৭১।
নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিসমিল্লা বলে টাকাটা পকেটে ভরে উপরে উঠে আসলেন। এসেই আবার নিঃসঙ্গ একা। টাকাটা পকেট থেকে বের করে দেখলো। টাকা নয় পাউন্ড, পাউন্ড স্টার্লিং। ব্রিটেনের রানীর মাথার ছবি আঁকা ব্রিটিশ পাউন্ড। বিশ্বের সবচেয়ে দামি নোট। যার এক পাউন্ডের মূল্য বর্তমানে বাংলাদেশের বিরানব্বই টাকা। হায়রে টাকা! তোমার জন্যে আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে, আমাকে আমার মা মনিদেরকে ছেড়ে আসতে হয়েছে, আমার মনিকে আমাকে এখানে একা রেখে দেশে ফিরে যেতে হয়েছে হাতে ধরে নোট গুলি বার বার নাড়া চাড়া করছেন। হায়রে অর্থ! তোমার মূল্য কত? মানুষের প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা এর চেয়ে কত বেশি, কত বেশি তোমার মূল্য?
সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ পেলেন। টাকা গুলি পকেটে রাখার আগেই কবির রুমে ঢুকে হাতে টাকা দেখে জিজ্ঞেস করলো-
-কি, টাকা দিছে?
-হ্যাঁ দিলো, এইতো।
-রেখে দেন, সাবধানে রাখবেন।
-সাবধান আর কি কোন লকার তো নেই।
-সাথে রাখবেন, সবসময় সাথে রাখবেন ভাববেন না এদেশে চোর নাই। এদেশেও চোর আছে পকেটমার ছিনতাইকারি আছে। আপনে একা একা থাকতে চান কেন? একা একা থাকবেন না। একা থাকলে মন খারাপ হবে, নানান রকম চিন্তা এসে মাথায় ঢুকবে, থাকতে পারবেন না। তাস খেলতে পারেন?
-জানি তবে একমাত্র ব্রিজ, তাও বেশীক্ষণ খেলতে পারি না মথা ঘুড়ে।
-আর কিছু পারেন না?
-না আর কিছু পারিনা। কেন আপনারা কি খেলেন?
-আমরা খেলি টুয়েন্টি নাইন।
-না আমি ওটা পারিনা।
-আপনার অফের কথা কিছু বলেছে?
-অফ মানে?
-অফ মানে ছুটি, যেদিন কাজ করবেন না।
-না তা কিছু বলেনি।
-বুঝেছি আপনার অফ দেলু ভাই এসে দিবে।
-দেলু ভাই কে?
-দেলু ভাই আমাদের কিচেনের সেফ এবং এই রেস্টুরেন্টের আর এক জন পার্টনার।
-ও আচ্ছা, ওনার নামও কি দেলোয়ার?
-হ্যাঁ আমরা দেলু ভাই বলি।
-কবির ভাই আপনি এখানে কতদিন যাবত আছেন?
-অনেক দিন প্রায় এক বৎসর।
-আমাকে একটু অফ সম্পর্কে বলেন তো!
-কি বলবো, সাধারণ ব্যাপার। রাতে ডিউটি শেষ হলেই আপনার অফ শুরু। আপনি ইচ্ছা করলে তখনই কোথাও যেতে পারেন। তারপর দিন সারা দিন ছুটি। যেখানে ইচ্ছা যাবেন, লন্ডন যান বারমিংহাম যান, অক্সফোর্ড যান যেখানে খুশি, তারপর দিন সন্ধ্যায় এসে ডিউটিতে হাজির হবেন। ব্যাস আর কি?
-আমার বাইরে যাবার জায়গা নেই তাহলে আমি কি করবো?
-কেন, অক্সফোর্ড যাবেন না হলে এই টাউনেই ঘোরাঘুরি করবেন। ভালো কথা, এখানে লাইবেরি আছে ওখানে যেতে পারবেন, কেনা কাটার দরকার হলে করবেন কাপর চোপর ধুবেন।
-আর খাওয়া দাওয়া?
-কেন সময়মতো এসে খেয়ে যাবেন।
-কেও কিছু বলবে না?
-আরে না, কে কি বলবে? সবাই তাই করে।
-হ্যাঁ আমার বন্ধু বলেছে লাইবেরিতে যেতে। ওটা কোথায়?
-আসেন দেখিয়ে দেই।
জানালার কাছে গিয়ে-
-এই যে রাস্তা এটা যেখানে শেষ হয়েছে ওখান থেকে বায়ে যাবেন একটু এগিয়েই দেখবেন বায়ে আবিংডন লাইবেরি, ডানে সমারফিল্ড সুপারস্টোর। ফল টল কিছু খাইতে চাইলে ওখান থেকে কিনবেন।
-আপনারা কাপর চোপর কোথায় কিভাবে ধুয়ে থাকেন?
-কেন বাথরুমে ইয়েলো বাকেট আছে না?
-মানে তাজমহল ডালডার বাকেট?
-হ্যাঁ ওতে কাপর ভিজিয়ে রাখবেন, সকালে উঠে গোসলের সময় ধুয়ে বাথরুমের পাশে যে রুম ওটার বাইরে একটা বারান্দার মত আছে ওখানে শুকাতে দিবেন তবে কাপর ভালো করে আটকাবেন নয়তো বাতাসে নিয়ে যাবে। রশিতে ক্লিপ আছে দেখবেন, হ্যাঙ্গারও আছে।
নুরু ভাইয়ের বেডের ওপাশে দেখে বললো –
-হ্যাঁ এইযে ইস্ত্রি আপনের রুমেই আছে চাইলে কাপর ইস্ত্রি করে নিবেন। আপনের কিছু ধুইতে হলে পাউডার আছে? না থাকলে আমার আছে নিয়ে নিবেন।
-না এখন ধুতে হবে না আর পাউডার নেই কিনতে হবে।
-দেখেন কবে অফ দেয় সে দিন বাইরে যাবেন।
-আর একটা কথা, আমি যে বাইরে যাব ফেরার সময় চাবির কি ব্যবস্থা?
-সবই আছে কাল দেখিয়ে দিব। আজও কি আগেই সেহেরি খাবেন?
-হ্যাঁ তাহলে যান আপনের সেহেরি খাবার সময় হয়ে গেছে।
-যাক ভাই আপনার সাথে কথা বলে সময়টা ভালোই কাটল।
-হ্যাঁ তাইতো বলি একা থাকবেন না একা থাকলেই বিপদ।
-হ্যাঁ কবির ভাই, ঠিকই বলেছেন। চলেন সেহেরি খেয়ে আসি।
-আমাদের সাথে খান আমরা সালাদ বানাই খেতে পারবেন।
-আসলে ভাই আমার একটু আগে সেহেরি খাবার অভ্যাস তাই আর কি।
-ঠিক আছে যার যাতে সুবিধা খান আপনার যেভাবে সুবিধা, জানেন তো কোথায় কি থাকে ইচ্ছা হলে সালাদ বানিয়ে নিতে পারেন। তারপর রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকতে ডান পাশে সেলফ দেখেছেন ওতে আচার আছে খেতে পারেন। যা খাইতে ইচ্ছা হয় এখানে যা আছে খাবেন কেও কিছু বলবে না।
মোঃ খালিদ উমর এর সকল পোস্ট
নক্ষত্রে গোধূলি-৫২/২৫০
৭০।
মনে আর কত থাকবে? তুমি তো জান না মারুফ আমার মনে কত বোঝা বয়ে বেড়াই। এতো বোঝা মাথায় রেখে আর কত মনে রাখা যায়? এই যে কথায় কথায় ভুলে যাই আমি এমন ছিলাম না। আমার মা বাজার থেকে কখনো কিছু আনার কথা বললে সে কথা আমার এক মাস পরেও মনে থাকতো। বাজার থেকে নিয়ে আসতাম মা বলতেন বাব্বাহ! সেই কবে বলেছিলাম এখনও মনে রেখেছিস কিন্তু এই দিন তো সেই দিন নয়। এখান থেকে শুনছি আর ওখানে যাবার আগেই ভুলে যাচ্ছি। এজন্যে যে কত বিড়ম্বনা হচ্ছে তা কাকে বলি? মাংস রান্না হয়ে গেছে। এই ফাঁকে কিচেন ব্রাশ করা হয়েছে। মারুফকে দেখল ইফতারের জন্যে কাবলি ছোলা ভুনতে। সাড়ে চারশো গ্রামের ছোট টিনের মধ্যে সেদ্ধ কাবলি ছোলা এখানে যার নাম চিক পিজ। ফ্রাই প্যানে তেল পিঁয়াজ মশলা গরম করে তার মধ্যে দুইটা টিনের মুখ খুলে পানি ফেলে দিয়ে ছোলা ছেড়ে দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করেই ছোলা ভুনা। মারুফ জিগ্যেস করেছিলো-
-ইফতারির জন্যে আর কিছু বানাবেন? আপনি খিচুরি খান না।
-না আমি পারিই বা কি আর বানাবোই বা কি যা আছে এতেই চলবে। আচ্ছা এখানে তো বেসন আছে দেখলাম আপনারা অনিওন ভাজি বানান তা ওরকম করে কিছু পাকোরা বানানো যায় না?
-হ্যাঁ যাবে না কেন বানান সব কিছুই আছে যা লাগে নিয়ে নেন বানান নিজেও খান আমরাও খাই।
-ঠিক আছে তবে আজ না কাল বানাবো কিন্তু কথা হলো আমার কোন আন্দাজ অনুমান নেই আমাকে লবণ দিয়ে দিবেন।
-আচ্ছা আচ্ছা তা দেয়া যাবে। বেশ কালই বানাবেন।
এখনকার মত কাজ শেষ। এপ্রণটা খুলে তিন লিটারের একটা দুধের বোতল খালি হয়েছিলো সেটা রেখে দিয়েছিলো ওটা ভরে পানি নিয়ে উপরে চলে গেলো।
আজ রাতে তেমন ভারি কিছু মনে হলো না। গত দুই দিনের তুলনায় এ যেন কিছুই না। অনেক হালকা, বেশ নীরবে চলেছে সব কিছু। কোন হাঙ্গামা নেই, ভুল ভ্রান্তি নেই। হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই নেই। এর মধ্যে মালিকরা এসে গল্প করেছে অনেকক্ষণ। দেশের কি অবস্থা, রাজনীতির অবস্থা কেমন, লোকজন কেমন আছে এখানে কেমন লাগছে এইসব। এরকম হলে চলে কিন্তু তাই কি আর হয়? এভাবে চললে মালিকের ব্যবসা হবে কি করে? এইযে এতো গুলো মানুষের বেতন দেয়া, মালিকরা তিন জন, বাইরের ছয় জন এদের বেতন, ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল, কাউন্সিল ট্যাক্স কত কি! নাহ তবুও এভাবে এই কাজ করা যাবে না সামনে যেতেই হবে। ডিউটি শেষ হয়ে আসছে এমন সময় আনোয়ার এসে বললো-
-ভাইছাব আপনার ফোন, যান উপরে যেয়ে ধরেন।
উপরে উঠে ফোন ধরতেই কাজলের কণ্ঠ-
-কে, মামা?
-হ্যাঁ মামা, তা কি মনে করে, নম্বর কোথায় পেলে?
-কেন ফিরোজ মামার থেকে নিয়েছি।
-ও আচ্ছা, বল কি খবর!
