছু বিক্রি করে না। তবে দলের মধ্যে পারুল, সুফি, হিরা এবং অনেকের কাছেই তাবিজ কবচ, গাছ গাছড়ার তৈরি ঔষধ এবং ঝুরির মধ্যে সাপ নিয়েই প্রথম দিন নদীর ওপাড়ে গোপীনাথপুর গ্রামে গেল। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ভালই বেচা কেনা হয়েছে। সন্ধ্যার আগে আগে আবার দল বেধে সবাই ঘাটে ফিরে এসেছে। পা ধুয়ে নৌকায় উঠে মাথার ঝাঁকা নামিয়ে বাবার প্রিয় মেয়ে আগে বাবার সাথে দেখা না করে কিছুই করবে না। বাবার সাথে দেখা হলো। আজকের এই নতুন এলাকা কেমন এই সব নিয়ে কথা হলো। এবার রেশমি আগা নায়ে এসে মুখ হাত ধুয়ে আগামী কালের জন্য কিছু মালামাল ঝাঁকায় ভরে মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করল মা কিছু রানছ?
রানছি
কি রানছ?
তর বাপে ইচা মাছ আর পুই শাক আনছিল তাই আর ডাইল রানছি
দেও মা খিধা লাগছে। এহ! সারাদিন যা ঘুরছি পাও এক্কেবারে টনটন করতেছে।
৩।
বেদেদের সমাজ ব্যবস্থা দেশের আর দশটা সমাজের মত নয়, এদের সমাজে ভিন্ন নিয়ম শৃঙ্খলা। এদের না আছে কোন ঠিকানা না আছে বাড়ি ঘর। নৌকায়ই এদের জন্ম, নৌকায়ই এদের জীবন, সুখ-দুঃখ, সংসার, উৎসব আনন্দ বেদনা আবার নৌকায়ই মৃত্যু। ঝর তুফান, শীত গ্রীষ্ম, বর্ষা সারা বছর নৌকায় ভেসে এক ঘাটে এসে লগি গারে। কোথাও আবার দল বেধে বাজার ঘাট বা স্কুল কলেজের পাশে পতিত জমি বা খাস জমিতে পলিথিন, বাঁশের চালি বা সস্তা হোগলা পাতা খেজুর পাতা দিয়ে ছৈয়ের মত বানিয়ে তার নিচেই বসবাস করে তবে এটাও অস্থায়ী। যাযাবর এই দল কোন এক জায়গায় স্থায়ী হতে পারে না। রক্তেই এদের যাযাবরের নেশা। কারা এদের পূর্ব পুরুষ সে ইতিহাস এরা জানে না। দাদা দাদি বা বংশ পরস্পরায় যা শুনে এসেছে এর বেশি আর যেতে পারে না। মাস খানিক এক জায়গায় থেকে অস্থির হয়ে যায়, নৌকার বহর নিয়ে বা ছৈ গুটিয়ে ছুটে চলে ভিন্ন কোন ঘাটের উদ্দেশ্যে। সর্দারই এদের নেতা। পরের গন্তব্য কোথায় হবে, কে মারামারি বা ঝগড়া ঝাটি করল, কার বিয়ে হবে, কাদের ছাড়াছাড়ি হবে এসব সালিস বিচার সর্দারই করে। স্থায়ী কোন নিবাস না থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দীক্ষা এদের নেই তবে শিশুকাল থেকেই বেঁচে থাকার জন্যে এদের পেশাগত নানান শিক্ষা দেয়া হয়। লতা (সাপ) ধরা, সাপের খেলা দেখান, সাপে কাটা রুগীর চিকিৎসা করে বিষ নামান, পোক্কর (পাখি) শিকার করা ছেলেদের শেখান হয় আবার তেমনি করে মেয়েদেরও নানা ভাবে সেজে গুজে হাটে বাজারে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করা বা গাওয়ালে (গ্রামে) যেয়ে ফেরি করা শিক্ষা দেয়া হয়। ছেলে মেয়ে ১০/ ১২ বছর বয়স হলেই মাথায় ঝাঁকা দিয়ে বা যে যেভাবে পারে তাকে সে ভাবে নিজে রোজগারের পথে নামিয়ে দেয়। ছোট ছেলেরা বনে জঙ্গলে ঘুরে রান্নার কাঠ খড়ি কুড়ায় আবার সুযোগ পেলে পাখি টাখি শিকার করে, মাছ ধরে। মেয়েরা সাধারণত মাথায় ঝাঁকা নিয়ে গ্রামে বা মহল্লায় ঘুরে ঘুরে ফেরি করে আবার কখনও হাটে বাজারে পসরা সাজিয়ে বসে। পুরুষেরা নৌকা নিয়েই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করে সাথে বয়স্ক মহিলা যারা ঘুরে ফেরি করতে পারে না তারা নৌকায় থাকে। কখনও পুরুষেরা বনে জঙ্গলে ঘুরে সাপ ধরে, নৌকায় বসে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। বেদেনীরাও সাপ ধরতে পারে। ঢোঁরা, লাউডগা, কালনাগিনী এমন সব বিষাক্ত সাপ। তবে সবাই সাপ ধরতে পারে না। হিংস্র মেজাজের এবং ভয়ঙ্কর বিষাক্ত দাঁড়াশ, শঙ্খিনী, গোখরো, কাল কেউটে জাতের সাপ নিজেরা ধরতে না পারলে অন্য বেদের কাছ থেকে কিনে নেয়। কালনাগিনী বেদেনীদের ভীষণ পছন্দের সাপ, তাই হয়ত বেদেনীদের হাঁটা চলাফেরা বা স্বভাব অনেকটা সাপের মত। লক্ষ করলে দেখা যাবে হাঁটার সময় এদের পা ফেলার ভঙ্গিও ভিন্ন রকম, এরা এক পায়ের পর আরেক পা ফেলতে সোজা করে ফেলে। সাপ খেলা দেখানোর সময় হিংস্র বিষাক্ত সাপকে বেদেনী বাহুতে কিংবা গলায় পেঁচিয়ে বাঁশী বাজিয়ে সুরেলা গলায় এই চির চেনা গান গেয়ে পথচারী বা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে
‘খা খা রে খা, বক্ষিলারে খা,
কিপটারে খা, কঞ্জুসরে খা।
গাঁইটে টাকা বাইন্দা যে
না দেয় বেদেনীরে,
মা মনসার চেড়ি তাদের
খা খা করে খা।
খা খা খা ওই বক্ষিলেরে, কিপ্পিনেরে খা
গাঁইটে পয়সা বাইন্দা যে
না দেয় বেদেনীরে
তার চক্ষু উপড়াইয়া খা’।
এমন অনেক গান প্রচলিত আছে যা বিশেষ করে বেদেদের মুখে মুখে বেঁচে আছে। সমাজ এদের অবহেলা করে স্বীকৃতি না দিলেও এদের নিয়ে অনেক মনে দোলা দেয়া কাহিনী রচনা করেছে। অনেক সিনেমা তৈরি করেছে যেমন মহুয়া, বেদের মেয়ে, মনসামঙ্গল, সাপুড়ে, বেহুলা লখিন্দর, নাগিনী কন্যার কাহিনী, নাগিনী, সর্প রানী, সাপুড়ে মেয়ে, নাচে নাগিনী, বেদের মেয়ে, রাজার মেয়ে বেদেনী, বেদের মেয়ে জোসনা।

এদের স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া হলে কেউ কারো গায়ে হাত দেয়ার সুযোগ পায় না, নিয়ম নেই। নৌকার সামনের গলুইতে একজন আর পিছনের গলুইতে একজন বসে উত্তেজিত হয়ে গালাগালি করে, লগি বৈঠা এ ওর দিকে ছুড়ে দেয়। হুলুও (বিয়ে)এদের নিজেদের মধ্যেই হয়। ছেলে বা মেয়ের বয়স হবার সাথে সাথেই কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার আগে বিয়ে দিয়ে দেয়। মেয়েদের ১৪/১৫ বছর বয়স হলেই বিয়ে দেয়া হয়। স্ত্রী গাওয়ালে গেলে স্বামী রান্না বান্না সহ নৌকার গোছগাছ করে রাখে আবার সন্তানের দেখাশোনাও করে। নারী শাসিত এই সমাজে নারীরাই পেশায় মুল ভূমিকা পালন করে। পুরুষেরা সাধারণত অলস হয়, তবুও স্বামীকে বশে রাখার জন্য স্ত্রীরা নানা রকম তাবিজ কবচ তন্ত্র মন্ত্র করে যাতে পুরুষ ভিন্ন নারীতে আসক্ত না হয়। বেদেনীরা স্বামীদের আঁচলে বেঁধে রাখতে তুলনাহীন। পুরুষ বশে রাখতে তারা শরীরে সাপের চর্বি দিয়ে তৈরি তেল ব্যবহার করে, স্বামীর শরীরে এই তেল নিয়মিত মালিশ করে। কোনও পুরুষের পক্ষে বেদেনীর এই কৌশল উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। বেদেনীর মায়াজালে পড়লে কোন পুরুষ বেদেনীকে ছেড়ে যেতে পারে না। স্বামী বেদে স্ত্রীদের কাছে দেবতার মত, যাবতীয় ঝুট ঝামেলা বিপদ আপদ থেকে তাকে আগলে রাখার জন্য স্ত্রী আপ্রাণ চেষ্টা তদবির করে।[অপেক্ষায় থাকুন] আমার প্রকাশিত গ্রন্থ “ষঢ়ঋতু” থেকে।

মরীচিকা

cene (15)

মনের বীণায় যে সুর বাজে
বাঁশরী সে গান গায় না,
আজ এই ফাল্গুনি হাওয়া
নীরবে কেন বয়ে যায় তুমি জান না।।

সবই তো হলো আজ মরীচিকা
মিছে হলো ভালোবাসা।
আলেয়ার টানে তাই
নিভে গেল সব আশা।।

বুঝি নাই সে তো ভুলেরই হাতছানি
তুমি আজও সে কথা মান না।

মরুতে হারায় যে নদী
সেতো বয় না সাগর পানে।
বিরহের গান গেয়ে যায়
বাতাসের কানে কানে
ভুলেই সাজানো মধু যামিনী
আর তো ফিরে আসে না।।

ফাগুন বেলা

the green villages_397_7960

দিগন্ত বিস্তৃত মেঠো প্রান্তর
সময়ের হাত ধরে চলে নিরন্তর।
আকাশে ওড়ে সাদা মেঘের ভেলা
শান্ত অশান্ত উদাসী বালুকা বেলা।

ছোট ছোট গাং চিলে করে কানাকানি
এমনি হলো তোমার আমার জানাজানি।
বাসব ভাল, বুকের কোণে প্রদীপ শিখা জ্বেলে
যেখানে মিশেছে আকাশ আর সাগরের নীলে।

তেমনি করে শুধু চেয়ে রব নীরব আমি
তোমার মুখপানে, নিরবধি অবাক বিহ্বলে।
গুন গুন শোনাবে ঘুম পারানি গান
মায়াবী রাতে আঁধারের কলতান।

ঝিরি ঝিরি বইবে বাতাস, আসবে যখন ফাগুন
হৃদয় মাঝে জ্বালব তখন ভালবাসার আগুন।
সেই আগুনের পরশ নিয়ে একটু দিও ছোঁয়া
দিবানিশি দেখবে তাই ভুবন ভরা মায়া।