-না এমনিই, মামা বললো আপনার খোঁজ খবর কি কোথায় গেলেন কি করছেন জানার জন্যে তাই ফোন করলাম।
-ঠিক আছে, এইতো আসলাম। আজ মাত্র তিন দিন, এর মধ্যে গত দুই দিনের অবস্থা দেখে ভাবছিলাম এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। তা আজ একটু সহজ মনে হচ্ছে।
-মামা আসল কথা হলো প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে তবে আপনি সামনে কাজ পেলেন না?
-না পাইনি।
-ঠিক আছে করতে থাকেন দেখা যাক আর কখন কোথায় থাকেন ঠিকানাটা অন্তত ফোন নম্বরটা জানাবেন। তাহলে রাখি মামা পরে আবার ফোন করব।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-ওহ ভালো কথা! কখনো দরকার হলে রাস্তার মোরে মোরে দেখবেন ফোন বক্স আছে সেখান থেকে ফোন করবেন বিশ পেনি লাগে।
-আচ্ছা।
নিচে আসতেই সবাই এক সাথে বললো-
-আপনে না বলেছেন আপনার কেও নেই তাহলে এতো ফোন করে কে?
-না এমনিই পরিচিত চেনা মানুষ।
কাজ কর্ম শেষ করে উপরে আসবে এমন সময় ওসমান দৌড়ে এসে বললো-
-ভাইছাব একটু দাঁড়ান এই যে নেন এটা রাখেন।
-কি এটা?
-আপনে কাজ করলেন এই তিন দিনের পয়সা।
-ও, মানে কি আমার কাজ ঠিক হচ্ছেনা তাই বিদায়?
-আরে না না বিদায় কেন এটা আমাদের নিয়ম আমরা প্রতি রবিবারে যার যার বেতন দিয়ে দেই। এখানে আপনার সাথে জব সেন্টারে যে ভাবে কথা হয়েছিলো সেই হিসাবে তিন দিনের পয়সা আছে।
-ও তাই? তাহলে দেন।
নক্ষত্রে গোধূলি-৫১
৬৯।
নিচে চেঁচামেচির শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালো। লোকজন উঠছে। বারোটা বাজার দশ মিনিট বাকি। কাজের পোষাক পরে নিচে নেমে এলো। কিচেনের লাইট জ্বালিয়ে গত দুই দিনের অভিজ্ঞতায় যা যা করতে হবে তা করতে করতে কবির নেমে এলো।
-ভাইছাব ঐ মাঝারি ডেকচিটায় চার পট চাউল আনেন।
-আচ্ছা আনছি, এই যে চাউল।
-এবারে এই তাজমহল মার্কা ডালডার বাকেট থেকে এই চামচ দিয়ে সাত আট চামচ ডালডা নেন। লবণ, গরম মশলা দেন, তেজপাতা দেন। এবারে আঙ্গুলের কড় দেখিয়ে বললো এই পরিমাণ পানি দেন।
-আচ্ছা দিলাম।
-এবারে ঢাকনা দিয়ে এই চুলায় বসিয়ে দেন। আজকের পোলাও আপনেই রান্না করলেন। এবারে লক্ষ রাখবেন চালটা ফুটে উঠলেই এই যে ওভেন এইটা জালিয়ে দেন, হ্যাঁ এটা গরম হোক। এইখানে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিবেন দশ থেকে পনের মিনিট। ব্যাস পোলাও শেষ। এরপর ওভেন থেকে বের করে নামিয়ে এইখানে রাখবেন। আজ বেশি কাজ নেই যা আছে ধীরে সুস্থে করা যাবে চিন্তা নাই।
বলে সে নিজেই বাইরে বের হয়ে গেলো বাইরের স্টোরের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে আদা রসুন নিয়ে ফিরে এলো।
-এবারে ঐ কেটলিতে এক কেটলি পানি গরম দেন। পানি গরম হলে এই রসুনগুলি এই বাকেটে ভিজিয়ে দিবেন। গরম পানিতে রসুনের খোসা ছাড়াতে সুবিধা। এবারে বসে বসে ছুরি দিয়ে আদা গুলি ছিলে এই বাকেটে রাখেন।
দুইজনের আদা রসুন ছেলা হলে একটা ব্লেন্ডার বের করে এনে বললো-
-এবারে এইগুলি পেস্ট বানিয়ে এইরকম কন্টেইনারে রাখবেন। তারপরে ব্লেন্ডারটা ধুয়ে পানি ঝরিয়ে ওখানে রেখে দিবেন। কিচেন ছেড়ে যাবার আগে ঐ যে কুরুনি ওটা দিয়ে পোলাওগুলি এই যে এই ভাবে কুরিয়ে রেখে যাবেন। কুরিয়ে রাখলে পোলাও ঝরঝরে থাকে, দেখবেন সারাদিন লাগাবেন না। দুপুর দুইটার মধ্যে সব শেষ করবেন।
এর মধ্যে মারুফ এলে তাকে বললো-
-আজকে ভাইছাবকে দিয়ে পোলাও রান্না করিয়েছি।
-বাহ! এইতো দেখলেন তিন দিনেই আপনি কুক হয়ে গেছেন। রাতে কি খাবেন বের করেছেন?
-না ভুলে গেছি।
-ঠিক আছে এবারে নিয়ে আসেন।
-সেহেরিরটা?
-হ্যাঁ ওটাও আনেন।
এক প্যাকেট ল্যাম্ব আর এক প্যাকেট মাছ এনে ভিজিয়ে রাখলেন।
মারুফ বললো –
-ভাইছাব আজকের ল্যাম্বটা আপনে রান্না করেন আমি বলে দেই।
-বলেন।
-একটু পরে বলি মাংসের বরফ গলতে দেন আগে।
আজকে বেশ নিরিবিলি মনে হলো, কোন তারা হুড়ো নেই। হাঁক ডাক নেই, সবার মন একটু ভিন্ন রকমের। বেশ গল্পে গল্পে চলছে কাজ কর্ম। প্রায় একটার দিকে মারুফ বললো-
-ভাইছাব এবারে মাংস ধুয়ে একটু পানি দিয়ে সেদ্ধ দেন এখানকার মাংস আমাদের দেশের মত না। এগুলি আগে সেদ্ধ করে রান্না করতে হয়।
একটু সেদ্ধ হলে মশলা দেখিয়ে বললো-
-চামচ নেন, এখান থেকে আমি যেমনে বলি তেমন পরিমাণ মশলা দেন, পিঁয়াজ নেন ওখান থেকে গরম মশলা তেজপাতা এগুলি দিয়ে এই চুলায় বসিয়ে দেন। সবসময় এই চুলাটা ব্যাবহার করবেন এটা ছোটতো তাই।
-আচ্ছা মারুফ ভাই, আপনারা জায়ফল জৈত্রি ব্যাবহার করেন না?
-না আমরা এখানে এগুলি করি না তবে আমি জানি ঢাকাইয়ারা মাংসে জায়ফল জৈত্রি দেয়। আচ্ছা যা যা বললাম তা মনে থাকবে?
-হ্যাঁ থাকতে পারে।
নক্ষত্রে গোধূলি-৫০
৬৮।
সকালে সাড়ে দশটার দিকে ঘুম ভাংল, তারপরেও কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন। ভাল ঘুম হয়েছে কিন্তু তবুও কেন যেন মাথা ঝিম ঝিম করছে। উঠে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে ভাবছিলেন কি করবেন তারতো কোথাও যাবার জায়গা নেই। সবাই ঘুমে, এক জানালা ছাড়া আর কোথায় যাবেন? পিছনে একটু হাঁটা যায় কিন্তু ভীষণ ঠাণ্ডা। জানালার পাশে এসেই দাঁড়ালেন। চেয়ারটা এনে কি বসা যায়? চেয়ার টেনে এনে বসলেন, না দাঁড়ানই ভাল বসলে কিছু দেখা যায়না। কীইবা আর দেখবেন দুই এক জন যাতায়াত করছে মাঝেমাঝে গাড়ি আর খোলা আকাশ আর কিচ্ছু নেই। প্রথম দিনের দেখা দোকান গুলিতে কোন মানুষ ঢুকতে বা বের হতে দেখা গেল না এখনও। এগুলি কি বন্ধ নাকি? মানুষই দেখা যায়না তা আর দোকানে আসবে কে? বাইরে বের হতে পারলে আশে পাশে একটু ঘুরে দেখা যেত, কিন্তু বাইরে বের হলে ঢুকবে কিভাবে? চাবির ব্যাপার আছে, থাক পরে সব কিছু জেনে শুনে তখন বেরুনো যাবে। পাবটার গেটের সামনে তাকাল, বন্ধ। অবশ্য এদেশের সব দরজাই শীতের জন্যে বন্ধ থাকে। দরজার সামনে ওপেন/ক্লোজ সাইন দেখে বুঝতে হয় দোকান খোলা না বন্ধ। এখন বন্ধ তাহলে খুলবে কখন? হয়তো সন্ধ্যায় যখন উল্লাস করার জন্য সবাই ছুটে আসবে। আজ রবিবার, আজতো ছুটির দিন শহর বন্ধ থাকার কথা। হ্যাঁ মনে পরেছে এই জন্যেই রাস্তায় মনুষ্য নেই।
খুকু কি করছে, মাঝু কি কলেজে গিয়েছিলো, আর যূথী? যূথীটা যে কেমন শুধু ক্লাস কামাই করার চিন্তা! কবে যে ও বড় হবে? হোক আস্তে আস্তেই হোক। ওর ছোট চাচাও এই রকম ছিলো। মনি কি করছে এখন? এখন দেশে বিকেল পাঁচটা বাজে, হয়তো বিকেলের চা নাস্তা বানাচ্ছে, নিয়ে ছাদে যাবে নয়তো নামাজ পড়ছে। সামনের দোকানের সারির ছাদের চূড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রাশেদ সাহেব। যেন মনিকে, যূথীকে, মাঝুকে, খুকুকে সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে ওখানে। নীচে কোথায় যেন টেলিফোনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকক্ষণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ রেস্টুরেন্টের ভিতরেই বাজছে। ওরা কি রেস্টুরেন্টের সময়সূচী জানে না নাকি মনে করেছে সারা দিন রাত খোলা থাকে? রেস্টুরেন্ট এখন বন্ধ কে ধরবে? কত কি মনে আসছে যাচ্ছে কোনটাই স্থায়ী হচ্ছে না। এলো মেলো হালকা মেঘের মত এখান থেকে ওখানে কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছে! আসার আগে ঈদের জন্যে কিছু কেনাকাটা করে দিয়ে আসেনি। মেয়েরা তা মেনে নিয়েছে কিচ্ছু বলেনি। সবারই এক কথা তুমি আগে ঠিক হও তখন দেখা যাবে। ঈদের দিন নতুন কাপর না পরলে কি হয়? যারা সারা বৎসরে একটা কাপর পায়না তাদের দিন যায়না? আমাদের কিছু লাগবে না। আমার লক্ষ্মী সোনা মনি বলে তিন মেয়েকেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চোখ ভিজে গিয়েছিলো। ছোট মেয়ে যূথী হাত ছাড়িয়ে বলেছিলো আব্বু আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি। মাঝু আর খুকু বললো তুমি এতো চিন্তা করবেনাতো আব্বু। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মনিকে বলেছিলো তুমি কি যেয়ে ঈদে মেয়েদের কিছু কিনে দিতে পারবে? না আমার মনে হয় তার দরকার হবে না। তার চেয়ে টাকাটা থাকলে কখন কি হয় কাজে লাগতে পারে। ঠিক আছে যা ভাল মনে কর তাই করবে। সংসারের হিসাব নিকাশ সবসময় মনিই দেখে আসছে। রাশেদ সাহেবের মাথায় এগুলি ভালো কাজ করেনা।
নক্ষত্রে গোধূলি-৪৯
৬৭।
শুয়ে শুয়ে সারাদিনের ছবি ভাবতে চাইলেন। না, ভেবে আর কি হবে? এই ভাবেই যখন চলবে চলুক না! কি আছে ভাবার? তার চেয়ে মেনে নেয়াই ভালো। মেনে নিতে না পারলে কষ্ট আরও বাড়বে। মনের মধ্যে কোথায় যেন এই মেনে নেয়াতে একটু দ্বিধা লাগছে। কিন্তু কেন? এতো পরিশ্রম কি পারবো? টিকে থাকতে হবে! এই করে যদি নিজেই শেষ হয়ে যাই তাহলে চলবে কি করে? ডায়াবেটিসটাই তো দিলো আমাকে শেষ করে। মাথা ব্যথা হলে ওষুধ খেয়ে ব্যথা সারাতে হয়, মাথা কেটে আর ব্যথা সারান যায় না। তা হলে কি করা যায়? মারুফ বলেছিলো সামনের কাজ খুঁজে দেখতে, কিন্তু আমি কিভাবে খুঁজবো কাকে চিনি আমি? দেখা যাক কয়েকদিন। শুক্র শনিবার গেলো। সামনের কয়েকটা দিন দেখি কেমন। হাত দু’টার দিকে চোখ পড়ল, সব গুলি আঙ্গুল কাটা কাটিতে ভরা, কয়েকটা নখ ভেঙ্গে গেছে, আঙ্গুল গুলি কালো দাগে ভরা দেখে তাকিয়ে রইলো। রাশেদ সাহেব তুমি কি পারবে এভাবে? গ্রেভির ডেকচি, রাইসের ডেকচি নাড়া চারা করতে হচ্ছে। আজকেই কোমরে টান লেগেছিলো কখন কি হবে বলা যায়? মানুষ কি সবসময় সাবধানে চলতে পারে? ভাল হবে তুমি সামনে কাজের চেষ্টা কর। বুঝলাম, কিন্তু—, আবার ঐ কিন্তু। আচ্ছা দেখিনা কয়েকদিন। দাঁড়াবার জায়গা যখন হয়েছে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাও একটা হবে। কয়েক দিন একটু মেনে নিতেই হবে, উপায় নেই। এখানে আমার কে আছে এমন কেও নেই যে আমাকে সব কিছু করে দিবে। আমিও কিছু জানি না চিনি না একেবারে নতুন, কিছুদিনের অপেক্ষায় থাকতেই হবে। সময়ই বলে দিবে কখন কি করতে হবে। ঘড়িতে পৌনে দুইটা বেজে গেছে। না আর না এবার উঠতে হয়। উঠে নিচে যেয়ে দেখে আলু দিয়ে রুই মাছ রান্না হয়েছে তাই দিয়ে সেহেরি খেয়ে এসে ওষুধ খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কাত হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে একা একা মনে মনে কথা বলছিলেন।
নুরুল ইসলাম এসে বললো -চলেন ভাই সাহেব খেয়ে আসি।
-আমি এইমাত্র খেয়ে আসলাম, রাতে ভাত খাইনি তাই একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নিলাম আপনি যান।
নুরুল ইসলামের সাথে এখনও আলাপ হয়নি। আস্তে আস্তে আলাপটা করে নিতে হবে এক রুমে থাকি দরকার আছে।
-আচ্ছা ভাই এ রুমে হিটার নেই?
-জানি না, আমিও নতুন এসেছি।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ।
-কবে?
-এইতো গত মাসের মাঝামাঝি মানে তিন সপ্তাহ চলছে।
-ও আচ্ছা। তাহলে কি করা যায়? ঠাণ্ডা লাগে একটু একটু শেষ রাতের দিকে। আপনার লাগে না?
-হ্যাঁ লাগে দেখি সেফ এলে বলতে হবে।
-কেন সেফ কেন আপনার সামনেও তো দুইজন মালিক আছে।
-তা থাকলে কি হবে ওরা এসব গুরুত্ব দেয়না। যাই আমি খেয়ে আসি।
-হ্যাঁ আসেন এসে যদি দেখেন আমি ঘুমিয়ে পরেছি তাহলে—
-না না ডাকব না, বুঝেছি ঘুমান আপনে। লাইট নিভিয়ে দিবো?
-হ্যাঁ ভালোই হবে।
হাতের সিগারেট শেষ করে নিভিয়ে ফেললেন।
নক্ষত্রে গোধূলি-৪৮
৬৬।
গতরাতের মত আজও প্রায় সাড়ে এগারোটার পরে আনোয়ার এসে হাঁক দিল মারুফ আটাও আটাও শেষ কর। এবার শুরু হলো গুছানোর পালা। ফ্রিজ থেকে যা যা বের করেছিলো সেগুলি যা রয়েছে তা ছোট ছোট আইসক্রিমের বাক্সের মত কন্টেইনারে ঢেলে বড় ট্রেগুলি সব সিংকে জমা হচ্ছে। ওদিক থেকে কাস্টমারের প্লেট পেয়ালা খালি ডিশ ইত্যাদি জমে পাহাড়ের মত হয়ে গেছে তবুও মাঝে দুইবার বেশ কিছু ধুয়ে দিয়েছে। চামচ, কাটা চামচ, টেবিল ছুরি এগুলিকে বলে সিলভার। সিলভারগুলি পাশে নিচে একটা বালতিতে জমা করে রাখে। সিলভারও এক বালতি ভরে পরি পরি ভাব। মাঝে একবার অর্ধ্বেক বালতির কিছু কম ধুয়ে দিয়েছিলো ওগুলি আবার এখান থেকে ধুয়ে বালতিতে একটু লিকুইড সাবান দিয়ে গরম পানি সহ দিয়ে দেয়। সামনের লোকজন ন্যাপকিন দিয়ে মুছে নেয়। হাতের দিকে দেখে হাত কাল হয়ে গেছে, কত যে কেটেছে তার হিসাব নেই। বেশি বড় না তবে যন্ত্রণাদায়ক। নুরুল ইসলাম ড্রিঙ্কস এনে দেখিয়ে দিল এটা ডায়েট। রাশেদ সাহেব তুলে নিলেন। এক পেয়ালা রাইস নিয়ে একটা চামচ নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে ওমনি কবির বললো-
-ভাইছাব একটু পোলাও রাইস গরম করে দেন কুইক।
পেয়ালা রেখে তাকে যোগান দিলেন। কবির বললো –
-আপনে এভাবে খেতে পারবেন না। পাশে রাখেন, চামচ দিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শেষ করবেন। নিশ্চিন্তায় বসে খাবার মত এতো সময় কোথায়?
গতরাতের মতই কবির সাহায্য করছে।
ধোয়া টোয়ার কাজ শেষ। দুইটা বড় বিন ব্যাগ ড্রাম সহ দুইজনে ধরে বাইরে কাউন্সিলের বিন কন্টেইনারে ফেলে এসে দেখে সবার কাজ প্রায় শেষ। আগেই মপের বালতি চুলায় দিয়ে গিয়েছিলো। পানি গরম হয়ে গেছে এবারে ব্লিচ, সাবান আর সুগন্ধি মিশিয়ে ফ্লোর মুছে বালতির পানি বাইরে ফেলে ব্রাশটা যায়গা মত রেখে এসে দেখে সবাই খাচ্ছে।
-আসেন ভাই খেয়ে নেন।
ঘড়ি দেখে একটু চিন্তা করে বললো-
-না আপনারা খান আমি এখন কিছু খাবো না, দুইটার দিকে একেবারে সেহেরি খেয়ে শুয়ে পরবো।
-আরে কি বলেন শরীর খারাপ হবে!
-না তখন যে রাইস খেলাম ওতেই হবে আপনারা খেয়ে নেন আমি উপরে নামাজ পড়ে নিই।
-ঠিক আছে যান রেস্ট করেন।
-আচ্ছা কাল সকালে বারোটায় নামতে হবে তাইনা?
-হ্যাঁ কাল বারোটায় নামলেই হবে।
-তাহলে আমি আসি।
রাশেদ সাহেব উপরে চলে গেলেন। কাপর বদলে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে উঠে গোসল করে এসে নামাজ পড়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালেন। গত রাতের মত একই দৃশ্য। আজ যেটা নতুন লক্ষ্য করলেন তা হলো মহিলাদের পরনের স্বল্প বসন। গরম পোষাক নেইই সাধারণ কাপর যা আছে তাও খুবই সংক্ষিপ্ত। এই শীতের মধ্যে এই কাপর পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে? অথচ দিব্বি কথা বলছে হাসছে। হাতে প্রায় সবারই একটা করে গ্লাস যাতে রঙ্গিন পানীয়, এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ও হ্যাঁ, পাবে এসেছে আগুন পান করার জন্য! তারপর নাচানাচি। ঠাণ্ডা লাগবে কোথা দিয়ে? পেটে আগুন ভরছে, এখনও হাতে আগুনের গ্লাস। আমাদের দেশে এইরকম সময়ে এই রকম জায়গায় এই বেশে কোন মহিলাকে ভাবাই যায়না! সভ্যতা, এই হলো সভ্যতা! হাতের সিগারেট শেষ হতেই বিছানায় এলিয়ে পরলেন।
নক্ষত্রে গোধূলি-৪৭
৬৫।
এসে কি করতে হবে সব ভুলে গেছেন। মনের যে অবস্থা আর এইমাত্র যে খুকুর দেয়া পেয়ালা রেখে এসেছেন তাতে আর কীইবা মনে থাকবে? সমস্ত কিচেনে ঘুরঘুর করতে লাগলেন কি করি, কি করি? আচ্ছা অন্তত ইফতারের ঝামেলা গুলি ধুয়ে রাখি এর মধ্যে কবির এলে ওর কাছে জানা যাবে কি করতে হবে। একটু পরেই কবির নেমে এলো।
-সালামালেকুম কবির ভাই, আসেন আসেন কি খবর?
-আরে আপনে এগুলি কি করেন ফ্রিজ থেকে মাল বার করেন!
-হ্যাঁ ভাই আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম কি করতে হবে তাই এইটা করছিলাম।
-ও বুঝছি আসেন আমার সাথে।
দুইজনে মিলে সব মালামাল বের করে যা যা করতে হবে সব গুছিয়ে একেবারে রেডি। মিনিট দশেকের মধ্যেই অর্ডার আসতে শুরু হয়েছে। প্রথম অর্ডার নিয়ে এলো আসাদ। আজকের অর্ডার একটু তাড়াতাড়ি এলো। একের পর এক টেক এওয়ের অর্ডার আসছে আর মারুফের ফ্রাই প্যান, চামচের ঠং ঠং শব্দ, কুকের চিৎকার, কবিরের দৌড়া দৌড়ী, রাশেদ সাহেবের প্যাকেটের গায়ে কারির নাম লেখা, বিল দেখে ব্যাগে ভরা আবার সাথে সাথে মারুফের প্যান ধুয়ে দেয়া, কুককে পোলাও রাইস গরম করে দেয়া, তন্দুরি সেফের নান বানানোর শব্দ। নানের শিক উঠানো নামানোর শব্দ, একটা কিমা নান, একটা পেশোয়ারি নান, দুইটা নানের হাঁক ডাক সব কিছু গতকালের ব্যস্ততাকে ছাড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে ঘটনা একটা ঘটে গেলো। ভিতরে চার জনের এক টেবিলের অর্ডারের কারি রাশেদ সাহেব প্যাকেটে ভরে ফেলেছে এখন আসাদ এসে ওই কারি খুঁজে পাচ্ছেনা। মারুফ বললো-
-আমি বানিয়ে সব ডিশে ভরে হট বক্সে রাখতে বলেছি। ভাই সাহেব, ওই যে দিলাম ওটা কি করলেন?