আমায় তুমি দিও শুধু একটু সময় ঋণ
তোমায় আমি দেব তাই ভালবাসার দিন।
ফুরাবে না এই জনমে রেখ যতন করে
যত্নে ভরা সোহাগ মেখে সোনার খাঁচায় ভরে।

আমার দেশের মাটির গন্ধ

গত কয়েকদিন দেখা আমার গ্রাম
Anar Gram (1)

Anar Gram (2)

Anar Gram (3)
বিজয়নগর বাজার
Bijoynagar Bazar (7)

Bijoynagar Bazar (6)

Bijoynagar Bazar (4)

Bijoynagar Bazar (3)

Bijoynagar Bazar (2)

Bijoynagar Bazar (8)
ফুলকফি বাজারে নেয়ার প্রস্তুতি
Cauli Harvesting
গায়ের মানুষ শাজাহান কাকা
Gayer Manush
ঝিটকা হাট
Jhitka Hat (1)

Jhitka Hat (2)
বিজয়নগর বাজারে চায়ের আড্ডা
Tea Adda
পিয়াজের ডাটা ঢাকায় যাবার প্রস্তুতি
Piajer Data
খেসারি আর ধনিয়া ফুল
Kheshari and Dhania

ঢাকা শহরের মৌণ সঙ্গীত

ছবি কথা বলে আবার মাঝে মাঝে নীরবে গানও শোনায় ঢাকা শহরের তেমনি কিছু সঙ্গীতের সাথে দেখুন তার বিভিন্ন সময়ের কিছু রূপ আমার বিশ্বাস যা সে নিজেই বলতে পারবে।

1._lead_photo_nawabpur_road_in_1954

1-2

2._pilkhana_area_1880

3._elephant_road_1905

4-2

5-2

6._air_port_area_kurmitola_1964

6-2

7-2

15._bsmmu-_the_then_shahbagh_hotel_1954

21._dhaka_street_in_1975

46._nawab_bari_boat_race_year_unknown

50._paltan_maidan_1950s

1000 Rupee Note-1938

amiruddin-darogahs-mosque-near-to-babubazar-ghat-on-the-bank-of-buriganga-1912

baitul-mukarram-1967-web

book-fair-1987

buriganga-1974

buriganga-from-ahsan-manzil-1974

chawkbazar-iftar-market-1974

dacca-1933-shantinagar-british-army-barrak

Dhaka 1975

Dhaka college-1

Dhaka college-2

dhaka-1887-after-the-tornado

Dhaka-1947 (1)

Dhaka-1947 (3)

Dhaka-1947 (4)

dhaka-1961-people-gathered-in-ramna-race-course-to-see-queen-elizabeth-ii

dhaka-club-1890

dhaka-race-course-1890s

dhaka-stadium-1950

Dhanmondi 1960

Dhanmondi 1960-

dhanmondi-1966-bridge-on-road-7-8

dhanmondi-rd-29-1964

dholai-khal-1870

Dholair khal Lohar pul

dilkhusha_1970s

dilkusha-bhulbhulaiya-garden-1880

eid-in-paltan-maidan-1954-2

eid-prayer-paltan-maidan-1954

farmgate-in-1979

farrukh-siyars-mosque-now-lalbagh-shahi-jaame-mosque-1880

Fulbari Rail Stn- 1947

Gulistan dacca-1963-hall

gulistan-1957

kamlapur-railway-station-1966

Kazi Nazrul Islam in Dhaka

mirpur-1966-gabtoli-haat

motijheel-shapla-chattar-1980s

nawabs-shahbagh-garden-modhur-canteen-dhaka-university-1904

new-bedford-buses-were-launched-dhaka-1966

pallabi-housing-society-mirpur-dhaka-1960s

Picture1

Picture2

Postal in 1947

Race-course-and-ramna-kali-mandir-from-bardhaman-house-bangla-academy-1960

race-course-dhaka-1890

Ramna gate-Now Doel Chattar-1904

sadarghat-area-dhaka-1965

sadarghat-august-1962

sodorghat-1962

stadium-area-bangabandhu-avenue-1960

st-gregory-high-school-1882

tejgaon-1880

Village (1)

Village (2)

Village man

Village

Z1000 (1)

Z1000 (2)

Z1000 (3)

একটি কাল রাত

Nature-vs-man-Spain-Lightning
বাংলাদেশের একটি সমুদ্র বন্দরে চাকরি করছি তখন। স্ত্রী সন্তান নিয়ে ওখানেই কর্তৃপক্ষের বাসায় বসবাস করি। দিন গুলি বেশ কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ অফিসের একটা জরুরী কাজে ৩/৪ দিনের জন্য ঢাকায় শিপিং অফিসে এসেছিলাম। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি বলে সঙ্গত ভাবে এখানেই থেকে কাজ সেরে আবার চলে যাব। শেষ দিনে অর্থাৎ ১৯৮৫ সালের ২৫শে মে তারিখে সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে শিপিং অফিসে যাবার আগে ঢাকা লিয়াজো অফিসে গেলাম ওখানে যারা আছে তাদের সাথে একটু সৌজন্য সাক্ষাত করতে। লিয়াজো অফিসার খালেক সাহেব দেখেই সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে বলল স্যর কবে এসেছেন, কেমন আছেন ইত্যাদি বলে বলল আপনি তো ঢাকায় এলে বাড়িতেই থাকেন এদিকে আসেন না তাই আপনার সাথে তেমন দেখাও হয় না। শিপিং অফিসে যাবেন জানি, তবে স্যর আজ কিন্তু দুপুরে এখানে এসে খেয়ে যাবেন। কেন, কি ব্যাপার খালেক সাহেব, আজ কি কোন বিশেষ আয়োজন আছে না কি?হ্যাঁ একটু আছে। আচ্ছা ঠিক আছে দেখি যদি সুযোগ পাই তাহলে আসব। তবে খারাপ ওয়েদার চলছে কি জানি কি হয়। আমি চেষ্টা করব আজ যদি কাজ শেষ করতে পারি তাহলে আজই রাতের কোচে চলে যাব বলে আর যারা ছিল তাদের একটু হ্যালো বলে বের হয়ে গেলাম।
বন্দরের নিজস্ব কয়েকটা জাহাজের জরিপ কাজের কিছু আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ডিজি শিপিং এর সাথে আলোচনা করে একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার কথা। আলোচনা শেষে খসরা চিঠি টাইপ করে ডিজি সাহেবের সই স্বাক্ষর নিয়ে অফিস অর্ডার ইস্যু করে আমার কপি নিয়ে বের হয়ে এলাম। এখানে একটু বলে নেই যে ডিজি সাহেব কিছু দিন আগে আমাদের ডাইরেক্টর (এডমিন) ছিলেন বলে কাজটা বেশ একটু দরদ দিয়ে তারা তারি করে দিলেন। বিকেল ৫ টায় ৯ তলা অফিস থেকে নেমে বাইরে বের হয়ে দেখি আকাশ কাল হয়ে গেছে। জীবনের বেশ অনেকটা সময় সাগরে কাটিয়েছি, বর্তমানে সামুদ্রিক বন্দরে কাজ করছি কাজেই আকাশের চেহারা দেখে কিছুটা নয় বেশ অনেকটা অনুমান করতে পারি কি হতে চলছে। এজন্য বেরো মিটার, হাইগ্রো মিটার এসব দেখার দরকার হয় না। দুপুরে খালেক সাহেবের নিমন্ত্রণে যেতে পারিনি। মতিঝিলের শিপিং অফিস থেকে সেগুন বাগিচার লিয়াজো অফিসে গেলে এই কাজ আজ শেষ হতো না। তবে খালেক সাহেবকে ফোনে বলে দিয়েছিলাম।
আকাশের অবস্থা দেখে মনে কেমন যেন একটা আতঙ্ক এসে ভর করল। দক্ষিণের আকাশ লালচে। কোথাও একটু সময় নষ্ট না করে একটা স্কুটার নিয়ে মিরপুরে বাড়িতে চলে এলাম। তবুও প্রায় ৭ টা বেজে গেল। বাড়ি থেকে যত তারা তারি পারি মংলার উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। মা বেঁকে বসলেন, এই অবস্থায় কি ভাবে যাবি? একটা দোটানায় পরে গেলাম। ওদিকে ওরা এত বড় বাড়িতে মাত্র তিনটে প্রাণী তার দুই টাই আবার ছোট, কি করবে?এমন সময় টিভিতে বিশেষ সংবাদ বুলেটিন প্রচার করছে। তারা তারি টিভির সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম ‘একটি বিশেষ সংবাদ, আবহাওয়ার বিপদ সঙ্কেত, সকল নদী বন্দরের জন্য ৪ নম্বর এবং মংলা বন্দরে ১০ নম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে ৭ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত প্রদর্শন করতে বলা হচ্ছে। মাই গড! এর মানে নদী পথ বন্ধ, সমুদ্র বন্দরে যে সব জাহাজ আছে তারা স্ট্যান্ডবাই থাকবে যে কোন সময় জেটি ছেড়ে যেতে এবং জেটি ছাড়তে হলে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিবে। ভয়ঙ্কর বিপদ। মংলা যেতে হলে পদ্মা নদী পার হয়ে যেতে হবে ওদিকে খুলনায় রূপসা নদী পার হতে হবে অথচ কোন নদীতেই ফেরি চলবে না। তার মানে আজ মংলা যাবার কোন উপায় নেই।
বাইরে বের হয়ে দেখি দক্ষিণের আকাশ আগুনের মত লাল হয়ে গেছে, বাতাস নেই, চারিদিকে একটা স্তব্ধ ভাব। তার মানে দক্ষিণে প্রচণ্ড কিছু হচ্ছে। বাসায় ফোন করলাম ফোন যাচ্ছে না। মংলার হারবার কন্ট্রোলে ফোন করলাম কোন জবাব নেই। খুলনার পোর্ট কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম শুধু এনগেজড পাচ্ছি। লিয়াজো অফিসে একটা ওয়ারলেস আছে।
ওখানে ফোন করলাম,
খালেক সাহেব মংলার খবর কি?
না স্যর কোন খবর পাচ্ছি না। মংলায় আমাদের হারবার কন্ট্রোল, পোর্ট কন্ট্রোল বা মংলা রেডিও কেউ কল রিসিভ করছে না বা ওদের কোন কথাও শুনছি না। আপনার সেট কিসে চলছে ব্যাটারিতে নাকি পাওয়ারে?
আমরা স্যর সব সময় পাওয়ারেই চালাই।
আপনার রিসিভার ঠিক আছে?চিটাগাং পোর্টে বা ডায়মন্ড হারবারের কোন সারা পাচ্ছেন?
শুধু চিটাগাংয়ের কিছু কথা শোনা যাচ্ছে।
আচ্ছা চিটাগাং পোর্টকে একটু বলে দেখেন ওরা মংলা পোর্টকে পাচ্ছে না কি। ফোনে শুনছি খালেক সাহেব চিটাগাং পোর্টকে ডাকছে। ওরা জবাব দিল তাও আমি শুনছি।
না, আমরাও মংলা পোর্টকে পাচ্ছি না।
আচ্ছা খালেক সাহেব মংলায় যে জাহাজ গুলি আছে তাদের কাওকে একটু ডেকে দেখেন তারা কেউ কোন জবাব দেয় নাকি।
হ্যাঁ স্যর এটা করে দেখি।
দেখেন আমাকে জানাবেন কি হল।
একটু পরে খালেক সাহেব ফোন করে জানাল যে মংলার কেউ কোন সারা দিচ্ছে না তবে ফেয়ার ওয়ের কাছে আউটার এঙ্কোরেজ থেকে এক জাহাজ আমার ডাকাডাকি শুনে আমাকে বলল ‘মংলা ইজ অবজার্ভিং হেভি স্টর্ম উইথ হাই সি’।
তার মানে ওদের এনটিনা ফেল কিন্তু এক সাথে তিনটা এনটিনা ফেল হয় কি করে?নিশ্চয়ই যা ভেবেছি তেমন কোন প্রচণ্ড কিছু হয়েছে না হলে এমন হতে পারে না।
কালো মুখ দেখে মা বাবা সবাই আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন
কি, কোন খবর পেলি?
না, সব বন্ধ।
মানে?
যোগাযোগের সব পথ বন্ধ। কোন খবর জানা যাচ্ছে না। দূরে ফেয়ার ওয়ে বয়ার কাছে থেকে একটা জাহাজ জানিয়েছে যে মংলার উপর দিয়ে প্রচণ্ড ঝড় বইছে সাথে জলোচ্ছ্বাস। মনে হয় ঝড়ে সব ওয়ারলেসের এরিয়েল ভেঙ্গে গেছে, হয় তো বিজলী বন্ধ যার জন্য টেলি ফোন কাজ করছে না।
মা উদ্বিগ্ন হলেন। তাহলে ওরা কি করছে?
কি আর করবে, পাশে রহমান সাহেব আছে ওরা সবাই মিলে যাহোক একটা পথ বের করে নিয়েছে।
একটু পরে আবার খালেক সাহেব ফোন করে জানাল যে বাগেরহাট ডিসি অফিসে ফোন করে জেনেছে মংলার উপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঝড় বয়ে গেছে প্রথম ধাক্কায় পাওয়ার লাইনের মেইন গ্রিডের যে পোল তার একটা সহ কয়েকটা বিদ্যুৎ বাহি পোল ভেঙ্গে গেছে বলে বিদ্যুৎ বন্ধ, সাথে ছিল ৭/৮ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস, নদী থেকে কয়েকটা বড় লঞ্চ ডাঙ্গায় চলে এসে আটকে গেছে। জলোচ্ছ্বাস দুই ঘণ্টার মত ছিল তবে মানুষ জনের কোন ক্ষতির খবর তারা পায় নি। পোর্টের জেটি থেকে সব জাহাজ কাস্ট অফ করে মিল স্টিমে ভেসে ছিল, বন্দরের সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে আছে। খালেক সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম, রাখার আগে খালেক সাহেব বলল চিন্তা করবেন না স্যর, সবাই ভাল আছে।
হু। জলোচ্ছ্বাসের এই ৭/৮ ফুট উচ্চতা হিসেব করে মোটামুটি একটা আন্দাজ করলাম তাহলে আমাদের আবাসিক এলাকায় নিচতলার বাসা গুলিতে অন্তত দুই ফুট পানি ঢুকেছে। ভীষণ রকমের উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন নদী বন্দরের সঙ্কেত কমবে। এই ঘটনার ঠিক তৃতীয় দিন সকালে রেডিওতে খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পরলাম। গাবতলি এসে সোহাগ কোচে একটা টিকেট নিয়ে বসে পরলাম। কোচ যতই খুলনার দিকে এগুচ্ছে ততই মনে হচ্ছে যেন হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বাড়ছে।
দুপুর ৩ টার দিকে খুলনা পৌঁছে রিকশায় রূপসা ফেরি ঘাটে। ফেরি পার হয়ে মংলার বাসে। বাস মংলার দিকে এগুচ্ছে আর একটু একটু করে ঝাড়ের কীর্তি দেখছি। দিব রাজের কাছে এসে চমকে গেলাম ওই তো পোল গুলি ভেঙ্গে পরে রয়েছে, পশুর নদীর পাড়ে ৩/৪ টা বড় বড় লঞ্চ ডাঙ্গায় পরে আছে, গাছ পালা ভেঙ্গে চুড়ে নাস্তা নাবুদ অবস্থা এমন প্রলয়ঙ্করী ঘটনা এর আগে কখনো দেখিনি। বাসায় গিয়ে কি দেখব, স্ত্রী সন্তানরা কি অবস্থায় আছে ভেবে ভেবে ঢাকা থেকে এই পর্যন্ত সারাটা পথে যা হোক তাই মেনে নেয়ার মত মনকে শক্ত হতে বলছি কিন্তু মন ততই বিদ্রোহ করছে কিছুতেই মানতে রাজী হচ্ছে না। এইতো কাছে এসে পরেছি, আবাসিক এলাকা দেখা যাচ্ছে, ওই তো আমি যে বিল্ডিংয়ে থাকি দেখা যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে দেখি জায়গায় জায়গায় জলোচ্ছ্বাসের পানি জমে রয়েছে, প্রায় সব বাসার জানালা ভাঙ্গা, কাচ ভাঙ্গা কেউ কেউ চট বা অন্য কিছু দিয়ে আপাতত ঠেকিয়ে রেখেছে। বাসার কাছে এসে নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এত শখের বাগানের ফুল গাছগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, দোতলার বাসার দিকে তাকিয়ে কারো কোন সারা না পেয়ে ভয়টা আরও জেঁকে বসল। পা চলতে চাইছে না। কিছুতেই সিঁড়ি ঘরের ভিতর ঢুকতে পারছি না। এই বিল্ডিংয়ের সব ফ্ল্যাটের জানালা ভাঙ্গা, আমার বাসার ব্যালকনির দরজা খোলা রয়েছে দেখলাম। কতক্ষণ দাড়িয়ে ছিলাম মনে করতে পারছি না। পাশের বাসার রহমান সাহেবের ছোট ছেলে তুহিন ব্যালকনিতে এসে আমাকে দেখেই ডেকে উঠল কাকা এসেছেন?আস্তে করে ওর দিকে তাকিয়ে কি বলব কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তুহিন এক দৌড়ে ব্যালকনি থেকে ভিতরে চলে গেল নিচে থেকে ওর দুম দাম পায়ের শব্দ শুনলাম। একটু পরেই আমার স্ত্রী মেঝ মেয়েকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে আমাকে দেখে ডাকল,
কি হোল ওখানে কি কর ভিতরে এসো।
এই এতক্ষণে যেন আমার পা একটু একটু জোর পাচ্ছে। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠছি পায়ের শব্দ পেয়ে উপরে তাকিয়ে দেখি মেয়ে কোলে নিয়ে ও নিচে নেমে আসছে। আমার কাছে আসতেই আমি ওর হাত চেপে ধরলাম।
তুমি তোমরা আছ?আমার যে বিশ্বাস হচ্ছে না।
ঘরের ভিতর ঢুকেই কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে মেয়েকে কোলে নিলাম, পাশে বড় মেয়ে এসে দাঁড়াল। মা মেয়ে সহ সবাইকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে মনে হচ্ছিল যেন চেপে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলি।
বড় মেয়ে বলে উঠল আব্বু ব্যথা পাচ্ছি।
সম্বিত ফিরে পেলাম। ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি করেছিলে?
শুনছি। বিকেলেই মসজিদের মাইকে সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিল, আপনারা সবাই নিজ নিজ বাসায় ফিরে যান, নিচ তলায় যারা থাকেন তারা মালামাল সামলে রেখে উপর তলায় কারো বাসায় চলে যাবেন। সন্ধ্যার একটু আগে হঠাত্ করেই শুরু হোল ঝড়। জানালা দুইটা বন্ধ করতে পেরেছিলাম ওই দুইটাই ভাল আছে বাকী সব এক ঝটকায় ভেঙ্গে গেল, সাথে সাথে কারেন্ট নেই, চার্জার লাইট দিয়ে যা হয় তাই। ফোন উঠিয়ে দেখি ডায়াল টোন নেই। মুষল ধারে বৃষ্টি, ঝড়ের সাথে বৃষ্টির ঝাপটায় সমস্ত ঘর ভিজে একাকার। এমন সময় তুহিনের মা এসে আমাদের নিয়ে গেল। নিচে থেকে বিকাশ বাবু, নাহারদের বাসার সবাই রহমান ভাইর বাসায় চলে এলো। সবাই ওখানে। সন্ধ্যার একটু পরেই সামনের মাঠে দেখি প্রায় হাঁটু পানি, পানি বেড়ে বেশ অনেক খানি হয়ে গেল। দেখো নিচে দাগ আছে। সিঁড়ি ঘরে বের হলাম সবাই। নিচে দেখি দরজার অর্ধেক পানি। ঘণ্টা দুই আড়াই ছিল এর মধ্যেই সব চুরমার। রাতে আমার আর তুহিনের মা যা রান্না করা ছিল তাই দিয়েই সবাই কিছু কিছু করে খেয়ে নিলাম। নাহারের মা, বিষ্ণুর মা আফসোস করছে তাদের রান্না করা খাবার আনবে কেমনে, ঘর ভরা পানি। সকালে নিচে নেমে দেখলাম কি প্রলয় হয়ে গেছে, বাগানে কিচ্ছু নেই।
যাক যা হবার হয়েছে, তুমি ভয় পেয়েছ?
না সবাই এক সাথেই ছিলাম বলে তেমন ভয় পাইনি। তুমি কি করেছিলে?
এক এক করে সব ঘটনা বললাম। এখানে এসেও যে কেন ঘরে ঢুকার সাহস পাচ্ছিলাম না তা বলতেও বাদ দেইনি।

ব্লগিং এর মূলমন্ত্র

Bangla Blogeeer

আসলে আমরা একটা ব্লগে কি চাই?

সবাইকে এই কথাটাই মনে রাখতে হবে ব্লগিং কোন পেশা নয়। ব্লগিং করা সবারই একটা নেশা। এখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে সহ অবস্থানটাই, সবার আগে বিবেচ্য। এখানে যে যা পারছে যে যা ভাবছে তা অন্যের কাছে প্রকাশ করে ছোট্ট একটু মতামত চাইছে। নিজের চেয়ে জ্ঞানে গুণে বড় বা নিজের সমসাময়িক এমন সবার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছে। তবে এখানে লিখতে লিখতে যে কেউ কোনদিন হুমায়ুন আহমেদ বা ইমদাদুল হক হয়ে যাবে না, তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে?