-আমিতো প্যাকেটে ভরে ফেলেছি।
-ইইশ কি করেছেন কি?
-শিগগির বের করেন আবার যেমন ছিলো তেমন করে ডিশে ঢালেন, না না থাক এটা আর দেয়া যাবেনা আমি আবার বানিয়ে দিচ্ছি। এর পর একটু দেখে ভরবেন। নতুন মানুষ নিয়ে কাজ করার কি যে ঝামেলা!
রাশেদ সাহেব মারুফকে বললেন-
-ভাই এই ডেকচিতে কিন্তু সাদা রাইস আর নেই।
-আরে বলেন কি? এই কবির শিগগির সাদা রাইস চড়াও।
-ভাইছাব চার পট রাইস ধুয়ে দেন তাড়াতাড়ি।
এই ভাবে ভুল ঠিক, এলোমেলো, বকাঝকা, গালাগালি, তারা হুড়ো, গুঁতো গাঁতি, চিৎকার, হইচই, চেঁচামেচি সব কিছু মিলিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটু হালকা হবার পর আসাদ গতকালের মত ট্রে করে চারটা গ্লাসে অরেঞ্জ জুস আর কোক এনে সবার সামনে ধরল। যার যা খুশি তুলে নিয়ে এক চুমুকে শেষ। এর মধ্যে একটু পানি খাবার সময় কেও পায়নি। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়নি তবে একটু ভিড় কমেছে। তবুও একটু শান্ত পরিবেশ। টেক এওয়ের ভিড়ও কমেছে। এবারে যারা ভিতরে বসে খাচ্ছে তাদের ভিড়। এগুলি মোটামুটি সামাল দেয়া যায়। এখন একটু ধীর গতিতে চলছে। তারপরও কম না, রোজা রাখা শরীর তো এমনিতেই কাহিল তারপর ইফতার আর কি হয় মাঝে একটু পানি খাবার মত সুযোগও পাওয়া যায়না তারপরে নতুন মানুষ। এবার কবিরের একটা মাশরুম রাইসের অর্ডারের সাথে কবির স্টাফের জন্যেও কিছু বানিয়ে কয়েকটা পেয়ালায় রেখে বললো-
-ভাইছাব এই কড়াইটা ধুয়ে দেন তারপরে এই যে এখান থেকে একটা নিয়ে খান।
আসাদ এলো মাশরুম রাইস নেয়ার জন্যে। তখন তাকে বললো-
-ভাই একটু ডায়েট কোক দেয়া যাবে?
-আচ্ছা দিব আর কেও কিছু খাবেন?
-আমাকে একটা, আমাকে অরেঞ্জ, আমাকে পাইন এপল।
-আচ্ছা আনছি, এই টেবিলটা সার্ভ করে নেই।
নক্ষত্রে গোধূলি-৪৬
৬৪।
আবার নিচে এসে চা পর্ব সেরে উপরে এসে এবারে একটা সিগারেট বানিয়ে বিছানায় কাত হলেন।
মেয়েরা কি করছে? নিশ্চয়ই বাবার কথা মনে করছে। মনি আজ কি ইফতার বানিয়েছিলো? নাকি মনিকে আজ মেয়েরা রান্না ঘড়ে ঢুকতে দেয়নি? এতো লম্বা জার্নি করে গেছে। ধকল তো কম না। তাহলে কে ইফতার বানিয়েছে? হয়তো রেখা নয়তো খুকু। মাঝু কি বাবার জন্যে প্লেট সাজিয়েছিলো? না না তা সাজাবে কেন? বাবা নেই সে কথা কি আর মাঝু জানে না? তবে মনে করেছিলো নিশ্চয়। অভ্যস্ত চোখটা বাবাকে খুঁজেছে ইফতারের টেবিলে। বাবা নেই কেমন লাগছিলো তখন মেয়েদের? ইফতারের প্লেটটা বাবার জন্যে মাঝুই সাজাত। বাবা যা পছন্দ করে মা বলে দিতে দিতে কখন যে ওদের তা মুখস্থ হয়ে গেছে তা কি ওরা জানে? তবুও মা মনে করিয়ে দিতেন মাঝু তোমার বাবার প্লেটে পিঁয়াজু কোনটা দিয়েছ? রাশেদ সাহেব কড়া ভাজা পিঁয়াজু খেতে চায়না তার জন্যে আলাদা নরম করে ভেজে দিতো। মাঝু বলতো হ্যাঁ বাবা দিয়েছি, আমার বাবা আমি কি জানিনা আব্বুকে কি দিতে হবে? তুমি তাড়াতাড়ি মরিচ ভেজে দাও। গোলান বেসন মাখা মরিচ ভাজা তার প্রিয়। মাঝু জানে আর কারো জন্যে না হোক বাবার জন্যে অন্তত চারটা মরিচ ভাজতেই হবে। ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে বাবা আসছে না মাঝু ফোন করে খবর নিতো। আব্বু তুমি কোথায়?
হ্যাঁ আব্বু আমি আসছি, এইতো মসজিদ পর্যন্ত এসেছি। তাড়াতাড়ি আস ঘড়ি দেখেছ?
এক গ্লাস ক্যান্ডিরালের সরবত। ভেজানো চিড়া, বেল, কলা, পেঁপে, তরমুজ, লেবু না থাকলে ছাদের টবের লেবু গাছ থেকে লেবু পাতা এনে তাই শরবতের সাথে ডলে দেয়। মাঝে মাঝে পুদিনা পাতা যখন যা পেতো তাই দিয়ে বাবার জন্যে এক গ্লাস ক্যান্ডিরালের সরবত। যূথী ইফতারে পিঁয়াজু, ঘুমনি, ছোলার চেয়ে আলুর চপ বেশি পছন্দ করে তাই সে সবসময় একটা চপ যূথীকে তুলে দিত। চপ নিয়ে যূথী আর ওর দাদার হইচই। দাদা বলে আমার দাঁত নেই তাই আমি চপ খাই তুমি চপ পছন্দ কর কেন? তুমি পিঁয়াজু খাও সব চপ আমার। টেবিলে প্লেট গ্লাস সাজানোর কাজটা করে যূথী আর মার সাথে থাকে খুকু। আবার ওদিকে ইফতার নামাজ সেরে মা একটু শুয়ে বিশ্রাম না নিলে অস্থির হয়ে পড়ে। এমনিতেই সে শ্বাসকষ্টের রুগী, তার বিছানাটাও যূথী করে রাখে। আজ কি করেছে না কি ভুলে গেছে? মনি কি আজ ইফতারের পরে একটু শুতে পেরেছিলো? ইফতারের পরে নামাজ সেরে সবাই আবার টেবিলে এসে বসতো বড় এক থালায় করে পিঁয়াজু, ঘুমনি, ছোলা, চপ, কুচানো ধনে পাতা কিংবা পুদিনা পাতা যেদিন যা থাকে কাঁচামরিচ, টমাটো রাখা থাকে। এই থালাটাও মনি কিনেছিলো। বড় দেখে, শুধু ইফতারের জন্যে। সবাই খেয়ে যা থাকে তাই দিয়ে এবার মুড়ি মাখানোর পালা। এটা করতো সেঝ ভাই। এইসব মাখামাখি ভর্তা ইত্যাদি ও যা বানায় তা মনে রাখার মত। ও না থাকলে মাঝু। এই থালাটাও মাঝুই গুছিয়ে রাখত। টেবিলের মাখানো মুড়ির গন্ধটা যেন নাকে আসছে। সামনে ওই তো একটা পেয়ালা হাতে খুকু বলে উঠলো আব্বু ধর। তার বিহীন যোগাযোগটা কিভাবে যেন ছিঁড়ে গেলো। হঠাৎ চমকে উঠলেন। সামনের ঘড়ি বলছে আমি আর মাত্র দশ মিনিট সময় দিতে পারি উঠে পর রাশেদ। হাতের সিগারেট দুই আঙ্গুলের ফাঁকেই নিভে গেছে। আবার জ্বালালেন। ছাদের দিকে তাকিয়ে পর পর কয়েকটা টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে নিভিয়ে কাপর বদলে নিচে চললেন।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪৫
৬৩।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে যোহর আসর দুই ওয়াক্তের নামাজ পড়েই বিছানায় গড়িয়ে পরলেন। ক্লান্ত লাগছে। বিছানার সামনে দেয়াল ঘড়িতে দেখলেন তিনটা দশ। কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে, ঘুম ভাঙল নুরুল ইসলামের ডাকে।
-কি ভাই সাহেব ইফতার করবেন না? উঠেন উঠেন সময় নাই।
লাফ দিয়ে উঠে বাথরুম থেকে ওযু করে নিচে গিয়ে দেখে ইফতারের আয়োজন চলছে। আসাদ বললো-
-ভাই আপনি ওই ওখানে দেখেন গ্লাস আছে. ওই যে ওই বারের ভিতরে। ওখানে সিংক ও আছে ওখান থেকে কয়েক গ্লাস পানি আনেন।
গ্লাস ভরে আনতে যাবে আবার আসাদ বললো –
-আরে ওখানে ট্রে আছে তো! ট্রেতে করে আনেন।
-ওহ! হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি।
ট্রেতে করে গ্লাস নিয়ে এসে সবার সামনে একটা একটা করে নামিয়ে রেখে নিজে বসল এক পাশে।
-রোজা আজ কয়টা যাচ্ছে?
-২৬টা।
-দেখতে দেখতে চলে গেলো।
রাশেদ সাহেব রোজার দিনে তার বাড়ির ইফতারের টেবিলে সবাইকে নিয়ে বসে এক সাথে রোজা সম্পর্কে কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করতেন, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা দেবার জন্যে। তার কথা হলো ইফতার তৈরি করে অন্তত কিছুক্ষণ আগেই যেন সবাই ধীরে সুস্থে টেবিলে এসে বসে। ইফতারির সময় এত হুলুস্থুল করার কি দরকার? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন আরও আট দশ মিনিট বাকি আছে। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে রোজার শেষ কয়দিনের সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বলা শেষ করে বললেন আসেন আমরা সবাই এবারে একটু মুনাজাত করি। মুনাজাত শেষ হবার সাথে সাথেই কবির বললো –
-টাইম হয়ে গেছে নিয়ত করেন।
আজকেও গতকালের মত খেজুর, ছোলা ভুনা আর পায়েসের মত দেখতে হলুদ রঙের স্বাদহীন খিচুরি। রাশেদ
সাহেব এই স্বাদ বিহীন খিচুরি খেতে পারলেন না।
মারুফ বললো –
-তাহলে ভাই সাহেব আপনে আর একটু ছোলা নেন।
-তা নেয়া যায়।
-যদি মনে করেন তাহলে ভাত খেয়ে নিতে পারেন তরকারি রেডি আছে।
-না ভাত লাগবে না এতেই হবে।
ইফতার করতে করতে নুরুল ইসলাম বললো –
-ভাই সাহেব খুব সুন্দর মুনাজাত করলেন। যে কয়দিন আছে এইভাবে করবেন। সবাই একসাথে বলে উঠলো হ্যাঁ হ্যাঁ আগে কিছু বলে নিবেন। আজকের মত ইফতারের সময় আর গল্প হবে না। কাল থেকে ভাইছাব মুনাজাত করবে।
-আচ্ছা, নামাজ কি সবাই আলাদা আলাদা পরেন?