এখানে অনেকেই নয়; কেউ কেউ নিজের পরিচিতি অংশে নিজেকে এমন করে জাহির করছেন যেন, তিনি এ দেশের কোন একজন মস্ত মহাজন পদের জন্য নিজের বায়োডাটা সকলকে জানাচ্ছেন।

আসলে তার কোন প্রয়োজন আছে কি?
এখানে বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন চরিত্রের, বিভিন্ন পরিবেশের, বিভিন্ন পেশার ব্লগার রয়েছেন। কেউ হয়ত বিমানের পাইলট, কেউ হয়ত জাহাজের ক্যাপ্টেন, কেউ সরকারি সচিবালয়ের উপ-সচিব, কেউ কৃষক, কেউ ডাক্তার আবার কেউবা নিতান্ত কাঠমিস্ত্রি কিংবা সাধারণ দোকানদার। অতএব সঙ্গত কারণেই সবার মন, মনন, চিন্তাশক্তি, ধ্যান ধারনা, লেখার গভীরতা, ভাবনার প্রশস্ততা যার যার মতই। এদের কাউকে বাদ দিয়ে কিন্তু আমরা ব্লগিং করতে পারব না। সবাইকে নিয়েই আমাদের এক সাথে চলতে হবে। এতে যদি আপনার ভাল না লাগে তাহলে কে কি করবে বলুন! এখানে কারোও সাথে কারও প্রতিযোগিতা কাম্য নয়। কেউ কারো সাথে প্রতিযোগিতার জন্য এখানে আসেনি। প্রতিযোগিতা হয় সমসাময়িকদের সাথে। অসম প্রতিযোগিতা সুন্দর বা সহনীয় হয় না। সবাই সবার সঙ্গে মিশবে, ছোটরা নতুনরা বড়দের কাছে অভিজ্ঞদের কাছে শিখবে, আলাপ আলোচনা করবে তবেই না হবে সহ অবস্থান।

আর প্রতিযোগিতা যেখানে আছে, যে ব্লগেই এমন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা ছিল বা আছে সেখানে কি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছে কেউ? আর নিরপেক্ষতাই যদি না থাকে তাহলে আবার কিসের প্রতিযোগিতা? আমি ভাত রান্না করব, আপনি সুন্দর কবিতা লিখবেন, তিনি সুন্দর উপন্যাস লিখবেন, রহিম সুন্দর ফুল ফোটাবে, জামাল বাঘ শিকারের গল্প বলবে, কামাল রাঙ্গামাটি বা টোকিও বেড়াবার গল্প বলবে, মামুন খেজুরের রস খাবার ছবি দেখাবে, কোন সুন্দর বাগানের ছবি দেখাবে এদের কার সাথে কার প্রতিযোগিতা করবেন? কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েই কি আর ব্লগ চলে? কখনও চলেছে বলে বিশ্বাসও করি না।

আপনি একে দেখে নাক সিটকাবেন, ওর ব্লগে যাবেন না, এর ব্লগে মতামত বা আপনার প্রতিক্রিয়া জানাবেন না, এতে আপনার মান রক্ষা হবে না, এমনকি আপনার লেখায় মতামত করলেও নিতান্ত ভদ্রতা করে হলেও তাকে চা নাস্তা খাওয়ানো তো দূরের কথা ধন্যবাদ টুকু জানাতে কৃপণতা করবেন তাহলে আর এক সাথে থাকার ইচ্ছা কেন? আপনি বড় পদে চাকরি করেন বলেই যদি আপনি বড় মানুষ হয়ে থাকেন, বড় কিছু লিখতে পারেন তাহলে তো আপনি ব্যবসায়িক সফল ব্যক্তি, আপনি আর কেন ব্লগিং করে সময় নষ্ট করবেন?

প্রতিযোগিতার মনোভাব ছেড়ে, ছোট বড়র বিভেদ ছেড়ে আসুন আমরা সবাই একই শব্দনীড়ের ছায়ায় বসে হাসি তামাশা করে, আনন্দ পাবার চেষ্টা করি, সময়গুলোকে রাঙ্গিয়ে তুলি। ক’দিনেরই বা এই জীবন! আসুন সবাই সবাইকে ভালবাসি। পরস্পরকে ভালবেসে নিজ অবস্থান থেকে শব্দনীড়কে রাঙ্গিয়ে তুলি।