-হ্যাঁ অই আরকি যে যেমনে পারে।
-তা কেন, উপরে বেশ জায়গা আছে ওখানে সবাই এক সাথে পড়া যায়। চলেন সবাই এক সাথেই পড়ি এমনিতেই আমরা অনেক কিছু জেনেও না জানার মত চলি। মানার মত ব্যবস্থা থাকলেও মানি না। কত কিছু ইচ্ছা করেই হোক বা অনিচ্ছা করেই হোক ছেড়ে দিই। জামাতে সওয়াব বেশি এটা যদি পারি তাহলে করবো না কেন?
-আচ্ছা চলেন তাহলে আপনে যখন বলছেন।
উপরে এসে নামাজ পড়ে রাশেদ বললো –
-আমার একটু চা লাগবে আমি নিচে যাই আপনারা কেও আসবেন?
-হ্যাঁ আসছি চলেন।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪৪
৬১।
যাক, আল্লাহর রহমতে মনি ঠিকভাবে পৌঁছেছে। আলহামদুলিল্লাহ! এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো। কাল রাতে যেখানে এতো হৈ চৈ ছিলো এখন সেখানে নীরব। কেও নেই। রাস্তা দিয়ে দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে এই শুধু। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশ মেঘে ঢাকা। কিন্তু বৃষ্টি নেই রাস্তায় লোকজন নেই এ আবার কেমন দেশ? ভাবছিলো রাশেদ সাহেব। এখন কি করবে কোথাও যাবার জায়গা নেই কিছু চেনা নেই। এই ভাবেই চলবে আস্তে আস্তে চেনা জানা হবে হয়তো। কত দিন এখানে থাকতে হবে বা থাকা যাবে তা সে জানে না। তবে এটা জানে যে এদেশের রানী তার জন্য দরজা খুলে বসে নেই। ভিসার মেয়াদ যতদিন আছে ততদিন নিশ্চিন্ত। তারপর কি হবে? কখনো ধরতে পারলে পাঠিয়ে দিবে এইত? তা যদি দেয়ই দিবে। জোড় করে তো থাকা যাবেনা। ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। কতক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো খেয়াল নেই। নুরুল ইসলাম উঠে পড়েছে।
-কি ভাই সাব কি দেখেন?
-না কি আর দেখব এই দাঁড়িয়ে থাকা আর কি, এছাড়া কি করব সবাই ঘুমে।
-হ্যাঁ সবাই সাধারণত সারে এগারোটা পর্যন্ত ঘুমবে। এখন এগারোটা বাজে। আজকে তো আপনাদের সারে এগারোটায় নামতে হবে, সব কিছু আটাইয়ে নিতে হয়তো তাই।
-প্রতিদিন সারে এগারোটায়?
-না শুধু শুক্র শনি বারে, অন্যদিন বারোটার দশ মিনিট আগে নামলেই হয়। আজও কিন্তু কালকের মত কিংবা কালকের চাইতে বেশি বিজি হবে।
৬২।
রাশেদ সাহেব একটু ভয় পেলেন কি ভাবে কুলাবেন বুঝতে পারছেন না। দেখা যাক যা হোক একটা কিছু হবে। এতো ভয়ের কি আছে? এবারে বিছানায় এসে একটু কাত হয়ে শুয়ে পরলেন। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে সামনের দেয়াল ঘড়িতে এগারোটা পঁচিশ দেখে উঠে প্যান্ট সার্ট বদলে নিচে নেমে একটা এপ্রণ গায়ে কিচেনে ঘুরে দেখে বুঝার চেষ্টা করে দেখলেন কি কি করতে হবে। রাতের আর সেহেরির তরকারির ডেকচি গুলি ধুয়ে রাখলেন। ছেলা পিঁয়াজের ড্রামটা অর্ধেক খালি হয়েছে। ভাবলেন এক বস্তা এনে রাখি। স্টোর থেকে বের হতেই ঠাণ্ডার একটা ধাক্কা লাগলো গায়ে। মনে হলো সমস্ত শরীরে সুই বিঁধিয়ে দিয়েছে কেও। ঝট পট এক বস্তা পিঁয়াজ এনে রাখলেন কিচেনের সাথের স্টোরে। এসে দেখে মারুফ পিঁয়াজ কাটছে। পিঁয়াজ কাটার ধরনটা তার কাছে বেশ ভাল লাগল। একটা চপিং বোর্ডের নিচে ভেজা কাপর বিছান, তার পাশে টেবিলের উপর প্রায় এক বালতি ছেলা পিঁয়াজ। একটা একটা করে নিয়ে কাটছে আর টেবিলের নিচে বোর্ড বরাবর একটা বালতিতে ছেড়ে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেবকে দেখে বললো –
-ভাইছাব এক বস্তা পিঁয়াজ আনতে পারবেন?
হ্যাঁ এইতো নিয়ে এলাম ওপাশে রেখেছি।
-আচ্ছা বেশ, এখন এই যে এ ড্রয়ারের ভিতরে ছুরি ওখান থেকে একটা নিয়ে যান ওগুলি ছিলতে থাকেন। আপনে দুইটা পিঁয়াজ নিয়ে আসেন আমি দেখিয়ে দেই কিভাবে ছিলবেন।
দুই তিন টা পিঁয়াজ নিয়ে এসে মারুফের সামনে রাখতেই এপাশে ওপাশে কেটে দেখিয়ে দিল আবার বললো ওই যে বিন ওইটা নিয়ে যান খোসাগুলি এতে ফেলবেন আর ছেলা গুলি রাখার জন্যে একটা বালতি নিয়ে নেন বালতি ভরলে আমাকে দিয়ে যাবেন। এদেশের পিঁয়াজগুলি বেশ বড় বড়।
রাশেদ সাহেব মারুফ কে বললেন-
-এই এতদিনে ওসি ডিসির মানে বুঝলাম।
মারুফ বললো-
-কিরকম।
-শোনেন তাহলে, ছেলে বিদেশে লাখ টাকা কামাচ্ছে শুনে বাবা খুব খুশী। একবার জানতে চাইলেন বাবা তুমি কি কর, কি কাজ তোমার? তখন ছেলে লিখে পাঠাল বাবা আমি এখানে ওসি ডিসির কাজ করি। তা মারুফ ভাই আপনি আমাকে সেই ওসি ডিসি বানালেন? মানে অনিওন কাটার এন্ড ডিশ ক্লিনার!
-ও আচ্ছা আচ্ছা, হ্যাঁ ভাই কি আর করা যাবে দেখেন না আমরাও তাই করি। আপনি কি মনে করেছেন আমি এসেই সেফ বা তন্দুরি সেফ হয়ে গেছি? না আমিও ওই কিচেন পোর্টার থেকে শুরু করেছি এবং শুধু আমি না এদেশে যত সেফ দেখবেন তা সেফই হোক আর মালিকই হোক সবাই এই একই কাজ থেকে শুরু করেছে। নয়তো কুমি ওয়েটার থেকে। কুমি ওয়েটার কি জানেন?
-না।
-শুধু কুমি ওয়েটার বলি কেন সব ওয়েটারকেই টয়লেট পরিষ্কার করতে হয়।
-বলেন কি সুইপার নেই?
-আরে না সুইপার রাখলে বেতন কত হবে জানেন? তার বেতন দিতে গেলে মালিকের লাভ শেষ আর ব্যবসা চলেনা। মালিক নিজেও করে আপনি যদি সামনের কাজ নেন আপনাকেও করতে হবে। কিচেনের কাজে বেতন বেশি তবে কষ্টও বেশি আপনি কুলাতে পারবেন না। আপনি দেশে কি করেছেন তা না বললেও আমরা বুঝতে পারছি। আমরা কাল রাতে আপনাকে নিয়ে আলাপ করেছি। আপনি এ কাজ পারবেন না আপনার জন্য এ কাজ না। দেখি আমিও দেখছি আপনিও দেখেন সামনে একটা কাজ জোগাড় করে নেন। ওখানে আরামে থাকতে পারবেন নয়তো শেষ হয়ে যাবেন। সামনেও পরিশ্রম আছে তবে কিচেনের মত না। ওখানে সুট টাই পরে সেন্ট মেখে কাজ করবেন সাহেবের মত। সাহেব মেম সাহেবদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলবেন।
এমন সময় কবির আর দেলোয়ার কথা বলতে বলতে কিচেনে ঢুকে বললো-
-রাশেদ কার নাম? ভাই সাহেব আপনার নাম রাশেদ নাকি?
-হ্যাঁ আমিই রাশেদ, কেন?
-আপনার ফোন।
-কোথায়?
-ভিতরে যান, না না এভাবে না এপ্রণ খুলে রাখে যান।
-ও আচ্ছা।
এপ্রণটা খুলে দরজার বাইরে হুকে ঝুলিয়ে রেখে ভিতরে গিয়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ফিরোজের কণ্ঠ-
-কি রাশেদ কি খবর?
-ভাল।
-কাজ শুরু করেছ?
-হ্যাঁ সে তো কাল এখানে আসার সাথে সাথেই শুরু।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কাল ফোন করিনি কারণ আমি জানি অবস্থা। যাক কেমন লাগছে কষ্ট হচ্ছে?
-হ্যাঁ তা তো বুঝতেই পার। ডেকচি মাজতে মাজতে হাতের আঙ্গুলে বেশ কেটে কুটে গেছে।
-কেন গ্লোভস নেই? তুমি বল গ্লোভস দিতে, গ্লোভস পরে করবে এসব। এখন কি আর করবে, আপাতত করতে থাক সাবধানে কর কষ্ট তো একটু হবেই। আচ্ছা আমি মাঝে মাঝে ফোন করব। তোমাকে যেদিন অফ দিবে সেদিন ঘরে বসে থাকবে না মন খারাপ হবে। কাপর চোপর ধুবে, বিছানা পত্র ঘর গুছাবে, বাইরে বের হবে, ঘুরবে দেখবে সময়মত এসে খেয়ে যাবে। মন ভাল থাকবে আর দেখবে আসে পাশে লাইবেরি কোথায় যে কোন লোককে বললেই দেখিয়ে দিবে। সেখানে যাবে। তোমার পাসপোর্ট দিয়েই হবে, বলবে আমি ভিজিটর। ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারবে, বাসায় মেইল পাঠাবে। ভাল কথা, বাসায় ফোন করেছ? ভাবীর খবর কি?
-ও পৌঁছেছে অসুবিধা হয়নি।
-তো ঠিক আছে আজকে রাখি তাহলে। ফোন করবে মাঝে মাঝে। দরকার মনে করলে আসে পাশেই দেখবে কয়েন ফোন বক্স আছে সেখান থেকে তুমিও ফোন করতে পার আমাকে। আমি বাসায় না থাকলে তোমার ভাবী তো থাকবে কি দরকার বলে দিও।
-আচ্ছা।
-ফোন টা রেখে আবার পিঁয়াজ ছেলা শুরু করতেই কুইক করেন ভাইছাব। দেলোয়ারের তাগিদ। পনের মিনিটে এক বস্তা পিঁয়াজ ছিলতে হবে, বুঝলেন? কুইক, কুইক করেন।
-হবে ভাই হবে একটু সময় তো দিবেন।
-কথা বাদ দেন কুইক করেন, হাত চালান।
মারুফের পিঁয়াজ কাটা শেষ। এখানে যে কয়টা ছেলা হয়েছে সেগুলিও শেষ। এবারে মারুফও ছেলার কাজে হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি বস্তা শেষ করে আবার কাটা কাটিতে লেগে গেলো।
এবার কবিরের হুকুম-
-ভাইছাব করে থেকে একটা ডেকচিতে করে আট পট চাউল এনে ধুয়ে দেন।
-করে মানে?
-ও! করে মানে পিছনে।
-আচ্ছা।
চাউল এনে ধুয়ে দেয়ার আগেই-
-এই যে ভাই এই কিমা গুলি মাখান তো।
শুধু রাশেদ সাহেব নয় সবাই বিজি কারো নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
মারুফ বললো –
-ভাই এক ফাঁকে রাতে আর সেহেরির জন্যে ওই ফ্রিজ থেকে এক পোটলা মাছ আর এক পোটলা চিকেন বের করে পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন আর এখন আমাকে কয়েকটা টমাটো আর দুই তিন টা লাল পিঁয়াজ দেন।
এর মধ্যে বিরাট এক ডেকচিতে সদ্য কাটা সব পিঁয়াজ বিভিন্ন মশলা, লবণ, টমাটো আরও কি কি সব দিয়ে চুলায় দিয়ে দিল।
-এটা কি হবে ভাই?
-এটা হচ্ছে গ্রেভি, এগুলি দিয়েই কারি রান্না হবে।
রাশেদ সাহেব বুঝলেন ফ্রাইংপ্যানে চামচ দিয়ে যে জিনিস দেয়া হয় তাহলে এই সেই। এটা হলো কারির ঝোল। ওদিকে একজন বড় এক গামলায় করে মুরগির মাংস মশলা দিয়ে মাখাচ্ছে। একজন আবার একটা সিংক এর ভিতর দিকটা পরিষ্কার করে তার মধ্যে ময়দা ছেড়ে দিল বস্তা থেকে। তার মধ্যে ডিম, লবণ, চিনি, কালিজিরা, বেকিং পাউডার এসব দিয়ে মাখাচ্ছে।
এই যে ভাই এই গুলি ধুয়ে দেনতো, আরে ভাই দেখে আসেন তো ওই ওখানে কড়াইতে ফুলকপি কত গুলি আছে দেখেন। কুইক করেন। আচ্ছা ভাইছাব এই যে দেখেন এইরকম তিনটা কৌটা নিয়ে আসেন স্টোর থেকে। হ্যাঁ ঠিক আছে। আচ্ছা উপরের টয়লেটের পাশে যে রুম ওখানে দেখবেন এই যে ভিম পাউডার এই গুলি আছে এরকম দুইটা নিয়ে আসেন। ভাইছাব এইগুলি একটু কুইক ধুয়ে দেন। শ্বাস ফেলার সময় নেই। হুলস্থূল ব্যাপার। যাক মোটামুটি দুইটার মধ্যে একটু হালকা হলো। মারুফ বললো-
-ভাই সাহেব রান্না করতে পারেন?
-আসলে রান্না করার তো কখনও প্রয়োজন হয়নি তাই চেষ্টা করা হয়ে উঠেনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে শিখিয়ে নিব।
-হ্যাঁ তাতে আপত্তি নেই।
-ঠিক আছে কাল দেখিয়ে দিব আপনে রান্না করবেন। এখন কিচেন টা একটু ব্রাশ করে শেষ করে উপরে চলে যান।
কয়েকটা চুলা সমানে জ্বলছে। কোনটায় গ্রেভি, কোনটায় মুরগী, কোনটায় ভেড়া আরও কি কি যেন। রাশেদ সাহেব বললেন-
-আপনি যাবেন না?
-না আমার যেতে একটু দেরি হবে আপনে যান।
-না কি দরকার চলেন এক সাথে যাই।
-না আপনি টায়ার্ড, নতুন তো রেস্ট নেন।
-না চলেন একসাথে যাই।
এই বলে টেবিলের উপর উঠে বসল।
বাড়ি কোথায়, কবে এসেছে মানে তাকে যা যা বলেছে সবাই সেও তাই জানতে চাইল। মারুফ সুনামগঞ্জ থেকে এসেছে। ওখানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বেকার ঘুরছিলো এদেশের এক মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে বাবা। আর দেরি না করে লন্ডনি মেয়ে বিয়ে করে তার আঁচল ধরে চলে এসেছি চার বৎসর আগে, আমরা তো আর অন্য কোন কাজ পারি না লেখাপড়াও তেমন নেই তাই এই কাজই করি। তবে ভালই আছি বাড়ি কিনেছি। না না এক বারে না। মাসে মাসে কিস্তি দেই। গাড়ি কিনেছি।
-ও আচ্ছা, ওই যে পিছনের গাড়িটা?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই আমার। আমি এইতো সোম বারে রাতে ডিউটি শেষ করে আমার অফ আমি গাড়ি নিয়ে লন্ডন চলে যাব। সেফ আসবে মঙ্গলবারে। আবার বৃহস্পতিবার বিকেলে এসে ডিউটি করব।
-আচ্ছা, আপনার ওয়াইফ তাহলে লন্ডন থাকে, কতক্ষণ লাগে লন্ডন যেতে?
-বেশি না, দেড় ঘণ্টার মত। ওই যে কবির, ওকে দেখছেন ও এসেছে তিন বৎসর আপনার মত টুরিস্ট হয়ে এসেছিলো এখন বেআইনি।
-উনি বেআইনি কেন থাকবে? দেখে টেখে একটা বিয়ে করিয়ে দেন আপনাদের সবাই এদেশে অনেক জানাশোনা। ওর একটা গতি হোক। ওর বাড়ি কি আপনার এলাকায়?
-হ্যাঁ সেই জন্যেই একটু মাথা ব্যথা। খুঁজছি কিন্তু পাইনা সেরকম।
-আর দেলোয়ার?
-না ও টেম্পোরারি। সেফ নেই তাই ওকে আনা হয়েছে। সেফ এলেই ওকে বিদায় দেয়া হবে দেখবেন ওকে কিন্তু আবার একথা বলবেন না। দেখেন না আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করে তবুও আমরা কিছু বলি না।
-না আমি আর কি বলতে যাব? আচ্ছা, দুপুরে মালিকেরা কেও আসেনা?
-আসে তো, দেখেন নাই? ও! তখন আপনে স্টোরে ছিলেন। ওরা সামনে কাজ সেরে চলে যায়। সেফ না থাকলে এদিকে খুব একটা আসেনা। দেখি আমার গ্রেভির কি অবস্থা!
টেবিল থেকে নেমে যা যা জ্বাল হচ্ছিল সব কিছু দেখে একটা একটা করে চুলা নিভিয়ে দিয়ে বললো-
-চলেন যাই।
এক সাথেই উপরে চলে এলো দুই জনে।
-আসেন একটু বসেন।
আমতা আমতা করে বললো-
-নামাজ পড়া হয়নি।
-ও না না ঠিক আছে নামাজ পড়েন গিয়ে পরে আলাপ করা যাবে।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪৩
৬০।
সকালে নয়টার দিকে ঘুম ভাঙলেও উঠি উঠি করে আবার ঘুমিয়ে পরেছেন। প্রায় ঘণ্টা খানিক পর ঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে উঠে পরলেন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ পড়ে মনে হলো এখন দেশে কয়টা বাজে? হ্যাঁ এখন দুপুর একটা। ফোন করা দরকার। কার্ডটা নিয়ে ফোনের কাছে গিয়ে নাম্বার ঘুরাতেই ওপাশ থেকে খুকুর কণ্ঠ কানে এলো।
-হ্যালো, আব্বু কি খবর তোমাদের?
-হ্যাঁ আব্বু আম্মু এসেছে। সেঝ কাকু এয়ারপোর্টে গিয়েছিলো কিন্তু আম্মু জানে না। আম্মু কায়সার চাচার সাথে বেরিয়ে পড়েছিলো। পরে উনার সাথে উনার বাসায় আজিমপুর পর্যন্ত যায় সেখানে উনি নেমে গেলে আম্মু ওই ট্যাক্সিতেই চলে এসেছে।
-ও আচ্ছা, যাক নিশ্চিন্ত হলাম। তোমার মা কোথায় আব্বু?
-আম্মু খুব টায়ার্ড, এসেই গোসল করে খেয়ে দেয়ে একটু শুয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরেছে। তুমি কেমন আছ আব্বু?
-হ্যাঁ আব্বু আমি ভাল আছি।
-কাজ করতে পারছ?
-হ্যাঁ আব্বু করতে হবে তাই পারছি।
-তোমার ঠিকানা কি আব্বু?
-আব্বু আমি ঠিকানা আর সব জানিয়ে মেইল পাঠাব। দেখি ইন্টারনেট কোথায় আছে পাই নাকি, ফোনে তো এতো কথা বলা যাবেনা। এখন রাখি আব্বু?