সকলে আমরা সকলের তরে প্রবাদটি শুধু কথায় নয় কাজে ফুটিয়ে তুলি।

আবদুলের রোজনামচা

Cleaner
ফরিদ সাহেব এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। এতদিন সরকারি চাকরি করে ক্লান্ত হয়ে হাত পায়ে যখন নানা উপসর্গ যেমন গিরায় গিরায় ব্যথা, মাজায় ব্যথা দেখা দিচ্ছিল তখন একেবারে সময় মত এলপিআরের অফিস অর্ডার পেল। বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণে সাগর উপকূল ছাড়িয়ে সুন্দরবনের ধারে মংলায় সুন্দর মনোরম পরিবেশে জীবনের অনেকগুলি বছর কাটিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দোতলার বারান্দায় বসে বাসার বাম দিকে মংলা নালা আর পশ্চিমে একটু দূরে পশুর নদী এবং সামনে একটু ডানে সুন্দরবনের অবারিত সবুজ সেই সাথে পাখপাখালির কিচিরমিচির শুনে শুনে সুখেই কাটিয়ে দিয়েছে দিনগুলি। অবসর পেয়ে পৈত্রিক বাড়ি ঢাকায় এসে ঢাকা শহরের অন্ধ গলির পাশে বন্ধ অন্ধকার বাড়িতে হাঁপিয়ে উঠছিল। এতদিন যখন ঊর্ধ্বতন কর্তার নানা রকমের হুকুম তামিল করা, সরকারি নানা ধরনের কাজকর্ম দেখাশুনা করা এবং অধস্তনদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে তা নিরসনের জন্য জটিল ভাবনায় ব্যস্ত থাকত সেখানে এখন সারাদিন শুয়ে বসে শুধু শুধু গায়ে গতরের ওজন আর সর্বাঙ্গের ব্যথা বাড়ান ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এমনি এক সময় মেঝ মেয়ে একদিন মা বাবা আর বোনদের ডেকে বেশ আনন্দের সাথে জানাল তার একটা চাকরি হয়েছে। ভাল পদ, ভাল বেতন তবে থাকতে হবে একেবারে প্রত্যন্ত এক উপজেলায়।
বাহ! বেশ ভাল কথা!
হ্যাঁ আব্বু আমিও এমনি একটা চাকরি খুজছিলাম। এখানে বছর দুয়েকের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলে আমার পরের ডিগ্রিটা নেয়া হবে। ওতে প্র্যাকটিকাল এক্সপেরিয়ান্সের দরকার।
বেশ ভাল হয়েছে, তাহলে জয়েন করে ফেল। জয়েন করার লাস্ট ডেট কবে?
এইতো সামনের ১৭ তারিখ কিন্তু তোমরা আমার সাথে যাবে না?
তোমরা কারা?
মা আর তুমি!
হ্যাঁ যাব। আমরা গিয়ে তোমার থাকা রান্না খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসবইতো
না শুধু দিয়ে আসলেই হবে না, আমার সাথে ওখানে থাকতে হবে
থাকতে হবে? বল কি! এই দুই বছর ওখানে থাকতে হবে?
এখানেই বা কি করবে? এখানে তোমার কি কাজ?
ফরিদ সাহেব ভেবে দেখল মন্দ কি? এখানে বসে বসে হাড়ে ঘাস গজাবার সময় হয়ে গেছে
কিন্তু বাবা তোমার মা না হয় তোমার রান্না বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকবে কিন্তু আমি কি করব? আমার সময় কি করে কাটবে ওই অজ গ্রামে?
তুমি চিন্তা করোনা আব্বু আমি তোমার জন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিব
কি ব্যবস্থা করবে, কোথায়?
আহা আগে চলইনা তখন দেখব কি করা যায়!
বেশ চল।
সুনামগঞ্জের আগাম টিকেট করা হলো। সুনামগঞ্জে নেমে আবার পাশের এক উপজেলায় যেতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যা যা সাথে নেয়া দরকার বা কোচে যেতে যা যা নেয়া যায় সেগুলি বাঁধাছাঁদা করে শুভক্ষণে শুভ লগ্নে রওয়ানা হলো। বিকেলে সুনামগঞ্জ পৌঁছে আবার একটা সিএনজি নিয়ে চাকরীস্থলে পৌঁছল। প্রথমেই থাকার জন্য একটা হোটেলে আশ্রয় নিয়ে বের হলো খাবার সন্ধানে। আশেপাশে বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট দেখে একটায় ঢুকে পরল। খাবার পাট সেরে এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখার জন্য রিকশায় উঠে বসল। চারদিকে হাওরে থৈ থৈ পানি, দূরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় ছায়া ছায়া দেখা যায়। বেশ সুন্দর এলাকা। ছোট্ট উপজেলা শহর ঘুরে আসতে বেশিক্ষণ লাগল না।
পরদিন কাগজপত্র নিয়ে জয়েন করার জন্য মাঝু অফিসে চলে গেল। জয়েন করে অফিসের বস আর কলিগদের সাথে আলাপ পরিচয় হলো। সবাই জানতে চাইল কোথায় উঠেছেন?
হোটেলের নাম বলতে সবাই চিনতে পারল। সাথে মা বাবা এসেছে জেনে সবাই অবাক হলো।
বলেন কি আপনি কি একই মেয়ে?
না না আমার বড় আর ছোট দুই বোন আছে ঢাকার বাড়িতে।
ও তাহলে আপনি বুঝি বাবা মার খুব প্রিয় মেয়ে?
তা একেবারে অস্বীকার করা যাবে না তবে বাবা রিটায়ার্ড মানুষ তাই মা বাবাকে নিয়েই এসেছি তাছাড়া বাবা মা আমাদের তিন বোনকেই খুব স্নেহ করেন। কখনও কোথাও একা থাকিনি তাই একা আসতে দিতে রাজি হয়নি। ওনারা না এলে আমার এখানে জয়েন করা হতো না।
বেশ ভাল কথা। তাহলে এখন আপনার জন্য একটা ভাল বাসা খুঁজতে হয়।
বস সবাইকে ডেকে মেয়ের জন্য একটা বাসা দেখতে বলে দিল। একজন বলল
আপা কাছেই একটা সুন্দর বাসা আছে চলেন বিকেলে যেয়ে দেখবেন। কাছেই, আপনি হেটে অফিসে আসতে পারবেন।
হ্যাঁ যাব, সাথে আব্বু আম্মুকেও নিয়ে যাব।
বিকেলে অফিস সেরে মেয়ে তার এক কলিগকে সাথে নিয়ে হোটেলে উপস্থিত। পরিচয়ের পালা শেষ করে বলল
চল, আব্বু আম্মু দুইজনেই চল মনির ভাই একটা বাসা দেখাতে নিয়ে যাবে। কাছেই, হেটেই যেতে পারব।
চল।
বাসা দেখে খুবই ভাল লাগল। এত তাড়াতাড়ি এমন জায়গায় মেয়ের অফিসের এত কাছে এত সুন্দর বাসা পাবে ভাবতেই পারেনি। তিন রুম, বারান্দা, দুই টয়লেট তাতে আবার টাইলস বসান। উপজেলা শহরে এমন বাসা! চমৎকার! ঢাকার তুলনায় ভাড়া এত কম যে ভাবাই যায় না! তবে সমস্যা হলো এখানে রান্নার গ্যাস নেই। অবশ্য লাকড়ি দিয়ে রান্নার জন্য খুবই সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। বেশ বড়সড় রান্না ঘর আর তার এক পাশে টেবিল সমান উঁচুতে দুইটা লাকড়ির চুলা, উপরে এক্সাস্ট ফ্যান আর লাইটের ব্যবস্থা রয়েছে, চুলার নিচে আবার বেশ কিছু লাকড়ি রাখা যায়। ওরা সবাই এমন ব্যবস্থা দেখে অবাক হলো। এর আগে কোথাও এমন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। বাসায় ঢুকতে রাস্তার মুখে পাশেই আবার এলপি গ্যাসের বোতলের দোকানও দেখেছে একটা। মনির সাহেব জানাল এখানে রান্নার লাকড়ির দাম বেশ সস্তা। লাকড়িতেই রান্না বান্না হবে তবে জরুরী কাজের জন্য একটা সিলিন্ডার রাখলেই হবে। ব্যাস আর কি! বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়া ইত্যাদি নিয়ে আলাপ সেরে পাকা কথা হয়ে গেল। ঢাকার মত কোন অগ্রিম দেয়ার ঝামেলা নেই। আগামী কাল ধোয়া মুছা করে তার পরেরদিন বাসায় উঠবে এমন কথা হলো। যথা সময়ে হোটেল ছেড়ে বাসায় এসে উঠল। এবারে ছুটল হাড়ি পাতিল, রান্নার আয়োজন, বিছানাপত্র ইত্যাদি কেনাকাটা করতে। বাল্ব, ফ্যান, বাসন পেয়ালা, চামচ খুন্তি, রুটি বানাবার বেলন পিড়ি, দাও বটি, তোষক জাজিম বালিশ মশারি কম কিছুতো লাগে না! ছোট শহর বলে হাতের কাছেই সব পাওয়া যায়। একটা নিয়ে এসেই শুনে আর একটা আনতে হবে। আবার ছুটল। আবার ছুটল। আবার ছুটল। এবারে মোটামুটি থাকার মত একটু ব্যবস্থা হলো। মাঝুর মা ডাল, আলু ভর্তা ভাত রান্না করল। আস্তে আস্তে খাট, ডাইনিং টেবিল চেয়ার ফ্রিজ সহ আরও অনেক টুকি টাকি কেনা হচ্ছে একে একে। প্রায় প্রতিদিনই তিন চারবার করে মাঝুর বাবাকে বাজারে যেতে হচ্ছে। কাছে বলে হেঁটেই যায় আবার হেঁটেই আসে। তবে মাঝুর বাবা ফরিদ সাহেব মাছ কিনতে পারেননা বলে দেখে শুনে মাছ কেনার জন্য মাঝুর মা তার সাথে যায়। এখানে এসে এত সব কিছু সুবিধা হলে কি হবে হাউজ এসিস্ট্যান্ট বা কাজের মানুষ সখিনা কিংবা আবদুল কাওকে পাওয়া যাচ্ছে না মোটেই।
এদিকে ফরিদ সাহেব এখানে আসার আগে যেমন করে ভেবেছিলেন ওখানে যেয়ে আমার সময় কাটাব কি করে! আসলে দেখা যাচ্ছে কোথা দিয়ে যে তার দিনগুলি কেটে যাচ্ছে তা টেরই পাচ্ছেন না। যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই মাঝুর মা মধুর কণ্ঠে আবদার করেন: শোন আমিতো আটা মাখাচ্ছি তুমি একটু সিংকের বাসন পেয়ালা গুলি ধুয়ে দাও না!
বেশ ধুয়ে দিচ্ছি। এই নাও তোমার সিংক খালি করে দিলাম।
বাহ! বেশ কাজ করেছ এবার এক কাজ করতে পারবে?
কি কাজ?
যা গরম পরেছে রান্না ঘরে মোটেই টিকতে পারছি না ওদিকে মাঝুর অফিসে যাবার সময় হয়ে এলো তুমি রুটি গুলি বেলে দাও আমি সেঁকে নিচ্ছি।
আচ্ছা দাও আমিই বেলে দিচ্ছি
এই ভাবে কেউ রুটি বেলে! এ তো বাংলাদেশের মানচিত্র বানিয়েছ! সারা জীবন ভরে কি শিখেছ? কিচ্ছু শিখলে না! রুটিও বেলতে পার না!
বাংলাদেশের মানচিত্র রুটি বেলা এবং সেঁকা হয়ে গেল। ফরিদ সাহেব এসে একটু বারান্দায় দাঁড়াল। বাইরে ডোবার পরে রাস্তা। রাস্তা দিয়ে বাস, লেগুনা সিলেট সুনামগঞ্জে যাচ্ছে আসছে তাই দেখছে। এর মধ্য এবার আর এক আবদার রেডি। রান্না ঘর থেকে মধুর ডাক ভেসে এলো, তুমি কোথায়? শুনছ এদিকে একটু আস না!
ওমনিই ফরিদ সাহেব এসে হাজির।
বল কি জন্য ডেকেছ
পেঁপে ভাজি করেছি এবার ডিম ভাজতে হবে, মাঝুতো পোচ খায় না ওর জন্যে একটা ডিম ভেজে দিই কি বল!
দাও, এজন্যে আবার আমাকে ডাকছ কেন?
একটু মিষ্টি হেসে, দুইটা পিয়াজ মরিচ কেটে দাওনা!
বেশ দিচ্ছি।
আহা করছ কি? এই এত মোটা করে কেউ মরিচ কুচি করে? আরও পাতলা করে কাট।
ডিমের পোচ এবং অমলেট হয়ে গেল, রুটিতো আগেই হয়ে গেছে। এবার মাঝু রেডি হয়ে টেবিলে এসে বসল। সবাই এক সাথে নাস্তা করছে।
শুনছ চা টা একটু ঢেলে আনতে পারবে? ওখানে দেখ চায়ের কাপ রেডি আছে
কথাটা শুনে মাঝু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মার মুখের দিকে তাকাল, আব্বুকে বলছ কেন, আমি আনতে পারি না?
থাক না তোমার আব্বু খুব ভাল চা বানাতে পারে।
সবার নাশতা এবং চা পর্ব শেষ হলো। মাঝু অফিসে চলে গেল।
তুমি আবার এগুলি ধোয়ার চেষ্টা করবে না সেই আজানের সময় উঠেছি আমি একটু গড়িয়ে নিয়ে আসছি।
মাঝুর মা বললে কি হবে মাঝুর বাবা রান্না ঘরে গিয়ে নাশতার বাসন পেয়ালা চায়ের কাপ সব কিছু ধুয়ে রেখে আসল। একটু পরে মাঝুর মা বলল বাজারে যেতে হবে। দেশী মুরগি পেলে আনবে আর সবজি, কাঁচামরিচ টমেটো আনবে আর চিংড়ি মাছ পেলে নিয়ে আসবে একটু ভর্তা বানাব।
মাঝুর বাবা আবার দুইটার বেশি সদাই হলে কোনোদিনই মনে রাখতে পারে না তাই স্লিপ প্যাড আর কলম নিয়ে লিখে নেয়ার জন্য আবার ডাইনিং টেবিলে বসল।
কি কি যেন বললে আবার বল না!
আচ্ছা তুমি কি কাজের মানুষ নাকি যে তোমাকে লিখে নিতে হবে? যা যা পাবে যা ভাল লাগবে নিয়ে আসবে।
না মানে ভুলে গেলেতো আবার যেতে হবে তাই লিখে নিয়েই যাই না কেন। তাছাড়া লিখতে পারি আর তা কাজে লাগাব না?
বাজারে থাকতেই মাঝুর বাবার পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠল।
হ্যালো, কি ব্যাপার? আর কি লাগবে?
শোন, দেখতো লাউ আছে নাকি বাজারে!
না লাউতো দেখলাম না
চিংড়ি মাছ পেয়েছ?
হ্যাঁ নিয়েছি
আচ্ছা চলে আস তাহলে, রিকশায় এসো হেটে আসবে না কিন্তু
আচ্ছা দেখি।
বাজার থেকে ফিরে এসে দেখে মাঝুর মা রান্না ঘরে রান্নার আয়োজন করছে।
এই যে দেখ তোমাকে তখন নিষেধ করলাম বাসন পেয়ালা ধুবে না কিন্তু দেখ কি করেছ!
কি করেছি?
এই যে দেখ ডিমের প্লেটে যেমন তেল ছিল ওমনিই রয়ে গেছে
ও তাই নাকি?
তোমার ধোয়া এমনই হয় মনে হয় সখিনারা ধুয়েছে, তোমাকে দিয়ে কোন কাজই হবে না কি করে যে চলেছ এতদিন!
আরে ঠিক আছে কেউতো আর দেখছে না! চালিয়ে দাও না! এত এমন করছ কেন? আমিতো তোমার একটু আয়েশের জন্যেই চেষ্টা করেছি!
থাক এমন আয়েশের দরকার নেই, এগুলি আমাকে আবার ধুতে হবে, বুঝেছ?
তখনকার ঝর মোটামুটি ওখানেই থেমে গেল। আবার দুপুরে বাথরুম থেকে ডাকাডাকি।
কি হলো?
শোন এই কাপর গুলি ভাল করে ঝেরে বারান্দায় শুকাতে দাও
আচ্ছা দিচ্ছি।
গোসল সেরে এসে মাঝুর মায়ের আর এক দফা সুবচন প্রক্ষেপণ শুরু হলো
তোমাকে বললাম ভাল করে ঝেরে শুকাতে দিতে আর একি করেছ? কাপড়গুলা ঝাড়তে পার না?
আহা ইস্ত্রি করে নিলেই হবে এতে এত অস্থির হবার কি আছে?

থাক আর সাফাই গাইতে হবে না এখন যাও মেয়ের লাঞ্চে আসার সময় হয়েছে রান্নাঘর থেকে ভাত তরকারি পেয়ালায় বেরে টেবিলে নিয়ে আস আমি নামাজ পড়ে আসছি।
আবার বিকেল বেলা। শুনছ! বারান্দা থেকে শুকানো কাপড়গুলা নিয়ে এসে খাটে রাখ ভাজ করতে যেও না আবার। আমি ভাজ করব। কাপড় আনা হলে জানালা গুলি বন্ধ করে মশার কয়েল জ্বালিয়ে ওঘর থেকে কয়েকটা ছোট শুকনা লাকড়ি রান্না ঘরে এনে রাখ দেখি রাতের জন্য ভাত রান্না করতে হবে।
রাতের খাবার হয়ে গেল।
শোন, তরকারি গুলি বাটিতে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে পারবে?
হ্যাঁ তা আর পারব না? দাড়াও রাখছি।
বেশ রেখে আস।
ফরিদ সাহেবের অবস্থা এমনিই চলছে।
একদিন ফরিদ সাহেব মেয়েকে বলল বাবা তুমি না বলেছিলে আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দিবে, মনে আছে?
থাকবেনা কেন?
তাহলে ব্যবস্থা করছ না কেন?
এ আবার নতুন করে কি করব! তুমি একটা জব করছ না?
সে আবার কি করছি?
কেন আম্মুর আবদুলের কাজটা করছ না?

আমি ঢাকা মহানগরী

Dhaka City

এই যে আজকে আপনারা বসবাস করছেন আমার বুকে এই আমি ঢাকা মহানগরী। এক সময় কিন্তু আমি এত বড় ছিলাম না। নবাবদের আমলে মাত্র কয়েকজন নবাব বাড়ির নায়েব, গোমস্তা আর খানসামারা এখানে বসবাস করত এবং তাদের সেবা যত্নের জন্য কামার, কুমার, নাপিত ধোপা, স্বর্ণকার, তাঁতি, গোয়ালা, ময়রা এমনি যাদের প্রয়োজন তেমনি কয়েক ঘর জনবসতি ছিল। সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় চারশো পঞ্চাশ বছর হবে। আমার চারিদিকে ছিল খাল বিল নদী নালা এমনি সব কিছু, হ্যাঁ হ্যাঁ, ধান ক্ষেতও ছিল। ওই যে বুড়িগঙ্গা নদী, সে যে কি সুন্দর নদী ছিল তা বলার নেই। নবাব বাড়ির আশপাশ থেকে এসে রাজহাঁস গুলি যখন নদীর বুকে সাতার কাটত কি সুন্দর ছিল সে দৃশ্য। পানসী নৌকা, নবাবদের বজরা ছোপাত ছোপাত বৈঠা তুলে বেয়ে যেত সে দৃশ্য ছিল দেখার মত। এগুলি আবার কখনও পাল তুলে যেত তখন আরও বেশি সুন্দর লাগত, নানা রঙ বেরঙের পাল দেখতে যে কি সুন্দর ছিল তা আর বলার নয়। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কতজনে এই দৃশ্য দেখত! বজরা বা পানসী থেকে ঘাটে নেমে বেশিরভাগই যেত ঘোরার গাড়ি করে। সাধারণ মানুষেরা যেত এক্কা গাড়ি করে। গরুর গাড়িও ছিল আবার হাতে টানা রিকশাও ছিল অনেক। নবাব বাড়ির মেয়েরা তাতি বাজারে গয়না বানাতে যেত, তারা বেশির ভাগই আসত ঘোরার গাড়িতে চেপে। অল্প কিছু পাকা রাস্তা ছিল। নবাব বাড়ির সৈন্যরা যখন ওই পাকা রাস্তায় কুচকাওয়াজ করে যেত ভারি সুন্দর লাগত। লোকজনে চেয়ে দেখত তাদের। সবারই একরকম পোষাক, এক রকম তরবারি হাতে, মাথায় এক রকম পাগড়ী। সন্ধ্যার পরে রাস্তার পাশে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে দিত। সে সব দিন ছিল সুখের দিন শান্তির দিন। মানুষ কত ভাবেই যে উৎসব করত যেমন শবে বরাত, রমজান এবং তারপরে ঈদ, দুর্গা পূজা, কালি পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা। এ ছাড়া বার মাসে তের পাবন লেগেই ছিল। নবান্ন উৎসব, বৈশাখী উৎসব, বসন্ত উৎসব, নৌকা বাইচ এমনি কত কি! সুন্দর সুন্দর পোষাক পরে লোক জনেরা আমার বুকের উপর দিয়ে হেটে বেড়াত বাচ্চারা কত খেলাধুলা করত! কি আনন্দ ছিল! দেশের নানা জায়গা থেকে নৌকা করে কত মালামাল লোকজন আসত যেত। সদরঘাটে সবসময় হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকত।

একদিন দেখলাম কোথায় থেকে ফিরিঙ্গী না কি যেন বলে তারা এসে হাজির। ইংরেজিতে ট্যাঁস টুস করে কথা বলত। আস্তে আস্তে তাদের অনেক লোকজন এসে আমার বুকে ডেরা বাধতে শুরু করল। সে যে কি ভয়ংকর দিন গেছে সে কথা মনে হলে আজও আমার বুক কেপে উঠে। দেশের মানুষ যারা ওদের কথামত চাষ বাস কাজ কর্ম করত না তাদের ধরে এনে চাবুক দিয়ে যে কি মারাই মারত সে সব চাবুক দেখলেও ভয় হতো। শুরু হলো রক্তের বন্যা, এত রক্ত আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এইতো শুরু হলো অত্যাচার। তবে ওই ফিরিঙ্গীরা কিছু ভাল কাজ করেছিল। আমার উপর দিয়ে বেশ কিছু রাস্তা বানিয়েছিল, স্কুল কলেজ বানিয়েছিল। ওদের দেখাদেখি অভিজাত এবং ধনী পরিবারের লোকজনেরা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ও বানিয়েছিল। তারপরের ইতিহাস বড়ই করুণ। যখন তাদের অত্যাচার চরমে পৌঁছল তখন এদেশের যুবকেরা একে একে জেগে উঠল। অনেক চোরাগোপ্তা আক্রমণ, শাস্তি আরও কত কি হলো! অনেক দিন পরে দেখলাম ওই ব্যটা ফিরিঙ্গীরা লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু ওরা পালালে কি হবে ওদের জায়গায় যারা এলো তারা আরও ভয়ংকর। পাঞ্জাবী না কি যেন বলত। কেমন করে কথা বলত। একদিন শুনলাম আমাদের এখান থেকে ওরা সমস্ত সম্পদ নিয়ে অনেক দূরে নাকি ওদের দেশ সেখানে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে ওরা আবার এক হুকুম জারি করল, কেও বাংলায় কথা বলতে পারবে না। আচ্ছা বলুনতো, বাংলায় কথা বলা যাবে না এটা আবার কেমন কথা? জন্ম থেকে যে ভাষায় কথা বলে আসছে সেই কথা কি ইচ্ছে করলেই বন্ধ করা যায়? এইতো শুরু হলো এক যুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ত তারা সহ সকল ছাত্র ছাত্রী মিলে এর প্রতিবাদ করল আর ফলাফল যা হবার তাই হলো। পাঞ্জাবীরা নির্বিচারে গুলি শুরু করল। কতজন মারা গেল। বয়ে গেল রক্ত স্রোত। তাদের কথা মনে রাখার জন্য শহীদ মিনার হলো। আজও তাদের কথা কেও ভুলেনি আর কোনদিন ভুলবেও না। তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। সবই হয়েছে আমার বুকের উপরে। এমনি করে নানা অত্যাচার যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন শেখ মজিবর রহমান দল সংগঠন করা শুরু করল। ক্রমে সে যখন শক্তিমান হলো তখন একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিল আর অমনিই সারা দেশবাসী তার আহবানে সারা দিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। যুবকেরা ট্রেনিঙের জন্য চলে গেল পাশের দেশে। ওদিকে ওই পাঞ্জাবীরা শুরু করল বাঙালি নিধন অভিযান। আমার উপরে ছাত্র ছাত্রীদের যত হল হোস্টেল, পুলিশ নিবাস ছিল সে গুলিসহ পথে ঘাটে শুরু করল ট্যাংক মেশিন গান দিয়ে গুলি করা। কত মানুষ যে মরল তার কোন হিসাব নেই। অনুমান করে বলছি, কয়েক লক্ষতো হবেই। যারা সুযোগ পেল তারা আমার আশ্রয় ছেড়ে চলে গেল, যার যেখানে সুবিধা। সেদিন আমার যে কি কান্না পেয়েছিল! কিন্তু আমি কাওকে কিছু বলতে পারিনি। আমিই তাদের বলে দিলাম তোমরা যে যেখানে পার চলে যাও। আমি আর তোমাদের বুকে আগলে রাখতে পারছি না, আমার উপরে হায়েনার আসর হয়েছে। আমি নিজেই বিপদগ্রস্ত। কয়েকদিন আগে থেকেই ওদের সেনা দলে আমার বুক ভারি করে ফেলেছে। ওদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল পাপে ভরা। ওরা যেমন খুশি তেমনি চলা ফেরা করছে। আমার বুকে বয়ে যাচ্ছে রক্ত নদী। যাকে খুশি তাকে মারছে সম্পদ লুটে নিচ্ছে কেও দেখার নেই কেউ প্রতিবাদ করার নেই। সকল বিদেশীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারী করে দিল। সংবাদ সংগ্রহের জন্যে কেও আসতে পারেনি। আমার বুকে বাস করে আমার আলো বাতাস জল নিয়ে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের কিছু অমানুষ আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ওই পাঞ্জাবীদের সাথে হাত মেলাল। আহ! কত অনাচার অবিচার জুলুমই যে ওরা করেছে তা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারা শহর আতংকে ছিল। যখন তখন গোলাগুলি হয়েছে, তখন এক বিভীষিকাময় দিন গেছে। কোন ভাবে কাজকর্ম সেরেই মানুষ ঘরে ফিরে এসেছে। কাজে বের হবার পর বাড়ির মানুষ ভাবতেও পারেনি সে আবার সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে।

এভাবেই চলে গেল নয়টা মাস। একদিন পাশের দেশ থেকে সৈন্য এলো আর তাদের কাছে এখানে যারা অত্যাচার করছিল তাদের প্রধান আত্মসমর্পণ করল। এই দেশ স্বাধীন হলো। আমার ইতিহাসের আর এক অধ্যায় শুরু হলো। আমার বুকে বসে কত পরিকল্পনা হয়েছে, কত আলাপ আলোচনা হয়েছে, কত আশা উদ্দীপনা হয়েছে তা মনে হলে আজ মনটা ভরে যায়। শুরু হলো আমার বুকে আর এক খেলা। আমার বুকে নতুন বড় বড় রাস্তা ঘাট তৈরি হলো, কত সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় ভরে গেল। গন ভবন হলো, বঙ্গ ভবন হলো, সংসদ ভবন হলো। এমনি আকাশ ছোঁয়া কত দালান হলো। আমাকে এদেশের রাজধানী বানানো হলো। আমাকে মহানগরীর মর্যাদা দেয়া হলো। একটুখানি জায়গার কত দাম হলো, আমার আকার পরিধি কত বেড়ে গেল। কয়েক হাজার থেকে এখন আমার বুকে এক কোটি মানুষ বসবাস করছে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যেতে অনেক সময় লেগে যায়। কত রঙ বেরঙের গাড়ি চলছে। গাড়ি চাপা পড়ে কত মানুষ প্রতিদিন মরছে কে তার হিসাব রাখে আর কেই বা তার বিচার করে? গাড়িতে গাড়িতে আমার সমস্ত রাস্তা ভরে আছে। শুধু গাড়িতে পা দিয়ে দিয়ে যাত্রা বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে বসে থাকে। কাজের কত ক্ষতি হয় কত তেল গ্যাসের অপচয় হয় কেও দেখে না। রাজা মহারাজারা এদিক ওদিক যাবার সময় শহর বাসির সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পথে বসিয়ে রেখে কত আনন্দ পায়। দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে দেখছি যেই আমার বুকে আসে সেই হনুমান হয়ে যায়। আমার মনে কোন শান্তি পাচ্ছি না। কেও আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। কত মিছিল দেখেছি, কতি শ্লোগান শুনছি, ভিন্ন মিছিলের ভিন্ন ভিন্ন শ্লোগান। হরেক রকম ভাষা, হরেক রকম উদ্দেশ্য, কত কি যে হচ্ছে! এতদিন ভিন দেশিরা এখানে অন্যায় অনাচার করেছে এখন শুরু হয়েছে নিজেদের অনাচার। এত অনাচার আমি কি করে সহ্য করি? জনসাধারণের সংসদ ভবনে বসে যাকে তাকে অশ্রাব্য গালাগালি করছে। জুতা ছোড়া ছুরি করছে! ছি! ছি! কি লজ্জা!
আমার বুকের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যেয়ে কত পাপ করছে। বিধাতা এই পাপ কেমনে সইবে ভেবে অস্থির হই। মানুষ খুন করা, ধর্ষণ করাতো এখন মামুলি ব্যাপার এতে আর এখন আমি আঁতকে উঠি না। কত বিচিত্র ভাবে নৃশংস উপায়ে মানুষ খুন করছে, গুম করছে। আহা! তাদের পরিবারের কি আহাজারি! সে আর আমি সইতে পারছি না! মানুষ এত নৃশংস এত জঘন্য পিশাচ কি করে হয় ভেবে পাই না। শুনেছি বনের হিংস্র পশুরাও নাকি এমন হয় না। মেয়েরা যে ভাবে চলাফেরা করে তাতে আমার ভারি লজ্জা লাগে, আমি ওদের দিকে তাকাতে পারি না। পুরুষেরা সন্ধ্যার পর ওত পেতে থাকে কখন মেয়েরা আসবে! দেহ ব্যবসা করার জন্য কত বড় বড় লোকেরা তাদের মাইনে দিয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করে রাখে আবার ওদিকে মঞ্চে উঠে দামি দামি মন ভেজানো কথা বলে। যে সব মেয়েরা স্বাধীন ভাবে এই ব্যবসা করে তারা এখন আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে না তারা অভিজাত এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেয়।