-ঠিক আছে তবে তুমি সাবধানে থেকো আর খাবার ওষুধ এসব সময়মত খেয়ো মনে করে। দেখো ডায়াবেটিস যেন ঠিক থাকে।
-আচ্ছা আব্বু তোমার মা উঠলে বলবে যেন চিন্তা না করে আর তোমরা সাবধানে থাকবে, রাখি আব্বু আল্লাহ হাফেজ।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪৩
৫৮।
হাতের কাপটা নিয়ে বাইরে থেকে শব্দ আসা জানালার পাশে দাঁড়ালেন। তখন দিনের বেলা যে পাব দেখেছিলেন সেই পাবের সামনে মহিলা পুরুষ মিলে দশ বারোজন। এর মধ্যে আবার কেও ভিতরে যাচ্ছে কেও বাইরে আসছে। এদেরই হৈ চৈ। পাবের ভিতর উচ্চ শব্দের বাজনাও শোনা যাচ্ছে। কাল পরশু ছুটি তাই আজ কাজের শেষে পানের উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। এই জন্যই তাহলে এখানে শুক্র শনি বারে এতো ব্যস্ত! এই হলো এদের আনন্দ ফুর্তি। এরা তাহলে আনন্দের জন্য ভিড় করে পাব আর নাইট ক্লাবে? আর আমাদের দেশে এমন দুই দিন ছুটি পেলে ভিড় দেখা যায় বাস আর লঞ্চে। সবাই ছুটে যায় নিজ নিজ আপন জনের কাছে। এরা আনন্দ ভোগ করে নিজে নিজে, একা একা আর আমরা করি সবাইকে নিয়ে অন্তত আপনজনকে নিয়ে। এই জন্যেই আমাদের এতো কষ্ট। এদের আঘাত করার কেও থাকেনা আর আমরা আঘাত পাই পায়ে পায়ে। মানে আপন জনের কাছে যেমন করে যা আশা করি ঠিক তেমন করে তা পাওয়া হয়ে উঠে না একটু হয়তোবা এদিক সেদিক হয়ে যায় হয়তো আমি ঠিক যেভাবে যা চাইছি সেভাবে পাইনি তাই বলে একেবারে যে পাইনি তা নয় হয়তো বা বেশিই পেয়েছি তখন ব্যবধানটা হয়ে দাঁড়ায় শুধু অভিমানের। আর এদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন এদের তো কারো কাছ থেকে কিছুই পাবার নেই যা করছে তা নিজেই করছে নিজের কাছ থেকেই আনন্দ বা দুঃখ যাই হোক পাচ্ছে। সারা রাত পান করে নিজের অনুভব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে ভাবছে সব পেয়েছি, কিছুই অবশিষ্ট নেই।
৫৯।
নিচে থেকে ডাকছে, দুইটা বেজে গেছে! হ্যাঁ তাইতো, ওদিকে পাবের সামনের জটলা কমে গেছে ভিতরের বাজনাও থেমে গেছে। দুই এক জন করে পাব থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব নিচে নেমে এলেন সেহেরি খাবার জন্যে। দুই এক জন করে সবাই নেমে এলো। সবাই যা করছে সেফ এর পিছনের লম্বা টেবিলের মত তার নিচের সেলফে ভাত তরকারির ডেকচি ওখান থেকে যার যার মত ভাত তরকারি নিয়ে পিছনের মাইক্রোওয়েভে গরম করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। পানি খাবার কোন গ্লাস নেই। যে কন্টেইনারে করে টেক এওয়ে নিয়ে যাবার ভাত দেয় সেটাতে করে পানি নিয়েছে সবাই। রাশেদ সাহেব গত রাতে যে গ্লাসে কোক খেয়েছিলেন সেখান থেকে একটা গ্লাস ধুয়ে তাতে পানি নিয়ে এক পাশে টেবিলের উপর ভাতের প্লেট নামিয়ে আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলেন। কবির বললো –
-কি ভাই বাড়ির কথা মনে হইতেছে? খান না কেন?
-খাচ্ছি তো। আমি এতো তাড়াতাড়ি খেতে পারিনা একটু আস্তে আস্তেই খাই।
-ও আচ্ছা ঠিক আছে খান খাওয়া হলে এগুলি ঢেকে রেখে লাইট নিভিয়ে আসবেন। আমরা তাহলে যাই।
সেহেরি শেষ করে কবির যেভাবে বলেছে সেই ভাবে সব রেখে এক কাপ চা নিয়ে উপরে এসে বিছানার উপর বসে ওষুধের প্যাকেট বের করলেন। ওহ! পানি তো আনা হয়নি! আবার নিচে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। একটা জগ বা অন্তত একটা বোতল হলে পানি এনে রাখা যায়। দেখি কাল সকালে কবির বা নুরুল ইসলামকে বলে ব্যবস্থা করা যাবে। এখন এ ভাবেই চলুক। ওষুধ খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। বালিশের নিচে থেকে তামাকের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট বানিয়ে জ্বালালেন।
বাড়িতে খুকু তার দুই বোনকে নিয়ে কি করছে? না খুকুকে নিয়ে এতো ভাবার কিছু নেই মনে হয়। খুকুর ছোট খালা আর নানুকে রেখে এসেছে তারা ভালই আছে। রাত প্রায় তিনটা বাজে। না এখন ভাবার সময় নেই। চা শেষ, সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে শুয়ে পরলেন। কম্বলটা টেনে নিয়ে স্বভাব মত ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পরলেন। এমন সময় নুরুল ইসলাম এসে বললো –
-কি ভাই ঘুমিয়ে পরেছেন?
-না এখনও ঘুমাইনি।
নুরুল ইসলাম কি যেন বলছিলো কানে ঢুকেছিলো কিন্তু জবাব দেয়া হয়নি। সারা দিনের ক্লান্তি আর অবসাদে কখন যে শ্রান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পরেছে তা আর বুঝতে পারেনি।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪২
৫৭।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে নিজের বিছানায় বসলেন সারা দিনে নামাজ পড়া হয়নি। তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ওজু করে রুমে আসতে আসতে পানি শুকিয়ে গেছে আর তোয়ালে বের করার দরকার নেই। কিন্তু জায়নামাজটা মনে হয় বের করতে হবে। একটু এদিক ওদিক তাকাতেই চেয়ারের উপর দেখলেন জায়নামাজ। দেখে বুঝলেন নুরুল ইসলামের হয়তো হবে এটা। এখন কেবলা? না এবার তো নিচে যেতেই হবে। নিচে গিয়ে দেখে সবাই তাস নিয়ে বেশ ভাল জমিয়ে নিয়েছে।
-আচ্ছা ভাই কেবলা কোন দিকে?
নুরুল ইসলাম ওই ঘরেই দেখিয়ে দিল এই যে এই দিকে।
উপরে এসে নামাজ পড়ে নিলেন।
এতো রাত হয়েছে তবুও বাইরে নারী পুরুষের হৈ চৈ হাসা হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। জানালার ডবল কাচ ভেদ করে সে শব্দ আসছে। দেখার মত কৌতূহল নেই। বেশিক্ষণ বসলেন না। উঠে সুটকেসটা খুলে লুঙ্গি আর শোবার কাপর চোপর টুকি টাকি বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। কাপর বদলে বিছানায় বসে একটা সিগারেট বানালেন। ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা, মনে হয় হিটার নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে তার বেডের পাশেই তো হিটারের রেডিয়েটার। রেডিয়েটার ছুঁয়ে দেখলেন ঠাণ্ডা। তার মানে কাজ করছে না। যাক এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। তেমন ঠাণ্ডা লাগছে না গায়ে তো থার্মাল পাজামা আর থার্মাল ফুল স্লিভ গেঞ্জি রয়েছে। বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট টানতে টানতে আস্তে আস্তে একটা একটা করে সারা দিনের সব ছবি গুলি মাথায় এসে ভিড় করলো। মনি কোথায়? ঘড়ির দিকে তাকাল। দেড়টা বাজে। মনি এখন কুয়ালালামপুরে। ও কি ঠিক ঠাক মত চেক আউট করতে পেরেছে? হোটেলে যাওয়া এসব কি করতে পেরেছে? প্লেনে কি শ্বাসকষ্ট হয়েছিলো? কি করেছে তা হলে? না কিছুই হয়নি, মনি ভালোই আছে এবং কুয়ালালামপুরে হোটেলে শুয়ে আছে। তবে ঘুমুতে পারছেনা। যাক ও ভাল থাকুক ভাল ভাবে দেশে গিয়ে পৌঁছুক। একটু চা হলে ভাল হোত। আবার নিচে গিয়ে কবিরকে বললো –
-ভাই চায়ের ব্যবস্থা আছে নাকি?
-নিচে যান, লাইট জ্বালাতে পারবেন? নেমেই ডান দিকে সুইচ, লাইটটা জ্বালিয়ে সামনে টেবিলের পাশে দেখবেন কেটলি আর পাতা দুধ চিনি এগুলি আছে। কেটলির নিচের সেলফের ভিতর কফিও আছে যা ইচ্ছা খেয়ে আসেন।
-আপনারা কেও খাবেন?
-এইতো একটু পরেই তো সেহেরি খাবো তখন একবারে খাবো।
-তাহলে আমি এখন একটু খেয়ে আসি তখন না হয় আপনাদের সাথে আবার এক কাপ খাবো।
-তা খাবেন। খাবার ব্যাপারে কোন নিষেধ নেই। যখন যা ইচ্ছা খাবেন তবে একটা কথা মনে রাখবেন এখানে সবাই কাজের জন্য বলবে কিন্তু কেও আপনাকে খেতে বলবে না কাজেই সেটা নিজেকেই করতে হবে।
-হ্যাঁ ঠিক বলেছেন এটাই স্বাভাবিক, ঘরের বাইরে এমনই হয় এতে কিছু মনে করার মত নেই।
আসাদ যে ভাবে বলে দিয়েছে সেভাবেই চা, কেটলি, কাপ সব পেয়ে কেটলিতে পানি দিয়ে সুইচ অন করে দিয়ে কিচেনটা আবার একটু চোখ মেলে দেখে নিলেন। এর মধ্যে পানি ফুটে উঠলে কাপে ঢেলে লাইটটা নিভিয়ে চামচ দিয়ে নারতে নারতে উপরে নিয়ে এলেন। সে ডায়াবেটিস রুগী, সুইট্যাক্স নিচে নিয়ে যায়নি। উপরে এসে ব্যাগ থেকে সুইট্যাক্স বের করে কাপে দিয়ে নেরে নিয়ে চামচটা পিরিচে নামিয়ে রেখে একটা চুমুক দিতেই মনটা বেশ ভাল লাগল।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪১
৫৬।
এই হলো অবস্থা। এর পর আর কিছু বলার প্রবৃত্তি হয়নি। দেখা যাক ধীরে ধীরে যদি কিছু বোঝা যায়, যাবেই এক সময়। কাজের যে চাপ, যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশ হলে অন্তত আরও চার জন লোক প্রয়োজন হতো। তাছাড়া আজ একেবারে ভিড়ের মধ্যে এসে পরেছে। কেও কিছু দেখিয়ে দিতেও পারছেনা আর তার নিজেরও হঠাৎ পরিশ্রম হয়ে যাওয়ায় কুলিয়ে উঠতে পারেনি। কয়েক দিন গেলে সব কিছু দেখা চেনা রপ্ত হয়ে গেলে মনে হয় ঠিক হয়ে যেতে পারে। দেখা যাক কি হয় কবির তো বলেছে সব কিছু চেনা জানা হলে কষ্ট কম হবে। দেখা যাক। আর কিই বা আছে দেখার, যেভাবেই হোক এর মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। আর তো কোন বিকল্প নেই। রাশেদ সাহেবের ধৈর্য এবং সহ্য একেবারে খারাপ নয়।
কি খাচ্ছে কেমন হয়েছে সেদিকে মন দেবার মত সময় এটা নয়। পেট ভরছে কিনা এইই যথেষ্ট। আর সবাই চলে গেছে শুধু আসাদ খাওয়া শেষ করে ওর সাথে বসে আছে।
-ভাত তরকারি নেন, সারা দিন তো খুব ধকল গেছে ভাল করে খান কালকে কিন্তু আরও বিজি হবে।
-হ্যাঁ আর একটু ভাত লাগবে এইতো নিচ্ছি।
বিশাল ডেকচির মধ্যে একটা পিরিচ রাখা যেটা দিয়ে প্রথম ভাত নিয়েছিলো ওটা দিয়েই আবার আরও একটু ভাত নিয়ে একটু ভেড়ার মাংসের তরকারি নিয়ে খেতে খেতে কথা বলছিলো।
-আমি তো মনে করেছিলাম এসব খাবার হয়তো এখানে পাওয়া যাবেনা হয়তো ব্রেড বাটার খেয়ে কাটাতে হবে।
-না তা কেন, এই তো রাতে এক দিন ভেড়া এক দিন মুরগি আর দুপুরে প্রতিদিনই মাছ।
-সকালে?
-না সকালের জন্য এমনি কিছু নেই তবে দেখে নিবেন যা আছে এর মধ্যে আপনার যা ভাল লাগে তাই খেয়ে নিবেন।
-না মানে আপনি বা সবাই কি খায়?