কত জন্ম হয়েছে কত মৃত্যু হয়েছে এই আমার বুকে। এক দিকে আনন্দ হাসি উচ্ছ্বাস আবার আর এক দিকে শোক কান্না। প্রতিদিন কত লঞ্চ, জাহাজ, বাস, কোচ, প্লেন ছেড়ে যায় আবার কত আসে কেও তার হিসেব জানে না। আমার বুকে একটু আশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে কত মানুষ আসছে, রোজগারের জন্য একটু ভাল থাকার জন্য। রাস্তার ফুটপাথে মানুষ গিজগিজ করে, কিন্তু আমি সবার মনের আশা পূরণ করতে পারছি না। রাস্তায় কত বাস চলে কিন্তু তবুও মানুষের ভিড় কমে না। এত মানুষ কেন আসে? মানুষের লোভ লালসা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, কেও আর অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। মানুষের অভিলাষ এত উঁচু কেন হলো?

চকচকে কর্পোরেট কালচার নামে বৈধ উপায়ে নির্লজ্জের মত লোক ঠকাবার, কর্মচারীদের ঠকাবার জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা আমদানি হয়েছে। শ্রমিক কর্মচারীদের ঠকিয়ে, এ ওকে ঠকিয়ে ফাকি দিয়ে মেরে কেটে কতজনে শত শত কোটি টাকা জমা করছে, টাকার পাহাড় বানাচ্ছে। ব্যাংকও সে টাকা রাখার জায়গা পায় না অথচ আমার বুকেই কত শিশুকে দেখি খাবার না পেয়ে আস্তা কুড়ে খাবার খুঁজছে। কতজনে ফ্রান্স থেকে পানি এনে পান করে আবার কতজন রাস্তার ফুটপাথে রাত কাটায়। এত টাকা দিয়ে কি করবে ওরা? এই উন্নয়নশীল দেশে এত চাকচিক্যের কি এমন প্রয়োজন আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিনে দিনে আমার দুর্নাম ছড়িয়ে যাচ্ছে! কি লজ্জা! আমি নাকি বিশ্বের সবচেয়ে নোংরা শহর! কিন্তু কারা আমাকে নোংরা করছে? আমাকে নোংরা করে তারা কেমন করে ভাল থাকছে?

যারা আইন রক্ষা করবে তারাই আজ আইনের তোয়াক্কা না করে জঘন্য অপরাধে, পাপ কাজে, অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়েছে। কেও তাদের বিচার করছে না। সবাই শুধু নিজের কথা, নিজের ক্ষমতা-লোভের কথা ভাবছে। আমার বুকে বসেই ওই পাঞ্জাবী ইয়াহিয়া খান বলেছিল আমি ইস্ট পাকিস্তানের মানুষ চাই না শুধু মাটি চাই। এখনও সেই রূপ দেখছি, যারা শাসন করছে তাদের এমন মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।
আসলে আমার কোন পরিবর্তন হয়নি আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি শুধু পাপের প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়েছে, পাপের পথ পরিবর্তন হয়েছে এবং পাপের ওজন ভারি হচ্ছে। মানুষের আমোদ প্রমোদের ধরণ বদলে গেছে। সেদিন দেখলাম কয়েকজন বন্ধু সারাদিন কাজ কর্ম সেরে রাতে ক্লাবে মিলিত হয়ে ইচ্ছে মত মদ পান করে সবাই যার যার গাড়ির চাবি টেবিলের উপরে রাখল এবং এক এক করে চোখ বন্ধ করে সামনে রাখা চাবি থেকে একটা চাবি তুলে নিল, যার হাতে যে চাবি আসল সে রাতের জন্য সে ওই গাড়ি যার তার বাড়িতে যেয়ে তার স্ত্রীর সাথে রাত কাঁটালো। এমন বিকৃত মানসিকতা এবং বিকৃত রুচি আমার বুকে আগে কখনও দেখিনি।

আমার ভীষণ ভয় করে! মাঝে মাঝে লজ্জায় ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমার বুকে নিরীহ সাধারণ মানুষ যারা বাস করে তাদের কি হবে ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেই। আমি আর পারছি না বিধাতা! আমাকে রক্ষা কর! আর কত পাপ আমাকে দেখতে হবে? হে বিধাতা তুমি কোথায়? আমাকে রক্ষা কর! মানুষের মনে শান্তি দাও!

শিম্পাঞ্জির দেশে

maxresdefault (1)
রাস্তার দুই পাশে যতদূর দৃষ্টি যায় লাইন ধরে সব সুন্দর সুন্দর বাড়ি ঘর, এলো মেলো ভাবে কোন বাড়ি নেই। অধিকাংশই সিরামিক ইটের রঙের মত দেয়াল, উপরে লাল টালির দোচালা ছাদ। প্রতিটা বাড়ির সামনে সুন্দর করে কাঠের জাফরি করা বেড়া আর তার ভিতরে চমৎকার সব ফুলের গাছে ফুল ফুটে আছে। রাসেল শুধু একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করল যে সব বাড়ি এক তলা, কোথাও কোন দোতলা বা এক তলার বেশি উঁচু কোন বাড়ি নেই। সব বাড়ির সুন্দর রঙ করা দরজা জানালা খোলা কিন্তু কোথাও কোন জন প্রাণীর সারা শব্দ নেই। প্রতিটা বাড়ির পিছনেই নানান ফল গাছে ফল ঝুলছে। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট সুন্দর ফুলের গাছে নানা রঙ বেরঙের ফুল ফুটে রয়েছে প্রজাপতি আর মৌমাছিরা উড়ে উড়ে এক ফুল থেকে আর এক ফুলের মধু নিচ্ছে। এমনি নির্জন ছিমছাম রাস্তায় একা একা হাটতে হাটতে গ্রাম ছেড়ে বেশ অনেক দূরে চলে এসেছে যেখানে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। শুরু হয়েছে নানা ফসল এবং শাক সবজির জমি। টমাটো, কলা, গম, ভুট্টা, গাজর, বিট, ফুল কফি, বাঁধা কফি, লেটুস এমনি নানা কিছু সহ অচেনা নানা ফসল বেশ ফলে রয়েছে কিন্তু এখানেও কোন জন প্রাণী নেই। যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে আর একটু একটু করে এগুচ্ছে। সামনে ডান পাশের ভুট্টা ক্ষেত ছাড়িয়ে যেতেই দেখল বেশ বড় সাইজের কয়েকটা কাল শিম্পাঞ্জি একটা টমাটো ক্ষেত থেকে ঝাঁকায় করে টমাটো তুলছে। একটু দূরে দূরে এমনি আরও অনেক শিম্পাঞ্জি বিভিন্ন ক্ষেতে কাজ করছে। রাসেল অবাক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল। এ কি দেখছি! নিজের চোখে দেখছে তবুও নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হলো। এও কি সম্ভব? কোন মানুষ নেই শুধু শিম্পাঞ্জি এই জমিতে কাজ করছে? অবাক হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। পা আর সরতে চাইছে না। একটু ভয়ও পেল।

এমনি সময় এক শিম্পাঞ্জি ঝাঁকা নিয়ে এপাশে ঘুরতেই রাসেলকে দেখল। ওকে দেখে ঝাঁকাটা নামিয়ে রেখে ওর কাছে এসে মানুষের মত জিজ্ঞেস করল
কি দেখছেন?
রাসেলের মুখ দিয়ে কথা আসছে না। দিশাহারা। কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায় মানুষ সমান লম্বা লেজ ওয়ালা একটা শিম্পাঞ্জি যদি এই ভাবে সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের মত কথা বলে তাহলে কে না অবাক হয়? ঝাঁকা নামিয়ে চার হাত পায়ে এদিকে এগিয়ে এসেছে কিন্তু এখন মানুষের মত দুই পায়ে দাঁড়ান।
শিম্পাঞ্জিটা এবার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
এতক্ষণে রাসেল সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, ভাল আছি কিন্তু…………
কিন্তু বলেই থেমে গেল। আর কিছু বলতে পারছে না।
তাই লক্ষ করে শিম্পাঞ্জিটা বলল
আপনি অবাক হয়েছেন তাই না? আমাদের দেখে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, এই তো?
হ্যাঁ তাই, কিন্তু………………
আবার থেমে গেল।
এর মধ্যে ওদের কথার শব্দ পেয়ে অন্য যারা কাজ করছিল তারা সবাই ফিরে দেখল কি হচ্ছে।
আরে সাহেব এটা আপনাদের মানুষের দেশ নয় এটা আমাদের শিম্পাঞ্জিদের দেশ। এখানে আমরাই বাস করি। আমাদের পূর্ব পুরুষ আপনাদের দেশেই ছিল কিন্তু আপনাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, না খেতে পেয়ে এই দেশে এসে বসতি করেছে। আমরা তাদের বংশধর। আমার নাম কিলা, ভয় পেয়েছেন?
আমতা আমতা করে বলল, না না ভয়ের কি!
না ভয় পাবেন না। আমরা জাতে শিম্পাঞ্জি হলেও আমরা আপনাদের চেয়ে অনেক সভ্য। চলেন আমার বাড়িতে চলেন দেখবেন আমরা কেমন সভ্য।
বাড়িতে যাব?
হ্যাঁ অতিথিকে কি আর রাস্তায় ফেলে চলে যাওয়া যায়? আপনি একটু অপেক্ষা করেন সন্ধ্যা হলেই দেখবেন সবাই কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরবে তখন আপনাকে নিয়ে যাব। ওদের দিকে ঘুরে বলল এই তোমরা কাজ কর অতিথির সাথে পরে আলাপ হবে।
বসেন এই ঘাসের উপরেই বসি।
বলেই শিম্পাঞ্জিটা রাসেলের হাত ধরে টেনে বসে পড়ল।

এবার বলুনতো এতক্ষণে আমাদের দেশ যতটা দেখলেন তাতে আপনার কাছে কেমন লাগল?
রাসেল এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়ে বলল
খুব ভাল লাগছে, এমন সুন্দর এলাকা আমি আগে কখনও দেখিনি।
হ্যাঁ, চলেন আমাদের বাড়ি চলেন ওখানে গেলে আরও ভাল লাগবে।
আচ্ছা আপনারা কি কি চাষ করেন?
আমরা বানরেরা যা খেতে পারি আমরা তাই চাষ করি, আমরাতো আর আপনাদের দেশে যেতে পারি না যে ওখান থেকে কিনে আনব তাই আমাদের প্রয়োজনীয় খাবার নিজেদেরই করে নিতে হয়। এইতো চার দিকে যা দেখছেন এই সবই করি, কখনও তরমুজ, চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, আখ তবে ধানের চাষ করি না আর দেখেছেনতো আমাদের বাড়িতে নানা ফলের গাছ আছে আমাদের এই এলাকায় সব রকমের ফল পাবেন কারণ আমরাতো ফল আর সবজি খাই তাই। মাঝে মাঝে কেও কেও গম আর ভুট্টার চাষ করে কারণ মাঝে মাঝে রুটি পরটা খেতে ইচ্ছা করেতো! আমরাতো আবার মাছ মাংস ডিম খাই না।
বেশ ভাল কথা!
আচ্ছা আপনার নামটা কিন্তু এখনও বলেননি!
ও হ্যাঁ আমার নাম রাসেল।
বাহ!, বেশ সুন্দর নাম!
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। যারা বিভিন্ন জমিতে কাজ করছিল তারা সবাই কাজ শেষে যার যার জিনিস পত্র গুটিয়ে আল ধরে বড় রাস্তায় চলে এলো। এবার যার যার বাড়িতে যাবে। কিলার শিম্পাঞ্জিরাও এসে রাস্তায় দাঁড়াল আর কিলা বলল, চল বাড়ি যাই। আসেন রাসেল সাহেব বাড়ি যাই। টমাটোর ঝাঁকা মাথায় করে ওরা কিলাকে অনুসরণ করছে, রাসেলও কিলার পাশে পাশে হাঁটছে। অল্প কিছুক্ষণ হেঁটেই আগের দেখা ওই আবাসিক এলাকায় এসে ডান দিকের একটা গলিতে ঢুকে বাম হাতের প্রথম বাড়িটাই কিলার।
ঘরে ঢুকে রাসেলকে বসার ঘরে বসতে বলে কিলা ভিতরে চলে গেল। সুন্দর সাজান গোছান ঘর তবে ঘরে কোন আসবাব নেই শুধু ভুট্টার পাতা দিয়ে বোনা পুরু সুন্দর গালিচা বিছান। ওতেই বসে পড়ল। একটু পরেই কিলা আর তার পিছনে কিলার স্ত্রী এবং দুই বাচ্চা আসল। কিলার স্ত্রীর হাতে ছোট ট্রেতে একটা বড় গ্লাসে শরবতের মত কি মনে হলো। রাসেলের দিকে বাড়িয়ে বলল নেন শরবত খান। কিলা পরিচয় করিয়ে দিল। এই আমার স্ত্রী যুঁই আর এরা আমার ভবিষ্যৎ তারা আর টুকি। এ হচ্ছে রাসেল। যুঁই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড সেক করে বলল
আপনি বসুন আমি আসছি।

রাসেল ভয়ে ভয়ে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে দেখল দারুণ শরবত। এক চুমুকেই শেষ করে ফেলল।
তাই দেখে কিলা বলল, আর একটু খাবেন?
না না অনেক খেয়েছি
একটু পরে যুঁই একটা সুন্দর নক্সা করা বড় ট্রেতে করে নানা রকম ফল কেটে সাজিয়ে এনে সামনে নামিয়ে রাখল। কিছু চেনা ফল আর বাকি সবই অচেনা। মাঝ খানে ট্রে রেখে চারদিকে গোল হয়ে বসে সবাই এক সাথে ফল খাচ্ছে আর আলাপ করছে। ভীষণ সুস্বাদু ফল।
তারপর বলুন রাসেল সাহেব আপনাদের দেশের কি অবস্থা?
এই চলছে আর কি, কোন ভাবে দিন চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশের কথা আর কি বলব আপনাদের এখানকার কথা বলেন শুনি আমার কাছে খুব ভাল লাগছে।
চলেন তাহলে আমার প্রতিবেশীদের সাথে আপনার আলাপ করিয়ে দেই
হ্যাঁ তাহলে ভালই হয়, চলেন
তারা আর টুকি দুইজনে লাফ দিয়ে বাবা মার কাঁধে উঠে বসল। কিলা আর যুঁই অতিথিকে সাথে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে রাস্তার পাশে আর এক বাড়িতে যেয়ে দেখে ওই বাড়ির সামনের বাগানে কয়েকজন শিম্পাঞ্জি বাঁশের চেয়ারে বসে গল্প করছে।
এই যে মিশা, টাকি, ইগু তোমরা দেখি এখানেই আছ, বেশ হয়েছে দেখ আমাদের এখানে নতুন অতিথি এসেছে তার সাথে আলাপ করিয়ে দেই। ওরা কিলার সাথে একজন মানুষ দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড সেক করে বসতে বলল।
কেমন আছেন অতিথি?
ভাল ভাল বেশ ভাল
আপনারা সবাই ভাল আছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ আমরাও খুব ভাল আছি, বলেন ভাই আমাদের দেশ কেমন লাগছে?
খুউব ভাল লাগছে। যতই দেখছি ততই ভাল লাগছে আর তার সাথে অবাক হচ্ছি। আসলে আপনাদের সম্পর্কে আমার আরও অনেক জানতে ইচ্ছে করছে, কিছু বলুন না ভাই

মিশা বলল কি আর বলব! আমাদের এখানে আপনাদের মত না। আমি ছোট বেলায় বাবার সাথে আপনাদের দেশে গিয়েছিলাম সেখানে ভয়ংকর অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। দেখেছেন আমাদের রাস্তা ঘাট কেমন? আমাদের বাড়ির আশে পাশে দেখেন কেমন সুন্দর সাজান গোছান। এমনকি পথে একটা কাগজের টুকরোও খুঁজে পাবেন না পলিথিনতো দূরের কথা। তারপরে আমাদের জমিগুলাও লক্ষ করেছেন, এখানে কেও কারো জমির আল কাটে না। আমাদের সব কিছুই নিয়মের মধ্যে থাকে কিছুই নিয়মের বাইরে যায় না। আমরা সবাই এই নিয়ম মেনে চলি। ছোটরা কেউ এদিক ওদিক করলে সাথে সাথে বাবা মা বা প্রতিবেশী যেই সামনে থাকে সেই দেখিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয়।
মিশা থামলে টাকি বলতে শুরু করল
এখানে কেউ কারো গায়ে হাত দেয় না, কেউ নিয়ম ভাঙ্গে না। মারামারি, কাটাকাটি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, খুন খারাবি, অন্যায় অবিচার, লুটপাট, চুরি ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ, ঘুষ দুর্নীতি এসব আমাদের এখানে কেও জানেই না।
বাহ! বেশ সুন্দর কথা! আরও বলুন
হ্যাঁ বলছি, আমরা প্রতিবেশীরা প্রতি সপ্তাহে এক এক দিন এক এক বাড়িতে পার্টি করি।
মানে, বুঝলাম না
এবারে ইগু বলল
মানে হলো প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল বারে আমরা কোন কাজ করি না সেদিন সবাই নিজের বাড়ি ঘর, বাগান, পাশের রাস্তা এগুলি পরিষ্কার করি। আগে থেকেই ঠিক করা থাকে কবে কার বাড়িতে এই পার্টি হবে সেদিন সন্ধ্যা হলে সবাই ওই বাড়িতে চলে যাই। সবার সাথে গল্প হয়, কার ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে এগুলি দেখে বিয়ে শাদীর জন্য পাত্র পাত্রী নির্বাচন করা হয়। তবে ছেলে মেয়েদের কারো কোন পছন্দ অপছন্দ থাকলে আমরা তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এলাকার সমস্যা নিয়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত হয় আনন্দ হয়, হৈ চৈ হয়, খাওয়া দাওয়া হয় তারপর আমরা সবাই এক সাথে সৃষ্টি কর্তার প্রার্থনা করি এবং প্রার্থনা শেষ করে রাত হলে আগামী মঙ্গল বারে কার বাড়িতে যাব সেটাও ওই সময় সবাইকে জানিয়ে দিয়ে যার যার বাড়ি ফিরে এসে ঘুমিয়ে পরি।
বাহ! দারুণ!
আমাদের আরও কিছু নিয়ম আছে
সেগুলি আবার কেমন?
আমাদের বাচ্চাদের স্কুলে কোন শিক্ষক নেই
তাহলে কে পড়ায়?
আমরা পালা করে বাচ্চাদের স্কুলে পড়াই, প্রতি মাসে একটা শিডিউল করে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয় সেই অনুযায়ী ক্লাসে চলে যাই। ওই যে দেখুন ওটাই আমাদের স্কুল। স্কুল থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আমাদের হাসপাতাল, বাজার এবং অনেক কিছু আছে। আজকে থাকুন কাল আমাদের ছুটির দিন সব দেখিয়ে আনব আবার বিকেলে আমাদের সাথে পার্টিতেও নিয়ে যাব কাল আমার বাড়িতে পার্টি হবে।
আপনার বাড়ি কোথায়?
ওই স্কুলের পাশে।

আচ্ছা, তখন দেখলাম সব বাড়ির দরজা জানালা খোলা কিন্তু কোন প্রাণী দেখলাম না এর মানে কি?
কিলা প্রচণ্ড অট্টহাসি হেসে বলল কি করে দেখবেন বলুন সবাই যে কাজে গিয়েছিল।
তা এই খোলা পথে যদি কেও ঢুকে পরে?
কে আসবে? বলল না এখানে কেও অমন কিছু জানেই না। আর তা ছাড়া আমাদেরতো আর আপনাদের মত রান্না করতে হয় না কাজেই বাড়ির মহিলারাও জমিতেই কাজ করে সাথে বাচ্চাদেরও নিয়ে যায় না হলে ওরা শিখবে কি করে?
আপনাদের এখানে কোর্ট কাচারি নেই? পুলিশ, সেনা বাহিনী?
মিশা বলল, আরে ভাই এতক্ষণ বললাম কি! আমাদের এখানে কেও কোন অপরাধই করে না কেও জানেই না অপরাধ কি, তো কোর্ট কাচারি থাকার দরকারটা কি? আর পুলিশ বা সেনাবাহিনীর কথা বলছেন, হ্যাঁ সেনাবাহিনী আছে তবে সেটা শুধু আমাদের দেশের নিরাপত্তার জন্য যাতে করে বাইরে থেকে কেও এসে কোন হাঙ্গামা করতে না পারে তবে আপনাদের মত কোন পুলিশ নেই। আমাদের সেনা বাহিনীর লোকেরা শুধু আমাদের দেশের সীমানা পাহারা দেয় ওদের আর কোন কাজ নেই।
বাহ! কি সুন্দর দেশ! রাসেল বলল ঈশ আমিও যদি আপনাদের মত শিম্পাঞ্জি হয়ে এই দেশে আসতে পারতাম!
এমন সময় রাসেল শুনল মা ডাকছে কিরে রাসেল অফিসে যাবি না? আর কত ঘুমাবি? এবার ওঠ!