-কেও ব্রেড খায় কেও কর্ণ ফ্ল্যাকস আর দুধ যার যা ইচ্ছা।
-ও আচ্ছা। এখন তো রোজা কাজেই সকালের চিন্তা নেই তাই না?
-না রোজা আর কয় দিন এই তো আর মাত্র তিন বা চারটা আছে হয়তো।
-ঈদে কি এখানেই থাকবেন?
-হ্যাঁ, তাছাড়া আর কোথায় যাব?
-ও ভালো কথা, সেহরির কি ব্যাবস্থা?
-আমরা সাধারণত, এই যে এখন সবাই উপরে উঠে গেছে যেয়ে দেখেন সবাই তাস খেলছে। রাত দুইটা বা আড়াইটার দিকে সবাই এসে সেহেরি খাবে। দেখি সেহরির জন্য আজ কি রান্না করেছে, বলেই নিচু হয়ে রাশেদ সাহেব যে টেবিলের উপর বসে খাচ্ছিলেন ওটার নীচে ডেকচি আছে তাই খুঁজে পেয়ে বললো-
-মাছ আর আলু।
-কি মাছ?
-মনে হয় রুই।
-কি শেষ? ও হ্যাঁ প্লেটটা ওই যে ওই সেলফের মত ওই ব্রাকেটের মধ্যে রেখে দেন। বেশ চলেন এবার।
-আপনার বেড কোনটা দিয়েছে?
-ওইতো তিন তলায়, আর আপনার?
-আমার এই যে গোয়াল ঘরে ওই দরজার বাম পাশে যেটা ওটা।
কথা বলতে বলতে সদ্য শোনা গোয়াল ঘরে ঢুকল। আগে আসাদ পিছনে রাশেদ সাহেব।
-এই যে নয়া ভাইছাব আসেন আসেন তাস খেলতে খেলতে মারুফ বলে উঠল আপনার সাথে তো আজ কথাই বলা হয়নি আসলে আপনেও এমন বিজির মধ্যে আসলেন। তা বলেন কেমন লাগলো? এইতো কালকের দিন গেলেই দেখবেন সব ঠাণ্ডা। শুধু শুক্র আর শনি বারেই যা একটু ঝামেলা তারপর এরকম থাকে না। ঠিক হয়ে যাবে।
কবির বললো-
-না আপনে যান গোসল করলে করে নেন এখন একটা বাজে দুইটায় আমরা পতা খাই আপনে ওই সময় চলে আসবেন আর যদি বসতে চান বসেন।
-না আমি না হয় যাই টায়ার্ড লাগছে পরে অবসর মত আলাপ করা যাবে। আচ্ছা ওই যে বললেন পতা, এর মানে কি?
রাশেদ সাহেবের কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
-আরে পতা মানে জানেন না? সেহরি, সেহরি, বুঝলেন?
-হ্যাঁ এখন বুঝলাম। আচ্ছা কাল কখন ডিউটি?
-কাল সকালে সাড়ে এগারটায় নামবেন।
-তাহলে ভাই আমি আসি কিছু মনে করবেন না ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
-না না মনে করার কিছু নাই আজকে যান তবে সবসময় একা থাকবেন না তাহলে খারাপ লাগবে।
নক্ষত্রের গোধূলি-৪০
৫৫।
সবাই রাশেদ সাহেবকে নিয়ে মোটামুটি হাসি তামাশা হৈ চৈ গালা গালি যার যখন যা ইচ্ছা চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু রাশেদ সাহেব কোন প্রতিবাদ করছে না। আরে এইটা করতে এতক্ষণ লাগে নাকি, ওইটা কোথায় থাকে জানেন না, একটু দেখে নিলেই তো হয়, হা করে কি দেখেন এই ধরনের সব কথার প্রতিবাদ করবেই বা কী। নীরবে শুনে যাওয়াই ভালো। বোবার নাকি শত্রু থাকে না। ঘড়ি দেখার কথা মনে নেই। মারুফ বললো
-ওরে বাবা সারে বারোটা বেজে গেছে? তাড়াতাড়ি কর সবাই। নয়া ভাই সাহেব আপনি মপের বালতি ভরে চুলায় দেন।
মপের পানি গরম হলে বললো-
-ওই যে ওই খানে ব্রাশ আছে ওটা নিয়ে আসেন। পারবেন তো ব্রাশ করতে? দেন আমি দেখিয়ে দেই
বলে বালতিতে গুড়া সাবান, ব্লিচ, এনটি ব্যাকটেরিয়াল সুগন্ধি মিশিয়ে বললো-
-দেখেন কি ভাবে ব্রাশ করবেন।
দেখিয়ে দেয়ার পর রাশেদ সাহেব পুরো কিচেন আর তার পাশের স্টোরে মপ মেরে জিজ্ঞেস করলো-
-এই পানি কোথায় ফেলব?
দেলোয়ার বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা ড্রেনের মুখ দেখিয়ে বললো-
-এই খানে ফেলবেন সবসময়। আর ওই বালতি ব্রাশ এই যে এইখানে রাখবেন সবসময়। একই ভাবে করবেন যাতে করে আপনে যেদিন না থাকবেন সেদিন যেন আমাদের কারো খুঁজে পেতে অসুবিধা না হয়।
ফিরে এসে দেখে কাজ কর্ম সব শেষ। কিচেন দেখে মনেই হবে না এখানে এতক্ষণ মহাযজ্ঞ চলেছে। সমস্ত কিচেন চক চক করছে।
-এই যে ভাই সাহেব হাত মুখ ধুয়ে আসেন।
-কেন?
-খাইবেন না?
-ও আচ্ছা, তা হলে আমি কাপর গুলিও বদলে আসি। সিংক থেকে নোংরা পানি ছিটে এসেছে কেমন লাগছে এই কাপর গায়ে খেতে পারবো না।
বলেই রাশেদ সাহেব আর দেরি করলেন না। সারা দিনের এই নতুন ধরনের শারীরিক পরিশ্রম যাতে সে অভ্যস্ত নয়, এর পর বিষণ্ণ মন, অবসাদ আর ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর যেন আর চলতে চাইছিলো না। কোন রকম টেনেটুনে তিন তলায় এসে কাপর বদলে বিছানায় একটু বসে মনে হলো কতদিন যেন বসতে পারেনি। মুখে হাত দিয়ে দেখে ঘাম শুকিয়ে লবণ কিচ কিচ করছে। সেই সাড়ে পাঁচটার পর একটা সিগারেট ও টানার সুযোগ পায়নি। আগে একটা সিগারেট বানিয়ে তাড়াতাড়ি দুটো টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে ফেলে দিলেন। বেশি দেরি হলে আবার কি বলে এমনিতেই নতুনের দোষ বেশি।
বাথরুমে গিয়ে সাবানের কথা মনে হলো, আগে একেবারে মনেই হয়নি এখন আর অত দূরে সাবান আনতে যেতে ইচ্ছা হলো না। সাবান ছাড়াই মুখ হাত ভাল করে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিচে এসে দেখে সবাই যার যার মত কিচেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। মালিকদের অন্য এক অংশীদার ওসমান বললো-
-নেন নেন ভাই তাড়াতাড়ি একটা প্লেট নেন।
রাশেদ সাহেব দেখলেন সে যেখানে প্লেট গুলি ধুয়ে রেখেছে এগুলি সেই প্লেট। সে নিজেও একটা হাতে নিয়ে নিলেন। আসাদ সাহেব ভাতের ডেকচি আর তরকারির হাড়ি দেখিয়ে দিল। মারুফ বললো-
-নিজেই নিয়ে নেন কেও দিয়ে দিবে না।
-ও আচ্ছা, ঠিক আছে নিচ্ছি।
কাস্টমারের জন্যে যে প্লেইন রাইস সেই একই রাইস, তরকারির হাড়িতে দেখে কিসের মাংস যেন।
-এটা কি গরুর মাংস?
-না না এ হলো ল্যাম্ব মানে ভেড়া। কেন খান না নাকি?
-না না সেরকম কিছু না সবই খাই।
-ঠিক আছে, নিয়ে নিবেন যা লাগে।
ওসমান বললো-
-ভাই সাবের সাথে তো কথা বলার সময় পাইলাম না, ঠিক আছে আছেন তো পরে আলাপ করবো।
এর মধ্যে তার খাওয়া শেষ। কোন রকম হাতটা ধুয়ে বললো আচ্ছা আমি আসি, সালামালেকুম বলেই দৌড়।
রাশেদ সাহেব খেতে শুরু করেছেন। আসাদ বললো-
-কি, ঠিক আছে? চলবে তো! না কি?
-হা ভাই চলবে মানে কি চালাতে হবে এছাড়া তো উপায় নেই।
-আচ্ছা আপনি এই কাজ নিলেন কেন? আপনার তো এই কাজের বয়স না। দেশ থেকে কবে এসেছেন, দেশের খবর কেমন, ওখানে কি করতেন ইত্যাদিসহ নানা প্রশ্ন যা এখন রাশেদ সাহেবের কাছে যন্ত্রণার মতো মনে হচ্ছিল। এমনিতেই কথা বলতে ভাল লাগছিলো না তার মধ্যে একই প্যাঁচাল বার বার আর কত! কেন, মানুষের এতো কৌতূহল কেন? আমি কি করতাম তা জানার কি এমন দরকার? কি হবে জেনে? যাই হোক কিছু বুঝতে দিলো না। অবলীলায় তার সব কথার জবাব দিয়ে গে্লেন।
যদিও সে বুঝতে পারছিলো এটা হলো আলাপ করার একটা পদ্ধতি। প্রথম আলাপ আর কি ভাবে শুরু করে তাই এই সব অবান্তর প্রসঙ্গ। তবে যাই হোক লোকটাকে ভালোই লাগলো। নতুন এসেছে এতো বিরক্ত হলে তো চলবে না কিন্তু তার মনের অবস্থা তো তার জানার কথা নয় তাই এই প্রসঙ্গ। কি আর করা যাবে এই ভাবেই তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সবার কাছ থেকেই ভাল আশা করা সম্ভব নয়। রান্না খারাপ ভালো দেখার অবস্থা নেই। কোন ফাঁকে যে রান্না করেছে কে করেছে তা রাশেদ সাহেব খেয়াল করতে পারেনি। আর করবেই কখন এক সাথে দুই তিন জনে হুকুম করেছে। কোথায় কি থাকে, কি আছে, কাকে কি বলে এগুলি তো কিছুই জানা নেই। তারপর কিভাবে কি করবে তাও কিছু জানা নেই। কেও যে দেখিয়ে দিবে সে উপায়ও নেই। সবাই যার যার মত ব্যস্ত। আর এক সমস্যা ভাষা। কথাটা শুনেছে কিন্তু বুঝতে পারছেনা, জিজ্ঞেস করেছিলো দুএক বার। জবাব শুনে আর করতে ইচ্ছা হয়নি। যেমন বাংলাটাও শিখে আসেন নাই!! একবার বলেছিলো এটা তো -বাংলার একটা আঞ্চলিক রূপ সে তো আমার সব বোঝার কথা নয়।
-কি বললেন আমরা বাঙ্গালি না?
-না না তা হবে কেন?
-ও! উনি শুদ্ধ ভাষা ছাড়া বুঝেন না তা জানেন না? এখানে সবাই এই রকম কথা বলে তো আপনে এখানে আসলেন কেন?